উদারমনাদের মতে সরকারী নজরদারী একটি ভয়াবহ বিষয়। এ যেন সাইক্লপসের দৈত্যাকার চোখের মতো সর্বস্তরের মানুষের ওপর তার কড়া নজর বজায় রেখেছে। অন্যদিকে প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এর বিপরীতে কথা বলছে। চাইছে ব্যক্তির নিজস্ব পরিসর। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা একজন ব্যক্তিকে ‘নিজ’ হয়ে ওঠার অধিকার দেয়। এডওয়ার্ড স্নেডেন এই প্রসঙ্গে ২০১৬ সালে বলেছিলেন ‘আপনি কি, পৃথিবীতে এটাকে নিজের মতো ভাষায় বলার অধিকারই হচ্ছে প্রাইভেসি’। মানে হচ্ছে, পৃথিবী ততটুকুই জানতে পারবে যতটুকু আপনি জানাতে ইচ্ছুক। স্নোডেনের মতে প্রাইভেসির অধিকার থাকলে একজন মানুষ তার সমস্ত অধিকারই আদায় করে নিতে পারে। প্রত্যেক মানুষেরই একটা নিজস্ব জায়গা প্রয়োজন, যেখানে সরকার নাক গলাতে আসবে না। এই আলাপের দরকার আছে। এসব কথাবার্তার মধ্যে দিয়েই পরিবর্তন আসে। কিন্তু গোপনীয়তার এই সুবিধা কি সবাই সমানভাবে পায়? একজন ধনী সাদা ব্যক্তি তার প্রাইভেসি যেভাবে পাচ্ছে, দরিদ্র সাদা ব্যক্তিও কি সেভাবে পাচ্ছে? বাদামী, কালো তাদেরই বা কী অবস্থা? প্রান্তিক মানুষের ক্ষেত্রে গোপনীয়তার নীতি সেভাবে কখনই কার্যকর হয় নি। ব্যত্যয় দেখা গেছে জাতি আর বর্ণ ভেদেও।
পুলিশি কেসে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের সীমা কতটুকু? এ ব্যাপারে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্পষ্ট ধারণা দেয়া আছে। সেখানে বলে দেয়া হয়েছে একজন ব্যক্তি কোন জায়গায় কেমন গোপনীয়তা আশা করতে পারে। আপনি নিজের বাড়িতে সবচেয়ে বেশি গোপনীয়তা আশা করতে পারেন। আপনার গাড়িতে আরেকটু কম, আর জনসমক্ষে এই আশাটা একপ্রকার বাতুলতাই। মানে কী দাঁড়াচ্ছে? মানে হলো গোপনীয়তা কেনা যায়। যার ব্যক্তিগত সম্পদ (যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট) যত বেশি তার গোপনীয়তা রক্ষার সুযোগও বেশি। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার মানুষের এই সুযোগ কম। আর ঘরহীন মানুষ, যারা রাস্তায় থাকে, তারা তো এই ব্যাপারটা আশাই করতে পারে না। সুতরাং উদারপন্থীরা যেমন সবার জন্যে সমান প্রাইভেসির কথা বলে, সেটা আসলে বাস্তবানুগ কিছু না।
একজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ মানুষের প্রাইভেসি বিষয়ক উদ্বিগ্নতা কেমন? সে ভয়ে থাকে তার ই-মেইল হ্যাক হলো কি না, অথবা সেক্সটিং ফাঁস হলো কি না! তবে এগুলির কোনোটাই আসলে জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় না। গরিবদের জন্য বিষয়টা এমন না। তাদের হুট করে রাস্তায় ধরে তল্লাশি করতে চাইলে প্রাইভেসির কথা বলে সে বাধা দিতে পারবে না। বাধা দিতে গেলে এমন কী গুলিতে মৃত্যুও হতে পারে তার। তাদের ই-মেইল বা সেক্সটিং ফাঁস হবার চেয়েও বড় ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হয়। পুলিশের কাছে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সব তথ্য থাকে। তা দেখে যেকোনো সময় তাকে গ্রেফতার বা তদন্তের উদ্দেশে চলে আসতে পারে পুলিশ বা সমাজকর্মী। দেখা গেল যে তারা যেভাবে ছেলে-মেয়ে মানুষ করছে তা বিধিসম্মত না। ফলে, শাস্তি পেতে হয়। বহু অভিবাসীর জীবন এভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে, ভেঙে গেছে তাদের পরিবার আর সংসার।
