WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

‘এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে মাংসখেকোদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন ভেজিটেরিয়ানদের হবে।’  

বলেছিলেন কে? মহাত্মা গান্ধী নাকি? জি না স্যার, যে মানুষটা বলেছিল, স্বৈরাচারী সমাজে তাকে সবাই বস বলে মানে। লোকটার নাম অ্যাডলফ হিটলার। ১৯৪১ সাল, বারুদ-ধোঁয়া-রক্ত-হাহাকারে পৃথিবীটাই তখন একাকার। এমন সময় এই লোক দেবে যুদ্ধের হুঙ্কার, যেন প্রতিপক্ষের প্যান্ট খারাপ হয়ে যায়; এইসব সবজি খাওয়া-টাওয়ার কথা কেন বলছে? সবজির কথা শুনে উদ্যানের লোকরা আবার খুশি হয়ে যাবেন না। হিটলার ভাত-ডালের সাথে মাখিয়ে যে সবজি খাওয়া হয়; তার কথাই বলেছিল। আর বলার কারণটা লালন ফকিরই বলে গিয়েছেন—খাওন ছাড়া দুনিয়া চলে না… 

কী বললেন? লালন খাওন না বলে পাগল বলেছিলেন? বলেছিলেন হয়তো। তবে এটাও সত্য যে খাওন ছাড়া দুনিয়া আসলেই চলে না। সেজন্যই পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটা খায়, পাড়ার লালু পাগল খায়, সাগরের তিমি মাছটা খায়, হিমালয়ের সাধু খায়, স্বৈরাচাররাও খায়। কী খেত তারা, কেন খেত—এইসবই আজকে একটু জানার চেষ্টা আরকি। 

ভালো কথা, স্বৈরাচাররা কী খায়, কীভাবে খায়—এইসব আলোচনায় কি তাদের একটু মানবিকভাবে দেখানো হয়ে যায়? মোটেই না। বরং তারা যে অতিমানব টাইপের কিছু না, এক্কেবারে আর দশটা সাধারণ মানুষের কাতারেই, সেটাই আরও ভালো করে স্পষ্ট হয়। এখন আপনি যদি ‘কী? হিটলার ভাত খেত? কী মিল, সেও ভাত খেত! সবকিছুতেই তার কথা মনে পড়ে।’ বলে হু-হু করে কান্না জুড়ে দেন; আপনার ব্যাপার! 

চলুন ঢুকে পড়ি স্বৈরাচারদের খাদ্যজগতে। 

মানুষটার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ক্যাভিয়ার। কোন স্বৈরশাসকের? অ্যাডলফ হিটলার? বা রোমানিয়ান স্বৈরশাসক চসেস্কুর? না, এই ক্যাভিয়ার লাভারের নাম হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ! মোটামুটি দুর্ভিক্ষপীড়িত এক দেশ, তার প্রেসিডেন্টের প্রিয় হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম দামি খাবারটা? আহা, সে তো হতেই পারে। যেমন আপনার প্রিয় হতে পারে সোনারগাঁ হোটেলের সোনার রাঙতা দেওয়া জিলাপি। প্রিয় বলেই আপনাকে সবসময় খেতে হবে নাকি? ব্যাপার হলো, এরশাদ সাহেব খেতেন। প্রায় প্রায়ই খেতেন কিনা জানি না, তবে সুযোগ পেলে ক্যাভিয়ার তিনি হাতছাড়া করতেন না।  

