ahmed kabir
আহমেদ কবির
কথাসাহিত্যিক
Schulson-headshot
মাইকেল শুলসন
লেখক ও সম্পাদক
ইন্টারনেট যদি আসক্তিতেই রূপ নেয়, সেক্ষেত্রে কি ইন্টারনেট রেগুলেট করা উচিৎ? অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

অনলাইনে গেলেই আমার আমার মনে পড়ে বি এফ স্কিনারের সেই সাদা কবুতরগুলোর কথা। নিজেকে তখন ওদের একটা বলেই মনে হয়। ছোটো একটা বাক্সে প্লেক্সিগ্লাসের টুকরোতে ঠোকর মেরে মেরে এই কবুতরগুলোর জীবন কেটেছে। ব্যাপার হচ্ছে, ওদের এই ঠোকরা-ঠুকরির দেখেই হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী স্কিনার বেশকিছু আচরণগত নীতি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার এই নীতিগুলো আজকের এই ডিজিটাল দুনিয়াতেও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।          

স্কিনার তার কবুতরগুলোকে একটা শিক্ষাই দিয়েছিলেন—ঠোকর মারলেই খাবার! কখনো ঠোকর মারার সাথে সাথে, আবার কখনো একটা নির্দষ্ট সময় পরপর। যেমন, একবার খাবার দেওয়ার পর ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে আর কিছু দেওয়া হবে না। এই সময় পার হলে আবার ঠোকর, আবার খাবার। একটা পর্যায় পর্যন্ত কবুতরগুলো সময়ের ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারত। কিন্তু স্কিনার করলেন কী, সময়ের ব্যাপারটা এলোমেলো করে দিলেন—কখনো ৬০ সেকেন্ড, কখনোবা ৫ সেকেন্ড, আবার কখনোবা ২০০ সেকেন্ড। এবার সময়ের বিভ্রান্তিতে পড়ে কবুতরগুলো রীতিমতো দিশেহারা হয়ে গেল। একটা কবুতর তো টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে প্রতি সেকেন্ডে আড়াইবার করে ঠোকর মেরেছিল! আর আরেকটা কবুতর ১৪ ঘণ্টায় ঠোকর মেরেছিল ৮৭ হাজার বার। অবশ্য এই কষ্টের ১% খাবারও তার ভাগ্যে জোটেনি! 

এবার তাহলে দেখা যাক, এই কবুতর-গবেষণার ব্যাপারটা কীভাবে আজকের এই ডিজিটাল জীবনের সাথে মিলে যায়। ধরা যাক, মাইকেল এস একজন সাংবাদিক (কাল্পনিক)। তার কাজের একটা বড় অংশই হচ্ছে ইমেইল চালাচালি। প্রতি ৪৫ মিনিটে তার কাছে একটা ইমেইল হলেও আসে। কখনো ২ মিনিটের মধ্যেও আসে, আবার কখনো ৩ ঘণ্টাও লাগে। বেশিরভাগই হয়তো ফালতু আর অহেতুক ইমেইল, কিন্তু কিছু তো মজার, কাজের তো বটেই। তো মাইকেল ইন্টারনেটে এলেই প্রথমে প্রতি ৩০ মিনিটে একবার ইমেইল চেক করতে থাকেন, একটা পর্যায়ে ৫ মিনিট পরপর, এমনকি কখনো কখনো ২ মিনিট পরপরই। ব্যাপারটা যেন বাধ্যতামূলক একটা অভ্যাস হয়ে গেল তার। সেই ক্রমাগত ঠোকরানো কবুতরগুলোর মতোই মাইকেল হয়ে উঠলেন একজন ক্রমাগত ঠোকরানো ওয়েব ইউজার।

ছোট্ট একটা বাটন চেপে চেপেই এভাবে সময় নষ্ট করার জন্য কি আমরা মাইকেলকে দোষ দিতে পারি? হয়তো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। আর তার পেশাটাই এমন, যেখানে কমিউনিকেশনের জন্য ইমেইল আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে স্কিনারের কবুতরগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কী ভাবব? ওদের কি আসলে কোনো দোষ আছে? বাক্সবন্দি কবুতরগুলো খাবারের জন্য ঠুকরেই যাচ্ছে, আর এক গবেষক তাদের এই পাগলামি নিয়ে গবেষণা করছেন! পুরো ব্যাপারটা আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে? কবুতরগুলো? না কি স্কিনার, যিনি এই বাক্সটি নিজ হাতে বানিয়েছেন? 

