মনোযোগের অর্থনীতি যেভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি

এই লেখা পড়তে পড়তে এই মুহূর্তে  আপনি আর কতগুলো কাজ করছেন? ইমেইল বা টুইটার ফিড চেক করছেন নাকি আপনার ফেসবুক পেজ আপডেট করছেন?    

পাঁচ বছর আগে ডেভিড ফস্টার ‘টোটাল নয়েজ’ সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘প্রতিটি জিনিস ও অভিজ্ঞতার উত্তেজক দৃশ্য আর একজন মানুষের অনন্ত বিকল্প থেকে পছন্দ করার স্বাধীনতা’। এই টোটাল নয়েজ বর্তমান দুনিয়ায় যাপিত-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগামী বছরের মধ্যে এই দুনিয়া হয়তো তার ৮  বিলিয়ন বাসিন্দার প্রত্যেকের জন্য একটি মোবাইল ফোন নিয়ে বড়াই করবে।          

আমরা সকলেই মনোযোগের কাঁচা অর্থনীতিবিদ, কেননা আমরা মুহূর্তগুলো জমিয়ে লেনদেন করছি — অথবা হাজার হাজার ইউটিউব ক্লিপের মধ্যে এই মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেতে দেখছি।  বিনামূল্যে অনলাইন সেবা গ্রহণ করে থাকলে—আপ্তবাক্য মতে—আপনি নিজেই হচ্ছেন পণ্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপনি না, বরং আপনার আচরণ ও ব্যস্ততার পরিমাপযোগ্য তথ্য, যা ক্রমাগতভাবে বিক্রির জন্য জমানো ও মেশানো হচ্ছে, আর আপনার প্রতিটি কার্যকলাপ ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে এবং ইউজারদের ধরে রাখার মেকানিজমে পরিণত হচ্ছে।           

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আপওয়ার্থি’-তে প্রকাশিত স্লাইড শো ‘ওয়েবসাইট ফর ভাইরাল কনটেন্ট’ বিবেচনা করুন। স্লাইড শো’টি অনলাইনে মনোযোগ শিকারের কায়দা-কানুন বিস্তারিত বর্ণনা করে। তারা দেখান যে, সত্যিকার অর্থে ভাইরাল হতে হলে কনটেন্ট হতে হবে এমন যেন লোকে কনটেন্টটিতে ক্লিক করে এবং সবার সাথে শেয়ার করে যারা নিজেরাও কনটেন্টটিতে ক্লিক ও শেয়ার করবে। মানে হলো এমন সব কনটেন্ট বাছাই করা যা মানুষকে তাৎক্ষণিক আকৃষ্ট করবে। সারাংশ, শিরোনাম, উদ্ধৃতি, চিত্র এবং টুইট যেখানে এমন নিখুতভাবে সাজানো থাকে যা কনটেন্টটি ছড়াতে সাহায্য করবে। সহজ ভাষায় এর মানে হচ্ছে একই কনটেন্টের ২৫টি ভার্সন বানানো,  সেগুলোর মধ্য থেকে সেরাটা বাছাই করা এবং সাইটের প্রতিটি জিনিস ক্রমাগত বদলাতে প্রস্তুত থাকা। আপনাকে ক্রমাগত প্রচুর পরিমাণে কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে যেন আপনার কনটেন্ট হিট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে আর একই সাথে ফেসবুকে চোখ রাখতে হবে। এভাবেই আপওয়ার্থি তাদের সবচেয়ে ভাইরাল হিট পেয়েছে। পোস্টটির শিরোনাম ছিল: ‘বুলি কলস নিউজ অ্যাঙ্কর ফ্যাট, নিউজ অ্যাঙ্কর ডেস্ট্রয়স হিম অন লাইভ টিভি’ এবং যা ফেসবুকে ৮০০,০০০ এর বেশি লাইক এবং ইউটিউবে ১১ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।                          

