বিষয় নারীবাদ: সেমসেম সেরা ৭ বই 

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
নারীবাদ বিষয়ক বইয়ে মূলত নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা প্রশ্নে বৈষম্যের বিষয়টি উঠে আসে। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

নারীবাদ বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের জন্যই প্রাসঙ্গিক একটা লড়াই। এবং যেকোনো মতাদর্শিক লড়াইয়ের আগে তার তাত্ত্বিক পাটাতনটা মজবুত থাকা দরকার বলেই আমরা মনে করি। সেই সংগ্রামের অংশ হিসেবে বিভিন্ন নারীবাদী তাত্ত্বিক ও দার্শনিক নানান সময়ে এ ব্যাপারে যে লেখালেখি করেছেন, তারই উল্লেখযোগ্য একটা অংশ এখানে হাজির করার চেষ্টা করা হয়েছে। দুনিয়ার আর সব লিস্টের মতই, এই তালিকাও নিখুঁত বা পূর্ণাঙ্গ নয়। এখানে উল্লিখিত বইগুলো ছাড়াও নারীবাদ-বিষয়ক অসংখ্য দুর্দান্ত বই রয়েছে। যে নিরিখে এখানের বইগুলো রাখা হয়েছে তা হলো এগুলো নারীবাদ ও তার বহুমাত্রিক সংগ্রামের বুনিয়াদি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। সিমোন দ্য ব্যুভোয়া, জুডিথ বাটলার, চিমামান্দা আদিচি ইত্যাদি লেখকের চমৎকার বই থাকা সত্ত্বেও তা এই তালিকায় রাখা হয়নি কারণ ওই বইগুলোর সাথে হয়তো অনেকেই ইতোমধ্যে কিছু মাত্রায় পরিচিত। একটু ভিন্ন ধারার কিছু নারীবাদী লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পাশাপাশি, তাদের বইগুলোও অবশ্যই ঘেঁটে দেখার প্রণোদনা থাকবে। তাছাড়া, ভৌগোলিক বিচারে হয়তো সব অঞ্চলের চিন্তার প্রতিফলন এই তালিকায় উঠে আসেনি। তবে ওইতো, তালিকামাত্রেরই থাকে এমন নানান সীমাবদ্ধতা। এখান থেকে যদি নতুন কিছু চিন্তার সাথে পাঠক নতুন করে পরিচিত হতে পারেন, তাহলেই এই তালিকা সার্থক। 

১. হোয়াইট টিয়ারস/ব্রাউন স্কারস | রুবি হামাদ  

নারীবাদ কোনো বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম না। শ্রেণি ও বর্ণের প্রশ্নও এর সাথে জড়িত। এ ব্যাপারে অসচেতনতা থেকে পশ্চিমে এক প্রকার প্রিভিলিজড শ্বেতাঙ্গ নারীবাদের উদ্ভব হয়েছিল। তাদের নারীবাদী তৎপরতা কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের নানা ধরণের অসুবিধা নজরআন্দাজ করে যায়। রুবি হামাদ তার এ বইতে দেখাচ্ছেন যে এমনকি শ্বেতাঙ্গ নারীদের অশ্রুও ভিন্নবর্ণের নারীদের ওপরকার অত্যাচারকে চলমান রাখার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সেই অশ্রুর মাধ্যমে তারা বিপন্ন বনিতার (Damsel in Distress) ভূমিকা পালন করে দায়বদ্ধতা এড়িয়ে যায়। এমনকি শ্বেতাঙ্গ নারীরা যতটা সহজে নিজেদের অনুভূতি ও হতাশা ব্যক্ত করতে পারে, ভিন্নবর্ণের নারীদের এসব ব্যাপারে আরো অনেক সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের দেশেও একপ্রকার উচ্চকোটির নারীবাদচর্চার ধারা দেখা যায়। রুবি হামাদ এমনকি ঔপনিবেশিক ইতিহাস ঘেটে দেখাচ্ছেন কীভাবে বিভিন্ন বর্ণবাদী আদর্শের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ নারীরা লাভবান হয়ে এসেছে। নারীবাদকে আরো ইনক্লুসিভ ও বর্ণসচেতন করার একটা প্রয়াস হিসেবে এ বইটা প্রাসঙ্গিক থেকে গেছে।

হোয়াইট টিয়ার্স/ব্রাউন স্কার্স  বইয়ের প্রচ্ছদ

         


