ঝাল কি আসলেই গরিবের খাবার? 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: রিসাদ

ওই ঝাল ঝাল খাবার? ওটা তো রজিলদের খাদ্য!  

মুঘল অন্দরমহলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সম্রাট আজ তশরিফ রেখেছেন, কী সৌভাগ্য! সাধারণত সম্রাট যখন এমন ঘোষণা দিয়ে আসেন, বুঝে নিতে হবে বিবির কাছে বসে ওনার পরিপাটি আহার সারার ইচ্ছে হয়েছে। এমন না যে অন্য কোথাও সম্রাটের খাওয়ার জায়গা নেই। একঘণ্টার নোটিশে দুইশ লোকের ব্যাপক ভোজনের ব্যবস্থা মুঘল হেঁশেলে সবসময় রাখা হতো। সেটা চেক, ডবল চেক হয়ে নানা নিরাপত্তায় সম্রাটের সামনে এসে পৌঁছুতো। কিন্তু অন্দরমহলের যখন ব্যাপার, এখানে বিবির হাতের রান্নার, বা বিবির পছন্দের খাবারের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে। 

শুরু হয়েছে খাবার। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকানো মোমবাতির আলো তৈরী করেছে একটা রোমান্টিক আবহ।  বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আগরবাতির সুবাস। শত পদের খাবার সামনে, সম্রাট কোনোটা চাখছেন, কোনোটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কোনোটা আবার রানির পীড়াপিড়িতে বেশ কয়েকগাল খাচ্ছেন। হুট করে একটা খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ঘি-মালাই-বাদামের সমারোহে যে মুঘল খানা-খাদ্য, এটার ঘ্রাণটা যেন ভিন্নরকম! কী এটা? সম্রাটের চোখে প্রশ্ন।

জাঁহাপনা, আপনার হিন্দুস্তানি দরবারীরা খুব আগ্রহ করে খায় এটা। ঝাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এটার মাঝে ওদের মতো মরিচ দেইনি। মরিচ ফেঁড়ে বীজগুলো ফেলে দিয়ে সবুজ শাঁসটা গাভীর দুধে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই শাঁস ফেলে দিয়ে দুধটুকু দিয়েছি মাংসে। খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।

সম্রাট আস্তে করে বললেন, ও… ওই গরীবদের খাদ্য? 

তিনি তো আমাদের মতো বাংলায় বলেননি, ফারসিতে বলেছিলেন, রজিলদের খাদ্য?  

তারপর পাতে নিলেন, ঝালে একটু হু-হা করলেন, বললেন স্বাদটা খারাপ না!

 ওই যে ‘রজিলদের খাদ্য’ বললেন, খাবারের নামটা পরিচিতি পেয়ে গেল এই নামেই। বলুন তো এই খাবারের এখনকার ভার্সনকে আমরা কী বলে ডাকি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, রেজালা!

গল্পটা মশলা মাখানো, তবে মূল ঘটনা সত্য। মুঘল সম্রাট সত্যিই ‘রজিলদের খাদ্য’ বলে ডেকেছিলেন দাবী খাদ্য গবেষকদের।

এখন প্রশ্ন হলো, ‘রজিল’ বা দরিদ্র মানুষের খাবারকে সম্রাটের মতো উন্নাসিক মানুষের পাতে উঠতে কী করতে হয়েছে? এককথায় উত্তর—ঝালটা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে।

তাহলে দুর্মুখেরা যে বলে, গরিবমানুষ ঝাল বেশি খায়—সত্যি নাকি ব্যাপারটা? কী অন্যায় ব্যাপার বলেন তো! একটা মানুষ স্রেফ ঝাল বেশি খায় দেখে তাকে একটা ভাগে ফেলে দেবেন? বা তার পূর্বপুরুষ কেমন ছিল হিসাব করে ফেলবেন? বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, তখন স্বাদের ভিত্তিতে এ কেমন বিভাজন? সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে এর প্রতিবাদে হয়তো ছড়াও লিখে ফেলতেন—

ঝালের আমি, ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা।

এমনটি বলবে না!

আবার, এত এত মানুষ ‘গরিবমানুষ ঝাল খায় বেশি’ কথাটা বলেছে, ঠিক উড়িয়ে দিতে মন চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফেলুদার মতো আমাদেরও তাই বলতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!  

