Klosterman profile
চাক ক্লস্টারম্যান
পপ কালচার ক্রিটিক
ahmed kabir
আহমেদ কবির
কথাসাহিত্যিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা



আমরা কেন নস্টালজিয়া অনুভব করি?   
আর বিনোদনের এই অস্বাভাবিক সহজলভ্যতা কি আমাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর  ধরন-ধারণকে বদলে দিচ্ছে?    

কিছু সমস্যা সারাজীবনই থেকে যায়। ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, এই সমস্যাগুলোর আদতে কোনো সমাধানই নেই। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, এগুলো আসলে কোনো সমস্যাই না, নিতান্তই কিছু অযৌক্তিক ব্যাপার-স্যাপার। আর সমস্যাগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে, যা নিয়ে দুজন বুঝদার মানুষ সারাক্ষণই পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করতে পারে। নস্টালজিয়ার সমস্যাটাও আসলে এই কাতারে পড়ে। সংস্কৃতিমনা লোকজনরা তো সবসময়ই—শিল্প কিংবা পপ-সংগীতের ক্ষেত্রে তো বটেই—নস্টালজিয়ার ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। একটা নতুন প্রজন্ম দ্বিধান্বিত হওয়া সত্ত্বেও যখন সামাজিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে, তখন একটা চক্রের মতো এই বিতর্কটা ফিরে আসে। আমার ধারণা যদি কখনো এই চক্রটা বন্ধ হয়ে যায়, আমরা হয়তো সেই সময়টাকে মনে করে নস্টালজিক হব, যেই সময়টাতে বিতর্কটা লোকজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল!     

বর্তমানে নস্টালজিয়া নিয়ে আলাপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ লেখক সাইমন রেইনল্ডসের বই Retromania: Pop Culture’s Addiction to Its Own PastSlate-এ এই বইয়ের প্রচারণার সময়ে তিনি দুটি বইয়ের কথা বলেছিলেন : Everybody Loves Our Town (গ্রাঞ্জ মিউজিক নিয়ে) এবং “I Want My MTV” (মূলত আশির দশকের সংগীত নিয়ে)। রেইনল্ডসের মতে দুটি বইয়েই নস্টালজিয়ার প্রভাব আছে। কিন্তু এই দুই বইয়ের লেখক তার এই ধারণাকে বিনয়ের সাথেই নাকচ করে দিয়েছেন (কারণ, ধারণা করা হয় নস্টালজিয়া সাধারণত সাহিত্যিকভাবে নেতিবাচক অর্থই ধারণ করে)। তবে এটিই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের একজন সংগীতলেখক Pitchfork-এ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছেন। আমি যা বলেছি, তার আলাপ ঠিক সেরকমই—যে কারণেই হোক না কেন, এই নস্টালজিয়ার সমস্যাটা হঠাৎ করেই লেখকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদল মানুষ নানান কায়দায় নস্টালজিয়াকে সমর্থন বা এর বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। অবশ্য তাদের এত এত আলোচনার মধ্য থেকে অল্প কিছু যুক্তিই আমাকে আলোড়িত করতে পেরেছে। এসব যুক্তির চাইতে আমি বরং আগ্রহ পাই এই প্রশ্নটিতে যে, মানুষ কেন নস্টালজিয়া অনুভব করে, বিশেষত এই অনুভূতিটা যখন এমন একটা কিছু থেকে আসে, যার সাথে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো মিলই থাকে না! নস্টালজিয়া ভালো না কি মন্দ আমি সেই আলোচনাতেই যাব না। এই বিশেষণ দুটি এই আলোচনার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই খাটে না।              

আসলে, এই প্রবন্ধটি শেষ করার পরদিনই আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম।  

