আচ্ছা, একজন মানুষকে ‘সুন্দর’ বলতে গেলে কোন দিকগুলো আমরা বিবেচনা করি? সৌন্দর্যের মাপকাঠি আজকের দিনে যেমন, অতীতের দিনগুলোতেও তেমনই ছিলো- এমন ধারণা ভুল। নারী (কিংবা পুরুষের) ‘নিখুঁত’ অবয়বের সংজ্ঞা যুগে যুগে বদলেছে, যদিও বিবর্তনের ধারায় নারীর শারীরিক গঠনে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। কখনো নিজের দেহের গড়ন নিয়ে দ্বিধা বা সংকোচ হলে, তাই, মনে রাখবেন যে, ‘নিখুঁত’ দৈহিক গঠন একটি পরিবর্তনশীল ধারণা- যুগ আর প্রজন্মের সাথে সাথে বদলায় ‘আকর্ষণীয়’ দেহের সংজ্ঞা।
প্যালিওলিথিক যুগ
মানবজাতির ইতিহাসের একদম প্রথম দিকের একটি শিল্পচর্চার নিদর্শন হলো উইলেনডর্ফের ভেনাস (Venus of Willendorf), যা একটি আদিম নারীমূর্তি। খৃষ্টপূর্ব ২৪,০০০ থেকে ২২,০০০ সালের মাঝে নির্মিত এই নারীর অবয়ব—যা উর্বরতার প্রতীক হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিলো- দেখতে মোটেই বর্তমান যুগের মডেলদের মতো নয়। এই নারীর আদলকে কোন রাকঢাক না করেই সরাসরি স্থূল বলা যায়। স্ফীত বক্ষযুগল, চওড়া নিতম্ব আর মেদবহুল উদরের এই মূর্তি দেখে ধারণা করা যায়, অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য উপযোগী দেহই ছিলো সে যুগের আকর্ষণীয় নারীদেহের পূর্বশর্ত। প্রতিমাটি নির্মাণের সময় এর চোখ, ঠোঁট কিংবা মুখাবয়ব নিয়ে কোন কাজই করা হয় নি, মনে হতে পারে- কারিগরের চোখ মুখ নিয়ে কোন মাথাব্যাথাই ছিলো না। তবে স্বাভাবিকভাবেই সে যুগে নারী কিংবা পুরুষ- কারো জন্যই ক্ষীণকায় দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো না। বেঁচে থাকতে হলে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কোন বিকল্প ছিলো না। তাই মুখাবয়বের সৌন্দর্য নিয়ে কারো মাথাব্যাথা ছিলো না। কারণ সুন্দর চোখের ঝলক দেখিয়ে আর যাই হোক- হিংস্র সিংহের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব ছিলো না, দরকার ছিলো পেশীর জোর।
শিল্প যে সবসময় বাস্তবের মতোই হতে হবে, এমন কোন দায়িত্ব শিল্পীর ঘাড়ে থাকে না। উইলেনডর্ফের ভেনাস যে সমসাময়িক নারী আদলের নির্ভুল প্রতিকৃতি- এমনটি আশা করা ভুল। তবুও, ২৫০০০ বছর আগে সুডৌল আর স্বাস্থ্যবান নারীদেহই ছিল কামনীয়- এই ধারণার প্রমাণ পাওয়াই যায়।
প্রাচীন গ্রিস
গ্রিকরা আক্ষরিক অর্থেই সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়ন করছিলো। প্রাচীন গ্রিসে নারীদের সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রীক সাহিত্যিক হেসিয়ডের (খৃষ্টপূর্ব ৮-৭ শতক) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম নারীর সৃষ্টি হয়েছিলো ‘কালন কাকন’ (Kalon Kakon) রূপে, যার মানে হলো ‘অশুভ-সুন্দর’। সুন্দর বলেই প্রথম নারী ছিল অশুভ, আর অশুভ বলেই প্রথম নারী ছিলো সুন্দর।’ তবে কি সেই যুগে পুরুষের সৌন্দর্য ছিলো সৌভাগ্য, আর নারীর সৌন্দর্য অলুক্ষুণে ব্যাপার? হতেও পারে! প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্যগুলোতে নারীদের যেই আদর্শ আদল শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়া হয়েছিলো- সেখানে তাদের চওড়া কোমর, ভরাট স্তন আর কিছুটা মেদযুক্ত উদরের অধিকারী দেখানো হতো। তবে গ্রীকরা সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বের করার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে ছিলোঃ তারা আবেদনময়তার অঙ্ক বের করার সংকল্প নিয়েছিলো।
গোল্ডেন রেশিও বা সোনালী অনুপাতের ধারণাটি প্লেটোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেলেও এটি মূলত তার সহকর্মী পীথাগোরাসের মস্তিষ্কপ্রসূত (হ্যাঁ, জ্যামিতি বইয়ের সেই পীথাগোরাস)। প্রকৃতি কিংবা মানুষের মুখাবয়ব- সবখানেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে বেছে নেয়া হয় গোল্ডেন রেশিওকে। এই গোল্ডেন রেশিওর হিসেবে একজন নারীর চেহারা তখনই সুন্দর বলা যাবে, যখন তার মুখের প্রস্থ তার দৈর্ঘ্যের দুই-তৃতীয়াংশ হবে, এবং মুখমন্ডলের দুইটি দিকেই প্রতিসমতা থাকবে। এই প্রতিসম মুখমন্ডল সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়। ‘আজ দেখতে ভালো না বলে…’- এরকম হতাশা যদি আপনার থাকে, তাহলে পীথাগোরাসকেই দোষারোপ করতে পারেন!
