Klosterman profile
চাক ক্লস্টারম্যান
পপ কালচার ক্রিটিক
ahmed kabir
আহমেদ কবির
কথাসাহিত্যিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা



আমরা কেন নস্টালজিয়া অনুভব করি?   
আর বিনোদনের এই অস্বাভাবিক সহজলভ্যতা কি আমাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর  ধরন-ধারণকে বদলে দিচ্ছে?    

কিছু সমস্যা সারাজীবনই থেকে যায়। ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, এই সমস্যাগুলোর আদতে কোনো সমাধানই নেই। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, এগুলো আসলে কোনো সমস্যাই না, নিতান্তই কিছু অযৌক্তিক ব্যাপার-স্যাপার। আর সমস্যাগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে, যা নিয়ে দুজন বুঝদার মানুষ সারাক্ষণই পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করতে পারে। নস্টালজিয়ার সমস্যাটাও আসলে এই কাতারে পড়ে। সংস্কৃতিমনা লোকজনরা তো সবসময়ই—শিল্প কিংবা পপ-সংগীতের ক্ষেত্রে তো বটেই—নস্টালজিয়ার ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। একটা নতুন প্রজন্ম দ্বিধান্বিত হওয়া সত্ত্বেও যখন সামাজিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে, তখন একটা চক্রের মতো এই বিতর্কটা ফিরে আসে। আমার ধারণা যদি কখনো এই চক্রটা বন্ধ হয়ে যায়, আমরা হয়তো সেই সময়টাকে মনে করে নস্টালজিক হব, যেই সময়টাতে বিতর্কটা লোকজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল!     

বর্তমানে নস্টালজিয়া নিয়ে আলাপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ লেখক সাইমন রেইনল্ডসের বই Retromania: Pop Culture’s Addiction to Its Own PastSlate-এ এই বইয়ের প্রচারণার সময়ে তিনি দুটি বইয়ের কথা বলেছিলেন : Everybody Loves Our Town (গ্রাঞ্জ মিউজিক নিয়ে) এবং “I Want My MTV” (মূলত আশির দশকের সংগীত নিয়ে)। রেইনল্ডসের মতে দুটি বইয়েই নস্টালজিয়ার প্রভাব আছে। কিন্তু এই দুই বইয়ের লেখক তার এই ধারণাকে বিনয়ের সাথেই নাকচ করে দিয়েছেন (কারণ, ধারণা করা হয় নস্টালজিয়া সাধারণত সাহিত্যিকভাবে নেতিবাচক অর্থই ধারণ করে)। তবে এটিই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের একজন সংগীতলেখক Pitchfork-এ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছেন। আমি যা বলেছি, তার আলাপ ঠিক সেরকমই—যে কারণেই হোক না কেন, এই নস্টালজিয়ার সমস্যাটা হঠাৎ করেই লেখকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদল মানুষ নানান কায়দায় নস্টালজিয়াকে সমর্থন বা এর বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। অবশ্য তাদের এত এত আলোচনার মধ্য থেকে অল্প কিছু যুক্তিই আমাকে আলোড়িত করতে পেরেছে। এসব যুক্তির চাইতে আমি বরং আগ্রহ পাই এই প্রশ্নটিতে যে, মানুষ কেন নস্টালজিয়া অনুভব করে, বিশেষত এই অনুভূতিটা যখন এমন একটা কিছু থেকে আসে, যার সাথে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো মিলই থাকে না! নস্টালজিয়া ভালো না কি মন্দ আমি সেই আলোচনাতেই যাব না। এই বিশেষণ দুটি এই আলোচনার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই খাটে না।              

আসলে, এই প্রবন্ধটি শেষ করার পরদিনই আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম।  

