নারীবাদ বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের জন্যই প্রাসঙ্গিক একটা লড়াই। এবং যেকোনো মতাদর্শিক লড়াইয়ের আগে তার তাত্ত্বিক পাটাতনটা মজবুত থাকা দরকার বলেই আমরা মনে করি। সেই সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক ও দার্শনিক নানান সময়ে এ ব্যাপারে যে লেখালেখি করেছেন, তারই উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখানে হাজির করার চেষ্টা করা হয়েছে। দুনিয়ার আর সব লিস্টের মতই, এই তালিকাও নিখুঁত বা পূর্ণাঙ্গ নয়। এখানে উল্লিখিত বইগুলো ছাড়াও নারীবাদ-বিষয়ক অসংখ্য দুর্দান্ত বই রয়েছে। যে নিরিখে এখানের বইগুলো রাখা হয়েছে তা হলো এগুলো নারীবাদ ও তার বহুমাত্রিক সংগ্রামের বুনিয়াদি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। সিমোন দ্য ব্যুভোয়া, জুডিথ বাটলার, চিমামান্দা আদিচি ইত্যাদি লেখকের চমৎকার বই থাকা সত্ত্বেও তা এই তালিকায় রাখা হয়নি কারণ ওই বইগুলোর সাথে হয়তো অনেকেই ইতোমধ্যে কিছু মাত্রায় পরিচিত। একটু ভিন্ন ধারার কিছু নারীবাদী লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি, তাদের বইগুলোও অবশ্যই ঘেঁটে দেখার প্রণোদনা থাকবে। তাছাড়া, ভৌগোলিক বিচারে হয়তো সব অঞ্চলের চিন্তার প্রতিফলন এই তালিকায় উঠে আসেনি। তবে ওইতো, তালিকামাত্রেরই থাকে এমন নানান সীমাবদ্ধতা। এখান থেকে যদি নতুন কিছু চিন্তার সাথে পাঠক নতুন করে পরিচিত হতে পারেন, তাহলেই এই তালিকা সার্থক।
১. হোয়াইট টিয়ারস/ব্রাউন স্কারস | রুবি হামাদ
নারীবাদ কোনো বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম না। শ্রেণি ও বর্ণের প্রশ্নও এর সাথে জড়িত। এ ব্যাপারে অসচেতনতা থেকে পশ্চিমে এক প্রকার প্রিভিলিজড শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের উদ্ভব হয়েছিল। তাদের নারীবাদী তৎপরতা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নানা ধরণের অসুবিধা নজরআন্দাজ করে যায়। রুবি হামাদ তার এ বইতে দেখাচ্ছেন যে এমনকি শ্বেতাঙ্গ নারীদের অশ্রুও ভিন্নবর্ণের নারীদের ওপরকার অত্যাচারকে চলমান রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সেই অশ্রুর মাধ্যমে তারা বিপন্ন বনিতার (Damsel in Distress) ভূমিকা পালন করে দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যায়। এমনকি শ্বেতাঙ্গ নারীরা যতটা সহজে নিজেদের অনুভূতি ও হতাশা ব্যক্ত করতে পারে, ভিন্নবর্ণের নারীদের এসব ব্যাপারে আরো অনেক সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের দেশেও একপ্রকার উচ্চকোটির নারীবাদচর্চার ধারা দেখা যায়। রুবি হামাদ এমনকি ঔপনিবেশিক ইতিহাস ঘেটে দেখাচ্ছেন কীভাবে বিভিন্ন বর্ণবাদী আদর্শের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ নারীরা লাভবান হয়ে এসেছে। নারীবাদকে আরো ইনক্লুসিভ ও বর্ণসচেতন করার একটা প্রয়াস হিসেবে এ বইটা প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে।

২. ইনভিজিবল উইমেন | ক্যারোলিন ক্রিয়াদো পেরেজ
