WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
আলোচিত কিছু ভিলেন। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা।


বাংলা সিনেমার কিছু উল্লেখযোগ্য ভিলেনের নাম মনে করুন তো।
কাদের কথা মাথায় আসছে?
স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে ভেসে ওঠার কথা ডিপজল, কাবিলা কিংবা জাম্বুর চেহারা। 

তাদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান কি?
এদের মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো এরা কালো, মোটা, চুল কম। হিরোদের বিপরীতে তাদের ভাষাভঙ্গির মধ্যেও স্পষ্ট তফাৎ টের পাবেন। হিরোরা কথা বলে সুন্দর, সুললিত, তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ ভাষায়, এবং নিজেদেরই চারিত্রিক অশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই যেন, ভিলেনরা বলে ‘অশুদ্ধ’ ভাষায়। এইটুকু অন্তত স্পষ্ট, ভিলেনদেরকে আমাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটার মধ্যে তাদের ব্যাপারে অন্তর্নিহিত কিছু পূর্বানুমান লুকিয়ে রয়েছে। সেটা হলো, যারা খারাপ তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘কদর্যতার’ সাথে মিলিয়ে দেখি। সহজ কথায়, কালা মানেই বদ। অথচ, কিছু আরোপিত অতিরঞ্জন বাদে, কাবিলা বা জাম্বু  কিন্তু গড়নের দিক দিয়ে আর দশজন বাংলাদেশির খুব কাছাকাছি। তবুও বিশেষভাবে তাদের গড়নটাকেই চারিত্রিক ত্রুটির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকাটার মধ্যে আমাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সেখান থেকে জন্ম নেয়া আত্মঘৃণার কোনো ভূমিকা নেই তা বলা যাবে না। আমরা ইদানীং প্রায়ই কিছু নাটক হয়তো দেখি যাতে সাবিলা নূর বা মেহজাবিনের মত ফর্সা নায়িকারা মুখে কালি মেখে কালো হওয়ার অভিনয় করছে। বাংলাদেশের মত অঞ্চলে তো আদতেই চাপা বর্ণের মেয়েদের কোনো অভাব থাকার কথা না। তবুও কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? কেননা যখন কোনো অভিনেতা খুনি হওয়ার অভিনয় করে, তখনো যেমন দর্শকের জানা থাকা দরকার যে সে আসলে খুনি না, একইভাবে আমাদের জানা থাকা দরকার যে টিভির নায়িকারাও আসলে কালো না।

ছবিঃ সাবিলা নূর
নাটকের একটি দৃশ্যে সাবিলা নূর


কেননা মহাভারতের দ্রৌপদীর গায়ের রঙ কালো হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও, গায়ের রঙ কালো হওয়া নাটক-সিনেমার নায়িকা হওয়ার পূর্বশর্তের বিরোধী। এরকম কেলেঙ্কারি একটা কাণ্ড ঘটেছিল ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া অথেলো সিনেমাটাতে। সেখানে অথেলোর অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ের তার ভিলেনসুলভ কাজকর্ম আরো রঙচঙ মাখিয়ে ফুটিয়ে তোলেন নিজের মুখে কালো কালি মেখে। মানে, কালো হওয়া আর যাবতীয় অকাজ-কুকাজ যে একই লাইনের, সেটাই স্পষ্ট করে দেয়া হলো। এসব খুচরা ট্রিক্সের মাধ্যমে হিরোদের ব্যাপারে খুব সহজেই আমাদের সহানুভূতি ও ভিলেনদের প্রতি ঘৃণা আদায় করে নেয়া যায়। অর্থাৎ, হিরো ও ভিলেনদের এই বিরোধী গুণগুলি তাদের মধ্যকার বিভাজনরেখার কাজই করে।  

