ব্যাটারি-চালিত রিকশা, অহিদের সুন্দর-মসৃণ পা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুখ    

Md Azam
মোহাম্মদ আজম
ব্যাটারি-চালিত রিকশা এখন দেশের অন্যতম পরিচিত বাহন । অলঙ্করণ: সামিউল।

এক.
অহিদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে। বেড়াতে গিয়েছিলাম বোয়ালমারিতে এক ধনী আত্মীয়ের প্রাসাদোপম বাড়িতে। ছুটির অবসরে। এ বাড়িতে তেমন কেউ থাকে না। ছুটি কাটাতে বছরে এক-দুইবার যাওয়া হয়। ওই বাড়িতে ভ্যানচালক অহিদকে দেখি। 

সে এসেছে তার ভ্যানগাড়ির ব্যাটারিতে চার্জ দিতে। বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে ভ্যান বা রিকশাওয়ালাদের এ বন্দোবস্ত হয়েছে। দেখলাম, বেশ কয়েকটি ভ্যান আর রিকশা এসেছে। প্রতিটির জন্য দৈনিক দশ টাকা পরিশোধ করতে হয়। আলাপ করে বুঝলাম, খরচের পরিমাণটা তুলনামূলক বেশি হলেও কারো আপত্তি নাই। একে বরং তারা তাদের দিক থেকে সুবিধা হিসাবেই দেখছে।  

আমি বেরিয়েছিলাম বোধ হয় হাওয়া খেতে। রাত দশটার দিকে। দেখলাম বাইরের একটি ঘরের, বোধ হয় স্টোররুম জাতীয় কিছু একটা, কোনায় চার্জ দেয়ার এনতেজাম চলছে। কেয়ারটেকার চাচা ওখানেই ছিল। আমি এগিয়ে গেলাম। ভ্যানচালকদের একজন ভ্যানের উপর দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ-সংযোগ দিচ্ছিল। তাদের সুবিধার জন্যই বোধ হয় বাইরের দিকটাতে চড়া আলোর বাতি লাগানো হয়েছে। সেই আলোয় আমি ভ্যানের উপর দাঁড়ানো অহিদের পা দেখি। আসলে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে কী হচ্ছে তার খোঁজ নিতে। অহিদের পা ভ্যানের উপর থাকায় তুলনামূলক কম দূরত্বের কারণে আমার নজর পড়ে পায়ের দিকে। উপরের দিকে তাকিয়ে তার মুখ দেখার চেয়ে এটাই সহজ ছিল। নজর পড়তেই তার পায়ে আমার চোখ আটকে যায়।  

অহিদের ভ্যানটাও নতুন। জানলাম, ত্রিশ হাজার টাকা লোন নিয়ে সদ্য কেনা হয়েছে। মনে রং আছে ব্যাটার। লাল-সবুজ রং দিয়ে, নানা ধরনের ঝরকা লাগিয়ে সাজিয়েছে ভ্যানটা। ওই সাজানো ভ্যানের উপর আমি দেখলাম সাজানো পা। পায়ের নখ সুন্দরভাবে কাটা। পায়ের পাতার উপরের দিকটায় ঘষামাজার চিহ্ন। নিচের সাদা অংশটা এবড়ো-থেবড়ো বা ছেঁড়া-ফাটা নয় – রীতিমতো মসৃণ। ব্যাপারটা চট করে আমার চোখে বিঁধে যায়। এখনো, এতদিন পরেও, চোখের সামনে ছবিটা পরিষ্কার দেখতে পাই।

দেখতে পাওয়ার মূল কারণ আসলে একটা বৈপরীত্যের বোধ। শ্রমজীবী মানুষের যে ধরনের পা দেখে আমি অভ্যস্ত, অহিদের পায়ের সাথে তার একটা বিরোধ আছে। শ্রমজীবী মানুষের পায়ে তার শ্রমের চিহ্ন লেগে থাকে। প্রাথমিক কারণটা অবশ্য বায়োলজিকেল। পা থাকে নিচের দিকে। শরীরের ওজন বহন করে। মাটির সাথে সম্পর্ক রচনা করে। পায়ে ধুলা-কাদা লাগার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। ফলে প্রসাদনের মধ্য দিয়ে একে দেখনসই করে তোলার পরিশ্রমটা বেশি। তদুপরি নিছক অবস্থানগত কারণেই মানুষের নিম্নাঙ্গের তুলনায় ঊর্ধ্বাঙ্গে চোখ পড়ে আগে। নিম্নভাগে পরে। ফলে যার প্রসাধন করার সক্ষমতা কম, সে স্বভাবতই মনোযোগী হবে ঊর্ধ্বাঙ্গের দিকে। 

স্পষ্টতই পায়ের যত্নের একটা আর্থিক দিক আছে। পাকা রাস্তা, জুতা কেনার সামর্থ্য, অবসর, সৌন্দর্যবোধ উৎপাদিত হওয়ার মতো শ্রম, সময় বা অর্থের জোগান। বাংলাদেশের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী এত বেশি পরিশ্রমে এত কম আয় করে যে তাদের সৌন্দর্যসাধনা পা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। ফলে তারা যদি আদৌ প্রসাধনে মনোযোগী হয়ই, বড়জোর উত্তমার্ধ পর্যন্ত যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বাস্তবের ছাপমাখা রোমান্টিক গল্প ‘শাস্তি’র ফাজিল নায়ক ছিদাম যেমন করে। লেখক জানাচ্ছেন, ছিদামের ‘বেশভূষা সাজসজ্জায় বিলক্ষণ একটু যত্ন আছে।’ তো, সে যত্নের ধরন কেমন? ‘বড়ো বড়ো কালো চুল তেল দিয়া কপাল হইতে যত্নে আঁচড়াইয়া তুলিয়া কাঁধে আনিয়া ফেলিয়াছে।’ নরেন্দ্রনাথ মিত্রের বিখ্যাত ‘রস’ গল্পের নায়কও চুলের যত্ন নেয়। তার বাবরি চুলের দেখনদারিও বেশ উল্লেখযোগ্য। ওই মাথা আর চুল ছেড়ে মুখ, আর তার বেশি নামলে জামা পর্যন্ত। শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে পা পর্যন্ত নামা বেশ বিরল ব্যাপার। 

কিন্তু প্রসাধনের সময়-সুযোগ থাকলেই যে পা সুন্দর আর মসৃণ হয়ে উঠবে তা নয়। এর বংশগত-জিনগত একটা দিক আছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর একটু এলানো কিন্তু জরুরি রচনা দূরবীন-এ ধ্রুবর মুখ দিয়ে বড়লোকের ছেলেমেয়েদের ছবি-চেহারা সুন্দর হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। প্রজন্ম-পরম্পরায় সুলক্ষণা নারীদের বিয়ে করা, আরাম-আয়েশ আর প্রযত্নে থাকা ক্রমশ চেহারায় তৈলচিক্কন ভাব নিয়ে আসে। কথাটা আমাদের মতো দোআঁশলা মানুষদের দেশে আরো বেশি প্রযোজ্য। আমি অহিদের সাথে কথা বললাম। দেখলাম, তার দেখনদারিও ভালো। নিশ্চয়ই কোনো-না-কোনো মাত্রার জিনগত আনুকূল্য সে পেয়েছে। প্রশ্ন হল, পিতামাতাসূত্রে পাওয়া এই দেখনদারি ধরে রাখার জন্য তার কি তুলনামূলক কম পরিশ্রমের অন্য কোনো পেশায় যাওয়ার সুযোগ ছিল? তাকে জিজ্ঞাসা করিনি। নিজেই উত্তর খুঁজেছি। 

আকবর আলী খানের বিখ্যাত ‘সোনার বাংলা’ থিসিস খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু ত্রুটিহীন নয়। সুযোগ থাকলে কম পারিশ্রমিকের শ্রমিক পেশাবদল করবে, এ কথা মধ্যযুগের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সত্য নয়। সেকালে মানুষের সচলতা এতটা ছিল না। তাছাড়া জাত, বর্ণ, বংশ, গোত্র ইত্যাদির সাথে পেশার সম্পর্ক এতটাই নিবিড় ছিল যে, পেশাবদলের জন্য শুধু ইচ্ছা বা উদ্যম যথেষ্ট ছিল না। তবে কথাটা আজকের দিনের ক্ষেত্রে বেশ সত্য। প্রসঙ্গটা এখানে তুললাম এ কারণে যে, অহিদ বিকল্প খুঁজতে পারত। এমন বিকল্প, যেখানে পায়ের প্রযত্ন সম্ভব। কিন্তু বিকল্প তাকে খুঁজতে হয়নি। অথবা বলা যায়, অন্য বিকল্প বিছড়ে দেখেই সে এ পেশায় এসেছে। বেছে নিয়েছে ভারি, পরিশ্রমসাধ্য কাজ – রিকশা-ভ্যান চালানো। অথচ তার পা মসৃণ-সুন্দর। নিঃসন্দেহে ব্যাটারি-চালিত রিকশাই এই সুন্দর মসৃণতার উৎস।

দুই. 