সেই ‘কালটিভেট’ করতে আমাদের প্রয়োজন ঝালের সাগরে ডুব দেওয়া। আর সেজন্য প্রথমে দরকার, ঝালের ইতিহাস-পাতিহাসটা হালকা করে ঘুরে আসা। ওটা না জানলে ঝালের পোস্টমর্টেম আর করা যাবে কীভাবে? পাঠক, ঝালের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।

ঝাল মশলার রাজনীতি

দেশীয় যেকোনো খাবারেই আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচামরিচ ঠাসি। আলুভর্তায় দেই, পান্তাভাতে দেই, মাছ-মাংসের ঝোলে তো দেই-ই। অন্যদিকে, যেসব বিদেশি খাবার আমরা মোটামুটি চিনি, সেগুলোয় কাঁচামরিচটা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। পাস্তায় কাঁচামরিচ? বার্গারে কাঁচামরিচ? হাহা, মানুষ শুনলে হাসবে তো! ওইসব জায়গায় ব্ল্যাক পিপার ব্যবহার করাই রীতি। এইসব দেখে একটা ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক, কাঁচামরিচ হচ্ছে আমাদের দিশি খাদ্য। জন্ম-জন্মান্তরের ভাই। অন্যদিকে গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার হচ্ছে বিদেশি সৎ ভাই। অথচ, পুরো ব্যাপারটাই উল্টো!

১৫২০ বা ৩০ অথবা তার কাছাকাছি সময়ে এই উপমহাদেশে কাঁচামরিচের আগমন। তার আগে আমাদের ঝাল ছিল আদা, লবঙ্গ, দারচিনি, চুইঝাল, গোলমরিচ, বনের মাঝে জন্মানো পিপ্পলি। এই গোলমরিচ নিয়ে আরবরা বাণিজ্যও করত জলপথে। বাণিজ্য বলতে, তারা নিয়ে বিক্রি করত মিশরে। সেই মিশর রোমানদের অধীনে থাকায় মশলা সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপে। সারা ইউরোপ তখন খাচ্ছে এই অঞ্চলের ব্ল্যাক পেপার। ইয়োর কান্ট্রি, আওয়ার পিপার স্যার। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার!

ঘটনা এরপর ঘটিয়ে ফেলল মুসলমানরা। তারা মিশরের দখল নিয়ে ফেলে ইউরোপের সাথে কানেকশন দিল ঘ্যাচাং করে। এবার ইউরোপ কী করে? খাবারে একটু ঝাল না হলে হবে কী করে? লাগাও অভিযান, আরবদের ওপর ভরসা না করে নিজেদেরই ভারতবর্ষে আসার পথ বের করতে হবে।

এইভাবেই স্পেনের ক্রিস্টোফার কলম্বাস সাহেব ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা মহাদেশ! কী অসাধারণ ভুল! সুকুমার রায়ও সম্ভবত তার ননসেন্স রাইমে এমন ‘আবোল-তাবোল’ লিখতে পারতেন না। যাই হোক, কলম্বাস সেখানে মরিচও পান, আর সেটা ইউরোপে নিয়ে আসার পাশাপাশি ইউরোপীয় বণিকদের জন্যও খুলে দেন এক নতুন দুয়ার, ঝাল ব্যবসার দুয়ার।

ওই যে শুরুতে বললাম, ১৫২০-১৫৩০, এরমাঝে কোনো একটা সময়েই পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে ভারতের গোয়া দিয়ে ঝাল ভরা হয়। মানে, গোয়া বন্দরে ঝালের জাহাজ ভেড়ানো হয়। সেই যে উপমহাদেশবাসীর মরিচপ্রেম শুরু, দিনে দিনে তা কেবল বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আর যে ইউরোপের হাত ধরে এ অঞ্চলে মরিচ আসলো, সেই ইউরোপের লোকজন মরিচ খাওয়ায় রয়ে গেল আমাদের কাছে শিশু। 

ইতিহাস-পাতিহাস ঘোরা হলো, এবার ইতিহাস থেকে একটা জোক শোনা যাক। 

উপমহাদেশীয় নেটিভের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত ছিল এক বৃটিশ কর্মকর্তার। বুঝতেই পারছেন, বৃটিশ আমলের জোক। খেলেন-দেলেন, বাড়ি ফিরলেন ভদ্রলোক। সকালে স্ত্রীকে বললেন, এখন আমি জানি, এখানকার নেটিভরা কেন খাওয়ার পর পানি ব্যবহার করে।

স্ত্রী প্রশ্ন করলেন—কেন?  