কিন্তু তা-ও, কোনো সমস্যাকে এড়াতে চাইলে প্রথমেই সমস্যাটাকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে হয়। আমার মতে এই বিতর্কের তিনটি প্রধান দিক আছে। অবশ্য এর কোনোটাই নতুন কিছু না। শিল্পের প্রতি এক ধরনের অন্ধ-আনুগত্যের জন্যই বেশিরভাগ বুঝদার মানুষ এবং সমালোচক নস্টালজিয়াকে খারাপ চোখে দেখে। আপনি অতীতের কোনোকিছুকে নিঃস্বার্থভাবে যদি ভালোবাসেন, তাহলে আপনি হয়তো সেই পুরো সময়কালটাকেই ভালোবাসেন। আরও সহজভাবে বললে, আপনি শুধু যে Baby Got Back গানটি শুনছেন, তা নয়। আপনি আসলে শুনছেন এমন একটি গান যা আপনাকে আপনার অতীতের সুখের সময়টার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আপনি অবচেতনে সুখময় সেই অতীতের সাথে গানটিকে মিলিয়ে ফেলছেন এবং গানটি প্রথম শোনার সেই আনন্দময় স্মৃতি থেকে বর্তমানকে আলাদা করতে পারছেন না।   
[এর পাল্টা যুক্তিটা এমন হতে পারে: যেকোনো মহৎ শিল্পই অতীতের সাথে বর্তমানকে এমন চমৎকারভাবে মিলিয়ে দেয়।


দ্বিতীয় সমালোচনাটা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে নিজের হীনমন্যতাকে ঢেকে দেওয়ার একটা প্রয়াস। আমরা নিজেদের অতীতের কোনো ঘটনাকে যখন ইতিবাচকভাবে মনে করি, আমরা ভাবি সেই ঘটনাগুলো সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই ঘটনাগুলো যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তার মানে হচ্ছে আমাদের জীবনটাও ঠিক একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই ঘটনাগুলোই তো আমাদের অতীতটাকে তৈরি করেছে।     

[পাল্টা যুক্তি : ব্যক্তিগত স্মৃতি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিগত স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই আমাদের বাস্তবতা তৈরি হয়।]   

তৃতীয় সমালোচনা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে অলসদের হাতিয়ার এবং জীবনবিমুখ। নস্টালজিয়া মানুষের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে।

[এর পাল্টা যুক্তি হতে পারে এমন : এমনকি যারা নস্টালজিয়াকে রীতিমতো অপছন্দই করে, তারাও  এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে নস্টালজিয়া ভালোলাগার একটা অনুভূতি তৈরি করে। আর ভালোলাগার এই অনুভূতিই  হয়তো জীবনের মুখ্য বিষয়।]  

এই প্রধান তিনটি আলাপের বাইরেও নস্টালজিয়া নিয়ে আরও অনেক কিছু বলা যায়। আপনি নস্টালজিয়ার পক্ষে থাকুন বা বিপক্ষে, আপনার কোনো না কোনো যুক্তি এই অনুচ্ছেদের কোথাও না কোথাও মিলে যাবেই। এই তিন আলাপের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিতর্কটা আসলে দাঁড়িয়ে আছে শিল্প এবং জীবনবাস্তবতার সূক্ষ্ম মিশেলের মধ্যে। নস্টালজিয়ায় আমরা এমনসব স্মৃতির প্রতি টান অনুভব করি যা সবসময়ই আমাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা সেই অতীতের দিকে। এই যাত্রাটা কখনো খুব দারুণ হয়, কখনোবা হয় অত্যন্ত করুণ।  

কিন্তু আমরা যদি নস্টালজিয়াকে শুধু এভাবেই ব্যাখ্যা করি, তাহলে কেমন হয়? আমরা যেরকমটা ধারণা করি, নস্টালজিয়ার সাথে যদি আমাদের জীবনের সম্পর্কটা অতটাও না থাকে, তাহলেই বা কেমন হবে? 

অথবা নস্টালজিয়াকে যদি কেবলই আকস্মিক পুনরাবৃত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে?   

