আদিবাসীরা কি সাপ-ব্যাঙ খায়: খাদ্য সংস্কৃতির ভৌগোলিক রাজনীতি 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী

আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসছে বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ। তার সুসজ্জিত ক্যান্টিনে খেতে বসেছেন এক মার্কিন নাগরিক। হুট করে খেয়াল করলেন, পাশেই বসে খাচ্ছেন এক মহিলা। মার্কিন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?  

আফ্রিকা, মহিলা উত্তর দিলেন। 

আফ্রিকা? আচ্ছা, আপনারা কি এখনও মানুষ খান? 

মহিলা একটুখানি চুপ থেকে খেতে খেতে উত্তর দিলেন, না, সুযোগ আর পাই কোথায়? পাশে পেয়ে গেলে মাঝেমধ্যে খাই। 

প্রচলিত কৌতুক। পড়ে আমরা হয়তো ঠা-ঠা করে হাসি। এই আমরাই কারও ‘আদিবাসী’ পরিচয় পেলে নাকমুখ চোখা করে জিজ্ঞেস করি, তোমরা তো আদিবাসী, সাপ-ব্যাঙ খাও?  

ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, সাপ-ব্যাঙ খাওয়াটা খুব লজ্জার বিষয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে কেউ সাপ-ব্যাঙ খায় কীভাবে? বলাই বাহুল্য, এই যুক্তিতে সমর্থক পাবেন। একবাক্যে সমর্থন দেবে সাপ আর ব্যাঙ! এই সমর্থকদের পাশাপাশি দাঁড় করাবেন না যেন, একটা আরেকটাকে কপ করে খেয়ে নেবে।  

এই যে স্বজাত্যবোধের অহংকার, অন্যদেরকে একটু ‘আদারিং’ করে ফেলে কিঞ্চিত খাটো করে ফেলা, ব্যাপারটা যে এই একবিংশ শতাব্দীর অভিনব আবিষ্কার এমন না। হয়তো দেখা যাবে ডায়নোসররাও এমন ফুড-শেমিং বা খাদ্য-তাচ্ছিল্যে অভ্যস্ত ছিলো। এক টি-রেক্স হয়তো আরেক টি-রেক্সকে বলত, এই দ্যাখ দ্যাখ ওরা ট্রাইসেরাটস বাদ দিয়ে অ্যাডমন্টাসোরাসের মাংস খায়। ছিছি! 

কল্পনা করার দরকার কী? মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবুর তার আত্মজীবনীতে বলে গেছেন, ঘোড়ার মাংস খুব প্রিয় দেখে হিন্দুস্তানের আমির-অমাত্যরা কীরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। নেহায়েত সম্রাট মানুষ, হাসিঠাট্টা তো আর করা যায় না! তাই তারা চুপ করে থাকতেন। বাবুর অবশ্য ঠিকই সেই চাহনিটা টের পেতেন!

খাদ্য তাচ্ছিল্য বাবুরও ফিরিয়ে দিয়েছেন। বারবার হাহাকার করেছেন, ‘এ কোন মরার দেশে এসেছেন’ বলে। বাবুরের বোন খানজাদা কাবুল থেকে তরমুজ পাঠিয়েছেন শুনে একেবারে বাচ্চাদের মতো হাপুস-হুপুস করে খেয়েছেন। তারপর বলেছেন, যেমন কাষ্ঠং-সুষ্ঠং দেশ, তেমনি খটখটে তার ফল। হ্যাঁ, ওই আম নামের ফলটা একটু ভালো। তবে, কাবুলের ফলের তুলনায় সেটা আসলে একটুই। 

ঠিক তার তিন প্রজন্ম পরের সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেশ কিন্তু হিন্দুস্তানই। কাবুলকে ঠেস দিয়ে তিনি বললেন, আমের মতো একটা ফলের সমতুল্য ফল তামাম কাবুলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা কী আসলে? খাবারটা রূপক এখানে। আড়ালে নিজের জাতটাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা। 