২. ইনভিজিবল উইমেন | ক্যারোলিন ক্রিয়াদো পেরেজ

গুডরিডসে ‘ইনভিজিবল উইমেন’ বইটার একটা রিভিউতে একজন লিখেছেন, প্রেশারের রোগীরা এই বইটা পড়বেন না, পড়লে মেজাজ সামলানো কঠিন হয়ে যাবে। সত্যিই তাই। ক্যারোলিন পেরেজ তার এই বইতে বিভিন্ন পরিসংখ্যানের মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কীভাবে আমাদের সমাজটা ‘ডিফল্ট পুরুষালি’। অর্থাৎ বিভিন্ন খুঁটিনাটি আঙ্গিকে পুরুষদের সুবিধাকেই আমলে নেয়া হয়ে থাকে, এছাড়া অন্য কোনো লিঙ্গপরিচয়ের মানুষকে বিবেচনায় আনা হয় না। ফলে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে পদে পদে নারীরা একপ্রকার ‘মাইক্রো অ্যাগ্রেশন’ তথা খুচরা আগ্রাসনের সম্মুখীন হন। কর্মস্থল, রাস্তাঘাট, যানবাহন সবকিছুই পুরুষের সুবিধা মাথায় রেখে বানানো হয়ে থাকে এবং আমাদের সমাজের সকল প্রতিষ্ঠানের নির্মাণের পেছনে রয়েছে এই পূর্বানুমান যে পুরুষ বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করবে ও নারী থাকবে ঘরের ভেতর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রায় সকল গাড়ি ডিজাইন করা হয় ১৫৫ পাউন্ডের পুরুষের দৈহিক গড়নকে আদর্শ ধরে। আবার ওষুধপত্রও পরীক্ষা করার সময় তা একটা গড় পুরুষ শরীরের হিসাবে অনুমোদন দেয়া হয়, এবং নারীদের হরমোনাল অবস্থা খুব একটা পাত্তা দেয়া হয় না। ফলে সংখ্যায় ‘সংখ্যালঘু’ না হলেও এরকম একটা পুরুষ-নির্মিত দুনিয়ায় নারীদের প্রায় একটা অদৃশ্য জীবন যাপন করতে হয়। তবে এই বইতে কেবল লিঙ্গবৈষম্যই না—বর্ণ, শ্রেণি ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা নিয়েও যথেষ্ট উপাত্ত উল্লেখ করা আছে। ২০১৭ সালে যখন বিবিসি’র নারী ও পুরুষ কর্মচারীদের মধ্যকার রোজগারের ব্যবধানের খবর প্রকাশ পায়, তখন গণমাধ্যমে তোলপাড় লেগে গেছিল। এরই ফলস্বরূপ পরবর্তীতে এই ব্যবধান কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এতে করেই প্রমাণ হয় যে, সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য পরিসংখ্যান অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ক্যারোলিনা পেরেজ সেই
ভূমিকাটুকুই পালন করেছেন।  

ইনভিজিবল বইয়ের প্রচ্ছদ



৩. ফেমিনিজম ইজ ফর এভরিবডি: প্যাশনেট পলিটিক্স | বেল হুকস 


বেল হুকসের ‘ফেমিনিজম ইজ ফর এভরিবডি: প্যাশনেট পলিটিক্স’ বইটাকে নারীবাদকে একটা ক্রিটিকাল থিওরি হিসেবে এস্তেমাল করার প্রয়াস হিসেবেই দেখা যায়। সরাসরি দমনমূলক না হয়েও পুরুষতন্ত্র কীভাবে একটা সর্বব্যাপী আবহ হিসেবে ছড়িয়ে থাকে সমাজে, একপ্রকার সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনায় কীভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে যে-কেউ, সেটাই দেখাচ্ছেন হুকস। ফলে একটা নারীবাদী তৎপরতার প্রথম ধাপ হিসেবে তিনি দেখেছেন এসব অভ্যাস পরিশোধন করা ও যা কিছু দীর্ঘদিন ধরে আমরা শিখে এসেছি তার অনেককিছু ভুলে যাওয়া। এইসব অভ্যাস থেকে জন্ম নেয়া কসমেটিক্স ইন্ডাস্ট্রি, নারী নির্যাতন, বৈবাহিক ধর্ষণ এরকম অসংখ্য চর্চার দিকে আমাদের নজর ফেরাতে চেয়েছেন তিনি। একইসাথে নারীবাদকে পুরুষ বনাম নারী জাতীয় বাইনারি তর্ক থেকে মুক্ত করে তিনি একটা বিস্তর আলোচনার পরিসর তৈরি করতে চেয়েছেন এই বইতে। যেমন, বিচ্ছিন্নভাবে পুরুষেরা আদতে নারীদের শত্রু না, আবার নারীরাও অনেকসময় নারীবিদ্বেষী চিন্তা-ভাবনার পরিবাহক হিসেবে কাজ করে থাকে। এ ধরণের নারীবিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক অবস্থাকে তিনি দেখছেন বৃহত্তর ‘শ্বেতাঙ্গ-কেন্দ্রিক, পুঁজিবাদী পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজের অন্যতম একটা গাঁথুনি হিসেবে। নারীবাদকে একটা সামগ্রিক সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে বোঝার জন্য এই বই এখনো অপরিহার্য হয়ে আছে। 

