সুকুমারী_ভট্টাচার্য
সুকুমারী ভট্টাচার্য

বংশ মানে বাঁশ, প্রকৃতির বাঁশে একটু দূরে গাঁট বা কস্তিকা থাকে, এতে বাঁশটির বয়স বোঝা যায়। মানুষের চেতনায় এ গ্রন্থিগুলি সম্ভবত প্রজন্মের চিহ্ন বহন করে। পুরো বংশ একটা অবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ ধারার প্রতীক। বংশের কল্পনাই এই কোনও এক প্রখ্যাত (কখনও বা অখ্যাত) আদিপুরুষের (আদিনারীর কথা খুব কমই শ্রুত হয়) থেকে শুরু করে অবিচ্ছিন্ন অব্যাহত একটা পরম্পরা; এবং সারা পৃথিবীতেই এটা একটা বিশিষ্ট পরিচয়। এই ধরনের পরিচয়ের জন্যে মানবচিত্তে যে আকাঙ্ক্ষা তার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এর একটা কারণ সম্ভবত এই যে, ব্যক্তিমানুষ সদাই মৃত্যুভয়ে ত্রস্ত শঙ্কিত। সন্তানের মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের সূচনা এবং প্রজন্ম পরম্পরার মধ্য দিয়ে গৌণ ভাবে হলেও ওই আদিপুরুষ বা তার উত্তরাধিকারী যেন ওই ধারার মধ্য দিয়ে জীবিত থাকে। এ এক ধরনের অমরতা — মননে, কল্পনায় মৃত্যুকে জয় করা। মৃত্যুর পূর্বে মানুষটি জেনে যায় যে, ব্যক্তিপুরুষের সঙ্গে সঙ্গে তার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটবে না। এইখানেই বংশ, বংশরক্ষা বংশের ধারা, ইত্যাদির যেন একটা তত্ত্বগত সমর্থন মেলে। বংশপরম্পরা এক প্রজন্মপুরুষের মৃত্যুর পরেও অব্যাহত থাকবে। এটি একটি পরম আশ্বাস। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মৃত বংশকর্তা এক ভাবে নিজেকে প্রসারিত করে এবং সেই কারণেই এক বিদেহ সত্তায় বর্তমান থাকে বলে অনুভব করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ঊর্ধ্বতন দু-তিনপুরুষের বেশি স্মৃতিচিন্তাতেও বিধৃত নয়, অথচ আর্যদের মধ্যে এই বোধ প্রবল ভাবে বিদ্যমান। সম্ভবত আগন্তুক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আর্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাগার্যদের মধ্যে বসবাস করেও তারা, আর্যরা, যে স্বতন্ত্র একটি জনগোষ্ঠী এবং তারা যে নানা কারণে বিশিষ্ট ও উন্নততর এ কথা স্মরণে রাখবার জন্যে এবং প্রতিবেশীদের কাছে এর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যেই সৃষ্টি হয় বংশপরিচয়। এতে আর্যদের একটা আত্মপরিচয় যেন নিহিত ছিল। বংশকর আদিপুরুষের পরে খ্যাতিমান বংশধর থেকে গোত্র এবং তারও পরে পরপ্রজন্মের উজ্জ্বল ব্যক্তি প্রবর নামে খ্যাত হতেন। এঁরা সকলেই বংশের মর্যাদা বৃদ্ধি করতেন বলেই পরপ্রজন্মের কাছে সম্মানিত হতেন। এ সব বিভাগের দ্বারা আর্যদের বংশ আরও সুপরিচিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত হত।

