কমলা ভাসিনের জেন্ডার বোঝাপড়া 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন
কমলা ভাসিনের প্রতিকৃতিঃ শফিক হীরার অলঙ্করণ

ব্যাকরণে লিঙ্গ শব্দটি আমরা জানলেও, স্পষ্টত এটি এখন ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আপনি এই নতুন অর্থ ব্যাখ্যা করতে পারেন কি?  

সামাজিক ও ধারনাগতভাবে লিঙ্গ শব্দটির একটি নির্দিষ্ট অর্থ আছে। সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে নারী ও পুরুষ অর্থে লিঙ্গ শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছে যেভাবে সমাজ নারী ও পুরুষকে আলাদা করে এবং তাদের সামাজিক ভূমিকা অর্পণ করে। নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে সামাজিক বাস্তবতা বোঝার জন্য এটি একটি বিশ্লেষণমূলক টুল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।      

সেক্স ও জেন্ডারের মধ্যে পার্থক্যটি দৈহিক গঠনতন্ত্রে নারীদের অধিনস্ত করবার সাধারণ প্রবণতাকে মোকাবেলা করার জন্য চালু হয়েছিল। পটার যুগে বিশ্বাস করা হত যে সমাজে নারী ও পুরুষদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা এবং মর্যাদা জৈবিক দিক (যেমন, সেক্স) দিয়া নির্ধারিত হয় সেটা প্রাকৃতিক, এবং পরিবর্তনযোগ্য নয়। 

একভাবে নারী এবং নারীদেহ সমাজে তাদের অধস্তন অবস্থানের জন্য দায়ী ছিল এবং আছে। একবার এটি স্বাভাবিক হিসাবে গ্রহণ করা হলে, অবশ্যই সমাজে বিদ্যমান লিঙ্গ বৈষম্য এবং অবিচারকে মোকাবেলা করার প্রয়োজন থাকে না।     

লিঙ্গের ধারণা থেকে আমরা বলতে পারি সেক্স এবং লিঙ্গ সম্পূর্ণ আলাদা। প্রত্যেকেই জন্মগতভাবে পুরুষ বা নারী, এবং আমাদের যৌনাঙ্গ দেখেই আমাদের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু প্রতিটি সংস্কৃতিতে মেয়েদের এবং ছেলেদের মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন ভূমিকা, প্রতিক্রিয়া এবং গুণাবলি বরাদ্দ করা হয়। সমস্ত সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ‘প্যাকেজিং’  যা মেয়েদের জন্য করা হয় এবং জন্মের পর থেকে ছেলেরা হয় ‘জেন্ডারিং’।       

সমাজ ধীরে ধীরে একজন পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গকে বিভিন্ন গুণ, আচরণের ধরণ, ভূমিকা, দায়িত্ব, অধিকার ও প্রত্যাশার সাথে পুরুষ বা নারীতে রূপান্তরিত করে। লিঙ্গের বিপরীতে, যা জৈবিক, নারী ও পুরুষের লিঙ্গ পরিচয় মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিকভাবে যার অর্থ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত। 

এই ধারণাটি ব্যবহারকারীর প্রথম নারীবাদীদের একজন অ্যান ওকেলি। ওকেলি বলেছেন: ‘’লিঙ্গ’ একটি সংস্কৃতির বিষয়;  পুরুষ এবং নারীর সামাজিক শ্রেণীবিভাগকে বোঝায় ‘পুংলিঙ্গ’ এবং ‘স্ত্রীলিঙ্গ’। মানুষ পুরুষ নাকি  নারী তা সাধারণত জৈবিক প্রমাণ উল্লেখ করে বিচার করা যেতে পারে। তারা পুংলিঙ্গ বা মেয়েলি একইভাবে বিচার করা যায় না: মানদণ্ড সাংস্কৃতিক, সময় এবং স্থানের সাথে সাথে বদলে যায়। 

লিঙ্গের সামঞ্জস্যতা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, তবে লিঙ্গের পরিবর্তনশীলতাও স্বীকার করতে হবে। তিনি পরিশেষে বলেন ‘লিঙ্গের কোনও জৈবিক উৎস নেই, সেক্স এবং লিঙ্গের মধ্যে সংযোগ আসলেই ‘প্রাকৃতিক’ নয়।   

আসুন আমরা প্রধান তফাতগুলো দেখি: 