গত কয়েক বছরে এই সংক্রান্ত বেশ কিছু গবেষণা করা হয়েছে; বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটা বিষয়ে একমত হয়েছেন। তারা বলছেন, সবার জন্যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নীতি একইরকম ভাবলে আসলে কাজের কাজ তেমন কিছুই হবে না। ব্যক্তি আর পরিস্থিতিভেদে এ সংক্রান্ত নীতিমালা পরিবর্তিত হওয়া উচিত। উদারপন্থী গোপনীয়তা সমর্থকরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, সঠিক নীতিমালা না থাকলে সামনে আসতে যাচ্ছে দুঃস্বপ্নের কাল। পুলিশ এবং এনএসএ আমাদের সেলফোনের ডেটার অবাধ অধিকার পেয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু নতুন যুগের গবেষকরা বলছেন, এই অবস্থা ইতোমধ্যেই এসে গেছে। আমেরিকার অনেক মানুষেরই গোপনীয়তার অধিকার নেই। আর যারা এই সুবিধা পাচ্ছে, তারা অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ ধনী।
দাসপ্রথার পঙ্কিল সময় থেকেই আমেরিকায় সরকারী নজরদারীর এই চক্র চলে আসছিল। সেই সময় ক্রীতদাসদের নজরে রাখার জন্যে তিনটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। তাদের জন্যে ছিল বিশেষ ‘পাস’। এটা ছাড়া তারা চলাচল করতে পারত না। কেউ পালিয়ে গেলে তার সন্ধানে ছাপা হতো পোস্টার। পলায়নকারী ক্রীতদাসদের ধরার জন্যে টহলকারী বিশেষ দলও ছিল। তারা দাসদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করত। ক্রীতদাসদের মালিকেরা এভাবেই তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দক্ষিণে আরো বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
দাসদের যেখানে রাখা হতো সেখানকার হিসেবের বইগুলি ছিল যেন একদম জলজ্ব্যান্ত কম্পিউটার ডেটাবেস! সেখানে আর্থিক বিবরণী লেখার পাশাপাশি ক্রীতদাসের দেহের বর্ণনা, চোখের রং, চুলের ধরণ— সবই লিপিবদ্ধ থাকত। সেখানকার বাড়িঘরের নকশাও ছিল বিশেষরকম! ওভারসিয়ার যেন বারান্দা থেকে সকল ক্রীতদাসকে ভালোভাবে দেখতে পারেন সেই ব্যবস্থা করা ছিল। তারা বারান্দায় বসে মাঠ, থাকার ঘর সবই স্পষ্ট দেখতে পেতেন। দাসরা থাকত এক ভয়ের রাজত্বে। বিদ্রোহ করার সাহস হয়ে উঠত না তাদের। তাদের একতা নষ্ট করতে সচেষ্ট ছিল কর্তৃপক্ষ। বন্ধ ছিল পালানোর সমস্ত দুয়ার।
উত্তরের শহরগুলিতে দাসেরা অসদাচরণ করলে কোর্টে নেয়ার বালাই ছিল না। কনস্টেবল, জেলার আর পর্যবেক্ষকেরাই দায়িত্বটি নিয়ে নিতেন। তারা বিশেষভাবে নজর দিত খেটে খাওয়া নারীদের প্রতি। জেন ম্যানিয়ন তার Liberty’s Prisoners: Carceral Culture in Early America বইয়ে লিখেছেন, ‘যেসব নারী অতি দরিদ্র, বেশি কথা বলে, যৌনতার ব্যাপারে স্বাধীন, মদ্যপ এবং স্বাধীনচেতা, তারাই হতো লক্ষ্যবস্তু’। পুরুষশাসিত সাদা সমাজের জন্যে হুমকি মনে হয়, এমন যে কাউকেই কর্তৃপক্ষ নজরদারীতে নিয়ে নিত। ম্যানিয়ন লিখেছেন, ‘গরীবদের একমাত্র দোষ ছিল গরীব হওয়া। যাদের ঘর নেই, কাজ নেই, তাদের জন্যেই যত আচরণগত নিষেধাজ্ঞা ছিল।’
ভার্জিনিয়া ইউব্যাংক্সের বই Automating Inequality: How High-Tech Tools Profile, Police, and Punish the Poor–এ ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়টির সাথে ২১ শতকের বর্তমান অবস্থার সাদৃশ্য দেখানো হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন দাসপ্রথা বিলোপ, শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিক অধিকার এবং নারীবাদী আন্দোলন নিয়ে অনেক কাজ হলেও আমেরিকা গরীবদের জন্যে এখনও কারাগারতূল্য। সব পুলিশি নজরদারী শুধু যেন নিম্ন আয়ের