ঝাল কি আসলেই গরিবের খাবার? 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: রিসাদ

ওই ঝাল ঝাল খাবার? ওটা তো রজিলদের খাদ্য!  

মুঘল অন্দরমহলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সম্রাট আজ তশরিফ রেখেছেন, কী সৌভাগ্য! সাধারণত সম্রাট যখন এমন ঘোষণা দিয়ে আসেন, বুঝে নিতে হবে বিবির কাছে বসে ওনার পরিপাটি আহার সারার ইচ্ছে হয়েছে। এমন না যে অন্য কোথাও সম্রাটের খাওয়ার জায়গা নেই। একঘণ্টার নোটিশে দুইশ লোকের ব্যাপক ভোজনের ব্যবস্থা মুঘল হেঁশেলে সবসময় রাখা হতো। সেটা চেক, ডবল চেক হয়ে নানা নিরাপত্তায় সম্রাটের সামনে এসে পৌঁছুতো। কিন্তু অন্দরমহলের যখন ব্যাপার, এখানে বিবির হাতের রান্নার, বা বিবির পছন্দের খাবারের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে। 

শুরু হয়েছে খাবার। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকানো মোমবাতির আলো তৈরী করেছে একটা রোমান্টিক আবহ।  বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আগরবাতির সুবাস। শত পদের খাবার সামনে, সম্রাট কোনোটা চাখছেন, কোনোটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কোনোটা আবার রানির পীড়াপিড়িতে বেশ কয়েকগাল খাচ্ছেন। হুট করে একটা খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ঘি-মালাই-বাদামের সমারোহে যে মুঘল খানা-খাদ্য, এটার ঘ্রাণটা যেন ভিন্নরকম! কী এটা? সম্রাটের চোখে প্রশ্ন।

জাঁহাপনা, আপনার হিন্দুস্তানি দরবারীরা খুব আগ্রহ করে খায় এটা। ঝাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এটার মাঝে ওদের মতো মরিচ দেইনি। মরিচ ফেঁড়ে বীজগুলো ফেলে দিয়ে সবুজ শাঁসটা গাভীর দুধে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই শাঁস ফেলে দিয়ে দুধটুকু দিয়েছি মাংসে। খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।

সম্রাট আস্তে করে বললেন, ও… ওই গরীবদের খাদ্য? 

তিনি তো আমাদের মতো বাংলায় বলেননি, ফারসিতে বলেছিলেন, রজিলদের খাদ্য?  

তারপর পাতে নিলেন, ঝালে একটু হু-হা করলেন, বললেন স্বাদটা খারাপ না!

 ওই যে ‘রজিলদের খাদ্য’ বললেন, খাবারের নামটা পরিচিতি পেয়ে গেল এই নামেই। বলুন তো এই খাবারের এখনকার ভার্সনকে আমরা কী বলে ডাকি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, রেজালা!

গল্পটা মশলা মাখানো, তবে মূল ঘটনা সত্য। মুঘল সম্রাট সত্যিই ‘রজিলদের খাদ্য’ বলে ডেকেছিলেন দাবী খাদ্য গবেষকদের।

এখন প্রশ্ন হলো, ‘রজিল’ বা দরিদ্র মানুষের খাবারকে সম্রাটের মতো উন্নাসিক মানুষের পাতে উঠতে কী করতে হয়েছে? এককথায় উত্তর—ঝালটা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে।

তাহলে দুর্মুখেরা যে বলে, গরিবমানুষ ঝাল বেশি খায়—সত্যি নাকি ব্যাপারটা? কী অন্যায় ব্যাপার বলেন তো! একটা মানুষ স্রেফ ঝাল বেশি খায় দেখে তাকে একটা ভাগে ফেলে দেবেন? বা তার পূর্বপুরুষ কেমন ছিল হিসাব করে ফেলবেন? বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, তখন স্বাদের ভিত্তিতে এ কেমন বিভাজন? সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে এর প্রতিবাদে হয়তো ছড়াও লিখে ফেলতেন—

ঝালের আমি, ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা।

এমনটি বলবে না!

আবার, এত এত মানুষ ‘গরিবমানুষ ঝাল খায় বেশি’ কথাটা বলেছে, ঠিক উড়িয়ে দিতে মন চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফেলুদার মতো আমাদেরও তাই বলতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!  

