WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

‘এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে মাংসখেকোদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন ভেজিটেরিয়ানদের হবে।’  

বলেছিলেন কে? মহাত্মা গান্ধী নাকি? জি না স্যার, যে মানুষটা বলেছিল, স্বৈরাচারী সমাজে তাকে সবাই বস বলে মানে। লোকটার নাম অ্যাডলফ হিটলার। ১৯৪১ সাল, বারুদ-ধোঁয়া-রক্ত-হাহাকারে পৃথিবীটাই তখন একাকার। এমন সময় এই লোক দেবে যুদ্ধের হুঙ্কার, যেন প্রতিপক্ষের প্যান্ট খারাপ হয়ে যায়; এইসব সবজি খাওয়া-টাওয়ার কথা কেন বলছে? সবজির কথা শুনে উদ্যানের লোকরা আবার খুশি হয়ে যাবেন না। হিটলার ভাত-ডালের সাথে মাখিয়ে যে সবজি খাওয়া হয়; তার কথাই বলেছিল। আর বলার কারণটা লালন ফকিরই বলে গিয়েছেন—খাওন ছাড়া দুনিয়া চলে না… 

কী বললেন? লালন খাওন না বলে পাগল বলেছিলেন? বলেছিলেন হয়তো। তবে এটাও সত্য যে খাওন ছাড়া দুনিয়া আসলেই চলে না। সেজন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটা খায়, পাড়ার লালু পাগল খায়, সাগরের তিমি মাছটা খায়, হিমালয়ের সাধু খায়, স্বৈরাচাররাও খায়। কী খেত তারা, কেন খেত—এইসবই আজকে একটু জানার চেষ্টা আরকি। 

ভালো কথা, স্বৈরাচাররা কী খায়, কীভাবে খায়—এইসব আলোচনায় কি তাদের একটু মানবিকভাবে দেখানো হয়ে যায়? মোটেই না। বরং তারা যে অতিমানব টাইপের কিছু না, এক্কেবারে আর দশটা সাধারণ মানুষের কাতারেই, সেটাই আরও ভালো করে স্পষ্ট হয়। এখন আপনি যদি ‘কী? হিটলার ভাত খেত? কী মিল, সেও ভাত খেত! সবকিছুতেই তার কথা মনে পড়ে।’ বলে হু-হু করে কান্না জুড়ে দেন; আপনার ব্যাপার! 

চলুন ঢুকে পড়ি স্বৈরাচারদের খাদ্যজগতে। 

মানুষটার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ক্যাভিয়ার। কোন স্বৈরশাসকের? অ্যাডলফ হিটলার? বা রোমানিয়ান স্বৈরশাসক চসেস্কুর? না, এই ক্যাভিয়ার লাভারের নাম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ! মোটামুটি দুর্ভিক্ষপীড়িত এক দেশ, তার প্রেসিডেন্টের প্রিয় হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম দামি খাবারটা? আহা, সে তো হতেই পারে। যেমন আপনার প্রিয় হতে পারে সোনারগাঁ হোটেলের সোনার রাঙতা দেওয়া জিলাপি। প্রিয় বলেই আপনাকে সবসময় খেতে হবে নাকি? ব্যাপার হলো, এরশাদ সাহেব খেতেন। প্রায় প্রায়ই খেতেন কিনা জানি না, তবে সুযোগ পেলে ক্যাভিয়ার তিনি হাতছাড়া করতেন না।  

ক্যাভিয়ার কেন এত দামি? কারণ এটা স্টার্জন মাছের ডিম। এই অতি দুর্লভ স্টার্জন মাছ পাওয়া যায় কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ অংশে, যেখানে দূষণের হার বেশ কম। সেই দুর্লভ মাছ পাওয়ামাত্র তার পেট চেপে ধরলেই হড়হড় করে ডিম পাওয়া যাবে এমন না। স্ত্রী স্টার্জন ডিম দিতে শুরু করে ২০ বছর বয়স থেকে। ততদিন পর্যন্ত তাকে সময় দিতে হবে। তারপর সেই মাছ ধরে আন, ডিম সংগ্রহ করো, প্রসেস করো, ডিস্ট্রিবিউশন করো—কত কাজ! কাজেই দামটাও চড়া। এরশাদ সাহেব চড়া মূল্য দিতেন, খেতেন। তার পয়সা, তার খুশি। পয়সা কোত্থেকে আসত, এইসব আবার জিজ্ঞেস করতে যাবেন না। 