ফেমিনিজম ফর এভ্রিবডি: প্যাশনেট পলিটিক্স বইয়ের প্রচ্ছদ




৪. দ্য ফেমিনিন মিস্টিক | বেটি ফ্রিডান

১৯৬৩ সালের দিকের কথা। তখন আমেরিকায় অনেক মেয়েরই টিনেজ বয়সে বিয়ে হয়ে যেত এবং ৬০ শতাংশ মেয়ে পড়াশুনা বন্ধ করে ঘরনির জীবনে প্রবেশ করে ফেলত। এমন একটা প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিল বেটি ফ্রিডানের ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক।’ তখনো গড় আমেরিকান মানসে একজন সুখী, সন্তুষ্ট ঘরনির চিত্র খুব ভালোভাবে গেঁথে ছিল। বেটি ফ্রিডান ঠিক এই ধারণাটার মধ্যেই একটা ‘অনামা সংকট’ শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। সেই সংকটটা হলো সেই শান্তশিষ্ট ঘরনি জীবনের চিত্র আমেরিকান নারীদের উপর একটা ‘মিস্টিক’ অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন প্রত্যাশা চাপিয়ে দিচ্ছে। ওই জীবনটা যে খুব সুখের ও শান্তির এই ধারণাটা কোনো নারীর অভিমতে না, বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পুরুষালি সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে উদ্ভূত। এমন একটা অবস্থায় আটকা পড়া নারীদের দুর্দশা ও তা ব্যক্ত করতে না পারার সংকটই ফ্রিডান তুলে ধরেছেন তার বইতে। তা করতে গিয়ে সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন সাক্ষাৎকার, বিজ্ঞাপন ও জরিপ, যার ফলে সেসময়কার আমেরিকার সামাজিক আবহের খুবই বাস্তবিক একটা চিত্র পাওয়া যায়। তবে এই বইটার ব্যাপারে বিভিন্ন সমালোচনা চালু আছে যে বইটিতে একপেশে এবং ভিন্ন ভিন্ন বর্ণের ও শ্রেণির নারীদের সমস্যার ব্যাপারে তেমনকিছু বলা হয়নি। তবুও বইটির গুরুত্ব কম করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের জন্ম দেয়ার পিছনে বইটার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। যে প্রেক্ষাপট নিয়ে এ বইতে ফ্রিডান আলোচনা করেছেন সে প্রেক্ষাপটটা বাংলাদেশের মত বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক।

