নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জির রচনা: আম ও আদব 

অভিজিৎ ব্যানার্জি
অভিজিৎ ব্যানার্জি
অর্থনীতিবিদ
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

এতদিনকার আগের ঘটনা যে আমার ঠিকমত মনেও নেই কোথায় যাচ্ছিলাম বা কেন যাচ্ছিলাম। ওই যে সবুজ-হলুদ বগিওয়ালা লোকাল ট্রেনগুলো, যেগুলোর খোলা দরজাগুলো কেবল একটা লোহার অর্গল দিয়ে আলাদা করা থাকে, তাতে চড়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। গরমকাল ছিল। একজন সন্ন্যাসী এসে বসলেন দরজার পাশে, ট্রেনের মেঝেতে। কোমরের উপর থেকে তার পরনে কিচ্ছু ছিল না। ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর, তিনি নিজের কাচকির মধ্য থেকে বের করে আনলেন হলুদ-কমলাটে একটা আম, আর নিজের শক্ত বাদামি দুই হাতের মাঝখানে সেটাকে চেপে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর, যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে আমটা যথেষ্ট নরম হয়েছে, তখন আমটার উপরের দিক দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে চুষতে শুরু করলেন।   

রস চুইয়ে তার লম্বা দাঁড়ি বেয়ে গড়াতে শুরু করলো, তবু তা মোছার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে দেখা গেল না। জীবনে এভাবে আমি কাউকে আম খেতে দেখিনি। এখন আমি জানি যে একপ্রকার আম আছে যার নাম হলো চুষি আম। এসব আম এভাবেই খেতে হয়। কিন্তু যে অন্তরঙ্গতার সাথে তিনি আমটাকে দুই হাতের মধ্যে ধরে রেখেছিলেন আর বিশেষ করে যেভাবে ঠোঁট লাগিয়ে খাচ্ছিলেন, তাতে আমাদের কল্পনার জন্য কিছু বাকি থাকলো না। একবারের জন্যেও তিনি আমাদের কারো দিকে তাকাননি, তবুও সবারই মনে হয়ে থাকবে যে তিনি যেন একটা পারফর্মেন্স করছেন আমাদের সামনে। আমাদেরকে কী দেখাতে চাইছিলেন তিনি? যে এই উদাম বক্ষ ও জটপাকানো চুল সত্ত্বে তার জীবনে এক চমৎকার আনন্দ আছে? তার এই আনন্দের সাথে চারুতার কোনো জরুরি সংযোগ আদৌ ছিল না (যদিও তার পুরো কাজটার মধ্যে একপ্রকার চারুতা অবশ্যই ছিল, তবে সেটা বোন-চাইনিজ কাপগুলোর চারুতা না অবশ্যই)। কাউকে কোনোকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।      

খাদ্যগ্রহণের এ-ধরণের লাগামছাড়া দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় সেজন্যই সম্ভবত খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার আবিষ্কার করা হয়েছিল। পাশ্চাত্যে খেতে বসার সময় কোন কোন আচরণ শিষ্টাচারসম্পন্ন বলে ধরা হবে তার নির্ধারক মধ্যযুগের পর থেকে অনেকটাই পালটে গেছে। মধ্যযুগীয় ভোজগুলি তো নাচা-গানা, হৈ-হুল্লোড়, মদ এবং মাংসের নানা পদ মিলিয়ে বেশ জবরদস্ত এন্তেজাম ছিল বলেই জানা যায়। ল্যানক্যাস্টারের ডিউকের জন্য ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড যে ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন সেটার খাদ্যসূচিতে আমি অন্তত বারো পদের মাংসের হিসাব পেয়েছি। তার মধ্যে ছিল শুয়োরের মাথা, হাঁসের রোস্ট, বন্য শুয়োর, তিতির পাখি, লার্ক পাখি, বক পাখি, খরগোশ, ষাঁড়ের মাংস, সারস পাখি, হরিণের পেশির (এক ধরণের মাংসই হবে) এক ধরণের জেলি। অতিথিরা নিজেরা ছুরি নিয়ে আসতো, এবং সেই ছুরি দিয়ে হাড্ডি থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাত দিয়ে খেত। একই পানপাত্রে অনেকে একসাথে খেত। থালা হিসেবে ব্যবহার করা হতো এক টুকরা রুটি অথবা খোদ টেবিলটাকেই। আর অতিথিদের যেতে দেয়ার আগে চামচ গুণে নেয়া হতো। প্রচুর পরিমাণে খাওয়াদাওয়া হতো, হাঁড়ি-হাঁড়ি মদ গেলা হতো, আর এগুলোর সাথে স্বাভাবিকভাবেই চলতো ভালো পরিমাণে ‘মেয়েবাজি’ (এখানে বলা যায় সেই কুখ্যাত বাদামভোজের কথা, যা পাদ্রী সেজার বোর্জিয়ার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল একশজন উলঙ্গ বারবনিতা।)        

