মনোযোগের অর্থনীতি যেভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি

এই লেখা পড়তে পড়তে এই মুহূর্তে  আপনি আর কতগুলো কাজ করছেন? ইমেইল বা টুইটার ফিড চেক করছেন নাকি আপনার ফেসবুক পেজ আপডেট করছেন?    

পাঁচ বছর আগে ডেভিড ফস্টার ‘টোটাল নয়েজ’ সম্পর্কে বলেছিলেন: ‘প্রতিটি জিনিস ও অভিজ্ঞতার উত্তেজক দৃশ্য আর একজন মানুষের অনন্ত বিকল্প থেকে পছন্দ করার স্বাধীনতা’। এই টোটাল নয়েজ বর্তমান দুনিয়ায় যাপিত-জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আগামী বছরের মধ্যে এই দুনিয়া হয়তো তার ৮  বিলিয়ন বাসিন্দার প্রত্যেকের জন্য একটি মোবাইল ফোন নিয়ে বড়াই করবে।          

আমরা সকলেই মনোযোগের কাঁচা অর্থনীতিবিদ, কেননা আমরা মুহূর্তগুলো জমিয়ে লেনদেন করছি — অথবা হাজার হাজার ইউটিউব ক্লিপের মধ্যে এই মুহূর্তগুলো হারিয়ে যেতে দেখছি।  বিনামূল্যে অনলাইন সেবা গ্রহণ করে থাকলে—আপ্তবাক্য মতে—আপনি নিজেই হচ্ছেন পণ্য। আরও স্পষ্ট করে বললে, আপনি না, বরং আপনার আচরণ ও ব্যস্ততার পরিমাপযোগ্য তথ্য, যা ক্রমাগতভাবে বিক্রির জন্য জমানো ও মেশানো হচ্ছে, আর আপনার প্রতিটি কার্যকলাপ ব্যবসায়ীদের আকৃষ্ট করতে এবং ইউজারদের ধরে রাখার মেকানিজমে পরিণত হচ্ছে।           

২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘আপওয়ার্থি’-তে প্রকাশিত স্লাইড শো ‘ওয়েবসাইট ফর ভাইরাল কনটেন্ট’ বিবেচনা করুন। স্লাইড শো’টি অনলাইনে মনোযোগ শিকারের কায়দা-কানুন বিস্তারিত বর্ণনা করে। তারা দেখান যে, সত্যিকার অর্থে ভাইরাল হতে হলে কনটেন্ট হতে হবে এমন যেন লোকে কনটেন্টটিতে ক্লিক করে এবং সবার সাথে শেয়ার করে যারা নিজেরাও কনটেন্টটিতে ক্লিক ও শেয়ার করবে। মানে হলো এমন সব কনটেন্ট বাছাই করা যা মানুষকে তাৎক্ষণিক আকৃষ্ট করবে। সারাংশ, শিরোনাম, উদ্ধৃতি, চিত্র এবং টুইট যেখানে এমন নিখুতভাবে সাজানো থাকে যা কনটেন্টটি ছড়াতে সাহায্য করবে। সহজ ভাষায় এর মানে হচ্ছে একই কনটেন্টের ২৫টি ভার্সন বানানো,  সেগুলোর মধ্য থেকে সেরাটা বাছাই করা এবং সাইটের প্রতিটি জিনিস ক্রমাগত বদলাতে প্রস্তুত থাকা। আপনাকে ক্রমাগত প্রচুর পরিমাণে কনটেন্ট প্রকাশ করতে হবে যেন আপনার কনটেন্ট হিট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে আর একই সাথে ফেসবুকে চোখ রাখতে হবে। এভাবেই আপওয়ার্থি তাদের সবচেয়ে ভাইরাল হিট পেয়েছে। পোস্টটির শিরোনাম ছিল: ‘বুলি কলস নিউজ অ্যাঙ্কর ফ্যাট, নিউজ অ্যাঙ্কর ডেস্ট্রয়স হিম অন লাইভ টিভি’ এবং যা ফেসবুকে ৮০০,০০০ এর বেশি লাইক এবং ইউটিউবে ১১ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।                          

