‘শোকের অযোগ্য’ জীবন ও সার্বভৌমত্বের বিকার

WhatsApp Image 2025-03-13 at 18.32.36
অরিত্র আহমেদ
লেখক
বাঙলাদেশের পাহাড়িদের জীবন আসলে বাটলার-কথিত শোকের অযোগ্য, খরচযোগ্য জীবন। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

বাংলাদেশে জাতিগত সংঘাত কিংবা সংখ্যালঘু নিয়ে কোনো আলাপ উঠলেই জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে-র Can a Muslim Be an Indian আর্টিকেলটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পর যেসব মুসলমান পাকিস্তানে চলে না গিয়ে ভারতে থেকে গেছিল, সদ্য-স্বাধীন ভারতে নাগরিক হিসেবে সেই মুসলমানেরা যে অপরায়ন ও রাজনৈতিক হেনস্থার ভেতর দিয়ে গেছিল, সেটাই মূলত এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু। পাণ্ডে তাঁর আলোচনা শুরু করেছেন দু’টো প্রস্তাবনা দিয়ে। 

এক. জাতি মাত্রেরই একটা কেন্দ্র। মূলধারা থাকে। এই মূলধারার নাগরিকেরা জন্মসূত্রেই ওই জাতি ও জাতিরাষ্ট্রের সহজাত, স্বাভাবিক কিংবা প্রাকৃতিক নাগরিক হিসেবে পরিচিত হন। তাদেরকে আলাদা করে দেশপ্রেম কিংবা দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেখাতে হয় না তাদেরকে।      

দুই. জাতিগঠনের সাথে তাল মিলিয়ে অনিবার্যভাবেই গড়ে ওঠে এক বা একাধিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যাদেরকে আমরা কখনো কখনো প্রান্তীয় নাগরিক বলেও সম্বোধন করে থাকি। মাইনরিটি ছাড়া কখনো কোনো জাতিরাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না, এমনকি জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে বলবৎ রাখার জন্য কালেভদ্রে মাইনরিটি তৈরীও করে নিতে হয়। রাষ্ট্রের মূলধারা এই মাইনরিটিকে প্রান্তে ঠেলে দেয় (গোষ্ঠীভেদে এই প্রান্তিকীকরণের মাত্রা কমবেশি হতে পারে) এবং প্রায়শই তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকে। ফলে মাইনরিটির উপর একটা সার্বক্ষণিক চাপ থাকে রাষ্ট্রের প্রতি তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেওয়ার। পাণ্ডে দেখিয়েছেন, দেশভগের পর সেক্যুলার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ভারত রাষ্ট্রে মুসলমানরা হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ‘সন্দেহজনক’ নাগরিক। মুসলমানদের চেয়েও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তো অবশ্যই ছিলো। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূলধারা গড়ে উঠেছিলো হিন্দুদের হাতেই, সেহেতু দেশভাগোত্তর পরিস্থিতিতে ভারতের মুসলমানরা যে তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ অনুভব করেছিলেন, সেটা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে অনুভব করতে হয়নি।  

গত সেপ্টেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজনের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে মাথায় একইরকম একটা একটা প্রশ্ন ঘুরছিলো: ‘Can a Pahari Be a Bangladeshi?
মাত্র দেড় মাস আগে হাসিনা পালিয়ে গেছে, হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম অবসানের রেশ তখনো কাটেনি। কিন্তু বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের পুরোটা সময় জুড়ে ফেসবুকে বাঙালি নেটিজেনদের উল্লাস ও উদযাপন দেখে হঠাৎ মনে হচ্ছিলো আমরা সম্ভবত উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বর্ণযুগে বাস করছি। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও প্রচারক আওয়ামী লীগ তখন মাঠে নেই, বরং ছত্রিশে জুলাইয়ের পর থেকে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি, বাঙালি’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে চারিদিকে। মনে হচ্ছিলো, কাগজে-কলমে যাই লেখা থাক, পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রশ্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘তুই বাঙালি হইয়া যা’-র সঙ্গে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ‘তুই বাংলাদেশি হইয়া যা’-র আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। কারণ বাঙালি নেটিজেনরা তখন একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে: পাহাড়িরা বাংলাদেশ চায় না (অর্থাৎ, পাহাড়িরা বাংলাদেশি হতে চায় না); তারা আলাদা দেশ গঠন করতে চায়; অতএব বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এখন যেকোনো মূল্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী পাহাড়িদের দমন করতে হবে। ‘পাহাড়ি’ মানেই তখন বাঙলাদেশের শত্রু। আমরা হলাম ‘আমরা’, আর পাহাড়িরা হলো ‘ওরা’। এমন একটা পরিস্থিতিতে, নাগরিক হিসেবে একজন পাহাড়িকে সন্দেহ করার জন্য কারো কোনো প্রমাণ লাগে না। কিন্তু ভালো বলার জন্য প্রমাণের দরকার হয়। ভারতের মুসলমানদের মতোই বাঙলাদেশের একজন আদিবাসীকে সবসময় প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় যে তিনি বাঙলাদেশের একজন ‘বিশ্বস্ত নাগরিক ’।      