কিন্তু তা-ও, কোনো সমস্যাকে এড়াতে চাইলে প্রথমেই সমস্যাটাকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে হয়। আমার মতে এই বিতর্কের তিনটি প্রধান দিক আছে। অবশ্য এর কোনোটাই নতুন কিছু না। শিল্পের প্রতি এক ধরনের অন্ধ-আনুগত্যের জন্যই বেশিরভাগ বুঝদার মানুষ এবং সমালোচক নস্টালজিয়াকে খারাপ চোখে দেখে। আপনি অতীতের কোনোকিছুকে নিঃস্বার্থভাবে যদি ভালোবাসেন, তাহলে আপনি হয়তো সেই পুরো সময়কালটাকেই ভালোবাসেন। আরও সহজভাবে বললে, আপনি শুধু যে Baby Got Back গানটি শুনছেন, তা নয়। আপনি আসলে শুনছেন এমন একটি গান যা আপনাকে আপনার অতীতের সুখের সময়টার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আপনি অবচেতনে সুখময় সেই অতীতের সাথে গানটিকে মিলিয়ে ফেলছেন এবং গানটি প্রথম শোনার সেই আনন্দময় স্মৃতি থেকে বর্তমানকে আলাদা করতে পারছেন না।   
[এর পাল্টা যুক্তিটা এমন হতে পারে: যেকোনো মহৎ শিল্পই অতীতের সাথে বর্তমানকে এমন চমৎকারভাবে মিলিয়ে দেয়।


দ্বিতীয় সমালোচনাটা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে নিজের হীনমন্যতাকে ঢেকে দেওয়ার একটা প্রয়াস। আমরা নিজেদের অতীতের কোনো ঘটনাকে যখন ইতিবাচকভাবে মনে করি, আমরা ভাবি সেই ঘটনাগুলো সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই ঘটনাগুলো যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তার মানে হচ্ছে আমাদের জীবনটাও ঠিক একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই ঘটনাগুলোই তো আমাদের অতীতটাকে তৈরি করেছে।     

[পাল্টা যুক্তি : ব্যক্তিগত স্মৃতি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিগত স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই আমাদের বাস্তবতা তৈরি হয়।]   

তৃতীয় সমালোচনা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে অলসদের হাতিয়ার এবং জীবনবিমুখ। নস্টালজিয়া মানুষের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে।

[এর পাল্টা যুক্তি হতে পারে এমন : এমনকি যারা নস্টালজিয়াকে রীতিমতো অপছন্দই করে, তারাও  এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে নস্টালজিয়া ভালোলাগার একটা অনুভূতি তৈরি করে। আর ভালোলাগার এই অনুভূতিই  হয়তো জীবনের মুখ্য বিষয়।]  

এই প্রধান তিনটি আলাপের বাইরেও নস্টালজিয়া নিয়ে আরও অনেক কিছু বলা যায়। আপনি নস্টালজিয়ার পক্ষে থাকুন বা বিপক্ষে, আপনার কোনো না কোনো যুক্তি এই অনুচ্ছেদের কোথাও না কোথাও মিলে যাবেই। এই তিন আলাপের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিতর্কটা আসলে দাঁড়িয়ে আছে শিল্প এবং জীবনবাস্তবতার সূক্ষ্ম মিশেলের মধ্যে। নস্টালজিয়ায় আমরা এমনসব স্মৃতির প্রতি টান অনুভব করি যা সবসময়ই আমাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা সেই অতীতের দিকে। এই যাত্রাটা কখনো খুব দারুণ হয়, কখনোবা হয় অত্যন্ত করুণ।  

কিন্তু আমরা যদি নস্টালজিয়াকে শুধু এভাবেই ব্যাখ্যা করি, তাহলে কেমন হয়? আমরা যেরকমটা ধারণা করি, নস্টালজিয়ার সাথে যদি আমাদের জীবনের সম্পর্কটা অতটাও না থাকে, তাহলেই বা কেমন হবে? 

অথবা নস্টালজিয়াকে যদি কেবলই আকস্মিক পুনরাবৃত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে?   

