আপনি ‘পভার্টি ফটোগ্রাফ’ লিখে গুগলে সার্চ করলে দেখবেন, ৯০% ছবিই সাদাকালো। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো দারিদ্র্যের ‘অ্যাস্থেটিক ফোটোগ্রাফিরও বেশির ভাগ রঙহীন। এর কারণ ভেবে দেখেছেন কী?  

গরিব কি আসলেই বেরঙিন? 

আমাদের সমাজের কম আয় সম্পন্ন মানুষের দিকে তাকালে আমরা হয়তো চিত্রটা ঠিক তেমন দেখবো না। সকালে ক্লাসে বা কাজে বেরুলে গার্মেন্টসে কর্মরত মানুষদের যে ঢল আমরা দেখি তাদের বেশিরভাগের পরনেই থাকে উষ্ণ রঙের বড় বড় প্যাটার্নের পোশাক সাথে রঙিন ফিতার চপ্পল। রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি। রঙের বহুল ব্যবহার বা ‘বাহুল্য’কে সমাজে বরং দেখা হয় প্রায়শই ‘ক্ষ্যাত বা ছোটলোকি’ সংস্কৃতি হিসেবে (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে লেখার পরবর্তী অংশে)।  

তাহলে দরিদ্র মানুষের ছবি থেকে রঙ তুলে নিয়ে আসলে কী সিম্বোলাইজ করে?

ফোটোগ্রাফার মাইক লাশমোর তার ‘পোভার্টি ইজ নট সো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ লেখায় মনে করেছেন যে, এ ধরণের দু’রঙা ছবির একটা উদ্দেশ্য থাকে গরিব মানুষের প্রতি কিছুটা জোর করেই সিম্প্যাথির সৃষ্টি করা, তাদের করুণ অবস্থাকে আরো করুণতর, রঙহীন করে।   

লাশমোরের মত আমারও একটা হাইপোথিসিস আছে। আমরা মনে করি দরিদ্র মানুষ অতীতে বসবাস করে, ঠিক বর্তমান বা আধুনিকের অপর পাশে। থ্রি ইডিয়টস ছবিতে রাজু রাস্তোগি চরিত্রের নিম্ন আয়ের বাড়িতে গেলেই সব সাদাকালো হয়ে যায়, এমনকি স্ক্রিনের উপর পুরোনো দিনের ছবির ঝিরিঝিরি দাগও দেখা যায়। এই দৃশ্যটি বলিউডের ৭০-৮০ দশকের “জীবনঘনিষ্ঠ” ওরফে রিয়েলিস্ট সিনেমার গল্পের ধরণ ও বলার ঢংয়ের স্যাটায়ার। এই ধরনের গল্প বলার টুল বেছে নেওয়ার কারণ মানুষ দুর্দশা দেখলে সে যুগের সেই সাদাকালো ছবির কথাই ভাবে। মানুষগুলোও ছবি মুক্তি পাওয়ার সেই সময়ে আটকা।  

কেননা আমরা যাপনে নানা প্রযুক্তির অভাবকে ও কিছু নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণাকে অতীতের বিষয় হিসেবেই দেখি। এর নানা বিশেষণও আছে আমাদের ঝুলিতে। যেমন, ওল্ড ফ্যাশনড, ব্যাকওয়ার্ড, প্রিমিটিভ, ব্যাকডেটেড, আদিম, অসভ্য ইত্যাদি। এক কথায় বললে, অমুকটা না থাকলে ‘আধুনিক’ হয়নি, তমুকটা বললে অতীতেই আছে। যে অতীতে আছে তার ছবিও সেই অতীতের সাদাকালো, সেপিয়া এফেক্ট দেওয়া হবে তাই তো স্বাভাবিক।  

রঙ বা তার অভাব নিয়ে যারা ভিজুয়াল তৈরি করে আর যারা তার গ্রাহক আমরা উভয়ই  এক ধরনের পারসেপশন আর স্টেরিওটাইপের রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছি, পার্থক্য এটাই যে কেউ জেনে নিচ্ছি আর কেউ না জেনে। 

‘ক্ষ্যাত’ রঙ বা গর্জিয়াসের মধ্যে গর্জিয়াস বৃত্তান্ত  

কটকটা-ক্যাটক্যাটা, ক্ষ্যাত, লাউড, তীব্র, চোখে লাগা, দুবাইওয়ালা, বস্তি, ছাপড়ি ইত্যাদি বিশেষণে আমরা কিছু রঙকে বা রঙের শেডকে বিশেষায়িত করি। আবার আনুশকা শর্মার বিয়ের প্যাস্টেল রঙগুলোকে ‘ক্লাসি’-ও বলি সবাই তৎক্ষনাৎ। শুরুতে যে নাক কুঁচকানো রঙগুলোর কথা বলা হলো সেগুলোও অবশ্য ভিনদেশী পপ আইকনেরা (নিকি মিনাজ, কারডি বি, হ্যারি স্টাইল অ্যান্ড কোঃ) পরলে ‘নিয়ন’ নামে সমাদর পায়।  

এই যে কোনো রঙকে অচ্ছুৎ ঘোষণা বা কোনো রঙকে ‘জাতে’-র ভাবা এটা আসলে কারা কীভাবে ঠিক করে? এটা করায় কী সুবিধা হয়?

