হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও ক্যাপিটালিজম যেভাবে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে প্রভাবিত করে

হ্যালো, আমার নাম জেসিকা ডিফিনো। আমি একজন বিউটি রিপোর্টার আর আমার উদ্দেশ্য হলো বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করা।  

একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল মনে হয়। তবে আমি যে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করতে চাই তা সত্যি। আর সেই প্রচেষ্টায় আমি টিন ভোগ-এর জন্য নতুন মাসিক কলাম ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’ লিখছি।   

আমার মতে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে, বা বলা যায় সারা বিশ্বে, যত সমস্যা আছে তার মূলে রয়েছে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড। এই বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধরে সেক্সিজম, বর্ণবাদ, শ্রেণীবাদ, বয়সবাদ, প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য এবং জেন্ডার ভিত্তিক অসমতাকে জোরাল করা হয়েছে। আমাদের সমাজে এই অবাস্তব স্ট্যান্ডার্ডগুলো তৈরি করে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলোই আমাদের উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, ডিসমরফিয়া, ইটিং ডিসঅর্ডার এবং আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভূমিকা রাখে। এমনকি ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কথাটা শুনলেই আমার বিরক্ত লাগে।  

মানে, ভাবুন তো, সৌন্দর্যের মতো অপরিমেয়, বায়বীয়, আবেগগত অথচ প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা একটি কনসেপ্টকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডে সীমাবদ্ধ করার কথা? কেন? কী কারণে? কার জন্য?         

এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কী সেটা নির্ধারণ করতে হবে। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো আদর্শ  মেয়েলি সৌন্দর্যের যোগ্যতা যা নারীয়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত পর্যায়ে সফল হওয়ার জন্য পূরণ করবে বলে আশা করা হয়। (‘নারী’ এবং ‘মেয়েলি’ শব্দগুলি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বাইনারির উপর ভিত্তি করে বানানো – যা পিতৃতন্ত্রকে সমর্থন করে এবং নারী, পুরুষ ও নন বাইনারি ব্যক্তিদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু সে আলাপ অন্য একটি কলামের জন্য।) এই যোগ্যতাগুলো প্রতিনিয়ত ফিল্ম, টেলিভিশন, সাহিত্য, ম্যাগাজিন, স্কুল সিস্টেম, চিকিৎসা ব্যবস্থা, রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সোশ্যাল মিডিয়া, আইন এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। মনে হয় যেন আমাদের ব্রেইনওয়াশ করা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের যুক্তি অনুসারে, সমাজ আমাদেরকে যা সুন্দর বলে তা থেকে আমরা স্বতন্ত্রভাবে যা সুন্দর বলে মনে করি তা আলাদা করা অসম্ভব।       

‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ আর ‘আদর্শ মেয়েলি সৌন্দর্য’ উভয়ই চলমান নিশানা। এগুলো সময়ের সাথে সাথে এবং এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে পশ্চিমা উপনিবেশের  বদৌলতে  ইউরোসেন্ট্রিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডই বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের মান হয়ে উঠেছে। নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন ‘দ্য বিউটিওয়েল’ প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা, আমিরা আদাওয়ে টিন ভোগকে বলেন, ‘আফ্রিকায় আমার গবেষণার সময় আমি কসমেটিক ডিলারদের সাক্ষাৎকার নিই। তাদের মতে, আফ্রিকা এবং এশিয়া পশ্চিমাদের অনুসরণ করে থাকে। আমরা এখন আমেরিকায় যে বিউটি ট্রেন্ডগুলো দেখছি তিন বছরের মধ্যে তা আফ্রিকা এবং এশিয়ায় পৌঁছে যাবে।’ পশ্চিমা বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো ক্যাপিটালিস্ট, কলোনিয়ালিস্ট, পুরুষতান্ত্রিক, সাদা আধিপত্যবাদী সমাজের পণ্য, যা তৈরি হয়েছে আমাদেরকে গ্রাস করে রাখার জন্য।    

