ওই ঝাল ঝাল খাবার? ওটা তো রজিলদের খাদ্য!
মুঘল অন্দরমহলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সম্রাট আজ তশরিফ রেখেছেন, কী সৌভাগ্য! সাধারণত সম্রাট যখন এমন ঘোষণা দিয়ে আসেন, বুঝে নিতে হবে বিবির কাছে বসে ওনার পরিপাটি আহার সারার ইচ্ছে হয়েছে। এমন না যে অন্য কোথাও সম্রাটের খাওয়ার জায়গা নেই। একঘণ্টার নোটিশে দুইশ লোকের ব্যাপক ভোজনের ব্যবস্থা মুঘল হেঁশেলে সবসময় রাখা হতো। সেটা চেক, ডবল চেক হয়ে নানা নিরাপত্তায় সম্রাটের সামনে এসে পৌঁছুতো। কিন্তু অন্দরমহলের যখন ব্যাপার, এখানে বিবির হাতের রান্নার, বা বিবির পছন্দের খাবারের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে।
শুরু হয়েছে খাবার। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকানো মোমবাতির আলো তৈরী করেছে একটা রোমান্টিক আবহ। বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আগরবাতির সুবাস। শত পদের খাবার সামনে, সম্রাট কোনোটা চাখছেন, কোনোটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কোনোটা আবার রানির পীড়াপিড়িতে বেশ কয়েকগাল খাচ্ছেন। হুট করে একটা খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ঘি-মালাই-বাদামের সমারোহে যে মুঘল খানা-খাদ্য, এটার ঘ্রাণটা যেন ভিন্নরকম! কী এটা? সম্রাটের চোখে প্রশ্ন।
জাঁহাপনা, আপনার হিন্দুস্তানি দরবারীরা খুব আগ্রহ করে খায় এটা। ঝাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এটার মাঝে ওদের মতো মরিচ দেইনি। মরিচ ফেঁড়ে বীজগুলো ফেলে দিয়ে সবুজ শাঁসটা গাভীর দুধে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই শাঁস ফেলে দিয়ে দুধটুকু দিয়েছি মাংসে। খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।
সম্রাট আস্তে করে বললেন, ও… ওই গরীবদের খাদ্য?
তিনি তো আমাদের মতো বাংলায় বলেননি, ফারসিতে বলেছিলেন, রজিলদের খাদ্য?
তারপর পাতে নিলেন, ঝালে একটু হু-হা করলেন, বললেন স্বাদটা খারাপ না!
ওই যে ‘রজিলদের খাদ্য’ বললেন, খাবারের নামটা পরিচিতি পেয়ে গেল এই নামেই। বলুন তো এই খাবারের এখনকার ভার্সনকে আমরা কী বলে ডাকি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, রেজালা!
গল্পটা মশলা মাখানো, তবে মূল ঘটনা সত্য। মুঘল সম্রাট সত্যিই ‘রজিলদের খাদ্য’ বলে ডেকেছিলেন দাবী খাদ্য গবেষকদের।
এখন প্রশ্ন হলো, ‘রজিল’ বা দরিদ্র মানুষের খাবারকে সম্রাটের মতো উন্নাসিক মানুষের পাতে উঠতে কী করতে হয়েছে? এককথায় উত্তর—ঝালটা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে।
তাহলে দুর্মুখেরা যে বলে, গরিবমানুষ ঝাল বেশি খায়—সত্যি নাকি ব্যাপারটা? কী অন্যায় ব্যাপার বলেন তো! একটা মানুষ স্রেফ ঝাল বেশি খায় দেখে তাকে একটা ভাগে ফেলে দেবেন? বা তার পূর্বপুরুষ কেমন ছিল হিসাব করে ফেলবেন? বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, তখন স্বাদের ভিত্তিতে এ কেমন বিভাজন? সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে এর প্রতিবাদে হয়তো ছড়াও লিখে ফেলতেন—
ঝালের আমি, ঝালের তুমি
ঝাল দিয়ে যায় চেনা।
এমনটি বলবে না!
আবার, এত এত মানুষ ‘গরিবমানুষ ঝাল খায় বেশি’ কথাটা বলেছে, ঠিক উড়িয়ে দিতে মন চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফেলুদার মতো আমাদেরও তাই বলতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!
