নারীমুক্তি প্রসঙ্গে কেতকী  কুশারী ডাইসন 

Katoki-kushari
কেতকী কুশারী ডাইসন

মনে পড়ছে আমার ক্যানাডাবাসের কোনো এক সময়ে আমি আমার সদ্যোজাত প্রথম সন্তানটিকে মানুষ করা আর অন্যান্য গার্হস্থ্য দায়িত্ব পালন করা ছাড়া ‘আপাতত আর কিছুই করছি না’ জেনে একটি বাঙালি যুবক অকপট বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের ধারে-কাছে কোনো দাসদাসীর উপস্থিতি যে ছিলো না তা তো বলাই বাহুল্য, উল্লেখ করা যেতে পারে যে সে-দেশে আমার অথবা আমাদের সন্তানের পিতার কোনো আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন না। ফলে ঘরের কাজ আর নবজাতকের দেখাশোনা নিয়ে আমরা দুজনেই বেশ ব্যাস্ত ছিলাম। তার আগে আমি বিলেপ্তে সপ্তাহে তিনবার দৈনিক চার ঘন্টা ট্রেনে যাতায়াত করে চাকরি করতাম; আমার ধারণা ছিলো বিয়োবার জন্যে মেয়েরা কিছু অবকাশ নিতে পারে; হাজার হোক, প্রসূতির প্রসবোত্তর দূর্বলতা থেকে সেরা ওঠার ব্যাপারটা তো আছে, এবং আমার প্রথম প্রসব যথেষ্ট কঠিনই হয়েছিলো, কিন্তু সেসব বোধ করি ছিলো যুবকটির ধারণার বাইরে। আমি তাকে তখনই জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, সংসার সামলানো আর ছেলে মানুষ করা বুঝি কোনো কাজের কাজ নয়? তিনি লজ্জা পেয়ে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করেছিলেন যে, হ্যা ওগুলোও মর্যাদাসম্পন্ন মনুষ্যকর্ম বটে। 

অবশ্য ক্যানাডায় থাকাকালীন আমি যে ‘আর কিছুই’ করিনি তাও ঠিক কথা নয়। কিছু কবিতা আর গ্রন্থসমালোচনা লিখেছিলাম (আমার ধারণা আর্জেন্টাই লেখক বর্হেস সম্পর্কে বাংলায় দু’চার কথা হয়তো বা আমিই প্রথম লিখি, এবং সেটা লিখেছিলাম ক্যানাডা থেকে); তাছাড়া স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের জন্য কিছু খাতা দেখেছিলাম এবং সাহিত্যের ব্যাপারে একেবারেই সংবেদনশূন্য একটি ছাত্রীকে কয়েকটি টিউটোরিয়ালও দিয়েছিলাম। বসন্তসমাগমে পুষ্পোদগম দেখে কবিদের চিত্ত যে পুলকিত হয়ে ওঠে এই সাধারণ তথ্যটাও মেয়েটির জানা ছিলো না, এবং বেশ মনে আছে তাকে বাগানে নিয়ে গিয়ে ফুলটুল দেখিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর একটা চেষ্টা করেছিলাম।  

বাঙালি যুবকটির সঙ্গে কথাবার্তার এই অভিজ্ঞতাটির বিপরীত কোণে অবস্থিত স্বল্পকাল পরবর্তী আরেকটি অভিজ্ঞতা। তখন আমি জাতে উঠেছিঃ দু’টি বাচ্চা মানুষ করছি, একই সঙ্গে অক্সফোর্ডে একটি বৃহদায়তন স্নাতোকোত্তর গবেষণাও আরম্ভ করেছি। ( আমার বিয়ের পর আমার জননী ও শ্বশ্রুঠাকুরাণী দু’জনে দুই ভিন্ন দেশের, দু’টি ভিন্ন সমাজের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও দিয়েছিলেন একই সদুপদেশঃ পতিদেবতার স্নাতকোত্তর গবেষণার কালে সন্তান উৎপাদন ক’রে আমি যেন তার সাধনার বিঘ্ন না করি। সুবোধ বালিকার ন্যায় সে-উপদেশ আমি গ্রহণ করেছিলাম ব’লে শেষ পর্যন্ত কোলে-কাখে দুটি বাচ্চা নিয়ে নাকানি-চোবানি খেতে খেতে স্নাতকোত্তর গবেষণা করতে হয়েছিলো আমাকেই)। 