২০১৫ সালের পর থেকে ইন্টারনেটকে নিতান্তই একটা বিধ্বংসী ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে। আসক্তি বা বাধ্যতামূলক কিছুর উদাহরণ হিসেবে আমরা অহরহই ডিজিটাল লাইফের কথা বলি। ২০০০ সালের দিকে ইউজাররা তাদের স্মার্টফোনগুলোকে বলত,  ক্র্যাকবেরি (ক্র্যাক নামক একটা মাদকের সাথে মিলিয়ে)। এখন সাধারণ কথাবার্তাতেও আমরা ফেসবুক, টুইটার, ইমেইল, নেটফ্লিক্সকে এমনভাবে উপস্থাপন করি যে এগুলো আসলে নেশা বা জুয়ার কোনো বস্তু।  

সাইকোলজিস্টরা ১৯৯৬ সাল থেকেই সম্ভাব্য ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে কথা বলে আসছেন। মানে ওয়েব ব্রাউজার আসারও তিন বছর আগে থেকে। কিন্তু এটা আসলেই বাস্তব কোনো রোগ কি না, কিংবা হলেও কীভাবে তার সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কেউই এখনো একমত হতে পারেনি। কতজন এই আসক্তিতে ভুগছে, তার হিসেবও একেক গবেষণায় একেক রকম। ইন্টারনেট তো আর হেরোইনের মতো মানুষকে মেরে ফেলে না। ইন্টারনেট আসলে অনেক কাজে লাগে। আর এটা বলাও খুব শক্ত যে, মানুষ কি আসলে ইন্টারনেটে আসক্ত, না কি ইন্টারনেটের পাওয়া যায় এমন কোনো জিনিসে (যেমন পর্নোগ্রাফি বা অনলাইন জুয়া)। 

তবে এসব আসক্তির ব্যাপারগুলো কিন্তু খুবই ভয়ংকর। ক্র্যাকবেরির মতো মাদক নিয়ে হাসিঠাট্টা করা কিংবা ফেসবুক-টাম্বলারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা দিয়ে তা পরিষ্কার বোঝা যায় না।

তবুও লাখো মানুষ ইন্টারনেটকে রীতিমতো বাধ্যতামূলক একটা ব্যাপার বলে মনে করে। এজন্য কেউ ইন্টারনেটকেই দোষারোপ করে। আবার কেউবা মনে করে দোষ হচ্ছে যে ব্যবহার করছে, তার নিজের। আসলে দুটো কথার একটাও ঠিক না। ইন্টারনেট এমনকিছু না যেখানে আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে। এটা জাস্ট যোগাযোগের একটা মাধ্যম। আর এই নেটওয়ার্ক এমন কিছু না যে, ব্যবহার করলে আমি নিজের অজান্তেই আসক্ত হয়ে যাবেন। 

তাহলে নিজেকে সামলাতে না-পারার দোষ কি মানুষকেই দিতে হবে? হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। নিজেকে তো নিজেরই সামলাতে হবে। কিন্তু এ-কথাও সত্য যে, অনেক অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়, যাতে একবার এখানে ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছা করবে না কারও।

বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের এই প্রতিদিনকার ইন্টারনেট ব্যবহার করার দিকটা ঠিক করে দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার মডেলই হচ্ছে মানুষের মনযোগ ধরে রেখে পেজভিউ আর ক্লিকের সংখ্যা বাড়ানো। মানুষের মনযোগ আরও বেশি পাওয়ার জন্য তো বড় কোম্পানিগুলোর বিশেষজ্ঞ দল আছে। আর তাদের হাতে আছে মানুষের ব্যক্তিগত অসংখ্য তথ্য। এই সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই, যেকোনো মূল্যে মানুষকে তাদের ওয়েবসাইটে ধরে রাখা।

‘ইচ্ছাশক্তি, দায়িত্ববোধ, সংযমের মাধ্যমে একজন অনেক চেষ্টাই করতে পারে, এবং এটা সত্যিই খুব ভালো একটা ব্যাপার। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাস্তার অপর পাশে ভিন্ন একটা বাস্তবতাও আছে।’ —এই কথাটা ট্রিসিয়ান হ্যারিসের। তিনি গুগলে কাজ করেন এবং এথিক্যাল ডিজাইনের একজন প্রবক্তা। হ্যারিস আমাকে বলেছিলেন, ‘বড় টেক কোম্পানিগুলোর হাতে শত শত প্রতিভাবান পরিসংখ্যানবিদ আর বিজ্ঞানী আছে, যাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে নানান উপায়ে মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে ভেঙে দেওয়া।

সহজ করে বলতে গেলে, এই যুদ্ধে এক পক্ষ অন্য পক্ষের চাইতে অনেক বেশিই দুর্বল।

সিলিকন ভ্যালি ও আসক্তির সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে যখন Nir Eyal-এর বই Hooked প্রকাশিত হয়—যেখানে ডিজাইনারদের শেখানো হয় কীভাবে ব্যবহারকারীর মনে ‘চাহিদা’ তৈরি করতে হয়—তখন তা কোনোরকম বিতর্কেরই জন্ম দেয়নি। বরং বইটি বেস্টসেলার হয়। নামকরা প্রযুক্তি লেখকরা এই বইটির প্রশংসা করেছিলেন, এমনকি WordPress-এর প্রতিষ্ঠাতাও। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনারও হয় বইটি নিয়ে।

Eyal তার ক্লায়েন্টদের শেখান কীভাবে ফেসবুক আর পিন্টারেস্টের মতো ‘নেশা ধরানো’ ওয়েবসাইট বানাতে হয়। বিজনেস ইনসাইডারকে তিনি বলেছিলেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবহারকারীদের এমন একটা চক্রের মধ্যে ফেলে দেওয়া, যার কোনো শেষ নেই। Hooked বইয়ে এ তিনি একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন : ‘এই কোম্পানিগুলো তো কিছু কোডই তৈরি করছে মাত্র—তাহলে ইউজারদের মনটাকে এত বেশি নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে তারা?’  