কারণ আমাদের মতো ওরা টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে আগুন ধরে যেত!

কিন্তু আমরা, মানে উপমহাদেশের মানুষরা, কেন মরিচ বেশি খায়?

তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন মরিচ খায়। 

বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করেছেন—ঝাল কোনো স্বাদ না। ঝাল একটা অনুভূতির নাম! ভাবছেন পপুলার একটা ইমোশনাল বাক্য ঝেড়ে দিলাম? না স্যার, ঝালের অনুভূতি তৈরি হয় একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। আমাদের জিভে প্রায় ১০ হাজার স্বাদগ্রন্থি আর ধারক কোষ থাকে, যা আমাদের পাঁচ ধরনের স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। এই পাঁচ ধরনে ঝালের অস্তিত্ব নেই! কী আছে সেটাও বলে দিচ্ছি, টক, মিষ্টি, তিতা, নোনতা আর উমামি। জিভের ডগা বা অগ্রভাগে মিষ্টি এবং পেছনের দিকটায় তিক্ত বা তেতো স্বাদগ্রাহক থাকে, অগ্রভাগের কিছু পরে এবং মাঝখানে লবণাক্ত বা নোনতা, দুইপাশে টক ও উমামি স্বাদ গ্রহণের জন্য একটা করে অংশ থাকে। কারও যদি উমামির স্বাদ কেমন জানতে ইচ্ছা করে, পনির খান; কিংবা সয়া সস খান। ওটার মাঝে উমামির স্বাদ আছে!

তাহলে এই জ্বালাপোড়া পাওয়ার জন্য মানুষ ঝাল কেন খায়?

এই বিষয়ে একটা গবেষণা আছে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার মনোরোগবিদ পল রোজিনের। তিনি খেয়াল করেন, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে। প্রচুর মানুষকে গবেষণার অংশ হিসেবে ঝাল খাইয়ে খাইয়ে তিনি যে পরীক্ষাটা করেছেন, তাতে ঝাল খাওয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন ভূতের সিনেমা দেখে মানুষ ভয় পেলেও ভৌতিক সিনেমার প্রতি আসক্তির সাথে। রোজিনের কথা, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।

ঝাল আসলে মরিচ গাছের আত্মরক্ষার একটা কৌশল। বিভিন্ন মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই জিনিস মরিচ ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদে পাওয়া যায় না। এখন তার তো বংশবৃদ্ধি করা দরকার। এইদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খেলে বীজসুদ্ধো হজম করে ফেলে। তাহলে স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মরিচ খাইয়ে মরিচ গাছের কী লাভ? কাজেই বাড়াও ক্যাপসাইসিন। স্তন্যপায়ী ঠেকাও। সেইসাথে পোকামাকড় ঠেকাও। 

আরেকদিকে, পাখিরা বেশিরভাগই মরিচ খেলে বীজ হজম করে ফেলে না। তারা মরিচ খেলে লাভ। তাই, পাখির টেস্টবাডে মরিচের ঝাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও করে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা! 

টিয়াপাখিকে দেখবেন কপকপিয়ে মরিচ খায়। তার বিষ্ঠার সাথে মনের আনন্দে চলে মরিচ গাছের বংশবৃদ্ধি। এমন প্রাণীকে খাইয়েই তো লাভ!

মানুষ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ঝালে এমনই আসক্ত, মরিচ গাছ বছর বছর ঝাল বাড়িয়েও এদের থামাতে পারছে না। একটু পরিসংখ্যান শোনাই, বিবিসির দেওয়া তথ্য। এই তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন। নতুন প্রজন্ম মনে হয় আরও বেশি বেশি ঝাল খাচ্ছে! 

ঝাল সহযোগে খাওয়ার প্রতীকী ছবি। একেছেন সামিউল

এইবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন কেন ঝাল বেশি খায় প্রসঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা তিনটা কারণ বলেছেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে না, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলোর মানুষের ঝাল খাওয়ার একইরকম কারণ। এর মাঝে তুরষ্ক আছে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আছে, মেক্সিকো, আফ্রিকান দেশগুলোও আছে। 

প্রথম কারণ, গরম দেশে খাবার-দাবার ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। কী ছোটোলোক জীব, মানুষ যা খায়, তার সেখানে ভাগ বসাতে হবেই! শীতপ্রধান দেশে তো এইসব ফ্যাসিজম চলবে না! ঠান্ডা আবহাওয়াই ব্যাকটেরিয়াকে সাইজ করে দেবে। গরম দেশে ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে মশলাই ভরসা। অন্যান্য মশলার পাশাপাশি ক্যাপসাইসিন ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে ভালো ভূমিকা রাখে। কাজেই, ঠাসো ঝাল! খাবার ফিট তো রাঁধুনি হিট!