নাওমি উলফ তার বই দ্য বিউটি মিথ -এ লিখেছেন, ‘বিউটি মিথের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক বা জৈবিক ব্যাখ্যা নেই।’  তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সমাজের আদর্শগুলো যে সঙ্গী নির্বাচনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া থেকে এসেছে তারও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি নৃবিজ্ঞানীরা। 

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজের লেকচারার ড. হান্নাহ ম্যাকক্যান একমত জানিয়ে লেখেন, ‘যারা বলে যে সৌন্দর্য্যের সর্বজনীন আদর্শ আছে যা সবধরণের সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যায় তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ যে সৌন্দর্যের এই আদর্শগুলো বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে।’  

সৌন্দর্যের কনসেপ্ট আমাদের মধ্যে সবসয়ই উপস্থিত ছিল – কিন্তু শুরুর দিকে সৌন্দর্যের ব্যাপারটা শারীরিক সম্পর্কে কম এবং আত্মার সাথে বেশি সম্পৃক্ত ছিল। সৌন্দর্যবিদ Władysław Tatarkiewicz বিশ্লেষণ করেন যে গ্রেকো-রোমানরা সৌন্দর্যকে কীভাবে ঐশ্বরিক এবং ভালোর সাথে সংযুক্ত করত। প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্যেরও একটি আধ্যাত্মিক গুণ ছিল। মেকআপ তখন সাজসজ্জার এমন একটি রূপ ছিল যা দেবতাদের অনুকরণ এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করা হতো।  

মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের পর থেকে সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সংযোগ যেন হারিয়ে যেতে শুরু করে। মার্ক টুংগেট তার বই ব্র্যান্ডেড বিউটি-তে লিখেছেন, ‘[নারীদের] উৎসাহিত করা হয়েছিল পবিত্র এবং কুমারী দেখাতে, যেন তারা চির-তরুণী!    

স্বর্ণকেশী, নীল নয়না এবং ফর্সা ত্বককে মানা হতো ‘ঈশ্বরের জ্যোতি’র মতো সুন্দরের প্রতীক হিসেবে।  অ্যাডাওয়ের মতে, ‘১৫ শতকের দিকে কলোনাইজাররা আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় গিয়ে এই ধারণা প্রচার করে যে সাদা হওয়াই ভাল, সাদার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই না। শুধুমাত্র সাদারাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো ছিল, তাদের ভালো চাকরি আর শিক্ষা অর্জন ছিল।’  

চামড়ার রঙের সঙ্গে সমাজে শ্রেণী নির্ধারণের বিষয়টা জড়িত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান সমাজে হালকা গায়ের রঙের মানুষদের উচ্চ শ্রেণীর অন্তর্গত করা হতো। কারণ হিসেবে টুঙ্গেট লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই ফর্সা চামড়ার একজন মহিলা ব্রোঞ্জ রঙের শ্রমিকের থেকে আলাদা জীবনযাপন করেছে।’  কিন্তু কলোনাইজাররা এই ধারণাটাকে সমস্ত জাতির মধ্যে প্রয়োগ করে।      

অ্যাডাওয়ে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের সময় এই একই ধারণা অনুসরণ করা হয়েছিল। যারা কালো রঙের ছিল তারা বাইরে মাঠে কাজ করত। আর যাদের গায়ের রঙ ফর্সা ছিল, তারা বাড়িতে কাজ করত। ফর্সা ত্বকের মানুষেরা সুন্দর বলে বিবেচিত হতো আর এই ধারণাটি এখনও আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন যে কলোনাইজাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেলেও, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, এই ধারণাটা রয়ে যায়। ‘কলোনাইজাররা চলে গেলেও তারা একটি উত্তরাধিকার রেখে গেছে: সাদাচামড়ার উত্তরাধিকার। এটি আমাদের মানসিকতার একটি চলমান উপনিবেশ।’  