তার মতে, একটা সহজ চার-স্টেপের একটা মডেলই হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর। ফেসবুকের নিউজফিডের কথাই ধরা যাক। প্রথম দুটো স্টেপ একদম সহজ, প্রথমেই কিছু একটা আপনাকে ট্রিগার করবে, যাতে স্ক্রল করার ইচ্ছাটা হয়। আর তারপরেই কাজটা করা হয়। মানে স্ক্রল করে নিচে নামতে শুরু করলেন আপনি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে স্ক্রল করে নিচে নামলে কী পাওয়া যাবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। কিছু একটা পাওয়ার আশায় স্ক্রল করতেই থাকবেন আপনি। ফেসবুক হলে হয়তো আপনি বিড়ালের একটা মজার ভিডিও পাবেন, কিংবা আপনার চোখে পড়তে পারে কোনো পরিচিত মানুষের বিরক্তিকর পোস্ট!

এই অনিশ্চয়তা থেকেই আসলে আগ্রহ তৈরি হয়—আর এটাকেই বলে ‘ভ্যারিয়েবল রিওয়ার্ড’।

এরপর, Eyal-এর মতে, আপনাকে ছোটখাটো কোনো ইনভেস্টমেন্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়—যেমন কোনো পোস্টে লাইক দেওয়া, কমেন্ট করা বা শেয়ার করা। একজন যত বেশি এগুলো করতে থাকবে, সে তত বেশি এই চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়বে—ট্রিগার, অ্যাকশন, রিওয়ার্ড, ইনভেস্টমেন্ট! 

আর এইভাবেই একসময় আপনি আসক্ত হয়ে যাবেন।

ব্যাপারটা সেই স্কিনারের পরীক্ষার মতোই। কারণ এই মডেলটা ঠিক সেই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। যেমনটা স্কিনার দেখিয়েছিলেন—পুরস্কারটা অনিশ্চিত হলে সেটা পাওয়ার জন্য লোকজন পাগলা হয়ে উঠতে পারে। জুয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে এই কৌশল বহুদিন ধরেই চলছে—স্কিনার নিজেও বলেছিলেন, সবচেয়ে ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে স্লট মেশিন, যেটা বারবার ঘোরানোর পরেও কী আসবে, তা আগে থেকে কখনোই আন্দাজ করা যায় না।

নাতাশা শুল, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একজন নৃতত্ত্ববিদ। তার কাজ হচ্ছে মানুষ আর যন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে। ২০১২ সালে তাঁর লেখা Addiction by Design বইটা বের হওয়ার পর সিলিকন ভ্যালির অনেক ডিজাইনার তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসেন। বইটা ছিল লাস ভেগাসের জুয়াড়ি আর জুয়ার মেশিন ডিজাইনারদের নিয়ে।

অনেকের ধারণা, জুয়ায় আসক্তরা আসলে জিততেই চায়। কিন্তু শুল বলেন, তারা মূলত একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যান, যেটাকে তিনি বলেন ‘মেশিন জোন’। এই জোনে মানুষ সময়, জায়গা বা নিজের পরিচয়—সব ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র মেশিনের একঘেয়ে ঘূর্ণির মধ্যেই ডুবে থাকে। 

স্লট মেশিন আর ওয়েবসাইট এক জিনিস না, পার্থক্য আছে। লোভনীয় রিওয়ার্ডের জন্য স্লট মেশিনে আপনি যত বেশি সময় কাটান, তত বেশি টাকা হারান। কিন্তু ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আপনি যত বেশি সময় ধরে থাকেন, যত বেশি ক্লিক করেন, স্ক্রল করেন—বিজ্ঞাপন থেকে তত বেশি লাভ হয় প্রযুক্তি কোম্পানির। আমরা সাধারণত বলি ইন্টারনেট আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে, কিন্তু যখন আপনি বারবার মেইল চেক করেন, ফেসবুক ঘাঁটেন বা ক্যান্ডি ক্রাশ খেলেন, তখন আপনাকে বিশেষ আরেক ধরনের মনযোগ দিতে হয়—যার পুরোটাই আসলে দ্রুত কিছু পাওয়ার আশাতেই গড়ে ওঠে।

জুয়ার দুনিয়ায় সাধারণত আসক্তদেরই দোষ দেওয়া হয়। বেশিরভাগ গবেষণাতেও আসক্তদের মন ও অভ্যাস নিয়েই আলোচনা করা হয়। কিন্তু গবেষক নাতাশা শুল মনে করেন মানুষ আর মেশিনের মাঝে অবশ্যই কিছু একটা আছে। সেই মেশিন বা গেমগুলো এমনভাবেই বানানো হয় যাতে মানুষ নিজের অজান্তেই আটকে যায়!

