মনোযোগের অর্থনীতি যেভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি

এই লেখা পড়তে পড়তে এই মুহূর্তে  আপনি আর কতগুলো কাজ করছেন? ইমেইল বা টুইটার ফিড চেক করছেন নাকি আপনার ফেসবুক পেজ আপডেট করছেন?    

পাঁচ বছর আগে ডেভিড ফস্টার ‘টোটাল নয়েজ’ সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘প্রতিটি জিনিস ও অভিজ্ঞতার উত্তেজক দৃশ্য আর একজন মানুষের অনন্ত বিকল্প থেকে পছন্দ করার স্বাধীনতা’। এই টোটাল নয়েজ বর্তমান দুনিয়ায় যাপিত-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগামী বছরের মধ্যে এই দুনিয়া হয়তো তার ৮  বিলিয়ন বাসিন্দার প্রত্যেকের জন্য একটি মোবাইল ফোন নিয়ে বড়াই করবে।          

আমরা সকলেই মনোযোগের কাঁচা অর্থনীতিবিদ, কেননা আমরা মুহূর্তগুলো জমিয়ে লেনদেন করছি — অথবা হাজার হাজার ইউটিউব ক্লিপের মধ্যে এই মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেতে দেখছি।  বিনামূল্যে অনলাইন সেবা গ্রহণ করে থাকলে—আপ্তবাক্য মতে—আপনি নিজেই হচ্ছেন পণ্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপনি না, বরং আপনার আচরণ ও ব্যস্ততার পরিমাপযোগ্য তথ্য, যা ক্রমাগতভাবে বিক্রির জন্য জমানো ও মেশানো হচ্ছে, আর আপনার প্রতিটি কার্যকলাপ ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে এবং ইউজারদের ধরে রাখার মেকানিজমে পরিণত হচ্ছে।           

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আপওয়ার্থি’-তে প্রকাশিত স্লাইড শো ‘ওয়েবসাইট ফর ভাইরাল কনটেন্ট’ বিবেচনা করুন। স্লাইড শো’টি অনলাইনে মনোযোগ শিকারের কায়দা-কানুন বিস্তারিত বর্ণনা করে। তারা দেখান যে, সত্যিকার অর্থে ভাইরাল হতে হলে কনটেন্ট হতে হবে এমন যেন লোকে কনটেন্টটিতে ক্লিক করে এবং সবার সাথে শেয়ার করে যারা নিজেরাও কনটেন্টটিতে ক্লিক ও শেয়ার করবে। মানে হলো এমন সব কনটেন্ট বাছাই করা যা মানুষকে তাৎক্ষণিক আকৃষ্ট করবে। সারাংশ, শিরোনাম, উদ্ধৃতি, চিত্র এবং টুইট যেখানে এমন নিখুতভাবে সাজানো থাকে যা কনটেন্টটি ছড়াতে সাহায্য করবে। সহজ ভাষায় এর মানে হচ্ছে একই কনটেন্টের ২৫টি ভার্সন বানানো,  সেগুলোর মধ্য থেকে সেরাটা বাছাই করা এবং সাইটের প্রতিটি জিনিস ক্রমাগত বদলাতে প্রস্তুত থাকা। আপনাকে ক্রমাগত প্রচুর পরিমাণে কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে যেন আপনার কনটেন্ট হিট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে আর একই সাথে ফেসবুকে চোখ রাখতে হবে। এভাবেই আপওয়ার্থি তাদের সবচেয়ে ভাইরাল হিট পেয়েছে। পোস্টটির শিরোনাম ছিল: ‘বুলি কলস নিউজ অ্যাঙ্কর ফ্যাট, নিউজ অ্যাঙ্কর ডেস্ট্রয়স হিম অন লাইভ টিভি’ এবং যা ফেসবুকে ৮০০,০০০ এর বেশি লাইক এবং ইউটিউবে ১১ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।                          

