মানব সমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে: পুরনো বয়ানকে চ্যালেঞ্জ 

IMG-20240308-WA0035-01
অর্নি শওকত
john-gray profile pics
জন গ্রে
দার্শনিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

আমরা বর্তমানে আটকে আছি কোথায়? প্রয়াত ডেভিড গ্রেবার এবং তার সহ-লেখক ডেভিড ওয়েনগ্রোর মতে, একে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে ধরা যেতে পারে। ‘মানুষের বিস্তৃত সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য, আমরা মূলত উপভোগ করেছি ‘তিনটি আদিম স্বাধীনতা’: ‘চলবার স্বাধীনতা, অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি বা রূপান্তর করার স্বাধীনতা’। আজ আমরা যাকে অসমতা বা অরাজকতা হিসাবে বর্ণনা করবো, আদিম মানব সমাজের অস্তিত্ব কিন্তু এই অসমতা ছাড়া ছিল না, এমনকি তাদের আধিপত্যের জোরের অভাব ছিল যার মিল আমরা পাই শ্রেণিবদ্ধ সরকারের সাথে। বলা যেতে পারে মানবজাতি সবসময় একটি শান্তিপূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করত।     

তারপর কিছু ‘ভয়ংকর ভুল’ হলো।  

স্পষ্ট যে মানব সমাজে কিছু  পরিবর্তন সত্যিই ঘটেছে এবং তা ঘটেছে গভীরভাবেই। তিনটি মৌলিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে আজ বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে কিভাবে মানবজাতি একটি সামাজিক ব্যবস্থার ভেতর বাস করতো। আসলে কিভাবে ঘটেছে? আমরা কিভাবে আটকে গেলাম? এবং ঠিক কিভাবে আমরা ভিন্ন এক পথে চলে এলাম?       

লেখকদের এই প্রশ্নগুলি কেবল তাদের পাণ্ডিত্যের প্রচেষ্টা থেকে এসেছে এমন নয়। গ্রেবার লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স (এলএসই) এর নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে, ওয়েনগ্রো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে, এমনকি একজন কর্মী হিসাবে গ্রেবারের ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকেও এই প্রশ্নগুলো এসেছে।  গ্রেবার ২০১১ সালের সেই কিশোর বয়স থেকেই একজন অরাজপন্থী (এনার্কিস্ট) গ্রেবার, ২০১১ সালের ওকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার একাডেমিক কাজ এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিল, যা তার কর্মজীবনে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারে। ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি শ্রমিক ​​পরিবারে তার জন্ম। ফিলিপস একাডেমি অ্যান্ডোভারে পড়াশুনা শেষ করেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল রিসার্স চালিয়ে যান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন এবং তার কর্মক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাকে মেয়াদের জন্য আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একাডেমিক অবস্থান খুঁজে পেতে তিনি অক্ষম হয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতটা বিবাদী মনের ছিল না। ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে এলএসই’র অধ্যাপক হন।      

দুই ডেভিড: গ্রেবার ও ওয়েংগ্রো। ফটো ক্রেডিট: কল্পেশ লাথিগ্রা


একাডেমিতে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐক্যমত্য এবং তার ফলস্বরূপ যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বলে বিশ্বাস — গ্রেবারের কাজ উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করে।  ২০০৪ সালে তিনি ফ্র্যাগমেন্টস অভ এ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপলজি নামে  ছোট একটি বই প্রকাশ করেন। একে বলা যেতে পারে ওয়েনগ্রোর সাথে দশ বছর ধরে সহলেখক হিসেবে লিখিত আরও পদ্ধতিগত গবেষণার বই ডন অভ এভ্রিথিং– এর একটি মুখবন্ধ। অন্যান্য বইয়ের  মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট অ্যাকশন: অ্যান এথনোগ্রাফি (২০০৯), ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ডেট: ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ার্স  (২০১১) এবং বুলশিট জবস: এ থিওরি (২০১৮)। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেক্রোটিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে আকস্মিকভাবে গ্রেবার মারা যান। তার অকাল প্রয়াণ আমাদেরকে একজন প্রতিভাধর এবং মৌলিক চিন্তাবিদ থেকে বঞ্চিত করেছে।          

