নারীমুক্তি প্রসঙ্গে কেতকী  কুশারী ডাইসন 

Katoki-kushari
কেতকী কুশারী ডাইসন

মনে পড়ছে আমার ক্যানাডাবাসের কোনো এক সময়ে আমি আমার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটিকে মানুষ করা আর অন্যান্য গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করা ছাড়া ‘আপাতত আর কিছুই করছি না’ জেনে একটি বাঙালি যুবক অকপট বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের ধারে-কাছে কোনো দাসদাসীর উপস্থিতি যে ছিলো না তা তো বলাই বাহুল্য, উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে-দেশে আমার অথবা আমাদের সন্তানের পিতার কোনো আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন না। ফলে ঘরের কাজ আর নবজাতকের দেখাশোনা নিয়ে আমরা দুজনেই বেশ ব্যাস্ত ছিলাম। তার আগে আমি বিলেপ্তে সপ্তাহে তিনবার দৈনিক চার ঘন্টা ট্রেনে যাতায়াত করে চাকরি করতাম; আমার ধারণা ছিলো বিয়োবার জন্যে মেয়েরা কিছু অবকাশ নিতে পারে; হাজার হোক, প্রসূতির প্রসবোত্তর দূর্বলতা থেকে সেরা ওঠার ব্যাপারটা তো আছে, এবং আমার প্রথম প্রসব যথেষ্ট কঠিনই হয়েছিলো, কিন্তু সেসব বোধ করি ছিলো যুবকটির ধারণার বাইরে। আমি তাকে তখনই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, সংসার সামলানো আর ছেলে মানুষ করা বুঝি কোনো কাজের কাজ নয়? তিনি লজ্জা পেয়ে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন যে, হ্যা ওগুলোও মর্যাদাসম্পন্ন মনুষ্যকর্ম বটে। 

অবশ্য ক্যানাডায় থাকাকালীন আমি যে ‘আর কিছুই’ করিনি তাও ঠিক কথা নয়। কিছু কবিতা আর গ্রন্থসমালোচনা লিখেছিলাম (আমার ধারণা আর্জেন্টাই লেখক বর্হেস সম্পর্কে বাংলায় দু’চার কথা হয়তো বা আমিই প্রথম লিখি, এবং সেটা লিখেছিলাম ক্যানাডা থেকে); তাছাড়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের জন্য কিছু খাতা দেখেছিলাম এবং সাহিত্যের ব্যাপারে একেবারেই সংবেদনশূন্য একটি ছাত্রীকে কয়েকটি টিউটোরিয়ালও দিয়েছিলাম। বসন্তসমাগমে পুষ্পোদগম দেখে কবিদের চিত্ত যে পুলকিত হয়ে ওঠে এই সাধারণ তথ্যটাও মেয়েটির জানা ছিলো না, এবং বেশ মনে আছে তাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে ফুলটুল দেখিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম।  

বাঙালি যুবকটির সঙ্গে কথাবার্তার এই অভিজ্ঞতাটির বিপরীত কোণে অবস্থিত স্বল্পকাল পরবর্তী আরেকটি অভিজ্ঞতা। তখন আমি জাতে উঠেছিঃ দু’টি বাচ্চা মানুষ করছি, একই সঙ্গে অক্সফোর্ডে একটি বৃহদায়তন স্নাতোকোত্তর গবেষণাও আরম্ভ করেছি। ( আমার বিয়ের পর আমার জননী ও শ্বশ্রুঠাকুরাণী দু’জনে দুই ভিন্ন দেশের, দু’টি ভিন্ন সমাজের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও দিয়েছিলেন একই সদুপদেশঃ পতিদেবতার স্নাতকোত্তর গবেষণার কালে সন্তান উৎপাদন ক’রে আমি যেন তার সাধনার বিঘ্ন না করি। সুবোধ বালিকার ন্যায় সে-উপদেশ আমি গ্রহণ করেছিলাম ব’লে শেষ পর্যন্ত কোলে-কাখে দুটি বাচ্চা নিয়ে নাকানি-চোবানি খেতে খেতে স্নাতকোত্তর গবেষণা করতে হয়েছিলো আমাকেই)। 

