মানব সমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে: পুরনো বয়ানকে চ্যালেঞ্জ 

IMG-20240308-WA0035-01
অর্নি শওকত
john-gray profile pics
জন গ্রে
দার্শনিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

আমরা বর্তমানে আটকে আছি কোথায়? প্রয়াত ডেভিড গ্রেবার এবং তার সহ-লেখক ডেভিড ওয়েনগ্রোর মতে, একে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে ধরা যেতে পারে। ‘মানুষের বিস্তৃত সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য, আমরা মূলত উপভোগ করেছি ‘তিনটি আদিম স্বাধীনতা’: ‘চলবার স্বাধীনতা, অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি বা রূপান্তর করার স্বাধীনতা’। আজ আমরা যাকে অসমতা বা অরাজকতা হিসাবে বর্ণনা করবো, আদিম মানব সমাজের অস্তিত্ব কিন্তু এই অসমতা ছাড়া ছিল না, এমনকি তাদের আধিপত্যের জোরের অভাব ছিল যার মিল আমরা পাই শ্রেণিবদ্ধ সরকারের সাথে। বলা যেতে পারে মানবজাতি সবসময় একটি শান্তিপূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করত।     

তারপর কিছু ‘ভয়ংকর ভুল’ হলো।  

স্পষ্ট যে মানব সমাজে কিছু  পরিবর্তন সত্যিই ঘটেছে এবং তা ঘটেছে গভীরভাবেই। তিনটি মৌলিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে আজ বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে কিভাবে মানবজাতি একটি সামাজিক ব্যবস্থার ভেতর বাস করতো। আসলে কিভাবে ঘটেছে? আমরা কিভাবে আটকে গেলাম? এবং ঠিক কিভাবে আমরা ভিন্ন এক পথে চলে এলাম?       

লেখকদের এই প্রশ্নগুলি কেবল তাদের পাণ্ডিত্যের প্রচেষ্টা থেকে এসেছে এমন নয়। গ্রেবার লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স (এলএসই) এর নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে, ওয়েনগ্রো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে, এমনকি একজন কর্মী হিসাবে গ্রেবারের ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকেও এই প্রশ্নগুলো এসেছে।  গ্রেবার ২০১১ সালের সেই কিশোর বয়স থেকেই একজন অরাজপন্থী (এনার্কিস্ট) গ্রেবার, ২০১১ সালের ওকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার একাডেমিক কাজ এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিল, যা তার কর্মজীবনে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারে। ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি শ্রমিক ​​পরিবারে তার জন্ম। ফিলিপস একাডেমি অ্যান্ডোভারে পড়াশুনা শেষ করেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল রিসার্স চালিয়ে যান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন এবং তার কর্মক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাকে মেয়াদের জন্য আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একাডেমিক অবস্থান খুঁজে পেতে তিনি অক্ষম হয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতটা বিবাদী মনের ছিল না। ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে এলএসই’র অধ্যাপক হন।      

দুই ডেভিড: গ্রেবার ও ওয়েংগ্রো। ফটো ক্রেডিট: কল্পেশ লাথিগ্রা


একাডেমিতে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐক্যমত্য এবং তার ফলস্বরূপ যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বলে বিশ্বাস — গ্রেবারের কাজ উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করে।  ২০০৪ সালে তিনি ফ্র্যাগমেন্টস অভ এ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপলজি নামে  ছোট একটি বই প্রকাশ করেন। একে বলা যেতে পারে ওয়েনগ্রোর সাথে দশ বছর ধরে সহলেখক হিসেবে লিখিত আরও পদ্ধতিগত গবেষণার বই ডন অভ এভ্রিথিং– এর একটি মুখবন্ধ। অন্যান্য বইয়ের  মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট অ্যাকশন: অ্যান এথনোগ্রাফি (২০০৯), ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ডেট: ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ার্স  (২০১১) এবং বুলশিট জবস: এ থিওরি (২০১৮)। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেক্রোটিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে আকস্মিকভাবে গ্রেবার মারা যান। তার অকাল প্রয়াণ আমাদেরকে একজন প্রতিভাধর এবং মৌলিক চিন্তাবিদ থেকে বঞ্চিত করেছে।          

