আপনি ‘পভার্টি ফটোগ্রাফ’ লিখে গুগলে সার্চ করলে দেখবেন, ৯০% ছবিই সাদাকালো। ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো দারিদ্র্যের ‘অ্যাস্থেটিক ফোটোগ্রাফিরও বেশির ভাগ রঙহীন। এর কারণ ভেবে দেখেছেন কী?  

গরিব কি আসলেই বেরঙিন? 

আমাদের সমাজের কম আয় সম্পন্ন মানুষের দিকে তাকালে আমরা হয়তো চিত্রটা ঠিক তেমন দেখবো না। সকালে ক্লাসে বা কাজে বেরুলে গার্মেন্টসে কর্মরত মানুষদের যে ঢল আমরা দেখি তাদের বেশিরভাগের পরনেই থাকে উষ্ণ রঙের বড় বড় প্যাটার্নের পোশাক সাথে রঙিন ফিতার চপ্পল। রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি। রঙের বহুল ব্যবহার বা ‘বাহুল্য’কে সমাজে বরং দেখা হয় প্রায়শই ‘ক্ষ্যাত বা ছোটলোকি’ সংস্কৃতি হিসেবে (এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা আছে লেখার পরবর্তী অংশে)।  

তাহলে দরিদ্র মানুষের ছবি থেকে রঙ তুলে নিয়ে আসলে কী সিম্বোলাইজ করে?

ফোটোগ্রাফার মাইক লাশমোর তার ‘পোভার্টি ইজ নট সো ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট’ লেখায় মনে করেছেন যে, এ ধরণের দু’রঙা ছবির একটা উদ্দেশ্য থাকে গরিব মানুষের প্রতি কিছুটা জোর করেই সিম্প্যাথির সৃষ্টি করা, তাদের করুণ অবস্থাকে আরো করুণতর, রঙহীন করে।   

লাশমোরের মত আমারও একটা হাইপোথিসিস আছে। আমরা মনে করি দরিদ্র মানুষ অতীতে বসবাস করে, ঠিক বর্তমান বা আধুনিকের অপর পাশে। থ্রি ইডিয়টস ছবিতে রাজু রাস্তোগি চরিত্রের নিম্ন আয়ের বাড়িতে গেলেই সব সাদাকালো হয়ে যায়, এমনকি স্ক্রিনের উপর পুরোনো দিনের ছবির ঝিরিঝিরি দাগও দেখা যায়। এই দৃশ্যটি বলিউডের ৭০-৮০ দশকের “জীবনঘনিষ্ঠ” ওরফে রিয়েলিস্ট সিনেমার গল্পের ধরণ ও বলার ঢংয়ের স্যাটায়ার। এই ধরনের গল্প বলার টুল বেছে নেওয়ার কারণ মানুষ দুর্দশা দেখলে সে যুগের সেই সাদাকালো ছবির কথাই ভাবে। মানুষগুলোও ছবি মুক্তি পাওয়ার সেই সময়ে আটকা।  

কেননা আমরা যাপনে নানা প্রযুক্তির অভাবকে ও কিছু নির্দিষ্ট ধ্যান-ধারণাকে অতীতের বিষয় হিসেবেই দেখি। এর নানা বিশেষণও আছে আমাদের ঝুলিতে। যেমন, ওল্ড ফ্যাশনড, ব্যাকওয়ার্ড, প্রিমিটিভ, ব্যাকডেটেড, আদিম, অসভ্য ইত্যাদি। এক কথায় বললে, অমুকটা না থাকলে ‘আধুনিক’ হয়নি, তমুকটা বললে অতীতেই আছে। যে অতীতে আছে তার ছবিও সেই অতীতের সাদাকালো, সেপিয়া এফেক্ট দেওয়া হবে তাই তো স্বাভাবিক।  

রঙ বা তার অভাব নিয়ে যারা ভিজুয়াল তৈরি করে আর যারা তার গ্রাহক আমরা উভয়ই  এক ধরনের পারসেপশন আর স্টেরিওটাইপের রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছি, পার্থক্য এটাই যে কেউ জেনে নিচ্ছি আর কেউ না জেনে। 

‘ক্ষ্যাত’ রঙ বা গর্জিয়াসের মধ্যে গর্জিয়াস বৃত্তান্ত  

কটকটা-ক্যাটক্যাটা, ক্ষ্যাত, লাউড, তীব্র, চোখে লাগা, দুবাইওয়ালা, বস্তি, ছাপড়ি ইত্যাদি বিশেষণে আমরা কিছু রঙকে বা রঙের শেডকে বিশেষায়িত করি। আবার আনুশকা শর্মার বিয়ের প্যাস্টেল রঙগুলোকে ‘ক্লাসি’-ও বলি সবাই তৎক্ষনাৎ। শুরুতে যে নাক কুঁচকানো রঙগুলোর কথা বলা হলো সেগুলোও অবশ্য ভিনদেশী পপ আইকনেরা (নিকি মিনাজ, কারডি বি, হ্যারি স্টাইল অ্যান্ড কোঃ) পরলে ‘নিয়ন’ নামে সমাদর পায়।  

এই যে কোনো রঙকে অচ্ছুৎ ঘোষণা বা কোনো রঙকে ‘জাতে’-র ভাবা এটা আসলে কারা কীভাবে ঠিক করে? এটা করায় কী সুবিধা হয়?

