সেমসেম সেরা ৭ বাংলা ছোটগল্প 

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণ: সামিউল

 
[ বাংলা ভাষার অজস্র ছোটগল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠতাভিত্তিক কোনো ক্রম তৈরি করা আদৌ এই তালিকার উদ্দেশ্য না। বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের ইতিহাসমোটামুটি দুইশ বছরের। এই দুইশ বছরে বিষয় ও প্রকরণে এত বিচিত্র ও অসাধারণ সব গল্প লিখিত হয়েছে এই ভাষায়, যে তা মাত্র সাতটায় নামিয়ে আনা অসম্ভবই। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, অসংখ্য চমৎকার লেখক ও ছোটগল্প বাদ থেকেই যাবে। তাও, তালিকা বানানোর দস্তুরমত ‘সেরা’ অভিধাটা শিরোনামে ব্যবহার করতেই হলো। পাঠক বুঝে নেবেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই ভাষাটাকে আরো সমৃদ্ধকারী কিছু লেখক ও তাদের লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াসন্ধানী পাঠকের জন্য এই তালিকাটা তাদের পাঠের কেবল শুরুয়াত হবে, সেই আশায়।     
    

এছাড়া প্রচ্ছন্ন একটা থিমকে কেন্দ্র করে তালিকায় গল্পগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত সাতটি গল্পেই দেখা যাবে প্রধান চরিত্র বা প্রটাগনিস্টরা প্রান্তজন। ‘চোখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র, যার বয়ানে গল্পটা আমরা শুনি, একজন ডাকাত। তিনি ধরা পড়েছেন, মানুষ তার কী ভয়াবহ বিচার করবে তা দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন। ‘পাদটীকা’ গল্পটা আমাদের বলে সর্বগ্রাসী উপনিবেশের কবলে বিলুপ্তির মুখে আমাদের নিজস্ব এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা। কিংবা শহীদুল জহিরের ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পে আমরা দেখতে পাই এই প্রচণ্ড কর্মব্যস্ত দুনিয়ায় একজন জাত অকর্মণ্য অলসের কী দশা হতে পারে।    
আমরা মনে করি, ভালো গল্পের ‘স্পয়লার’ বলতে কিছু হয় না। একটা গল্প কেবল ঘটনাপরম্পরা দিয়ে তৈরি হয় না, কোনো টুইস্টের উপরেও নির্ভরশীল হয় না। তাও, গল্পগুলো প্রধান চমক বাতলে না দিয়ে যতটুকু বর্ণনা পাঠককে আগ্রহী করতে পারবে ততটুকুই খোলাসা করে বলার চেষ্টা করেছি। এবার একটু পড়ে দেখুন, নিজের পছন্দের কোনো গল্প খুঁজে পেয়ে গদগদ হতে পারেন কিনা। বা কোন অসাধারণ লেখককে নজরআন্দাজ করে যাওয়ার অপরাধে রাগও ঝাড়তে পারেন। পাঠকের যা মর্জি।  —-সেমসেম ডেস্ক]  