এমনকি আপওয়ার্থির মতো প্রচেষ্টাও শক্তিশালী অ্যালগরিদমিক সাইটগুলোর কাছে তুচ্ছ। এমনই একটি সাইট হচ্ছে ইয়াহু!। আমেরিকান লেখক ও মার্কেটার রায়ান হলিডের মতে, ইয়াহু!র হোম পেজে প্রতি পাঁচ মিনিটে ৪৫,০০০টিরও বেশি শিরোনাম এবং ছবির কম্বিনেশন পরীক্ষা করে। ঠিক যেমন খাবার ও পানীয় স্বাদ, টেক্সচার ও লোভনীয় উপাদান বাড়াতে কর্পোরেশনগুলো যেমন সেগুলো খাওয়া বন্ধ করা কতটা কঠিন তা পরিমাপ করে অনলাইনে প্রতিটি ব্যক্তির কার্যকলাপ মাপে। এক্ষেত্রে অনিবার্য হওয়া মানেই বেশি ভালো: বেশি পাঠক, বেশি দর্শক, বেশি এক্সপোজার, বেশি প্রভাব, বেশি বিজ্ঞাপন, ডেটা সংগ্রহ ও বিক্রির আরও বেশি সুযোগ। 

অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

মনোযোগ তেল বা সোনার মতো নিষ্ক্রিয় কিন্তু সীমিত এক সম্পদ: এটি লেনদেনযোগ্য সম্পদ যা দক্ষ ম্যানিপুলেটররা সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে নিলাম করে বা যা থেকে লাভের আশা করে। এমনকি সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনের উপমা দিয়ে বিশ্বের ‘পিক অ্যাটেনশন’-এ পৌঁছানোর কথাও বলা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে এখন মানুষের কাছে ব্যয় করার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ আর নেই।           

সময়কে বোঝার এটা একটি উপায়। এটা এমন সংখ্যাগত পরিমাপ যা গুণগত দিকগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়। আমেরিকান লেখক মাইকেল এইচ গোল্ডহেবার, কয়েক বছর আগে ওয়্যার্ড ম্যাগানিজের এক লেখায় বিষয়টিকে ‘অ্যাটেনশন শপার্স’ নামে শনাক্ত করেন। তার যুক্তি হচ্ছে, ‘মনোযোগ বহু রূপে আসে: প্রেম, স্বীকৃতি, কথা শোনা, আনুগত্য, চিন্তাশীলতা, যত্ন নেওয়া, প্রশংসা করা, দেখাশোনা করা, কারও ইচ্ছার প্রতি খেয়াল রাখা, সাহায্য করা, পরামর্শ দেওয়া, সমালোচনামূলক মূল্যায়ন, নতুন দক্ষতা বিকাশে সহায়তা ইত্যাদি। ম্যাডোনা যে ধরনের মনোযোগ চান, একজন সেনা সার্জেন্ট সৈন্যদের আদেশ দেওয়ার সময় সেই ধরনের মনোযোগ চান না। আমি এই লেখার ক্ষেত্রে যে ধরণের মনোযোগ চাই তিনি তেমনটাও চান না।’ 

আমরা এমন জটিল এক পৃথিবীতে আছি যেখানে আমাদের জাগ্রত সময়ের বেশিরভাগ অংশ মিডিয়া দেখা বা মিডিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যয় হচ্ছে। অথচ মনোযোগ জিনিসটা যে কী তা আমরা ভালো করে বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয় না। মাপামাপির নতুন পদ্ধতি আসার সঙ্গে সঙ্গে, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে সৃষ্ট একটি রিসোর্সের ভিত্তিতে যেখানে আমাদের ব্যবসায়িক ও মানসিক মডেল তৈরি, সেখানে আমরা আসলে কী নিয়ে কথা বলছি?    

ল্যাটিন ভাষায় ক্রিয়াপদ অ্যাটেন্ডার – যা থেকে ‘অ্যাটেনশন’ শব্দটি এসেছে – এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘দিকে প্রসারিত করা’। ‘অ্যাড’ (‘এর দিকে’) এবং ‘টেন্ডার’ (প্রসারিত করা)- এর একটি যৌগিক শব্দ, যা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্রকে আহ্বান করে: এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য, মনো-দৈহিক উভয় দিক দিয়েই তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।  

মনোযোগ প্রত্যাশার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সৈন্যরা মনোযোগকে মূর্ত করতে আর প্রস্তুতি ও সম্মান প্রদর্শন করতে মুহূর্তের মধ্যেই মনোযোগী হয়ে যায়। একে অপরের মন পড়তে অক্ষম হওয়ায় আমরা মনোযোগের বাহ্যিক প্রদর্শনী চাই। অমনোযোগী ছাত্রদের এলোমেলো চিন্তাভাবনা থেকে বাস্তব জগতে ফেরত আনতে শিক্ষকরা চিৎকার করে বলে ‘মনোযোগ দাও!’।  দৈহিক অভিনিবেশ, সময় দেওয়া আর হাজির থাকা আমাদের তরফে বেসিক এমন কিছুর প্রক্সি যা আসলে প্রমাণ করা যায় না। এই বেসিক জিনিসটা হচ্ছে নিজেদেরকে বুঝতে চাওয়া।  