চ্যাপা শুটকি, গরুর বট, জর্দা দেওয়া পানের মত কিছু খাবার আমাদের সমাজে গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত। কখনো দোষ দেওয়া হয় এসব খাবারের ‘উৎকট’ গন্ধকে কিন্তু মূলত এই খাবারগুলোর কম মূল্য খাবারগুলোর  গরিবের খাবারের মর্যাদা এনে দেয়। এক সময় ছোট মাছকেও গরিবের খাবার হিসেবে দেখা হত এবং ঢাউস সাইজের রুই-কাতলা ছিল স্বচ্ছলতার চিহ্ন। ছোট মাছের দাম বাড়ার পর এবং যোগান কমার পর এখন তা আবার বড়লোকের খাবার। এমন এটা গরিবের, ওটা বড়লোকের হিসেবে কিছু জিনিসকে শ্রেণীভুক্ত করা আসলে কেন প্রয়োজন? 

নিজেকে ঐ শ্রেণীভুক্ত খাবার খাওয়া বা কাপড় পরা মানুষগুলো থেকে আলাদা করতে। নৃবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বে একটা প্রক্রিয়ার নাম প্রায়ই শোনা যায়ঃ আদারিং  বা অপরায়ন। এটা হলো কাউকে ‘অপর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ আমি সে বা তার দলভুক্ত নই। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে এই আদারিং সবসময় নিজের চেয়ে কম ক্ষমতা বা বিত্তশালী গোষ্ঠীকে করা হয়। নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান অংশকে বরং অনুকরণ করা হয়, তার সাথে একই শ্রেণীভুক্ত হওয়া হয় গর্বের বিষয়।  

উপনিবেশকতার সময়ে যেমন যা কিছু উপনিবেশিত রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীগুলো খেতো, পরতো, করতো তা ছিল ছোটলোকের কাজ এবং তারা ছিল ‘আদার’ পশ্চিমাদের কাছে। পিতৃতন্ত্রে নারীর যেকোনো কাজ বা পছন্দ ‘মেয়েলি’ যা পুরুষ করলে তার ‘জাত’ নিচে নামবে কারণ নারী পুরুষের আদার। রঙের ক্ষেত্রেও এমন আদার-এর রঙ আছে, বিত্তশালীর রঙ আছে। কোনো রঙ ক্ষ্যাত বলেই তো অন্য রঙটা এলিট হতে পারে।     

লেখার শুরুর অংশে বলা হয়েছে যে আমাদের চলাফেরায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাপড়ে আমরা বহু রঙ ও প্যাটার্ন দেখি – এগুলোই সমাজে ক্ষ্যাত বা কটকটা বলে পরিচিত। সকল নিম্ন আয়ের মানুষই যে এসব রঙের পোশাকই পরে তাও নয়, হয়তো আমাদের চোখে শুধু রঙিন কাপড়গুলোই পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। আর এই ধরনের পোশাক যদি সেই গোষ্ঠীর বেছে নেয় তবে তারও নানা কারণ থাকতে পারে।  হতে পারে যে এ ধরনের রঙের কাপড় ময়লা হলে কম দেখা যায় যেহেতু কায়িক শ্রমের চাকরিতে এবং পাবলিক পরিবহনে কাপড় ময়লা হওয়াটাই স্বাভাবিক, এগুলো ছিড়ে গেলে সেলাই বা ‘রিপু’ করলেও আলাদা করে চোখে পড়ে না আর ফিকে হলেও কাপড়ের বয়স বোঝা যাওয়া দুষ্কর। এই লেখাটা লেখার সময় আমরা সাতদিন সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা পরে চলাফেরা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের একজনের বাসা মোহাম্মদপুরে, আরেকজনের ভূতের গলিতে এবং দু’জন ঢাকার দুটো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। মোটামুটি ডে থ্রিতেই আমাদের জুতো, জামা আর পরার মত ছিল না আমাদের পারিপার্শ্বিকের দরুন। ঢাকার দু-তিনটি ‘গেটেড’ পাড়া ছাড়া সব অঞ্চলেই এমন অবস্থাই হওয়ার কথা। সেসব অঞ্চলের কাপড়ের আর ঘরের ইন্টেরিয়রের ধরন ও রঙও যে সমাজে ‘মার্জিত’ বা ‘রুচিশীল’ হিসেবে পরিচিত এ নিয়েও খুব আশ্চর্য হবার কিছু নেই। 

রুচির পাহারাদার মধ্য ও উচ্চবিত্তের মধ্যে কোনো ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখতে চান না বলেই আমরা জানি। তাদের আরোপিত রঙের মাত্রাজ্ঞানকে তাই আরেকটু খতিয়ে দেখা চাই।   

পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়া বা রঙ বিমুখতা

২০০০ সালে শিল্পী ডেভিড ব্যাচেলরের ক্রোমোফোবিয়া নামে একটা বই প্রকাশিত হয় রিকশন প্রকাশনী থেকে। ক্রোমোফোবিয়া বলতে তিনি বুঝান রঙের প্রতি ভয় বা বিমুখতাকে এবং তিনি এটাকে পশ্চিমা শিল্প ও সংস্কৃতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে হাজির করেন। তিনি একের পর এক উদাহরণ হাজির করেন যেখানে পশ্চিমের এ ফোবিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় দৃশ্যশিল্পে।   

যেমন, ১৯৩৯ সালের উইজার্ড অফ অজ ছবিতে একজন কিশোরী একটি ‘স্বাভাবিক’ রঙহীন জগতে বসবাস করে। এক পর্যায়ে সে একটি গর্ত বা পোর্টাল দিয়ে একটি ‘অদ্ভুত’ রঙিন জগতের দেখা পায়। এক সময় আমরা জানতে পারি এর পুরোটাই ছিল একটি স্বপ্ন বা ‘ফিভার ড্রিম’। এই ছবিতে রঙিন দুনিয়া ‘মোহ’ বা অসত্য জগতের হাতছানি দেয়, সেটা আকর্ষণীয় হলেও সত্য বা আদর্শ নয়।  ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অক্টোবর আর্ট ম্যাগাজিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্ট ম্যাগাজিন। অথচ এ ম্যাগাজিনের পুরোটাই সাদাকালো! কিন্তু এই ম্যাগাজিনেই পাওয়া যেত ‘উচ্চমার্গীয়’ আর্ট ও রুচির খোঁজ। বলে রাখা ভালো যে এই ম্যাগাজিন বাংলাদেশের বহু শিল্প প্রকাশনার ন্যায় অর্থের অভাবে রঙহীন ছিল না। 

ব্যাচেলর এই উদাহরণগুলোর পাশাপাশি ইতিহাসের দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখান যে, চিরকাল উপনিবেশিত দেশগুলো ছিল রঙের পিগমেন্টের খোরাকের দিক দিয়ে পশ্চিমের উপনিবেশক দেশগুলোর তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। রঙের পিগমেন্ট অর্থাৎ যা দিয়ে কোনো রঙ পুনুরুৎপাদন করা যায় আর যে কোনো রঙিন উদ্ভিদ বা খনিজ এক নয়। যেমন, নর্থ আমেরিকার বিখ্যাত সুগার মেপল গাছের ফল ঋতুর লাল-কমলা পাতা থেকে লাল-কমলা রঙের পিগমেন্ট পুনরায় কিছুকে সে রঙে রাঙানোর জন্য ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় মেহেদি পাতা থেকে খয়েরি-কমলা রঙের পিগমেন্ট তৈরি করা সম্ভব। নীলের পিগমেন্টের অন্যতম উৎস ইন্ডিগো গাছ পাওয়া যায় আফ্রিকা ও এশিয়াতে, লাল পিগমেন্টের গাছ ম্যাডারের ক্ষেত্রেও উৎপত্তিস্থল ভারত আর এশিয়ার অন্য কিছু অংশ। হলুদ, স্যাফ্লাওয়ার, কলানাট, কাচ ইত্যাদি অনেক উদাহরণ এখানে যোগ করা যায়। 

পশ্চিমে পিগমেন্টের অপ্রতুলতা উপনিবেশিকতার দশকগুলোতে তাদের দুটি জিনিসের দিকে ধাবিত করে।
এক. রঙ ও রঙিন সবকিছুকে বন্য, মেয়েলি, মোহময়, কুরুচিপূর্ণ (সভ্য, পুরুষালি, সত্য, রুচিশীলের ঠিক বিপরীত অর্থাৎ পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাধারার ঠিক উল্টোটা) বলে আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে আদারিং করা।
দুই. প্রচুর পিগমেন্ট উপনিবেশিত দেশগুলো থেকে নিয়ে আসা (উপনিবেশিত ভারতের নীলচাষ ও বিদ্রোহের ইতিহাস এই ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত উদাহরণ)।    