এখনও কথায় কথায় লোকে বংশের সম্বন্ধে কথা বলতে গেলে ‘চোদ্দপুরুষ’ বলে থাকে— অর্থাৎ বংশ পরিচয়কে সুদীর্ঘ অতীতে বিস্তারিত করবার চেষ্টা। ক্রিয়াকর্মে ঊর্ধ্বতন তিনপুরুষের নাম উল্লেখ করে অনুষ্ঠান করা হয়, আর তারও পূর্বের পুরুষদের নাম উল্লেখ না করে তর্পণ করা হয়। লোকে নিজেদের বংশ কত প্রাচীন তা নিয়ে গর্ব করে থাকে। প্রাগার্য পরিবেষ্টিত আর্যদের বংশ পরিচয় ছিল গর্বের উপাদান। যার যত দীর্ঘ বংশতালিকা তার তত বেশি প্রতিষ্ঠা, তত গর্ব। ভিনদেশে এসে বসবাস করলে এটাই হয়তো নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও গর্ব করবার বিশেষ উপায় ছিল। একটা সময়ে যখন এ দেশে আর্য বসবাসের ইতিহাস হ্রস্ব ছিল তখন সমাজে বংশপরিচয়কে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হত। এখনও কোনও কোনও পরিবার তাদের গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে বংশের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা করে। আর্যদের চেতনায় গোপন একটি বাসনা ছিল, এই উপায়ে তারা তাদের আগন্তুক সত্তাকে আড়াল করবে, এ দেশে বসবাসের দীর্ঘতা দিয়ে অভিবাসনের ইতিহাস গৌণ করে রাখবে। বংশ ও বংশপরিচয় তাই তখন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

এর মধ্যে আরও একটা ব্যাপার ছিল: ঋগ্‌বেদে দেখি প্রাগার্যদের প্রতি আর্যদের প্রবল একটা অবজ্ঞা; ওরা কৃষ্ণবর্ণ, হ্রস্বজঙ্ঘ। এই অবজ্ঞাত, প্রাগার্যদের সঙ্গে পাছে আর্যরা মিলে যায় এবং তার ফলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হয় তাই বংশতালিকার দৈর্ঘ্য দিয়ে, গোত্র-প্রবরের পরিচয় দিয়ে আর্যদের স্বতন্ত্র মহিমাকে অমলিন রাখার একটা চেষ্টা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সতর্ক প্রহরার মধ্যে দেখা যায়; অর্থাৎ আর্য-প্রগার্য মিশ্রবিবাহের ফলে বর্ণসংকর ঘটলে আর্যমহিমা ক্ষুণ্ণ হবে এই আশঙ্কাতেই নিজেদের বংশগৌরব সম্বন্ধে আর্যরা তীব্র ভাবে সচেতন ছিল; তাদের শ্রাদ্ধ, বিবাহ ইত্যাদি বহু শুভকর্মের সূচনাই হত ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষের নামোল্লেখ করে। অর্থাৎ তারা যে বহুকাল ধরে এ দেশে বাস করছে— উটকো আগন্তুক নয়— এ সম্বন্ধে নিজেদের ও প্রাগার্যদের বিশেষ ভাবে সচেতন থাকতে হত। এতে আর্যদের আত্মপ্রত্যয় ও শ্লাঘা প্রশ্রয় পেত। প্রাগার্যদের মধ্যে বংশপরিচয় সংরক্ষণের কোনও রীতি ছিল না। আজও তাই বর্ণহিন্দুর বাইরে যারা, তারা বংশপরিচয় সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন বলেই তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাপের নাম এবং গ্রামের নামেই তাদের পরিচয়, এতেই তাদের চলে এসেছে এতাবৎকাল এবং আজও চলছে। অথচ এখনও মধ্যবিত্ত পরিবার যখন বংশগৌরব নিয়ে পরস্পরের মধ্যে কথা বলেন, তখন তাঁরা ভুলে যান যে বাড়ির পরিচারিকাটি ওই পরিচয়ে বঞ্চিত এবং সে জন্য সে কিছুমাত্র ক্ষুব্ধ নয়।

