WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
আলোচিত কিছু ভিলেন। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা।


বাংলা সিনেমার কিছু উল্লেখযোগ্য ভিলেনের নাম মনে করুন তো।
কাদের কথা মাথায় আসছে?
স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে ভেসে ওঠার কথা ডিপজল, কাবিলা কিংবা জাম্বুর চেহারা। 

তাদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান কি?
এদের মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো এরা কালো, মোটা, চুল কম। হিরোদের বিপরীতে তাদের ভাষাভঙ্গির মধ্যেও স্পষ্ট তফাৎ টের পাবেন। হিরোরা কথা বলে সুন্দর, সুললিত, তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ ভাষায়, এবং নিজেদেরই চারিত্রিক অশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই যেন, ভিলেনরা বলে ‘অশুদ্ধ’ ভাষায়। এইটুকু অন্তত স্পষ্ট, ভিলেনদেরকে আমাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটার মধ্যে তাদের ব্যাপারে অন্তর্নিহিত কিছু পূর্বানুমান লুকিয়ে রয়েছে। সেটা হলো, যারা খারাপ তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘কদর্যতার’ সাথে মিলিয়ে দেখি। সহজ কথায়, কালা মানেই বদ। অথচ, কিছু আরোপিত অতিরঞ্জন বাদে, কাবিলা বা জাম্বু  কিন্তু গড়নের দিক দিয়ে আর দশজন বাংলাদেশির খুব কাছাকাছি। তবুও বিশেষভাবে তাদের গড়নটাকেই চারিত্রিক ত্রুটির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকাটার মধ্যে আমাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সেখান থেকে জন্ম নেয়া আত্মঘৃণার কোনো ভূমিকা নেই তা বলা যাবে না। আমরা ইদানীং প্রায়ই কিছু নাটক হয়তো দেখি যাতে সাবিলা নূর বা মেহজাবিনের মত ফর্সা নায়িকারা মুখে কালি মেখে কালো হওয়ার অভিনয় করছে। বাংলাদেশের মত অঞ্চলে তো আদতেই চাপা বর্ণের মেয়েদের কোনো অভাব থাকার কথা না। তবুও কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? কেননা যখন কোনো অভিনেতা খুনি হওয়ার অভিনয় করে, তখনো যেমন দর্শকের জানা থাকা দরকার যে সে আসলে খুনি না, একইভাবে আমাদের জানা থাকা দরকার যে টিভির নায়িকারাও আসলে কালো না।

ছবিঃ সাবিলা নূর
নাটকের একটি দৃশ্যে সাবিলা নূর


কেননা মহাভারতের দ্রৌপদীর গায়ের রঙ কালো হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও, গায়ের রঙ কালো হওয়া নাটক-সিনেমার নায়িকা হওয়ার পূর্বশর্তের বিরোধী। এরকম কেলেঙ্কারি একটা কাণ্ড ঘটেছিল ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া অথেলো সিনেমাটাতে। সেখানে অথেলোর অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ের তার ভিলেনসুলভ কাজকর্ম আরো রঙচঙ মাখিয়ে ফুটিয়ে তোলেন নিজের মুখে কালো কালি মেখে। মানে, কালো হওয়া আর যাবতীয় অকাজ-কুকাজ যে একই লাইনের, সেটাই স্পষ্ট করে দেয়া হলো। এসব খুচরা ট্রিক্সের মাধ্যমে হিরোদের ব্যাপারে খুব সহজেই আমাদের সহানুভূতি ও ভিলেনদের প্রতি ঘৃণা আদায় করে নেয়া যায়। অর্থাৎ, হিরো ও ভিলেনদের এই বিরোধী গুণগুলি তাদের মধ্যকার বিভাজনরেখার কাজই করে।  