মানুষ, কালো আর বাদামীদের জন্যেই প্রযোজ্য! তার মতে উনবিংশ শতকের ‘দরিদ্রশালা’ বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। তা এখন ফিরে এসেছে ডিজিটাল ‘দরিদ্রশালা’ রূপে! আজকের তথাকথিত কল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় দরিদ্রদের যোগ্যতা এবং তাদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাবার যৌক্তিকতাকে বিশ্লেষণ করা হয় ডিজিটাল আতশ কাঁচ দিয়ে। বলা হয়েছিল এতে করে তাদের জন্যে ভালোই হবে, বৈষম্য কমবে, কিন্তু হয়েছে তার উল্টো! ইউব্যাংক্স তিনটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছেন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ কীভাবে গরীবদের অধিকার নষ্ট করছে। ইন্ডিয়ানার স্বয়ংক্রিয় মেডিকেড সহায়তা পদ্ধতি, লস অ্যাঞ্জেলেসের গৃহহীনদের সহায়তার প্রক্রিয়া এবং পেনসিলভানিয়ায় শিশুদের নির্যাতন বা অবহেলার ঝুঁকি নির্ধারণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল অ্যালগরিদম ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে।
ইন্ডিয়ানার প্রোগ্রামটি বাদ দিলে বাকিগুলি মূলত নিম্ন আয়ের মানুষের সহায়তার জন্যেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আসলে কতটা সহায়তা পেয়েছিল তারা? বাস্তবে এই স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলো দরিদ্র মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার তোয়াক্কাই করে না। তাদের দুঃখ, মানসিক শক্তি, অনুভূতি, ভয় সবকিছু শ্রেণিবদ্ধ করে রাখা হয়। সাহায্যের জন্য আবেদন করার পর থেকেই তারা নজরদারির জালে আটকে যান। তাদের সব সময় সন্দেহের চোখে দেখা হয়, নানা প্রশ্ন করা হয়, সন্তান নেওয়া বা না নেওয়ার বিষয়ে চাপ দেওয়া হয়, এবং তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা লঙ্ঘন করা হয়। প্রতারণা ঠেকানো, সরকারের অর্থ বাঁচানো আর শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার নামে, সরকার এই দরিদ্র পরিবারগুলোর জীবন খোলা বইয়ের মতো পড়ে দেখতে চায়। তারা কী করছে, কী কিনছে, কীভাবে সন্তান পালন করছে সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
অটোমেশন দিয়ে ন্যায়ের প্রাপ্যতা নিশ্চিত হয় না, বরং আরো নতুন সব জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়াগুলির সিদ্ধান্ত দরিদ্রদের কষ্ট কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেয়। অনেকক্ষেত্রে তারা বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দেয় যে দরিদ্ররা বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেটাই সঠিক! উদাহরণস্বরূপ, এলেগেনি অ্যালগরিদমের কথা বলা যায়। এই অ্যালগরিদমের মতে সরকারী পরিষেবাগুলি শিশুদের জন্য বিপদের কারণ। ইউব্যাংকস বলছেন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় AFST (Allegheny Family Screening Tool) যেসব বিষয় বিবেচনা করে তার ২৫% ই দারিদ্রের সাথে সম্পর্কযুক্ত। দরিদ্ররা তাদের শিশুদের সাথে সাধারণভাবে যেমন আচরণ করে থাকে সেগুলি খারাপ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। TANF, SSI, SNAP এই জাতীয় প্রোগ্রামগুলি সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা দরিদ্রদের অভিযুক্ত করে ফেলে, বিশেষ করে তারা যদি সরকারী পরিষেবাগুলি থেকে কোনো সুবিধা নিতে চায়, তাহলে তো কথাই নেই!