মনে করুন, অনেক আগে সম্পর্ক ছিল, এমন কারও সাথে আপনি আপনার একটি ফটোগ্রাফ দেখছেন। আপনি যদি স্বাভাবিক থাকেন, তাহলে বলাই যায়, ছবিটি আপনাকে একটা ভালো অনুভূতি দেবে। এমনকি ছবির ব্যক্তিটি আপনাকে যদি কষ্টও দিয়ে থাকে, সেই কষ্টের অনুভূতিগুলোও আপনি বিনা ক্লেশেই মনে করতে পারবেন। এটিই আসলে নস্টালজিয়া : আপনি এমনকিছু দেখছেন যা আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এই ছবিটির সাথে সম্পর্কিত সব ঘটনাই আপনি কল্পনা করতে পারছেন। আপনি অবশ্যই এই ছবিটির ফ্রেমিং বা কম্পোজিশন নিয়ে ভাববেন না। কিংবা আপনি এটাও বলবেন না যে, এটি পেশাদার ফটোগ্রাফ হয়েছে কি না, তা আমি জানি না; আমি শুধু ছবি তোলার দিনটি সম্পর্কেই সবকিছু বলতে পারি। মানে হচ্ছে, ছবিটি কীভাবে তোলা হচ্ছে তা আপনাকে মোটেই ভাবাচ্ছে না। ছবিটি শুধুমাত্র আপনাকে অতীতের সেই স্মৃতিটুকুই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এজনই পুরোনো কোনো গান (অথবা বই, অথবা কোনো সিনেমা) নিয়ে ভাবতে গেলেই ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে যায়। এমন না যে এই গানের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত স্মৃতিটাই আমাদের ভালো লাগার মূল কারণ। আমরা মূলত গানটিই ভালোবাসি, এমনকি গানটি সেই প্রথম শোনার অভিজ্ঞতা মনে না থাকলেও। তবুও আমরা এই পুরো অনুভূতিটাকে নস্টালজিয়ার কাতারে ফেলি। এভাবেই পুরো ব্যাপারটাকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়।

নস্টালজিয়াঃ প্রতীকী ছবি

সিনেমার ব্যাপারটা অবশ্য আরও বিভ্রান্তিকর। একটা গান বারবার শোনা যায়, কিন্তু একটা সিনেমা বারবার অতটা দেখা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তা-ও ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন Footloose সিনেমাটির রিমেক করা হবে বলে ঘোষণা এল, তখন অনেকেই ভেবেছিল, আবার কেন এই সিনেমা! হলিউডের কি সব আইডিয়া শেষ? কিন্তু আমার মনে হয় এমন অনেক নারীই আছেন, নব্বইয়ের দশকে যখন তারা কিশোরী, এই সিনেমাটি ডিভিডিতে অনেকবার দেখেছেন। ঠিক তেমনই আশির দশকের মেয়েরা লেজার ডিস্কে বারবার Grease  সিনেমাটি দেখেছে। Footloose সিনেমাটিই হয়তো আমাদের এই আলাপের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ—এটা এমন একটা সিনেমা, যা শুধুমাত্র তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, যারা এটা বারবার দেখেছে। বলে রাখা ভালো, কোনো মেসেজ, অভিনয় বা বিশেষ কোনো চিন্তার জন্য কিন্তু নয়, তারা এই সিনেমাটি বারবার দেখেছে শুধুমাত্র দেখার অভ্যাসের জন্যই। 

আসলে এমনটা ভাবা ঠিক নয়।  

অতীতের কোনো গান, সিনেমা, ছবি বা যেকোনো শিল্পকর্ম আবার নতুন করে দেখলে এমনিতেই আমাদের ভালো লাগে, এমন ভাবার কোনো কারণই নেই। অতীতের সেই সময়টা হয়তো ঠিকঠাক আমাদের মনেও নেই, অথবা এতটা আহামরি কিছু ছিল না। হ্যাঁ, কিছু গান অবশ্যই হয়তো নির্দিষ্ট মানুষ বা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোন ধরনের গান শুনলে তুমি নস্টালজিক হয়ে যাও, তবে আমরা এই ধরনের গানের কথাই বলব। কিন্তু পুরোনো এমন অনেক গানই আছে, যা শুধুমাত্র ভালোলাগার অনুভূতিটাই দেয়। অতীতের কোনোরকম স্মৃতির সাথেই এর কোনো যোগাযোগ নেই, তবুও তা শুনলে মন আনন্দে ভরে ওঠে। একে স্মৃতি ছাড়া নস্টালজিয়া বলা যেতে পারে। ব্যাপারটা আসলে এমন, জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা কিছু গানই ঘুরেফিরে বারবার শুনতাম। আর একারণে গানগুলো অবচেতনেই আমাদের মনে স্থায়ীভাবে ভালোলাগার জায়গা করে নিয়েছে। এই ভালোলাগার সাথে তখনকার সময়ে জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের কোনো সংযোগ যে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। নস্টালজিয়া আসলে একটা অভ্যাস, যা আমাদের গান শোনার আনন্দটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়, এই আর কী।  

