গোপনীয়তা কেনা যায়। যার ব্যক্তিগত সম্পদ (যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট) যত বেশি তার গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগও বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের এই সুযোগ কম। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

উদারমনাদের মতে সরকারী নজরদারী একটি ভয়াবহ বিষয়। এ যেন সাইক্লপসের দৈত্যাকার চোখের মতো সর্বস্তরের মানুষের ওপর তার কড়া নজর বজায় রেখেছে। অন্যদিকে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এর বিপরীতে কথা বলছে। চাইছে ব্যক্তির নিজস্ব পরিসর। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা একজন ব্যক্তিকে ‘নিজ’ হয়ে ওঠার অধিকার দেয়। এডওয়ার্ড স্নেডেন এই প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে বলেছিলেন ‘আপনি কি, পৃথিবীতে এটাকে নিজের মতো ভাষায় বলার অধিকারই হচ্ছে প্রাইভেসি’। মানে হচ্ছে, পৃথিবী ততটুকুই জানতে পারবে যতটুকু আপনি জানাতে ইচ্ছুক। স্নোডেনের মতে প্রাইভেসির অধিকার থাকলে একজন মানুষ তার সমস্ত  অধিকারই আদায় করে নিতে পারে। প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব জায়গা প্রয়োজন, যেখানে সরকার নাক গলাতে আসবে না। এই আলাপের দরকার আছে। এসব কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই পরিবর্তন  আসে। কিন্তু গোপনীয়তার এই সুবিধা কি সবাই সমানভাবে পায়? একজন ধনী সাদা ব্যক্তি তার প্রাইভেসি যেভাবে পাচ্ছে, দরিদ্র সাদা ব্যক্তিও কি সেভাবে পাচ্ছে? বাদামী, কালো তাদেরই বা কী অবস্থা?  প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার নীতি সেভাবে কখনই কার্যকর হয় নি। ব্যত্যয় দেখা গেছে জাতি আর বর্ণ ভেদেও।    

পুলিশি কেসে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের সীমা কতটুকু? এ ব্যাপারে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্পষ্ট ধারণা দেয়া আছে। সেখানে বলে দেয়া হয়েছে একজন ব্যক্তি কোন জায়গায় কেমন গোপনীয়তা আশা করতে পারে। আপনি নিজের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি গোপনীয়তা আশা করতে পারেন। আপনার গাড়িতে আরেকটু কম, আর জনসমক্ষে এই আশাটা একপ্রকার বাতুলতাই। মানে কী দাঁড়াচ্ছে? মানে হলো গোপনীয়তা কেনা যায়। যার ব্যক্তিগত সম্পদ (যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট) যত বেশি তার গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগও বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের এই সুযোগ কম। আর ঘরহীন মানুষ, যারা রাস্তায় থাকে, তারা তো এই ব্যাপারটা আশাই করতে পারে না। সুতরাং উদারপন্থীরা যেমন সবার জন্যে সমান প্রাইভেসির কথা বলে, সেটা আসলে বাস্তবানুগ কিছু না।   


একজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রাইভেসি বিষয়ক উদ্বিগ্নতা কেমন? সে ভয়ে থাকে তার ই-মেইল হ্যাক হলো কি না, অথবা সেক্সটিং ফাঁস হলো কি না! তবে এগুলির কোনোটাই আসলে জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না। গরিবদের জন্য বিষয়টা এমন না। তাদের হুট করে রাস্তায় ধরে তল্লাশি করতে চাইলে প্রাইভেসির কথা বলে সে বাধা দিতে পারবে না। বাধা দিতে গেলে এমন কী গুলিতে মৃত্যুও হতে পারে তার। তাদের ই-মেইল বা সেক্সটিং ফাঁস হবার চেয়েও বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়।  পুলিশের কাছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সব তথ্য থাকে। তা দেখে যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার বা তদন্তের উদ্দেশে চলে আসতে পারে পুলিশ বা সমাজকর্মী। দেখা গেল যে তারা যেভাবে ছেলে-মেয়ে মানুষ করছে তা বিধিসম্মত না। ফলে, শাস্তি পেতে হয়। বহু অভিবাসীর জীবন এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, ভেঙে গেছে তাদের পরিবার আর সংসার।   