লস এঞ্জেলেসের আশ্রয়হীন মানুষদের এক অদ্ভুত ডিলেমায় পড়তে হয়। বাসা পাওয়ার জন্য তাদের একটি ‘দুর্দশা সূচক’ এর সার্ভে পূরণ করতে হয়। এই সার্ভেতে অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয় যেমন সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর, পুরো নাম, জন্ম তারিখ, বয়স, জাতিগত তথ্য, সেনাবাহিনীর সদস্য কি না, অভিবাসন ও বাসস্থানের অবস্থা, এবং দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কোথায় থাকে, ইত্যাদি। এছাড়াও পারিবারিক সঙ্ঘাত, যৌন নির্যাতন, আত্মহত্যার চেষ্টা, মাদক ব্যবহার, এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কেও উত্তর দিতে হয়। যদি কেউ এই সার্ভেতে ঝুঁকিপূর্ণ বা বেআইনী আচরণের কথা স্বীকার করে নেন তাহলে তারা একটা স্থায়ী বাসা পাবার জন্যে অগ্রাধিকার পান কিন্তু এতে পুলিশের নজরে পড়ার সম্ভাবনা বাড়ে। তারা যে তথ্য দেন তা কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়াই LAPD-এর সাথে শেয়ার করা হয়।
ইউব্যাংক্স দেখিয়েছেন এই ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল নজরদারী আর অটোমেশন পদ্ধতি ধনীদের থেকে দরিদ্রদের একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এই দুই শ্রেণির মধ্যে একটা সংহতি এবং সহানুভূতির সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। কিন্তু তার বদলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছ থেকে দারিদ্রকে লুকিয়ে ফেলা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় দরিদ্রদের কথা ভেবে একটু মানবিক বা নৈতিক হবার বালাই থাকছে না।
কম্পিউটার স্ক্রিনে বসে ০ কে ১ করে ফেলা যায় খুব সহজেই, কিন্তু তাতে করে যে একজন অসহায় প্রতিবন্ধী শিশু তার প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা কে দেখবে! ইন্ডিয়ানার স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এমন অনেক ঘটনাই ঘটছে।
এই ডিজিটাল ন্যায়বিচার পদ্ধতি মানুষের স্কোর ঠিক করতে পারে, কিন্তু আসলেই কার কতটা দরকার তা নিরূপন করার ক্ষমতা তার নেই। আইনের প্রফেসর গ্যারি ব্লাসি ইউব্যাংক্সকে বলেছিলেন ‘গৃহহীনের জন্যে ঘর তৈরি করা কাঠমিস্ত্রীর কাজ। এর জন্যে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার লাগবে না’। ইউব্যাংক্স লিখেছেন, ‘অটোমেশন আসলে দরিদ্রদের নিয়ন্ত্রণে রাখাত উপায়, এবং এর উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য দূর না করা’।
দরিদ্রদের নিয়ে লেখা গল্পগুলির উপসংহারে সবসময় মোটামুটি দুটি বার্তা থাকে। একটি হলো, ‘দরিদ্রদের নিয়ে দুঃখিত হও’ আরেকটি হলো ‘দরিদ্রদের নিয়ে দুঃখিত হতে হবে না’। ইউব্যাংক্স তার বইয়ে এই একরৈখিক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দৃষ্টিকোণ উন্মোচন করেছেন। তিনি তাদের সাথে মিশেছেন, শুনেছেন তাদের গল্প। ইউব্যাংক্স দারিদ্র নিয়ে তৈরি মিথগুলি ভাঙতে চান। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত আমেরিকান দারিদ্রের যন্ত্রণা, কঠিন বাস্তবতা এই দিকগুলি সম্পর্কে জানেন এবং মনে করেন যে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণই এসবের জন্যে দায়ী। মধ্যবিত্তদের এভাবে চট করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়ার সমালোচনা করেছেন তিনি। মধ্যবিত্তরা মনে করেন যে দারিদ্রের কারণ মূলত নৈতিক বোধের অভাব। এই ভাবনাটা তাদের বেশ ভালো বোধ করায়। তারা অক্লেশে দরিদ্রদের সন্তান মানুষ করার প্রক্রিয়ার সমালোচনা করেন। এভাবেই তারা দরিদ্রদের জীবনে সরকার কর্তৃক স্থায়ী নজরদারী এবং গোপনীয়তা হরণের প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যান।