আমরা সবাই জানি যে, এত সব বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আজকের হিন্দু সমাজে আর্যরক্ত বহু ভিন্ন গোষ্ঠীর রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে চলেছিল দীর্ঘকাল ধরে; এই মিশ্রণ শুধু প্রাগার্যদের রক্তের সঙ্গে নয়, একে একে যত আগন্তুক জাতি আক্রমণকারী বা অন্য ভূমিকাতেও ভারতবর্ষে এসেছে এবং ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভাবে নিঃশেষে তাদের মধ্যে মিশে গেছে এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সকলের রক্ত মিশে আছে। ‘হিন্দুর’ রক্তে মিশে আছে পাঠান, মোগল, খ্রিস্টান, পারসি, পহ্লব, কুষাণ, শক, হূন, পারদ সকলেরই রক্ত। কাজেই বংশগৌরবের পূর্বে প্রাচীন আর্যসমাজে যে ভিত্তি ছিল, আজ তার বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এতে কিন্তু সমাজে যাঁরা বংশগৌরবে গর্বিত তাঁদের গর্বের মাত্রা কিছুই কমেনি। কারণ, এর সঙ্গে যুক্ত প্রাগার্য, প্রত্যন্তবাসী জনগোষ্ঠীর থেকে নিজেদের পার্থক্য ঘোষণা। বংশপরিচয়ে মর্যাদার তারতম্য জ্ঞাপন আবার বংশগর্বে গর্বিত ওপরতলার মানুষের নীচুতলার লোকদের থেকে নিজেদের পার্থক্য ও গৌরব ঘোষণা করার এক উপায়।

ঋগ্বেদের কাল থেকে ধীরে ধীরে বেদাঙ্গসূত্রের কাল পর্যন্ত বংশ, গোত্র, প্রবর ইত্যাদি এক ভাবে বেড়েই উঠেছিল ও ক্রমেই পল্লবিত হচ্ছিল। কিন্তু এর পরের যুগে খ্রিস্টীয় পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে কি তার অল্প আগে থেকেই যে সব শাস্ত্র রচিত হচ্ছিল যার মধ্য দিয়ে ধর্মসূত্রের চিন্তাধারার প্রসার ঘটছিল— যেমন নিবন্ধ শাস্ত্রগুলি, স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণ— এ সবের মধ্যে বংশ গোত্র-প্রবর ইত্যাদি ক্রমেই বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে। শুধু তাই নয়, এগুলির শাখা-প্রশাখার বিস্তার হয়ে চলে এবং নানা সামাজিক প্রভাবে ক্রমেই পল্লবিত হয় এবং ক্রমশ কঠিন দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীরের মধ্যে আবদ্ধ হয়; পরস্পরের মধ্যে সঞ্চরণ ক্রমেই বন্ধ হতে থাকে। ফলে সমাজে মানুষের পরিচয় তার পূর্বপুরুষের পরিচয়ের দ্বারাই নিরূপিত হয়। যার বংশমর্যাদা যত প্রাচীন ও যার গোত্র-প্রবর পরিচয় যত খ্যাতিমান, সমাজে তার আভিজাত্য তত বেশি। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সংযুক্ত হল যার বংশ-গোত্র-প্রবর, ইত্যাদি পরিচয় নেই সেই প্রাগার্য বা সমাজের প্রত্যন্তবাসী আদিবাসী সম্প্রদায়— বংশপরিচয়হীন বলে সমাজে তার অবনমন। শুধু তাই নয়, যাদের বংশ পরিচয় আছে, তারাও সেই পরিচয়ে সকলে সমান নয় বলে সমাজে এই হিসাবে উঁচুনীচু ভেদ বাড়ল। যে বংশপরিচয়ে যত দীন সে অভিজাত সম্প্রদায় থেকে তত নীচে সরে যেতে থাকল। এই প্রক্রিয়া কয়েকশো বছর ধরে বেড়েই চলেছে এবং হিন্দুসমাজেই একটি বংশের ছোঁওয়া জল অন্য বংশ পান করবে না— ক্রমে এমন অমানবিক পরিণতিও দেখা দিল এবং কায়েম হয়ে রইল। এটা হল, সমাজের শতকরা নম্বই ভাগের কথা; বাকি দশ ভাগ বিগত দুই শতকের নানা মানবিক আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওই সব সংস্কারের জগদ্দল চাপ থেকে কতকটা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু এখনও সমাজের মূলস্রোতে বংশপরিচয়ের প্রবল প্রতাপ বর্তমান।

আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত সমাজের লোকেদেরও প্রায়ই বলতে শোনা যায় ‘কত বড় বংশ তা দেখতে হবে তো?’ কিংবা, ‘অমন ছোটবংশের লোকের কাছে আর কী-ই বা আশা করা যায়?’ ‘সরাসরি প্রশ্ন করলে এঁরা স্বীকার করবেন যে, বংশ ইত্যাদির কোনও যথার্থ সামাজিক বা মানবিক ভিত্তি নেই। অর্থাৎ বংশপরিচয় ধীরে ধীরে আমাদের চেতনার অভ্যন্তরে স্থান করে নিয়েছে। জাতিভেদে যে শ্রেণিবিভাজন ঘটে তারই আনুষঙ্গিক এবং অনুরূপ একটি মারাত্মক বিভাজন ঘটে বংশপরিচয়ে। এটি আরও মারাত্মক এই কারণে যে, বহু শতক বা সহস্রাব্দ পূর্বের কোনও পূর্বপুরুষের পরিচয়ের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত, তা এত দূর অতীতের যে, একে কোনও ভাবে প্রভাবিত করার সাধ্য বর্তমান প্রজন্মের নেই; অতএব অমোঘ নিয়তির মতো এর দ্বারা নিরূপিত হয় বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় এবং সে পরিচয়ের দ্বারা সমাজে তার স্থান নির্ণীত হয়। তথাকথিত উচ্চবংশের মানুষ যেমন বিনা আয়াসে সুদূর অতীতের বংশের কোনও পুরুষের পরিচয় আত্মসাৎ করে সমাজে মাথা তুলে থাকে এবং নীচের দিকের মানুষের উপরে প্রতিপত্তি ফলায়, তেমনই আজ তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের কোনও সাধ্য নেই দু-আড়াই হাজার বছর আগেকার পূর্বপুরুষের নীচ অবস্থানকে কোনও ভাবেই অতিক্রম করা। এতে এক দিকে যেমন মানুষের আপন যোগ্যতা ও কৃতিত্ব যথার্থ মর্যাদা পায় না, তেমনই সম্পূর্ণ অযোগ্য অপদার্থ মানুষও বহু পূর্বের কোনও বংশকর মানুষের কৃতিত্ব অনায়াসে আত্মসাৎ করে দাপিয়ে বেড়ায়। মানুষের যথাযথ ব্যক্তিপরিচয় এতে গৌণ হয়ে যায়; বহু পূর্বের ধার করা এক তাৎপর্যহীন পরিচয়ই হয়ে উঠেছে আজকের সমাজে তার পরিচয়ের গৌরব বা দৈন্যের হেতু। এর মধ্যে একটা কৃত্রিমতা আছে।

এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে, শুধু বংশকৌলিন্যের চেয়ে অনেক বেশি গৌরবের বংশ ও বিত্তের সহাবস্থান। সমাজ বিত্তকে চিরদিনই বাড়তি খাতির করে এসেছে, এখনও করে। তবে বিত্ত না থাকলেও শুধু বংশমর্যাদার ওজন এখনও আছে। যদিও গত পঞ্চাশ বছর ধরে উল্টোটাও সত্যি, অর্থাৎ বংশগৌরবহীন নিছক বিত্তকৌলিন্যও এখন সমাজে অস্বাভাবিক এবং কুরুচিকর প্রাধান্য পায়।

বংশপরিচয় প্রধানত পিতৃতান্ত্রিক; বংশকর পুরুষ, গোত্র ও প্রবরের প্রতিষ্ঠাতা সকলেই পুরুষ— শুধু এ দেশে নয়, অধিকাংশ দেশেই। কিছু কিছু আদিবাসী অঞ্চলে এবং দেশের কোনও কোনও মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে মাতৃবংশের পরিচয়েও সন্তানের পরিচয় হয়। প্রাচীনকালেও বেদে কোথাও কোথাও এবং রামায়ণ মহাভারতেও দেখি রাধেয় (কর্ণ), কৌন্তেয় (প্রথম তিন পাণ্ডব), গাঙ্গেয় (ভীষ্ম), মাদ্রেয় (নকুল, সহদেব), বৈনতেয় (গরুড়), কাদ্রবেয় (কদ্রুর সপসন্তানরা), প্রভৃতি মাতৃ-পরিচয় ভিত্তিক নাম পাওয়া যায়। এগুলি ঠিক বংশপরিচয় না হলেও সমাজে এতটাই স্বীকৃত পরিচয় ছিল যে, ভীষ্মকে ‘শান্তনব’ বলে পিতৃপরিচয়ে খুব কমই অভিহিত করা হয়েছে। যেমন গরুড়কে কাশ্যপের সন্তান বা কর্ণকে অধিরথের পুত্র বলে তেমন উল্লেখ করা হয়নি। গঙ্গার ব্যক্তিত্ব রাজা শান্তনুর চেয়ে উন্নত ছিল। সে জন্য এ ধরনের মাতৃ-পরিচয়ের উল্লেখ স্বাভাবিক ও সঙ্গত বোধ করা হত বলে মনে হয়।

