‘শোকের অযোগ্য’ জীবন ও সার্বভৌমত্বের বিকার

WhatsApp Image 2025-03-13 at 18.32.36
অরিত্র আহমেদ
লেখক
বাঙলাদেশের পাহাড়িদের জীবন আসলে বাটলার-কথিত শোকের অযোগ্য, খরচযোগ্য জীবন। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

বাংলাদেশে জাতিগত সংঘাত কিংবা সংখ্যালঘু নিয়ে কোনো আলাপ উঠলেই জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে-র Can a Muslim Be an Indian আর্টিকেলটা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ার পর যেসব মুসলমান পাকিস্তানে চলে না গিয়ে ভারতে থেকে গেছিল, সদ্য-স্বাধীন ভারতে নাগরিক হিসেবে সেই মুসলমানেরা যে অপরায়ন ও রাজনৈতিক হেনস্থার ভেতর দিয়ে গেছিল, সেটাই মূলত এই আর্টিকেলের বিষয়বস্তু। পাণ্ডে তাঁর আলোচনা শুরু করেছেন দু’টো প্রস্তাবনা দিয়ে। 

এক. জাতি মাত্রেরই একটা কেন্দ্র। মূলধারা থাকে। এই মূলধারার নাগরিকেরা জন্মসূত্রেই ওই জাতি ও জাতিরাষ্ট্রের সহজাত, স্বাভাবিক কিংবা প্রাকৃতিক নাগরিক হিসেবে পরিচিত হন। তাদেরকে আলাদা করে দেশপ্রেম কিংবা দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেখাতে হয় না তাদেরকে।      

দুই. জাতিগঠনের সাথে তাল মিলিয়ে অনিবার্যভাবেই গড়ে ওঠে এক বা একাধিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, যাদেরকে আমরা কখনো কখনো প্রান্তীয় নাগরিক বলেও সম্বোধন করে থাকি। মাইনরিটি ছাড়া কখনো কোনো জাতিরাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না, এমনকি জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোকে বলবৎ রাখার জন্য কালেভদ্রে মাইনরিটি তৈরীও করে নিতে হয়। রাষ্ট্রের মূলধারা এই মাইনরিটিকে প্রান্তে ঠেলে দেয় (গোষ্ঠীভেদে এই প্রান্তিকীকরণের মাত্রা কমবেশি হতে পারে) এবং প্রায়শই তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে থাকে। ফলে মাইনরিটির উপর একটা সার্বক্ষণিক চাপ থাকে রাষ্ট্রের প্রতি তার বিশ্বস্ততার প্রমাণ দেওয়ার। পাণ্ডে দেখিয়েছেন, দেশভগের পর সেক্যুলার ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ভারত রাষ্ট্রে মুসলমানরা হয়ে উঠেছিলেন ভারতের ‘সন্দেহজনক’ নাগরিক। মুসলমানদের চেয়েও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী তো অবশ্যই ছিলো। কিন্তু যেহেতু বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মূলধারা গড়ে উঠেছিলো হিন্দুদের হাতেই, সেহেতু দেশভাগোত্তর পরিস্থিতিতে ভারতের মুসলমানরা যে তীব্র সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ অনুভব করেছিলেন, সেটা অন্য কোনো গোষ্ঠীকে অনুভব করতে হয়নি।  