ক্যাভিয়ার কেন এত দামি? কারণ এটা স্টার্জন মাছের ডিম। এই অতি দুর্লভ স্টার্জন মাছ পাওয়া যায় কাস্পিয়ান সাগরের দক্ষিণ অংশে, যেখানে দূষণের হার বেশ কম। সেই দুর্লভ মাছ পাওয়ামাত্র তার পেট চেপে ধরলেই হড়হড় করে ডিম পাওয়া যাবে এমন না। স্ত্রী স্টার্জন ডিম দিতে শুরু করে ২০ বছর বয়স থেকে। ততদিন পর্যন্ত তাকে সময় দিতে হবে। তারপর সেই মাছ ধরে আন, ডিম সংগ্রহ করো, প্রসেস করো, ডিস্ট্রিবিউশন করো—কত কাজ! কাজেই দামটাও চড়া। এরশাদ সাহেব চড়া মূল্য দিতেন, খেতেন। তার পয়সা, তার খুশি। পয়সা কোত্থেকে আসত, এইসব আবার জিজ্ঞেস করতে যাবেন না। 

তিনি আমও যে খেতেন, পত্রিকা ঘাঁটলে এই তথ্য পাওয়া যায়। তবে শখ করে খান নাকি শুধু ঠ্যাকায় পড়লে, এই তথ্য পত্রিকা দিতে পারেনি। ঘটনা হলো পার্টি অফিস থেকে বাসায় এসেছেন এরশাদ, সাথে দলীয় লোকজন কিছু। এরশাদ বারবারই বলছেন, এবার খেতে যাব আমি, কিন্তু ভেতর থেকে ডাক আর আসে না! একটু পর খবর এল ভেতর থেকে, রওশন এরশাদ কোনো কারণে রাগ করেছেন, আজকে ‘ভাত বন্ধ।’ আহা… এত মজা পাওয়ার কী হলো? আপনার ভাত বন্ধ হয় না? এহ, কোথাকার কোন উত্তম কুমার এসেছেন আপনি!  

যা হোক, স্বৈরাচার হলেও, এরশাদের ক্ষুধা তো দমাতে হবে। আম আনালেন, কেটে দিতে বললেন। নিজে খেলেন, উপস্থিত নেতা কর্মীদেরও সাধলেন। আর আমাদের দিয়ে গেলেন মেসেজ, হ্যাঁ, স্বৈরাচাররা ডিনারে আম খায়। অন্তত কিচেনে সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে ঠ্যাকায় পড়ে হলেও খায়। 

তার চিরবিদায়ের কিছুদিন আগে প্রকাশ পাওয়া একটা সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম পত্রিকার পাতায়। তিনি খুব সখেদে বলছিলেন, না, এইসব মাংস-টাংস খেতে আর ভালো লাগে না। কোথাও দাওয়াত পেলে আর খেতে ইচ্ছা করে না। বয়স যখন বেড়েছে, গুঁড়া মাছ, সবজি খেতেই ভালো লাগে। 

আমার চোখ চকচক করে উঠল। মাছের প্রসঙ্গ যখন এসেছে, সাংবাদিক নিশ্চয়ই ক্যাভিয়ারের কথা জানতে চাইবেন, এখন আগের মতো ভালো লাগে কিনা। নাহ, সাংবাদিক ওই লাইনেই আর থাকলেন না, চলে গেলেন পলিটিক্যাল প্রশ্নে। যত্তসব বেরসিক! 

বগুড়ার দই তার প্রিয় খাবারের একটা। কার? এরশাদের? উঁহু। হাসিনার? উঁহু। জেনারেল আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের। তা হতেই পারে, বগুড়া তো তারই ‘রাজত্বের’ অংশ তখন; নিজের ‘প্রজাদের’ তৈরি খাবার প্রিয় হবে না? কী তাজ্জব কথা! 