ঐ অবস্থা আমার অক্সফোর্ডের কলেজের একটি সান্ধ্য ভোজে আমার আসন নির্দিষ্ট হয় ইংরেজি সাহিত্যের জাঁদরেল অধ্যাপিকা ডেইম হেলেন গার্ডনারের পাশে। তিনি আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়িকা ছিলেন না এবং আমার অবস্থা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেনও না। যখন কথাক্রমে কিছুটা অবগত হলেন তখন বেশ বকুনি দিয়েই যা বললেন তার সারমর্ম হচ্ছে এইঃ ‘তোমরা আজকালকার মেয়েরা দুটো আলাআ দুনিয়ার সুযোগসুবিধগুলো পেতে চাও, এ তোমাদের বড় দুঃসাহস। আমাদের সময়ে এত আদেখলাপনার সুযোগ ছিলো না। হয় বিবাহ ও সংসারধর্ম, নয় বহির্জগতের কর্মজীবনঃ এ দুটোর মধ্যে একটাকে আমাদের বেছে নিতে হতো। ও দুটো একসঙ্গে হয় না। যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হয়।’ সারাজীবন অবিবাহিতা থেকে হেলেন গার্ডনার অবলম্বন করেছিলেন দ্বিতীয় বিকল্পটিকেই এবং তার কর্মজীবনে এমনই দীপ্তির পরিচয় দিয়েছিলেন যে অবশেষে উপনীত হয়েছিলেন সরকার-প্রদত্ত ‘ডেইম’ খেতাবটিতে।  

পরে ঐ কলেজের তৎকালীন আরেক রত্নবিশেষ, —ইতিহাস বিভাগের রিসার্চ ফেলো, আমার চাইতে বয়সে খানিকটা বড়, তিন সন্তানের জননী, যিনি কিনা সংসারধর্ম এবং কেরিয়র দুই নৌকাতেই পা রেখে স্রোত অতিক্রম করছিলেন,— এ বিষয়ে আমাকে যা বলেছিলেন তার সারাংশ এইরকমঃ আসলে এই দুরুহ সমন্বয় যে কোনো নারীর একেবারে অসাধ্য তা নয়, কিন্তু এ কাজে সফল হতে হলে আরও কান্ডজ্ঞান থাকা চাই। আপনি বিয়ে করেছেন আপনার এক সমবয়সীকে, যিনি নিজে এখনো তার কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত নন। আমি বিএ করেছি আমার চাইতে দশ বছরের বড় চাকুরিজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত একজন অধ্যাপককে। ফলে কতগুল সুবিধা পাই। যেমন বিবিধ গার্হস্থ্য গ্যাজেট, বাচ্চা ধরার জন্যে একজন সহায়িকা। আপনার উচিৎ ছিলো অর্থের বনিয়াদে সুদৃঢ় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন পুরুষমানুষকে পাকড়াও করা।’ শুনে কিছুটা থাবড়ে গেছিলাম,— গোড়াতেই গলদ হয়ে গেছে?— কিন্তু যা-ই হোক, বেচারা সমবয়স্ক জীবনসঙ্গীকে তালাক দিইনি। স্বীকার করতে আপত্তি নেই, সে বেচারা আমার জন্যে জীবনে অনেক স্বার্থত্যাগ করেছে। 