ঢাকায় এবং বাংলাদেশের আরো কোনো কোনো জায়গায় রিকশা ও ভ্যানের ব্যবহারবিধিতে ফারাক আছে। এখানে ভ্যান মাল টানে, আর রিকশা টানে মানুষ। একবার মিরপুর স্টেডিয়াম মার্কেট থেকে কিছু আসবাবপত্র কিনে বাসায় নেয়ার জন্য ভ্যান খুঁজছিলাম। দোকানদারই এক ভ্যানওয়ালাকে ডেকে আনে। সে যে ভাড়া হাঁকল তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। কাতর কণ্ঠে বললাম, এট্টুক মাত্র পথ, রিকশায় ভাড়া বড়জোর চল্লিশ, আর তুমি চারশ চাচ্ছ? ভ্যানওয়ালা একটুও না ভড়কে চোখে-মুখে বেশ কতকটা পরিহাসের চিহ্ন এঁকে বলল, রিকশার সাথে ভ্যানের তুলনা কইরেন না; দুইটা দুই জিনিস। আমি আলাপ আর বাড়াইনি। কারণ, তার কথাটা ন্যায্য মনে হয়েছিল। বাংলাদেশের বহু অঞ্চলে কিন্তু ভ্যান প্রধানত মানুষ টানে। এক-দুইজন নয়; সংখ্যায় বহু আর ওজনে ভারি। মালও টানে। ওজনে বেশি বৈ কম নয়।

ব্যাটারি-চালিত রিকশার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আরো আগে। ঢাকার তুলনামূলক গরিব এলাকায়। এয়ারপোর্টের পেছনে বাউনিয়া এলাকা। সেখানে আমার মা থাকেন। আমাকে মাঝে-মধ্যে যেতে হয়। উত্তরা জসীমউদ্দীন রোড ধরে। সেখানে বারকয়েক ব্যাটারি-রিকশায় চড়েছিলাম।

রিকশা বা রিকশাওয়ালার প্রতি আমার বেশ কতকটা বাড়তি মনোযোগ আছে। মনোযোগের কারণটা অবশ্য খুব স্পষ্ট নয়। হুমায়ূন আহমেদের ‘অপরাহ্ণ’ নামের এক গল্প আছে। এক রিকশাওয়ালাকে নিয়ে। আগেও পড়েছিলাম। খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি। গুরুত্বটা উপলব্ধি করলাম অধ্যাপক নিয়াজ জামানের এক লেখা পড়ে। নিয়াজ জামান গল্পটির মানবিক রসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এক. আমরা রিকশাওয়ালার মুখ দেখি না; পিঠ দেখি। দুই. রিকশাওয়ালার শ্রেণি বা বর্গীয় নামের আড়ালে ব্যক্তিটা এমনভাবে হাওয়া হয়ে যায় যে ব্যক্তিটার দিকে মনোযোগ দেবার অবকাশই আরোহীরা পায় না। এরও বছর কয়েক আগে পত্রিকায় রিকশাশ্রমিকের একটা পরিসংখ্যান দেখেছিলাম। বলা হয়েছিল, ঢাকায় মোটামুটি আট লক্ষ লোক রিকশাশ্রমের সাথে যুক্ত। সারাদেশে আছে আরো অন্তত সাত লক্ষ। এ সংখ্যা এখন যদি বেড়ে বিশ লক্ষ হয়, অবাক হব না। তার মানেই হল, দেশের অন্তত এক কোটি লোক, মানে অন্তত ষোল ভাগের একভাগ মানুষ রিকশাশ্রমের উপর নির্ভরশীল। এই পরিসংখ্যান আমাকে নিশ্চয়ই প্রভাবিত করেছিল। আরেকটা মজার ঘটনা পড়েছিলাম আহমদ ছফার মহাগ্রন্থ যদ্যপি আমার গুরুতে। ছফা রাজ্জাকের বরাতে রুশবিপ্লবের মানবিক উপলব্ধিগত অর্জন নিয়ে একটা ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। এক রুশ ভদ্রলোক এসেছিলেন রাজ্জাকের সাথে দেখা করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন থেকে বেরিয়ে তাঁরা রওয়ানা দিয়েছিলেন বোধ হয় শান্তিনগরের দিকে। রাজ্জাক সাহেব রিকশা নেয়ার জন্য রিকশাওয়ালাকে ডাকেন। রুশ ভদ্রলোক বলেন, আরেকটু হাঁটি। পরে নেয়া যাবে। কিছুক্ষণ পর রাজ্জাক সাহেব আবার রিকশা ডাকেন। ওই ভদ্রলোক বলেন, আরেকটু হাঁটি। এভাবে তাঁরা শান্তিনগর পৌঁছে গেলেন। রিকশা নেয়া হল না। ছফাকে রাজ্জাক বলেছিলেন, আসলে ওই রুশ ভদ্রলোক এটা কিছুতেই মানতে পারছিলেন না, একটা লোক এত পরিশ্রম করে তাদের টেনে নিয়ে যাবে, আর তারা আরামে বসে থাকবে। শেষে রাজ্জাক স্যারের মন্তব্য : রুশ বিপ্লবের যদি কোনো তাৎপর্য থেকেই থাকে, তাহলে আছে এই গভীরতর মানবিক বোধ সৃষ্টিতে। 

এ ধরনের অভিজ্ঞতা বা পঠনপাঠন হয়ত রিকশাওয়ালাদের প্রতি আমাকে বিশেষভাবে মনোযোগী করেছে। কিংবা হতে পারে, মনোযোগটা এসেছে ভুলে যাওয়া অন্য কোনো কারণে বা এমনকি বিনা কারণে। নিছক অভ্যাসও হতে পারে। রিকশায় উঠলে কখনো কখনো খোঁজ-খবর নেয়া – মালিককে কত ভাড়া দিতে হয়, কত খরচ, কত আয় ইত্যাদি। 

ব্যাটারি-চালিত রিকশার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়ার অবশ্য এক প্রত্যক্ষ কারণ আছে। আমার মা যে এলাকায় থাকেন সেখানকার রাস্তা খারাপ। বয়স্ক হাড়-ব্যথার রোগীর জন্য রীতিমত ভয়াবহ। অথচ মাকে মাঝে-মধ্যেই ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। মা দেখলাম একটু বেশি ভাড়া দিয়ে নতুন চালু হওয়া ব্যাটারি-রিকশা নেন। সে আজ প্রায় দশ-বার বছর আগের কথা। ওই রিকশাগুলো ছিল বড়, ভারি আর আরামদায়ক। আমি খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, এগুলোর নির্মাণ-খরচ তিন লাখেরও বেশি। মালিককে দৈনিক ভাড়া দিতে হয় সাধারণ রিকশার তিনগুণ। তবু অনেক চালকই এগুলো ভাড়া নেয় এবং চালায়।

ওই জসীমউদ্দীন রোডেই আমি দ্বিতীয় অহিদের দেখা পাই। তার নাম জানা হয় নাই। নাম জিজ্ঞাস করার সুযোগই দেয় নাই সে। কারণ, সে আমাকে সওয়ারি হিসাবে নেয় নাই। কিন্তু তার বেশভূষা আমার দৃষ্টি কাড়ে। বয়স আঠার-উনিশের বেশি নয়। পরণে জিন্স আর টি-শার্ট। সস্তা কিন্তু হালকালের ফ্যাশনদুরস্ত। চেহারা আর হাবভাবে মধ্যবিত্ত ছাত্রসুলভ ভঙ্গি। এ বয়সি আমুদে পোলাপাইনের সাথে আমার দেখা হয়েছে নীলক্ষেত থেকে মিরপুরগামী ডাইরেক্ট বাসে। লোকাল বাসে নয়, ডাইরেক্ট বাসে। নটা-দশটা নাগাদ নিউমার্কেট এলাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে এরা দল বেঁধে বাসে ওঠে। প্রায় সবার হাতে বড় আকারের চাইনিজ মোবাইল। কানে এয়ারফোন লাগানো। এরা বাসে হৈ-হুল্লোড় করতে থাকে। একজন আরেকজনকে চিৎকার করে ডাকে, ইশারা-ভাষার মতো করে সংক্ষেপে কথাবার্তা বলে, আর শব্দ করে হাসে। বোধ হয় সংখ্যায় বেশি হওয়ায় বাসের অন্য যাত্রীদেরকে এরা বিশেষ কেয়ার করে না। পরে নিউমার্কেটের তিনতলায় নতুন গড়ে ওঠা রেডিমেড কাপড়ের দোকানে গিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটা পোক্ত হয়। আমি গিয়েছিলাম সস্তা জিন্সের প্যান্ট খুঁজতে। বেশিরভাগ দোকানে কম বয়সি সেলসম্যান। টিন এজের শেষের দিকে, অথবা দু-চার বছর বেশি। বিস্ময়করভাবে বেশিরভাগ তরুণের চুলের ছাঁট নজরকাড়া, অনেকেরই আবার রং করা। কানে দুল পরেছে অনেকেই, গলায় বাহারি নেকলেস। দাম বোধ হয় কোনোটারই বেশি নয়। কিন্তু ফ্যাশন রক্ষা করার ব্যাপারে বেশিরভাগই যে মনোযোগী এবং অভ্যস্ত, তা তাদের স্বচ্ছন্দ গতিবিধিতেই পরিষ্কার ধরা পড়ে।

এসব দেখা ছিল বলেই বোধ হয়, উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডের রিকশাচালক ওই নবীন যুবা আমাকে এ মর্মে আশ্বস্ত করেছিল যে, অপেক্ষাকৃত নিম্ন শ্রেণি-পেশার বিপুল মানুষ বর্তমান বিশ্বায়নকৃত ও যান্ত্রিকীকৃত আর্থিক জমানায় এ ধরনের আমুদে জীবনের উল্লাসময় সম্ভাবনায় প্রবেশ করতে পারবে। 

আমি তাকে বললাম, যাবে? সে ঠোঁট উলটিয়ে নিরাসক্ত ভঙ্গিতে না করল। আমার রাগ হওয়ার কথা। ভদ্রলোক-ইগো আহত হওয়ার কথা। কিন্তু আমি মজা পেলাম। আমি দেখলাম, তার রিকশায় মাথার উপরে একটা বাড়তি ছাদ। অল্প বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে পারবে। রোদ থেকে তো বটেই। এই ছাদটাকে আমার প্রতীকীভাবে তার ঔদ্ধত্যের উৎস মনে হল।

আমাদের রিকশার গড়নের মধ্যেই একটা মনিব-দাস সম্পর্কের নিশ্চয়তা আছে। হুডের নিচে আরোহী রোদ-বৃষ্টির বিপর্যয় থেকে নিরাপদে থাকবে, আর রিকশাশ্রমিক বাধ্যতামূলকভাবে ওই ওই বিপর্যয় দেহ পেতে নেবে – এই সিদ্ধান্তের মধ্যেই রিকশাওয়ালার জন্য মনস্তাত্ত্বিক হীনমন্যতার বোধটা পোক্ত হয়ে যায়। রিকশাওয়ালা যে সেবা দিচ্ছে এবং সেবার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে, এই বোধটা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে এমন এক ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ক তৈরি হয়, যেখানে মানুষ হিসাবে রিকশাশ্রমিকের প্রাথমিক মানবিক মর্যাদা মুলতুবি হয়ে মানবেতর আচরণ পাওয়ার জন্য রিকশাওয়ালা প্রস্তুত হয়েই থাকে। রিকশাওয়ালারা প্রতিনিয়ত যে ‘মানবেতর’ গালিগালাজ আর চড়-থাপ্পড়ের মুখোমুখি হয়, তার প্রাথমিক কারণ নিহিত আছে খোদ রিকশার গড়নে। বস্তুত রিকশার চালু মডেলে এবং যান্ত্রিক ধরনে রিকশাওয়ালার ‘মাথা’ রক্ষা করার বন্দোবস্ত সম্ভব নয়। 

আমি আশা করেছিলাম, ব্যাটারি-চালিত রিকশা ক্রমশ বিকাশ ও বিস্তারলাভ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপুল পরিমাণ মানুষের মাথা-মুখ এবং পা বাঁচানোর বন্দোবস্ত করতে পারবে। বলা দরকার, সে আশা পূরণ হয় নাই।

তিন. 