এটা অবশ্য নতুন কিছু না। আর যেকোনো ধারণার ইতিহাসের মতই, সৌন্দর্যের ধারণার কুলজি সন্ধানের জন্যেও আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন গ্রিসে। আমাদের বাংলা সিনেমার যে নজিরগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর উহ্য বক্তব্যটা হলো সৌন্দর্যের সাথে শুভের ও কদর্যতার সাথে অশুভের একটা অনিবার্য সংযোগ রয়েছে। গ্রিকরাও তাই বিশ্বাস করতো, এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্য কোনোরকম রাখঢাকের বালাই ছিল না। ভাষার মধ্যে একটা সংস্কৃতির বদ্ধমূল ধ্যানধারণার হদিস পাওয়া যায়। সৌন্দর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ ছিল কালোস, একইসাথে যার অর্থ ছিল সততাও। আবার, কদর্যতার প্রতিশব্দ ছিল আইস্ক্রোস, যেটার আরেক অর্থ ছিল লজ্জাজনক কোনোকিছু। হোমারের ইলিয়াডের এক পর্যায়ে থের্সিটেস নামে একজন সাধারণ লোক আগামেমননের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে নারাজ হয় এবং অডিসিউস দ্রুতই তাকে পরাস্ত করে। গ্রিক ভাষায় কদর্যতা ও জঘন্যতার সমার্থকতার দরুন তার ব্যাপারে হোমারের বিবরণটা এভাবে পড়া যায়: ‘ইলিয়নে জন্মানো সবচেয়ে নিকৃষ্ট/কুশ্রী মানুষ ছিল সে। তার পা ছিল বাঁকা, ফলে এক পায়ে সে ছিল খোড়া। তার কাঁধ ঝুঁকে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছিল, আর মাথার খুলি ছিল ভীষণ উঁচা আর তাতে ছোপ ছোপ সাদা উলের মতন চুল।’ অর্থাৎ, আমাদের সিনেমার সেই চল তার উত্তরাধিকারের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারে হাজার হাজার বছর পুরানো, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্যকেও। যদিও এখানে কেউ উল্লেখ করতে পারেন সক্রেটিসের কথা, যে অত্যন্ত কুৎসিত বলে প্রখ্যাত, তবুও সম্মানিত। আমি অবশ্য এটাকে দেখি এমনভাবে যে, নিজের বাহ্যিক কদর্যতার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই সম্ভবত তাকে হতে হয়েছিল সমস্ত এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রিকরা বাহ্যিক রূপকে অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন হিসেবেই দেখত। অর্থাৎ, আপনার বাহ্যিক গড়ন ও মুখাবয়ব দেখে বুঝে ফেলা সম্ভব আপনার চরিত্র ও মন কেমন। ফলে কদর্যতা ছিল এমন এক অবস্থা, যার থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাময় পাওয়া যায় তত ভালো। ইতিহাসবিদ জেকব বার্খার্ট এক স্পার্টান শিশুর কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে পরে ডেমারেটাসের স্ত্রী হয়েছিল। সে দেখতে ভীষণ খারাপ হওয়ায় রোজ তাকে থেরাপনিতে হেলেনের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো, এবং সেই সুন্দরীতমার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে আর্জি জানানো হতো যেন দেবী সেই মেয়ের কদর্যতা মুছে যায়। কদর্যতা যেনবা একটা রোগ, একটা বিশেষ কন্ডিশন, যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া জরুরি।

এরকম ধারণার বিস্তার আরো বহুদূর পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা যেসব গল্পের হাত ধরে দিনদুনিয়া বুঝতে শুরু করে, অর্থাৎ রূপকথার মধ্যে এরকম উপাদানের প্রাচুর্য আমলে নেয়ার মতই। রূপকথাগুলোর সাধারণত আন্তর্জাতিকতা অন্য যেকোনো গল্পমাধ্যমের চেয়ে বেশি, কেননা খুব সহজেই তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে, আঞ্চলিক উপাদানগুলোকে নিজের অংশ করে নিয়ে হাজির হতে থাকে। আমাদের অঞ্চলে আছে শুয়োরানি-দুয়োরানিদের গল্প, কিংবা ডাইনিবুড়িরা। তারা হয় বিগতযৌবনা, অদ্ভুত গায়ের রঙ আর উঁচা নাকবিশিষ্ট নারী। অন্যদিকে নায়িকারা হয় অনন্য সুন্দরী ও ফর্সা। যেমন সিন্ডেরেলা কিংবা স্নো হোয়াইট। এখানে, তাদের সৌন্দর্য গল্পের কোনো আকস্মিক অংশ না, বরং তাদের সৌন্দর্যকে ঘিরেই গল্পগুলো আবর্তিত হয়। ‘মিরর, মিরর অন দ্য ওয়াল/হু’জ দ্য ফেয়ারেস্ট অফ দেম অল?’ দেখা যায় নিজেদের সৌন্দর্যের কারণেই নিজেদের কুশ্রী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা কাজের মেয়ের ঈর্ষার শিকার হয়ে বিপদে পড়ে, নাহয় দেখা যায় তাদের লাবণ্যের প্রেমে পড়ে নায়ক নানারকমের পাগলামি করে। আর এখানেও সেই একই যুক্তি অনুসৃত হয়: সিন্ডেরেলার মুখশ্রী তার পরিষ্কার মনের কারণেই এমন, অন্যদিকে তার কিম্ভূত সৎমা ও সৎবোনেদের চেহারা তাদের অন্তরের কাদারই ইশারা।  

ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করে বোঝার জন্য বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট গল্পটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর দশটা রূপকথার মতই, এই গল্পেরও দেশকালভেদে অসংখ্য সংস্করণ পাওয়া যায়। গল্পের মূল লেখক ছিল গাব্রিয়েল-সুজান বার্বো দে ভিলেন্যুভ। গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৪০ সালের দিকে। গল্পটার কঙ্কাল এরকম: এক বিপত্নীক বণিকের তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে বেশ নিষ্ঠুর আর নিচুমনা, আর কনিষ্ঠ মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর, একইসাথে নির্লোভ ও আন্তরিক। সেই মেয়ের নামই বেল। বেল শব্দের অর্থই সুন্দরী। এতক্ষণ সৌন্দর্য ও সদাচারের সংযোগের ব্যাপারে যা যা বললাম, সেসবই এই গল্পে পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক, সেই বণিক একবার ব্যবসার কাজে দূরে এক জায়গায় যায়। তার বড় দুই মেয়ে তার কাছে দামি জিনিসপত্র চায় (যেহেতু তারা লোভী), আর বেল চায় একটা দুর্লভ গোলাপ (যেহেতু সে নির্লোভ।) বণিকের অনেক বড় লোকসান হয়, ফলে সে কিছু কিনতে পারে না। কিন্তু একটা বাগানে ছোট মেয়ের কাঙ্ক্ষিত সেই গোলাপ দেখতে পেয়ে সেটা তুলতে যান। জানা যায় সেই বাগানটাই হলো বিস্ট তথা এক জন্তুসুলভ ব্যক্তির। সে এক শর্তে বণিককে যেতে দিতে রাজি হয়, যে বণিক ফিরে গিয়ে তার বদলে এক মেয়েকে এখানে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেবে। অবশ্যই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ছোট মেয়ে বেলই এগিয়ে আসে। পরে দেখা যায় সেই বিস্টের সাথে বেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় বিস্ট বেলকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। পরে বেল বাড়ি ফিরতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসার শর্তে বিস্ট রাজি হয়। কিন্তু বেলের বড় দুই বোন বেলের আলিশান জীবনযাপনে ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রেখে দেয়। পরে বেল টের পায় সে বিস্টকেই ভালোবাসে, ফলে সে তার কাছে ফিরে যায়। বেলের ভালোবাসা পেয়ে বিস্টের উপর থেকে অভিশাপ উঠে যায় এবং সে রাজকুমারের রূপে আবির্ভূত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, বিস্ট যতক্ষণ নিজের মনের মধ্যে সংকীর্ণতা ও রূঢ়তা লালন করে চলছিল, ততক্ষণ তার জানোয়ার-রূপ বলবৎ ছিল। কিন্তু যখনই সে কোমলতা ও ভালোবাসাকে নিজের অন্তরে ঠাই দেয়, তখনই সে তার রাজকীয় রূপ ফিরে পায়। আবারো, সেই একই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, কারো মনের কুরূপই নিজেকে প্রকাশ করে তার চেহারা ও বাহ্যিক অবয়বে।

