এক গল্পের বিপদ

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

আমি একজন গল্পকার। আমার ব্যক্তিগত কিছু গল্প আপনাদের সাথে আজ আমি শেয়ার করতে যাচ্ছি। আমি এর নাম দিয়েছি, ‘এক গল্পের বিপত্তি’। আমার বেড়ে ওঠা পূর্ব নাইজেরিয়ার এক ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। মা বলেন, আমি নাকি সেই ২ বছর বয়স থেকেই বই পড়া শুরু করেছিলাম। আমি অবশ্য মনে করি এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। যতদূর মনে পড়ে আমি ৪ বছর বয়স থেকে বই পড়া শুরু করি। মোটকথা, অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ দ্রুত পড়তে শিখে গেছিলাম। ব্রিটিশ আর আমেরিকান বইগুলো বেশি পড়া হতো তখন। লেখালেখিটাও আমার বেশ অল্প বয়স থেকে শুরু হয়। ৭ বছর বয়সে ক্রেয়ন রঙে আঁকিবুকির সঙ্গে পেন্সিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে গল্প লিখতাম। সেই দূর্বোধ্য গল্পের একমাত্র পাঠক ছিল আমার বেচারি মা।  সেসময় আমি তেমন গল্পই লিখতাম যা আমি পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার সব চরিত্র ছিল ফর্সা বর্ণের আর তাদের চোখের রঙ ছিল নীল। তারা তুষার বরফে খেলতো, আপেল খেত, আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতো, আর কথা বলতো মেঘ সরে গিয়ে সূর্য তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়ার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। আমি তখনও নাইজেরিয়ার বাইরে যাইনি। নাইজেরিয়ায় কখনো তুষারপাত হতো না। আম ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আর আবহাওয়া নিয়ে কখনো আমাদের কথা বলার প্রয়োজনই হয়নি। আমার গল্পের চরিত্রগুলো জিঞ্জার বিয়ার খেতো, কারণ ওইযে, ব্রিটিশ বইয়ের ওরাও খেতো বলে। যদিও জিঞ্জার বিয়ার যে আদতে কী তা-ই আমার জানা ছিল না। এমনকি কিছু বছর পর আমার জিঞ্জার বিয়ার টেস্ট করার বেশ শখও জেগেছিল। সে এক অন্য গল্প। আজ এই গল্পেই থাকি। এই সামান্য গল্পগুলো আমার ওপর, বিশেষভাবে আমার মত শিশুদের ওপর তখন এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলছিল। ছোটবেলায় আমার পড়া বইগুলোর সকল চরিত্র ছিল বিদেশি। বিদেশি বইয়ের প্রভাব এতটাই ছিল যে আমি বিশ্বাস করতাম, বিদেশি চরিত্র ছাড়া কোনো বই-ই নেই এই পৃথিবীতে। আর বইয়ে এমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার সঙ্গে আমি নিজের কিংবা আমার চারপাশের মিল খুঁজে পেতে পারি। বইয়ের দুনিয়াটা বুঝি যথারীতি আমার দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে। আমি জানলাম, আমার মতো যাদের চকলেট বর্ণের গায়ের রং আর কোকড়া চুল, তারাও হতে পারে গল্পের অংশ, তাদেরও স্থান আছে সাহিত্যে। তাই সেই দেখাদেখি আমিও লিখতে শুরু করলাম নিজের পরিচিত দুনিয়া নিয়ে। আমি সেই আমেরিকান আর ব্রিটিশ বইগুলোকেও সমানভাবেই ভালোবাসতাম। আমার কল্পনার জগতের ঢাকনাটা যে তারাই খুলে দিয়েছিল। নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করি আমি তাদের হাত ধরেই। তবে তার অনিচ্ছাকৃত ফল হলো আমার মতো মানুষরাও যে সেই দুনিয়ার অংশ হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তাই আফ্রিকান বই আমাকে যা দিয়েছে তা হলো ‘বই কী’ সেই বিষয়ে পুরোপুরি এক ভিন্ন ধারণা, আর পরিচয় করিয়েছে আমার পরিচিত বইয়ের দুনিয়ার সঙ্গে।  