সরকার ব্যাটারি-চালিত রিকশাকে, অন্তত ঢাকা শহরে, কঠোরভাবে দমন করেছে। এ ব্যাপারে কোনো সার্কুলার জারি হয়েছিল কি না জানি না; কিন্তু রিকশাওয়ালাসহ অন্য অনেকের সাথে আলাপ করে দুটি কারণ জানা গেল। এক. ব্যাটারি-রিকশায় বিদ্যুৎ খরচ হয়; সরকার এই ব্যয়কে সুনজরে দেখছে না। দুই. এই রিকশায় দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বাড়ে। সরকারি এই সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্ত পরিসরে সম্মতি পেয়েছে বলেই মনে হয়। ভালোই হয়েছে। যে মধ্যবিত্ত এ ধরনের সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায় তাদেরকে, এবং তাদের পছন্দের সরকার ও রাষ্ট্রকে চিনতে খুব সুবিধা হয়েছে।

বিদ্যুৎ-ব্যবহারের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে পনের হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় বলে সরকারি ভাষ্যে ব্যাপক প্রচার আছে। প্রশ্ন হল, এ বিদ্যুৎ কারা কিভাবে ব্যবহার করবে? রাষ্ট্র কিভাবে সেবাখাতের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে তা আমাদের অজানা নয়। আর শ্রেণির প্রশ্নে রিকশাশ্রমিকরা যে তলানিতে ঠেকবে, তাও অনুমান করা যায়। রাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় আসতে গেলে বিশেষ বিশেষ চটকদার বর্গের আওতায় আসতে পারতে হয়। রিকশাশ্রমিকেরা নিশ্চয়ই এধরনের কোনো ডিসকোর্সের অংশীদার নয়।

কিন্তু রিকশাশ্রমিকের বিদ্যুৎ ব্যবহার যে সম্পূর্ণ অন্য দিক থেকে বিচার্য, সে কথাটা মনে রাখা জরুরি। ‘রক্ত পানি করে’ রিকশা চালানো আর বিদ্যুৎশক্তির সহায়তা নিয়ে রিকশা চালানোর মধ্যে উৎপাদনশীলতার ফারাক আছে। ‘রক্ত পানি করে’ রিকশা চালানো কী বিপুল মানুষের দীর্ঘমেয়াদি অ-সুখের কারণ হয়, কী বিপুল মানুষ অকালে বার্ধক্যে উপনীত হয়, তার হিসাব আমলে আনার মতো রাষ্ট্র আমরা আজতক তৈরি করে উঠতে পারি নাই; কখনো পারব কি না বর্তমান লক্ষণ দেখে তা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু রাষ্ট্র তো এ বিপুল মানুষের স্বাস্থ্য-বিপর্যয়জনিত আর্থিক ক্ষতির হিসাবটা অন্তত করতে পারে। ব্যাটারি-রিকশার বিদ্যুৎ-খরচ এরচেয়ে বেশি বলে মনে হয় না।

রিকশায় বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে তাতে কেবল রিকশাশ্রমিকেরই উপকার হয় না; আসলে গ্রাম-শহরবাসী বিপুল সংখ্যক মানুষ তার ফলভোগী হয়। এ ধরনের রিকশায় গতি বাড়ে, স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে। তৎপরতার নানামুখী সুবিধা হয়। ফলে বিদ্যুৎ-খরচের দোহাই দিয়ে ব্যাটারি-রিকশা বন্ধ করে যে রাষ্ট্র, তা স্পষ্টতই একটা কুরাষ্ট্র। সে কেবল এ কারণে নয় যে, এ রাষ্ট্র শ্রেণিবিদ্বেষী এবং জনবিরোধী; বরং বলতে হয়, এটা একটা বেওকুফ রাষ্ট্র; কারণ, সে লাভ-ক্ষতির যোগ-বিয়োগটা করে ব্যক্তির মতো করে – রাষ্ট্রের মতো করে নয়। 

এবার আসা যাক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে। ব্যাটারি-চালিত রিকশায় দুর্ঘটনার হার বেশি কি না, এ সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান চোখে পড়েনি। তবে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় কেউ কেউ বলেছেন, দুর্ঘটনা ঘটতে তাঁরা দেখেছেন বা শুনেছেন। আমার ধারণা, দুর্ঘটনার প্রচারণাটা লোকের আন্দাজ থেকে জোরালো হয়েছে। গতি বাড়লে দুর্ঘটনা বাড়বে, এটা তো জানা কথা। তাছাড়া বর্তমান রিকশার যে যান্ত্রিক গড়ন, তা এতই পলকা যে, অতিরিক্ত গতিতে এটা যে তাল সামলাতে পারবে না, তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। কিন্তু এ ভাবনাটা আমাদের কোনো পক্ষের মনেই জোরালোভাবে দানা বাঁধে নাই যে, রিকশায় নতুন গড়ন ও প্রযুক্তি সম্ভব। গতির সাথে তাল মিলিয়ে একেবারেই যন্ত্রকৌশলের সূত্র মেনে রিকশায় পরিবর্তন আসতে পারে। তাতে দুর্ঘটনার সম্ভাবনাও কমে আসবে। তাছাড়া গতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই সম্ভব। আইন প্রণয়ন করা এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশের আইন-না-মানা জনগোষ্ঠীর মধ্যে রিকশাচালকরা সামনের সারিতে পড়ে – এমন কোনো পরিসংখ্যান আমাদের হাতে নাই। 

আমরা পরে দেখব, ব্যাটারি-রিকশা সর্ব-অর্থেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পেতে পারত। কিন্তু ঘটেছে বিপরীতটা। প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে যে সংস্কৃতি সামাজিকভাবেই তৈরি হচ্ছিল, রাষ্ট্র তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কত বিচিত্র সম্ভাবনা যে নষ্ট হয়ে থাকতে পারে, তা বোঝার জন্য আমরা এই অর্বাচীন রাষ্ট্রের অন্য একটি উদ্যোগের খবর নেব।

চার. 

সিএনজি অটোরিকশা প্রথম যখন চালু হয়, তখনকার দিনগুলোর কথা হয়ত অনেকেই মনে করতে পারবেন। পুরানা অটোরিকশার আওয়াজ আর বায়ুদূষণের সেই দিনগুলোর আংশিক সমাপ্তির জন্যই পরিবর্তনটা তখন বেশ বড় মনে হয়েছিল। আসলে একটা প্রায়-বৈপ্লবিক বদল ঘটতে পারত এ উপলক্ষে। ঘটে নাই। বরং গণপরিবহণের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরবর্তী বছরগুলোতে যে বিশৃঙ্খলা ও হয়রানি দেখা গেছে, এবং আজ পর্যন্তও যা পূর্ণ মাত্রায় বহাল আছে, তার সূত্রপাত হয়েছিল সেই শুরুর কালেই। প্রথমে যে টাকায় গাড়িগুলো বরাদ্দ দেয়া হবে বলে বলা হয়েছিল, ক্রমশ বেড়ে সে টাকার পরিমাণ দুই-তিনগুণে দাঁড়িয়েছিল। কথাটা আমি বেশ ভালোভাবেই জেনেছিলাম প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। ওইসময় আমি ঢাকা কমার্স কলেজে মাস্টারি করি। কমার্স কলেজে আমার কলিগরা বেশ কজন সিএনজির মালিক বনেছিলেন। প্রায় প্রতিদিনই এ বিষয়ে বিচিত্র কথাবার্তা কানে আসত। শুনতাম, অকারণ বিলম্ব হচ্ছে। অবশ্য ঠিক অকারণ নয়। বড় অংকের ভাগ-বাঁটোয়ারার জন্য সেকালের যোগাযোগমন্ত্রী এবং সরকারের অ-পদস্থ এক প্রতাপশালী ছক কষছেন – এরকম কথা হরহামেশাই শোনা গেছে।

মধ্যবিত্ত সমাজ এ ঘটনায় নিন্দামুখর হয়েছিল। সিএনজি অটোরিকশার ক্রয়মূল্য হিসাবে বেশি টাকা নেয়ার জন্য। লুটপাটের মওকা হিসাবে ব্যাপারটাকে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু নিন্দাটা আরো গোড়ায় যেখানে হওয়া উচিত ছিল, সেখানে হয়নি। সিএনজির সাথে কোনোরকম সম্পর্ক নাই, এমন লোকেরাই-যে নতুন গাড়িগুলোর মালিক হয়ে উঠেছিল, নিন্দাটা প্রধানত সেজন্য হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ ধারায় ভদ্রলোকসমাজের চিন্তা যায়নি। কারণ, কম-পয়সাওয়ালা ভদ্রলোকসমাজের জন্য ব্যবস্থাটা শেষ পর্যন্ত লাভজনক হয়েছে। অদ্যাবধি এ খাতে সে একই দশা বিদ্যমান আছে।

