সেমসেম সেরা ৭ বাংলা ছোটগল্প 

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণ: সামিউল

 
[ বাংলা ভাষার অজস্র ছোটগল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠতাভিত্তিক কোনো ক্রম তৈরি করা আদৌ এই তালিকার উদ্দেশ্য না। বাংলা ভাষায় ছোটগল্পের ইতিহাসমোটামুটি দুইশ বছরের। এই দুইশ বছরে বিষয় ও প্রকরণে এত বিচিত্র ও অসাধারণ সব গল্প লিখিত হয়েছে এই ভাষায়, যে তা মাত্র সাতটায় নামিয়ে আনা অসম্ভবই। যতই চেষ্টা করা হোক না কেন, অসংখ্য চমৎকার লেখক ও ছোটগল্প বাদ থেকেই যাবে। তাও, তালিকা বানানোর দস্তুরমত ‘সেরা’ অভিধাটা শিরোনামে ব্যবহার করতেই হলো। পাঠক বুঝে নেবেন যে, আমাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই ভাষাটাকে আরো সমৃদ্ধকারী কিছু লেখক ও তাদের লেখাপত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়াসন্ধানী পাঠকের জন্য এই তালিকাটা তাদের পাঠের কেবল শুরুয়াত হবে, সেই আশায়।     
    

এছাড়া প্রচ্ছন্ন একটা থিমকে কেন্দ্র করে তালিকায় গল্পগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। নির্বাচিত সাতটি গল্পেই দেখা যাবে প্রধান চরিত্র বা প্রটাগনিস্টরা প্রান্তজন। ‘চোখ’ গল্পের প্রধান চরিত্র, যার বয়ানে গল্পটা আমরা শুনি, একজন ডাকাত। তিনি ধরা পড়েছেন, মানুষ তার কী ভয়াবহ বিচার করবে তা দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন। ‘পাদটীকা’ গল্পটা আমাদের বলে সর্বগ্রাসী উপনিবেশের কবলে বিলুপ্তির মুখে আমাদের নিজস্ব এক শিক্ষাব্যবস্থার কথা। কিংবা শহীদুল জহিরের ‘কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায়’ গল্পে আমরা দেখতে পাই এই প্রচণ্ড কর্মব্যস্ত দুনিয়ায় একজন জাত অকর্মণ্য অলসের কী দশা হতে পারে।    
আমরা মনে করি, ভালো গল্পের ‘স্পয়লার’ বলতে কিছু হয় না। একটা গল্প কেবল ঘটনাপরম্পরা দিয়ে তৈরি হয় না, কোনো টুইস্টের উপরেও নির্ভরশীল হয় না। তাও, গল্পগুলো প্রধান চমক বাতলে না দিয়ে যতটুকু বর্ণনা পাঠককে আগ্রহী করতে পারবে ততটুকুই খোলাসা করে বলার চেষ্টা করেছি। এবার একটু পড়ে দেখুন, নিজের পছন্দের কোনো গল্প খুঁজে পেয়ে গদগদ হতে পারেন কিনা। বা কোন অসাধারণ লেখককে নজরআন্দাজ করে যাওয়ার অপরাধে রাগও ঝাড়তে পারেন। পাঠকের যা মর্জি।  —-সেমসেম ডেস্ক]  