চ্যাপা শুটকি, গরুর বট, জর্দা দেওয়া পানের মত কিছু খাবার আমাদের সমাজে গরিবের খাবার হিসেবে পরিচিত। কখনো দোষ দেওয়া হয় এসব খাবারের ‘উৎকট’ গন্ধকে কিন্তু মূলত এই খাবারগুলোর কম মূল্য খাবারগুলোর  গরিবের খাবারের মর্যাদা এনে দেয়। এক সময় ছোট মাছকেও গরিবের খাবার হিসেবে দেখা হত এবং ঢাউস সাইজের রুই-কাতলা ছিল স্বচ্ছলতার চিহ্ন। ছোট মাছের দাম বাড়ার পর এবং যোগান কমার পর এখন তা আবার বড়লোকের খাবার। এমন এটা গরিবের, ওটা বড়লোকের হিসেবে কিছু জিনিসকে শ্রেণীভুক্ত করা আসলে কেন প্রয়োজন? 

নিজেকে ঐ শ্রেণীভুক্ত খাবার খাওয়া বা কাপড় পরা মানুষগুলো থেকে আলাদা করতে। নৃবিজ্ঞান বা সমাজতত্ত্বে একটা প্রক্রিয়ার নাম প্রায়ই শোনা যায়ঃ আদারিং  বা অপরায়ন। এটা হলো কাউকে ‘অপর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ আমি সে বা তার দলভুক্ত নই। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে এই আদারিং সবসময় নিজের চেয়ে কম ক্ষমতা বা বিত্তশালী গোষ্ঠীকে করা হয়। নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান অংশকে বরং অনুকরণ করা হয়, তার সাথে একই শ্রেণীভুক্ত হওয়া হয় গর্বের বিষয়।  

উপনিবেশকতার সময়ে যেমন যা কিছু উপনিবেশিত রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীগুলো খেতো, পরতো, করতো তা ছিল ছোটলোকের কাজ এবং তারা ছিল ‘আদার’ পশ্চিমাদের কাছে। পিতৃতন্ত্রে নারীর যেকোনো কাজ বা পছন্দ ‘মেয়েলি’ যা পুরুষ করলে তার ‘জাত’ নিচে নামবে কারণ নারী পুরুষের আদার। রঙের ক্ষেত্রেও এমন আদার-এর রঙ আছে, বিত্তশালীর রঙ আছে। কোনো রঙ ক্ষ্যাত বলেই তো অন্য রঙটা এলিট হতে পারে।     

লেখার শুরুর অংশে বলা হয়েছে যে আমাদের চলাফেরায় নিম্ন আয়ের মানুষের কাপড়ে আমরা বহু রঙ ও প্যাটার্ন দেখি – এগুলোই সমাজে ক্ষ্যাত বা কটকটা বলে পরিচিত। সকল নিম্ন আয়ের মানুষই যে এসব রঙের পোশাকই পরে তাও নয়, হয়তো আমাদের চোখে শুধু রঙিন কাপড়গুলোই পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। আর এই ধরনের পোশাক যদি সেই গোষ্ঠীর বেছে নেয় তবে তারও নানা কারণ থাকতে পারে।  হতে পারে যে এ ধরনের রঙের কাপড় ময়লা হলে কম দেখা যায় যেহেতু কায়িক শ্রমের চাকরিতে এবং পাবলিক পরিবহনে কাপড় ময়লা হওয়াটাই স্বাভাবিক, এগুলো ছিড়ে গেলে সেলাই বা ‘রিপু’ করলেও আলাদা করে চোখে পড়ে না আর ফিকে হলেও কাপড়ের বয়স বোঝা যাওয়া দুষ্কর। এই লেখাটা লেখার সময় আমরা সাতদিন সাদা প্যান্ট, সাদা জুতা পরে চলাফেরা করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাদের একজনের বাসা মোহাম্মদপুরে, আরেকজনের ভূতের গলিতে এবং দু’জন ঢাকার দুটো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। মোটামুটি ডে থ্রিতেই আমাদের জুতো, জামা আর পরার মত ছিল না আমাদের পারিপার্শ্বিকের দরুন। ঢাকার দু-তিনটি ‘গেটেড’ পাড়া ছাড়া সব অঞ্চলেই এমন অবস্থাই হওয়ার কথা। সেসব অঞ্চলের কাপড়ের আর ঘরের ইন্টেরিয়রের ধরন ও রঙও যে সমাজে ‘মার্জিত’ বা ‘রুচিশীল’ হিসেবে পরিচিত এ নিয়েও খুব আশ্চর্য হবার কিছু নেই। 

রুচির পাহারাদার মধ্য ও উচ্চবিত্তের মধ্যে কোনো ‘দুর্ভিক্ষ’ দেখতে চান না বলেই আমরা জানি। তাদের আরোপিত রঙের মাত্রাজ্ঞানকে তাই আরেকটু খতিয়ে দেখা চাই।   

পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়া বা রঙ বিমুখতা

২০০০ সালে শিল্পী ডেভিড ব্যাচেলরের ক্রোমোফোবিয়া নামে একটা বই প্রকাশিত হয় রিকশন প্রকাশনী থেকে। ক্রোমোফোবিয়া বলতে তিনি বুঝান রঙের প্রতি ভয় বা বিমুখতাকে এবং তিনি এটাকে পশ্চিমা শিল্প ও সংস্কৃতির একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে হাজির করেন। তিনি একের পর এক উদাহরণ হাজির করেন যেখানে পশ্চিমের এ ফোবিয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় দৃশ্যশিল্পে।   

যেমন, ১৯৩৯ সালের উইজার্ড অফ অজ ছবিতে একজন কিশোরী একটি ‘স্বাভাবিক’ রঙহীন জগতে বসবাস করে। এক পর্যায়ে সে একটি গর্ত বা পোর্টাল দিয়ে একটি ‘অদ্ভুত’ রঙিন জগতের দেখা পায়। এক সময় আমরা জানতে পারি এর পুরোটাই ছিল একটি স্বপ্ন বা ‘ফিভার ড্রিম’। এই ছবিতে রঙিন দুনিয়া ‘মোহ’ বা অসত্য জগতের হাতছানি দেয়, সেটা আকর্ষণীয় হলেও সত্য বা আদর্শ নয়।  ৭০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে অক্টোবর আর্ট ম্যাগাজিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় আর্ট ম্যাগাজিন। অথচ এ ম্যাগাজিনের পুরোটাই সাদাকালো! কিন্তু এই ম্যাগাজিনেই পাওয়া যেত ‘উচ্চমার্গীয়’ আর্ট ও রুচির খোঁজ। বলে রাখা ভালো যে এই ম্যাগাজিন বাংলাদেশের বহু শিল্প প্রকাশনার ন্যায় অর্থের অভাবে রঙহীন ছিল না। 

ব্যাচেলর এই উদাহরণগুলোর পাশাপাশি ইতিহাসের দিকেও দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখান যে, চিরকাল উপনিবেশিত দেশগুলো ছিল রঙের পিগমেন্টের খোরাকের দিক দিয়ে পশ্চিমের উপনিবেশক দেশগুলোর তুলনায় অনেক সমৃদ্ধ। রঙের পিগমেন্ট অর্থাৎ যা দিয়ে কোনো রঙ পুনুরুৎপাদন করা যায় আর যে কোনো রঙিন উদ্ভিদ বা খনিজ এক নয়। যেমন, নর্থ আমেরিকার বিখ্যাত সুগার মেপল গাছের ফল ঋতুর লাল-কমলা পাতা থেকে লাল-কমলা রঙের পিগমেন্ট পুনরায় কিছুকে সে রঙে রাঙানোর জন্য ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় মেহেদি পাতা থেকে খয়েরি-কমলা রঙের পিগমেন্ট তৈরি করা সম্ভব। নীলের পিগমেন্টের অন্যতম উৎস ইন্ডিগো গাছ পাওয়া যায় আফ্রিকা ও এশিয়াতে, লাল পিগমেন্টের গাছ ম্যাডারের ক্ষেত্রেও উৎপত্তিস্থল ভারত আর এশিয়ার অন্য কিছু অংশ। হলুদ, স্যাফ্লাওয়ার, কলানাট, কাচ ইত্যাদি অনেক উদাহরণ এখানে যোগ করা যায়। 

পশ্চিমে পিগমেন্টের অপ্রতুলতা উপনিবেশিকতার দশকগুলোতে তাদের দুটি জিনিসের দিকে ধাবিত করে।
এক. রঙ ও রঙিন সবকিছুকে বন্য, মেয়েলি, মোহময়, কুরুচিপূর্ণ (সভ্য, পুরুষালি, সত্য, রুচিশীলের ঠিক বিপরীত অর্থাৎ পশ্চিমা এনলাইটেনমেন্ট চিন্তাধারার ঠিক উল্টোটা) বলে আখ্যা দেওয়ার মাধ্যমে আদারিং করা।
দুই. প্রচুর পিগমেন্ট উপনিবেশিত দেশগুলো থেকে নিয়ে আসা (উপনিবেশিত ভারতের নীলচাষ ও বিদ্রোহের ইতিহাস এই ক্ষেত্রে একটি উপযুক্ত উদাহরণ)।    

দ্বিতীয়টা ঘটলে প্রথমটা কেন বিরাজমান থাকবে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শাসকেরা আমাদের অঞ্চল থেকে অনেক মসলাও নিয়েছিলো কিন্তু তারপরও ভারতীয়-চীনদেশীয় মশলার ‘স্বাদ-গন্ধ’ নিয়ে ও দেশে এই দশকেও পড়তে যাওয়া এশীয় ছাত্ররা কম বুলি হয় না, আগের কথা আর না-ই লিখলাম। আসলে ঐতিহাসিক ঘটনা বা শাসন একরৈখিক ফলাফল বয়ে আনে না, রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বহুরৈখিক চিন্তার ঘরানা ও বৈষম্য আছে। বৈষম্য পদ্ধতিগতভাবে শেখানো হয় যে গ্রুপের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে তাদেরও। এভাবে সৃষ্টি হয় নিজ জাতি ও সংস্কৃতির নানা কিছুর প্রতি বৈষম্যমূলক মানসিকতা। বৈষম্যের শিক্ষা পদ্ধতি কখনো প্রত্যক্ষ যেমন কোনো কিছু নিষিদ্ধ করে দেওয়া, আবার কখনো পরোক্ষ বা হেজেমনিক যেমন, আর্ট গ্যালারিতে, পত্রিকায় বা সিনেমার জগতে কিছু বিশেষ দৃশ্য বা স্টাইলকে প্রাধান্য দেওয়ার মাধ্যমে অন্যগুলোকে খারিজ বা অজনপ্রিয় করা। 

