আমাদের মূল্যবোধের মূল্য 

Alexander-Prescott-Couch-1440x960
আলেকজান্ডার প্রেসকট-কাউচ
দার্শনিক

হিউম্যান, অল টু হিউম্যান (১৮৭৮) গ্রন্থে ফ্রেডরিক নিৎশে লিখেছিলো ‘সকল দার্শনিকের ব্যর্থতার মূল উৎস হলো একটা জোরালো ইতিহাসবোধের ঘাটতি।’ দার্শনিকদের মধ্যে ইতিহাসবোধের ঘাটতি থাকার অভিযোগ নিৎশে তুলেছে, তা উনিশ শতকের কিছু চলতি প্রবণতারই প্রতিধ্বনি। আঠার শতককে যদি বলা হয় ‘দার্শনিক’ তবে তার তুলনায় উনিশ শতককে বলা চলে একটা ‘ঐতিহাসিক শতক।’ কেননা এই শতকে মানুষের যুক্তিবুদ্ধি বিষয়ক গভীর অনুসন্ধান পথ করে দিয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাক্রম কীভাবে ভাষা, সংস্কৃতি ও নৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখার।         

উনিশ শতককে আবার ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের শতকও’ বলা যায়। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব (Philology) হলো বিভিন্ন লিখিত নথির উৎস, তাদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ক গভীর অধ্যয়ন। আজকের দিনে এ শব্দটা বেশ সেকেলে মনে হয়। শুনলেই মনে হয় ধূলাজমা পুরানো বই মুখস্থ করে এসে কেউ উৎসকেন্দ্রিক খুঁতখুঁতে সমালোচনা করছে। কিন্তু উনিশ শতকের জার্মানিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে গণ্য হতো। তার প্রধান কারণ ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনের কারণে প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলি বোঝাপড়ায় আমাদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। ফলে উৎস চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, অনুমানভিত্তিক প্রকল্পগুলো নিরুৎসাহিত হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে আরো বিস্তৃত তুলনামূলক অধ্যয়নের সূত্রপাত ঘটে। এসব প্রকরণ ও পদ্ধতি ছিল মোটাদাগে বেশ পান্ডিত্যপূর্ণ, এমনকি কখনও কখনও পাণ্ডিত্যবাদীও ছিল। তবে এসবের প্রয়োগের সাংস্কৃতিক প্রভাব এতটাই জোরালো ছিল যে একাডেমিক জার্নালগুলো ছাড়াও তা গণচৈতন্যের অংশ হয়ে যাচ্ছিল।  


চলতি এই চিন্তাগুলোকে যুবক বয়সেই  নিৎশে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। নিৎশে ছিল সকল বিষয়ে পারদর্শী এক মেধাবী ছাত্র (তার দূর্বলতা ছিল শুধু অঙ্কে)। ফলে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল স্কুল্পফোর্টায়, যা মানবিক বিষয়গুলির জন্য জার্মানির সবচেয়ে সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। উঠতি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে এ  বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদী প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য বিশেষভাবে পড়ানো হতো। নিৎশে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় ভালোমত শিক্ষাগ্রহণ করেছিল, ভলতেয়ার ও সিসেরোর ঐতিহাসিক লেখাগুলো ভালোমত পড়েছিল। নিজে এরমানারিখের আখ্যান ও গ্রিক কবি থিয়োগনিসের উপর তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভও লিখেছে।    

তার এই ভাষাতাত্ত্বিক শিক্ষা কেবল দ্য বার্থ অফ ট্র‍্যাজেডি(১৮৭২) মত তার শুরুর দিককার রচনার উপরেই ছাপ রেখেছে তা নয়, নৈতিকতা ও নৈতিক মনস্তত্ত্বের উপর তার পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্যেও এর প্রভাব টের পাওয়া যায়। দার্শনিক দিক দিয়ে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি (১৮৮৭) বইটার গুরুত্ব ও তার দর্শনের ব্যুৎপত্তিগত পদ্ধতির স্বরূপ বুঝতে হলে তার এই তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক তালিমের বিষয়টি আমলে নিতেই হবে।   

অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি বেশ দুরূহ বই। নৈতিক দর্শনের ধ্রুপদী কিছু বিষয় মোকাবেলা করতে চেয়েছে এই বই। যেমন শুভ-অশুভের ধারণা, স্বাধীন ইচ্ছা, নৈতিক দায়-দায়িত্ব, অনুতাপ ইত্যাদি। তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে সে প্রচলিত দার্শনিক ধারায় অনুসন্ধান চালায়নি—উদাহরণস্বরূপ, যখন নিৎশে জিজ্ঞেস করে ‘কোনটা ভালো?’  বা ‘আমাদের কি স্বাধীন ইচ্ছা আছে?’ তখন সে খুব ঐতিহাসিক কায়দায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে, শুভ-অশুভ, সন্তাপ, স্বাধীন ইচ্ছার ধারণাগুলোর উদ্ভব কোথা থেকে হলো সে বিষয়ে আলোচনা করে।     

এ-জাতীয় ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তরে নিৎশে যা বলেছে তা, কমিয়ে বললেও, ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। অযথাই তো নিজেকে সে ডাইনামাইট বলে ডাকতো না। যেমন, নিৎশে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে সমকালীন পাশ্চাত্যে সাম্য ও মানবতার যত ধারণা আছে সবই এক প্রকার ‘দাস নৈতিকতা’ যার উদ্ভব হয়েছিলো যাজকবর্গের প্রতি হতাশা ও অসন্তোষ থেকে। এই দাস নৈতিকতা ছিল মূলত প্রভু নৈতিকতারই একটি প্রতিক্রিয়া। নিৎশের মতে ‘প্রভু নৈতিকতা’ হলো এমন কতগুলো নৈতিক উপাদান যা মহত্ত্ব, সুস্বাস্থ্য, সামাজিক স্তরের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করে। এই প্রভু নৈতিকতা ক্ষমতাকে মহিমান্বিত করে আর যাজকবর্গের ধর্মীয় নেতাদের ভীরুতা ও পুঁথিগত জ্ঞানকে খাটো করে দেখে। 

নিৎশের মতে, এই প্রভু নৈতিকতার প্রত্যুত্তরে ধর্মগুরুরা একটা নতুন মূল্যায়ন-কাঠামো (Evaluative Framework) উদ্ভাবন করে যাতে করে তারাই সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করে—এই কাঠামো অনুসারে আগ্রাসী মনোভাবকে খারাপ এবং ভীরুতা ও পরোপকারকে ভালো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা পুনর্মূল্যায়ন দাঁড় করালো। এই নৈতিক পূর্বানুমানগুলি পরে একসময় নিচুতলার দাসেরা আত্মস্থ করে নেয়। ফলে নিজেদের নিচু অবস্থানকেই তারা মহীয়ান করে তোলে, এবং নিজেদের অক্ষমতাকেই পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়। অর্থাৎ, নিৎশের নজরে, আমাদের মৌলিক নৈতিক অবস্থানের অনেকগুলোই আসলে জন্মেছে প্রাচীন অবস্থানগত লড়াইয়ের গর্ভ থেকে।           

নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনেক পাঠক যে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি তা হলো এইসব ঐতিহাসিক দাবির সাথে দার্শনিক প্রশ্নের সম্বন্ধটা ঠিক কী। নিৎশে উল্লেখ করেছিল যে তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘সকল মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়ন’, কিন্তু তার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক নজিরগুলো কীরকম অবদান রাখবে বা রাখতে পারবে তা অতটা স্পষ্ট না। ইতিহাসের দিকে নজর ফেরানোতে মনে হতে পারে নিৎশে কেবল নৈতিক দর্শনের বিষয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে। অনেকটা সেই পুরান প্রবাদের মত যা বলে যদি যা নিয়ে কথা হচ্ছে তা তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে আলাপের বিষয়ই বদলে ফেলো। কেননা যত যাই হোক, নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃতি, মূল্য ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর চাইতে সে মূল্যবোধের উদ্ভব কোথা থেকে হলো সেই প্রশ্ন ভীষণ আলাদা। নিৎশে যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে ইতিহাসের ব্যবহার করতে যায়, তাহলে মনে হতে পারে সে একটা ফ্যালাসির ব্যবহার করছে, যাকে বলে ‘ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসি’।’ কোনো কিছুর উৎসস্থল খারাপ প্রমাণ করা গেলেই যে বস্তুটা নিজেও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না। কোনো কিছুর উৎস বা অতীতের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বর্তমানে তার মূল্যায়ন করতে গেলে এই ফ্যালাসি হয়। যেমন ধরুন, আপনার এক বন্ধু হঠাৎ এসে বললো, আপনার বিয়ের আংটি পরবেন না কেননা আগেকার দিনে মহিলারা যাতে স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে না যেতে পারে সেজন্য গোড়ালিতে যে শেকল পরানো হতো তারই প্রতীক রূপে বিয়ের আংটি এখনো টিকে আছে। বিয়ের আংটির যদি এমন বাজে ইতিহাস থেকেও থাকে, সেই ইতিহাসের কারণে এটা প্রমাণিত হয় না যে এখন আর এটা পরা যাবে না। নিৎশে যখন খ্রিষ্টীয় নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে তাদের উৎসকাহিনী ধরে বিচার করার দাবি তোলে, তখন আমাদের সন্দেহ জাগতেই পারে সেও একই রকম কুযুক্তি অবলম্বন করছে কিনা।          

