অনলাইনে গেলেই আমার আমার মনে পড়ে বি এফ স্কিনারের সেই সাদা কবুতরগুলোর কথা। নিজেকে তখন ওদের একটা বলেই মনে হয়। ছোটো একটা বাক্সে প্লেক্সিগ্লাসের টুকরোতে ঠোকর মেরে মেরে এই কবুতরগুলোর জীবন কেটেছে। ব্যাপার হচ্ছে, ওদের এই ঠোকরা-ঠুকরির দেখেই হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী স্কিনার বেশকিছু আচরণগত নীতি আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। তার এই নীতিগুলো আজকের এই ডিজিটাল দুনিয়াতেও ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।
স্কিনার তার কবুতরগুলোকে একটা শিক্ষাই দিয়েছিলেন—ঠোকর মারলেই খাবার! কখনো ঠোকর মারার সাথে সাথে, আবার কখনো একটা নির্দষ্ট সময় পরপর। যেমন, একবার খাবার দেওয়ার পর ৬০ সেকেন্ডের মধ্যে আর কিছু দেওয়া হবে না। এই সময় পার হলে আবার ঠোকর, আবার খাবার। একটা পর্যায় পর্যন্ত কবুতরগুলো সময়ের ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারত। কিন্তু স্কিনার করলেন কী, সময়ের ব্যাপারটা এলোমেলো করে দিলেন—কখনো ৬০ সেকেন্ড, কখনোবা ৫ সেকেন্ড, আবার কখনোবা ২০০ সেকেন্ড। এবার সময়ের বিভ্রান্তিতে পড়ে কবুতরগুলো রীতিমতো দিশেহারা হয়ে গেল। একটা কবুতর তো টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে প্রতি সেকেন্ডে আড়াইবার করে ঠোকর মেরেছিল! আর আরেকটা কবুতর ১৪ ঘণ্টায় ঠোকর মেরেছিল ৮৭ হাজার বার। অবশ্য এই কষ্টের ১% খাবারও তার ভাগ্যে জোটেনি!
এবার তাহলে দেখা যাক, এই কবুতর-গবেষণার ব্যাপারটা কীভাবে আজকের এই ডিজিটাল জীবনের সাথে মিলে যায়। ধরা যাক, মাইকেল এস একজন সাংবাদিক (কাল্পনিক)। তার কাজের একটা বড় অংশই হচ্ছে ইমেইল চালাচালি। প্রতি ৪৫ মিনিটে তার কাছে একটা ইমেইল হলেও আসে। কখনো ২ মিনিটের মধ্যেও আসে, আবার কখনো ৩ ঘণ্টাও লাগে। বেশিরভাগই হয়তো ফালতু আর অহেতুক ইমেইল, কিন্তু কিছু তো মজার, কাজের তো বটেই। তো মাইকেল ইন্টারনেটে এলেই প্রথমে প্রতি ৩০ মিনিটে একবার ইমেইল চেক করতে থাকেন, একটা পর্যায়ে ৫ মিনিট পরপর, এমনকি কখনো কখনো ২ মিনিট পরপরই। ব্যাপারটা যেন বাধ্যতামূলক একটা অভ্যাস হয়ে গেল তার। সেই ক্রমাগত ঠোকরানো কবুতরগুলোর মতোই মাইকেল হয়ে উঠলেন একজন ক্রমাগত ঠোকরানো ওয়েব ইউজার।
ছোট্ট একটা বাটন চেপে চেপেই এভাবে সময় নষ্ট করার জন্য কি আমরা মাইকেলকে দোষ দিতে পারি? হয়তো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তার নেই বললেই চলে। আর তার পেশাটাই এমন, যেখানে কমিউনিকেশনের জন্য ইমেইল আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাহলে স্কিনারের কবুতরগুলোর ক্ষেত্রে আমরা কী ভাবব? ওদের কি আসলে কোনো দোষ আছে? বাক্সবন্দি কবুতরগুলো খাবারের জন্য ঠুকরেই যাচ্ছে, আর এক গবেষক তাদের এই পাগলামি নিয়ে গবেষণা করছেন! পুরো ব্যাপারটা আসলে কে নিয়ন্ত্রণ করছে? কবুতরগুলো? না কি স্কিনার, যিনি এই বাক্সটি নিজ হাতে বানিয়েছেন?