গত কয়েক বছরে এই সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণা করা হয়েছে;  বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা বলছেন, সবার জন্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি একইরকম ভাবলে আসলে কাজের কাজ তেমন কিছুই হবে না। ব্যক্তি আর পরিস্থিতিভেদে এ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তিত হওয়া উচিত। উদারপন্থী গোপনীয়তা সমর্থকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সঠিক নীতিমালা না থাকলে সামনে আসতে যাচ্ছে দুঃস্বপ্নের কাল। পুলিশ এবং এনএসএ আমাদের সেলফোনের ডেটার অবাধ অধিকার পেয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু নতুন যুগের  গবেষকরা বলছেন, এই অবস্থা ইতোমধ্যেই এসে গেছে। আমেরিকার অনেক মানুষেরই গোপনীয়তার অধিকার নেই। আর যারা এই সুবিধা পাচ্ছে, তারা অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ ধনী।      

দাসপ্রথার পঙ্কিল সময় থেকেই আমেরিকায় সরকারী নজরদারীর এই চক্র চলে আসছিল। সেই সময় ক্রীতদাসদের নজরে রাখার জন্যে তিনটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। তাদের জন্যে ছিল বিশেষ ‘পাস’। এটা ছাড়া তারা চলাচল করতে পারত না। কেউ পালিয়ে গেলে তার সন্ধানে ছাপা হতো পোস্টার। পলায়নকারী ক্রীতদাসদের ধরার জন্যে টহলকারী বিশেষ দলও ছিল। তারা দাসদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করত। ক্রীতদাসদের মালিকেরা এভাবেই তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দক্ষিণে আরো বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। 

দাসদের যেখানে রাখা হতো সেখানকার হিসেবের বইগুলি ছিল যেন একদম জলজ্ব্যান্ত কম্পিউটার ডেটাবেস! সেখানে আর্থিক বিবরণী লেখার পাশাপাশি ক্রীতদাসের দেহের বর্ণনা, চোখের রং, চুলের ধরণ— সবই লিপিবদ্ধ থাকত।  সেখানকার বাড়িঘরের নকশাও ছিল বিশেষরকম! ওভারসিয়ার যেন বারান্দা থেকে সকল ক্রীতদাসকে ভালোভাবে দেখতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা ছিল। তারা বারান্দায় বসে মাঠ, থাকার ঘর সবই স্পষ্ট দেখতে পেতেন। দাসরা থাকত এক ভয়ের রাজত্বে। বিদ্রোহ করার সাহস হয়ে উঠত না তাদের। তাদের একতা নষ্ট করতে সচেষ্ট ছিল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ ছিল পালানোর সমস্ত দুয়ার।     

উত্তরের শহরগুলিতে দাসেরা অসদাচরণ করলে কোর্টে নেয়ার বালাই ছিল না। কনস্টেবল, জেলার আর  পর্যবেক্ষকেরাই দায়িত্বটি নিয়ে নিতেন। তারা বিশেষভাবে নজর দিত খেটে খাওয়া নারীদের প্রতি। জেন ম্যানিয়ন তার  Liberty’s Prisoners: Carceral Culture in Early America বইয়ে লিখেছেন, ‘যেসব নারী অতি দরিদ্র, বেশি কথা বলে, যৌনতার ব্যাপারে স্বাধীন, মদ্যপ এবং স্বাধীনচেতা, তারাই হতো লক্ষ্যবস্তু’। পুরুষশাসিত সাদা সমাজের জন্যে হুমকি মনে হয়, এমন যে কাউকেই কর্তৃপক্ষ নজরদারীতে নিয়ে নিত। ম্যানিয়ন লিখেছেন, ‘গরীবদের একমাত্র দোষ ছিল গরীব হওয়া। যাদের ঘর নেই, কাজ নেই, তাদের জন্যেই যত আচরণগত নিষেধাজ্ঞা ছিল।’      