এই ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসির শিকার হওয়া নিয়ে যে দুশ্চিন্তা, তাতে নৈতিক দর্শনের ইতিহাসবোধের ঘাটতি আরো প্রকট হয়। কোনো কিছু উৎসগত দিক দিয়ে খারাপ তা প্রমাণ করা গেলেই সেই জিনিসটাও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না, এটা আগেই উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে। আবার আমাদের মূল্যবোধগুলোর মূল্যায়নের জন্য তাদের উৎস বিবেচনা করাও অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আমাদের নৈতিক বিশ্বাস ও চর্চার মূল্যায়নের জন্য শুধু তাদের পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো দেখলেই হয়ে যায়; সেসবে আমাদের বিশ্বাস করার মূল কার‍ণগুলো খতিয়ে না দেখলেও চলে। যেমন, সাম্যবাদের সমালোচনা করতে হলে আমাদের উচিত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে কীরকম আপত্তি উঠতে পারে সেগুলো বিবেচনায় আনা। যেমন, একটি পয়েন্ট হলো যে সাম্যবাদ সকল মানুষকে নিচের পর্যায়ে নেমে আসতে বলে, মানবের প্রতিভার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে বাধা দেয়, অথবা নৈতিক চিন্তার ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে না। এসব সমালোচনার কথা যখন কেউ মাথায় আনবে, তখন মনে হতে পারে এরকম সমালোচনার জন্য এই মূল্যবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখার তেমন কোনো দরকার নেই। যদি দাবিগুলো সত্য হয়, তাহলে তো ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করেই তো নৈতিক দর্শন চলতে পারে: নৈতিক দর্শনের লক্ষ্য যদি হয় আমাদের মূল্যবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়ন, আর তা করার ক্ষেত্রে যদি তাদের উৎসের কাহিনি জরুরি বা পর্যাপ্ত কোনোটাই না হয়, তবে নৈতিক দর্শনে এইসব উৎসের কাহিনি আদৌ প্রাসঙ্গিক না।  

নিৎশের কাছে এ ধরণের যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। যদিও তার সেই মনে হওয়ার ব্যাপারে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। তার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ব্যাপারে দুইরকম বোঝাপড়া রয়েছে: হয় সে মনে করতো ঐতিহাসিক বাস্তবতা কোনো নৈতিক ধারণার ন্যায্যতা বা কর্তৃত্বের প্রশ্নে সরাসরি প্রাসঙ্গিক, নয়তো সে মনে করতো যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা পরোক্ষভাবে হলেও এটা প্রমাণ করতে সাহায্য করে যে আমাদের নৈতিক অভ্যাস বহুলাংশে আমাদের অবদমিত অনুভূতি দ্বারা নির্ধারিত ও তা মানুষের মহৎ অর্জনের পথে বাধা। 

আমাদের মূল্যবোধের সাথে ইতিহাস কীভাবে সরাসরি জড়িত তা বুঝতে হলে, আমাদের আগেভাগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, বহু মানবিক অনুষঙ্গের মূল্যই নির্ভর করে তাদের ইতিহাসের উপর। পিকাসোর একটি চিত্রকর্ম তার নিখুঁত রেপ্লিকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান কেননা ওগুলো পিকাসোর নিজের হাতে আঁকা, কোনো অনুকারকের নয়। আপনার পারিবারিক স্মৃতিবাহী বিভিন্ন বস্তু আপনার মনে বিশেষ স্থান অধিকার করে রাখে কেননা তা আপনার পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের মূল্যবোধ সম্পর্কেও এটা সত্যি হতে পারে।      