গত সেপ্টেম্বর মাসে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষজনের প্রতিক্রিয়া দেখতে দেখতে মাথায় একইরকম একটা একটা প্রশ্ন ঘুরছিলো: ‘Can a Pahari Be a Bangladeshi?
মাত্র দেড় মাস আগে হাসিনা পালিয়ে গেছে, হাসিনার ফ্যাসিস্ট রেজিম অবসানের রেশ তখনো কাটেনি। কিন্তু বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের পুরোটা সময় জুড়ে ফেসবুকে বাঙালি নেটিজেনদের উল্লাস ও উদযাপন দেখে হঠাৎ মনে হচ্ছিলো আমরা সম্ভবত উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বর্ণযুগে বাস করছি। অথচ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও প্রচারক আওয়ামী লীগ তখন মাঠে নেই, বরং ছত্রিশে জুলাইয়ের পর থেকে ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি, বাঙালি’ স্লোগান শোনা যাচ্ছে চারিদিকে। মনে হচ্ছিলো, কাগজে-কলমে যাই লেখা থাক, পাহাড়ের আদিবাসীদের প্রশ্নে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ‘তুই বাঙালি হইয়া যা’-র সঙ্গে তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ‘তুই বাংলাদেশি হইয়া যা’-র আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। কারণ বাঙালি নেটিজেনরা তখন একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেছে: পাহাড়িরা বাংলাদেশ চায় না (অর্থাৎ, পাহাড়িরা বাংলাদেশি হতে চায় না); তারা আলাদা দেশ গঠন করতে চায়; অতএব বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এখন যেকোনো মূল্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী পাহাড়িদের দমন করতে হবে। ‘পাহাড়ি’ মানেই তখন বাঙলাদেশের শত্রু। আমরা হলাম ‘আমরা’, আর পাহাড়িরা হলো ‘ওরা’। এমন একটা পরিস্থিতিতে, নাগরিক হিসেবে একজন পাহাড়িকে সন্দেহ করার জন্য কারো কোনো প্রমাণ লাগে না। কিন্তু ভালো বলার জন্য প্রমাণের দরকার হয়। ভারতের মুসলমানদের মতোই বাঙলাদেশের একজন আদিবাসীকে সবসময় প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় যে তিনি বাঙলাদেশের একজন ‘বিশ্বস্ত নাগরিক ’।      

কাছাকাছি সময়েই আরো কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিলো বা ঘটছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক যুবককে পিটিয়ে খুন করেছিলো কিছু ছাত্র। ঘটনাটা হৃদয়বিদারক। ফলে সারা বাঙলাদেশ বেশ কয়েক দিন ধরে তোফাজ্জলের জন্য অশ্রুপাত করেছে। ওদিকে জুলাই আন্দোলনের আহতরা তখনো ১/২ জন করে প্রায় প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে। শহীদের তালিকা বড়ো হচ্ছে। মানুষ কাঁদছে। একেকজন শহীদের মৃত্যু তখন একেকটা জাতীয় ঘটনা। আমরা আমাদের শহীদদের জন্য শোক করবো- এটা স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়া উচিত। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কিছুদিন পর আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে একজন শ্রমিক মারা যাওয়ার পর সেইটা নিয়ে দেখা গেলো তেমন কোনো প্রতিবাদ হলো না, দেশব্যাপী শোকপ্রকাশও দেখা গেলো না। আবার বাঙলাদেশের আরেক প্রান্তে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ছড়িয়ে পড়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় চার জন পাহাড়ি মারা গেলো। পাহাড়ে আগুন জ্বললো টানা কয়েকদিন। কিন্তু এই ঘটনায় সারা দেশের মানুষ যে প্রতিক্রিয়া দেখালো, তাকে মোটা দাগে উদযাপন ছাড়া কিছু বলা যায় না। এটা বাঙলাদেশে নতুন কোনো ঘটনা না। নেহাত রানা প্লাজা টাইপের কিছু না ঘটলে শ্রমিকদের জীবন-মরণ নিয়ে আমরা অতো ঘামাই না কখনোই। আর স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে পাহাড়ে সেনাবাহিনী বা বাঙালি সেটেলারদের হাতে কোনো পাহাড়ি নিহত (নিহতই মাত্র, শহীদ নয় কিছুতেই) বা নির্যাতিত হলে সেইটা নিয়ে পাবলিক স্ফিয়ারে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য শোনা যায় না। হয় নীরবতা, নয়তো উদযাপন, নয়তো নীরব উদযাপন- পাহাড়িদের উপর নিপীড়নের বিপরীতে এই হলো আমাদের মোটামুটি প্রতিক্রিয়া। ঢাকা শহরে বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন মানুষ হত্যার শিকার সারা জাতির চোখ ছলোছলো হয়ে ওঠে। ভারতে কোনো নারী ডাক্তার ধর্ষিত হলে সেইটার প্রতিবাদ বাংলাদেশেও হয়। কিন্তু সেনাবাহিনী যখন গুলি করে পাহাড়ি মারে, তখন সেইটা নিয়ে শোকসভা বসে না ফেসবুকে। পাহাড়ি মেয়েরা ধর্ষিত হলে তার জন্য ‘মেয়েরা রাত দখল করো’ প্রোগ্রাম হয় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য প্রোগ্রাম হওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় পাহাড়ি মেয়েদের ধর্ষণের খবর আসে কয়টা? 