তিনি আমও যে খেতেন, পত্রিকা ঘাঁটলে এই তথ্য পাওয়া যায়। তবে শখ করে খান নাকি শুধু ঠ্যাকায় পড়লে, এই তথ্য পত্রিকা দিতে পারেনি। ঘটনা হলো পার্টি অফিস থেকে বাসায় এসেছেন এরশাদ, সাথে দলীয় লোকজন কিছু। এরশাদ বারবারই বলছেন, এবার খেতে যাব আমি, কিন্তু ভেতর থেকে ডাক আর আসে না! একটু পর খবর এল ভেতর থেকে, রওশন এরশাদ কোনো কারণে রাগ করেছেন, আজকে ‘ভাত বন্ধ।’ আহা… এত মজা পাওয়ার কী হলো? আপনার ভাত বন্ধ হয় না? এহ, কোথাকার কোন উত্তম কুমার এসেছেন আপনি!  

যা হোক, স্বৈরাচার হলেও, এরশাদের ক্ষুধা তো দমাতে হবে। আম আনালেন, কেটে দিতে বললেন। নিজে খেলেন, উপস্থিত নেতা কর্মীদেরও সাধলেন। আর আমাদের দিয়ে গেলেন মেসেজ, হ্যাঁ, স্বৈরাচাররা ডিনারে আম খায়। অন্তত কিচেনে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে ঠ্যাকায় পড়ে হলেও খায়। 

তার চিরবিদায়ের কিছুদিন আগে প্রকাশ পাওয়া একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম পত্রিকার পাতায়। তিনি খুব সখেদে বলছিলেন, না, এইসব মাংস-টাংস খেতে আর ভালো লাগে না। কোথাও দাওয়াত পেলে আর খেতে ইচ্ছা করে না। বয়স যখন বেড়েছে, গুঁড়া মাছ, সবজি খেতেই ভালো লাগে। 

আমার চোখ চকচক করে উঠল। মাছের প্রসঙ্গ যখন এসেছে, সাংবাদিক নিশ্চয়ই ক্যাভিয়ারের কথা জানতে চাইবেন, এখন আগের মতো ভালো লাগে কিনা। নাহ, সাংবাদিক ওই লাইনেই আর থাকলেন না, চলে গেলেন পলিটিক্যাল প্রশ্নে। যত্তসব বেরসিক! 

বগুড়ার দই তার প্রিয় খাবারের একটা। কার? এরশাদের? উঁহু। হাসিনার? উঁহু। জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের। তা হতেই পারে, বগুড়া তো তারই ‘রাজত্বের’ অংশ তখন; নিজের ‘প্রজাদের’ তৈরি খাবার প্রিয় হবে না? কী তাজ্জব কথা! 

স্বৈরাচারদের শুধু প্রিয় খাবার না, খাদ্যাভিমানও থাকে, সেটা দেখিয়েছিলেন এই ইয়াহিয়া খান। উত্তাল ১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সেই ডাক বাঙালির মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো। ইয়াহিয়া খান দেখলেন অবস্থা সুবিধার না, আলোচনা করতে ঢাকায় এলেন তিনি। বসল বৈঠক, স্বাভাবিকভাবেই তাতে হোস্ট শেখ মুজিব, গেস্ট ইয়াহিয়া খান। অতিথির জন্য বাঙালির স্বভাবসুলভ ঔদার্য্যে নানা রকমের খাবারের আয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান খেলেন না সেসব কিছুই। যতটুকু খেলেন, সেটা না খাওয়ার মতোই। ঢাকার অস্থায়ী বাসভবন থেকে বাবুর্চির রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি, সেটাই খাবেন। খেলেনও তাই। আলোচনায় যেমন এক হওয়া যাচ্ছে না, খাবারেও একই দশা। কী একটা অবস্থা! 

