মানব সমাজ যেভাবে গড়ে উঠেছে: পুরনো বয়ানকে চ্যালেঞ্জ 

IMG-20240308-WA0035-01
অর্নি শওকত
john-gray profile pics
জন গ্রে
দার্শনিক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

আমরা বর্তমানে আটকে আছি কোথায়? প্রয়াত ডেভিড গ্রেবার এবং তার সহ-লেখক ডেভিড ওয়েনগ্রোর মতে, একে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে ধরা যেতে পারে। ‘মানুষের বিস্তৃত সামাজিক অভিজ্ঞতা’ অর্জনের জন্য, আমরা মূলত উপভোগ করেছি ‘তিনটি আদিম স্বাধীনতা’: ‘চলবার স্বাধীনতা, অবাধ্য হওয়ার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সম্পর্ক তৈরি বা রূপান্তর করার স্বাধীনতা’। আজ আমরা যাকে অসমতা বা অরাজকতা হিসাবে বর্ণনা করবো, আদিম মানব সমাজের অস্তিত্ব কিন্তু এই অসমতা ছাড়া ছিল না, এমনকি তাদের আধিপত্যের জোরের অভাব ছিল যার মিল আমরা পাই শ্রেণিবদ্ধ সরকারের সাথে। বলা যেতে পারে মানবজাতি সবসময় একটি শান্তিপূর্ণ নৈরাজ্যের মধ্যে বাস করত।     

তারপর কিছু ‘ভয়ংকর ভুল’ হলো।  

স্পষ্ট যে মানব সমাজে কিছু  পরিবর্তন সত্যিই ঘটেছে এবং তা ঘটেছে গভীরভাবেই। তিনটি মৌলিক স্বাধীনতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে, যেখানে আজ বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষ জানেই না যে কিভাবে মানবজাতি একটি সামাজিক ব্যবস্থার ভেতর বাস করতো। আসলে কিভাবে ঘটেছে? আমরা কিভাবে আটকে গেলাম? এবং ঠিক কিভাবে আমরা ভিন্ন এক পথে চলে এলাম?       

লেখকদের এই প্রশ্নগুলি কেবল তাদের পাণ্ডিত্যের প্রচেষ্টা থেকে এসেছে এমন নয়। গ্রেবার লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স (এলএসই) এর নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে, ওয়েনগ্রো ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক হিসাবে, এমনকি একজন কর্মী হিসাবে গ্রেবারের ব্যক্তিগত ইতিহাস থেকেও এই প্রশ্নগুলো এসেছে।  গ্রেবার ২০১১ সালের সেই কিশোর বয়স থেকেই একজন অরাজপন্থী (এনার্কিস্ট) গ্রেবার, ২০১১ সালের ওকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তার একাডেমিক কাজ এবং রাজনৈতিক সক্রিয়তা ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত ছিল, যা তার কর্মজীবনে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল তার কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পারে। ১৯৬১ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে একটি শ্রমিক ​​পরিবারে তার জন্ম। ফিলিপস একাডেমি অ্যান্ডোভারে পড়াশুনা শেষ করেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল রিসার্স চালিয়ে যান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেন। ছাত্রদের কাছ থেকে শক্তিশালী সমর্থন এবং তার কর্মক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাকে মেয়াদের জন্য আবেদন করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একাডেমিক অবস্থান খুঁজে পেতে তিনি অক্ষম হয়েছিলেন। সৌভাগ্যবশত, ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এতটা বিবাদী মনের ছিল না। ২০০৮ সালে তিনি লন্ডনের গোল্ডস্মিথ কলেজে যোগদান করেন এবং ২০১৩ সালে এলএসই’র অধ্যাপক হন।      

