হোয়াইট সুপ্রিমেসি ও ক্যাপিটালিজম যেভাবে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে প্রভাবিত করে

হ্যালো, আমার নাম জেসিকা ডিফিনো। আমি একজন বিউটি রিপোর্টার আর আমার উদ্দেশ্য হলো বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করা।  

একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল মনে হয়। তবে আমি যে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করতে চাই তা সত্যি। আর সেই প্রচেষ্টায় আমি টিন ভোগ-এর জন্য নতুন মাসিক কলাম ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’ লিখছি।   

আমার মতে বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে, বা বলা যায় সারা বিশ্বে, যত সমস্যা আছে তার মূলে রয়েছে বিউটি স্ট্যান্ডার্ড। এই বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধরে সেক্সিজম, বর্ণবাদ, শ্রেণীবাদ, বয়সবাদ, প্রতিবন্ধীদের প্রতি বৈষম্য এবং জেন্ডার ভিত্তিক অসমতাকে জোরাল করা হয়েছে। আমাদের সমাজে এই অবাস্তব স্ট্যান্ডার্ডগুলো তৈরি করে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছে। এই স্ট্যান্ডার্ডগুলোই আমাদের উদ্বেগ, ডিপ্রেশন, ডিসমরফিয়া, ইটিং ডিসঅর্ডার এবং আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভূমিকা রাখে। এমনকি ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কথাটা শুনলেই আমার বিরক্ত লাগে।  

মানে, ভাবুন তো, সৌন্দর্যের মতো অপরিমেয়, বায়বীয়, আবেগগত অথচ প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা একটি কনসেপ্টকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ডে সীমাবদ্ধ করার কথা? কেন? কী কারণে? কার জন্য?         

এইসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাকে ‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ কী সেটা নির্ধারণ করতে হবে। বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো আদর্শ  মেয়েলি সৌন্দর্যের যোগ্যতা যা নারীয়া ব্যক্তিগত এবং পেশাগত পর্যায়ে সফল হওয়ার জন্য পূরণ করবে বলে আশা করা হয়। (‘নারী’ এবং ‘মেয়েলি’ শব্দগুলি এখানে ব্যবহার করা হয়েছে কারণ বিউটি ইন্ডাস্ট্রি বাইনারির উপর ভিত্তি করে বানানো – যা পিতৃতন্ত্রকে সমর্থন করে এবং নারী, পুরুষ ও নন বাইনারি ব্যক্তিদের নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু সে আলাপ অন্য একটি কলামের জন্য।) এই যোগ্যতাগুলো প্রতিনিয়ত ফিল্ম, টেলিভিশন, সাহিত্য, ম্যাগাজিন, স্কুল সিস্টেম, চিকিৎসা ব্যবস্থা, রাজনীতি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সোশ্যাল মিডিয়া, আইন এবং বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাদের সামনে প্রদর্শন করা হচ্ছে। মনে হয় যেন আমাদের ব্রেইনওয়াশ করা হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানীদের যুক্তি অনুসারে, সমাজ আমাদেরকে যা সুন্দর বলে তা থেকে আমরা স্বতন্ত্রভাবে যা সুন্দর বলে মনে করি তা আলাদা করা অসম্ভব।       

‘বিউটি স্ট্যান্ডার্ড’ আর ‘আদর্শ মেয়েলি সৌন্দর্য’ উভয়ই চলমান নিশানা। এগুলো সময়ের সাথে সাথে এবং এক সংস্কৃতি থেকে আরেক সংস্কৃতিতে পরিবর্তিত হতে থাকে। তবে পশ্চিমা উপনিবেশের  বদৌলতে  ইউরোসেন্ট্রিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডই বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যের মান হয়ে উঠেছে। নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন ‘দ্য বিউটিওয়েল’ প্রজেক্টের প্রতিষ্ঠাতা, আমিরা আদাওয়ে টিন ভোগকে বলেন, ‘আফ্রিকায় আমার গবেষণার সময় আমি কসমেটিক ডিলারদের সাক্ষাৎকার নিই। তাদের মতে, আফ্রিকা এবং এশিয়া পশ্চিমাদের অনুসরণ করে থাকে। আমরা এখন আমেরিকায় যে বিউটি ট্রেন্ডগুলো দেখছি তিন বছরের মধ্যে তা আফ্রিকা এবং এশিয়ায় পৌঁছে যাবে।’ পশ্চিমা বিউটি স্ট্যান্ডার্ড হলো ক্যাপিটালিস্ট, কলোনিয়ালিস্ট, পুরুষতান্ত্রিক, সাদা আধিপত্যবাদী সমাজের পণ্য, যা তৈরি হয়েছে আমাদেরকে গ্রাস করে রাখার জন্য।    

