সেমসেম সেরা ৭ বাংলা ছোটগল্প 

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণ: সামিউল

 
[ বাংলা ভাষার অজস্র ছোটগল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠতাভিত্তিক কোনো ক্রম তৈরি করা আদৌ এই তালিকার উদ্দেশ্য না। বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের ইতিহাসমোটামুটি দুইশ বছরের। এই দুইশ বছরে বিষয় ও প্রকরণে এত বিচিত্র ও অসাধারণ সব গল্প লিখিত হয়েছে এই ভাষায়, যে তা মাত্র সাতটায় নামিয়ে আনা অসম্ভবই। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, অসংখ্য চমৎকার লেখক ও ছোটগল্প বাদ থেকেই যাবে। তাও, তালিকা বানানোর দস্তুরমত ‘সেরা’ অভিধাটা শিরোনামে ব্যবহার করতেই হলো। পাঠক বুঝে নেবেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই ভাষাটাকে আরো সমৃদ্ধকারী কিছু লেখক ও তাদের লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াসন্ধানী পাঠকের জন্য এই তালিকাটা তাদের পাঠের কেবল শুরুয়াত হবে, সেই আশায়।     
    

এছাড়া প্রচ্ছন্ন একটা থিমকে কেন্দ্র করে তালিকায় গল্পগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত সাতটি গল্পেই দেখা যাবে প্রধান চরিত্র বা প্রটাগনিস্টরা প্রান্তজন। ‘চোখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র, যার বয়ানে গল্পটা আমরা শুনি, একজন ডাকাত। তিনি ধরা পড়েছেন, মানুষ তার কী ভয়াবহ বিচার করবে তা দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন। ‘পাদটীকা’ গল্পটা আমাদের বলে সর্বগ্রাসী উপনিবেশের কবলে বিলুপ্তির মুখে আমাদের নিজস্ব এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা। কিংবা শহীদুল জহিরের ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পে আমরা দেখতে পাই এই প্রচণ্ড কর্মব্যস্ত দুনিয়ায় একজন জাত অকর্মণ্য অলসের কী দশা হতে পারে।    
আমরা মনে করি, ভালো গল্পের ‘স্পয়লার’ বলতে কিছু হয় না। একটা গল্প কেবল ঘটনাপরম্পরা দিয়ে তৈরি হয় না, কোনো টুইস্টের উপরেও নির্ভরশীল হয় না। তাও, গল্পগুলো প্রধান চমক বাতলে না দিয়ে যতটুকু বর্ণনা পাঠককে আগ্রহী করতে পারবে ততটুকুই খোলাসা করে বলার চেষ্টা করেছি। এবার একটু পড়ে দেখুন, নিজের পছন্দের কোনো গল্প খুঁজে পেয়ে গদগদ হতে পারেন কিনা। বা কোন অসাধারণ লেখককে নজরআন্দাজ করে যাওয়ার অপরাধে রাগও ঝাড়তে পারেন। পাঠকের যা মর্জি।  —-সেমসেম ডেস্ক]  