উপনিবেশি এই মানসিকতা আজও টিকে আছে। এই মানসিকতা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতায় প্রতিফলিত হয় যেখানে দেখা যায় প্রতিটি মুখ প্রায় একচেটিয়াভাবে সাদা। এমনকি মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিতে ইনক্লুসিভ শেডস যোগ করার উপর ফোকাস থাকা সত্ত্বেও গায়ের সাদা রঙের জন্য ১০ ধরনের ফাউন্ডেশন শেড পাওয়া যায় আর কালো গায়ের রঙের জন্য মাত্র দুই ধরনের।  এই একই অবস্থা কসমেটিক কর্পোরেশনগুলোর, যারা এশিয়ায় গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্রিম বিক্রি করছে — যদিও সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এখন এই পণ্যগুলোর নাম কম বর্ণবাদী। 

অলঙ্করণঃ ঈহা

  

ক্যাপিটালিজমকে এভাবেই উপনিবেশ দারুণ এক ব্যবসায়িক মডেল উপহার দিয়েছে: এটি দেখিয়ে দিল, সারাজীবন অন্যের কাছে নিকৃষ্ট বোধ করা থেকে জন্মানো হীনমন্যতা থেকে মুক্তি লাভ করা কতটা সহজ। এভাবেই ইতিহাস জুড়ে কলোনিয়ালিজম আমাদের সবার মধ্যে হীনমন্যতা বীজ বপন করে গেছে। আমাদের দেহ সম্পর্কে আমরা যা বিশ্বাস করি তার বেশিরভাগই মার্কেটিং-এর ফলাফল, যা বিউটি ব্র্যান্ডগুলো শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করে থাকে।   

লেখক লিন্ডি উডহেড ওয়ার পেইন্ট বইয়ে কসমেটিক উদ্যোক্তা হেলেনা রুবেনস্টাইনের কর্মজীবন ডকুমেন্ট করেন। লিন্ডি লিখেন, ‘তিনিই প্রথম সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ যিনি ১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে ত্বককে ‘শুষ্ক,’ ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘তৈলাক্ত’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন এবং এই শ্রেণীবিভাগগুলোকে ব্যবহার করে তার ফেস ক্রিম ‘ভেলেজ’ বিক্রি করেছিলেন।  তখনই নারীরা তাদের ত্বকের স্বাভাবিক দিক যেমন বলিরেখা, দাগ, তৈলাক্ত ভাব, মৃত কোষ ইত্যাদি লক্ষ্য করতে শুরু করে এবং এগুলো ঠিক করার জন্য ক্রিম কিনতে শুরু করে।   

ঠিক একইভাব বর্তমান সময়ে চুলের যত্নের জন্য একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নয় বরং —সারপ্রাইজ! –পরামর্শ দেয় একজন মার্কেটার। ১৯৩৮ সালে লরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা ইউজিন শ্যুলার যখন এই ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু বের করেছিলেন, তখন তিনি একটি স্ট্যান্ডার্ড চালু করেছিলেন। টুঙ্গেটের ভাষ্যমতে ইউজিন শ্যুলার বলেন, ‘ফ্রান্সে ৪৩ মিলিয়ন মানুষ আছে। যদি এই ৪৩ মিলিয়ন মানুষ সপ্তাহে একবারও তাদের চুল ধোয়, তাহলে আমরা বর্তমানে বিক্রি করা ইউনিটের ২০ গুণ বিক্রি করব।’    

শ্যুলারের মার্কেটিং পদ্ধতি ছিল: ‘লোকদের বলুন তারা নোংরা, তাদের থেকে দুর্গন্ধ বের হয় আর তারা আকর্ষণীয় নয়।’  তবে এগুলো বলতে হবে খুব নম্রভাবে। মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশরের উপর ভিত্তি করেই বিউটি মার্কেটিং-এর গঠন। আর এই পদ্ধতি শুধুমাত্র পণ্য বিক্রির জন্য নয়, পিতৃতন্ত্র বজায় রাখার জন্যও আদর্শ।    