নাওমি উলফ তার বই দ্য বিউটি মিথ -এ লিখেছেন, ‘বিউটি মিথের পক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো ঐতিহাসিক বা জৈবিক ব্যাখ্যা নেই।’  তিনি আরো উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সমাজের আদর্শগুলো যে সঙ্গী নির্বাচনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া থেকে এসেছে তারও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাননি নৃবিজ্ঞানীরা। 

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কালচারাল স্টাডিজের লেকচারার ড. হান্নাহ ম্যাকক্যান একমত জানিয়ে লেখেন, ‘যারা বলে যে সৌন্দর্য্যের সর্বজনীন আদর্শ আছে যা সবধরণের সংস্কৃতিকে ছাড়িয়ে যায় তারা এটা বুঝতে ব্যর্থ যে সৌন্দর্যের এই আদর্শগুলো বিক্রি করার উদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে।’  

সৌন্দর্যের কনসেপ্ট আমাদের মধ্যে সবসয়ই উপস্থিত ছিল – কিন্তু শুরুর দিকে সৌন্দর্যের ব্যাপারটা শারীরিক সম্পর্কে কম এবং আত্মার সাথে বেশি সম্পৃক্ত ছিল। সৌন্দর্যবিদ Władysław Tatarkiewicz বিশ্লেষণ করেন যে গ্রেকো-রোমানরা সৌন্দর্যকে কীভাবে ঐশ্বরিক এবং ভালোর সাথে সংযুক্ত করত। প্রাচীন মিশরীয় সৌন্দর্যেরও একটি আধ্যাত্মিক গুণ ছিল। মেকআপ তখন সাজসজ্জার এমন একটি রূপ ছিল যা দেবতাদের অনুকরণ এবং তাদের সাথে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করা হতো।  

মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের উত্থানের পর থেকে সৌন্দর্য এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সংযোগ যেন হারিয়ে যেতে শুরু করে। মার্ক টুংগেট তার বই ব্র্যান্ডেড বিউটি-তে লিখেছেন, ‘[নারীদের] উৎসাহিত করা হয়েছিল পবিত্র এবং কুমারী দেখাতে, যেন তারা চির-তরুণী!    

স্বর্ণকেশী, নীল নয়না এবং ফর্সা ত্বককে মানা হতো ‘ঈশ্বরের জ্যোতি’র মতো সুন্দরের প্রতীক হিসেবে।  অ্যাডাওয়ের মতে, ‘১৫ শতকের দিকে কলোনাইজাররা আফ্রিকা, এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় গিয়ে এই ধারণা প্রচার করে যে সাদা হওয়াই ভাল, সাদার চেয়ে সুন্দর আর কিছুই না। শুধুমাত্র সাদারাই অর্থনৈতিকভাবে ভালো ছিল, তাদের ভালো চাকরি আর শিক্ষা অর্জন ছিল।’  

চামড়ার রঙের সঙ্গে সমাজে শ্রেণী নির্ধারণের বিষয়টা জড়িত ছিল। প্রাচীন মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান সমাজে হালকা গায়ের রঙের মানুষদের উচ্চ শ্রেণীর অন্তর্গত করা হতো। কারণ হিসেবে টুঙ্গেট লিখেছেন, ‘নিশ্চয়ই ফর্সা চামড়ার একজন মহিলা ব্রোঞ্জ রঙের শ্রমিকের থেকে আলাদা জীবনযাপন করেছে।’  কিন্তু কলোনাইজাররা এই ধারণাটাকে সমস্ত জাতির মধ্যে প্রয়োগ করে।      