দ্বিতীয়টা ঘটলে প্রথমটা কেন বিরাজমান থাকবে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের অঞ্চল থেকে অনেক মসলাও নিয়েছিলো কিন্তু তারপরও ভারতীয়-চীনদেশীয় মশলার ‘স্বাদ-গন্ধ’ নিয়ে ও দেশে এই দশকেও পড়তে যাওয়া এশীয় ছাত্ররা কম বুলি হয় না, আগের কথা আর না-ই লিখলাম। আসলে ঐতিহাসিক ঘটনা বা শাসন একরৈখিক ফলাফল বয়ে আনে না, রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বহুরৈখিক চিন্তার ঘরানা ও বৈষম্য আছে। বৈষম্য পদ্ধতিগতভাবে শেখানো হয় যে গ্রুপের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে তাদেরও। এভাবে সৃষ্টি হয় নিজ জাতি ও সংস্কৃতির নানা কিছুর প্রতি বৈষম্যমূলক মানসিকতা। বৈষম্যের শিক্ষা পদ্ধতি কখনো প্রত্যক্ষ যেমন কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে দেওয়া, আবার কখনো পরোক্ষ বা হেজেমনিক যেমন, আর্ট গ্যালারিতে, পত্রিকায় বা সিনেমার জগতে কিছু বিশেষ দৃশ্য বা স্টাইলকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে অন্যগুলোকে খারিজ বা অজনপ্রিয় করা। 

ঔপনিবেশিকতা, পিতৃতন্ত্র, ধনতন্ত্র এগুলো ব্যক্তিক ও সামাজিক পর্যায়ে এক ধরনের মানসিকতা ও চর্চাও বটে। তাই এ দেশে কোনো রঙকে বিশেষণে চিহ্নিত করার পিছে এগুলোর কারণ থাকতেই পারে। কোন এলাকার ঘরবাড়ি, শোরুম, কাপড়ে কোন রঙ এগুলো খতিয়ে দেখবার সময়, কিংবা কোন রঙকে আমরা কেমন বলে চিনি, কার রঙ বলে চিনি এগুলো ভাবার সময় তাই এসবের পিছে কোন অন্তর্নিহিত সামাজিক বা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে তাও ভাবার অবকাশ আছে। 

মেন ইন ব্ল্যাক এবং শুধুই ব্ল্যাক

আপনি যদি মেয়ে হন, তাহলে খুব সম্ভব যে আপনি আপনার একাধিক ছেলে বন্ধু, সহপাঠী বা ভাইকে শীতকালে কোনো ভীড়ভাট্টার ভেতর একে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন, কারণ শতকরা ৯০ ভাগ সম্ভাবনা আছে যে তাদের বেশিরভাগই কালো পোশাক পরে আছে। আর কোন কনসার্ট বা কোন কলেজ ফেস্ট হলে তো কথাই নেই, দেখবেন আপনি ভাসছেন কালোর বন্যায়।  

কারণ আমাদের চর্চায় এখন কালো হলো ‘ক্লাসি’ এবং ‘পুরুষালি’।  কালো রঙ ‘স্মার্ট’, কোনো রঙের উপদ্রব নেই এখানে, নেই কোন উজ্জ্বলতার ঝামেলা। বরং, কালো রঙ যেন এখন সব রঙের উর্ধ্বে এক ছড়ি ঘোরানো এক এলিট রঙ।  

কিন্তু আমাদের এ অঞ্চলে কালো রঙের এহেন প্রসার ও ক্ষমতা কি শুরু থেকেই ছিলো? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সেই সময়’-এ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জামার রঙের বর্ণনা আছে, কিন্তু উকিল ব্যতীত কালো পরিহিত চরিত্র নেই বললেই চলে। ইতিহাসের পাতায় ভারতীয় পোশাক-আশাকে কালো খুবই অজনপ্রিয়। বর্তমানে কালোর প্রতি আগ্রহ, অন্য অনেক কিছুর মতোই পশ্চিম থেকে আমদানীকৃত। পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়ার কথা তো উপরেই বলা হলো, রঙবিমুখদের প্রিয় রঙ স্বভাবতই কালো।    

পশ্চিমে কালো রঙের ইতিহাসেও মিশে আছে ধর্ম, রাজনীতি ও বাণিজ্য। ইউরোপে প্রটেস্টেন্ট আন্দোলন আর ডাচ মার্কেন্টাইলিজমের প্রভাবে কালো ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ত্যাগের নিদর্শন। এভাবে চার্চের পাদ্রী বা ধর্মপিতাদের পোশাকের রঙ থেকে বাইবেলের কাভারের রঙ হয়ে ওঠে কালো, যেখানে ‘ছলনাময়’ ওরফে ‘আবেদনময়ী’ রঙের কোনো জায়গা নেই। পশ্চিমের আদালতের আইনজীবী ও বিচারক অর্থাৎ সমাজের আক্ষরিক নীতিনির্ধারকদের রোবের রঙ কালো। ফলে  মৌসুমী আবহাওয়ার গরমের দেশেও সেই কালো রোব পরে উকিলদের ঘামতে দেখা যায় প্রত্যহ। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যেই নব্য ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব হয়, সেই ‘ব্যাংকিং ক্লাস’ এর কোট ও জামায় ছিল ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলের ছাপ। সেই শ্যানেলের কালো সারা পৃথিবীর কাছে হয়ে উঠে আভিজাত্য, পরিশীলতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতীক। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই শাসনের রঙই যে পুরুষালি রঙ হয়ে উঠবে, তা নতুন কিছু নয়!   

রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি।

পৃথিবীজুড়ে এখন ‘বার্বেনহাইমার’ উন্মাদনা। এখানে বার্বির ‘মেয়েলি’ ব্র্যান্ড কালার গোলাপির বিপরীতে, ওপেনহাইমারের রঙ হিসেবে দ্বৈরথে দাঁড় করানো হয়েছে পুরুষালি কালো রঙকে। অথচ, ওপেনহাইমার কোন মাল্টিমিলিওন-ডলার খেলনার কোম্পানি নয় যার ব্র্যান্ড কালার থাকবে।  এমনকি এই সিনেমার প্রচারণার কোনো পোস্টারেও কালো রঙের তেমন ব্যবহার ছিলোনা। তাও সোশ্যাল মিডিয়া ও সিনেমা হলজুড়ে উৎসাহী দর্শকেরা কালোর সাথে ওপেনহাইমারকে সংযুক্ত করেছে, নিজেরা কাল জামা পরে এ ছবি দেখতে গিয়েছে। মেয়েলি গোলাপি বার্বির বিরুদ্ধে এ যেন এক কঠোর পুরুষালি জবাব!  

গোলাপি ‘মেয়েদের রঙ’ কী করে হল?

গোলাপি কি চিরকালই ‘মেয়েলি’ রঙ ছিল? সব মেয়েরই কি গোলাপি পছন্দ? দুটোর উত্তরই স্বাভাবিকভাবে, না। 

গোলাপিকে মার্কিন মুল্লুকে ১৮ শতকে প্রথম ‘লিঙ্গীয় রঙ’ হিসেবে নির্মাণের চেষ্টা করা হয় শিশুদের পোশাক ও খেলনার মাধ্যমে কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল ছেলে শিশুদের রঙ! ‘গোলাপি আগ্রাসী ও বিপ্লবী রঙ লালেরই একটি শেড তাই এটা পুরুষালি রঙ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল’ – বলেন প্যান্টন কালার ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লিয়াট্রিস আইজম্যান। কিন্তু শিশুপণ্য বিক্রেতারা এ দু রঙের মধ্যে কোনটা কোন লিঙ্গের তা নিয়ে একমত হতে পারেন না এবং শেষমেষ শিল্পী হেনরি হান্টিংটনের ‘দ্যা ব্লু বয়’ ও ‘পিংকি’ নামে দুটো পেইন্টিং (প্রথমটিতে নীল পোশাক পরা ছেলে শিশু এবং দ্বিতীয়টিতে গোলাপি পোশাক পরা মেয়ে শিশু আছে) অনেক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর মার্কেটে ছেলেদের নীল পোশাক এবং মেয়েদের গোলাপি পোশাকের যোগান ও কাটতি দুটোই বেড়ে যায়। এভাবেই গোলাপি মেয়েদের রঙ ও নীল ছেলেদের রঙ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আইজম্যান আরো জানান যে, এটি মুলত আরো বেশি শিশুপণ্যর বিক্রি নিশ্চিত করতে এক ধরনের মার্কেটিং তরিকা ছিল। বেশি বিক্রি হবে কেননা বড় ভাইয়ের পোশাক তবে ছোট বোন পরবে না এবং ভাইস ভার্সা। সব শিশুরই কিছু নতুন কালার কোডেড পোশাক ও খেলনা কেনার চল দেখা যাবে।  হয়েছিলও তাই। ১৯২০ নাগাদ মোটামুটিভাকে আমেরিকান সমাজে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পুরো পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক মহলেই গোলাপি এবং নীলের লিঙ্গ নির্ধারণ হয়ে যায়।  

এখন প্রায় একশো বছর পর নারীর রঙ হিসেবে পরিচিত গোলাপির বহু নির্মাণ-বিনির্মাণ ঘটেছে। গোলাপি বর্জন, তার পরবর্তী সমাদর (বার্বি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি দ্রষ্টব্য), আবার সেই সমাদরের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের সমালোচনা (বারবি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি পরবর্তী আলোচনা দ্রষ্টব্য) শেষে অন্তত এইটুকু বলা যায় যে, গোলাপির যেই সংযোগ লিঙ্গের সাথে করা হয় সেটাকে মাথা থেকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। এখন গোলাপি নারীর জন্য সচেতনতামূলক কার্যকলাপ যেমন জাতিসংঘের ব্রেস্ট ক্যান্সার আওয়্যারনেস ক্যাম্পেইনে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি নারীদের উপর করা বৈষম্যমূলক আচরণ যেমন ফেমিনিন পণ্য (স্যানিটারি প্যাড, মেন্সট্রুয়াল কাপ, ভ্যাজাইনাল ওয়াশ ইত্যাদি) ইত্যাদির উপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের বিরোধী আন্দোলনকারীরাও নারীর এই বিশেষ ট্যাক্সকে ‘পিংক ট্যাক্স’ নামে অভিহিত করেন। কিন্তু রঙের রাজনীতি কালো-গোলাপিতেই শেষ হয়ে যায় না।     

নীল পৃথিবীর বিরল নীল 

ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় যে, মানবজাতি হিসেবে নীল রঙের প্রতি এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ আছে আমাদের। সিএনএনের বিখ্যাত কালারস্কোপ সিরিজে তারা দাবি করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিহিত রঙ নীল। ব্লু জিন্স থেকে স্কুল ইউনিফরমের নেভী ব্লু প্যান্ট, বা এদেশীয় নীল চেক ডিজাইনের লুঙ্গি – পৃথিবীজুড়ে সবাই এ রংটাকে আপন করে নিয়েছে, হয়তো খুব বেশি না ভেবেই। নীলের প্রতি এই দুর্বলতার শুরুটা কখন?     