উলফ দ্য বিউটি মিথ-এ লিখেছেন, ‘নারীরা পুরুষের সংস্কৃতিতে নিছক ‘সুন্দরী’ যাতে সংস্কৃতিকে পুরুষ শাসিত রাখা যায়।’  তিনি যুক্তি দেন যে, নারীবাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ‘নারীদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র’  হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে যখন নারীবাদী আন্দোলন চলছিল ঠিক সেই সময়ে নারীদের চেহারার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। নারীবাদীদের বার্তাকে দুর্বল করার জন্য তাদেরকে ‘কুৎসিত’ হিসাবে স্টেরিওটাইপ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে মহিলাদের ম্যাগাজিনে ডায়েট নিয়ে আর্টিকেলের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে, জেরক্স একজন মহিলার ওজনের উপর ভিত্তি করে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছিল। ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশক জুড়ে আদালত ধারাবাহিকভাবে নারী কর্মচারীদের উপর চেহারার উপর ভিত্তি করে নীতি প্রয়োগ করেছে।  রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আইনগতভাবে একটাই বার্তা ছিল: বাইরের জগতে এবং কর্মক্ষেত্রে, উভয়ক্ষেত্রে  নারীদের মূল্য তাদের সৌন্দর্যের সমান।      

‘দেখতে সুন্দর লাগা’ কর্মজীবী নারীদের জন্য দ্বিতীয় জব হয়ে উঠেছিল — কিন্তু সৌন্দর্য কিছুক্ষেত্রে তাদের কর্মজীবনকে অগ্রসর করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য বাধা হয়ে রেনি এবেগেল, পিএইচডি, মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তার বিউটি সিক বইয়ে লেখেন, ‘আমরা সৌন্দর্যের জন্য ব্যয় করা সময় এবং অর্থের মধ্যে জেন্ডাররের ব্যবধান বিবেচনা করি না। কিন্তু সময় আর অর্থের মূল্য আছে। এগুলো হচ্ছে শক্তি, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার প্রধান উৎস।’ 

বিউটি ইন্ডাস্ট্রি সৌন্দর্যের সাধনাকে ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন হিসেবে রিব্র্যান্ডিং করে। যেমন ধরুন, ল’ওরিয়ালের বিখ্যাত স্লোগানটি  Because, I’m worth it, যা ১৯৭৩ সালে একজন পুরুষ কপিরাইটার দ্বারা লেখা হয়। টুঙ্গেট লিখেন, ‘এটা সেই সময়ের জন্য একটা আদর্শ অনুভূতি ছিল যখন নারীরা সমতার দাবি করছিল।’  ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে: অন্যের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করা থেকে নিজের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে চাওয়ার পরিবর্তন। এবেগেল যেমন বলেছেন, ‘আমরা এক সংস্কৃতি থেকে সরে—যেখানে আপনার শরীরকে পর্যবেক্ষণ করা হতো—এমন আরেক সংস্কৃতিতে এসেছি যেখানে আপনিই আপনার নিজের শরীরের পর্যবেক্ষক।’  অথবা লেখক গ্লেনন ডয়েল যেমন বলেছেন, ‘নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো নারীদের নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজি করানো।’     