দ্য ফেমিনিন মিস্টিক বইয়ের প্রচ্ছদ

   
৫.  আন্তিগোনে রাইজিং | হেলেন মোর‍্যালেস 

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রিক মিথগুলোর নানান রকমের নতুন অ্যাডাপ্টেশন বেশ বিখ্যাত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কোনো এক কারণে মানুষ এখনো সেসব গল্প ও কথনের সাথে রিলেট করতে পারছে। হেলেন মোর‍্যালেসের বইটা সেই হাজার বছরের পুরনো গল্পগুলোকেই বর্তমান জমানার সাথে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আলোচনার আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছে। মিথ কিংবা উপকথার যে স্বভাবটার উপর মোর‍্যালেস জোর দিয়েছেন তা হলো যুগের সাথে সাথে এর নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজির হওয়া। আমরা দেখি যে কোনো উপকথা বহুরূপে যুগে যুগে হাজির হয়, এবং প্রাচীন উপকথাগুলোর মধ্য থেকে কোনগুলো আমরা নিয়ত চর্চার মধ্যে রাখছি সেটাও আমাদের বর্তমান সমাজের ব্যাপারে অনেক ইশারা বহন করে। সেজন্যই মোর‍্যালেস সেই গ্রিক গল্পগুলোকে একটা নারীবাদী লেন্স থেকে হাজির করেন। বইটা শুরু হয় কিশোরী আন্তিগোনের গল্প দিয়ে, যে রাজা ও গোটা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের ভাইকে কবর দেয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। আন্তিগোনের মধ্যে মোর‍্যালেস খুঁজে পেয়েছেন এখনকার বড় বড় কর্পোরেশন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একলা সংগ্রামরত মেয়েদের আদিরূপ। এর পাশাপাশি স্বৈরিতা অ্যামাজন নারীদেরকে কীভাবে নষ্টা প্রতিপন্ন করা হতো কিংবা লিউক্রেশিয়া ও মেডুসার মত ধর্ষণের শিকার নারীদের গল্পের উল্লেখের মধ্য দিয়ে সেসময় ধর্ষিতাদের প্রতি মনোভাব কেমন ছিল সেসবের একটা সামগ্রিক পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার সেসময় বীর বলে যাদেরকে ধরা হতো, তাদের বীরত্বের জায়গাটা আসলে কোথায় সে প্রশ্নও তিনি তুলেছেন। যেমন, হেরাক্লিস ঝোঁকের মাথায় নিজের স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করার পর তার প্রায়শ্চিত্তের জন্য তাকে বারোটি দুরূহ কাজ করতে বলা হয়। সেগুলোর মধ্যে একটা কাজ ছিল একজন অ্যামাজন নারীর থেকে যুদ্ধ-বন্ধনী ছিনিয়ে আনা। অর্থাৎ, স্ত্রীহত্যার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য তিনি আরো অসংখ্য নারীকে হত্যা করেন। এরপরেও তাকে খুনি না বলে বীর বলার পেছনের যুক্তিগুলো কী? আগেই যেমনটা বলা হলো, মিথ কোনো একরোখা গল্পের উৎস না, বরং অসংখ্য কথন ও পুনর্কথনের মধ্য দিয়ে একেক যুগে নতুন প্রাণ নিয়ে তারা হাজির হয়। মোর‍্যালেস আমাদের যুগের লৈঙ্গিক সমস্যার আওতায় নিয়ে এসে সে গল্পগুলোকেই নতুন ও প্রাসঙ্গিক একটা নজরে দেখার চেষ্টা করেছেন। 

আন্তিগোনে রাইজিং বইয়ের প্রচ্ছদ

  

৬.  ওয়ার্ডস্লাট | অ্যামান্ডা মন্টেল  

সমাজ ভাষাবিজ্ঞান (সোশিওলিঙ্গুইস্টিক্স) নিয়ে আগ্রহ থাকলে এই বইটা অবশ্যপাঠ্য। লিঙ্গবৈষম্য কীভাবে নিত্যদিনকার ভাষার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় তাই নিয়ে লেখা। লেখক দেখান ইংরেজিতে নারীবাচক বহু নিরীহ শব্দই পরে গালিতে পরিণত হয়েছে। যেমন স্লাট শব্দটার আদি অর্থ ছিল নোংরা মহিলা (চারিত্রিক অর্থে না, আক্ষরিক অর্থেই।) এবং এটার পুরুষবাচক শব্দটার অর্থের কোনো হেরফের না ঘটলেও, এই শব্দটার উপর একটা চরিত্র-সংক্রান্ত ব্যঞ্জনা আরোপিত হয়ে গেছে। বাংলাতেও এরকম হয়েছে। যেমন, খানকি শব্দটা এসেছে খানকা থেকে, মাগী শব্দ দ্বারাও আগে বোঝানো হতো (এখনো হয়) স্রেফ কোনো নারীকে। কিন্তু কোনো এক কারণে এগুলো এখন গালিতে পরিণত হয়েছে। 