লেখকদের মতে, ১৮ শতকের জেনেভান দার্শনিক জ্য জাক রুশোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ডন অফ এভরিথিং-এর বেশিরভাগ অংশই পড়া যেতে পারে, যার ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অ্যান্ড দ্য ফাউন্ডেশন অফ ইনইকুয়ালিটি অভ হিউম্যানিটি। তাদের বিশ্বাস যে ১৭৫৫ সালে রচিত রুশোর এই তত্ত্ব  সমাজ-তাত্ত্বিকদের বিভ্রান্ত করেছে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ থমাস হবস, বিখ্যাত বই লেভিয়াথান (১৬৫১)-এ  ঘোষণা করেছিলেন যে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ জীবন ছিল ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত’। হবস ও রুশো উভয়ের মতকেই তারা বিশেষ আপত্তিকর বলে মনে করে।  হবস এবং রুশো একমত হয়ে যান। তাদের মতে দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে পরবর্তীরা বিদ্রোহ করেছিল যা হবসের মতে সভ্য জীবনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর মতে, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে হবস এবং রুশো উভয়ের তত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করা উচিত কারণ তারা প্রাথমিক মানব ইতিহাসের যে বিবরণ দিয়েছে তা কেবল সত্য নয়, তার ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এবং অতীতকে করে নিস্তেজ।    

তত্ত্বগুলি মারাত্মক অকেজো হওয়ার কারণে হবস এবং রুশোর তত্ত্বগুলি নিয়ে লেখকদের নিন্দা বেশ লক্ষ্য করার মতো। যদি তাদের ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে এই বিষয়টির এখানেই শেষ হওয়া উচিত কেননা মানব ইতিহাস সম্পর্কে আসল সত্য অনুপ্রেরণামূলক, বা উত্তেজনাপূর্ণ হবার প্রয়োজন নেই। সত্য সর্বদা চিরন্তন।  এটিকে অনুসরণ করা হলে তখন  তা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে।   

হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, লেখকের মানবতার নতুন ইতিহাস রুশোর সামাজিক বৈষম্যের অরিজিনের গল্পের মতো শোনাচ্ছে, যা এমন অনেকের দ্বারা গৃহীত হয়েছে যারা তার লেখার একটি শব্দও পড়েননি। রুশোর বিবরণে, মানুষ তাদের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে শিকারী-সংগ্রাহকদের ছোট সমতাবাদী দলে বসবাস করেছিল। তারপর তারা কৃষক হয়ে ওঠে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, শহরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অসমতা এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। 


গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো রুশোর বয়ানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেন। মানুষ তাদের বিবর্তনের বেশিরভাগ সময় ছোট ছোট দলে বসবাস করেনি;  সামাজিক বিবর্তনে কৃষি একটি পরিবর্তনীয় পর্যায় ছিল; এবং আদি শহরগুলি কখনও কখনও দৃঢ়ভাবে সমতাবাদী ছিল।  তখন আদি মানুষেরা সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। রুশোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা যেতে পারে, সমাজের তখন কোন ‘প্রকৃত রূপ’ ছিল না।  

১৮ শতকের দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যত বেশি সভ্য হয়ে উঠছে তারা তাদের নিজস্ব প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ হারিয়েছে এবং একে অপরকে অনুকরণ করতে শুরু করেছে। রুশোর জন্য, এটি ছিল মানুষের আদিপাপ – যে ত্রুটি থেকে সমাজের সমস্ত ত্রুটিগুলি সৃষ্টি হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, হবসের মতে, মানুষ প্রথমে একটি প্রাক-সামাজিক অবস্থায় বাস করেছিল। তারপর তারা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল যা ইতিহাস তৈরি করেছে।  অন্যদিকে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর বিশ্বাস প্রকৃতির এমন প্রাক-সামাজিক অবস্থা কখনও ছিলই না কেননা  মানুষ মূলত সামাজিক জীব। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, লেখকরা যাকে তাদের আদিম স্বাধীনতা বলে মনে করেন তারা কেন তা ত্যাগ করলেন?     