ঔপনিবেশিকতা, পিতৃতন্ত্র, ধনতন্ত্র এগুলো ব্যক্তিক ও সামাজিক পর্যায়ে এক ধরনের মানসিকতা ও চর্চাও বটে। তাই এ দেশে কোনো রঙকে বিশেষণে চিহ্নিত করার পিছে এগুলোর কারণ থাকতেই পারে। কোন এলাকার ঘরবাড়ি, শোরুম, কাপড়ে কোন রঙ এগুলো খতিয়ে দেখবার সময়, কিংবা কোন রঙকে আমরা কেমন বলে চিনি, কার রঙ বলে চিনি এগুলো ভাবার সময় তাই এসবের পিছে কোন অন্তর্নিহিত সামাজিক বা ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে তাও ভাবার অবকাশ আছে। 

মেন ইন ব্ল্যাক এবং শুধুই ব্ল্যাক

আপনি যদি মেয়ে হন, তাহলে খুব সম্ভব যে আপনি আপনার একাধিক ছেলে বন্ধু, সহপাঠী বা ভাইকে শীতকালে কোনো ভীড়ভাট্টার ভেতর একে অন্যের সাথে গুলিয়ে ফেলতে পারেন, কারণ শতকরা ৯০ ভাগ সম্ভাবনা আছে যে তাদের বেশিরভাগই কালো পোশাক পরে আছে। আর কোন কনসার্ট বা কোন কলেজ ফেস্ট হলে তো কথাই নেই, দেখবেন আপনি ভাসছেন কালোর বন্যায়।  

কারণ আমাদের চর্চায় এখন কালো হলো ‘ক্লাসি’ এবং ‘পুরুষালি’।  কালো রঙ ‘স্মার্ট’, কোনো রঙের উপদ্রব নেই এখানে, নেই কোন উজ্জ্বলতার ঝামেলা। বরং, কালো রঙ যেন এখন সব রঙের উর্ধ্বে এক ছড়ি ঘোরানো এক এলিট রঙ।  

কিন্তু আমাদের এ অঞ্চলে কালো রঙের এহেন প্রসার ও ক্ষমতা কি শুরু থেকেই ছিলো? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘সেই সময়’-এ অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের জামার রঙের বর্ণনা আছে, কিন্তু উকিল ব্যতীত কালো পরিহিত চরিত্র নেই বললেই চলে। ইতিহাসের পাতায় ভারতীয় পোশাক-আশাকে কালো খুবই অজনপ্রিয়। বর্তমানে কালোর প্রতি আগ্রহ, অন্য অনেক কিছুর মতোই পশ্চিম থেকে আমদানীকৃত। পশ্চিমের ক্রোমোফোবিয়ার কথা তো উপরেই বলা হলো, রঙবিমুখদের প্রিয় রঙ স্বভাবতই কালো।    

পশ্চিমে কালো রঙের ইতিহাসেও মিশে আছে ধর্ম, রাজনীতি ও বাণিজ্য। ইউরোপে প্রটেস্টেন্ট আন্দোলন আর ডাচ মার্কেন্টাইলিজমের প্রভাবে কালো ছিল আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ত্যাগের নিদর্শন। এভাবে চার্চের পাদ্রী বা ধর্মপিতাদের পোশাকের রঙ থেকে বাইবেলের কাভারের রঙ হয়ে ওঠে কালো, যেখানে ‘ছলনাময়’ ওরফে ‘আবেদনময়ী’ রঙের কোনো জায়গা নেই। পশ্চিমের আদালতের আইনজীবী ও বিচারক অর্থাৎ সমাজের আক্ষরিক নীতিনির্ধারকদের রোবের রঙ কালো। ফলে  মৌসুমী আবহাওয়ার গরমের দেশেও সেই কালো রোব পরে উকিলদের ঘামতে দেখা যায় প্রত্যহ। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যেই নব্য ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব হয়, সেই ‘ব্যাংকিং ক্লাস’ এর কোট ও জামায় ছিল ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেলের ছাপ। সেই শ্যানেলের কালো সারা পৃথিবীর কাছে হয়ে উঠে আভিজাত্য, পরিশীলতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতীক। আর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এই শাসনের রঙই যে পুরুষালি রঙ হয়ে উঠবে, তা নতুন কিছু নয়!   