এমনকি আপওয়ার্থির মতো প্রচেষ্টাও শক্তিশালী অ্যালগরিদমিক সাইটগুলোর কাছে তুচ্ছ। এমনই একটি সাইট হচ্ছে ইয়াহু!। আমেরিকান লেখক ও মার্কেটার রায়ান হলিডের মতে, ইয়াহু!র হোম পেজে প্রতি পাঁচ মিনিটে ৪৫,০০০টিরও বেশি শিরোনাম এবং ছবির কম্বিনেশন পরীক্ষা করে। ঠিক যেমন খাবার ও পানীয় স্বাদ, টেক্সচার ও লোভনীয় উপাদান বাড়াতে কর্পোরেশনগুলো যেমন সেগুলো খাওয়া বন্ধ করা কতটা কঠিন তা পরিমাপ করে অনলাইনে প্রতিটি ব্যক্তির কার্যকলাপ মাপে। এক্ষেত্রে অনিবার্য হওয়া মানেই বেশি ভালো: বেশি পাঠক, বেশি দর্শক, বেশি এক্সপোজার, বেশি প্রভাব, বেশি বিজ্ঞাপন, ডেটা সংগ্রহ ও বিক্রির আরও বেশি সুযোগ। 

অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

মনোযোগ তেল বা সোনার মতো নিষ্ক্রিয় কিন্তু সীমিত এক সম্পদ: এটি লেনদেনযোগ্য সম্পদ যা দক্ষ ম্যানিপুলেটররা সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে নিলাম করে বা যা থেকে লাভের আশা করে। এমনকি সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনের উপমা দিয়ে বিশ্বের ‘পিক অ্যাটেনশন’-এ পৌঁছানোর কথাও বলা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে এখন মানুষের কাছে ব্যয় করার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ আর নেই।           

সময়কে বোঝার এটা একটি উপায়। এটা এমন সংখ্যাগত পরিমাপ যা গুণগত দিকগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়। আমেরিকান লেখক মাইকেল এইচ গোল্ডহেবার, কয়েক বছর আগে ওয়্যার্ড ম্যাগানিজের এক লেখায় বিষয়টিকে ‘অ্যাটেনশন শপার্স’ নামে শনাক্ত করেন। তার যুক্তি হচ্ছে, ‘মনোযোগ বহু রূপে আসে: প্রেম, স্বীকৃতি, কথা শোনা, আনুগত্য, চিন্তাশীলতা, যত্ন নেওয়া, প্রশংসা করা, দেখাশোনা করা, কারও ইচ্ছার প্রতি খেয়াল রাখা, সাহায্য করা, পরামর্শ দেওয়া, সমালোচনামূলক মূল্যায়ন, নতুন দক্ষতা বিকাশে সহায়তা ইত্যাদি। ম্যাডোনা যে ধরনের মনোযোগ চান, একজন সেনা সার্জেন্ট সৈন্যদের আদেশ দেওয়ার সময় সেই ধরনের মনোযোগ চান না। আমি এই লেখার ক্ষেত্রে যে ধরণের মনোযোগ চাই তিনি তেমনটাও চান না।’ 

আমরা এমন জটিল এক পৃথিবীতে আছি যেখানে আমাদের জাগ্রত সময়ের বেশিরভাগ অংশ মিডিয়া দেখা বা মিডিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যয় হচ্ছে। অথচ মনোযোগ জিনিসটা যে কী তা আমরা ভালো করে বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয় না। মাপামাপির নতুন পদ্ধতি আসার সঙ্গে সঙ্গে, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে সৃষ্ট একটি রিসোর্সের ভিত্তিতে যেখানে আমাদের ব্যবসায়িক ও মানসিক মডেল তৈরি, সেখানে আমরা আসলে কী নিয়ে কথা বলছি?    

ল্যাটিন ভাষায় ক্রিয়াপদ অ্যাটেন্ডার – যা থেকে ‘অ্যাটেনশন’ শব্দটি এসেছে – এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘দিকে প্রসারিত করা’। ‘অ্যাড’ (‘এর দিকে’) এবং ‘টেন্ডার’ (প্রসারিত করা)- এর একটি যৌগিক শব্দ, যা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্রকে আহ্বান করে: এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য, মনো-দৈহিক উভয় দিক দিয়েই তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।  

মনোযোগ প্রত্যাশার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সৈন্যরা মনোযোগকে মূর্ত করতে আর প্রস্তুতি ও সম্মান প্রদর্শন করতে মুহূর্তের মধ্যেই মনোযোগী হয়ে যায়। একে অপরের মন পড়তে অক্ষম হওয়ায় আমরা মনোযোগের বাহ্যিক প্রদর্শনী চাই। অমনোযোগী ছাত্রদের এলোমেলো চিন্তাভাবনা থেকে বাস্তব জগতে ফেরত আনতে শিক্ষকরা চিৎকার করে বলে ‘মনোযোগ দাও!’।  দৈহিক অভিনিবেশ, সময় দেওয়া আর হাজির থাকা আমাদের তরফে বেসিক এমন কিছুর প্রক্সি যা আসলে প্রমাণ করা যায় না। এই বেসিক জিনিসটা হচ্ছে নিজেদেরকে বুঝতে চাওয়া।  