এই যে, পাহাড়িদের উপর চলমান গুম-খুন-ধর্ষণ নিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কোনো মাথাব্যাথা নেই, কোনো শোক নেই, হাহাকার নেই, এইটা কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা না। এইখানে রাজনীতি আছে। একই সাথে খুব স্থুল, আবার খুব সূক্ষ্ম রাজনীতি। বলা যায়, শোক-প্রকাশের রাজনীতি। শোক তো মানুষের সহজাত একটা ব্যাপার৷ ব্যক্তি হিসেবে আমি-আপনি সবাই-ই তো শোক প্রকাশ করি। আমি আমার আপনজনের মৃত্যুতে শোকে কাতর হই, আবার আপনি হয়তো কাতর হচ্ছেন আপনার কোনো বন্ধুর চলে যাওয়ায়। এই শোক মানবিক ও নিতান্তই ব্যক্তিগত। কিন্তু এই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা কাদের জীবন-মৃত্যু নিয়ে ভাবান্বিত হই? কাদের বেঁচে থাকা ও না থাকায়, ভালো থাকা ও না থাকায় আমাদের যায় আসে? কাদের মৃত্যুতে আমরা ব্যথিত হই, শোকে কাতর হই? ভারতের কোনো নারী ডাক্তার ধর্ষিত হলে আমরা আওয়াজ তুলি, কিন্তু পাহাড়ি নারীদের উপর চলমান যৌন নিপীড়ন আমাদের গায়ে লাগে না কেনো? পাহাড়িদের জীবন আর সমতলের বাঙালিদের জীবন কি সমান মর্যাদার অধিকারী? যে অর্থে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের ‘জীবন’ আছে, সেই অর্থে কি পাহাড়িদের আদৌ কোনো ‘জীবন’ আছে? 

‘শোকের অযোগ্য জীবন’ কথাটা ব্যবহার করেছেন জুডিথ বাটলার। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আছে, যাদের জন্য শোক করার কেউ নেই। তাদের জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেউ তেমন কোনো প্রতিবাদ করে না। বাংলাদেশের পাহাড়িদের জীবন কী ‘শোকের অযোগ্য’। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

‘Can one lead a good life in a bad life?’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় জুডিথ বাটলার ‘ungrievable lives’ নামে একটা টার্ম ব্যবহার করেছিলেন। বাংলায় সম্ভবত দাঁড়ায় ‘শোকের অযোগ্য জীবন’। পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আছে, যাদের জন্য শোক করার কেউ নেই। তাদের জীবনের ভালো-মন্দ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, তাদের সাথে ঘটে যাওয়া অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কেউ তেমন কোনো প্রতিবাদ করে না। কেনো করে না? বাটলার বলছেন, এর জন্য দায়ী হচ্ছে রাষ্ট্র কিংবা আমাদের চারপাশে জারি থাকা ক্ষমতা-কাঠামোর এক বিশেষ ধরনের বায়োপলিটিক্স। এই ক্ষমতাকাঠামোই তার নিজস্ব সুরক্ষার খাতিরে আমাদের জীবনের মূল্য নির্ধারণ করে। একই ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক পরিমণ্ডলে সত্ত্বেও আমাদের কারো কারো জীবন হয়ে ওঠে খুবই মূল্যবান ও শোকের যোগ্য, আবার কারো কারো জীবন হয়ে ওঠে নিতান্তই মূল্যহীন ও শোকের অযোগ্য। রাজনীতির অদলবদল ও পটপরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে কারো কারো জীবনের মূল্যে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটতে থাকে নিরন্তর। ফলে রাষ্ট্র এবং চারপাশের সামাজিক-রাজনৈতিক কখন কেন কার জীবনকে শোকের যোগ্য বা অযোগ্য করে তুলছে, সেই বায়োপলিটিক্স বুঝতে না পারলে কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীর উপর চলমান বৈষম্য ও নিপীড়নকে যথার্থভাবে বোঝা সম্ভব নয়। বলাই বাহুল্য, রাষ্ট্র এই বায়োপলিটিক্সের আশ্রয় নেয় নিজের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে নয়। প্রোপাগান্ডা দিয়ে হোক কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভায়োলেন্স দিয়ে হোক, যে সমস্ত ব্যক্তি বা কমিউনিটি বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর পক্ষে বাঁধা কিংবা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র তাদেরকে যেকোনো মূল্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে এমনভাবে হাজির করে, যাতে মনে হয় ওই বিশেষ ব্যক্তি বা কমিউনিটির ভালোমন্দের খোঁজ রাখার কোনো দরকার নেই, বা বৃহত্তর জনস্বার্থে ওই কমিউনিটিকে নিপীড়নের উপর রাখতে হবে, এমনকি দরকার হলে কায়দা করে উপড়ে ফেলতে হবে। আর যাদেরকে রাষ্ট্র বাঁচাতে চায়, সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করা হয়। মানুষ যেন তাদের ভাবমূর্তির প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত থাকে, সেটা খুব সূক্ষ্মভাবে দেখভাল করা হয়। 