স্বৈরাচারদের শুধু প্রিয় খাবার না, খাদ্যাভিমানও থাকে, সেটা দেখিয়েছিলেন এই ইয়াহিয়া খান। উত্তাল ১৯৭১ সালের মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সেই ডাক বাঙালির মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মতো। ইয়াহিয়া খান দেখলেন অবস্থা সুবিধার না, আলোচনা করতে ঢাকায় এলেন তিনি। বসল বৈঠক, স্বাভাবিকভাবেই তাতে হোস্ট শেখ মুজিব, গেস্ট ইয়াহিয়া খান। অতিথির জন্য বাঙালির স্বভাবসুলভ ঔদার্য্যে নানা রকমের খাবারের আয়োজন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান খেলেন না সেসব কিছুই। যতটুকু খেলেন, সেটা না খাওয়ার মতোই। ঢাকার অস্থায়ী বাসভবন থেকে বাবুর্চির রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন তিনি, সেটাই খাবেন। খেলেনও তাই। আলোচনায় যেমন এক হওয়া যাচ্ছে না, খাবারেও একই দশা। কী একটা অবস্থা! 

এটা গেল ইয়াহিয়ার খাদ্যাভিমানের অংশ। এবার এর বেগতিক দশার কথা শোনাই। শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনে ততক্ষণে যোগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের বাঙালি পাচক নুরু মিয়া। ড. কামাল হোসেন ঘটনাটা বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন এইভাবে—‘জেনারেল পীরজাদা ফোন করে বললেন, দেখেন আপনারা বাঙালিরা তো অতিথিদের ব্যাপারে দুর্বল থাকেন। ইয়াহিয়া তো আপনাদের অতিথি হিসেবে এসেছে। তিনদিন ধরে কোনো রান্না হচ্ছে না। বাবুর্চিরা রান্না করবে না। তারা অসহযোগ করছে। আপনারা যদি একটু অনুমতি দেন তাহলে বাবুর্চিরা ওনার (প্রেসিডেন্টের) জন্য কিছু গরম খাবার তৈরি করতে পারে।’  

শেখ মুজিব অনুমতি দিলেন ডাল-রুটি রান্না করতে। সেটাই খেয়ে ইয়াহিয়া প্রাণধারণ করলেন। অবশ্য মাঝের দিনগুলোতে তিনি একেবারে না খেয়ে ছিলেন বলা যায় না। কফি আর বিস্কিট খেয়েছিলেন। বগুড়ার দই সম্ভবত তখন আর তার এত প্রিয় ছিল না! 

কফি ইয়াহিয়ার প্রিয় ছিল বোঝা গেল। এই খেয়েই কি তিনি নেশার ঝোঁক সামলাতেন? তাহলে তো হয়েছিলই! বলা হতো এঞ্জিনের মতো ধূম্র উদগীরণ করতেন তিনি। দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ তার ‘প্রাইভেট লাইফ অভ ইয়াহিয়া খান’ বইতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটা ঘটনা তুলে এনেছেন। ইয়াহিয়া খানের কিছু জেনারেল পাকিস্তানে একটা পার্টির আয়োজন করেছেন। খাবারের আয়োজন, পার্টির সাজসজ্জা দেখে বোঝার উপায় নেই যে দেশে একটা ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। তুমুল পার্টির একপর্যায়ে ইয়াহিয়া খান বেহেড মাতাল হলেন। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট ঠেসে ধরলেন একটা বেলুনের ওপর। ঠাস। ‘গেল গেল, জগজীবন রাম গেল’—হাসিতে প্রায় হাততালি দিয়ে উঠলেন প্রেসিডেন্ট। বলে রাখা ভালো, জগজীবন রাম ছিলেন সেসময়ের ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। যা হোক, ইয়াহিয়া সিগারেট চেপে ধরলেন আরেকটা বেলুনের ওপর—ঠাস। ‘এবার গেল ভুট্টো’। 

শেষ আরেকটা বেলুন ফাটালেন। কার নাম বললেন তা আর বলার দরকার নেই, পাঠক হিসেবে আপনি বুদ্ধিমান আমি জানি। তারপর বিখ্যাত গায়িকার হাত ধরে বেরিয়ে গেলেন। গায়িকার নাম জানতে চাইছেন? থাক থাক… স্বৈরাচারদের খানা-খাদ্য নিয়ে এই লেখা, তাদের প্রেম-মুহাব্বত নিয়ে এত কথার কী দরকার? 