মনে করা হয় সেরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঙ্গে চেঁচামেচি করেন না – কারণ তারা ছাত্রদের প্ররোচিত করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও আগ্রহ তৈরিতেও দক্ষ। পারসুয়েড করা বা ভজানো বিষয়টা প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে শিক্ষার প্রধানতম অংশ ছিল। ২১০০ বছর আগের অলঙ্কারশাস্ত্রের বই, রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম-এ যেমনটা বলা হয়েছে: ‘আমরা চাই আমাদের শ্রোতারা হবে ভাবগ্রাহী (রিসেপ্টিভ), সুবিবেচক আর মনোযোগী (বিনয়ী, সদয়, মনোযোগী)।’  সভ্য হওয়ার মানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যেমন, আইন ও প্রথা, আনুগত্য ও ন্যায়বিচার—সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো এবং অন্যদেরকে একমত করে তোলে এমনভাবে কথা বলা।      

এতে জোর দেওয়া আদর্শবাদ বা মর্যাদার বিষয় ছিলো না, ছিল পাঁচ-ধাপের বাস্তববাদী এক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াগুলো হলো মনোগ্রাহী একটা প্রস্তাব হাজির করা, উপাদানগুলোকে সুচারুভাবে সাজানো, স্টাইলকে আরও হৃদয়গ্রাহী করা, মানুষের স্মৃতিতে বা মিডিয়াতে ফলটাকে তুলে ধরা, এবং সর্বোচ্চ প্রভাবের জন্য উপস্থাপন করা। এ যেন প্রাচীন ‘শেয়ার’ বাটনের সংক্ষিপ্ত রূপ! ভাইরাল হওয়ার জন্য আপওয়ার্থির রেসিপির সাথে মিলগুলো বেশ অবাক করা। প্রথাগতভাবে যাকে রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম–এর রচয়িতা ভাবা হয়, সেই সিসেরোও, তার ব্যবসার জন্যে চাটুকারিতা, ঘুষ, পক্ষপাতের তদবির করতে এবং অসত্য বলাতেও আপত্তি করতেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে ফলাফল।     

তবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ব্যাপারে ব্যক্তির অন্যের কথা শোনার চেয়েও বেশি কিছু আছে। আর পরিমাপ এবং পারসুয়েশন প্রক্রিয়ার কিছু অপ্রীতিকর দিকও আছে। অনলাইনে পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমি হয়তো সিস্টেমের নিয়ম মেনে খেলতে পারি — লাইক, লিঙ্ক, মন্তব্য, ক্লিক, শেয়ার, রিটুইট করে— অথবা এই সকল সিস্টেমের জন্য অযোগ্য হতে পারি। আমেরিকান লেখক এবং সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী ডেভিড অয়ারবাচ এটিকে n+1 ম্যাগাজিনে ‘দ্য স্টুপিডিটি অফ কম্পিউটারস’ (২০১২) লেখায় উল্লেখ করেন, স্ক্রিনে যা আছে তা আমার জটিলতার মতো কিছুই দাবি করে না: ‘যেহেতু কম্পিউটার আমাদের  কাছে আসতে পারে না এবং আমাদের জগতে আমাদের সাথে দেখা করতে পারে না, তাই আমাদের নিজেদের জগতকেই মানিয়ে নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবন এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিগুলো এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করব যেন একটি কম্পিউটার বুঝতে পারে। যন্ত্রের এই মূর্খতা আমাদের হয়ে যাবে।’   

কম্পিউটিংয়ের ভাষায়, সিস্টেমটি ‘বোঝে না’ এমনভাবে কিছু করা মানে কিছুই না করা। অবোধগম্য, অযৌক্তিক, —-যেমন প্রিন্টারে কাগজের পরিবর্তে কলা ঢোকানোর মতো ব্যাপার। যা গণ্য হয় তা যা গণনা করা যায় তার সমার্থক। এই সবকিছু সিস্টেম আর্কিটেক্টদের হাতে দায়িত্বের পাশাপাশি অপরিসীম ক্ষমতাও দেয়: কোডার, ডিজাইনার, বিজ্ঞাপনদাতা, পেশাদার মিডিয়া ম্যানিপুলেটর এবং সামাজিক মিডিয়া গুরুরা লাভজনক ক্লিক করার জন্য নিবেদিত।  

