যেভাবে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন একজন সফল স্বৈরাচারী

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক


কে না চায় মনে মনে স্বৈরাচারী হতে? দেশজুড়ে নিজের জয়জয়কার, পাবলিকের টাকায় বাড়ি-গাড়ি, অপছন্দের লোকজনকে হাপিশ করে দেয়া—আহা! কে না চায়? 

কিন্তু দুঃসংবাদ হলো এই চাওয়া এ যুগের সঙ্গে একটু বেমানান। মানুষজন ইদানিং বেশিই সেন্সিটিভ। মানবাধিকারে একটু টোকা পড়লেই ছ্যাঁত করে ওঠে। তাদেরকে নাকি গুম করা যাবে না, তাদের টাকায় বিদেশে বাড়ি করা যাবে না, বিচারব্যবস্থা স্বচ্ছ রাখতে হবে। শখ কত! আহা, ‘কোথায় হারিয়ে গেল সোনালি বিকেলগুলো সেই’  যখন একজন স্বৈরাচারী শান্তিতে পুরা দেশটাকে নিজের বাপের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি ও দেশের জনগণকে নিজের দাসানুদাসের মত ব্যবহার করতে পারতো? প্যারা নাই, এখনো আছে সেই দিন। শুধু আরেকটু কৌশলী হতে হবে আরকি। স্বৈরাচারকে চিনির প্রলেপ দিয়ে খাওয়াতে হবে মানুষকে। সেটি কীভাবে করবেন? আপনার জন্যই এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো একজন সফল স্বৈরাচারী হওয়ার কলাকৌশল। 

ক্ষমতায় আসবেন কীভাবে?    

স্বৈরাচারী হওয়ার মানে হলো খাদ্যশৃঙ্খলের সবচেয়ে উপরে অবস্থান করা। ক্ষমতার আদ্যপান্ত আপনাতেই শুরু এবং শেষ। আপনি হয়তো ভাবছেন কঠোর পরিশ্রম ও একান্ত নিষ্ঠার মাধ্যমেই সে পর্যায়ে পৌঁছনো সম্ভব। কিন্তু, না। জীবন একটা পাতানো খেলা। এ খেলায় নিয়ম হলো শুরুতেই জিতে বসে থাকতে হবে। সুতরাং, সবচেয়ে ভালো হয় যদি ক্ষমতা বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। অথবা ধরুন বাপ যদি হয় দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের একজন নায়ক, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! তখন তো দেশের উপর আপনার হক স্বাভাবিকভাবেই সবচেয়ে বেশি; জনগণ-টনগণ পরে।  অবশ্য আপনি দুর্ভাগা হলে, অন্য উপায় খুঁজতে হবে। ঢুকে পড়ুন কোনো একটি রাজনৈতিক দলে। ঝোপ বুঝে কোপ মারুন ও ধীরে ধীরে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে শীর্ষে উঠে যান এবং হাসিল করুন নিজের উদ্দেশ্য। স্বৈরাচারীদের ওস্তাদ অ্যাডলফ হিটলার কিন্তু ১৯১৯ সালে জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টিতে ঢোকেন। একবার এক সভায় দলপ্রধানের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে নিজের বাগ্মিতার প্রমাণ দেন হিটলার ভরা মজলিসে। এরপর থেকে আস্তে আস্তে এই দলকে পরিণত করেন নাৎসি পার্টিতে। হিটলারের কাছ থেকে অনেককিছু শেখার আছে আপনার। আরো ভালো হয়, যদি কোনোভাবে একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারেন। তাহলে সেটা আপনার ভবিষ্যতের সকল স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করতে সাহায্য করবে, আবার আন্তর্জাতিক মহল থেকেও চাপ খাবেন কম। আর একবার ক্ষমতায় চলে আসার পর পরবর্তী নির্বাচনসমূহ হাতিয়ে নেয়া কঠিন কিছু না। তা না হলে, জনগণের কোনো বিপ্লবকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগান, হাইজ্যাক করে নিন। সেটাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় চলে আসুন। আলা বাদিউর ‘বিবাহ যেভাবে প্রতিবার প্রেমের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, একটা রাষ্ট্রও প্রতিবার যেই আদর্শিক আন্দোলনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সাথে প্রতারণা করে’-এই উক্তিটাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিন। গুডলাক। 

আপনিই সর্বেসর্বা!