ভার্জিনিয়া ইউব্যাংক্সের বই Automating Inequality: How High-Tech Tools Profile, Police, and Punish the Poor–এ ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়টির সাথে ২১ শতকের বর্তমান অবস্থার সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন দাসপ্রথা বিলোপ, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার এবং নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে অনেক কাজ হলেও আমেরিকা গরীবদের জন্যে এখনও কারাগারতূল্য। সব পুলিশি নজরদারী শুধু যেন নিম্ন আয়ের মানুষ, কালো আর বাদামীদের জন্যেই প্রযোজ্য! তার মতে উনবিংশ শতকের ‘দরিদ্রশালা’ বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। তা এখন ফিরে এসেছে ডিজিটাল ‘দরিদ্রশালা’ রূপে! আজকের তথাকথিত কল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্রদের যোগ্যতা এবং তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবার যৌক্তিকতাকে বিশ্লেষণ করা হয় ডিজিটাল আতশ কাঁচ দিয়ে। বলা হয়েছিল এতে করে তাদের জন্যে ভালোই হবে, বৈষম্য কমবে, কিন্তু হয়েছে তার উল্টো! ইউব্যাংক্স তিনটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কীভাবে গরীবদের অধিকার নষ্ট করছে। ইন্ডিয়ানার স্বয়ংক্রিয় মেডিকেড সহায়তা পদ্ধতি, লস অ্যাঞ্জেলেসের গৃহহীনদের সহায়তার প্রক্রিয়া এবং পেনসিলভানিয়ায়  শিশুদের নির্যাতন বা অবহেলার ঝুঁকি নির্ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে।       

ইন্ডিয়ানার প্রোগ্রামটি বাদ দিলে বাকিগুলি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের সহায়তার জন্যেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আসলে কতটা সহায়তা পেয়েছিল তারা? বাস্তবে এই স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলো দরিদ্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার তোয়াক্কাই করে না। তাদের দুঃখ, মানসিক শক্তি, অনুভূতি, ভয় সবকিছু শ্রেণিবদ্ধ করে রাখা হয়। সাহায্যের জন্য আবেদন করার পর থেকেই তারা নজরদারির জালে আটকে যান। তাদের সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়, নানা প্রশ্ন করা হয়, সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে চাপ দেওয়া হয়, এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়। প্রতারণা ঠেকানো, সরকারের অর্থ বাঁচানো আর শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার নামে, সরকার এই দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন খোলা বইয়ের মতো পড়ে দেখতে চায়। তারা কী করছে, কী কিনছে, কীভাবে সন্তান পালন করছে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলে।    

অটোমেশন দিয়ে ন্যায়ের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয় না, বরং আরো নতুন সব জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াগুলির সিদ্ধান্ত দরিদ্রদের কষ্ট কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেয় যে দরিদ্ররা বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেটাই সঠিক! উদাহরণস্বরূপ, এলেগেনি অ্যালগরিদমের কথা বলা যায়। এই অ্যালগরিদমের মতে  সরকারী পরিষেবাগুলি শিশুদের জন্য বিপদের কারণ।  ইউব্যাংকস বলছেন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়  AFST (Allegheny Family Screening Tool) যেসব বিষয় বিবেচনা করে তার ২৫% ই দারিদ্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দরিদ্ররা তাদের শিশুদের  সাথে সাধারণভাবে যেমন  আচরণ করে থাকে সেগুলি খারাপ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। TANF, SSI, SNAP এই জাতীয় প্রোগ্রামগুলি সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা দরিদ্রদের অভিযুক্ত করে ফেলে, বিশেষ করে তারা যদি সরকারী পরিষেবাগুলি থেকে কোনো সুবিধা নিতে চায়, তাহলে তো কথাই নেই!   

লস এঞ্জেলেসের আশ্রয়হীন মানুষদের এক অদ্ভুত ডিলেমায় পড়তে হয়। বাসা পাওয়ার জন্য তাদের একটি  ‘দুর্দশা সূচক’  এর সার্ভে পূরণ করতে হয়। এই সার্ভেতে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয় যেমন সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর, পুরো নাম, জন্ম তারিখ, বয়স, জাতিগত তথ্য, সেনাবাহিনীর সদস্য কি না, অভিবাসন ও বাসস্থানের অবস্থা, এবং দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কোথায় থাকে, ইত্যাদি। এছাড়াও পারিবারিক সঙ্ঘাত,  যৌন নির্যাতন, আত্মহত্যার চেষ্টা, মাদক ব্যবহার, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেও উত্তর দিতে হয়। যদি কেউ এই সার্ভেতে ঝুঁকিপূর্ণ বা বেআইনী আচরণের কথা স্বীকার করে নেন তাহলে তারা একটা স্থায়ী বাসা পাবার জন্যে অগ্রাধিকার পান কিন্তু এতে পুলিশের নজরে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তারা যে তথ্য দেন তা কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই  LAPD-এর সাথে শেয়ার করা হয়।     