সেই ‘কালটিভেট’ করতে আমাদের প্রয়োজন ঝালের সাগরে ডুব দেওয়া। আর সেজন্য প্রথমে দরকার, ঝালের ইতিহাস-পাতিহাসটা হালকা করে ঘুরে আসা। ওটা না জানলে ঝালের পোস্টমর্টেম আর করা যাবে কীভাবে? পাঠক, ঝালের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।
ঝাল মশলার রাজনীতি
দেশীয় যেকোনো খাবারেই আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচামরিচ ঠাসি। আলুভর্তায় দেই, পান্তাভাতে দেই, মাছ-মাংসের ঝোলে তো দেই-ই। অন্যদিকে, যেসব বিদেশি খাবার আমরা মোটামুটি চিনি, সেগুলোয় কাঁচামরিচটা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। পাস্তায় কাঁচামরিচ? বার্গারে কাঁচামরিচ? হাহা, মানুষ শুনলে হাসবে তো! ওইসব জায়গায় ব্ল্যাক পিপার ব্যবহার করাই রীতি। এইসব দেখে একটা ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক, কাঁচামরিচ হচ্ছে আমাদের দিশি খাদ্য। জন্ম-জন্মান্তরের ভাই। অন্যদিকে গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার হচ্ছে বিদেশি সৎ ভাই। অথচ, পুরো ব্যাপারটাই উল্টো!
১৫২০ বা ৩০ অথবা তার কাছাকাছি সময়ে এই উপমহাদেশে কাঁচামরিচের আগমন। তার আগে আমাদের ঝাল ছিল আদা, লবঙ্গ, দারচিনি, চুইঝাল, গোলমরিচ, বনের মাঝে জন্মানো পিপ্পলি। এই গোলমরিচ নিয়ে আরবরা বাণিজ্যও করত জলপথে। বাণিজ্য বলতে, তারা নিয়ে বিক্রি করত মিশরে। সেই মিশর রোমানদের অধীনে থাকায় মশলা সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপে। সারা ইউরোপ তখন খাচ্ছে এই অঞ্চলের ব্ল্যাক পেপার। ইয়োর কান্ট্রি, আওয়ার পিপার স্যার। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার!
ঘটনা এরপর ঘটিয়ে ফেলল মুসলমানরা। তারা মিশরের দখল নিয়ে ফেলে ইউরোপের সাথে কানেকশন দিল ঘ্যাচাং করে। এবার ইউরোপ কী করে? খাবারে একটু ঝাল না হলে হবে কী করে? লাগাও অভিযান, আরবদের ওপর ভরসা না করে নিজেদেরই ভারতবর্ষে আসার পথ বের করতে হবে।
এইভাবেই স্পেনের ক্রিস্টোফার কলম্বাস সাহেব ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা মহাদেশ! কী অসাধারণ ভুল! সুকুমার রায়ও সম্ভবত তার ননসেন্স রাইমে এমন ‘আবোল-তাবোল’ লিখতে পারতেন না। যাই হোক, কলম্বাস সেখানে মরিচও পান, আর সেটা ইউরোপে নিয়ে আসার পাশাপাশি ইউরোপীয় বণিকদের জন্যও খুলে দেন এক নতুন দুয়ার, ঝাল ব্যবসার দুয়ার।
ওই যে শুরুতে বললাম, ১৫২০-১৫৩০, এরমাঝে কোনো একটা সময়েই পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে ভারতের গোয়া দিয়ে ঝাল ভরা হয়। মানে, গোয়া বন্দরে ঝালের জাহাজ ভেড়ানো হয়। সেই যে উপমহাদেশবাসীর মরিচপ্রেম শুরু, দিনে দিনে তা কেবল বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আর যে ইউরোপের হাত ধরে এ অঞ্চলে মরিচ আসলো, সেই ইউরোপের লোকজন মরিচ খাওয়ায় রয়ে গেল আমাদের কাছে শিশু।
ইতিহাস-পাতিহাস ঘোরা হলো, এবার ইতিহাস থেকে একটা জোক শোনা যাক।
উপমহাদেশীয় নেটিভের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত ছিল এক বৃটিশ কর্মকর্তার। বুঝতেই পারছেন, বৃটিশ আমলের জোক। খেলেন-দেলেন, বাড়ি ফিরলেন ভদ্রলোক। সকালে স্ত্রীকে বললেন, এখন আমি জানি, এখানকার নেটিভরা কেন খাওয়ার পর পানি ব্যবহার করে।
স্ত্রী প্রশ্ন করলেন—কেন?
