সারা বিশ্বে প্রাণিরা বিপন্ন। জমিন ও সাগর থেকে শুরু করে আকাশ পর্যন্ত মানুষের আধিপত্য। কোনো প্রাণিই মানুষের এই প্রভুত্ব থেকে রেহাই পায় না। বেশিরভাগ সময় এই আধিপত্য প্রাণিদের ক্ষতি করে, সেটা কারখানার মাংস-শিল্পের বর্বর নিষ্ঠুরতা বা শিকারের মাধ্যমে হোক, বাসস্থান ধ্বংসের মাধ্যমে, বায়ু এবং সমুদ্র দূষণের মাধ্যমে বা ভালোবাসার নামে পোষা প্রাণির প্রতি অবহেলার মাধ্যমে হোক।
এই সমস্যাটি অনেক বছর পুরনো। পাশ্চাত্য আর পাশ্চাত্যের বাইরের দার্শনিক ঐতিহ্য প্রায় দুই সহস্রাব্দ ধরে প্রাণিদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের নিন্দা করে আসছে। হিন্দু সম্রাট অশোক (আনুমানিক ৩০৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর মাংস খাওয়া ও প্রাণিদের ক্ষতি করে এমনসব অভ্যাস ত্যাগ করার প্রচেষ্টা নিয়ে লিখেছেন। গ্রিসে প্ল্যাটোনিস্ট দার্শনিক প্লুটার্ক (৪৬-১১৯ সি.ই) এবং পোরফাইরি (সি. ২৩৪-৩০৫ সি.ই) প্রাণিদের প্রতি মানুষের নিষ্ঠুরতার নিন্দা করে বিস্তারিত বই লিখেছেন, যেখানে প্রাণিদের প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও সামাজিক জীবনের জন্য তাদের ক্ষমতা সম্পর্কে লিখেছেন এবং মানুষকে তাদের জীবনযাপণের ধরন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু এই অনুরোধ বেশিরভাগ মানুষের কানে পৌঁছায়নি, এমনকি দার্শনিকদের নৈতিক রাজ্যেও এই অনুরোধ মানা হয়নি। বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের স্বার্থে প্রাণিদেরকে কষ্ট দিয়ে বস্তু হিসেবে ব্যবহার করে চলেছে। আর প্রাণিরা মানুষের নিষ্ঠুরতা, বঞ্চনা, অবহেলার শিকার হয়ে চলেছে।
তাই আজ আমাদের উপর এক নৈতিক ঋণ রয়ে গেছে: আমরা যে যুক্তিগুলি শুনতে অস্বীকার করে এসেছি তা শোনা, যাদের অবহেলা করে এসেছি তাদের যত্ন নেওয়া এবং আমাদের খারাপ অভ্যাস থেকে শিক্ষা নিয়ে তা কাজে লাগানো। এই কাজগুলো খুব কঠিন না। আজ প্রাণিদের প্রতি মানুষের অন্যায়ের বিপক্ষে লড়াই করার জন্য আমাদের কাছে এমন সব কারণ আছে যা এর আগে মানুষের কাছে ছিল না।
প্রথমত, গত দুই শতাব্দীতে মানুষের আধিপত্য খুব দ্রুতগতিতে বেড়েছে। পোরফিরির জগতে, খাবারের জন্য যখন প্রাণিদের হত্যা করা হতো তখন তারা কষ্ট পেত, কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত প্রাণিরা বেশ ভালোভাবেই জীবনযাপন করছিল। বর্তমান যুগের মতো মাংস-শিল্পের আলাদা কারখানা ছিল না যেখানে প্রাণিদের শুধু মাংস হিসেবে গন্য করা হয়, ভয়ঙ্কর, আবদ্ধ এবং বিচ্ছিন্ন অবস্থায় তাদের প্রজননের জন্য রাখা হয়, যেখানে এই প্রাণিগুলো কোনোদিন ভালোভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পর্যন্ত পায় না। দীর্ঘকাল ধরে বন্য প্রাণিদের শিকার করা হতো, তবে আগে কখনো তাদের আবাসস্থল মানুষের থাকার জন্য দখল করা হয়নি বা অর্থ উপার্জনের জন্য চোরা শিকারীরা কোনও বুদ্ধিসম্পন্ন প্রাণি যেমন– হাতি বা গন্ডারকে হত্যা করেনি।