আমি খুবই সাধারণ, মধ্যবিত্ত নাইজেরিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা প্রফেসর ছিলেন। আমার মা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। আর পাঁচজনের মত আমাদের বাড়িতেও গৃহকর্মী রাখা হতো। আমার বয়স যেবার আট হলো, আমাদের বাড়িতে এক নতুন কাজের ছেলে আসে, নাম ফাইদ। মা তার সম্পর্কে শুধু একটাই কথা বলেছিল যে, ফাইদের পরিবার খুব গরিব। মা প্রায়ই ফাইদের বাড়িতে মিষ্টি আলু, ভাত এবং আমাদের পুরানো কাপড় পাঠাতো। আর আমি কখনো খাবার প্লেটে রেখে উঠে যেতে গেলেই মা বলতেন, ‘এক্ষুনি খাবার শেষ করো। দেখতে পাওনা ফাইদের মতো পরিবারগুলোর যে কিছু নেই?’ আমার ফাইদের পরিবারের জন্য প্রচুর করুণা হতো। তারপর এক শনিবার আমরা তার গ্রামে বেড়াতে যাই। এবং ফাইদের মা তার ভাইয়ের বানানো রঙ্গিন রাফিয়া দিয়ে তৈরি সুন্দর ডিজাইনের এক ঝুড়ি দেখান আমাদের। আমি চমকে উঠি। আমার কখনো মনেই হয় নি যে তার পরিবারের কেউ আসলে কিছু করতে পারে। আমি তাদের সম্পর্কে শুধু এটাই শুনেছি যে তারা কতটা গরিব। তাই তাদেরকে দরিদ্র ছাড়া অন্য কিছু হিসাবে কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিয়ে আমার জানা একমাত্র গল্প, একমাত্র ধারণা, একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গী।    

অনেক বছর পর ফাইদের গল্পটা আমার আবারও মনে পড়লো যখন আমি নাইজেরিয়া ছেড়ে আমেরিকার এক ভার্সিটিতে পড়তে আসি। আমি তখন ১৯ বছরের তরুনী। আমার মার্কিন রুমমেট তো আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর একেবারে হতভম্ব! জিজ্ঞেস করে বসেছিল, কোথা থেকে আমি এত ভালো ইংরেজি বলতে শিখেছি। তবে সে আরও জোরদার হতভম্ব হলো যখন জানতে পারলো নাইজেরিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। এরপর সে কৌতুহলবশত আমাদের ‘আদিবাসি গান’ শুনতে চাইলো। বেচারি আমি মারিয়া ক্যারের গানের ক্যাসেট  বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো তার ‘আদিবাসি গান’ শোনার বাসনায় আমি পানি ঢেলে দিয়েছি! এমনকি সে ভাবতো যে আমি বুঝি চুলাও জ্বালাতে জানি না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমার প্রতি তার ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া ছিল করুণা, যদিও তা নেতিবাচক করুনা নয়, উদ্দেশ্য তার ভালোই ছিল। আমার রুমমেট আফ্রিকা সম্বন্ধে একটি গল্পই জানতো। আফ্রিকার বিপর্যয়ের গল্প। এই গল্পে আফ্রিকান কোনো মানুষের সঙ্গে তার মিল থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমার জন্যে করুণা ছাড়া অন্য কোন জটিল অনুভূতির জায়গা ছিল না তার। আমাকে তার সমানভাবে দেখারও কোন সম্ভাবনা ছিল না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আমি নিজেকে সেভাবে আফ্রিকান ভাবতাম না। কিন্তু সেখানে আফ্রিকার নাম এলেই মানুষ আমার দিকে ফিরে তাকাতো। আমি অবশ্য আমার এই নতুন পরিচয়টাকে আপন করে নিতে শিখেছি। আমি নিজেকে এখন আফ্রিকান বলেই মনে করি। যদিও আফ্রিকাকে দেশ বললে আমি এখনও বেশ বিরক্ত হই। একটা উদাহরণ দিই। দুইদিন আগে লাগোস থেকে ফেরার সময় ফ্লাইটে ‘ভারত, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের’ দাতব্যমূলক কাজের বর্ণনা দিচ্ছিল। 

