Klosterman profile
চাক ক্লস্টারম্যান
পপ কালচার ক্রিটিক
ahmed kabir
আহমেদ কবির
কথাসাহিত্যিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা



আমরা কেন নস্টালজিয়া অনুভব করি?   
আর বিনোদনের এই অস্বাভাবিক সহজলভ্যতা কি আমাদের অতীতের দিকে ফিরে তাকানোর  ধরন-ধারণকে বদলে দিচ্ছে?    

কিছু সমস্যা সারাজীবনই থেকে যায়। ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, এই সমস্যাগুলোর আদতে কোনো সমাধানই নেই। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায় যে, এগুলো আসলে কোনো সমস্যাই না, নিতান্তই কিছু অযৌক্তিক ব্যাপার-স্যাপার। আর সমস্যাগুলো এতটাই অস্পষ্ট যে, যা নিয়ে দুজন বুঝদার মানুষ সারাক্ষণই পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক করতে পারে। নস্টালজিয়ার সমস্যাটাও আসলে এই কাতারে পড়ে। সংস্কৃতিমনা লোকজনরা তো সবসময়ই—শিল্প কিংবা পপ-সংগীতের ক্ষেত্রে তো বটেই—নস্টালজিয়ার ভালো-মন্দ নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে। একটা নতুন প্রজন্ম দ্বিধান্বিত হওয়া সত্ত্বেও যখন সামাজিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসে, তখন একটা চক্রের মতো এই বিতর্কটা ফিরে আসে। আমার ধারণা যদি কখনো এই চক্রটা বন্ধ হয়ে যায়, আমরা হয়তো সেই সময়টাকে মনে করে নস্টালজিক হব, যেই সময়টাতে বিতর্কটা লোকজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল!     

বর্তমানে নস্টালজিয়া নিয়ে আলাপের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে ব্রিটিশ লেখক সাইমন রেইনল্ডসের বই Retromania: Pop Culture’s Addiction to Its Own PastSlate-এ এই বইয়ের প্রচারণার সময়ে তিনি দুটি বইয়ের কথা বলেছিলেন : Everybody Loves Our Town (গ্রাঞ্জ মিউজিক নিয়ে) এবং “I Want My MTV” (মূলত আশির দশকের সংগীত নিয়ে)। রেইনল্ডসের মতে দুটি বইয়েই নস্টালজিয়ার প্রভাব আছে। কিন্তু এই দুই বইয়ের লেখক তার এই ধারণাকে বিনয়ের সাথেই নাকচ করে দিয়েছেন (কারণ, ধারণা করা হয় নস্টালজিয়া সাধারণত সাহিত্যিকভাবে নেতিবাচক অর্থই ধারণ করে)। তবে এটিই কিন্তু একমাত্র উদাহরণ নয়। নিউইয়র্ক ম্যাগাজিনের একজন সংগীতলেখক Pitchfork-এ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করেছেন। আমি যা বলেছি, তার আলাপ ঠিক সেরকমই—যে কারণেই হোক না কেন, এই নস্টালজিয়ার সমস্যাটা হঠাৎ করেই লেখকদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে একদল মানুষ নানান কায়দায় নস্টালজিয়াকে সমর্থন বা এর বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন। অবশ্য তাদের এত এত আলোচনার মধ্য থেকে অল্প কিছু যুক্তিই আমাকে আলোড়িত করতে পেরেছে। এসব যুক্তির চাইতে আমি বরং আগ্রহ পাই এই প্রশ্নটিতে যে, মানুষ কেন নস্টালজিয়া অনুভব করে, বিশেষত এই অনুভূতিটা যখন এমন একটা কিছু থেকে আসে, যার সাথে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো মিলই থাকে না! নস্টালজিয়া ভালো না কি মন্দ আমি সেই আলোচনাতেই যাব না। এই বিশেষণ দুটি এই আলোচনার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই খাটে না।              

আসলে, এই প্রবন্ধটি শেষ করার পরদিনই আমি ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম।  