আসলে এটা ছিল এই গুরুত্বপূর্ণ প্রাইভেট গণপরিবহণের মালিকানার ধরন বদল করার এক অভূতপূর্ব সুযোগ। গাড়িগুলো ড্রাইভারদের দেয়া যেত। কিংবা শিথিল ধরনের কোম্পানি খুলে মালিকানার নতুন ধরন তৈরি করা যেত। আগের অটোরিকশাগুলোর মালিকদের রাখা যেত সেই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসাবে। আগের গাড়িগুলো চলে গিয়েছিল ঢাকার বাইরে; কাজেই ওই গাড়ির মালিকদের বিশেষ পাত্তা দেবার দায় ছিল না। যদি থেকেও থাকে, কোম্পানির মালিকানার মধ্য দিয়ে সে সমস্যার সমাধান করা যেত। এর কোনোটাই না করে যা করা হয়েছিল, তারচেয়ে নিকৃষ্ট কিছু আর হতে পারে না। অটোরিকশার সাথে কোনোপ্রকার সম্পর্ক নাই এমন মধ্যবিত্ত পরিসরে চলে যায় হাজার হাজার গাড়ি। গাড়িগুলোর হাতবদল হতে থাকে। বেশি দামে কেনা গাড়িগুলোর ভাড়া বাড়তে থাকে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ে যাত্রীদের উপর। যাত্রীরা দোষারোপ করতে থাকে ড্রাইভারদের। আসলে পুরো বিশৃঙ্খলার জন্য ড্রাইভারদের দায় ছিল ন্যূনতম। শুরুতেই অন্তত বেশ-অর্ধেক গাড়ি যদি ড্রাইভারদের মালিকানায় যেত, তাহলে সিএনজি খাতে গত প্রায় দুদশক ধরে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা যেত। যন্ত্র-সুবিধা পেয়েও, অর্থাৎ শারীরিক শ্রমের অন্তত অনেকাংশ যন্ত্র দিয়ে সম্পন্ন করার পরেও আমাদের সিএনজি-চালকেরা যে ‘মানবিক’ জীবনে প্রবেশ করতে পারল না, তার মূল কারণ মধ্যবিত্ত-মালিকানা – তজ্জনিত হাতবদল এবং মূল্যবৃদ্ধি। তার সাক্ষাৎ ফল এই যে, সিএনজি অটোরিকশা ঢাকার নির্ভরযোগ্য পাবলিক পরিবহণ হয়ে উঠতে পারল না।

ড্রাইভারের মালিকানায় গাড়িগুলো গেলে আরেকটা ব্যাপার ঘটত। নিজ নিজ গাড়ির প্রযুক্তিগত দিকগুলোতে এক-একজন মালিক কাম ড্রাইভার ওস্তাদ হয়ে উঠত। ফলে সামগ্রিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমে যেত অনেক। সরাসরি উপকৃত হত একটি বড় শ্রেণি, আর পরোক্ষে তার সুফল ভোগ করত জনগণ।

এ তো গেল একদিক। অন্যদিকও আছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী-বিশেষজ্ঞরা-যে সিএনজি অটোরিকশা চালুর ওই ক্ষণে অন্য এক সম্ভাবনার কথা একবারও উচ্চারণ করল না, তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কথাটা এই : নতুন গাড়িগুলো আসলে দেশেই তৈরি হতে পারত।

আদমজি জুটমিল বন্ধের দিনগুলোর কথা আমার বেশ মনে আছে। ভিতরের খবর অত বলতে পারব না। কিন্তু পত্রপত্রিকায় যেসব লেখাপত্র এবাবদ ছাপা হচ্ছিল, কৌতূহলবশে তার একটা বড় অংশ আমি পড়েছি। সবাই জানেন, মিলটি বন্ধ হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মিলটি চালানো সহজ ছিল না। কোনো বিকল্প প্রস্তাবও খুব একটা উচ্চারিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো একাডেমিক প্রতিবেদন প্রণীত হয়নি। রাষ্ট্র ব্যাপারটা বুঝে ওঠার জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ চায়নি। একাডেমি ও রাষ্ট্রের যৌথতার মধ্য দিয়ে যেভাবে বিভিন্ন দেশে ব্যাপারগুলো বুঝে ওঠার এবং বাস্তবায়নের চেষ্টাটা চলে, আদমজি নিয়ে তার কোনোটা হয়েছে বলে মনে হয় না। মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অবশ্য বিস্তর আহাজারি এবং বিলম্বিত পরামর্শমূলক লেখা প্রচুর ছাপা হয়েছে। আজকাল পাট নানারকম খবরের কেন্দ্র হয়ে নতুন করে আমাদের ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী শ্লাঘার উপলক্ষ হচ্ছে। পাটের জীবনচক্র আবিষ্কার করে জাতীয় নায়ক-নায়িকার আবির্ভাব ঘটেছে। ইংল্যান্ডের রাজপরিবারে ‘আমাদের’ পাটজাত পণ্য প্রবেশ করে আমাদের সামষ্টিক বুকের ছাতি বেশ কতকটা ফুলে ওঠার এনতেজাম হয়েছে। কিন্তু শিল্পায়ন আর হল না। বোঝা যায়, আমাদের রাষ্ট্র আরোপিত বহিস্থ উপাদানের মতো জীবনের সাথে লেপ্টে আছে মাত্র – দৈনন্দিন হয়ে ওঠেনি।

আদমজি জুটমিলের কথাটা তুললাম আমাদের রাষ্ট্র, একাডেমি আর বুদ্ধিজীবী সমাজের তৎপরতার বা অপতৎপরতার একটা ছবি মনে আনানোর জন্য। সিএনজি অটোরিকশা চালুর ওই মুহূর্তটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সামগ্রিক দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির এক দুর্দান্ত সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করা যেত। ভাবাদর্শিক পটভূমি ছিল প্রস্তুত। রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহৃত হবে, তেলের উপর চাপ কমবে, দেশীয় উৎপাদনের নতুন ধরনের ব্যবহার হবে, সর্বোপরি খরচ কমবে – এতগুলো ব্যাপার একসাথে ব্যবহার করে মধ্যবিত্ত লাভখোর জনগোষ্ঠীকে তাদের সম্মতির ভিত্তিতেই বেশ কতকটা কচলে নেয়া যেত। তখন সিএনজি এবং ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিনের সাথে পরিবেশগত উন্নতির সুভাষণও জনসমাজে বেশ উচ্চারিত ছিল। তার মানেই হল, প্রস্তুত ভাবাদর্শিক আনুকূল্য ব্যবহার করে সিএনজি চালুর ক্ষেত্রে একটু বেশি সময় নেয়া যেত। এই পরিসরে ইঞ্জিনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন আর অপরাপর যান্ত্রিক কলাকৌশলের দেশীয় সংস্থান সম্ভবপর হত। আমাদের হাতে বিপুল সংখ্যক প্রশিক্ষিত চালক তো ছিলই। পুরো ব্যাপারটা হতে পারত মাঝারি আকারের শিল্পায়নের দারুণ ভিত্তি।

কিন্তু প্রসঙ্গটি কারো মনে এলো না। ক্ষমতাসীনরা ভাগবাঁটোয়ারার বন্দোবস্তটাই কেবল করল। বিরোধীদল একে মনোযোগ দেয়ার মতো ইস্যু হিসাবে গ্রাহ্যই করল না। আর আমাদের ভাড়াটে-ছাপোষা-অর্গানিক বুদ্ধিজীবীর দল নির্বাক রইল।

আমাদের জাতীয়তাবাদ ক্রমশ এসে ঠেকল ক্রিকেটে; আমরা সুন্দর সিএনজি আমদানি করলাম; এবং অনাগত কাল ধরে সুন্দর-সুন্দর গাড়ি আমদানির পথ উন্মুক্ত রাখলাম।  

পাঁচ.
ব্যাটারি-চালিত রিকশার ক্ষেত্রে এ ধরনের দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া সম্ভব। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ ও উদ্যোগ জনগণের একাংশের সামগ্রিক জীবনযাত্রায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে।

প্রথমেই দরকার মালিকানার ধরন বদলে দেয়া। চালকের মালিকানাকে উৎসাহিত করার জন্য ব্যাংকিংয়ের কৌশল ব্যবহার করা খুবই সম্ভব। গরিবের ব্যাংকিং বলে প্রধানত গ্রামীণ ব্যাংকের কল্যাণে এবং গৌণত আর্থিক কায়কারবার করা এনজিওগুলোর তৎপরতায় বাংলাদেশে যে ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে বড় ধরনের ফাঁক ও ফাঁকি আছে। প্রধান ফাঁকিটি এই যে, গরিবের জন্য নির্ধারিত সুদের হার ধনী তো বটেই, সম্ভবত দুনিয়ার যে কোনো ব্যাংকিংয়ের চেয়ে বেশি। গরিবি মোচনের সুভাষণ ব্যবহার করে এবং গরিব মানুষের নগদ টাকার টান লেগেই থাকে – এই বাস্তবতাকে কাজে খাটিয়ে এসব কথিত গরিবের ব্যাংকিং যে বড়লোকদের এক ধরনের লাভজনক আর্থিক কারবার, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এ ধরনের ফাঁকিবাজি নয়, দরকার প্রকৃত গরিবের ব্যাংকিং। মোবাইল ফোনের সুবিধা ব্যবহার করে একটা সীমা পর্যন্ত আর্থিক লেনদেন করা এখন খুবই সহজ হয়েছে। ফলে রিকশা চালানোয় যার প্রকৃত স্কিল আছে, তার সাথে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঋণে রিকশাক্রয় এবং কিস্তিতে পরিশোধের বন্দোবস্ত করা মোটেই কঠিন নয়। গরিব মানুষের টাকা মেরে দেয়ার হার ধনীদের চেয়ে অনেক কম হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। দরকার সরকারি ব্যবস্থাপনা। বস্তুত সরকারের সমাজসেবা বা যুব-উন্নয়ন বা সমধর্মী এক বা একাধিক বিভাগের একটি সেল দৈনিক এক ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করেই এ ধরনের প্রকল্পের সমন্বয় করতে পারে। 