দুই ডেভিড: গ্রেবার ও ওয়েংগ্রো। ফটো ক্রেডিট: কল্পেশ লাথিগ্রা


একাডেমিতে বুদ্ধিবৃত্তিক ঐক্যমত্য এবং তার ফলস্বরূপ যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে বলে বিশ্বাস — গ্রেবারের কাজ উভয়কেই চ্যালেঞ্জ করে।  ২০০৪ সালে তিনি ফ্র্যাগমেন্টস অভ এ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপলজি নামে  ছোট একটি বই প্রকাশ করেন। একে বলা যেতে পারে ওয়েনগ্রোর সাথে দশ বছর ধরে সহলেখক হিসেবে লিখিত আরও পদ্ধতিগত গবেষণার বই ডন অভ এভ্রিথিং– এর একটি মুখবন্ধ। অন্যান্য বইয়ের  মধ্যে রয়েছে ডিরেক্ট অ্যাকশন: অ্যান এথনোগ্রাফি (২০০৯), ব্যাপকভাবে প্রশংসিত ডেট: ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ার্স  (২০১১) এবং বুলশিট জবস: এ থিওরি (২০১৮)। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে নেক্রোটিক প্যানক্রিয়াটাইটিসে আকস্মিকভাবে গ্রেবার মারা যান। তার অকাল প্রয়াণ আমাদেরকে একজন প্রতিভাধর এবং মৌলিক চিন্তাবিদ থেকে বঞ্চিত করেছে।          

লেখকদের মতে, ১৮ শতকের জেনেভান দার্শনিক জ্য জাক রুশোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ডন অফ এভরিথিং-এর বেশিরভাগ অংশই পড়া যেতে পারে, যার ডিসকোর্স অন দ্য অরিজিন অ্যান্ড দ্য ফাউন্ডেশন অফ ইনইকুয়ালিটি অভ হিউম্যানিটি। তাদের বিশ্বাস যে ১৭৫৫ সালে রচিত রুশোর এই তত্ত্ব  সমাজ-তাত্ত্বিকদের বিভ্রান্ত করেছে। ব্রিটিশ চিন্তাবিদ থমাস হবস, বিখ্যাত বই লেভিয়াথান (১৬৫১)-এ  ঘোষণা করেছিলেন যে ‘প্রকৃতির রাজ্যে’ জীবন ছিল ‘নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, কদর্য, পাশবিক এবং সংক্ষিপ্ত’। হবস ও রুশো উভয়ের মতকেই তারা বিশেষ আপত্তিকর বলে মনে করে।  হবস এবং রুশো একমত হয়ে যান। তাদের মতে দমনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিরুদ্ধে পরবর্তীরা বিদ্রোহ করেছিল যা হবসের মতে সভ্য জীবনের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচিত।  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর মতে, নাগরিক সমাজ এবং রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্পর্কে হবস এবং রুশো উভয়ের তত্ত্বই প্রত্যাখ্যান করা উচিত কারণ তারা প্রাথমিক মানব ইতিহাসের যে বিবরণ দিয়েছে তা কেবল সত্য নয়, তার ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এবং অতীতকে করে নিস্তেজ।    

তত্ত্বগুলি মারাত্মক অকেজো হওয়ার কারণে হবস এবং রুশোর তত্ত্বগুলি নিয়ে লেখকদের নিন্দা বেশ লক্ষ্য করার মতো। যদি তাদের ভুল প্রমাণ করা যায়, তাহলে এই বিষয়টির এখানেই শেষ হওয়া উচিত কেননা মানব ইতিহাস সম্পর্কে আসল সত্য অনুপ্রেরণামূলক, বা উত্তেজনাপূর্ণ হবার প্রয়োজন নেই। সত্য সর্বদা চিরন্তন।  এটিকে অনুসরণ করা হলে তখন  তা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করে।   

হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে, লেখকের মানবতার নতুন ইতিহাস রুশোর সামাজিক বৈষম্যের অরিজিনের গল্পের মতো শোনাচ্ছে, যা এমন অনেকের দ্বারা গৃহীত হয়েছে যারা তার লেখার একটি শব্দও পড়েননি। রুশোর বিবরণে, মানুষ তাদের ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ধরে শিকারী-সংগ্রাহকদের ছোট সমতাবাদী দলে বসবাস করেছিল। তারপর তারা কৃষক হয়ে ওঠে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব ঘটে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, শহরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং অসমতা এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের সাথে সাথে সভ্যতার বিকাশ ঘটে। 


গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো রুশোর বয়ানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরোধিতা করেন। মানুষ তাদের বিবর্তনের বেশিরভাগ সময় ছোট ছোট দলে বসবাস করেনি;  সামাজিক বিবর্তনে কৃষি একটি পরিবর্তনীয় পর্যায় ছিল; এবং আদি শহরগুলি কখনও কখনও দৃঢ়ভাবে সমতাবাদী ছিল।  তখন আদি মানুষেরা সামাজিক সংগঠনের বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিল। রুশোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা যেতে পারে, সমাজের তখন কোন ‘প্রকৃত রূপ’ ছিল না।  

১৮ শতকের দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন যে মানুষ যত বেশি সভ্য হয়ে উঠছে তারা তাদের নিজস্ব প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ হারিয়েছে এবং একে অপরকে অনুকরণ করতে শুরু করেছে। রুশোর জন্য, এটি ছিল মানুষের আদিপাপ – যে ত্রুটি থেকে সমাজের সমস্ত ত্রুটিগুলি সৃষ্টি হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, হবসের মতে, মানুষ প্রথমে একটি প্রাক-সামাজিক অবস্থায় বাস করেছিল। তারপর তারা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছিল যা ইতিহাস তৈরি করেছে।  অন্যদিকে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর বিশ্বাস প্রকৃতির এমন প্রাক-সামাজিক অবস্থা কখনও ছিলই না কেননা  মানুষ মূলত সামাজিক জীব। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে, লেখকরা যাকে তাদের আদিম স্বাধীনতা বলে মনে করেন তারা কেন তা ত্যাগ করলেন?     

প্রাচীন মিশর থেকে নিকটবর্তী প্রাচ্য, ভারত এবং চীন পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো দেখান যেখানে তারা বিশেষত আমেরিকার আদিবাসীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। এই নিবন্ধনে সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি বিশাল বৈচিত্র্য ছিল। বছরের সময়ের উপর নির্ভর করে কিছু গোষ্ঠীতে শাসনের বিভিন্ন রূপ ছিল—গোষ্ঠীগুলো  শিকারের মৌসুমে আরও দৃঢ়ভাবে সংগঠিত থাকতো। অন্যথায় তারা থাকতো অত্যন্ত বিকেন্দ্রীকৃত। তাদের ভেতর কেউ কেউ দাস রাখতো, কেউ রাখতো না। চোরাচালানকারীরা তখন হয়তো ছোট দলে সংগটিত হতো কিন্তু তাদের ছিল দূরবর্তী নেটওয়ার্ক। সে সময়ে অনেক ধরণের প্রাচীন সমাজ ছিল, মানুষের প্রয়োজন এবং পরিস্থিতির সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হয়েছিল, কিন্তু তাদের সবকটিতেই রাষ্ট্রের স্থায়ী শ্রেণিবিন্যাস ছিল না।       

   

এই পর্যায়ে এসে গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রোর সভ্যতার নতুন ইতিহাস নিয়ে হওয়া বিড়ম্বনার কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদিও তাদের যুক্তি এমন যে রুশোর আদিম সমাজের ধারাবাহিক বিবরণ ভুল ছিল। রুশোর বয়ান প্রত্যাখ্যান করার পরে, তাদের এখন নিজেদের একটি ব্যাখ্যার প্রয়োজন যা দিয়ে তারা মানবতার দাসত্বের হদিস ব্যাখ্যা করবেন কিন্তু এটি পাওয়া যায় না। সাহসী এবং চিন্তায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই বইটির শেষের কয়েক পৃষ্ঠা আগেও তাদের প্রশ্ন : ‘রাষ্ট্রহীন সমাজগুলি যদি নিয়মিতভাবে নিজেদেরকে এমনভাবে সংগঠিত করে যে রাষ্ট্র প্রধানদের কোন জবরদস্তি করবার ক্ষমতা থাকে না, তবে তখন সমাজে বা রাষ্ট্রে কী হতে পারে?’       