তারপরও আমরা দোষ দিই শুধু মানুষকেই। শুল বলেন, ‘মানুষকে আসক্ত করার জন্য যখন ইচ্ছা করেই এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, তখন শুধু মানুষকেই দোষ দেওয়াটা আসলে অন্যায়।’

Nir Eyal নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। ফোনে কথা বলার সময় একজন চিন্তাশীল, সিরিয়াস, এবং নিজের কাজের নৈতিক দিকগুলো নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ব্যক্তি হিসেবে ধরা দেন। তিনি প্রায়ই হেলথকেয়ার কোম্পানিগুলোকে Hooked বইয়ের কৌশলগুলো ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন—যেমন, এমনকিছু টুল বানানো, যেগুলো মানুষকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পর্ন বা গ্যাম্বলিং সাইটের জন্য কখনোই কাজ করেন না তিনি। তার ভাষ্য : তার বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমনকিছু বানানো যা মানুষকে সুন্দর ও সুখী জীবন দিতে সাহায্য করবে।

তিনি আরও বলেন, ‘কাউকে জোর করে কিছু গছিয়ে দেওয়া ঠিক না। আমি শুধু মানুষকে বোঝাতে বলি, কোও কিছু চাপিয়ে দিতে বলি না। আর আমি জানিও না, কীভাবে একটা মানুষকে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়।’ 

Addiction by Design বইতে শুল লিখেছেন, ‘গেম ডিজাইনাররা ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রযুক্তিকে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে জুয়ারিরা ধাঁধায় পড়ে যায়। কেউ কেউ এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত হয় বটে, আবার কেউ কেউ এগুলোর পক্ষে যুক্তি দেয় এই বলে যে, তারা তো শুধু জুয়ারিদের ইচ্ছা পূরণ করতেই এমনটা করে।’ 

এই কথাগুলো অনেকটা Eyal-এর সেই দাবির মতো শোনায়: আপনি কাউকে এমন কিছু বিক্রি করতে পারবেন না, যা সে ইতোমধ্যেই আর চায় না। আমি যখন Schüll–কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় ইয়েল ভালোমনেই কথাটা বলেছে,’ তবে তিনি এটাও বলেন যে, মেশিন ডিজাইনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু মানুষ কী চায় বা চায় না, তার উপর আটকে থাকে না। আসল ব্যাপার হচ্ছে এক্ষেত্রে চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানের জায়গাটাকে আরেকটু উসকে দেওয়া হয়, জোরদার করা হয় আর নতুন একটা রূপ দেওয়া হয়।

অর্থাৎ, আমাদের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য থেকেই যায়। আমরা অনলাইনে যাই বিনোদনের জন্য, যোগাযোগের জন্য বা তথ্য খুঁজতে। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আমরা ইচ্ছা করেই একটু অমনোযোগী হয়ে যাই আর কী। আর কোম্পানিগুলো এই সুযোগটাই কাজে লাগায়—তারা আমাদের চাওয়াটাকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দেয়। যেমন আমরা ফেসবুকে ১০ মিনিট থাকার ইচ্ছে নিয়ে ঢুকি, কিন্তু আধা ঘণ্টাতেও আর বের হতে পারি না।

চাওয়ার এই বাড়তি রূপকে ঠিক কী নামে ডাকা যায়, তা বলা শক্ত। খারাপভাবে বললে, এটা জোরজবরদস্তি। ভালোভাবে বললে ব্যাপারটা এমন যে, প্রযুক্তির কাছে সাধারণ কনজিমারদের ইচ্ছাশক্তির কোনো দামই নেই। জুয়া এর ভালো উদাহরণ—সেই মেশিনগুলো এমনভাবে বানানো হয়, যাতে মানুষ অনেকক্ষণ ধরে খেলে যায়, আর কোম্পানির লাভ হয়। এখন ইন্টারনেটেও ঠিক এরকম কায়দা-কানুনের ব্যবহার দেখা যায়। অবশ্য এর শুরু থেকেই ধরনের নৈতিক অস্বস্তিও আমাদের মনে জন্ম নিয়েছে।

১৯৯৮ সালে, ক্যাপটোলজি (কম্পিউটার দিয়ে মানুষের আচরণ বদলানোর প্রসেস) নিয়ে প্রথম গবেষণা হয়, তখন স্ট্যানফোর্ডের একজন মনোবিজ্ঞানী বি. জে. ফগ বলেছিলেন, ‘উচ্চপ্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা যেন ভালো-মন্দ সবকিছু বিবেচনা করেই কাজটা করেন।’ তবে এটাকে খুব শক্ত কোনো সতর্কবার্তা বলা যায় না।