প্রাচীন মিশর থেকে নিকটবর্তী প্রাচ্য, ভারত এবং চীন পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো দেখান যেখানে তারা বিশেষত আমেরিকার আদিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এই নিবন্ধনে সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি বিশাল বৈচিত্র্য ছিল। বছরের সময়ের উপর নির্ভর করে কিছু গোষ্ঠীতে শাসনের বিভিন্ন রূপ ছিল—গোষ্ঠীগুলো  শিকারের মৌসুমে আরও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত থাকতো। অন্যথায় তারা থাকতো অত্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত। তাদের ভেতর কেউ কেউ দাস রাখতো, কেউ রাখতো না। চোরাচালানকারীরা তখন হয়তো ছোট দলে সংগটিত হতো কিন্তু তাদের ছিল দূরবর্তী নেটওয়ার্ক। সে সময়ে অনেক ধরণের প্রাচীন সমাজ ছিল, মানুষের প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের সবকটিতেই রাষ্ট্রের স্থায়ী শ্রেণিবিন্যাস ছিল না।       

   

এই পর্যায়ে এসে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর সভ্যতার নতুন ইতিহাস নিয়ে হওয়া বিড়ম্বনার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও তাদের যুক্তি এমন যে রুশোর আদিম সমাজের ধারাবাহিক বিবরণ ভুল ছিল। রুশোর বয়ান প্রত্যাখ্যান করার পরে, তাদের এখন নিজেদের একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন যা দিয়ে তারা মানবতার দাসত্বের হদিস ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু এটি পাওয়া যায় না। সাহসী এবং চিন্তায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই বইটির শেষের কয়েক পৃষ্ঠা আগেও তাদের প্রশ্ন : ‘রাষ্ট্রহীন সমাজগুলি যদি নিয়মিতভাবে নিজেদেরকে এমনভাবে সংগঠিত করে যে রাষ্ট্র প্রধানদের কোন জবরদস্তি করবার ক্ষমতা থাকে না, তবে তখন সমাজে বা রাষ্ট্রে কী হতে পারে?’       

দ্য ডন অফ এভ্রিথিং বইয়ের প্রচ্ছদ

   

ইতিহাস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসারের বিষয়টি তাদের কাছে রুশোর বয়ানের চেয়ে ‘আরও দুঃখজনক’ বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানবসমাজ আসলে কেমন তা নিয়ে আমরা আমূল ভিন্ন ধারণার অধীনে আমরা বসবাস করতে পারতাম। অর্থাৎ গণদাসত্ব, গণহত্যা, কারাগার, এমনকি পিতৃতন্ত্র বা মজুরি শ্রমের শোষণ কখনও ঘটবার ছিলো না। আবার অন্যদিকে, এখনও যে মানুষের ইতিবাচক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি—সে ইশারাও দেয়।    

অন্যভাবে বললে, যেকোনো বিবেচনায় প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে বড়সড় একটি ভুল ছিল। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই অরাজপন্থী, কিন্তু গত কয়েক হাজার বছর ধরে অধিকাংশ মানুষই দাসত্বের মধ্যে বসবাস করছে। ২১ শতকের সামাজিক আন্দোলনে, আমরা মানবজাতি সবচেয়ে মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃআবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসেছি যা ‘সামাজিক বাস্তবতার নতুন এবং বিভিন্ন রূপ তৈরি করার স্বাধীনতা’ হিসেবে জায়গা পেয়েছিল। লেখকদের মতে, ‘আমাদের সংশোধনবাদী ইতিহাসের অনিবার্য প্রভাব এই সামাজিক আন্দোলন।’          