মনে করুন, অনেক আগে সম্পর্ক ছিল, এমন কারও সাথে আপনি আপনার একটি ফটোগ্রাফ দেখছেন। আপনি যদি স্বাভাবিক থাকেন, তাহলে বলাই যায়, ছবিটি আপনাকে একটা ভালো অনুভূতি দেবে। এমনকি ছবির ব্যক্তিটি আপনাকে যদি কষ্টও দিয়ে থাকে, সেই কষ্টের অনুভূতিগুলোও আপনি বিনা ক্লেশেই মনে করতে পারবেন। এটিই আসলে নস্টালজিয়া : আপনি এমনকিছু দেখছেন যা আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এই ছবিটির সাথে সম্পর্কিত সব ঘটনাই আপনি কল্পনা করতে পারছেন। আপনি অবশ্যই এই ছবিটির ফ্রেমিং বা কম্পোজিশন নিয়ে ভাববেন না। কিংবা আপনি এটাও বলবেন না যে, এটি পেশাদার ফটোগ্রাফ হয়েছে কি না, তা আমি জানি না; আমি শুধু ছবি তোলার দিনটি সম্পর্কেই সবকিছু বলতে পারি। মানে হচ্ছে, ছবিটি কীভাবে তোলা হচ্ছে তা আপনাকে মোটেই ভাবাচ্ছে না। ছবিটি শুধুমাত্র আপনাকে অতীতের সেই স্মৃতিটুকুই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এজনই পুরোনো কোনো গান (অথবা বই, অথবা কোনো সিনেমা) নিয়ে ভাবতে গেলেই ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে যায়। এমন না যে এই গানের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত স্মৃতিটাই আমাদের ভালো লাগার মূল কারণ। আমরা মূলত গানটিই ভালোবাসি, এমনকি গানটি সেই প্রথম শোনার অভিজ্ঞতা মনে না থাকলেও। তবুও আমরা এই পুরো অনুভূতিটাকে নস্টালজিয়ার কাতারে ফেলি। এভাবেই পুরো ব্যাপারটাকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়।

নস্টালজিয়াঃ প্রতীকী ছবি

সিনেমার ব্যাপারটা অবশ্য আরও বিভ্রান্তিকর। একটা গান বারবার শোনা যায়, কিন্তু একটা সিনেমা বারবার অতটা দেখা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তা-ও ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন Footloose সিনেমাটির রিমেক করা হবে বলে ঘোষণা এল, তখন অনেকেই ভেবেছিল, আবার কেন এই সিনেমা! হলিউডের কি সব আইডিয়া শেষ? কিন্তু আমার মনে হয় এমন অনেক নারীই আছেন, নব্বইয়ের দশকে যখন তারা কিশোরী, এই সিনেমাটি ডিভিডিতে অনেকবার দেখেছেন। ঠিক তেমনই আশির দশকের মেয়েরা লেজার ডিস্কে বারবার Grease  সিনেমাটি দেখেছে। Footloose সিনেমাটিই হয়তো আমাদের এই আলাপের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ—এটা এমন একটা সিনেমা, যা শুধুমাত্র তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, যারা এটা বারবার দেখেছে। বলে রাখা ভালো, কোনো মেসেজ, অভিনয় বা বিশেষ কোনো চিন্তার জন্য কিন্তু নয়, তারা এই সিনেমাটি বারবার দেখেছে শুধুমাত্র দেখার অভ্যাসের জন্যই। 

আসলে এমনটা ভাবা ঠিক নয়।  

অতীতের কোনো গান, সিনেমা, ছবি বা যেকোনো শিল্পকর্ম আবার নতুন করে দেখলে এমনিতেই আমাদের ভালো লাগে, এমন ভাবার কোনো কারণই নেই। অতীতের সেই সময়টা হয়তো ঠিকঠাক আমাদের মনেও নেই, অথবা এতটা আহামরি কিছু ছিল না। হ্যাঁ, কিছু গান অবশ্যই হয়তো নির্দিষ্ট মানুষ বা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোন ধরনের গান শুনলে তুমি নস্টালজিক হয়ে যাও, তবে আমরা এই ধরনের গানের কথাই বলব। কিন্তু পুরোনো এমন অনেক গানই আছে, যা শুধুমাত্র ভালোলাগার অনুভূতিটাই দেয়। অতীতের কোনোরকম স্মৃতির সাথেই এর কোনো যোগাযোগ নেই, তবুও তা শুনলে মন আনন্দে ভরে ওঠে। একে স্মৃতি ছাড়া নস্টালজিয়া বলা যেতে পারে। ব্যাপারটা আসলে এমন, জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা কিছু গানই ঘুরেফিরে বারবার শুনতাম। আর একারণে গানগুলো অবচেতনেই আমাদের মনে স্থায়ীভাবে ভালোলাগার জায়গা করে নিয়েছে। এই ভালোলাগার সাথে তখনকার সময়ে জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের কোনো সংযোগ যে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। নস্টালজিয়া আসলে একটা অভ্যাস, যা আমাদের গান শোনার আনন্দটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়, এই আর কী।  

