আচ্ছা, একজন মানুষকে ‘সুন্দর’ বলতে গেলে কোন দিকগুলো আমরা বিবেচনা করি? সৌন্দর্যের মাপকাঠি আজকের দিনে যেমন, অতীতের দিনগুলোতেও তেমনই ছিলো- এমন ধারণা ভুল। নারী (কিংবা পুরুষের) ‘নিখুঁত’ অবয়বের সংজ্ঞা যুগে যুগে বদলেছে, যদিও বিবর্তনের ধারায় নারীর শারীরিক গঠনে তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। কখনো নিজের দেহের গড়ন নিয়ে দ্বিধা বা সংকোচ হলে, তাই, মনে রাখবেন যে, ‘নিখুঁত’ দৈহিক গঠন একটি পরিবর্তনশীল ধারণা- যুগ আর প্রজন্মের সাথে সাথে বদলায় ‘আকর্ষণীয়’ দেহের সংজ্ঞা।
প্যালিওলিথিক যুগ
মানবজাতির ইতিহাসের একদম প্রথম দিকের একটি শিল্পচর্চার নিদর্শন হলো উইলেনডর্ফের ভেনাস (Venus of Willendorf), যা একটি আদিম নারীমূর্তি। খৃষ্টপূর্ব ২৪,০০০ থেকে ২২,০০০ সালের মাঝে নির্মিত এই নারীর অবয়ব—যা উর্বরতার প্রতীক হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিলো- দেখতে মোটেই বর্তমান যুগের মডেলদের মতো নয়। এই নারীর আদলকে কোন রাকঢাক না করেই সরাসরি স্থূল বলা যায়। স্ফীত বক্ষযুগল, চওড়া নিতম্ব আর মেদবহুল উদরের এই মূর্তি দেখে ধারণা করা যায়, অধিক সন্তান জন্মদানের জন্য উপযোগী দেহই ছিলো সে যুগের আকর্ষণীয় নারীদেহের পূর্বশর্ত। প্রতিমাটি নির্মাণের সময় এর চোখ, ঠোঁট কিংবা মুখাবয়ব নিয়ে কোন কাজই করা হয় নি, মনে হতে পারে- কারিগরের চোখ মুখ নিয়ে কোন মাথাব্যাথাই ছিলো না। তবে স্বাভাবিকভাবেই সে যুগে নারী কিংবা পুরুষ- কারো জন্যই ক্ষীণকায় দেহ নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিলো না। বেঁচে থাকতে হলে শারীরিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার কোন বিকল্প ছিলো না। তাই মুখাবয়বের সৌন্দর্য নিয়ে কারো মাথাব্যাথা ছিলো না। কারণ সুন্দর চোখের ঝলক দেখিয়ে আর যাই হোক- হিংস্র সিংহের আক্রমণ ঠেকানো সম্ভব ছিলো না, দরকার ছিলো পেশীর জোর।
শিল্প যে সবসময় বাস্তবের মতোই হতে হবে, এমন কোন দায়িত্ব শিল্পীর ঘাড়ে থাকে না। উইলেনডর্ফের ভেনাস যে সমসাময়িক নারী আদলের নির্ভুল প্রতিকৃতি- এমনটি আশা করা ভুল। তবুও, ২৫০০০ বছর আগে সুডৌল আর স্বাস্থ্যবান নারীদেহই ছিল কামনীয়- এই ধারণার প্রমাণ পাওয়াই যায়।
প্রাচীন গ্রিস
গ্রিকরা আক্ষরিক অর্থেই সৌন্দর্যের সংজ্ঞায়ন করছিলো। প্রাচীন গ্রিসে নারীদের সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা পাওয়া যায় গ্রীক সাহিত্যিক হেসিয়ডের (খৃষ্টপূর্ব ৮-৭ শতক) লেখায়। তিনি লিখেছেন, ‘প্রথম নারীর সৃষ্টি হয়েছিলো ‘কালন কাকন’ (Kalon Kakon) রূপে, যার মানে হলো ‘অশুভ-সুন্দর’। সুন্দর বলেই প্রথম নারী ছিল অশুভ, আর অশুভ বলেই প্রথম নারী ছিলো সুন্দর।’ তবে কি সেই যুগে পুরুষের সৌন্দর্য ছিলো সৌভাগ্য, আর নারীর সৌন্দর্য অলুক্ষুণে ব্যাপার? হতেও পারে! প্রাচীন গ্রীক ভাস্কর্যগুলোতে নারীদের যেই আদর্শ আদল শিল্পীর ছোঁয়ায় গড়া হয়েছিলো- সেখানে তাদের চওড়া কোমর, ভরাট স্তন আর কিছুটা মেদযুক্ত উদরের অধিকারী দেখানো হতো। তবে গ্রীকরা সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বের করার চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে ছিলোঃ তারা আবেদনময়তার অঙ্ক বের করার সংকল্প নিয়েছিলো।
