এতদিনকার আগের ঘটনা যে আমার ঠিকমত মনেও নেই কোথায় যাচ্ছিলাম বা কেন যাচ্ছিলাম। ওই যে সবুজ-হলুদ বগিওয়ালা লোকাল ট্রেনগুলো, যেগুলোর খোলা দরজাগুলো কেবল একটা লোহার অর্গল দিয়ে আলাদা করা থাকে, তাতে চড়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। গরমকাল ছিল। একজন সন্ন্যাসী এসে বসলেন দরজার পাশে, ট্রেনের মেঝেতে। কোমরের উপর থেকে তার পরনে কিচ্ছু ছিল না। ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার পর, তিনি নিজের কাচকির মধ্য থেকে বের করে আনলেন হলুদ-কমলাটে একটা আম, আর নিজের শক্ত বাদামি দুই হাতের মাঝখানে সেটাকে চেপে ধরলেন। কিছুক্ষণ পর, যখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে আমটা যথেষ্ট নরম হয়েছে, তখন আমটার উপরের দিক দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে চুষতে শুরু করলেন।
রস চুইয়ে তার লম্বা দাঁড়ি বেয়ে গড়াতে শুরু করলো, তবু তা মোছার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে দেখা গেল না। জীবনে এভাবে আমি কাউকে আম খেতে দেখিনি। এখন আমি জানি যে একপ্রকার আম আছে যার নাম হলো চুষি আম। এসব আম এভাবেই খেতে হয়। কিন্তু যে অন্তরঙ্গতার সাথে তিনি আমটাকে দুই হাতের মধ্যে ধরে রেখেছিলেন আর বিশেষ করে যেভাবে ঠোঁট লাগিয়ে খাচ্ছিলেন, তাতে আমাদের কল্পনার জন্য কিছু বাকি থাকলো না। একবারের জন্যেও তিনি আমাদের কারো দিকে তাকাননি, তবুও সবারই মনে হয়ে থাকবে যে তিনি যেন একটা পারফর্মেন্স করছেন আমাদের সামনে। আমাদেরকে কী দেখাতে চাইছিলেন তিনি? যে এই উদাম বক্ষ ও জটপাকানো চুল সত্ত্বে তার জীবনে এক চমৎকার আনন্দ আছে? তার এই আনন্দের সাথে চারুতার কোনো জরুরি সংযোগ আদৌ ছিল না (যদিও তার পুরো কাজটার মধ্যে একপ্রকার চারুতা অবশ্যই ছিল, তবে সেটা বোন-চাইনিজ কাপগুলোর চারুতা না অবশ্যই)। কাউকে কোনোকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি।
খাদ্যগ্রহণের এ-ধরণের লাগামছাড়া দৃশ্য যাতে দেখতে না হয় সেজন্যই সম্ভবত খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে শিষ্টাচার আবিষ্কার করা হয়েছিল। পাশ্চাত্যে খেতে বসার সময় কোন কোন আচরণ শিষ্টাচারসম্পন্ন বলে ধরা হবে তার নির্ধারক মধ্যযুগের পর থেকে অনেকটাই পালটে গেছে। মধ্যযুগীয় ভোজগুলি তো নাচা-গানা, হৈ-হুল্লোড়, মদ এবং মাংসের নানা পদ মিলিয়ে বেশ জবরদস্ত এন্তেজাম ছিল বলেই জানা যায়। ল্যানক্যাস্টারের ডিউকের জন্য ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড যে ভোজের ব্যবস্থা করেছিলেন সেটার খাদ্যসূচিতে আমি অন্তত বারো পদের মাংসের হিসাব পেয়েছি। তার মধ্যে ছিল শুয়োরের মাথা, হাঁসের রোস্ট, বন্য শুয়োর, তিতির পাখি, লার্ক পাখি, বক পাখি, খরগোশ, ষাঁড়ের মাংস, সারস পাখি, হরিণের পেশির (এক ধরণের মাংসই হবে) এক