কিন্তু তা-ও, কোনো সমস্যাকে এড়াতে চাইলে প্রথমেই সমস্যাটাকে ঠিকঠাক চিহ্নিত করতে হয়। আমার মতে এই বিতর্কের তিনটি প্রধান দিক আছে। অবশ্য এর কোনোটাই নতুন কিছু না। শিল্পের প্রতি এক ধরনের অন্ধ-আনুগত্যের জন্যই বেশিরভাগ বুঝদার মানুষ এবং সমালোচক নস্টালজিয়াকে খারাপ চোখে দেখে। আপনি অতীতের কোনোকিছুকে নিঃস্বার্থভাবে যদি ভালোবাসেন, তাহলে আপনি হয়তো সেই পুরো সময়কালটাকেই ভালোবাসেন। আরও সহজভাবে বললে, আপনি শুধু যে Baby Got Back গানটি শুনছেন, তা নয়। আপনি আসলে শুনছেন এমন একটি গান যা আপনাকে আপনার অতীতের সুখের সময়টার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। আপনি অবচেতনে সুখময় সেই অতীতের সাথে গানটিকে মিলিয়ে ফেলছেন এবং গানটি প্রথম শোনার সেই আনন্দময় স্মৃতি থেকে বর্তমানকে আলাদা করতে পারছেন না।   
[এর পাল্টা যুক্তিটা এমন হতে পারে: যেকোনো মহৎ শিল্পই অতীতের সাথে বর্তমানকে এমন চমৎকারভাবে মিলিয়ে দেয়।


দ্বিতীয় সমালোচনাটা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে নিজের হীনমন্যতাকে ঢেকে দেওয়ার একটা প্রয়াস। আমরা নিজেদের অতীতের কোনো ঘটনাকে যখন ইতিবাচকভাবে মনে করি, আমরা ভাবি সেই ঘটনাগুলো সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই ঘটনাগুলো যদি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হয়, তার মানে হচ্ছে আমাদের জীবনটাও ঠিক একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই ঘটনাগুলোই তো আমাদের অতীতটাকে তৈরি করেছে।     

[পাল্টা যুক্তি : ব্যক্তিগত স্মৃতি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিগত স্মৃতির উপর ভিত্তি করেই আমাদের বাস্তবতা তৈরি হয়।]   

তৃতীয় সমালোচনা হচ্ছে, নস্টালজিয়া আসলে অলসদের হাতিয়ার এবং জীবনবিমুখ। নস্টালজিয়া মানুষের সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে।

[এর পাল্টা যুক্তি হতে পারে এমন : এমনকি যারা নস্টালজিয়াকে রীতিমতো অপছন্দই করে, তারাও  এটা স্বীকার করতে বাধ্য যে নস্টালজিয়া ভালোলাগার একটা অনুভূতি তৈরি করে। আর ভালোলাগার এই অনুভূতিই  হয়তো জীবনের মুখ্য বিষয়।]  

এই প্রধান তিনটি আলাপের বাইরেও নস্টালজিয়া নিয়ে আরও অনেক কিছু বলা যায়। আপনি নস্টালজিয়ার পক্ষে থাকুন বা বিপক্ষে, আপনার কোনো না কোনো যুক্তি এই অনুচ্ছেদের কোথাও না কোথাও মিলে যাবেই। এই তিন আলাপের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিতর্কটা আসলে দাঁড়িয়ে আছে শিল্প এবং জীবনবাস্তবতার সূক্ষ্ম মিশেলের মধ্যে। নস্টালজিয়ায় আমরা এমনসব স্মৃতির প্রতি টান অনুভব করি যা সবসময়ই আমাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা সেই অতীতের দিকে। এই যাত্রাটা কখনো খুব দারুণ হয়, কখনোবা হয় অত্যন্ত করুণ।  

কিন্তু আমরা যদি নস্টালজিয়াকে শুধু এভাবেই ব্যাখ্যা করি, তাহলে কেমন হয়? আমরা যেরকমটা ধারণা করি, নস্টালজিয়ার সাথে যদি আমাদের জীবনের সম্পর্কটা অতটাও না থাকে, তাহলেই বা কেমন হবে? 

অথবা নস্টালজিয়াকে যদি কেবলই আকস্মিক পুনরাবৃত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তবে?   

