আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসছে বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ। তার সুসজ্জিত ক্যান্টিনে খেতে বসেছেন এক মার্কিন নাগরিক। হুট করে খেয়াল করলেন, পাশেই বসে খাচ্ছেন এক মহিলা। মার্কিন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?
আফ্রিকা, মহিলা উত্তর দিলেন।
আফ্রিকা? আচ্ছা, আপনারা কি এখনও মানুষ খান?
মহিলা একটুখানি চুপ থেকে খেতে খেতে উত্তর দিলেন, না, সুযোগ আর পাই কোথায়? পাশে পেয়ে গেলে মাঝেমধ্যে খাই।
প্রচলিত কৌতুক। পড়ে আমরা হয়তো ঠা-ঠা করে হাসি। এই আমরাই কারও ‘আদিবাসী’ পরিচয় পেলে নাকমুখ চোখা করে জিজ্ঞেস করি, তোমরা তো আদিবাসী, সাপ-ব্যাঙ খাও?
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, সাপ-ব্যাঙ খাওয়াটা খুব লজ্জার বিষয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে কেউ সাপ-ব্যাঙ খায় কীভাবে? বলাই বাহুল্য, এই যুক্তিতে সমর্থক পাবেন। একবাক্যে সমর্থন দেবে সাপ আর ব্যাঙ! এই সমর্থকদের পাশাপাশি দাঁড় করাবেন না যেন, একটা আরেকটাকে কপ করে খেয়ে নেবে।
এই যে স্বজাত্যবোধের অহংকার, অন্যদেরকে একটু ‘আদারিং’ করে ফেলে কিঞ্চিত খাটো করে ফেলা, ব্যাপারটা যে এই একবিংশ শতাব্দীর অভিনব আবিষ্কার এমন না। হয়তো দেখা যাবে ডায়নোসররাও এমন ফুড-শেমিং বা খাদ্য-তাচ্ছিল্যে অভ্যস্ত ছিলো। এক টি-রেক্স হয়তো আরেক টি-রেক্সকে বলত, এই দ্যাখ দ্যাখ ওরা ট্রাইসেরাটস বাদ দিয়ে অ্যাডমন্টাসোরাসের মাংস খায়। ছিছি!
কল্পনা করার দরকার কী? মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবুর তার আত্মজীবনীতে বলে গেছেন, ঘোড়ার মাংস খুব প্রিয় দেখে হিন্দুস্তানের আমির-অমাত্যরা কীরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। নেহায়েত সম্রাট মানুষ, হাসিঠাট্টা তো আর করা যায় না! তাই তারা চুপ করে থাকতেন। বাবুর অবশ্য ঠিকই সেই চাহনিটা টের পেতেন!
খাদ্য তাচ্ছিল্য বাবুরও ফিরিয়ে দিয়েছেন। বারবার হাহাকার করেছেন, ‘এ কোন মরার দেশে এসেছেন’ বলে। বাবুরের বোন খানজাদা কাবুল থেকে তরমুজ পাঠিয়েছেন শুনে একেবারে বাচ্চাদের মতো হাপুস-হুপুস করে খেয়েছেন। তারপর বলেছেন, যেমন কাষ্ঠং-সুষ্ঠং দেশ, তেমনি খটখটে তার ফল। হ্যাঁ, ওই আম নামের ফলটা একটু ভালো। তবে, কাবুলের ফলের তুলনায় সেটা আসলে একটুই।
ঠিক তার তিন প্রজন্ম পরের সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেশ কিন্তু হিন্দুস্তানই। কাবুলকে ঠেস দিয়ে তিনি বললেন, আমের মতো একটা ফলের সমতুল্য ফল তামাম কাবুলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা কী আসলে? খাবারটা রূপক এখানে। আড়ালে নিজের জাতটাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা।
আরও কয়েক শতক পর মাইকেল মধুসূদন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনে দেখালেন, গ্রাম্য মাতবরের টাকা খাওয়া কুচুটে বুড়ি মুসলমান বাড়িতে এসেছে কৃষকের সুন্দরী বউকে হাত করতে। বৃদ্ধ মাতবরের একটু আশনাই করার শখ আরকি। বুড়ি এসেছে তো ঠিকই, কিন্তু মুসলমান বাড়ির চারদিকে শুধু মুরগির পাখা আর পেঁয়াজের খোসা দেখে সে নাক কুঁচকায়। কুঁকড়োর পাখা, প্যাঁজের খোসা… থু থু! বুদ্ধিমান পাঠক, এটাই আদারিং!