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,  আমাদের মূল্যবোধের স্বর যদি হয় আদেশমূলক, তবে হয়তো ঐতিহাসিকভাবে সে মূল্যবোধ কর্তৃত্বের সাথে, মান্যতার সাথে জড়িত। বহু আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে আদেশদাতার কর্তৃত্বের উপর। এবং একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজক যারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে তাদেরকে তো ঠিক কর্তৃত্ববাদী নির্দেশদাতা বলে মনে হয় না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, কারো মনে হতে পারে যে নৈতিক আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে বিশুদ্ধ যুক্তি অথবা ঈশ্বরপ্রদত্ত বাণীর উপর। কিন্তু ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে যদি পাওয়া যায় যে এসবের উদ্ভব ভীষণ ইহলৌকিক, ‘মানবিক, খুবই মানবিক’ একটা উৎস থেকে, তবে ইতিহাস হয়তো তাদের কর্তৃত্বকে খাটো করে দেখতে পারে। যদি জানা যায় যে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের উদ্ভব হয়েছে আমাদেরই অবদমিত অনুভূতি থেকে, তবে আমাদের নজরে আজ তার মূল্য অনেকটাই খর্বিত হয়। একইভাবে, তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে যদি বাইবেলের ইহলৌকিক উৎসের ছাপ খুঁজে বের করা যায়, তাহলে বাইবেলের নৈতিক বাণীগুলো যে যীশু ও ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেনি তা প্রমাণিত হলে সেই বাণীগুলোর ওজন আমাদের কাছে কমে যায়।     

আরও একভাবে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সাথে তাদের ইতিহাস সরাসরি জড়িত। আমার কোনো এক নৈতিক বিশ্বাসে ফাটল ধরতে পারে যদি আমি জানতে পারি যে, যে প্রক্রিয়ায় আমি সেই বিশ্বাসটি গ্রহণ করেছিলাম সেটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ধরা যাক, আমি একটা গুজবে বিশ্বাস করি যে আমার দাদা গীর্জার দানবাক্স থেকে টাকা-পয়সা চুরি করতো, এবং এই তথ্য আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। কিন্তু তারপর আমি একদিন জানতে পারলাম যে আমার বাবা এই তথ্য পেয়েছিল আমার ভাইয়ের কাছ থেকে, যে কুখ্যাত মিথ্যুক এবং ধর্মীয় জোরজবরদস্তির উপর ভীষণ বিরক্ত। ফলে যেহেতু আমার এই বিশ্বাসটার সূত্র গিয়ে ঠেকেছে একটা অবিশ্বাসযোগ্য উৎসে, ফলে যৌক্তিকভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে আমার এই বিশ্বাসের কোনো ন্যায্যতা নেই। যদি নৈতিক বিশ্বাসগুলোর উৎস হয় অবদমিত অনুভূতি, তবে স্বাভাবিকভাবে তাদের ন্যায্যতার উপরেও প্রশ্ন চলে আসে। একইভাবে, হতে পারে আমাদের নৈতিক বিশ্বাস আমরা পেয়েছি আমাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে, তারা আবার সেই বিশ্বাসগুলো পেয়েছিল তাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে। এভাবে পিছনে যেতে যেতে মূল উৎস হিসেবে পাবো একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকদলকে। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকরা যদি নৈতিক সত্যের ভরসাযোগ্য কাণ্ডারি না হন, তবে তো আমাদেরকে বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া আমাদের শিক্ষা ও নৈতিক বিশ্বাসগুলোকেও অস্বীকার করতে হবে। ফলে নিৎশের ঐতিহাসিক গল্প আমাদের লালিত অনির্ভরযোগ্য বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার মত তথ্য হাজির করে এনে আমাদের ভ্রমগুলো ভেঙে দিতে পারে।   

নৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে দার্শনিকরা প্রায়ই ন্যায্যতার ও কর্তৃত্বের প্রশ্ন তোলেন। হতে পারে নিৎশে এমনই কিছু করতে চাইছিলেন। কিন্তু আমপাঠক ও ভাষ্যকাররা নিৎশের লেখার মর্ম হিসেবে যা ধরে এসেছেন তার সাথে এই পাঠ পুরোপুরি মেলে না। যেমন, স্নাতকের ছাত্ররা যখন এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের সাথে পরিচিত হয়, তখন তারা ধরে নেয় যে নিৎশের ইতিহাসপাঠ মোতাবেক সদ্গুণ, শুভবোধ ও ন্যায়ের ধারণার উৎস আমরা যতটা নির্দোষ বলে মনে করি ততটা না – বরং এই ধারণাগুলো কোনো-না-কোনোভাবে নীচ প্রতিশোধস্পৃহা, আত্মম্ভরিতা এবং ক্ষমতাবান ও উচ্চকোটির লোকেদের প্রতি অবজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। তবে এখানে যাজক, যোদ্ধা ও দাসেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে নিৎশে যে 

দাবিগুলো উত্থাপন করছেন সেটাই বেশি মনোযোগের দাবি করে, সেই সত্তাগুলো কেউ যে ঐশী কর্তৃত্বধারী বা নির্ভরযোগ্য নয় সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।   

মূল্যবোধের উপর নিৎশের পর্যালোচনায় এসব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য কীরকম ভূমিকা পালন করে? হয়তো নিৎশে ধরে নিচ্ছে যে নৈতিক ধ্যানধারণাগুলোর উৎস যদি হয় অবদমিত অনুভূতি, তাহলে তাতে সরাসরি সেই মূল্যবোধগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি যদি এখন আর সেসব ধারণা পোষণকারীরা একই উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত নাও হয়। কিন্তু নিৎশের এমন কোনো পূর্বানুমান রাখার প্রয়োজনও নেই। খুব সম্ভবত নিজের ঐতিহাসিক আখ্যানটা নিৎশে আরো পরোক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক মনে করে, বর্তমান সমাজেও একইরকম মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধির প্রমাণ হিসেবে। এই দিক দিয়ে দেখলে, নৈতিকতার পর্যালোচনার জন্য ব্যুৎপত্তিগত অধ্যয়ন এজন্যেও প্রাসঙ্গিক যে তা প্রমাণ করে যে আমাদের সমকালীন নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যেও আপত্তিকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো ঐতিহাসিক কিছু না, যেমন উদ্দেশ্যের অসততা।  

গৃহীত অনেক নৈতিক ধ্যান-ধারণার উদ্দেশ্য যে প্রশ্নবিদ্ধ সেটা মানুষকে খাওয়ানো কঠিন কিছু না। বিশেষত আধুনিক ইন্টারনেট সংস্কৃতির কল্যাণে তা আরো সহজ। সে ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণের জন্য এত ইতিহাস ঘাটানোর দরকারটা কী তাও ভাবা যেতে পারে। এর পিছনে দুইটা কারণ আছে। প্রথমত, নিৎশের ইতিহাসপাঠের মাধ্যমে আমাদের সামনে এইসব মিথস্ক্রিয়া খুবই সরল ও অনাবৃত রূপে হাজির হয়। বর্তমান নৈতিকতার ধারণায় অনেক জটিলতা ও ব্যাখ্যা হাজির আছে। যদি একবার অতীতের দিকে ঘুরে তাকাই, তাহলে এমন অনেক মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধি আমাদের নজরে পড়বে যা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। নিৎশের পাঠে, ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয়েছে বর্তমানের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য।  

দ্বিতীয়ত, অতীতের ঘটনাবলি নিরীক্ষণে আমাদের ব্যক্তিগত ও অনুভূতিগত সংশ্লিষ্টতা কম থাকে, ফলে অতীতের ব্যাপারে আরো নির্মোহ ও বাস্তবিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা সহজ হয়। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলো উদ্দেশ্যগতভাবে যে অবদমিত অনুভূতি দ্বারা চালিত তা ভেবে হয়তো আমাদের ভীষণ রাগ উঠবে, কিন্তু সময়ের দিক দিয়ে যারা এখন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে তাদের মধ্যে এই প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করা আমাদের জন্য আরো সহজ, এবং তারই জের ধরে নিজেদের মধ্যেও সেই প্রবণতাগুলো আমরা চিনতে পারি। একটা জোরালো ইতিহাসবোধ আমাদেরকে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখার হাত থেকে রক্ষা করে।  