ধরণের জেলি। অতিথিরা নিজেরা ছুরি নিয়ে আসতো, এবং সেই ছুরি দিয়ে হাড্ডি থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাত দিয়ে খেত। একই পানপাত্রে অনেকে একসাথে খেত। থালা হিসেবে ব্যবহার করা হতো এক টুকরা রুটি অথবা খোদ টেবিলটাকেই। আর অতিথিদের যেতে দেয়ার আগে চামচ গুণে নেয়া হতো। প্রচুর পরিমাণে খাওয়াদাওয়া হতো, হাঁড়ি-হাঁড়ি মদ গেলা হতো, আর এগুলোর সাথে স্বাভাবিকভাবেই চলতো ভালো পরিমাণে ‘মেয়েবাজি’ (এখানে বলা যায় সেই কুখ্যাত বাদামভোজের কথা, যা পাদ্রী সেজার বোর্জিয়ার দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ছিল একশজন উলঙ্গ বারবনিতা।)
তবে সত্যি কথা হলো যে শুধুমাত্র চরম উদাহরণগুলোর কথাই লিখিত থেকে যায়। বেশিরভাগ খাবারের উৎসব নিশ্চয়ই আরো শান্তশিষ্ট ছিল। মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদরা বারবার এই দিকে জোর দিয়েছেন যে যাজকবর্গ ও অন্যান্যদের পক্ষ থেকে বারবার চেষ্টা করা হচ্ছিল খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট আদব-লেহাজ প্রচার করার। এই তৎপরতা থেকেই বোঝা যায় যে এ ব্যাপারে কিছু সমস্যা নিশ্চয়ই চালু ছিল। বারো শতকের একটা গ্রন্থ পাওয়া যায়, যার নাম হলো সুসভ্য মানুষের গ্রন্থ (লাতিনে এর নাম Urbanus Magnus।) বইটার লেখক ছিলেন বেক্লেসের ড্যানিয়েল। কীভাবে যেন বইটা আমার মায়ের হাতে এসে পৌঁছায়। ড্যানিয়েলের মত তারও কড়া নির্দেশ ছিল ‘টেবিলের উপর কনুই রাখা যাবে না।’ ড্যানিয়েল বলেছিলেন, ‘নিজের টেবিলে তাও চাইলে করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য কারোর বাড়িতে দাওয়াতের সময় একদমই না।’ আমার মা এ ব্যাপারে ড্যানিয়েলের চাইতে কম সহিষ্ণু ছিলেন।

যাহোক, মধ্যযুগের ভোজগুলো ভিক্টোরিয়ান আমলের অতিরিক্ত সুশীল ডিনার পার্টিগুলোর চেয়ে অনেক দিক দিয়েই আলাদা ছিল। সেখানে টেবিলের পায়াগুলো আগাগোরা কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকত যাতে করে কোনো উদাম ঠ্যাঙের ন্যূনতম আঁচও না পাওয়া যায়, আর প্রতিটি কোর্সের জন্য থাকত আলাদা চামচ ও কাঁটাচামচ। এই বদলের পিছনে বড় একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও পরিচ্ছন্নতাবোধের উদ্ভবের। মানুষের যখন বেশি বেশি পাত্র কেনার সামর্থ্য হলো, তখন আর তারা ভাগাভাগি করতে যাবে কেন? চামচটামচ যখন আরো সহজলভ্য হয়ে গেল, তখন নিজের হাত এঁটো না করে (যেহেতু হাত ধুয়ে ফেলার গরম পানি অতটাও সুলভ ছিল না) চামচ ও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়াই তাদের জন্য বেশি সুবিধাজনক মনে হতে শুরু করলো। এই একই যুক্তি উলটে দিয়ে বলা যায়, আমরা ভারতীয়রা যে হাত দিয়ে খাই তার পেছনে একটা কারণ এই হতে পারে যে আমাদের এখানকার পানি এতটাও ঠান্ডা না যে হাত থেকে তেল-মসলা