তবে, স্বৈরাচারদের বিষাদ নিয়ে লেখা যেতে পারে। ইরানের সাংবাদিক আমির তাহেরি একাত্তরের সময়টা ইয়াহিয়াকে বেশ কাছে থেকে দেখেছেন। তার কথা অনুযায়ী, অন্তত আড়াই লিটার মদ ইয়াহিয়ার দৈনিক লাগতই। আর মদের প্রভাবটাও মাঝেমাঝে বোঝা যেত, যখন ইয়াহিয়ার ঘর থেকে বদ্ধ মাতালের হুঙ্কার আসত ভেসে—‘মুজিবকে এখান থেকে নিয়ে যাও, সোজা ফাঁসিতে নিয়ে ঝোলাও! এক্ষন ঝোলাও!’ 

‘ফাঁসিতে ঝোলাও’ আরেকজনও বলতেন, তবে সুযোগ পেলে। ভদ্রমহিলার নাম ডোনা র‍্যাচেল, পরিচয় তখন ফাস্টলেডি। তার পতিপ্রবর হলেন ইতালির কুখ্যাত ফ্যাসিস্ট মুসোলিনি। ডিনারের সময় হলে দুনিয়া উল্টে যাক, র‍্যাচেলকে পাঁচ সন্তান নিয়ে ডাইনিঙে উপস্থিত থাকতেই হবে। মুসোলিনি আসবেন, গম্ভীর মুখে সালাদ খাবেন। সালাদের ওপর ঢালা হবে অলিভ অয়েল, লেবুর রস আর মুঠো মুঠো রসুনের কুচি। সেই রসুন কুচির পরিমাণ এমন হবে যে বিরাট বোল উপচে পড়তে হবে। স্বৈরাচার সাহেবের একটু গ্যাসের সমস্যা, তাই তার ধারণা রসুন খেলে এই উপদ্রব থেকে মুক্তি পাবেন। র‍্যাচেলের কথা অনুযায়ী, ডিনারের পর মুসোলিনি ঘরে ঢুকলে মনে হতো বিশাল একটা রসুন তার যাবতীয় দুর্গন্ধ নিয়ে হাজির হয়েছে! কী আর করা, বাচ্চাদের বেডরুমে ঠাঁই নিতেন তিনি।  

‘পেটের ভুটভাট’ সারাতে আরেকটা টোটকাও নিয়মিত চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। সেটা হলো প্রতিদিন তিন লিটার দুধ খাওয়া। আমি ডাক্তার না, তবে মানবজীবন যাপনের অভিজ্ঞতা থেকে যেটা বুঝি, তিন লিটার দুধ দৈনিক খেলে গ্যাস্ট্রিকের রোগির পেটের আওয়াজটা ভুটভাট থেকে ধ্রুম-ধ্রাম হয়ে যাওয়ার কথা! বেচারা র‍্যাচেল, তাকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ! 

মজার ব্যাপার হলো, এই দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা যেন হিটলার না জানেন, সেজন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যেতেন মুসোলিনি। তার ধারণা ছিল, দুধ খাওয়ার মতো ভালো-ছেলে টাইপের একটা কাজ হিটলারের কাছে যথেষ্ট ‘ফ্যাসিস্ট-সুলভ’ মনে হবে না! 