এমনকি আপওয়ার্থির মতো প্রচেষ্টাও শক্তিশালী অ্যালগরিদমিক সাইটগুলোর কাছে তুচ্ছ। এমনই একটি সাইট হচ্ছে ইয়াহু!। আমেরিকান লেখক ও মার্কেটার রায়ান হলিডের মতে, ইয়াহু!র হোম পেজে প্রতি পাঁচ মিনিটে ৪৫,০০০টিরও বেশি শিরোনাম এবং ছবির কম্বিনেশন পরীক্ষা করে। ঠিক যেমন খাবার ও পানীয় স্বাদ, টেক্সচার ও লোভনীয় উপাদান বাড়াতে কর্পোরেশনগুলো যেমন সেগুলো খাওয়া বন্ধ করা কতটা কঠিন তা পরিমাপ করে অনলাইনে প্রতিটি ব্যক্তির কার্যকলাপ মাপে। এক্ষেত্রে অনিবার্য হওয়া মানেই বেশি ভালো: বেশি পাঠক, বেশি দর্শক, বেশি এক্সপোজার, বেশি প্রভাব, বেশি বিজ্ঞাপন, ডেটা সংগ্রহ ও বিক্রির আরও বেশি সুযোগ। 

অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

মনোযোগ তেল বা সোনার মতো নিষ্ক্রিয় কিন্তু সীমিত এক সম্পদ: এটি লেনদেনযোগ্য সম্পদ যা দক্ষ ম্যানিপুলেটররা সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে নিলাম করে বা যা থেকে লাভের আশা করে। এমনকি সর্বোচ্চ তেল উৎপাদনের উপমা দিয়ে বিশ্বের ‘পিক অ্যাটেনশন’-এ পৌঁছানোর কথাও বলা হয়েছে, যার মানে হচ্ছে এখন মানুষের কাছে ব্যয় করার জন্য অতিরিক্ত মনোযোগ আর নেই।           

সময়কে বোঝার এটা একটি উপায়। এটা এমন সংখ্যাগত পরিমাপ যা গুণগত দিকগুলোকে চাপা দিয়ে দেয়। আমেরিকান লেখক মাইকেল এইচ গোল্ডহেবার, কয়েক বছর আগে ওয়্যার্ড ম্যাগানিজের এক লেখায় বিষয়টিকে ‘অ্যাটেনশন শপার্স’ নামে শনাক্ত করেন। তার যুক্তি হচ্ছে, ‘মনোযোগ বহু রূপে আসে: প্রেম, স্বীকৃতি, কথা শোনা, আনুগত্য, চিন্তাশীলতা, যত্ন নেওয়া, প্রশংসা করা, দেখাশোনা করা, কারও ইচ্ছার প্রতি খেয়াল রাখা, সাহায্য করা, পরামর্শ দেওয়া, সমালোচনামূলক মূল্যায়ন, নতুন দক্ষতা বিকাশে সহায়তা ইত্যাদি। ম্যাডোনা যে ধরনের মনোযোগ চান, একজন সেনা সার্জেন্ট সৈন্যদের আদেশ দেওয়ার সময় সেই ধরনের মনোযোগ চান না। আমি এই লেখার ক্ষেত্রে যে ধরণের মনোযোগ চাই তিনি তেমনটাও চান না।’ 

আমরা এমন জটিল এক পৃথিবীতে আছি যেখানে আমাদের জাগ্রত সময়ের বেশিরভাগ অংশ মিডিয়া দেখা বা মিডিয়ার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় ব্যয় হচ্ছে। অথচ মনোযোগ জিনিসটা যে কী তা আমরা ভালো করে বুঝতে পেরেছি বলে মনে হয় না। মাপামাপির নতুন পদ্ধতি আসার সঙ্গে সঙ্গে, সম্পূর্ণ শূন্য থেকে সৃষ্ট একটি রিসোর্সের ভিত্তিতে যেখানে আমাদের ব্যবসায়িক ও মানসিক মডেল তৈরি, সেখানে আমরা আসলে কী নিয়ে কথা বলছি?    