৩০ লক্ষ বছর আগে যখন মানুষ পা ফেললো এই রুক্ষ ধরায়, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো  দেখে বিস্তৃত নীলাভ ধূসর আকাশ। আবার অমাবস্যার অন্ধকার আকাশে সেখানে দেখা যায় নীলচে তারা আর ছায়াপথের আবছা ছবি, কিংবা সুবিশাল সমুদ্রের দিকে চেয়ে সে দেখে গাঢ় নীল জল।  কিন্তু এই নীলের পুরোটাই দৃষ্টিভ্রম, আলোর কারসাজি। পানি, আকাশ যে কোনোটার ক্যাঁচে বা ভেতরে গেলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিজ্ঞানও সেটাই বলে। এমনকি, নীলরঙা চোখের মণি নিয়ে যে এত মাতামাতি প্রকৃতপক্ষে সেটাও নীল না, বাদামী আইরিশের ছলচাতুরি – এর বিজ্ঞানটা গুগল করে দেখলে বেশ মজা পাবেন। 

যাহোক আপাতভাবে নীলের  প্রকৃতিতে নীলের প্রাচুর্য মনে হলেও একটু ভেবে দেখুন তো, কয়টা নীলরঙা ফল আর সবজি আপনি চেনেন? কিংবা গাঢ় নীল বা আকাশি রঙের কোন জন্তু? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, প্রকৃতির দুর্লভতম রঙ নীল। কোনো এক অদ্ভুত পরিহাসে, পৃথিবী নামক এই নীলচে গ্রহটা তার পরিবেশে লাল, হলুদ, সবুজ – সকল রকম রঞ্জকের মাঝে নীলকে হাপিস করে দিয়েছে প্রায়। সেটা প্রাণী আর উদ্ভিদ উভয়ক্ষেত্রেই। হিসেবে বলে, ৬৪ হাজার ভার্টিব্রেট, অর্থাৎ মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কেবল দুইটি প্রজাতির গায়ে নীল রঙ আছে। বাকি বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে সে রঙটা এক ইল্যুশনের মাধ্যমে তৈরী, দেহের কোন রঞ্জক থেকে নয়।    

আমরা মানুষের ইতিহাসের দিকে ফিরলে দেখি, অনেক প্রাচীন সভ্যতায় নীল রঙের জন্য কোন নাম ছিলোনা, অর্থাৎ সেইসব প্রাচীন মানুষের চোখে নীল ধরা দিত অন্য কোন রঙের হিসেবে, অথবা তার বাইরের কোন ধাঁধাঁ হিসেবে। এমনকি, হোমারের অমর পুরাণ ইলিয়াডে নীল রঙের কোনো উল্লেখ নেই। হয়তো সেকারণেই পরবর্তীতে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, সভ্যতায় দেখি এই নীল রঙকে ব্যবহার করা হয়েছে স্বর্গীয়, আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে।   

সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদজুড়ে মাইকেল্যাঞ্জেলোর সেই অমর সৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ডের রঙ আকাশি নীল, অর্থাৎ মাইকেল্যাঞ্জেলো স্বর্গকে একেছিলেন নীল রঙ দিয়ে। ইউরোপজুড়ে সুউচ্চ আর থমথমে যেসব গথিক ক্যাথেড্রাল আর চার্চ আমরা দেখি, সেখানে রঙিন ঘষা কাঁচের জানালা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বৃত্তাকার বা লম্বাটে এসব রঙিন কাচের জানালা দিয়ে আলো পড়ে ক্যাথেড্রালের ভেতরটাকে নানান রঙে জ্বেলে এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত তৈরী করতো, সেই রঙিন কাচ বা স্টেইন-গ্লাস উইন্ডোতেও আমরা নীল কাঁচের আধিক্য দেখি। এভাবে নীল হয়ে উঠলো দেবত্বের রঙ, এক অপার্থিবতার রঙ।  