রেনেসাঁ যুগের প্রাথমিক পর্যায়
মধ্যযুগের প্রচলিত রক্ষণশীল চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো রেনেসাঁ যুগের শিল্পীরা। ১৩০০ থেকে ১৫০০ খৃষ্টাব্দে চলমান রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে নগ্ন বক্ষের নারীদের দেখা যেত উর্বরতা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে।
রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত শিল্পী রাফায়েলের চিত্রকর্মে নারীদের আদর্শ অবয়ব ছিলো সুডৌল, কিছুটা ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণের, এবং তাদের মুখ গোলগাল নরম আর রক্তিম আভায় রাঙানো। রাফায়েল নিজেই বলেছিলেন, তার ছবিতে তিনি বাস্তব নারীর আদলে আঁকেন নি, বরং তার কল্পনায় সুন্দর নারী যেমন ভাবতেন- তেমন করেই এঁকেছেন। অনেক চিত্রশিল্পী এমন স্টাইলেই ছবি আঁকতেন। রেনেসাঁ যুগ শৈল্পিক ধারায় এক নতুন যুগ ছিলো, যেখানে নারীদের নিছক জন্মদাত্রীর বদলে কামনা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।
এলিজাবেথীয় যুগ
রানী এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৮ সালে, আর তখন থেকেই শুরু হয় মেকআপ ব্যবহারের সূচনা। সেই আমলে মুখে মেকআপ করা নারীদের মনে করা হতো ‘শয়তানের অবতার’। আর এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন রানী এলিজাবেথ- মুখে সাদা মেকআপ আর তার বিখ্যাত ঠোঁটে লাল রং মেখে। বলা চলে, তার এই মেকআপের কারণেই সে আমলে পুরো ট্রেন্ড বদলে যায়। সেই যুগে সাদা আর ফ্যাকাশে গায়ের রং ছিলো সামাজিক উচ্চতার প্রতীক, কারণ অভিজাত শ্রেণী ঘরে বসেই জীবনযাপন করার বিলাসিতা করতে পারতো। রোদে পুড়ে তামাটে হওয়া গায়ের রংকে ধরা হতো দারিদ্রের লক্ষণ, খেটে খাওয়া মানুষের পরিচয়।
নিজের কুমারী ও রাজকীয়তার পরিচয় দিতে (পরবর্তীতে নিজের গুটিবসন্তের দাগ লুকাতে) রানী এলিজাবেথ মুখে সাদা সীসার পাউডার মাখতেন, এবং ঠোঁট রাঙাতেন লাল রঙে। তার এই ট্রেন্ড অনুসরণ করতে শুরু করে অভিজাত সমাজ, এমনকি সংবাদপত্রে বলা হতো যে ঠোঁটে লিপস্টিক জাদুর মতো কাজ করে- এমনকি মৃত্যুকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। নিয়তির পরিহাসই হয়তো বলা যায়, মৃত্যুর সময় রানীর ঠোঁট রাঙানো ছিলো আধ-ইঞ্চি লাল রঙের প্রলেপে।
অলঙ্করণঃ রাজিব
ফরাসী বিপ্লব-পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে ১৮ শতকের শেষভাগ
১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে মানুষ অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সকল প্রতীক থেকে সরে আসতে চেয়েছিলো। অতিরিক্ত মেকআপের বদলে তখন অনাড়ম্বর প্রসাধনই বেশি প্রচলিত হওয়া শুরু করে, অভিজাতদের বিশাল ফোলানো গাউনের পরিধিও ছোট হয়ে আসতে শুরু করে।
ফরাসী বিপ্লবের আগে মেকআপ ছিলো নারী-পুরুষ সবার প্রসাধন। কিন্তু এই বিপ্লবের পর থেকেই কৃত্রিমতা হয়ে উঠে ঘৃণ্য একটি ধারণা, যার কারনে হালকা প্রসাধনের ‘ন্যাচারাল লুক’-এর প্রতি সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু উনবিংশ শতক থেকে বিপ্লবের স্মৃতি ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে, নারীদের মাঝে আবার মেকআপের আধিক্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