আরেকটু বুঝিয়ে বলি। একটা সময়ে আমার কাছে মাত্র ছয়টা ক্যাসেট ছিল। এর মধ্যে একটা অজি অসবর্নের Bark at the Moon। আমার মনে হয় এই অ্যালবামটি অসবর্নের চতুর্থ কিংবা বড়জোর তৃতীয়-সেরা অ্যালবাম। কিন্তু আমি এই অ্যালবামটিই সবচেয়ে বেশিবার শুনেছি। কারণটা স্বাভাবিক, আমার কাছে অন্য আর পাঁচটা ক্যাসেট ছাড়া আর কিছু ছিলও না। আসলে সত্যি বলতে আমি যতবার Bark at the Moon শুনেছি, অসবর্নের অন্য সব অ্যালবাম মিলিয়েও হয়তো ততবার শুনিনি!    

এই অ্যালবামের সাইড টু-এর প্রথম গানটি ছিল Center of Eternity। গানটা একটু ভারিক্কি ধরনের আর অনেকটাই ক্লিশে। এই গানের সাথে আমার ব্যক্তিজীবনের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এবং গানটি কোনোভাবে আমাকে স্মৃতিকাতরও করে তোলে না। এই নিবন্ধটি লেখার আগে, অন্তত দশ বছর হবে, আমি গানটি শুনিনি। কিন্তু এখন গানটা আবার যখন শুনলাম, বেশ ভালো লাগল। মনে হলো একদম নতুন কিছু শুনলাম। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। শুধু যে গানটাই ভালো লাগল তা নয়, এর প্রতিটি অংশই (প্রথমদিকের অতিরঞ্জিত অর্গান, জেক ই. লির গিটার টিউনিং, যখন ড্রাম বাজতে শুরু করল, এর হাস্যকর সাই-ফাই লিরিকস ইত্যাদি) আমার নতুন করে আমার কাছে ধরা দিল। মোটকথা এই গানটা যতটা উপভোগ করা সম্ভব, ঠিক ততটাই আমি উপভোগ করলাম। এই গানের সাথে কিন্তু আমার আশির দশকের স্মৃতির কোনো যোগসূত্রই নেই। তখনকার অনেককিছুই আমার মনে নেই। এই গানটা এখন আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে, এর কারণ একটাই—তখন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বছরের ৩৬৫ দিনই এই অজি অসবর্নের গানগুলো শুনতাম। এটা কোনো আবেগের বিষয় না।  বরং এই অভিজ্ঞতা রীতিমতো অঙ্কের মতো ছককষা। নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে এই গানটাকে আমি অতিমহৎ কিছু হিসেবে দেখিনি, বরং এই গানটা আমি এতবার শুনেছি যে না চাইতেও এখন আমি গানটার আদ্যোপান্ত বুঝতে পারি। আমরা হয়তো আমাদের স্মৃতিগুলোর প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দিই না, কিংবা হয়তো কোনো বিষয়ের সাথে আমাদের যে অনেকদিনের সম্পর্ক, তা নিয়ে আমরা উদাসীন থাকি। আসলে কোনোকিছুকে বারবার অনুভব করতে না পারলে তা কখনোই অর্থবহ কিছু হয়ে ওঠে না।    