ল্যাটিন ভাষায় ক্রিয়াপদ অ্যাটেন্ডার – যা থেকে ‘অ্যাটেনশন’ শব্দটি এসেছে – এর আক্ষরিক অর্থ হল ‘দিকে প্রসারিত করা’। ‘অ্যাড’ (‘এর দিকে’) এবং ‘টেন্ডার’ (প্রসারিত করা)- এর একটি যৌগিক শব্দ, যা একটি প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্রকে আহ্বান করে: এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য, মনো-দৈহিক উভয় দিক দিয়েই তার দিকে ঝুঁকে পড়ছে।  

মনোযোগ প্রত্যাশার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সৈন্যরা মনোযোগকে মূর্ত করতে আর প্রস্তুতি ও সম্মান প্রদর্শন করতে মুহূর্তের মধ্যেই মনোযোগী হয়ে যায়। একে অপরের মন পড়তে অক্ষম হওয়ায় আমরা মনোযোগের বাহ্যিক প্রদর্শনী চাই। অমনোযোগী ছাত্রদের এলোমেলো চিন্তাভাবনা থেকে বাস্তব জগতে ফেরত আনতে শিক্ষকরা চিৎকার করে বলে ‘মনোযোগ দাও!’।  দৈহিক অভিনিবেশ, সময় দেওয়া আর হাজির থাকা আমাদের তরফে বেসিক এমন কিছুর প্রক্সি যা আসলে প্রমাণ করা যায় না। এই বেসিক জিনিসটা হচ্ছে নিজেদেরকে বুঝতে চাওয়া।  

মনে করা হয় সেরা শিক্ষকেরা ছাত্রদের সঙ্গে চেঁচামেচি করেন না – কারণ তারা ছাত্রদের প্ররোচিত করার পাশাপাশি তাদের কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও আগ্রহ তৈরিতেও দক্ষ। পারসুয়েড করা বা ভজানো বিষয়টা প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের কাছে শিক্ষার প্রধানতম অংশ ছিল। ২১০০ বছর আগের অলঙ্কারশাস্ত্রের বই, রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম-এ যেমনটা বলা হয়েছে: ‘আমরা চাই আমাদের শ্রোতারা হবে ভাবগ্রাহী (রিসেপ্টিভ), সুবিবেচক আর মনোযোগী (বিনয়ী, সদয়, মনোযোগী)।’  সভ্য হওয়ার মানে ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—যেমন, আইন ও প্রথা, আনুগত্য ও ন্যায়বিচার—সম্পর্কে আগ্রহ জাগানো এবং অন্যদেরকে একমত করে তোলে এমনভাবে কথা বলা।      

এতে জোর দেওয়া আদর্শবাদ বা মর্যাদার বিষয় ছিলো না, ছিল পাঁচ-ধাপের বাস্তববাদী এক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াগুলো হলো মনোগ্রাহী একটা প্রস্তাব হাজির করা, উপাদানগুলোকে সুচারুভাবে সাজানো, স্টাইলকে আরও হৃদয়গ্রাহী করা, মানুষের স্মৃতিতে বা মিডিয়াতে ফলটাকে তুলে ধরা, এবং সর্বোচ্চ প্রভাবের জন্য উপস্থাপন করা। এ যেন প্রাচীন ‘শেয়ার’ বাটনের সংক্ষিপ্ত রূপ! ভাইরাল হওয়ার জন্য আপওয়ার্থির রেসিপির সাথে মিলগুলো বেশ অবাক করা। প্রথাগতভাবে যাকে রেটোরিকা অ্যাড হেরেনিয়াম–এর রচয়িতা ভাবা হয়, সেই সিসেরোও, তার ব্যবসার জন্যে চাটুকারিতা, ঘুষ, পক্ষপাতের তদবির করতে এবং অসত্য বলাতেও আপত্তি করতেন না। আসল ব্যাপার হচ্ছে ফলাফল।     