আরেকটু বুঝিয়ে বলি। একটা সময়ে আমার কাছে মাত্র ছয়টা ক্যাসেট ছিল। এর মধ্যে একটা অজি অসবর্নের Bark at the Moon। আমার মনে হয় এই অ্যালবামটি অসবর্নের চতুর্থ কিংবা বড়জোর তৃতীয়-সেরা অ্যালবাম। কিন্তু আমি এই অ্যালবামটিই সবচেয়ে বেশিবার শুনেছি। কারণটা স্বাভাবিক, আমার কাছে অন্য আর পাঁচটা ক্যাসেট ছাড়া আর কিছু ছিলও না। আসলে সত্যি বলতে আমি যতবার Bark at the Moon শুনেছি, অসবর্নের অন্য সব অ্যালবাম মিলিয়েও হয়তো ততবার শুনিনি!    

এই অ্যালবামের সাইড টু-এর প্রথম গানটি ছিল Center of Eternity। গানটা একটু ভারিক্কি ধরনের আর অনেকটাই ক্লিশে। এই গানের সাথে আমার ব্যক্তিজীবনের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এবং গানটি কোনোভাবে আমাকে স্মৃতিকাতরও করে তোলে না। এই নিবন্ধটি লেখার আগে, অন্তত দশ বছর হবে, আমি গানটি শুনিনি। কিন্তু এখন গানটা আবার যখন শুনলাম, বেশ ভালো লাগল। মনে হলো একদম নতুন কিছু শুনলাম। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। শুধু যে গানটাই ভালো লাগল তা নয়, এর প্রতিটি অংশই (প্রথমদিকের অতিরঞ্জিত অর্গান, জেক ই. লির গিটার টিউনিং, যখন ড্রাম বাজতে শুরু করল, এর হাস্যকর সাই-ফাই লিরিকস ইত্যাদি) আমার নতুন করে আমার কাছে ধরা দিল। মোটকথা এই গানটা যতটা উপভোগ করা সম্ভব, ঠিক ততটাই আমি উপভোগ করলাম। এই গানের সাথে কিন্তু আমার আশির দশকের স্মৃতির কোনো যোগসূত্রই নেই। তখনকার অনেককিছুই আমার মনে নেই। এই গানটা এখন আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে, এর কারণ একটাই—তখন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বছরের ৩৬৫ দিনই এই অজি অসবর্নের গানগুলো শুনতাম। এটা কোনো আবেগের বিষয় না।  বরং এই অভিজ্ঞতা রীতিমতো অঙ্কের মতো ছককষা। নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে এই গানটাকে আমি অতিমহৎ কিছু হিসেবে দেখিনি, বরং এই গানটা আমি এতবার শুনেছি যে না চাইতেও এখন আমি গানটার আদ্যোপান্ত বুঝতে পারি। আমরা হয়তো আমাদের স্মৃতিগুলোর প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দিই না, কিংবা হয়তো কোনো বিষয়ের সাথে আমাদের যে অনেকদিনের সম্পর্ক, তা নিয়ে আমরা উদাসীন থাকি। আসলে কোনোকিছুকে বারবার অনুভব করতে না পারলে তা কখনোই অর্থবহ কিছু হয়ে ওঠে না।    