গোল্ডেন রেশিও বা সোনালী অনুপাতের ধারণাটি প্লেটোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেলেও এটি মূলত তার সহকর্মী পীথাগোরাসের মস্তিষ্কপ্রসূত (হ্যাঁ, জ্যামিতি বইয়ের সেই পীথাগোরাস)। প্রকৃতি কিংবা মানুষের মুখাবয়ব- সবখানেই সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে বেছে নেয়া হয় গোল্ডেন রেশিওকে। এই গোল্ডেন রেশিওর হিসেবে একজন নারীর চেহারা তখনই সুন্দর বলা যাবে, যখন তার মুখের প্রস্থ তার দৈর্ঘ্যের দুই-তৃতীয়াংশ হবে, এবং মুখমন্ডলের দুইটি দিকেই প্রতিসমতা থাকবে। এই প্রতিসম মুখমন্ডল সৌন্দর্যের মাপকাঠি হিসেবে আজও বিবেচিত হয়। ‘আজ দেখতে ভালো না বলে…’- এরকম হতাশা যদি আপনার থাকে, তাহলে পীথাগোরাসকেই দোষারোপ করতে পারেন!
রেনেসাঁ যুগের প্রাথমিক পর্যায়
মধ্যযুগের প্রচলিত রক্ষণশীল চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো রেনেসাঁ যুগের শিল্পীরা। ১৩০০ থেকে ১৫০০ খৃষ্টাব্দে চলমান রেনেসাঁ যুগের চিত্রকর্মে নগ্ন বক্ষের নারীদের দেখা যেত উর্বরতা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে।
রেনেসাঁ যুগের প্রখ্যাত শিল্পী রাফায়েলের চিত্রকর্মে নারীদের আদর্শ অবয়ব ছিলো সুডৌল, কিছুটা ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণের, এবং তাদের মুখ গোলগাল নরম আর রক্তিম আভায় রাঙানো। রাফায়েল নিজেই বলেছিলেন, তার ছবিতে তিনি বাস্তব নারীর আদলে আঁকেন নি, বরং তার কল্পনায় সুন্দর নারী যেমন ভাবতেন- তেমন করেই এঁকেছেন। অনেক চিত্রশিল্পী এমন স্টাইলেই ছবি আঁকতেন। রেনেসাঁ যুগ শৈল্পিক ধারায় এক নতুন যুগ ছিলো, যেখানে নারীদের নিছক জন্মদাত্রীর বদলে কামনা ও বাসনার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।
এলিজাবেথীয় যুগ
রানী এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৮ সালে, আর তখন থেকেই শুরু হয় মেকআপ ব্যবহারের সূচনা। সেই আমলে মুখে মেকআপ করা নারীদের মনে করা হতো ‘শয়তানের অবতার’। আর এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেন রানী এলিজাবেথ- মুখে সাদা মেকআপ আর তার বিখ্যাত ঠোঁটে লাল রং মেখে। বলা চলে, তার এই মেকআপের কারণেই সে আমলে পুরো ট্রেন্ড বদলে যায়। সেই যুগে সাদা আর ফ্যাকাশে গায়ের রং ছিলো সামাজিক উচ্চতার প্রতীক, কারণ অভিজাত শ্রেণী ঘরে বসেই জীবনযাপন করার বিলাসিতা করতে পারতো। রোদে পুড়ে তামাটে হওয়া গায়ের রংকে ধরা হতো দারিদ্রের লক্ষণ, খেটে খাওয়া মানুষের পরিচয়।