মূলধারার এই ভাবনার বিরুদ্ধে যে কজন বুদ্ধিজীবী উচ্চকন্ঠে সোচ্চার হয়েছিলেন ইউব্যাংক্স তাদের মধ্যে একজন।এ প্রসঙ্গে খিয়ারা ব্রিজেস এর নামও বলতেই হয়। বোস্টন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষক তিনি। ২০১৬ সালে The Poverty of Privacy Rights বইতে তিনি দেখিয়েছেন কল্যাণ সুবিধা গ্রহণকারী নারীরা তাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কীভাবে বঞ্চিত হন। এইসব সুবিধা পেতে হলে তাদেরকে নানারকম হস্তক্ষেপমূলক এবং সংবেদনশীল প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এসবের জবাব দেয়াটা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। শুধু তাই না তাদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে। অনেকসময় তাদেরকে গর্ভপাতে বাধ্য করা হয়। তাদের ঘরে বারবার ওয়ারেন্টিবিহীন তল্লাশি চালানো হচ্ছে আদালতের অনুমোদনেই! অথচ চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে ঘর হচ্ছে সবচেয়ে পবিত্র জায়গা। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিও মজুদ আছে তাদের। আদালত বলছে, তাদের ঘরে জোর করে তল্লাশি চালানো হয় না। তারা চাইলে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। কিন্তু আসলেই কি পারে? এখানে একটা ফাঁক আছে। হ্যাঁ, অস্বীকৃতি জানাতে পারে ঠিকই, কিন্তু এতে করে তারা যেসব কল্যাণমূলক সুযোগ সুবিধা পায়, সেগুলি রহিত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। কে খামোখা এই ঝুঁকি নিতে চাইবে! ফলে তাদের রাজী না হয়ে উপায় থাকে না। আইন বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্লোবোগেইন বলেছেন, “যারা ট্যাক্স জালিয়াতি করছে, তারা চতুর্থ সংশোধনী অনুযায়ী পূর্ণ সুবিধাই পেয়ে থাকেন। অথচ ট্যাক্স জালিয়াতির কারণে রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। আর যারা কল্যাণমূলক সুবিধা পাবার ক্ষেত্রে এক আধটু জালিয়াতি করছে, তাদের ক্ষেত্রে কিছুই নেই।”
সরকার ঠিকই দায়মুক্তি দিচ্ছে এসবের। শিশুদের সুরক্ষা এবং জালিয়াতি থেকে রক্ষার জন্যে এসব দরকার বলেই তারা মনে করে। কিন্তু যে ব্যাপারটা করলে দরিদ্র শিশুরা সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুবিধা পাবে সে কাজটাই তারা করছে না। দরিদ্রদের দারিদ্র থেকে মুক্তি দিতে কাজ করছে না। আমেরিকার প্রতি পাঁচজন শিশুর একজনই দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে। ধনী দেশগুলির ভালো থাকার সূচকে আমেরিকা আছে ২৬ নম্বর অবস্থানে। আমেরিকার কল্যাণ ব্যবস্থা খুবই কঠোর। তারা শিশুদের সুরক্ষা দেয়ার বদলে তাদের মায়েদের ভালো আচরণ শেখাতে এবং দারিদ্রের জন্যে নৈতিকতার অবক্ষয়কে দায়ী করতেই বেশি ব্যস্ত।
কল্যাণ ব্যবস্থার কলঙ্কজনক দিকগুলো দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায় হবে মিন্স-টেস্টেড সুবিধা (যেখানে আয়ের ভিত্তিতে সুবিধা দেওয়া হয়) পুরোপুরি বন্ধ করা। এর বদলে, আয় এবং শিশু ভাতার বৈশ্বিক মানদণ্ড চালু করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে আয় যেমনই হোক, সবাই টাকা পাবে। এর ফলে আর সরকারকে নিয়মিত তদারকি তথ্য সংগ্রহ করতে হবে না। কালো মায়েদের এখন যেভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে তাদের দারিদ্র, তাদের আচরণের জন্যে, সেটাও বন্ধ হবে।
গোপনীয়তা আর নজরদারীর ক্ষেত্রে সম্পদশালী সাদা পুরুষেরা যে অবাধ সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে, সেটা বন্ধ হওয়া উচিত। অশ্বেতাঙ্গ এবং দরিদ্র মানুষেরও এই অধিকার আছে। কতভাবে যে তাদের গোপনীয়তার ওপর আঘাত আসছে তা তাদের জায়গায় না থাকলে বোঝাও সম্ভব না। ব্র্যান্ডিস এবং ওয়ারেন ১৮৯০ সালে বলেছিলেন, ‘একাকী থাকতে চাওয়ার অধিকার সেইসব মানুষের জন্য তেমন কাজে আসে না, যারা অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অন্যের উপর নির্ভরশীল জীবন যাপন করতে বাধ্য’। আইনে লেখা আছে যে ‘ঘরই হলো মানুষের দুর্গ’। কিন্তু যার ঘর নেই, সে কী করবে?
আমরা যারা গোপনীয়তাকে একটি মৌলিক অধিকার এবং মানুষের সম্মান, স্বাধীনতা এবং নিজেকে নিয়ন্ত্রণের জন্যে জরুরী বলে মনে করি তাদের উচিত একটা নতুন নীতি নিয়ে আওয়াজ ওঠানো। ধন এবং ক্ষমতার বৈষম্যকে কমানোই হবে এই নীতির মূলকথা। করবে। কারণ, এই বৈষম্যই গোপনীয়তা উপভোগ করা সকলের জন্য অসাধ্য করে তুলেছে।
(স্যাম এডলার-বেল এর বর্তমান লেখাটি Privacy for Whom? শিরোনামে দ্য নিউ ইনকোয়াইয়ার ম্যাগাজিনে প্রথম প্রকাশিত হয়।)