লেখকদ্বয় আমাদেরকে জানান, আদিম স্বাধীনতাকে যে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষভাবে তারা, যারা আনুগত্যের জন্য প্রশিক্ষিত নয় (যেমন এই বইটি পড়ার জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই ছিল)। এখানে তারা পৃষ্ঠপোষকতামূলক ঘৃণার সাথে পৃথিবীর নিপীড়িত ও হতভাগাদের মুক্তি দেবার প্রস্তাব করেন যা উগ্র তাত্ত্বিকদের বৈশিষ্ট্য। মানবজাতির জনসাধারণ, যাইহোক, হুইপেট নয়: তারা বোঝে, আদর্শগত স্বপ্নদর্শীদের চেয়ে, বিরোধপূর্ণ চাহিদাগুলি যে জটিল এবং প্রায়শই পরস্পর-বিরোধী বিশ্বে তারা বাস করে সেখানে স্বাধীনতাকে রূপ দেয়।  

নতুন এই ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রুশোর অসমতার ইতিহাসের মতোই, এর বেশিরভাগই অত্যন্ত অনুমানমূলক। লেখকরা এটি স্বীকার করেছেন: ‘অধিকাংশ মানববেতিহাস আমাদের কাছে অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে। আমাদের প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স, অন্তত ২০০০০০ বছর ধরে বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই সময়ের বেশিরভাগ সময় কি ঘটছে তা আমরা জানি না।’  কিন্তু ইতিহাসে যদি এত খালি পাতা থাকে, তাহলে তারা কীভাবে নিশ্চিত হবে যে মানুষ সহজাতভাবেই অরাজপন্থী? পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায় হবস-সুলভ চিন্তার আবির্ভাবকেও তারা প্রমাণ হিসেবে উপেক্ষা করেন।   


তাদের বই পড়লে আপনার মনে হবে হবসীয় চিন্তাভাবনা ছিল পশ্চিমা মননের অদ্ভুত এক বিকৃতি। অথচ চীনা আইনবিদ হান ফেই প্রায় ২ হাজার বছর আগে একই ধরণের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন এবং একই সময়ে ভারতীয় লেখক কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র বইয়ে রাজনৈতিক বাস্তববাদের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। এই লেখাগুলি ইশারা দেয় যে হবস যে রাজনৈতিক বিষয়গুলি মোকাবেলা করেছিলেন – মানবপ্রকৃতি, স্বাধীনতা, যুদ্ধ, নিরাপত্তা, ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র – তা ‘মালিকানামূলক ব্যক্তিবাদ’ (‘পজেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিজম’) দিয়ে জর্জরিত প্রাথমিক আধুনিক পশ্চিমা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যেমনটি মার্কসবাদী স্কলার সি বি ম্যাকফারসন এক সময়ের প্রভাবশালী রচনায় দাবি করেছিলেন। ১৯৬২ সালের এই গবেষণাকর্ম  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো উৎসাহের সঙ্গে উদ্ধৃত করেন।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

হবস বিশ্বাস করতেন যে মানুষ ‘ক্ষমতার পরে ক্ষমতার জন্য অস্থির  ও অনন্ত এক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা আবিষ্ট হয় যা শুধুমাত্র মৃত্যুতে থেমে যায়’। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা সম্পত্তি জমা করার প্ররোচনা দ্বারা চালিত হয় না, যেমন গ্রেবার এবং ওয়েংরো দাবি করেন, বা প্রধানত অহংবোধ দ্বারা চালিত হয়, যেমন হবস নিজেই কখনও কখনও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা যে প্ররোচনা দ্বারাই চালিত হোক না কেন – হিংসাত্মক মৃত্যুর বিপদ, জীবনযাত্রার একটি উপায় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বা প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন – মানুষ অন্য মানুষের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। আগ্রাসী লোভ নয়, ভয়ই প্রকৃত হবসীয় আবেগ।       