গুডরিডসে ‘ইনভিজিবল উইমেন’ বইটার একটা রিভিউতে একজন লিখেছেন, প্রেশারের রোগীরা এই বইটা পড়বেন না, পড়লে মেজাজ সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। সত্যিই তাই। ক্যারোলিন পেরেজ তার এই বইতে বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কীভাবে আমাদের সমাজটা ‘ডিফল্ট পুরুষালি’। অর্থাৎ বিভিন্ন খুঁটিনাটি আঙ্গিকে পুরুষদের সুবিধাকেই আমলে নেয়া হয়ে থাকে, এছাড়া অন্য কোনো লিঙ্গপরিচয়ের মানুষকে বিবেচনায় আনা হয় না। ফলে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে পদে পদে নারীরা একপ্রকার ‘মাইক্রো অ্যাগ্রেশন’ তথা খুচরা আগ্রাসনের সম্মুখীন হন। কর্মস্থল, রাস্তাঘাট, যানবাহন সবকিছুই পুরুষের সুবিধা মাথায় রেখে বানানো হয়ে থাকে এবং আমাদের সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মাণের পেছনে রয়েছে এই পূর্বানুমান যে পুরুষ বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করবে ও নারী থাকবে ঘরের ভেতর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রায় সকল গাড়ি ডিজাইন করা হয় ১৫৫ পাউন্ডের পুরুষের দৈহিক গড়নকে আদর্শ ধরে। আবার ওষুধপত্রও পরীক্ষা করার সময় তা একটা গড় পুরুষ শরীরের হিসাবে অনুমোদন দেয়া হয়, এবং নারীদের হরমোনাল অবস্থা খুব একটা পাত্তা দেয়া হয় না। ফলে সংখ্যায় ‘সংখ্যালঘু’ না হলেও এরকম একটা পুরুষ-নির্মিত দুনিয়ায় নারীদের প্রায় একটা অদৃশ্য জীবন যাপন করতে হয়। তবে এই বইতে কেবল লিঙ্গবৈষম্যই না—বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নিয়েও যথেষ্ট উপাত্ত উল্লেখ করা আছে। ২০১৭ সালে যখন বিবিসি’র নারী ও পুরুষ কর্মচারীদের মধ্যকার রোজগারের ব্যবধানের খবর প্রকাশ পায়, তখন গণমাধ্যমে তোলপাড় লেগে গেছিল। এরই ফলস্বরূপ পরবর্তীতে এই ব্যবধান কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে করেই প্রমাণ হয় যে, সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য পরিসংখ্যান অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যারোলিনা পেরেজ সেই
ভূমিকাটুকুই পালন করেছেন।

৩. ফেমিনিজম ইজ ফর এভরিবডি: প্যাশনেট পলিটিক্স | বেল হুকস
বেল হুকসের ‘ফেমিনিজম ইজ ফর এভরিবডি: প্যাশনেট পলিটিক্স’ বইটাকে নারীবাদকে একটা ক্রিটিকাল থিওরি হিসেবে এস্তেমাল করার প্রয়াস হিসেবেই দেখা যায়। সরাসরি দমনমূলক না হয়েও পুরুষতন্ত্র কীভাবে একটা সর্বব্যাপী আবহ হিসেবে ছড়িয়ে থাকে সমাজে, একপ্রকার সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনায় কীভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে যে-কেউ, সেটাই দেখাচ্ছেন হুকস। ফলে একটা নারীবাদী তৎপরতার প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি দেখেছেন এসব অভ্যাস পরিশোধন করা ও যা কিছু দীর্ঘদিন ধরে আমরা শিখে এসেছি তার অনেককিছু ভুলে যাওয়া। এইসব অভ্যাস থেকে জন্ম নেয়া কসমেটিক্স ইন্ডাস্ট্রি, নারী নির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ এরকম অসংখ্য চর্চার দিকে আমাদের নজর ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। একইসাথে নারীবাদকে পুরুষ বনাম নারী জাতীয় বাইনারি তর্ক থেকে মুক্ত করে তিনি একটা বিস্তর আলোচনার পরিসর তৈরি করতে চেয়েছেন এই বইতে। যেমন, বিচ্ছিন্নভাবে পুরুষেরা আদতে নারীদের শত্রু না, আবার নারীরাও অনেকসময় নারীবিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনার পরিবাহক হিসেবে কাজ করে থাকে। এ ধরণের নারীবিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক অবস্থাকে তিনি দেখছেন বৃহত্তর ‘শ্বেতাঙ্গ-কেন্দ্রিক, পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজের অন্যতম একটা গাঁথুনি হিসেবে। নারীবাদকে একটা সামগ্রিক সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে বোঝার জন্য এই বই এখনো অপরিহার্য হয়ে আছে।

৪. দ্য ফেমিনিন মিস্টিক | বেটি ফ্রিডান
১৯৬৩ সালের দিকের কথা। তখন আমেরিকায় অনেক মেয়েরই টিনেজ বয়সে বিয়ে হয়ে যেত এবং ৬০ শতাংশ মেয়ে পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরনির জীবনে প্রবেশ করে ফেলত। এমন একটা প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল বেটি ফ্রিডানের ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক।’ তখনো গড় আমেরিকান মানসে একজন সুখী, সন্তুষ্ট ঘরনির চিত্র খুব ভালোভাবে গেঁথে ছিল। বেটি ফ্রিডান ঠিক এই ধারণাটার মধ্যেই একটা ‘অনামা সংকট’ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। সেই সংকটটা হলো সেই শান্তশিষ্ট ঘরনি জীবনের চিত্র আমেরিকান নারীদের উপর একটা ‘মিস্টিক’ অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন প্রত্যাশা চাপিয়ে দিচ্ছে। ওই জীবনটা যে খুব সুখের ও শান্তির এই ধারণাটা কোনো নারীর অভিমতে না, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুরুষালি সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত। এমন একটা অবস্থায় আটকা পড়া নারীদের দুর্দশা ও তা ব্যক্ত করতে না পারার সংকটই ফ্রিডান তুলে ধরেছেন তার বইতে। তা করতে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন ও জরিপ, যার ফলে সেসময়কার আমেরিকার সামাজিক আবহের খুবই বাস্তবিক একটা চিত্র পাওয়া যায়। তবে এই বইটার ব্যাপারে বিভিন্ন সমালোচনা চালু আছে যে বইটিতে একপেশে এবং ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের ও শ্রেণির নারীদের সমস্যার ব্যাপারে তেমনকিছু বলা হয়নি। তবুও বইটির গুরুত্ব কম করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের জন্ম দেয়ার পিছনে বইটার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যে প্রেক্ষাপট নিয়ে এ বইতে ফ্রিডান আলোচনা করেছেন সে প্রেক্ষাপটটা বাংলাদেশের মত বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

৫. আন্তিগোনে রাইজিং | হেলেন মোর্যালেস