এটা গেল ইয়াহিয়ার খাদ্যাভিমানের অংশ। এবার এর বেগতিক দশার কথা শোনাই। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনে ততক্ষণে যোগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের বাঙালি পাচক নুরু মিয়া। ড. কামাল হোসেন ঘটনাটা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন এইভাবে—‘জেনারেল পীরজাদা ফোন করে বললেন, দেখেন আপনারা বাঙালিরা তো অতিথিদের ব্যাপারে দুর্বল থাকেন। ইয়াহিয়া তো আপনাদের অতিথি হিসেবে এসেছে। তিনদিন ধরে কোনো রান্না হচ্ছে না। বাবুর্চিরা রান্না করবে না। তারা অসহযোগ করছে। আপনারা যদি একটু অনুমতি দেন তাহলে বাবুর্চিরা ওনার (প্রেসিডেন্টের) জন্য কিছু গরম খাবার তৈরি করতে পারে।’  

শেখ মুজিব অনুমতি দিলেন ডাল-রুটি রান্না করতে। সেটাই খেয়ে ইয়াহিয়া প্রাণধারণ করলেন। অবশ্য মাঝের দিনগুলোতে তিনি একেবারে না খেয়ে ছিলেন বলা যায় না। কফি আর বিস্কিট খেয়েছিলেন। বগুড়ার দই সম্ভবত তখন আর তার এত প্রিয় ছিল না! 

কফি ইয়াহিয়ার প্রিয় ছিল বোঝা গেল। এই খেয়েই কি তিনি নেশার ঝোঁক সামলাতেন? তাহলে তো হয়েছিলই! বলা হতো এঞ্জিনের মতো ধূম্র উদগীরণ করতেন তিনি। দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার ‘প্রাইভেট লাইফ অভ ইয়াহিয়া খান’ বইতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা ঘটনা তুলে এনেছেন। ইয়াহিয়া খানের কিছু জেনারেল পাকিস্তানে একটা পার্টির আয়োজন করেছেন। খাবারের আয়োজন, পার্টির সাজসজ্জা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে একটা ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। তুমুল পার্টির একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বেহেড মাতাল হলেন। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরলেন একটা বেলুনের ওপর। ঠাস। ‘গেল গেল, জগজীবন রাম গেল’—হাসিতে প্রায় হাততালি দিয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট। বলে রাখা ভালো, জগজীবন রাম ছিলেন সেসময়ের ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। যা হোক, ইয়াহিয়া সিগারেট চেপে ধরলেন আরেকটা বেলুনের ওপর—ঠাস। ‘এবার গেল ভুট্টো’। 

শেষ আরেকটা বেলুন ফাটালেন। কার নাম বললেন তা আর বলার দরকার নেই, পাঠক হিসেবে আপনি বুদ্ধিমান আমি জানি। তারপর বিখ্যাত গায়িকার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন। গায়িকার নাম জানতে চাইছেন? থাক থাক… স্বৈরাচারদের খানা-খাদ্য নিয়ে এই লেখা, তাদের প্রেম-মুহাব্বত নিয়ে এত কথার কী দরকার? 

তবে, স্বৈরাচারদের বিষাদ নিয়ে লেখা যেতে পারে। ইরানের সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের সময়টা ইয়াহিয়াকে বেশ কাছে থেকে দেখেছেন। তার কথা অনুযায়ী, অন্তত আড়াই লিটার মদ ইয়াহিয়ার দৈনিক লাগতই। আর মদের প্রভাবটাও মাঝেমাঝে বোঝা যেত, যখন ইয়াহিয়ার ঘর থেকে বদ্ধ মাতালের হুঙ্কার আসত ভেসে—‘মুজিবকে এখান থেকে নিয়ে যাও, সোজা ফাঁসিতে নিয়ে ঝোলাও! এক্ষন ঝোলাও!’ 