এই হবসিয়ান আবশ্যিকতা ‘রাষ্ট্র-ছাড়া-সমাজ’ গঠনের আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প অরাজপন্থার (এনার্কিজম) চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। খুব কমই নির্ভরযোগ্যভাবে অকার্যকর। অরাজপন্থীদের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রুরাও অত্যাচারী নয় যাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল। যদি বিপ্লবগুলি প্রায়শই এমন শাসনের পরিণতি ঘটায় যেগুলি উৎখাত হওয়া শাসনের চেয়ে বেশি দমনমূলক, তবে একটি বড় কারণ হল ক্ষমতার জন্য বাধাহীন লড়াই যা সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী আন্দোলনগুলির মধ্যে ঘটেছিল।

অরাজপন্থী আন্দোলনগুলি ২০ শতকে মাত্র দুই বার বড় আকারের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিলুপ্ত হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে, রাশিয়ার অরাজপন্থী  কৃষ্ণাঙ্গ বাহিনী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং বলশেভিকরা প্রতি-বিপ্লবী শ্বেতাঙ্গদের দমনে রেড আর্মিকে সাহায্য করার পর তাদের কমান্ডারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে, অরাজপন্থী মিলিশিয়ারা প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারপর সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত সামরিক ইউনিট দ্বারা শোষিত হয়। রাষ্ট্রহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা নিয়মিতভাবে পরাজিত হয়েছে উন্নততর সংগঠিত এবং আরও নির্মম বিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রের মতো কাজ ক’রে। 

রাষ্ট্রহীন একটি অঞ্চল সৃষ্টি হলে, তখন রাষ্ট্রটির টিকে থাকা তার চারপাশের রাজ্যগুলির উপর নির্ভর করে। উত্তর সিরিয়ার কুর্দি রোজাভা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ঘটনা এমন। ২০১৪ সালে গ্রেবার এই অঞ্চলটি ঘুরে এসেছিলেন। অঞ্চলটিকে তিনি অরাজপন্থার একটি প্র্যাক্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট বলে দাবি করেছিলেন। (এই অঞ্চলটির কারারুদ্ধ নেতা আবদুল্লাহ ওকালান আমেরিকান তাত্ত্বিক মারে বুকচিনের (1921-2006) ‘অনটন-উত্তর অরাজপন্থা’-এর
প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। ফলে গ্রেবারের মতের কিছু ভিত্তি রয়েছে।) রোজাভার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ার বাশার আল- আসাদ ও কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের উপর। এই অঞ্চলের এখনও বাশারের বাহিনী ও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। বুকচিনের অরাজপন্থায়  পরিবেশগত চাহিদার থাকা সত্ত্বেও,  করুণ ব্যাপার হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি হল এই অঞ্চলের প্রধান সম্পদ।                     

রোজাভা এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে শেষ হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তেলক্ষেত্র নিয়ে কোনো দ্বন্দ্বে, রোজাভাকেও অপরাপর রাষ্ট্রের মতো, এই অঞ্চলের অন্যদের সাথে জোট গঠন করে, প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, অন্যথায় এটি অদৃশ্য হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, রোজাভা অনিবার্য ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধরত রাষ্ট্রের বিশ্বে শান্তিপূর্ণ অরাজপন্থার (নৈরাজ্যের) কোনো জায়গা নেই।      