তবে সত্যি কথা হলো যে শুধুমাত্র চরম উদাহরণগুলোর কথাই লিখিত থেকে যায়। বেশিরভাগ খাবারের উৎসব নিশ্চয়ই আরো শান্তশিষ্ট ছিল। মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদরা বারবার এই দিকে জোর দিয়েছেন যে যাজকবর্গ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে বারবার চেষ্টা করা হচ্ছিল খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট আদব-লেহাজ প্রচার করার। এই তৎপরতা থেকেই বোঝা যায় যে এ ব্যাপারে কিছু সমস্যা নিশ্চয়ই চালু ছিল। বারো শতকের একটা গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার নাম হলো সুসভ্য মানুষের গ্রন্থ (লাতিনে এর নাম Urbanus Magnus।) বইটার লেখক ছিলেন বেক্লেসের ড্যানিয়েল। কীভাবে যেন বইটা আমার মায়ের হাতে এসে পৌঁছায়। ড্যানিয়েলের মত তারও কড়া নির্দেশ ছিল ‘টেবিলের উপর কনুই রাখা যাবে না।’ ড্যানিয়েল বলেছিলেন, ‘নিজের টেবিলে তাও চাইলে করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য কারোর বাড়িতে দাওয়াতের সময় একদমই না।’ আমার মা এ ব্যাপারে ড্যানিয়েলের চাইতে কম সহিষ্ণু ছিলেন।    

ছবি: অভিজিৎ ব্যানার্জি


যাহোক, মধ্যযুগের ভোজগুলো ভিক্টোরিয়ান আমলের অতিরিক্ত সুশীল ডিনার পার্টিগুলোর চেয়ে অনেক দিক দিয়েই আলাদা ছিল। সেখানে টেবিলের পায়াগুলো আগাগোরা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকত যাতে করে কোনো উদাম ঠ্যাঙের ন্যূনতম আঁচও না পাওয়া যায়, আর প্রতিটি কোর্সের জন্য থাকত আলাদা চামচ ও কাঁটাচামচ। এই বদলের পিছনে বড় একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও পরিচ্ছন্নতাবোধের উদ্ভবের। মানুষের যখন বেশি বেশি পাত্র কেনার সামর্থ্য হলো, তখন আর তারা ভাগাভাগি করতে যাবে কেন? চামচটামচ যখন আরো সহজলভ্য হয়ে গেল, তখন নিজের হাত এঁটো না করে (যেহেতু হাত ধুয়ে ফেলার গরম পানি অতটাও সুলভ ছিল না) চামচ ও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়াই তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক মনে হতে শুরু করলো। এই একই যুক্তি উলটে দিয়ে বলা যায়, আমরা ভারতীয়রা যে হাত দিয়ে খাই তার পেছনে একটা কারণ এই হতে পারে যে আমাদের এখানকার পানি এতটাও ঠান্ডা না যে হাত থেকে তেল-মসলা ধুয়ে ফেলা যাবে না। আমার জন্য হাত দিয়ে খাওয়াটা এতই স্বাভাবিক যে আমি শুধু ভাবি পাশ্চাত্যেও যদি গরম পানির কল সবখানে চালু হয়ে যেত তাহলে কত ভালো হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল আমাদের সন্তানদেরকেই নিজেদের দলে ভেড়াতে পেরেছি। আপনারা বুঝতেই পারছেন, এই কারণে আমাদের কতটা ঝামেলা তৈরি হয় (বিশেষ করে আমার জন্য) যখন আমরা কোনো ‘শিষ্টাচারসম্পন্ন’ বাড়িতে দাওয়াতে যাই আর আমার ছেলে-মেয়েরা মাংসটা হাত দিয়ে তুলে নেয়।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সেটা হলো খাবার-দাবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এইসব নিয়ম-নীতিকে কেবল এই নিক্তিতে বিচার করা যাবে না যে কোনটা বেশি সুবিধাজনক। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়রাও যে হাত দিয়ে খাবার খায় সেটা নিয়ে পাশ্চাত্যে একটা অস্বস্তি চালু রয়েছে। কিন্তু হাত দিয়ে যেমন-তেমন উপায়ে খাওয়া যাবে এই ভাবনাটাও বেশ অপরিচিত। আমাদের পরিবারে শেখানো হতো খাবার যেন কোনোমতেই আঙুলের দ্বিতীয় করের উপরে না ওঠে। আবার আমি খেয়াল করেছি যে আমার ভাইয়ের আয়া নিজের পুরো থাবা দিয়ে খাবার খেত। তার কয়েক বছর পরে আমি ‘দখল’ নামে গৌতম ঘোষের অসাধারণ সিনেমাটা দেখি। সেখানে একটা আনন্দোৎসবের দৃশ্য আছে, এবং এই দৃশ্যটাই গোটা সিনেমার প্রাণকেন্দ্র। সেই দৃশ্যে দেখায় যে অভিবাসীরা নিজেদের পুরো হাত দিয়ে ভাত চটকাচ্ছে এবং কবজি পর্যন্ত চেটে খাচ্ছে। আমাদের এই মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ সমাজে এ-ধরণের আচরণ করলে বেশ গালি খেতে হতো।