এগুলি কিন্তু ব্যক্তি-পরিচয়— বংশপরিচয় নয়। বংশের বেলায় সমাজ অনমনীয় ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। তার একটা কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পিতৃকুলের পরিচয়ে পরিচিত সন্তান উত্তরাধিকারসূত্রে পিতৃপিতামহের সঞ্চিত বিত্ত লাভ করত। যে সব মাতৃতান্ত্রিক অঞ্চলে পুত্ৰ মায়ের সম্পত্তি পায়— যেমন দক্ষিণ ভারতের কোথাও কোথাও— সেখানে মাতৃপরিচয়েরই প্রাধান্য। বংশ সম্পত্তির ধারা বহন করে, তা ছাড়া মানুষ বিশ্বাস করে বংশগত গুণ (এবং দোষ)গুলিও উত্তরপুরুষে বর্তায়। আজ আমরা জানি, এ ধারণা যতটা সত্যি ততটাই মিথ্যে। বংশগত দোষগুণ একেবারেই বর্তায়নি এমন বহু দৃষ্টান্ত চারিদিকে পাওয়া যায়, সৎ মানুষের দুর্বৃত্ত পুত্র, মূর্খের বুদ্ধিমান বিদ্বান পুত্র, দাতার কৃপণ পুত্র এ সবের ভূরি ভূরি উদাহরণ পাওয়া যায় এবং আজ ‘জিন’ চর্চায় বৈজ্ঞানিকরা তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও উদ্ধার করেছেন। কাজেই দোষ-গুণের ধারা সর্বত্রই বংশ ধরে দেখা দেয় এ ধারণা আজ আর বিদ্বজ্জনের কাছে গ্রাহ্য নয়।

তবে একটা জিনিস যা আইনের জোরে বংশে বর্তায়, তা হল বিত্ত। এই বিত্ত আপন ঔরসজাত পুত্রের হাতে রেখে যাওয়ার জন্যেই স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সংসর্গ থেকে সযত্নে দূরে রাখার কঠোর প্রয়াস সেই সুদূর অতীত থেকেই, যাতে পিতার সারা জীবনের সঞ্চয় নিজের ঔরসজাত পুত্র এবং পরে পৌত্রের হাতেই পড়ে। এখানে বংশের ধারাবাহিকতার একটা মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি পাওয়া যায়। তবে গুণ, বিদ্যাবুদ্ধি, যোগ্যতা যদি পুত্র-পৌত্র ধারায় সঞ্চারিত হয় তবে সমাজে বংশ অন্য এক ধরনের প্রতিপত্তির সূচনা করে, এবং কখনও কখনও তা হয়ও।