            সেক্স        লিঙ্গ
          সেক্স প্রাকৃতিক লিঙ্গ সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং এটি মানবসৃষ্ট
সেক্স জৈবিক। এটি যৌনাঙ্গে দৃশ্যমান পার্থক্য এবং প্রজননশীল ফাংশনে সম্পর্কিত পার্থক্য বোঝায়। লিঙ্গ সামাজিক-সাংস্কৃতিক।  এটি পুরুষ এবং নারীর গুণাবলী, আচরণের ধরণ, ভূমিকা এবং দায়িত্ব ইত্যাদি বোঝায়। 
সেক্স অপরিবর্তনীয়ও, এটি সব জায়গায় একই। লিঙ্গ পরিবর্তনশীল; এটি সময়ে সময়ে, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, এমনকি পরিবার থেকে পরিবারেও পরিবর্তিত হয়।

কিভাবে লিঙ্গকে দক্ষিণ এশীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়?  

এটি সত্যিই একটি সমস্যা। যদিও ইংরেজিতে দুটি ভিন্ন শব্দ রয়েছে— সেক্স এবং জেন্ডার-বেশিরভাগ দক্ষিণ এশীয় ভাষায় শুধুমাত্র একটি শব্দ রয়েছে- ‘লিঙ্গ’ যেটি উভয়ের জন্যই ব্যবহৃত হয়। তাদের মধ্যে পার্থক্য বোঝানোর জন্য লিঙ্গের জন্য আমরা  দুটি শব্দ খুঁজে পেয়েছি। সেক্স এর জন্য আমরা বলি প্রাকৃতিক লিঙ্গ বা প্রাকৃতিক/জৈবিক লিঙ্গ, আর লিঙ্গের জন্য বলি সামাজিক লিঙ্গ। আসলে এই সংজ্ঞাটি প্রায়শই ‘সেক্স’ এবং ‘লিঙ্গ’-এর চেয়ে ভাল কাজ করে কারণ শব্দগুলোই সংজ্ঞা ধারণ করে, এবং তাই আর কোনও ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।      

কিন্তু সেক্স কি আমাদের লিঙ্গের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত নয়? ভূমিকা এবং আচরণ কি নারী এবং পুরুষদের যৌন পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে বরাদ্দ করা হয় না?      