Eyal তার Hooked বইতে নৈতিকতার সহজ নিয়ম বাতলে দিয়েছেন—যাতে ডিজাইনাররা বুঝতে পারেন, তারা ঠিকভাবে কাজ করছেন কি না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউ যদি এই বই পড়ে খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করে, তাকে থামাবে কে? Eyal-এর সোজাসাপ্টা বললেন, ‘কেউ না।’ তবে তার মতে, অনেক কোম্পানি নিজেরাই সচেতন থাকে, কারণ বেশি আসক্ত হয়ে গেলে বিরক্ত হয়ে একসময় ইউজাররা সব ছেড়েছুড়ে দিতে পারে।

তবে এই মধ্যপন্থা অবলম্বন করার মতো ব্যাপারগুলো আসলে সিলিকন সিলিকন ভ্যালির বিজনেস মডেলের সাথে ঠিক খাপ খায় না।  

ইন্টারনেটকে একটা বিশাল লাইব্রেরির মতো ভাবা যেতে পারে। প্রতিটা আর্টিকেল, উইজেট, স্লাইড, গেমের লেভেল আর ল্যান্ডিং পেজগুলো হচ্ছে এককেটা ঘর। একটা লিংকে ক্লিক করছেন মানেই আপনি নতুন কোনো ঘরে ঢুকে পড়ছেন। 

শুরুর দিকে, অনলাইনে আয় করার জন্য লোকজন সেই ঘরের ভেতরের জিনিসগুলোই বিক্রি করত। হতে পারে সেটা ভালো মানের সাংবাদিকতা, কোনো গেম, কোনো রেসিপি, বা এমন কিছু যা কারও বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। এই মডেলে ইন্টারনেট ছিল ডিজিটাল দুনিয়ায় সরাসরি কেনাবেচার একটা জায়গা।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শুধু ঘরের ভেতরের জিনিস দিয়ে নয়, দরজাগুলোর মাধ্যমেও আয় করতে শুরু করে। তারা দরজায় সেন্সর বসায়। আপনি যতবার কোনো দরজা দিয়ে ঢুকবেন, কেউ না কেউ বিনিময়ে টাকা পাবে। এবং এজন্যই নিত্যনতুন দরজা যোগ করতে থাকে মানুষ। আবার কেউ কেউ এমন ঘর তৈরি করে যেগুলো ভেতরে ফাঁকা, কিন্তু বানানো হয়েছে শুধু মানুষ যেন ঢুকেই আবার বেরিয়ে যেতে পারে— যত বেশি মানুষ যত বেশি দরজা পার হবে, তত বেশি লাভ। 

আপনি যদি Slate.com-এ কোনো আর্টিকেলে ক্লিক করেন, তার মানে হচ্ছে আপনি এক ধরনের ‘আর্টিকেল ঘরে’ ঢুকলেন। Slate এই ঘর থেকে আয় করে কারণ তারা ওই ঘরের ভেতরে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘দরজা’ বিক্রি করেছে। এই দরজাগুলোকেই বলা হয় বিজ্ঞাপন। এই কাঠামো এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করে, কারণ বাইরে থেকে মনে হয় Slate চায় মানুষ তার ভালোমানের আর্টিকেল পড়ুক, কিন্তু আসলে ওরা আয় করে তখনই, যখন কেউ ঘরে ঢুকে আবার দ্রুত বেরিয়ে যায়—হয়তো কোনো বিজ্ঞাপন দেখে ক্লিক করে, না হয় আরেকটা আর্টিকেলে।

এবং সত্যি বলতে, Slate ঠিক এভাবেই কাজ করে। ২০১৩ সালেএক ভাইরাল আর্টিকেলে প্রযুক্তি সাংবাদিক ফরহাদ মাঞ্জু (Chartbeat-এর সঙ্গে পার্টনারশিপে) দেখান Slate-এর পাঠকরা আসলে কতক্ষণ একটা আর্টিকেলে থাকেন। তারা দেখেন ৩৮ শতাংশ মানুষ আর্টিকেল খোলে কিন্তু একটুও পড়ে না। যারা পড়া শুরু করে, তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশেরও কম মানুষ শেষ পর্যন্ত পড়ে। আর ৫ শতাংশ কেবল হেডলাইন দেখেই সরে পড়ে। লোকজনের এই প্রবণতাকে মাঞ্জু ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—‘আমরা এখন স্কিমিং-এর যুগে আছি!’ কিন্তু এতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই পরিকল্পনাটা করাই হয়েছে শুধু লাভ করার জন্য।

সময় বদলে গেছে, চমৎকার ঘর বানিয়ে ইন্টারনেটে টাকা আয় করে না কেউ। এখন মানুষকে যত বেশি সম্ভব দরজা দিয়ে পার করিয়ে দিতে পারলেই টাকা আসে। মানে, তাদেরকে ইন্টারনেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা—যেন তারা একটা করিডোর ধরে হাঁটছে তো হাঁটছেই, থামার কোনো লক্ষণই নেই। তারা শুধু ক্লিক করে করে এগিয়েই চলছে।