ঐ অবস্থা আমার অক্সফোর্ডের কলেজের একটি সান্ধ্য ভোজে আমার আসন নির্দিষ্ট হয় ইংরেজি সাহিত্যের জাঁদরেল অধ্যাপিকা ডেইম হেলেন গার্ডনারের পাশে। তিনি আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়িকা ছিলেন না এবং আমার অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেনও না। যখন কথাক্রমে কিছুটা অবগত হলেন তখন বেশ বকুনি দিয়েই যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে এইঃ ‘তোমরা আজকালকার মেয়েরা দুটো আলাআ দুনিয়ার সুযোগসুবিধগুলো পেতে চাও, এ তোমাদের বড় দুঃসাহস। আমাদের সময়ে এত আদেখলাপনার সুযোগ ছিলো না। হয় বিবাহ ও সংসারধর্ম, নয় বহির্জগতের কর্মজীবনঃ এ দুটোর মধ্যে একটাকে আমাদের বেছে নিতে হতো। ও দুটো একসঙ্গে হয় না। যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হয়।’ সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে হেলেন গার্ডনার অবলম্বন করেছিলেন দ্বিতীয় বিকল্পটিকেই এবং তার কর্মজীবনে এমনই দীপ্তির পরিচয় দিয়েছিলেন যে অবশেষে উপনীত হয়েছিলেন সরকার-প্রদত্ত ‘ডেইম’ খেতাবটিতে।  

পরে ঐ কলেজের তৎকালীন আরেক রত্নবিশেষ, —ইতিহাস বিভাগের রিসার্চ ফেলো, আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড়, তিন সন্তানের জননী, যিনি কিনা সংসারধর্ম এবং কেরিয়র দুই নৌকাতেই পা রেখে স্রোত অতিক্রম করছিলেন,— এ বিষয়ে আমাকে যা বলেছিলেন তার সারাংশ এইরকমঃ আসলে এই দুরুহ সমন্বয় যে কোনো নারীর একেবারে অসাধ্য তা নয়, কিন্তু এ কাজে সফল হতে হলে আরও কান্ডজ্ঞান থাকা চাই। আপনি বিয়ে করেছেন আপনার এক সমবয়সীকে, যিনি নিজে এখনো তার কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত নন। আমি বিএ করেছি আমার চাইতে দশ বছরের বড় চাকুরিজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন অধ্যাপককে। ফলে কতগুল সুবিধা পাই। যেমন বিবিধ গার্হস্থ্য গ্যাজেট, বাচ্চা ধরার জন্যে একজন সহায়িকা। আপনার উচিৎ ছিলো অর্থের বনিয়াদে সুদৃঢ় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন পুরুষমানুষকে পাকড়াও করা।’ শুনে কিছুটা থাবড়ে গেছিলাম,— গোড়াতেই গলদ হয়ে গেছে?— কিন্তু যা-ই হোক, বেচারা সমবয়স্ক জীবনসঙ্গীকে তালাক দিইনি। স্বীকার করতে আপত্তি নেই, সে বেচারা আমার জন্যে জীবনে অনেক স্বার্থত্যাগ করেছে। 

