WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
আলোচিত কিছু ভিলেন। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা।


বাংলা সিনেমার কিছু উল্লেখযোগ্য ভিলেনের নাম মনে করুন তো।
কাদের কথা মাথায় আসছে?
স্বাভাবিকভাবে আপনার মনে ভেসে ওঠার কথা ডিপজল, কাবিলা কিংবা জাম্বুর চেহারা। 

তাদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান কি?
এদের মধ্যে সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য হলো এরা কালো, মোটা, চুল কম। হিরোদের বিপরীতে তাদের ভাষাভঙ্গির মধ্যেও স্পষ্ট তফাৎ টের পাবেন। হিরোরা কথা বলে সুন্দর, সুললিত, তথাকথিত ‘শুদ্ধ’ ভাষায়, এবং নিজেদেরই চারিত্রিক অশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবেই যেন, ভিলেনরা বলে ‘অশুদ্ধ’ ভাষায়। এইটুকু অন্তত স্পষ্ট, ভিলেনদেরকে আমাদের সামনে কীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে সেটার মধ্যে তাদের ব্যাপারে অন্তর্নিহিত কিছু পূর্বানুমান লুকিয়ে রয়েছে। সেটা হলো, যারা খারাপ তাদের কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলোকে আমরা ‘কদর্যতার’ সাথে মিলিয়ে দেখি। সহজ কথায়, কালা মানেই বদ। অথচ, কিছু আরোপিত অতিরঞ্জন বাদে, কাবিলা বা জাম্বু  কিন্তু গড়নের দিক দিয়ে আর দশজন বাংলাদেশির খুব কাছাকাছি। তবুও বিশেষভাবে তাদের গড়নটাকেই চারিত্রিক ত্রুটির সাথে মিলিয়ে দেখতে থাকাটার মধ্যে আমাদের ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও সেখান থেকে জন্ম নেয়া আত্মঘৃণার কোনো ভূমিকা নেই তা বলা যাবে না। আমরা ইদানীং প্রায়ই কিছু নাটক হয়তো দেখি যাতে সাবিলা নূর বা মেহজাবিনের মত ফর্সা নায়িকারা মুখে কালি মেখে কালো হওয়ার অভিনয় করছে। বাংলাদেশের মত অঞ্চলে তো আদতেই চাপা বর্ণের মেয়েদের কোনো অভাব থাকার কথা না। তবুও কাস্টিং-এর ক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তের কারণ কী? কেননা যখন কোনো অভিনেতা খুনি হওয়ার অভিনয় করে, তখনো যেমন দর্শকের জানা থাকা দরকার যে সে আসলে খুনি না, একইভাবে আমাদের জানা থাকা দরকার যে টিভির নায়িকারাও আসলে কালো না।

ছবিঃ সাবিলা নূর
নাটকের একটি দৃশ্যে সাবিলা নূর


কেননা মহাভারতের দ্রৌপদীর গায়ের রঙ কালো হওয়ার স্পষ্ট উল্লেখ থাকলেও, গায়ের রঙ কালো হওয়া নাটক-সিনেমার নায়িকা হওয়ার পূর্বশর্তের বিরোধী। এরকম কেলেঙ্কারি একটা কাণ্ড ঘটেছিল ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া অথেলো সিনেমাটাতে। সেখানে অথেলোর অভিনেতা লরেন্স অলিভিয়ের তার ভিলেনসুলভ কাজকর্ম আরো রঙচঙ মাখিয়ে ফুটিয়ে তোলেন নিজের মুখে কালো কালি মেখে। মানে, কালো হওয়া আর যাবতীয় অকাজ-কুকাজ যে একই লাইনের, সেটাই স্পষ্ট করে দেয়া হলো। এসব খুচরা ট্রিক্সের মাধ্যমে হিরোদের ব্যাপারে খুব সহজেই আমাদের সহানুভূতি ও ভিলেনদের প্রতি ঘৃণা আদায় করে নেয়া যায়। অর্থাৎ, হিরো ও ভিলেনদের এই বিরোধী গুণগুলি তাদের মধ্যকার বিভাজনরেখার কাজই করে।  