সেই ‘কালটিভেট’ করতে আমাদের প্রয়োজন ঝালের সাগরে ডুব দেওয়া। আর সেজন্য প্রথমে দরকার, ঝালের ইতিহাস-পাতিহাসটা হালকা করে ঘুরে আসা। ওটা না জানলে ঝালের পোস্টমর্টেম আর করা যাবে কীভাবে? পাঠক, ঝালের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।

ঝাল মশলার রাজনীতি

দেশীয় যেকোনো খাবারেই আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচামরিচ ঠাসি। আলুভর্তায় দেই, পান্তাভাতে দেই, মাছ-মাংসের ঝোলে তো দেই-ই। অন্যদিকে, যেসব বিদেশি খাবার আমরা মোটামুটি চিনি, সেগুলোয় কাঁচামরিচটা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। পাস্তায় কাঁচামরিচ? বার্গারে কাঁচামরিচ? হাহা, মানুষ শুনলে হাসবে তো! ওইসব জায়গায় ব্ল্যাক পিপার ব্যবহার করাই রীতি। এইসব দেখে একটা ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক, কাঁচামরিচ হচ্ছে আমাদের দিশি খাদ্য। জন্ম-জন্মান্তরের ভাই। অন্যদিকে গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার হচ্ছে বিদেশি সৎ ভাই। অথচ, পুরো ব্যাপারটাই উল্টো!

১৫২০ বা ৩০ অথবা তার কাছাকাছি সময়ে এই উপমহাদেশে কাঁচামরিচের আগমন। তার আগে আমাদের ঝাল ছিল আদা, লবঙ্গ, দারচিনি, চুইঝাল, গোলমরিচ, বনের মাঝে জন্মানো পিপ্পলি। এই গোলমরিচ নিয়ে আরবরা বাণিজ্যও করত জলপথে। বাণিজ্য বলতে, তারা নিয়ে বিক্রি করত মিশরে। সেই মিশর রোমানদের অধীনে থাকায় মশলা সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপে। সারা ইউরোপ তখন খাচ্ছে এই অঞ্চলের ব্ল্যাক পেপার। ইয়োর কান্ট্রি, আওয়ার পিপার স্যার। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার!

ঘটনা এরপর ঘটিয়ে ফেলল মুসলমানরা। তারা মিশরের দখল নিয়ে ফেলে ইউরোপের সাথে কানেকশন দিল ঘ্যাচাং করে। এবার ইউরোপ কী করে? খাবারে একটু ঝাল না হলে হবে কী করে? লাগাও অভিযান, আরবদের ওপর ভরসা না করে নিজেদেরই ভারতবর্ষে আসার পথ বের করতে হবে।

এইভাবেই স্পেনের ক্রিস্টোফার কলম্বাস সাহেব ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা মহাদেশ! কী অসাধারণ ভুল! সুকুমার রায়ও সম্ভবত তার ননসেন্স রাইমে এমন ‘আবোল-তাবোল’ লিখতে পারতেন না। যাই হোক, কলম্বাস সেখানে মরিচও পান, আর সেটা ইউরোপে নিয়ে আসার পাশাপাশি ইউরোপীয় বণিকদের জন্যও খুলে দেন এক নতুন দুয়ার, ঝাল ব্যবসার দুয়ার।

ওই যে শুরুতে বললাম, ১৫২০-১৫৩০, এরমাঝে কোনো একটা সময়েই পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে ভারতের গোয়া দিয়ে ঝাল ভরা হয়। মানে, গোয়া বন্দরে ঝালের জাহাজ ভেড়ানো হয়। সেই যে উপমহাদেশবাসীর মরিচপ্রেম শুরু, দিনে দিনে তা কেবল বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আর যে ইউরোপের হাত ধরে এ অঞ্চলে মরিচ আসলো, সেই ইউরোপের লোকজন মরিচ খাওয়ায় রয়ে গেল আমাদের কাছে শিশু। 

ইতিহাস-পাতিহাস ঘোরা হলো, এবার ইতিহাস থেকে একটা জোক শোনা যাক। 

উপমহাদেশীয় নেটিভের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত ছিল এক বৃটিশ কর্মকর্তার। বুঝতেই পারছেন, বৃটিশ আমলের জোক। খেলেন-দেলেন, বাড়ি ফিরলেন ভদ্রলোক। সকালে স্ত্রীকে বললেন, এখন আমি জানি, এখানকার নেটিভরা কেন খাওয়ার পর পানি ব্যবহার করে।

স্ত্রী প্রশ্ন করলেন—কেন?  