এই যে, কান টানলে যেমন মাথা আসে, এক স্বৈরাচারের কথায় কথায় এসে পড়েছে আরেক স্বৈরাচার। কুখ্যাত হিটলার, যাকে স্বৈরাচারদেরও স্বৈরাচার বলে উপাধি দেওয়া হয়। কিন্তু তার খাদ্যাভ্যাস যেকোনো নিরীহ লোকের চেয়ে যেন মিনমিনে। সকালে উঠে লোকটা খাবে ওটসের সাথে ফলমূল, ভেষজ চা। কোনো কোনোদিন স্বাদ বদলাতে রুটির সাথে জ্যাম। 

মাংস? ছি ছি ছি… এইসব ‘বর্বর’ খাবার আর হিটলার? কখনও না! হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে স্কোয়াব খাওয়া যেতে পারে বটে, কিন্তু সেটা কেউ যেন না জানে! স্কোয়াবটা কী জিনিস? ওই যে চার সপ্তাহ বয়সী বাচ্চা কবুতরের মাংস হালকা একটু ভাজা ভাজা, একটু রোস্ট টাইপ। 

তাহলে স্বৈরাচার সাহেব খান কী? দুনিয়ার তাজা শাকসবজি, স্যুপ, পাস্তা, ভাত, সয়াবিন। সয়াবিন তো তিনি এমনভাবে খেতেন যে এর নামই বাজারে চাউর হওয়া শুরু করেছিল নাজি-বিন নামে। কেন এসব খেতেন হিটলার? কারণ তারও পেটের সমস্যা! মাছ-মাংস ‘হারাম’।  ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অমান্য করবে, এমন সাধ্য স্বৈরাচারেরও নেই। 

মদটা খেতেন হিটলার কালেভদ্রে, সেটাও শুধু বিয়ার আর ওয়াইন। বরং মিষ্টি খাবার মুখ তার। পেস্ট্রি, ক্যান্ডি—এসব পেলে ছাড়াছাড়ি নেই। চকলেট খাওয়া শুরু করে মিটিং পিছিয়ে দিয়েছেন এমন নজিরও আছে।  

এই যে নিরীহ খাবার-দাবার খেয়ে যাচ্ছে লোকটা, তার আগে প্রতিবেলায় কিন্তু ঘটত একটা নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া। আর সেটা যেত ১৫ জন তরুণীর একটা ফুড টেস্টিং টিমের ওপর দিয়ে। নামেই ফুড টেস্টার, আসলে তাদের মূল কাজ খাবারে বিষ আছে কিনা সেটা পরখ করা। হিটলারের সবসময় ভয় ছিল বৃটিশরা যেকোনো ভাবেই হোক তার খাবারে বিষ মেশাবে। 

তা ফুড টেস্টাররা কীভাবে বিষ পরখ করবে? খুব সরল ব্যাপারটা। ১৫ জনকেই হিটলারের জন্য প্রস্তুত করা খাবারটা খাওয়াও, ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিট অপেক্ষা করো। যদি ওরা না মরে, অসুস্থ না হয়ে পড়ে, ফ্যুয়েরারকে গিয়ে বল যে জাঁহাপনা, খাবার প্রস্তুত। আর ফুড টেস্টাররা মরলে বাবুর্চি যারা আছে ব্রাশফায়ার করে ফেলে দাও! 

এই ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জনকে জার্মানির পতনের পর গুলি করে মারে রাশিয়ান আর্মি। বেঁচে গিয়েছিল একজন—মার্গট ওয়ল্ক। হিটলার আত্মহত্যার আগেই পালিয়ে যাওয়ায় জানে বেঁচে যায় সে, তবে টানা ১৪ দিন সোভিয়েত আর্মির হাতে ধর্ষিত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি সারাজীবনের সঙ্গী হয়েছে তার। হিটলারের জন্য ফুড টেস্টিং নিয়ে ১৯১২ সালে মার্গটের দেওয়া জবানীর একটা অংশ শোনা যাক—কিছু মেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই খাবার খাওয়া শুরু করত। কারণ প্রচণ্ড মৃত্যুভয় নিয়ে আমাদের সব খাবার খেতে হতো। খাওয়ার পর আমরা অপেক্ষা করতাম কোনো প্রতিক্রিয়া হয় কিনা। যখন দেখতাম আমরা বেঁচে আছি, তখন সবাই কুকুরের মতো চিৎকার করে কাঁদতাম।