চোখ | হুমায়ূন আহমেদ | ১৯৯৪

‘নয়ন কখন তুলবেন?’
এরকম আপাত সরল কিন্তু বিস্ফোরক বাক্য শুধু বাংলা না, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদের ওস্তাদি উপন্যাসের চেয়েও বেশি। খুব অল্প পরিসরে, অল্প কথায় চরিত্রায়ন ও হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে গভীর মানবিক দিকগুলো আপাত হাস্যরসের পোশাকে উঠে আসে। একজন ডাকাত বসে বসে অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ তোলা হবে। তাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী। আছরের পর তার চোখ তোলা হবে। বেশ একটা উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে গোটা গ্রাম জুড়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও হাজির হচ্ছেন একে একে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলা হবে। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। কেউ এই দৃশ্য মিস করতে চায় না। নিতসের মতে, মানুষের সকল উৎসবের গভীরে একপ্রকার নৃশংসতা লুকানো থাকে। এই গল্পে খেলাচ্ছলে যেভাবে নিষ্ঠুরতাকে উদযাপন করতে দেখা যায় তা সেই উক্তিরই সম্প্রসারণ। ‘গ্রামের মানুষ খুব সহজ-সরল, নিষ্পাপ হয়’ এ-জাতীয় মুখস্থ ধারণা পোষণকারীরা এ গল্পের সামনে এসে একটা ধাক্কা খাবেন। মানুষ একমাত্রিক না; মানুষ জটিল, বহুমাত্রিক। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এ কথা বারবার প্রমাণিত হয়। আর যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই মতি ডাকাত নির্লিপ্তভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে তাকে ঘিরে ধরা উন্মত্ত জনতাকে, বোঝার চেষ্টা করে মবের মতিগতি। সে বোঝার চেষ্টা করে আসলেই তার চোখ তুলে ফেলা হবে কিনা। তাকে ধরে এনেছে যেই হাসান আলী, সে রসিয়ে সবার কাছে নিজের বীরত্বের গল্প করে শোনায়। গল্পে প্রতিবার নতুন শাখা-প্রশাখা যুক্ত হতে থাকে। মতি নিজেই সে গল্প আগ্রহ নিয়ে শোনে। যে গল্পের উপজীব্য, সে-ই শ্রোতা হয়ে উঠছে।  রোমন্থন করতে চোখ লাগে না, তাই সে স্মৃতি হাতড়ায়। ডাকাতের জীবনে ভালোবাসা কীভাবে আসে, আবার কীভাবে চলে যায়? ঘোর ভেঙে সে দেখে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, যেই ইদরিস আলী তার চোখ তুলবে সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। মানুষের চোখে সে জন্তু হয়ে ওঠে। সে ভয় পায়। তার চোখ কি আসলেই তুলে ফেলা হবে? সে জানে নিষ্ঠুরতার মত মানুষের মনে মমতাও জাগে অকস্মাৎ, অচিন উৎস থেকে। সে অপেক্ষা করে সেখানে কারো মধ্যে মমতা জাগার।  
চোখ গল্পটি পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের ‘এই আমি’ গ্রন্থে।    

কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায় | শহীদুল জহির  

শহীদুল জহিরের গল্পের প্লট ধরে আলোচনা করা মুশকিল। কারণ তার গল্পের মূল মজা গল্পটা বলার কায়দায়। কেবল ভঙ্গিমার জোরে নিতান্ত স্বাভাবিক একটা কাহিনিকেও জহির মনোহর করে তুলতে পারেন। তার কৌতূহলজাগানিয়া লেখার সিগনেচার স্টাইল, চাপা উইট সবই ধরা টের পাওয়া যাবে এই গল্পে।   

গল্পটা ফৈজুদ্দিন ওরফে ফজুকে কেন্দ্র করে। সে একজন দরিদ্র কৃষক। তার মত আর দশটা ভূমিহীন কৃষকের মত সেও রোগা, টিঙটিঙা। ব্যতিক্রম হলো, সে একজন পিপুফিশু, অর্থাৎ অলস। এবং অলস বলেই একটু দার্শনিক গোছের। স্বাভাবিক। আলস্যযাপী না হলে চিন্তা করার ফুরসৎ কীভাবেই বা পাওয়া যাবে? বউ তাকে কাজ করতে তাগাদা দিলে সে বলে, কাজ করে তো তার আর জমিদার হওয়া হবে না, লাভ কী? তাই সে ভিটার সামনে একটা বিচিকলা ঝোপের পাশে একটা বাঁশের মাচান বানিয়ে তাতে শুয়ে থাকে, আকাশ দেখে, ভাবে। তার এই আলস্যের ক্ষতিপূরণ করে তার স্ত্রী গুলনেহার। সে সুহাসিনী গ্রামের মিঞাবাড়ির আবদুল কাদের মিঞার বাড়িতে কাজ করে। এই বৃদ্ধ আবদুল কাদের মিঞা আবার ফজুর পৈতৃক জমি আত্মসাৎ করে বসে আছে। তবু তাকে মেনেই চলতে হয় ফজুর। তার সাথে হাঁটতে বের হয় মাঝেমাঝে। ফজুকে এমন নির্ভার, স্বস্তিতে কর্মহীন দেখে তার বিরক্ত লাগে। এমনকি ভয় হয় ফজুর অকর্মণ্যতা সংক্রামিত হয়ে তার মধ্যেও ঢুকে পড়ে কিনা। সে অকারণেই ফজুকে খাটাতে চায়, যেভাবেই পারে। অন্যদিকে তার বাসায় যে কাজ করে গুলনেহার, তার দিকে ক্রমেই তার বদনজর ঘনিয়ে উঠতে থাকে। ওদিকে বেহাত জমি নিয়ে ফজু ও কাদের মিঞার তর্কাতর্কি। প্রাণের সংশয়। মালিকবর্গের সাথে ফজুর মত ভূমিহীন কৃষকবর্গের বিজয় কী করে হতে পারে? তারপর, জহিরীয় কায়দায় পুনরাবৃত্তি। আবর্তিত হতে হতে ঘটনার চূড়ান্তির দিকে ধেয়ে যাওয়া।     