রিকশাচালকদের শার্ট হয় রঙ, প্যাটার্ন ও লেখা সর্বস্ব। টং দোকানিরাও ‘ধূসর’ নন। শহরে ‘বস্তি’ হিসেবে পরিচিত আবাসনগুলোর ইন্টেরিয়রেও থাকে রঙিন চাদর, পর্দা, টেবিলক্লথের ছড়াছড়ি।

পৃথিবীজুড়ে এখন ‘বার্বেনহাইমার’ উন্মাদনা। এখানে বার্বির ‘মেয়েলি’ ব্র্যান্ড কালার গোলাপির বিপরীতে, ওপেনহাইমারের রঙ হিসেবে দ্বৈরথে দাঁড় করানো হয়েছে পুরুষালি কালো রঙকে। অথচ, ওপেনহাইমার কোন মাল্টিমিলিওন-ডলার খেলনার কোম্পানি নয় যার ব্র্যান্ড কালার থাকবে।  এমনকি এই সিনেমার প্রচারণার কোনো পোস্টারেও কালো রঙের তেমন ব্যবহার ছিলোনা। তাও সোশ্যাল মিডিয়া ও সিনেমা হলজুড়ে উৎসাহী দর্শকেরা কালোর সাথে ওপেনহাইমারকে সংযুক্ত করেছে, নিজেরা কাল জামা পরে এ ছবি দেখতে গিয়েছে। মেয়েলি গোলাপি বার্বির বিরুদ্ধে এ যেন এক কঠোর পুরুষালি জবাব!  

গোলাপি ‘মেয়েদের রঙ’ কী করে হল?

গোলাপি কি চিরকালই ‘মেয়েলি’ রঙ ছিল? সব মেয়েরই কি গোলাপি পছন্দ? দুটোর উত্তরই স্বাভাবিকভাবে, না। 

গোলাপিকে মার্কিন মুল্লুকে ১৮ শতকে প্রথম ‘লিঙ্গীয় রঙ’ হিসেবে নির্মাণের চেষ্টা করা হয় শিশুদের পোশাক ও খেলনার মাধ্যমে কিন্তু এটা হওয়ার কথা ছিল ছেলে শিশুদের রঙ! ‘গোলাপি আগ্রাসী ও বিপ্লবী রঙ লালেরই একটি শেড তাই এটা পুরুষালি রঙ হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল’ – বলেন প্যান্টন কালার ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক লিয়াট্রিস আইজম্যান। কিন্তু শিশুপণ্য বিক্রেতারা এ দু রঙের মধ্যে কোনটা কোন লিঙ্গের তা নিয়ে একমত হতে পারেন না এবং শেষমেষ শিল্পী হেনরি হান্টিংটনের ‘দ্যা ব্লু বয়’ ও ‘পিংকি’ নামে দুটো পেইন্টিং (প্রথমটিতে নীল পোশাক পরা ছেলে শিশু এবং দ্বিতীয়টিতে গোলাপি পোশাক পরা মেয়ে শিশু আছে) অনেক জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর মার্কেটে ছেলেদের নীল পোশাক এবং মেয়েদের গোলাপি পোশাকের যোগান ও কাটতি দুটোই বেড়ে যায়। এভাবেই গোলাপি মেয়েদের রঙ ও নীল ছেলেদের রঙ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। 

আইজম্যান আরো জানান যে, এটি মুলত আরো বেশি শিশুপণ্যর বিক্রি নিশ্চিত করতে এক ধরনের মার্কেটিং তরিকা ছিল। বেশি বিক্রি হবে কেননা বড় ভাইয়ের পোশাক তবে ছোট বোন পরবে না এবং ভাইস ভার্সা। সব শিশুরই কিছু নতুন কালার কোডেড পোশাক ও খেলনা কেনার চল দেখা যাবে।  হয়েছিলও তাই। ১৯২০ নাগাদ মোটামুটিভাকে আমেরিকান সমাজে এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পুরো পুঁজিবাদী আন্তর্জাতিক মহলেই গোলাপি এবং নীলের লিঙ্গ নির্ধারণ হয়ে যায়।  

এখন প্রায় একশো বছর পর নারীর রঙ হিসেবে পরিচিত গোলাপির বহু নির্মাণ-বিনির্মাণ ঘটেছে। গোলাপি বর্জন, তার পরবর্তী সমাদর (বার্বি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি দ্রষ্টব্য), আবার সেই সমাদরের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যের সমালোচনা (বারবি ফ্র্যাঞ্চাইজ ও মুভি পরবর্তী আলোচনা দ্রষ্টব্য) শেষে অন্তত এইটুকু বলা যায় যে, গোলাপির যেই সংযোগ লিঙ্গের সাথে করা হয় সেটাকে মাথা থেকে মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব। এখন গোলাপি নারীর জন্য সচেতনতামূলক কার্যকলাপ যেমন জাতিসংঘের ব্রেস্ট ক্যান্সার আওয়্যারনেস ক্যাম্পেইনে যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি নারীদের উপর করা বৈষম্যমূলক আচরণ যেমন ফেমিনিন পণ্য (স্যানিটারি প্যাড, মেন্সট্রুয়াল কাপ, ভ্যাজাইনাল ওয়াশ ইত্যাদি) ইত্যাদির উপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের বিরোধী আন্দোলনকারীরাও নারীর এই বিশেষ ট্যাক্সকে ‘পিংক ট্যাক্স’ নামে অভিহিত করেন। কিন্তু রঙের রাজনীতি কালো-গোলাপিতেই শেষ হয়ে যায় না।     