বেদের ব্রাহ্মণ অংশ থেকেই বংশ সম্বন্ধে একটা সম্ভ্রমবোধ দেখা যায়, উপনিষদেও বেশ কিছু বংশাবলি পাওয়া যায়। রামায়ণ, মহাভারতেও বংশতালিকা আছে; অর্থাৎ খ্রিস্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীতে ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও এর উদ্ভব আরও সাত-আটশো বছর আগে। পৃথিবীর অন্য দেশের প্রাচীন সাহিত্যেও বংশতালিকা দেওয়া থাকে, প্রধানত আগন্তুক জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ও অভিবাসনের ইতিহাস রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এবং সেই সঙ্গে সেই গোষ্ঠীর প্রাচীনতা ও আপেক্ষিক মাহাত্ম্য ঘোষণা করার জন্য। বংশাবলিগুলি লক্ষ করলে দেখি দু-চারজন প্রতিষ্ঠিত বা স্বনামধন্য পণ্ডিত বা ঋষি থাকলেও সুদীর্ঘ বংশতালিকায় অধিকাংশেরই পরিচয় দীন, নিষ্প্রভ। বাস্তবে তো এমনটাই হয়, যে-কোনও বংশতালিকায় দু-তিনটির বেশি উজ্জ্বল ব্যক্তির নাম থাকে না, তবু বংশটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে ওই দু-তিনটি প্রসিদ্ধ মানুষের জোরেই। সমাজ এইটেই মেনে নিয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ অনার্য পরিবেশে কয়েকটি আর্যবংশ কিছু বিদ্বান ও গুণবান ব্যক্তির জোরেই নিজ বংশকে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতেন। যেহেতু আর্যরা প্রাগার্যদের বরাবরই হেয় জ্ঞান করেছে, সে জন্যে প্রাগার্য সংস্কৃতিতে উন্নত কিছু আছে আর্যরা তা বিশ্বাসই করত না, তাই কখনও তার সন্ধানও করেনি। নইলে হয়তো তারা প্রাগার্য বংশের কিছু উন্নত গুণ, যোগ্যতা, বিদ্যা ও জ্ঞান সেখান থেকে আত্মসাৎ করে সমৃদ্ধতর করে তুলতে পারত। আবার আর্য সমাজের মধ্যে সকল বংশ প্রখ্যাত ছিল না; আমরা যে কটির নাম পরিচয় জানতে পারি, গোটা আর্যসমাজ তার মধ্যে নিবদ্ধ ছিল না, তাদের বাইরেও বহু বংশ ছিল, যাদের পরিচয়ের উল্লেখ শাস্ত্রে নেই। তারাও সমাজে হীন ও নত হয়েই ছিল। গুণী বা বিদ্বান জ্যোতিষ্কস্বরূপ বংশধর সে সব বংশে জন্মায়নি বলেই তাদের পরিচয় গৌণ থেকে পরে লুপ্ত হয়ে গেছে। সে সব বংশের ধারাও হয়তো বংশধরদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল, কিন্তু কোনও উজ্জ্বল বংশধরের পরিচয় সে বংশতালিকায় ছিল না বলে সেগুলির স্বতন্ত্র পরিচয় শাস্ত্রে ছিল না, ছিল হয়তো বংশধরদের মনে, তাদের স্মৃতিতে। ব্রাহ্মণের বংশে যেমন ঋষি, বেদজ্ঞ, অধ্যাপক ও যজ্ঞকারী বিশিষ্ট ব্রাহ্মণের দ্বারা বংশ উজ্জ্বল হত, ক্ষত্রিয় বংশে তেমনই যুদ্ধে বিজয়ী বীর বা শৌর্যবান বা দাতা ক্ষত্রিয়ের দ্বারাই বংশ খ্যাতিলাভ করত। কিন্তু ক্ষত্রিয় বংশতালিকা খুব কমই পাওয়া যায়, বৈশ্যের তো একেবারেই পাওয়া যায় না, আর শূদ্রের বংশধারা শূদ্রের কাছেও স্মরণীয় বোধ হত না, কারণ সে ছিল উচ্চ ত্রিবর্ণের সেবক— দাসের আবার বংশপরিচয় কী করে হবে! অতএব দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় শুধু ব্রাহ্মণের। উপযুক্ত ব্রাহ্মণ রাজার কাছে প্রচুর দক্ষিণা ধনরত্ন পেতেন। ফলে যোগ্যতার সঙ্গেই থাকত ঐশ্বর্য, সমাজে বংশটির প্রতিপত্তি বাড়ত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের ওই জাতীয় বংশতালিকার সন্ধান পাই না, এক প্রজন্মে কৃতী বীর বা ব্যবসায়ী নিজের পরিচয়েই প্রতিষ্ঠা পেত। তার বংশ পরিচয়ের সে ভাবে প্রয়োজন ছিল না। তাই শাস্ত্রেও তার নজির নেই।