এ নিয়ে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, বারবনিতারা মেকআপ আর পোশাকের মুন্সিয়ানা দেখাতো মূলত পুরুষের মন জয় করতে। কিছু কিছু অভিজাত নারী রীতিমতো আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের অনাবৃত হওয়ার প্রদর্শনীর আয়োজন করতো দর্শনার্থীদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের কাছে এই ট্রেন্ড যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলো। তবে পুরুষদের মেকআপ করার রীতির প্রচলন তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি, এটি নারীর ভূ্যণ হিসেবেই তকমা পেয়ে যায়। নারীদের সৌন্দর্যবর্ধন আর আবেদনময়ী হিসেবে দেখানোতেই প্রসাধন ব্যবহার করা হতো বেশি।
ভিক্টোরিয়ান যুগ
১৮৩৭ সালে যখন রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন, ব্রিটিশ লাইব্রেরির রিপোর্টের মতে, সেই আমলে পরিমিতিবোধই ছিলো সৌন্দর্যের প্রতীক। আর বিবিসির বর্ণনায় জানা যায়, সেই যুগে ঘরে বসে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার মাঝেই নারীদের জীবনের পরিপূর্ণতা নিহিত ছিলো বলে ভাবা হতো। শক্ত-সামর্থ্য নারীদের চেয়ে যেন ক্ষীণ, দুর্বলতাই ছিলো নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্যের প্রতীক। শিল্পী এবং গবেষক এলেক্সিস কার্ল বলেন, ‘নারীদের ক্ষীণকায়ার মাঝেই প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায় বলে ধারণা করা হতো।’ কে জানতো, রোগা আর শীর্ণ দেহও আবেদনের প্রতীক হিসেবে ভাবা যেতে পারে?
সেই যুগে মেকআপের সামগ্রী ব্যবহার করাও ছিলো বিপদজনক ব্যাপার। সীসা, এমোনিয়া, পারদ আর নাইটশেডের মতো বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করা হতো প্রসাধনে, এগুলো বিপদজনক- এ কথা জানা সত্ত্বেও তারা এসব ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য বাড়াতে বিষাক্রান্ত হতেও অনীহা ছিলো না ভিক্টোরিয়ান যুগের নারীদের। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নমনীয় নারীদের মাঝেই এই ট্রেন্ড ফলো করার ঝোঁক ছিলো বেশি, তবে সব নারী আবার শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য মৃত্যুবরণ করতে রাজি ছিলো না।
বিশ শতকের শুরুতে
১৮৯০ সালে জনপ্রিয়তা পায় চার্লস গিবসনের আঁকা ‘গিবসন গার্ল’ ছবিটি, যা ছিলো সেই আমলের সুন্দর নারীর সংজ্ঞা। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত সেই চিত্রকর্মের নারীর মতোই হতে চেষ্টা করতো অনেক নারী। গিবসনের এই ছবিতে ফর্সা রঙের এই মেয়েটির পরিধান ছিলো আঁটসাঁট করসেট, যার ভাঁজ থেকে দেহের গড়নও স্পষ্ট দেখা যেতো।
চওড়া কটি, নরম এবং সুডৌল গঠন তখনও সবার আকাঙ্ক্ষিত ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ হলেও সেই আমল থেকেই শুরু হয় কিছুটা সরু গঠনের দেহের জনপ্রিয়তা। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি। তবে ঘুরেফিরে সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি এসেছিলো একজন পুরুষের কল্পনা থেকেই, কোন সত্যিকারের নারীদেহের উপর ভিত্তি করে আসে নি।
এভেলিন নিসবেট। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি।
১৯২০-এর দশক