চোখ | হুমায়ূন আহমেদ | ১৯৯৪

‘নয়ন কখন তুলবেন?’
এরকম আপাত সরল কিন্তু বিস্ফোরক বাক্য শুধু বাংলা না, বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ছোটগল্পে হুমায়ূন আহমেদের ওস্তাদি উপন্যাসের চেয়েও বেশি। খুব অল্প পরিসরে, অল্প কথায় চরিত্রায়ন ও হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে গভীর মানবিক দিকগুলো আপাত হাস্যরসের পোশাকে উঠে আসে। একজন ডাকাত বসে বসে অপেক্ষা করছে কখন তার চোখ তোলা হবে। তাকে ঘিরে জড়ো হয়েছে গ্রামবাসী। আছরের পর তার চোখ তোলা হবে। বেশ একটা উৎসবের আবহ তৈরি হয়েছে গোটা গ্রাম জুড়ে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও হাজির হচ্ছেন একে একে। একটা জলজ্যান্ত মানুষের চোখ খেজুর কাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলা হবে। এমন ঘটনা তো রোজ রোজ ঘটে না। কেউ এই দৃশ্য মিস করতে চায় না। নিতসের মতে, মানুষের সকল উৎসবের গভীরে একপ্রকার নৃশংসতা লুকানো থাকে। এই গল্পে খেলাচ্ছলে যেভাবে নিষ্ঠুরতাকে উদযাপন করতে দেখা যায় তা সেই উক্তিরই সম্প্রসারণ। ‘গ্রামের মানুষ খুব সহজ-সরল, নিষ্পাপ হয়’ এ-জাতীয় মুখস্থ ধারণা পোষণকারীরা এ গল্পের সামনে এসে একটা ধাক্কা খাবেন। মানুষ একমাত্রিক না; মানুষ জটিল, বহুমাত্রিক। হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যে এ কথা বারবার প্রমাণিত হয়। আর যাকে ঘিরে এত আয়োজন, সেই মতি ডাকাত নির্লিপ্তভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে তাকে ঘিরে ধরা উন্মত্ত জনতাকে, বোঝার চেষ্টা করে মবের মতিগতি। সে বোঝার চেষ্টা করে আসলেই তার চোখ তুলে ফেলা হবে কিনা। তাকে ধরে এনেছে যেই হাসান আলী, সে রসিয়ে সবার কাছে নিজের বীরত্বের গল্প করে শোনায়। গল্পে প্রতিবার নতুন শাখা-প্রশাখা যুক্ত হতে থাকে। মতি নিজেই সে গল্প আগ্রহ নিয়ে শোনে। যে গল্পের উপজীব্য, সে-ই শ্রোতা হয়ে উঠছে।  রোমন্থন করতে চোখ লাগে না, তাই সে স্মৃতি হাতড়ায়। ডাকাতের জীবনে ভালোবাসা কীভাবে আসে, আবার কীভাবে চলে যায়? ঘোর ভেঙে সে দেখে গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, যেই ইদরিস আলী তার চোখ তুলবে সে তার দিকে তাকাচ্ছেও না। মানুষের চোখে সে জন্তু হয়ে ওঠে। সে ভয় পায়। তার চোখ কি আসলেই তুলে ফেলা হবে? সে জানে নিষ্ঠুরতার মত মানুষের মনে মমতাও জাগে অকস্মাৎ, অচিন উৎস থেকে। সে অপেক্ষা করে সেখানে কারো মধ্যে মমতা জাগার।  
চোখ গল্পটি পাওয়া যাবে হুমায়ূন আহমেদের ‘এই আমি’ গ্রন্থে।    

কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায় | শহীদুল জহির  

শহীদুল জহিরের গল্পের প্লট ধরে আলোচনা করা মুশকিল। কারণ তার গল্পের মূল মজা গল্পটা বলার কায়দায়। কেবল ভঙ্গিমার জোরে নিতান্ত স্বাভাবিক একটা কাহিনিকেও জহির মনোহর করে তুলতে পারেন। তার কৌতূহলজাগানিয়া লেখার সিগনেচার স্টাইল, চাপা উইট সবই ধরা টের পাওয়া যাবে এই গল্পে।   