এই যে পুস্তক সমালোচনার নাম ক’রে কেবল ব্যক্তিগত কথা ব’লে  যাচ্ছি, তার কারণ বর্তমান প্রসঙ্গে কথাগুলো একটিও অবান্তর নয়। উপরে যে-বইটির নাম দিয়েছি সেটি মেয়েদের জীবনের এই জাতীয় এবং সম্পৃক্ত নানান সমস্যা নিয়ে লেখা একটি সুচিন্তিত দার্শনিক বই। ফেমিনিজমের বিভিন্ন ইশুগুলি আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের  জীবনকেই কম-বেশি স্পর্শ করে, এবং আরও অনেক কথাই আমাদের স্পষ্ট করে আলোচনা করা উচিৎ। লক্ষনীয় উপরে উল্লিখিত অক্সফোর্ডের দুই মহিলাই ( ডেইম হেলেন এবং মেরিলিন বাটলার) প্রধানত তাদের নিজেদের কেরিয়রের মতো অ্যাকাডেমিক কর্মজীবনের কথাই ভাবছিলেন। শ্রমজীবী শ্রেণির মেয়েরা কিন্তু বরাবরই ঘরে-বাইরে খেটেছে, তাদের জন্য মধ্যবিত্তদের তেমন মাথা ব্যাথা হয়নি। এবং এই সুযোগে বলি, আমি অনেকবারই ভেবেছি, আমি যে ঠিক কীভাবে স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছিলাম তার খুটিনাটি দিয়েই একটি স্বতন্ত্র বই লেখা যায়। সে-সময়ে আমি আমার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতাম যে কোনো কোনোদিন রাতে শুতে যাবার আগে খেয়াল করতাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত্রিবাসের উপরে ড্রেসিং-গাউন জড়িয়ে নিয়ে যে অবস্থায় দিনের কাজ আরম্ভ করেছি দিনশেষেও সেই অবস্থাতেই আছি, সারা দিনেও বেশ বদলে শাড়ি পরে নেবার সময় হয়নি। সত্যি বলতে কি, সে সময়ে আমার সমস্ত দায়িত্বের মধ্যে গবেষণার কাজটাই ছিলো সব থেকে সহজ, কেননা যার রিসার্সে মন আছে তার কাছে রিসার্চ তো স্রেফ আনন্দ, প্রেমের শ্রম, অপরপক্ষে সন্তানপালন ও গৃহস্থালির খুঁটিনাটি আরও বিবিধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ গুণাবলী দাবি করেঃ তাতে কেবল কায়িক পরিশ্রম লাগে না, লাগে অনেক মানসিক গুণ, স্থৈর্য এবং ধৈর্য থেকে নিমেষের মধ্যে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, জীবননৈপুণ্য, সামগ্রিক ‘ম্যানেজমেন্ট’। 

নারীমুক্তি সপক্ষে নানান ধারনাই আজকাল পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন দেশে কম-বেশি চালু হয়েছে, — সম্প্রতি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে, বিশেষত মোল্লাতান্ত্রিক ইরানে,— কিন্তু সর্বত্রই এইসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ভুলভ্রান্তি  প্রচুর। 

একটি সুপ্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা এই যে সাম্য মানে জ্যামিতিক সাম্যঃ পুরুষ যেমন, নারীকেও অবিকল তেমনি হতে হবে।  যেন তারা সম্পূর্ণরূপে সমানধর্মা দু’টি ত্রিভুজ। নারী যেখানে পুরুষের থেকে আলাদা, সেই এলাকাটাকে একেবারের ভাজ করে মুড়ে গোপন করে ফেলতে হবে। কোনো মেয়ে যদি প্রসবের পরের দিন সকালেই ক্ষেতে হাজিরা দিয়ে ট্র্যাক্টর চালাতে পারেন তবেই তিনি আধুনিকা। 

এই ধারণার জের টেনে কারও কারও চোখ ঘরের বাইরে চাকরি করা এবং তার জন্যে মাইনে পাওয়াটাই হচ্ছে মুক্তির লক্ষণ। মেয়েদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নটা-পাচটার চাকরি করতে হবে, নয়তো তারা মুক্ত নারী হতে পারবে না। চাকুরীজীবী মানসতার সঙ্গে অর্থনীতিশাসিত বিভিন্ন শৈলীর মার্কসবাদী জীবন-ভাষ্যের মিলিত বিচিত্র ককটেলের প্রভাবে ‘আধুনিক’ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে নারীমুক্তির প্রধান তাৎপর্য এইখানেইঃ চাকরি করায় আর মাইনে পাওয়ায়। যে-মেয়ে চাকরি করে না এবং মাইনে পায় না, তার জীবন অন্য নানা দিকে কর্মব্যস্ত, সমৃদ্ধ, পূর্ণ, সার্থক হলেও এই নব্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সে ফেল্‌ ফেল্‌ ফেল্‌। 