১৯১০-এর দশকের পরপর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর তখন অনেক নারীই পুরুষের সাথে সমান তালে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া শুরু করে। আর যুদ্ধের পর তারা তাদের এই স্বাধীনতার স্বাদ ভুলে যায় নি। ১৯২০-এর দশকে পশ্চিমা নারীরা ভোট দেয়ার অধিকার অর্জন করে, এবং এতদিন ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেয়া সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড বর্জন করা শুরু করে তারা। কিছুটা সংক্ষিপ্ত পোশাক আর ছোট চুলের একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, আর যেসব নারী এমন ট্রেন্ড অনুসরণ করতেন, তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় ফ্ল্যাপারস (Flappers) বলে। প্রথমবারের মতো সুডৌল দেহাবয়বের বদলে একহারা গড়নকে নিজেদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে তারা। ছোট চুলকে বেশ ফ্যাশনেবল বলেই মনে করা হতো।
স্কার্টের পাশে থাকা হেমলাইন বা চিরের উচ্চতা তখন অনেকটা বেড়ে যায়, যাতে করে নারীরা আরও বেশি স্বাচ্ছ্যন্দে চলাফেরা করতে পারতো, মনের আনন্দে নাচতে চাইলে পা বেঁধে যেত না স্কার্টের ঘেরে। তবে এই আমলের একটি নেতিবাচক দিক হলো, একহারা সরু দেহের এই ট্রেন্ড নারীদের দেহের মেদ আর প্রস্থ নিয়ে অনেকটা হীনমন্যতায় ফেলে দেয়। ১৯২০-এর দশকের আগে নিজের ওজন মাপা একটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো, এমনকি পুরো দেহ দেখা যায় এমন আয়না বিলাসী দ্রব্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। সেই সময়ের আগে শুধু ধনীরাই নিজেদের পুরো অবয়ব আয়নায় দেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এই ১৯২০-এর দশকে দেহের ওজন মাপার মেশিন হয়ে যায় সহজলভ্য, চাইলেই যে কেউ কিনে তার বাথরুমে রেখে দিতে পারতো। আর নিজের ওজন কতো, বেড়ে গেল কিনা- এমন ভাবনা বিভোর করে রাখতো সে সময়ের নারীদের। আর সে সময় অলিতে গলিতে গড়ে উঠতে শুরু করে অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর- যেখানে চাইলেই নারীরা নিজেদের পুরো আকার দেখতে পেতেন লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আর নিজেদের এই প্রতিচ্ছবিতে নিজ দেহের খুঁতগুলোই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে তাদের চোখে ধরা দিতো। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিলো নারীদের ‘বডি অবসেশন’।
তিরিশ ও চল্লিশের দশক
১৯২০-এর দশকের শেষদিকে শুরু হয় ‘মহামন্দা’র যুগ। তখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ফ্যাশন নিয়ে ভাবনার সুযোগ তেমন ছিলো না। বেশিরভাগ নারীই আগের দশকের একহারা গড়নের এই ফ্যাশন নিয়ে ভাবা ভুলে যায়, আর তখনকার আমলে ভরাট নারীদেহই বেশি প্রচলিত হতে শুরু করে।
যুদ্ধ ও অন্যান্য দুঃসময়ে অভাব নারীদেরকে নিজেদের পোশাক নিয়ে আরও সৃজনশীল হতে বাধ্য করে। পুরুষের পুরোনো স্যুট কেটে নারীরা নিজেদের পোশাক বানানো শুরু করে তখন। চওড়া কাঁধ আর সরু কোমরে অনেকটা বালুর ঘড়ির মতো আদল নারীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যেহেতু এর আগের বছরগুলোতে অভাবের দুঃসময় কাটিয়ে আসতে হয়েছে, কেউ আর শীর্ণ দেহে নিজেকে দেখতে চাইতো না, কারণ তা বিগত অভাবের দিনের কথাই মনে করিয়ে দিতো। তাই বলে ১৯১০-এর দশকের গিবসন গার্লের মতো সুডৌল গড়ন হতে হবে- এমনটাও কেউ আশা করতো না।
পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের শুরুর বছরগুলো
এই সময়টিতে গ্রেট ডিপ্রেশন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করেছিলো সবাই। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, এই সময় ধনী হতে শুরু করে। সবার মাঝেই কাজ করতো ফুর্তির মেজাজ, আর সেখান থেকেই আরেকটু ভরাট দেহ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, ৫০’এর দশকের আবেদনময়ী নারীদেরকে আজকের যুগে ‘প্লাস সাইজ’ হিসেবে ধরা হবে। যদিও একালের মডেলদের তুলনায় তাদেরকে সামান্য ভারী বলা যায়, সিনেমার তারকা অভিনেত্রীরা কিন্তু বেশ ছিপছিপে গড়ন অধিকারী ছিলেন। তথ্যমতে, সে আমলে বেশিরভাগ রূপালি পর্দার নারীদের বিএমআই ছিলো ১৮.৮ থেকে ২০.৫ এর মাঝামাঝি, যা গড়পড়তা নারীদের ২৩.৬ মাত্রার চেয়ে বেশ কম ছিলো। তাই আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ভরাট গড়নের দেহকেই নারীদের জন্য আদর্শ বলা হলেও, সাধারণ নারীদের দেহের গড়নের সাথে এই মাপকাঠির ভালো রকমের অসামঞ্জস্যতা ছিলো বলা যায়। এই দশকের একটি নিউজরিলে দেখা যায়, আমেরিকার একটি শহরে আয়োজিত হয়েছিলো ‘মিস ফ্যাট অ্যান্ড বিউটিফুল’ প্রতিযোগিতা। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন আয়োজন করে কোন নারীকে ‘মোটা’ উপাধি দেয়া হচ্ছে- এমন কথা কল্পনাই করা যায় না। আর সেই ৫০’এর দশকের এই প্রতিযোগিতায় যেসব নারী অংশ নিয়েছিলেন, বর্তমান যুগের স্ট্যান্ডার্ডে স্থুল হিসেবে বিবেচনাও করবে না কেউ! এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ছিপছিপে দেহ অনেক দিন ধরেই ছিলো নারীদের জন্য আরাধ্য বিষয়।
৬০ এর দশকের শেষ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত
ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও জীবনধারায় পরিবর্তন আসা শুরু করে। বাড়ি গাড়ি পেয়ে ঘরে বসে থাকা গৃহিণীর জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলো না পশ্চিমের নারীরা। ৫০’এর দশকের রক্ষণশীল জীবনধারার বাইরে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো সে সময়ের তরুণেরা। এই যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ছিলো টুইগি- আর তা থেকেই বোঝা যায়, ছিপছিপে একহারা গড়ন আবার হয়ে উঠে ফ্যাশনেবল।
সত্তরের দশকে নারী স্বাধীনতার স্রোত আরও জোরে বইতে শুরু করলেও, পাতলা গড়নের প্রতি মোহ তখনও চলমান ছিলো। টুইগির চেয়ে ফারাহ ফসেটের গড়ন সামান্য চওড়া হলেও দিনশেষে তিনিও ছিলেন ক্ষীণ গড়নের একজন নারী- আর তিনি ছিলেন এই সত্তরের দশকে সবচেয়ে আবেদনময়ী একজন নারী। মেকআপ আর ফ্যাশনে প্রাধান্য পেত ‘ন্যাচারাল লুক’। ষাটের দশকে যেমন প্রকট সব ফ্যাশন ট্রেন্ড চালু হয়েছিলো, এই দশকে তেমনটি ছিলো না। নারীদের মধ্যে লম্বা চুল খোলা রেখে দেয়ার প্রবণতাই ছিলো বেশি।
আশির দশক নিয়ে আসে ‘সুপারমডেল’-দের যুগ। তামাটে, লম্বা, পাতলা কিন্তু সুগঠিত দেহই ছিলো নারীদের ‘আদর্শ’ দেহের আদল। ক্ষীণকটি কিন্তু ভরাট বক্ষযুগলবিশিষ্ট দেহ তখনও ছিলো আবেদনময়তার মাপকাঠি। অভিনেত্রীদের দেখে নয়, বরং মডেলদের ফ্যাশন আর দেহের গড়ন দেখেই সেই সময়ের নারীরা বেশি অনুপ্রাণিত হতেন। যদিও গড়পড়তা নারী আর ফ্যাশন মডেলের দেহের প্রস্থে ছিল বিস্তর ফারাক!