তবে মনোযোগ আকর্ষণের জন্য স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমের ব্যাপারে ব্যক্তির অন্যের কথা শোনার চেয়েও বেশি কিছু আছে। আর পরিমাপ এবং পারসুয়েশন প্রক্রিয়ার কিছু অপ্রীতিকর দিকও আছে। অনলাইনে পুরো বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমি হয়তো সিস্টেমের নিয়ম মেনে খেলতে পারি — লাইক, লিঙ্ক, মন্তব্য, ক্লিক, শেয়ার, রিটুইট করে— অথবা এই সকল সিস্টেমের জন্য অযোগ্য হতে পারি। আমেরিকান লেখক এবং সফ্টওয়্যার প্রকৌশলী ডেভিড অয়ারবাচ এটিকে n+1 ম্যাগাজিনে ‘দ্য স্টুপিডিটি অফ কম্পিউটারস’ (২০১২) লেখায় উল্লেখ করেন, স্ক্রিনে যা আছে তা আমার জটিলতার মতো কিছুই দাবি করে না: ‘যেহেতু কম্পিউটার আমাদের  কাছে আসতে পারে না এবং আমাদের জগতে আমাদের সাথে দেখা করতে পারে না, তাই আমাদের নিজেদের জগতকেই মানিয়ে নিয়ে তাদের কাছে যেতে হবে। আমরা ব্যক্তিগত, সামাজিক জীবন এবং নিজেদের সম্পর্কে আমাদের উপলব্ধিগুলো এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করব যেন একটি কম্পিউটার বুঝতে পারে। যন্ত্রের এই মূর্খতা আমাদের হয়ে যাবে।’   

কম্পিউটিংয়ের ভাষায়, সিস্টেমটি ‘বোঝে না’ এমনভাবে কিছু করা মানে কিছুই না করা। অবোধগম্য, অযৌক্তিক, —-যেমন প্রিন্টারে কাগজের পরিবর্তে কলা ঢোকানোর মতো ব্যাপার। যা গণ্য হয় তা যা গণনা করা যায় তার সমার্থক। এই সবকিছু সিস্টেম আর্কিটেক্টদের হাতে দায়িত্বের পাশাপাশি অপরিসীম ক্ষমতাও দেয়: কোডার, ডিজাইনার, বিজ্ঞাপনদাতা, পেশাদার মিডিয়া ম্যানিপুলেটর এবং সামাজিক মিডিয়া গুরুরা লাভজনক ক্লিক করার জন্য নিবেদিত।  

পাপেটিয়ারের মতো অনায়াসে সকলের মনোযোগ টানার এই কল্পনা—গিকদের ফ্যান্টাসি পূরণ বা প্রাচীনপন্থী প্রযুক্তি-বিরোধীদের যতই মাথাব্যাথার কারণ হোক না কেন— স্পষ্টত সন্দেহজনক। ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্ট ১৯৭৫ সালে একটি অ্যাফোরিজমে যুক্তি দিয়েছিলেন যা গুডহার্টের আইন হিসেবে পরিচিত, ‘কোনো পরিমাপ যখন একটি লক্ষ্যে পরিণত হয়, সেটা তখন আর ভালো পরিমাপ থাকে না।’ মনোযোগ অর্থনীতির মৌলিক ত্রুটি সম্পর্কের এর চেয়ে ভালো পর্যবেক্ষণ খুব কমই আছে।  

মনোযোগ-এঞ্জিনিয়াররা যেন ব্যক্তিগত মুদ্রার জন্য ছাপাখানা বিতরণ করছেন— আর প্রত্যেকেই যত বেশি সম্ভব সেই মুদ্রা বানিয়ে নিতে মরিয়া— সেটা যেভাবেই সম্ভব হোক না কেন। মনোযোগের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যা ঘটছে সেটি যৌক্তিক ও ন্যায্য বাণিজ্যের চেয়ে বরং নৈরাজ্যকর লুটপাট বলাই শ্রেয়।  