তবে আফ্রিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বছর কাটানোর পর আমার প্রতি সেই রুমমেটের প্রতিক্রিয়া আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আমি  যদি নাইজেরিয়ায় বেড়ে না উঠতাম, তবে আমিও ভাবতাম আফ্রিকা মানে সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা এক স্থান যেখানে সুন্দরসব প্রাণী আর অসংখ্য মানুষের বাস, যারা প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছে অর্থহীন যুদ্ধ, মরছে এইডস কিংবা দরিদ্রতায় ভুগে। নেই তাদের নিজেদের হয়ে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তারা তাই অপেক্ষা করছে কবে এক সহৃদয়, শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ব্যক্তি এসে রক্ষা করবে তাদের। ছোটবেলায় নাইজেরিয়াতে না থাকলে আমি ফাইদের পরিবারকে যেভাবে দেখতাম, ঠিক সেভাবেই দেখতাম আফ্রিকানদেরও। আমার মনে হয় আফ্রিকানদের প্রতি এই একতরফা ধারণাটা এসেছে পশ্চিমা সাহিত্য থেকে। ১৫৬১ সালে পশ্চিম আফ্রিকা পাড়ি দেওয়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী জন লক ব্ল্যাক আফ্রিকানদের সম্বোধন করেছিলেন ‘গৃহহীন জানোয়ার’ হিসেবে। ‘মুণ্ডুহীন মানুষ, যাদের চোখ আর মুখ থাকে তাদের স্তনে/বুকে’, এভাবেই জন লক বর্ণনা করেছেন আফ্রিকানদের। জন লকের বর্ণনা আমি যতবার পড়ি, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। সত্যিই জন লকের কল্পনা করার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। এমন সব লেখা দিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে আফ্রিকান গল্পের চল। তাই সাব-সাহারান আফ্রিকাকে সকলে এক অদ্ভুত অন্ধকার জায়গা আর এর বাসিন্দাদের রুডইয়ার্ড কিপলিং এর ভাষায় ‘হাফ ডেভিল, হাফ চাইল্ড’ (অর্ধেক শয়তান আর অর্ধেক শিশু) হিসেবেই দেখতো। ফলে আমিও বুঝতে শুরু করলাম আমার সেই রুমমেটও বোধহয় সারাজীবন আফ্রিকানদের বিষয়ে এমন এক ধরনের গল্পই শুনে গেছে ভিন্ন আদলে কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে। শুধু আমার রুমমেট নয়, এমন এক গল্পের বিপত্তির স্বীকার হয়েছিলেন আমার এক প্রফেসরও। সেই প্রফেসর আমার উপন্যাস পড়ে বলেছিলেন তা নাকি ঠিক ‘খাঁটি আফ্রিকান’ উপন্যাস হয়নি। যদিও ‘খাঁটি আফ্রিকানত্ব’ কীভাবে অর্জন করা যায় বা ইহা যে আসলে কি জিনিস তাই আমার জানা ছিল না। শেষমেশ প্রফেসর জানালেন, আমার গল্পের চরিত্র নাকি এক সাধাসিধে, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত লোক, যিনি অনেকটা তার মতো। আমার চরিত্রদের নিজস্ব গাড়ি ছিল। তারা না খেতে পেয়ে মরছে না বলে নাকি তারা খাঁটি আফ্রিকান নন!   

তবে আমিও যে এই এক গল্পের বিপত্তিতে পড়িনি তা কিন্তু নয়। কয়েক বছর আগে আমি মেক্সিকো ঘুরতে যাই। তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল বেশ উত্তপ্ত, অভিবাসন নিয়ে চলছিল নানা তর্ক-বিতর্ক। আর তখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর/অভিবাসনের মানেই ছিল মেক্সিকান। মেক্সিকানদের ঘিরে ছিল লুকিয়ে সীমান্ত পার করা, সীমান্ত পার করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার গল্প। আমার মনে আছে, প্রথমদিন মেক্সিকোর গুয়াদালাজারায় ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সেখানে মানুষ গতানুগতিকভাবে কাজে যাচ্ছে, বাজারে টর্টিলা তৈরি হচ্ছে, কেউ বা ধূমপান করছে, কেউ বা প্রাণখুলে হাসছে। তৎক্ষণাৎ এমন চিত্র দেখে কিছুটা অবাক হলেও, পরমুহূর্তেই আমি লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আমেরিকায় মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপর মিডিয়া কাভারেজ দেখতে দেখতে আমিও তাদের শুধুমাত্র দুঃস্থ অভিবাসী হিসেবেই দেখা শুরু করেছিলাম। আমি নিজেও মেক্সিকানদের এক গল্পে, এক পরিচয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই এভাবে শুধু এক গল্পের মাধ্যমে মানুষকে দেখলে, চিনলে আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলো বারবার শুনতে থাকলে, সেই গল্পের বাইরে মানুষগুলোর অস্তিত্ব চিন্তা করা প্রায় কঠিন হয়ে যায়। এক গল্প সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ক্ষমতার প্রসঙ্গ আসেই। একটা ইগবো শব্দ আছে ‘এনকালি’ (nkali) মোটাদাগে যার অর্থ ‘অন্যের চেয়ে মহৎ’। বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে ভাবতে গেলেই শব্দটি আমার মনে পড়ে। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুনিয়ার মতো, গল্পগুলাকে এনকালির নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায়। গল্প কে বলছে, কীভাবে বলছে, কখন বলছে, কতগুলি গল্প বলছে, সবকিছুই ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা শুধু অন্য ব্যক্তির গল্প বলে দেওয়ার ক্ষমতা না, একটি গল্পই ব্যক্তির চূড়ান্ত গল্প বলে প্রতিষ্ঠা করা। ফিলিস্তিনী কবি মুরিদ বারঘুতি লিখেছেন যে, আপনি যদি কাউকে অধিকারচ্যুত করতে চান, সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের গল্প বলা এবং ‘দ্বিতীয়ত’ দিয়ে শুরু করা। 