পাপেটিয়ারের মতো অনায়াসে সকলের মনোযোগ টানার এই কল্পনা—গিকদের ফ্যান্টাসি পূরণ বা প্রাচীনপন্থী প্রযুক্তি-বিরোধীদের যতই মাথাব্যাথার কারণ হোক না কেন— স্পষ্টত সন্দেহজনক। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্ট ১৯৭৫ সালে একটি অ্যাফোরিজমে যুক্তি দিয়েছিলেন যা গুডহার্টের আইন হিসেবে পরিচিত, ‘কোনো পরিমাপ যখন একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়, সেটা তখন আর ভালো পরিমাপ থাকে না।’ মনোযোগ অর্থনীতির মৌলিক ত্রুটি সম্পর্কের এর চেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ খুব কমই আছে।  

মনোযোগ-এঞ্জিনিয়াররা যেন ব্যক্তিগত মুদ্রার জন্য ছাপাখানা বিতরণ করছেন— আর প্রত্যেকেই যত বেশি সম্ভব সেই মুদ্রা বানিয়ে নিতে মরিয়া— সেটা যেভাবেই সম্ভব হোক না কেন। মনোযোগের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটছে সেটি যৌক্তিক ও ন্যায্য বাণিজ্যের চেয়ে বরং নৈরাজ্যকর লুটপাট বলাই শ্রেয়।  

অ্যালগরিদম এবং ফিল্টার যতই ধূর্ত হোক না কেন, মনোযোগ উৎপাদনের সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি মুনাফার প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে প্রস্ফুটিত এবং বিবর্ণ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অর্জনগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কম বেতনের কর্মীদের ‘ক্লিক ফার্ম’ থেকে অকৃত্রিম এনগেজমেন্ট কামাই করা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটিদের বিপুল সংখ্যক কেনা ফলোয়ার এবং ভুয়া মাঠকর্মীদের মাধ্যমে পেইড এনগেজমেন্ট। প্রতিটি লক্ষ্য ক্রমাগতভাবে সরানো হচ্ছে, পরিমার্জিত হচ্ছে এবং অবমূল্যায়িত হচ্ছে। কারো কোনো নিয়ন্ত্রণে নেই।    

আর কেই বা বলবে যে কাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত? বিস্তৃত পরিসরে ডেটাকে দেখলে, ডেটার জটিল শৃঙ্খল রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে দেখে আমার সহজেই তথ্যসমুদ্রে দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ এটা বড়জোর একটা ক্যাটাগরি এরর! আর সবচে নিকৃষ্ট হতে পারে বুলশিটে ডুবে যাওয়া: সুবিধাজনক প্রপাগান্ডা এবং সান্ত্বনাদায়ক আত্ম-প্রতারণার মিশ্রণ যা নতুন ধরনের এজেন্সিকে অভ্যর্থনা জানায়, অফারে যা আছে তার বেশিরভাগের তির্যকতা স্বীকার না করেই।    

প্রবন্ধ সংকলন ‘Tremendous Trifles’ (১৯০৯)-এর ভূমিকায়, ইংরেজ লেখক, অনটোলজিস্ট এবং পেশাদার প্যারাডক্স-কারিগর জি কে চেস্টারটন, দুটি ছেলের গল্প বলেছিলেন যাদের প্রত্যেককে একটি ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন আকারে দৈত্য হতে চেয়েছে; আরেকজন চেয়েছে আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, দৈত্য তার পায়ের নিচের সঙ্কুচিত জমিতে উদাস অনুভব করতে লাগল। অন্যদিকে ছোট ছেলেটি আনন্দের সাথে তার সামনের বাগানে যে বিস্ময়ের অন্তহীন জগৎ আছে তা অন্বেষণ করতে রওনা দিল। চেস্টারটনের মতে, এই গল্পের নৈতিক দিকটা ছিল দৃষ্টিকোণ:  ‘যদি কেউ বলে যে আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরি করছি, আমি তা গর্বের সাথে স্বীকার করি। আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরির চেয়ে বেশি সফল এবং ফলপ্রসু রূপ কল্পনা করতে পারি না…সবকিছুর শীর্ষে যাওয়া, সবকিছুকে উপেক্ষা করা, পর্বতারোহণের এই সমস্ত বাস্তব মূল্য সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যিশুকে যখন একটি উচ্চ পর্বতের চূড়ায় নিয়ে তাকে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য দেখিয়েছিল, তখন শয়তান ছিলো আলপাইন গাইডদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু চূড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তানের আনন্দ বিশালতায় নয়, বরং ক্ষুদ্রতা দেখার মধ্যে ছিল, কারণ তার পায়ের কাছে সমস্ত মানুষকে পোকামাকড়ের মতো লাগছিলো।’    