হিটলার নিরামিষ খেতেন, তবে টেবিলে অন্যান্য অফিসারদের জন্য মাছ-মাংস থাকত। অন্যদের হিটলার এগুলো খেতে না করতেন না, তবে কেউ খেলে মরা-খাদক বলে ঠাট্টা করতেও ছাড়তেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে হিটলার খেতেন শুধু ক্লিয়ার স্যুপ আর ম্যাশড পটেটো। তার প্রিয় অনুচর গ্যোয়েবলস প্রায়ই এটাসেটা বলে ডিনারের টেবিল থেকে সটকে পড়তেন। কাঁহাতক আর ‘শবাহারী’ খোঁটা শুনতে ভালো লাগে? আরেক পারিষদ বরম্যান অবশ্য এই দিক দিয়ে পাক্কা। দিব্বি হিটলারের সাথে স্যুপে চুমুক দিতেন, কচরমচর করে গাজর চিবাতেন; তারপর হিটলারকে ডিনারের জন্য অনেক ধন্যবাদ দিয়ে নিজের বাঙ্কারে ফিরে সাঁটাতেন পর্ক চপ, কাটলেট আর বাছুরের স্নিৎজেল!  

অলংকরণ: রাজিব কান্তি রায়

এইরকম মাংস চিবানোর ব্যাপারে কিঞ্চিৎ গুজব আছে উগান্ডার স্বৈরশাসক ইদি আমিনকে নিয়েও। এই মাংসটা নরমাংস। সাংবাদিক অনিতা সুরিউইচ ‘ডিক্টেটরস উইথ স্ট্রেঞ্জ ইটিং হ্যাবিটস’ নামের একটা ফিচার লিখতে গিয়ে ইদি আমিনকে ‘আপনি ক্যানিবাল কিনা’ প্রশ্ন করলে, উত্তর পেয়েছিলেন, আরে না, আমি নরমাংস খুব একটা পছন্দ করি না। এইরকম নোনতা নোনতা মাংস এত শখ করে খাওয়ার কী আছে? 

লোকটা রসিকতা করল নাকি? কে জানে! ডিক্টেটর মানুষ, অনিতা আর ডিটেইলসে জিজ্ঞেস করতে যাননি। 

স্বৈরাচারদের এমন খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করলে একটা মজার জিনিস পাওয়া যায়। তারা যতই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরা শুরু করে, খাবার নিয়ে খুঁতখুতানি তাদের ততই বেড়ে যায়। খাবারের ‘বিশুদ্ধতার’ দিকে এমনভাবে তারা কড়াকড়ি শুরু করে, যেন মানুষের জন্য না, আকাশের দেবতার জন্য খাদ্য প্রস্তুত করা হচ্ছে! এই যেমন কিম জং ইলের কথাই ধরা যাক। হ্যাঁ, উত্তর কোরিয়ার এখনকার সুপ্রিম লিডার কিম জং উনের বাবার কথাই হচ্ছে।  তিনিও ছিলেন সুপ্রিম লিডার। হিটলারের মতো ফুড টেস্টার হিসেবে তারও ছিল এক প্রমীলা বাহিনী। বিষ-টিষ আছে কিনা তা তো চেখে দেখতই, তার ওপর প্রতিটা ভাতের কণা সমান ও একই রঙের রয়েছে কি না, তা ভাল করে পরীক্ষা করতেন তারা। সুপ্রিম লিডারের খাবার বলে কথা, প্রতিটা ভাত যমজের মতো একরকম না হলে কি চলে? 