নীল পৃথিবীর বিরল নীল 

ইতিহাসের দিকে তাকালে মনে হয় যে, মানবজাতি হিসেবে নীল রঙের প্রতি এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ আছে আমাদের। সিএনএনের বিখ্যাত কালারস্কোপ সিরিজে তারা দাবি করে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিহিত রঙ নীল। ব্লু জিন্স থেকে স্কুল ইউনিফরমের নেভী ব্লু প্যান্ট, বা এদেশীয় নীল চেক ডিজাইনের লুঙ্গি – পৃথিবীজুড়ে সবাই এ রংটাকে আপন করে নিয়েছে, হয়তো খুব বেশি না ভেবেই। নীলের প্রতি এই দুর্বলতার শুরুটা কখন?     

৩০ লক্ষ বছর আগে যখন মানুষ পা ফেললো এই রুক্ষ ধরায়, মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো  দেখে বিস্তৃত নীলাভ ধূসর আকাশ। আবার অমাবস্যার অন্ধকার আকাশে সেখানে দেখা যায় নীলচে তারা আর ছায়াপথের আবছা ছবি, কিংবা সুবিশাল সমুদ্রের দিকে চেয়ে সে দেখে গাঢ় নীল জল।  কিন্তু এই নীলের পুরোটাই দৃষ্টিভ্রম, আলোর কারসাজি। পানি, আকাশ যে কোনোটার ক্যাঁচে বা ভেতরে গেলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিজ্ঞানও সেটাই বলে। এমনকি, নীলরঙা চোখের মণি নিয়ে যে এত মাতামাতি প্রকৃতপক্ষে সেটাও নীল না, বাদামী আইরিশের ছলচাতুরি – এর বিজ্ঞানটা গুগল করে দেখলে বেশ মজা পাবেন। 

যাহোক আপাতভাবে নীলের  প্রকৃতিতে নীলের প্রাচুর্য মনে হলেও একটু ভেবে দেখুন তো, কয়টা নীলরঙা ফল আর সবজি আপনি চেনেন? কিংবা গাঢ় নীল বা আকাশি রঙের কোন জন্তু? আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, প্রকৃতির দুর্লভতম রঙ নীল। কোনো এক অদ্ভুত পরিহাসে, পৃথিবী নামক এই নীলচে গ্রহটা তার পরিবেশে লাল, হলুদ, সবুজ – সকল রকম রঞ্জকের মাঝে নীলকে হাপিস করে দিয়েছে প্রায়। সেটা প্রাণী আর উদ্ভিদ উভয়ক্ষেত্রেই। হিসেবে বলে, ৬৪ হাজার ভার্টিব্রেট, অর্থাৎ মেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে কেবল দুইটি প্রজাতির গায়ে নীল রঙ আছে। বাকি বেশিরভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে সে রঙটা এক ইল্যুশনের মাধ্যমে তৈরী, দেহের কোন রঞ্জক থেকে নয়।    

আমরা মানুষের ইতিহাসের দিকে ফিরলে দেখি, অনেক প্রাচীন সভ্যতায় নীল রঙের জন্য কোন নাম ছিলোনা, অর্থাৎ সেইসব প্রাচীন মানুষের চোখে নীল ধরা দিত অন্য কোন রঙের হিসেবে, অথবা তার বাইরের কোন ধাঁধাঁ হিসেবে। এমনকি, হোমারের অমর পুরাণ ইলিয়াডে নীল রঙের কোনো উল্লেখ নেই। হয়তো সেকারণেই পরবর্তীতে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, সভ্যতায় দেখি এই নীল রঙকে ব্যবহার করা হয়েছে স্বর্গীয়, আধ্যাত্মিকতার যোগসাজশে।   

সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদজুড়ে মাইকেল্যাঞ্জেলোর সেই অমর সৃষ্টির ব্যাকগ্রাউন্ডের রঙ আকাশি নীল, অর্থাৎ মাইকেল্যাঞ্জেলো স্বর্গকে একেছিলেন নীল রঙ দিয়ে। ইউরোপজুড়ে সুউচ্চ আর থমথমে যেসব গথিক ক্যাথেড্রাল আর চার্চ আমরা দেখি, সেখানে রঙিন ঘষা কাঁচের জানালা একটা অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। বৃত্তাকার বা লম্বাটে এসব রঙিন কাচের জানালা দিয়ে আলো পড়ে ক্যাথেড্রালের ভেতরটাকে নানান রঙে জ্বেলে এক ঐশ্বরিক মুহূর্ত তৈরী করতো, সেই রঙিন কাচ বা স্টেইন-গ্লাস উইন্ডোতেও আমরা নীল কাঁচের আধিক্য দেখি। এভাবে নীল হয়ে উঠলো দেবত্বের রঙ, এক অপার্থিবতার রঙ।  