এই প্রতিন্যাসের আরেকটি রকমফেরে মা হওয়াই এখনও নারীজীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা বটে, কিন্তু তার একটি আধুনিক রূপ আছে। যেমন ধরা যাক, কোনো বাঙালি মেয়ে বাচ্চা নিয়ে বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না হয়েছে। সে যদি ঘরের বাইরে রোজগার করে এবং ঘরের ভিতরে ঝি-চাকর রেখে তার বাচ্চাদের ভরণপোষণ করতে পারে, তা হলে আজকের দিনে তার কপালে বিস্তর প্রশংসা অবশ্যই জুটবে, —’এমন লক্ষ্মী মেয়ে বড় চোখে পড়ে না’ — কিন্তু যে সে বলবে, ‘এবারে আরেকটা বিয়ে করা যাক, কেননা কেবল বাচ্চাদের মানুষ করে আর চাকরি করে আমার চরিতার্থতা হচ্ছে না, আমার একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সঙ্গী লাগবে’, অমনি আধুনিক মা-মাসীরা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসবেন, কেননা ১. ঐতিহ্যিক রীতিতে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরে এবং ২. আধুনিক রীতিতে চাকরি করে তার তো ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে মোক্ষলাভ হয়ে আছে, তার বাইরে অল্প কিছু আবার লক্ষ্মী মেয়েদের লাগে নাকি, ছিঃ?  

কোনো নারী সেই অন্যদের কথামতোন নৌকো না বেয়ে নিজের জীবনের কোনো ক্ষেত্রে স্বকীয় নির্বাচনকে, স্ব-তন্ত্রতাকে, আত্মবশতাকে খাটাতে যাবেন, তখনই তাকে নানাবিধ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাঁতরাতে হবে। নারীর মুক্তি কীভাবে সম্ভব এই বিষয়টিতে সংকীর্ণ একদেশদর্শী গৃহীত মত এবং রক্তচক্ষু অনুশাসনের অভাব নেই। 

মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম বইয়ের প্রচ্ছদ

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শ মেয়েদের কিছু-কিছু ক্ষতি করেছে। সন্তানপালন এবং সংসারধর্মের গুরুদায়িত্বগুলি অনেকাংশে  তাদের প্রাক্তন মর্যাদাগুলি হারিয়েছে। যেন প্রত্যেকটি মেয়েকে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত কর্মী করে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের পাশে একটি করে সরকারি ক্রেশ গড়ে দিলেই মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মেয়েদের দেখেছেন, তা হয় না। কয়েক দশক ধরে মেয়েদের প্রতিবাদের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রেও এ ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে, নীড়রচনার এবং গার্হস্থ্য জীবনের, মাতৃত্বের এবং শৈশবের দাবিদাওয়া মেনে নেবার একটা চেষ্টা চলেছে। যারা পুঁজিবাদী-বাণিজ্যিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ফরিয়াদী তাদের এটাও বুঝতে হবে যে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের স্বার্থে নাগরিকদের প্রোডাকশন লাইনের বলিতে পর্যবসিত করতে পারে। 

তর্কের ডামাডোলে আজকাল প্রায়ই একটি কেন্দ্রিক প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছেঃ পরবর্তী প্রজন্মকে কারা গঠন করবে? কেবল দুধভাত খাওয়ানোর কথা ভাবছি না, কিংবা কেবল বর্ণমালা শেখানোর কথাও ভাবছি না, ভাবছি মানসিক গঠনের, চরিত্রগঠনের কথা। কারা শিশুদের ভালো-মন্দের ভেদ শেখাবে, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসা-শুভবুদ্ধি-নীতিবোধকে জাগ্রত করবে, আধুনিক পৃথিবীর সমস্যাগুলি সম্পর্কে তাদের অবহিত করবে? এ সমস্ত পুরো দায়িত্বই কি অর্পিত হবে ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন-বিদ্যালয় ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি উপরে? বাপ-মায়েরা কি অংশগ্রহণ করবে না? না করাটা কি কাম্য? যদি করে, তো করবে কখন? রোববার বিকেলে? অথচ এই দায়িত্ব কি আজকের পৃথিবীতে আগের দিনের চাইতে সূক্ষ্মতর, জটিলতর, ক্রমাগত আড়ও বেশি দাবিদার হয়ে উঠছে না? এ কাজে আমরা যে পরিমাণে ফাকি দেবো সেই পরিমাণেই প্রজাতির ভবিষ্যতকেও কি সংকটাপন্ন করে তুলবো না? 