কোরিয়া থেকে আমাদের অঞ্চলে আবার একটু ফিরি। আসামের চা বেশ কড়া, দার্জিলিঙের চা বেশ সুগন্ধি। দুটার কম্বো করে কড়া লিকারের সুগন্ধি চা বানিয়ে কে খায় বলুন তো? মোদী? না। মমতা? না। যে খায়, তার নাম শেখ হাসিনা। 

জানি, আপনারা একেবারেই চমকে উঠছেন না। নিত্য-নতুন রেসিপি তো তিনি আর আজকে থেকে দিচ্ছেন না! এই জন্যই এদেশবাসী সময়ে সময়ে পায় মাংসের বদলে কাঁঠালের বার্গারের রেসিপি, মিষ্টি কুমড়ার বেগুনীর রেসিপি, পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি, মাছের কাঁটা গলিয়ে নরম করে গিলে খাওয়ার রেসিপি। এছাড়াও তার থেকে পাওয়া যায় শীতের দিনে ডিম সেদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেওয়ার টোটকা, টমেটোকে সান-ড্রাইড করার তরিকা। বলতেই হবে, বাংলাদেশের এই স্বৈরাচার রেসিপি তথা রান্নাকে ব্যবহার করেন কূটনীতির অংশ হিসেবে। তাই তাকে দেখা যায় জেলে থাকা অবস্থায় আরেক কারাবন্দী খালেদা জিয়াকে রান্না করে পাঠাতে, দিল্লীতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির বাড়িতে ভাপা ইলিশ রান্না করতে। সেসময় অবশ্য মমতাও প্রণবের বাড়িতে  গিয়েছিলেন হাসিনার সাথে দেখা করতে। হাসিনা মমতার জন্যও ইলিশ রেঁধেছিলেন। কিন্তু মমতা ‘অত তাড়াতাড়ি আমি রাতের খাবার মুখি তুলি না’ বলে কেন এড়ালেন, কে জানে! 

একইসাথে, খাওয়া-দাওয়ার মজলিশটাকেও হাসিনা পলিটিক্যাল কমিউনিকেশন ফিল্ড হিসেবে ভালোই ব্যবহার করেন। নির্বাচনী প্রচারে মিঠামইন যাওয়া হচ্ছে? ওকে, রাষ্ট্রপতির বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করা যাক। আমরা খবরে শুনি সেসময়ের রাষ্ট্রপতির পুত্র গম্ভীর গলায় বলছেন, ২০ পদের মাছ রান্না হবে, এরমাঝে শেখ হাসিনার পছন্দ রুই, পাবদা, চিতল। অষ্টগ্রামের পনির প্রায়ই গণভবনে যায়, এবারও যাবে। আর এখানে তো খাওয়ানো হবেই। 

আমরা শুনি, শ্বাস ফেলে ভাবি, এমনই তো মাটির মানুষ হওয়া উচিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর। বাংলার মাটি-বাংলার জলের মানুষ তো মাছই খাবে, পনির পেলে আদর করে কোলে তুলে নেবে। 

শেখ হাসিনা সভা করতে যাবেন রংপুরের পীরগঞ্জে। শ্বশুরবাড়িতে তার জন্য আয়োজন হচ্ছে রুটির সাথে ছোটো ছোটো পিস করা মুরগির মাংস, নানা পদের ভর্তা, অনেকরকম শাক, মাছের নানা আইটেম। এগুলো সবই তার প্রিয় খাবার। আমরা পত্রিকায় পড়ে আকুল হই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতার এগুলোই তো হওয়া উচিত পছন্দের খাবার! সে ভোট দিনের নাকি রাতের, তাতে কী আসে যায়! 