নিজের কুমারী ও রাজকীয়তার পরিচয় দিতে (পরবর্তীতে নিজের গুটিবসন্তের দাগ লুকাতে) রানী এলিজাবেথ মুখে সাদা সীসার পাউডার মাখতেন, এবং ঠোঁট রাঙাতেন লাল রঙে। তার এই ট্রেন্ড অনুসরণ করতে শুরু করে অভিজাত সমাজ, এমনকি সংবাদপত্রে বলা হতো যে ঠোঁটে লিপস্টিক জাদুর মতো কাজ করে- এমনকি মৃত্যুকেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। নিয়তির পরিহাসই হয়তো বলা যায়, মৃত্যুর সময় রানীর ঠোঁট রাঙানো ছিলো আধ-ইঞ্চি লাল রঙের প্রলেপে।
অলঙ্করণঃ রাজিব
ফরাসী বিপ্লব-পরবর্তীকাল থেকে শুরু করে ১৮ শতকের শেষভাগ
১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে মানুষ অভিজাততন্ত্র ও রাজতন্ত্রের সকল প্রতীক থেকে সরে আসতে চেয়েছিলো। অতিরিক্ত মেকআপের বদলে তখন অনাড়ম্বর প্রসাধনই বেশি প্রচলিত হওয়া শুরু করে, অভিজাতদের বিশাল ফোলানো গাউনের পরিধিও ছোট হয়ে আসতে শুরু করে।
ফরাসী বিপ্লবের আগে মেকআপ ছিলো নারী-পুরুষ সবার প্রসাধন। কিন্তু এই বিপ্লবের পর থেকেই কৃত্রিমতা হয়ে উঠে ঘৃণ্য একটি ধারণা, যার কারনে হালকা প্রসাধনের ‘ন্যাচারাল লুক’-এর প্রতি সবার আগ্রহ বেড়ে যায়। কিন্তু উনবিংশ শতক থেকে বিপ্লবের স্মৃতি ধীরে ধীরে মলিন হতে থাকে, নারীদের মাঝে আবার মেকআপের আধিক্য জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
এ নিয়ে অনেক সমালোচনা সত্ত্বেও, বারবনিতারা মেকআপ আর পোশাকের মুন্সিয়ানা দেখাতো মূলত পুরুষের মন জয় করতে। কিছু কিছু অভিজাত নারী রীতিমতো আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের অনাবৃত হওয়ার প্রদর্শনীর আয়োজন করতো দর্শনার্থীদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের কাছে এই ট্রেন্ড যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলো। তবে পুরুষদের মেকআপ করার রীতির প্রচলন তেমন জনপ্রিয়তা পায় নি, এটি নারীর ভূ্যণ হিসেবেই তকমা পেয়ে যায়। নারীদের সৌন্দর্যবর্ধন আর আবেদনময়ী হিসেবে দেখানোতেই প্রসাধন ব্যবহার করা হতো বেশি।
ভিক্টোরিয়ান যুগ
১৮৩৭ সালে যখন রানী ভিক্টোরিয়া সিংহাসনে আরোহন করেছিলেন, ব্রিটিশ লাইব্রেরির রিপোর্টের মতে, সেই আমলে পরিমিতিবোধই ছিলো সৌন্দর্যের প্রতীক। আর বিবিসির বর্ণনায় জানা যায়, সেই যুগে ঘরে বসে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার মাঝেই নারীদের জীবনের পরিপূর্ণতা নিহিত ছিলো বলে ভাবা হতো। শক্ত-সামর্থ্য নারীদের চেয়ে যেন ক্ষীণ, দুর্বলতাই ছিলো নারীদের প্রকৃত সৌন্দর্যের প্রতীক। শিল্পী এবং গবেষক এলেক্সিস কার্ল বলেন, ‘নারীদের ক্ষীণকায়ার মাঝেই প্রকৃত সৌন্দর্য প্রকাশ পায় বলে ধারণা করা হতো।’ কে জানতো, রোগা আর শীর্ণ দেহও আবেদনের প্রতীক হিসেবে ভাবা যেতে পারে?