ধুয়ে ফেলা যাবে না। আমার জন্য হাত দিয়ে খাওয়াটা এতই স্বাভাবিক যে আমি শুধু ভাবি পাশ্চাত্যেও যদি গরম পানির কল সবখানে চালু হয়ে যেত তাহলে কত ভালো হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবল আমাদের সন্তানদেরকেই নিজেদের দলে ভেড়াতে পেরেছি। আপনারা বুঝতেই পারছেন, এই কারণে আমাদের কতটা ঝামেলা তৈরি হয় (বিশেষ করে আমার জন্য) যখন আমরা কোনো ‘শিষ্টাচারসম্পন্ন’ বাড়িতে দাওয়াতে যাই আর আমার ছেলে-মেয়েরা মাংসটা হাত দিয়ে তুলে নেয়।
তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, সেটা হলো খাবার-দাবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এইসব নিয়ম-নীতিকে কেবল এই নিক্তিতে বিচার করা যাবে না যে কোনটা বেশি সুবিধাজনক। প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়রাও যে হাত দিয়ে খাবার খায় সেটা নিয়ে পাশ্চাত্যে একটা অস্বস্তি চালু রয়েছে। কিন্তু হাত দিয়ে যেমন-তেমন উপায়ে খাওয়া যাবে এই ভাবনাটাও বেশ অপরিচিত। আমাদের পরিবারে শেখানো হতো খাবার যেন কোনোমতেই আঙুলের দ্বিতীয় করের উপরে না ওঠে। আবার আমি খেয়াল করেছি যে আমার ভাইয়ের আয়া নিজের পুরো থাবা দিয়ে খাবার খেত। তার কয়েক বছর পরে আমি ‘দখল’ নামে গৌতম ঘোষের অসাধারণ সিনেমাটা দেখি। সেখানে একটা আনন্দোৎসবের দৃশ্য আছে, এবং এই দৃশ্যটাই গোটা সিনেমার প্রাণকেন্দ্র। সেই দৃশ্যে দেখায় যে অভিবাসীরা নিজেদের পুরো হাত দিয়ে ভাত চটকাচ্ছে এবং কবজি পর্যন্ত চেটে খাচ্ছে। আমাদের এই মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ সমাজে এ-ধরণের আচরণ করলে বেশ গালি খেতে হতো।
কিন্তু সব ক্ষেত্রেই খাবার খাওয়ার আগে ও পরে হাত ধুয়ে নিতে হয়। কেবল সহজলভ্যতা যদি প্রধান নিয়ামক না-ও হয়, আমরা কীভাবে খাই সেটা পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দেয় আমরা কারা, এবং সমান গুরুত্বের সাথে জানিয়ে দেয় আমরা কারা নই। খাদ্যগ্রহণের শিষ্টাচার মূলত শ্রেণি ও বর্ণসাপেক্ষ ব্যাপার-স্যাপার। সেই সূত্রেই ইউরোপ যে হাত দিয়ে খাওয়ার প্রচলন দিয়ে সরে আসলো তা ছিল আরো বৃহত্তর আত্মসংযমী এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই অংশ। এই আত্মসংযম লক্ষ করা গেছে সকল শরীরবৃত্তীয় আচরণে (জনসমক্ষে আর কোনো পাদ দেয়া বা কুলি করা হবে না), যৌনরুচি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে, পশু-পাখি ও অন্যান্য মানুষের প্রতি নির্মম আচরণের বিরুদ্ধে। তখন থেকে আর আস্ত কোনো জন্তুর গা থেকে মাংস ছাড়িয়ে খেতে হতো না, কাটা অবস্থায়ই টেবিলে মাংস হাজির করা হতো। আমার প্রবৃত্তি বলে যে কিছুকাল আগ পর্যন্তও যে রাজকীয়তার সাথে বীরদর্পের একটা সংযোগ ছিল সেটা এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল বলশালী (শারিরীকভাবে