আরও কয়েক শতক পর মাইকেল মধুসূদন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনে দেখালেন, গ্রাম্য মাতবরের টাকা খাওয়া কুচুটে বুড়ি মুসলমান বাড়িতে এসেছে কৃষকের সুন্দরী বউকে হাত করতে। বৃদ্ধ মাতবরের একটু আশনাই করার শখ আরকি। বুড়ি এসেছে তো ঠিকই, কিন্তু মুসলমান বাড়ির চারদিকে শুধু মুরগির পাখা আর পেঁয়াজের খোসা দেখে সে নাক কুঁচকায়। কুঁকড়োর পাখা, প্যাঁজের খোসা… থু থু! বুদ্ধিমান পাঠক, এটাই আদারিং! 

এই আদারিং-এর পাল্লায় পড়ে বাঙালি বলে ঘটিরা হলো চিংড়ি নামের পোকা খাওয়া বোকা, ঘটি বলে আলসে বাঙালি চেনে খালি বালিশ আর ইলিশ। এভাবেই ‘গরুখেকো’ মুসলিম, ‘কাছিম খাওয়া’ হিন্দু, ‘শুয়োর খাওয়া’ ক্রিশ্চান, ব্যাঙ খাওয়া ফরাসি, সাপ খাওয়া চাইনিজ, কুকুর খাওয়া কোরিয়ান, খেজুর খাওয়া আরব! 

কিন্তু কথা তো সেটা না! কথা হলো আদিবাসীরা তো সাপ-ব্যাঙ খায়। খায় তো! আমাদের দেশে বিশেষ করে মারমা সম্প্রদায় ব্যাঙ খাবার জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু তারাই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাঙখেকো জাতি নয়! এই ব্যাপারে পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ হলো ফরাসিরা। ছবির দেশে কবিতার দেশে পাঠকের অজানা নয় যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসি প্রেমিকা মার্গারিটের সাথে দেখা করতে প্যারিসে এসে খুব আগ্রহের সাথে বললেন, এবার তাহলে ব্যাঙ খাওয়া যাক! মার্গারিট অবাক। ব্যাঙ তো সেও আগে খায়নি! এ তো খুব বড়লোকের খাবার।    

দুজনে মিলে টাকা দিয়ে ব্যাঙের পা কিনল। তারপর মাখনে ভেজে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মুখে দিল। মুখে দিয়েই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার! এত অপূর্ব স্বাদ হবে তারাও ভাবতে পারেনি! 

তারমানে কী দাঁড়াল? আদিবাসীদের মতো প্যারিসবাসীও ব্যাঙ খায়। আজ পর্যন্ত কোনো ফরাসিকে দেখলে কাউকে বলতে শুনেছেন যে ‘ও, ফ্রেঞ্চ? তোমরা ব্যাঙ খাও?’ কেন বলে না? কারণ ফরাসিদের সাথে আমাদের এই আদারিংটা করার দরকার নেই। 

চাইনিজরা শুধু সাপ না, হেন কোনো প্রাণী সম্ভবত বাদ নেই যেটা তারা খাবার জন্য মুখে নেয় না। সৈয়দ মুজতবা আলী তো চাইনিজদের আরশোলা প্রীতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই ইঙ্গিত রেখেছেন। বলবেন চাইনিজ দেখলে এই কথা? বলবেন না। বলবেন আদিবাসী দেখলে: খাস তো তোরা সাপ ব্যাঙ!   