বাংলাদেশের পাহাড়িদের জীবন আসলে বাটলার-কথিত শোকের অযোগ্য, খরচযোগ্য জীবন। এর কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী মূলধারা থেকে তারা সবচেয়ে বেশি বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতা কিভাবে তৈরী হয়েছে, সেই ইতিহাস অনেক দীর্ঘ এবং আপাতত অপ্রাসঙ্গিক। যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হচ্ছে, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা এই বিচ্ছিন্নতা কমাতে পারিনি বা কমাতে চাইনি। প্রত্যেকটা দেশেই এমন কিছু ঐতিহাসিক মুহূর্ত আসে, যখন প্রচলিত সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোকে ঢেলে সাজানোর কাজটা শুরু করা যায়, কিংবা নতুন রাজনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করা যায়। আমরা আমাদের ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। একাত্তর আমাদেরকে একটা বড়ো সুযোগ করে দিয়েছিলো, কিন্তু অনতিপরেই দেখা গেলো সংকীর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ততোধিক সংকীর্ণ একটা জাতিরাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে বাংলাদেশে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের বিষয়টা আমলে না নিয়ে পাহাড়িদেরকে বলা হলো বাঙালি হয়ে যেতে, যেনো বিচ্ছিন্নতা দূর করার দায়টা কেবল তাদেরই। এর কয়েক বছর পরে জিয়াউর রহমান আসলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে। ‘বাংলাদেশি’ শব্দটা দেখে অনেকে ধারণা করেছিলেন, এতে বোধ হয় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের ঝুঁকিগুলো আর থাকলো না। কিন্তু জিয়াউর রহমানই উন্নয়নের নাম করে পাহাড়ে বাঙালি সেটেলমেন্ট শুরু করলেন (শুধু পাহাড়ি না, স্বয়ং পাহাড়কেই বাঙালি করে তোলার চেষ্টা), যাতে বিচ্ছিন্নতা তো কমলোই না, বরং ওই সেটেলমেন্ট থেকেই পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত আরো তীব্রতা ও সহিংসতা লাভ করলো। এরশাদ এসেও এই সেটেলমেন্ট এবং তথাকথিত ‘উন্নয়নের ধারা’ অব্যাহত রেখে গেছেন। যদি ধরেও নিই যে, এই উন্নয়নের পেছনে কোনো গোপন অভিপ্রায় নেই, এই উন্নয়ন নিতান্তই সদিচ্ছা-প্রণোদিত, তবু প্রশ্ন ওঠে, এই উন্নয়ন থেকে পাহাড়িরা কতোটুকু লাভবান হয়েছে বা হচ্ছে? মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক চাহিদা, আজ শতকরা কতোজন পাহাড়ি সেগুলো পূরণ করতে পারে? বেশির ভাগ মানুষ তো এখনো সেখানে ঠিকমতো খেতে-পরতেই পারে না। তাহলে লাভটা হলো কাদের?