সেই যুগে মেকআপের সামগ্রী ব্যবহার করাও ছিলো বিপদজনক ব্যাপার। সীসা, এমোনিয়া, পারদ আর নাইটশেডের মতো বিষাক্ত উপাদান ব্যবহার করা হতো প্রসাধনে, এগুলো বিপদজনক- এ কথা জানা সত্ত্বেও তারা এসব ব্যবহার করতো। সৌন্দর্য বাড়াতে বিষাক্রান্ত হতেও অনীহা ছিলো না ভিক্টোরিয়ান যুগের নারীদের। যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নমনীয় নারীদের মাঝেই এই ট্রেন্ড ফলো করার ঝোঁক ছিলো বেশি, তবে সব নারী আবার শুধুমাত্র সৌন্দর্যের জন্য মৃত্যুবরণ করতে রাজি ছিলো না।
বিশ শতকের শুরুতে
১৮৯০ সালে জনপ্রিয়তা পায় চার্লস গিবসনের আঁকা ‘গিবসন গার্ল’ ছবিটি, যা ছিলো সেই আমলের সুন্দর নারীর সংজ্ঞা। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত সেই চিত্রকর্মের নারীর মতোই হতে চেষ্টা করতো অনেক নারী। গিবসনের এই ছবিতে ফর্সা রঙের এই মেয়েটির পরিধান ছিলো আঁটসাঁট করসেট, যার ভাঁজ থেকে দেহের গড়নও স্পষ্ট দেখা যেতো।
চওড়া কটি, নরম এবং সুডৌল গঠন তখনও সবার আকাঙ্ক্ষিত ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ হলেও সেই আমল থেকেই শুরু হয় কিছুটা সরু গঠনের দেহের জনপ্রিয়তা। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি। তবে ঘুরেফিরে সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি এসেছিলো একজন পুরুষের কল্পনা থেকেই, কোন সত্যিকারের নারীদেহের উপর ভিত্তি করে আসে নি।
এভেলিন নিসবেট। যদিও ‘গিবসন গার্ল’ একটি কাল্পনিক নারীর আদলেই আঁকা হয়েছিলো, তবুও ইতিহাসের প্রথম সুপারমডেল এভেলিন নিসবেটের গড়ন ছিলো সেই গিবসন গার্লের অনেকটা কাছাকাছি।
১৯২০-এর দশক
১৯১০-এর দশকের পরপর শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর তখন অনেক নারীই পুরুষের সাথে সমান তালে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়া শুরু করে। আর যুদ্ধের পর তারা তাদের এই স্বাধীনতার স্বাদ ভুলে যায় নি। ১৯২০-এর দশকে পশ্চিমা নারীরা ভোট দেয়ার অধিকার অর্জন করে, এবং এতদিন ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেঁধে দেয়া সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড বর্জন করা শুরু করে তারা। কিছুটা সংক্ষিপ্ত পোশাক আর ছোট চুলের একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই, আর যেসব নারী এমন ট্রেন্ড অনুসরণ করতেন, তাদের সংজ্ঞায়িত করা হয় ফ্ল্যাপারস (Flappers) বলে। প্রথমবারের মতো সুডৌল দেহাবয়বের বদলে একহারা গড়নকে নিজেদের সৌন্দর্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করে তারা। ছোট চুলকে বেশ ফ্যাশনেবল বলেই মনে করা হতো।