রিকশা এবং রিকশাওয়ালার ডাটাবেজ যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো তৈরি করে উঠতে পারে নাই, এমনকি এ ধরনের কিছু করার কথা ভাবেও নাই, তাতেই এ রাষ্ট্রের ভঙ্গুরতার প্রমাণ মেলে। প্রকৃতপক্ষে যে কোনো উপাত্তপঞ্জি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক-ভূমিকাকে সংহত করে, এবং প্রাত্যহিক জীবনযাপনে রাষ্ট্রের উপস্থিতি অধিকতর হারে টের পেতে বাধ্য করে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির কারণে রাষ্ট্র আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক সহজে এবং নিপুণভাবে এ কাজ করতে পারে। আমরা চালক-সম্পর্কিত তথ্যভান্ডার করব কী, রিকশার রেজিস্ট্রেশনও নিশ্চিত করতে পারিনি। তথ্য-উপাত্ত বলছে, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ রিকশা বস্তুত হালনাগাদ কাগজপত্র ছাড়াই চলছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, বাংলাদেশে নিচ থেকে উপর পর্যন্ত প্রায় সব মহলে ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নতি’ বলতে যে ধারণা চালু আছে, তাকে ধারণা না বলে কুসংস্কার বলাই ভালো। নতুন প্রযুক্তি-যে প্রথমত এবং প্রধানত বৈশ্বিক পুঁজিপ্রবাহের অংশ হিসাবে তৃতীয় দুনিয়ায় প্রবেশ করে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এবং রাষ্ট্রের ছলে জনগণের পকেট কাটে, সে বোধ আমাদের সমাজে বিশেষ দেখা যায় না। জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সাথে সম্পর্কহীন তথ্যপ্রযুক্তির আমদানি প্রকৃতপক্ষে ঔপনিবেশিক কারবার মাত্র। ব্রিটিশ ভারতে শাসকপক্ষ ইডিওলজিকেল স্টেট অ্যাপারেটাসের অংশ হিসাবে পশ্চিমা এবং সে অর্থে আধুনিক প্রযুক্তি আমদানির বড়াই করত। ভারতীয়রাও তা মেনে নিয়েছিল। প্রযুক্তির এ ধরনের আমদানি যে কত ক্ষয়িষ্ণু এবং উপরিতলের, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে পূর্ব এশিয়ার অ-উপনিবেশিত দেশগুলোতে প্রযুক্তির জীবনায়নের বিপরীতে আমাদের উপনিবেশিত অঞ্চলে প্রযুক্তির আমদানিপ্রবণতার মধ্যে। অথচ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত অর্জনগুলোকে সত্যি সত্যি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ অংশ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। বস্তুত, জীবনযাপনের উন্নতি বলতে এটাই বোঝায়। 

আমরা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে প্রযুক্তির এ ধরনের ব্যবহারে খুব সামান্যই প্রবেশ করতে পেরেছি। উদাহরণ হিসাবে বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারজনিত বৈশ্বিক বিপ্লবের খুব সামান্য অংশই এযাবত আত্মীকৃত হয়েছে। ভর্তির সময়ে একটি আইডি নির্ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ ওই আইডিতে সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সমগ্র কর্মকান্ডকে পরিমাণের দিক থেকে অর্ধেকে কমিয়ে আনা সম্ভব। কাজটি গত বিশ বছর ধরে অপেক্ষিত আছে। আরেকটি উদাহরণ দিলে এ বাবদ পশ্চাৎপদতার শোচনীয়তা উপলব্ধি করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য, ধরা যাক, এসোসিয়েট প্রফেসর পদে মোট এগার কপি আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। এজন্য প্রশাসনিক ভবন থেকে পঞ্চাশ টাকায় একটা ফরম খরিদ করতে হয়। সেটি পূরণ করে ফটোকপি করে, প্রত্যেক কপির সাথে যাবতীয় কাগজপত্র যোগ করে আলাদা আলাদা সেট তৈরি করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় কাগজপত্রের মধ্যে যেহেতু লেখাও আছে, ফলে লেখার কপিসহ এক একটি আবেদনপত্র হয় ঢাউস। এভাবে এগার কপি আবেদনপত্র তৈরি করা এবং জমা দেয়া আর জমা দেয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সেগুলোর নথিভুক্তকরণ, সংরক্ষণ, বিতরণ ইত্যাদি মিলে উল্লেখযোগ্য শারীরিক শ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অথচ, অনলাইনে আবেদনের বন্দোবস্ত করলে পুরো ব্যাপারটা এত সহজ হয়, সময়, শ্রম ও অর্থের এতটা সাশ্রয় হয়, যা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। প্রযুক্তির সাহায্য নেয়ার অন্য সুবিধাও আছে। ধরা যাক, একজন আবেদনকারীর একশ লেখা আছে। কয়েকটি বই আছে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে এর সবগুলো দাখিল করা কার্যত অসম্ভব। এগার কপি করা তো দূরের কথা। কিন্তু অনলাইনে এটা শুধু সম্ভবই নয়, মূল্যায়নকারীর জন্য সহজে খুঁজে বের করা, প্রয়োজনীয় লিংক দেখে প্রামাণিকতা পরীক্ষা করা এবং দ্রুত জরুরি অংশগুলো দেখে নেয়া ইত্যাদিও সম্ভব হতে পারত। প্রযুক্তির যে কোনো ধাপ কেবল শারীরিক শ্রমই কমায় না, কেবল কাজের গতিই বাড়ায় না, পুরো কাজের ধরন আর সম্ভাবনারও মৌলিক বদল ঘটায়।

রিকশাচালকদের বিন্যাস-সমাবেশ ও শ্রেণিকরণের মাধ্যমে মালিকানার ধরনে যেমন তাৎপর্যপূর্ণ বদল আনা যায়, ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় সুবিধার অন্তত কোনো কোনো অংশে তাদের অংশীদারত্ব নিশ্চিত করা যায়। যেমন ধরা যাক, রিকশার মহাজনরা গ্যারেজ হিসাবে দেশের বিভিন্ন অংশে যে বিপুল পরিমাণ খাসজমির সুবিধা ভোগ করে, কমিউনিটি ভিত্তিতে এ সুবিধার অন্তত একাংশ চালকরাই পেতে পারে। পাওয়াই উচিত। ব্যাটারি চার্জ করার জন্য যে বিদ্যুতের দরকার হয় বা হবে, তার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় কিছু সুবিধা বিতরণ করা খুবই সম্ভব। যেমন সম্ভব ব্যাটারি বা সংশ্লিষ্ট অন্য উপকরণের খরচ কমানো থেকে শুরু করে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া পর্যন্ত অনেক কিছু। রাষ্ট্র তার জনগোষ্ঠীর কোন অংশকে কী পরিমাণে আর কী ফর্মে কতটা প্রণোদনা দেবে বা দেয়, তা তো খোদ ওই রাষ্ট্রকেই চিহ্নিত করে।

ব্যাটারি-চালিত রিকশাকে যে কোনো মাপের রাষ্ট্রীয় প্রকল্প হিসাবে নেয়া সবচেয়ে বড় যে সম্ভাবনা তৈরি করবে তা হল, রিকশার যান্ত্রিক উন্নতির দ্বার অবারিত হওয়া। বর্তমানে বিদ্যমান রিকশার আকার ও প্রযুক্তিতে একটা বাড়তি উটকো উপাদান হিসাবে ব্যাটারি সংযোজিত হওয়ায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। অতিরিক্ত গতি এবং গতিজনিত দুর্ঘটনার যে সম্ভাবনার কথা বাজারে ব্যাপকভাবে চালু আছে, তা এ কারণেই হয়েছে। পায়ে-টানা রিকশার গতি তার দৈহিক সক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ – ব্যাটারিজাত গতির সাথে নয়। রিকশার যান্ত্রিক উন্নতি এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। আসলে নতুন আকৃতি-প্রকৃতির ব্যাটারি-চালিত রিকশা ধীরে ধীরে চালুই হচ্ছিল। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে সে উদ্যোগ সামনের দিকে অগ্রসর হয়নি। দরকার ছিল সরকারি উদ্যোগে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায়তনগুলোকে সম্পৃক্ত করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাপ্রকল্প হাতে নেয়া। বস্তুত বাংলাদেশের যন্ত্রকৌশল বিভাগগুলোর একটা কাজই হতে পারত এই দেশীয় প্রযুক্তিকে তুলনামূলক জুতসই করার জন্য মনোযোগী হওয়া। রিকশা যে এ মনোযোগ কখনো পায়নি তা আসলে আমাদের একাডেমির সাথে বাস্তব জীবনের অব্যাহত বিযোগের এক তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ। এখন সরকারি উদ্যোগে এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেয়া উচিত। পরিমাণ বিবেচনায় আর বিপুল মানুষের রুটি-রুজির সাথে প্রত্যক্ষত সম্পর্কিত বলে একে ‘শিল্প’ হিসাবে মূল্য দিয়ে বিশেষ সুবিধাভোগীর তালিকায় আনা দরকার। 

রিকশার যান্ত্রিক উন্নতির দিকে আমাদের মনোযোগের এক কারণ মানুষকে পাশবিক শ্রমের নিগড় থেকে মুক্তির বন্দোবস্ত করা। তবে অন্য এক কারণও আছে। বাংলাদেশের যে কোনো জেলা বা থানা শহরে গেলেই দেখা যাবে অসংখ্য ব্যাটারি-চালিত থ্রি-হুইলার। এগুলো আমদানিকৃত। সরকারি পরিকল্পনার বাইরে যান্ত্রিক-প্রাযুক্তিক সুবিধার ব্যবহার বা ব্যবসায়ের সুযোগ মানুষ নিজেরাই করে নিয়েছে। এ আমদানি ঠেকানো হয়ত সম্ভব নয়। কিন্তু এটা তো সত্য, রিকশা যদি ক্রমশ ব্যাটারি-চালিত রিকশায় রূপ নেয়, যদি তার প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সংস্কার অব্যাহত থাকে, তাহলে আমদানিকৃত থ্রি-হুইলারের বিপুল চাহিদার অন্তত একাংশ এই রিকশার মাধ্যমেই মেটানো সম্ভব হবে।

এখানে দুটো ব্যাপারে সতর্কতামূলক টীকা যোগ করা জরুরি মনে করছি। 

এক.
যে রাষ্ট্র যে বস্তু উৎপাদনে কুশলী তারা তা উৎপাদন করে অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অন্য দেশ থেকে আমদানি করলে তুলনামূলকভাবে সবাই লাভবান হবে – এরকম একটা আর্থিক হিসাব উপনিবেশ আমলে বিশ্বব্যাপি অর্থশাস্ত্রের নামে জনপ্রিয় হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে বলি, আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং সেকালের অন্য ভাবুকরা কার্যত এ শাস্ত্রীয় ফতোয়া মান্য করতেন। ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ নামের মশহুর রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ইংরেজ শাসনে বাংলার শিল্প ধ্বংস হলেও কৃষিতে উন্নতি হয়েছে। ফলে শিল্প থেকে বিচ্যুত শ্রমিকসমাজ কৃষিতে নিযুক্ত হতে পারবে, আর সামগ্রিকভাবে উৎপাদন ঠিক থাকবে। উপনিবেশিত বিশ্বে কাঁচামাল সংগ্রহ আর শিল্পপণ্য বিক্রির অনুকূল মতাদর্শ হিসাবে এ বক্তব্য যে বেশ জুতসই ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আর আমাদের ভাবুকরা সেই মতাদর্শকে ‘জ্ঞান’ গণ্য করে তাতে বিলকুল সায় দিয়েছিলেন। গত দুইশ বছরের দুনিয়ার ইতিহাস এই সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই মতাদর্শ মেনে নিয়ে যারা নিজেদেরকে কৃষির জন্যই কেবল লায়েক ভেবেছিল, তারা অদ্যাবধি কৃষিতেই আছে। শিল্পের উৎপাদনশীলতার সুবিধা থেকে ওইসব জনগোষ্ঠী আজতক বঞ্চিতই আছে। ফলে চীন থেকে তুলনামূলক সস্তায় থ্রি হুইলার কেনার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি থাকতেও পারে; কিন্তু রিকশার যান্ত্রিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আমাদের নিজস্ব শিল্পোৎপাদনের কোনো সম্ভাবনা যদি থেকেই থাকে, তুলনামূলক সস্তায় কেনার চেয়ে তা হবে অনেক বড় ঘটনা। 