অ্যাডাওয়ে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাসত্বের সময় এই একই ধারণা অনুসরণ করা হয়েছিল। যারা কালো রঙের ছিল তারা বাইরে মাঠে কাজ করত। আর যাদের গায়ের রঙ ফর্সা ছিল, তারা বাড়িতে কাজ করত। ফর্সা ত্বকের মানুষেরা সুন্দর বলে বিবেচিত হতো আর এই ধারণাটি এখনও আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়ে গেছে।’ তিনি আরো বলেন যে কলোনাইজাররা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে চলে গেলেও, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, এই ধারণাটা রয়ে যায়। ‘কলোনাইজাররা চলে গেলেও তারা একটি উত্তরাধিকার রেখে গেছে: সাদাচামড়ার উত্তরাধিকার। এটি আমাদের মানসিকতার একটি চলমান উপনিবেশ।’  

উপনিবেশি এই মানসিকতা আজও টিকে আছে। এই মানসিকতা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের পাতায় প্রতিফলিত হয় যেখানে দেখা যায় প্রতিটি মুখ প্রায় একচেটিয়াভাবে সাদা। এমনকি মেকআপ ইন্ডাস্ট্রিতে ইনক্লুসিভ শেডস যোগ করার উপর ফোকাস থাকা সত্ত্বেও গায়ের সাদা রঙের জন্য ১০ ধরনের ফাউন্ডেশন শেড পাওয়া যায় আর কালো গায়ের রঙের জন্য মাত্র দুই ধরনের।  এই একই অবস্থা কসমেটিক কর্পোরেশনগুলোর, যারা এশিয়ায় গায়ের রঙ ফর্সা করার ক্রিম বিক্রি করছে — যদিও সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়ার কারণে এখন এই পণ্যগুলোর নাম কম বর্ণবাদী। 

অলঙ্করণঃ ঈহা

  

ক্যাপিটালিজমকে এভাবেই উপনিবেশ দারুণ এক ব্যবসায়িক মডেল উপহার দিয়েছে: এটি দেখিয়ে দিল, সারাজীবন অন্যের কাছে নিকৃষ্ট বোধ করা থেকে জন্মানো হীনমন্যতা থেকে মুক্তি লাভ করা কতটা সহজ। এভাবেই ইতিহাস জুড়ে কলোনিয়ালিজম আমাদের সবার মধ্যে হীনমন্যতা বীজ বপন করে গেছে। আমাদের দেহ সম্পর্কে আমরা যা বিশ্বাস করি তার বেশিরভাগই মার্কেটিং-এর ফলাফল, যা বিউটি ব্র্যান্ডগুলো শুধু অর্থ উপার্জনের জন্য তৈরি করে থাকে।   

লেখক লিন্ডি উডহেড ওয়ার পেইন্ট বইয়ে কসমেটিক উদ্যোক্তা হেলেনা রুবেনস্টাইনের কর্মজীবন ডকুমেন্ট করেন। লিন্ডি লিখেন, ‘তিনিই প্রথম সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ যিনি ১৯০০ এর দশকের প্রথম দিকে ত্বককে ‘শুষ্ক,’ ‘স্বাভাবিক’ এবং ‘তৈলাক্ত’ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছিলেন এবং এই শ্রেণীবিভাগগুলোকে ব্যবহার করে তার ফেস ক্রিম ‘ভেলেজ’ বিক্রি করেছিলেন।  তখনই নারীরা তাদের ত্বকের স্বাভাবিক দিক যেমন বলিরেখা, দাগ, তৈলাক্ত ভাব, মৃত কোষ ইত্যাদি লক্ষ্য করতে শুরু করে এবং এগুলো ঠিক করার জন্য ক্রিম কিনতে শুরু করে।   

ঠিক একইভাব বর্তমান সময়ে চুলের যত্নের জন্য একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নয় বরং —সারপ্রাইজ! –পরামর্শ দেয় একজন মার্কেটার। ১৯৩৮ সালে লরিয়ালের প্রতিষ্ঠাতা ইউজিন শ্যুলার যখন এই ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু বের করেছিলেন, তখন তিনি একটি স্ট্যান্ডার্ড চালু করেছিলেন। টুঙ্গেটের ভাষ্যমতে ইউজিন শ্যুলার বলেন, ‘ফ্রান্সে ৪৩ মিলিয়ন মানুষ আছে। যদি এই ৪৩ মিলিয়ন মানুষ সপ্তাহে একবারও তাদের চুল ধোয়, তাহলে আমরা বর্তমানে বিক্রি করা ইউনিটের ২০ গুণ বিক্রি করব।’    