ট্রিসিয়ান হ্যারিস ছোটোবেলা থেকেই হাতসাফাইয়ের প্র্যাকটিস করতেন। তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন যে, কীভাবে একজন মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। স্ট্যানফোর্ডে তিনি Fogg-এর সাথেই  persuasive technology নিয়ে পড়েছেন। তার ক্লাসের অনেকেই এখন সিলিকন ভ্যালিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার ক্লাস প্রজেক্টের এক পার্টনারই তো পরবর্তীতে হয়েছিলেন ইনস্টাগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। স্ট্যানফোর্ড থেকে বের হওয়ার পর হ্যারিস অ্যাপলের ইন্টারফেস ডিজাইন করেন। তিনি Apture নামের একটা মাল্টিমিডিয়া সার্চ টুলও বানিয়েছিলেন, যেটা পরবর্তীতে গুগল কিনে নেয়। বর্তমানে তিনি গুগলেই ডিজাইন ফিলসফার হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি এথিক্যাল ডিজাইন নিয়ে বেশ সোচ্চার এবং তিনি Time Well Spent নামে ছোট্ট পরিসরের একটি আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছেন। 

একটা আদর্শ Time Well Spent ডিজিটাল দুনিয়ায় ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করবে, তারা আসলে কী চায়। আর ঠিক এজন্যই হ্যারিস এমন একটা ওয়েবের কল্পনা করেন, যেটা খুবই ফ্লেক্সিবল। যেমন ধরা যাক, কেউ মাত্র ১৫ মিনিট ফেসবুকে থাকতে চায়। তার ইচ্ছাকে ফেসবুকও সম্মান করবে। আর নির্ধারিত সময় শেষ হলে ভালোভাবেই মনে করিয়ে দেবে যে, সময় শেষ। আবার যদি কেউ চায় কোনো রকম ইমেইল না দেখেই নিরিবিলি কম্পিউটারে দুই ঘণ্টা কাজ করবে, তাহলে সার্ভারগুলোও তাকে সাহায্য করবে, অহেতুক ইমেইলের নোটিফিকেশন পাঠিয়ে সেই সময়টাতে আর তাকে বিরক্ত করবে না, কাজ শেষে একবারে পাঠাবে। আবার কেউ যদি চায় যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণই Angry Birds খেলবে, সে তা-ও করতে পারবে।  

কিছু অ্যাপ ইতোমধ্যেই এই ধরনের কাজে সহায়তা করে। Freedom নামের একটি অ্যাপ নির্দিষ্ট কিছু সাইটে ঢুকতেই দেবে না। Saent নামের একটি প্রোডাক্টিভ টুল কারও অনলাইন বিহেভয়ার ট্র্যাক করে তাকে সাজেশন দিয়ে থাকে যাতে অকারণে সে সময় নষ্ট না করে। 

হ্যারিস বলেন যে, ‘শুধুমাত্র মনযোগ পাওয়ার জন্যই চেষ্টা করলে হবে না, বরং আমাদের দেখা উচিত যে মানুষের জীবনে ভালো কিছু হচ্ছে কি না।’ এরকম কথা তো ভালোই লাগে শুনতে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হবে কীভাবে! ইনভেস্টররা তো এরকমভাবে ভাবে না।   

এই Time Well Spent-এর ব্যাপারটাকে হ্যারিস তুলনা করেন অর্গানিক খাবারের সাথে। তার মনে এখনকার ইন্টারনেটটা হচ্ছে জাঙ্ক ফুডের মতো—যা আছে তার সবটাই অস্বাস্থ্যকর। তিনি এমনকিছু বানাতে চান, যা মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে স্বাস্থ্যকর  

করে তুলবে। অর্গানিক খাবারগুলোতে যেমন সরকারের সার্টিফিকেট থাকে, হ্যারিসের মনে হয় যে ওয়েবসাইটগুলো মানুষের ভালোর জন্যই কাজ করে, সেগুলোকেও ভবিষ্যতে এমন সার্টিফিকেট দেওয়া যেতে পারে। 

তুলনাটা চমৎকার হলেও এখানে কিছু চিন্তার ব্যাপার আছে। অর্গানিক খাবারের বাজারটা খুব একটা বড় না এবং বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। এর সুবিধা নিয়ে কিছু ধনী মানুষজন বড় ধরনের শিল্পভিত্তিক খাদ্য আলোচনার বাইরে থেকেই নিজেদের মতো করে আলাদা পথ তৈরি করে নেয়। অর্গানিক ওয়েব-এর ক্ষেত্রেও আসলে সমস্যাটা একই রকম। এসব টুল হাতের কাছে থাকলেও তা  ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর বিশেষ দক্ষতা আর চেষ্টার প্রয়োজন। যেমনটা দেখা যায়, Freedom-এর টুলগুলো শুধুমাত্র প্রযুক্তি-সচেতন পেশাজীবীরাই এটা ব্যবহার করে। Saent-এর প্রথমদিকের ব্যবহারকারীদের তিনভাগের দুইভাগই ছিলেন সফটওয়্যার ডেভেলপার। 