কারণ আমাদের মতো ওরা টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে আগুন ধরে যেত!

কিন্তু আমরা, মানে উপমহাদেশের মানুষরা, কেন মরিচ বেশি খায়?

তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন মরিচ খায়। 

বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করেছেন—ঝাল কোনো স্বাদ না। ঝাল একটা অনুভূতির নাম! ভাবছেন পপুলার একটা ইমোশনাল বাক্য ঝেড়ে দিলাম? না স্যার, ঝালের অনুভূতি তৈরি হয় একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। আমাদের জিভে প্রায় ১০ হাজার স্বাদগ্রন্থি আর ধারক কোষ থাকে, যা আমাদের পাঁচ ধরনের স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। এই পাঁচ ধরনে ঝালের অস্তিত্ব নেই! কী আছে সেটাও বলে দিচ্ছি, টক, মিষ্টি, তিতা, নোনতা আর উমামি। জিভের ডগা বা অগ্রভাগে মিষ্টি এবং পেছনের দিকটায় তিক্ত বা তেতো স্বাদগ্রাহক থাকে, অগ্রভাগের কিছু পরে এবং মাঝখানে লবণাক্ত বা নোনতা, দুইপাশে টক ও উমামি স্বাদ গ্রহণের জন্য একটা করে অংশ থাকে। কারও যদি উমামির স্বাদ কেমন জানতে ইচ্ছা করে, পনির খান; কিংবা সয়া সস খান। ওটার মাঝে উমামির স্বাদ আছে!

তাহলে এই জ্বালাপোড়া পাওয়ার জন্য মানুষ ঝাল কেন খায়?

এই বিষয়ে একটা গবেষণা আছে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার মনোরোগবিদ পল রোজিনের। তিনি খেয়াল করেন, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে। প্রচুর মানুষকে গবেষণার অংশ হিসেবে ঝাল খাইয়ে খাইয়ে তিনি যে পরীক্ষাটা করেছেন, তাতে ঝাল খাওয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন ভূতের সিনেমা দেখে মানুষ ভয় পেলেও ভৌতিক সিনেমার প্রতি আসক্তির সাথে। রোজিনের কথা, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।

ঝাল আসলে মরিচ গাছের আত্মরক্ষার একটা কৌশল। বিভিন্ন মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই জিনিস মরিচ ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদে পাওয়া যায় না। এখন তার তো বংশবৃদ্ধি করা দরকার। এইদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খেলে বীজসুদ্ধো হজম করে ফেলে। তাহলে স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মরিচ খাইয়ে মরিচ গাছের কী লাভ? কাজেই বাড়াও ক্যাপসাইসিন। স্তন্যপায়ী ঠেকাও। সেইসাথে পোকামাকড় ঠেকাও। 

আরেকদিকে, পাখিরা বেশিরভাগই মরিচ খেলে বীজ হজম করে ফেলে না। তারা মরিচ খেলে লাভ। তাই, পাখির টেস্টবাডে মরিচের ঝাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও করে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা! 

টিয়াপাখিকে দেখবেন কপকপিয়ে মরিচ খায়। তার বিষ্ঠার সাথে মনের আনন্দে চলে মরিচ গাছের বংশবৃদ্ধি। এমন প্রাণীকে খাইয়েই তো লাভ!

মানুষ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ঝালে এমনই আসক্ত, মরিচ গাছ বছর বছর ঝাল বাড়িয়েও এদের থামাতে পারছে না। একটু পরিসংখ্যান শোনাই, বিবিসির দেওয়া তথ্য। এই তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন। নতুন প্রজন্ম মনে হয় আরও বেশি বেশি ঝাল খাচ্ছে! 

ঝাল সহযোগে খাওয়ার প্রতীকী ছবি। একেছেন সামিউল

এইবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন কেন ঝাল বেশি খায় প্রসঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা তিনটা কারণ বলেছেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে না, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলোর মানুষের ঝাল খাওয়ার একইরকম কারণ। এর মাঝে তুরষ্ক আছে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আছে, মেক্সিকো, আফ্রিকান দেশগুলোও আছে। 

প্রথম কারণ, গরম দেশে খাবার-দাবার ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। কী ছোটোলোক জীব, মানুষ যা খায়, তার সেখানে ভাগ বসাতে হবেই! শীতপ্রধান দেশে তো এইসব ফ্যাসিজম চলবে না! ঠান্ডা আবহাওয়াই ব্যাকটেরিয়াকে সাইজ করে দেবে। গরম দেশে ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে মশলাই ভরসা। অন্যান্য মশলার পাশাপাশি ক্যাপসাইসিন ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে ভালো ভূমিকা রাখে। কাজেই, ঠাসো ঝাল! খাবার ফিট তো রাঁধুনি হিট!