গল্পটা ফৈজুদ্দিন ওরফে ফজুকে কেন্দ্র করে। সে একজন দরিদ্র কৃষক। তার মত আর দশটা ভূমিহীন কৃষকের মত সেও রোগা, টিঙটিঙা। ব্যতিক্রম হলো, সে একজন পিপুফিশু, অর্থাৎ অলস। এবং অলস বলেই একটু দার্শনিক গোছের। স্বাভাবিক। আলস্যযাপী না হলে চিন্তা করার ফুরসৎ কীভাবেই বা পাওয়া যাবে? বউ তাকে কাজ করতে তাগাদা দিলে সে বলে, কাজ করে তো তার আর জমিদার হওয়া হবে না, লাভ কী? তাই সে ভিটার সামনে একটা বিচিকলা ঝোপের পাশে একটা বাঁশের মাচান বানিয়ে তাতে শুয়ে থাকে, আকাশ দেখে, ভাবে। তার এই আলস্যের ক্ষতিপূরণ করে তার স্ত্রী গুলনেহার। সে সুহাসিনী গ্রামের মিঞাবাড়ির আবদুল কাদের মিঞার বাড়িতে কাজ করে। এই বৃদ্ধ আবদুল কাদের মিঞা আবার ফজুর পৈতৃক জমি আত্মসাৎ করে বসে আছে। তবু তাকে মেনেই চলতে হয় ফজুর। তার সাথে হাঁটতে বের হয় মাঝেমাঝে। ফজুকে এমন নির্ভার, স্বস্তিতে কর্মহীন দেখে তার বিরক্ত লাগে। এমনকি ভয় হয় ফজুর অকর্মণ্যতা সংক্রামিত হয়ে তার মধ্যেও ঢুকে পড়ে কিনা। সে অকারণেই ফজুকে খাটাতে চায়, যেভাবেই পারে। অন্যদিকে তার বাসায় যে কাজ করে গুলনেহার, তার দিকে ক্রমেই তার বদনজর ঘনিয়ে উঠতে থাকে। ওদিকে বেহাত জমি নিয়ে ফজু ও কাদের মিঞার তর্কাতর্কি। প্রাণের সংশয়। মালিকবর্গের সাথে ফজুর মত ভূমিহীন কৃষকবর্গের বিজয় কী করে হতে পারে? তারপর, জহিরীয় কায়দায় পুনরাবৃত্তি। আবর্তিত হতে হতে ঘটনার চূড়ান্তির দিকে ধেয়ে যাওয়া।     

উৎসব | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস | ১৯৭৬ 

ইলিয়াসের প্রথম গল্পগ্রন্থ অন্য ঘরে অন্য স্বর– এর দ্বিতীয় গল্প।  ইলিয়াস ছিলেন প্রখর শ্রেণি ও রাজনীতি সচেতন লেখক। তার প্রথম গল্পগ্রন্থেই সেই শ্রেণি-সচেতনতার প্রকাশ পেয়েছে। বড়লোক বন্ধুর বৌ-ভাতের দাওয়াত খাওয়ার পর ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফেরেন আনোয়ার আলি। ধানমণ্ডির ঝলমলে, আলিশান বাড়ি থেকে ফিরে সে মুখোমুখি হয় নিজ পাড়ার নোংরা গলির। এমনিতে তো এইখানেই সে থাকে, অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ারই কথা এতদিনে। কিন্তু ধানমণ্ডির সেই প্রাসাদের সুখস্মৃতির বিপরীতে নিজের এই বিশ্রী বাসস্থান তার মনে বিরক্তি জাগায়। কোথায় ধানমণ্ডির প্রশস্ত ঝকঝকে রাস্তা, আর কোথায় তার বাড়ির এই ঘুপচি গলি যার প্রবেশমুখেই নালা-নর্দমায় গু ভাসতে দেখা যায়! সেসব এলাকার সুরুচিপূর্ণ, তন্বী রূপসীদের তুলনায় তার হোঁৎকা গেঁয়ো স্ত্রী’র দিকে তো তাকানোই যায় না। এমনকি ধনীদের কুকুরেরাও শ্রদ্ধার দাবিদার তার কাছে। সে বলে, ‘কুকুর কি আর ওদিকে নেই? ওদিকেও আছে। বিয়ে বাড়িতেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন। কি গম্ভীর তাঁর মুখ, কি তাঁর চেহারা!’ একদম চন্দ্রবিন্দু সমেত, ‘তাঁর’। কী সশ্রদ্ধ সম্বোধন!    
বৌ-ভাত অনুষ্ঠানে ধনী, সংস্কৃতিমনস্ক বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। প্রতিমুহূর্তে সে তাদের সাথে তাল মেলানোর চেষ্টা করে। বন্ধুদের সুন্দরী স্ত্রী’দের সাথে কথা বলতে বেগ পেতে থাকে। খুব স্বাভাবিক কথাও মাথার মধ্যে হাজারবার সাজিয়েও বলে উঠতে পারে না সে। এবং এসবের মধ্যেই সে ভালোমত দেখে নিতে থাকে তাদের শরীর। স্মৃতিতে ছাপিয়ে নিতে থাকে। পরে, রাতে, কাজে দেবে। কিন্তু রাতে ঘরে ফেরার পর, এলাকার জঘন্য পরিবেশ, চারপাশের অশ্লীল গান-বাজনা, নিজের পরিবার সবকিছুর উপর বিতৃষ্ণ হয়ে কিছুতেই নিজের স্ত্রী’র প্রতি মনকে জাগাতে পারেন না আনোয়ার আলি। স্মৃতি হাতড়ে ধানমণ্ডির রূপসীদেরকেও স্মরণে আনতে পারেন না একদম। শেষমেষ যা হয়, তা একমাত্র ইলিয়াসের পক্ষেই কল্পনা করা সম্ভব।