মনে রাখবেন, আপনিই সব। ত্রাতা, দাতা, নবাবজাদা সবই আপনি। দেশ ও জাতির সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু যেন আপনিই হন। তা না হলে আপনার স্বপ্নের সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্র কায়েম হবে না। আগেকার দিনে তো শাসককে খোদ ঈশ্বরের বংশধর বলে মেনে নেয়াই হতো। এখন আর সেই সুবর্ণ দিন নাই। ফলে এখন আপনারই নিজ দায়িত্বে মানুষকে বোঝাতে হবে যে আপনিই তাদের অধীশ্বর; গড়ে তুলতে হবে নিজের কাল্ট অফ পার্সোনালিটি। এর জন্য প্রথমেই নিজেকে কোনো এক আদর্শ বা চেতনার সাথে একাত্ম করে ফেলতে হবে, যাতে আপনার বিরুদ্ধে যাওয়া মানেই সেই আদর্শের বিরুদ্ধে যাওয়া বলে সাব্যস্ত করা যায়। 

আপনি আর ব্যক্তি থাকবেন না, নিজেই হয়ে উঠবেন সেই চেতনার মূর্তরূপ। তারপর, সম্ভব হলে নিজের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে জাতির কোনো পুরানো হিরোর। অগাস্টাস সিজার যেমন নিজের পালক-পিতা জুলিয়াসের খ্যাতি বেচে নিজের উত্থান নিশ্চিত করেছিল। এই সহজ কৌশলটা এখনো কার্যকর। বিশেষ করে সেই হিরো যদি হয় আপনারই বাপ-মা বা স্বামী, তাহলে তো আরো ভালো। এরপর শুরু করবেন আসল কাজ। সকল নোটে আপনার, বা আপনার সেই বাপ-দাদার ছবি থাকতে হবে। রাস্তাঘাটে, প্রতিটা চত্বরে, ময়দানে থাকবে ভাস্কর্য, সকল অফিস-আদালতে আপনাদের ছবি টাঙিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক হবে। পদে পদে জনতাকে মনে করিয়ে দিতে হবে দেশটা কার। এবং আপনি যে সর্বগুণে গুণান্বিত তা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য মোসাহেবরা যেন আপনার নামের আগে কয়েকশ বিশেষণ যোগ করে নেয় তা অবশ্যই নিশ্চিত করবেন। কিম ইল সুং পরিচিত ছিলেন ‘দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, চিরজয়ী সেনাপতি , ‘মহান সূর্য ও মহৎ মানব’, ‘মহান নেতা’, ‘মহান পিতা’, ‘জাতির সূর্য, ‘দূরদর্শী, ‘জাতির বিবেকের পরাকাষ্ঠা’, ‘অদ্বিতীয় দেশপ্রেমিক’, ‘জাতীয় বীর’, ‘আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম পথপ্রদর্শক’ ইত্যাদি অভিধায়। আমাদের দেশেও এমন নজির বিরল নয়। তবে মানুষ অবশ্যই জানবে আপনি এসব চান না। এসব আপনার ভক্তকূল তথা দেশের জনগণই চায়, কারণ তারা আপনাকে ভালোবাসে। তুর্কমেনিস্তানের সাপারমুরাত নিয়াযভের মত আপনাকে বলতে হবে, ‘রাস্তাঘাটে নিজের ছবি ও ভাস্কর্য দেখতে আমার ভালো লাগে না, কিন্তু জনগণ তাই চায়।’  