উন্নয়নের নামে এই চালিয়াতি বাংলাদেশের অনেক জায়গায়ই হচ্ছে, কিন্তু প্রায় পাঁচ দশক ধরে সেনাবাহিনীর হাতে যে নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হয়ে চলেছে পাহাড়িরা, তার সমতুল্য অভিজ্ঞতা স্বাধীন বাংলাদেশে অন্য কোনো জনপদের হয়নি। পাহাড়িদের মৌলিক সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে সামরিক উপায়ে দমন করার ব্যাপারটা শুরু হয়েছিলো জিয়ার আমলে। পাহাড়ে বাঙালি সেটেলমেন্টও আদতে একটা সামরিক কৌশলই ছিলো। এরপর থেকে গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে পাহাড়ি এলাকায় রীতিমতো সেনাশাসন বলবৎ আছে। এই সেনাশাসনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সহিংসতা। গুম, খুন, ধর্ষণ, নির্বিচার গ্রেফতার ও হয়রানি- মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি মাইলস্টোনই সেনাবাহিনী স্পর্শ করে ফেলেছে। সময়ে সময়ে গণহত্যা চলেছে পাহাড়িদের উপর। পাহাড়ি মেয়েদের উপর যৌন নিপীড়ন এখনো প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এতো কিছুর পরও বাঙালি সুশীল সমাজ এসব নিয়ে কোনো আওয়াজ তোলে না, কারণ তারা বিশ্বাস করে, বা তাদেরকে বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, পাহাড়ি মাত্রই বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাদেরকে ‘মাইরের উপরে’ না রাখলে তারা স্বাধীন জুম্মল্যান্ড কায়েম করে ফেলবে।  

সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্যেই যেহেতু এতো কিছু, সেহেতু এ বিষয়ে কিছু কথা বলা আবশ্যক। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হবে বা বহিঃশত্রুর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে- এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু সার্বভৌমত্ব যদি নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে? বা মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে যদি সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি হিসেবে ঘোষণা করা হয়? রাষ্ট্র যদি কোনো জনপদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয় বা অনিচ্ছুক হয়, তো সেই জনপদকে সার্বভৌমত্বের সবক দেওয়ার কোনো অধিকার কি রাষ্ট্রের থাকে? এর উত্তর হচ্ছে, না, থাকে না। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য মানুষ নয়। 

এটা ঠিক যে, পাহাড়িদের ভেতরে কিছু উগ্র জাতীয়তাবাদী, সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্রিয়াশীল আছে, যারা হয়তো আসলেই স্বাধীন জুমল্যান্ড বা ওই ধরনের কোনো স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়। তীব্র সহিংস আচরণের ইতিহাস তাদেরও আছে। কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলোকে কি আপামর পাহাড়িদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়? এখানে মনে রাখতে হবে যে, পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। তাদের ভেতরেও মেজরিটি-মাইনরিটি আছে। পাহাড়িদের স্বায়ত্তশাসন স্বায়ত্তশাসন কিভাবে আদায় করতে হবে- এই প্রশ্নে স্বয়ং পাহাড়িদের মধ্যেই মতভেদের ষভাব নেই। সুতরাং কয়েকটা সশস্ত্র গোষ্ঠীর আচরণকে আপামর পাহাড়িদের আচরণ ধরে নিলে সেটা ভুল হয়ে যাবে। তাছাড়া সশস্ত্র পাহাড়িরা যদি শেষ পর্যন্ত পাহাড়ে কোনো স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র কায়েম করতে সক্ষম হয়েও থাকে, এরপরও পাহাড়ি এলাকায় চলমান বৈষম্যের একটা বড়ো অংশই দূর হবে না। আজ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা পাহাড়িদেরকে যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রান্তে ঠেলে দিয়েছে, ঠিক সেইভাবেই অপেক্ষাকৃত বড়ো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে ছোটো আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর নিগৃহীত ও নিপীড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাবে। সুতরাং আলাদা জাতিরাষ্ট্র কায়েম পাহাড়িদের জন্যও কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। এক সার্বভৌমত্বের বিকারের সমাধান আরেক সার্বভৌমত্ব দিয়ে করা সম্ভব নয়, যদি রাষ্ট্রকাঠামোর উগ্র জাতীয়তাবাদী মেজাজে কোনো টেকসই পরিবর্তন না আসে। 