লেখকদের মতে, ১৮ শতকের জেনেভান দার্শনিক জ্য জাক রুশোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ডন অফ এভরিথিং-এর বেশিরভাগ অংশই পড়া যেতে পারে, যার ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অ্যান্ড দ্য ফাউন্ডেশন অফ ইনইকুয়ালিটি অভ হিউম্যানিটি। তাদের বিশ্বাস যে ১৭৫৫ সালে রচিত রুশোর এই তত্ত্ব  সমাজ-তাত্ত্বিকদের বিভ্রান্ত করেছে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ থমাস হবস, বিখ্যাত বই লেভিয়াথান (১৬৫১)-এ  ঘোষণা করেছিলেন যে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ জীবন ছিল ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত’। হবস ও রুশো উভয়ের মতকেই তারা বিশেষ আপত্তিকর বলে মনে করে।  হবস এবং রুশো একমত হয়ে যান। তাদের মতে দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে পরবর্তীরা বিদ্রোহ করেছিল যা হবসের মতে সভ্য জীবনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর মতে, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে হবস এবং রুশো উভয়ের তত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করা উচিত কারণ তারা প্রাথমিক মানব ইতিহাসের যে বিবরণ দিয়েছে তা কেবল সত্য নয়, তার ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এবং অতীতকে করে নিস্তেজ।    

তত্ত্বগুলি মারাত্মক অকেজো হওয়ার কারণে হবস এবং রুশোর তত্ত্বগুলি নিয়ে লেখকদের নিন্দা বেশ লক্ষ্য করার মতো। যদি তাদের ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে এই বিষয়টির এখানেই শেষ হওয়া উচিত কেননা মানব ইতিহাস সম্পর্কে আসল সত্য অনুপ্রেরণামূলক, বা উত্তেজনাপূর্ণ হবার প্রয়োজন নেই। সত্য সর্বদা চিরন্তন।  এটিকে অনুসরণ করা হলে তখন  তা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে।   

হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, লেখকের মানবতার নতুন ইতিহাস রুশোর সামাজিক বৈষম্যের অরিজিনের গল্পের মতো শোনাচ্ছে, যা এমন অনেকের দ্বারা গৃহীত হয়েছে যারা তার লেখার একটি শব্দও পড়েননি। রুশোর বিবরণে, মানুষ তাদের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে শিকারী-সংগ্রাহকদের ছোট সমতাবাদী দলে বসবাস করেছিল। তারপর তারা কৃষক হয়ে ওঠে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, শহরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অসমতা এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। 


গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো রুশোর বয়ানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেন। মানুষ তাদের বিবর্তনের বেশিরভাগ সময় ছোট ছোট দলে বসবাস করেনি;  সামাজিক বিবর্তনে কৃষি একটি পরিবর্তনীয় পর্যায় ছিল; এবং আদি শহরগুলি কখনও কখনও দৃঢ়ভাবে সমতাবাদী ছিল।  তখন আদি মানুষেরা সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। রুশোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা যেতে পারে, সমাজের তখন কোন ‘প্রকৃত রূপ’ ছিল না।  

১৮ শতকের দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যত বেশি সভ্য হয়ে উঠছে তারা তাদের নিজস্ব প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ হারিয়েছে এবং একে অপরকে অনুকরণ করতে শুরু করেছে। রুশোর জন্য, এটি ছিল মানুষের আদিপাপ – যে ত্রুটি থেকে সমাজের সমস্ত ত্রুটিগুলি সৃষ্টি হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, হবসের মতে, মানুষ প্রথমে একটি প্রাক-সামাজিক অবস্থায় বাস করেছিল। তারপর তারা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল যা ইতিহাস তৈরি করেছে।  অন্যদিকে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর বিশ্বাস প্রকৃতির এমন প্রাক-সামাজিক অবস্থা কখনও ছিলই না কেননা  মানুষ মূলত সামাজিক জীব। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, লেখকরা যাকে তাদের আদিম স্বাধীনতা বলে মনে করেন তারা কেন তা ত্যাগ করলেন?     