তৃতীয় পুরুষের বয়ানে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই গল্পে আনোয়ার আলির মগজে ঢুঁ মেরে মেরে আপাত-গড়পড়তা একজন মধ্যবিত্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের অভাবনীয় ভাঁজ খুলে দেখান। মধ্যবিত্তের জীবনের অবদমন, হীনম্মন্যতা ও আত্মঘৃণার স্বরূপ কী অভাবনীয় রূপে পেশ করা যায়, তারই এক চমৎকার নজির এই গল্প।  

পাদটীকা | সৈয়দ মুজতবা আলী | ১৯৫২ 

মুজতবা আলীর বিখ্যাত চাচা কাহিনী গল্পগ্রন্থের অন্তর্গত।  সৈয়দ মুজতবা আলীর স্বভাবসুলভ বৈঠকি ভঙ্গির গল্প। হাস্যরসে চলতে চলতে গল্পের একদম শেষ লাইনে এসে পাঠককে চমকে দেওয়া এক গভীর দুঃখবোধ। গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। 

এই হলো গল্পের শুরুর লাইন। গত শতক বলতে উনিশ শতক, এই শতক বলতে বিশ শতক। সুরসিক সৈয়দ মুজতবা আলী যে মড়কের কথা বললেন, তা শারীরিক কোনো রোগ নয়। রাজনৈতিক রোগ! 

ইংরেজ আমলের আগে উপমহাদেশে যে মোগল যুগ ছিলো, তাতে মুসলিমরা শিক্ষা নিত মক্তবে, হিন্দুরা টোলে। ইংরেজ আমলে ইংরেজি স্কুলে শিক্ষার যে জয়জয়কার, তার কারণ স্পষ্ট। ওটা শিখেই তো দুটো করে খাওয়া যাবে! তাই পণ্ডিতমশাইদের অবস্থা মড়ক লাগার মতোই। যারা গেছেন তো গেছেন, যারা আছেন, স্কুলে এক্কেবারে পেটেভাতে আছেন। 

এই গল্পেও একজন পণ্ডিতমশাই আছেন। আর লেখক এখানে নাম ভূমিকায়, পণ্ডিতমশাইয়ের প্রিয় ছাত্রদের একজন। হুট করে স্কুলে খবর এল, লাট সাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন। কী সর্বনেশে কথা! হেডমাস্টার সাহেবের খিটখিটে মেজাজে তখন ছাত্র-শিক্ষক সবার অবস্থা ভাজাভাজা! আর যেদিন লাটসাহেব স্কুল পরিদর্শনে আসবেন, আলী সাহেবের ভাষায়, ‘হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চড়কিবাজীর মতন তুর্কি-নাচন নাচছেন। যেদিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার। নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ ভাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব কজনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।’