উৎসব | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস | ১৯৭৬ 

ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর– এর দ্বিতীয় গল্প।  ইলিয়াস ছিলেন প্রখর শ্রেণি ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তার প্রথম গল্পগ্রন্থেই সেই শ্রেণি-সচেতনতার প্রকাশ পেয়েছে। বড়লোক বন্ধুর বৌ-ভাতের দাওয়াত খাওয়ার পর ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরেন আনোয়ার আলি। ধানমণ্ডির ঝলমলে, আলিশান বাড়ি থেকে ফিরে সে মুখোমুখি হয় নিজ পাড়ার নোংরা গলির। এমনিতে তো এইখানেই সে থাকে, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ারই কথা এতদিনে। কিন্তু ধানমণ্ডির সেই প্রাসাদের সুখস্মৃতির বিপরীতে নিজের এই বিশ্রী বাসস্থান তার মনে বিরক্তি জাগায়। কোথায় ধানমণ্ডির প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা, আর কোথায় তার বাড়ির এই ঘুপচি গলি যার প্রবেশমুখেই নালা-নর্দমায় গু ভাসতে দেখা যায়! সেসব এলাকার সুরুচিপূর্ণ, তন্বী রূপসীদের তুলনায় তার হোঁৎকা গেঁয়ো স্ত্রী’র দিকে তো তাকানোই যায় না। এমনকি ধনীদের কুকুরেরাও শ্রদ্ধার দাবিদার তার কাছে। সে বলে, ‘কুকুর কি আর ওদিকে নেই? ওদিকেও আছে। বিয়ে বাড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। কি গম্ভীর তাঁর মুখ, কি তাঁর চেহারা!’ একদম চন্দ্রবিন্দু সমেত, ‘তাঁর’। কী সশ্রদ্ধ সম্বোধন!    
বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে ধনী, সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। প্রতিমুহূর্তে সে তাদের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করে। বন্ধুদের সুন্দরী স্ত্রী’দের সাথে কথা বলতে বেগ পেতে থাকে। খুব স্বাভাবিক কথাও মাথার মধ্যে হাজারবার সাজিয়েও বলে উঠতে পারে না সে। এবং এসবের মধ্যেই সে ভালোমত দেখে নিতে থাকে তাদের শরীর। স্মৃতিতে ছাপিয়ে নিতে থাকে। পরে, রাতে, কাজে দেবে। কিন্তু রাতে ঘরে ফেরার পর, এলাকার জঘন্য পরিবেশ, চারপাশের অশ্লীল গান-বাজনা, নিজের পরিবার সবকিছুর উপর বিতৃষ্ণ হয়ে কিছুতেই নিজের স্ত্রী’র প্রতি মনকে জাগাতে পারেন না আনোয়ার আলি। স্মৃতি হাতড়ে ধানমণ্ডির রূপসীদেরকেও স্মরণে আনতে পারেন না একদম। শেষমেষ যা হয়, তা একমাত্র ইলিয়াসের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব।

তৃতীয় পুরুষের বয়ানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গল্পে আনোয়ার আলির মগজে ঢুঁ মেরে মেরে আপাত-গড়পড়তা একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের অভাবনীয় ভাঁজ খুলে দেখান। মধ্যবিত্তের জীবনের অবদমন, হীনম্মন্যতা ও আত্মঘৃণার স্বরূপ কী অভাবনীয় রূপে পেশ করা যায়, তারই এক চমৎকার নজির এই গল্প।  

পাদটীকা | সৈয়দ মুজতবা আলী | ১৯৫২ 

মুজতবা আলীর বিখ্যাত চাচা কাহিনী গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত।  সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বভাবসুলভ বৈঠকি ভঙ্গির গল্প। হাস্যরসে চলতে চলতে গল্পের একদম শেষ লাইনে এসে পাঠককে চমকে দেওয়া এক গভীর দুঃখবোধ। গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। 

এই হলো গল্পের শুরুর লাইন। গত শতক বলতে উনিশ শতক, এই শতক বলতে বিশ শতক। সুরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী যে মড়কের কথা বললেন, তা শারীরিক কোনো রোগ নয়। রাজনৈতিক রোগ! 

ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে যে মোগল যুগ ছিলো, তাতে মুসলিমরা শিক্ষা নিত মক্তবে, হিন্দুরা টোলে। ইংরেজ আমলে ইংরেজি স্কুলে শিক্ষার যে জয়জয়কার, তার কারণ স্পষ্ট। ওটা শিখেই তো দুটো করে খাওয়া যাবে! তাই পণ্ডিতমশাইদের অবস্থা মড়ক লাগার মতোই। যারা গেছেন তো গেছেন, যারা আছেন, স্কুলে এক্কেবারে পেটেভাতে আছেন। 

এই গল্পেও একজন পণ্ডিতমশাই আছেন। আর লেখক এখানে নাম ভূমিকায়, পণ্ডিতমশাইয়ের প্রিয় ছাত্রদের একজন। হুট করে স্কুলে খবর এল, লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। কী সর্বনেশে কথা! হেডমাস্টার সাহেবের খিটখিটে মেজাজে তখন ছাত্র-শিক্ষক সবার অবস্থা ভাজাভাজা! আর যেদিন লাটসাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন, আলী সাহেবের ভাষায়, ‘হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চড়কিবাজীর মতন তুর্কি-নাচন নাচছেন। যেদিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার। নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ ভাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব কজনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।’

গল্পের এই পণ্ডিতমশাই বাংলা সাহিত্যিপ্রেমীদের মনে অক্ষয় হয়ে থাকবেন কয়েকটা কারণে। তার একটিও পণ্ডিতমশাইয়ের সংস্কৃতিতে দক্ষতার জন্য নয়। প্রথম কারণটা হলো উর্ধাঙ্গে বস্ত্রে অনভ্যস্ততা। এখন লাটসাহেব মানী মানুষ, তার সামনে তো খালি গায়ে থাকা যায় না! অতএব পণ্ডিতমশাই হলুদ গেঞ্জি কিনলেন, যেহেতু শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে সেলাই ছাড়া জামা পরতে হবে। অনভ্যস্ততার ফোঁটা যেমন কপালে চড়চড় করে, পণ্ডিতমশাইয়েরও তাই হলো। এরমাঝেই লাটসাহেব আসলেন, পণ্ডিতমশাইয়ের গায়ে গেঞ্জি পরার চুলকুনি হলো, লাটসাহেব হালকা নড করায় পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভাবোল্লাস হলো, ঘটনাপ্রবাহে আরও অনেককিছুই হলো। ভাবগতিকে মনে হচ্ছিলো লাটসাহেবের সাথে পণ্ডিতমশাইয়ের সাক্ষাতই এই গল্পের মূল আলোচ্য। 

কিন্তু দিনদুয়েক পর পণ্ডিতমশাই নিয়ে আসলেন এক্কেবারে নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে। কোথায় কোন ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছেন লাটসাহেবের নানা গল্প, লাটসাহেবের কুকুরের গল্প। হ্যাঁ, লাটসাহেবের কুকুরও ছিল একটা। তিনঠ্যাঙে কুকুর। পণ্ডিতমশাই হুট করেই তার প্রিয় ছাত্রকে আঁক কষতে দিলেন একটা। আলী সাহেবের ভাষায় আবার যাওয়া যাক, ‘‘বেশ বেশ! তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’

আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’

তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?’

আমি হতবাক। 

‘বল না।’

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’

শুধু সেদিন না, এই সময়ে এসেও যেন পণ্ডিতমশাইরা হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দে!

পুরো জাতি তখন থাকে নিস্তব্ধ, ঠিক সেদিনের সেই ক্লাসরুমটার মতো। 

প্রাগৈতিহাসিক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৯৩৭ 

‘অতসী মামী’ গল্পের মাধ্যমে সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদার্পণ ঘটলেও “সিরিয়াস সাহিত্যিক” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটার দ্বারাই। নামেই আভাস পাওয়া যায়, মানিক এই গল্পে ডিল করতে চাচ্ছেন মানুষের ভিতরকার আদিম এক অন্ধকার নিয়ে। অন্ধকার শব্দটা মানিকের খুব প্রিয়। এই অন্ধকারেরই মূর্তায়ন হলো গল্পটার প্রধান চরিত্র ভিখু। খুনাখুনি, ডাকাতি, রক্তপাত কোনোকিছুতেই ভিখুর হাত কাঁপে না। কাঁপে না কারণ, যেকোনো মূল্যে সে টিকে থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকার জন্যে যদি এসবই করতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এই বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন কাঁধে দগদগে ঘা নিয়ে, পলাতক অবস্থায় বনের গহীনে জোঁক-মশা-শেয়ালের উৎপাতেও সে মরতে রাজি হয় না। ‘মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।’ 