প্রাচীন মিশর থেকে নিকটবর্তী প্রাচ্য, ভারত এবং চীন পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো দেখান যেখানে তারা বিশেষত আমেরিকার আদিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এই নিবন্ধনে সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি বিশাল বৈচিত্র্য ছিল। বছরের সময়ের উপর নির্ভর করে কিছু গোষ্ঠীতে শাসনের বিভিন্ন রূপ ছিল—গোষ্ঠীগুলো  শিকারের মৌসুমে আরও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত থাকতো। অন্যথায় তারা থাকতো অত্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত। তাদের ভেতর কেউ কেউ দাস রাখতো, কেউ রাখতো না। চোরাচালানকারীরা তখন হয়তো ছোট দলে সংগটিত হতো কিন্তু তাদের ছিল দূরবর্তী নেটওয়ার্ক। সে সময়ে অনেক ধরণের প্রাচীন সমাজ ছিল, মানুষের প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের সবকটিতেই রাষ্ট্রের স্থায়ী শ্রেণিবিন্যাস ছিল না।       

   

এই পর্যায়ে এসে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর সভ্যতার নতুন ইতিহাস নিয়ে হওয়া বিড়ম্বনার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও তাদের যুক্তি এমন যে রুশোর আদিম সমাজের ধারাবাহিক বিবরণ ভুল ছিল। রুশোর বয়ান প্রত্যাখ্যান করার পরে, তাদের এখন নিজেদের একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন যা দিয়ে তারা মানবতার দাসত্বের হদিস ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু এটি পাওয়া যায় না। সাহসী এবং চিন্তায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই বইটির শেষের কয়েক পৃষ্ঠা আগেও তাদের প্রশ্ন : ‘রাষ্ট্রহীন সমাজগুলি যদি নিয়মিতভাবে নিজেদেরকে এমনভাবে সংগঠিত করে যে রাষ্ট্র প্রধানদের কোন জবরদস্তি করবার ক্ষমতা থাকে না, তবে তখন সমাজে বা রাষ্ট্রে কী হতে পারে?’       

দ্য ডন অফ এভ্রিথিং বইয়ের প্রচ্ছদ

   

ইতিহাস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসারের বিষয়টি তাদের কাছে রুশোর বয়ানের চেয়ে ‘আরও দুঃখজনক’ বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানবসমাজ আসলে কেমন তা নিয়ে আমরা আমূল ভিন্ন ধারণার অধীনে আমরা বসবাস করতে পারতাম। অর্থাৎ গণদাসত্ব, গণহত্যা, কারাগার, এমনকি পিতৃতন্ত্র বা মজুরি শ্রমের শোষণ কখনও ঘটবার ছিলো না। আবার অন্যদিকে, এখনও যে মানুষের ইতিবাচক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি—সে ইশারাও দেয়।    

অন্যভাবে বললে, যেকোনো বিবেচনায় প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে বড়সড় একটি ভুল ছিল। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই অরাজপন্থী, কিন্তু গত কয়েক হাজার বছর ধরে অধিকাংশ মানুষই দাসত্বের মধ্যে বসবাস করছে। ২১ শতকের সামাজিক আন্দোলনে, আমরা মানবজাতি সবচেয়ে মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃআবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসেছি যা ‘সামাজিক বাস্তবতার নতুন এবং বিভিন্ন রূপ তৈরি করার স্বাধীনতা’ হিসেবে জায়গা পেয়েছিল। লেখকদের মতে, ‘আমাদের সংশোধনবাদী ইতিহাসের অনিবার্য প্রভাব এই সামাজিক আন্দোলন।’          