কেবল কিছু মাত্রায়। নারীরা তাদের শরীরের কারণে কিন্তু সব নারী নয়, সন্তান ধারণ করে, শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ায় এবং তাদের মাসিক হয়; কিন্তু এর বাইরে এমন কিছু নেই যা পুরুষরা করতে পারে না বা পুরুষরা পারে এবং নারীরা পারে না। সন্তান জন্মদানের অর্থ এই নয় যে শুধুমাত্র নারীরা তাদের দেখাশোনা করতে পারে বা করা উচিত। পুরুষেরাও একইভাবে যত্ন নিতে পারে। তাই শুধু পুরুষ বা নারীর শরীর থাকলেই আমাদের বৈশিষ্ট্য, ভূমিকা বা ভাগ্য নির্ধারণ করতে হবে এমন নয়। কিন্তু বাস্তবে কোনটি প্রাকৃতিক এবং কোনটি সামাজিকভাবে নির্মিত তা প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন, কারণ একটি শিশু জন্মের সাথে সাথে পরিবার ও সমাজ লিঙ্গ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। অনেক দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে একটি পুত্র সন্তান জন্মালে উদযাপন করা হয়, একটি কন্যা সন্তান জন্মালে শোক করা হয়; ছেলেদের ভালবাসা, সম্মান, ভাল খাবার এবং ভাল স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। ছেলেদেরকে কঠোর এবং বহির্মুখী হতে উৎসাহিত করা হয় আর মেয়েদেরকে সংযমী এবং ঘরের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে উৎসাহিত করা হয়। একটি মেয়ের শরীরে এমন কিছু নেই যা তাকে হাফপ্যান্ট পরতে, গাছে উঠতে বা সাইকেল চালাতে বাধা দেয় এবং ছেলের শরীরে এমন কিছু নেই যা তাকে পুতুল খেলা থেকে, ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে বা রান্না বা ঘর পরিষ্কার করতে সাহায্য করতে বাধা দেয়। এই সমস্ত লিঙ্গের পার্থক্য সমাজ দ্বারা সৃষ্ট। লিঙ্গ যে একটি সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্য, তার প্রমাণ হল যে এটি সময়ের সাথে সাথে, বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে পরিবর্তনশীল। যেমন, একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে বাড়িতে বা স্কুলে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে, অপরদিকে একটি আদিবাসী মেয়ে অবাধে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে পারে, পশু চরাতে নিয়ে যেতে পারে বা ফল, পাতা বা ডালপালা সংগ্রহে গাছে উঠতে পারে।  তাদের শারীরিক গঠন এক এবং উভয়ই মেয়ে হলেও তাদের ক্ষমতা, আকাঙ্খা এবং স্বপ্ন আলাদা। একইভাবে, অনেক পরিবারে মেয়েদের ঐতিহ্যগতভাবে ১০ বা ১১ বছর বয়সের পরে স্কুলে পাঠানো হত না বা বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হত না এবং প্রায়ই বয়ঃসন্ধিকালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু এখন কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই, পুরুষদের শিক্ষা, ভূমিকা এবং দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়েছে, যদিও সম্ভবত ততটা নয়। লিঙ্গ পরিবর্তনশীল বলতে এটাকেই বোঝানো হয়; এটি বিভিন্ন পরিবার বা সম্প্রদায়ে এবং একই পরিবারে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন হতে পারে। এমনকি আমাদের দেহও আমাদের, সমাজ বা সংস্কৃতি দ্বারা আকৃতি বা পরিবর্তিত হতে পারে। আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবহার অথবা সার্জারি করে আমাদের শরীরের আকার, আকৃতি এবং শক্তি পরিবর্তন করতে পারি। স্পষ্ট উদাহরণ হল পুরুষ ও নারী কুস্তিগীর, ক্রীড়াবিদ, নৃত্যশিল্পী, যোগ ব্যায়াম অনুশীলনকারীদের দেহ। একইভাবে, নারীদের শরীর এমন যে তারা প্রজনন করতে পারে। তবে আমরা এখন বেছে নিতে পারি সন্তান ধারণ করতে হবে কিনা, কতজন সন্তান হবে এবং কত সময় বিরতি নিয়ে জন্ম দিতে হবে। প্রজনন নারীর ক্ষেত্রে একইভাবে অনিবার্য নয় যেমন তা স্ত্রীলিঙ্গের অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে অনিবার্য।  

একজন নারী যদি রান্না করতে পারে,
তবে একজন পুরুষও তাই পারে,
কারণ একজন নারী তার গর্ভাশয় দিয়ে রান্না করে না। 

এর থেকে যা বোঝা যায় তা হল যে সমাজে নারী ও পুরুষের ভিন্নরকম  মর্যাদা আসলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নির্ধারিত হয়। এটি মানবসৃষ্ট; প্রকৃতির সাথে এর খুব কমই সম্পর্ক আছে। এটি সেক্স নয়, লিঙ্গ যা নির্ধারণ করেছে যে, (প্রায়) সর্বত্র, একটি গোষ্ঠী হিসাবে নারীরা পুরুষদের থেকে নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়। তারা কম অধিকার ভোগ করে, কম সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে, পুরুষদের তুলনায় বেশি সময় কাজ করে কিন্তু তাদের কাজকে অবমূল্যায়ন করা হয় বা কম বেতনের হয়। তারা পুরুষ ও সমাজের হাতে পদ্ধতিগতভাবে সহিংসতার সম্মুখীন হয়।  সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কম।  

ক্লডিয়া ভন ওয়ারহফ বলেছেন- ‘ইতিহাসের কোনো সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের মতো নৃশংসভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে লিঙ্গের মধ্যে প্রাকৃতিক পার্থক্যকে প্রসারিত, বিকৃত এবং ব্যবহার করেনি। এই আদেশটি প্রথমে প্রাকৃতিক লিঙ্গকে একটি কৃত্রিম সামাজিক লিঙ্গে রূপান্তরিত করেছিল, পুরুষদের থেকে ‘পুরুষ’ এবং নারীদের থেকে ‘নারী’ তৈরি করেছিল— আসলে, ‘পুরুষ’কে ‘মানব জাতি’ এবং নারীকে কেবল স্ত্রীলিঙ্গে পরিণত করেছিল। … এবং অবশেষে, এই পার্থক্যগুলি তৈরি করে, এটি তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণযোগ্য করার জন্য তাদের আবার ‘প্রাকৃতিক’ বলে ঘোষণা করে।’    