এটা অবশ্য নতুন কিছু না। আর যেকোনো ধারণার ইতিহাসের মতই, সৌন্দর্যের ধারণার কুলজি সন্ধানের জন্যেও আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন গ্রিসে। আমাদের বাংলা সিনেমার যে নজিরগুলোর কথা বললাম, সেগুলোর উহ্য বক্তব্যটা হলো সৌন্দর্যের সাথে শুভের ও কদর্যতার সাথে অশুভের একটা অনিবার্য সংযোগ রয়েছে। গ্রিকরাও তাই বিশ্বাস করতো, এবং এ ব্যাপারে তাদের মধ্য কোনোরকম রাখঢাকের বালাই ছিল না। ভাষার মধ্যে একটা সংস্কৃতির বদ্ধমূল ধ্যানধারণার হদিস পাওয়া যায়। সৌন্দর্যের গ্রিক প্রতিশব্দ ছিল কালোস, একইসাথে যার অর্থ ছিল সততাও। আবার, কদর্যতার প্রতিশব্দ ছিল আইস্ক্রোস, যেটার আরেক অর্থ ছিল লজ্জাজনক কোনোকিছু। হোমারের ইলিয়াডের এক পর্যায়ে থের্সিটেস নামে একজন সাধারণ লোক আগামেমননের কর্তৃত্ব স্বীকার করতে নারাজ হয় এবং অডিসিউস দ্রুতই তাকে পরাস্ত করে। গ্রিক ভাষায় কদর্যতা ও জঘন্যতার সমার্থকতার দরুন তার ব্যাপারে হোমারের বিবরণটা এভাবে পড়া যায়: ‘ইলিয়নে জন্মানো সবচেয়ে নিকৃষ্ট/কুশ্রী মানুষ ছিল সে। তার পা ছিল বাঁকা, ফলে এক পায়ে সে ছিল খোড়া। তার কাঁধ ঝুঁকে বুক পর্যন্ত নেমে এসেছিল, আর মাথার খুলি ছিল ভীষণ উঁচা আর তাতে ছোপ ছোপ সাদা উলের মতন চুল।’ অর্থাৎ, আমাদের সিনেমার সেই চল তার উত্তরাধিকারের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারে হাজার হাজার বছর পুরানো, পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্যকেও। যদিও এখানে কেউ উল্লেখ করতে পারেন সক্রেটিসের কথা, যে অত্যন্ত কুৎসিত বলে প্রখ্যাত, তবুও সম্মানিত। আমি অবশ্য এটাকে দেখি এমনভাবে যে, নিজের বাহ্যিক কদর্যতার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্যই সম্ভবত তাকে হতে হয়েছিল সমস্ত এথেন্সের সবচেয়ে জ্ঞানী পুরুষ। এসব ব্যতিক্রম বাদ দিলে গ্রিকরা বাহ্যিক রূপকে অন্তরের অবস্থার প্রতিফলন হিসেবেই দেখত। অর্থাৎ, আপনার বাহ্যিক গড়ন ও মুখাবয়ব দেখে বুঝে ফেলা সম্ভব আপনার চরিত্র ও মন কেমন। ফলে কদর্যতা ছিল এমন এক অবস্থা, যার থেকে যত দ্রুত সম্ভব নিরাময় পাওয়া যায় তত ভালো। ইতিহাসবিদ জেকব বার্খার্ট এক স্পার্টান শিশুর কথা উল্লেখ করেছিলেন, যে পরে ডেমারেটাসের স্ত্রী হয়েছিল। সে দেখতে ভীষণ খারাপ হওয়ায় রোজ তাকে থেরাপনিতে হেলেনের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হতো, এবং সেই সুন্দরীতমার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে আর্জি জানানো হতো যেন দেবী সেই মেয়ের কদর্যতা মুছে যায়। কদর্যতা যেনবা একটা রোগ, একটা বিশেষ কন্ডিশন, যার কবল থেকে উদ্ধার পাওয়া জরুরি।