চিকন দেহের এই প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায় ৯০’এর দশকে। ব্রিটিশ মডেল ‘কেট মস’-এর গড়ন সেই ষাটের দশকে ক্ষীণদেহের জন্য বিখ্যাত মডেল ‘টুইগি’কেও প্রায় হার মানিয়ে দিয়েছিলো। কেট মসের বিএমআই ছিলো মাত্র ১৬, আর তার মাধ্যমেই এই দশকে ‘হিরোইন শিক’ বা হাড্ডিচর্মসার গড়নের ট্রেন্ড জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মজার ব্যপার হলো, ৯০’এর দশক আর ভিক্টোরিয়ান যুগের মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল আছে- তা হলো এই দুই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রীদের সাথে তুলনীয় দেহের গড়নকে সুন্দর বলে ধরা হতো! ভগ (vogue) ম্যাগাজিনের পাতা ঘেঁটে বলাই যায়, আদর্শ নারীদেহের গড়ন সবচেয়ে বেশি সরু ছিলো এই নব্বইয়ের দশকেই।
‘নিখুঁত’ মানে আসলে কী?
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করছি যখন গণমাধ্যমে জাতি কিংবা গড়ন নির্বিশেষে সৌন্দর্যের প্রশংসা করা হয়- যদিও আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। ২০১৭ সালে ‘নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উয়িক’ শুরু হওয়ার আগে আমেরিকার ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাউন্সিল সকল ডিজাইনারের কাছে একটি বার্তা পাঠায়- যেখানে তারা ডিজাইনারদের মনে করিয়ে দেয় ‘নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করে নানা জাতির নানা গড়নের বৈচিত্র্যময় সব মানুষ। আমরা চাই আমাদের এই আয়োজনে এই বৈচিত্র্যের উদযাপন হোক।’ তার জন্যেই তারা ডিজাইনারদের উৎসাহিত করেছিলো বিভিন্ন গড়ন আর জাতির মডেলদের সাথে কাজ করতে।
এও মনে রাখা দরকার যে ইতিহাস জুড়ে আমরা বেশিরভাগ সময়েই নারীর যেই ‘আদর্শ’ গড়নের রূপ দেখেছি- তা এসেছে কোন পুরুষের কল্পনা থেকেই। বর্তমানে ফটোশপ করার প্রবণতাও যেন সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশাই প্রতিষ্ঠা করছে। ফটোশপের ডিজিটাল জাদু দিয়ে অসম্ভব বডি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেয়া হচ্ছে- যা বাস্তবে কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। কল্পনার নারীদেহের অবয়ব কিংবা ডিজিটালি বদলে দেয়া ছবির মতো দেহ বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিবর্জিত। সময়ের সাথে স্ট্যান্ডার্ড যে বদলেই চলেছে, তা হয়তো এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি। তাই ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ আসলে একটি ক্ষনস্থায়ী ব্যাপার, সময়ের সাথে বদলেই চলবে।
হতে পারে এ সময়ের মাপকাঠিতে আপনার দেহ ‘আদর্শ’ নয়, তাতে কী আসে যায়? ‘নিখুঁত’ বা ‘আদর্শ’ হচ্ছে একটি রূপকথা, যা বাস্তবের সাথে কখনোই মিলবে না। সে কারণেই নিজের এই খুঁতে ভরা সুন্দর দেহটিকে নিয়েই চলুন খুশি থাকি, জীবনের উৎসবে মেতে থাকি।
[নর-নারীর সৌন্দর্য যে স্থিরনির্দিষ্ট কিছু নয়, যুগের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত– এটি কমবেশি আমরা সবাই জানি। বর্তমান লেখাটিতে ‘পার্ফেক্ট’ নারীদেহের গড়ন বিষয়ে মূলত পাশ্চাত্যের ধারণা রূপান্তরশীল ইতিহাসের কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই সৌন্দর্যবোধ প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই ভিন্ন। সেমসেম- এ পরবর্তীতে নারী-পুরুষের প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধ নিয়েও ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হবে। — সম্পাদক ]
ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’
[elementor-template id="1854"]
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।
আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।
আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে। পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।
একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য। আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে। কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর।
নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়।
মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন – ‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক।
মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।
মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’
পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।
পুঁজির একনায়কতন্ত্র
কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।
ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে।
কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো- কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব।
যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।
পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।
সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ, উৎপাদন যখন অবস্তুগত হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।
বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান।
নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব।
বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।
অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় ।
আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে।
ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।
আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়? ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়।
আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’
নজরদারী স্বৈরাচার
শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।
কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর।
তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।
বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।
গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা। তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই।
যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়।
স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়। এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।
নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।
বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই।
স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।
স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’
এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।
সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।
লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে।
আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ। কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।
যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো- সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি।
স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।