আজ ‘আত্ম-ক্ষমতায়নের’ বার্তা নারীবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি বিকশিত হচ্ছে — কিন্তু ক্ষমতায়নের সকল মার্কেটিং হীনমন্যতাকে কেন্দ্র করেই হয়। (কর্পোরেশনগুলো ভোক্তাদের পণ্যের মাধ্যমে তখনই  ‘ক্ষমতায়ন’ করতে পারবে যখন ভোক্তারা পণ্য ছাড়া ক্ষমতাহীন হবে।) এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো Dove-এর রিয়াল বিউটির জন্য ২০০৪ সালের ক্যাম্পেইন, যেখানে মডেলদের পরিবর্তে সাধারণ নারীরা অংশগ্রহণ করে। টুঙ্গেটের মতে, যদিও এই সিরিজটি বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বিউটি মিডিয়া এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে, প্রাথমিক বিজ্ঞাপনের সাথে যে পণ্য জড়িত ছিল তা একটি স্কিন-ফার্মিং ক্রিম ছিল যা সেলুলাইট কমানোর দাবি করে।       

বলা দরকার যে, ত্বকে সেলুলাইট হওয়া প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর সত্যিটা আমাদের শরীরে যা যা পরিবর্তন করতে বলা হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা আমাদের ত্বককে ফর্সা বা কালো করার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের চুলের রঙ আর গঠন পরিবর্তন করি। আমরা বার্ধক্যকে থামাতে এবং  উল্টামুখী করতে চেষ্টা করি।  আমরা আমাদের পেট ও বাহু থেকে চর্বি নিয়ে সেটা স্তন এবং নিতম্বে যোগ করি। আমরা আমাদের পা এবং বগল থেকে চুল সরিয়ে সেগুলো আমাদের চোখের পাপড়ির জন্য ব্যবহার করি এবং আমাদের ভ্রুর হাড়ে উপর ট্যাটু করি।    

আমরা যে সৌন্দর্যকে আদর্শ বলে বিশ্বাস করি তা অর্জন করা শারীরিকভাবে অসম্ভব, তাই এর পেছনে যে সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয় তার কোনো শেষ নেই।

২০১৮ সালের টক্সিক বিউটির ডকুমেন্টারিয়ান ফিলিস এলিস টিন ভোগ-কে বলেন, ‘মূল উদ্দেশ্য হলো সবসময় পণ্য বিক্রি করা। যদি আমরা মনে করি বিউটি ইন্ডাস্ট্রি অন্য কিছু সম্পর্কে, এটা আমাদের ভুল ধারণা। কিন্তু সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষকে লজ্জিত করার ব্যাপারে আমি সংবেদনশীল এবং সচেতন। এটা মাস্কারা পরার জন্য কাউকে খারাপ বোধ করানোর বিষয় মাত্র না। বরং আমি যা জানতে বেশি আগ্রহী তা হচ্ছে কেন।’  

এই ‘কেন’-কে আমি প্রতি মাসে বিশ্লেষণ করব ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’-এ, যেখানে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের পচা শিকড়গুলোকে খুঁজে বের করে ছিঁড়ে ফেলা হবে আর ভালো কিছু পুনর্নির্মাণ করা হবে।   

এমন এক ইন্ডাস্ট্রি যা ক্ষমতায়ন বেচার করার নামে ইনসিকিউরিটির শিকার করে না।

সৌন্দর্যের এমন এক সংজ্ঞা যা পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে সুবিধাজনকভাবে মিল রাখে না। 

এমন এক বিশ্ব যেখানে ব্ল্যাক বিউটি ব্র্যান্ডের হেডলাইন তৈরি করার জন্য কালো বর্ণের নারী ও পুরুষদের হত্যা করা লাগে না।  

আমি বিশ্বাস করি, বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধ্বংস করা হচ্ছে মুক্তি, সমতা এবং সুস্থতার কাজ। নিজের ও  কমিউনিটির যত্ন নেওয়া। এটা আধ্যাত্মিক। রাজনৈতিক। অপরিহার্য। কারণ যখন বিউটি স্ট্যান্ডার্ড বদলাবে, তখন বিশ্বও বদলাবে।

[ ভোগ-এ প্রথম প্রকাশিত এই লেখাটি সেমসেম-এর জন্য অনুবাদ করেছেন ফাবিহা জাবিন]   

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।