চোখ | হুমায়ূন আহমেদ | ১৯৯৪

‘নয়ন কখন তুলবেন?’
এরকম আপাত সরল কিন্তু বিস্ফোরক বাক্য শুধু বাংলা না, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদের ওস্তাদি উপন্যাসের চেয়েও বেশি। খুব অল্প পরিসরে, অল্প কথায় চরিত্রায়ন ও হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে গভীর মানবিক দিকগুলো আপাত হাস্যরসের পোশাকে উঠে আসে। একজন ডাকাত বসে বসে অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ তোলা হবে। তাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী। আছরের পর তার চোখ তোলা হবে। বেশ একটা উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে গোটা গ্রাম জুড়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও হাজির হচ্ছেন একে একে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলা হবে। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। কেউ এই দৃশ্য মিস করতে চায় না। নিতসের মতে, মানুষের সকল উৎসবের গভীরে একপ্রকার নৃশংসতা লুকানো থাকে। এই গল্পে খেলাচ্ছলে যেভাবে নিষ্ঠুরতাকে উদযাপন করতে দেখা যায় তা সেই উক্তিরই সম্প্রসারণ। ‘গ্রামের মানুষ খুব সহজ-সরল, নিষ্পাপ হয়’ এ-জাতীয় মুখস্থ ধারণা পোষণকারীরা এ গল্পের সামনে এসে একটা ধাক্কা খাবেন। মানুষ একমাত্রিক না; মানুষ জটিল, বহুমাত্রিক। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এ কথা বারবার প্রমাণিত হয়। আর যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই মতি ডাকাত নির্লিপ্তভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে তাকে ঘিরে ধরা উন্মত্ত জনতাকে, বোঝার চেষ্টা করে মবের মতিগতি। সে বোঝার চেষ্টা করে আসলেই তার চোখ তুলে ফেলা হবে কিনা। তাকে ধরে এনেছে যেই হাসান আলী, সে রসিয়ে সবার কাছে নিজের বীরত্বের গল্প করে শোনায়। গল্পে প্রতিবার নতুন শাখা-প্রশাখা যুক্ত হতে থাকে। মতি নিজেই সে গল্প আগ্রহ নিয়ে শোনে। যে গল্পের উপজীব্য, সে-ই শ্রোতা হয়ে উঠছে।  রোমন্থন করতে চোখ লাগে না, তাই সে স্মৃতি হাতড়ায়। ডাকাতের জীবনে ভালোবাসা কীভাবে আসে, আবার কীভাবে চলে যায়? ঘোর ভেঙে সে দেখে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, যেই ইদরিস আলী তার চোখ তুলবে সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। মানুষের চোখে সে জন্তু হয়ে ওঠে। সে ভয় পায়। তার চোখ কি আসলেই তুলে ফেলা হবে? সে জানে নিষ্ঠুরতার মত মানুষের মনে মমতাও জাগে অকস্মাৎ, অচিন উৎস থেকে। সে অপেক্ষা করে সেখানে কারো মধ্যে মমতা জাগার।  
চোখ গল্পটি পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের ‘এই আমি’ গ্রন্থে।    

কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায় | শহীদুল জহির  

শহীদুল জহিরের গল্পের প্লট ধরে আলোচনা করা মুশকিল। কারণ তার গল্পের মূল মজা গল্পটা বলার কায়দায়। কেবল ভঙ্গিমার জোরে নিতান্ত স্বাভাবিক একটা কাহিনিকেও জহির মনোহর করে তুলতে পারেন। তার কৌতূহলজাগানিয়া লেখার সিগনেচার স্টাইল, চাপা উইট সবই ধরা টের পাওয়া যাবে এই গল্পে।   

গল্পটা ফৈজুদ্দিন ওরফে ফজুকে কেন্দ্র করে। সে একজন দরিদ্র কৃষক। তার মত আর দশটা ভূমিহীন কৃষকের মত সেও রোগা, টিঙটিঙা। ব্যতিক্রম হলো, সে একজন পিপুফিশু, অর্থাৎ অলস। এবং অলস বলেই একটু দার্শনিক গোছের। স্বাভাবিক। আলস্যযাপী না হলে চিন্তা করার ফুরসৎ কীভাবেই বা পাওয়া যাবে? বউ তাকে কাজ করতে তাগাদা দিলে সে বলে, কাজ করে তো তার আর জমিদার হওয়া হবে না, লাভ কী? তাই সে ভিটার সামনে একটা বিচিকলা ঝোপের পাশে একটা বাঁশের মাচান বানিয়ে তাতে শুয়ে থাকে, আকাশ দেখে, ভাবে। তার এই আলস্যের ক্ষতিপূরণ করে তার স্ত্রী গুলনেহার। সে সুহাসিনী গ্রামের মিঞাবাড়ির আবদুল কাদের মিঞার বাড়িতে কাজ করে। এই বৃদ্ধ আবদুল কাদের মিঞা আবার ফজুর পৈতৃক জমি আত্মসাৎ করে বসে আছে। তবু তাকে মেনেই চলতে হয় ফজুর। তার সাথে হাঁটতে বের হয় মাঝেমাঝে। ফজুকে এমন নির্ভার, স্বস্তিতে কর্মহীন দেখে তার বিরক্ত লাগে। এমনকি ভয় হয় ফজুর অকর্মণ্যতা সংক্রামিত হয়ে তার মধ্যেও ঢুকে পড়ে কিনা। সে অকারণেই ফজুকে খাটাতে চায়, যেভাবেই পারে। অন্যদিকে তার বাসায় যে কাজ করে গুলনেহার, তার দিকে ক্রমেই তার বদনজর ঘনিয়ে উঠতে থাকে। ওদিকে বেহাত জমি নিয়ে ফজু ও কাদের মিঞার তর্কাতর্কি। প্রাণের সংশয়। মালিকবর্গের সাথে ফজুর মত ভূমিহীন কৃষকবর্গের বিজয় কী করে হতে পারে? তারপর, জহিরীয় কায়দায় পুনরাবৃত্তি। আবর্তিত হতে হতে ঘটনার চূড়ান্তির দিকে ধেয়ে যাওয়া।     