অনলাইনে আসক্তি বা মনোযোগের সমস্যাগুলো যারা বিস্তর পড়েছে, তারা নিশ্চয়ই একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। লেখকরা প্রথমে যথেষ্ট রাগের সাথেই বলেন যে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সাথে আসলে ক্যাসিনো বা এই ধরনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবসাগুলোর কোনো পার্থক্য নেই, এদের সবার কাজই হচ্ছে মানুষদের আসক্ত করে ফেলা। এরকম রাগ দেখাতে দেখাতেই আবার তারা হুট করে বলে বসেন, এখানে ডিজাইনারদের কিছু করার নাই, বাঁচতে হলে ইউজারদেরই উচিত নিজেকে বদলে ফেলা। 

এসব কথাবার্তার আসলে কোনো মানে হয় না। টেক সমালোচক ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিল ডেভিডো ‘The Atlantic’-এর ওয়েবসাইটে লিখেছেন যে, টেক কোম্পানিগুলো মানুষের ‘নার্ভ সায়েন্সকে হাইজ্যাক’ করে। এরা আসলে তামাক কোম্পানি আর ক্যাসিনোর মতোই। সমাজে এক ধরনের মহামারির কথা বলার পর তিনি আফসোস করে বলেন যে, ‘এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই’। তারপর, হঠাৎ যেন একটু নরম সুরেই তিনি বলেন, ইউজাররা চাইলে স্মার্টফোনটা নিজেদের নাগালের বাইরে রাখতে পারে, এতে আশেপাশের মানুষের সাথে কথাবার্তা বলার একটা সুযোগ তৈরি হবে।

ডেভিডো আসলে মূল কথাটাই ধরতে পারেননি। তার কথামতো পরিস্থিতি যদি এতটাই খারাপ হয়, এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলো নিজেরাই নিজেদের ঠিক করে নেবে—এরকম শিশুতোষ ভাবনা যদি আমাদের না থাকে, তাহলে দিনশেষে একটা অপশনই আমাদের হাতে আছে : আমাদেরই এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। 

‘নিয়ম’ (regulation) শব্দটা আসলে ভয়ংকর, বিশেষ করে যারা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেটের স্বাধীনতার পরিবেশে বড় হয়েছে, তাদের কাছে। এজন্যই হয়তো মনোযোগ নষ্ট করা প্রযুক্তিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার কথা ভাবতেও আমাদের অস্বস্তি লাগে। একদিকে আমরা ভাবি কারও আসক্তি বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার হচ্ছে ইউজারদের ব্যক্তিগত সমস্যা, এসব ডিজাইন করা কোনো ফাঁদ না। আরেকদিকে আমরা মনে করি, নিয়ম মানেই হচ্ছে ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!

কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এখানে এমন নিয়ম করা যেতে পারে যা আসলে ইউজারদের আরও বেশি স্বাধীনতা দেবে। এখানে খুব হম্বিতম্বি করার কিছু নেই, শুধু এমনকিছু করতে হবে যাতে ইউজাররা নিজেরাই নিজেদের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।

এই কাজটা অবশ্য মোটেই সহজ কিছু না। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন, যখন সরকার কিছু বিশেষ ধরনের মাদক নিষিদ্ধ করে, যেমন কৃত্রিম গাঁজা (যেটাকে অনেকে K2 বা Spice বলে), তখন মাদক কারবারিরা ওই মাদকের গঠন একটু বদলে নতুন একটা ধরনের মাদক বানিয়ে ফেলে, যেটা প্রচলিত আইনের বাধার মধ্যে পড়ে না। ঠিক তেমনই, মনোযোগের সমস্যাটা যেহেতু খুবই ধোঁয়াটে একটা ব্যাপার আর ইন্টারনেটের ব্যপ্তিটাও বিশাল, তাই কোম্পানিগুলোও সহজেই তাদের ডিজাইনে হালকা পরিবর্তন করেই আবার নতুনভাবে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার কৌশল বের করে ফেলবে। তবুও, নিয়ম-কানুন করাটা খুব ভালো একটা কাজ হবে। এসব নিয়মের মাধ্যমে কিছু সাধারণ কৌশলগুলোকে টার্গেট করা যাবে, যেগুলো ব্যবহার করে ডিজাইনাররা মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইনে ধরে রাখে।

এখানে তিনটি কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া ও গেমিং সাইট, ইমেইল সার্ভিস এবং স্মার্টফোন নির্মাতাদের বাধ্য করা যেতে পারে যেন তারা এমন একটি “ড্যাশবোর্ড” দেয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা নিজেদের মনমতো তাদের ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।

ফেসবুক এখন কিছু নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে (পরীক্ষামূলক, সবাই এখনো পায়নি)। ইউজাররা এই ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে ঠিক করতে পারে কখন, কীভাবে, এবং কতবার নোটিফিকেশন পাবে। আমরা কোম্পানিগুলোকে এমন উপায় বের করতে বলতে পারি, যাতে ইউজাররা নিজেরাই ঠিক করতে পারে, দিনে কতবার ইমেইল পাবে বা একটি সামাজিক মাধ্যম কতবার তাদের ফিড আপডেট করবে। এমনকি ইউজাররা এমন ড্যাশবোর্ড ব্যবহার করে পেজের ডিজাইনও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবে, যেমন ধরুন, একটা পেজে কতটা নতুন কনটেন্ট তারা দেখতে চায়!