২০১৫ সালের পর থেকে ইন্টারনেটকে নিতান্তই একটা বিধ্বংসী ব্যাপার বলে মনে করা হচ্ছে। আসক্তি বা বাধ্যতামূলক কিছুর উদাহরণ হিসেবে আমরা অহরহই ডিজিটাল লাইফের কথা বলি। ২০০০ সালের দিকে ইউজাররা তাদের স্মার্টফোনগুলোকে বলত, ক্র্যাকবেরি (ক্র্যাক নামক একটা মাদকের সাথে মিলিয়ে)। এখন সাধারণ কথাবার্তাতেও আমরা ফেসবুক, টুইটার, ইমেইল, নেটফ্লিক্সকে এমনভাবে উপস্থাপন করি যে এগুলো আসলে নেশা বা জুয়ার কোনো বস্তু।
সাইকোলজিস্টরা ১৯৯৬ সাল থেকেই সম্ভাব্য ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে কথা বলে আসছেন। মানে ওয়েব ব্রাউজার আসারও তিন বছর আগে থেকে। কিন্তু এটা আসলেই বাস্তব কোনো রোগ কি না, কিংবা হলেও কীভাবে তার সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কেউই এখনো একমত হতে পারেনি। কতজন এই আসক্তিতে ভুগছে, তার হিসেবও একেক গবেষণায় একেক রকম। ইন্টারনেট তো আর হেরোইনের মতো মানুষকে মেরে ফেলে না। ইন্টারনেট আসলে অনেক কাজে লাগে। আর এটা বলাও খুব শক্ত যে, মানুষ কি আসলে ইন্টারনেটে আসক্ত, না কি ইন্টারনেটের পাওয়া যায় এমন কোনো জিনিসে (যেমন পর্নোগ্রাফি বা অনলাইন জুয়া)।
তবে এসব আসক্তির ব্যাপারগুলো কিন্তু খুবই ভয়ংকর। ক্র্যাকবেরির মতো মাদক নিয়ে হাসিঠাট্টা করা কিংবা ফেসবুক-টাম্বলারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা দিয়ে তা পরিষ্কার বোঝা যায় না।
তবুও লাখো মানুষ ইন্টারনেটকে রীতিমতো বাধ্যতামূলক একটা ব্যাপার বলে মনে করে। এজন্য কেউ ইন্টারনেটকেই দোষারোপ করে। আবার কেউবা মনে করে দোষ হচ্ছে যে ব্যবহার করছে, তার নিজের। আসলে দুটো কথার একটাও ঠিক না। ইন্টারনেট এমনকিছু না যেখানে আগে থেকেই সব ঠিক করা থাকে। এটা জাস্ট যোগাযোগের একটা মাধ্যম। আর এই নেটওয়ার্ক এমন কিছু না যে, ব্যবহার করলে আমি নিজের অজান্তেই আসক্ত হয়ে যাবেন।
তাহলে নিজেকে সামলাতে না-পারার দোষ কি মানুষকেই দিতে হবে? হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে তো অবশ্যই। নিজেকে তো নিজেরই সামলাতে হবে। কিন্তু এ-কথাও সত্য যে, অনেক অ্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট এমনভাবেই ডিজাইন করা হয়, যাতে একবার এখানে ঢুকলে আর বের হতে ইচ্ছা করবে না কারও।
বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আমাদের এই প্রতিদিনকার ইন্টারনেট ব্যবহার করার দিকটা ঠিক করে দেয়। অনেক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার মডেলই হচ্ছে মানুষের মনযোগ ধরে রেখে পেজভিউ আর ক্লিকের সংখ্যা বাড়ানো। মানুষের মনযোগ আরও বেশি পাওয়ার জন্য তো বড় কোম্পানিগুলোর বিশেষজ্ঞ দল আছে। আর তাদের হাতে আছে মানুষের ব্যক্তিগত অসংখ্য তথ্য। এই সবকিছুর উদ্দেশ্য একটাই, যেকোনো মূল্যে মানুষকে তাদের ওয়েবসাইটে ধরে রাখা।
‘ইচ্ছাশক্তি, দায়িত্ববোধ, সংযমের মাধ্যমে একজন অনেক চেষ্টাই করতে পারে, এবং এটা সত্যিই খুব ভালো একটা ব্যাপার। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রাস্তার অপর পাশে ভিন্ন একটা বাস্তবতাও আছে।’ —এই কথাটা ট্রিসিয়ান হ্যারিসের। তিনি গুগলে কাজ করেন এবং এথিক্যাল ডিজাইনের একজন প্রবক্তা। হ্যারিস আমাকে বলেছিলেন, ‘বড় টেক কোম্পানিগুলোর হাতে শত শত প্রতিভাবান পরিসংখ্যানবিদ আর বিজ্ঞানী আছে, যাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে নানান উপায়ে মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে ভেঙে দেওয়া।
সহজ করে বলতে গেলে, এই যুদ্ধে এক পক্ষ অন্য পক্ষের চাইতে অনেক বেশিই দুর্বল।
সিলিকন ভ্যালি ও আসক্তির সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ যে যখন Nir Eyal-এর বই Hooked প্রকাশিত হয়—যেখানে ডিজাইনারদের শেখানো হয় কীভাবে ব্যবহারকারীর মনে ‘চাহিদা’ তৈরি করতে হয়—তখন তা কোনোরকম বিতর্কেরই জন্ম দেয়নি। বরং বইটি বেস্টসেলার হয়। নামকরা প্রযুক্তি লেখকরা এই বইটির প্রশংসা করেছিলেন, এমনকি WordPress-এর প্রতিষ্ঠাতাও। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সেমিনারও হয় বইটি নিয়ে।
Eyal তার ক্লায়েন্টদের শেখান কীভাবে ফেসবুক আর পিন্টারেস্টের মতো ‘নেশা ধরানো’ ওয়েবসাইট বানাতে হয়। বিজনেস ইনসাইডারকে তিনি বলেছিলেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে ব্যবহারকারীদের এমন একটা চক্রের মধ্যে ফেলে দেওয়া, যার কোনো শেষ নেই। Hooked বইয়ে এ তিনি একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন : ‘এই কোম্পানিগুলো তো কিছু কোডই তৈরি করছে মাত্র—তাহলে ইউজারদের মনটাকে এত বেশি নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে তারা?’