কারণ আমাদের মতো ওরা টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে আগুন ধরে যেত!
কিন্তু আমরা, মানে উপমহাদেশের মানুষরা, কেন মরিচ বেশি খায়?
তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন মরিচ খায়।
বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করেছেন—ঝাল কোনো স্বাদ না। ঝাল একটা অনুভূতির নাম! ভাবছেন পপুলার একটা ইমোশনাল বাক্য ঝেড়ে দিলাম? না স্যার, ঝালের অনুভূতি তৈরি হয় একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। আমাদের জিভে প্রায় ১০ হাজার স্বাদগ্রন্থি আর ধারক কোষ থাকে, যা আমাদের পাঁচ ধরনের স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। এই পাঁচ ধরনে ঝালের অস্তিত্ব নেই! কী আছে সেটাও বলে দিচ্ছি, টক, মিষ্টি, তিতা, নোনতা আর উমামি। জিভের ডগা বা অগ্রভাগে মিষ্টি এবং পেছনের দিকটায় তিক্ত বা তেতো স্বাদগ্রাহক থাকে, অগ্রভাগের কিছু পরে এবং মাঝখানে লবণাক্ত বা নোনতা, দুইপাশে টক ও উমামি স্বাদ গ্রহণের জন্য একটা করে অংশ থাকে। কারও যদি উমামির স্বাদ কেমন জানতে ইচ্ছা করে, পনির খান; কিংবা সয়া সস খান। ওটার মাঝে উমামির স্বাদ আছে!
তাহলে এই জ্বালাপোড়া পাওয়ার জন্য মানুষ ঝাল কেন খায়?
এই বিষয়ে একটা গবেষণা আছে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার মনোরোগবিদ পল রোজিনের। তিনি খেয়াল করেন, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে। প্রচুর মানুষকে গবেষণার অংশ হিসেবে ঝাল খাইয়ে খাইয়ে তিনি যে পরীক্ষাটা করেছেন, তাতে ঝাল খাওয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন ভূতের সিনেমা দেখে মানুষ ভয় পেলেও ভৌতিক সিনেমার প্রতি আসক্তির সাথে। রোজিনের কথা, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।
ঝাল আসলে মরিচ গাছের আত্মরক্ষার একটা কৌশল। বিভিন্ন মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই জিনিস মরিচ ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদে পাওয়া যায় না। এখন তার তো বংশবৃদ্ধি করা দরকার। এইদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খেলে বীজসুদ্ধো হজম করে ফেলে। তাহলে স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মরিচ খাইয়ে মরিচ গাছের কী লাভ? কাজেই বাড়াও ক্যাপসাইসিন। স্তন্যপায়ী ঠেকাও। সেইসাথে পোকামাকড় ঠেকাও।
আরেকদিকে, পাখিরা বেশিরভাগই মরিচ খেলে বীজ হজম করে ফেলে না। তারা মরিচ খেলে লাভ। তাই, পাখির টেস্টবাডে মরিচের ঝাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও করে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা!
টিয়াপাখিকে দেখবেন কপকপিয়ে মরিচ খায়। তার বিষ্ঠার সাথে মনের আনন্দে চলে মরিচ গাছের বংশবৃদ্ধি। এমন প্রাণীকে খাইয়েই তো লাভ!
মানুষ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ঝালে এমনই আসক্ত, মরিচ গাছ বছর বছর ঝাল বাড়িয়েও এদের থামাতে পারছে না। একটু পরিসংখ্যান শোনাই, বিবিসির দেওয়া তথ্য। এই তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন। নতুন প্রজন্ম মনে হয় আরও বেশি বেশি ঝাল খাচ্ছে!

এইবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন কেন ঝাল বেশি খায় প্রসঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা তিনটা কারণ বলেছেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে না, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলোর মানুষের ঝাল খাওয়ার একইরকম কারণ। এর মাঝে তুরষ্ক আছে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আছে, মেক্সিকো, আফ্রিকান দেশগুলোও আছে।
প্রথম কারণ, গরম দেশে খাবার-দাবার ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। কী ছোটোলোক জীব, মানুষ যা খায়, তার সেখানে ভাগ বসাতে হবেই! শীতপ্রধান দেশে তো এইসব ফ্যাসিজম চলবে না! ঠান্ডা আবহাওয়াই ব্যাকটেরিয়াকে সাইজ করে দেবে। গরম দেশে ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে মশলাই ভরসা। অন্যান্য মশলার পাশাপাশি ক্যাপসাইসিন ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে ভালো ভূমিকা রাখে। কাজেই, ঠাসো ঝাল! খাবার ফিট তো রাঁধুনি হিট!