আপনিও কিন্তু একটা কাজ করতে পারেন। তেমন শোনা হয়নি, আগামী ছয়মাস ধরে এমন কোনো গান আপনি প্রতিদিন দুইবার করে শুনবেন। আমি নিশ্চিত দশ বছর পর যদি আপনি গানটি আবার শোনেন, আপনার বেশ ভালো লাগবে, যদিও আপনার এখনকার জীবনযাপনের সঙ্গে গানটির কোনো সম্পর্কই নেই। এক কাজ করা যাক। এখন যারা এই প্রবন্ধটি পড়ছেন, তারা সবাই White Rune গানটি ডাউনলোড করুন। NCAA টুর্নামেন্ট শুরু না হওয়া পর্যন্ত গানটি সকাল-বিকাল দুইবেলা শুনবেন। তারপর ২০২১ সালে আপনাদের সাথে আবার কথা হবে। তখন এই গান নিয়ে আপনাদের অনুভূতির কথা শুনব। 

এবং আমার মনে হয় কি জানেন, এটাই আমাদের বর্তমানের নস্টালজিয়ার সমস্যাকে দশ বছর আগের সমস্যার চেয়ে জটিল করে তুলেছে। আমি আসলে যা বলতে চাই, জোর করে বারবার কিছু করার মাধ্যমে নস্টালজিয়ার যে মিথ্যা একটা অনুভূতি তৈরি করে মানুষ, তার আয়ু শেষ হয়েছে। এমনটা আর কখনোই হবে না।

আমি বুঝি না, এই ২০১১ সালে এসেও মানুষ কেন প্রতিদিনই একটা গান শুনবে। এমনকি সবচেয়ে পছন্দের গানও তো এতবার শোনার কোনো মানে হয় না। এটা তো প্রতিদিন সকালে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে শুধুমাত্র Jonathan Livingston Seagull পড়ার মতোই ব্যাপার হবে! এখন তো ফ্রিতেই গান শোনা যায়, তাই ক্যাসেট কেনার ঝামেলাতেও কাউকে পড়তে হয় না। রেডিও কেউ আর আগের মতো শোনে না (মানে গান আর শ্রোতাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না!), এমটিভির ভিডিও-ও আর কেউ দেখে না। আর স্পটিফাই তো রীতিমতো গেমচেঞ্জার। আধুনিক জামানার পপ গানের রেকর্ডিং আর প্রোডাকশনের ধরনও কিন্তু পাল্টে গেছে। ডিজিটাল দুনিয়ায়  রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়াই এর লক্ষ্য। রিয়ানার Loud অ্যালবামটার প্রথম নব্বই সেকেন্ড শুনে দেখুন তো—যদি প্রথবারেই ভালো না লাগে, একমাস ধরে শুনলেও তা ভালো লাগবে না। আর এখন তো সমালোচক বা বোদ্ধারা কোনো অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেন, বিশেষ Radiohead-এর The King of Limbs অথবা Kanye এবং Jay-Z-এর Watch the Throne-এর মতো অ্যালবামগুলোর ক্ষেত্রে তো এই কথা দিনের আলোর মতোই সত্য। এখন কেউ যদি বলে যে ‘একটা গান খুব বেশি চলছে’, এর মানে হচ্ছে গানটি বেশি বেশি বিজ্ঞাপন বা সিনেমার ট্রেইলারে জায়গা করে নিতে পেরেছে।   

আসলে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না, এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা ভালো না কি মন্দ, বা ভালো-মন্দের বাইরের কিছু একটা। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আর্টিস্টদের জন্য এই পরিবর্তনটা নেতিবাচক কিছুই হবে। অবশ্য সাধারণ ভোক্তারা একে দেখবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে, আর সিরিয়াস মিউজিক ফ্যানদের এতে কিছুই যায়-আসে না। তবে নস্টালজিয়া নিয়ে আমাদের এতদিনকার ধারণাকে (সেটা ঠিক বা ভুল যা-ই হোক না কেন) এটা নিশ্চিতভাবেই বদলে দেবে। নস্টালজিয়ার ধারণা যে একেবারে নাই হয়ে যাবে, তা না, তবে নস্টালজিয়া আগের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আমাদের কাছে ধরা দেবে।   