তার মতে, একটা সহজ চার-স্টেপের একটা মডেলই হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর। ফেসবুকের নিউজফিডের কথাই ধরা যাক। প্রথম দুটো স্টেপ একদম সহজ, প্রথমেই কিছু একটা আপনাকে ট্রিগার করবে, যাতে স্ক্রল করার ইচ্ছাটা হয়। আর তারপরেই কাজটা করা হয়। মানে স্ক্রল করে নিচে নামতে শুরু করলেন আপনি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে স্ক্রল করে নিচে নামলে কী পাওয়া যাবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা যায় না। কিছু একটা পাওয়ার আশায় স্ক্রল করতেই থাকবেন আপনি। ফেসবুক হলে হয়তো আপনি বিড়ালের একটা মজার ভিডিও পাবেন, কিংবা আপনার চোখে পড়তে পারে কোনো পরিচিত মানুষের বিরক্তিকর পোস্ট!
এই অনিশ্চয়তা থেকেই আসলে আগ্রহ তৈরি হয়—আর এটাকেই বলে ‘ভ্যারিয়েবল রিওয়ার্ড’।
এরপর, Eyal-এর মতে, আপনাকে ছোটখাটো কোনো ইনভেস্টমেন্ট করার সুযোগ দেওয়া হয়—যেমন কোনো পোস্টে লাইক দেওয়া, কমেন্ট করা বা শেয়ার করা। একজন যত বেশি এগুলো করতে থাকবে, সে তত বেশি এই চক্রের মধ্যে ঢুকে পড়বে—ট্রিগার, অ্যাকশন, রিওয়ার্ড, ইনভেস্টমেন্ট!
আর এইভাবেই একসময় আপনি আসক্ত হয়ে যাবেন।
ব্যাপারটা সেই স্কিনারের পরীক্ষার মতোই। কারণ এই মডেলটা ঠিক সেই পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি। যেমনটা স্কিনার দেখিয়েছিলেন—পুরস্কারটা অনিশ্চিত হলে সেটা পাওয়ার জন্য লোকজন পাগলা হয়ে উঠতে পারে। জুয়ার ইন্ডাস্ট্রিতে এই কৌশল বহুদিন ধরেই চলছে—স্কিনার নিজেও বলেছিলেন, সবচেয়ে ক্লাসিক উদাহরণ হচ্ছে স্লট মেশিন, যেটা বারবার ঘোরানোর পরেও কী আসবে, তা আগে থেকে কখনোই আন্দাজ করা যায় না।
নাতাশা শুল, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির একজন নৃতত্ত্ববিদ। তার কাজ হচ্ছে মানুষ আর যন্ত্রের সম্পর্ক নিয়ে। ২০১২ সালে তাঁর লেখা Addiction by Design বইটা বের হওয়ার পর সিলিকন ভ্যালির অনেক ডিজাইনার তাঁর কাছে পরামর্শ নিতে আসেন। বইটা ছিল লাস ভেগাসের জুয়াড়ি আর জুয়ার মেশিন ডিজাইনারদের নিয়ে।
অনেকের ধারণা, জুয়ায় আসক্তরা আসলে জিততেই চায়। কিন্তু শুল বলেন, তারা মূলত একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যান, যেটাকে তিনি বলেন ‘মেশিন জোন’। এই জোনে মানুষ সময়, জায়গা বা নিজের পরিচয়—সব ভুলে গিয়ে শুধুমাত্র মেশিনের একঘেয়ে ঘূর্ণির মধ্যেই ডুবে থাকে।
স্লট মেশিন আর ওয়েবসাইট এক জিনিস না, পার্থক্য আছে। লোভনীয় রিওয়ার্ডের জন্য স্লট মেশিনে আপনি যত বেশি সময় কাটান, তত বেশি টাকা হারান। কিন্তু ইন্টারনেটের দুনিয়ায় আপনি যত বেশি সময় ধরে থাকেন, যত বেশি ক্লিক করেন, স্ক্রল করেন—বিজ্ঞাপন থেকে তত বেশি লাভ হয় প্রযুক্তি কোম্পানির। আমরা সাধারণত বলি ইন্টারনেট আমাদের মনোযোগ নষ্ট করে, কিন্তু যখন আপনি বারবার মেইল চেক করেন, ফেসবুক ঘাঁটেন বা ক্যান্ডি ক্রাশ খেলেন, তখন আপনাকে বিশেষ আরেক ধরনের মনযোগ দিতে হয়—যার পুরোটাই আসলে দ্রুত কিছু পাওয়ার আশাতেই গড়ে ওঠে।
জুয়ার দুনিয়ায় সাধারণত আসক্তদেরই দোষ দেওয়া হয়। বেশিরভাগ গবেষণাতেও আসক্তদের মন ও অভ্যাস নিয়েই আলোচনা করা হয়। কিন্তু গবেষক নাতাশা শুল মনে করেন মানুষ আর মেশিনের মাঝে অবশ্যই কিছু একটা আছে। সেই মেশিন বা গেমগুলো এমনভাবেই বানানো হয় যাতে মানুষ নিজের অজান্তেই আটকে যায়!