অথচ যার সাহায্যে এই টিকে থাকা তার জন্য সহজ হয়, তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতেও তার কোনো সমস্যা হয় না। তারপর সে পালিয়ে বেড়ায়। রোগে শীর্ণ এক বাহুকে পুঁজি করে ভিক্ষুক হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করে অপর এক অঞ্চলে। বিনয়ই ভিক্ষুকের ভূষণ। ফলে ভিক্ষা কম পেলে, বা পথচারীর কোনো আচরণে তাদেরকে গালি দেয়ার, বা তাদের উপর হামলে পড়ার ইচ্ছা অনেক কষ্ট করে দমন করে সে। এমন সময় দেখা হয় পাঁচীর সাথে। একই পথের মুসাফির তারা। পাঁচীর পায়ে একটা ঘা। সেটা সারানো দুঃসাধ্য কিছু না, কিন্তু এই ঘায়ের বদৌলতেই ভিক্ষুক হিসেবে তার আয়টা হয়। তাই এই ঘা’টাকেই সে পরম যত্নে লালন করে, জিইয়ে রাখে। ভিখু এই পাঁচীর সাথে খাতির জমাতে যায়, চায় তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তারপর, সেই প্রাগৈতিহাসিক দ্বন্দ্ব: যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধ, যেকোনো একজনের বিজয় ও অপরজনের মৃত্যু, এবং বিজয়ীর নারীলাভ। কিন্তু, যেই ভিখু এত হিংস্র, এত মারমুখী, তার মনে কি কোমলতারও কোনো জায়গা আছে? সে কি ভালোবাসতেও পারে? এমন একটা প্রশ্ন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঝুলিয়ে দেন আমাদের সামনে। যেভাবে পাঁচী নিজের শরীরের ক্ষতের কারণে লাভবান হয়, ফলে তা সারাতেও চায় না, একইভাবে হয়তো সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই কিছু মানুষ নিজেদের অন্তরের ক্ষত, বা মানিকের ভাষায়, তাদের ভিতরকার অন্ধকারকে জিইয়ে রাখে, লালন করতে থাকে। এবং, সময়মত, উত্তরাধিকারে পাওয়া এই অন্ধকার সে চালান করে দেয় পরের প্রজন্মে। 

টোপ | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় | ১৯৪৫

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সিরিয়াস সাহিত্য ও সরস সাহিত্যের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। অত্যন্ত রসিক, উইটি এই লেখকের অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘টোপ’। শুরুতে হাল্কা খেলাচ্ছলে ও হাস্যরসপূর্ণ ভঙ্গিতে গল্পটা বলা হতে থাকে, কিন্তু আস্তে-আস্তে অসাধারণ ধৈর্য ও নৈপুণ্যের সাথে গল্পটার ভেতরকার অন্ধকার প্রকাশিত হয় পাঠকের নজরে।   

কাহিনীর শুরু কথকের দুয়ারে বাঘের চামড়ার একজোড়া জুতা হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে। জুতাজোড়া পাঠিয়েছেন রাজাবাহাদুর। কে এই রাজাবাহাদুর? অতীতচারণ করে সে গল্পই বলতে শুরু করে কথক। রামগড় জমিদারি এস্টেটের মালিক এন. আর. চৌধুরী তথা রাজাবাহাদুরের সাথে পরিচয় হয় গল্পের কথকের, যিনি একজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও কবি। রাজাবাহাদুরের সম্মানে তিনি একটা প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে দেন। ফলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক বলতে, রাজা ও প্রজার মধ্যে যে সম্পর্ক আরকি। সে যাই হোক, একজন জমিদারের সাথে খাতির জমানোর সুযোগ পেয়ে গল্পের কথকও খুশিই হন। ঘটনাক্রমে একসময় জমিদারের তরফ থেকে একসাথে শিকারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সব কাজকর্ম ফেলে তিনি রওনা দেন। একটা আলিশান রোলস রয়েস গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বনমধ্যে জমিদারের বিরাট বাংলোতে। সেখানে গোসল, খানাপিনা শেষে রাজাবাহাদুর নিজের আগ্নেয়াস্ত্রের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ কথককে দেখিয়ে গর্ব করেন, খানিকটা টিটকারিও মারেন। এরপরেই আসে শিকারের পালা। এই শিকার তো আসলে তার পৌরুষ ও সাহসিকতারই দাম্ভিক প্রদর্শন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি গাড়ির মধ্যে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি করেই ঘায়েল করতে থাকেন পশু-পাখি। বড় কোনো শিকার না পেয়ে তিরিক্ষি মেজাজে দু-একটা বনমুরগিই মেরে ফেলেন তিনি। এবং সে মুরগি তিনি ঘরেও তোলেন না। অর্থাৎ, এই শিকার থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল নিজের বিক্রম প্রকাশের, একটা কিছু মেরে ফেলার আনন্দ ছাড়া। 