মনে করুন, অনেক আগে সম্পর্ক ছিল, এমন কারও সাথে আপনি আপনার একটি ফটোগ্রাফ দেখছেন। আপনি যদি স্বাভাবিক থাকেন, তাহলে বলাই যায়, ছবিটি আপনাকে একটা ভালো অনুভূতি দেবে। এমনকি ছবির ব্যক্তিটি আপনাকে যদি কষ্টও দিয়ে থাকে, সেই কষ্টের অনুভূতিগুলোও আপনি বিনা ক্লেশেই মনে করতে পারবেন। এটিই আসলে নস্টালজিয়া : আপনি এমনকিছু দেখছেন যা আপনাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এই ছবিটির সাথে সম্পর্কিত সব ঘটনাই আপনি কল্পনা করতে পারছেন। আপনি অবশ্যই এই ছবিটির ফ্রেমিং বা কম্পোজিশন নিয়ে ভাববেন না। কিংবা আপনি এটাও বলবেন না যে, এটি পেশাদার ফটোগ্রাফ হয়েছে কি না, তা আমি জানি না; আমি শুধু ছবি তোলার দিনটি সম্পর্কেই সবকিছু বলতে পারি। মানে হচ্ছে, ছবিটি কীভাবে তোলা হচ্ছে তা আপনাকে মোটেই ভাবাচ্ছে না। ছবিটি শুধুমাত্র আপনাকে অতীতের সেই স্মৃতিটুকুই মনে করিয়ে দিচ্ছে। এজনই পুরোনো কোনো গান (অথবা বই, অথবা কোনো সিনেমা) নিয়ে ভাবতে গেলেই ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে যায়। এমন না যে এই গানের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত স্মৃতিটাই আমাদের ভালো লাগার মূল কারণ। আমরা মূলত গানটিই ভালোবাসি, এমনকি গানটি সেই প্রথম শোনার অভিজ্ঞতা মনে না থাকলেও। তবুও আমরা এই পুরো অনুভূতিটাকে নস্টালজিয়ার কাতারে ফেলি। এভাবেই পুরো ব্যাপারটাকে বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়।

নস্টালজিয়াঃ প্রতীকী ছবি

সিনেমার ব্যাপারটা অবশ্য আরও বিভ্রান্তিকর। একটা গান বারবার শোনা যায়, কিন্তু একটা সিনেমা বারবার অতটা দেখা হয়ে ওঠে না। কিন্তু তা-ও ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যায়। যখন Footloose সিনেমাটির রিমেক করা হবে বলে ঘোষণা এল, তখন অনেকেই ভেবেছিল, আবার কেন এই সিনেমা! হলিউডের কি সব আইডিয়া শেষ? কিন্তু আমার মনে হয় এমন অনেক নারীই আছেন, নব্বইয়ের দশকে যখন তারা কিশোরী, এই সিনেমাটি ডিভিডিতে অনেকবার দেখেছেন। ঠিক তেমনই আশির দশকের মেয়েরা লেজার ডিস্কে বারবার Grease  সিনেমাটি দেখেছে। Footloose সিনেমাটিই হয়তো আমাদের এই আলাপের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ—এটা এমন একটা সিনেমা, যা শুধুমাত্র তাদের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, যারা এটা বারবার দেখেছে। বলে রাখা ভালো, কোনো মেসেজ, অভিনয় বা বিশেষ কোনো চিন্তার জন্য কিন্তু নয়, তারা এই সিনেমাটি বারবার দেখেছে শুধুমাত্র দেখার অভ্যাসের জন্যই। 

আসলে এমনটা ভাবা ঠিক নয়।  

অতীতের কোনো গান, সিনেমা, ছবি বা যেকোনো শিল্পকর্ম আবার নতুন করে দেখলে এমনিতেই আমাদের ভালো লাগে, এমন ভাবার কোনো কারণই নেই। অতীতের সেই সময়টা হয়তো ঠিকঠাক আমাদের মনেও নেই, অথবা এতটা আহামরি কিছু ছিল না। হ্যাঁ, কিছু গান অবশ্যই হয়তো নির্দিষ্ট মানুষ বা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ যদি প্রশ্ন করে, কোন ধরনের গান শুনলে তুমি নস্টালজিক হয়ে যাও, তবে আমরা এই ধরনের গানের কথাই বলব। কিন্তু পুরোনো এমন অনেক গানই আছে, যা শুধুমাত্র ভালোলাগার অনুভূতিটাই দেয়। অতীতের কোনোরকম স্মৃতির সাথেই এর কোনো যোগাযোগ নেই, তবুও তা শুনলে মন আনন্দে ভরে ওঠে। একে স্মৃতি ছাড়া নস্টালজিয়া বলা যেতে পারে। ব্যাপারটা আসলে এমন, জীবনের একটা পর্যায়ে আমরা কিছু গানই ঘুরেফিরে বারবার শুনতাম। আর একারণে গানগুলো অবচেতনেই আমাদের মনে স্থায়ীভাবে ভালোলাগার জায়গা করে নিয়েছে। এই ভালোলাগার সাথে তখনকার সময়ে জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের কোনো সংযোগ যে থাকতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। নস্টালজিয়া আসলে একটা অভ্যাস, যা আমাদের গান শোনার আনন্দটাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়, এই আর কী।  