দ্বিতীয় কারণ, ক্যাপসাইসিন শুধু জিভেই জ্বালাপোড়া শুরু করে না, ভালোরকম ঝাল খেলে দেখবেন কপালে চিকন ঘাম দেওয়া শুরু করেছে। আরেকটু খেলে সারা শরীরে ঘাম। এই যে স্বেদগ্রন্থি ঘাম ছেড়ে দিচ্ছে, শরীরের উত্তাপও কিন্তু তাতে যাচ্ছে কমে। গরমের মাঝেও আপনি পাবেন ফুরফুরে এক অনুভূতি। এজন্য হলেও ঝাল খাবেন। ঘামেই শান্তি!

তৃতীয় কারণ, এইরকম গরম আবহাওয়ায় মরিচ ভালো জন্মায়। ব্যস, এই একটা কারণই তো যথেষ্ট মরিচ খাওয়ার জন্য। ফলন বেশি, দাম কম—মানুষের খেতে কী আর লাগে? বাসায় তরকারি নাই? লাগাও মরিচ দিয়ে কোনো ভর্তা। তরকারি পছন্দ না? লাগাও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিমভাজা।

এই পর্যন্ত কারণগুলো শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে গরম দেশ হওয়ায় মানুষজন ঝাল বেশি খায়—এর সাথে গরিবহওয়ার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকী কারণগুলো শুনুন।

চতুর্থ কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কয়েকটা পাখি আর পোকামাকড়ের জন্য ক্যাপসাইসিন যে বিষ হিসেবে কাজ করে, মানুষ এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। বেশি করে মরিচ খেলে ঘামের সাথে ক্যাপসাইসিনের যে ঘ্রাণ বের হয়, পোকামাকড় তাতেই কাত! এইভাবে আফ্রিকায় মানুষ সেৎসি মাছি ঠেকায়, এদিককার মানুষ ম্যালেরিয়া ঠেকায়।  এবার বলুন আপনি, মশা-মাছি কাদের এলাকায় দেখা যায়? ইউরোপে? আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া জাপানে? নাকি আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, কড়াইলের বস্তিতে? তাহলে ঝালটা কারা খাবে? বড়লোকরা?

পঞ্চম কারণ, রাস্তায় বসে এক লোকের খাওয়া দেখছিলাম। খুব যত্ন করে একটা সেদ্ধ আলু ছিলল। তাতে গুচ্ছের মরিচ আর লবণ মেশালো। তারপর সামনে পলিথিনের ওপর রাখা পাহাড়সম ভাতে একটু একটু করে মাখিয়ে গবগব করে গিলে ফেলল। এটা আর কিছু না, দরিদ্র হওয়ার খুব নিষ্ঠুর অর্থনীতি। আপনাকে খুব উত্তেজক আর সস্তা খাবার দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, নুন দিয়েও সম্ভব। কিন্তু ঝালের যে মজা, নুনে তো ওটা পাবেন না! ডোমিনিক ল্যাপিয়ের তার কলকাতাকে নিয়ে লেখা সিটি অব জয়তে ক্ষুধার সাথে ঝালের একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!

গরিবমানুষের মস্তিষ্কও সম্ভবত খুব দ্রুত অর্থনীতি বুঝে যায়!

ষষ্ঠ কারণ, জিভে লেগেছে ঝাল। শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। সিগন্যাল চলে গেছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কও তো বসে থাকার বান্দা না! সে সাথে সাথে ছাড়া শুরু করল এন্ডরফিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটা একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই এন্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেবে আপনার। কিন্তু এই মস্তিষ্কের কাজ কি শুধু ব্যথা কমানো? এই যে ‘ব্যথা’ পেয়ে আপনার মন যে বিষণ্ণ হলো, সেটা ঠিক করবে কে? ইউসুফ সরকার? উঁহু, কাজটা মস্তিষ্কই করবে। শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। যার কারণে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা, সুখের অনুভূতি তৈরি হয়।

এইবার, আপনার কাছে জিজ্ঞাসা। মন ভালো করতে আপনি কী করেন? শপিং করেন? ভালো ভালো খাবার খান? দেশে-বিদেশে ঘুরতে যান? এগুলো কিছু করেন না? কী বললেন? ঝাল খান?