তারপরও আমরা দোষ দিই শুধু মানুষকেই। শুল বলেন, ‘মানুষকে আসক্ত করার জন্য যখন ইচ্ছা করেই এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, তখন শুধু মানুষকেই দোষ দেওয়াটা আসলে অন্যায়।’
Nir Eyal নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। ফোনে কথা বলার সময় একজন চিন্তাশীল, সিরিয়াস, এবং নিজের কাজের নৈতিক দিকগুলো নিয়ে যথেষ্ট সচেতন ব্যক্তি হিসেবে ধরা দেন। তিনি প্রায়ই হেলথকেয়ার কোম্পানিগুলোকে Hooked বইয়ের কৌশলগুলো ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন—যেমন, এমনকিছু টুল বানানো, যেগুলো মানুষকে সময়মতো ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেবে। পর্ন বা গ্যাম্বলিং সাইটের জন্য কখনোই কাজ করেন না তিনি। তার ভাষ্য : তার বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে এমনকিছু বানানো যা মানুষকে সুন্দর ও সুখী জীবন দিতে সাহায্য করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘কাউকে জোর করে কিছু গছিয়ে দেওয়া ঠিক না। আমি শুধু মানুষকে বোঝাতে বলি, কোও কিছু চাপিয়ে দিতে বলি না। আর আমি জানিও না, কীভাবে একটা মানুষকে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়।’
Addiction by Design বইতে শুল লিখেছেন, ‘গেম ডিজাইনাররা ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রযুক্তিকে এমনভাবে ব্যবহার করে যাতে জুয়ারিরা ধাঁধায় পড়ে যায়। কেউ কেউ এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তিত হয় বটে, আবার কেউ কেউ এগুলোর পক্ষে যুক্তি দেয় এই বলে যে, তারা তো শুধু জুয়ারিদের ইচ্ছা পূরণ করতেই এমনটা করে।’
এই কথাগুলো অনেকটা Eyal-এর সেই দাবির মতো শোনায়: আপনি কাউকে এমন কিছু বিক্রি করতে পারবেন না, যা সে ইতোমধ্যেই আর চায় না। আমি যখন Schüll–কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় ইয়েল ভালোমনেই কথাটা বলেছে,’ তবে তিনি এটাও বলেন যে, মেশিন ডিজাইনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু মানুষ কী চায় বা চায় না, তার উপর আটকে থাকে না। আসল ব্যাপার হচ্ছে এক্ষেত্রে চাওয়া আর পাওয়ার মাঝখানের জায়গাটাকে আরেকটু উসকে দেওয়া হয়, জোরদার করা হয় আর নতুন একটা রূপ দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, আমাদের চাওয়া পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য থেকেই যায়। আমরা অনলাইনে যাই বিনোদনের জন্য, যোগাযোগের জন্য বা তথ্য খুঁজতে। হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আমরা ইচ্ছা করেই একটু অমনোযোগী হয়ে যাই আর কী। আর কোম্পানিগুলো এই সুযোগটাই কাজে লাগায়—তারা আমাদের চাওয়াটাকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দেয়। যেমন আমরা ফেসবুকে ১০ মিনিট থাকার ইচ্ছে নিয়ে ঢুকি, কিন্তু আধা ঘণ্টাতেও আর বের হতে পারি না।
চাওয়ার এই বাড়তি রূপকে ঠিক কী নামে ডাকা যায়, তা বলা শক্ত। খারাপভাবে বললে, এটা জোরজবরদস্তি। ভালোভাবে বললে ব্যাপারটা এমন যে, প্রযুক্তির কাছে সাধারণ কনজিমারদের ইচ্ছাশক্তির কোনো দামই নেই। জুয়া এর ভালো উদাহরণ—সেই মেশিনগুলো এমনভাবে বানানো হয়, যাতে মানুষ অনেকক্ষণ ধরে খেলে যায়, আর কোম্পানির লাভ হয়। এখন ইন্টারনেটেও ঠিক এরকম কায়দা-কানুনের ব্যবহার দেখা যায়। অবশ্য এর শুরু থেকেই ধরনের নৈতিক অস্বস্তিও আমাদের মনে জন্ম নিয়েছে।
১৯৯৮ সালে, ক্যাপটোলজি (কম্পিউটার দিয়ে মানুষের আচরণ বদলানোর প্রসেস) নিয়ে প্রথম গবেষণা হয়, তখন স্ট্যানফোর্ডের একজন মনোবিজ্ঞানী বি. জে. ফগ বলেছিলেন, ‘উচ্চপ্রযুক্তি নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা যেন ভালো-মন্দ সবকিছু বিবেচনা করেই কাজটা করেন।’ তবে এটাকে খুব শক্ত কোনো সতর্কবার্তা বলা যায় না।