দ্বিতীয় কারণ, ক্যাপসাইসিন শুধু জিভেই জ্বালাপোড়া শুরু করে না, ভালোরকম ঝাল খেলে দেখবেন কপালে চিকন ঘাম দেওয়া শুরু করেছে। আরেকটু খেলে সারা শরীরে ঘাম। এই যে স্বেদগ্রন্থি ঘাম ছেড়ে দিচ্ছে, শরীরের উত্তাপও কিন্তু তাতে যাচ্ছে কমে। গরমের মাঝেও আপনি পাবেন ফুরফুরে এক অনুভূতি। এজন্য হলেও ঝাল খাবেন। ঘামেই শান্তি!

তৃতীয় কারণ, এইরকম গরম আবহাওয়ায় মরিচ ভালো জন্মায়। ব্যস, এই একটা কারণই তো যথেষ্ট মরিচ খাওয়ার জন্য। ফলন বেশি, দাম কম—মানুষের খেতে কী আর লাগে? বাসায় তরকারি নাই? লাগাও মরিচ দিয়ে কোনো ভর্তা। তরকারি পছন্দ না? লাগাও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিমভাজা।

এই পর্যন্ত কারণগুলো শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে গরম দেশ হওয়ায় মানুষজন ঝাল বেশি খায়—এর সাথে গরিবহওয়ার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকী কারণগুলো শুনুন।

চতুর্থ কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কয়েকটা পাখি আর পোকামাকড়ের জন্য ক্যাপসাইসিন যে বিষ হিসেবে কাজ করে, মানুষ এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। বেশি করে মরিচ খেলে ঘামের সাথে ক্যাপসাইসিনের যে ঘ্রাণ বের হয়, পোকামাকড় তাতেই কাত! এইভাবে আফ্রিকায় মানুষ সেৎসি মাছি ঠেকায়, এদিককার মানুষ ম্যালেরিয়া ঠেকায়।  এবার বলুন আপনি, মশা-মাছি কাদের এলাকায় দেখা যায়? ইউরোপে? আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া জাপানে? নাকি আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, কড়াইলের বস্তিতে? তাহলে ঝালটা কারা খাবে? বড়লোকরা?

পঞ্চম কারণ, রাস্তায় বসে এক লোকের খাওয়া দেখছিলাম। খুব যত্ন করে একটা সেদ্ধ আলু ছিলল। তাতে গুচ্ছের মরিচ আর লবণ মেশালো। তারপর সামনে পলিথিনের ওপর রাখা পাহাড়সম ভাতে একটু একটু করে মাখিয়ে গবগব করে গিলে ফেলল। এটা আর কিছু না, দরিদ্র হওয়ার খুব নিষ্ঠুর অর্থনীতি। আপনাকে খুব উত্তেজক আর সস্তা খাবার দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, নুন দিয়েও সম্ভব। কিন্তু ঝালের যে মজা, নুনে তো ওটা পাবেন না! ডোমিনিক ল্যাপিয়ের তার কলকাতাকে নিয়ে লেখা সিটি অব জয়তে ক্ষুধার সাথে ঝালের একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!

গরিবমানুষের মস্তিষ্কও সম্ভবত খুব দ্রুত অর্থনীতি বুঝে যায়!

ষষ্ঠ কারণ, জিভে লেগেছে ঝাল। শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। সিগন্যাল চলে গেছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কও তো বসে থাকার বান্দা না! সে সাথে সাথে ছাড়া শুরু করল এন্ডরফিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটা একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই এন্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেবে আপনার। কিন্তু এই মস্তিষ্কের কাজ কি শুধু ব্যথা কমানো? এই যে ‘ব্যথা’ পেয়ে আপনার মন যে বিষণ্ণ হলো, সেটা ঠিক করবে কে? ইউসুফ সরকার? উঁহু, কাজটা মস্তিষ্কই করবে। শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। যার কারণে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা, সুখের অনুভূতি তৈরি হয়।

এইবার, আপনার কাছে জিজ্ঞাসা। মন ভালো করতে আপনি কী করেন? শপিং করেন? ভালো ভালো খাবার খান? দেশে-বিদেশে ঘুরতে যান? এগুলো কিছু করেন না? কী বললেন? ঝাল খান?