এটা অবশ্য নতুন কিছু না। আর যেকোনো ধারণার ইতিহাসের মতই, সৌন্দর্যের ধারণার কুলজি সন্ধানের জন্যেও আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন গ্রিসে। আমাদের বাংলা সিনেমার যে নজিরগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর উহ্য বক্তব্যটা হলো সৌন্দর্যের সাথে শুভের ও কদর্যতার সাথে অশুভের একটা অনিবার্য সংযোগ রয়েছে। গ্রিকরাও তাই বিশ্বাস করতো, এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্য কোনোরকম রাখঢাকের বালাই ছিল না। ভাষার মধ্যে একটা সংস্কৃতির বদ্ধমূল ধ্যানধারণার হদিস পাওয়া যায়। সৌন্দর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ ছিল কালোস, একইসাথে যার অর্থ ছিল সততাও। আবার, কদর্যতার প্রতিশব্দ ছিল আইস্ক্রোস, যেটার আরেক অর্থ ছিল লজ্জাজনক কোনোকিছু। হোমারের ইলিয়াডের এক পর্যায়ে থের্সিটেস নামে একজন সাধারণ লোক আগামেমননের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে নারাজ হয় এবং অডিসিউস দ্রুতই তাকে পরাস্ত করে। গ্রিক ভাষায় কদর্যতা ও জঘন্যতার সমার্থকতার দরুন তার ব্যাপারে হোমারের বিবরণটা এভাবে পড়া যায়: ‘ইলিয়নে জন্মানো সবচেয়ে নিকৃষ্ট/কুশ্রী মানুষ ছিল সে। তার পা ছিল বাঁকা, ফলে এক পায়ে সে ছিল খোড়া। তার কাঁধ ঝুঁকে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছিল, আর মাথার খুলি ছিল ভীষণ উঁচা আর তাতে ছোপ ছোপ সাদা উলের মতন চুল।’ অর্থাৎ, আমাদের সিনেমার সেই চল তার উত্তরাধিকারের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারে হাজার হাজার বছর পুরানো, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্যকেও। যদিও এখানে কেউ উল্লেখ করতে পারেন সক্রেটিসের কথা, যে অত্যন্ত কুৎসিত বলে প্রখ্যাত, তবুও সম্মানিত। আমি অবশ্য এটাকে দেখি এমনভাবে যে, নিজের বাহ্যিক কদর্যতার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই সম্ভবত তাকে হতে হয়েছিল সমস্ত এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রিকরা বাহ্যিক রূপকে অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন হিসেবেই দেখত। অর্থাৎ, আপনার বাহ্যিক গড়ন ও মুখাবয়ব দেখে বুঝে ফেলা সম্ভব আপনার চরিত্র ও মন কেমন। ফলে কদর্যতা ছিল এমন এক অবস্থা, যার থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাময় পাওয়া যায় তত ভালো। ইতিহাসবিদ জেকব বার্খার্ট এক স্পার্টান শিশুর কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে পরে ডেমারেটাসের স্ত্রী হয়েছিল। সে দেখতে ভীষণ খারাপ হওয়ায় রোজ তাকে থেরাপনিতে হেলেনের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো, এবং সেই সুন্দরীতমার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে আর্জি জানানো হতো যেন দেবী সেই মেয়ের কদর্যতা মুছে যায়। কদর্যতা যেনবা একটা রোগ, একটা বিশেষ কন্ডিশন, যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া জরুরি।

এরকম ধারণার বিস্তার আরো বহুদূর পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা যেসব গল্পের হাত ধরে দিনদুনিয়া বুঝতে শুরু করে, অর্থাৎ রূপকথার মধ্যে এরকম উপাদানের প্রাচুর্য আমলে নেয়ার মতই। রূপকথাগুলোর সাধারণত আন্তর্জাতিকতা অন্য যেকোনো গল্পমাধ্যমের চেয়ে বেশি, কেননা খুব সহজেই তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে, আঞ্চলিক উপাদানগুলোকে নিজের অংশ করে নিয়ে হাজির হতে থাকে। আমাদের অঞ্চলে আছে শুয়োরানি-দুয়োরানিদের গল্প, কিংবা ডাইনিবুড়িরা। তারা হয় বিগতযৌবনা, অদ্ভুত গায়ের রঙ আর উঁচা নাকবিশিষ্ট নারী। অন্যদিকে নায়িকারা হয় অনন্য সুন্দরী ও ফর্সা। যেমন সিন্ডেরেলা কিংবা স্নো হোয়াইট। এখানে, তাদের সৌন্দর্য গল্পের কোনো আকস্মিক অংশ না, বরং তাদের সৌন্দর্যকে ঘিরেই গল্পগুলো আবর্তিত হয়। ‘মিরর, মিরর অন দ্য ওয়াল/হু’জ দ্য ফেয়ারেস্ট অফ দেম অল?’ দেখা যায় নিজেদের সৌন্দর্যের কারণেই নিজেদের কুশ্রী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা কাজের মেয়ের ঈর্ষার শিকার হয়ে বিপদে পড়ে, নাহয় দেখা যায় তাদের লাবণ্যের প্রেমে পড়ে নায়ক নানারকমের পাগলামি করে। আর এখানেও সেই একই যুক্তি অনুসৃত হয়: সিন্ডেরেলার মুখশ্রী তার পরিষ্কার মনের কারণেই এমন, অন্যদিকে তার কিম্ভূত সৎমা ও সৎবোনেদের চেহারা তাদের অন্তরের কাদারই ইশারা।  

ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করে বোঝার জন্য বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট গল্পটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর দশটা রূপকথার মতই, এই গল্পেরও দেশকালভেদে অসংখ্য সংস্করণ পাওয়া যায়। গল্পের মূল লেখক ছিল গাব্রিয়েল-সুজান বার্বো দে ভিলেন্যুভ। গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৪০ সালের দিকে। গল্পটার কঙ্কাল এরকম: এক বিপত্নীক বণিকের তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে বেশ নিষ্ঠুর আর নিচুমনা, আর কনিষ্ঠ মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর, একইসাথে নির্লোভ ও আন্তরিক। সেই মেয়ের নামই বেল। বেল শব্দের অর্থই সুন্দরী। এতক্ষণ সৌন্দর্য ও সদাচারের সংযোগের ব্যাপারে যা যা বললাম, সেসবই এই গল্পে পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক, সেই বণিক একবার ব্যবসার কাজে দূরে এক জায়গায় যায়। তার বড় দুই মেয়ে তার কাছে দামি জিনিসপত্র চায় (যেহেতু তারা লোভী), আর বেল চায় একটা দুর্লভ গোলাপ (যেহেতু সে নির্লোভ।) বণিকের অনেক বড় লোকসান হয়, ফলে সে কিছু কিনতে পারে না। কিন্তু একটা বাগানে ছোট মেয়ের কাঙ্ক্ষিত সেই গোলাপ দেখতে পেয়ে সেটা তুলতে যান। জানা যায় সেই বাগানটাই হলো বিস্ট তথা এক জন্তুসুলভ ব্যক্তির। সে এক শর্তে বণিককে যেতে দিতে রাজি হয়, যে বণিক ফিরে গিয়ে তার বদলে এক মেয়েকে এখানে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেবে। অবশ্যই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ছোট মেয়ে বেলই এগিয়ে আসে। পরে দেখা যায় সেই বিস্টের সাথে বেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় বিস্ট বেলকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। পরে বেল বাড়ি ফিরতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসার শর্তে বিস্ট রাজি হয়। কিন্তু বেলের বড় দুই বোন বেলের আলিশান জীবনযাপনে ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রেখে দেয়। পরে বেল টের পায় সে বিস্টকেই ভালোবাসে, ফলে সে তার কাছে ফিরে যায়। বেলের ভালোবাসা পেয়ে বিস্টের উপর থেকে অভিশাপ উঠে যায় এবং সে রাজকুমারের রূপে আবির্ভূত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, বিস্ট যতক্ষণ নিজের মনের মধ্যে সংকীর্ণতা ও রূঢ়তা লালন করে চলছিল, ততক্ষণ তার জানোয়ার-রূপ বলবৎ ছিল। কিন্তু যখনই সে কোমলতা ও ভালোবাসাকে নিজের অন্তরে ঠাই দেয়, তখনই সে তার রাজকীয় রূপ ফিরে পায়। আবারো, সেই একই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, কারো মনের কুরূপই নিজেকে প্রকাশ করে তার চেহারা ও বাহ্যিক অবয়বে।