‘ফাঁসিতে ঝোলাও’ আরেকজনও বলতেন, তবে সুযোগ পেলে। ভদ্রমহিলার নাম ডোনা র‍্যাচেল, পরিচয় তখন ফাস্টলেডি। তার পতিপ্রবর হলেন ইতালির কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি। ডিনারের সময় হলে দুনিয়া উল্টে যাক, র‍্যাচেলকে পাঁচ সন্তান নিয়ে ডাইনিঙে উপস্থিত থাকতেই হবে। মুসোলিনি আসবেন, গম্ভীর মুখে সালাদ খাবেন। সালাদের ওপর ঢালা হবে অলিভ অয়েল, লেবুর রস আর মুঠো মুঠো রসুনের কুচি। সেই রসুন কুচির পরিমাণ এমন হবে যে বিরাট বোল উপচে পড়তে হবে। স্বৈরাচার সাহেবের একটু গ্যাসের সমস্যা, তাই তার ধারণা রসুন খেলে এই উপদ্রব থেকে মুক্তি পাবেন। র‍্যাচেলের কথা অনুযায়ী, ডিনারের পর মুসোলিনি ঘরে ঢুকলে মনে হতো বিশাল একটা রসুন তার যাবতীয় দুর্গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছে! কী আর করা, বাচ্চাদের বেডরুমে ঠাঁই নিতেন তিনি।  

‘পেটের ভুটভাট’ সারাতে আরেকটা টোটকাও নিয়মিত চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। সেটা হলো প্রতিদিন তিন লিটার দুধ খাওয়া। আমি ডাক্তার না, তবে মানবজীবন যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝি, তিন লিটার দুধ দৈনিক খেলে গ্যাস্ট্রিকের রোগির পেটের আওয়াজটা ভুটভাট থেকে ধ্রুম-ধ্রাম হয়ে যাওয়ার কথা! বেচারা র‍্যাচেল, তাকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ! 

মজার ব্যাপার হলো, এই দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা যেন হিটলার না জানেন, সেজন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। তার ধারণা ছিল, দুধ খাওয়ার মতো ভালো-ছেলে টাইপের একটা কাজ হিটলারের কাছে যথেষ্ট ‘ফ্যাসিস্ট-সুলভ’ মনে হবে না! 

এই যে, কান টানলে যেমন মাথা আসে, এক স্বৈরাচারের কথায় কথায় এসে পড়েছে আরেক স্বৈরাচার। কুখ্যাত হিটলার, যাকে স্বৈরাচারদেরও স্বৈরাচার বলে উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু তার খাদ্যাভ্যাস যেকোনো নিরীহ লোকের চেয়ে যেন মিনমিনে। সকালে উঠে লোকটা খাবে ওটসের সাথে ফলমূল, ভেষজ চা। কোনো কোনোদিন স্বাদ বদলাতে রুটির সাথে জ্যাম। 

মাংস? ছি ছি ছি… এইসব ‘বর্বর’ খাবার আর হিটলার? কখনও না! হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে স্কোয়াব খাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু সেটা কেউ যেন না জানে! স্কোয়াবটা কী জিনিস? ওই যে চার সপ্তাহ বয়সী বাচ্চা কবুতরের মাংস হালকা একটু ভাজা ভাজা, একটু রোস্ট টাইপ। 

তাহলে স্বৈরাচার সাহেব খান কী? দুনিয়ার তাজা শাকসবজি, স্যুপ, পাস্তা, ভাত, সয়াবিন। সয়াবিন তো তিনি এমনভাবে খেতেন যে এর নামই বাজারে চাউর হওয়া শুরু করেছিল নাজি-বিন নামে। কেন এসব খেতেন হিটলার? কারণ তারও পেটের সমস্যা! মাছ-মাংস ‘হারাম’।  ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অমান্য করবে, এমন সাধ্য স্বৈরাচারেরও নেই। 

মদটা খেতেন হিটলার কালেভদ্রে, সেটাও শুধু বিয়ার আর ওয়াইন। বরং মিষ্টি খাবার মুখ তার। পেস্ট্রি, ক্যান্ডি—এসব পেলে ছাড়াছাড়ি নেই। চকলেট খাওয়া শুরু করে মিটিং পিছিয়ে দিয়েছেন এমন নজিরও আছে।  

এই যে নিরীহ খাবার-দাবার খেয়ে যাচ্ছে লোকটা, তার আগে প্রতিবেলায় কিন্তু ঘটত একটা নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। আর সেটা যেত ১৫ জন তরুণীর একটা ফুড টেস্টিং টিমের ওপর দিয়ে। নামেই ফুড টেস্টার, আসলে তাদের মূল কাজ খাবারে বিষ আছে কিনা সেটা পরখ করা। হিটলারের সবসময় ভয় ছিল বৃটিশরা যেকোনো ভাবেই হোক তার খাবারে বিষ মেশাবে। 