লেখকদ্বয় আমাদেরকে জানান, আদিম স্বাধীনতাকে যে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষভাবে তারা, যারা আনুগত্যের জন্য প্রশিক্ষিত নয় (যেমন এই বইটি পড়ার জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই ছিল)। এখানে তারা পৃষ্ঠপোষকতামূলক ঘৃণার সাথে পৃথিবীর নিপীড়িত ও হতভাগাদের মুক্তি দেবার প্রস্তাব করেন যা উগ্র তাত্ত্বিকদের বৈশিষ্ট্য। মানবজাতির জনসাধারণ, যাইহোক, হুইপেট নয়: তারা বোঝে, আদর্শগত স্বপ্নদর্শীদের চেয়ে, বিরোধপূর্ণ চাহিদাগুলি যে জটিল এবং প্রায়শই পরস্পর-বিরোধী বিশ্বে তারা বাস করে সেখানে স্বাধীনতাকে রূপ দেয়।  

নতুন এই ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রুশোর অসমতার ইতিহাসের মতোই, এর বেশিরভাগই অত্যন্ত অনুমানমূলক। লেখকরা এটি স্বীকার করেছেন: ‘অধিকাংশ মানববেতিহাস আমাদের কাছে অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে। আমাদের প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স, অন্তত ২০০০০০ বছর ধরে বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই সময়ের বেশিরভাগ সময় কি ঘটছে তা আমরা জানি না।’  কিন্তু ইতিহাসে যদি এত খালি পাতা থাকে, তাহলে তারা কীভাবে নিশ্চিত হবে যে মানুষ সহজাতভাবেই অরাজপন্থী? পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায় হবস-সুলভ চিন্তার আবির্ভাবকেও তারা প্রমাণ হিসেবে উপেক্ষা করেন।   


তাদের বই পড়লে আপনার মনে হবে হবসীয় চিন্তাভাবনা ছিল পশ্চিমা মননের অদ্ভুত এক বিকৃতি। অথচ চীনা আইনবিদ হান ফেই প্রায় ২ হাজার বছর আগে একই ধরণের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন এবং একই সময়ে ভারতীয় লেখক কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র বইয়ে রাজনৈতিক বাস্তববাদের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। এই লেখাগুলি ইশারা দেয় যে হবস যে রাজনৈতিক বিষয়গুলি মোকাবেলা করেছিলেন – মানবপ্রকৃতি, স্বাধীনতা, যুদ্ধ, নিরাপত্তা, ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র – তা ‘মালিকানামূলক ব্যক্তিবাদ’ (‘পজেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিজম’) দিয়ে জর্জরিত প্রাথমিক আধুনিক পশ্চিমা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যেমনটি মার্কসবাদী স্কলার সি বি ম্যাকফারসন এক সময়ের প্রভাবশালী রচনায় দাবি করেছিলেন। ১৯৬২ সালের এই গবেষণাকর্ম  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো উৎসাহের সঙ্গে উদ্ধৃত করেন।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

হবস বিশ্বাস করতেন যে মানুষ ‘ক্ষমতার পরে ক্ষমতার জন্য অস্থির  ও অনন্ত এক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা আবিষ্ট হয় যা শুধুমাত্র মৃত্যুতে থেমে যায়’। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা সম্পত্তি জমা করার প্ররোচনা দ্বারা চালিত হয় না, যেমন গ্রেবার এবং ওয়েংরো দাবি করেন, বা প্রধানত অহংবোধ দ্বারা চালিত হয়, যেমন হবস নিজেই কখনও কখনও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা যে প্ররোচনা দ্বারাই চালিত হোক না কেন – হিংসাত্মক মৃত্যুর বিপদ, জীবনযাত্রার একটি উপায় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বা প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন – মানুষ অন্য মানুষের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। আগ্রাসী লোভ নয়, ভয়ই প্রকৃত হবসীয় আবেগ।       