পোশাক 

বেশিরভাগ সমাজে মেয়ে এবং ছেলে, নারী এবং পুরুষদের পোশাক আলাদা। কিছু জায়গায় এই পার্থক্য ন্যূনতম হতে পারে, আবার কিছু জায়গায় প্রকট। কিছু সম্প্রদায়ে নারীরা তাদের মুখমন্ডল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত শরীর ঢেকে রাখে। পোশাক মানুষের গতিশীলতা,  স্বাধীনতার অনুভুতি এবং মর্যাদাকে প্রভাবিত করতে পারে।    

গুণাবলি 

বেশিরভাগ সমাজে নারীদের নিখুঁত গুণাবলি যেমন ভদ্রতা, যত্নশীলতা, লালন-পালন এবং বাধ্যতা আশা করা হয়; পুরুষদের শক্তিশালী, আত্মবিশ্বাসী, প্রতিযোগিতামূলক এবং যুক্তিবাদী হতে হবে বলে আশা করা হয়। ভারতীয় নারীবাদী ভাসান্ত কান্নাবিরান একবার জেন্ডার প্রশিক্ষণে বলেছিলেন, ‘সন্তানের লালন-পালন নারীদের জন্য সন্তান জন্মদানের মতোই স্বাভাবিক হওয়া উচিত… এবং এটা শুধুমাত্র শিশুদের জন্মদানের সাথে সম্পর্কিত নয়; ধরে নেওয়া হয় যে ভালোবাসা বা মাতৃত্ব আমার মধ্যে বসে আছে স্রোতের মতো প্রবাহিত হওয়ার অপেক্ষায় যার প্রয়োজন আছে। আমরা চিরন্তন মা হয়ে উঠি। তাই আমি আমার সন্তান, অন্যের সন্তান, আমার স্বামী, আমার ভাই, আমার বোন, আমার বাবা যে আমাকে আসলে ‘আমার ছোট মা’ বলে ডাকে তাদেরকে মায়ের মতন লালন-পালন করি!   

আপনি সমগ্র মহাবিশ্বের প্রতি মাতৃ অনুভূতিতে উপচে পড়বেন বলে আশা করা হচ্ছে। আর এটাই স্বাভাবিক হওয়ার কথা! এটি কোনো  কাজও নয়; এটি এমন কিছু যা আপনি শ্বাস নেওয়া, খাওয়া বা ঘুমানোর মতো সহজে করেন।   

ভূমিকা ও দায়িত্ব

পুরুষদের পরিবারের প্রধান, উপার্জনকারী, সম্পত্তির মালিক, ম্যানেজার এবং রাজনীতি, ধর্ম, ব্যবসা এবং পেশায় সক্রিয় বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে, নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সন্তান জন্মদান ও দেখাশোনা করার জন্য, অসুস্থ ও বৃদ্ধদের সেবাযত্ন করার জন্য, গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করার জন্য। এটি তাদের শিক্ষার অভাব, কর্মসংস্থানের প্রস্তুতি, কর্মসংস্থানের প্রকৃতি ইত্যাদি নির্ধারণ করে। তবে, পুরুষ এবং নারীর ভূমিকার মধ্যে পার্থক্যের মাত্রা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কখনও কখনও নিয়মগুলি নিছক অগ্রাধিকারমূলক, এবং অস্থায়ী ভূমিকার বিপরীতে সেক্স দ্বারা খুব কম উদ্বেগ দেখানো হয়।       

কোরা ডু বোইস রিপোর্ট বলছে, যদিও লিঙ্গের অর্থনৈতিক ভূমিকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, তবে একজনের পক্ষে অন্য লিঙ্গের কাজ নেওয়াকে অস্বাস্থ্যকর বলে মনে করা হয় না – বরং তারা একটি পরিপূরক দক্ষতার অধিকারী হওয়ার জন্য প্রশংসিত হয়। নারীরা জীবিকা নির্বাহের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরুষরা আর্থিক লেনদেন করে, কিন্তু অনেক পুরুষ উৎসাহী মালি এবং অনেক নারীর আর্থিক দক্ষতাও রয়েছে। অন্যদিকে, কিছু সংস্কৃতিতে, যেখানে বাগানের দেখভাল করাকে  নারীর কাজ হিসাবে শনাক্ত করা হয়, সেখানে একজন পুরুষের মধ্যে এটির জন্য প্ররোচনাকে যৌন বিচ্যুতির প্রমাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে, এমনকি নারীদের জন্যও একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করা যেতে পারে যারা উভয় লিঙ্গের জন্য নির্ধারিত কাজে পারদর্শী (অ্যান ওকলি)।      