স্কার্টের পাশে থাকা হেমলাইন বা চিরের উচ্চতা তখন অনেকটা বেড়ে যায়, যাতে করে নারীরা আরও বেশি স্বাচ্ছ্যন্দে চলাফেরা করতে পারতো, মনের আনন্দে নাচতে চাইলে পা বেঁধে যেত না স্কার্টের ঘেরে। তবে এই আমলের একটি নেতিবাচক দিক হলো, একহারা সরু দেহের এই ট্রেন্ড নারীদের দেহের মেদ আর প্রস্থ নিয়ে অনেকটা হীনমন্যতায় ফেলে দেয়। ১৯২০-এর দশকের আগে নিজের ওজন মাপা একটা ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিলো, এমনকি পুরো দেহ দেখা যায় এমন আয়না বিলাসী দ্রব্য হিসেবেই বিবেচনা করা হতো। সেই সময়ের আগে শুধু ধনীরাই নিজেদের পুরো অবয়ব আয়নায় দেখার সুযোগ পেত। কিন্তু এই ১৯২০-এর দশকে দেহের ওজন মাপার মেশিন হয়ে যায় সহজলভ্য, চাইলেই যে কেউ কিনে তার বাথরুমে রেখে দিতে পারতো। আর নিজের ওজন কতো, বেড়ে গেল কিনা- এমন ভাবনা বিভোর করে রাখতো সে সময়ের নারীদের। আর সে সময় অলিতে গলিতে গড়ে উঠতে শুরু করে অনেক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর- যেখানে চাইলেই নারীরা নিজেদের পুরো আকার দেখতে পেতেন লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আর নিজেদের এই প্রতিচ্ছবিতে নিজ দেহের খুঁতগুলোই সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে তাদের চোখে ধরা দিতো। সেখান থেকেই শুরু হয়েছিলো নারীদের ‘বডি অবসেশন’।
তিরিশ ও চল্লিশের দশক
১৯২০-এর দশকের শেষদিকে শুরু হয় ‘মহামন্দা’র যুগ। তখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ফ্যাশন নিয়ে ভাবনার সুযোগ তেমন ছিলো না। বেশিরভাগ নারীই আগের দশকের একহারা গড়নের এই ফ্যাশন নিয়ে ভাবা ভুলে যায়, আর তখনকার আমলে ভরাট নারীদেহই বেশি প্রচলিত হতে শুরু করে।
যুদ্ধ ও অন্যান্য দুঃসময়ে অভাব নারীদেরকে নিজেদের পোশাক নিয়ে আরও সৃজনশীল হতে বাধ্য করে। পুরুষের পুরোনো স্যুট কেটে নারীরা নিজেদের পোশাক বানানো শুরু করে তখন। চওড়া কাঁধ আর সরু কোমরে অনেকটা বালুর ঘড়ির মতো আদল নারীদের মাঝে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। যেহেতু এর আগের বছরগুলোতে অভাবের দুঃসময় কাটিয়ে আসতে হয়েছে, কেউ আর শীর্ণ দেহে নিজেকে দেখতে চাইতো না, কারণ তা বিগত অভাবের দিনের কথাই মনে করিয়ে দিতো। তাই বলে ১৯১০-এর দশকের গিবসন গার্লের মতো সুডৌল গড়ন হতে হবে- এমনটাও কেউ আশা করতো না।
পঞ্চাশের দশক থেকে ষাটের দশকের শুরুর বছরগুলো
এই সময়টিতে গ্রেট ডিপ্রেশন আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করেছিলো সবাই। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা, এই সময় ধনী হতে শুরু করে। সবার মাঝেই কাজ করতো ফুর্তির মেজাজ, আর সেখান থেকেই আরেকটু ভরাট দেহ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।
অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন, ৫০’এর দশকের আবেদনময়ী নারীদেরকে আজকের যুগে ‘প্লাস সাইজ’ হিসেবে ধরা হবে। যদিও একালের মডেলদের তুলনায় তাদেরকে সামান্য ভারী বলা যায়, সিনেমার তারকা অভিনেত্রীরা কিন্তু বেশ ছিপছিপে গড়ন অধিকারী ছিলেন। তথ্যমতে, সে আমলে বেশিরভাগ রূপালি পর্দার নারীদের বিএমআই ছিলো ১৮.৮ থেকে ২০.৫ এর মাঝামাঝি, যা গড়পড়তা নারীদের ২৩.৬ মাত্রার চেয়ে বেশ কম ছিলো। তাই আপাতদৃষ্টিতে কিছুটা ভরাট গড়নের দেহকেই নারীদের জন্য আদর্শ বলা হলেও, সাধারণ নারীদের দেহের গড়নের সাথে এই মাপকাঠির ভালো রকমের অসামঞ্জস্যতা ছিলো বলা যায়। এই দশকের একটি নিউজরিলে দেখা যায়, আমেরিকার একটি শহরে আয়োজিত হয়েছিলো ‘মিস ফ্যাট অ্যান্ড বিউটিফুল’ প্রতিযোগিতা। আধুনিক সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন আয়োজন করে কোন নারীকে ‘মোটা’ উপাধি দেয়া হচ্ছে- এমন কথা কল্পনাই করা যায় না। আর সেই ৫০’এর দশকের এই প্রতিযোগিতায় যেসব নারী অংশ নিয়েছিলেন, বর্তমান যুগের স্ট্যান্ডার্ডে স্থুল হিসেবে বিবেচনাও করবে না কেউ! এ থেকেই প্রমাণিত হয়, ছিপছিপে দেহ অনেক দিন ধরেই ছিলো নারীদের জন্য আরাধ্য বিষয়।
৬০ এর দশকের শেষ থেকে ৯০-এর দশক পর্যন্ত
ষাটের দশক থেকেই পশ্চিমাদের সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও জীবনধারায় পরিবর্তন আসা শুরু করে। বাড়ি গাড়ি পেয়ে ঘরে বসে থাকা গৃহিণীর জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলো না পশ্চিমের নারীরা। ৫০’এর দশকের রক্ষণশীল জীবনধারার বাইরে বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো সে সময়ের তরুণেরা। এই যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মডেল ছিলো টুইগি- আর তা থেকেই বোঝা যায়, ছিপছিপে একহারা গড়ন আবার হয়ে উঠে ফ্যাশনেবল।
সত্তরের দশকে নারী স্বাধীনতার স্রোত আরও জোরে বইতে শুরু করলেও, পাতলা গড়নের প্রতি মোহ তখনও চলমান ছিলো। টুইগির চেয়ে ফারাহ ফসেটের গড়ন সামান্য চওড়া হলেও দিনশেষে তিনিও ছিলেন ক্ষীণ গড়নের একজন নারী- আর তিনি ছিলেন এই সত্তরের দশকে সবচেয়ে আবেদনময়ী একজন নারী। মেকআপ আর ফ্যাশনে প্রাধান্য পেত ‘ন্যাচারাল লুক’। ষাটের দশকে যেমন প্রকট সব ফ্যাশন ট্রেন্ড চালু হয়েছিলো, এই দশকে তেমনটি ছিলো না। নারীদের মধ্যে লম্বা চুল খোলা রেখে দেয়ার প্রবণতাই ছিলো বেশি।
আশির দশক নিয়ে আসে ‘সুপারমডেল’-দের যুগ। তামাটে, লম্বা, পাতলা কিন্তু সুগঠিত দেহই ছিলো নারীদের ‘আদর্শ’ দেহের আদল। ক্ষীণকটি কিন্তু ভরাট বক্ষযুগলবিশিষ্ট দেহ তখনও ছিলো আবেদনময়তার মাপকাঠি। অভিনেত্রীদের দেখে নয়, বরং মডেলদের ফ্যাশন আর দেহের গড়ন দেখেই সেই সময়ের নারীরা বেশি অনুপ্রাণিত হতেন। যদিও গড়পড়তা নারী আর ফ্যাশন মডেলের দেহের প্রস্থে ছিল বিস্তর ফারাক!