বইটাতে এই গালিগুলোকে রিক্লেইম করার ব্যাপারে একটা অধ্যায় আছে। যেমন পশ্চিমে অনেক নারী Hoe, Bad Bitch এসব নিন্দাবাচক শব্দকে আপন করে নিয়েছে, বেশ গর্বের সাথে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে এসব নামে সম্বোধন করে। আমাদের এখানেও ভয়াবহ আকারে স্লাটশেমিংয়ের পর রাতের রাণি শব্দবন্ধটাকে আত্মীকৃত করে নিয়েছিলেন নারীরা। ফলে যারা এই শব্দগুলোকে গালি হিসেবে ব্যবহার করতো তাদেরকে ক্ষমতাহীন করে ফেলা হয়। এই শব্দগুলোর নেতিবাচক প্রভাব অনেকটা মুছে ফেলা গেছে সেই কারণে। আমাদের প্রতিদিনের আচরণে, অজান্তে উচ্চারণ করা শব্দেও কীভাবে একটা নারীবিদ্বেষী সামাজিক বন্দোবস্তকেই জায়গা করে দেই সেটা বোঝার জন্য এই বইটা ভীষণ কাজের।

অ্যাামান্ডা মন্টেলের ওয়ার্ডস্লাট বইয়ের প্রচ্ছদ



৭) ইটস নট অ্যাবাউট দ্য বুরকা | সম্পাদক: মরিয়ম খান 

মরিয়ম খান কর্তৃক সম্পাদিত এই বইটাতে রয়েছে ১৭জন মুসলিম নারীর লেখা প্রবন্ধ। লেখিকাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই বসবাস যুক্তরাজ্যে। সংখ্যালঘু গোষ্ঠী হিসেবে যুক্তরাজ্যে ও অন্যান্য পাশ্চাত্য অঞ্চলে তাদের যাপিত অভিজ্ঞতাগুলো উঠে এসেছে এই বইতে। পর্দাপ্রথা কিংবা অন্যান্য নারী-কেন্দ্রিক বিষয়কে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যে যেসব ইসলামোফোবিক বয়ান গড়ে ওঠে তারই একপ্রকার পালটা পর্যালোচনা এখানে পাওয়া যাবে। এছাড়াও বইটাতে তারা নিজেদের দৃঢ় ভাষায় জানান দেন কীভাবে পাশ্চাত্যের নারীবাদের একরোখা সংজ্ঞা ভেঙে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় ও নারীবাদের মধ্যে সমঝোতা করেন। ‘মুসলিম নারী’ বলে মোটাদাগে যে একই খোপে সবাইকে বন্দি করার প্রয়াস, তার জবাবে তারা জানান যে এই বর্গটা খোদ আরো নানাম বর্গে বিভাজিত। পাশ্চাত্য অঞ্চলগুলো বাদেও, ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও কীভাবে পুরুষতন্ত্র ও অন্যায্য বলপ্রয়োগের চর্চা গড়ে ওঠে তা নিয়েও সমালোচনা করা হয়েছে। মোটের ওপর, নারীবাদ ও ইসলাম নিয়ে পুরনো বস্তাপচা ক্লিশেগুলোর বাইরে গিয়ে বিভিন্ন মুসলিম নারীর নিজস্ব জীবনের গল্প তাদেরই জবানে পাওয়া যাবে এই গ্রন্থে।  

ইট’স নট এবাউট দ্য বুরকা বইয়ের প্রচ্ছদ

বোনাস আরেকটা বই। 

উইমেন অ্যান্ড পাওয়ার | মেরি বিয়ার্ড

ছোট্ট একটা বই, শ’খানেক পৃষ্ঠার। মেরি বিয়ার্ডেরই দুইখানা লেকচারের মুদ্রিত রূপ। নারীবিদ্বেষকে কেবল শনাক্ত করাই না, বরং একটা যুৎসই সংজ্ঞায়নের আওতায় নিয়ে আসার প্রয়াস এই বইটা। মেরি শুরু করেন সেই প্রাচীনকাল থেকে, এসে পৌঁছান আজকালকার টুইটার-ইন্স্টা অব্দি। আর এই এত হাজার বছরের ব্যবধানের মধ্যে অপরিবর্তিত থেকে যায় একটা জিনিস: কাঠামোগতভাবে নারীর জবানকে রুদ্ধ করা ও নানান মাধ্যমে নারীবিদ্বেষের স্বাভাবিকীকরণ। কয়েক ঘণ্টায় পড়ে ফেলা যায়, এমন ছোটখাটো বইয়ের খোঁজ চান যদি, তাহলে এই বইটা পড়ে ফেলতে পারেন। তবে অবশ্যই, বইটার মূল বার্তাটাকে ধীরেসুস্থে হজম হতে দেবেন।

অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।