গল্পের এই পণ্ডিতমশাই বাংলা সাহিত্যিপ্রেমীদের মনে অক্ষয় হয়ে থাকবেন কয়েকটা কারণে। তার একটিও পণ্ডিতমশাইয়ের সংস্কৃতিতে দক্ষতার জন্য নয়। প্রথম কারণটা হলো উর্ধাঙ্গে বস্ত্রে অনভ্যস্ততা। এখন লাটসাহেব মানী মানুষ, তার সামনে তো খালি গায়ে থাকা যায় না! অতএব পণ্ডিতমশাই হলুদ গেঞ্জি কিনলেন, যেহেতু শাস্ত্র অনুযায়ী তাকে সেলাই ছাড়া জামা পরতে হবে। অনভ্যস্ততার ফোঁটা যেমন কপালে চড়চড় করে, পণ্ডিতমশাইয়েরও তাই হলো। এরমাঝেই লাটসাহেব আসলেন, পণ্ডিতমশাইয়ের গায়ে গেঞ্জি পরার চুলকুনি হলো, লাটসাহেব হালকা নড করায় পণ্ডিতমশাইয়ের মনে ভাবোল্লাস হলো, ঘটনাপ্রবাহে আরও অনেককিছুই হলো। ভাবগতিকে মনে হচ্ছিলো লাটসাহেবের সাথে পণ্ডিতমশাইয়ের সাক্ষাতই এই গল্পের মূল আলোচ্য। 

কিন্তু দিনদুয়েক পর পণ্ডিতমশাই নিয়ে আসলেন এক্কেবারে নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে। কোথায় কোন ঘাটে গিয়ে জানতে পেরেছেন লাটসাহেবের নানা গল্প, লাটসাহেবের কুকুরের গল্প। হ্যাঁ, লাটসাহেবের কুকুরও ছিল একটা। তিনঠ্যাঙে কুকুর। পণ্ডিতমশাই হুট করেই তার প্রিয় ছাত্রকে আঁক কষতে দিলেন একটা। আলী সাহেবের ভাষায় আবার যাওয়া যাক, ‘‘বেশ বেশ! তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’

আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’

তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?’

আমি হতবাক। 

‘বল না।’

আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।

পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’

শুধু সেদিন না, এই সময়ে এসেও যেন পণ্ডিতমশাইরা হুঙ্কার দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, উত্তর দে!

পুরো জাতি তখন থাকে নিস্তব্ধ, ঠিক সেদিনের সেই ক্লাসরুমটার মতো। 

প্রাগৈতিহাসিক | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় | ১৯৩৭ 

‘অতসী মামী’ গল্পের মাধ্যমে সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদার্পণ ঘটলেও “সিরিয়াস সাহিত্যিক” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পটার দ্বারাই। নামেই আভাস পাওয়া যায়, মানিক এই গল্পে ডিল করতে চাচ্ছেন মানুষের ভিতরকার আদিম এক অন্ধকার নিয়ে। অন্ধকার শব্দটা মানিকের খুব প্রিয়। এই অন্ধকারেরই মূর্তায়ন হলো গল্পটার প্রধান চরিত্র ভিখু। খুনাখুনি, ডাকাতি, রক্তপাত কোনোকিছুতেই ভিখুর হাত কাঁপে না। কাঁপে না কারণ, যেকোনো মূল্যে সে টিকে থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে চায়। টিকে থাকার জন্যে যদি এসবই করতে হয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। এই বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা আরো ভালোভাবে বোঝা যায় যখন কাঁধে দগদগে ঘা নিয়ে, পলাতক অবস্থায় বনের গহীনে জোঁক-মশা-শেয়ালের উৎপাতেও সে মরতে রাজি হয় না। ‘মরিবে না। সে কিছুতেই মরিবে না। বনের পশু যে অবস্থায় বাঁচে না সেই অবস্থায়, মানুষ সে বাঁচিবেই।’ 