এই আদারিং-এর পাল্লায় পড়ে বাঙালি বলে ঘটিরা হলো চিংড়ি নামের পোকা খাওয়া বোকা, ঘটি বলে আলসে বাঙালি চেনে খালি বালিশ আর ইলিশ। এভাবেই ‘গরুখেকো’ মুসলিম, ‘কাছিম খাওয়া’ হিন্দু, ‘শুয়োর খাওয়া’ ক্রিশ্চান, ব্যাঙ খাওয়া ফরাসি, সাপ খাওয়া চাইনিজ, কুকুর খাওয়া কোরিয়ান, খেজুর খাওয়া আরব!
কিন্তু কথা তো সেটা না! কথা হলো আদিবাসীরা তো সাপ-ব্যাঙ খায়। খায় তো! আমাদের দেশে বিশেষ করে মারমা সম্প্রদায় ব্যাঙ খাবার জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু তারাই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাঙখেকো জাতি নয়! এই ব্যাপারে পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ হলো ফরাসিরা। ছবির দেশে কবিতার দেশে পাঠকের অজানা নয় যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসি প্রেমিকা মার্গারিটের সাথে দেখা করতে প্যারিসে এসে খুব আগ্রহের সাথে বললেন, এবার তাহলে ব্যাঙ খাওয়া যাক! মার্গারিট অবাক। ব্যাঙ তো সেও আগে খায়নি! এ তো খুব বড়লোকের খাবার।
দুজনে মিলে টাকা দিয়ে ব্যাঙের পা কিনল। তারপর মাখনে ভেজে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মুখে দিল। মুখে দিয়েই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার! এত অপূর্ব স্বাদ হবে তারাও ভাবতে পারেনি!
তারমানে কী দাঁড়াল? আদিবাসীদের মতো প্যারিসবাসীও ব্যাঙ খায়। আজ পর্যন্ত কোনো ফরাসিকে দেখলে কাউকে বলতে শুনেছেন যে ‘ও, ফ্রেঞ্চ? তোমরা ব্যাঙ খাও?’ কেন বলে না? কারণ ফরাসিদের সাথে আমাদের এই আদারিংটা করার দরকার নেই।
চাইনিজরা শুধু সাপ না, হেন কোনো প্রাণী সম্ভবত বাদ নেই যেটা তারা খাবার জন্য মুখে নেয় না। সৈয়দ মুজতবা আলী তো চাইনিজদের আরশোলা প্রীতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই ইঙ্গিত রেখেছেন। বলবেন চাইনিজ দেখলে এই কথা? বলবেন না। বলবেন আদিবাসী দেখলে: খাস তো তোরা সাপ ব্যাঙ!