আরেকটু বুঝিয়ে বলি। একটা সময়ে আমার কাছে মাত্র ছয়টা ক্যাসেট ছিল। এর মধ্যে একটা অজি অসবর্নের Bark at the Moon। আমার মনে হয় এই অ্যালবামটি অসবর্নের চতুর্থ কিংবা বড়জোর তৃতীয়-সেরা অ্যালবাম। কিন্তু আমি এই অ্যালবামটিই সবচেয়ে বেশিবার শুনেছি। কারণটা স্বাভাবিক, আমার কাছে অন্য আর পাঁচটা ক্যাসেট ছাড়া আর কিছু ছিলও না। আসলে সত্যি বলতে আমি যতবার Bark at the Moon শুনেছি, অসবর্নের অন্য সব অ্যালবাম মিলিয়েও হয়তো ততবার শুনিনি!    

এই অ্যালবামের সাইড টু-এর প্রথম গানটি ছিল Center of Eternity। গানটা একটু ভারিক্কি ধরনের আর অনেকটাই ক্লিশে। এই গানের সাথে আমার ব্যক্তিজীবনের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই এবং গানটি কোনোভাবে আমাকে স্মৃতিকাতরও করে তোলে না। এই নিবন্ধটি লেখার আগে, অন্তত দশ বছর হবে, আমি গানটি শুনিনি। কিন্তু এখন গানটা আবার যখন শুনলাম, বেশ ভালো লাগল। মনে হলো একদম নতুন কিছু শুনলাম। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। শুধু যে গানটাই ভালো লাগল তা নয়, এর প্রতিটি অংশই (প্রথমদিকের অতিরঞ্জিত অর্গান, জেক ই. লির গিটার টিউনিং, যখন ড্রাম বাজতে শুরু করল, এর হাস্যকর সাই-ফাই লিরিকস ইত্যাদি) আমার নতুন করে আমার কাছে ধরা দিল। মোটকথা এই গানটা যতটা উপভোগ করা সম্ভব, ঠিক ততটাই আমি উপভোগ করলাম। এই গানের সাথে কিন্তু আমার আশির দশকের স্মৃতির কোনো যোগসূত্রই নেই। তখনকার অনেককিছুই আমার মনে নেই। এই গানটা এখন আমাকে এত আনন্দ দিয়েছে, এর কারণ একটাই—তখন আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে বছরের ৩৬৫ দিনই এই অজি অসবর্নের গানগুলো শুনতাম। এটা কোনো আবেগের বিষয় না।  বরং এই অভিজ্ঞতা রীতিমতো অঙ্কের মতো ছককষা। নিজের জীবনের সাথে মিলিয়ে এই গানটাকে আমি অতিমহৎ কিছু হিসেবে দেখিনি, বরং এই গানটা আমি এতবার শুনেছি যে না চাইতেও এখন আমি গানটার আদ্যোপান্ত বুঝতে পারি। আমরা হয়তো আমাদের স্মৃতিগুলোর প্রতি খুব একটা গুরুত্ব দিই না, কিংবা হয়তো কোনো বিষয়ের সাথে আমাদের যে অনেকদিনের সম্পর্ক, তা নিয়ে আমরা উদাসীন থাকি। আসলে কোনোকিছুকে বারবার অনুভব করতে না পারলে তা কখনোই অর্থবহ কিছু হয়ে ওঠে না।    