ব্রিটিশদের আগমনের বদলে নেটিভ আমেরিকানদে তীর-ধনুক দিয়ে শুরু করুন, দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পকে প্রতিস্থাপন করুণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলির ইতিহাস থেকে, পাবেন ভিন্ন স্বাদের গল্প।  

আমি সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলতে গেছি। একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলেন, নাইজেরিয়ার সকল পুরুষই যে শারীরিক নির্যাতনকারী তা জেনে সে খুবই হতাশ হয়েছে। কারণ আমার লেখা বইটির বাবা চরিত্রটি ছিল শারীরিক নির্যাতনকারী। তখন আমি তাকে বললাম, ‘আমি সবেমাত্র ‘আমেরিকান সাইকো’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। ‘সেই উপন্যাসের চরিত্রের মত আমেরিকার তরুনরাও সবাই সিরিয়াল কিলার সেটি জানতে পেরে আমিও বেশ হতাশ হলাম’ অবশ্যই কথাটি আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আর কিছুটা মজা করেই বলেছি। একটি মার্কিন উপন্যাসের চরিত্র সিরিয়াল কিলার ছিল বলে আমি নিশ্চয়ই সকল আমেরিকানকে সিরিয়াল কিলার ভাবছি না। এমন নয় যে আমি সেই শিক্ষার্থী থেকে ভালো মানুষ বলে আমেরিকানদের নিয়ে আমি এভাবে ভাবছি, বরং এক গল্প পড়েই আমেরিকানদের সিরিয়াল কিলার না ভাবার কারণ বিশ্বজুড়ে তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিস্তৃতি। আমি আমেরিকার আরও অনেক গল্প পড়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তাই আমার তাদেরকে এক গল্প দিয়ে বিচার করতে হয়নি। আমি টাইলার আর আপডাইক যেমন পড়েছি, তেমনি পড়েছি স্টেইনব্যাক কিংবা গ্যাটস্কিল। আমেরিকা নিয়ে আমার একটি নয়, অনেক গল্পই জানা ছিল, একটি নয়। 

কয়ের বছর আগে আমি জানতে পারি শৈশব সুখের হলে নাকি সফল লেখক হওয়া যায় না! এরপর থেকে আমার বাবা-মা কীভাবে ছোটবেলায় আমার সঙ্গে কী কী বাজে ব্যবহার করেছে তার স্মৃতি খুড়তে শুরু করি। কিন্তু আদতে আমার ছেলেবেলা ছিল আমার ছোট্ট পরিবারের সঙ্গে খুব হাসিখুশি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবুও কঠিন সময় যে যায়নি তা কিন্তু নয়। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন আমার দাদা মারা গেছিলেন। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে আমার চাচাতো ভাই পল মারা যান। আমার বন্ধু ওকোলামা মারা যায় প্লেন দূর্ঘটনায়। আমি যেই সামরিক সরকারের শাসনে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শিক্ষার মূল্য ছিল না, প্রায়ই আমার বাবা-মা বেতন পেতো না।  হুট করেই কোন একদিন সকালে উঠে দেখতাম নাস্তার টেবিল থেকে জেলির বয়াম উধাও হয়ে গেছে। কোনদিন আবার হয়তো মার্জারিন উধাও হয়ে যেত, আস্তে আস্তে পাউরুটির দাম বাড়তে লাগলো, এরপর দুধ আগের মত যত ইচ্ছে খাওয়া যেত না, বুঝেশুনে নিতে হতো। আমাদের জীবনে খুব সাধারণভাবেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্থিরভাবে বিরাজমান ছিল। এই গল্পগুলোই আজ আমাকে আমি করে তুলেছে। কিন্তু শুধু এই অসুন্দর গল্পগুলো দিয়ে আমাকে বিচার করা যাবে না। এক গল্প খুব সহজেই স্টেরিওটাইপ তৈরি করে ফেলে। এই বাঁধাধরা কিংবা স্টেরিওটিপিকাল গল্পগুলো সত্য, তবে পুরোপুরি নয়। এক গল্পের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানে সেটাকেই একমাত্র গল্প বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু তার বাইরেও যে অসংখ্য গল্প আছে।  