দ্য ডন অফ এভ্রিথিং বইয়ের প্রচ্ছদ

   

ইতিহাস সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সংক্ষিপ্তসারের বিষয়টি তাদের কাছে রুশোর বয়ানের চেয়ে ‘আরও দুঃখজনক’ বলে মনে হয়। অর্থাৎ মানবসমাজ আসলে কেমন তা নিয়ে আমরা আমূল ভিন্ন ধারণার অধীনে আমরা বসবাস করতে পারতাম। অর্থাৎ গণদাসত্ব, গণহত্যা, কারাগার, এমনকি পিতৃতন্ত্র বা মজুরি শ্রমের শোষণ কখনও ঘটবার ছিলো না। আবার অন্যদিকে, এখনও যে মানুষের ইতিবাচক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি—সে ইশারাও দেয়।    

অন্যভাবে বললে, যেকোনো বিবেচনায় প্রচলিত ইতিহাসের বয়ানে বড়সড় একটি ভুল ছিল। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই অরাজপন্থী, কিন্তু গত কয়েক হাজার বছর ধরে অধিকাংশ মানুষই দাসত্বের মধ্যে বসবাস করছে। ২১ শতকের সামাজিক আন্দোলনে, আমরা মানবজাতি সবচেয়ে মৌলিক স্বাধীনতা পুনঃআবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে এসেছি যা ‘সামাজিক বাস্তবতার নতুন এবং বিভিন্ন রূপ তৈরি করার স্বাধীনতা’ হিসেবে জায়গা পেয়েছিল। লেখকদের মতে, ‘আমাদের সংশোধনবাদী ইতিহাসের অনিবার্য প্রভাব এই সামাজিক আন্দোলন।’          


লেখকদ্বয় আমাদেরকে জানান, আদিম স্বাধীনতাকে যে কেউ অগ্রাহ্য করতে পারে, বিশেষভাবে তারা, যারা আনুগত্যের জন্য প্রশিক্ষিত নয় (যেমন এই বইটি পড়ার জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই ছিল)। এখানে তারা পৃষ্ঠপোষকতামূলক ঘৃণার সাথে পৃথিবীর নিপীড়িত ও হতভাগাদের মুক্তি দেবার প্রস্তাব করেন যা উগ্র তাত্ত্বিকদের বৈশিষ্ট্য। মানবজাতির জনসাধারণ, যাইহোক, হুইপেট নয়: তারা বোঝে, আদর্শগত স্বপ্নদর্শীদের চেয়ে, বিরোধপূর্ণ চাহিদাগুলি যে জটিল এবং প্রায়শই পরস্পর-বিরোধী বিশ্বে তারা বাস করে সেখানে স্বাধীনতাকে রূপ দেয়।  

নতুন এই ইতিহাসের একটি বৈশিষ্ট্য হল, রুশোর অসমতার ইতিহাসের মতোই, এর বেশিরভাগই অত্যন্ত অনুমানমূলক। লেখকরা এটি স্বীকার করেছেন: ‘অধিকাংশ মানববেতিহাস আমাদের কাছে অপূরণীয়ভাবে হারিয়ে গেছে। আমাদের প্রজাতি, হোমো স্যাপিয়েন্স, অন্তত ২০০০০০ বছর ধরে বিদ্যমান ছিল, কিন্তু সেই সময়ের বেশিরভাগ সময় কি ঘটছে তা আমরা জানি না।’  কিন্তু ইতিহাসে যদি এত খালি পাতা থাকে, তাহলে তারা কীভাবে নিশ্চিত হবে যে মানুষ সহজাতভাবেই অরাজপন্থী? পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায় হবস-সুলভ চিন্তার আবির্ভাবকেও তারা প্রমাণ হিসেবে উপেক্ষা করেন।   