অভিনন্দন, আপনি গরীবস। পকেটে পয়সা থাকলে কেউ এত সস্তায় সুখী হওয়ার চেষ্টা করে না।

সপ্তম কারণ, বিখ্যাত আমেরিকান শেফ কাম লেখক অ্যান্থনি বোর্ডেইন প্রায় প্রায়ই বলতেন, গরিবদেশগুলোর খাবারই সবচেয়ে মজা, কারণ মজা না করে তাদের উপায় নাই! যদি গরুর সবচেয়ে ভালো জায়গার অংশটা বা টাটকা অ্যাসপ্যারাগাস প্রতিদিন খাওয়ার মতো অর্থ আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার খুব ক্রিয়েটিভ হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মাথার মাংস, ভূঁড়ি, লেজ, জিহবাই যদি আপনাকে বাধ্য হয়ে খেতে হয়, কোনো না কোনো ক্রিয়েটিভ উপায়ে এই রান্না মজা না করে আপনার উপায় নাই। আর ঝাল, মশলা এই ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম অস্ত্র।

কী বুঝলেন? অ্যান্থনি বোর্ডেইন তার অভিজ্ঞতায় তার পরিচিত খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু চিন্তা করেন তো নিজের টেবিলের কথা? একদিন দুইদিন পান্তা খেতে ভালোই লাগে। অর্থের কারণে প্রতিদিন যদি এটাই খেতে হয়? কয়দিন পারবেন মশলার, ঝালের  সাহায্য নেওয়া ছাড়া?

নজরুল চাইলে লিখতেও পারতেন— 

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে খাইয়েছ ঝালের বিরান।

তাহলে? গরীবদের বেশি ঝাল খাওয়া কি প্রমাণিত?

২০১৮ সালে চাও মা, জে সং ও আরও কয়েকজন মিলে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, চায়নার মাঝে সিচুয়ান অঞ্চলের খাবার সবচেয়ে ঝাল। আর সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়! অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ঝালের মাত্রা যত কমতে থাকে, সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থাও ততো চাঙ্গা! শেষমেষ মনে হচ্ছিলো, চায়নার কোনো প্রদেশ চমচম খাওয়া শুরু করলে ওদের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!

কিন্তু খুব বড় পরিসরে এমন আর গবেষণা খুঁজে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকটাক গবেষণা কিছু দেখা যায়, ফলাফল ওই আগেরটাই। 

সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু হুট করে যদি পিছিয়ে যাই সাড়ে তিনশ বছর? সম্রাট আওরংজেবের আমলে? নিখিল ভারতবর্ষ তখনও ঝাল খেত, ভালোভাবেই খেত। তারা কি গরিবতখন? সেই সময়ে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ কর যারা দেয়, তাদের গরিববলবেন কীভাবে? সেই সময়ের ঝাল-খেকো হিন্দুস্তানীদের ক্ষেত্রে এই ‘গরিব মানেই ঝাল’ তত্ত্ব খাটবে কীভাবে? বা ইউরোপের যখন মধ্যযুগ, খুব কি ঝাল-মশলা খেত তারা? তখনই বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয়দের’ জন্য এই তত্ত্ব কোথায় যায়?

সম্ভবত ঝাল-তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে চলমান একটা সাইন কার্ভের মতো। সময় কখনও বলবে ঝাল খায় গরীবরা। কখনও বলবে ঝাল খায় ধনীরা, ট্যালট্যালে স্যুপ, নুন ছেটানো মাছ হচ্ছে গরীবদের জন্য। কে জানে?   

তবে, আমার এত কঠিন তত্ত্ব টানার কী দরকার? এখনকার জ্ঞানীগুণীরা যখন বলছেন, হয়তো কিছু চিন্তা করেই বলছেন। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব, কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেনে নেওয়াই ভালো যে গরীবরা ঝাল বেশি খায়।

সেক্ষেত্রে সুকুমার রায় হয়তো তার কবিতাটা আবার সংশোধন করে লিখতেন—

ঝালের আমি ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা

চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে

তুই ব্যাটা মিশবি না।

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।