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিক মিথগুলোর নানান রকমের নতুন অ্যাডাপ্টেশন বেশ বিখ্যাত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কোনো এক কারণে মানুষ এখনো সেসব গল্প ও কথনের সাথে রিলেট করতে পারছে। হেলেন মোর্যালেসের বইটা সেই হাজার বছরের পুরনো গল্পগুলোকেই বর্তমান জমানার সাথে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আলোচনার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। মিথ কিংবা উপকথার যে স্বভাবটার উপর মোর্যালেস জোর দিয়েছেন তা হলো যুগের সাথে সাথে এর নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হওয়া। আমরা দেখি যে কোনো উপকথা বহুরূপে যুগে যুগে হাজির হয়, এবং প্রাচীন উপকথাগুলোর মধ্য থেকে কোনগুলো আমরা নিয়ত চর্চার মধ্যে রাখছি সেটাও আমাদের বর্তমান সমাজের ব্যাপারে অনেক ইশারা বহন করে। সেজন্যই মোর্যালেস সেই গ্রিক গল্পগুলোকে একটা নারীবাদী লেন্স থেকে হাজির করেন। বইটা শুরু হয় কিশোরী আন্তিগোনের গল্প দিয়ে, যে রাজা ও গোটা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভাইকে কবর দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। আন্তিগোনের মধ্যে মোর্যালেস খুঁজে পেয়েছেন এখনকার বড় বড় কর্পোরেশন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একলা সংগ্রামরত মেয়েদের আদিরূপ। এর পাশাপাশি স্বৈরিতা অ্যামাজন নারীদেরকে কীভাবে নষ্টা প্রতিপন্ন করা হতো কিংবা লিউক্রেশিয়া ও মেডুসার মত ধর্ষণের শিকার নারীদের গল্পের উল্লেখের মধ্য দিয়ে সেসময় ধর্ষিতাদের প্রতি মনোভাব কেমন ছিল সেসবের একটা সামগ্রিক পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার সেসময় বীর বলে যাদেরকে ধরা হতো, তাদের বীরত্বের জায়গাটা আসলে কোথায় সে প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। যেমন, হেরাক্লিস ঝোঁকের মাথায় নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করার পর তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাকে বারোটি দুরূহ কাজ করতে বলা হয়। সেগুলোর মধ্যে একটা কাজ ছিল একজন অ্যামাজন নারীর থেকে যুদ্ধ-বন্ধনী ছিনিয়ে আনা। অর্থাৎ, স্ত্রীহত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি আরো অসংখ্য নারীকে হত্যা করেন। এরপরেও তাকে খুনি না বলে বীর বলার পেছনের যুক্তিগুলো কী? আগেই যেমনটা বলা হলো, মিথ কোনো একরোখা গল্পের উৎস না, বরং অসংখ্য কথন ও পুনর্কথনের মধ্য দিয়ে একেক যুগে নতুন প্রাণ নিয়ে তারা হাজির হয়। মোর্যালেস আমাদের যুগের লৈঙ্গিক সমস্যার আওতায় নিয়ে এসে সে গল্পগুলোকেই নতুন ও প্রাসঙ্গিক একটা নজরে দেখার চেষ্টা করেছেন।

৬. ওয়ার্ডস্লাট | অ্যামান্ডা মন্টেল
সমাজ ভাষাবিজ্ঞান (সোশিওলিঙ্গুইস্টিক্স) নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই বইটা অবশ্যপাঠ্য। লিঙ্গবৈষম্য কীভাবে নিত্যদিনকার ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় তাই নিয়ে লেখা। লেখক দেখান ইংরেজিতে নারীবাচক বহু নিরীহ শব্দই পরে গালিতে পরিণত হয়েছে। যেমন স্লাট শব্দটার আদি অর্থ ছিল নোংরা মহিলা (চারিত্রিক অর্থে না, আক্ষরিক অর্থেই।) এবং এটার পুরুষবাচক শব্দটার অর্থের কোনো হেরফের না ঘটলেও, এই শব্দটার উপর একটা চরিত্র-সংক্রান্ত ব্যঞ্জনা আরোপিত হয়ে গেছে। বাংলাতেও এরকম হয়েছে। যেমন, খানকি শব্দটা এসেছে খানকা থেকে, মাগী শব্দ দ্বারাও আগে বোঝানো হতো (এখনো হয়) স্রেফ কোনো নারীকে। কিন্তু কোনো এক কারণে এগুলো এখন গালিতে পরিণত হয়েছে।