আদিবাসী বললে আমাদের সামনে এমন একটা অবয়ব ভেসে ওঠে, আদিবাসী মাত্রই নিজের ভাষা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, আদিবাসী মানেই সব এক ধর্মের অনুসারী, আদিবাসী মানেই দেশের সাড়ে ষোলো লাখ মানুষ প্রতিদিন একটা খাবারই খায়। আর কী সেই খাবার? ঠিক ধরেছেন। সাপ আর ব্যাঙ। এক অবিচ্ছেদ্য ডুয়ো। একটা ছাড়া আরেকটা জমেই না। ঠিক যেন জ্যাম আর পাউরুটি।   

বাংলাদেশে মোট ৫০ সম্প্রদায়ের আদিবাসী বাস করে। এর মাঝে অনেকেই বাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে । কেউ কেউ সমতলে। নানা ধর্মের অনুসারী এই আদিবাসীরা। এদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে বাস করা সাঁওতালের সাথে সিলেটে বাস করা মণিপুরী আদিবাসীর খাদ্যাভ্যাসে মিল খুঁজতে যাওয়াটা বাতুলতাই বলা যায়। তামাম বাংলাদেশ যেমন বিভিন্ন আঞ্চলিক খাবার খাচ্ছে, ওরাও খাক যেটায় ওরা অভ্যস্ত। 

খানাখাদ্য নিয়ে এই যে কাউকে নমো নমো করা, আবার কাউকে ছিছি করে নাক কুঁচকানো, অর্থনৈতিক অগ্রসরতা দিয়ে একে সহজভাবে ধরতে পারা যায়। মধ্যযুগ মাত্র শেষ হয়েছে। তমসা থেকে অল্প অল্প গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে ইউরোপ। উপমহাদেশে তখন ধন-সম্পদের রমরমা। টুকটাক যেসব ইউরোপীয় বনিক এ অঞ্চলে পাড়া দেয়া শুরু করেছে, তারা এখানকার ধন-দৌলত দেখে মুগ্ধ, এখানকার খাবার-দাবার দেখে মুগ্ধ। সে মুগ্ধতাই আবার পালটে গেল, যখন পাশার দান উলটে ইউরোপীয়রা এই অঞ্চলের শাসন-শোষণের মালিক। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সে সময়ের বিবরণ পড়লে চোখে ভেসে ওঠে সভ্য ও সৌখিন বৃটিশ শাসকদল ভারতীয় উপনিবেশে বসে কাঁটাচামচে স্টু ঠুকছে, স্যুপ খেয়ে ন্যাপকিনে ব্লট করছে, আদর করে পুডিং খাচ্ছে, শ্যাম্পনের গবলেটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। অন্যদিকে হতভাগা নেটিভরা? গামলা গামলা ভাত হয় মাংস-চর্বি দিয়ে ঠুসছে, না হয় বসে বসে রুটির জাবর কাটছে! কী গরীব… কী গরীব…  

ইউরোপ ধন-দৌলতে ভারতের নিচে আর নামেনি। কাজেই তাদের খাওয়া-খাদ্যও আমাদের কাছে হয়ে থেকেছে সভ্যতার পরম উৎকর্ষ, খাদ্য-ভদ্রতার স্ট্যান্ডার্ড। খাবার সময় ঢেঁকুর তোলা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেয়া যাবে না, মুখে চপ চপ শব্দ করা যাবে না… অনেক নিয়ম। সে নিয়ম খারাপ কেউ বলছে না, কিন্তু নিজের খাদ্য সংস্কৃতি দিয়ে সারা বিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড মাপার তুমি কে, হরিরাম? 

পাশ্চাত্যের খাবারের খুব কদর তখন, সেসময়ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটতে লাগল চীন, জাপানের। পাশ্চাত্য খাদ্য সংস্কৃতির উল্টোই বলা যায় সবকিছু। হাতে চপস্টিক থাকলেই হলো, সেটাই কারির বোলে ডোবাও, সেটাই মুখে দাও, সেটাই সবার সাথে অন্যান্য খাবার ভাগ করে খাও। আর শব্দ? নুডলস খাবার সময় যদি আপনি হুশ-হুশ জাতীয় কোনো শব্দ না-ই করে থাকেন, রাঁধুনীকে অপমান করলেন!   