কাছাকাছি সময়েই আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিলো বা ঘটছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে পিটিয়ে খুন করেছিলো কিছু ছাত্র। ঘটনাটা হৃদয়বিদারক। ফলে সারা বাঙলাদেশ বেশ কয়েক দিন ধরে তোফাজ্জলের জন্য অশ্রুপাত করেছে। ওদিকে জুলাই আন্দোলনের আহতরা তখনো ১/২ জন করে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে। শহীদের তালিকা বড়ো হচ্ছে। মানুষ কাঁদছে। একেকজন শহীদের মৃত্যু তখন একেকটা জাতীয় ঘটনা। আমরা আমাদের শহীদদের জন্য শোক করবো- এটা স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়া উচিত। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছুদিন পর আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে একজন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর সেইটা নিয়ে দেখা গেলো তেমন কোনো প্রতিবাদ হলো না, দেশব্যাপী শোকপ্রকাশও দেখা গেলো না। আবার বাঙলাদেশের আরেক প্রান্তে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় চার জন পাহাড়ি মারা গেলো। পাহাড়ে আগুন জ্বললো টানা কয়েকদিন। কিন্তু এই ঘটনায় সারা দেশের মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দেখালো, তাকে মোটা দাগে উদযাপন ছাড়া কিছু বলা যায় না। এটা বাঙলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা না। নেহাত রানা প্লাজা টাইপের কিছু না ঘটলে শ্রমিকদের জীবন-মরণ নিয়ে আমরা অতো ঘামাই না কখনোই। আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাহাড়ে সেনাবাহিনী বা বাঙালি সেটেলারদের হাতে কোনো পাহাড়ি নিহত (নিহতই মাত্র, শহীদ নয় কিছুতেই) বা নির্যাতিত হলে সেইটা নিয়ে পাবলিক স্ফিয়ারে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। হয় নীরবতা, নয়তো উদযাপন, নয়তো নীরব উদযাপন- পাহাড়িদের উপর নিপীড়নের বিপরীতে এই হলো আমাদের মোটামুটি প্রতিক্রিয়া। ঢাকা শহরে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মানুষ হত্যার শিকার সারা জাতির চোখ ছলোছলো হয়ে ওঠে। ভারতে কোনো নারী ডাক্তার ধর্ষিত হলে সেইটার প্রতিবাদ বাংলাদেশেও হয়। কিন্তু সেনাবাহিনী যখন গুলি করে পাহাড়ি মারে, তখন সেইটা নিয়ে শোকসভা বসে না ফেসবুকে। পাহাড়ি মেয়েরা ধর্ষিত হলে তার জন্য ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ প্রোগ্রাম হয় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য প্রোগ্রাম হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় পাহাড়ি মেয়েদের ধর্ষণের খবর আসে কয়টা? 