ভ্রম বজায় রাখুন 

যেমনটা বললাম, মানুষ এখন আর স্বৈরাচারের কদর করে না। গণতন্ত্রে কি এক মধু যেন পেয়ে গেছে তারা! ফলে আপনার স্বৈরাচারটাকে পাতলা ঘোমটার আড়ালে রাখা গেলেই ভালো। দেশে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার ভ্রমটুকু অন্তত বজায় রাখতে হবে। তাই বলে লাগাম ছেড়ে দেয়া যাবে না। কেউ বাকস্বাধীনতার নামে আপনার আসনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বসবে, বা বাজেট নিয়ে সমালোচনা করবে তা তো হতে পারে না। বাকস্বাধীনতা মানে তো স্বৈরাচারানুভূতিতে আঘাত দেয়া নয়, তাইনা? এমন কোথাও হতে দেখলে তা দমন করা আপনার দায়িত্ব। কিন্তু তাই বলে যেন দেশে নীরবতা বিরাজ না করে তাও খেয়াল রাখবেন। স্লাভোয় জিজেকের একটা টোটকা মনে রাখবেন:  ‘স্তালিনের আমলে যদি কেউ জনসমক্ষে স্তালিনের সাথে দ্বিমত করে বসে, আর দ্বিতীয় কেউ যদি চিৎকার করে উঠে তাকে থামিয়ে দেয়, তাহলে প্রথমজনের আগে গুম হবেন দ্বিতীয়জন। কেননা সে বাকস্বাধীনতার যে ভুয়া পর্দা, তাতে আঘাত হেনেছে।’ 

স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভয় জিজেক

বাকস্বাধীনতা না থাকলেও তার ভ্রম বজায় থাকতে হবে সর্বদা। নীরবতা হতে পারে উস্কানিমূলক, জায়গা তৈরি করে দিতে পারে আরো ভয়াবহ সব প্রশ্ন ও সন্দেহের। তাই বাকোয়াজি কোলাহল দিয়ে ভরে রাখবেন মানুষের মন। ইন্টারনেটের কল্যাণে তা এমনিতেও খুব সহজ। এখানে সবকিছুই হাজির হয় ‘ইস্যু’ আকারে। তুচ্ছ থেকে বিরাট সকল ঘটনার ব্যাপারে সমান গুরুত্ব দিয়ে মতামত দাঁড় করানোর প্রয়োজন বোধ করবে লোকে। পেপারে ছাপতে থাকুন নায়িকাদের প্রিয় ফলের খবর, টিভি টকশোতে যেন তুমুল তর্ক চলতে থাকে অপ্রাসঙ্গিক সব বিষয়ে। উমবের্তো একো’র মতে, সেন্সরশিপের ক্ষেত্রে আপনার দায়িত্ব মানুষের কথাকে নীরব করেই দেয়াই না, বরং তাকে অহেতুক কোলাহল দিয়ে প্রতিস্থাপিত করাও।   

ইতালিয়ান লেখক ও দার্শনিক উমবের্তো একো

  
কিছু বিষয়ে ছাড় দিতে হবে, এমনকি সহযোগিতাও করতে হবে। আসল বিষয়গুলিতে কেউ হাত না দিলেই হলো। আশা করা যায় এই খর্বিত স্বাধীনতা উপভোগ করতে করতে একসময় মানুষ ভুলে যাবে আদতে স্বাধীনতা কী। জনগণ জানবে তারাই ক্ষমতায়। মাঝে-মাঝে বলবেন, ‘আপনারা না চাইলে আমি আর নেতৃত্বে থাকব না।’  ইকুয়েটরিয়াল নিউ গিনি’র তিওডোরো ওবিয়াং নগুয়েমা টানা ৩২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ঘোষণা দিলেন, ‘যেদিন আপনারা আমার উপর বিরক্ত হয়ে যাবেন, সেদিন আমি পদত্যাগ করে চলে যাব।’ এতদিনে বোধহয় ওই দেশের লোকেরা বিরক্ত হতেও ভুলে গেছিল। গণতন্ত্র কী? স্রেফ একটা শব্দই তো। তাকে নিজের মত সংজ্ঞায়িত করে নেয়াই যায়। 