নীল রঞ্জককে মানুষ প্রথম তৈরী করতে সক্ষম হয় হয় লাপিস লাজুলি নামক এক পাথর থেকে, যে পাথরের সবচেয়ে বৃহৎ খনি পাওয়া গিয়েছিলো বর্তমান আফগানিস্তানের এক অঞ্চলে। সেই লাপিস লাজুলির চূর্ণের সাথে মোম ও অন্যান্য দ্রব্যাদি মিশিয়ে তৈরী হয় এই নীলরঙা রঞ্জক, শোনা যায় সেযুগে স্বর্ণের চেয়েও দামী ছিলো এ পাথর। আর ভূমধ্যসাগর পারি দিয়ে ইউরোপ আসতে আসতে তাই নীল রঙের দাম হয়ে উঠে আকাশচুম্বি। এতোটাই বেশি, যে সেসময় কোনো পৃষ্ঠপোষক ( মূলত চার্চ ও পরবর্তীতে বনেদি বণিক পরিবারগণ)  যখন কো্নো শিল্পীকে ফরমায়েশ করতেন কোন ছবির জন্য, তখন সে ছবিতে নীল রঙ ব্যবহার করতে হলে তাকে অতিরিক্ত মূল্য চোকাতে হতো।  একারণে গ্রেকো-রোমান পিরিয়ডে ও রেঁনেসার সময় যেসব খৃষ্ট ধর্মীয় পেইন্টিং আমরা দেখতে পাই, সেগুলোতে নীল কেবল ব্যবহৃত হয়েছে ম্যাডোনা এবং যীশুর গায়ের জামায়। অর্থাৎ সবচেয়ে দামী রঙটা ছবির এবং ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত এবং ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া ব্যক্তির গায়েই থাকে। এভাবে, নীল রঙ  বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে জড়িয়ে গেল সম্মান ও ঐশ্বরিকতার সাথে।  

কেবল ঈশ্বরের পরেই যাদের স্থান, অর্থাৎ সমাজের উঁচুশ্রেনীর লোকেরা, সেটা রাজা থেকে বড় ব্যবসায়ী, ডিউক কিংবা ভূপতি পর্যন্ত; তাদের নিজের প্রতিকৃতিতে নীল ব্যবহার করে নীলকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজকীয় রঙ হিসেবে। আর যেখানেই রাজা ও রাজার পরাক্রম থাকে, সেখানেই থাকে বঞ্চিত লোকদের উপর অত্যাচার। সাদা চামড়ার বাবুদের এই অঞ্চলের নীল চাষের প্রতি লকলকে লোভ তার সবচেয়ে উদাহরণ। ১৭৭৭ থেকে প্রথমে একচেটিয়া ভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ও পরবর্তিতে কোম্পানির বাইরের অসংখ্য ব্রিটিশ বণিক নদীয়া, যশোর ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য নীলকুঠি স্থাপন করে কী ভীষণ অত্যাচার চালায় নীলচাষিদের ওপর, তা আমাদের অজানা নয়। 

রঙ হিসেবে নীলের ইতিহাস রক্তাক্ত হলেও, এখন নীলের আরও অনেক রূপ আমরা দেখি চারপাশে। আমাদের সবচেয়ে চেনা ভার্চুয়াল দুনিয়া হলো ফেসবুক, যার Azure Blue রঙে ডুবে ডুবেই হয়তো এই লেখার খোঁজ পেয়েছেন আপনি। ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ নিজে রেড-গ্রিন টাইপের বর্ণান্ধ হওয়ার কারণেই ফেসবুকের রঙ নীল রেখেছিলেন। বেশিরভাগ বর্ণান্ধ মানুষেরা নীল রঙটাই সবচেয়ে বেশি দেখতে পায়। কাজেই নীল রঙ এখন ডিজেবিলিটি-বান্ধব রঙও বটে। আর এ দেশে নীল প্রতিদিনকার রঙ, সেটা রিকশার হুড থেকে নীল ঢেউটিন, নীল অপরাজিতা থেকে লুঙ্গির ভাঁজ পর্যন্ত। অর্থাৎ নীলও অন্য সব রঙের মত তার ইতিহাস বা একরৈখিক পরিচয় বা নির্মাণেই আবদ্ধ নয়।

রঙের মনস্তত্ব ওরফে সমাজতত্ত্ব

শুধু লিঙ্গ, রাজনীতি বা শ্রেণীপরিচয় নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে লম্বা সময় ধরে রঙকে মানব অনুভূতি, বক্তব্য বা ভাবনার সাথেও সংযুক্ত করা হয়ে আসছে। 

সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কোনো পানির ট্যাপে এক দিকে নীল আর অন্য দিকে লাল থাকলে, সহজেই বুঝে নেওয়া যায় যে নীল দিকে ট্যাপ ঘুরালে ঠান্ডা আর লাল এর দিকে ট্যাপ ঘুরালে গরম পানি বের হবে ট্যাপ থেকে। এখানে আমরা রঙকে তাপমাত্রার সাথে যুক্ত করছি, খুব সহজেই। 