এই যে পুস্তক সমালোচনার নাম ক’রে কেবল ব্যক্তিগত কথা ব’লে  যাচ্ছি, তার কারণ বর্তমান প্রসঙ্গে কথাগুলো একটিও অবান্তর নয়। উপরে যে-বইটির নাম দিয়েছি সেটি মেয়েদের জীবনের এই জাতীয় এবং সম্পৃক্ত নানান সমস্যা নিয়ে লেখা একটি সুচিন্তিত দার্শনিক বই। ফেমিনিজমের বিভিন্ন ইশুগুলি আজকের দিনে আমাদের প্রত্যেকের  জীবনকেই কম-বেশি স্পর্শ করে, এবং আরও অনেক কথাই আমাদের স্পষ্ট করে আলোচনা করা উচিৎ। লক্ষনীয় উপরে উল্লিখিত অক্সফোর্ডের দুই মহিলাই ( ডেইম হেলেন এবং মেরিলিন বাটলার) প্রধানত তাদের নিজেদের কেরিয়রের মতো অ্যাকাডেমিক কর্মজীবনের কথাই ভাবছিলেন। শ্রমজীবী শ্রেণির মেয়েরা কিন্তু বরাবরই ঘরে-বাইরে খেটেছে, তাদের জন্য মধ্যবিত্তদের তেমন মাথা ব্যাথা হয়নি। এবং এই সুযোগে বলি, আমি অনেকবারই ভেবেছি, আমি যে ঠিক কীভাবে স্নাতকোত্তর গবেষণা করেছিলাম তার খুটিনাটি দিয়েই একটি স্বতন্ত্র বই লেখা যায়। সে-সময়ে আমি আমার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে এমনই ব্যস্ত থাকতাম যে কোনো কোনোদিন রাতে শুতে যাবার আগে খেয়াল করতাম, সকালে ঘুম থেকে উঠে রাত্রিবাসের উপরে ড্রেসিং-গাউন জড়িয়ে নিয়ে যে অবস্থায় দিনের কাজ আরম্ভ করেছি দিনশেষেও সেই অবস্থাতেই আছি, সারা দিনেও বেশ বদলে শাড়ি পরে নেবার সময় হয়নি। সত্যি বলতে কি, সে সময়ে আমার সমস্ত দায়িত্বের মধ্যে গবেষণার কাজটাই ছিলো সব থেকে সহজ, কেননা যার রিসার্সে মন আছে তার কাছে রিসার্চ তো স্রেফ আনন্দ, প্রেমের শ্রম, অপরপক্ষে সন্তানপালন ও গৃহস্থালির খুঁটিনাটি আরও বিবিধ, বৈচিত্র্যপূর্ণ গুণাবলী দাবি করেঃ তাতে কেবল কায়িক পরিশ্রম লাগে না, লাগে অনেক মানসিক গুণ, স্থৈর্য এবং ধৈর্য থেকে নিমেষের মধ্যে জরুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, জীবননৈপুণ্য, সামগ্রিক ‘ম্যানেজমেন্ট’। 

নারীমুক্তি সপক্ষে নানান ধারনাই আজকাল পৃথিবীর বিচ্ছিন্ন দেশে কম-বেশি চালু হয়েছে, — সম্প্রতি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে, বিশেষত মোল্লাতান্ত্রিক ইরানে,— কিন্তু সর্বত্রই এইসব ভাবনা-চিন্তার মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ভুলভ্রান্তি  প্রচুর। 

একটি সুপ্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা এই যে সাম্য মানে জ্যামিতিক সাম্যঃ পুরুষ যেমন, নারীকেও অবিকল তেমনি হতে হবে।  যেন তারা সম্পূর্ণরূপে সমানধর্মা দু’টি ত্রিভুজ। নারী যেখানে পুরুষের থেকে আলাদা, সেই এলাকাটাকে একেবারের ভাজ করে মুড়ে গোপন করে ফেলতে হবে। কোনো মেয়ে যদি প্রসবের পরের দিন সকালেই ক্ষেতে হাজিরা দিয়ে ট্র্যাক্টর চালাতে পারেন তবেই তিনি আধুনিকা। 

এই ধারণার জের টেনে কারও কারও চোখ ঘরের বাইরে চাকরি করা এবং তার জন্যে মাইনে পাওয়াটাই হচ্ছে মুক্তির লক্ষণ। মেয়েদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নটা-পাচটার চাকরি করতে হবে, নয়তো তারা মুক্ত নারী হতে পারবে না। চাকুরীজীবী মানসতার সঙ্গে অর্থনীতিশাসিত বিভিন্ন শৈলীর মার্কসবাদী জীবন-ভাষ্যের মিলিত বিচিত্র ককটেলের প্রভাবে ‘আধুনিক’ বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে নারীমুক্তির প্রধান তাৎপর্য এইখানেইঃ চাকরি করায় আর মাইনে পাওয়ায়। যে-মেয়ে চাকরি করে না এবং মাইনে পায় না, তার জীবন অন্য নানা দিকে কর্মব্যস্ত, সমৃদ্ধ, পূর্ণ, সার্থক হলেও এই নব্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সে ফেল্‌ ফেল্‌ ফেল্‌। 