উৎসব | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস | ১৯৭৬ 

ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর– এর দ্বিতীয় গল্প।  ইলিয়াস ছিলেন প্রখর শ্রেণি ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তার প্রথম গল্পগ্রন্থেই সেই শ্রেণি-সচেতনতার প্রকাশ পেয়েছে। বড়লোক বন্ধুর বৌ-ভাতের দাওয়াত খাওয়ার পর ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরেন আনোয়ার আলি। ধানমণ্ডির ঝলমলে, আলিশান বাড়ি থেকে ফিরে সে মুখোমুখি হয় নিজ পাড়ার নোংরা গলির। এমনিতে তো এইখানেই সে থাকে, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ারই কথা এতদিনে। কিন্তু ধানমণ্ডির সেই প্রাসাদের সুখস্মৃতির বিপরীতে নিজের এই বিশ্রী বাসস্থান তার মনে বিরক্তি জাগায়। কোথায় ধানমণ্ডির প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা, আর কোথায় তার বাড়ির এই ঘুপচি গলি যার প্রবেশমুখেই নালা-নর্দমায় গু ভাসতে দেখা যায়! সেসব এলাকার সুরুচিপূর্ণ, তন্বী রূপসীদের তুলনায় তার হোঁৎকা গেঁয়ো স্ত্রী’র দিকে তো তাকানোই যায় না। এমনকি ধনীদের কুকুরেরাও শ্রদ্ধার দাবিদার তার কাছে। সে বলে, ‘কুকুর কি আর ওদিকে নেই? ওদিকেও আছে। বিয়ে বাড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। কি গম্ভীর তাঁর মুখ, কি তাঁর চেহারা!’ একদম চন্দ্রবিন্দু সমেত, ‘তাঁর’। কী সশ্রদ্ধ সম্বোধন!    
বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে ধনী, সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। প্রতিমুহূর্তে সে তাদের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করে। বন্ধুদের সুন্দরী স্ত্রী’দের সাথে কথা বলতে বেগ পেতে থাকে। খুব স্বাভাবিক কথাও মাথার মধ্যে হাজারবার সাজিয়েও বলে উঠতে পারে না সে। এবং এসবের মধ্যেই সে ভালোমত দেখে নিতে থাকে তাদের শরীর। স্মৃতিতে ছাপিয়ে নিতে থাকে। পরে, রাতে, কাজে দেবে। কিন্তু রাতে ঘরে ফেরার পর, এলাকার জঘন্য পরিবেশ, চারপাশের অশ্লীল গান-বাজনা, নিজের পরিবার সবকিছুর উপর বিতৃষ্ণ হয়ে কিছুতেই নিজের স্ত্রী’র প্রতি মনকে জাগাতে পারেন না আনোয়ার আলি। স্মৃতি হাতড়ে ধানমণ্ডির রূপসীদেরকেও স্মরণে আনতে পারেন না একদম। শেষমেষ যা হয়, তা একমাত্র ইলিয়াসের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব।

তৃতীয় পুরুষের বয়ানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গল্পে আনোয়ার আলির মগজে ঢুঁ মেরে মেরে আপাত-গড়পড়তা একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের অভাবনীয় ভাঁজ খুলে দেখান। মধ্যবিত্তের জীবনের অবদমন, হীনম্মন্যতা ও আত্মঘৃণার স্বরূপ কী অভাবনীয় রূপে পেশ করা যায়, তারই এক চমৎকার নজির এই গল্প।  

পাদটীকা | সৈয়দ মুজতবা আলী | ১৯৫২ 

মুজতবা আলীর বিখ্যাত চাচা কাহিনী গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত।  সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বভাবসুলভ বৈঠকি ভঙ্গির গল্প। হাস্যরসে চলতে চলতে গল্পের একদম শেষ লাইনে এসে পাঠককে চমকে দেওয়া এক গভীর দুঃখবোধ। গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। 

এই হলো গল্পের শুরুর লাইন। গত শতক বলতে উনিশ শতক, এই শতক বলতে বিশ শতক। সুরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী যে মড়কের কথা বললেন, তা শারীরিক কোনো রোগ নয়। রাজনৈতিক রোগ! 

ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে যে মোগল যুগ ছিলো, তাতে মুসলিমরা শিক্ষা নিত মক্তবে, হিন্দুরা টোলে। ইংরেজ আমলে ইংরেজি স্কুলে শিক্ষার যে জয়জয়কার, তার কারণ স্পষ্ট। ওটা শিখেই তো দুটো করে খাওয়া যাবে! তাই পণ্ডিতমশাইদের অবস্থা মড়ক লাগার মতোই। যারা গেছেন তো গেছেন, যারা আছেন, স্কুলে এক্কেবারে পেটেভাতে আছেন। 

এই গল্পেও একজন পণ্ডিতমশাই আছেন। আর লেখক এখানে নাম ভূমিকায়, পণ্ডিতমশাইয়ের প্রিয় ছাত্রদের একজন। হুট করে স্কুলে খবর এল, লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। কী সর্বনেশে কথা! হেডমাস্টার সাহেবের খিটখিটে মেজাজে তখন ছাত্র-শিক্ষক সবার অবস্থা ভাজাভাজা! আর যেদিন লাটসাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন, আলী সাহেবের ভাষায়, ‘হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চড়কিবাজীর মতন তুর্কি-নাচন নাচছেন। যেদিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার। নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ ভাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব কজনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।’

গল্পের এই পণ্ডিতমশাই বাংলা সাহিত্যিপ্রেমীদের মনে অক্ষয় হয়ে থাকবেন কয়েকটা কারণে। তার একটিও পণ্ডিতমশাইয়ের সংস্কৃতিতে দক্ষতার জন্য নয়। প্রথম কারণটা হলো উর্ধাঙ্গে বস্ত্রে অনভ্যস্ততা। এখন লাটসাহেব মানী মানুষ, তার সামনে তো খালি গায়ে থাকা যায় না! অতএব পণ্ডিতমশাই হলুদ গেঞ্জি কিনলেন, যেহেতু শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে সেলাই ছাড়া জামা পরতে হবে। অনভ্যস্ততার ফোঁটা যেমন কপালে চড়চড় করে, পণ্ডিতমশাইয়েরও তাই হলো। এরমাঝেই লাটসাহেব আসলেন, পণ্ডিতমশাইয়ের গায়ে গেঞ্জি পরার চুলকুনি হলো, লাটসাহেব হালকা নড করায় পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভাবোল্লাস হলো, ঘটনাপ্রবাহে আরও অনেককিছুই হলো। ভাবগতিকে মনে হচ্ছিলো লাটসাহেবের সাথে পণ্ডিতমশাইয়ের সাক্ষাতই এই গল্পের মূল আলোচ্য। 

কিন্তু দিনদুয়েক পর পণ্ডিতমশাই নিয়ে আসলেন এক্কেবারে নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে। কোথায় কোন ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছেন লাটসাহেবের নানা গল্প, লাটসাহেবের কুকুরের গল্প। হ্যাঁ, লাটসাহেবের কুকুরও ছিল একটা। তিনঠ্যাঙে কুকুর। পণ্ডিতমশাই হুট করেই তার প্রিয় ছাত্রকে আঁক কষতে দিলেন একটা। আলী সাহেবের ভাষায় আবার যাওয়া যাক, ‘‘বেশ বেশ! তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’

আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’

তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?’

আমি হতবাক। 

‘বল না।’

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’

শুধু সেদিন না, এই সময়ে এসেও যেন পণ্ডিতমশাইরা হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দে!

পুরো জাতি তখন থাকে নিস্তব্ধ, ঠিক সেদিনের সেই ক্লাসরুমটার মতো। 

প্রাগৈতিহাসিক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৯৩৭ 

‘অতসী মামী’ গল্পের মাধ্যমে সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদার্পণ ঘটলেও “সিরিয়াস সাহিত্যিক” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটার দ্বারাই। নামেই আভাস পাওয়া যায়, মানিক এই গল্পে ডিল করতে চাচ্ছেন মানুষের ভিতরকার আদিম এক অন্ধকার নিয়ে। অন্ধকার শব্দটা মানিকের খুব প্রিয়। এই অন্ধকারেরই মূর্তায়ন হলো গল্পটার প্রধান চরিত্র ভিখু। খুনাখুনি, ডাকাতি, রক্তপাত কোনোকিছুতেই ভিখুর হাত কাঁপে না। কাঁপে না কারণ, যেকোনো মূল্যে সে টিকে থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকার জন্যে যদি এসবই করতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এই বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন কাঁধে দগদগে ঘা নিয়ে, পলাতক অবস্থায় বনের গহীনে জোঁক-মশা-শেয়ালের উৎপাতেও সে মরতে রাজি হয় না। ‘মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।’ 