মনে করা হয় সেরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঙ্গে চেঁচামেচি করেন না – কারণ তারা ছাত্রদের প্ররোচিত করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও আগ্রহ তৈরিতেও দক্ষ। পারসুয়েড করা বা ভজানো বিষয়টা প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে শিক্ষার প্রধানতম অংশ ছিল। ২১০০ বছর আগের অলঙ্কারশাস্ত্রের বই, রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম-এ যেমনটা বলা হয়েছে: ‘আমরা চাই আমাদের শ্রোতারা হবে ভাবগ্রাহী (রিসেপ্টিভ), সুবিবেচক আর মনোযোগী (বিনয়ী, সদয়, মনোযোগী)।’  সভ্য হওয়ার মানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যেমন, আইন ও প্রথা, আনুগত্য ও ন্যায়বিচার—সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো এবং অন্যদেরকে একমত করে তোলে এমনভাবে কথা বলা।      

এতে জোর দেওয়া আদর্শবাদ বা মর্যাদার বিষয় ছিলো না, ছিল পাঁচ-ধাপের বাস্তববাদী এক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াগুলো হলো মনোগ্রাহী একটা প্রস্তাব হাজির করা, উপাদানগুলোকে সুচারুভাবে সাজানো, স্টাইলকে আরও হৃদয়গ্রাহী করা, মানুষের স্মৃতিতে বা মিডিয়াতে ফলটাকে তুলে ধরা, এবং সর্বোচ্চ প্রভাবের জন্য উপস্থাপন করা। এ যেন প্রাচীন ‘শেয়ার’ বাটনের সংক্ষিপ্ত রূপ! ভাইরাল হওয়ার জন্য আপওয়ার্থির রেসিপির সাথে মিলগুলো বেশ অবাক করা। প্রথাগতভাবে যাকে রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম–এর রচয়িতা ভাবা হয়, সেই সিসেরোও, তার ব্যবসার জন্যে চাটুকারিতা, ঘুষ, পক্ষপাতের তদবির করতে এবং অসত্য বলাতেও আপত্তি করতেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে ফলাফল।     

তবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ব্যাপারে ব্যক্তির অন্যের কথা শোনার চেয়েও বেশি কিছু আছে। আর পরিমাপ এবং পারসুয়েশন প্রক্রিয়ার কিছু অপ্রীতিকর দিকও আছে। অনলাইনে পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমি হয়তো সিস্টেমের নিয়ম মেনে খেলতে পারি — লাইক, লিঙ্ক, মন্তব্য, ক্লিক, শেয়ার, রিটুইট করে— অথবা এই সকল সিস্টেমের জন্য অযোগ্য হতে পারি। আমেরিকান লেখক এবং সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী ডেভিড অয়ারবাচ এটিকে n+1 ম্যাগাজিনে ‘দ্য স্টুপিডিটি অফ কম্পিউটারস’ (২০১২) লেখায় উল্লেখ করেন, স্ক্রিনে যা আছে তা আমার জটিলতার মতো কিছুই দাবি করে না: ‘যেহেতু কম্পিউটার আমাদের  কাছে আসতে পারে না এবং আমাদের জগতে আমাদের সাথে দেখা করতে পারে না, তাই আমাদের নিজেদের জগতকেই মানিয়ে নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবন এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিগুলো এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করব যেন একটি কম্পিউটার বুঝতে পারে। যন্ত্রের এই মূর্খতা আমাদের হয়ে যাবে।’   

কম্পিউটিংয়ের ভাষায়, সিস্টেমটি ‘বোঝে না’ এমনভাবে কিছু করা মানে কিছুই না করা। অবোধগম্য, অযৌক্তিক, —-যেমন প্রিন্টারে কাগজের পরিবর্তে কলা ঢোকানোর মতো ব্যাপার। যা গণ্য হয় তা যা গণনা করা যায় তার সমার্থক। এই সবকিছু সিস্টেম আর্কিটেক্টদের হাতে দায়িত্বের পাশাপাশি অপরিসীম ক্ষমতাও দেয়: কোডার, ডিজাইনার, বিজ্ঞাপনদাতা, পেশাদার মিডিয়া ম্যানিপুলেটর এবং সামাজিক মিডিয়া গুরুরা লাভজনক ক্লিক করার জন্য নিবেদিত।  