চিকন দেহের এই প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে যায় ৯০’এর দশকে। ব্রিটিশ মডেল ‘কেট মস’-এর গড়ন সেই ষাটের দশকে ক্ষীণদেহের জন্য বিখ্যাত মডেল ‘টুইগি’কেও প্রায় হার মানিয়ে দিয়েছিলো। কেট মসের বিএমআই ছিলো মাত্র ১৬, আর তার মাধ্যমেই এই দশকে ‘হিরোইন শিক’ বা হাড্ডিচর্মসার গড়নের ট্রেন্ড জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। মজার ব্যপার হলো, ৯০’এর দশক আর ভিক্টোরিয়ান যুগের মধ্যে একটি অদ্ভুত মিল আছে- তা হলো এই দুই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রীদের সাথে তুলনীয় দেহের গড়নকে সুন্দর বলে ধরা হতো! ভগ (vogue) ম্যাগাজিনের পাতা ঘেঁটে বলাই যায়, আদর্শ নারীদেহের গড়ন সবচেয়ে বেশি সরু ছিলো এই নব্বইয়ের দশকেই।
‘নিখুঁত’ মানে আসলে কী?
সৌভাগ্যের বিষয় হলো, আমরা এমন একটি যুগে প্রবেশ করছি যখন গণমাধ্যমে জাতি কিংবা গড়ন নির্বিশেষে সৌন্দর্যের প্রশংসা করা হয়- যদিও আরও অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া বাকি। ২০১৭ সালে ‘নিউ ইয়র্ক ফ্যাশন উয়িক’ শুরু হওয়ার আগে আমেরিকার ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাউন্সিল সকল ডিজাইনারের কাছে একটি বার্তা পাঠায়- যেখানে তারা ডিজাইনারদের মনে করিয়ে দেয় ‘নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করে নানা জাতির নানা গড়নের বৈচিত্র্যময় সব মানুষ। আমরা চাই আমাদের এই আয়োজনে এই বৈচিত্র্যের উদযাপন হোক।’ তার জন্যেই তারা ডিজাইনারদের উৎসাহিত করেছিলো বিভিন্ন গড়ন আর জাতির মডেলদের সাথে কাজ করতে।
এও মনে রাখা দরকার যে ইতিহাস জুড়ে আমরা বেশিরভাগ সময়েই নারীর যেই ‘আদর্শ’ গড়নের রূপ দেখেছি- তা এসেছে কোন পুরুষের কল্পনা থেকেই। বর্তমানে ফটোশপ করার প্রবণতাও যেন সেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশাই প্রতিষ্ঠা করছে। ফটোশপের ডিজিটাল জাদু দিয়ে অসম্ভব বডি স্ট্যান্ডার্ড বেঁধে দেয়া হচ্ছে- যা বাস্তবে কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়। কল্পনার নারীদেহের অবয়ব কিংবা ডিজিটালি বদলে দেয়া ছবির মতো দেহ বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিবর্জিত। সময়ের সাথে স্ট্যান্ডার্ড যে বদলেই চলেছে, তা হয়তো এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি। তাই ‘বডি স্ট্যান্ডার্ড’ আসলে একটি ক্ষনস্থায়ী ব্যাপার, সময়ের সাথে বদলেই চলবে।
হতে পারে এ সময়ের মাপকাঠিতে আপনার দেহ ‘আদর্শ’ নয়, তাতে কী আসে যায়? ‘নিখুঁত’ বা ‘আদর্শ’ হচ্ছে একটি রূপকথা, যা বাস্তবের সাথে কখনোই মিলবে না। সে কারণেই নিজের এই খুঁতে ভরা সুন্দর দেহটিকে নিয়েই চলুন খুশি থাকি, জীবনের উৎসবে মেতে থাকি।
[নর-নারীর সৌন্দর্য যে স্থিরনির্দিষ্ট কিছু নয়, যুগের রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত– এটি কমবেশি আমরা সবাই জানি। বর্তমান লেখাটিতে ‘পার্ফেক্ট’ নারীদেহের গড়ন বিষয়ে মূলত পাশ্চাত্যের ধারণা রূপান্তরশীল ইতিহাসের কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই সৌন্দর্যবোধ প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধের চেয়ে অনেক দিক দিয়েই ভিন্ন। সেমসেম- এ পরবর্তীতে নারী-পুরুষের প্রাচ্যের সৌন্দর্যবোধ নিয়েও ধারাবাহিক লেখা প্রকাশিত হবে। — সম্পাদক ]
ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’
[elementor-template id="1854"]
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।
হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল
যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়।
‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি। এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?
‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’। কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।