অ্যালগরিদম এবং ফিল্টার যতই ধূর্ত হোক না কেন, মনোযোগ উৎপাদনের সমগ্র ইন্ডাস্ট্রি মুনাফার প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে প্রস্ফুটিত এবং বিবর্ণ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গেছে, ক্ষেত্রবিশেষে অর্জনগুলো ভিন্ন ভিন্ন, কম বেতনের কর্মীদের ‘ক্লিক ফার্ম’ থেকে অকৃত্রিম এনগেজমেন্ট কামাই করা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া সেলেব্রিটিদের বিপুল সংখ্যক কেনা ফলোয়ার এবং ভুয়া মাঠকর্মীদের মাধ্যমে পেইড এনগেজমেন্ট। প্রতিটি লক্ষ্য ক্রমাগতভাবে সরানো হচ্ছে, পরিমার্জিত হচ্ছে এবং অবমূল্যায়িত হচ্ছে। কারো কোনো নিয়ন্ত্রণে নেই।    

আর কেই বা বলবে যে কাদের হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত? বিস্তৃত পরিসরে ডেটাকে দেখলে, ডেটার জটিল শৃঙ্খল রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে দেখে আমার সহজেই তথ্যসমুদ্রে দিশা হারিয়ে ফেলি। অথচ এটা বড়জোর একটা ক্যাটাগরি এরর! আর সবচে নিকৃষ্ট হতে পারে বুলশিটে ডুবে যাওয়া: সুবিধাজনক প্রপাগান্ডা এবং সান্ত্বনাদায়ক আত্ম-প্রতারণার মিশ্রণ যা নতুন ধরনের এজেন্সিকে অভ্যর্থনা জানায়, অফারে যা আছে তার বেশিরভাগের তির্যকতা স্বীকার না করেই।    

প্রবন্ধ সংকলন ‘Tremendous Trifles’ (১৯০৯)-এর ভূমিকায়, ইংরেজ লেখক, অনটোলজিস্ট এবং পেশাদার প্যারাডক্স-কারিগর জি কে চেস্টারটন, দুটি ছেলের গল্প বলেছিলেন যাদের প্রত্যেককে একটি ইচ্ছা পূরণের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন আকারে দৈত্য হতে চেয়েছে; আরেকজন চেয়েছে আকারে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হতে। অবাক করা ব্যাপার হলো, দৈত্য তার পায়ের নিচের সঙ্কুচিত জমিতে উদাস অনুভব করতে লাগল। অন্যদিকে ছোট ছেলেটি আনন্দের সাথে তার সামনের বাগানে যে বিস্ময়ের অন্তহীন জগৎ আছে তা অন্বেষণ করতে রওনা দিল। চেস্টারটনের মতে, এই গল্পের নৈতিক দিকটা ছিল দৃষ্টিকোণ:  ‘যদি কেউ বলে যে আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরি করছি, আমি তা গর্বের সাথে স্বীকার করি। আমি মোলহিল থেকে পাহাড় তৈরির চেয়ে বেশি সফল এবং ফলপ্রসু রূপ কল্পনা করতে পারি না…সবকিছুর শীর্ষে যাওয়া, সবকিছুকে উপেক্ষা করা, পর্বতারোহণের এই সমস্ত বাস্তব মূল্য সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। যিশুকে যখন একটি উচ্চ পর্বতের চূড়ায় নিয়ে তাকে পৃথিবীর সমস্ত রাজ্য দেখিয়েছিল, তখন শয়তান ছিলো আলপাইন গাইডদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু চূড়ায় দাঁড়িয়ে শয়তানের আনন্দ বিশালতায় নয়, বরং ক্ষুদ্রতা দেখার মধ্যে ছিল, কারণ তার পায়ের কাছে সমস্ত মানুষকে পোকামাকড়ের মতো লাগছিলো।’    

বৈশ্বিক জলাধারে জল ছলকে ওঠার উপমায় প্রতিটি জীবন্ত মানুষের মনোযোগকে দেখার ক্ষেত্রে রূপান্তরমূলক ব্যাপার আছে। যৌথ নির্মাণ হিসাবে মনোযোগের এই ধারণা যতটা বাজেট খরচার সাথে মেলে, তার চেয়ে সহানুভুতির সাথেই বেশি যেহেতু মেলে, বেখেয়াল মুহূর্তগুলোতে নিজেদের প্রতি, আমাদের পরিপার্শ্বের প্রতি আমরা যখন মনোযোগ দিই, বা না দিই, তখন পরিসরটা আসলে কোথায়?      