বাস্তবতা হচ্ছে যে, বেশির ভাগ পাহাড়িই আদৌ কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র চায় না। কিন্তু নিজস্ব সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা মেনে জীবনধারণ করার ন্যায্য বাসনা আছে তাদের। বাংলাদেশে যে জাতিরাষ্ট্র আমরা কায়েম করেছি, সেটা যেহেতু চারিত্রিক ও সাংবিধানিকভাবেই সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী, সেহেতু পাহাড়িদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে এই রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিতে চায় না। পাহাড়িদেরকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নিলে যে রাষ্ট্রের ঘাড়ে যে দায়দায়িত্ব বর্তায়, রাষ্ট্র সেটা নিতে চায় না। সুতরাং সার্বভৌমত্বের মিথ তৈরী করে পাহাড়িদের ন্যায্য দাবিদাওয়াকে দমন করার দরকার হয় রাষ্ট্রের। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় পাহাড়ি এলাকায় এক সার্বক্ষণিক জরুরী অবস্থা (কল্পনা চাকমার ভাষায় ‘ধাও-পালাও’ অবস্থা) জারি করে রাখা হয় এ কারণেই। কিন্তু এই বন্দোবস্ত সংঘাত খালি বাড়ায়, কমায় না। পাহাড়িদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ না হলে এবং তাদেরকে সেনাবাহিনী দিয়ে লাগাতার শায়েস্তা করে গেলে তারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক পক্ষ হিসেবে কখনোই পাবকিক স্ফিয়ারে আসতে পারবে না- এইটা মনে করে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদীরা সাময়িক একটা সুখ পেতেই পারেন। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে, তাদের এই বন্দোবস্তই পাহাড়িদেরকে চরমপন্থা ও চরমপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে। শান্তির সম্ভাবনা যাও-বা থাকে, তাও দেখা যায় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পৃথিবীর যেকোনো শোষক রাষ্ট্রই সংঘাত জারি রাখার এই কৌশল অবলম্বন করে উত্তরোত্তর নিপীড়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য। জিজেক বলেছিলেন, Israel ‘Hamasizes’ the Palestinians to justify ethnic cleansing and present the expansion of Israel ‘from the river to the sea’ as an act of self-defence.” পাহাড়ের প্রশ্নে ইসরায়েলের সাথে বাংলাদেশের তফাত কী তাহলে? পাহাড়ি মাত্রই কুকিচিন, এই অজুহাত দিয়ে পাহাড়ে সেনাশাসন চালালে কুকিচিনের শক্তি বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ, একই সঙ্গে কোনো জনপদের রাজনীতি আর চরমপন্থা উভয়কেই একসাথে মুছে ফেলা যায় না। একটা মুছলে আরেকটার আবির্ভাব হয়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সেই আবির্ভাব প্রাদুর্ভাবে পরিণত হতে পারে।  