নির্দিষ্ট কিছু compulsive design বা আসক্তিকর ডিজাইনের ফিচার একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেওয়াই সম্ভবত ভালো হবে। এটার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে— ‘continuous’ বা ‘infinite scroll’, অর্থাৎ এমন ডিজাইন যেখানে স্ক্রল করলেও কখনো একদম শেষে পৌঁছানো যায় না। যেমন ফেসবুক বা টুইটারের মতো সাইটগুলোতে পেজ নিজে থেকেই বারবার রিফ্রেশ হয়—আপনি ফিডের একদম শেষ পর্যন্ত পারবেন না। ঠিক তেমনি, টিন্ডারে আপনি একটানা লেফট বা রাইট সোয়াইপ করতে পারেন, এর কোনো সীমা নেই। আবার ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো সাইটগুলোও নিজে থেকেই পরবর্তী ভিডিও বা শো চালিয়ে দেয়।

সোশাল মিডিয়ার infinite scroll এমন ডিজাইন যেখানে স্ক্রল করলেও কখনো একদম শেষে পৌঁছানো যায় না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

‘হুকড’ মডেল অনুযায়ী, এভাবেই সাইটগুলো আমাদের বারবার ব্যবহার করতে বাধ্য করে। এতে কোম্পানির লাভ হয়, কারণ আমরা বেশি সময় সেখানে থাকি। কিন্তু ইউজারদের জন্য এতে বিশেষ কোনো উপকার নেই। বরং এই ব্যাপারটা ইউজারদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটাই নষ্ট করে দেয়। যদি একেকটা পেজ বা সেশনের শেষে থামার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে— চলবে কি না! এতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।

আরেকটা নিয়ম হতে পারে: যেসব যে ইউজাররা একটু বেশিই আসক্ত, তাদের সতর্ক করে দেওয়া। ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে পারাটা শক্ত। কিন্তু কিছু সমস্যা তো চোখেই দেখা যায়। ফেসবুকের মতো সাইটগুলো জানে কে আসলে কতটুকু আসক্ত। Eyal-ও ঠিক এমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, আগে মদের ব্যবসায়ীরা বলতো, আমরা জানি না কে মদে আসক্ত। কিন্তু এখন ফেসবুক জানে আপনি কতবার ফেসবুক চেক করছেন, টুইটার জানে আপনি কতক্ষণ টুইটারে থাকেন, গেম কোম্পানিগুলো জানে আপনি তাদের ফ্রি-টু-প্লে গেম কতক্ষণ খেলেন। তাই চাইলেই কোম্পানিগুলো ব্যবস্থা নিতে পারে।’  আর নাগরিক হিসেবে আমরাও কোম্পানিগুলোকে চাপ দিতে পারি, যেন তারা ইউজারদের জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয় এবং বেশিমাত্রায় আসক্তদের সতর্ক করে দেয়।

তৃতীয় উপায় হতে পারে একটু হালকাভাবে ইউজারদের সাহায্য করা। যেমন, কিছু ওয়েবসাইট বা ব্রাউজারে এমন ফিচার থাকতে পারে, যেখানে ইউজাররা নিজেরা দেখতে পারবে—আমি আজ কতক্ষণ এই সাইটে ছিলাম, দিনে কয়বার ঢুকেছি ইত্যাদি। এমনকি চাইলে নিজের জন্য একটা সময়সীমাও ঠিক করে নিতে পারবে: যেমন, ‘আমি যদি আজ টুইটারে এক ঘণ্টার বেশি থাকি, তাহলে আমাকে সাইট থেকে বের করে দিয়ো।’

অবশ্য মনে হয় না, এই উপায়গুলোকে আমরা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারব। অন্তত আমেরিকায় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ম-কানুনের মধ্যে নিয়ে আসা খুব কঠিন। তবে মাঝেমধ্যেই এসব কথা বলা দরকার, যাতে সবাই নতুনভাবে চিন্তা করতে পারে। ইন্টারনেট আমাদের অনেক কাজে লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা সবসময় আমাদের ভালোর জন্যই না। আমরা আসলে একটা চুক্তির মধ্যে ঢুকে যাই—আমরা আমাদের সময় আর ব্যক্তিগত তথ্য দেব, আর বিনিময়ে সার্ভিস নেব। 

অন্যান্য সাধারণ চুক্তির মতো এই চুক্তিতে দুই পক্ষের শক্তি সমান না। আজকের ইন্টারনেটের আদ্যোপান্ত দেখে মনে হয় এর ডিজাইনারদের হাতেই অনেক বেশি ক্ষমতা চলে গেছে। বেচারা মাইকেল বা স্কিনারের সেই কবুতরগুলোর মতো হতে না চাইলে আমাদের সত্যিই ভাবা উচিত—আমরা আসলে ভুল যায়গায় বেশি মনযোগ দিয়ে ফেলছি কি না। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।