এই যে, পাহাড়িদের উপর চলমান গুম-খুন-ধর্ষণ নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কোনো মাথাব্যাথা নেই, কোনো শোক নেই, হাহাকার নেই, এইটা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা না। এইখানে রাজনীতি আছে। একই সাথে খুব স্থুল, আবার খুব সূক্ষ্ম রাজনীতি। বলা যায়, শোক-প্রকাশের রাজনীতি। শোক তো মানুষের সহজাত একটা ব্যাপার৷ ব্যক্তি হিসেবে আমি-আপনি সবাই-ই তো শোক প্রকাশ করি। আমি আমার আপনজনের মৃত্যুতে শোকে কাতর হই, আবার আপনি হয়তো কাতর হচ্ছেন আপনার কোনো বন্ধুর চলে যাওয়ায়। এই শোক মানবিক ও নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কাদের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ভাবান্বিত হই? কাদের বেঁচে থাকা ও না থাকায়, ভালো থাকা ও না থাকায় আমাদের যায় আসে? কাদের মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হই, শোকে কাতর হই? ভারতের কোনো নারী ডাক্তার ধর্ষিত হলে আমরা আওয়াজ তুলি, কিন্তু পাহাড়ি নারীদের উপর চলমান যৌন নিপীড়ন আমাদের গায়ে লাগে না কেনো? পাহাড়িদের জীবন আর সমতলের বাঙালিদের জীবন কি সমান মর্যাদার অধিকারী? যে অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ‘জীবন’ আছে, সেই অর্থে কি পাহাড়িদের আদৌ কোনো ‘জীবন’ আছে? 

‘শোকের অযোগ্য জীবন’ কথাটা ব্যবহার করেছেন জুডিথ বাটলার। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আছে, যাদের জন্য শোক করার কেউ নেই। তাদের জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেউ তেমন কোনো প্রতিবাদ করে না। বাংলাদেশের পাহাড়িদের জীবন কী ‘শোকের অযোগ্য’। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

‘Can one lead a good life in a bad life?’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় জুডিথ বাটলার ‘ungrievable lives’ নামে একটা টার্ম ব্যবহার করেছিলেন। বাংলায় সম্ভবত দাঁড়ায় ‘শোকের অযোগ্য জীবন’। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আছে, যাদের জন্য শোক করার কেউ নেই। তাদের জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেউ তেমন কোনো প্রতিবাদ করে না। কেনো করে না? বাটলার বলছেন, এর জন্য দায়ী হচ্ছে রাষ্ট্র কিংবা আমাদের চারপাশে জারি থাকা ক্ষমতা-কাঠামোর এক বিশেষ ধরনের বায়োপলিটিক্স। এই ক্ষমতাকাঠামোই তার নিজস্ব সুরক্ষার খাতিরে আমাদের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করে। একই ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক পরিমণ্ডলে সত্ত্বেও আমাদের কারো কারো জীবন হয়ে ওঠে খুবই মূল্যবান ও শোকের যোগ্য, আবার কারো কারো জীবন হয়ে ওঠে নিতান্তই মূল্যহীন ও শোকের অযোগ্য। রাজনীতির অদলবদল ও পটপরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে কারো কারো জীবনের মূল্যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটতে থাকে নিরন্তর। ফলে রাষ্ট্র এবং চারপাশের সামাজিক-রাজনৈতিক কখন কেন কার জীবনকে শোকের যোগ্য বা অযোগ্য করে তুলছে, সেই বায়োপলিটিক্স বুঝতে না পারলে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর উপর চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নকে যথার্থভাবে বোঝা সম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, রাষ্ট্র এই বায়োপলিটিক্সের আশ্রয় নেয় নিজের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নয়। প্রোপাগান্ডা দিয়ে হোক কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভায়োলেন্স দিয়ে হোক, যে সমস্ত ব্যক্তি বা কমিউনিটি বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর পক্ষে বাঁধা কিংবা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র তাদেরকে যেকোনো মূল্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে এমনভাবে হাজির করে, যাতে মনে হয় ওই বিশেষ ব্যক্তি বা কমিউনিটির ভালোমন্দের খোঁজ রাখার কোনো দরকার নেই, বা বৃহত্তর জনস্বার্থে ওই কমিউনিটিকে নিপীড়নের উপর রাখতে হবে, এমনকি দরকার হলে কায়দা করে উপড়ে ফেলতে হবে। আর যাদেরকে রাষ্ট্র বাঁচাতে চায়, সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করা হয়। মানুষ যেন তাদের ভাবমূর্তির প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত থাকে, সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখভাল করা হয়। 