এই বিষয়গুলো নিৎশের চিন্তাকাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা তুলে ধরে। কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে নিৎশে যেভাবে ইতিহাসকে ব্যবহার করেছে সেভাবে গ্রহণ করার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইতিহাসের এমন ব্যাখ্যা অতীতকে কেবল বর্তমানের একটা সরলীকৃত সংস্করণ হিসেবে দেখে, বর্তমান সমাজের থেকে যার পার্থক্যগুলো অত গুরুত্বপূর্ণ না। ফলে, এই ইতিহাসবাদের নজরে আমাদের সামাজিক অভ্যাসের জন্য ইতিহাসে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক ও পরিবর্তন হয়েছিল সেগুলোকে উপেক্ষা করে। নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত হিসাব-নিকাশই যদি পুরো গল্পটা হতো, তাহলে মনে হতে পারতো যে খোদ নিৎশের ইতিহাসবোধেই ঘাটতি আছে। এসব ইতিহাসবাদী পূর্বানুমানকে নিৎশের ব্যুৎপত্তিগত বোঝাপড়া কীভাবে গ্রহণ করে তা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে নিৎশের নিজের এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের ব্যুৎপত্তির দিকে। অর্থাৎ, আমাদের ফিরে যেতে হবে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জায়গায়।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি রায়


নিৎশের সময়ে তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিকদের মূল আগ্রহের জায়গা ছিল প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলো কতটা জটিল কাঠামোর অংশ, এবং বহুবিধ পরস্পরবিরোধী উৎস থেকে নানানরকমের উপাদান একসাথে এইসব গ্রন্থে এসে মেশে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা। যেমন, জুলিয়াস ওয়েলহাউসেন যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে হিব্রু ভাষার বাইবেল, পেন্টাটিউখ একটা মানব-নির্মিত গ্রন্থ এবং একে ভাঙলে চার রকমের স্বতন্ত্র উৎস হতে প্রাপ্ত গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায়। আর এর প্রতিটিরই উদ্ভব হয়েছে মোজেসের আমলের অনেক পরে (কিন্তু মনে করা হতো মোজেসই সে বাইবেলের একমাত্র রচয়িতা, ঈশ্বরের গোস্টরাইটার)। এই উৎসগত পর্যালোচনার কল্যাণে আমরা এখন হিব্রু বাইবেলকে একটা একক গ্রন্থ হিসেবে দেখার বদলে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান ও ইতিহাসের একটি সংকলন হিসেবে দেখতে পারি। এই তথ্যটি পাওয়ার কারণে এখন আমরা বাইবেলকে একটা অখণ্ড ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখতে নিরুৎসাহিত হই। ফলে বাইবেলের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক নজরটা একটু সরিয়ে রাখতে পারি।    

 

কিশোর বয়সেই স্কুল্পফোর্টায় পড়ার কল্যাণে নিৎশে প্রাচীন গ্রন্থগুলোর প্রতি এই উদার ভাষাতাত্ত্বিক পন্থার সাথে পরিচিত ছিল। যেমন, তার শিক্ষক ফ্রেডরিখ অগাস্ট কোবেরস্টাইন (যে নিজেও একজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ) তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল চতুর্থ শতকের অস্ত্রোগথ রাজা এরমানারিখের ব্যাপারে একটা কবিতার উপর গবেষণা করার। কবিতাটা অত্যন্ত গোলমেলে, কেননা কিছু অংশে এরমানারিখকে একজন মহান বীর হিসেবে দেখানো হয়, আবার অপর কিছু অংশে তাকে দেখানো একজন ভীতু হিসেবে যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছে। পাঠকের এরমানারিখের ব্যাপারে কী ভাবা উচিত তা ঠিক স্পষ্ট না। একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে নিৎশে দেখিয়েছিল যে কবিতাটার মধ্যকার এই স্ববিরোধের কারণ হলো এই কবিতার কোনো একক রচয়িতা নেই, বরং নানান উৎস থেকে এই কবিতার উদ্ভব হয়েছে। নিকট প্রাচ্য, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ব্রিটেনের নানান অংশ থেকে আসা বহু বিভিন্ন অনুষঙ্গ মিশে তৈরি হয়েছে বহু স্তরপূর্ণ এই কবিতাটি।