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রিকশার মালিকানা নির্ধারণে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ তৎপরতা, রিকশা-শ্রমিকের জন্য কিছু সুবিধার বন্দোবস্ত করা এবং রিকশার যান্ত্রিক উন্নয়নের প্রকল্প গ্রহণ করাকে রাষ্ট্রের জন্য বাড়তি কাজ বলে মনে হতে পারে। বলা দরকার, এ প্রস্তাবের মধ্যে কোনো বিপ্লবী রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা নাই। দুনিয়ার ইতিহাসে রাষ্ট্র মাত্রই তার জনগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্র নামের প্রতিষ্ঠানের যদি কোনো বৈধতা থেকে থাকে তবে তা মূলত এই যে, ব্যক্তির বদলে তুলনামূলক বড় একক যেমন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর জন্য নৈর্ব্যক্তিক জ্ঞানের আলোকে প্রকল্প গ্রহণ করা কেবল রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্ভব। আমরা আমাদের দেশে ‘প্রাইভেট’ কথাটা এত ভুলভাবে আকছার ব্যবহার করি যে, আমাদের এই ছোট প্রস্তাবকেও কারো প্রাইভেট পরিসরে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত অংশগ্রহণ বলে মনে হতে পারে। আসলে তা নয়। বিশুদ্ধ প্রাইভেট বা প্রাইভেট-পাবলিক কোলাবোরেশন ইত্যাদি কথাবার্তা বস্তুত ‘জ্ঞানী-জ্ঞানী’ কুসংস্কার। বিশুদ্ধ প্রাইভেট বা পাবলিক বলে কিছু নাই। পয়লা দুনিয়ায় উৎপাদনশীলতা বাড়ার প্রেক্ষাপটে, রাষ্ট্রের শক্তি-নজরদারি-শৃঙ্খলা এবং কর্তৃত্ব নিশ্ছিদ্র হয়ে ওঠায় রাষ্ট্র তার কিছু কাজ ব্যক্তিকে দিয়ে করায়। এরই নাম প্রাইভেট। এই প্রাইভেট আসলে রাষ্ট্রের নজরদারিতে জনস্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে এবং নির্দিষ্ট বিধিবিধান মান্য করে স্বাধীন কায়কারবারের নাম। এ কারণে অন্তত গ্লোবাল কর্পোরেট পুঁজির আগমনের আগ পর্যন্ত পয়লা দুনিয়ায় প্রাইভেটে-পাবলিকে বিরোধ ঘটে নাই। এখনো, এই বিশ্বায়িত দুনিয়ায়, কর্পোরেট পুঁজি-যে ‘জাতীয় স্বার্থে’র ছত্রছায়ায় কাজ করে তার নজির রোজই দেখা যায়।

আমরা যেমন আধুনিকতা ধার করেছি পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে, ঠিক তেমনি প্রাইভেট ধার করেছি পাবলিককে বাদ দিয়ে। কার্যত রাষ্ট্র শক্তিশালী ছিল এবং থাকবে। কোনো দূর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিসম দুনিয়ায় এ অবস্থার বদল ঘটলেও ঘটতে পারে। আমরা জানি, রাষ্ট্র মাত্রই নিপীড়ক। কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের সামষ্টিক জীবনের যাপনযোগ্য অন্য কোনো প্রকৌশল জানা নাই। তারচেয়ে বড় কথা, রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিপুল মানুষের জীবনযাত্রার বৈপ্লবিক উন্নয়ন করা যে সম্ভব; গত তিন-চার দশকেও তার যথেষ্ট নজির দুনিয়াব্যাপি দেখা গেছে।

আমাদের অ-রাষ্ট্র বা নিম-রাষ্ট্রে নিপীড়নটা যত প্রত্যক্ষ, কল্যাণকরতা তার পাইর পাইও নাই। প্রচলিত প্রবাদ ধার করে বলতে পারি, এ রাষ্ট্র ‘ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল মারার গোঁসাই’।

শহরের রাস্তায় রিকশা ও রিকশাচালক । অলঙ্করণ: শফিক হীরা

ছয়.
বাংলাদেশ রাষ্ট্র তাই কাজগুলো করতে পারে না। গরিবির কারণে এমনিতেই কল্যাণমূলক হয়ে ওঠার পথে তার অনেক বিপত্তি। কিন্তু যে কাজগুলো এমনকি এরকম গরিব দেশের পক্ষেও সম্ভব, তাও সে করে না। কারণ, তার রাজনৈতিক প্রকল্পের মধ্যে জনগণ অনুপস্থিত। এ কারণেই আসলে জনগণের যে অংশ রাষ্ট্রের কোনো-না-কোনো মাত্রার সুবিধাভোগী, তারাও এ ধরনের কথাবার্তা কদাচ উচ্চারণ করে। উচ্চারণ না করার অন্য কিছু কারণ আছে। 

সব মানুষকে মানুষ হিসাবে গণ্য করা এবং হিসাবের মধ্যে আনা বা আমলে আনতে পারা খুব সহজ কাজ নয়। মানবতাবাদী লব্জ এজন্য খুব একটা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি; জাতীয়তাবাদও মোটেই যথেষ্ট নয় – ক্রিকেট জাতীয়তাবাদ তো নয়ই। ইউরোপ অন্তত নিজেদের মধ্যে কাজটা অনেকদূর পর্যন্ত, বলা দরকার, সন্তোষজনক মাত্রায় করে উঠতে পেরেছে প্রধানত উপনিবেশ আমলের উদ্বৃত্ত ব্যবহার করে। দুনিয়াজুড়ে তাদের এত এত ‘অপর’ ছিল যে, নিজেদের দেশে বা অঞ্চলে ‘অপর’ খোঁজা তাদের জন্য জরুরি হয় নাই। বরং নিজেদের কাছা সামলানোর দরকারেই দেশের সমস্ত নাগরিককে ‘আমরা’র আওতায় হিসাবের মধ্যে আনতে হয়েছে। রাশিয়া বা চীনের জন্য এ ধরনের পন্থা সহজ ছিল না। তাদের যেতে হয়েছে রক্তাক্ত পথে। জাতীয়তাবাদ সেখানে অবস্থা-দুর্বিপাকে শ্রেণি-রাজনীতির পথ নিয়েছে। অন্তত চীনের ক্ষেত্রে একথা তো বলাই যাবে, নিজেদের দেড়শ কোটি মানুষকে জীবনযাপনের স্তরে উন্নীত করা হয়ত তার পক্ষে আর কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। ভারত রাষ্ট্রটি তার সব ধরনের আনুকূল্য সত্ত্বেও সে পর্যায়ে উপনীত হতে পারল না। তার একশ ত্রিশ কোটি ত্রিশ কোটিতে বন্দি হয়ে থাকল। একদিকে সীমিত উচ্চশ্রেণির সাথে বিপুল বিত্তহীনের উপনিবেশ আমলে তৈরি হওয়া দূরত্ব, আরেকদিকে হাজার বছরের দুরারোগ্য বর্ণগত বিভাজন – এ দুটিতে মিলে ভারত রাষ্ট্রটিকে জনমুখী হতে দিচ্ছেই না। তবু শক্তিশালী ঐতিহ্য আর শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী-পেশাজীবী শ্রেণি রাষ্ট্রটির গণকল্যাণ- আকাঙ্ক্ষাকে মাঝে-মধ্যেই বেশ আকর্ষণীয় মাত্রায় উন্নীত করে। 

আমরা এরকম কোনো হিসাবেই পড়ি না। বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে ধনার্জন করে না, স্রেফ লুটতরাজ করে। ফলে এখানে নতুন মিলিয়নার বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ; আর টাকা পাচারের পরিমাণ কল্পনাতীত রকমের বেশি। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিদেশনির্ভর, আর মধ্যবিত্তের প্রত্যেকেই সম্ভাব্য ইমিগ্র্যান্ট। এমতাবস্থায় রিকশাওয়ালা এবং তাদের পরিবার-পরিজনকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প তথা ভাবনাচিন্তার আওতায় নিয়ে আসার কোনো সক্ষমতাই এ রাষ্ট্রের থাকার কথা নয়।

দুনিয়ার ইতিহাসে বেশিরভাগ সময়ে বেশিরভাগ মানুষ মানবেতর জীবনযাপনই করেছে। বণ্টনজনিত সমস্যার বাইরে উৎপাদন-স্বল্পতাও এর অন্যতম প্রধান কারণ। কেবল সাম্প্রতিক কয়েক দশক ধরেই, প্রধানত জিনপ্রযুক্তি আর তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে, এ অবস্থার অভাবনীয় পরিবর্তন হয়েছে। এখন অন্তত এটা ভাবা সম্ভব যে, উৎপাদন-স্বল্পতার কারণে দুনিয়ার কোনো মানুষকে ‘মানবেতর’ জীবনযাপন করতে হবে না। প্রযুক্তিগত উন্নতি একদিকে মানুষের উৎপাদনসংকট দূর করার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, অন্যদিকে ‘অমানবিক’ কায়িক শ্রম থেকে তার মুক্তির বন্দোবস্ত করেছে। নিছক টিকে থাকার জন্যই যাদের মাত্রাহীন শারীরিক শ্রম করতে হয়, তাদের পক্ষে মানবসম্মত জীবনযাপনের ভাবনা অমূলক। প্রশ্ন হল, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে মানুষের সভ্যতা আজ সকল মানুষকে ওই ধরনের মাত্রাছাড়া শ্রম থেকে মুক্তির যে সম্ভাবনায় উপনীত করেছে, দুনিয়ার সকল মানুষ সে সুবিধা পাবে কি?