পাপেটিয়ারের মতো অনায়াসে সকলের মনোযোগ টানার এই কল্পনা—গিকদের ফ্যান্টাসি পূরণ বা প্রাচীনপন্থী প্রযুক্তি-বিরোধীদের যতই মাথাব্যাথার কারণ হোক না কেন— স্পষ্টত সন্দেহজনক। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্ট ১৯৭৫ সালে একটি অ্যাফোরিজমে যুক্তি দিয়েছিলেন যা গুডহার্টের আইন হিসেবে পরিচিত, ‘কোনো পরিমাপ যখন একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়, সেটা তখন আর ভালো পরিমাপ থাকে না।’ মনোযোগ অর্থনীতির মৌলিক ত্রুটি সম্পর্কের এর চেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ খুব কমই আছে।  

মনোযোগ-এঞ্জিনিয়াররা যেন ব্যক্তিগত মুদ্রার জন্য ছাপাখানা বিতরণ করছেন— আর প্রত্যেকেই যত বেশি সম্ভব সেই মুদ্রা বানিয়ে নিতে মরিয়া— সেটা যেভাবেই সম্ভব হোক না কেন। মনোযোগের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটছে সেটি যৌক্তিক ও ন্যায্য বাণিজ্যের চেয়ে বরং নৈরাজ্যকর লুটপাট বলাই শ্রেয়।  

অ্যালগরিদম এবং ফিল্টার যতই ধূর্ত হোক না কেন, মনোযোগ উৎপাদনের সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি মুনাফার প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে প্রস্ফুটিত এবং বিবর্ণ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অর্জনগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কম বেতনের কর্মীদের ‘ক্লিক ফার্ম’ থেকে অকৃত্রিম এনগেজমেন্ট কামাই করা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটিদের বিপুল সংখ্যক কেনা ফলোয়ার এবং ভুয়া মাঠকর্মীদের মাধ্যমে পেইড এনগেজমেন্ট। প্রতিটি লক্ষ্য ক্রমাগতভাবে সরানো হচ্ছে, পরিমার্জিত হচ্ছে এবং অবমূল্যায়িত হচ্ছে। কারো কোনো নিয়ন্ত্রণে নেই।    

আর কেই বা বলবে যে কাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত? বিস্তৃত পরিসরে ডেটাকে দেখলে, ডেটার জটিল শৃঙ্খল রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে দেখে আমার সহজেই তথ্যসমুদ্রে দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ এটা বড়জোর একটা ক্যাটাগরি এরর! আর সবচে নিকৃষ্ট হতে পারে বুলশিটে ডুবে যাওয়া: সুবিধাজনক প্রপাগান্ডা এবং সান্ত্বনাদায়ক আত্ম-প্রতারণার মিশ্রণ যা নতুন ধরনের এজেন্সিকে অভ্যর্থনা জানায়, অফারে যা আছে তার বেশিরভাগের তির্যকতা স্বীকার না করেই।    

প্রবন্ধ সংকলন ‘Tremendous Trifles’ (১৯০৯)-এর ভূমিকায়, ইংরেজ লেখক, অনটোলজিস্ট এবং পেশাদার প্যারাডক্স-কারিগর জি কে চেস্টারটন, দুটি ছেলের গল্প বলেছিলেন যাদের প্রত্যেককে একটি ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন আকারে দৈত্য হতে চেয়েছে; আরেকজন চেয়েছে আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, দৈত্য তার পায়ের নিচের সঙ্কুচিত জমিতে উদাস অনুভব করতে লাগল। অন্যদিকে ছোট ছেলেটি আনন্দের সাথে তার সামনের বাগানে যে বিস্ময়ের অন্তহীন জগৎ আছে তা অন্বেষণ করতে রওনা দিল। চেস্টারটনের মতে, এই গল্পের নৈতিক দিকটা ছিল দৃষ্টিকোণ:  ‘যদি কেউ বলে যে আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরি করছি, আমি তা গর্বের সাথে স্বীকার করি। আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরির চেয়ে বেশি সফল এবং ফলপ্রসু রূপ কল্পনা করতে পারি না…সবকিছুর শীর্ষে যাওয়া, সবকিছুকে উপেক্ষা করা, পর্বতারোহণের এই সমস্ত বাস্তব মূল্য সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যিশুকে যখন একটি উচ্চ পর্বতের চূড়ায় নিয়ে তাকে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য দেখিয়েছিল, তখন শয়তান ছিলো আলপাইন গাইডদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু চূড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তানের আনন্দ বিশালতায় নয়, বরং ক্ষুদ্রতা দেখার মধ্যে ছিল, কারণ তার পায়ের কাছে সমস্ত মানুষকে পোকামাকড়ের মতো লাগছিলো।’    