বৈশ্বিক জলাধারে জল ছলকে ওঠার উপমায় প্রতিটি জীবন্ত মানুষের মনোযোগকে দেখার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক ব্যাপার আছে। যৌথ নির্মাণ হিসাবে মনোযোগের এই ধারণা যতটা বাজেট খরচার সাথে মেলে, তার চেয়ে সহানুভুতির সাথেই বেশি যেহেতু মেলে, বেখেয়াল মুহূর্তগুলোতে নিজেদের প্রতি, আমাদের পরিপার্শ্বের প্রতি আমরা যখন মনোযোগ দিই, বা না দিই, তখন পরিসরটা আসলে কোথায়?      

অন্যভাবে দেখলে, তথ্য নিজেই সকলের দড়ি টানছে: ফ্রি-রেঞ্জিং মিমের মতো যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল নিজের ছড়িয়ে পড়া এবং যার উন্মত্ত বিবর্তন সমস্ত পূর্ববর্তী হিসাবকে ছাড়িয়ে যায়। এটি চেস্টারটনের শয়তানের পাহাড়চুড়ার দৃশ্য, যা ব্রাউজারের কানে ফিসফিস করে: আপনি যে বাটনে ক্লিক করছেন তার মতো নিজেকে রূপান্তরযোগ্য ভাবুন, যে সিস্টেমে জড়িত আছেন তার মতো নিজেকে স্বয়ংক্রিয় মনে করুন। দূর উচু থেকে দেখলে, আপনি আপনার রেকর্ড করা কর্মের বাইরে কিছুই না। 

টোটালাইজিং সকল ভিশনের মতো, অভিনিবেশ সহকারে দেখলে, এটি একইসঙ্গে যেমন শক্তিশালী, তেমনি বিভ্রান্তিকরও। দূর থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় অস্পষ্ট কিছু, কাছে থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা মনোযোগকে ‘সহজে রূপান্তরযোগ্য সম্পদ’-এ পরিণত করতে গিয়ে সময়কে আমরা যতটা অবমূল্যায়ন করছি ততটা অর্থ উৎপাদন করছি না।   

৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপনের মূল্যে আমরা এখন ভিডিও দেখি; আমরা বন্ধুদের এন্ডোর্সমেন্টের অনুরোধ করি, স্টেটাস আপডেট আর গৎবাধা প্রতিক্রিয়ায়, বাক্যের পর বাক্যে, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা ব্যয় করি। এগুলোর কোনোটিই আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সকে নষ্ট করে না। অথচ এর মোট খরচ, পরিমাপ করা কঠিন হলেও, ঋদ্ধ সম্পর্ক, অমূল্য  অবসর, অর্থপূর্ণ কাজ কিংবা  মানসিক শান্তির মতো এমন অনেক কিছুকে প্রভাবিত করে যা আমরা একটি সুখি জীবনের কেন্দ্রে রাখতে চাই।    

চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রাপ্য বা কী ধরণের মনোযোগ তাদেরকে দেওয়া উচিত? পরিপূর্ণ অর্থে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চাইলে, কী ধরণের মনোযোগ আমরা ডিজার্ভ করি বা কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রয়োজন?  এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে বানানো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাও দিতে অক্ষম। অবশ্য পরিতৃপ্তি এবং নিয়ন্ত্রণবোধ যদি সাফল্যের আংশিক পরিমাপও হয়, তবে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে খুব সস্তায় বিকিয়েছি।      

আপনি কি এখনও মনোযোগ দিতে পারছেন? আমি লক্ষণগুলো বের করতে পারি, কিন্তু অবশেষে আপনি কী ভাবছেন বা করবেন তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। আর এখান থেকেই যেকোনো গঠনমূলক আলোচনার শুরু হতে পারে। আপনাকে যে যাই বলুক না কেন, আমাকে উপেক্ষা করার কিংবা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনার আছে।    

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।