বাংলাদেশের পাহাড়িদের জীবন আসলে বাটলার-কথিত শোকের অযোগ্য, খরচযোগ্য জীবন। এর কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী মূলধারা থেকে তারা সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা কিভাবে তৈরী হয়েছে, সেই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং আপাতত অপ্রাসঙ্গিক। যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা এই বিচ্ছিন্নতা কমাতে পারিনি বা কমাতে চাইনি। প্রত্যেকটা দেশেই এমন কিছু ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসে, যখন প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোকে ঢেলে সাজানোর কাজটা শুরু করা যায়, কিংবা নতুন রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করা যায়। আমরা আমাদের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। একাত্তর আমাদেরকে একটা বড়ো সুযোগ করে দিয়েছিলো, কিন্তু অনতিপরেই দেখা গেলো সংকীর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ততোধিক সংকীর্ণ একটা জাতিরাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে বাংলাদেশে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের বিষয়টা আমলে না নিয়ে পাহাড়িদেরকে বলা হলো বাঙালি হয়ে যেতে, যেনো বিচ্ছিন্নতা দূর করার দায়টা কেবল তাদেরই। এর কয়েক বছর পরে জিয়াউর রহমান আসলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে। ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা দেখে অনেকে ধারণা করেছিলেন, এতে বোধ হয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝুঁকিগুলো আর থাকলো না। কিন্তু জিয়াউর রহমানই উন্নয়নের নাম করে পাহাড়ে বাঙালি সেটেলমেন্ট শুরু করলেন (শুধু পাহাড়ি না, স্বয়ং পাহাড়কেই বাঙালি করে তোলার চেষ্টা), যাতে বিচ্ছিন্নতা তো কমলোই না, বরং ওই সেটেলমেন্ট থেকেই পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত আরো তীব্রতা ও সহিংসতা লাভ করলো। এরশাদ এসেও এই সেটেলমেন্ট এবং তথাকথিত ‘উন্নয়নের ধারা’ অব্যাহত রেখে গেছেন। যদি ধরেও নিই যে, এই উন্নয়নের পেছনে কোনো গোপন অভিপ্রায় নেই, এই উন্নয়ন নিতান্তই সদিচ্ছা-প্রণোদিত, তবু প্রশ্ন ওঠে, এই উন্নয়ন থেকে পাহাড়িরা কতোটুকু লাভবান হয়েছে বা হচ্ছে? মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা, আজ শতকরা কতোজন পাহাড়ি সেগুলো পূরণ করতে পারে? বেশির ভাগ মানুষ তো এখনো সেখানে ঠিকমতো খেতে-পরতেই পারে না। তাহলে লাভটা হলো কাদের?

উন্নয়নের নামে এই চালিয়াতি বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই হচ্ছে, কিন্তু প্রায় পাঁচ দশক ধরে সেনাবাহিনীর হাতে যে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছে পাহাড়িরা, তার সমতুল্য অভিজ্ঞতা স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য কোনো জনপদের হয়নি। পাহাড়িদের মৌলিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে সামরিক উপায়ে দমন করার ব্যাপারটা শুরু হয়েছিলো জিয়ার আমলে। পাহাড়ে বাঙালি সেটেলমেন্টও আদতে একটা সামরিক কৌশলই ছিলো। এরপর থেকে গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে পাহাড়ি এলাকায় রীতিমতো সেনাশাসন বলবৎ আছে। এই সেনাশাসনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সহিংসতা। গুম, খুন, ধর্ষণ, নির্বিচার গ্রেফতার ও হয়রানি- মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি মাইলস্টোনই সেনাবাহিনী স্পর্শ করে ফেলেছে। সময়ে সময়ে গণহত্যা চলেছে পাহাড়িদের উপর। পাহাড়ি মেয়েদের উপর যৌন নিপীড়ন এখনো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এতো কিছুর পরও বাঙালি সুশীল সমাজ এসব নিয়ে কোনো আওয়াজ তোলে না, কারণ তারা বিশ্বাস করে, বা তাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, পাহাড়ি মাত্রই বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাদেরকে ‘মাইরের উপরে’ না রাখলে তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড কায়েম করে ফেলবে।  

সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যেই যেহেতু এতো কিছু, সেহেতু এ বিষয়ে কিছু কথা বলা আবশ্যক। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে বা বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে- এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু সার্বভৌমত্ব যদি নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে? বা মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে যদি সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়? রাষ্ট্র যদি কোনো জনপদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বা অনিচ্ছুক হয়, তো সেই জনপদকে সার্বভৌমত্বের সবক দেওয়ার কোনো অধিকার কি রাষ্ট্রের থাকে? এর উত্তর হচ্ছে, না, থাকে না। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। 