নস্টালজিয়ার ব্যাপারটাকে যদি অপছন্দ করেন তাহলে এই পরিবর্তন আপনার ভালোই লাগবে। আপনার মনে হবে, ‘ভালোই হয়েছে, এখন আর কারও এই যুক্তি শুনতে হবে না যে, তারা স্কুল জীবনে পার্ল জ্যামের No Code অনেকবার শুনত বলেই এই গানটা এখনো ভালো!’ বাস্তবতা হচ্ছে, নিজেদের তৈরি করা এই নস্টালজিয়ার ধারণা নাই হয়ে গেলে অতীত ইতিহাসের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, কারণ ইন্টারনেটে সবকিছুই থাকে। এমনকি মানুষ যা মনে রাখতে পারে না, তা-ও। যেহেতু ইন্টারনেট হচ্ছে একটা কিউরেটর-ভিত্তিক মাধ্যম, স্বাভাবিকভাবেই যা অতীতকে ধারণ করতে পারে। পার্ল জ্যামের টিকে থাকার জন্য আমাদের তাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হবে না। ৫০০ বছর পরেও মোজার্ট, জন ফিলিপ সাউসা বা চাক বেরির চাইতেও এডি ভেডারের  সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাব, তখন হয়তো আমেরিকার কেউই আর জানবে না যে Jeremy বলে একটা গান ছিল! মেনে নিতে অস্বস্তি লাগলেও এই কথাটা সত্য যে ইন্টারনেট আমাদের স্মৃতিশক্তির ব্যবহার একরকম কমিয়েই দিয়েছে। ভালো স্মৃতিশক্তি থাকাটা একসময় দারুণ একটা ব্যাপার ছিল, এতে বেশ সুবিধা পাওয়া যেত। এখন এই সময়ে এসে ভালো স্মৃতিশক্তি মনে মনে চার অঙ্কের সংখ্যা গুণ করে লোকজনকে তাক লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।  

ভাববেন না যে, আমি পার্ল জ্যামের সমালোচনা করছি। এই ব্যান্ডটা আমি পছন্দ করি। আসলে এই ধরনের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আলাপে পার্ল জ্যামকেই ব্যবহার করা সহজ। অবশ্য আমি বিব্রতই হই, আমি পার্ল জ্যামকে নিয়ে কিছু লিখলেই কেন যেন মনে হয় আমি আসলে তাদের সমালোচনাই করছি, ঠিক যেমনটা পোস্ট অফিসের ক্ষেত্রে হয়!

অবশ্য এতকিছুর পরেও, মানুষ তার অতীতকে মনে রাখতে চায়। মানুষ তার নিজের অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসে। এই স্মৃতিই জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। জীবনের পর্যায় তো এই দুটিই—এখন যা করছি, আগে যা করেছিলাম। এজন্যই একটা গান বারবার শুনলে তা শুধুমাত্র ভালোলাগার একটা গানই থাকে না, আরও মহৎ কিছু হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়, অবচেতনেই আমরা সেই সময়ের কথা, সেই সময়ের চিন্তাগুলোর কথা মনে করতে পারি। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই আর একটা গান বারবার শোনে না। যখন এটাও বন্ধ হয়ে যাবে—যখন বছরে প্রতিদিন কেউ আর Centre of Eternity গানটা শুনবে না—তখনকার অভিজ্ঞতা কেমন হবে?  

আমার মনে হয়, তখন অন্য মানুষই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। 

পুনরাবৃত্তির চাইতে তখন মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগটাই মুখ্য হবে। বারবার একই কাজ করে করে নস্টালজিয়া তৈরি করার বদলে আমরা এমনসব মুহূর্ত নিয়ে আরেক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করব, যেই মুহূর্তগুলোতে মনে হবে আশেপাশের সবাই মিলে একসাথে একই কাজ করছে। মানে এক গান কেউ আর ১০০০ বার শুনবে না, বরং মানুষ সেই সময়টাই মনে রাখবে যখন সে আর ৯৯৯ জন মিলে একটা গান একবারই শুনে টুইটার বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তা নিয়ে আলাপ করবে। এই ছোট অভিজ্ঞতাটাই তখন অনেক বড় কিছু বলে মনে হবে। এটা ভালো না মন্দ—এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, কিন্তু আমি এটা অন্তত বুঝতে পারি, কিছু মানুষ থাকবে, যারা তাদের পুরোনো দিনের কথা মনে করে সত্যিই খুব মনখারাপ করবে।   

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।