এই প্রতিন্যাসের আরেকটি রকমফেরে মা হওয়াই এখনও নারীজীবনের চূড়ান্ত সার্থকতা বটে, কিন্তু তার একটি আধুনিক রূপ আছে। যেমন ধরা যাক, কোনো বাঙালি মেয়ে বাচ্চা নিয়ে বিধবা বা বিবাহবিচ্ছিন্না হয়েছে। সে যদি ঘরের বাইরে রোজগার করে এবং ঘরের ভিতরে ঝি-চাকর রেখে তার বাচ্চাদের ভরণপোষণ করতে পারে, তা হলে আজকের দিনে তার কপালে বিস্তর প্রশংসা অবশ্যই জুটবে, —’এমন লক্ষ্মী মেয়ে বড় চোখে পড়ে না’ — কিন্তু যে সে বলবে, ‘এবারে আরেকটা বিয়ে করা যাক, কেননা কেবল বাচ্চাদের মানুষ করে আর চাকরি করে আমার চরিতার্থতা হচ্ছে না, আমার একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সঙ্গী লাগবে’, অমনি আধুনিক মা-মাসীরা ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে আসবেন, কেননা ১. ঐতিহ্যিক রীতিতে বাচ্চাদের বুকে জড়িয়ে ধরে এবং ২. আধুনিক রীতিতে চাকরি করে তার তো ইতিমধ্যেই সম্পূর্ণভাবে মোক্ষলাভ হয়ে আছে, তার বাইরে অল্প কিছু আবার লক্ষ্মী মেয়েদের লাগে নাকি, ছিঃ?  

কোনো নারী সেই অন্যদের কথামতোন নৌকো না বেয়ে নিজের জীবনের কোনো ক্ষেত্রে স্বকীয় নির্বাচনকে, স্ব-তন্ত্রতাকে, আত্মবশতাকে খাটাতে যাবেন, তখনই তাকে নানাবিধ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সাঁতরাতে হবে। নারীর মুক্তি কীভাবে সম্ভব এই বিষয়টিতে সংকীর্ণ একদেশদর্শী গৃহীত মত এবং রক্তচক্ষু অনুশাসনের অভাব নেই। 

মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম বইয়ের প্রচ্ছদ

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শ মেয়েদের কিছু-কিছু ক্ষতি করেছে। সন্তানপালন এবং সংসারধর্মের গুরুদায়িত্বগুলি অনেকাংশে  তাদের প্রাক্তন মর্যাদাগুলি হারিয়েছে। যেন প্রত্যেকটি মেয়েকে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানে বেতনভুক্ত কর্মী করে ঢুকিয়ে দিয়ে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের পাশে একটি করে সরকারি ক্রেশ গড়ে দিলেই মেয়েদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক মেয়েদের দেখেছেন, তা হয় না। কয়েক দশক ধরে মেয়েদের প্রতিবাদের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রেও এ ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন লক্ষিত হচ্ছে, নীড়রচনার এবং গার্হস্থ্য জীবনের, মাতৃত্বের এবং শৈশবের দাবিদাওয়া মেনে নেবার একটা চেষ্টা চলেছে। যারা পুঁজিবাদী-বাণিজ্যিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ফরিয়াদী তাদের এটাও বুঝতে হবে যে তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও রাষ্ট্রের স্বার্থে নাগরিকদের প্রোডাকশন লাইনের বলিতে পর্যবসিত করতে পারে। 

তর্কের ডামাডোলে আজকাল প্রায়ই একটি কেন্দ্রিক প্রশ্ন চাপা পড়ে যাচ্ছেঃ পরবর্তী প্রজন্মকে কারা গঠন করবে? কেবল দুধভাত খাওয়ানোর কথা ভাবছি না, কিংবা কেবল বর্ণমালা শেখানোর কথাও ভাবছি না, ভাবছি মানসিক গঠনের, চরিত্রগঠনের কথা। কারা শিশুদের ভালো-মন্দের ভেদ শেখাবে, তাদের মধ্যে জিজ্ঞাসা-শুভবুদ্ধি-নীতিবোধকে জাগ্রত করবে, আধুনিক পৃথিবীর সমস্যাগুলি সম্পর্কে তাদের অবহিত করবে? এ সমস্ত পুরো দায়িত্বই কি অর্পিত হবে ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন-বিদ্যালয় ইত্যাদি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলি উপরে? বাপ-মায়েরা কি অংশগ্রহণ করবে না? না করাটা কি কাম্য? যদি করে, তো করবে কখন? রোববার বিকেলে? অথচ এই দায়িত্ব কি আজকের পৃথিবীতে আগের দিনের চাইতে সূক্ষ্মতর, জটিলতর, ক্রমাগত আড়ও বেশি দাবিদার হয়ে উঠছে না? এ কাজে আমরা যে পরিমাণে ফাকি দেবো সেই পরিমাণেই প্রজাতির ভবিষ্যতকেও কি সংকটাপন্ন করে তুলবো না? 