অথচ যার সাহায্যে এই টিকে থাকা তার জন্য সহজ হয়, তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতেও তার কোনো সমস্যা হয় না। তারপর সে পালিয়ে বেড়ায়। রোগে শীর্ণ এক বাহুকে পুঁজি করে ভিক্ষুক হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করে অপর এক অঞ্চলে। বিনয়ই ভিক্ষুকের ভূষণ। ফলে ভিক্ষা কম পেলে, বা পথচারীর কোনো আচরণে তাদেরকে গালি দেয়ার, বা তাদের উপর হামলে পড়ার ইচ্ছা অনেক কষ্ট করে দমন করে সে। এমন সময় দেখা হয় পাঁচীর সাথে। একই পথের মুসাফির তারা। পাঁচীর পায়ে একটা ঘা। সেটা সারানো দুঃসাধ্য কিছু না, কিন্তু এই ঘায়ের বদৌলতেই ভিক্ষুক হিসেবে তার আয়টা হয়। তাই এই ঘা’টাকেই সে পরম যত্নে লালন করে, জিইয়ে রাখে। ভিখু এই পাঁচীর সাথে খাতির জমাতে যায়, চায় তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তারপর, সেই প্রাগৈতিহাসিক দ্বন্দ্ব: যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধ, যেকোনো একজনের বিজয় ও অপরজনের মৃত্যু, এবং বিজয়ীর নারীলাভ। কিন্তু, যেই ভিখু এত হিংস্র, এত মারমুখী, তার মনে কি কোমলতারও কোনো জায়গা আছে? সে কি ভালোবাসতেও পারে? এমন একটা প্রশ্ন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঝুলিয়ে দেন আমাদের সামনে। যেভাবে পাঁচী নিজের শরীরের ক্ষতের কারণে লাভবান হয়, ফলে তা সারাতেও চায় না, একইভাবে হয়তো সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই কিছু মানুষ নিজেদের অন্তরের ক্ষত, বা মানিকের ভাষায়, তাদের ভিতরকার অন্ধকারকে জিইয়ে রাখে, লালন করতে থাকে। এবং, সময়মত, উত্তরাধিকারে পাওয়া এই অন্ধকার সে চালান করে দেয় পরের প্রজন্মে। 

টোপ | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় | ১৯৪৫

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সিরিয়াস সাহিত্য ও সরস সাহিত্যের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। অত্যন্ত রসিক, উইটি এই লেখকের অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘টোপ’। শুরুতে হাল্কা খেলাচ্ছলে ও হাস্যরসপূর্ণ ভঙ্গিতে গল্পটা বলা হতে থাকে, কিন্তু আস্তে-আস্তে অসাধারণ ধৈর্য ও নৈপুণ্যের সাথে গল্পটার ভেতরকার অন্ধকার প্রকাশিত হয় পাঠকের নজরে।   

কাহিনীর শুরু কথকের দুয়ারে বাঘের চামড়ার একজোড়া জুতা হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে। জুতাজোড়া পাঠিয়েছেন রাজাবাহাদুর। কে এই রাজাবাহাদুর? অতীতচারণ করে সে গল্পই বলতে শুরু করে কথক। রামগড় জমিদারি এস্টেটের মালিক এন. আর. চৌধুরী তথা রাজাবাহাদুরের সাথে পরিচয় হয় গল্পের কথকের, যিনি একজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও কবি। রাজাবাহাদুরের সম্মানে তিনি একটা প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে দেন। ফলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক বলতে, রাজা ও প্রজার মধ্যে যে সম্পর্ক আরকি। সে যাই হোক, একজন জমিদারের সাথে খাতির জমানোর সুযোগ পেয়ে গল্পের কথকও খুশিই হন। ঘটনাক্রমে একসময় জমিদারের তরফ থেকে একসাথে শিকারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সব কাজকর্ম ফেলে তিনি রওনা দেন। একটা আলিশান রোলস রয়েস গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বনমধ্যে জমিদারের বিরাট বাংলোতে। সেখানে গোসল, খানাপিনা শেষে রাজাবাহাদুর নিজের আগ্নেয়াস্ত্রের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ কথককে দেখিয়ে গর্ব করেন, খানিকটা টিটকারিও মারেন। এরপরেই আসে শিকারের পালা। এই শিকার তো আসলে তার পৌরুষ ও সাহসিকতারই দাম্ভিক প্রদর্শন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি গাড়ির মধ্যে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি করেই ঘায়েল করতে থাকেন পশু-পাখি। বড় কোনো শিকার না পেয়ে তিরিক্ষি মেজাজে দু-একটা বনমুরগিই মেরে ফেলেন তিনি। এবং সে মুরগি তিনি ঘরেও তোলেন না। অর্থাৎ, এই শিকার থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল নিজের বিক্রম প্রকাশের, একটা কিছু মেরে ফেলার আনন্দ ছাড়া। 

