প্রাণিরা অধিকার কেন পাবে না? 

তারা চিন্তা করতে ও কষ্ট অনুভব করতে পারে, ভালোবাসতে পারে। তাহলে, প্রাণিদের অধিকার পাওয়ার সময় কি এখনও হয়নি? অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

সারা বিশ্বে প্রাণিরা বিপন্ন। জমিন ও সাগর থেকে শুরু করে আকাশ পর্যন্ত মানুষের আধিপত্য। কোনো প্রাণিই মানুষের এই প্রভুত্ব থেকে রেহাই পায় না। বেশিরভাগ সময় এই আধিপত্য প্রাণিদের ক্ষতি করে, সেটা কারখানার মাংস-শিল্পের বর্বর নিষ্ঠুরতা বা শিকারের মাধ্যমে হোক, বাসস্থান ধ্বংসের মাধ্যমে, বায়ু এবং সমুদ্র দূষণের মাধ্যমে বা ভালোবাসার নামে পোষা প্রাণির প্রতি অবহেলার মাধ্যমে হোক।   

এই সমস্যাটি অনেক বছর পুরনো। পাশ্চাত্য আর পাশ্চাত্যের বাইরের দার্শনিক ঐতিহ্য প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে প্রাণিদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের নিন্দা করে আসছে। হিন্দু সম্রাট অশোক (আনুমানিক ৩০৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর মাংস খাওয়া ও প্রাণিদের ক্ষতি করে এমনসব অভ্যাস ত্যাগ করার প্রচেষ্টা নিয়ে লিখেছেন। গ্রিসে প্ল্যাটোনিস্ট দার্শনিক প্লুটার্ক (৪৬-১১৯ সি.ই) এবং পোরফাইরি (সি. ২৩৪-৩০৫ সি.ই) প্রাণিদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে বিস্তারিত বই লিখেছেন, যেখানে প্রাণিদের প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক জীবনের জন্য তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে লিখেছেন এবং মানুষকে তাদের জীবনযাপণের ধরন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু এই অনুরোধ বেশিরভাগ মানুষের কানে পৌঁছায়নি, এমনকি দার্শনিকদের নৈতিক রাজ্যেও এই অনুরোধ মানা হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের স্বার্থে প্রাণিদেরকে কষ্ট দিয়ে বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। আর প্রাণিরা মানুষের নিষ্ঠুরতা, বঞ্চনা, অবহেলার শিকার হয়ে চলেছে।       

তাই আজ আমাদের উপর এক নৈতিক ঋণ রয়ে গেছে: আমরা যে যুক্তিগুলি শুনতে অস্বীকার করে এসেছি তা শোনা, যাদের অবহেলা করে এসেছি তাদের যত্ন নেওয়া এবং আমাদের খারাপ অভ্যাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তা কাজে লাগানো। এই কাজগুলো খুব কঠিন না। আজ প্রাণিদের প্রতি মানুষের অন্যায়ের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য আমাদের কাছে এমন সব কারণ আছে যা এর আগে মানুষের কাছে ছিল না। 

প্রথমত, গত দুই শতাব্দীতে মানুষের আধিপত্য খুব দ্রুতগতিতে বেড়েছে। পোরফিরির জগতে, খাবারের জন্য যখন প্রাণিদের হত্যা করা হতো তখন তারা কষ্ট পেত, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত প্রাণিরা বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করছিল। বর্তমান যুগের মতো  মাংস-শিল্পের আলাদা কারখানা ছিল না যেখানে প্রাণিদের শুধু মাংস হিসেবে গন্য করা হয়, ভয়ঙ্কর, আবদ্ধ এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের প্রজননের জন্য রাখা হয়, যেখানে এই প্রাণিগুলো কোনোদিন ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। দীর্ঘকাল ধরে বন্য প্রাণিদের শিকার করা হতো, তবে আগে কখনো তাদের আবাসস্থল মানুষের থাকার জন্য দখল করা হয়নি বা অর্থ উপার্জনের জন্য চোরা শিকারীরা কোনও বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণি যেমন– হাতি বা গন্ডারকে হত্যা করেনি।    

সকল প্রাণি ভালোভাবে বাঁচতে পারবে এমন এক জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিটি প্রজাতি ভালোভাবে টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