ইউব্যাংক্স দেখিয়েছেন এই ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল নজরদারী আর অটোমেশন পদ্ধতি ধনীদের থেকে দরিদ্রদের একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই দুই শ্রেণির মধ্যে একটা সংহতি এবং সহানুভূতির সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। কিন্তু তার বদলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছ থেকে দারিদ্রকে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দরিদ্রদের কথা ভেবে একটু মানবিক বা নৈতিক হবার বালাই থাকছে না।   

কম্পিউটার স্ক্রিনে বসে ০ কে ১ করে ফেলা যায় খুব সহজেই, কিন্তু তাতে করে যে একজন অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু তার প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা কে দেখবে! ইন্ডিয়ানার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে।  

এই ডিজিটাল ন্যায়বিচার পদ্ধতি মানুষের স্কোর ঠিক করতে পারে, কিন্তু আসলেই কার কতটা দরকার তা নিরূপন করার ক্ষমতা তার নেই। আইনের প্রফেসর গ্যারি ব্লাসি ইউব্যাংক্সকে বলেছিলেন ‘গৃহহীনের জন্যে ঘর তৈরি করা কাঠমিস্ত্রীর কাজ। এর জন্যে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার লাগবে না’। ইউব্যাংক্স লিখেছেন, ‘অটোমেশন আসলে দরিদ্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখাত উপায়,  এবং এর উদ্দেশ্য হলো  দারিদ্র্য দূর না করা’।  


দরিদ্রদের নিয়ে লেখা গল্পগুলির উপসংহারে সবসময় মোটামুটি দুটি বার্তা থাকে। একটি হলো, ‘দরিদ্রদের নিয়ে দুঃখিত হও’ আরেকটি হলো ‘দরিদ্রদের নিয়ে দুঃখিত হতে হবে না’। ইউব্যাংক্স তার বইয়ে এই একরৈখিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করেছেন। তিনি তাদের সাথে মিশেছেন, শুনেছেন তাদের গল্প। ইউব্যাংক্স দারিদ্র নিয়ে তৈরি মিথগুলি ভাঙতে চান। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত আমেরিকান দারিদ্রের যন্ত্রণা, কঠিন বাস্তবতা এই দিকগুলি সম্পর্কে জানেন এবং মনে করেন যে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণই এসবের জন্যে দায়ী। মধ্যবিত্তদের এভাবে চট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার সমালোচনা করেছেন তিনি। মধ্যবিত্তরা মনে করেন যে দারিদ্রের কারণ মূলত নৈতিক বোধের অভাব। এই ভাবনাটা তাদের বেশ ভালো বোধ করায়। তারা অক্লেশে দরিদ্রদের সন্তান মানুষ করার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। এভাবেই তারা দরিদ্রদের জীবনে সরকার কর্তৃক স্থায়ী নজরদারী এবং গোপনীয়তা হরণের প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যান।    

মূলধারার এই ভাবনার বিরুদ্ধে যে কজন বুদ্ধিজীবী উচ্চকন্ঠে সোচ্চার হয়েছিলেন ইউব্যাংক্স তাদের মধ্যে একজন।এ প্রসঙ্গে খিয়ারা ব্রিজেস এর নামও বলতেই হয়। বোস্টন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক তিনি। ২০১৬ সালে The Poverty of Privacy Rights বইতে তিনি দেখিয়েছেন কল্যাণ সুবিধা গ্রহণকারী নারীরা তাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কীভাবে  বঞ্চিত হন। এইসব সুবিধা পেতে হলে তাদেরকে নানারকম হস্তক্ষেপমূলক এবং সংবেদনশীল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এসবের জবাব দেয়াটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। শুধু তাই না তাদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। অনেকসময় তাদেরকে গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়। তাদের ঘরে বারবার ওয়ারেন্টিবিহীন তল্লাশি চালানো হচ্ছে আদালতের অনুমোদনেই! অথচ চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে ঘর হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র জায়গা। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিও মজুদ আছে তাদের। আদালত বলছে, তাদের ঘরে জোর করে তল্লাশি চালানো হয় না। তারা চাইলে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। কিন্তু আসলেই কি পারে? এখানে একটা ফাঁক আছে। হ্যাঁ, অস্বীকৃতি জানাতে পারে ঠিকই, কিন্তু এতে করে তারা যেসব কল্যাণমূলক সুযোগ সুবিধা পায়, সেগুলি রহিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কে খামোখা এই ঝুঁকি নিতে চাইবে! ফলে তাদের রাজী না হয়ে উপায় থাকে না। আইন বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্লোবোগেইন বলেছেন, “যারা ট্যাক্স জালিয়াতি করছে, তারা চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী পূর্ণ সুবিধাই পেয়ে থাকেন। অথচ ট্যাক্স জালিয়াতির কারণে রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। আর যারা কল্যাণমূলক সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে এক আধটু জালিয়াতি করছে, তাদের ক্ষেত্রে কিছুই নেই।” 