কিছু সমাজে সেক্সের ভূমিকা কঠোরভাবে আরোপ করে। মধ্য ব্রাজিলের মুন্ডুরকু ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এমন একটি সমাজের উদাহরণ আছে যেখানে সেক্সের ভূমিকা এবং লিঙ্গের গ্রুপিংগুলির মেরুকরণ একটি প্রাথমিক সামাজিক উপাদান হয়ে উঠেছে। লিঙ্গের শারীরিক এবং সামাজিক বিচ্ছেদ কার্যত সম্পূর্ণ: পুরুষ এবং ছেলেরা পুরুষদের বাড়িতে নারীদের থেকে আলাদা থাকে। প্রতিটি সেক্স গ্রুপে, (ছোট বাচ্চাদের বাদ দিয়ে) শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই মিথস্ক্রিয়া করে এবং অনেক আচার-অনুষ্ঠানে উভয়ের মধ্যে বৈরিতা দেখানো হয়। সেক্সের মেরুকরণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ভূমিকা নয়, ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রেও বিস্তৃত, ফলে এটি আধিপত্য এবং উদ্বেগের রূপ নেয়।  পূর্ব-নির্ধারিত এই সেক্সের ভূমিকা ও ব্যক্তিত্বের ধরণগুলির মধ্যে থাকার বাস্তব ও কাল্পনিক আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে উদ্বেগ  লোককাহিনী এবং আচার-অনুষ্ঠানের অনেকগুলিতেই  প্রকাশ পায়।   

বহিরাগতদের কাছে, পশ্চিমা সমাজগুলিতে লিঙ্গগত পার্থক্য খুব কম বলে মনে হয়, কিন্তু অ্যান ওকলি যেমনটা উল্লেখ করেছেন, ‘আজ পশ্চিমা সমাজে, যৌনতা হল সামাজিক কাঠামোর একটি সংগঠিত নীতি, এবং বিপরীতে জনপ্রিয় বিশ্বাস সত্ত্বেও, সামাজিক ভূমিকা নির্ধারণ করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকের কাজ করে। তাই আশ্চর্যের কিছু নয় যে, মুন্ডুরুকুর মতো, পশ্চিমা সংস্কৃতিতে লিঙ্গ ভূমিকার মধ্যেই প্রচুর উদ্বেগের শিকড় রয়েছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন প্রাপ্তবয়স্কদের হিসাবে আমাদের নিরাপত্তার একটি বড় অংশ এই ভূমিকাগুলির সীমার মধ্যে থেকে আসে— মানসিক স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে হলে আমাদের অবশ্যই তাদের মধ্যে থাকতে হবে।’ 

মেয়েরা এবং নারীরা জৈবিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে কি এই তারতম্য ঘটতে পারে?  

