‘বন্ধু তুমি একা হলে আমায় দিও ডাক,
তোমার সঙ্গে গল্প করব আমি সারারাত।’
অথবা
‘তুমি আমি ফুলের কলি ফুটবো একসাথে,
তোমার আমার দেখা হবে ফুলশয্যার রাতে।
তুমি দিবে কিছু, আমি দিব কিছু,
সেই থেকে জন্ম নিবে ছোট্ট এক শিশু।’
অথবা
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
উপুস মাথায় দিয়ে,
দরজা খুলে যারে দেহুম
তারে করুম বিয়ে’
এইসব বহুল-প্রচারিত পদ্যের রচয়িতা রিপন মিয়া ওরফে রিপন ভিডিও। নেত্রকোনায় কাঠমিস্ত্রীর কাজ করতেন। ২০১৬ সালে প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বানানো শুরু করেন। উপরে উদ্ধৃত লাইন দুটোর মত আরো অসংখ্য লাইন সেসময় তিনি আবৃত্তি করে আপলোড করেছেন। মানুষও সুযোগ ছাড়েনি। ইচ্ছামতন ট্রল, প্যারডি করেছে তাকে নিয়ে। এমনকি কোনো এক অদ্ভুত কারণে এতটাই ঘৃণা তার প্রতি কারো কারো জন্মেছিল যে একাধিকবার তার আইডি হ্যাক করে নষ্ট করে ফেলা হয়। যার কারণে ২০১৯-এ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ভিডিও বানানো বাদ দিয়ে কাঠমিস্ত্রীর কাজেই মনোযোগ দেবেন। কিন্তু এরপর কিছুদিন আগে ইন্টারনেটে তার এক প্রকার পুনরুত্থান ঘটে। এখন আর তিনি ছন্দ বলেন না। এখন তিনি নিজের সাধারণ জীবনের চিত্রধারণ করেন, নিয়মিত ভ্লগ আপলোড করেন। এখন আর তাকে আগের মত কটাক্ষের শিকার হতে হয় না। মানুষ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর মত পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রতিবেদনও হচ্ছে।
কিন্তু যেই রিপন ভিডিও কয়েক বছর আগেও এতটা হাসি-তামাশার বিষয় ছিলেন, এতটাই বুলিং-এর শিকার ছিলেন যে সোশ্যাল মিডিয়া ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন, তিনি কীভাবে এখন এতটা খ্যাতির মালিক হলেন?
আমার ধারণাটাই বলি। রিপনভিডিও যখন ছন্দ আউড়াচ্ছিলেন তখন তিনি ঢুকে পড়েছিলেন সাহিত্যের দুনিয়ায়। কিন্তু বিদ্যমান যে সাহিত্যসমাজ, সেটা তাকে গ্রহণ করতে খুব একটা উৎসাহী যে ছিল না তা ধারণাই করা যায়। এরকম একটা ‘আনস্মার্ট’ ব্যাটা ‘অশুদ্ধ’ উচ্চারণে, ভুলভাল মাত্রায় একের পর এক পদ্য পড়ে যাচ্ছে সেটা তো মেনে নেয়া যায় না। আমাদের সুরুচির ঠিকাদারদের কাছে এগুলা রুচির দুর্ভিক্ষই। যেরকম আমোদ নিয়ে কোনো শিম্পাঞ্জির পিয়ানো বাজানো দেখে মানুষ, বড়জোর অনেকটা তেমনভাবেই ট্রিট করা যায় সেগুলোকে।