বইটাতে এই গালিগুলোকে রিক্লেইম করার ব্যাপারে একটা অধ্যায় আছে। যেমন পশ্চিমে অনেক নারী Hoe, Bad Bitch এসব নিন্দাবাচক শব্দকে আপন করে নিয়েছে, বেশ গর্বের সাথে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে এসব নামে সম্বোধন করে। আমাদের এখানেও ভয়াবহ আকারে স্লাটশেমিংয়ের পর রাতের রাণি শব্দবন্ধটাকে আত্মীকৃত করে নিয়েছিলেন নারীরা। ফলে যারা এই শব্দগুলোকে গালি হিসেবে ব্যবহার করতো তাদেরকে ক্ষমতাহীন করে ফেলা হয়। এই শব্দগুলোর নেতিবাচক প্রভাব অনেকটা মুছে ফেলা গেছে সেই কারণে। আমাদের প্রতিদিনের আচরণে, অজান্তে উচ্চারণ করা শব্দেও কীভাবে একটা নারীবিদ্বেষী সামাজিক বন্দোবস্তকেই জায়গা করে দেই সেটা বোঝার জন্য এই বইটা ভীষণ কাজের।

৭) ইটস নট অ্যাবাউট দ্য বুরকা | সম্পাদক: মরিয়ম খান
মরিয়ম খান কর্তৃক সম্পাদিত এই বইটাতে রয়েছে ১৭জন মুসলিম নারীর লেখা প্রবন্ধ। লেখিকাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বসবাস যুক্তরাজ্যে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে যুক্তরাজ্যে ও অন্যান্য পাশ্চাত্য অঞ্চলে তাদের যাপিত অভিজ্ঞতাগুলো উঠে এসেছে এই বইতে। পর্দাপ্রথা কিংবা অন্যান্য নারী-কেন্দ্রিক বিষয়কে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যে যেসব ইসলামোফোবিক বয়ান গড়ে ওঠে তারই একপ্রকার পালটা পর্যালোচনা এখানে পাওয়া যাবে। এছাড়াও বইটাতে তারা নিজেদের দৃঢ় ভাষায় জানান দেন কীভাবে পাশ্চাত্যের নারীবাদের একরোখা সংজ্ঞা ভেঙে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ও নারীবাদের মধ্যে সমঝোতা করেন। ‘মুসলিম নারী’ বলে মোটাদাগে যে একই খোপে সবাইকে বন্দি করার প্রয়াস, তার জবাবে তারা জানান যে এই বর্গটা খোদ আরো নানাম বর্গে বিভাজিত। পাশ্চাত্য অঞ্চলগুলো বাদেও, ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও কীভাবে পুরুষতন্ত্র ও অন্যায্য বলপ্রয়োগের চর্চা গড়ে ওঠে তা নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে। মোটের ওপর, নারীবাদ ও ইসলাম নিয়ে পুরনো বস্তাপচা ক্লিশেগুলোর বাইরে গিয়ে বিভিন্ন মুসলিম নারীর নিজস্ব জীবনের গল্প তাদেরই জবানে পাওয়া যাবে এই গ্রন্থে।

বোনাস আরেকটা বই।
উইমেন অ্যান্ড পাওয়ার | মেরি বিয়ার্ড
ছোট্ট একটা বই, শ’খানেক পৃষ্ঠার। মেরি বিয়ার্ডেরই দুইখানা লেকচারের মুদ্রিত রূপ। নারীবিদ্বেষকে কেবল শনাক্ত করাই না, বরং একটা যুৎসই সংজ্ঞায়নের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়াস এই বইটা। মেরি শুরু করেন সেই প্রাচীনকাল থেকে, এসে পৌঁছান আজকালকার টুইটার-ইন্স্টা অব্দি। আর এই এত হাজার বছরের ব্যবধানের মধ্যে অপরিবর্তিত থেকে যায় একটা জিনিস: কাঠামোগতভাবে নারীর জবানকে রুদ্ধ করা ও নানান মাধ্যমে নারীবিদ্বেষের স্বাভাবিকীকরণ। কয়েক ঘণ্টায় পড়ে ফেলা যায়, এমন ছোটখাটো বইয়ের খোঁজ চান যদি, তাহলে এই বইটা পড়ে ফেলতে পারেন। তবে অবশ্যই, বইটার মূল বার্তাটাকে ধীরেসুস্থে হজম হতে দেবেন।