এরপরও পাহাড়িদের অধিকার নিয়ে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ততোটা সরব নয় কেনো? জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী মনোভাব এর একটা কারণ তো বটেই, কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়। পাহাড়িদের ব্যাপারে যথাযথ জ্ঞানের অভাব, বিশেষ করে সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে যথাযথ রাজনৈতিক বোঝাপড়ার অভাব বাঙলাদেশের জনগণের মধ্যে বেশ প্রকট। রাষ্ট্রের ধর্ম সার্বভৌমত্ব, এটা তো জানা কথা। কিন্তু পাহাড়িদের ব্যাপারে সমতলের বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া দেখলে যে কারো মনে হগে পারে, রাষ্ট্রের এই সার্বভৌমত্ব যেনো তাদেরও ধর্ম হয়ে উঠেছে, সার্বভৌমত্ব শব্দটাকেই তারা যেনো ঐশীজ্ঞান করছে। তাদের দাবিটা এমন যে, একবার সার্বভৌমত্বের দোহাই দিলেই রাষ্ট্রের সব কথা, সব কাজ পাই টু পাই মেনে নিতে হবে। অথচ এই অবসেশনের মধ্যেও বড়ো ঘাপলা আছে। যে সুরে ও যে ভাষায় আজ বাঙালিরা সার্বভৌমত্বের কথা বলে পাহাড়িদের উপর চলমান নিপীড়নকে উদযাপন করছে এবং একে ন্যায্য মনে করছে, সেই সুর ও সেই ভাষার সাথে উগ্র ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সুরের কোনো পার্থক্য আছে? সার্বভৌমত্বই যদি শেষ কথা হয়, তাহলে মণিপুর বা কাশ্মীরে ভারতীয় রাষ্ট্র যা করছে, তা কোন দিক দিয়ে অন্যায়? ভারতের উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা তো এইভাবেই কাশ্মীরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিপ্রেজেন্ট করে। ওরা সন্ত্রাসী, ওরা বিচ্ছিন্নতাবাদী, ওদেরকে মারো, ওদেরকে ধরো- এগুলো বলার জন্য ভারতে ‘উগ্র হিন্দু’ হওয়া লাগে না। ছিমছাম ‘জাতীয়তাবাদী’ হলেই হয়। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আর সার্বভৌমত্বের জিকির করলেই হয়। একাত্তরে পাকিস্তান রাষ্ট্র তাহলে কী অন্যায় করেছিলো বাংলাদেশের সঙ্গে? রাষ্ট্র যদি সার্বভৌমত্ব শব্দটাকে নিপীড়নের অস্ত্র বানিয়ে তোলে, যদি সার্বভৌমত্বের দোহাই দিয়েই লাখ লাখ মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়, তো সেই ‘সার্বভৌমত্বে’র ধারণাকে শয়তানি ছাড়া কিছু বলা যায় না আসলে। স্পষ্টতই, রাষ্ট্র খালি নিজের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে। মানে সে যা খুশি করবে, মানুষ কিছু বলতে পারবে না তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই সে বলবে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো হচ্ছে। 

রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী প্রচারণার ফলে সম্ভবত আমাদের জাতীয় জীবনে শোক প্রকাশের কেন্দ্রীয়করণ ঘটে গেছে। আমরা কিছু সুনির্দিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের খোঁজখবর রাখি, আমাদের যাবতীয় শোক ও উদযাপনও ওই বিষয়গুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশে দু’জন শ্রমিক পুলিশের গুলি খেয়ে মারা গেলেও আমাদের গায়ে  লাগে না, কিন্তু ঢাকা শহরের কোথায় কোন পুলিশ অফিসার কোন আর্মি অফিসারের গায়ে হাত তুলেছে, সেইটা নিয়ে আমরা রীতিমতো ব্যস্ত সময় পার করি৷ কলকাতায় একজন নারী ধর্ষিত হলে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে প্রতিবাদ হয়, কিন্তু পাহাড়ে গণহত্যা ঘটে গেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে তেমন কোনো শোরগোল দেখা যায় না। আসলে পাহাড়িদের জন্য আমাদের দায়ও নেই, দরদও নেই। আমরা ফিলিস্তিন নিয়ে কথা বলি, উইঘুর মুসলমানদের নিয়ে কথা বলি, কাশ্মীর কিংবা মণিপুর নিয়ে কথা বলি, কিন্তু নিজের দেশের পাহাড়িদের ব্যাপারে হয় আমরা নীরব, নয়তো সরব তাদের বিরুদ্ধে।  পাহাড়িদের জীবনকে জীবন মনে করি না আমরা। পাহাড়িদের অধিকারকে মানবাধিকার মনে করি না। রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, মিডিয়া, কর্পোরেট সেক্টর- কোথাও পাহাড়িদের মানবাধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য হয় না। যে অত্যাচার-নিপীড়নের স্টিমরোলার চলছে তাদের উপর, তা নিয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না মূলধারার গণমাধ্যমে, কিন্তু পাহাড়িদের ভুলগুলো ঠিকই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়।  ফলে দমন, দমন, এবং কেবলই দমন ছাড়া পাহাড়ের প্রশ্নে সংখ্যাগরিষ্ঠের চোখে আর কোনো সমাধান ধরা পড়ে না। আমরা আমাদের ভালোর কথা চিন্তা করে এক ধরনের শান্তি, এক ধরনের উন্নয়ন, এক ধরনের ট্যুরিজম চাপিয়ে দিয়েছি তাদের উপর। অথচ এতে তাদের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। রাষ্ট্রের বায়ো-পলিটিক্যাল গেইমে সায় দিতে দিতে আমরা ভুলে গেছি যে, যতক্ষণ না আমরা সংখ্যালঘুদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বীকৃতি না দিচ্ছি, যতক্ষণ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হচ্ছে, অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে যেটা শান্তি, সংখ্যালঘুর কাছে সেটা নিপীড়নের বন্দোবস্ত ছাড়া কিছু নয়; সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে যেটা উন্নয়ন, সংখ্যালঘুর কাছে সেটা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ছাড়া কিছু নয়। এই ব্যাপারগুলো আমরা স্বীকার করি বা না করি, আখেরে এগুলোর মুখোমুখি হওয়াই লাগবে আমাদের। এই যে, ধর্মীয় ডানপন্থার চেয়ে জাতীয়তাবাদী ডানপন্থা বাংলাদেশে আজ বেশি প্রকট, এটা বাংলাদেশের জন্য কোনো ভালো লক্ষণ না। 