কী আশ্চর্য, চীন-জাপানের অর্থনীতিটা চাঙ্গা হবার পর পাশ্চাত্যের কাছে যে খাবার রীতি ‘অসভ্য’ বলে মনে হতে পারত, সেই রীতিটাই লুফে নিলো সবাই। আমাদের দেশেও এল চাইনিজ রেস্তোঁরা। তাতে চামচের টুংটাং, গ্লাসের ঝনঝন সবই চলল। চাইনিজ খাওয়াটা তখন আভিজাত্যের প্রতীক, পয়সাওয়ালার লক্ষণ। বৃটিশ ভদ্রতার সাথে এটিকেট মিলছে না? খামোশ!

তখন পর্যন্ত আরবরা বেশ গরীব। মাটির নিচে তেলের আভাস পাওয়া যায়নি। আরবের বেদুইনরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়, একযোগে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খায়। কী জীবন, কী জীবন। ওদের খাবার আর খাওয়া কী, ওদের খাদ্য উপহার দিয়েই বরং বাঁচিয়ে রাখা উচিত। একসাথে এক থালে সবাই যে বসে খাচ্ছে, কেমন অস্বস্তি লাগে না? 

সেই আরবদের পয়সা হলো। ভুল বললাম, পেট্রো ডলার হলো। হাবিবি হাবিবিদের কদর বাড়ল বিশ্বজুড়ে। সেইসাথে কদর বাড়ল তাদের খাবারেরও। সবাই মিলে এক পাতের থেকেই তুলে তুলে খাওয়া? কী রাজসিক ব্যাপার! কী মানবিক উদারতা!  

হয়তো বাঙালিরও একসময় পয়সা হবে। তামাম বিশ্ব হয়তো সেই সময় গোগ্রাসে পোড়া মরিচ আর লবণ ডলা দিয়ে পান্তা মাখিয়ে খাবে। শীতের সিজনে ফুলকপি আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ইনস্টায় ছবি দিয়ে ভাইরাল হবে স্কুলপড়ুয়া কোনো মার্কিন কিশোরী।  

আর আদিবাসীরা টাকা-পয়সায় ধাঁই-ধাঁই উন্নতি করলে? সে উত্তর শেষে গিয়ে বলছি। 

অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে খাদ্যমোহে ভোগার একটা ব্যাপার আছে বোঝা গেল। কিন্তু তার মানে কি খাদ্য তাচ্ছিল্য করাটা খুবই যৌক্তিক? মানবিক? না। কেন আমরা এই খাদ্য তাচ্ছিল্য দেখাই, সেটার কারণগুলোই বলা হলো আরকি। 

শুধু খাদ্য গলাধঃকরণ নিয়েই আমরা আদারিং করি? মোটেই না। অন্য খাওয়া নিয়েও আমরা জাত-বেজাত বুঝিয়ে দেই। তাই আমাদের সমাজে দেখতে পাওয়া যায় ছ্যাঁকা-খাওয়া মজনুকে, আছাড়-খাওয়া শহুরে চাচাতো ভাইকে, ধরা-খাওয়া ব্যবসায়ীকে, পল্টি-খাওয়া রাজনীতিবিদকে, দৌড়ানি খাওয়া পকেটমারকে। 

নাটকে মোশাররফ করীম ফারুক আহমেদকে বলছিলেন, ‘দুনিয়াটা আসলে খাওয়াখাওয়ির খেলা।’ সত্যিই তাই। দুনিয়াটা খাওয়ার, অন্যকে খাওয়ানোর, আগামী প্রজন্মও যাতে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচে তার ব্যবস্থা করে যাওয়া। কিন্তু, খাদ্য-তাচ্ছিল্য করা? নৈব নৈব চ!  

আদিবাসীদের কথায় ফেরত আসি। তারা টাকা-পয়সার হিসেবে দাপট খাটানো পরিবর্তন নিয়ে আসলে কী হবে? কিচ্ছু হবে না, আমরা সম্ভবত খাবারেই পড়ে থাকব। খুব আগ্রহ নিয়ে বলব, ‘আদিবাসী আপনি? ওয়াও! নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে মজার মজার সাপ-ব্যাঙ খান!’   

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।