এবং মানসিকভাবে) হওয়া, যৌনসক্ষম হওয়া এবং গুরুভোজে পারঙ্গম হওয়া। রুচি ও শক্তির এ-ধরণের প্রদর্শনী ছিল রাজা হিসেবে তাদের যোগ্যতার সাক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তীতে যখন নেতা (কিংবা রাজাও বলা চলে) হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা ও সুপরিচালনার বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য হয়ে উঠলো, তখন রাজাদেরও হয়ে উঠতে হলো আরো সংযমী ও পারদর্শী। হয়তো আজ পুতিন ও ট্রাম্পের কল্যাণে আমরা পুরনো দিনগুলো ফিরে পাব।
তবে কেউ আবার এটা ভেবে বসবেন না যে আমি বলতে চাইছি দুনিয়ার সকল সমাজের অন্তর্নিহিত একটা প্যাটার্ন আছে যার কারণে সমাজগুলো সময়ের সাথে সাথে আরো আদবসম্পন্ন হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি আমি যখন লখনৌতে যাই, তখন নিজের বয়সী বা আরো মুরুব্বিদের সাথে আলাপ করতে বসলেই শুনি তেহজিবের কথা। তেহজিব হলো কতগুলো আদবসিদ্ধ আচরণের সমষ্টি যা উনিশ ও বিশ শতকে হিন্দু ও মুসলিমদের শহুরে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে ছিল। ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বোর্দো বলেছিলেন, আদব-লেহাজ হলো অভ্যাসের ব্যাপার। এসব আদব কোনো নির্দিষ্ট উপ-সংস্কৃতির সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত, এবং এর চর্চাকারীরা মনে করে এসব খুবই প্রাকৃতিক এবং সহজাত। কিন্তু সত্য হলো যে এসবের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে আপনি কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তার সাথে (যেমন, টেবিলে কনুই রাখলেই আমার মা ঝামটা মারতো) এবং সেই পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণকারী বৃহত্তর অর্থনৈতিক অবস্থার (যেমন, আমাদের বাসায় একটা টেবিল ছিল এবং আমার বাবা-মা কয়েক বছর ইংল্যান্ডে থেকেছিলেন)।
যারা আমাদের চাইতে ভিন্ন আচরণ করে তাদেরকে আমরা নিচু চোখে দেখি, বিশেষ করে যদি দেখা যায় সামাজিকভাবে তারা সুবিধাবঞ্চিত। এবং যারা প্রভাবশালী পদে থাকে তাদেরকে আমরা অনুকরণ করতে চাই। অসাধারণ বাঙালি রম্যলেখক পরশুরামের ‘উলট–পুরাণে’ দেখা যায় ভারত ব্রিটেনে উপনিবেশ গেড়েছে। সেখানে ব্রিটেনের ভারত কর্তৃক নিয়োজিত গভর্নর ভারতীয়দের মত আম খেতে চায়। সে বাথরুমে লুকিয়ে লুকিয়ে ওভাবে আম খাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে, তার হাত বেয়ে রস পড়তে থাকে। আমিও ফরাসিদের মত ছোট ছোট টুকরায় কেটে পিরিচে রেখে কাঁটাচামচ দিয়ে আম খেতে পারি। কিন্তু সেই সন্ন্যাসীর মত তৃপ্তি নিয়ে নিজের ঠোঁট চেটে চেটে আম খাওয়া, তা যদিও আমার খুব ইচ্ছা, তবু কেমন যেন দূরের ঠেকে। খাবার-দাবারকে ঘিরে এসব মনগড়া নৈতিকতা বাদ দিলেও তো দুনিয়ায় আমাদের বিভাজনের উপলক্ষ্য কম নেই, তাই না?