রিপন ভিডিও, অপু ভাই ও রুচির প্রশ্ন  

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
হা হা হা। এটাই বাস্তব সোশাল মিডিয়ায় অন্যতম ভাইরাল ক্যাচফ্রেজ। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা



‘বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক,
তোমার সঙ্গে গল্প করব আমি সারারাত।’  

অথবা
‘তুমি আমি ফুলের কলি ফুটবো একসাথে,

তোমার আমার দেখা হবে ফুলশয্যার রাতে। 

তুমি দিবে কিছু, আমি দিব কিছু,

সেই থেকে জন্ম নিবে ছোট্ট এক শিশু।’

অথবা
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর

উপুস মাথায় দিয়ে,

দরজা খুলে যারে দেহুম

তারে করুম বিয়ে’

এইসব বহুল-প্রচারিত পদ্যের রচয়িতা রিপন মিয়া ওরফে রিপন ভিডিও। নেত্রকোনায় কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ২০১৬ সালে প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বানানো শুরু করেন। উপরে উদ্ধৃত লাইন দুটোর মত আরো অসংখ্য লাইন সেসময় তিনি আবৃত্তি করে আপলোড করেছেন। মানুষও সুযোগ ছাড়েনি। ইচ্ছামতন ট্রল, প্যারডি করেছে তাকে নিয়ে। এমনকি কোনো এক অদ্ভুত কারণে এতটাই ঘৃণা তার প্রতি কারো কারো জন্মেছিল যে একাধিকবার তার আইডি হ্যাক করে নষ্ট করে ফেলা হয়। যার কারণে ২০১৯-এ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভিডিও বানানো বাদ দিয়ে কাঠমিস্ত্রীর কাজেই মনোযোগ দেবেন। কিন্তু এরপর কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে তার এক প্রকার পুনরুত্থান ঘটে। এখন আর তিনি ছন্দ বলেন না। এখন তিনি নিজের সাধারণ জীবনের চিত্রধারণ করেন, নিয়মিত ভ্লগ আপলোড করেন। এখন আর তাকে আগের মত কটাক্ষের শিকার হতে হয় না। মানুষ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর মত পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রতিবেদনও হচ্ছে।  

কিন্তু যেই রিপন ভিডিও কয়েক বছর আগেও এতটা হাসি-তামাশার বিষয় ছিলেন, এতটাই বুলিং-এর শিকার ছিলেন যে সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন, তিনি কীভাবে এখন এতটা খ্যাতির মালিক হলেন? 
আমার ধারণাটাই বলি। রিপনভিডিও যখন ছন্দ আউড়াচ্ছিলেন তখন তিনি ঢুকে পড়েছিলেন সাহিত্যের দুনিয়ায়। কিন্তু বিদ্যমান যে সাহিত্যসমাজ, সেটা তাকে গ্রহণ করতে খুব একটা উৎসাহী যে ছিল না তা ধারণাই করা যায়। এরকম একটা ‘আনস্মার্ট’ ব্যাটা ‘অশুদ্ধ’ উচ্চারণে, ভুলভাল মাত্রায় একের পর এক পদ্য পড়ে যাচ্ছে সেটা তো মেনে নেয়া যায় না। আমাদের সুরুচির ঠিকাদারদের কাছে এগুলা রুচির দুর্ভিক্ষই। যেরকম আমোদ নিয়ে কোনো শিম্পাঞ্জির পিয়ানো বাজানো দেখে মানুষ, বড়জোর অনেকটা তেমনভাবেই ট্রিট করা যায় সেগুলোকে।    

রিপন ভিডিও ও অপু ভাইয়ের উত্থান এবং ভদ্রবিত্তের মূল্যায়ন আমাদের সমাজের গভীর শ্রেণিচেতনাকে তুলে ধরে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল


যদিও মধ্যবিত্তপ্রিয় সাহিত্যের সাথে রিপন ভিডিওর পদ্যগুলো সাহিত্যগুণের খুব বেশি ফারাক আছে তাও বলা যায় না। লেখক তুহিন খান একবার রিপন ভিডিওর একটা পদ্যের পাশে জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসাইনের দুটি লাইন পাশাপাশি বসিয়ে দেখেন। রিপন ভিডিও রচিত লাইনগুলো ছিল ‘পাট ক্ষেতে পাট গাছ, চিকন চিকন পাতা/তুমার কথা মনে পড়লে বুকে লাগে বেতা।’ এবং সাদাত হোসাইনের লাইনটি ছিল ‘এই যে সন্ধ্যা, তারার আকাশ, রাত্রির রঙ জানে/কাছের মানুষ দূরে সরে যায়, কী গোপন অভিমানে!’ তুহিন খান দেখিয়েছিলেন এই দুই লাইনের মধ্যে আদৌ গুণগত কোনো তফাৎ টানার সুযোগ নেই। ফারাক বলতে এইটুকুই যে সাদাত হোসাইনের কবিতা প্রতিনিধিত্ব করে শহুরে মধ্যবিত্ত এস্থেটিক্সের, আর রিপন ভিডিওরটাতে আছে স্বাভাবিক গ্রামীণ অনুষঙ্গ। কিন্তু কোনো শিল্পই তো স্থান-কালনিরপেক্ষ না। টিভ জনগোষ্ঠীর কাছে যখন হ্যামলেটের গল্পটা পড়ে শোনানো হয় তখন তাদের কাছে সে গল্পের মজাটা অধরা থেকে যায়।  কেননা বাবার মৃত্যুতে চাচাই তার স্ত্রীকে বিয়ে করবেন সেটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আবার ভূত হয়ে হ্যামলেটের বাবার ফিরে আসার ব্যাপারটাও তাদের কাছে তেমন চমকদার কিছু বলে মনে হয় না, কারণ মৃতের ফিরে আসা তাদের দৈনন্দিন যাপনেরই অংশ। এর মানে হলো সকল শিল্পকর্মই আসলে নিজের স্থানিক ও কালিক বাস্তবতার যুক্তিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল, সেই কাঠামোর বাইরে নিয়ে গেলে সেই শিল্পটাও নিজের অর্থ হারাতে পারে। ফলে তথাকথিত উন্নতরুচির সাহিত্য মূলত কেবল নিজের সামাজিক কন্ডিশনগুলোকে পূরণ করে; এর বেশি কিছু না। তবুও রুচি নিয়ে এক বেহুদা স্তরবিভাগ চলতেই থাকে। এই স্তরবিভাগের আড়ালে থাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং শ্রেণিগত পরিচয়। ডেভ হিকির মতে, ‘ক্ষ্যাত রুচিই আসল রুচি, উন্নত রুচি হলো অন্য কারো শ্রেণি-প্রিভিলিজের উচ্ছিষ্ট।’ 

বুরদিও’র মত তাত্ত্বিকেরা রুচি ব্যাপারটাকে দেখতেন ক্ষমতার প্রছন্ন চর্চা হিসেবে। ক্ষমতার বৈধতা ও সাংস্কৃতিক পুনরুৎপাদনের অবিরাম লড়াই চলতে থাকে রুচিশীলতার ময়দানে। ভাষাও এই লড়াইয়ে চিরকাল ভূমিকা রেখে এসেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে পাই: ‘শ্রেনি-বিভাজনের স্থির রেখাটি এমনকি সংস্কৃত নাটকের নিজের মধ্যেও ছিল। সেখানে সবাই এক ভাষায় কথা বলতো না, রাজপুরুষদের সংলাপের ভাষা সংস্কৃতই হতো, কিন্ত রাণী ও তাঁর সখীরা কথোপকথন করতো শৌরসেনী প্রাকৃতে, আর সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল মাগধী প্রাকৃত, যে মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব বলে মনে করা হয়।’ ফলে সাহিত্য যেহেতু এখানে উচ্চকোটির ভাষিক সৌখিনতার পরিসর, ফলে সেখানে এইসব গাঁইয়াদের অনুপ্রবেশ মেনে নেয়ার সুযোগ নাই। কাব্য করতে আসা রিপন ভিডিও মূলত এই কারণেই তোপের মুখে পড়েন।

কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন রিপন ভিডিওর উত্থান ঘটে, তখন আর তিনি কবিতা বলেন না। এখন তিনি নিজের সহজ-সরল জীবনের ভ্লগ বানান। রিক্সা চালানোর, কাঠমিস্ত্রির কাজের, ছোটখাটো হোটেলে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খাওয়ার ভিডিও বানান। যেই রূপে একজন নিম্নবিত্ত কাঠমিস্ত্রিকে আমরা দেখতে চাই, ঠিক সেই রূপেই হাজির থাকেন সর্বদা। কিছুতেই আমাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন না, আমাদের শ্রেণিপরিচয়ে ভাগ বসাতে আসেন না। ফলে এখন তাকে গ্রহণ করা আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে খোলামনে আমরা এখন মাতামাতি করতে পারি।  

শ্রেণিপরিচয়ের প্রতি যে হুমকির কথা বললাম তার নজির হিসেবে হাজির আছেন অপুভাই। নোয়াখালির সোনাইমুড়ির এক নাপিত টিকটক ও লাইকিতে ভিডিও করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। গ্রামের ক্ষ্যাত এক ছোকরা নিজের ইচ্ছামত চুলে রঙ করে, ভাঙাচোরা উচ্চারণে বড় বড় ডায়লগ মারবে সেটা শহুরে স্মার্টদের সহ্য হবে কেন? ফলে অনেক বড় বড় ইউটিউবার সেই সময় অপুভাই এবং অন্যান্য টিকটকারদের নিয়ে যথেচ্ছ ট্রল ও রোস্ট করেছেন। টিকটক বনাম ইউটিউবের একটা মোটামুটি বড় আকারের ক্যাচালও তখন চালু ছিল। তখন পর্যন্ত ইউটিউব ছিল মোটামুটি স্মার্ট, উচ্চমধ্যবিত্ত ক্রিয়েটরদের প্ল্যাটফর্ম, আর টিকটক ছিল গাঁইয়া ক্ষ্যাতদের। এতক্ষণে আর বলে দিতে হবে না যে টিকটক বনাম ইউটিউবের সেই লড়াই আদতে ছিল এই দুই শ্রেণির মধ্যকার লড়াই। যাকগে, সেইসব ট্রলে অপুভাইর তেমন ক্ষতি হয়নি, বরং ফলোয়ার আরো বেড়েছে। জেলহাজতও খেটেছেন। পরে দুবাইতে চলে যান। এখন সেখানে বসেই কিছুদিন আগে একটা ল্যামবোরগিনি কিনেছেন যার দাম ৮ লাখ ২৫ হাজার দিরহাম (বাংলা টাকায় প্রায় ২ কোটি ৭২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।) গাড়িটা আদৌ তিনি কিনেছেন কিনা সেটা নিয়ে যদিও তর্ক আছে। তবু, তার ব্যাপারে মধ্যবিত্তের মতামত কী সেটা যেকোনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় তাকে নিয়ে করা খবরের কমেন্টে গেলেই পাবেন। যে ভবিষ্যৎ আমরা নিজেদের জন্য বর্গা নিয়ে রেখেছি সেটা আচানক এক ক্ষ্যাত টিকটকার পুরাপুরি ভিন্নপথে নিজের জন্য বাগিয়ে নিল এটা হজম করা নিশ্চয়ই সহজ নয়। 

এখন যদি রিপনভিডিও কালকে হঠাৎ রিক্সা ছেড়ে গাড়িতে উঠে বসে, নিজের জন্য নির্মিত শ্রেণিবিন্যস্ত খুপড়ির থেকে বের হয়ে আসতে যান, এবং তাহলে তাকে যদি আরেক দফা ভয়াবহ বুলিং-এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আমি অবাক হবো না। কারণ শ্রেণিরুচির ও শ্রেণিঘৃণার কঠিন নিগড়ে বন্দী আমাদের এস্থেটিক সমাজে এটাই বাস্তব!       

থেকে আরও পড়ুন

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।