আফ্রিকাতে একের পর এক বিপর্যয় লেগেই ছিল, আছে, থাকবে। আফ্রিকা ঘিরে যেমন আছে দগদগে ক্ষত রেখে যাওয়া কঙ্গোর সেই ভয়ানক ধর্ষণের কাহিনী, তেমনি আছে নাইজেরিয়ায় একটি মাত্র চাকরির জন্য ৫০০০ মানুষ আবেদন করার মত হতাশাজনক কাহিনী। কিন্তু আফ্রিকা মানেই কী শুধু দুঃসংবাদ? বিপর্যয়ের গল্প ছাড়াও নিশ্চয়ই আফ্রিকার আরও গল্প আছে। আর সেগুলো নিয়েও কথা বলা সমান গুরুত্বপূর্ণ।    

আমি মনে করি কোনো জায়গা বা মানুষ সম্পর্কে তার সকল রকমের গল্প না শুনে সেই স্থান বা মানুষের সঙ্গে মেশা প্রায় অসম্ভব। আমার মনেহয় এক গল্প দিয়ে মানুষকে বিচার করা মানে তার মর্যাদা কেড়ে নেওয়া/ তার সম্মান কেড়ে নেওয়া। এক গল্প দিয়ে বিচার করলে আমরা তখন সেই মানুষটাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখি না। সেই মানুষটার সঙ্গে আমার মিল খোঁজার বদলে সে কীভাবে আমার থেকে অন্যরকম সেদিকে আমাদের নজর চলে যায়। যদি আমি মেক্সিকোতে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমেরিকা-মেক্সিকোর অভিবাসন দ্বন্দ্ব উভয় দিক থেকে পর্যবেক্ষন করতাম কিংবা যদি আমার মা ছোটবেলায় আমাকে বলতো ফাইদের পরিবার গরীব কিন্তু তারা কঠোর পরিশ্রমি কিংবা যদি থাকতো কোন আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখানো হতো আফ্রিকার বিচিত্র সব গল্প, তাহলে হয়তো নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবের ভাষায় ‘গল্পের মাঝে সমতা’ খুঁজে পেতে আমাদের এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। 

আমার সেই রুমমেট নাইজেরিয়া সম্পর্কে যদি  অন্য গল্পগুলো জানতো তবে আমায় দেখে হয়তো তার করুণা হতো না। সে যদি জানতো নাইজেরিয়ান প্রকাশক মুক্তা বাকারার কথা, যিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে প্রকাশনী সংস্থা খুলে বসেন। তখন খুব প্রচলিত ছিল যে নাইজেরিয়ানরা তেমন পড়ুয়া নন, তাই সাহিত্য তাদের জন্য নয়। কিন্তু মুক্তা বাকারা বেঁকে বসেছিলেন। তিনি মনে করতেন হাতের কাছে নিয়ে গেলে আর সহজলভ্য করলে যাদের পড়ার তারা ঠিকই পড়বে। তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর আমি লাগোসে এক সাক্ষাৎকার দিতে যাই।  সেখানে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করা এক মহিলা এসে আমাকে বলেন, ‘আপনার উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু শেষটা ভালো লাগেনি। আপনার একটা সিক্যুয়েল লেখা উচিৎ যেখানে আপনি এসব জিনিস লিখবেন…’। এরপর তিনি বলতে লাগলেন কীভাবে সিক্যুয়েলটা লিখতে হবে। এ ব্যাপারটায় যে আমি শুধু মজা পেয়েছি তা না, আমি বেশ মুগ্ধও হয়েছি। এক সাধারণ নাইজেরিয়ান মহিলা, যার হয়তো বা আমার বইটা পড়ার কোনো কথাই ছিল না, সে আমার বইটা পড়ে আমি বইয়ের সিক্যুয়েলে কী লিখতে পারি তা নিয়েও নিজের মত জানিয়ে গেছেন। এভাবেই আমার রুমমেট যদি আরও জানতো আমার লাগোসের দুঃস্বাহসী বন্ধু ফুমি ওন্ডার কথা, নিজের টিভি শো’তে সে প্রতিনিয়ত এমন সব গল্প তুলে আনে যা আমরা ভুলে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদি সেই রুমমেট শুনতো জে-জি থেকে ফেলা, বব মার্লে থেকে তার আগেকার প্রজন্ম, সকলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংরেজি, পিজিন, ইগবো, ইয়োরুবা আর ইজো ভাষায় গাওয়া নাইজেরিয়ার সমসাময়িক গানগুলো। যদি আমার রুমমেট জানতো সেই নাইজেরিয়ান মহিলা আইনজীবীর কথা, আদালতে নারীদের পুনরায় পাসপোর্ট করতে হলে যিনি স্বামীর সম্মতি নেওয়ার মতো হাস্যকর নাইজেরিয়ান আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিংবা যদি আমার রুমমেট জানতো নলিউড সম্পর্কে, যেখানে অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েও গুণীসব মানুষ বানিয়ে চলছেন অসাধারণ সিনেমা। যদি সে জানতো আমার হেয়ার ব্রেইডার কীভাবে নিজস্ব হেয়ার এক্সটেনশনের ব্যবসা শুরু করেছে কিংবা যদি জানতো আরও লাখ লাখ নাইজেরিয়ানদের গল্প যারা নিজ উদ্যোগে ব্যাবসা শুরু করে, ব্যর্থ হয়, কিন্তু তবুও হাল ছাড়ে না।  