খুব সম্ভব, আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকায়, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট দ্বারা তৈরি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ব্যর্থ হয়নি বরং কেবল বিবর্ণ হয়েছে। আমেরিকান শহরগুলিতে সম্প্রতি যে অঞ্চলগুলি আবির্ভূত হয়েছে সেগুলি একটি ভিন্ন গতিপথ অনুসরণ করে। তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া, এবং এই লক্ষ্য অন্তত আংশিকভাবে অর্জনযোগ্য। বাস্তবে, এটি রাষ্ট্রকে বেসরকারিকরনের নব্য উদারনৈতিক কর্মসূচিরই এক ধরণের  সম্প্রসারণ। পুলিশ বাহিনী হারিয়ে যায় না, ক্ষমতাবানদের সেবায় নিয়োজিত সিকিউরিটি কোম্পানিতে পরিণত হয়। বাকিরা পড়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব  নিজেরাই নিয়ে আর সংগঠিত অপরাধচক্র ও গ্যাং শাসনের মানিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে যা যা করতে হয় করে। 

মাঝেমধ্যেই গ্রেবার এবং ওয়েংগ্রো সাম্প্রতিক ইতিহাসের নব্য-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি চলে আসেন। তারা স্পষ্ট অনুমোদনের সাথে খেয়াল করেন যে এখন দুনিয়াজুড়ে আমলাতন্ত্র রয়েছে (সরকারি এবং ব্যক্তিগত, IMF এবং WTO থেকে JP Morgan Chase এবং বিভিন্ন ক্রেডিট-রেটিং সংস্থা)… ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি পর্যন্ত সবকিছুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে।       

কিন্তু ইতিহাস চলছে উল্টো পথে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক সীমানা পুনঃস্থাপন করছে, সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তার স্বার্থে বৈশ্বিক বাণিজ্য  ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রবণতাগুলি মহামারী দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বৃদ্ধি ২০০৭-৮ এ ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন সরকারগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক পতন রোধ করতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সহায়তা করেছিলো। 

গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো নব্য উদারপন্থীদের সাথে কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি চিহ্নিত শত্রুতা ভাগ করে নেন। যেটিকে তারা শ্রমজীবী ​​শ্রেণীর আত্ম-উন্নয়নকে ক্ষুণ্ন করে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেন। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলি সাধারণ মানুষের জন্য যে সুবিধাসমূহ নিয়ে এসেছিল তারা লক্ষ্য করতে ভুলে যান।  উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য দাতব্য এবং বীমার প্যাচওয়ার্কের উপর নির্ভর করা থেকে স্বাধীনতা। মানুষের স্বাধীনতা জটিল বিষয়। এনএইচএস  বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত তৎকালীন শক্তিশালী ব্রিটিশ রাষ্ট্র থেকে, এনএইচএস আবির্ভূত হয়েছিল। অনেক মন্দ রাষ্ট্রের সাথে করে এসেছে, তবে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ভালো দিকও রয়েছে। অদ্ভুত লাগলেও সত্যি হচ্ছে এই কারণেই মানুষ রাষ্ট্রের দ্বারা শাসিত হতে ইচ্ছুক।        

লেখকরা অতীত এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন অস্বস্তিকর, দোকানে বিক্রিত মতামত এবং রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর মিথের নিন্দা করেছেন। তারা মনে করেন যে প্রাথমিক মানবসমাজগুলি সাধারণভাবে অনুমিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং কখনও কখনও পরীক্ষামূলক ছিল। তবুও গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো যা করেছেন তা হল রুশো এবং তার অনেক অজান্তে শিষ্যদের দ্বারা প্রচারিত একটি পরিচিত মিথকে পুনরায় সাজানো: এই বিশ্বাস যে মানবজাতি তার ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ‘আটকে’ আছে। স্বাধীনতা এবং মৈত্রীর একটি আসল শর্ত কখনও বিদ্যমান ছিল বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আমরা সবসময় যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, আমাদের অসুবিধাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি আর কোনো না কোনোভাবে তা কাটিয়ে উঠছি।

[ নিউ স্টেটসম্যান– এ প্রকাশিত লেখাটি সেমসেম-এর জন্য ভাষান্তর করেছেন অর্নি শওকত]       

থেকে আরও পড়ুন

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।