এই হবসিয়ান আবশ্যিকতা ‘রাষ্ট্র-ছাড়া-সমাজ’ গঠনের আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প অরাজপন্থার (এনার্কিজম) চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। খুব কমই নির্ভরযোগ্যভাবে অকার্যকর। অরাজপন্থীদের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রুরাও অত্যাচারী নয় যাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল। যদি বিপ্লবগুলি প্রায়শই এমন শাসনের পরিণতি ঘটায় যেগুলি উৎখাত হওয়া শাসনের চেয়ে বেশি দমনমূলক, তবে একটি বড় কারণ হল ক্ষমতার জন্য বাধাহীন লড়াই যা সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী আন্দোলনগুলির মধ্যে ঘটেছিল।

অরাজপন্থী আন্দোলনগুলি ২০ শতকে মাত্র দুই বার বড় আকারের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিলুপ্ত হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে, রাশিয়ার অরাজপন্থী  কৃষ্ণাঙ্গ বাহিনী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং বলশেভিকরা প্রতি-বিপ্লবী শ্বেতাঙ্গদের দমনে রেড আর্মিকে সাহায্য করার পর তাদের কমান্ডারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে, অরাজপন্থী মিলিশিয়ারা প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারপর সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত সামরিক ইউনিট দ্বারা শোষিত হয়। রাষ্ট্রহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা নিয়মিতভাবে পরাজিত হয়েছে উন্নততর সংগঠিত এবং আরও নির্মম বিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রের মতো কাজ ক’রে। 

রাষ্ট্রহীন একটি অঞ্চল সৃষ্টি হলে, তখন রাষ্ট্রটির টিকে থাকা তার চারপাশের রাজ্যগুলির উপর নির্ভর করে। উত্তর সিরিয়ার কুর্দি রোজাভা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ঘটনা এমন। ২০১৪ সালে গ্রেবার এই অঞ্চলটি ঘুরে এসেছিলেন। অঞ্চলটিকে তিনি অরাজপন্থার একটি প্র্যাক্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট বলে দাবি করেছিলেন। (এই অঞ্চলটির কারারুদ্ধ নেতা আবদুল্লাহ ওকালান আমেরিকান তাত্ত্বিক মারে বুকচিনের (1921-2006) ‘অনটন-উত্তর অরাজপন্থা’-এর
প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। ফলে গ্রেবারের মতের কিছু ভিত্তি রয়েছে।) রোজাভার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ার বাশার আল- আসাদ ও কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের উপর। এই অঞ্চলের এখনও বাশারের বাহিনী ও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। বুকচিনের অরাজপন্থায়  পরিবেশগত চাহিদার থাকা সত্ত্বেও,  করুণ ব্যাপার হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি হল এই অঞ্চলের প্রধান সম্পদ।                     

রোজাভা এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে শেষ হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তেলক্ষেত্র নিয়ে কোনো দ্বন্দ্বে, রোজাভাকেও অপরাপর রাষ্ট্রের মতো, এই অঞ্চলের অন্যদের সাথে জোট গঠন করে, প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, অন্যথায় এটি অদৃশ্য হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, রোজাভা অনিবার্য ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধরত রাষ্ট্রের বিশ্বে শান্তিপূর্ণ অরাজপন্থার (নৈরাজ্যের) কোনো জায়গা নেই।      