বিভিন্ন গ্রন্থের প্রতি এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সমকালীন নীতিবোধের ব্যাপারে নিৎশের চিন্তাকে মদদ জুগিয়েছে। জিনিওলজি গ্রন্থের মুখবন্ধে নিৎশে নীতিবোধকে বলেছে ‘দীর্ঘ, অর্থোদ্ধারে জটিল এক চিত্রিলিপিতে লেখা’। আমাদের বর্তমান নৈতিক মূল্যবোধগুলিতে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে দৃশ্যত কিছু মৃদু বিরোধ আছে। যেমন অনেকেই মনে করে মানুষের চমৎকার কোনো অর্জনের বিনিময়ে বিশেষ কিছু প্রতিদান ও সম্মান তার প্রাপ্য, এবং একইসাথে মানুষ মনে করে কেবল কোনো বড় অর্জনের বিনিময়েই মানুষের বিশেষ প্রতিদান পাওয়া উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বড় অর্জনগুলো আসে কিছু সহজাত প্রতিভার কারণে যা সেই ব্যক্তির অর্জন করতে হয়নি। ফলে এই চিন্তার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। নৈতিক দর্শনের একটা প্রধান কাজই হলো আমাদের স্বজ্ঞালব্ধ এইসব ধারণার মধ্যকার স্ববিরোধগুলো খুঁজে বের করে তার নিষ্পত্তির পথ বের করা। ধর্মতাত্ত্বিকদের বাইবেল পাঠের একটা অংশ যেমন বাইবেলের মধ্যকার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ধর্মতাত্ত্বিক দাবিগুলোকে শনাক্ত করা, তাদের মধ্যকার বিরোধগুলো বের করা ও তা সমাধানের চেষ্টা করা।        

তবে নিৎশের ধর্মতাত্ত্বিক নজর একটু আলাদা। ওয়েলহাউসেন হিব্রু বাইবেলের যেরকম ঐতিহাসিক পাঠ হাজির করেছিল, একইভাবে নিৎশে আমাদের নৈতিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশের নানান ভিন্ন উৎস তদন্ত করে বের করতে চেয়েছিল। এর শুদ্ধতাবাদী অংশগুলো আসে যোদ্ধাদের কাছ থেকে, সাম্যবাদের বাণীগুলো আসে যাজকবর্গ ও দাসবর্গের কাছ থেকে, এবং আমাদের নৈতিক কাঠামোর আরো যেসব অংশ আছে – যেমন পূর্বজদের প্রতি শ্রদ্ধা – সেগুলোরও আলাদা উৎস আছে। এমন না যে এখানে অনেকগুলো ভিন্ন ধারা এসে একসাথে মিশেছে, বরং আমাদের হাতে আছে একটা বিধানলিপি, সময়ের সাথে সাথে যার বহুবার পুনর্লিখন ও পুনর্ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে। আর প্রতিবার এ পুনর্লিখনগুলো ঘটেছে বহুবিধ জটিল ও স্ববিরোধী উদ্দেশ্যে। নৈতিকতার প্রতি এই ভাষাতাত্ত্বিক নজর একে একই মূল্যায়ন-কাঠামোর চেয়ে একটা জটিল সন্নিবেশ হিসেবে দেখতে সাহায্য করে।  

প্রথাগত নৈতিক দর্শনের কাঠামোর চেয়ে এটা ভিন্ন কেননা এই ধারায় ‘ন্যায় কী?’ –এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো একক অখণ্ড উত্তর খোঁজা হয় না, অন্তত যদি এর উত্তরটার আরো অনেক স্বজ্ঞাগত ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। বরং, আমাদের নীতিবোধের মধ্যে কত ধরণের ভিন্ন ধারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, দেখানো হয় যে এর কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়তো সম্ভব না। বাইবেলকে একটা বৈজ্ঞানিক ভাষাতাত্ত্বিক নজর দিয়ে দেখতে গেলে যেমন খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক পূর্বানুমানগুলিকে উপেক্ষা করে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, কেননা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মধ্যে যে একটা একক ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারেই এরা একমত হবে না। একইভাবে আমাদের নৈতিক কাঠামোকেও যখন ভাষাতত্ত্বের জায়গা থেকে দেখলে নৈতিকতার কোনো একক ধারা যেটা আমাদের সকল নৈতিক আচার ও বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দান করবে এমন কিছুতে বিশ্বাস রাখা সম্ভব হবে না। ঐতিহাসিকের নজরে দেখলে নৈতিক দর্শনের একটা বড় অংশকে মনে হবে অমীমাংসিতব্যের মীমাংসা করার একটা কাচুমাচু ব্যর্থ প্রয়াস। প্রভু ও দাসেদের মধ্যে এর চেয়ে বড় আপস আর হয় না।                                                       