তা ফুড টেস্টাররা কীভাবে বিষ পরখ করবে? খুব সরল ব্যাপারটা। ১৫ জনকেই হিটলারের জন্য প্রস্তুত করা খাবারটা খাওয়াও, ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করো। যদি ওরা না মরে, অসুস্থ না হয়ে পড়ে, ফ্যুয়েরারকে গিয়ে বল যে জাঁহাপনা, খাবার প্রস্তুত। আর ফুড টেস্টাররা মরলে বাবুর্চি যারা আছে ব্রাশফায়ার করে ফেলে দাও! 

এই ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জনকে জার্মানির পতনের পর গুলি করে মারে রাশিয়ান আর্মি। বেঁচে গিয়েছিল একজন—মার্গট ওয়ল্ক। হিটলার আত্মহত্যার আগেই পালিয়ে যাওয়ায় জানে বেঁচে যায় সে, তবে টানা ১৪ দিন সোভিয়েত আর্মির হাতে ধর্ষিত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছে তার। হিটলারের জন্য ফুড টেস্টিং নিয়ে ১৯১২ সালে মার্গটের দেওয়া জবানীর একটা অংশ শোনা যাক—কিছু মেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই খাবার খাওয়া শুরু করত। কারণ প্রচণ্ড মৃত্যুভয় নিয়ে আমাদের সব খাবার খেতে হতো। খাওয়ার পর আমরা অপেক্ষা করতাম কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। যখন দেখতাম আমরা বেঁচে আছি, তখন সবাই কুকুরের মতো চিৎকার করে কাঁদতাম।

হিটলার নিরামিষ খেতেন, তবে টেবিলে অন্যান্য অফিসারদের জন্য মাছ-মাংস থাকত। অন্যদের হিটলার এগুলো খেতে না করতেন না, তবে কেউ খেলে মরা-খাদক বলে ঠাট্টা করতেও ছাড়তেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে হিটলার খেতেন শুধু ক্লিয়ার স্যুপ আর ম্যাশড পটেটো। তার প্রিয় অনুচর গ্যোয়েবলস প্রায়ই এটাসেটা বলে ডিনারের টেবিল থেকে সটকে পড়তেন। কাঁহাতক আর ‘শবাহারী’ খোঁটা শুনতে ভালো লাগে? আরেক পারিষদ বরম্যান অবশ্য এই দিক দিয়ে পাক্কা। দিব্বি হিটলারের সাথে স্যুপে চুমুক দিতেন, কচরমচর করে গাজর চিবাতেন; তারপর হিটলারকে ডিনারের জন্য অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নিজের বাঙ্কারে ফিরে সাঁটাতেন পর্ক চপ, কাটলেট আর বাছুরের স্নিৎজেল!  

অলংকরণ: রাজিব কান্তি রায়

এইরকম মাংস চিবানোর ব্যাপারে কিঞ্চিৎ গুজব আছে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিনকে নিয়েও। এই মাংসটা নরমাংস। সাংবাদিক অনিতা সুরিউইচ ‘ডিক্টেটরস উইথ স্ট্রেঞ্জ ইটিং হ্যাবিটস’ নামের একটা ফিচার লিখতে গিয়ে ইদি আমিনকে ‘আপনি ক্যানিবাল কিনা’ প্রশ্ন করলে, উত্তর পেয়েছিলেন, আরে না, আমি নরমাংস খুব একটা পছন্দ করি না। এইরকম নোনতা নোনতা মাংস এত শখ করে খাওয়ার কী আছে? 