এটা ঠিক যে, পাহাড়িদের ভেতরে কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী, সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্রিয়াশীল আছে, যারা হয়তো আসলেই স্বাধীন জুমল্যান্ড বা ওই ধরনের কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। তীব্র সহিংস আচরণের ইতিহাস তাদেরও আছে। কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলোকে কি আপামর পাহাড়িদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়? এখানে মনে রাখতে হবে যে, পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাদের ভেতরেও মেজরিটি-মাইনরিটি আছে। পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসন স্বায়ত্তশাসন কিভাবে আদায় করতে হবে- এই প্রশ্নে স্বয়ং পাহাড়িদের মধ্যেই মতভেদের ষভাব নেই। সুতরাং কয়েকটা সশস্ত্র গোষ্ঠীর আচরণকে আপামর পাহাড়িদের আচরণ ধরে নিলে সেটা ভুল হয়ে যাবে। তাছাড়া সশস্ত্র পাহাড়িরা যদি শেষ পর্যন্ত পাহাড়ে কোনো স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হয়েও থাকে, এরপরও পাহাড়ি এলাকায় চলমান বৈষম্যের একটা বড়ো অংশই দূর হবে না। আজ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা পাহাড়িদেরকে যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে, ঠিক সেইভাবেই অপেক্ষাকৃত বড়ো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে ছোটো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর নিগৃহীত ও নিপীড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সুতরাং আলাদা জাতিরাষ্ট্র কায়েম পাহাড়িদের জন্যও কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এক সার্বভৌমত্বের বিকারের সমাধান আরেক সার্বভৌমত্ব দিয়ে করা সম্ভব নয়, যদি রাষ্ট্রকাঠামোর উগ্র জাতীয়তাবাদী মেজাজে কোনো টেকসই পরিবর্তন না আসে। 

বাস্তবতা হচ্ছে যে, বেশির ভাগ পাহাড়িই আদৌ কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র চায় না। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা মেনে জীবনধারণ করার ন্যায্য বাসনা আছে তাদের। বাংলাদেশে যে জাতিরাষ্ট্র আমরা কায়েম করেছি, সেটা যেহেতু চারিত্রিক ও সাংবিধানিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী, সেহেতু পাহাড়িদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে এই রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে চায় না। পাহাড়িদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিলে যে রাষ্ট্রের ঘাড়ে যে দায়দায়িত্ব বর্তায়, রাষ্ট্র সেটা নিতে চায় না। সুতরাং সার্বভৌমত্বের মিথ তৈরী করে পাহাড়িদের ন্যায্য দাবিদাওয়াকে দমন করার দরকার হয় রাষ্ট্রের। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পাহাড়ি এলাকায় এক সার্বক্ষণিক জরুরী অবস্থা (কল্পনা চাকমার ভাষায় ‘ধাও-পালাও’ অবস্থা) জারি করে রাখা হয় এ কারণেই। কিন্তু এই বন্দোবস্ত সংঘাত খালি বাড়ায়, কমায় না। পাহাড়িদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না হলে এবং তাদেরকে সেনাবাহিনী দিয়ে লাগাতার শায়েস্তা করে গেলে তারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে কখনোই পাবকিক স্ফিয়ারে আসতে পারবে না- এইটা মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীরা সাময়িক একটা সুখ পেতেই পারেন। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, তাদের এই বন্দোবস্তই পাহাড়িদেরকে চরমপন্থা ও চরমপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। শান্তির সম্ভাবনা যাও-বা থাকে, তাও দেখা যায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পৃথিবীর যেকোনো শোষক রাষ্ট্রই সংঘাত জারি রাখার এই কৌশল অবলম্বন করে উত্তরোত্তর নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য। জিজেক বলেছিলেন, Israel ‘Hamasizes’ the Palestinians to justify ethnic cleansing and present the expansion of Israel ‘from the river to the sea’ as an act of self-defence.” পাহাড়ের প্রশ্নে ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের তফাত কী তাহলে? পাহাড়ি মাত্রই কুকিচিন, এই অজুহাত দিয়ে পাহাড়ে সেনাশাসন চালালে কুকিচিনের শক্তি বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ, একই সঙ্গে কোনো জনপদের রাজনীতি আর চরমপন্থা উভয়কেই একসাথে মুছে ফেলা যায় না। একটা মুছলে আরেকটার আবির্ভাব হয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সেই আবির্ভাব প্রাদুর্ভাবে পরিণত হতে পারে।  