এ কাজ কেবল মেয়েরাই করবে এমন কথা বলা হচ্ছে না, পুরুষদেরও যে যোগ দিতে হবে সেই ইঙ্গিতই দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কর্মের একটা ক্ষেত্র, একটা মঞ্চ তো চাই। পারিবারিক নীড় নতুন ধরণের পিতাকে লালন করতে পারে; ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন পারে। তাই ফেমিনিজম কেবল মেয়েদের ইশু নয়, সকলের ইশু। এবং এর খুঁটিনাটি সকলেরই তলিয়ে দেখা উচিৎ, পর্যালোচনা করা উচিৎ। ঘড়ির কাটাকে প্রাক-ফেমিনিস্ট সময়ে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। 

ফেমিনিজম আজকের আন্দোলন নয়। জন স্টুয়ার্ট মিল পৃথিবীর একজন উল্লেখযোগ্য ফেমিনিস্ট। এই চিন্তাধারা বর্তমান সময়ে কোন্‌ উপত্যকায় পৌছেছে, এই পৌছানোর তাৎপর্য কী, এখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখাচ্ছে, এখন থেকে তাকে কী ধরণের জমি অতিক্রম করতে হবে, কী কী সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হতে হবেঃ এইসব বিষয়ে ভারসাম্যযুক্ত আলোচনা যারা পড়তে চান তাদের মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। এটি আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখা একটি সুমিত, বুদ্ধিপ্রোজ্জ্বল, বিশ্লেষণধর্মী বই। এটি পড়লে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন তারা যারা উনিশ আর বিশ শ্তকের ফেমিনিস্ট চিন্তার বিভিন্ন শাখা-উপশাখাগুলিকে কিছুটা অনুধাবন করেছেন, তার এযাবৎ বিবর্তনের সঙ্গে কিয়দংশে পরিচিত। ফেমিনিস্ট চিন্তায় মার্কসবাদী বিশ্লেষণপদ্ধতি কতটা স্বার্থক হয়েছে, মার্কসবাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের চেহারা এখন থেকে কেমন হবে, সত্তরের দশকের ফেমিনিস্ট আন্দোলনের উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গগুলির পর এই মুহূর্তে কী জাতের মূল্যায়ন ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন, শ্রীমতি শুলামিথ ফায়ারস্টোনের (Shulamith Firestone, The Dialectic of Sex, 1970)। প্রবলভাবে মৌলিক প্রস্তাবসমূহের উত্তরাধিকারে আমরা শেষ পর্যন্ত কী পেলাম, ফেমিনিস্ট চিন্তায় চরমপন্থার কোনো অর্থ বা ভূমিকা থাকতে পারে কিনাঃ এই ধরণের নানান প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে। যুক্তিনিষ্ঠার সঙ্গে এখানে মিলিত হয়েছে মাত্রাজ্ঞান এবং একটি বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারার ক্ষমতা; নেই কোন আতিশায্য বা কচকচানি বা অহেতুক পারিভাষিক শব্দের আমদানি। আমার ব্যক্তিগত রুচির পক্ষে বইটির রচনা-শৈলী একটু বেশি সাদামাঠা, সমতল; স্টাইলটা আরও উচ্চাবচ, আলোছায়াভরা হলে আমি আড়ও উপভোগ করতাম। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে একটা সাহিত্য সমালোচনা ঘেষা হলো; আলোচ্য প্রসঙ্গে এ অভিযোগ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