যুগ যুগ ধরে মানুষ খাবারের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরে আসছে আর বাণিজ্যিক মূল্যের জন্য তিমি শিকার করে আসছে। কিন্তু আগে সমুদ্র প্লাস্টিকে ভরা ছিল না, আগে প্রাণিদের খাবারের খোঁজে প্লাস্টিক খেতে হতো না এবং সেই প্লাস্টিকের কারণে তাদের শ্বাসরোধে মরতে হতো। না সমুদ্রের তলদেশে তেলের জন্য ড্রিলিং কোম্পানিগুলো শব্দ দূষণ করত (ড্রিলিং হচ্ছে এয়ার বোমা ব্যবহার করে সমুদ্রের তলে মানচিত্র তৈরি করার প্রক্রিয়া), যে শব্দে প্রাণিদের জীবনযাত্রা আরো দুঃসহ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে সেইসব প্রাণিদের জন্য যারা শ্রবণশক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আগেও খাবারের জন্য পাখিদের শিকার করা হতো, কিন্তু যারা বেঁচে যেত তারা হয়তো বায়ু দূষণে বা শহরের আকাশচুম্বী ভবনগুলোতে ধাক্কা খেয়ে মারা যেত না। এককথায় বলতে গেলে, আগে মানুষের নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার পরিধি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। 

বর্তমান যুগে প্রাণিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের নতুন রূপ প্রতিনিয়ত দেখা যায় – এমনকি এই আচরণগুলো নিষ্ঠুর হিসাবে গণ্য করা হয় না, কারণ প্রাণিদের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে কেউ চিন্তাও করে না। তাই আমাদের উপর এখন শুধু অতীতের ঋণ না, বরং আরো এক নতুন নৈতিক ঋণ যুক্ত হয়েছে যা দিন দিন বেড়েই চলছে।  

কারণ মানুষের নিষ্ঠুরতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি সেই নিষ্ঠুরতায় জড়িয়ে পড়ছে সবাই। যারা কারখানা অথবা ফার্মিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে উৎপাদিত মাংস খায় না তারাও বাধ্য হয়ে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র কিংবা সমুদ্রের তলদেশ খনন করা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছে, যা বায়ুকে দূষিত করছে। তাদেরকেও এমনসব এলাকায় বাস করতে হচ্ছে যেখানে একসময় হাতি ও ভালুক বিচরণ করত। আকাশচুম্বী ভবনগুলো পরিযায়ী পাখিদের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ, ফলে সেসব উঁচু উঁচু বাড়িতে বসবাসকারীরাও কোনো-না-কোনোভাবে এই নিষ্ঠুরতার সাথে জড়িত। এসব অভ্যাসের কারণে প্রাণিদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা বিবেচনা করে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করার বদলে এই সমস্যা স্বীকার করে নেয়া এবং সামগ্রিকভাবে এর সমাধান বের করা মানবজাতির সম্মিলিত দায়িত্ব।             

এ পর্যন্ত আমি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণিদের কথা বলিনি, কারণ বইটি প্রাণিদের হারিয়ে যাওয়া আর প্রাণিদের অবহেলিত হওয়ার গল্প, আর তাদের প্রত্যেকেই ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাতি হিসেবে কোনো প্রাণিই হারায় না। তবে, প্রাণিদের ব্যাপক যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই বিলুপ্তি ঘটে। যেমন, একটি মেরু ভালুক যে সমুদ্র পার হয়ে শিকার করতে পারে না, ফলে বরফের স্তূপে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যায়, একটি এতিম হাতি যে তার প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার কারণে পারস্পরিক যত্ন ও কমিউনিটি থেকে বঞ্চিত হয়; বায়ুদূষণের কারণে গানের পাখির প্রজাতির ব্যাপক বিলুপ্তি, যা এক ভয়ংকর মৃত্যু। যখন মানুষের কর্মকান্ড অন্যান্য প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়, তখন সেসব প্রজাতির প্রাণিরা সবসময় খুব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এক সংকুচিত ও বাধাগ্রস্ত জীবনযাপন করে। এছাড়া, সকল প্রাণি ভালোভাবে বাঁচতে পারবে এমন এক জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিটি প্রজাতি ভালোভাবে টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।       

মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াও প্রাণিদের বিলুপ্তি এমনিতেই ঘটত। এমন পরিস্থিতিতেও, জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বের কারণে আমরা হয়তো বিলুপ্তি থামাতে হস্তক্ষেপের কারণ খুঁজতাম। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, আজকের বিলুপ্তির হার প্রাকৃতিক বিলুপ্তির হারের চেয়ে এক হাজার থেকে দশ হাজার গুণ বেশি। (এখানে আমাদের অনিশ্চয়তা অনেক, কারণ আমরা জানি না পৃথিবীতে কত ধরনের প্রজাতি আছে, বিশেষ করে মাছ ও কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে।) বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণি এবং ৪০ শতাংশেরও বেশি উভচর প্রাণি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে আছে কয়েক প্রজাতির ভালুক, এশীয় হাতি (বিলুপ্তপ্রায়), আফ্রিকান হাতি (বিলুপ্তপ্রায়), বাঘ, ছয় প্রজাতির তিমি, ধূসর মহিষ ও আরও অনেক প্রজাতির প্রাণি। সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি আইন অনুযায়ী ৩৭০টিরও বেশি প্রজাতির প্রাণির অস্তিত্ব বিপন্ন বা হুমকির মধ্যে আছে। এ তালিকায় পাখিরা নেই, পাখিদের জন্য আলাদা একটি তালিকা আছে। এশিয়ায় থাকা গানের পাখিরা বন্যপ্রকৃতিতে প্রায় বিলুপ্ত। এর কারণ হলো বিলাসবহুল পণ্যের লাভজনক ব্যবসা। এছাড়াও অন্য অনেক প্রজাতির পাখি সম্প্রতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদিকে, পাখি ( ও অন্যান্য অনেক প্রাণি) রক্ষার্থে তৈরি আন্তর্জাতিক চুক্তি CITIES একদমই কার্যকর নয়। এই বইয়ের গল্প প্রাণিদের বিলুপ্তি নিয়ে না, বরং জীববৈচিত্র্য নিয়ে মানবজাতির উদাসীনতার কারণে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিদের যন্ত্রণা নিয়ে।   

অতীতের নৈতিক অবহেলা কাটিয়ে ওঠার আরেকটি কারণ আছে। আজ আমরা প্রাণিদের সম্পর্কে অনেককিছু জানি যা হয়তো ৫০ বছর আগেও জানতাম না। বর্তমানে আমরা এত বেশি জানি যে অতীতের অজুহাতগুলো এখন ব্যবহার করা খুবই লজ্জাজনক। পোরফিরি, প্লুটার্ক (এবং তাদের আগে অ্যারিস্টটল) প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। অতীতের বিজ্ঞানচর্চায়ও এসব প্রমাণ স্পষ্টভাবে হাজির থাকার পরেও কোনো কারণে মানুষ সেসব আমলে না নেয়ার অজুহাত খুঁজে নেয়। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষ, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দার্শনিক, মনে করতেন প্রাণিরা হলো বর্বর, যাদের জগত নিয়ে কোনো উপলব্ধি, অনুভূতি নেই, এমনকি ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতাও নেই।        

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রাণিজগত নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা হয়েছে। এখন আমরা শুধু দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা প্রাণি, যেমন, বানর ও সঙ্গী প্রাণি সম্পর্কেই না, এমনকি এমনসব প্রাণি সম্পর্কে জানি যাদের নিয়ে গবেষণা করা অনেক কঠিন — যেমন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি, তিমি, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, এবং সেফালোপডস।    

আমরা এখন শুধু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই না, বরং সুপরিকল্পিত পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমেও জানি যে সকল মেরুদণ্ডী প্রাণি এবং অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণি ব্যথা অনুভব করতে পারে। তাদেরও পৃথিবী নিয়ে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমরা জানি যে এই সব প্রাণিদের কিছুটা হলেও অনুভূতি আছে (তারা ভয় অনুভব করে, যা সবচেয়ে কমন) এবং অনেক প্রাণির সহানুভূতি ও শোকের মতো অনুভূতি রয়েছে। ফলে বোঝা যায় প্রাণিদের জন্য পরিস্থিতি কতটা জটিল হতে পারে।
আমরা জানি যে ডলফিন থেকে শুরু করে কাক, এত ভিন্ন ভিন্ন প্রাণিরাও জটিল সমস্যা সমাধার করতে পারে এবং সে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করতেও শিখতে পারে। আমরা এও জানি যে প্রাণিদের জটিল সামাজিক সংগঠন এবং সামাজিক আচার রয়েছে। সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি যে প্রাণিদের এই গোষ্ঠীগুলোতে শুধু বংশানুক্রমিক কার্যক্রমই বাস্তবায়িত হয় না, বরং এগুলো সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করে। তিমি, কুকুর এবং পাখির মতো ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি তাদের বাচ্চাদের প্রজাতির মূল অভ্যাসগুলো সামাজিকভাবে শেখায়, কেবলমাত্র বংশানুক্রমে সঞ্চারিত করে না।     