এরপরও পাহাড়িদের অধিকার নিয়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ততোটা সরব নয় কেনো? জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মনোভাব এর একটা কারণ তো বটেই, কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়। পাহাড়িদের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞানের অভাব, বিশেষ করে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যথাযথ রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাব বাঙলাদেশের জনগণের মধ্যে বেশ প্রকট। রাষ্ট্রের ধর্ম সার্বভৌমত্ব, এটা তো জানা কথা। কিন্তু পাহাড়িদের ব্যাপারে সমতলের বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া দেখলে যে কারো মনে হগে পারে, রাষ্ট্রের এই সার্বভৌমত্ব যেনো তাদেরও ধর্ম হয়ে উঠেছে, সার্বভৌমত্ব শব্দটাকেই তারা যেনো ঐশীজ্ঞান করছে। তাদের দাবিটা এমন যে, একবার সার্বভৌমত্বের দোহাই দিলেই রাষ্ট্রের সব কথা, সব কাজ পাই টু পাই মেনে নিতে হবে। অথচ এই অবসেশনের মধ্যেও বড়ো ঘাপলা আছে। যে সুরে ও যে ভাষায় আজ বাঙালিরা সার্বভৌমত্বের কথা বলে পাহাড়িদের উপর চলমান নিপীড়নকে উদযাপন করছে এবং একে ন্যায্য মনে করছে, সেই সুর ও সেই ভাষার সাথে উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সুরের কোনো পার্থক্য আছে? সার্বভৌমত্বই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে মণিপুর বা কাশ্মীরে ভারতীয় রাষ্ট্র যা করছে, তা কোন দিক দিয়ে অন্যায়? ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তো এইভাবেই কাশ্মীরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিপ্রেজেন্ট করে। ওরা সন্ত্রাসী, ওরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, ওদেরকে মারো, ওদেরকে ধরো- এগুলো বলার জন্য ভারতে ‘উগ্র হিন্দু’ হওয়া লাগে না। ছিমছাম ‘জাতীয়তাবাদী’ হলেই হয়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আর সার্বভৌমত্বের জিকির করলেই হয়। একাত্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাহলে কী অন্যায় করেছিলো বাংলাদেশের সঙ্গে? রাষ্ট্র যদি সার্বভৌমত্ব শব্দটাকে নিপীড়নের অস্ত্র বানিয়ে তোলে, যদি সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়েই লাখ লাখ মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়, তো সেই ‘সার্বভৌমত্বে’র ধারণাকে শয়তানি ছাড়া কিছু বলা যায় না আসলে। স্পষ্টতই, রাষ্ট্র খালি নিজের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে। মানে সে যা খুশি করবে, মানুষ কিছু বলতে পারবে না তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই সে বলবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হচ্ছে। 

রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী প্রচারণার ফলে সম্ভবত আমাদের জাতীয় জীবনে শোক প্রকাশের কেন্দ্রীয়করণ ঘটে গেছে। আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের খোঁজখবর রাখি, আমাদের যাবতীয় শোক ও উদযাপনও ওই বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশে দু’জন শ্রমিক পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেলেও আমাদের গায়ে  লাগে না, কিন্তু ঢাকা শহরের কোথায় কোন পুলিশ অফিসার কোন আর্মি অফিসারের গায়ে হাত তুলেছে, সেইটা নিয়ে আমরা রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করি৷ কলকাতায় একজন নারী ধর্ষিত হলে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদ হয়, কিন্তু পাহাড়ে গণহত্যা ঘটে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে তেমন কোনো শোরগোল দেখা যায় না। আসলে পাহাড়িদের জন্য আমাদের দায়ও নেই, দরদও নেই। আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলি, উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে কথা বলি, কাশ্মীর কিংবা মণিপুর নিয়ে কথা বলি, কিন্তু নিজের দেশের পাহাড়িদের ব্যাপারে হয় আমরা নীরব, নয়তো সরব তাদের বিরুদ্ধে।  পাহাড়িদের জীবনকে জীবন মনে করি না আমরা। পাহাড়িদের অধিকারকে মানবাধিকার মনে করি না। রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, কর্পোরেট সেক্টর- কোথাও পাহাড়িদের মানবাধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না। যে অত্যাচার-নিপীড়নের স্টিমরোলার চলছে তাদের উপর, তা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না মূলধারার গণমাধ্যমে, কিন্তু পাহাড়িদের ভুলগুলো ঠিকই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়।  ফলে দমন, দমন, এবং কেবলই দমন ছাড়া পাহাড়ের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে আর কোনো সমাধান ধরা পড়ে না। আমরা আমাদের ভালোর কথা চিন্তা করে এক ধরনের শান্তি, এক ধরনের উন্নয়ন, এক ধরনের ট্যুরিজম চাপিয়ে দিয়েছি তাদের উপর। অথচ এতে তাদের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাষ্ট্রের বায়ো-পলিটিক্যাল গেইমে সায় দিতে দিতে আমরা ভুলে গেছি যে, যতক্ষণ না আমরা সংখ্যালঘুদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি না দিচ্ছি, যতক্ষণ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হচ্ছে, অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে যেটা শান্তি, সংখ্যালঘুর কাছে সেটা নিপীড়নের বন্দোবস্ত ছাড়া কিছু নয়; সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে যেটা উন্নয়ন, সংখ্যালঘুর কাছে সেটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া কিছু নয়। এই ব্যাপারগুলো আমরা স্বীকার করি বা না করি, আখেরে এগুলোর মুখোমুখি হওয়াই লাগবে আমাদের। এই যে, ধর্মীয় ডানপন্থার চেয়ে জাতীয়তাবাদী ডানপন্থা বাংলাদেশে আজ বেশি প্রকট, এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো লক্ষণ না। 

রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে শোক খুবই শক্তিশালী। এই ভাষাকে যদি আমরা সীমায়িত করে ফেলি, যদি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মানসিকতার কারণে আমরা কোদালকে কোদাল বলতে ভয় পাই, নিপীড়নকে নিপীড়ন বলতে দ্বিধা করি, তো তাতে করে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে শোক ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্য একটাই, রাষ্ট্রের খড়গ স্বয়ং আমাদের উপর নেমে আসার আগ পর্যন্ত আমরা হয়তো সেটা টের পাবো না৷ যেমন, এখন পাচ্ছি না।  জুলাইয়ের আন্দোলনের একটা বড়ো স্লোগান ছিলো যে, এটা ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলন। আন্দোলন সফল হয়েছে, কিন্তু ‘বৈষম্যে’র বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু করার ব্যাপারটা এবারও দেখা যায়নি৷ একাত্তরের মতোই আরো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। এর প্রধান কারণ হয়তো আমরা এখনো কিছু কিছু বৈষম্য চালু রাখার পক্ষে। আওয়ামী লীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও পলিটিকাল ক্যাটেগরি হিসেবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এখনো আমরা দাঁড়াতে পারিনি। আওয়ামী ফ্যাসিজমকে তাড়ালেও দেশে বিভিন্ন চেহারায় ফ্যাসিজম এখনো তুমুলভাবেই জারি আছে। নতুন চেহারা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসছে অনেক ক্ষেত্রে। শুনতে খারাপ লাগলে এগুলো সত্য৷ মানুষের মধ্যে যদি আত্ম-সমালোচনার আকাঙ্খা না থাকে বা নতুন করে না জন্মায়, তো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আদৌ তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যদি পরিবর্তনের পক্ষে না থাকে, তো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে নেওয়া পরিবর্তনের উদ্যোগ যতো ইতিবাচকই হোক, মানুষ তাকে চাপিয়ে দেওয়া স্বৈরাচার হিসেবেই দেখবে। সুতরাং, প্রতিষ্ঠান কোনো মহৌষধ না৷ সরকার কোনো জাদুকর না। কোনো জাদুর কাঠি দিয়ে দেশকে রাতারাতি ফ্যাসিবাদমুক্ত করাও সম্ভব না। জাতিগত বৈষম্যের ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনীতি-সচেতন জনগণ যদি সক্রিয় না হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী অবস্থান থেকে সরে না আসে, তো সেটা আমাদেরকে আরো বৃহত্তর বিপদের দিকে নিয়ে যাবে। সুতরাং যারা সবকিছু জেনেও চুপ থাকছেন, তাদের বিবেক আরো সক্রিয় হোক, এই কামনা করি। আর যারা বোঝেই না, বা বুঝতে চায়ও না, শুনতে যতো খারাপই লাগুক, তারা হয়তো কোনো না কোনো ফ্যাসিবাদেরই পক্ষে।

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।