রাজনৈতিক ভাষা হিসেবে শোক খুবই শক্তিশালী। এই ভাষাকে যদি আমরা সীমায়িত করে ফেলি, যদি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মানসিকতার কারণে আমরা কোদালকে কোদাল বলতে ভয় পাই, নিপীড়নকে নিপীড়ন বলতে দ্বিধা করি, তো তাতে করে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে শোক ধীরে ধীরে ভোঁতা হয়ে যাবে। দুর্ভাগ্য একটাই, রাষ্ট্রের খড়গ স্বয়ং আমাদের উপর নেমে আসার আগ পর্যন্ত আমরা হয়তো সেটা টের পাবো না৷ যেমন, এখন পাচ্ছি না।  জুলাইয়ের আন্দোলনের একটা বড়ো স্লোগান ছিলো যে, এটা ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলন। আন্দোলন সফল হয়েছে, কিন্তু ‘বৈষম্যে’র বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু করার ব্যাপারটা এবারও দেখা যায়নি৷ একাত্তরের মতোই আরো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের সদ্ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। এর প্রধান কারণ হয়তো আমরা এখনো কিছু কিছু বৈষম্য চালু রাখার পক্ষে। আওয়ামী লীগের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেও পলিটিকাল ক্যাটেগরি হিসেবে নিপীড়নের বিরুদ্ধে এখনো আমরা দাঁড়াতে পারিনি। আওয়ামী ফ্যাসিজমকে তাড়ালেও দেশে বিভিন্ন চেহারায় ফ্যাসিজম এখনো তুমুলভাবেই জারি আছে। নতুন চেহারা নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ এবং জাতিবাদী সাম্প্রদায়িকতা ফিরে আসছে অনেক ক্ষেত্রে। শুনতে খারাপ লাগলে এগুলো সত্য৷ মানুষের মধ্যে যদি আত্ম-সমালোচনার আকাঙ্খা না থাকে বা নতুন করে না জন্মায়, তো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে আদৌ তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা সন্দেহ। তার চেয়ে দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, মানুষ যদি পরিবর্তনের পক্ষে না থাকে, তো প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে নেওয়া পরিবর্তনের উদ্যোগ যতো ইতিবাচকই হোক, মানুষ তাকে চাপিয়ে দেওয়া স্বৈরাচার হিসেবেই দেখবে। সুতরাং, প্রতিষ্ঠান কোনো মহৌষধ না৷ সরকার কোনো জাদুকর না। কোনো জাদুর কাঠি দিয়ে দেশকে রাতারাতি ফ্যাসিবাদমুক্ত করাও সম্ভব না। জাতিগত বৈষম্যের ব্যাপারে বাংলাদেশের রাজনীতি-সচেতন জনগণ যদি সক্রিয় না হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী অবস্থান থেকে সরে না আসে, তো সেটা আমাদেরকে আরো বৃহত্তর বিপদের দিকে নিয়ে যাবে। সুতরাং যারা সবকিছু জেনেও চুপ থাকছেন, তাদের বিবেক আরো সক্রিয় হোক, এই কামনা করি। আর যারা বোঝেই না, বা বুঝতে চায়ও না, শুনতে যতো খারাপই লাগুক, তারা হয়তো কোনো না কোনো ফ্যাসিবাদেরই পক্ষে।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।