অন্যভাবে দেখলে, তথ্য নিজেই সকলের দড়ি টানছে: ফ্রি-রেঞ্জিং মিমের মতো যার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেবল নিজের ছড়িয়ে পড়া এবং যার উন্মত্ত বিবর্তন সমস্ত পূর্ববর্তী হিসাবকে ছাড়িয়ে যায়। এটি চেস্টারটনের শয়তানের পাহাড়চুড়ার দৃশ্য, যা ব্রাউজারের কানে ফিসফিস করে: আপনি যে বাটনে ক্লিক করছেন তার মতো নিজেকে রূপান্তরযোগ্য ভাবুন, যে সিস্টেমে জড়িত আছেন তার মতো নিজেকে স্বয়ংক্রিয় মনে করুন। দূর উচু থেকে দেখলে, আপনি আপনার রেকর্ড করা কর্মের বাইরে কিছুই না। 

টোটালাইজিং সকল ভিশনের মতো, অভিনিবেশ সহকারে দেখলে, এটি একইসঙ্গে যেমন শক্তিশালী, তেমনি বিভ্রান্তিকরও। দূর থেকে দেখা অভিজ্ঞতায় অস্পষ্ট কিছু, কাছে থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা মনোযোগকে ‘সহজে রূপান্তরযোগ্য সম্পদ’-এ পরিণত করতে গিয়ে সময়কে আমরা যতটা অবমূল্যায়ন করছি ততটা অর্থ উৎপাদন করছি না।   

৩০ সেকেন্ডের একটি বিজ্ঞাপনের মূল্যে আমরা এখন ভিডিও দেখি; আমরা বন্ধুদের এন্ডোর্সমেন্টের অনুরোধ করি, স্টেটাস আপডেট আর গৎবাধা প্রতিক্রিয়ায়, বাক্যের পর বাক্যে, ঘন্টার পর ঘন্টা আমরা ব্যয় করি। এগুলোর কোনোটিই আমাদের ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সকে নষ্ট করে না। অথচ এর মোট খরচ, পরিমাপ করা কঠিন হলেও, ঋদ্ধ সম্পর্ক, অমূল্য  অবসর, অর্থপূর্ণ কাজ কিংবা  মানসিক শান্তির মতো এমন অনেক কিছুকে প্রভাবিত করে যা আমরা একটি সুখি জীবনের কেন্দ্রে রাখতে চাই।    

চারপাশের মানুষের কাছ থেকে কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রাপ্য বা কী ধরণের মনোযোগ তাদেরকে দেওয়া উচিত? পরিপূর্ণ অর্থে ‘আমরা’ হয়ে উঠতে চাইলে, কী ধরণের মনোযোগ আমরা ডিজার্ভ করি বা কী ধরণের মনোযোগ আমাদের প্রয়োজন?  এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সবচেয়ে সূক্ষ্মভাবে বানানো জনপ্রিয় প্রতিযোগিতাও দিতে অক্ষম। অবশ্য পরিতৃপ্তি এবং নিয়ন্ত্রণবোধ যদি সাফল্যের আংশিক পরিমাপও হয়, তবে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে খুব সস্তায় বিকিয়েছি।      

আপনি কি এখনও মনোযোগ দিতে পারছেন? আমি লক্ষণগুলো বের করতে পারি, কিন্তু অবশেষে আপনি কী ভাবছেন বা করবেন তার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। আর এখান থেকেই যেকোনো গঠনমূলক আলোচনার শুরু হতে পারে। আপনাকে যে যাই বলুক না কেন, আমাকে উপেক্ষা করার কিংবা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আপনার আছে।    

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।