যুগ যুগ ধরে মানুষ খাবারের জন্য সমুদ্রে মাছ ধরে আসছে আর বাণিজ্যিক মূল্যের জন্য তিমি শিকার করে আসছে। কিন্তু আগে সমুদ্র প্লাস্টিকে ভরা ছিল না, আগে প্রাণিদের খাবারের খোঁজে প্লাস্টিক খেতে হতো না এবং সেই প্লাস্টিকের কারণে তাদের শ্বাসরোধে মরতে হতো। না সমুদ্রের তলদেশে তেলের জন্য ড্রিলিং কোম্পানিগুলো শব্দ দূষণ করত (ড্রিলিং হচ্ছে এয়ার বোমা ব্যবহার করে সমুদ্রের তলে মানচিত্র তৈরি করার প্রক্রিয়া), যে শব্দে প্রাণিদের জীবনযাত্রা আরো দুঃসহ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে সেইসব প্রাণিদের জন্য যারা শ্রবণশক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ করে। আগেও খাবারের জন্য পাখিদের শিকার করা হতো, কিন্তু যারা বেঁচে যেত তারা হয়তো বায়ু দূষণে বা শহরের আকাশচুম্বী ভবনগুলোতে ধাক্কা খেয়ে মারা যেত না। এককথায় বলতে গেলে, আগে মানুষের নিষ্ঠুরতা ও অবহেলার পরিধি তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
বর্তমান যুগে প্রাণিদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের নতুন রূপ প্রতিনিয়ত দেখা যায় – এমনকি এই আচরণগুলো নিষ্ঠুর হিসাবে গণ্য করা হয় না, কারণ প্রাণিদের জীবনে এর প্রভাব নিয়ে কেউ চিন্তাও করে না। তাই আমাদের উপর এখন শুধু অতীতের ঋণ না, বরং আরো এক নতুন নৈতিক ঋণ যুক্ত হয়েছে যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
কারণ মানুষের নিষ্ঠুরতা যেমন দিন দিন বাড়ছে, তেমনি সেই নিষ্ঠুরতায় জড়িয়ে পড়ছে সবাই। যারা কারখানা অথবা ফার্মিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে উৎপাদিত মাংস খায় না তারাও বাধ্য হয়ে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসপত্র কিংবা সমুদ্রের তলদেশ খনন করা জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করছে, যা বায়ুকে দূষিত করছে। তাদেরকেও এমনসব এলাকায় বাস করতে হচ্ছে যেখানে একসময় হাতি ও ভালুক বিচরণ করত। আকাশচুম্বী ভবনগুলো পরিযায়ী পাখিদের জন্য মৃত্যুর ফাঁদ, ফলে সেসব উঁচু উঁচু বাড়িতে বসবাসকারীরাও কোনো-না-কোনোভাবে এই নিষ্ঠুরতার সাথে জড়িত। এসব অভ্যাসের কারণে প্রাণিদের যে ক্ষতি হচ্ছে তা বিবেচনা করে প্রতিটি বিবেকবান মানুষকে এই পরিস্থিতি পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। একে অপরকে দোষারোপ করার বদলে এই সমস্যা স্বীকার করে নেয়া এবং সামগ্রিকভাবে এর সমাধান বের করা মানবজাতির সম্মিলিত দায়িত্ব।
এ পর্যন্ত আমি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণিদের কথা বলিনি, কারণ বইটি প্রাণিদের হারিয়ে যাওয়া আর প্রাণিদের অবহেলিত হওয়ার গল্প, আর তাদের প্রত্যেকেই ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ। প্রজাতি হিসেবে কোনো প্রাণিই হারায় না। তবে, প্রাণিদের ব্যাপক যন্ত্রণার মধ্য দিয়েই বিলুপ্তি ঘটে। যেমন, একটি মেরু ভালুক যে সমুদ্র পার হয়ে শিকার করতে পারে না, ফলে বরফের স্তূপে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মারা যায়, একটি এতিম হাতি যে তার প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার কারণে পারস্পরিক যত্ন ও কমিউনিটি থেকে বঞ্চিত হয়; বায়ুদূষণের কারণে গানের পাখির প্রজাতির ব্যাপক বিলুপ্তি, যা