আরো একটা ব্যাপার আছে। বলা হয় ভিলেন্যুভ গল্পটা লিখেছিল একটা বাস্তব ঘটনাকেভিত্তি করে। পেট্রাস গনসালভাসের একটা বিশেষ কন্ডিশন ছিল, যার নাম হাইপারট্রাইকোসিস। এই কন্ডিশনের কারণে শরীরে খুব দ্রুতগতিতে ও অত্যধিক পরিমাণে চুল ও পশম গজায়। এ কারণে পেট্রাস পরিচিত ছিল ‘বুনো আদমি’ নামে। তার বাগদত্তা ক্যাথেরিন বিয়ের দিনের আগ পর্যন্ত পেট্রাসের এই কন্ডিশনের ব্যাপারে জানতো না। এবং বলা হয় জানার পরেও এ ব্যাপারে তার তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। গোটা ইউরোপ জুড়ে তারপর এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাদেরকে ডাকা হয় ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ বলে। তাদের কাহিনির উপর ভিত্তি করেই ভিলেন্যুভ, ব্যুমোঁ ইত্যাদি লেখকেরা বিভিন্ন গল্প-রূপকথা রচনা করে। এভাবেই একজন লোক তার মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে হয়ে ওঠে রূপকথার রসদ। তাকে জন্তুর মত বানিয়ে তোলা হয়।

এখান থেকে আমরা নজর ফেরাতে পারি বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বহুলব্যবহৃত আরেকটি ট্রোপের দিকে। সেটা হলো শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভিলেন হিসেবে দেখানো। এই ট্রোপটা এত বহুলব্যবহৃত যে আমরা যেন প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গেছি। হ্যারি পটারের ভোল্ডেমোর্ট থেকে শুরু করে সুপারম্যানের লেক্স লুথর, সবাই এই ট্রোপের আওতায় পড়ে। বাংলা সাহিত্য ও নাটকেও আমরা অহরহ শুনতে পাই কানকাটা রমজান, ল্যাংড়া মাস্তান ইত্যাদি চরিত্রের নাম। তাদের বাহ্যিক অবয়বে এসব বিকলতা যেন তাদের অন্তরের ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিতপূর্ণ। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো দ্য ডার্ক নাইট-এ হার্ভি ডেন্টের ভিলেন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার মুহূর্তটা। সে ছিল গথাম শহরে ন্যায়ের পক্ষের এক যোদ্ধা। কিন্তু তার প্রেমিকার মৃত্যু ও নিজের মুখের অর্ধেক ঝলসে যাওয়ার মুহূর্তটা চিহ্নিত করে তার অশুভের দিকে পা বাড়ানোটাকেও। ব্যাটম্যানের সবচেয়ে পরিচিত ভিলেন জোকারের গল্পটাও প্রায় এরকম, তারও চেহারায় বিকৃতির ছাপ। এরকমটা প্রায়ই দেখানো হয় যে তাদের এই শারীরিক কমতিগুলোর কারণে তার মধ্যে একপ্রকার তিক্ততাবোধ জন্ম নেয়, যার ফলে সে বেছে নেয় খারাপের পথ। অপরদিকে, হিরোরা কেবল স্বাভাবিকই হয় না, হয় একটা অতিরঞ্জিত আদর্শ গড়নের অধিকারী। 

ভিলেনদেরকে এভাবে কুৎসিত কিংবা বিকলাঙ্গ হিসেবে চিত্রিত করার প্রধান উদ্দেশ্যটা হলো তারা কতটা আলাদা, ‘স্বাভাবিক’ থেকে কতটা চ্যুত, সেটা দেখানো। এ ধরণের চিত্রায়ণের মাধ্যমে একপ্রকার অপরায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি এতে করে একটা প্রচ্ছন্ন বিমানবীকরণও যে ঘটে না, তা বলা যাবে না। প্রায় সকল সভ্যতায়ই তথাকথিত কুৎসিত অথবা বিকলাঙ্গ মানুষদের জন্তুসদৃশ হিসেবে দেখার ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন সার্কাসে তাদেরকে মানুষ টিকেট কেটে দেখতে আসতো। তারা হয়ে উঠতো মজার কিছু দৃশ্য। বিভিন্ন নিউরোলজিকাল সমস্যাকেও অশুভ শক্তির আছর হিসেবে দেখার নজিরও কম না। মধ্যযুগে কারো কোনোপ্রকার মানসিক ব্যাধি দেখা দিলে মনে করা হতো তার মাথায় শয়তান বাসা বেঁধেছে, এবং শয়তান যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের খুলিতে ফুটা করে দেয়ার চিকিৎসাও প্রচলিত ছিল! একইভাবে বিভিন্ন হরর সিনেমাতে আমরা এখনো দেখি কোনো নিউরোলজিকাল কন্ডিশনযুক্ত চরিত্রকে শয়তান বা তেমন কোনো অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এভাবে বিগত যুগের বিশ্বাসগুলো ঠাই করে নিচ্ছে হাল আমলের শিল্পের মধ্যেও। 

এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের পুনরুৎপাদনে জন্ম নিতে পারে এক দুষ্টচক্র। আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা হলো মেগামাইন্ড। অনেকটা সুপারম্যানের প্যারডি করে বানানো এই সিনেমাটার শুরুতে দেখা যায় দুটো গ্রহ থেকে দুটো শিশুকে ক্যাপসুলে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর উদ্দেশে। তাদের মধ্যে একজন শিশু, মেট্রোম্যান, যে দেখতে খুব সুন্দর, তার সুপারম্যানের মত নানাবিধ ক্ষমতা, সে গিয়ে পড়ে এক আলিশান মহলে। অন্য শিশুটা হলো মেগামাইন্ড, যার গায়ের রঙ নীল আর মাথাটা অতিকায় বড়, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছাড়া যার আর কোনো ক্ষমতাই নেই, সে গিয়ে পড়ে একটা জেলখানায়। সেখানেই তাদের গোটা জীবনের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। মেট্রোম্যান বড় হয় পর্যাপ্ত যত্ন ও আদরের সাথে, স্বীকৃতির কোনো অভাব হয় না। সে গড়ে ওঠে একজন হিরো হিসেবে। অপরদিকে মেগামাইন্ড বড় হয় কয়েদিদের মাঝে। সদিচ্ছা বা প্রতিভার জন্য পুরস্কৃত হওয়া তো দূরের কথা, ন্যূনতম মূল্যায়নও সে পায় না। উদ্ভট দৈহিক গড়নের কারণে স্কুলেও সে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহারের শিকার হয়। চোখের সামনে সে দেখতে পায় মেট্রোম্যান কীভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই সবার মধ্যমণি হয়ে রয়েছে।

ছবিঃ মেগামাইন্ড
মেগামাইন্ড সিনেমার একটি ফ্রেম



একসময় নিজের এই হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষার প্রভাবেই যেন মেগামাইন্ড হয়ে ওঠে এক ভিলেন, সুপারভিলেন। তারপরের ঘটনা পাঠক নিজে সিনেমাটা দেখে জেনে নেবেন আশা করি। কিন্তু মেগামাইন্ডের এই ভিলেন হয়ে ওঠাটা কি অপ্রত্যাশিত কিছু? নাকি অসংখ্য আপাত-নিরীহ আচার ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আগে থেকেই তার ভিলেন হয়ে গড়ে ওঠার এন্তেজাম করে রাখা হয়েছিল? মেগামাইন্ড দর্শকদের কাছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে একটা সুপারহিরো বনাম সুপারভিলেন সিনেমা হিসেবে খ্যাত হলেও, আমার কাছে মনে হয়েছে এই সিনেমাটা আমাদের বলতে চেয়েছে যে অপরাধীরা শেষমেষ ভুঁইফোড় কিছু না। তাদের বাতাবরণ ও পরিপার্শ্বের মধ্য দিয়েই তাদের জন্ম। মেগামাইন্ড আমাদেরকে দেখায় যে, আমরা যদি আমাদের রিপ্রেজেন্টেশান ও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হই, তাহলে আমরা জন্ম দেব কিছু সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসির। যাদেরকে আমরা ইতোমধ্যে ভিলেন বলে বিশ্বাস করতে চাই, তারা ক্রমাগত ভিলেন হয়েই আমাদের সামনে হাজির হতে থাকবে।

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।