লোকটা রসিকতা করল নাকি? কে জানে! ডিক্টেটর মানুষ, অনিতা আর ডিটেইলসে জিজ্ঞেস করতে যাননি। 

স্বৈরাচারদের এমন খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করলে একটা মজার জিনিস পাওয়া যায়। তারা যতই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরা শুরু করে, খাবার নিয়ে খুঁতখুতানি তাদের ততই বেড়ে যায়। খাবারের ‘বিশুদ্ধতার’ দিকে এমনভাবে তারা কড়াকড়ি শুরু করে, যেন মানুষের জন্য না, আকাশের দেবতার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা হচ্ছে! এই যেমন কিম জং ইলের কথাই ধরা যাক। হ্যাঁ, উত্তর কোরিয়ার এখনকার সুপ্রিম লিডার কিম জং উনের বাবার কথাই হচ্ছে।  তিনিও ছিলেন সুপ্রিম লিডার। হিটলারের মতো ফুড টেস্টার হিসেবে তারও ছিল এক প্রমীলা বাহিনী। বিষ-টিষ আছে কিনা তা তো চেখে দেখতই, তার ওপর প্রতিটা ভাতের কণা সমান ও একই রঙের রয়েছে কি না, তা ভাল করে পরীক্ষা করতেন তারা। সুপ্রিম লিডারের খাবার বলে কথা, প্রতিটা ভাত যমজের মতো একরকম না হলে কি চলে? 

কোরিয়া থেকে আমাদের অঞ্চলে আবার একটু ফিরি। আসামের চা বেশ কড়া, দার্জিলিঙের চা বেশ সুগন্ধি। দুটার কম্বো করে কড়া লিকারের সুগন্ধি চা বানিয়ে কে খায় বলুন তো? মোদী? না। মমতা? না। যে খায়, তার নাম শেখ হাসিনা। 

জানি, আপনারা একেবারেই চমকে উঠছেন না। নিত্য-নতুন রেসিপি তো তিনি আর আজকে থেকে দিচ্ছেন না! এই জন্যই এদেশবাসী সময়ে সময়ে পায় মাংসের বদলে কাঁঠালের বার্গারের রেসিপি, মিষ্টি কুমড়ার বেগুনীর রেসিপি, পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি, মাছের কাঁটা গলিয়ে নরম করে গিলে খাওয়ার রেসিপি। এছাড়াও তার থেকে পাওয়া যায় শীতের দিনে ডিম সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার টোটকা, টমেটোকে সান-ড্রাইড করার তরিকা। বলতেই হবে, বাংলাদেশের এই স্বৈরাচার রেসিপি তথা রান্নাকে ব্যবহার করেন কূটনীতির অংশ হিসেবে। তাই তাকে দেখা যায় জেলে থাকা অবস্থায় আরেক কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে রান্না করে পাঠাতে, দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাড়িতে ভাপা ইলিশ রান্না করতে। সেসময় অবশ্য মমতাও প্রণবের বাড়িতে  গিয়েছিলেন হাসিনার সাথে দেখা করতে। হাসিনা মমতার জন্যও ইলিশ রেঁধেছিলেন। কিন্তু মমতা ‘অত তাড়াতাড়ি আমি রাতের খাবার মুখি তুলি না’ বলে কেন এড়ালেন, কে জানে! 

একইসাথে, খাওয়া-দাওয়ার মজলিশটাকেও হাসিনা পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন ফিল্ড হিসেবে ভালোই ব্যবহার করেন। নির্বাচনী প্রচারে মিঠামইন যাওয়া হচ্ছে? ওকে, রাষ্ট্রপতির বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করা যাক। আমরা খবরে শুনি সেসময়ের রাষ্ট্রপতির পুত্র গম্ভীর গলায় বলছেন, ২০ পদের মাছ রান্না হবে, এরমাঝে শেখ হাসিনার পছন্দ রুই, পাবদা, চিতল। অষ্টগ্রামের পনির প্রায়ই গণভবনে যায়, এবারও যাবে। আর এখানে তো খাওয়ানো হবেই। 

আমরা শুনি, শ্বাস ফেলে ভাবি, এমনই তো মাটির মানুষ হওয়া উচিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর। বাংলার মাটি-বাংলার জলের মানুষ তো মাছই খাবে, পনির পেলে আদর করে কোলে তুলে নেবে। 

শেখ হাসিনা সভা করতে যাবেন রংপুরের পীরগঞ্জে। শ্বশুরবাড়িতে তার জন্য আয়োজন হচ্ছে রুটির সাথে ছোটো ছোটো পিস করা মুরগির মাংস, নানা পদের ভর্তা, অনেকরকম শাক, মাছের নানা আইটেম। এগুলো সবই তার প্রিয় খাবার। আমরা পত্রিকায় পড়ে আকুল হই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতার এগুলোই তো হওয়া উচিত পছন্দের খাবার! সে ভোট দিনের নাকি রাতের, তাতে কী আসে যায়! 