বৈশ্বিক জলাধারে জল ছলকে ওঠার উপমায় প্রতিটি জীবন্ত মানুষের মনোযোগকে দেখার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক ব্যাপার আছে। যৌথ নির্মাণ হিসাবে মনোযোগের এই ধারণা যতটা বাজেট খরচার সাথে মেলে, তার চেয়ে সহানুভুতির সাথেই বেশি যেহেতু মেলে, বেখেয়াল মুহূর্তগুলোতে নিজেদের প্রতি, আমাদের পরিপার্শ্বের প্রতি আমরা যখন মনোযোগ দিই, বা না দিই, তখন পরিসরটা আসলে কোথায়?      

অন্যভাবে দেখলে, তথ্য নিজেই সকলের দড়ি টানছে: ফ্রি-রেঞ্জিং মিমের মতো যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল নিজের ছড়িয়ে পড়া এবং যার উন্মত্ত বিবর্তন সমস্ত পূর্ববর্তী হিসাবকে ছাড়িয়ে যায়। এটি চেস্টারটনের শয়তানের পাহাড়চুড়ার দৃশ্য, যা ব্রাউজারের কানে ফিসফিস করে: আপনি যে বাটনে ক্লিক করছেন তার মতো নিজেকে রূপান্তরযোগ্য ভাবুন, যে সিস্টেমে জড়িত আছেন তার মতো নিজেকে স্বয়ংক্রিয় মনে করুন। দূর উচু থেকে দেখলে, আপনি আপনার রেকর্ড করা কর্মের বাইরে কিছুই না। 

টোটালাইজিং সকল ভিশনের মতো, অভিনিবেশ সহকারে দেখলে, এটি একইসঙ্গে যেমন শক্তিশালী, তেমনি বিভ্রান্তিকরও। দূর থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় অস্পষ্ট কিছু, কাছে থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা মনোযোগকে ‘সহজে রূপান্তরযোগ্য সম্পদ’-এ পরিণত করতে গিয়ে সময়কে আমরা যতটা অবমূল্যায়ন করছি ততটা অর্থ উৎপাদন করছি না।   

৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপনের মূল্যে আমরা এখন ভিডিও দেখি; আমরা বন্ধুদের এন্ডোর্সমেন্টের অনুরোধ করি, স্টেটাস আপডেট আর গৎবাধা প্রতিক্রিয়ায়, বাক্যের পর বাক্যে, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা ব্যয় করি। এগুলোর কোনোটিই আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সকে নষ্ট করে না। অথচ এর মোট খরচ, পরিমাপ করা কঠিন হলেও, ঋদ্ধ সম্পর্ক, অমূল্য  অবসর, অর্থপূর্ণ কাজ কিংবা  মানসিক শান্তির মতো এমন অনেক কিছুকে প্রভাবিত করে যা আমরা একটি সুখি জীবনের কেন্দ্রে রাখতে চাই।    

চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রাপ্য বা কী ধরণের মনোযোগ তাদেরকে দেওয়া উচিত? পরিপূর্ণ অর্থে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চাইলে, কী ধরণের মনোযোগ আমরা ডিজার্ভ করি বা কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রয়োজন?  এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে বানানো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাও দিতে অক্ষম। অবশ্য পরিতৃপ্তি এবং নিয়ন্ত্রণবোধ যদি সাফল্যের আংশিক পরিমাপও হয়, তবে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে খুব সস্তায় বিকিয়েছি।      

আপনি কি এখনও মনোযোগ দিতে পারছেন? আমি লক্ষণগুলো বের করতে পারি, কিন্তু অবশেষে আপনি কী ভাবছেন বা করবেন তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। আর এখান থেকেই যেকোনো গঠনমূলক আলোচনার শুরু হতে পারে। আপনাকে যে যাই বলুক না কেন, আমাকে উপেক্ষা করার কিংবা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনার আছে।    

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।