গত দুই সহস্রাব্দে সমাজে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে; তার মধ্যে একটা প্রধান পরিবর্তন হল আজ গোষ্ঠীপরিচয় থেকে সমাজ ব্যক্তিপরিচয়কে প্রাধান্য দিচ্ছে। এর নানা কারণও আছে। বংশে নানা জাতির সংমিশ্রণ ঘটে গেছে, বহু বংশে আগের গৌরবের ভিত্তি নষ্ট হয়েছে। আগেকার পরিচিত, প্রতিষ্ঠিত বংশগুলির অধিকাংশই ছিল আর্য এবং ব্রাহ্মণ, পরবর্তিকালে বহু অব্রাহ্মণ বংশের বংশধর নিজের কীর্তি ও যোগ্যতা দিয়ে, জ্ঞানবুদ্ধি, সৎকর্ম ও সমাজ হিতৈষিতার দ্বারা সমাজে সম্মান ও প্রতিপত্তি লাভ করেছে। এখনও অধিকাংশ প্রখ্যাত বংশই ব্রাহ্মণ কায়স্থ বা বৈদ্যকুলের, কদাচিৎ অন্য বর্গের মধ্যে কীর্তিমান পুরুষের খ্যাতিতে কোনও কোনও বংশ গৌরব লাভ করেছে। এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বংশ সমাজে প্রতিষ্ঠিত, যাদের অনেকেরই গোত্র-প্রবর পরিচয় জানা নেই। এ কথা দেশের বৃহৎ আদিবাসী সম্প্রদায় সম্বন্ধেও সত্যি: ওই ধরনের বংশপরিচয়ে তারা বিশ্বাসী নয়, কাজেই ওই হিসেব তারা রাখেও না। বৈদিক যুগে যে যোগ্যতার, কৃতিত্বের নিরিখে গোত্র-প্রবরের প্রতিষ্ঠাতারা স্বীকৃতি পেত, সেই যোগ্যতা, উৎকর্ষের নিরিখেই পরবর্তিকালে অব্রাহ্মণ বংশে প্রখ্যাত পুরুষের নামে বংশের ধারা প্রবর্তিত হয়।

একটা ব্যাপার কিন্তু বংশপরিচয়ে সার্বত্রিক, তা হল বংশপরিচয় নির্ধারিত হয় কোনও একটি পুরুষেরই নামে, কারণ সমাজটা আগাগোড়া পুরুষতান্ত্রিক। আজকের সমাজ পুরুষতন্ত্রকে প্রতিস্পর্ধা জানাচ্ছে, উপেক্ষা করছে এবং বলছে, এ ব্যবস্থা ন্যায়সম্মত নয়। আজকে পৃথিবীর সর্বত্রই নারী স্বাধীনতার জন্যে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, বংশপরিচয় মূলত পুরুষের, নারীর নিজস্ব কোনও বংশপরিচয়ই নেই। কুমারীর পদবি পিতার, বিবাহিত বা বিধবার পদবি স্বামীর পদবির মধ্যে বংশপরিচয় নিহিত আছে। এই পদবির মধ্যে এক দিকে যেমন প্রকৃষ্ট ভাবে পুরুষতন্ত্রের ছাপ পড়ে এবং তেমনই ওরই মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে জাতি পরিচয় বা অনেকাংশে বংশপরিচয়। পদবিটির চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নারীর স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই, হয় সেটা তার বাবার পদবি নয় স্বামীর। তেমনই চট্টোপাধ্যায়কে সমাজ যে চোখে দেখে, মণ্ডল, নাই, দাস, বাউরি— এগুলিকে সে চোখে দেখে না কারণ, এরা সমাজে তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ। এ দিক থেকে পদবি বর্জন করার দ্বারা এক আঘাতে জাতি বা বংশপরিচয় এবং নারী পুরুষের পৃথক পরিচয় অস্বীকার করা হয়। নানা কারণে দু-চারজন ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া জনসাধারণ পদবি বর্জন করতে পারেননি। দাক্ষিণাত্যে নামের সঙ্গে গ্রামের নাম উল্লেখে একদা এ সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়েছিল, যেমন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন। কিন্তু এটা তখনই সম্ভব, যখন বাসস্থানের পরিচয় দীর্ঘকাল ধরে একই থাকে। দেশভাগের পরে বহু পরিবারেরই বাসস্থানের পরিচয় তছনছ হয়ে গেছে, উদ্বাস্তুরা কোন পরিচয় দেবে? বর্তমানের বা আদিবাসস্থানের? তারপর বহু পরিবারের কর্মস্থলই ধীরে ধীরে বাসস্থান হয়ে ওঠে, তখন কোনটা তার যথার্থ বাসস্থানের পরিচয়? কাজেই বাসস্থানের পরিচয়টা পদবির বিকল্প হতে পারে না। অতএব পদবির যথার্থ কোনও বিকল্প নেই। পদবিতে বংশপরিচয় এবং পিতৃপরিচয় অথবা স্বামীর পরিচয় নিহিত থাকে এবং সেটা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা চিহ্ন বহন করে।