Eyal তার Hooked বইতে নৈতিকতার সহজ নিয়ম বাতলে দিয়েছেন—যাতে ডিজাইনাররা বুঝতে পারেন, তারা ঠিকভাবে কাজ করছেন কি না। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেউ যদি এই বই পড়ে খারাপ উদ্দেশ্যে কিছু তৈরি করে, তাকে থামাবে কে? Eyal-এর সোজাসাপ্টা বললেন, ‘কেউ না।’ তবে তার মতে, অনেক কোম্পানি নিজেরাই সচেতন থাকে, কারণ বেশি আসক্ত হয়ে গেলে বিরক্ত হয়ে একসময় ইউজাররা সব ছেড়েছুড়ে দিতে পারে।
তবে এই মধ্যপন্থা অবলম্বন করার মতো ব্যাপারগুলো আসলে সিলিকন সিলিকন ভ্যালির বিজনেস মডেলের সাথে ঠিক খাপ খায় না।
ইন্টারনেটকে একটা বিশাল লাইব্রেরির মতো ভাবা যেতে পারে। প্রতিটা আর্টিকেল, উইজেট, স্লাইড, গেমের লেভেল আর ল্যান্ডিং পেজগুলো হচ্ছে এককেটা ঘর। একটা লিংকে ক্লিক করছেন মানেই আপনি নতুন কোনো ঘরে ঢুকে পড়ছেন।
শুরুর দিকে, অনলাইনে আয় করার জন্য লোকজন সেই ঘরের ভেতরের জিনিসগুলোই বিক্রি করত। হতে পারে সেটা ভালো মানের সাংবাদিকতা, কোনো গেম, কোনো রেসিপি, বা এমন কিছু যা কারও বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। এই মডেলে ইন্টারনেট ছিল ডিজিটাল দুনিয়ায় সরাসরি কেনাবেচার একটা জায়গা।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ শুধু ঘরের ভেতরের জিনিস দিয়ে নয়, দরজাগুলোর মাধ্যমেও আয় করতে শুরু করে। তারা দরজায় সেন্সর বসায়। আপনি যতবার কোনো দরজা দিয়ে ঢুকবেন, কেউ না কেউ বিনিময়ে টাকা পাবে। এবং এজন্যই নিত্যনতুন দরজা যোগ করতে থাকে মানুষ। আবার কেউ কেউ এমন ঘর তৈরি করে যেগুলো ভেতরে ফাঁকা, কিন্তু বানানো হয়েছে শুধু মানুষ যেন ঢুকেই আবার বেরিয়ে যেতে পারে— যত বেশি মানুষ যত বেশি দরজা পার হবে, তত বেশি লাভ।
আপনি যদি Slate.com-এ কোনো আর্টিকেলে ক্লিক করেন, তার মানে হচ্ছে আপনি এক ধরনের ‘আর্টিকেল ঘরে’ ঢুকলেন। Slate এই ঘর থেকে আয় করে কারণ তারা ওই ঘরের ভেতরে নির্দিষ্ট সংখ্যক ‘দরজা’ বিক্রি করেছে। এই দরজাগুলোকেই বলা হয় বিজ্ঞাপন। এই কাঠামো এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করে, কারণ বাইরে থেকে মনে হয় Slate চায় মানুষ তার ভালোমানের আর্টিকেল পড়ুক, কিন্তু আসলে ওরা আয় করে তখনই, যখন কেউ ঘরে ঢুকে আবার দ্রুত বেরিয়ে যায়—হয়তো কোনো বিজ্ঞাপন দেখে ক্লিক করে, না হয় আরেকটা আর্টিকেলে।
এবং সত্যি বলতে, Slate ঠিক এভাবেই কাজ করে। ২০১৩ সালেএক ভাইরাল আর্টিকেলে প্রযুক্তি সাংবাদিক ফরহাদ মাঞ্জু (Chartbeat-এর সঙ্গে পার্টনারশিপে) দেখান Slate-এর পাঠকরা আসলে কতক্ষণ একটা আর্টিকেলে থাকেন। তারা দেখেন ৩৮ শতাংশ মানুষ আর্টিকেল খোলে কিন্তু একটুও পড়ে না। যারা পড়া শুরু করে, তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশেরও কম মানুষ শেষ পর্যন্ত পড়ে। আর ৫ শতাংশ কেবল হেডলাইন দেখেই সরে পড়ে। লোকজনের এই প্রবণতাকে মাঞ্জু ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে—‘আমরা এখন স্কিমিং-এর যুগে আছি!’ কিন্তু এতে আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই পরিকল্পনাটা করাই হয়েছে শুধু লাভ করার জন্য।
সময় বদলে গেছে, চমৎকার ঘর বানিয়ে ইন্টারনেটে টাকা আয় করে না কেউ। এখন মানুষকে যত বেশি সম্ভব দরজা দিয়ে পার করিয়ে দিতে পারলেই টাকা আসে। মানে, তাদেরকে ইন্টারনেটের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা—যেন তারা একটা করিডোর ধরে হাঁটছে তো হাঁটছেই, থামার কোনো লক্ষণই নেই। তারা শুধু ক্লিক করে করে এগিয়েই চলছে।