অথচ যার সাহায্যে এই টিকে থাকা তার জন্য সহজ হয়, তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতেও তার কোনো সমস্যা হয় না। তারপর সে পালিয়ে বেড়ায়। রোগে শীর্ণ এক বাহুকে পুঁজি করে ভিক্ষুক হিসেবে সে নতুন জীবন শুরু করে অপর এক অঞ্চলে। বিনয়ই ভিক্ষুকের ভূষণ। ফলে ভিক্ষা কম পেলে, বা পথচারীর কোনো আচরণে তাদেরকে গালি দেয়ার, বা তাদের উপর হামলে পড়ার ইচ্ছা অনেক কষ্ট করে দমন করে সে। এমন সময় দেখা হয় পাঁচীর সাথে। একই পথের মুসাফির তারা। পাঁচীর পায়ে একটা ঘা। সেটা সারানো দুঃসাধ্য কিছু না, কিন্তু এই ঘায়ের বদৌলতেই ভিক্ষুক হিসেবে তার আয়টা হয়। তাই এই ঘা’টাকেই সে পরম যত্নে লালন করে, জিইয়ে রাখে। ভিখু এই পাঁচীর সাথে খাতির জমাতে যায়, চায় তাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। তারপর, সেই প্রাগৈতিহাসিক দ্বন্দ্ব: যৌন প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে যুদ্ধ, যেকোনো একজনের বিজয় ও অপরজনের মৃত্যু, এবং বিজয়ীর নারীলাভ। কিন্তু, যেই ভিখু এত হিংস্র, এত মারমুখী, তার মনে কি কোমলতারও কোনো জায়গা আছে? সে কি ভালোবাসতেও পারে? এমন একটা প্রশ্ন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ঝুলিয়ে দেন আমাদের সামনে। যেভাবে পাঁচী নিজের শরীরের ক্ষতের কারণে লাভবান হয়, ফলে তা সারাতেও চায় না, একইভাবে হয়তো সমাজ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণেই কিছু মানুষ নিজেদের অন্তরের ক্ষত, বা মানিকের ভাষায়, তাদের ভিতরকার অন্ধকারকে জিইয়ে রাখে, লালন করতে থাকে। এবং, সময়মত, উত্তরাধিকারে পাওয়া এই অন্ধকার সে চালান করে দেয় পরের প্রজন্মে। 

টোপ | নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় | ১৯৪৫

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে সিরিয়াস সাহিত্য ও সরস সাহিত্যের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। অত্যন্ত রসিক, উইটি এই লেখকের অন্যতম বিখ্যাত গল্প ‘টোপ’। শুরুতে হাল্কা খেলাচ্ছলে ও হাস্যরসপূর্ণ ভঙ্গিতে গল্পটা বলা হতে থাকে, কিন্তু আস্তে-আস্তে অসাধারণ ধৈর্য ও নৈপুণ্যের সাথে গল্পটার ভেতরকার অন্ধকার প্রকাশিত হয় পাঠকের নজরে।   

কাহিনীর শুরু কথকের দুয়ারে বাঘের চামড়ার একজোড়া জুতা হাজির হওয়ার মধ্য দিয়ে। জুতাজোড়া পাঠিয়েছেন রাজাবাহাদুর। কে এই রাজাবাহাদুর? অতীতচারণ করে সে গল্পই বলতে শুরু করে কথক। রামগড় জমিদারি এস্টেটের মালিক এন. আর. চৌধুরী তথা রাজাবাহাদুরের সাথে পরিচয় হয় গল্পের কথকের, যিনি একজন মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও কবি। রাজাবাহাদুরের সম্মানে তিনি একটা প্রশস্তিমূলক কবিতা লিখে দেন। ফলে তাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্ক বলতে, রাজা ও প্রজার মধ্যে যে সম্পর্ক আরকি। সে যাই হোক, একজন জমিদারের সাথে খাতির জমানোর সুযোগ পেয়ে গল্পের কথকও খুশিই হন। ঘটনাক্রমে একসময় জমিদারের তরফ থেকে একসাথে শিকারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সব কাজকর্ম ফেলে তিনি রওনা দেন। একটা আলিশান রোলস রয়েস গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বনমধ্যে জমিদারের বিরাট বাংলোতে। সেখানে গোসল, খানাপিনা শেষে রাজাবাহাদুর নিজের আগ্নেয়াস্ত্রের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ কথককে দেখিয়ে গর্ব করেন, খানিকটা টিটকারিও মারেন। এরপরেই আসে শিকারের পালা। এই শিকার তো আসলে তার পৌরুষ ও সাহসিকতারই দাম্ভিক প্রদর্শন। কিন্তু দেখা যায়, তিনি গাড়ির মধ্যে, নিরাপদ দূরত্ব থেকে গুলি করেই ঘায়েল করতে থাকেন পশু-পাখি। বড় কোনো শিকার না পেয়ে তিরিক্ষি মেজাজে দু-একটা বনমুরগিই মেরে ফেলেন তিনি। এবং সে মুরগি তিনি ঘরেও তোলেন না। অর্থাৎ, এই শিকার থেকে তার পাওয়ার কিছুই নেই, কেবল নিজের বিক্রম প্রকাশের, একটা কিছু মেরে ফেলার আনন্দ ছাড়া। 