এ কাজ কেবল মেয়েরাই করবে এমন কথা বলা হচ্ছে না, পুরুষদেরও যে যোগ দিতে হবে সেই ইঙ্গিতই দেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কর্মের একটা ক্ষেত্র, একটা মঞ্চ তো চাই। পারিবারিক নীড় নতুন ধরণের পিতাকে লালন করতে পারে; ক্রেশ-কিন্ডারগার্টেন পারে। তাই ফেমিনিজম কেবল মেয়েদের ইশু নয়, সকলের ইশু। এবং এর খুঁটিনাটি সকলেরই তলিয়ে দেখা উচিৎ, পর্যালোচনা করা উচিৎ। ঘড়ির কাটাকে প্রাক-ফেমিনিস্ট সময়ে আর ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। 

ফেমিনিজম আজকের আন্দোলন নয়। জন স্টুয়ার্ট মিল পৃথিবীর একজন উল্লেখযোগ্য ফেমিনিস্ট। এই চিন্তাধারা বর্তমান সময়ে কোন্‌ উপত্যকায় পৌছেছে, এই পৌছানোর তাৎপর্য কী, এখান থেকে পৃথিবীটাকে কেমন দেখাচ্ছে, এখন থেকে তাকে কী ধরণের জমি অতিক্রম করতে হবে, কী কী সমস্যার সমাধানে সচেষ্ট হতে হবেঃ এইসব বিষয়ে ভারসাম্যযুক্ত আলোচনা যারা পড়তে চান তাদের মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের বইটি পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। এটি আজকের দিনের পরিপ্রেক্ষিত থেকে লেখা একটি সুমিত, বুদ্ধিপ্রোজ্জ্বল, বিশ্লেষণধর্মী বই। এটি পড়লে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন তারা যারা উনিশ আর বিশ শ্তকের ফেমিনিস্ট চিন্তার বিভিন্ন শাখা-উপশাখাগুলিকে কিছুটা অনুধাবন করেছেন, তার এযাবৎ বিবর্তনের সঙ্গে কিয়দংশে পরিচিত। ফেমিনিস্ট চিন্তায় মার্কসবাদী বিশ্লেষণপদ্ধতি কতটা স্বার্থক হয়েছে, মার্কসবাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের চেহারা এখন থেকে কেমন হবে, সত্তরের দশকের ফেমিনিস্ট আন্দোলনের উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গগুলির পর এই মুহূর্তে কী জাতের মূল্যায়ন ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন, শ্রীমতি শুলামিথ ফায়ারস্টোনের (Shulamith Firestone, The Dialectic of Sex, 1970)। প্রবলভাবে মৌলিক প্রস্তাবসমূহের উত্তরাধিকারে আমরা শেষ পর্যন্ত কী পেলাম, ফেমিনিস্ট চিন্তায় চরমপন্থার কোনো অর্থ বা ভূমিকা থাকতে পারে কিনাঃ এই ধরণের নানান প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা এখানে পাওয়া যাবে। যুক্তিনিষ্ঠার সঙ্গে এখানে মিলিত হয়েছে মাত্রাজ্ঞান এবং একটি বিষয়কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পারার ক্ষমতা; নেই কোন আতিশায্য বা কচকচানি বা অহেতুক পারিভাষিক শব্দের আমদানি। আমার ব্যক্তিগত রুচির পক্ষে বইটির রচনা-শৈলী একটু বেশি সাদামাঠা, সমতল; স্টাইলটা আরও উচ্চাবচ, আলোছায়াভরা হলে আমি আড়ও উপভোগ করতাম। কিন্তু এটা নিঃসন্দেহে একটা সাহিত্য সমালোচনা ঘেষা হলো; আলোচ্য প্রসঙ্গে এ অভিযোগ ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। 