এ ধরনের বোধ অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক শিখন প্রক্রিয়ার ভেতর তৈরী হয়, অনেক সময় সামাজিক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়। আবার এই ধারণা ও অনুভূতিগুলো স্যাটেলাইট, ছাপাঅক্ষর ও মাইগ্রেশনের বদৌলতে আমদানি-রপ্তানিও হয় অপরাপর সমাজ, রাষ্ট্র, গোষ্ঠীতে।

যেমন, সবুজকে ধরা হয় প্রাচুর্যতা, সমৃদ্ধি, শান্তি ও প্রকৃতির রঙ হিসেবে। কেননা, অতীত এবং বর্তমানের বনবাসী মানুষের কাছে সবুজ অরণ্য খাদ্যের যোগানদার। ইংরেজি শব্দ Green এসেছে Grow শব্দটি থেকে। আবার, হলুদ রঙকে সমাজে দেখা হয় সতর্কতা হিসেবে, কারণ সব রঙের মধ্যে এর দৃশ্যমানতা সবচেয়ে বেশি। একারণে বিপদজনক  চিহ্ন, নিউক্লিয়ার চিহ্ন বা ট্যাক্সির রঙ হলুদ যাতে তা মানুষের চোখে সরাসরি আঘাত করতে পারে। লালকে দেখা হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয়, আবেদনময়, সবচেয়ে দুধর্ষ রঙ হিসেবে। আবার আমাদের শরীরের বহমান রক্তের রঙ লাল, তাই লালকে আমরা আমাদের আদিমতা বা পশুসত্ত্বার সাথেও যুক্ত করি। লাল রঙ এতই ব্যবহৃত যে পৃথিবীর শতকরা ৭৫% দেশের পতাকায় লাল আছে। অনেক জেলখানার দেয়ালে গোলাপি ব্যবহার করা হয় কারণ ধারণা করা হয় এই নরম রঙটি মানুষের মধ্যকার হিংস্রতা কমায় (যদিও পরবর্তীতে গবেষণায় এটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে)। এই একই গোলাপিকে আবার কোরিয়াতে দেখা হয় বিশ্বাস বা ভরসার রঙ হিসেবে।

তাহলে কোনো রঙকে দেখে এমন বিশেষ কিছু অনুভব করা বা করানোটা কি ভুল? কোনো রঙ কি আমরা শুধু পছন্দের খাতিরে পছন্দ করতে পারবোনা? কালো হুডিটা ফেলে আজই নিয়ন সবুজ হুডি অথবা যাত্রাবিরতির পটচিত্র ঘরানার রঙিন জামা কিনে আনতে হবে? নীল রঙ দিয়ে ছবি আঁকার আগে প্রতিবার বাধ্যতামূলক ক্ষমা চাইতে হবে নীলচাষীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে? 

উত্তরটা হলো না, আমাদের সকলের পছন্দ-অপছন্দের রঙ থাকবেই। বিভিন্ন রঙকে নানান জিনিস, আইডিয়া, বোধের সাথে যুক্ত করার চর্চা থাকবেই। কিন্তু সেটার পাশাপাশি আমরা এটাও মাথায় রাখতে পারি যে আমরা বিভিন্ন রঙ দেখে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখি নিজেদের ভেতর, তা অনেকাংশেই সাংস্কৃতিক বা সামাজিক নির্মাণ। অর্থাৎ, একটা সংস্কৃতিতে লম্বাসময় কোনো চর্চার মাধ্যমে কিছু ভাবনা, কিছু সম্পর্ক আমরা নির্মাণ করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নববর্ষের রঙ হিসেবে লাল-সাদাকে বিশেষায়িত করা। বিভিন্ন কারণে নববর্ষের সময় লাল ও সাদার ব্যবহার হয়ে আসছে একটা সময় ধরে, তাই লাল-সাদা একত্রে দেখলে আমরা তাকে নতুন বছর/বাঙালিয়ানার সাথে তাকে সংযুক্ত করি। 

এই পুরো লেখার উদ্দেশ্য কোনো রঙকে ভালো বা খারাপ বলা নয়, যারা বলে তাদের ধরে পানিতে ফেলে দেওয়াও নয়। বরং এই দিকে রঙের দুনিয়া যে কত জটিল এবং এর ব্যবহারের রাজনীতি যে কত গভীর ও ডাইনামিক সেদিকে আলোকপাত করাই ছিল এ লেখার লক্ষ্য। রঙের ব্যবহারের হায়ারার্কি বিরোধী আন্দোলন যেমন হিপি মুভমেন্টের বাটিকের “ট্রিপি” রঙকে আপন করে নেওয়া থেকে শুরু করে এ দেশে রিকশা পেইন্টিং এর রঙের (বা বলা চলে সে রঙে রাঙ্গানো উঁচু দামের পণ্য) নতুন সমাদর, এসব কিছুই আলোচনা-সমালোচনা ও জটিলতার ঊর্ধ্বে না। মোটকথায়, রঙ বিষয়ে যা-ই আমাদের চোখে ধরা পড়ে সব সময়ই ভেবে দেখা উচিত, লাল না হয়ে নীল হলো কেন। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।