যান্ত্রিক উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন মানুষের পারস্পরিক সাম্য এবং জীবনযাপনের সমুন্নতির সম্ভাবনা কী গভীরভাবে বাড়িয়েছে, তার এক দুর্দান্ত উদাহরণ দিয়েছেন ওয়াল্টার বেনজামিন। ‘যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের যুগে শিল্পকলা’ নামের ধ্রুপদী প্রবন্ধে বেনজামিন আলাপ করেছেন মূলত সিনেমা নিয়ে, যদিও নন্দনতত্ত্ব ও রাজনীতিসহ জীবনের আরো দশদিক তাঁর প্রকল্পের সাথে জৈবসম্পর্কে সম্পর্কিত ছিল। স্বভাবতই। বেনজামিন দেখিয়েছেন, চিত্রকলার মতো পুরানা শিল্পকলা শিল্পকর্ম হিসাবে যেমন এক ও অদ্বিতীয় হত, দ্বিতীয় কেউ একই সাথে একই তাৎপর্যে একটা শিল্পকর্মের মালিক হতে পারত না, তেমনি এর উপভোগেরও একটা ব্যক্তিগত ধরন ছিল। সিনেমা যান্ত্রিক প্রকৌশলের কল্যাণে এ দুই দিকেই বৈপ্লবিক বদল সাধিত হয়েছে। একদিকে সিনেমায় মূল বা একক কপি বলে কিছু নাই। যান্ত্রিক উপায়ে এর পুনরুৎপাদন করা যায়, আর সেই পুনরুৎপাদিত কপি আর ‘মূল’ কপিতে কোনো ফারাক থাকে না। তার মানেই হল, একক ও অদ্বিতীয় মালিকানার কোনো ব্যাপার আদতে সিনেমার ক্ষেত্রে খাটেই না। অন্যদিকে সিনেমা উপভোগ করা যায় অগণিত মানুষের সাথে একত্রে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় একই প্রতিক্রিয়াসমেত। তার মানেই হল, শিল্পকর্মের মালিকানা এবং উপভোগের সক্ষমতার হেরফের মানুষে মানুষে যে দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান তৈরি করে, যান্ত্রিক পুনরুৎপাদনের বা সিনেমার জমানায় তার বিপরীত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্ভাবনা তৈরি হওয়া মানেই-যে মানুষ সকলের জন্য সে সুযোগ তৈরি করার জন্য উঠে-পড়ে লাগবে, তা নয়। কিন্তু যে সুযোগটা আগে ছিলই না, সে সুযোগটা এখন তৈরি হল।

মানুষের শারীরিক-মানসিক মুক্তির ব্যাপারটাকে যন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত করে যে আলাপ আমরা এখানে তুলেছি, তা আরো পরিষ্কারভাবে বোঝানোর জন্য নারীমুক্তির ইতিহাস থেকে উদাহরণ দেব। নারীমুক্তি প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষত টেক্সট প্রণীত হচ্ছিল অন্তত দুশ বছর আগে থেকে। লিবারেল পরিসরে দুস্থদের নিয়ে ভাবার যে সুযোগ ও জরুরত, তার অংশ হিসাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিপীড়িত নারীদের নিয়ে অনেকেই ভাবছিলেন। এসব ভাবনায় কাজও হচ্ছিল। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছিল; আর অন্তত সচ্ছল নাগরিক পরিসরে নারীরা অধিকতর সুবিধা ভোগ করছিল। কিন্তু বিশ শতকের ষাটের দশকের আগে পর্যন্ত এমনকি পশ্চিমেও নিখিল নারীসমাজের পক্ষে কর্তাসত্তা বজায় রেখে স্বাধীন জীবনযাপন করা সম্ভবপর হয়নি। নারীমুক্তির ইতিহাসপ্রণেতারা খেয়াল করেছেন, মূলত উৎপাদনব্যবস্থা ও জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যান্ত্রিক-প্রাযুক্তিক উন্নতির পটভূমিতেই গত শতকের ষাটের দশকে নারীর ‘প্রকৃত’ মুক্তির সুযোগ তৈরি হয়। অন্তত তিনটি স্তরে যান্ত্রিক সুবিধার আনুকূল্য পেয়েছিল নারীমুক্তি আন্দোলন। 

এক. ভারি কাজের হাত থেকে মুক্তি। কাজের জন্য বা অর্থ উপার্জনের জন্য শারীরিক সক্ষমতা যদি প্রধানই থাকে, তাহলে নারীর শারীরিক ‘দুর্বলতা’র তথ্য গুরুতরই থেকে যাবে। কিন্তু যদি মেশিনের বাটন বা কম্পিউটারের চাবি টেপাই কাজের প্রধান দিক হয়ে ওঠে, তাহলে শারীরিক শক্তির প্রশ্নটি গৌণ হয়ে গুরুতর হয়ে উঠবে সুস্থতা, স্বস্তি ও সৌন্দর্যের মতো বিষয়গুলো। 

দুই. গৃহকর্মের ধরনে আমূল পরিবর্তন। ঘরে তৈরি খাবারই খেতে হবে, এমন কুসংস্কারের অবসান আর প্রক্রিয়াকৃত খাবারের প্রাচুর্য – এ দুই বাস্তবতা সার্বক্ষণিক গৃহকর্মের ধারণা থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়েছে। কাজগুলোকে নারীর জন্য আলাদা করে রাখার মানসিকতা থেকে মানুষ রেহাই পেয়েছে। রান্নাঘরের ধারণাই গেছে বদলে। 

তিন. জন্মনিরোধক ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিশ্চিত হতে পারা। অনিয়ন্ত্রিত গর্ভধারণ নারীমুক্তির প্রশ্নে সবসময়েই বড় সংকট ছিল; এবং কতকটা এখনো আছে। তবে জন্মনিরোধকের বৈচিত্র্যবৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিহ্রাসের কারণে এ ব্যাপারে নারীর ‘নিজের শরীরের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ’ অনেকটাই বেড়েছে। তদুপরি, স্বাস্থ্যগত সুবিধাবৃদ্ধি এবং বাচ্চা পালনে সামাজিক-রাষ্ট্রিক সহযোগিতার কারণে এখন উন্নত বিশ্বে সন্তানধারণ নারীর জন্য অসুবিধার বদলে অনেক ক্ষেত্রেই সুবিধার কারণ হয়ে উঠেছে। ‘একক মা’ দুনিয়ার ওই অঞ্চলে এখন আর আগের মতো বিভীষিকার নাম নয়।

এসব যান্ত্রিক-প্রাযুক্তিক উন্নতির কারণে দুনিয়ার নিখিল নারীসমাজ মুক্তির আস্বাদ পেয়েছে এমন নয়। কারণ, সম্পদ ও সুবিধার বণ্টনের দিক থেকে দুনিয়া আদিম আমল থেকে খুব একটা এগোয়নি। কিন্তু নিঃসন্দেহে আগে ধারণার মধ্যে যা ছিল, তার বাস্তব রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা এখন অনেক বেড়েছে। কথাটা অন্য শ্রেণি-পেশা বা বর্গের মানুষদের জন্যও সত্য।

প্রযুক্তিগত উন্নতির ব্যাপারগুলোকে জনগণের দৈনন্দিন ব্যবহারের আওতায় নিয়ে আসা রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আধুনিক কালে পয়লা দুনিয়ায় টেলিফোনের পাবলিক বুথের প্রাচুর্য তার একটা ভালো উদাহরণ। শার্লক হোমসে দেখি, উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে ঘড়ির কাঁটা ধরে ট্রেন চলছে; টেলিগ্রাফ ও ডাকের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে ঘন্টার হিসাব ধরে। দুনিয়া-শাসনের জন্য যে বিপুল জনশক্তি ইংল্যান্ড সেকালে তৈরি করে উঠতে পেরেছিল, যান্ত্রিক-প্রাযুক্তিক সুবিধাদি প্রান্তীয় জনগোষ্ঠীর নাগালে নিয়ে আসা নিশ্চয়ই তার অন্যতম প্রধান উৎস।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি তার অনেক পরে গঠিত হলেও প্রযুক্তিকে জনবান্ধব করে তোলার মনোভাব ও উদ্যোগের ক্ষেত্রে তার অবস্থান একেবারেই বিপরীত। এখানে ‘প্রাইভেটে’র প্রতি লোকের সীমাহীন আগ্রহ। রাষ্ট্রেরও। ‘ফোর জি’ নিয়ে এসেছে বা মহাকাশে উপগ্রহ পাঠিয়েছে – এই প্রচারণা এখানে রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষ থেকে বাহবা হিসাবে প্রচারিত হয়, আর দালাল বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও একে উন্নয়নের চিহ্ন হিসাবে হামেশা প্রচার করে। প্রযুক্তির নতুন পর্ব-যে আন্তর্জাতিকভাবে বাজারজাতকরণ করা হয়, এর জন্য যে দুনিয়া-চালানো কোম্পানিগুলোর লবি কাজ করে যাচ্ছে, ব্যাপক ঘুষ আর অপরাপর নামে লেনদেন চলছে, আর তারচেয়ে বড় কথা, প্রযুক্তির বাজারের গতিশীলতার স্বাভাবিক নিয়মেই-যে পুরানা মালের বদলে নতুন মাল কিনতে আমরা বাধ্য – সেসব তথ্য পর্যন্ত তালাশ করার ফুরসত না নিয়েই আমরা আমাদের প্রযুক্তিবান্ধব রাষ্ট্র চালাচ্ছি। নতুন প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে অধিকতর মানুষকে রাষ্ট্রের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে – এমন নজির খুব একটা দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় হতশ্রী রিকশাশ্রমিক যন্ত্রের বরাভয়ে মুক্তির বার্তা পেল কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ কোথায়?

কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নের জন্য – রাজনৈতিক সুভাষণের উন্নতি নয় – এসব শ্রেণির দিকে তাকাতেই হবে। প্রশ্নটা মানবিকতার নয় কেবল, একেবারেই সামষ্টিক উন্নয়নের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পর্যন্ত জনগোষ্ঠী, যাদের সন্তানের লেখাপড়াসহ সামগ্রিক প্রস্তুতির জন্য টাকা খরচ করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য আছে, মূলত ইংরেজি পড়ে বা পড়তে চায়। তাদের জীবনের পরম লক্ষ্য বিদেশে যাওয়া এবং ‘সেটেল্ড’ হওয়া। এতে দোষের কিছু নাই। যে রাষ্ট্র তার জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যতের ব্যাপারে ন্যূনতম সুখবর দিতে প্রতিদিন নতুন করে ব্যর্থ হচ্ছে, সে রাষ্ট্রের উপর ভরসা করা আসলে আত্মহননের শামিল। মুশকিল হল, এত এত লোকের চলে যাওয়ার পরেও যে বিপুল পরিমাণ লোক থেকেই যাচ্ছে, তাদের জন্য রাষ্ট্রটি চালাতেই হয়; উৎপাদন খাতে না হোক, সেবাখাতে কুশলী লোকের দরকার হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এ ধরনের কুশলী জনসম্পদ তৈরির সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। শিক্ষার্থীরা-যে তারপরেও নিজেদের অংশত প্রস্তুত করে, তার পেছনে নিজেদের শ্রম এবং অভিভাবকদের নিবেদন মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক দশকগুলোর শিক্ষার্থীদের ভুক্তি পরীক্ষা করলেই বোঝা যাবে, নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীর পরিমাণ রীতিমত উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের পরিবারগুলোর ন্যূনতম জীবনমানের নিশ্চয়তা ছাড়া এ জনগোষ্ঠী থেকে কুশলী জনশক্তি উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই অনেক কম থাকবে।

এ তো গেল ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নতির সাথে নিম্নশ্রেণির মানুষের ন্যূনতম জীবনমান রক্ষিত হওয়ার সম্পর্ক। দূরবর্তী কিন্তু গভীর। কার্যত সম্পর্কটি আরো প্রত্যক্ষ, আরো নিকটবর্তী। প্রায় শতবর্ষ হয়ে গেল, অর্থশাস্ত্র এ তত্ত্ব প্রচার করছে যে, ভোক্তার স্বাভাবিক সক্রিয়তা অর্থাৎ ক্রয় উৎপাদনের জন্য অতি জরুরি শর্ত। উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির বৈপ্লবিক বদলের প্রেক্ষাপটে গত কয়েক দশকের দুনিয়াজোড়া অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, দুটি কুশলী সক্রিয় হাত আর একটি সক্ষম সক্রিয় মুখ সামষ্টিক আর্থিক উন্নতির গোড়ার কথা। রূপক-অর্থে বলা যায়, হাত দুইটা বলে উৎপাদনটাই হচ্ছে বেশি। কিন্তু বণ্টনজনিত ভালো কারিগরি হাতে না থাকায় দুনিয়াজুড়ে সক্ষম মুখের সংখ্যা অর্থাৎ ভোক্তার সংখ্যা উৎপাদন-অনুপাতে বাড়ে নাই। ফলে দুনিয়ার উৎপাদন-বণ্টন-ভোগের সংকট বাড়ছে। বাংলাদেশে উৎপাদনের কুশলতা প্রায় সম্পূর্ণ গরহাজির, আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ রয়ে যাচ্ছে সক্ষম ভোক্তাতালিকার বাইরে। এরকম বৃহদাকার জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র দেশে জনসংখ্যার একটা অংশকে, ধরা যাক পাঁচ শতাংশকে, ভোক্তা হিসাবে একস্তর উন্নীত করা গেলে সামগ্রিক ক্রয়ক্ষমতায় যে বিপুল বদল হওয়ার কথা, অর্থনীতির হিসাবে তা নিশ্চয়ই তাৎপর্যপূর্ণ বলেই গণ্য হবে। শুধু এদিক বিবেচনা করেও রিকশা-শ্রমিকের মতো গোষ্ঠীগুলোকে রাষ্ট্রের সামষ্টিক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় আনা প্রয়োজন।

সাত.
আমরা এ লেখায় রিকশাচালক অহিদের পায়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুখচ্ছবি তালাশ করলাম। দেখা যায় না। যে ধরনের স্বচ্ছ-সুন্দর পায়ে মুখ প্রতিফলিত হতে পারত, এ গরিব বাংলার ততোধিক গরিব রিকশা-চালকদের সেরকম পায়ের বন্দোবস্ত রাষ্ট্র করতে পারেনি। সম্পদের অভাবে হয়ত সবসময় এ ধরনের সাফল্য সম্ভব হয় না। কিন্তু এ রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগজনক সত্য হল, রাষ্ট্র আজতক এ ব্যাপারে কখনো কোনো প্রকল্পই নেয় নাই। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এ রাষ্ট্রের জন্য প্রেম দেখিয়ে আমাদের কী লাভ?  

জাতীয়তাবাদ একটা বাজে ব্যাপার, যদি এর নামে রাষ্ট্রকে একই জাতিরাষ্ট্রের অধীন জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করিয়ে নেয়া না যায়। রাষ্ট্র, দেখতেই পাচ্ছি, একটা জরুরি সংগঠন। বিপুল মানুষের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে জীবনযাপনের মান অচিন্তনীয় পরিমাণে বদলে দিতে পারে একটা কার্যকর রাষ্ট্র। সে ধরনের রাষ্ট্রের মানুষ হিসাবে বেঁচে থাকার এবং দুনিয়ার অন্যত্র পরিচয় দেয়ার মধ্যে শুধু মানসিক প্রশান্তি নেই, কার্যকর প্রাপ্তিও আছে। একটা উদাহরণ দিলেই কথাটা বোঝা যাবে। ভিয়েতনাম রাষ্ট্র কদিন আগেও বেশ গরিব ছিল, আর তার নাগরিকদেরও নিশ্চয়ই ভিয়েতনামি পরিচয়ে কোনো সুখ ছিল না। নিছক অন্য কেউ এ দায়ভার নিতে রাজি হত না বলেই লোকে নিজেদের ভিয়েতনামি বলে পরিচয় দিত। কিন্তু অল্প সময়েই ওই রাষ্ট্র নিজেদের অবস্থা আর দুনিয়াজুড়ে অবস্থান বদলে ফেলেছে। এখনকার ভিয়েতনামি নাগরিকরা বাইরে রাষ্ট্রের পরিচয়ে সুবিধাও পায়, ওই পরিচয়ে সুখও পায়। বিপরীতে, বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে বা মালয়েশিয়ায় একজন ব্যক্তি সুবিধা পাওয়া দূরের কথা, বরং তাচ্ছিল্যের শিকার হবে। এমতাবস্থায় সে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে চাইবে না। নিছক আর কোনো পরিচয় দেবার নাই বলে সে এ পরিচয় দিতে বাধ্য হবে, এবং দুর্বল রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে অধিকতর লাঞ্ছনা ভোগ করবে। এ কারণেই রাষ্ট্র দরকার। রাষ্ট্র এক-দুটি কার্যকর পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন রাতারাতি পাল্টে দিতে পারে। ইউরোপ-আমেরিকার বাইরেও এ নজির আমরা গত পাঁচ দশকে অনেক দেখেছি।

নানা লক্ষণ থেকে মনে হয়, বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসাবে একটা কাঠামোগত ভিত্তির উপর গড়তে আমরা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছি। উপনিবেশ আমলে এবং পরে পাকিস্তান আমলে গড়ে ওঠা কাঠামোর ভিত্তিতে আমাদের ক্ষমতাসীন মহলগুলো ব্যতিক্রমহীনভাবে রাষ্ট্র চালিয়েছে। গত পাঁচ দশকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কোনো নতুন উদ্যম লক্ষিত হয়নি। কার্যকর স্থানীয় সরকার আর জনবান্ধব প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যে প্রবাসী শ্রমিক আর গার্মেন্টস কর্মীরা দেশের শাসকশ্রেণির যাবতীয় বাহাদুরির ভিত্তি, তাদের লক্ষ করে রাষ্ট্র একটাও উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় কেবল বলপ্রয়োগের ক্ষমতা আর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে। কিন্তু শুধু বলপ্রয়োগ রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না। তাহলে আইএস, বোকো হারেম প্রভৃতি যে শাসন চালিয়েছে বা চালাচ্ছে, অথবা দুনিয়াজুড়ে অসংখ্য আদিবাসী বা উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে যেভাবে শাসনকার্য চলে, তার সবগুলোকেই রাষ্ট্র বলতে হয়। আমরা নিশ্চয়ই ওগুলোকে রাষ্ট্র বলতে সম্মত হব না। রাষ্ট্রের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প প্রয়োজন হয়। অন্তর্গত জনগোষ্ঠীকে পেশা, শ্রেণি বা গোষ্ঠী হিসাবে সম্বোধন করতে পারা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রত্বের বড় প্রমাণ। এজন্য জানবাজ রাজনীতিকেরও দরকার হয় না। নিছক বিভিন্ন বর্গ, শ্রেণি বা গোষ্ঠীর মুখের ভাষায় নজর রাখাই যথেষ্ট। রাষ্ট্র একটা বড় প্রতিষ্ঠান বলে তার কর্মকাণ্ডের একটা বড়ত্ব থাকে। জনগণের দিক থেকে প্রাথমিক সম্মতি থাকে। তাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোকে ব্যবহার করেই এমন উদ্যোগ নেয়া সম্ভব, যা বিপুল মানুষের দৈনন্দিনতাকে সদর্থে প্রভাবিত করে যাবে।

আমরা তো আশা করতেই পারি, টাকা পাচার করা ছাড়া জীবনকে অর্থবহ করার আরো পন্থা যে আছে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির অন্তত একাংশ দ্রুত তা উপলব্ধি করতে শিখবে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যকর সংগঠনে ক্রমশ রূপায়িত করার ধারাবাহিক উদ্যোগ ও উদ্যমে শামিল হবে। দুনিয়াব্যাপি যান্ত্রিক-প্রাযুক্তিক উন্নতির কল্যাণে সমস্ত মানুষের ভালো জীবনযাপনের যে সম্ভাবনা আজ হাতে মুঠোয়, তাকে মানুষের অধিকার হিসাবে ভাবতে-বুঝতে শিখবে। তাতে অহিদদের পায়ের সুরত সামষ্টিকভাবেই পাল্টে যাবে; আর সেই মসৃণ-সুন্দর পায়ে প্রতিফলিত হবে সুন্দর বাংলাদেশের মুখ।                              

[সম্পাদকের নোট: বর্তমান লেখাটি সংহতি প্রকাশন থেকে ২০২২ সালে প্রকাশিত সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ বই থেকে নেওয়া হয়েছে।]  

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।