দ্বিতীয় কারণ, ক্যাপসাইসিন শুধু জিভেই জ্বালাপোড়া শুরু করে না, ভালোরকম ঝাল খেলে দেখবেন কপালে চিকন ঘাম দেওয়া শুরু করেছে। আরেকটু খেলে সারা শরীরে ঘাম। এই যে স্বেদগ্রন্থি ঘাম ছেড়ে দিচ্ছে, শরীরের উত্তাপও কিন্তু তাতে যাচ্ছে কমে। গরমের মাঝেও আপনি পাবেন ফুরফুরে এক অনুভূতি। এজন্য হলেও ঝাল খাবেন। ঘামেই শান্তি!
তৃতীয় কারণ, এইরকম গরম আবহাওয়ায় মরিচ ভালো জন্মায়। ব্যস, এই একটা কারণই তো যথেষ্ট মরিচ খাওয়ার জন্য। ফলন বেশি, দাম কম—মানুষের খেতে কী আর লাগে? বাসায় তরকারি নাই? লাগাও মরিচ দিয়ে কোনো ভর্তা। তরকারি পছন্দ না? লাগাও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিমভাজা।
এই পর্যন্ত কারণগুলো শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে গরম দেশ হওয়ায় মানুষজন ঝাল বেশি খায়—এর সাথে গরিবহওয়ার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকী কারণগুলো শুনুন।
চতুর্থ কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কয়েকটা পাখি আর পোকামাকড়ের জন্য ক্যাপসাইসিন যে বিষ হিসেবে কাজ করে, মানুষ এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। বেশি করে মরিচ খেলে ঘামের সাথে ক্যাপসাইসিনের যে ঘ্রাণ বের হয়, পোকামাকড় তাতেই কাত! এইভাবে আফ্রিকায় মানুষ সেৎসি মাছি ঠেকায়, এদিককার মানুষ ম্যালেরিয়া ঠেকায়। এবার বলুন আপনি, মশা-মাছি কাদের এলাকায় দেখা যায়? ইউরোপে? আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া জাপানে? নাকি আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, কড়াইলের বস্তিতে? তাহলে ঝালটা কারা খাবে? বড়লোকরা?
পঞ্চম কারণ, রাস্তায় বসে এক লোকের খাওয়া দেখছিলাম। খুব যত্ন করে একটা সেদ্ধ আলু ছিলল। তাতে গুচ্ছের মরিচ আর লবণ মেশালো। তারপর সামনে পলিথিনের ওপর রাখা পাহাড়সম ভাতে একটু একটু করে মাখিয়ে গবগব করে গিলে ফেলল। এটা আর কিছু না, দরিদ্র হওয়ার খুব নিষ্ঠুর অর্থনীতি। আপনাকে খুব উত্তেজক আর সস্তা খাবার দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, নুন দিয়েও সম্ভব। কিন্তু ঝালের যে মজা, নুনে তো ওটা পাবেন না! ডোমিনিক ল্যাপিয়ের তার কলকাতাকে নিয়ে লেখা সিটি অব জয়তে ক্ষুধার সাথে ঝালের একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!
গরিবমানুষের মস্তিষ্কও সম্ভবত খুব দ্রুত অর্থনীতি বুঝে যায়!
ষষ্ঠ কারণ, জিভে লেগেছে ঝাল। শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। সিগন্যাল চলে গেছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কও তো বসে থাকার বান্দা না! সে সাথে সাথে ছাড়া শুরু করল এন্ডরফিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটা একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই এন্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেবে আপনার। কিন্তু এই মস্তিষ্কের কাজ কি শুধু ব্যথা কমানো? এই যে ‘ব্যথা’ পেয়ে আপনার মন যে বিষণ্ণ হলো, সেটা ঠিক করবে কে? ইউসুফ সরকার? উঁহু, কাজটা মস্তিষ্কই করবে। শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। যার কারণে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা, সুখের অনুভূতি তৈরি হয়।
এইবার, আপনার কাছে জিজ্ঞাসা। মন ভালো করতে আপনি কী করেন? শপিং করেন? ভালো ভালো খাবার খান? দেশে-বিদেশে ঘুরতে যান? এগুলো কিছু করেন না? কী বললেন? ঝাল খান?