লেখিকাদ্বয় চেষ্টা করেছেন নির্বাচনের বিভিন্ন মিথ্যা দ্বান্দ্বিকতা থেকে নারীর এবং সঙ্গে সঙ্গে  পুরুষের জীবনকেও উদ্ধার করতে। যে দ্বান্দ্বিকতাগুলির মুখোমুখি আমাদের বারে বারেই দাঁড় করানো হয় সেগুলি আবশ্যিক নয়, তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আপাতবিচ্ছিন্নদের নৈকট্যসাধনই, আপাতবিপরীতদের সমন্বয়সাধনই মনুষ্যধর্ম, উভয় লিঙ্গের পক্ষে। 

সে সাধনায় উভয় লিঙ্গই  যাতে উত্তীর্ণ হতে পারে তার জন্যে উপযুক্ত নির্ভরস্বরূপ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়,  যদি নারী আর পুরুষ মিলিতভাবে চেষ্টা করে। তার জন্যে সর্বাগ্রে মুক্ত করতে হবে বুদ্ধিকে। বর্জন করতে হবে যোদ্ধৃসুলভ সেই চিন্তাভঙ্গিকে, যা জীবনের যাবতীয় জটিলতাকে সরলীকৃত করে নিয়ে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে একটি শত্রুকে, তার পর তাকে বিনাশ করতে ঝাঁটার মতন এগিয়ে যায়, বিনা বাধায়, ‘ফরাসী-বিপ্লবী কায়দায়’। জীবনের সূক্ষ্ম সমস্যাগুলির সমাধান ওভাবে হয় না। তার জন্যে লাগে আর সংবেদন, আরও বহুমাত্রিক প্রতিন্যাস, সূক্ষ্মতর পরিকল্পনা এবং তার সযত্ন বাস্তবায়ন।  

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শের সীমাবদ্ধতাগুলি ধরিয়ে দিয়ে এরা দুজনে বলেনঃ দুই লিঙ্গের মধ্য কিছু কিছু পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু পার্থক্য মানে এ নয় যে একটি অপরটির থেকে নিকৃষ্ট। যেগুলি তথাকথিত ‘মেয়েদের কাজ’  সেগুলি কোনো বিচারেই তথাকথিত পুরুষদের কাজের থেকে গুরুত্বে হীন নয়। আজকের মেয়েরা কী কী কাজ করবে, কীভাবে করবে, কীভাবে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, এ সমস্তর মীমাংসা করতে হবে মেয়েদের জীবনেরই প্রয়োজন অনুসারে এবং সেই নীতি হবে লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের শ্রমকে এবং তার মূল্যায়নকে আরও মনুষ্যোচিত করে তোলার বৃহত্তর প্রচেষ্টারই অন্তর্গত, কেননা কর্মজীবনের যে-মডেলটা পুরুষরা এ যাবত গড়ে তুলেছেন সেটা কোনো নিখুঁত মডেল নয়। (এই শেষ উদ্ধৃতিটিতে থেকে লেখিকাদের নিচু গলায় কথা বলার স্টাইলটা আশা করি খানিকটা বোঝা যাবে) সংক্ষেপেঃ 

… once we stop being obsessed with the ideas of treating men and women exactly alike, the immediate aim for women will be to make it possible for them to pass in and out of the child-bearing phase of life without either penalizing children or grotesquely interrupting and distorting women’s useful careers. 