আপনিও কিন্তু একটা কাজ করতে পারেন। তেমন শোনা হয়নি, আগামী ছয়মাস ধরে এমন কোনো গান আপনি প্রতিদিন দুইবার করে শুনবেন। আমি নিশ্চিত দশ বছর পর যদি আপনি গানটি আবার শোনেন, আপনার বেশ ভালো লাগবে, যদিও আপনার এখনকার জীবনযাপনের সঙ্গে গানটির কোনো সম্পর্কই নেই। এক কাজ করা যাক। এখন যারা এই প্রবন্ধটি পড়ছেন, তারা সবাই White Rune গানটি ডাউনলোড করুন। NCAA টুর্নামেন্ট শুরু না হওয়া পর্যন্ত গানটি সকাল-বিকাল দুইবেলা শুনবেন। তারপর ২০২১ সালে আপনাদের সাথে আবার কথা হবে। তখন এই গান নিয়ে আপনাদের অনুভূতির কথা শুনব। 

এবং আমার মনে হয় কি জানেন, এটাই আমাদের বর্তমানের নস্টালজিয়ার সমস্যাকে দশ বছর আগের সমস্যার চেয়ে জটিল করে তুলেছে। আমি আসলে যা বলতে চাই, জোর করে বারবার কিছু করার মাধ্যমে নস্টালজিয়ার যে মিথ্যা একটা অনুভূতি তৈরি করে মানুষ, তার আয়ু শেষ হয়েছে। এমনটা আর কখনোই হবে না।

আমি বুঝি না, এই ২০১১ সালে এসেও মানুষ কেন প্রতিদিনই একটা গান শুনবে। এমনকি সবচেয়ে পছন্দের গানও তো এতবার শোনার কোনো মানে হয় না। এটা তো প্রতিদিন সকালে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে শুধুমাত্র Jonathan Livingston Seagull পড়ার মতোই ব্যাপার হবে! এখন তো ফ্রিতেই গান শোনা যায়, তাই ক্যাসেট কেনার ঝামেলাতেও কাউকে পড়তে হয় না। রেডিও কেউ আর আগের মতো শোনে না (মানে গান আর শ্রোতাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না!), এমটিভির ভিডিও-ও আর কেউ দেখে না। আর স্পটিফাই তো রীতিমতো গেমচেঞ্জার। আধুনিক জামানার পপ গানের রেকর্ডিং আর প্রোডাকশনের ধরনও কিন্তু পাল্টে গেছে। ডিজিটাল দুনিয়ায়  রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়াই এর লক্ষ্য। রিয়ানার Loud অ্যালবামটার প্রথম নব্বই সেকেন্ড শুনে দেখুন তো—যদি প্রথবারেই ভালো না লাগে, একমাস ধরে শুনলেও তা ভালো লাগবে না। আর এখন তো সমালোচক বা বোদ্ধারা কোনো অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেন, বিশেষ Radiohead-এর The King of Limbs অথবা Kanye এবং Jay-Z-এর Watch the Throne-এর মতো অ্যালবামগুলোর ক্ষেত্রে তো এই কথা দিনের আলোর মতোই সত্য। এখন কেউ যদি বলে যে ‘একটা গান খুব বেশি চলছে’, এর মানে হচ্ছে গানটি বেশি বেশি বিজ্ঞাপন বা সিনেমার ট্রেইলারে জায়গা করে নিতে পেরেছে।   

আসলে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না, এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা ভালো না কি মন্দ, বা ভালো-মন্দের বাইরের কিছু একটা। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আর্টিস্টদের জন্য এই পরিবর্তনটা নেতিবাচক কিছুই হবে। অবশ্য সাধারণ ভোক্তারা একে দেখবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে, আর সিরিয়াস মিউজিক ফ্যানদের এতে কিছুই যায়-আসে না। তবে নস্টালজিয়া নিয়ে আমাদের এতদিনকার ধারণাকে (সেটা ঠিক বা ভুল যা-ই হোক না কেন) এটা নিশ্চিতভাবেই বদলে দেবে। নস্টালজিয়ার ধারণা যে একেবারে নাই হয়ে যাবে, তা না, তবে নস্টালজিয়া আগের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আমাদের কাছে ধরা দেবে।   