এক ভয়ংকর মৃত্যু। যখন মানুষের কর্মকান্ড অন্যান্য প্রজাতিকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়, তখন সেসব প্রজাতির প্রাণিরা সবসময় খুব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এক সংকুচিত ও বাধাগ্রস্ত জীবনযাপন করে। এছাড়া, সকল প্রাণি ভালোভাবে বাঁচতে পারবে এমন এক জীববৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিটি প্রজাতি ভালোভাবে টিকে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াও প্রাণিদের বিলুপ্তি এমনিতেই ঘটত। এমন পরিস্থিতিতেও, জীববৈচিত্র্যের গুরুত্বের কারণে আমরা হয়তো বিলুপ্তি থামাতে হস্তক্ষেপের কারণ খুঁজতাম। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে, আজকের বিলুপ্তির হার প্রাকৃতিক বিলুপ্তির হারের চেয়ে এক হাজার থেকে দশ হাজার গুণ বেশি। (এখানে আমাদের অনিশ্চয়তা অনেক, কারণ আমরা জানি না পৃথিবীতে কত ধরনের প্রজাতি আছে, বিশেষ করে মাছ ও কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে।) বর্তমান সময়ে পৃথিবীর প্রায় এক চতুর্থাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণি এবং ৪০ শতাংশেরও বেশি উভচর প্রাণি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে আছে কয়েক প্রজাতির ভালুক, এশীয় হাতি (বিলুপ্তপ্রায়), আফ্রিকান হাতি (বিলুপ্তপ্রায়), বাঘ, ছয় প্রজাতির তিমি, ধূসর মহিষ ও আরও অনেক প্রজাতির প্রাণি। সব মিলিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি আইন অনুযায়ী ৩৭০টিরও বেশি প্রজাতির প্রাণির অস্তিত্ব বিপন্ন বা হুমকির মধ্যে আছে। এ তালিকায় পাখিরা নেই, পাখিদের জন্য আলাদা একটি তালিকা আছে। এশিয়ায় থাকা গানের পাখিরা বন্যপ্রকৃতিতে প্রায় বিলুপ্ত। এর কারণ হলো বিলাসবহুল পণ্যের লাভজনক ব্যবসা। এছাড়াও অন্য অনেক প্রজাতির পাখি সম্প্রতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এদিকে, পাখি ( ও অন্যান্য অনেক প্রাণি) রক্ষার্থে তৈরি আন্তর্জাতিক চুক্তি CITIES একদমই কার্যকর নয়। এই বইয়ের গল্প প্রাণিদের বিলুপ্তি নিয়ে না, বরং জীববৈচিত্র্য নিয়ে মানবজাতির উদাসীনতার কারণে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণিদের যন্ত্রণা নিয়ে।
অতীতের নৈতিক অবহেলা কাটিয়ে ওঠার আরেকটি কারণ আছে। আজ আমরা প্রাণিদের সম্পর্কে অনেককিছু জানি যা হয়তো ৫০ বছর আগেও জানতাম না। বর্তমানে আমরা এত বেশি জানি যে অতীতের অজুহাতগুলো এখন ব্যবহার করা খুবই লজ্জাজনক। পোরফিরি, প্লুটার্ক (এবং তাদের আগে অ্যারিস্টটল) প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তা ও সংবেদনশীলতা সম্পর্কে অনেক কিছু জানতেন। অতীতের বিজ্ঞানচর্চায়ও এসব প্রমাণ স্পষ্টভাবে হাজির থাকার পরেও কোনো কারণে মানুষ সেসব আমলে না নেয়ার অজুহাত খুঁজে নেয়। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে মানুষ, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন দার্শনিক, মনে করতেন প্রাণিরা হলো বর্বর, যাদের জগত নিয়ে কোনো উপলব্ধি, অনুভূতি নেই, এমনকি ব্যথা অনুভব করার ক্ষমতাও নেই।