শ্যুলারের মার্কেটিং পদ্ধতি ছিল: ‘লোকদের বলুন তারা নোংরা, তাদের থেকে দুর্গন্ধ বের হয় আর তারা আকর্ষণীয় নয়।’  তবে এগুলো বলতে হবে খুব নম্রভাবে। মনস্তাত্ত্বিক ম্যানিপুলেশরের উপর ভিত্তি করেই বিউটি মার্কেটিং-এর গঠন। আর এই পদ্ধতি শুধুমাত্র পণ্য বিক্রির জন্য নয়, পিতৃতন্ত্র বজায় রাখার জন্যও আদর্শ।    

উলফ দ্য বিউটি মিথ-এ লিখেছেন, ‘নারীরা পুরুষের সংস্কৃতিতে নিছক ‘সুন্দরী’ যাতে সংস্কৃতিকে পুরুষ শাসিত রাখা যায়।’  তিনি যুক্তি দেন যে, নারীবাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ায় আধুনিক বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ‘নারীদের অগ্রগতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অস্ত্র’  হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকে যখন নারীবাদী আন্দোলন চলছিল ঠিক সেই সময়ে নারীদের চেহারার পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। নারীবাদীদের বার্তাকে দুর্বল করার জন্য তাদেরকে ‘কুৎসিত’ হিসাবে স্টেরিওটাইপ করা হয়েছিল। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে মহিলাদের ম্যাগাজিনে ডায়েট নিয়ে আর্টিকেলের সংখ্যা ৭০ শতাংশ বেড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে, জেরক্স একজন মহিলার ওজনের উপর ভিত্তি করে চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছিল। ১৯৬০ এবং ৭০ এর দশক জুড়ে আদালত ধারাবাহিকভাবে নারী কর্মচারীদের উপর চেহারার উপর ভিত্তি করে নীতি প্রয়োগ করেছে।  রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং আইনগতভাবে একটাই বার্তা ছিল: বাইরের জগতে এবং কর্মক্ষেত্রে, উভয়ক্ষেত্রে  নারীদের মূল্য তাদের সৌন্দর্যের সমান।      

‘দেখতে সুন্দর লাগা’ কর্মজীবী নারীদের জন্য দ্বিতীয় জব হয়ে উঠেছিল — কিন্তু সৌন্দর্য কিছুক্ষেত্রে তাদের কর্মজীবনকে অগ্রসর করলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তাদের জন্য বাধা হয়ে রেনি এবেগেল, পিএইচডি, মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তার বিউটি সিক বইয়ে লেখেন, ‘আমরা সৌন্দর্যের জন্য ব্যয় করা সময় এবং অর্থের মধ্যে জেন্ডাররের ব্যবধান বিবেচনা করি না। কিন্তু সময় আর অর্থের মূল্য আছে। এগুলো হচ্ছে শক্তি, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার প্রধান উৎস।’ 

বিউটি ইন্ডাস্ট্রি সৌন্দর্যের সাধনাকে ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন হিসেবে রিব্র্যান্ডিং করে। যেমন ধরুন, ল’ওরিয়ালের বিখ্যাত স্লোগানটি  Because, I’m worth it, যা ১৯৭৩ সালে একজন পুরুষ কপিরাইটার দ্বারা লেখা হয়। টুঙ্গেট লিখেন, ‘এটা সেই সময়ের জন্য একটা আদর্শ অনুভূতি ছিল যখন নারীরা সমতার দাবি করছিল।’  ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে: অন্যের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করা থেকে নিজের জন্য সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে চাওয়ার পরিবর্তন। এবেগেল যেমন বলেছেন, ‘আমরা এক সংস্কৃতি থেকে সরে—যেখানে আপনার শরীরকে পর্যবেক্ষণ করা হতো—এমন আরেক সংস্কৃতিতে এসেছি যেখানে আপনিই আপনার নিজের শরীরের পর্যবেক্ষক।’  অথবা লেখক গ্লেনন ডয়েল যেমন বলেছেন, ‘নারীদের নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো নারীদের নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে রাজি করানো।’     