অভিনন্দন, আপনি গরীবস। পকেটে পয়সা থাকলে কেউ এত সস্তায় সুখী হওয়ার চেষ্টা করে না।

সপ্তম কারণ, বিখ্যাত আমেরিকান শেফ কাম লেখক অ্যান্থনি বোর্ডেইন প্রায় প্রায়ই বলতেন, গরিবদেশগুলোর খাবারই সবচেয়ে মজা, কারণ মজা না করে তাদের উপায় নাই! যদি গরুর সবচেয়ে ভালো জায়গার অংশটা বা টাটকা অ্যাসপ্যারাগাস প্রতিদিন খাওয়ার মতো অর্থ আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার খুব ক্রিয়েটিভ হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মাথার মাংস, ভূঁড়ি, লেজ, জিহবাই যদি আপনাকে বাধ্য হয়ে খেতে হয়, কোনো না কোনো ক্রিয়েটিভ উপায়ে এই রান্না মজা না করে আপনার উপায় নাই। আর ঝাল, মশলা এই ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম অস্ত্র।

কী বুঝলেন? অ্যান্থনি বোর্ডেইন তার অভিজ্ঞতায় তার পরিচিত খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু চিন্তা করেন তো নিজের টেবিলের কথা? একদিন দুইদিন পান্তা খেতে ভালোই লাগে। অর্থের কারণে প্রতিদিন যদি এটাই খেতে হয়? কয়দিন পারবেন মশলার, ঝালের  সাহায্য নেওয়া ছাড়া?

নজরুল চাইলে লিখতেও পারতেন— 

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে খাইয়েছ ঝালের বিরান।

তাহলে? গরীবদের বেশি ঝাল খাওয়া কি প্রমাণিত?

২০১৮ সালে চাও মা, জে সং ও আরও কয়েকজন মিলে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, চায়নার মাঝে সিচুয়ান অঞ্চলের খাবার সবচেয়ে ঝাল। আর সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়! অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ঝালের মাত্রা যত কমতে থাকে, সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থাও ততো চাঙ্গা! শেষমেষ মনে হচ্ছিলো, চায়নার কোনো প্রদেশ চমচম খাওয়া শুরু করলে ওদের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!

কিন্তু খুব বড় পরিসরে এমন আর গবেষণা খুঁজে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকটাক গবেষণা কিছু দেখা যায়, ফলাফল ওই আগেরটাই। 

সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু হুট করে যদি পিছিয়ে যাই সাড়ে তিনশ বছর? সম্রাট আওরংজেবের আমলে? নিখিল ভারতবর্ষ তখনও ঝাল খেত, ভালোভাবেই খেত। তারা কি গরিবতখন? সেই সময়ে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ কর যারা দেয়, তাদের গরিববলবেন কীভাবে? সেই সময়ের ঝাল-খেকো হিন্দুস্তানীদের ক্ষেত্রে এই ‘গরিব মানেই ঝাল’ তত্ত্ব খাটবে কীভাবে? বা ইউরোপের যখন মধ্যযুগ, খুব কি ঝাল-মশলা খেত তারা? তখনই বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয়দের’ জন্য এই তত্ত্ব কোথায় যায়?

সম্ভবত ঝাল-তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে চলমান একটা সাইন কার্ভের মতো। সময় কখনও বলবে ঝাল খায় গরীবরা। কখনও বলবে ঝাল খায় ধনীরা, ট্যালট্যালে স্যুপ, নুন ছেটানো মাছ হচ্ছে গরীবদের জন্য। কে জানে?   

তবে, আমার এত কঠিন তত্ত্ব টানার কী দরকার? এখনকার জ্ঞানীগুণীরা যখন বলছেন, হয়তো কিছু চিন্তা করেই বলছেন। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব, কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেনে নেওয়াই ভালো যে গরীবরা ঝাল বেশি খায়।

সেক্ষেত্রে সুকুমার রায় হয়তো তার কবিতাটা আবার সংশোধন করে লিখতেন—

ঝালের আমি ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা

চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে

তুই ব্যাটা মিশবি না।

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।