তাদের বই পড়লে আপনার মনে হবে হবসীয় চিন্তাভাবনা ছিল পশ্চিমা মননের অদ্ভুত এক বিকৃতি। অথচ চীনা আইনবিদ হান ফেই প্রায় ২ হাজার বছর আগে একই ধরণের ধারণা প্রকাশ করেছিলেন এবং একই সময়ে ভারতীয় লেখক কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র বইয়ে রাজনৈতিক বাস্তববাদের একটি সাদৃশ্যপূর্ণ তত্ত্ব তৈরি করেছিলেন। এই লেখাগুলি ইশারা দেয় যে হবস যে রাজনৈতিক বিষয়গুলি মোকাবেলা করেছিলেন – মানবপ্রকৃতি, স্বাধীনতা, যুদ্ধ, নিরাপত্তা, ক্ষমতা এবং রাষ্ট্র – তা ‘মালিকানামূলক ব্যক্তিবাদ’ (‘পজেসিভ ইন্ডিভিজুয়ালিজম’) দিয়ে জর্জরিত প্রাথমিক আধুনিক পশ্চিমা সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, যেমনটি মার্কসবাদী স্কলার সি বি ম্যাকফারসন এক সময়ের প্রভাবশালী রচনায় দাবি করেছিলেন। ১৯৬২ সালের এই গবেষণাকর্ম  গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো উৎসাহের সঙ্গে উদ্ধৃত করেন।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

হবস বিশ্বাস করতেন যে মানুষ ‘ক্ষমতার পরে ক্ষমতার জন্য অস্থির  ও অনন্ত এক আকাঙ্ক্ষার দ্বারা আবিষ্ট হয় যা শুধুমাত্র মৃত্যুতে থেমে যায়’। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা সম্পত্তি জমা করার প্ররোচনা দ্বারা চালিত হয় না, যেমন গ্রেবার এবং ওয়েংরো দাবি করেন, বা প্রধানত অহংবোধ দ্বারা চালিত হয়, যেমন হবস নিজেই কখনও কখনও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারা যে প্ররোচনা দ্বারাই চালিত হোক না কেন – হিংসাত্মক মৃত্যুর বিপদ, জীবনযাত্রার একটি উপায় সংরক্ষণের প্রচেষ্টা বা প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন – মানুষ অন্য মানুষের থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য ক্ষমতার লড়াইয়ে অংশ নেয়। আগ্রাসী লোভ নয়, ভয়ই প্রকৃত হবসীয় আবেগ।       

এই হবসিয়ান আবশ্যিকতা ‘রাষ্ট্র-ছাড়া-সমাজ’ গঠনের আধুনিক প্রচেষ্টার ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। অনেক রাজনৈতিক প্রকল্প অরাজপন্থার (এনার্কিজম) চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হয়েছে। খুব কমই নির্ভরযোগ্যভাবে অকার্যকর। অরাজপন্থীদের সবচেয়ে মারাত্মক শত্রুরাও অত্যাচারী নয় যাদের বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ করেছিল। যদি বিপ্লবগুলি প্রায়শই এমন শাসনের পরিণতি ঘটায় যেগুলি উৎখাত হওয়া শাসনের চেয়ে বেশি দমনমূলক, তবে একটি বড় কারণ হল ক্ষমতার জন্য বাধাহীন লড়াই যা সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বী বিপ্লবী আন্দোলনগুলির মধ্যে ঘটেছিল।