অভিনন্দন, আপনি গরীবস। পকেটে পয়সা থাকলে কেউ এত সস্তায় সুখী হওয়ার চেষ্টা করে না।
সপ্তম কারণ, বিখ্যাত আমেরিকান শেফ কাম লেখক অ্যান্থনি বোর্ডেইন প্রায় প্রায়ই বলতেন, গরিবদেশগুলোর খাবারই সবচেয়ে মজা, কারণ মজা না করে তাদের উপায় নাই! যদি গরুর সবচেয়ে ভালো জায়গার অংশটা বা টাটকা অ্যাসপ্যারাগাস প্রতিদিন খাওয়ার মতো অর্থ আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার খুব ক্রিয়েটিভ হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মাথার মাংস, ভূঁড়ি, লেজ, জিহবাই যদি আপনাকে বাধ্য হয়ে খেতে হয়, কোনো না কোনো ক্রিয়েটিভ উপায়ে এই রান্না মজা না করে আপনার উপায় নাই। আর ঝাল, মশলা এই ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম অস্ত্র।
কী বুঝলেন? অ্যান্থনি বোর্ডেইন তার অভিজ্ঞতায় তার পরিচিত খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু চিন্তা করেন তো নিজের টেবিলের কথা? একদিন দুইদিন পান্তা খেতে ভালোই লাগে। অর্থের কারণে প্রতিদিন যদি এটাই খেতে হয়? কয়দিন পারবেন মশলার, ঝালের সাহায্য নেওয়া ছাড়া?
নজরুল চাইলে লিখতেও পারতেন—
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান
তুমি মোরে খাইয়েছ ঝালের বিরান।
তাহলে? গরীবদের বেশি ঝাল খাওয়া কি প্রমাণিত?
২০১৮ সালে চাও মা, জে সং ও আরও কয়েকজন মিলে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, চায়নার মাঝে সিচুয়ান অঞ্চলের খাবার সবচেয়ে ঝাল। আর সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়! অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ঝালের মাত্রা যত কমতে থাকে, সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থাও ততো চাঙ্গা! শেষমেষ মনে হচ্ছিলো, চায়নার কোনো প্রদেশ চমচম খাওয়া শুরু করলে ওদের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!
কিন্তু খুব বড় পরিসরে এমন আর গবেষণা খুঁজে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকটাক গবেষণা কিছু দেখা যায়, ফলাফল ওই আগেরটাই।
সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু হুট করে যদি পিছিয়ে যাই সাড়ে তিনশ বছর? সম্রাট আওরংজেবের আমলে? নিখিল ভারতবর্ষ তখনও ঝাল খেত, ভালোভাবেই খেত। তারা কি গরিবতখন? সেই সময়ে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ কর যারা দেয়, তাদের গরিববলবেন কীভাবে? সেই সময়ের ঝাল-খেকো হিন্দুস্তানীদের ক্ষেত্রে এই ‘গরিব মানেই ঝাল’ তত্ত্ব খাটবে কীভাবে? বা ইউরোপের যখন মধ্যযুগ, খুব কি ঝাল-মশলা খেত তারা? তখনই বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয়দের’ জন্য এই তত্ত্ব কোথায় যায়?
সম্ভবত ঝাল-তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে চলমান একটা সাইন কার্ভের মতো। সময় কখনও বলবে ঝাল খায় গরীবরা। কখনও বলবে ঝাল খায় ধনীরা, ট্যালট্যালে স্যুপ, নুন ছেটানো মাছ হচ্ছে গরীবদের জন্য। কে জানে?
তবে, আমার এত কঠিন তত্ত্ব টানার কী দরকার? এখনকার জ্ঞানীগুণীরা যখন বলছেন, হয়তো কিছু চিন্তা করেই বলছেন। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব, কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেনে নেওয়াই ভালো যে গরীবরা ঝাল বেশি খায়।
সেক্ষেত্রে সুকুমার রায় হয়তো তার কবিতাটা আবার সংশোধন করে লিখতেন—
ঝালের আমি ঝালের তুমি
ঝাল দিয়ে যায় চেনা
চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে
তুই ব্যাটা মিশবি না।