ট্রিসিয়ান হ্যারিস ছোটোবেলা থেকেই হাতসাফাইয়ের প্র্যাকটিস করতেন। তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন যে, কীভাবে একজন মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। স্ট্যানফোর্ডে তিনি Fogg-এর সাথেই persuasive technology নিয়ে পড়েছেন। তার ক্লাসের অনেকেই এখন সিলিকন ভ্যালিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তার ক্লাস প্রজেক্টের এক পার্টনারই তো পরবর্তীতে হয়েছিলেন ইনস্টাগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। স্ট্যানফোর্ড থেকে বের হওয়ার পর হ্যারিস অ্যাপলের ইন্টারফেস ডিজাইন করেন। তিনি Apture নামের একটা মাল্টিমিডিয়া সার্চ টুলও বানিয়েছিলেন, যেটা পরবর্তীতে গুগল কিনে নেয়। বর্তমানে তিনি গুগলেই ডিজাইন ফিলসফার হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি এথিক্যাল ডিজাইন নিয়ে বেশ সোচ্চার এবং তিনি Time Well Spent নামে ছোট্ট পরিসরের একটি আন্দোলনও চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটা আদর্শ Time Well Spent ডিজিটাল দুনিয়ায় ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহারকারীদের জিজ্ঞেস করবে, তারা আসলে কী চায়। আর ঠিক এজন্যই হ্যারিস এমন একটা ওয়েবের কল্পনা করেন, যেটা খুবই ফ্লেক্সিবল। যেমন ধরা যাক, কেউ মাত্র ১৫ মিনিট ফেসবুকে থাকতে চায়। তার ইচ্ছাকে ফেসবুকও সম্মান করবে। আর নির্ধারিত সময় শেষ হলে ভালোভাবেই মনে করিয়ে দেবে যে, সময় শেষ। আবার যদি কেউ চায় কোনো রকম ইমেইল না দেখেই নিরিবিলি কম্পিউটারে দুই ঘণ্টা কাজ করবে, তাহলে সার্ভারগুলোও তাকে সাহায্য করবে, অহেতুক ইমেইলের নোটিফিকেশন পাঠিয়ে সেই সময়টাতে আর তাকে বিরক্ত করবে না, কাজ শেষে একবারে পাঠাবে। আবার কেউ যদি চায় যতক্ষণ ইচ্ছা ততক্ষণই Angry Birds খেলবে, সে তা-ও করতে পারবে।
কিছু অ্যাপ ইতোমধ্যেই এই ধরনের কাজে সহায়তা করে। Freedom নামের একটি অ্যাপ নির্দিষ্ট কিছু সাইটে ঢুকতেই দেবে না। Saent নামের একটি প্রোডাক্টিভ টুল কারও অনলাইন বিহেভয়ার ট্র্যাক করে তাকে সাজেশন দিয়ে থাকে যাতে অকারণে সে সময় নষ্ট না করে।
হ্যারিস বলেন যে, ‘শুধুমাত্র মনযোগ পাওয়ার জন্যই চেষ্টা করলে হবে না, বরং আমাদের দেখা উচিত যে মানুষের জীবনে ভালো কিছু হচ্ছে কি না।’ এরকম কথা তো ভালোই লাগে শুনতে, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা হবে কীভাবে! ইনভেস্টররা তো এরকমভাবে ভাবে না।
এই Time Well Spent-এর ব্যাপারটাকে হ্যারিস তুলনা করেন অর্গানিক খাবারের সাথে। তার মনে এখনকার ইন্টারনেটটা হচ্ছে জাঙ্ক ফুডের মতো—যা আছে তার সবটাই অস্বাস্থ্যকর। তিনি এমনকিছু বানাতে চান, যা মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে স্বাস্থ্যকর
করে তুলবে। অর্গানিক খাবারগুলোতে যেমন সরকারের সার্টিফিকেট থাকে, হ্যারিসের মনে হয় যে ওয়েবসাইটগুলো মানুষের ভালোর জন্যই কাজ করে, সেগুলোকেও ভবিষ্যতে এমন সার্টিফিকেট দেওয়া যেতে পারে।
তুলনাটা চমৎকার হলেও এখানে কিছু চিন্তার ব্যাপার আছে। অর্গানিক খাবারের বাজারটা খুব একটা বড় না এবং বেশিরভাগ মানুষের নাগালের বাইরে। এর সুবিধা নিয়ে কিছু ধনী মানুষজন বড় ধরনের শিল্পভিত্তিক খাদ্য আলোচনার বাইরে থেকেই নিজেদের মতো করে আলাদা পথ তৈরি করে নেয়। অর্গানিক ওয়েব-এর ক্ষেত্রেও আসলে সমস্যাটা একই রকম। এসব টুল হাতের কাছে থাকলেও তা ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর বিশেষ দক্ষতা আর চেষ্টার প্রয়োজন। যেমনটা দেখা যায়, Freedom-এর টুলগুলো শুধুমাত্র প্রযুক্তি-সচেতন পেশাজীবীরাই এটা ব্যবহার করে। Saent-এর প্রথমদিকের ব্যবহারকারীদের তিনভাগের দুইভাগই ছিলেন সফটওয়্যার ডেভেলপার।
অনলাইনে আসক্তি বা মনোযোগের সমস্যাগুলো যারা বিস্তর পড়েছে, তারা নিশ্চয়ই একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করেছে। লেখকরা প্রথমে যথেষ্ট রাগের সাথেই বলেন যে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সাথে আসলে ক্যাসিনো বা এই ধরনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবসাগুলোর কোনো পার্থক্য নেই, এদের সবার কাজই হচ্ছে মানুষদের আসক্ত করে ফেলা। এরকম রাগ দেখাতে দেখাতেই আবার তারা হুট করে বলে বসেন, এখানে ডিজাইনারদের কিছু করার নাই, বাঁচতে হলে ইউজারদেরই উচিত নিজেকে বদলে ফেলা।