আমি প্রতিবার বাড়িতে ফিরলেই নাইজেরিয়ানদের দেখি আমাদের ব্যর্থ সরকার, অবকাঠামো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ব্যর্থ সিস্টেমের মধ্যে থেকেও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত পৌঁছে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। আমি প্রতি বছর গ্রীষ্মে লাগোসে লেখালেখির ওপর একটা কর্মশালা নেই। সেই কর্মশালার প্রতি সকলের আগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবি, কত মানুষ গল্প লিখতে চায়, নিজের গল্পগুলো বলতে চায়। নাইজেরিয়ান সেই প্রকাশক আর আমার এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ফারাফিনা ট্রাস্ট। আমাদের স্বপ্ন হলো বিশাল বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করা, আর পুরোনো লাইব্রেরিগুলো সংস্কার করা। এছাড়াও যেসব সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো বই নেই তাদের জন্য বই দেওয়া। আর নিজেদের গল্পগুলো বলতে যারা মুখিয়ে আছে তাদের জন্য বই পড়া ও লেখালেখির ওপর অসংখ্য অসংখ্য কর্মশালার আয়োজন করা। গল্প বলাটা খুব দরকার। আর অনেক ধরণের গল্প বলা আরও বেশি দরকার। কষ্ট, উৎখাত কিংবা অপমানের গল্প তো অনেক বলা হলো। গল্প যে দিতে পারে সাহস, ক্ষমতা আর জাগ্রত করতে পারে মনুষ্যত্বকেও। গল্পগুলো যেমন হতে পারে মানুষের সম্মান, মর্যাদা কেড়ে নেওয়া নিয়ে, তেমনি হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরে পাওয়ার।   

আমেরিকান লেখক এ্যালিস ওয়াকার তার দক্ষিনের আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কের বলেছিলেন যারা উত্তরে চলে এসেছে।  দক্ষিনের জীবন-যাপন বিষয়ক একটি বইয়ে তাদেরকে হাজির করেছেন এ্যালিস। ‘তারা গোল হয়ে বসতো,  পরস্পরকে বই পড়ে শোনাতো, আমার বই পড়া শুনতো, এবং এক ধরণের স্বর্গ যেন সেখানে নেমে আসতো’। 

আমি কথা শেষ করার আগে শুধু এটি বলবোঃ একটামাত্র গল্প প্রত্যাখ্যান করলে, যখন আমরা বুঝতে পারি যে কোনো স্থান নিয়ে একটামাত্র গল্প কোনোকালেই ছিল না, আমরা এক ধরণের স্বর্গ খুঁজে পাই। ধন্যবাদ। 

[ বর্তমান লেখাটি ২০০৬ সালে চিমামান্দার ‘ডেঞ্জার অফ ওয়ান স্টোরি’ শীর্ষক টেড টক- এর বঙ্গানুবাদ। সেমসেমের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাবিহা শারমিন ইভা।]

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।