নীল রঞ্জককে মানুষ প্রথম তৈরী করতে সক্ষম হয় হয় লাপিস লাজুলি নামক এক পাথর থেকে, যে পাথরের সবচেয়ে বৃহৎ খনি পাওয়া গিয়েছিলো বর্তমান আফগানিস্তানের এক অঞ্চলে। সেই লাপিস লাজুলির চূর্ণের সাথে মোম ও অন্যান্য দ্রব্যাদি মিশিয়ে তৈরী হয় এই নীলরঙা রঞ্জক, শোনা যায় সেযুগে স্বর্ণের চেয়েও দামী ছিলো এ পাথর। আর ভূমধ্যসাগর পারি দিয়ে ইউরোপ আসতে আসতে তাই নীল রঙের দাম হয়ে উঠে আকাশচুম্বি। এতোটাই বেশি, যে সেসময় কোনো পৃষ্ঠপোষক ( মূলত চার্চ ও পরবর্তীতে বনেদি বণিক পরিবারগণ)  যখন কো্নো শিল্পীকে ফরমায়েশ করতেন কোন ছবির জন্য, তখন সে ছবিতে নীল রঙ ব্যবহার করতে হলে তাকে অতিরিক্ত মূল্য চোকাতে হতো।  একারণে গ্রেকো-রোমান পিরিয়ডে ও রেঁনেসার সময় যেসব খৃষ্ট ধর্মীয় পেইন্টিং আমরা দেখতে পাই, সেগুলোতে নীল কেবল ব্যবহৃত হয়েছে ম্যাডোনা এবং যীশুর গায়ের জামায়। অর্থাৎ সবচেয়ে দামী রঙটা ছবির এবং ধর্মের সবচেয়ে সম্মানিত এবং ঈশ্বরের নৈকট্য পাওয়া ব্যক্তির গায়েই থাকে। এভাবে, নীল রঙ  বিশ্বশিল্পের ইতিহাসে জড়িয়ে গেল সম্মান ও ঐশ্বরিকতার সাথে।  

কেবল ঈশ্বরের পরেই যাদের স্থান, অর্থাৎ সমাজের উঁচুশ্রেনীর লোকেরা, সেটা রাজা থেকে বড় ব্যবসায়ী, ডিউক কিংবা ভূপতি পর্যন্ত; তাদের নিজের প্রতিকৃতিতে নীল ব্যবহার করে নীলকে প্রতিষ্ঠিত করেন রাজকীয় রঙ হিসেবে। আর যেখানেই রাজা ও রাজার পরাক্রম থাকে, সেখানেই থাকে বঞ্চিত লোকদের উপর অত্যাচার। সাদা চামড়ার বাবুদের এই অঞ্চলের নীল চাষের প্রতি লকলকে লোভ তার সবচেয়ে উদাহরণ। ১৭৭৭ থেকে প্রথমে একচেটিয়া ভাবে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ও পরবর্তিতে কোম্পানির বাইরের অসংখ্য ব্রিটিশ বণিক নদীয়া, যশোর ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য নীলকুঠি স্থাপন করে কী ভীষণ অত্যাচার চালায় নীলচাষিদের ওপর, তা আমাদের অজানা নয়। 

রঙ হিসেবে নীলের ইতিহাস রক্তাক্ত হলেও, এখন নীলের আরও অনেক রূপ আমরা দেখি চারপাশে। আমাদের সবচেয়ে চেনা ভার্চুয়াল দুনিয়া হলো ফেসবুক, যার Azure Blue রঙে ডুবে ডুবেই হয়তো এই লেখার খোঁজ পেয়েছেন আপনি। ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ নিজে রেড-গ্রিন টাইপের বর্ণান্ধ হওয়ার কারণেই ফেসবুকের রঙ নীল রেখেছিলেন। বেশিরভাগ বর্ণান্ধ মানুষেরা নীল রঙটাই সবচেয়ে বেশি দেখতে পায়। কাজেই নীল রঙ এখন ডিজেবিলিটি-বান্ধব রঙও বটে। আর এ দেশে নীল প্রতিদিনকার রঙ, সেটা রিকশার হুড থেকে নীল ঢেউটিন, নীল অপরাজিতা থেকে লুঙ্গির ভাঁজ পর্যন্ত। অর্থাৎ নীলও অন্য সব রঙের মত তার ইতিহাস বা একরৈখিক পরিচয় বা নির্মাণেই আবদ্ধ নয়।

রঙের মনস্তত্ব ওরফে সমাজতত্ত্ব

শুধু লিঙ্গ, রাজনীতি বা শ্রেণীপরিচয় নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে লম্বা সময় ধরে রঙকে মানব অনুভূতি, বক্তব্য বা ভাবনার সাথেও সংযুক্ত করা হয়ে আসছে। 

সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কোনো পানির ট্যাপে এক দিকে নীল আর অন্য দিকে লাল থাকলে, সহজেই বুঝে নেওয়া যায় যে নীল দিকে ট্যাপ ঘুরালে ঠান্ডা আর লাল এর দিকে ট্যাপ ঘুরালে গরম পানি বের হবে ট্যাপ থেকে। এখানে আমরা রঙকে তাপমাত্রার সাথে যুক্ত করছি, খুব সহজেই। 