এখানে উল্লেখ করি যে প্রজনন প্রক্রিয়ার উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আজকাল এৎ দ্রুতগতিতে বাড়ছে যে সাধারণ মানুষ কেন, দার্শনিকরাও তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছেন না। মিজলি ও হিউজের এই বইটি বার হবার পরে গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু বৈপ্লবিক খবরই বেরিয়েছে।  কাচপাত্রে সফল গর্ভাধানের এবং সেভাবে আহহিত প্রাণের নিরাপদ মানবজন্মের খবর এখন আর নতুন নয়, কিন্তু কিছু দিন আগেই পড়লাম এই প্রক্রিয়ায় আরেক ধাপ অগ্রগতির কথা। কাচপাত্রে  আরদ্ধজীবন ভ্রুণকে হিমপেটিকায় রাখা হয়েছে, তার পর থেকে বার ক্রে তার হিমত্ব ঘুচিয়ে তাকে মাতৃজরায়ুতে ঢোকানো হয়েছে, এবং সেই শিশু সুস্থদেহে জন্মলাভ করেছে। হিমসংরক্ষিত ভ্রুণকে ডিম্বদাত্রী মাতার জরায়ুতে না ঢুকিয়ে অন্য নারীর জরায়ুতেও ঢোকানো যায়। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে একজন মেয়ে অপর কোনো মেয়ের ডিম্বজাত ভ্রুণকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে পারে এবং যথাসময়ে সেই শিশুকে প্রসব করতে পারে। তেমন শিশু দুজন আ থাকবেঃ ডিম্বদাত্রী ‘জনয়িত্রী’ এবং গর্ভধারিনী প্রসূতি। বহু ভ্রুণ এখনই ত্রিশঙ্কুতুল্য অবস্থায় হিমপেটিকায় সুপ্তিমগ্ন এবং বিদ্যুতের সরবরাহে ঘাটতি না ঘটলে অনির্দিষ্টকাল ওভাবে থাকতে পারে। হয়তো আজকের ভ্রুণ জন্ম নেবে ভবিষ্যতের কোনো নারীর গর্ভে, যে নারী এখনো অজাতা। অর্থাৎ কিনা কোনো নারীর পক্ষে তার পিসীমাকে গর্ভে ধরা অসম্ভব হবে না। এইসব সম্ভাবনার তাৎপর্য ও পরিণাম নিশ্চয়ই যুগান্তকারী। এদিকে কাচপাত্রে আহিত প্রাণকে জরায়ুর বদলে কৃত্রিম কোনো আশ্রয়ে, টিস্যুর নীড়ে কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়, বর্ধিত করা যায়, তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এইসব গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে সমাজপতিদের মাথাব্যাথাও বাড়ছে। কিন্তু গবেষণা পিছিয়ে নেই। 

সত্তরের দশকের গোড়ায় আমরা প্রথম যখন শুলামিথ ফায়ারস্টোনের ভবিষ্যৎ-কল্পনায় পড়েছিলাম যে ভবিষ্যতের শিশুরা নারীদেহের বাইরে জরায়ুর বিকল্প আশ্রয়ে লালিত হয়ে আমাদের অধুনা-পরিচিত জীবনের ছককে একেবারে পালটে দেবে, তখন সে চিন্তাকে ইউটোপিয়াই মনে হয়েছিলো অধিকাংশ পাঠকের; কিন্তু বস্তুত এখন অস্বীকার করা যায় না যে যদিও সেই ইউটোপিয়া এখনো পুরোপুরি এসে পৌছয়নি, তবু তার পদধ্বনি ক্রমশ এগিয়েই আসছে, পিছু হটে যাচ্ছে না। আজকের গরম-গরম ইশুগুলি তত দিনে ঠান্ডা  হয়ে যাবে, তখন মানুষের সামনে হাজির হবে কত নতুন নতুন ‘চয়েস’, কত নতুন ‘ডিলেমা’। 

[ নারীবাদের বিভিন্ন দার্শনিক দিক বিষয়ে প্রভাববিস্তারকারী বই মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম’। বর্তমান প্রবন্ধ ক্লাসিক বইটির পর্যালোচনা। সেমসেম-এ ক্লাসিক বইয়ের পরিচিতি ও সমালোচনামূলক ধারাবাহিক রচনার ধারাবাহিক প্রকাশ প্রকল্পের অংশ হিসেবে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। বর্তমান লেখাটি নেওয়া হয়েছে তার ভাবনার ভাস্কর্য বইয়ের ১৯৮৭ সালের সংস্করণ থেকে। –সম্পাদক]

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।