আপনিও কিন্তু একটা কাজ করতে পারেন। তেমন শোনা হয়নি, আগামী ছয়মাস ধরে এমন কোনো গান আপনি প্রতিদিন দুইবার করে শুনবেন। আমি নিশ্চিত দশ বছর পর যদি আপনি গানটি আবার শোনেন, আপনার বেশ ভালো লাগবে, যদিও আপনার এখনকার জীবনযাপনের সঙ্গে গানটির কোনো সম্পর্কই নেই। এক কাজ করা যাক। এখন যারা এই প্রবন্ধটি পড়ছেন, তারা সবাই White Rune গানটি ডাউনলোড করুন। NCAA টুর্নামেন্ট শুরু না হওয়া পর্যন্ত গানটি সকাল-বিকাল দুইবেলা শুনবেন। তারপর ২০২১ সালে আপনাদের সাথে আবার কথা হবে। তখন এই গান নিয়ে আপনাদের অনুভূতির কথা শুনব। 

এবং আমার মনে হয় কি জানেন, এটাই আমাদের বর্তমানের নস্টালজিয়ার সমস্যাকে দশ বছর আগের সমস্যার চেয়ে জটিল করে তুলেছে। আমি আসলে যা বলতে চাই, জোর করে বারবার কিছু করার মাধ্যমে নস্টালজিয়ার যে মিথ্যা একটা অনুভূতি তৈরি করে মানুষ, তার আয়ু শেষ হয়েছে। এমনটা আর কখনোই হবে না।

আমি বুঝি না, এই ২০১১ সালে এসেও মানুষ কেন প্রতিদিনই একটা গান শুনবে। এমনকি সবচেয়ে পছন্দের গানও তো এতবার শোনার কোনো মানে হয় না। এটা তো প্রতিদিন সকালে নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে শুধুমাত্র Jonathan Livingston Seagull পড়ার মতোই ব্যাপার হবে! এখন তো ফ্রিতেই গান শোনা যায়, তাই ক্যাসেট কেনার ঝামেলাতেও কাউকে পড়তে হয় না। রেডিও কেউ আর আগের মতো শোনে না (মানে গান আর শ্রোতাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না!), এমটিভির ভিডিও-ও আর কেউ দেখে না। আর স্পটিফাই তো রীতিমতো গেমচেঞ্জার। আধুনিক জামানার পপ গানের রেকর্ডিং আর প্রোডাকশনের ধরনও কিন্তু পাল্টে গেছে। ডিজিটাল দুনিয়ায়  রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়াই এর লক্ষ্য। রিয়ানার Loud অ্যালবামটার প্রথম নব্বই সেকেন্ড শুনে দেখুন তো—যদি প্রথবারেই ভালো না লাগে, একমাস ধরে শুনলেও তা ভালো লাগবে না। আর এখন তো সমালোচক বা বোদ্ধারা কোনো অ্যালবাম মুক্তি পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়ে দেন, বিশেষ Radiohead-এর The King of Limbs অথবা Kanye এবং Jay-Z-এর Watch the Throne-এর মতো অ্যালবামগুলোর ক্ষেত্রে তো এই কথা দিনের আলোর মতোই সত্য। এখন কেউ যদি বলে যে ‘একটা গান খুব বেশি চলছে’, এর মানে হচ্ছে গানটি বেশি বেশি বিজ্ঞাপন বা সিনেমার ট্রেইলারে জায়গা করে নিতে পেরেছে।   

আসলে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না, এই পরিবর্তনের ব্যাপারটা ভালো না কি মন্দ, বা ভালো-মন্দের বাইরের কিছু একটা। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আর্টিস্টদের জন্য এই পরিবর্তনটা নেতিবাচক কিছুই হবে। অবশ্য সাধারণ ভোক্তারা একে দেখবে ইতিবাচক দৃষ্টিতে, আর সিরিয়াস মিউজিক ফ্যানদের এতে কিছুই যায়-আসে না। তবে নস্টালজিয়া নিয়ে আমাদের এতদিনকার ধারণাকে (সেটা ঠিক বা ভুল যা-ই হোক না কেন) এটা নিশ্চিতভাবেই বদলে দেবে। নস্টালজিয়ার ধারণা যে একেবারে নাই হয়ে যাবে, তা না, তবে নস্টালজিয়া আগের চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে আমাদের কাছে ধরা দেবে।   