এক জনসভায় আয়োজন করা হয়েছে ৩২ পদের। শেখ হাসিনা আগ্রহ করে খেলেন দুই পদ—কালোজিরার ভর্তা আর টাকি মাছের ভর্তা। নেতাকর্মীরা আবেগে থরোথরো—বঙ্গবন্ধুর কন্যা তো মাছপাগল হবেই। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় আয়োজন করা হয়েছে কয়েক হাজার নেতাকর্মীর খাবারের। আয়োজন সামান্য—খাসীর মাংস, সবজি, ডাল, সেমাই, ভাত, পোলাও। প্রধানমন্ত্রী পোলাও খেলেন না, আর সব খেলেন। 

পরদিন পত্রিকায় ছাপা হলো, কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যাহ্নভোজের জন্য পোলাও, সাদা ভাত, খাসির মাংস, ডাল, সবজি ও সেমাই করা হয়েছে। তিনি পোলাও ছাড়া বাকি সকল খাবার খেয়েছেন। এর আগে কোনো রাষ্ট্রনায়ক এভাবে নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে খেয়েছেন কিনা আমাদের জানা নেই।

তিনি খাওয়াতে ভালোবাসেন, খাওয়া নিয়ে, খাওয়ার রেসিপি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন, পছন্দের খাবার খেতে ভালোবাসেন। এমনকি, ৫ আগস্টে যখন বহু মানুষ গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়ছিল, তখন তার জন্য গণভবনে মজার মজার খাবার তৈরি হচ্ছিল। সে খাবার কী হবে, সেটা তিনি নাকি সকালের চা খেতে খেতে বাবুর্চিকে বলে দিয়েছেন। মানুষ যে কী না… গণভবনে লংমার্চ করবি ভালো কথা,  লাঞ্চের পরে করা যায় না? সেই না খাওয়া খাবার হয়তো তাকে খেতে হয়েছে ভারতের মাটিতে গিয়ে, কে জানে! 

‘আপনি কী খান বলুন, আমি আপনাকে বলে দেব আপনি কে’—বলে গেছেন উনিশ শতকের ফরাসি প্রাবন্ধিক জ্যঁ আঁথেলমা ব্রিলা-সাভারিন। স্বৈরাচারদের খানাখাদ্য নিয়ে বিখ্যাত বই ডিক্টেটর ডিনারসের লেখক ভিক্টোরিয়া ক্লার্ক আর মেলিসা স্কট একে বাড়িয়েছেন আরও—‘আপনি কে, সেটা নির্ভর করে আপনি কী খাচ্ছেন, কীভাবে খাচ্ছেন, কার সাথে খাচ্ছেন তার ওপর। খাবার আপনার মনকে নিয়ন্ত্রণ তো করেই, তার সাথে আপনার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে পৃথিবী নিয়ে আপনার ধ্যান-ধারণাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।’  

আবার, ঠিক কোন খাবারটা খেলে যে আপনি স্বৈরাচারী হবেন, তার কোনো ঠিক নেই। বেশিরভাগ স্বৈরাচারীই খেয়ে গেছেন ঠিক তার অঞ্চলের প্রচলিত খাবারটা। তবে হেহে, অন্যান্য কাজের মতোই, খাবারের ব্যাপারেও তারা রেখে গেছেন স্বৈরাচারীতার লক্ষণ। যা তারা চান, যেভাবে চান, সেটাই হতে হবে। আর না হলে, তারা খাবেন তাদের আরও প্রিয় খাবারটা—কল্লা!   

রাজা যায়, রাজা আসে। হাতেগোনা কয়েকজন স্বৈরাচারীর নাম কিংবা খাদ্যাভ্যাস এখানে আনার চেষ্টা করা হলো মাত্র। যারা অন্তত এই অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত, বা কিছুটা হলেও প্রাসঙ্গিক। আরও আছে অজস্র স্বৈরাচার, ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পড়ে থেকে মানুষের অনর্গল ঘৃণাই সম্ভবত এখন তাদের একমাত্র খাদ্য। 

হিটলারের ঠিক বিপরীত কথা বলেই আজকের আলোচনা শেষ করা যাক—এমন একটা সময়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন হবে বলা কঠিন। তবে স্বৈরাচারদের একটা কথা বলতে পারি, পৃথিবীটা একদিন গণমানুষের হবে।

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।