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে প্রাণিজগত নিয়ে গভীরভাবে গবেষণা করা হয়েছে। এখন আমরা শুধু দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা প্রাণি, যেমন, বানর ও সঙ্গী প্রাণি সম্পর্কেই না, এমনকি এমনসব প্রাণি সম্পর্কে জানি যাদের নিয়ে গবেষণা করা অনেক কঠিন — যেমন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণি, তিমি, মাছ, পাখি, সরীসৃপ, এবং সেফালোপডস।
আমরা এখন শুধু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই না, বরং সুপরিকল্পিত পরীক্ষামূলক কাজের মাধ্যমেও জানি যে সকল মেরুদণ্ডী প্রাণি এবং অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণি ব্যথা অনুভব করতে পারে। তাদেরও পৃথিবী নিয়ে এক ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমরা জানি যে এই সব প্রাণিদের কিছুটা হলেও অনুভূতি আছে (তারা ভয় অনুভব করে, যা সবচেয়ে কমন) এবং অনেক প্রাণির সহানুভূতি ও শোকের মতো অনুভূতি রয়েছে। ফলে বোঝা যায় প্রাণিদের জন্য পরিস্থিতি কতটা জটিল হতে পারে।
আমরা জানি যে ডলফিন থেকে শুরু করে কাক, এত ভিন্ন ভিন্ন প্রাণিরাও জটিল সমস্যা সমাধার করতে পারে এবং সে সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ব্যবহার করতেও শিখতে পারে। আমরা এও জানি যে প্রাণিদের জটিল সামাজিক সংগঠন এবং সামাজিক আচার রয়েছে। সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি যে প্রাণিদের এই গোষ্ঠীগুলোতে শুধু বংশানুক্রমিক কার্যক্রমই বাস্তবায়িত হয় না, বরং এগুলো সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবেও কাজ করে। তিমি, কুকুর এবং পাখির মতো ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি তাদের বাচ্চাদের প্রজাতির মূল অভ্যাসগুলো সামাজিকভাবে শেখায়, কেবলমাত্র বংশানুক্রমে সঞ্চারিত করে না।
নৈতিকতার উপর এই গবেষণার কী প্রভাব পড়ছে? অনেক বড় প্রভাব। এখন আর আমরা নিজেদের নিজেদের প্রজাতি এবং প্রাণিদের মধ্যে সীমা টানতে পারব না, যে সীমাটি বুদ্ধিমত্তা, অনুভূতি এবং সচেতনতাকে বর্বর প্রাণিদের জীবন থেকে আলাদা করতে ব্যবহৃত হতো। আমরা সেই প্রাণিগোষ্ঠীটির মধ্যে সীমা টানতে পারব না যাদেরকে আমরা ‘আমাদের মতো’ চিহ্নিত করেছি — যেমন বানর, হাতি, তিমি, কুকুর — এবং অন্য সেসব প্রাণি যাদের বুদ্ধিহীন হিসেবে ধরেছি। বাস্তব জগতে বুদ্ধিমত্তা্র ভিন্ন ভিন্ন রূপ আছে এবং পাখিরা, যারা বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে মানুষের চেয়ে একেবারে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে, বিকশিত হয়ে একই রকম ক্ষমতায় পৌঁছেছে। এমনকি অক্টোপাসের মতো এক অমেরুদণ্ডী প্রাণিরও বুদ্ধিমত্তা রয়েছে: একটি অক্টোপাস মানুষকে চিনতে পারে, এবং জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারে, তার এক হাত একটি গুহার মধ্যে ঢুকিয়ে খাবার খোঁজার জন্য চোখের সাহায্যে পরিচালনা করতে পারে। একবার যদি আমরা প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তার কথা স্বীকার করে ফেলি, তাহলে আমাদের নৈতিক চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসবেই। একটি বর্বর প্রাণিকে খাঁচায় রাখা আর একটি পাথরকে টেরেরিয়ামে রাখা একই ব্যাপার। কিন্তু, যা আমরা করতে চাচ্ছি তা এটা না। আমরা বুদ্ধিমান এবং জটিলভাবে সাজানো জীবনের অস্তিত্ব বিকৃত করছি। প্রতিটি প্রাণি সফল জীবন লাভের জন্য সংগ্রাম করছে। বিপদসংকুল এ পৃথিবীতে প্রতিটি প্রাণির সামাজিক ও ব্যক্তিগত সক্ষমতা তাকে একটি ভালো জীবনের জন্য প্রস্তুত করে তোলে। অথচ মানবজাতি প্রাণিদের জীবনযাপনে বাধা দিয়ে চ্যালেঞ্জ বাড়াচ্ছে, যা মোটেও ঠিক না।
যদিও এখন আমাদের অন্য প্রাণিদের প্রতি নৈতিক দায়িত্ব স্বীকারের সময় এসেছে, আমাদের কাছে এমন কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সরঞ্জাম নেই যার মাধ্যমে আমরা কোনো পরিবর্তন আনতে পারব। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, আমরা এমন এক পৃথিবী তৈরি করেছি যেখানে মানবজাতির উন্নতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হলো—আইন এবং রাজনৈতিক তত্ত্ব—আর এখন পর্যন্ত এই হাতিয়ারগুলো প্রাণিদের সাহায্য করতে খুব একটা কাজে লাগেনি। জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক আইনে সহচর প্রাণিদের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছুই বলা আছে কিন্তু অন্যান্য প্রাণিদের সম্পর্কে খুব একটা কিছু বলা নেই। অধিকাংশ দেশে প্রাণিদের জন্য আইনে ‘স্ট্যান্ডিং’ নেই, অর্থাৎ যদি প্রাণিদের অন্যায়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তাহলে আইনত কোনো দাবি করা যাবে না। অবশ্য প্রাণিরা চাইলেও নিজেদের পক্ষে এই আইনি দাবি করতে পারবে না, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষও তা করতে পারবে না। বিশেষ করে শিশু, মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষ, বলতে গেলে প্রায় সবাই। কারণ বেশিরভাগ মানুষের আইনের সম্পর্কে খুব কম ধারণা থাকে। আমাদের প্রত্যেকেরই নিজেদের দাবি আদায় করার জন্য একজন আইনজীবীর প্রয়োজন। কিন্তু এতক্ষণ পর্যন্ত যে সকল মানুষের কথা বলেছি—বিশেষ করে যারা মানসিক প্রতিবন্ধী—তারা চাইলে একজন সক্ষম আইনজীবীর সাহায্যে আইনি দাবি করতে পারবে। তবে আমরা যেভাবে আইনি ব্যবস্থা গঠন করেছি, সেখানে প্রাণিদের খুব একটা সুবিধা নেই, কারণ তারা গণনার মধ্যেই পড়ে না।
আইন মানুষের ধারণা অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। যখন এই ধারণাগুলো বর্ণবাদী ছিল, তখন আইনও ছিল বর্ণবাদী। যখন লিঙ্গ এবং যৌনতার ধারণা নারী-বিদ্বেষী ছিল, তখন আইনও ছিল তেমন। আর এটা অস্বীকার করার কোনো জায়গাই নেই যে, পৃথিবীজুড়ে মানুষের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা প্রধানত মানুষকেন্দ্রিক ছিল, যেখানে প্রাণিদের কোনো স্থানই ছিল না। এমনকি যে সমস্ত তত্ত্ব বিপদের সময় একে অপরকে সহায়তা করার কথা বলে, সেখানেও প্রাণিদের জীবন এবং প্রাণিদের সংগ্রাম গণনা করা হয়নি। আইন ও আইন শিক্ষা সম্পর্কে গভীর জ্ঞানসম্পম্ন একজন দার্শনিক ও রাজনীতি-তাত্ত্বিক হিসেবে আমি এই বই প্রকাশের মাধ্যমে পরিস্থিতি পরিবর্তনের আশা করছি।