খুব সম্ভব, আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকায়, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট দ্বারা তৈরি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ব্যর্থ হয়নি বরং কেবল বিবর্ণ হয়েছে। আমেরিকান শহরগুলিতে সম্প্রতি যে অঞ্চলগুলি আবির্ভূত হয়েছে সেগুলি একটি ভিন্ন গতিপথ অনুসরণ করে। তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া, এবং এই লক্ষ্য অন্তত আংশিকভাবে অর্জনযোগ্য। বাস্তবে, এটি রাষ্ট্রকে বেসরকারিকরনের নব্য উদারনৈতিক কর্মসূচিরই এক ধরণের  সম্প্রসারণ। পুলিশ বাহিনী হারিয়ে যায় না, ক্ষমতাবানদের সেবায় নিয়োজিত সিকিউরিটি কোম্পানিতে পরিণত হয়। বাকিরা পড়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব  নিজেরাই নিয়ে আর সংগঠিত অপরাধচক্র ও গ্যাং শাসনের মানিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে যা যা করতে হয় করে। 

মাঝেমধ্যেই গ্রেবার এবং ওয়েংগ্রো সাম্প্রতিক ইতিহাসের নব্য-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি চলে আসেন। তারা স্পষ্ট অনুমোদনের সাথে খেয়াল করেন যে এখন দুনিয়াজুড়ে আমলাতন্ত্র রয়েছে (সরকারি এবং ব্যক্তিগত, IMF এবং WTO থেকে JP Morgan Chase এবং বিভিন্ন ক্রেডিট-রেটিং সংস্থা)… ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি পর্যন্ত সবকিছুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে।       

কিন্তু ইতিহাস চলছে উল্টো পথে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক সীমানা পুনঃস্থাপন করছে, সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তার স্বার্থে বৈশ্বিক বাণিজ্য  ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রবণতাগুলি মহামারী দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বৃদ্ধি ২০০৭-৮ এ ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন সরকারগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক পতন রোধ করতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সহায়তা করেছিলো। 

গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো নব্য উদারপন্থীদের সাথে কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি চিহ্নিত শত্রুতা ভাগ করে নেন। যেটিকে তারা শ্রমজীবী ​​শ্রেণীর আত্ম-উন্নয়নকে ক্ষুণ্ন করে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেন। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলি সাধারণ মানুষের জন্য যে সুবিধাসমূহ নিয়ে এসেছিল তারা লক্ষ্য করতে ভুলে যান।  উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য দাতব্য এবং বীমার প্যাচওয়ার্কের উপর নির্ভর করা থেকে স্বাধীনতা। মানুষের স্বাধীনতা জটিল বিষয়। এনএইচএস  বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত তৎকালীন শক্তিশালী ব্রিটিশ রাষ্ট্র থেকে, এনএইচএস আবির্ভূত হয়েছিল। অনেক মন্দ রাষ্ট্রের সাথে করে এসেছে, তবে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ভালো দিকও রয়েছে। অদ্ভুত লাগলেও সত্যি হচ্ছে এই কারণেই মানুষ রাষ্ট্রের দ্বারা শাসিত হতে ইচ্ছুক।        

লেখকরা অতীত এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন অস্বস্তিকর, দোকানে বিক্রিত মতামত এবং রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর মিথের নিন্দা করেছেন। তারা মনে করেন যে প্রাথমিক মানবসমাজগুলি সাধারণভাবে অনুমিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং কখনও কখনও পরীক্ষামূলক ছিল। তবুও গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো যা করেছেন তা হল রুশো এবং তার অনেক অজান্তে শিষ্যদের দ্বারা প্রচারিত একটি পরিচিত মিথকে পুনরায় সাজানো: এই বিশ্বাস যে মানবজাতি তার ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ‘আটকে’ আছে। স্বাধীনতা এবং মৈত্রীর একটি আসল শর্ত কখনও বিদ্যমান ছিল বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আমরা সবসময় যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, আমাদের অসুবিধাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি আর কোনো না কোনোভাবে তা কাটিয়ে উঠছি।

[ নিউ স্টেটসম্যান– এ প্রকাশিত লেখাটি সেমসেম-এর জন্য ভাষান্তর করেছেন অর্নি শওকত]       

থেকে আরও পড়ুন

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।