সরকার ঠিকই দায়মুক্তি দিচ্ছে এসবের। শিশুদের সুরক্ষা এবং জালিয়াতি থেকে রক্ষার জন্যে এসব দরকার বলেই তারা মনে করে। কিন্তু যে ব্যাপারটা করলে দরিদ্র শিশুরা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা পাবে সে কাজটাই তারা করছে না। দরিদ্রদের দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে না। আমেরিকার প্রতি পাঁচজন শিশুর একজনই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ধনী দেশগুলির ভালো থাকার সূচকে আমেরিকা আছে ২৬ নম্বর অবস্থানে। আমেরিকার কল্যাণ ব্যবস্থা খুবই কঠোর। তারা শিশুদের সুরক্ষা দেয়ার বদলে তাদের মায়েদের ভালো আচরণ শেখাতে এবং দারিদ্রের জন্যে নৈতিকতার অবক্ষয়কে দায়ী করতেই বেশি ব্যস্ত।  

কল্যাণ ব্যবস্থার কলঙ্কজনক দিকগুলো দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হবে মিন্স-টেস্টেড সুবিধা (যেখানে আয়ের ভিত্তিতে সুবিধা দেওয়া হয়) পুরোপুরি বন্ধ করা। এর বদলে,  আয়  এবং  শিশু ভাতার বৈশ্বিক মানদণ্ড চালু করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে আয় যেমনই হোক, সবাই টাকা পাবে। এর ফলে আর সরকারকে নিয়মিত তদারকি তথ্য সংগ্রহ করতে হবে না।  কালো মায়েদের এখন যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তাদের দারিদ্র, তাদের আচরণের জন্যে, সেটাও বন্ধ হবে। 

গোপনীয়তা আর নজরদারীর ক্ষেত্রে সম্পদশালী সাদা পুরুষেরা যে অবাধ সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে, সেটা বন্ধ হওয়া উচিত। অশ্বেতাঙ্গ এবং দরিদ্র মানুষেরও এই অধিকার আছে। কতভাবে যে তাদের গোপনীয়তার ওপর আঘাত আসছে তা তাদের জায়গায় না থাকলে বোঝাও সম্ভব না। ব্র্যান্ডিস এবং ওয়ারেন ১৮৯০ সালে বলেছিলেন, ‘একাকী থাকতে চাওয়ার অধিকার  সেইসব মানুষের জন্য তেমন কাজে আসে না, যারা অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অন্যের উপর নির্ভরশীল জীবন যাপন করতে বাধ্য’। আইনে লেখা আছে যে ‘ঘরই হলো মানুষের দুর্গ’। কিন্তু যার ঘর নেই, সে কী করবে?  

আমরা যারা গোপনীয়তাকে একটি মৌলিক অধিকার  এবং মানুষের সম্মান, স্বাধীনতা এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে জরুরী বলে মনে করি তাদের উচিত একটা নতুন নীতি নিয়ে আওয়াজ ওঠানো। ধন এবং ক্ষমতার বৈষম্যকে কমানোই হবে এই নীতির মূলকথা। করবে। কারণ, এই বৈষম্যই গোপনীয়তা উপভোগ করা সকলের জন্য অসাধ্য করে তুলেছে।   

(স্যাম এডলার-বেল এর বর্তমান লেখাটি Privacy for Whom? শিরোনামে  দ্য নিউ ইনকোয়াইয়ার ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।)    

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।