এসব কথাবার্তার আসলে কোনো মানে হয় না। টেক সমালোচক ও ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট বিল ডেভিডো ‘The Atlantic’-এর ওয়েবসাইটে লিখেছেন যে, টেক কোম্পানিগুলো মানুষের ‘নার্ভ সায়েন্সকে হাইজ্যাক’ করে। এরা আসলে তামাক কোম্পানি আর ক্যাসিনোর মতোই। সমাজে এক ধরনের মহামারির কথা বলার পর তিনি আফসোস করে বলেন যে, ‘এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই’। তারপর, হঠাৎ যেন একটু নরম সুরেই তিনি বলেন, ইউজাররা চাইলে স্মার্টফোনটা নিজেদের নাগালের বাইরে রাখতে পারে, এতে আশেপাশের মানুষের সাথে কথাবার্তা বলার একটা সুযোগ তৈরি হবে।
ডেভিডো আসলে মূল কথাটাই ধরতে পারেননি। তার কথামতো পরিস্থিতি যদি এতটাই খারাপ হয়, এবং ইন্ডাস্ট্রিগুলো নিজেরাই নিজেদের ঠিক করে নেবে—এরকম শিশুতোষ ভাবনা যদি আমাদের না থাকে, তাহলে দিনশেষে একটা অপশনই আমাদের হাতে আছে : আমাদেরই এই ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
‘নিয়ম’ (regulation) শব্দটা আসলে ভয়ংকর, বিশেষ করে যারা দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেটের স্বাধীনতার পরিবেশে বড় হয়েছে, তাদের কাছে। এজন্যই হয়তো মনোযোগ নষ্ট করা প্রযুক্তিগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনার কথা ভাবতেও আমাদের অস্বস্তি লাগে। একদিকে আমরা ভাবি কারও আসক্তি বা অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার হচ্ছে ইউজারদের ব্যক্তিগত সমস্যা, এসব ডিজাইন করা কোনো ফাঁদ না। আরেকদিকে আমরা মনে করি, নিয়ম মানেই হচ্ছে ব্যবহারকারীদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ!
কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এখানে এমন নিয়ম করা যেতে পারে যা আসলে ইউজারদের আরও বেশি স্বাধীনতা দেবে। এখানে খুব হম্বিতম্বি করার কিছু নেই, শুধু এমনকিছু করতে হবে যাতে ইউজাররা নিজেরাই নিজেদের উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
এই কাজটা অবশ্য মোটেই সহজ কিছু না। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। যেমন, যখন সরকার কিছু বিশেষ ধরনের মাদক নিষিদ্ধ করে, যেমন কৃত্রিম গাঁজা (যেটাকে অনেকে K2 বা Spice বলে), তখন মাদক কারবারিরা ওই মাদকের গঠন একটু বদলে নতুন একটা ধরনের মাদক বানিয়ে ফেলে, যেটা প্রচলিত আইনের বাধার মধ্যে পড়ে না। ঠিক তেমনই, মনোযোগের সমস্যাটা যেহেতু খুবই ধোঁয়াটে একটা ব্যাপার আর ইন্টারনেটের ব্যপ্তিটাও বিশাল, তাই কোম্পানিগুলোও সহজেই তাদের ডিজাইনে হালকা পরিবর্তন করেই আবার নতুনভাবে মানুষের মনোযোগ ধরে রাখার কৌশল বের করে ফেলবে। তবুও, নিয়ম-কানুন করাটা খুব ভালো একটা কাজ হবে। এসব নিয়মের মাধ্যমে কিছু সাধারণ কৌশলগুলোকে টার্গেট করা যাবে, যেগুলো ব্যবহার করে ডিজাইনাররা মানুষকে দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইনে ধরে রাখে।
এখানে তিনটি কাজ করা যেতে পারে। প্রথমত, বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া ও গেমিং সাইট, ইমেইল সার্ভিস এবং স্মার্টফোন নির্মাতাদের বাধ্য করা যেতে পারে যেন তারা এমন একটি “ড্যাশবোর্ড” দেয়, যেখানে ব্যবহারকারীরা নিজেদের মনমতো তাদের ব্যবহারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে।
ফেসবুক এখন কিছু নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখার সুযোগ করে দিচ্ছে (পরীক্ষামূলক, সবাই এখনো পায়নি)। ইউজাররা এই ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে ঠিক করতে পারে কখন, কীভাবে, এবং কতবার নোটিফিকেশন পাবে। আমরা কোম্পানিগুলোকে এমন উপায় বের করতে বলতে পারি, যাতে ইউজাররা নিজেরাই ঠিক করতে পারে, দিনে কতবার ইমেইল পাবে বা একটি সামাজিক মাধ্যম কতবার তাদের ফিড আপডেট করবে। এমনকি ইউজাররা এমন ড্যাশবোর্ড ব্যবহার করে পেজের ডিজাইনও নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পাবে, যেমন ধরুন, একটা পেজে কতটা নতুন কনটেন্ট তারা দেখতে চায়!