কিছুদিন পর কথক নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলেও রাজাবাহাদুর তাকে নিজের বীরত্বের সম্পূর্ণ পরিসরটুকু না দেখিয়ে ছাড়বেন না। হুকুমের সুরে বলেন আরেক রাত থেকে যেতে। সেই রাতে বিশাল এক টোপ দিয়ে রাজাবাহাদুর একটা মাছ ধরবেন বলে জানানো হয়। কপিকল দিয়ে সেই টোপ নিচে এক নদীর ধারে নামানো হয় আর তখনই ভয়াল গর্জনে লাফ দিয়ে ওঠে একটা বাঘ, আর সাথে-সাথে এক গুলিতে তাকে ঘায়েল করে ফেলেন রাজাবাহাদুর। তিনি যে বীরোত্তম বীর, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। মাছটা তাহলে বাঘ, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু টোপটা কী ছিল? এর উত্তরে আমাদের সামনে যা উন্মোচিত হয় তাতে এক পলকে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। সামন্তবর্গের স্বেচ্ছাচার, নিপীড়নের এক অমোঘ নজির হয়ে দাঁড়ায় গল্পটা। 

আত্মজা ও করবী গাছ | হাসান আজিজুল হক | ১৯৬৭

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও করবী গাছ সে সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল। সেই গ্রন্থের নামগল্পই আমাদের আলোচ্য। গল্পটির মূল পটভূমি হলো দেশভাগের পরবর্তী প্রান্তিক মানুষের জীবন। হাসান আজিজুল হক নিজে একবার বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ আমার জীবনের জন্য একটা ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়। আমি এই দাগের অনুধাবন করার চেষ্টা করছি।’ এই গল্পটিও যেন সেই ক্ষত থেকেই উৎসারিত। এক বৃদ্ধ পিতা ও উচ্ছন্নে যাওয়া তিন ছেলের কথোপকথনের মধ্যে আনাগোনার মাধ্যমে আগাতে থাকে গল্পটা। পরিপার্শ্বের বিভিন্ন খুঁটিনাটির অপরূপ বর্ণনা ও আবহনির্মাণে এমনই এক মায়ার চাদর ঝুলিয়ে দেন চোখের সামনে, যে গল্পটার অভ্যন্তরীণ নির্মম বাস্তবতাটা টের পেতে একটু সময়ই লেগে যায় আমাদের। মূলত, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে বাস করছেন গল্পের বৃদ্ধ সেই পিতা। এমন অবস্থায় নিজের ও পরিবারের পেট চালানোর জন্য নিজের কন্যাকে উপজীব্য করে যেভাবে তিনি নিজের ও পরিবারের পেট চালান এবং তার ফলে সেই বৃদ্ধের মধ্যে জন্ম নেয়া অসহায় এক আত্মগ্লানিকে এত অদ্ভুতভাবে তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক যে অবাক হতে হয়। ক্রোধের বদলে ততক্ষণে জায়গা করে নিয়েছে একটা অক্ষম আত্মবিনাশী আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন তিনি একটা করবীগাছে পানি দিয়ে সেটাকে বড় করে তুলছেন, আদতে যা নিজের মৃত্যুরই আয়োজন। গোটা গল্প যে অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাওয়া হতে থাকে, যে ক্রোধ ও কান্না ঘনীভূত হয়ে জমে ছিল এতক্ষণ, শেষ বাক্যে এসে সবটুকু যেন একদম ফেটে পড়ে — এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? 

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।