    
বিদ্রোহ দমন

সাবধান হন। ন্যূনতম বিরোধীস্বরকেও হাল্কা করে নেবেন না। অবাধ্যতা সংক্রামক। আজকে যে ১০-১২জন ছোকড়া রাস্তার এক চিপায় কয়েকটা ব্যানার-পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কালকেই দেখা যাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে সংখ্যা বাড়তে বাড়তে শত, তারপর হাজার, এমনকি লাখ  ছাড়িয়েছে। ফলে এইসব বিদ্রোহের বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার আগেই নষ্ট করা দরকার। আরো ভালো হয় যদি সেই বীজ রোপনই না করা যায়, সে ব্যবস্থা করা। মানুষে-মানুষে স্বাভাবিক সংযোগ ও সম্পর্ক কঠিন করে তুলতে হবে। মাঠ, পার্ক, লাইব্রেরি ইত্যাদি গায়েব করে ফেলুন। সবখানে থাকবে শুধু বিরাট বিরাট স্থাপত্য। আলাপ-আলোচনা, পাঠচক্র এসব আয়োজনের পথ যতটা সম্ভব কঠিন করে তুলুন। মানুষ যদি মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগই না পায়, চিন্তার লেনদেনই না করতে পারে, তাহলে বিদ্রোহের সম্ভাবনা শুরুতেই নস্যাৎ হয়। যেমন ধরুন, জিম্বাবুয়ের নাগরিকদের কাছে আরব বসন্তের ঘটনাক্রম স্বাভাবিকভাবেই বেশ অনুপ্রেরণাদায়ক মনে হয়েছিল, ফলে তারা আরব বসন্ত থেকে কী কী শেখা যায় সে ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য একত্র হতে গেলে রবার্ট মুগাবে সেখানকার উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করেন। বাংলাদেশে কিছুদিন আগেই ২০২২ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরাকে গ্রেফতার করা হয়। খাদিজা ফেসবুকে একটি ওয়েবিনার সঞ্চালনা করেন, যেখানে একজন বক্তা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বক্তব্য রাখেন। তিনি প্রবাসী হওয়ায় তার বদলে গ্রেফতার করা হয় খাদিজাকে। এনআইডি কার্ডে তখন তার বয়স ১৭।

অথবা বেছে নিতে পারেন জনতুষ্টির পথ। জনগণকে যে আপনি খুব পাত্তা দেন তা তো না। কিন্তু তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে তাদের খুব বেশি খ্যাপানোও ঠিক হবে না। যেনতেনভাবে সন্তুষ্ট রাখতেই হবে। অগাস্টাস সিজার সৈন্যদের নানানরকম উপহার দিয়ে বাগে এনেছিল, সাধারণ জনগণকে দিয়েছিল সস্তার ভুট্টা ও বিশ্রামের সময়। ফলে কেউ খেয়ালও করেনি যে এসবের ফাঁকে সে সেনেট, প্রশাসন, বিচার-বিভাগ সব নিজের পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। জনগণের নজর সরিয়ে রাখার উপায় অনেক আছে। খেলাধুলা, বিনোদন মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগান। মুসোলিনির সময় খেলোয়াড়রা ছিল ইতালীয় পৌরুষের প্রতীক। নিজেদের ব্যক্তিত্ব ও কাজের মাধ্যমে মুসোলিনির শাসনের প্রতি জনগণের সম্মতি উৎপাদন করে চলেছিল তারা। আফ্রিকান দেশ যাঈয়ে-তে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। তখন মোবুতু প্রচুর পরিমাণে পয়সা খরচ করে মুহাম্মদ আলী আর জর্জ ফোরম্যানকে নিয়ে আসেন দেশে বক্সিং খেলার জন্য। অর্থাৎ জুভেনালের পরামর্শ অনুযায়ী, রুটি ও সার্কাস দিয়ে ব্যস্ত রাখতে হবে মানুষকে। আশা করা যায় তাহলেই তারা শান্ত থাকবে। 