এখন নিৎশের এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি শুধু দার্শনিক পদ্ধতিতেই প্রাসঙ্গিক হতো, তাহলে বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কের বাইরে এ ব্যাপারে কারো তেমন কোনো আগ্রহ থাকার কথা না। কিন্তু নৈতিকতার প্রতি তার এই নজর শুধু সমকালীন নৈতিক দর্শনের সমস্যাই তুলে ধরে না, আরো একটি সমস্যাও তুলে ধরে। কেননা আমাদের নীতিবোধ যে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন উৎস হতে আসে সেটাই একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। এর মানে হলো আমাদের আচরণে ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতা ধরে রাখা অনেক কঠিন, এবং কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অসংখ্য বিরোধী মতগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোনো উপায়ই নেই। অর্থাৎ আমরা নিজেদেরকে বিচার করি বেশকিছু স্ববিরোধী মানদণ্ডের নিরিখে; আবার সেই মানদণ্ডগুলো পুরোপুরি মেনে চলাও আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এটা আমাদেরকে নিজেদেরই বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের ধ্যান-ধারণার মধ্যকার এইসব স্ববিরোধ ও বিচ্ছিন্নতাকে নিৎশে এক প্রকার ব্যাধি হিসেবে দেখতো, এবং তার মতে গোটা আধুনিক সমাজটাই ব্যাধিগ্রস্ত।   
 

ভাষাতত্ত্বের হাতিয়ারগুলো কীভাবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা দেখতে পেলে আরো সহজে বোঝা যাবে আমাদের সমকালীন সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিসরেও এর প্রাসঙ্গিকতা কীরকম। যেসব নিয়ম-নীতি আমাদের সামাজিক পরিচয়ের কাঠামোকে বলবৎ রেখেছে সেগুলোর ইতিহাস ঘেটে দেখলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে প্রাত্যহিক জীবনে লুকিয়ে থাকা নানা ধরণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের লৈঙ্গিক ভূমিকার ব্যাপারে যেসব নিয়ম প্রচলিত আছে তার ইতিহাস তদন্ত করে দেখলে আমরা তার সাথে লিঙ্গের বর্তমান ধারণার মধ্যে বিভিন্ন বিরোধ খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন আপনি যদি একজন নারী হন, তবে আপনার একইসাথে ঘরের লক্ষ্মী ও গার্লবস হতে হবে। আবার আপনি যদি পুরুষ হন তবে আপনার একইসাথে আলফা মেইল হতে হবে আবার টক্সিক পুরুষও হওয়া যাবে না। যারা এসব পরিচয় অবলম্বন করতে চান তাদের মধ্যে এই বিরোধগুলো একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। আর এই দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারলে এসব বিরোধী ধারণাগুলোর সমন্বয় সাধন করার ব্যর্থ ও বিরক্তিকর প্রয়াস থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাতে পারব।      

অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ও স্ববিরোধ মানেই যে নেতিবাচক তা কিন্তু না। নিৎশে বুঝতে পেরেছিল যে ইতিবাচক বিরোধও হতে পারে। পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে তাত্ত্বিকেরা এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে তারা এর মুক্তিকামী সম্ভাবনার দিকে বিশেষ জোর দিয়েছে। যেমন, জাতীয় ইতিহাসকে এই রকম বহুমুখী উৎস থেকে বোঝার প্রয়াস সংস্কৃতি সম্ভারের বৈচিত্র্যকে বুঝতে, মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে, এবং সাংস্কৃতিক এককেন্দ্রিকতার সাধারণীকরণকেও টেক্কা দেয়। ‘একতা’ সকল ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কিছু না।    

একটু পিছিয়ে দেখলে, নিৎশের ব্যাপারে যে ব্যাপারটা বুঝতে একটু কষ্ট হয় তা হলো তার মত স্বঘোষিত ‘ভবিষ্যতের দার্শনিক’ কেন অতীত নিয়ে এত আগ্রহী। নিৎশের ইতিহাসবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখলেই এর উত্তর খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। যথেষ্ট গভীরভাবে ভাষাতত্ত্বকে অবলম্বন করা গেলে তা কেবল অতীত বিচরণেই সাহায্য করে না, বরং সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণেও ভূমিকা রাখে।  

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।