এক জনসভায় আয়োজন করা হয়েছে ৩২ পদের। শেখ হাসিনা আগ্রহ করে খেলেন দুই পদ—কালোজিরার ভর্তা আর টাকি মাছের ভর্তা। নেতাকর্মীরা আবেগে থরোথরো—বঙ্গবন্ধুর কন্যা তো মাছপাগল হবেই। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় আয়োজন করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর খাবারের। আয়োজন সামান্য—খাসীর মাংস, সবজি, ডাল, সেমাই, ভাত, পোলাও। প্রধানমন্ত্রী পোলাও খেলেন না, আর সব খেলেন। 

পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যাহ্নভোজের জন্য পোলাও, সাদা ভাত, খাসির মাংস, ডাল, সবজি ও সেমাই করা হয়েছে। তিনি পোলাও ছাড়া বাকি সকল খাবার খেয়েছেন। এর আগে কোনো রাষ্ট্রনায়ক এভাবে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে খেয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই।

তিনি খাওয়াতে ভালোবাসেন, খাওয়া নিয়ে, খাওয়ার রেসিপি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, পছন্দের খাবার খেতে ভালোবাসেন। এমনকি, ৫ আগস্টে যখন বহু মানুষ গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ছিল, তখন তার জন্য গণভবনে মজার মজার খাবার তৈরি হচ্ছিল। সে খাবার কী হবে, সেটা তিনি নাকি সকালের চা খেতে খেতে বাবুর্চিকে বলে দিয়েছেন। মানুষ যে কী না… গণভবনে লংমার্চ করবি ভালো কথা,  লাঞ্চের পরে করা যায় না? সেই না খাওয়া খাবার হয়তো তাকে খেতে হয়েছে ভারতের মাটিতে গিয়ে, কে জানে! 

‘আপনি কী খান বলুন, আমি আপনাকে বলে দেব আপনি কে’—বলে গেছেন উনিশ শতকের ফরাসি প্রাবন্ধিক জ্যঁ আঁথেলমা ব্রিলা-সাভারিন। স্বৈরাচারদের খানাখাদ্য নিয়ে বিখ্যাত বই ডিক্টেটর ডিনারসের লেখক ভিক্টোরিয়া ক্লার্ক আর মেলিসা স্কট একে বাড়িয়েছেন আরও—‘আপনি কে, সেটা নির্ভর করে আপনি কী খাচ্ছেন, কীভাবে খাচ্ছেন, কার সাথে খাচ্ছেন তার ওপর। খাবার আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ তো করেই, তার সাথে আপনার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবী নিয়ে আপনার ধ্যান-ধারণাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’  

আবার, ঠিক কোন খাবারটা খেলে যে আপনি স্বৈরাচারী হবেন, তার কোনো ঠিক নেই। বেশিরভাগ স্বৈরাচারীই খেয়ে গেছেন ঠিক তার অঞ্চলের প্রচলিত খাবারটা। তবে হেহে, অন্যান্য কাজের মতোই, খাবারের ব্যাপারেও তারা রেখে গেছেন স্বৈরাচারীতার লক্ষণ। যা তারা চান, যেভাবে চান, সেটাই হতে হবে। আর না হলে, তারা খাবেন তাদের আরও প্রিয় খাবারটা—কল্লা!   

রাজা যায়, রাজা আসে। হাতেগোনা কয়েকজন স্বৈরাচারীর নাম কিংবা খাদ্যাভ্যাস এখানে আনার চেষ্টা করা হলো মাত্র। যারা অন্তত এই অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত, বা কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক। আরও আছে অজস্র স্বৈরাচার, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পড়ে থেকে মানুষের অনর্গল ঘৃণাই সম্ভবত এখন তাদের একমাত্র খাদ্য। 

হিটলারের ঠিক বিপরীত কথা বলেই আজকের আলোচনা শেষ করা যাক—এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে স্বৈরাচারদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন গণমানুষের হবে।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।