আসলে, জৈবিকভাবে, লিঙ্গ এবং যে ওয়াই ক্রোমোজোমটি (শুধুমাত্র পুরুষদের মধ্যে পাওয়া যায়) সেটি পুরুষদের অনেক প্রতিবন্ধকতার জন্য দায়ী। অ্যাশলে মন্টাগু তার দ্য ন্যাচারাল সুপিরিওরিটি অফ উইমেন বইতে দেওয়া একটি তালিকায় ৬২ টি নির্দিষ্ট রোগের কথা উল্লেখ করেছেন যা মূলত সেক্স-সংযুক্ত জিনের কারণে বা সম্পূর্ণরূপে পুরুষদের মধ্যে পাওয়া যায়। ‘তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক গুরুতর, এবং হিমোফিলিয়া (রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়ার ব্যর্থতা), মিস্ট্রাল স্টেনোসিস (হার্টের এক ধরণের বিকৃতি) এবং কিছু ধরণের মানসিক ঘাটতি… জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, গর্ভধারণ থেকে শুরু করে, জেনেটিক কারণে নারীদের তুলনায়বেশি পুরুষ মারা যায়। নারীদের তুলনায় পুরুষের উৎপাদন বেশি হয় এবং বেশি মৃত্যুহার ও বেশি  উৎপাদনের দুটি ঘটনা একসাথে চলে বলে মনে হয়। যদিও X এবং Y শুক্রাণু সমান সংখ্যায় উৎপাদিত বলে মনে হয়, প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে ১২০ থেকে ১৫০ জন পুরুষ ধারণ করে। জন্মের সময় পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (শুধুমাত্র শ্বেতাঙ্গ) এবং ব্রিটেনে প্রায় ৯৪ঃ১০০ -এ পুরুষের সাথে মহিলাদের অনুপাত প্রায় ১০৬ঃ১০০-তে নেমে এসেছে। জন্মগত আঘাতে নারীদের চেয়ে বেশি পুরুষ মারা যায়; নারীদের তুলনায় ৫৪% বেশি পুরুষ জন্মগত আঘাতের কারণে এবং ১৮% বেশি জন্মগত ত্রুটির কারণে মারা যায়। প্রকৃতপক্ষে জন্মের সময় নারীদের আয়ু প্রায় সর্বজনীনভাবে পুরুষের তুলনায় বেশি। ব্রিটেনে, জন্মের সময় নারীদের আয়ু ৭৪.৪ বছর, কিন্তু পুরুষদের জন্য ৬৮.১; চীনে এটি যথাক্রমে ৬৫.৬ এবং ৬১.৩; ব্রাজিলে, ৪৫.৫ এবং ৪১.৮.৭।    

অ্যান ওকলে গবেষণা-অধ্যয়ন থেকে যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করে দেখান যে পুরুষরা সংক্রামক রোগ এবং মরণঘাতী রোগের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সংবেদনশীল। তার মতে এই সংবেদনশীলতা ‘পুরুষ ও নারীর মধ্যে ক্রোমোজোমের মেক-আপের পার্থক্যের সাথে সরাসরি যুক্ত। জিনগুলি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যে যে যে  প্রক্রিয়ায় শরীর সংক্রমণ প্রতিরোধ করে X ক্রোমোজোমের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়… তাই পুরুষের উচ্চতর সংবেদনশীলতার একটি স্বতন্ত্র জৈব রাসায়নিক ভিত্তি।’    

যদিও দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর জৈবিক শ্রেষ্ঠত্ব তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক ও সাংস্কৃতিক হীনমন্যতার দ্বারা ছাপিয়ে গেছে এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আজ নারীরা পুরুষদের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। অ্যারিস্টটল পুরুষনীতিকে এ্যাক্টিভ এবং নারীকে প্যাসিভ বলেছেন। তার জন্য একজন নারী ছিল ‘বিকৃত পুরুষ’, যার আত্মা নেই। তার দৃষ্টিতে নারীর জৈবিক হীনমন্যতা তাকে তার ক্ষমতা, তার যুক্তি এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে নিম্নতর করে তোলে। কারণ পুরুষ উচ্চতর এবং নারী নিকৃষ্ট, পুরুষের জন্ম শাসন করার জন্য এবং নারীরা জন্মে শাসিত হওয়ার জন্য। অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘পুরুষের সাহস দেখানো হয় আদেশে, নারীর আনুগত্যে।’             

সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছিলেন যে নারীদের জন্য ‘শারীরবৃত্তিই নিয়তি’। ফ্রয়েডের স্বাভাবিক মানুষ ছিল পুরুষ, নারী ছিল একজন বিপথগামী মানুষ, তার লিঙ্গের অভাব ছিল এবং তার পুরো মনোবিজ্ঞান এই অভাব পূরণের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে অনুমিত হয়।   

এবং নারীদের সম্পর্কে মিঃ ডারউইন যা বলেছিলেন তা হল: 

‘নারীকে মানসিক স্বভাবে পুরুষের থেকে আলাদা বলে মনে হয়, প্রধানত তার বেশি কোমলতা এবং কম স্বার্থপরতায়… এটি সাধারণত স্বীকার করা হয় যে নারীদের মধ্যে অন্তর্দৃষ্টি শক্তি, বা দ্রুত উপলব্ধি এবং সম্ভবত অনুকরণের ক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় বেশি শক্তিশালীভাবে থাকে; কিন্তু কিছু, অন্তত এই এগুলো নিম্ন জাতিগুলির বৈশিষ্ট্য; আর সেইজন্য সভ্যতার অতীত এবং নিম্ন অবস্থা।’  

আপনি কি বলছেন যে নারী এবং পুরুষের মধ্যে জৈবিক পার্থক্যের কোন ফল নেই? নারীরা যে সন্তান উৎপাদন করে তার সাথে সমাজে তাদের যে ভূমিকা অর্পিত হয় তার কোন সম্পর্ক নেই?      