নৈতিকতার উপর এই গবেষণার কী প্রভাব পড়ছে? অনেক বড় প্রভাব। এখন আর আমরা নিজেদের নিজেদের প্রজাতি এবং প্রাণিদের মধ্যে সীমা টানতে পারব না, যে সীমাটি বুদ্ধিমত্তা, অনুভূতি এবং সচেতনতাকে বর্বর প্রাণিদের জীবন থেকে আলাদা করতে ব্যবহৃত হতো। আমরা সেই প্রাণিগোষ্ঠীটির মধ্যে সীমা টানতে পারব না যাদেরকে আমরা ‘আমাদের মতো’ চিহ্নিত করেছি — যেমন বানর, হাতি, তিমি, কুকুর — এবং অন্য সেসব  প্রাণি যাদের বুদ্ধিহীন হিসেবে ধরেছি। বাস্তব জগতে বুদ্ধিমত্তা্র ভিন্ন ভিন্ন রূপ আছে এবং পাখিরা, যারা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের চেয়ে একেবারে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে, বিকশিত হয়ে একই রকম ক্ষমতায় পৌঁছেছে। এমনকি অক্টোপাসের মতো এক অমেরুদণ্ডী প্রাণিরও বুদ্ধিমত্তা রয়েছে: একটি অক্টোপাস মানুষকে চিনতে পারে, এবং জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, তার এক হাত একটি গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে খাবার খোঁজার জন্য চোখের সাহায্যে পরিচালনা করতে পারে। একবার যদি আমরা প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তার কথা স্বীকার করে ফেলি, তাহলে আমাদের নৈতিক চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসবেই। একটি বর্বর প্রাণিকে খাঁচায় রাখা আর একটি পাথরকে টেরেরিয়ামে রাখা একই ব্যাপার। কিন্তু, যা আমরা করতে চাচ্ছি তা এটা না। আমরা বুদ্ধিমান এবং জটিলভাবে সাজানো জীবনের অস্তিত্ব বিকৃত করছি। প্রতিটি প্রাণি সফল জীবন লাভের জন্য সংগ্রাম করছে। বিপদসংকুল এ পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণির সামাজিক ও ব্যক্তিগত সক্ষমতা তাকে একটি ভালো জীবনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। অথচ মানবজাতি প্রাণিদের জীবনযাপনে বাধা দিয়ে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে, যা মোটেও ঠিক না।    

যদিও এখন আমাদের অন্য প্রাণিদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব স্বীকারের সময় এসেছে, আমাদের কাছে এমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম নেই যার মাধ্যমে আমরা কোনো পরিবর্তন আনতে পারব। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, আমরা এমন এক পৃথিবী তৈরি করেছি যেখানে মানবজাতির উন্নতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো—আইন এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব—আর এখন পর্যন্ত এই হাতিয়ারগুলো প্রাণিদের সাহায্য করতে খুব একটা কাজে লাগেনি। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক  আইনে সহচর প্রাণিদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা আছে কিন্তু অন্যান্য প্রাণিদের সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলা নেই। অধিকাংশ দেশে প্রাণিদের জন্য আইনে ‘স্ট্যান্ডিং’ নেই, অর্থাৎ যদি প্রাণিদের অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাহলে আইনত কোনো দাবি করা যাবে না। অবশ্য প্রাণিরা চাইলেও নিজেদের পক্ষে এই আইনি দাবি করতে পারবে না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষও তা করতে পারবে না। বিশেষ করে শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ, বলতে গেলে প্রায় সবাই। কারণ বেশিরভাগ মানুষের আইনের সম্পর্কে খুব কম ধারণা থাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের দাবি আদায় করার জন্য একজন আইনজীবীর প্রয়োজন। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত যে সকল মানুষের কথা বলেছি—বিশেষ করে যারা মানসিক প্রতিবন্ধী—তারা চাইলে একজন সক্ষম আইনজীবীর সাহায্যে আইনি দাবি করতে পারবে। তবে আমরা যেভাবে আইনি ব্যবস্থা গঠন করেছি, সেখানে প্রাণিদের খুব একটা সুবিধা নেই, কারণ তারা গণনার মধ্যেই পড়ে না।   

আইন মানুষের ধারণা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। যখন এই ধারণাগুলো বর্ণবাদী ছিল, তখন আইনও ছিল বর্ণবাদী। যখন লিঙ্গ এবং যৌনতার ধারণা নারী-বিদ্বেষী ছিল, তখন আইনও ছিল তেমন। আর এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গাই নেই যে, পৃথিবীজুড়ে মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রধানত মানুষকেন্দ্রিক ছিল, যেখানে প্রাণিদের কোনো স্থানই ছিল না। এমনকি যে সমস্ত তত্ত্ব বিপদের সময় একে অপরকে সহায়তা করার কথা বলে, সেখানেও প্রাণিদের জীবন এবং প্রাণিদের সংগ্রাম গণনা করা হয়নি। আইন ও আইন শিক্ষা সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পম্ন একজন দার্শনিক ও রাজনীতি-তাত্ত্বিক হিসেবে আমি এই বই প্রকাশের মাধ্যমে পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশা করছি।   

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।