এরকম ধারণার বিস্তার আরো বহুদূর পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে বাচ্চারা যেসব গল্পের হাত ধরে দিনদুনিয়া বুঝতে শুরু করে, অর্থাৎ রূপকথার মধ্যে এরকম উপাদানের প্রাচুর্য আমলে নেয়ার মতই। রূপকথাগুলোর সাধারণত আন্তর্জাতিকতা অন্য যেকোনো গল্পমাধ্যমের চেয়ে বেশি, কেননা খুব সহজেই তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধরে, আঞ্চলিক উপাদানগুলোকে নিজের অংশ করে নিয়ে হাজির হতে থাকে। আমাদের অঞ্চলে আছে শুয়োরানি-দুয়োরানিদের গল্প, কিংবা ডাইনিবুড়িরা। তারা হয় বিগতযৌবনা, অদ্ভুত গায়ের রঙ আর উঁচা নাকবিশিষ্ট নারী। অন্যদিকে নায়িকারা হয় অনন্য সুন্দরী ও ফর্সা। যেমন সিন্ডেরেলা কিংবা স্নো হোয়াইট। এখানে, তাদের সৌন্দর্য গল্পের কোনো আকস্মিক অংশ না, বরং তাদের সৌন্দর্যকে ঘিরেই গল্পগুলো আবর্তিত হয়। ‘মিরর, মিরর অন দ্য ওয়াল/হু’জ দ্য ফেয়ারেস্ট অফ দেম অল?’ দেখা যায় নিজেদের সৌন্দর্যের কারণেই নিজেদের কুশ্রী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা কাজের মেয়ের ঈর্ষার শিকার হয়ে বিপদে পড়ে, নাহয় দেখা যায় তাদের লাবণ্যের প্রেমে পড়ে নায়ক নানারকমের পাগলামি করে। আর এখানেও সেই একই যুক্তি অনুসৃত হয়: সিন্ডেরেলার মুখশ্রী তার পরিষ্কার মনের কারণেই এমন, অন্যদিকে তার কিম্ভূত সৎমা ও সৎবোনেদের চেহারা তাদের অন্তরের কাদারই ইশারা।  

ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করে বোঝার জন্য বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট গল্পটা একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে। আর দশটা রূপকথার মতই, এই গল্পেরও দেশকালভেদে অসংখ্য সংস্করণ পাওয়া যায়। গল্পের মূল লেখক ছিল গাব্রিয়েল-সুজান বার্বো দে ভিলেন্যুভ। গল্পটা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭৪০ সালের দিকে। গল্পটার কঙ্কাল এরকম: এক বিপত্নীক বণিকের তিন মেয়ে। বড় দুই মেয়ে বেশ নিষ্ঠুর আর নিচুমনা, আর কনিষ্ঠ মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর, একইসাথে নির্লোভ ও আন্তরিক। সেই মেয়ের নামই বেল। বেল শব্দের অর্থই সুন্দরী। এতক্ষণ সৌন্দর্য ও সদাচারের সংযোগের ব্যাপারে যা যা বললাম, সেসবই এই গল্পে পাওয়া যাচ্ছে। যাইহোক, সেই বণিক একবার ব্যবসার কাজে দূরে এক জায়গায় যায়। তার বড় দুই মেয়ে তার কাছে দামি জিনিসপত্র চায় (যেহেতু তারা লোভী), আর বেল চায় একটা দুর্লভ গোলাপ (যেহেতু সে নির্লোভ।) বণিকের অনেক বড় লোকসান হয়, ফলে সে কিছু কিনতে পারে না। কিন্তু একটা বাগানে ছোট মেয়ের কাঙ্ক্ষিত সেই গোলাপ দেখতে পেয়ে সেটা তুলতে যান। জানা যায় সেই বাগানটাই হলো বিস্ট তথা এক জন্তুসুলভ ব্যক্তির। সে এক শর্তে বণিককে যেতে দিতে রাজি হয়, যে বণিক ফিরে গিয়ে তার বদলে এক মেয়েকে এখানে থাকার জন্য পাঠিয়ে দেবে। অবশ্যই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে ছোট মেয়ে বেলই এগিয়ে আসে। পরে দেখা যায় সেই বিস্টের সাথে বেলের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসময় বিস্ট বেলকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে সে রাজি হয় না। পরে বেল বাড়ি ফিরতে চাইলে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে আসার শর্তে বিস্ট রাজি হয়। কিন্তু বেলের বড় দুই বোন বেলের আলিশান জীবনযাপনে ঈর্ষাকাতর হয়ে তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রেখে দেয়। পরে বেল টের পায় সে বিস্টকেই ভালোবাসে, ফলে সে তার কাছে ফিরে যায়। বেলের ভালোবাসা পেয়ে বিস্টের উপর থেকে অভিশাপ উঠে যায় এবং সে রাজকুমারের রূপে আবির্ভূত হয়। এখানে দেখা যাচ্ছে, বিস্ট যতক্ষণ নিজের মনের মধ্যে সংকীর্ণতা ও রূঢ়তা লালন করে চলছিল, ততক্ষণ তার জানোয়ার-রূপ বলবৎ ছিল। কিন্তু যখনই সে কোমলতা ও ভালোবাসাকে নিজের অন্তরে ঠাই দেয়, তখনই সে তার রাজকীয় রূপ ফিরে পায়। আবারো, সেই একই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় যে, কারো মনের কুরূপই নিজেকে প্রকাশ করে তার চেহারা ও বাহ্যিক অবয়বে।