নির্দিষ্ট কিছু compulsive design বা আসক্তিকর ডিজাইনের ফিচার একেবারেই নিষিদ্ধ করে দেওয়াই সম্ভবত ভালো হবে। এটার সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হচ্ছে— ‘continuous’ বা ‘infinite scroll’, অর্থাৎ এমন ডিজাইন যেখানে স্ক্রল করলেও কখনো একদম শেষে পৌঁছানো যায় না। যেমন ফেসবুক বা টুইটারের মতো সাইটগুলোতে পেজ নিজে থেকেই বারবার রিফ্রেশ হয়—আপনি ফিডের একদম শেষ পর্যন্ত পারবেন না। ঠিক তেমনি, টিন্ডারে আপনি একটানা লেফট বা রাইট সোয়াইপ করতে পারেন, এর কোনো সীমা নেই। আবার ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো সাইটগুলোও নিজে থেকেই পরবর্তী ভিডিও বা শো চালিয়ে দেয়।

‘হুকড’ মডেল অনুযায়ী, এভাবেই সাইটগুলো আমাদের বারবার ব্যবহার করতে বাধ্য করে। এতে কোম্পানির লাভ হয়, কারণ আমরা বেশি সময় সেখানে থাকি। কিন্তু ইউজারদের জন্য এতে বিশেষ কোনো উপকার নেই। বরং এই ব্যাপারটা ইউজারদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাটাই নষ্ট করে দেয়। যদি একেকটা পেজ বা সেশনের শেষে থামার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে মানুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে— চলবে কি না! এতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়বে।
আরেকটা নিয়ম হতে পারে: যেসব যে ইউজাররা একটু বেশিই আসক্ত, তাদের সতর্ক করে দেওয়া। ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝতে পারাটা শক্ত। কিন্তু কিছু সমস্যা তো চোখেই দেখা যায়। ফেসবুকের মতো সাইটগুলো জানে কে আসলে কতটুকু আসক্ত। Eyal-ও ঠিক এমনটাই মনে করেন। তিনি বলেন, আগে মদের ব্যবসায়ীরা বলতো, আমরা জানি না কে মদে আসক্ত। কিন্তু এখন ফেসবুক জানে আপনি কতবার ফেসবুক চেক করছেন, টুইটার জানে আপনি কতক্ষণ টুইটারে থাকেন, গেম কোম্পানিগুলো জানে আপনি তাদের ফ্রি-টু-প্লে গেম কতক্ষণ খেলেন। তাই চাইলেই কোম্পানিগুলো ব্যবস্থা নিতে পারে।’ আর নাগরিক হিসেবে আমরাও কোম্পানিগুলোকে চাপ দিতে পারি, যেন তারা ইউজারদের জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করে দেয় এবং বেশিমাত্রায় আসক্তদের সতর্ক করে দেয়।
তৃতীয় উপায় হতে পারে একটু হালকাভাবে ইউজারদের সাহায্য করা। যেমন, কিছু ওয়েবসাইট বা ব্রাউজারে এমন ফিচার থাকতে পারে, যেখানে ইউজাররা নিজেরা দেখতে পারবে—আমি আজ কতক্ষণ এই সাইটে ছিলাম, দিনে কয়বার ঢুকেছি ইত্যাদি। এমনকি চাইলে নিজের জন্য একটা সময়সীমাও ঠিক করে নিতে পারবে: যেমন, ‘আমি যদি আজ টুইটারে এক ঘণ্টার বেশি থাকি, তাহলে আমাকে সাইট থেকে বের করে দিয়ো।’
অবশ্য মনে হয় না, এই উপায়গুলোকে আমরা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারব। অন্তত আমেরিকায় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ম-কানুনের মধ্যে নিয়ে আসা খুব কঠিন। তবে মাঝেমধ্যেই এসব কথা বলা দরকার, যাতে সবাই নতুনভাবে চিন্তা করতে পারে। ইন্টারনেট আমাদের অনেক কাজে লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা সবসময় আমাদের ভালোর জন্যই না। আমরা আসলে একটা চুক্তির মধ্যে ঢুকে যাই—আমরা আমাদের সময় আর ব্যক্তিগত তথ্য দেব, আর বিনিময়ে সার্ভিস নেব।
অন্যান্য সাধারণ চুক্তির মতো এই চুক্তিতে দুই পক্ষের শক্তি সমান না। আজকের ইন্টারনেটের আদ্যোপান্ত দেখে মনে হয় এর ডিজাইনারদের হাতেই অনেক বেশি ক্ষমতা চলে গেছে। বেচারা মাইকেল বা স্কিনারের সেই কবুতরগুলোর মতো হতে না চাইলে আমাদের সত্যিই ভাবা উচিত—আমরা আসলে ভুল যায়গায় বেশি মনযোগ দিয়ে ফেলছি কি না।