নস্টালজিয়ার ব্যাপারটাকে যদি অপছন্দ করেন তাহলে এই পরিবর্তন আপনার ভালোই লাগবে। আপনার মনে হবে, ‘ভালোই হয়েছে, এখন আর কারও এই যুক্তি শুনতে হবে না যে, তারা স্কুল জীবনে পার্ল জ্যামের No Code অনেকবার শুনত বলেই এই গানটা এখনো ভালো!’ বাস্তবতা হচ্ছে, নিজেদের তৈরি করা এই নস্টালজিয়ার ধারণা নাই হয়ে গেলে অতীত ইতিহাসের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, কারণ ইন্টারনেটে সবকিছুই থাকে। এমনকি মানুষ যা মনে রাখতে পারে না, তা-ও। যেহেতু ইন্টারনেট হচ্ছে একটা কিউরেটর-ভিত্তিক মাধ্যম, স্বাভাবিকভাবেই যা অতীতকে ধারণ করতে পারে। পার্ল জ্যামের টিকে থাকার জন্য আমাদের তাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হবে না। ৫০০ বছর পরেও মোজার্ট, জন ফিলিপ সাউসা বা চাক বেরির চাইতেও এডি ভেডারের  সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাব, তখন হয়তো আমেরিকার কেউই আর জানবে না যে Jeremy বলে একটা গান ছিল! মেনে নিতে অস্বস্তি লাগলেও এই কথাটা সত্য যে ইন্টারনেট আমাদের স্মৃতিশক্তির ব্যবহার একরকম কমিয়েই দিয়েছে। ভালো স্মৃতিশক্তি থাকাটা একসময় দারুণ একটা ব্যাপার ছিল, এতে বেশ সুবিধা পাওয়া যেত। এখন এই সময়ে এসে ভালো স্মৃতিশক্তি মনে মনে চার অঙ্কের সংখ্যা গুণ করে লোকজনকে তাক লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।  

ভাববেন না যে, আমি পার্ল জ্যামের সমালোচনা করছি। এই ব্যান্ডটা আমি পছন্দ করি। আসলে এই ধরনের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আলাপে পার্ল জ্যামকেই ব্যবহার করা সহজ। অবশ্য আমি বিব্রতই হই, আমি পার্ল জ্যামকে নিয়ে কিছু লিখলেই কেন যেন মনে হয় আমি আসলে তাদের সমালোচনাই করছি, ঠিক যেমনটা পোস্ট অফিসের ক্ষেত্রে হয়!

অবশ্য এতকিছুর পরেও, মানুষ তার অতীতকে মনে রাখতে চায়। মানুষ তার নিজের অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসে। এই স্মৃতিই জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। জীবনের পর্যায় তো এই দুটিই—এখন যা করছি, আগে যা করেছিলাম। এজন্যই একটা গান বারবার শুনলে তা শুধুমাত্র ভালোলাগার একটা গানই থাকে না, আরও মহৎ কিছু হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়, অবচেতনেই আমরা সেই সময়ের কথা, সেই সময়ের চিন্তাগুলোর কথা মনে করতে পারি। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই আর একটা গান বারবার শোনে না। যখন এটাও বন্ধ হয়ে যাবে—যখন বছরে প্রতিদিন কেউ আর Centre of Eternity গানটা শুনবে না—তখনকার অভিজ্ঞতা কেমন হবে?  

আমার মনে হয়, তখন অন্য মানুষই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। 

পুনরাবৃত্তির চাইতে তখন মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগটাই মুখ্য হবে। বারবার একই কাজ করে করে নস্টালজিয়া তৈরি করার বদলে আমরা এমনসব মুহূর্ত নিয়ে আরেক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করব, যেই মুহূর্তগুলোতে মনে হবে আশেপাশের সবাই মিলে একসাথে একই কাজ করছে। মানে এক গান কেউ আর ১০০০ বার শুনবে না, বরং মানুষ সেই সময়টাই মনে রাখবে যখন সে আর ৯৯৯ জন মিলে একটা গান একবারই শুনে টুইটার বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তা নিয়ে আলাপ করবে। এই ছোট অভিজ্ঞতাটাই তখন অনেক বড় কিছু বলে মনে হবে। এটা ভালো না মন্দ—এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, কিন্তু আমি এটা অন্তত বুঝতে পারি, কিছু মানুষ থাকবে, যারা তাদের পুরোনো দিনের কথা মনে করে সত্যিই খুব মনখারাপ করবে।   

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।