আরো একটা ব্যাপার আছে। বলা হয় ভিলেন্যুভ গল্পটা লিখেছিল একটা বাস্তব ঘটনাকেভিত্তি করে। পেট্রাস গনসালভাসের একটা বিশেষ কন্ডিশন ছিল, যার নাম হাইপারট্রাইকোসিস। এই কন্ডিশনের কারণে শরীরে খুব দ্রুতগতিতে ও অত্যধিক পরিমাণে চুল ও পশম গজায়। এ কারণে পেট্রাস পরিচিত ছিল ‘বুনো আদমি’ নামে। তার বাগদত্তা ক্যাথেরিন বিয়ের দিনের আগ পর্যন্ত পেট্রাসের এই কন্ডিশনের ব্যাপারে জানতো না। এবং বলা হয় জানার পরেও এ ব্যাপারে তার তেমন কোনো আপত্তি ছিল না। গোটা ইউরোপ জুড়ে তারপর এই গল্প ছড়িয়ে পড়ে, এবং তাদেরকে ডাকা হয় ‘বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট’ বলে। তাদের কাহিনির উপর ভিত্তি করেই ভিলেন্যুভ, ব্যুমোঁ ইত্যাদি লেখকেরা বিভিন্ন গল্প-রূপকথা রচনা করে। এভাবেই একজন লোক তার মেডিকেল কন্ডিশনের কারণে হয়ে ওঠে রূপকথার রসদ। তাকে জন্তুর মত বানিয়ে তোলা হয়।

এখান থেকে আমরা নজর ফেরাতে পারি বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে বহুলব্যবহৃত আরেকটি ট্রোপের দিকে। সেটা হলো শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের ভিলেন হিসেবে দেখানো। এই ট্রোপটা এত বহুলব্যবহৃত যে আমরা যেন প্রায় অভ্যস্তই হয়ে গেছি। হ্যারি পটারের ভোল্ডেমোর্ট থেকে শুরু করে সুপারম্যানের লেক্স লুথর, সবাই এই ট্রোপের আওতায় পড়ে। বাংলা সাহিত্য ও নাটকেও আমরা অহরহ শুনতে পাই কানকাটা রমজান, ল্যাংড়া মাস্তান ইত্যাদি চরিত্রের নাম। তাদের বাহ্যিক অবয়বে এসব বিকলতা যেন তাদের অন্তরের ঘাটতির প্রতিই ইঙ্গিতপূর্ণ। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো দ্য ডার্ক নাইট-এ হার্ভি ডেন্টের ভিলেন হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করার মুহূর্তটা। সে ছিল গথাম শহরে ন্যায়ের পক্ষের এক যোদ্ধা। কিন্তু তার প্রেমিকার মৃত্যু ও নিজের মুখের অর্ধেক ঝলসে যাওয়ার মুহূর্তটা চিহ্নিত করে তার অশুভের দিকে পা বাড়ানোটাকেও। ব্যাটম্যানের সবচেয়ে পরিচিত ভিলেন জোকারের গল্পটাও প্রায় এরকম, তারও চেহারায় বিকৃতির ছাপ। এরকমটা প্রায়ই দেখানো হয় যে তাদের এই শারীরিক কমতিগুলোর কারণে তার মধ্যে একপ্রকার তিক্ততাবোধ জন্ম নেয়, যার ফলে সে বেছে নেয় খারাপের পথ। অপরদিকে, হিরোরা কেবল স্বাভাবিকই হয় না, হয় একটা অতিরঞ্জিত আদর্শ গড়নের অধিকারী। 

ভিলেনদেরকে এভাবে কুৎসিত কিংবা বিকলাঙ্গ হিসেবে চিত্রিত করার প্রধান উদ্দেশ্যটা হলো তারা কতটা আলাদা, ‘স্বাভাবিক’ থেকে কতটা চ্যুত, সেটা দেখানো। এ ধরণের চিত্রায়ণের মাধ্যমে একপ্রকার অপরায়ন প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এমনকি এতে করে একটা প্রচ্ছন্ন বিমানবীকরণও যে ঘটে না, তা বলা যাবে না। প্রায় সকল সভ্যতায়ই তথাকথিত কুৎসিত অথবা বিকলাঙ্গ মানুষদের জন্তুসদৃশ হিসেবে দেখার ইতিহাস রয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন সার্কাসে তাদেরকে মানুষ টিকেট কেটে দেখতে আসতো। তারা হয়ে উঠতো মজার কিছু দৃশ্য। বিভিন্ন নিউরোলজিকাল সমস্যাকেও অশুভ শক্তির আছর হিসেবে দেখার নজিরও কম না। মধ্যযুগে কারো কোনোপ্রকার মানসিক ব্যাধি দেখা দিলে মনে করা হতো তার মাথায় শয়তান বাসা বেঁধেছে, এবং শয়তান যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য তাদের খুলিতে ফুটা করে দেয়ার চিকিৎসাও প্রচলিত ছিল! একইভাবে বিভিন্ন হরর সিনেমাতে আমরা এখনো দেখি কোনো নিউরোলজিকাল কন্ডিশনযুক্ত চরিত্রকে শয়তান বা তেমন কোনো অশুভ শক্তির বাহক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এভাবে বিগত যুগের বিশ্বাসগুলো ঠাই করে নিচ্ছে হাল আমলের শিল্পের মধ্যেও। 