নস্টালজিয়ার ব্যাপারটাকে যদি অপছন্দ করেন তাহলে এই পরিবর্তন আপনার ভালোই লাগবে। আপনার মনে হবে, ‘ভালোই হয়েছে, এখন আর কারও এই যুক্তি শুনতে হবে না যে, তারা স্কুল জীবনে পার্ল জ্যামের No Code অনেকবার শুনত বলেই এই গানটা এখনো ভালো!’ বাস্তবতা হচ্ছে, নিজেদের তৈরি করা এই নস্টালজিয়ার ধারণা নাই হয়ে গেলে অতীত ইতিহাসের তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, কারণ ইন্টারনেটে সবকিছুই থাকে। এমনকি মানুষ যা মনে রাখতে পারে না, তা-ও। যেহেতু ইন্টারনেট হচ্ছে একটা কিউরেটর-ভিত্তিক মাধ্যম, স্বাভাবিকভাবেই যা অতীতকে ধারণ করতে পারে। পার্ল জ্যামের টিকে থাকার জন্য আমাদের তাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হবে না। ৫০০ বছর পরেও মোজার্ট, জন ফিলিপ সাউসা বা চাক বেরির চাইতেও এডি ভেডারের  সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাব, তখন হয়তো আমেরিকার কেউই আর জানবে না যে Jeremy বলে একটা গান ছিল! মেনে নিতে অস্বস্তি লাগলেও এই কথাটা সত্য যে ইন্টারনেট আমাদের স্মৃতিশক্তির ব্যবহার একরকম কমিয়েই দিয়েছে। ভালো স্মৃতিশক্তি থাকাটা একসময় দারুণ একটা ব্যাপার ছিল, এতে বেশ সুবিধা পাওয়া যেত। এখন এই সময়ে এসে ভালো স্মৃতিশক্তি মনে মনে চার অঙ্কের সংখ্যা গুণ করে লোকজনকে তাক লাগিয়ে দেওয়া ছাড়া তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।  

ভাববেন না যে, আমি পার্ল জ্যামের সমালোচনা করছি। এই ব্যান্ডটা আমি পছন্দ করি। আসলে এই ধরনের অ্যাবস্ট্র্যাক্ট আলাপে পার্ল জ্যামকেই ব্যবহার করা সহজ। অবশ্য আমি বিব্রতই হই, আমি পার্ল জ্যামকে নিয়ে কিছু লিখলেই কেন যেন মনে হয় আমি আসলে তাদের সমালোচনাই করছি, ঠিক যেমনটা পোস্ট অফিসের ক্ষেত্রে হয়!

অবশ্য এতকিছুর পরেও, মানুষ তার অতীতকে মনে রাখতে চায়। মানুষ তার নিজের অতীত নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসে। এই স্মৃতিই জীবনকে অর্থবহ করে তোলে। জীবনের পর্যায় তো এই দুটিই—এখন যা করছি, আগে যা করেছিলাম। এজন্যই একটা গান বারবার শুনলে তা শুধুমাত্র ভালোলাগার একটা গানই থাকে না, আরও মহৎ কিছু হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেয়, অবচেতনেই আমরা সেই সময়ের কথা, সেই সময়ের চিন্তাগুলোর কথা মনে করতে পারি। কিন্তু এখন তো পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কেউই আর একটা গান বারবার শোনে না। যখন এটাও বন্ধ হয়ে যাবে—যখন বছরে প্রতিদিন কেউ আর Centre of Eternity গানটা শুনবে না—তখনকার অভিজ্ঞতা কেমন হবে?  

আমার মনে হয়, তখন অন্য মানুষই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। 

পুনরাবৃত্তির চাইতে তখন মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগটাই মুখ্য হবে। বারবার একই কাজ করে করে নস্টালজিয়া তৈরি করার বদলে আমরা এমনসব মুহূর্ত নিয়ে আরেক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করব, যেই মুহূর্তগুলোতে মনে হবে আশেপাশের সবাই মিলে একসাথে একই কাজ করছে। মানে এক গান কেউ আর ১০০০ বার শুনবে না, বরং মানুষ সেই সময়টাই মনে রাখবে যখন সে আর ৯৯৯ জন মিলে একটা গান একবারই শুনে টুইটার বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে তা নিয়ে আলাপ করবে। এই ছোট অভিজ্ঞতাটাই তখন অনেক বড় কিছু বলে মনে হবে। এটা ভালো না মন্দ—এই প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারব না, কিন্তু আমি এটা অন্তত বুঝতে পারি, কিছু মানুষ থাকবে, যারা তাদের পুরোনো দিনের কথা মনে করে সত্যিই খুব মনখারাপ করবে।   

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।