কিছুদিন পর কথক নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলেও রাজাবাহাদুর তাকে নিজের বীরত্বের সম্পূর্ণ পরিসরটুকু না দেখিয়ে ছাড়বেন না। হুকুমের সুরে বলেন আরেক রাত থেকে যেতে। সেই রাতে বিশাল এক টোপ দিয়ে রাজাবাহাদুর একটা মাছ ধরবেন বলে জানানো হয়। কপিকল দিয়ে সেই টোপ নিচে এক নদীর ধারে নামানো হয় আর তখনই ভয়াল গর্জনে লাফ দিয়ে ওঠে একটা বাঘ, আর সাথে-সাথে এক গুলিতে তাকে ঘায়েল করে ফেলেন রাজাবাহাদুর। তিনি যে বীরোত্তম বীর, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। মাছটা তাহলে বাঘ, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু টোপটা কী ছিল? এর উত্তরে আমাদের সামনে যা উন্মোচিত হয় তাতে এক পলকে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। সামন্তবর্গের স্বেচ্ছাচার, নিপীড়নের এক অমোঘ নজির হয়ে দাঁড়ায় গল্পটা। 

আত্মজা ও করবী গাছ | হাসান আজিজুল হক | ১৯৬৭

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও করবী গাছ সে সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল। সেই গ্রন্থের নামগল্পই আমাদের আলোচ্য। গল্পটির মূল পটভূমি হলো দেশভাগের পরবর্তী প্রান্তিক মানুষের জীবন। হাসান আজিজুল হক নিজে একবার বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ আমার জীবনের জন্য একটা ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়। আমি এই দাগের অনুধাবন করার চেষ্টা করছি।’ এই গল্পটিও যেন সেই ক্ষত থেকেই উৎসারিত। এক বৃদ্ধ পিতা ও উচ্ছন্নে যাওয়া তিন ছেলের কথোপকথনের মধ্যে আনাগোনার মাধ্যমে আগাতে থাকে গল্পটা। পরিপার্শ্বের বিভিন্ন খুঁটিনাটির অপরূপ বর্ণনা ও আবহনির্মাণে এমনই এক মায়ার চাদর ঝুলিয়ে দেন চোখের সামনে, যে গল্পটার অভ্যন্তরীণ নির্মম বাস্তবতাটা টের পেতে একটু সময়ই লেগে যায় আমাদের। মূলত, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে বাস করছেন গল্পের বৃদ্ধ সেই পিতা। এমন অবস্থায় নিজের ও পরিবারের পেট চালানোর জন্য নিজের কন্যাকে উপজীব্য করে যেভাবে তিনি নিজের ও পরিবারের পেট চালান এবং তার ফলে সেই বৃদ্ধের মধ্যে জন্ম নেয়া অসহায় এক আত্মগ্লানিকে এত অদ্ভুতভাবে তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক যে অবাক হতে হয়। ক্রোধের বদলে ততক্ষণে জায়গা করে নিয়েছে একটা অক্ষম আত্মবিনাশী আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন তিনি একটা করবীগাছে পানি দিয়ে সেটাকে বড় করে তুলছেন, আদতে যা নিজের মৃত্যুরই আয়োজন। গোটা গল্প যে অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাওয়া হতে থাকে, যে ক্রোধ ও কান্না ঘনীভূত হয়ে জমে ছিল এতক্ষণ, শেষ বাক্যে এসে সবটুকু যেন একদম ফেটে পড়ে — এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।