দ্য ডিক্টেটর্স হ্যান্ডবুক বইয়ের প্রচ্ছদ। অলঙ্করণঃ রিসাদ হাসান সৌরভ


তবুও যদি কোনোভাবে তারা একত্র হতে শুরু করে, আপনার জন্য ঝামেলার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন নিরুপায় হয়ে কঠোর হতেই হবে। স্বৈরাচারীর প্রকৃষ্ট বন্ধু ম্যাকিয়াভেলি বলে গেছেন, ‘জনগণের কাছ থেকে ভালোবাসা ও ভয় দুটো একইসাথে আদায় করা যেহেতু কঠিন, ফলে শাসকের জন্য জনগণের ভয়ই উত্তম।’ তবে তাই হোক— কায়েম হোক ভয়ের শাসন।  আন্দোলনকারীদেরকে দাগিয়ে দিন অপরাধী হিসেবে। এমন কোনো একটা তকমা দিয়ে দিতে পারেন যার বরাতে তাদের মানবাধিকার নাই করে দেওয়া জায়েজ হয়ে যায়। বলে দেন তারা স্বাধীনতাবিরোধী বা রাজাকার কিংবা টেরোরিস্ট। বেশিরভাগ সময় এসব তকমা বিরোধীমতের লোকদেরকে দেশের উপর কম হকদার প্রতিপন্ন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আপনার বিরোধিতা করা মানে তো আসলে দেশেরই বিরোধিতা করা। তারপর সবলে দমন করুন। নেতাগুলোকে আগে জেলে ভরুন। আন্দোলনকারীদের মেরে ফেলুন, গ্রেফতার করুন, গুম করুন। এদিকে ফাঁকতালে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংবাদিকরা যারা আপনার শাসনামলে শনপাপড়ি খেয়ে আসছে তাদের ডেকে নিন, বোঝান যেন তারা কো-অপারেট করে, কারণ আপনি না থাকলে তাদেরও খবর আছে। এদের সহযোগিতায় চালাইদেন যে এরা বিরোধীদলের, বা কোনো জঙ্গীগোষ্ঠীর মদদপুষ্ট। তদন্তের মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত করা অনেক সেকেলে। আগে অপরাধী শনাক্ত করে তক্তা বানান, তদন্ত তার পরে। 
এইতো! এই কাজগুলো ঠিকঠাক করতে পারলে আশা করা যায় আপনি হয়ে উঠবেন একজন সফল স্বৈরাচারী। পুরো দেশ থাকবে আপনার হাতের মুঠায়। লেখাটি যদি আপনার কাজে লাগে, ও কখনো যদি ক্ষমতায় চলে আসতে পারেন, তাহলে আশা করি আমাদেরকে আপনার সুনজরে রাখবেন।  

[ সম্পাদকের নোটঃ বিগত দুই দশকে ডিক্টেটরশিপ ও ফ্যাসিবাদ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অনেকগুলো বই। একাডেমিক বই যেমন আছে, আছে সাধারণ পাঠকদেরকে উদ্দেশ্য করে রচিত ননফিকশনও। কার্মাইন ডেলুকা ও র‍্যান্ডাল উড রচিত ‘দ্য ডিক্টেটর্স হ্যান্ডবুকঃ আ প্র্যাক্টিকেল ম্যানুয়াল ফর দি এ্যাস্পায়ারিং টাইরেন্ট’ ধারার বই যেখানে স্বৈরাচারের কর্মপদ্ধতি আলোচিত হয়েছে ‘হাউ টু’ ঢঙে। বর্তমান লেখাটি বইটির স্যাটায়ারিকাল রিভিউ হলেও হাউ টু ভঙ্গিতে স্বৈরাচারের কর্মপদ্ধতি ও স্বৈরাচারশাসিত সমাজের নানান দিকও তুলে ধরেছে ]    

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।