আমরা অস্বীকার করছি না যে পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে কিছু জৈবিক পার্থক্য রয়েছে। তবে সংস্কৃতির মধ্যে লৈঙ্গিক ভূমিকা এত বেশি পরিবর্তিত হয় বলে তা দেখিয়ে দেয় যে সেগুলিকে শুধুমাত্র সেক্সের উপর ভিত্তি করে বা ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের বিজ্ঞানের একটি সহজ নিয়ম মনে রাখা উচিত— পরিবর্তনশীলতা (লৈঙ্গিক ভূমিকাকে) ধ্রুবক (জেনিটালিয়া এবং ক্রোমোজোম বা লিঙ্গ) দিয়া ব্যাখ্যা করা যায় না। যদি জীববিজ্ঞান একাই আমাদের ভূমিকা নির্ধারণ করে, তবে বিশ্বের প্রতিটি নারীর রান্না করা, কাপড় ধোয়া এবং সেলাই করা উচিত তবে এটি স্পষ্টতই নয় কারণ বেশিরভাগ পেশাদার রন্ধনশিল্পি, ধোপা এবং দর্জিরা পুরুষ। আমরা যা বলছি তা হল নারী ও পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অযৌক্তিক বৈষম্যের জন্য সেক্স বা প্রকৃতি উভয়ই দায়ী নয়। জাতি, শ্রেণী ও বর্ণের বৈষম্যের মতো এগুলোও মানবসৃষ্ট।  তাই সেগুলিকে প্রশ্ন করা, চ্যালেঞ্জ করা এবং পরিবর্তন করা যেতে পারে। একজন নারীর সন্তান থাকতে পারে তবে এটি তার হীনমন্যতা এবং অধীনতার কোন কারণ হওয়া উচিত নয়। এর মাধ্যমে তার শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা কাজের সুযোগ নির্ধারণ করা উচিত নয়। কেন বিভিন্ন সংস্থা এবং বিভিন্ন ফাংশন থাকা বৈষম্যের দিকে পরিচালিত করবে? সমান অধিকার, সুযোগের জন্য আপনাকে জৈবিক দিয়ে সমান হতে হবে না। মারিয়া মিস, একজন নারীবাদী কর্মী, দ্য সোশ্যাল অরিজিন অফ সেক্সুয়াল ডিভিশন অফ লেবার-এ লিখেছেন, ‘… পুরুষত্ব এবং নারীত্ব জৈবিক উপহার নয়, বরং একটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। প্রতিটি ঐতিহাসিক যুগে পুরুষত্ব এবং নারীত্বকে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সংজ্ঞা নির্ভর করে সেই যুগে উৎপাদনের প্রধান পদ্ধতির উপরে… অতএব, নারী-পুরুষেরা তাদের নিজেদের দেহের সাথে গুণগতভাবে ভিন্ন সম্পর্ক গড়ে তোলে। এইভাবে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে, নারীত্বকে জীবনের উৎপাদনের প্রধান সক্রিয় নীতি হিসাবে সমস্ত উৎপাদনশীলতার সামাজিক দৃষ্টান্ত হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। সকল নারীকে ‘মা’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু ‘মা’দের তখন ভিন্ন অর্থ ছিল। পুঁজিবাদী পরিস্থিতিতে সমস্ত নারীকে সামাজিকভাবে গৃহিণী হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় (সকল পুরুষই উপার্জনকারী), এবং মাতৃত্ব এই গৃহিণী-সিনড্রোমের অংশ হয়ে ওঠে। নারীত্বের পূর্বের, মাতৃতান্ত্রিক সংজ্ঞা এবং আধুনিক সংজ্ঞার মধ্যে পার্থক্য হল, পরেরটি সমস্ত সক্রিয়, সৃজনশীল, উৎপাদনশীল (অর্থাৎ মানব) গুণাবলি থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে।’        

থেকে আরও পড়ুন

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।