অরাজপন্থী আন্দোলনগুলি ২০ শতকে মাত্র দুই বার বড় আকারের রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল এবং উভয় ক্ষেত্রেই তারা বিলুপ্ত হয়েছিল। ১৯২০ এর দশকের গোড়ার দিকে, রাশিয়ার অরাজপন্থী  কৃষ্ণাঙ্গ বাহিনী নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এবং বলশেভিকরা প্রতি-বিপ্লবী শ্বেতাঙ্গদের দমনে রেড আর্মিকে সাহায্য করার পর তাদের কমান্ডারদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে, অরাজপন্থী মিলিশিয়ারা প্রান্তিক হয়ে পড়ে এবং তারপর সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নিয়ন্ত্রিত নিয়মিত সামরিক ইউনিট দ্বারা শোষিত হয়। রাষ্ট্রহীন সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা নিয়মিতভাবে পরাজিত হয়েছে উন্নততর সংগঠিত এবং আরও নির্মম বিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্রের মতো কাজ ক’রে। 

রাষ্ট্রহীন একটি অঞ্চল সৃষ্টি হলে, তখন রাষ্ট্রটির টিকে থাকা তার চারপাশের রাজ্যগুলির উপর নির্ভর করে। উত্তর সিরিয়ার কুর্দি রোজাভা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ঘটনা এমন। ২০১৪ সালে গ্রেবার এই অঞ্চলটি ঘুরে এসেছিলেন। অঞ্চলটিকে তিনি অরাজপন্থার একটি প্র্যাক্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট বলে দাবি করেছিলেন। (এই অঞ্চলটির কারারুদ্ধ নেতা আবদুল্লাহ ওকালান আমেরিকান তাত্ত্বিক মারে বুকচিনের (1921-2006) ‘অনটন-উত্তর অরাজপন্থা’-এর
প্রভাবকে স্বীকার করেছেন। ফলে গ্রেবারের মতের কিছু ভিত্তি রয়েছে।) রোজাভার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ার বাশার আল- আসাদ ও কুর্দিস্তান আঞ্চলিক সরকারের উপর। এই অঞ্চলের এখনও বাশারের বাহিনী ও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় উপস্থিতি রয়েছে। বুকচিনের অরাজপন্থায়  পরিবেশগত চাহিদার থাকা সত্ত্বেও,  করুণ ব্যাপার হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি হল এই অঞ্চলের প্রধান সম্পদ।                     

রোজাভা এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে শেষ হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তেলক্ষেত্র নিয়ে কোনো দ্বন্দ্বে, রোজাভাকেও অপরাপর রাষ্ট্রের মতো, এই অঞ্চলের অন্যদের সাথে জোট গঠন করে, প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, অন্যথায় এটি অদৃশ্য হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, রোজাভা অনিবার্য ভূ-রাজনৈতিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। যুদ্ধরত রাষ্ট্রের বিশ্বে শান্তিপূর্ণ অরাজপন্থার (নৈরাজ্যের) কোনো জায়গা নেই।      

খুব সম্ভব, আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকায়, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট দ্বারা তৈরি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ব্যর্থ হয়নি বরং কেবল বিবর্ণ হয়েছে। আমেরিকান শহরগুলিতে সম্প্রতি যে অঞ্চলগুলি আবির্ভূত হয়েছে সেগুলি একটি ভিন্ন গতিপথ অনুসরণ করে। তাদের তাৎক্ষণিক লক্ষ্য পুলিশকে ফাঁকি দেওয়া, এবং এই লক্ষ্য অন্তত আংশিকভাবে অর্জনযোগ্য। বাস্তবে, এটি রাষ্ট্রকে বেসরকারিকরনের নব্য উদারনৈতিক কর্মসূচিরই এক ধরণের  সম্প্রসারণ। পুলিশ বাহিনী হারিয়ে যায় না, ক্ষমতাবানদের সেবায় নিয়োজিত সিকিউরিটি কোম্পানিতে পরিণত হয়। বাকিরা পড়ে নিজেদেরকে রক্ষা করার দায়িত্ব  নিজেরাই নিয়ে আর সংগঠিত অপরাধচক্র ও গ্যাং শাসনের মানিয়ে বেঁচেবর্তে থাকতে যা যা করতে হয় করে। 