লেখিকাদ্বয় চেষ্টা করেছেন নির্বাচনের বিভিন্ন মিথ্যা দ্বান্দ্বিকতা থেকে নারীর এবং সঙ্গে সঙ্গে  পুরুষের জীবনকেও উদ্ধার করতে। যে দ্বান্দ্বিকতাগুলির মুখোমুখি আমাদের বারে বারেই দাঁড় করানো হয় সেগুলি আবশ্যিক নয়, তাদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। আপাতবিচ্ছিন্নদের নৈকট্যসাধনই, আপাতবিপরীতদের সমন্বয়সাধনই মনুষ্যধর্ম, উভয় লিঙ্গের পক্ষে। 

সে সাধনায় উভয় লিঙ্গই  যাতে উত্তীর্ণ হতে পারে তার জন্যে উপযুক্ত নির্ভরস্বরূপ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়,  যদি নারী আর পুরুষ মিলিতভাবে চেষ্টা করে। তার জন্যে সর্বাগ্রে মুক্ত করতে হবে বুদ্ধিকে। বর্জন করতে হবে যোদ্ধৃসুলভ সেই চিন্তাভঙ্গিকে, যা জীবনের যাবতীয় জটিলতাকে সরলীকৃত করে নিয়ে প্রথমেই নির্দিষ্ট করে একটি শত্রুকে, তার পর তাকে বিনাশ করতে ঝাঁটার মতন এগিয়ে যায়, বিনা বাধায়, ‘ফরাসী-বিপ্লবী কায়দায়’। জীবনের সূক্ষ্ম সমস্যাগুলির সমাধান ওভাবে হয় না। তার জন্যে লাগে আর সংবেদন, আরও বহুমাত্রিক প্রতিন্যাস, সূক্ষ্মতর পরিকল্পনা এবং তার সযত্ন বাস্তবায়ন।  

জ্যামিতিক সাম্যের আদর্শের সীমাবদ্ধতাগুলি ধরিয়ে দিয়ে এরা দুজনে বলেনঃ দুই লিঙ্গের মধ্য কিছু কিছু পার্থক্য নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু পার্থক্য মানে এ নয় যে একটি অপরটির থেকে নিকৃষ্ট। যেগুলি তথাকথিত ‘মেয়েদের কাজ’  সেগুলি কোনো বিচারেই তথাকথিত পুরুষদের কাজের থেকে গুরুত্বে হীন নয়। আজকের মেয়েরা কী কী কাজ করবে, কীভাবে করবে, কীভাবে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হবে, এ সমস্তর মীমাংসা করতে হবে মেয়েদের জীবনেরই প্রয়োজন অনুসারে এবং সেই নীতি হবে লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষের শ্রমকে এবং তার মূল্যায়নকে আরও মনুষ্যোচিত করে তোলার বৃহত্তর প্রচেষ্টারই অন্তর্গত, কেননা কর্মজীবনের যে-মডেলটা পুরুষরা এ যাবত গড়ে তুলেছেন সেটা কোনো নিখুঁত মডেল নয়। (এই শেষ উদ্ধৃতিটিতে থেকে লেখিকাদের নিচু গলায় কথা বলার স্টাইলটা আশা করি খানিকটা বোঝা যাবে) সংক্ষেপেঃ 

… once we stop being obsessed with the ideas of treating men and women exactly alike, the immediate aim for women will be to make it possible for them to pass in and out of the child-bearing phase of life without either penalizing children or grotesquely interrupting and distorting women’s useful careers. 