আদিবাসী বললে আমাদের সামনে এমন একটা অবয়ব ভেসে ওঠে, আদিবাসী মাত্রই নিজের ভাষা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, আদিবাসী মানেই সব এক ধর্মের অনুসারী, আদিবাসী মানেই দেশের সাড়ে ষোলো লাখ মানুষ প্রতিদিন একটা খাবারই খায়। আর কী সেই খাবার? ঠিক ধরেছেন। সাপ আর ব্যাঙ। এক অবিচ্ছেদ্য ডুয়ো। একটা ছাড়া আরেকটা জমেই না। ঠিক যেন জ্যাম আর পাউরুটি।
বাংলাদেশে মোট ৫০ সম্প্রদায়ের আদিবাসী বাস করে। এর মাঝে অনেকেই বাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে । কেউ কেউ সমতলে। নানা ধর্মের অনুসারী এই আদিবাসীরা। এদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে বাস করা সাঁওতালের সাথে সিলেটে বাস করা মণিপুরী আদিবাসীর খাদ্যাভ্যাসে মিল খুঁজতে যাওয়াটা বাতুলতাই বলা যায়। তামাম বাংলাদেশ যেমন বিভিন্ন আঞ্চলিক খাবার খাচ্ছে, ওরাও খাক যেটায় ওরা অভ্যস্ত।
খানাখাদ্য নিয়ে এই যে কাউকে নমো নমো করা, আবার কাউকে ছিছি করে নাক কুঁচকানো, অর্থনৈতিক অগ্রসরতা দিয়ে একে সহজভাবে ধরতে পারা যায়। মধ্যযুগ মাত্র শেষ হয়েছে। তমসা থেকে অল্প অল্প গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে ইউরোপ। উপমহাদেশে তখন ধন-সম্পদের রমরমা। টুকটাক যেসব ইউরোপীয় বনিক এ অঞ্চলে পাড়া দেয়া শুরু করেছে, তারা এখানকার ধন-দৌলত দেখে মুগ্ধ, এখানকার খাবার-দাবার দেখে মুগ্ধ। সে মুগ্ধতাই আবার পালটে গেল, যখন পাশার দান উলটে ইউরোপীয়রা এই অঞ্চলের শাসন-শোষণের মালিক। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সে সময়ের বিবরণ পড়লে চোখে ভেসে ওঠে সভ্য ও সৌখিন বৃটিশ শাসকদল ভারতীয় উপনিবেশে বসে কাঁটাচামচে স্টু ঠুকছে, স্যুপ খেয়ে ন্যাপকিনে ব্লট করছে, আদর করে পুডিং খাচ্ছে, শ্যাম্পনের গবলেটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। অন্যদিকে হতভাগা নেটিভরা? গামলা গামলা ভাত হয় মাংস-চর্বি দিয়ে ঠুসছে, না হয় বসে বসে রুটির জাবর কাটছে! কী গরীব… কী গরীব…

ইউরোপ ধন-দৌলতে ভারতের নিচে আর নামেনি। কাজেই তাদের খাওয়া-খাদ্যও আমাদের কাছে হয়ে থেকেছে সভ্যতার পরম উৎকর্ষ, খাদ্য-ভদ্রতার স্ট্যান্ডার্ড। খাবার সময় ঢেঁকুর তোলা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেয়া যাবে না, মুখে চপ চপ শব্দ করা যাবে না… অনেক নিয়ম। সে নিয়ম খারাপ কেউ বলছে না, কিন্তু নিজের খাদ্য সংস্কৃতি দিয়ে সারা বিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড মাপার তুমি কে, হরিরাম?
পাশ্চাত্যের খাবারের খুব কদর তখন, সেসময়ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটতে লাগল চীন, জাপানের। পাশ্চাত্য খাদ্য সংস্কৃতির উল্টোই বলা যায় সবকিছু। হাতে চপস্টিক থাকলেই হলো, সেটাই কারির বোলে ডোবাও, সেটাই মুখে দাও, সেটাই সবার সাথে অন্যান্য খাবার ভাগ করে খাও। আর শব্দ? নুডলস খাবার সময় যদি আপনি হুশ-হুশ জাতীয় কোনো শব্দ না-ই করে থাকেন, রাঁধুনীকে অপমান করলেন!