সমস্যাটা হল একুশ শতকের সমাজ লিঙ্গভেদের সঙ্গে কোনও অধিকারভেদ জড়াতে রাজি নয়। একজন মানুষ পুরুষ বলেই একটু উঁচু আর একজন নারী বলেই নীচু— এ কথা এ সমাজ মানতে চায় না। কারণ বর্তমান সমাজ নারী-পুরুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। এ কথা মেনে নিলে এখনকার সমাজের সমদর্শিতাকে একটু প্রসারিত করলেই অনুসিদ্ধান্ত হবে— বংশ একা পুরুষের নয়, নারীরও। যেখানে স্কুলে অভিভাবক হতে পারে মা, রেশনকার্ডে ‘গৃহস্থ’ হতে পারে নারী, হাসপাতালে মা ভর্তি করতে পারে অসুস্থ শিশুকে, আইনে সাক্ষ্য দিতে পারে অর্থাৎ তাবৎ সামাজিক এবং সাংবিধানিক ক্ষেত্রে নারী সমান অধিকার ভোগ করে। সেখানে বংশপরিচয় শুধু পুরুষকে দিয়েই কেন হবে? একটি শিশু শুধু পিতামহ বা পিতামহীরই নাতি বা নাতনি, মাতামহ বা মাতামহীর নয়?

বহু প্রাচীনকালে ‘দম্পতি’ শব্দের অর্থ ‘জায়া ও পতি’ ছিল না। ইন্দো-ইয়োরোপীয় নির্বাচনে ‘দমঃপতী’ এই ছিল অর্থ। দম মানে গৃহ (যার থেকে domestic), এই গৃহের পতি ছিল দুজন; স্বামী ও স্ত্রী; যে কারণে দম্পতি শব্দ নিত্যদ্বিবচন, এখানে জায়া ও পতির কর্তৃত্বের মধ্যে তত্ত্বগত ভাবে কোনও পার্থক্য ছিল না, কার্যত ছিল। কিন্তু এই প্রাচীন বোধটি তো এক ধরনের সমানাধিকারের নিরিখ। তার অনতিকাল পরেই অবশ্য নারীর অধিকার খর্ব হতে থাকে। এখন প্রশ্ন হল, আজ যখন সারা পৃথিবীতে নারীপুরুষের সমানাধিকারের জন্যে ব্যাপক আন্দোলন চলছে তখন বৈষম্যমূলক বংশপরিচয়ের বোধকে বর্জন করে নারীকেও বংশকর্ত্রী বলে স্বীকার করা সঙ্গত। সন্তান শুধু পিতৃপরিচয়ে নয়, মাতৃপরিচয়েও অভিহিত হোক, বংশও নিরূপিত হোক ঊর্ধ্বতন প্রজন্মের পুরুষ এবং/অথবা নারীর পরিচয়েও। 

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র পরিচয়ের চেয়ে কি গান্ধারীর পুত্রপরিচয় কোনও অংশে ন্যূন? দশরথের পুত্র যদি কৌশল্যার পুত্র বলে পরিচিত হয় তো সেটা বেশি সম্মানের। এখনও পৃথিবীর কৃতী নারী ও কৃতী পুরুষের মধ্যে তারতম্য রক্ষা করে, নইলে পিতামহ-মাতামহ এবং পিতামহী-মাতামহী উভয়েরই পৌত্র পৌত্রী যে-কোনও পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকার থাকা উচিত ছিল। এবং আজ যে-কোনও বংশের পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় তা ঠিক করুক সেই উত্তরপুরুষই, বংশপরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন ঘটলে। তবে সেটা সাম্যদৃষ্টিতেই নিরূপিত হোক

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।