মাঝেমধ্যেই গ্রেবার এবং ওয়েংগ্রো সাম্প্রতিক ইতিহাসের নব্য-উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কাছাকাছি চলে আসেন। তারা স্পষ্ট অনুমোদনের সাথে খেয়াল করেন যে এখন দুনিয়াজুড়ে আমলাতন্ত্র রয়েছে (সরকারি এবং ব্যক্তিগত, IMF এবং WTO থেকে JP Morgan Chase এবং বিভিন্ন ক্রেডিট-রেটিং সংস্থা)… ক্রিপ্টোকারেন্সি থেকে প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি পর্যন্ত সবকিছুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে ক্ষুণ্ন করছে।       

কিন্তু ইতিহাস চলছে উল্টো পথে। সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলি আঞ্চলিক সীমানা পুনঃস্থাপন করছে, সাপ্লাই চেইনের নিরাপত্তার স্বার্থে বৈশ্বিক বাণিজ্য  ও ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ করছে। এই প্রবণতাগুলি মহামারী দ্বারা ত্বরান্বিত হতে পারে, তবে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বৃদ্ধি ২০০৭-৮ এ ফিরিয়ে নিয়ে যায়, যখন সরকারগুলি বিশ্বব্যাপী আর্থিক পতন রোধ করতে বিশ্ব অর্থনীতিকে সহায়তা করেছিলো। 

গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো নব্য উদারপন্থীদের সাথে কল্যাণ রাষ্ট্রের একটি চিহ্নিত শত্রুতা ভাগ করে নেন। যেটিকে তারা শ্রমজীবী ​​শ্রেণীর আত্ম-উন্নয়নকে ক্ষুণ্ন করে দাবি করে প্রত্যাখ্যান করেন। কল্যাণ রাষ্ট্রগুলি সাধারণ মানুষের জন্য যে সুবিধাসমূহ নিয়ে এসেছিল তারা লক্ষ্য করতে ভুলে যান।  উদাহরণস্বরূপ, অসুস্থতার বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য দাতব্য এবং বীমার প্যাচওয়ার্কের উপর নির্ভর করা থেকে স্বাধীনতা। মানুষের স্বাধীনতা জটিল বিষয়। এনএইচএস  বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধরত তৎকালীন শক্তিশালী ব্রিটিশ রাষ্ট্র থেকে, এনএইচএস আবির্ভূত হয়েছিল। অনেক মন্দ রাষ্ট্রের সাথে করে এসেছে, তবে কিছু অত্যাবশ্যকীয় ভালো দিকও রয়েছে। অদ্ভুত লাগলেও সত্যি হচ্ছে এই কারণেই মানুষ রাষ্ট্রের দ্বারা শাসিত হতে ইচ্ছুক।        

লেখকরা অতীত এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে আমাদের চিন্তাভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এমন অস্বস্তিকর, দোকানে বিক্রিত মতামত এবং রাজনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর মিথের নিন্দা করেছেন। তারা মনে করেন যে প্রাথমিক মানবসমাজগুলি সাধারণভাবে অনুমিত ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় এবং কখনও কখনও পরীক্ষামূলক ছিল। তবুও গ্রেবার এবং ওয়েনগ্রো যা করেছেন তা হল রুশো এবং তার অনেক অজান্তে শিষ্যদের দ্বারা প্রচারিত একটি পরিচিত মিথকে পুনরায় সাজানো: এই বিশ্বাস যে মানবজাতি তার ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় জুড়ে ‘আটকে’ আছে। স্বাধীনতা এবং মৈত্রীর একটি আসল শর্ত কখনও বিদ্যমান ছিল বলে বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আমরা সবসময় যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, আমাদের অসুবিধাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি আর কোনো না কোনোভাবে তা কাটিয়ে উঠছি।

[ নিউ স্টেটসম্যান– এ প্রকাশিত লেখাটি সেমসেম-এর জন্য ভাষান্তর করেছেন অর্নি শওকত]       

থেকে আরও পড়ুন

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।