কিছুদিন পর কথক নিজের বাড়ি ফিরে যেতে চাইলেও রাজাবাহাদুর তাকে নিজের বীরত্বের সম্পূর্ণ পরিসরটুকু না দেখিয়ে ছাড়বেন না। হুকুমের সুরে বলেন আরেক রাত থেকে যেতে। সেই রাতে বিশাল এক টোপ দিয়ে রাজাবাহাদুর একটা মাছ ধরবেন বলে জানানো হয়। কপিকল দিয়ে সেই টোপ নিচে এক নদীর ধারে নামানো হয় আর তখনই ভয়াল গর্জনে লাফ দিয়ে ওঠে একটা বাঘ, আর সাথে-সাথে এক গুলিতে তাকে ঘায়েল করে ফেলেন রাজাবাহাদুর। তিনি যে বীরোত্তম বীর, সে বিষয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। মাছটা তাহলে বাঘ, সেটা বোঝা গেল। কিন্তু টোপটা কী ছিল? এর উত্তরে আমাদের সামনে যা উন্মোচিত হয় তাতে এক পলকে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। সামন্তবর্গের স্বেচ্ছাচার, নিপীড়নের এক অমোঘ নজির হয়ে দাঁড়ায় গল্পটা। 

আত্মজা ও করবী গাছ | হাসান আজিজুল হক | ১৯৬৭

হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ আত্মজা ও করবী গাছ সে সময়ের বাংলাদেশের সাহিত্যের অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন ফেলেছিল। সেই গ্রন্থের নামগল্পই আমাদের আলোচ্য। গল্পটির মূল পটভূমি হলো দেশভাগের পরবর্তী প্রান্তিক মানুষের জীবন। হাসান আজিজুল হক নিজে একবার বলেছিলেন, ‘দেশ ভাগ আমার জীবনের জন্য একটা ক্ষতস্বরূপ। ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়। আমি এই দাগের অনুধাবন করার চেষ্টা করছি।’ এই গল্পটিও যেন সেই ক্ষত থেকেই উৎসারিত। এক বৃদ্ধ পিতা ও উচ্ছন্নে যাওয়া তিন ছেলের কথোপকথনের মধ্যে আনাগোনার মাধ্যমে আগাতে থাকে গল্পটা। পরিপার্শ্বের বিভিন্ন খুঁটিনাটির অপরূপ বর্ণনা ও আবহনির্মাণে এমনই এক মায়ার চাদর ঝুলিয়ে দেন চোখের সামনে, যে গল্পটার অভ্যন্তরীণ নির্মম বাস্তবতাটা টের পেতে একটু সময়ই লেগে যায় আমাদের। মূলত, দেশভাগের পর উদ্বাস্তু হয়ে বাস করছেন গল্পের বৃদ্ধ সেই পিতা। এমন অবস্থায় নিজের ও পরিবারের পেট চালানোর জন্য নিজের কন্যাকে উপজীব্য করে যেভাবে তিনি নিজের ও পরিবারের পেট চালান এবং তার ফলে সেই বৃদ্ধের মধ্যে জন্ম নেয়া অসহায় এক আত্মগ্লানিকে এত অদ্ভুতভাবে তুলে ধরেছেন হাসান আজিজুল হক যে অবাক হতে হয়। ক্রোধের বদলে ততক্ষণে জায়গা করে নিয়েছে একটা অক্ষম আত্মবিনাশী আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন তিনি একটা করবীগাছে পানি দিয়ে সেটাকে বড় করে তুলছেন, আদতে যা নিজের মৃত্যুরই আয়োজন। গোটা গল্প যে অদ্ভুত নির্বিকার ভঙ্গিতে বর্ণনা করে যাওয়া হতে থাকে, যে ক্রোধ ও কান্না ঘনীভূত হয়ে জমে ছিল এতক্ষণ, শেষ বাক্যে এসে সবটুকু যেন একদম ফেটে পড়ে — এ্যাহন তুমি কাঁদতিছ? এ্যাহন কাঁদতিছ তুমি? 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।