এসব ভ্রান্ত বিশ্বাসের পুনরুৎপাদনে জন্ম নিতে পারে এক দুষ্টচক্র। আমার খুব প্রিয় একটা সিনেমা হলো মেগামাইন্ড। অনেকটা সুপারম্যানের প্যারডি করে বানানো এই সিনেমাটার শুরুতে দেখা যায় দুটো গ্রহ থেকে দুটো শিশুকে ক্যাপসুলে ভরে পাঠিয়ে দেয়া হয় পৃথিবীর উদ্দেশে। তাদের মধ্যে একজন শিশু, মেট্রোম্যান, যে দেখতে খুব সুন্দর, তার সুপারম্যানের মত নানাবিধ ক্ষমতা, সে গিয়ে পড়ে এক আলিশান মহলে। অন্য শিশুটা হলো মেগামাইন্ড, যার গায়ের রঙ নীল আর মাথাটা অতিকায় বড়, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ছাড়া যার আর কোনো ক্ষমতাই নেই, সে গিয়ে পড়ে একটা জেলখানায়। সেখানেই তাদের গোটা জীবনের নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। মেট্রোম্যান বড় হয় পর্যাপ্ত যত্ন ও আদরের সাথে, স্বীকৃতির কোনো অভাব হয় না। সে গড়ে ওঠে একজন হিরো হিসেবে। অপরদিকে মেগামাইন্ড বড় হয় কয়েদিদের মাঝে। সদিচ্ছা বা প্রতিভার জন্য পুরস্কৃত হওয়া তো দূরের কথা, ন্যূনতম মূল্যায়নও সে পায় না। উদ্ভট দৈহিক গড়নের কারণে স্কুলেও সে প্রচণ্ড বাজে ব্যবহারের শিকার হয়। চোখের সামনে সে দেখতে পায় মেট্রোম্যান কীভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই সবার মধ্যমণি হয়ে রয়েছে।

ছবিঃ মেগামাইন্ড
মেগামাইন্ড সিনেমার একটি ফ্রেম



একসময় নিজের এই হীনম্মন্যতা ও ঈর্ষার প্রভাবেই যেন মেগামাইন্ড হয়ে ওঠে এক ভিলেন, সুপারভিলেন। তারপরের ঘটনা পাঠক নিজে সিনেমাটা দেখে জেনে নেবেন আশা করি। কিন্তু মেগামাইন্ডের এই ভিলেন হয়ে ওঠাটা কি অপ্রত্যাশিত কিছু? নাকি অসংখ্য আপাত-নিরীহ আচার ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আগে থেকেই তার ভিলেন হয়ে গড়ে ওঠার এন্তেজাম করে রাখা হয়েছিল? মেগামাইন্ড দর্শকদের কাছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে একটা সুপারহিরো বনাম সুপারভিলেন সিনেমা হিসেবে খ্যাত হলেও, আমার কাছে মনে হয়েছে এই সিনেমাটা আমাদের বলতে চেয়েছে যে অপরাধীরা শেষমেষ ভুঁইফোড় কিছু না। তাদের বাতাবরণ ও পরিপার্শ্বের মধ্য দিয়েই তাদের জন্ম। মেগামাইন্ড আমাদেরকে দেখায় যে, আমরা যদি আমাদের রিপ্রেজেন্টেশান ও ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল না হই, তাহলে আমরা জন্ম দেব কিছু সেলফ-ফুলফিলিং প্রফেসির। যাদেরকে আমরা ইতোমধ্যে ভিলেন বলে বিশ্বাস করতে চাই, তারা ক্রমাগত ভিলেন হয়েই আমাদের সামনে হাজির হতে থাকবে।

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।