কী আশ্চর্য, চীন-জাপানের অর্থনীতিটা চাঙ্গা হবার পর পাশ্চাত্যের কাছে যে খাবার রীতি ‘অসভ্য’ বলে মনে হতে পারত, সেই রীতিটাই লুফে নিলো সবাই। আমাদের দেশেও এল চাইনিজ রেস্তোঁরা। তাতে চামচের টুংটাং, গ্লাসের ঝনঝন সবই চলল। চাইনিজ খাওয়াটা তখন আভিজাত্যের প্রতীক, পয়সাওয়ালার লক্ষণ। বৃটিশ ভদ্রতার সাথে এটিকেট মিলছে না? খামোশ!
তখন পর্যন্ত আরবরা বেশ গরীব। মাটির নিচে তেলের আভাস পাওয়া যায়নি। আরবের বেদুইনরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়, একযোগে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খায়। কী জীবন, কী জীবন। ওদের খাবার আর খাওয়া কী, ওদের খাদ্য উপহার দিয়েই বরং বাঁচিয়ে রাখা উচিত। একসাথে এক থালে সবাই যে বসে খাচ্ছে, কেমন অস্বস্তি লাগে না?
সেই আরবদের পয়সা হলো। ভুল বললাম, পেট্রো ডলার হলো। হাবিবি হাবিবিদের কদর বাড়ল বিশ্বজুড়ে। সেইসাথে কদর বাড়ল তাদের খাবারেরও। সবাই মিলে এক পাতের থেকেই তুলে তুলে খাওয়া? কী রাজসিক ব্যাপার! কী মানবিক উদারতা!
হয়তো বাঙালিরও একসময় পয়সা হবে। তামাম বিশ্ব হয়তো সেই সময় গোগ্রাসে পোড়া মরিচ আর লবণ ডলা দিয়ে পান্তা মাখিয়ে খাবে। শীতের সিজনে ফুলকপি আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ইনস্টায় ছবি দিয়ে ভাইরাল হবে স্কুলপড়ুয়া কোনো মার্কিন কিশোরী।
আর আদিবাসীরা টাকা-পয়সায় ধাঁই-ধাঁই উন্নতি করলে? সে উত্তর শেষে গিয়ে বলছি।
অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে খাদ্যমোহে ভোগার একটা ব্যাপার আছে বোঝা গেল। কিন্তু তার মানে কি খাদ্য তাচ্ছিল্য করাটা খুবই যৌক্তিক? মানবিক? না। কেন আমরা এই খাদ্য তাচ্ছিল্য দেখাই, সেটার কারণগুলোই বলা হলো আরকি।
শুধু খাদ্য গলাধঃকরণ নিয়েই আমরা আদারিং করি? মোটেই না। অন্য খাওয়া নিয়েও আমরা জাত-বেজাত বুঝিয়ে দেই। তাই আমাদের সমাজে দেখতে পাওয়া যায় ছ্যাঁকা-খাওয়া মজনুকে, আছাড়-খাওয়া শহুরে চাচাতো ভাইকে, ধরা-খাওয়া ব্যবসায়ীকে, পল্টি-খাওয়া রাজনীতিবিদকে, দৌড়ানি খাওয়া পকেটমারকে।
নাটকে মোশাররফ করীম ফারুক আহমেদকে বলছিলেন, ‘দুনিয়াটা আসলে খাওয়াখাওয়ির খেলা।’ সত্যিই তাই। দুনিয়াটা খাওয়ার, অন্যকে খাওয়ানোর, আগামী প্রজন্মও যাতে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচে তার ব্যবস্থা করে যাওয়া। কিন্তু, খাদ্য-তাচ্ছিল্য করা? নৈব নৈব চ!
আদিবাসীদের কথায় ফেরত আসি। তারা টাকা-পয়সার হিসেবে দাপট খাটানো পরিবর্তন নিয়ে আসলে কী হবে? কিচ্ছু হবে না, আমরা সম্ভবত খাবারেই পড়ে থাকব। খুব আগ্রহ নিয়ে বলব, ‘আদিবাসী আপনি? ওয়াও! নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে মজার মজার সাপ-ব্যাঙ খান!’