কিন্তু সব ক্ষেত্রেই খাবার খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হয়। কেবল সহজলভ্যতা যদি প্রধান নিয়ামক না-ও হয়, আমরা কীভাবে খাই সেটা পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দেয় আমরা কারা, এবং সমান গুরুত্বের সাথে জানিয়ে দেয় আমরা কারা নই। খাদ্যগ্রহণের শিষ্টাচার মূলত শ্রেণি ও বর্ণসাপেক্ষ ব্যাপার-স্যাপার। সেই সূত্রেই ইউরোপ যে হাত দিয়ে খাওয়ার প্রচলন দিয়ে সরে আসলো তা ছিল আরো বৃহত্তর আত্মসংযমী এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অংশ। এই আত্মসংযম লক্ষ করা গেছে সকল শরীরবৃত্তীয় আচরণে (জনসমক্ষে আর কোনো পাদ দেয়া বা কুলি করা হবে না), যৌনরুচি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে, পশু-পাখি ও অন্যান্য মানুষের প্রতি নির্মম আচরণের বিরুদ্ধে। তখন থেকে আর আস্ত কোনো জন্তুর গা থেকে মাংস ছাড়িয়ে খেতে হতো না, কাটা অবস্থায়ই টেবিলে মাংস হাজির করা হতো। আমার প্রবৃত্তি বলে যে কিছুকাল আগ পর্যন্তও যে রাজকীয়তার সাথে বীরদর্পের একটা সংযোগ ছিল সেটা এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল বলশালী (শারিরীকভাবে এবং মানসিকভাবে) হওয়া, যৌনসক্ষম হওয়া এবং গুরুভোজে পারঙ্গম হওয়া। রুচি ও শক্তির এ-ধরণের প্রদর্শনী ছিল রাজা হিসেবে তাদের যোগ্যতার সাক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তীতে যখন নেতা (কিংবা রাজাও বলা চলে) হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও সুপরিচালনার বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য হয়ে উঠলো, তখন রাজাদেরও হয়ে উঠতে হলো আরো সংযমী ও পারদর্শী। হয়তো আজ পুতিন ও ট্রাম্পের কল্যাণে আমরা পুরনো দিনগুলো ফিরে পাব।      

তবে কেউ আবার এটা ভেবে বসবেন না যে আমি বলতে চাইছি দুনিয়ার সকল সমাজের অন্তর্নিহিত একটা প্যাটার্ন আছে যার কারণে সমাজগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো আদবসম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি আমি যখন লখনৌতে যাই, তখন নিজের বয়সী বা আরো মুরুব্বিদের সাথে আলাপ করতে বসলেই শুনি তেহজিবের কথা। তেহজিব হলো কতগুলো আদবসিদ্ধ আচরণের সমষ্টি যা উনিশ ও বিশ শতকে হিন্দু ও মুসলিমদের শহুরে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে ছিল। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের  বোর্দো বলেছিলেন, আদব-লেহাজ হলো অভ্যাসের ব্যাপার। এসব আদব কোনো নির্দিষ্ট উপ-সংস্কৃতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, এবং এর চর্চাকারীরা মনে করে এসব খুবই প্রাকৃতিক এবং সহজাত। কিন্তু সত্য হলো যে এসবের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আপনি কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তার সাথে (যেমন, টেবিলে কনুই রাখলেই আমার মা ঝামটা মারতো) এবং সেই পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণকারী বৃহত্তর অর্থনৈতিক অবস্থার (যেমন, আমাদের বাসায় একটা টেবিল ছিল এবং আমার বাবা-মা কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকেছিলেন)। 

যারা আমাদের চাইতে ভিন্ন আচরণ করে তাদেরকে আমরা নিচু চোখে দেখি, বিশেষ করে যদি দেখা যায় সামাজিকভাবে তারা সুবিধাবঞ্চিত। এবং যারা প্রভাবশালী পদে থাকে তাদেরকে আমরা অনুকরণ করতে চাই। অসাধারণ বাঙালি রম্যলেখক পরশুরামের ‘উলট–পুরাণে’ দেখা যায় ভারত ব্রিটেনে উপনিবেশ গেড়েছে। সেখানে ব্রিটেনের ভারত কর্তৃক নিয়োজিত গভর্নর ভারতীয়দের মত আম খেতে চায়। সে বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে ওভাবে আম খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তার হাত বেয়ে রস পড়তে থাকে। আমিও ফরাসিদের মত ছোট ছোট টুকরায় কেটে পিরিচে রেখে কাঁটাচামচ দিয়ে আম খেতে পারি। কিন্তু সেই সন্ন্যাসীর মত তৃপ্তি নিয়ে নিজের ঠোঁট চেটে চেটে আম খাওয়া, তা যদিও আমার খুব ইচ্ছা, তবু কেমন যেন দূরের ঠেকে। খাবার-দাবারকে ঘিরে এসব মনগড়া নৈতিকতা বাদ দিলেও তো দুনিয়ায় আমাদের বিভাজনের উপলক্ষ্য কম নেই, তাই না?  

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।