এখানে উল্লেখ করি যে প্রজনন প্রক্রিয়ার উপরে মানুষের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আজকাল এৎ দ্রুতগতিতে বাড়ছে যে সাধারণ মানুষ কেন, দার্শনিকরাও তার সঙ্গে তাল রাখতে পারছেন না। মিজলি ও হিউজের এই বইটি বার হবার পরে গত কয়েক মাসের মধ্যে বেশ কিছু বৈপ্লবিক খবরই বেরিয়েছে।  কাচপাত্রে সফল গর্ভাধানের এবং সেভাবে আহহিত প্রাণের নিরাপদ মানবজন্মের খবর এখন আর নতুন নয়, কিন্তু কিছু দিন আগেই পড়লাম এই প্রক্রিয়ায় আরেক ধাপ অগ্রগতির কথা। কাচপাত্রে  আরদ্ধজীবন ভ্রুণকে হিমপেটিকায় রাখা হয়েছে, তার পর থেকে বার ক্রে তার হিমত্ব ঘুচিয়ে তাকে মাতৃজরায়ুতে ঢোকানো হয়েছে, এবং সেই শিশু সুস্থদেহে জন্মলাভ করেছে। হিমসংরক্ষিত ভ্রুণকে ডিম্বদাত্রী মাতার জরায়ুতে না ঢুকিয়ে অন্য নারীর জরায়ুতেও ঢোকানো যায়। মানুষের ইতিহাসে এই প্রথম সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যে একজন মেয়ে অপর কোনো মেয়ের ডিম্বজাত ভ্রুণকে নিজের গর্ভে ধারণ করতে পারে এবং যথাসময়ে সেই শিশুকে প্রসব করতে পারে। তেমন শিশু দুজন আ থাকবেঃ ডিম্বদাত্রী ‘জনয়িত্রী’ এবং গর্ভধারিনী প্রসূতি। বহু ভ্রুণ এখনই ত্রিশঙ্কুতুল্য অবস্থায় হিমপেটিকায় সুপ্তিমগ্ন এবং বিদ্যুতের সরবরাহে ঘাটতি না ঘটলে অনির্দিষ্টকাল ওভাবে থাকতে পারে। হয়তো আজকের ভ্রুণ জন্ম নেবে ভবিষ্যতের কোনো নারীর গর্ভে, যে নারী এখনো অজাতা। অর্থাৎ কিনা কোনো নারীর পক্ষে তার পিসীমাকে গর্ভে ধরা অসম্ভব হবে না। এইসব সম্ভাবনার তাৎপর্য ও পরিণাম নিশ্চয়ই যুগান্তকারী। এদিকে কাচপাত্রে আহিত প্রাণকে জরায়ুর বদলে কৃত্রিম কোনো আশ্রয়ে, টিস্যুর নীড়ে কত দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়, বর্ধিত করা যায়, তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এইসব গবেষণার নৈতিকতা নিয়ে সমাজপতিদের মাথাব্যাথাও বাড়ছে। কিন্তু গবেষণা পিছিয়ে নেই। 

সত্তরের দশকের গোড়ায় আমরা প্রথম যখন শুলামিথ ফায়ারস্টোনের ভবিষ্যৎ-কল্পনায় পড়েছিলাম যে ভবিষ্যতের শিশুরা নারীদেহের বাইরে জরায়ুর বিকল্প আশ্রয়ে লালিত হয়ে আমাদের অধুনা-পরিচিত জীবনের ছককে একেবারে পালটে দেবে, তখন সে চিন্তাকে ইউটোপিয়াই মনে হয়েছিলো অধিকাংশ পাঠকের; কিন্তু বস্তুত এখন অস্বীকার করা যায় না যে যদিও সেই ইউটোপিয়া এখনো পুরোপুরি এসে পৌছয়নি, তবু তার পদধ্বনি ক্রমশ এগিয়েই আসছে, পিছু হটে যাচ্ছে না। আজকের গরম-গরম ইশুগুলি তত দিনে ঠান্ডা  হয়ে যাবে, তখন মানুষের সামনে হাজির হবে কত নতুন নতুন ‘চয়েস’, কত নতুন ‘ডিলেমা’। 

[ নারীবাদের বিভিন্ন দার্শনিক দিক বিষয়ে প্রভাববিস্তারকারী বই মেরি মিজলি ও জুডিথ হিউজের ‘উইমেন’স চয়েসেজঃ ফিলসফিকাল প্রবলেমস ফেসিং ফেমিনিজম’। বর্তমান প্রবন্ধ ক্লাসিক বইটির পর্যালোচনা। সেমসেম-এ ক্লাসিক বইয়ের পরিচিতি ও সমালোচনামূলক ধারাবাহিক রচনার ধারাবাহিক প্রকাশ প্রকল্পের অংশ হিসেবে লেখাটি প্রকাশ করা হলো। বর্তমান লেখাটি নেওয়া হয়েছে তার ভাবনার ভাস্কর্য বইয়ের ১৯৮৭ সালের সংস্করণ থেকে। –সম্পাদক]

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।