যদিও মধ্যবিত্তপ্রিয় সাহিত্যের সাথে রিপন ভিডিওর পদ্যগুলো সাহিত্যগুণের খুব বেশি ফারাক আছে তাও বলা যায় না। লেখক তুহিন খান একবার রিপন ভিডিওর একটা পদ্যের পাশে জনপ্রিয় লেখক সাদাত হোসাইনের দুটি লাইন পাশাপাশি বসিয়ে দেখেন। রিপন ভিডিও রচিত লাইনগুলো ছিল ‘পাট ক্ষেতে পাট গাছ, চিকন চিকন পাতা/তুমার কথা মনে পড়লে বুকে লাগে বেতা।’ এবং সাদাত হোসাইনের লাইনটি ছিল ‘এই যে সন্ধ্যা, তারার আকাশ, রাত্রির রঙ জানে/কাছের মানুষ দূরে সরে যায়, কী গোপন অভিমানে!’ তুহিন খান দেখিয়েছিলেন এই দুই লাইনের মধ্যে আদৌ গুণগত কোনো তফাৎ টানার সুযোগ নেই। ফারাক বলতে এইটুকুই যে সাদাত হোসাইনের কবিতা প্রতিনিধিত্ব করে শহুরে মধ্যবিত্ত এস্থেটিক্সের, আর রিপন ভিডিওরটাতে আছে স্বাভাবিক গ্রামীণ অনুষঙ্গ। কিন্তু কোনো শিল্পই তো স্থান-কালনিরপেক্ষ না। টিভ জনগোষ্ঠীর কাছে যখন হ্যামলেটের গল্পটা পড়ে শোনানো হয় তখন তাদের কাছে সে গল্পের মজাটা অধরা থেকে যায়। কেননা বাবার মৃত্যুতে চাচাই তার স্ত্রীকে বিয়ে করবেন সেটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আবার ভূত হয়ে হ্যামলেটের বাবার ফিরে আসার ব্যাপারটাও তাদের কাছে তেমন চমকদার কিছু বলে মনে হয় না, কারণ মৃতের ফিরে আসা তাদের দৈনন্দিন যাপনেরই অংশ। এর মানে হলো সকল শিল্পকর্মই আসলে নিজের স্থানিক ও কালিক বাস্তবতার যুক্তিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল, সেই কাঠামোর বাইরে নিয়ে গেলে সেই শিল্পটাও নিজের অর্থ হারাতে পারে। ফলে তথাকথিত উন্নতরুচির সাহিত্য মূলত কেবল নিজের সামাজিক কন্ডিশনগুলোকে পূরণ করে; এর বেশি কিছু না। তবুও রুচি নিয়ে এক বেহুদা স্তরবিভাগ চলতেই থাকে। এই স্তরবিভাগের আড়ালে থাকে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং শ্রেণিগত পরিচয়। ডেভ হিকির মতে, ‘ক্ষ্যাত রুচিই আসল রুচি, উন্নত রুচি হলো অন্য কারো শ্রেণি-প্রিভিলিজের উচ্ছিষ্ট।’
বুরদিও’র মত তাত্ত্বিকেরা রুচি ব্যাপারটাকে দেখতেন ক্ষমতার প্রছন্ন চর্চা হিসেবে। ক্ষমতার বৈধতা ও সাংস্কৃতিক পুনরুৎপাদনের অবিরাম লড়াই চলতে থাকে রুচিশীলতার ময়দানে। ভাষাও এই লড়াইয়ে চিরকাল ভূমিকা রেখে এসেছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ গ্রন্থে পাই: ‘শ্রেনি-বিভাজনের স্থির রেখাটি এমনকি সংস্কৃত নাটকের নিজের মধ্যেও ছিল। সেখানে সবাই এক ভাষায় কথা বলতো না, রাজপুরুষদের সংলাপের ভাষা সংস্কৃতই হতো, কিন্ত রাণী ও তাঁর সখীরা কথোপকথন করতো শৌরসেনী প্রাকৃতে, আর সাধারণ মানুষের ভাষা ছিল মাগধী প্রাকৃত, যে মাগধী প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব বলে মনে করা হয়।’ ফলে সাহিত্য যেহেতু এখানে উচ্চকোটির ভাষিক সৌখিনতার পরিসর, ফলে সেখানে এইসব গাঁইয়াদের অনুপ্রবেশ মেনে নেয়ার সুযোগ নাই। কাব্য করতে আসা রিপন ভিডিও মূলত এই কারণেই তোপের মুখে পড়েন।
কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন রিপন ভিডিওর উত্থান ঘটে, তখন আর তিনি কবিতা বলেন না। এখন তিনি নিজের সহজ-সরল জীবনের ভ্লগ বানান। রিক্সা চালানোর, কাঠমিস্ত্রির কাজের, ছোটখাটো হোটেলে তৃপ্তি নিয়ে ভাত খাওয়ার ভিডিও বানান। যেই রূপে একজন নিম্নবিত্ত কাঠমিস্ত্রিকে আমরা দেখতে চাই, ঠিক সেই রূপেই হাজির থাকেন সর্বদা। কিছুতেই আমাদের জন্য হুমকি হয়ে ওঠেন না, আমাদের শ্রেণিপরিচয়ে ভাগ বসাতে আসেন না। ফলে এখন তাকে গ্রহণ করা আমাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে খোলামনে আমরা এখন মাতামাতি করতে পারি।
শ্রেণিপরিচয়ের প্রতি যে হুমকির কথা বললাম তার নজির হিসেবে হাজির আছেন অপুভাই। নোয়াখালির সোনাইমুড়ির এক নাপিত টিকটক ও লাইকিতে ভিডিও করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। গ্রামের ক্ষ্যাত এক ছোকরা নিজের ইচ্ছামত চুলে রঙ করে, ভাঙাচোরা উচ্চারণে বড় বড় ডায়লগ মারবে সেটা শহুরে স্মার্টদের সহ্য হবে কেন? ফলে অনেক বড় বড় ইউটিউবার সেই সময় অপুভাই এবং অন্যান্য টিকটকারদের নিয়ে যথেচ্ছ ট্রল ও রোস্ট করেছেন। টিকটক বনাম ইউটিউবের একটা মোটামুটি বড় আকারের ক্যাচালও তখন চালু ছিল। তখন পর্যন্ত ইউটিউব ছিল মোটামুটি স্মার্ট, উচ্চমধ্যবিত্ত ক্রিয়েটরদের প্ল্যাটফর্ম, আর টিকটক ছিল গাঁইয়া ক্ষ্যাতদের। এতক্ষণে আর বলে দিতে হবে না যে টিকটক বনাম ইউটিউবের সেই লড়াই আদতে ছিল এই দুই শ্রেণির মধ্যকার লড়াই। যাকগে, সেইসব ট্রলে অপুভাইর তেমন ক্ষতি হয়নি, বরং ফলোয়ার আরো বেড়েছে। জেলহাজতও খেটেছেন। পরে দুবাইতে চলে যান। এখন সেখানে বসেই কিছুদিন আগে একটা ল্যামবোরগিনি কিনেছেন যার দাম ৮ লাখ ২৫ হাজার দিরহাম (বাংলা টাকায় প্রায় ২ কোটি ৭২ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা।) গাড়িটা আদৌ তিনি কিনেছেন কিনা সেটা নিয়ে যদিও তর্ক আছে। তবু, তার ব্যাপারে মধ্যবিত্তের মতামত কী সেটা যেকোনো মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় তাকে নিয়ে করা খবরের কমেন্টে গেলেই পাবেন। যে ভবিষ্যৎ আমরা নিজেদের জন্য বর্গা নিয়ে রেখেছি সেটা আচানক এক ক্ষ্যাত টিকটকার পুরাপুরি ভিন্নপথে নিজের জন্য বাগিয়ে নিল এটা হজম করা নিশ্চয়ই সহজ নয়।
এখন যদি রিপনভিডিও কালকে হঠাৎ রিক্সা ছেড়ে গাড়িতে উঠে বসে, নিজের জন্য নির্মিত শ্রেণিবিন্যস্ত খুপড়ির থেকে বের হয়ে আসতে যান, এবং তাহলে তাকে যদি আরেক দফা ভয়াবহ বুলিং-এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়, আমি অবাক হবো না। কারণ শ্রেণিরুচির ও শ্রেণিঘৃণার কঠিন নিগড়ে বন্দী আমাদের এস্থেটিক সমাজে এটাই বাস্তব!