আজ ‘আত্ম-ক্ষমতায়নের’ বার্তা নারীবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি বিকশিত হচ্ছে — কিন্তু ক্ষমতায়নের সকল মার্কেটিং হীনমন্যতাকে কেন্দ্র করেই হয়। (কর্পোরেশনগুলো ভোক্তাদের পণ্যের মাধ্যমে তখনই  ‘ক্ষমতায়ন’ করতে পারবে যখন ভোক্তারা পণ্য ছাড়া ক্ষমতাহীন হবে।) এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো Dove-এর রিয়াল বিউটির জন্য ২০০৪ সালের ক্যাম্পেইন, যেখানে মডেলদের পরিবর্তে সাধারণ নারীরা অংশগ্রহণ করে। টুঙ্গেটের মতে, যদিও এই সিরিজটি বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য বিউটি মিডিয়া এবং ভোক্তাদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছে, প্রাথমিক বিজ্ঞাপনের সাথে যে পণ্য জড়িত ছিল তা একটি স্কিন-ফার্মিং ক্রিম ছিল যা সেলুলাইট কমানোর দাবি করে।       

বলা দরকার যে, ত্বকে সেলুলাইট হওয়া প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর সত্যিটা আমাদের শরীরে যা যা পরিবর্তন করতে বলা হয় তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা আমাদের ত্বককে ফর্সা বা কালো করার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের চুলের রঙ আর গঠন পরিবর্তন করি। আমরা বার্ধক্যকে থামাতে এবং  উল্টামুখী করতে চেষ্টা করি।  আমরা আমাদের পেট ও বাহু থেকে চর্বি নিয়ে সেটা স্তন এবং নিতম্বে যোগ করি। আমরা আমাদের পা এবং বগল থেকে চুল সরিয়ে সেগুলো আমাদের চোখের পাপড়ির জন্য ব্যবহার করি এবং আমাদের ভ্রুর হাড়ে উপর ট্যাটু করি।    

আমরা যে সৌন্দর্যকে আদর্শ বলে বিশ্বাস করি তা অর্জন করা শারীরিকভাবে অসম্ভব, তাই এর পেছনে যে সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয় তার কোনো শেষ নেই।

২০১৮ সালের টক্সিক বিউটির ডকুমেন্টারিয়ান ফিলিস এলিস টিন ভোগ-কে বলেন, ‘মূল উদ্দেশ্য হলো সবসময় পণ্য বিক্রি করা। যদি আমরা মনে করি বিউটি ইন্ডাস্ট্রি অন্য কিছু সম্পর্কে, এটা আমাদের ভুল ধারণা। কিন্তু সৌন্দর্য সম্পর্কে মানুষকে লজ্জিত করার ব্যাপারে আমি সংবেদনশীল এবং সচেতন। এটা মাস্কারা পরার জন্য কাউকে খারাপ বোধ করানোর বিষয় মাত্র না। বরং আমি যা জানতে বেশি আগ্রহী তা হচ্ছে কেন।’  

এই ‘কেন’-কে আমি প্রতি মাসে বিশ্লেষণ করব ‘স্ট্যান্ডার্ড ইস্যুজ’-এ, যেখানে বিউটি স্ট্যান্ডার্ডের পচা শিকড়গুলোকে খুঁজে বের করে ছিঁড়ে ফেলা হবে আর ভালো কিছু পুনর্নির্মাণ করা হবে।   

এমন এক ইন্ডাস্ট্রি যা ক্ষমতায়ন বেচার করার নামে ইনসিকিউরিটির শিকার করে না।

সৌন্দর্যের এমন এক সংজ্ঞা যা পিতৃতন্ত্রের সংজ্ঞার সাথে সুবিধাজনকভাবে মিল রাখে না। 

এমন এক বিশ্ব যেখানে ব্ল্যাক বিউটি ব্র্যান্ডের হেডলাইন তৈরি করার জন্য কালো বর্ণের নারী ও পুরুষদের হত্যা করা লাগে না।  

আমি বিশ্বাস করি, বিউটি স্ট্যান্ডার্ডকে ধ্বংস করা হচ্ছে মুক্তি, সমতা এবং সুস্থতার কাজ। নিজের ও  কমিউনিটির যত্ন নেওয়া। এটা আধ্যাত্মিক। রাজনৈতিক। অপরিহার্য। কারণ যখন বিউটি স্ট্যান্ডার্ড বদলাবে, তখন বিশ্বও বদলাবে।

[ ভোগ-এ প্রথম প্রকাশিত এই লেখাটি সেমসেম-এর জন্য অনুবাদ করেছেন ফাবিহা জাবিন]   

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।