এ ধরনের বোধ অনেক সময় মনস্তাত্ত্বিক শিখন প্রক্রিয়ার ভেতর তৈরী হয়, অনেক সময় সামাজিক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়। আবার এই ধারণা ও অনুভূতিগুলো স্যাটেলাইট, ছাপাঅক্ষর ও মাইগ্রেশনের বদৌলতে আমদানি-রপ্তানিও হয় অপরাপর সমাজ, রাষ্ট্র, গোষ্ঠীতে।

যেমন, সবুজকে ধরা হয় প্রাচুর্যতা, সমৃদ্ধি, শান্তি ও প্রকৃতির রঙ হিসেবে। কেননা, অতীত এবং বর্তমানের বনবাসী মানুষের কাছে সবুজ অরণ্য খাদ্যের যোগানদার। ইংরেজি শব্দ Green এসেছে Grow শব্দটি থেকে। আবার, হলুদ রঙকে সমাজে দেখা হয় সতর্কতা হিসেবে, কারণ সব রঙের মধ্যে এর দৃশ্যমানতা সবচেয়ে বেশি। একারণে বিপদজনক  চিহ্ন, নিউক্লিয়ার চিহ্ন বা ট্যাক্সির রঙ হলুদ যাতে তা মানুষের চোখে সরাসরি আঘাত করতে পারে। লালকে দেখা হয় সবচেয়ে আকর্ষণীয়, আবেদনময়, সবচেয়ে দুধর্ষ রঙ হিসেবে। আবার আমাদের শরীরের বহমান রক্তের রঙ লাল, তাই লালকে আমরা আমাদের আদিমতা বা পশুসত্ত্বার সাথেও যুক্ত করি। লাল রঙ এতই ব্যবহৃত যে পৃথিবীর শতকরা ৭৫% দেশের পতাকায় লাল আছে। অনেক জেলখানার দেয়ালে গোলাপি ব্যবহার করা হয় কারণ ধারণা করা হয় এই নরম রঙটি মানুষের মধ্যকার হিংস্রতা কমায় (যদিও পরবর্তীতে গবেষণায় এটা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে)। এই একই গোলাপিকে আবার কোরিয়াতে দেখা হয় বিশ্বাস বা ভরসার রঙ হিসেবে।

তাহলে কোনো রঙকে দেখে এমন বিশেষ কিছু অনুভব করা বা করানোটা কি ভুল? কোনো রঙ কি আমরা শুধু পছন্দের খাতিরে পছন্দ করতে পারবোনা? কালো হুডিটা ফেলে আজই নিয়ন সবুজ হুডি অথবা যাত্রাবিরতির পটচিত্র ঘরানার রঙিন জামা কিনে আনতে হবে? নীল রঙ দিয়ে ছবি আঁকার আগে প্রতিবার বাধ্যতামূলক ক্ষমা চাইতে হবে নীলচাষীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে? 

উত্তরটা হলো না, আমাদের সকলের পছন্দ-অপছন্দের রঙ থাকবেই। বিভিন্ন রঙকে নানান জিনিস, আইডিয়া, বোধের সাথে যুক্ত করার চর্চা থাকবেই। কিন্তু সেটার পাশাপাশি আমরা এটাও মাথায় রাখতে পারি যে আমরা বিভিন্ন রঙ দেখে যেরকম প্রতিক্রিয়া দেখি নিজেদের ভেতর, তা অনেকাংশেই সাংস্কৃতিক বা সামাজিক নির্মাণ। অর্থাৎ, একটা সংস্কৃতিতে লম্বাসময় কোনো চর্চার মাধ্যমে কিছু ভাবনা, কিছু সম্পর্ক আমরা নির্মাণ করেছি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নববর্ষের রঙ হিসেবে লাল-সাদাকে বিশেষায়িত করা। বিভিন্ন কারণে নববর্ষের সময় লাল ও সাদার ব্যবহার হয়ে আসছে একটা সময় ধরে, তাই লাল-সাদা একত্রে দেখলে আমরা তাকে নতুন বছর/বাঙালিয়ানার সাথে তাকে সংযুক্ত করি। 

এই পুরো লেখার উদ্দেশ্য কোনো রঙকে ভালো বা খারাপ বলা নয়, যারা বলে তাদের ধরে পানিতে ফেলে দেওয়াও নয়। বরং এই দিকে রঙের দুনিয়া যে কত জটিল এবং এর ব্যবহারের রাজনীতি যে কত গভীর ও ডাইনামিক সেদিকে আলোকপাত করাই ছিল এ লেখার লক্ষ্য। রঙের ব্যবহারের হায়ারার্কি বিরোধী আন্দোলন যেমন হিপি মুভমেন্টের বাটিকের “ট্রিপি” রঙকে আপন করে নেওয়া থেকে শুরু করে এ দেশে রিকশা পেইন্টিং এর রঙের (বা বলা চলে সে রঙে রাঙ্গানো উঁচু দামের পণ্য) নতুন সমাদর, এসব কিছুই আলোচনা-সমালোচনা ও জটিলতার ঊর্ধ্বে না। মোটকথায়, রঙ বিষয়ে যা-ই আমাদের চোখে ধরা পড়ে সব সময়ই ভেবে দেখা উচিত, লাল না হয়ে নীল হলো কেন। 

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।