আরো একটা ব্যাপার আছে। বলা হয় ভিলেন্যুভ গল্পটা লিখেছিল একটা বাস্তব ঘটনাকেভিত্তি করে। পেট্রাস গনসালভাসের একটা বিশেষ কন্ডিশন ছিল, যার নাম হাইপারট্রাইকোসিস। এই কন্ডিশনের কারণে শরীরে খুব দ্রুতগতিতে ও অত্যধিক পরিমাণে চুল ও পশম গজায়। এ কারণে পেট্রাস পরিচিত ছিল ‘বুনো আদমি’ নামে। তার বাগদত্তা ক্যাথেরিন বিয়ের দিনের আগ পর্যন্ত পেট্রাসের এই কন্ডিশনের ব্যাপারে জানতো না। এবং বলা হয় জানার পরেও এ ব্যাপারে তার তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। গোটা ইউরোপ জুড়ে তারপর এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাদেরকে ডাকা হয় ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ বলে। তাদের কাহিনির উপর ভিত্তি করেই ভিলেন্যুভ, ব্যুমোঁ ইত্যাদি লেখকেরা বিভিন্ন গল্প-রূপকথা রচনা করে। এভাবেই একজন লোক তার মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে হয়ে ওঠে রূপকথার রসদ। তাকে জন্তুর মত বানিয়ে তোলা হয়।

এখান থেকে আমরা নজর ফেরাতে পারি বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বহুলব্যবহৃত আরেকটি ট্রোপের দিকে। সেটা হলো শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভিলেন হিসেবে দেখানো। এই ট্রোপটা এত বহুলব্যবহৃত যে আমরা যেন প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গেছি। হ্যারি পটারের ভোল্ডেমোর্ট থেকে শুরু করে সুপারম্যানের লেক্স লুথর, সবাই এই ট্রোপের আওতায় পড়ে। বাংলা সাহিত্য ও নাটকেও আমরা অহরহ শুনতে পাই কানকাটা রমজান, ল্যাংড়া মাস্তান ইত্যাদি চরিত্রের নাম। তাদের বাহ্যিক অবয়বে এসব বিকলতা যেন তাদের অন্তরের ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিতপূর্ণ। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো দ্য ডার্ক নাইট-এ হার্ভি ডেন্টের ভিলেন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার মুহূর্তটা। সে ছিল গথাম শহরে ন্যায়ের পক্ষের এক যোদ্ধা। কিন্তু তার প্রেমিকার মৃত্যু ও নিজের মুখের অর্ধেক ঝলসে যাওয়ার মুহূর্তটা চিহ্নিত করে তার অশুভের দিকে পা বাড়ানোটাকেও। ব্যাটম্যানের সবচেয়ে পরিচিত ভিলেন জোকারের গল্পটাও প্রায় এরকম, তারও চেহারায় বিকৃতির ছাপ। এরকমটা প্রায়ই দেখানো হয় যে তাদের এই শারীরিক কমতিগুলোর কারণে তার মধ্যে একপ্রকার তিক্ততাবোধ জন্ম নেয়, যার ফলে সে বেছে নেয় খারাপের পথ। অপরদিকে, হিরোরা কেবল স্বাভাবিকই হয় না, হয় একটা অতিরঞ্জিত আদর্শ গড়নের অধিকারী। 

ভিলেনদেরকে এভাবে কুৎসিত কিংবা বিকলাঙ্গ হিসেবে চিত্রিত করার প্রধান উদ্দেশ্যটা হলো তারা কতটা আলাদা, ‘স্বাভাবিক’ থেকে কতটা চ্যুত, সেটা দেখানো। এ ধরণের চিত্রায়ণের মাধ্যমে একপ্রকার অপরায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি এতে করে একটা প্রচ্ছন্ন বিমানবীকরণও যে ঘটে না, তা বলা যাবে না। প্রায় সকল সভ্যতায়ই তথাকথিত কুৎসিত অথবা বিকলাঙ্গ মানুষদের জন্তুসদৃশ হিসেবে দেখার ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন সার্কাসে তাদেরকে মানুষ টিকেট কেটে দেখতে আসতো। তারা হয়ে উঠতো মজার কিছু দৃশ্য। বিভিন্ন নিউরোলজিকাল সমস্যাকেও অশুভ শক্তির আছর হিসেবে দেখার নজিরও কম না। মধ্যযুগে কারো কোনোপ্রকার মানসিক ব্যাধি দেখা দিলে মনে করা হতো তার মাথায় শয়তান বাসা বেঁধেছে, এবং শয়তান যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের খুলিতে ফুটা করে দেয়ার চিকিৎসাও প্রচলিত ছিল! একইভাবে বিভিন্ন হরর সিনেমাতে আমরা এখনো দেখি কোনো নিউরোলজিকাল কন্ডিশনযুক্ত চরিত্রকে শয়তান বা তেমন কোনো অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এভাবে বিগত যুগের বিশ্বাসগুলো ঠাই করে নিচ্ছে হাল আমলের শিল্পের মধ্যেও। 

এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের পুনরুৎপাদনে জন্ম নিতে পারে এক দুষ্টচক্র। আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা হলো মেগামাইন্ড। অনেকটা সুপারম্যানের প্যারডি করে বানানো এই সিনেমাটার শুরুতে দেখা যায় দুটো গ্রহ থেকে দুটো শিশুকে ক্যাপসুলে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর উদ্দেশে। তাদের মধ্যে একজন শিশু, মেট্রোম্যান, যে দেখতে খুব সুন্দর, তার সুপারম্যানের মত নানাবিধ ক্ষমতা, সে গিয়ে পড়ে এক আলিশান মহলে। অন্য শিশুটা হলো মেগামাইন্ড, যার গায়ের রঙ নীল আর মাথাটা অতিকায় বড়, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছাড়া যার আর কোনো ক্ষমতাই নেই, সে গিয়ে পড়ে একটা জেলখানায়। সেখানেই তাদের গোটা জীবনের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। মেট্রোম্যান বড় হয় পর্যাপ্ত যত্ন ও আদরের সাথে, স্বীকৃতির কোনো অভাব হয় না। সে গড়ে ওঠে একজন হিরো হিসেবে। অপরদিকে মেগামাইন্ড বড় হয় কয়েদিদের মাঝে। সদিচ্ছা বা প্রতিভার জন্য পুরস্কৃত হওয়া তো দূরের কথা, ন্যূনতম মূল্যায়নও সে পায় না। উদ্ভট দৈহিক গড়নের কারণে স্কুলেও সে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহারের শিকার হয়। চোখের সামনে সে দেখতে পায় মেট্রোম্যান কীভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই সবার মধ্যমণি হয়ে রয়েছে।

ছবিঃ মেগামাইন্ড
মেগামাইন্ড সিনেমার একটি ফ্রেম



একসময় নিজের এই হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষার প্রভাবেই যেন মেগামাইন্ড হয়ে ওঠে এক ভিলেন, সুপারভিলেন। তারপরের ঘটনা পাঠক নিজে সিনেমাটা দেখে জেনে নেবেন আশা করি। কিন্তু মেগামাইন্ডের এই ভিলেন হয়ে ওঠাটা কি অপ্রত্যাশিত কিছু? নাকি অসংখ্য আপাত-নিরীহ আচার ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আগে থেকেই তার ভিলেন হয়ে গড়ে ওঠার এন্তেজাম করে রাখা হয়েছিল? মেগামাইন্ড দর্শকদের কাছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে একটা সুপারহিরো বনাম সুপারভিলেন সিনেমা হিসেবে খ্যাত হলেও, আমার কাছে মনে হয়েছে এই সিনেমাটা আমাদের বলতে চেয়েছে যে অপরাধীরা শেষমেষ ভুঁইফোড় কিছু না। তাদের বাতাবরণ ও পরিপার্শ্বের মধ্য দিয়েই তাদের জন্ম। মেগামাইন্ড আমাদেরকে দেখায় যে, আমরা যদি আমাদের রিপ্রেজেন্টেশান ও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হই, তাহলে আমরা জন্ম দেব কিছু সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসির। যাদেরকে আমরা ইতোমধ্যে ভিলেন বলে বিশ্বাস করতে চাই, তারা ক্রমাগত ভিলেন হয়েই আমাদের সামনে হাজির হতে থাকবে।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।