দর্শকরা কীভাবে ভিজুয়াল মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত হয়? তারা কীভাবে ‘দেখে’?
দেখাদেখির বা নজরের রাজনীতি নিয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকেই তাত্ত্বিকরা ভাবছেন। পুঁজির দুনিয়া সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষকেও কিভাবে কমোডিফায়েড করে তা নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ব্যাপক আকারে তাত্ত্বিক রচনা প্রকাশ করে। পঞ্চাশের দশকে রোলা বার্থ তার ‘মিথলজিস’ এর চিহ্নগত রাজনীতি থেকে নব্বইয়ের দশকের বদ্রিয়ার ‘সিমুলাক্রা এন্ড সিমুলেশন’ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা কাজ করেছেন। এই পরম্পরার অংশ হিসেবে দৃশ্য মাধ্যমে চিহ্নের লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকরা।
মেইল গেইজ বা পুরুষালি নজরকে এই চিহ্নবিদ্যার নারীবাদী ভাবনার সম্প্রসারণ। গেইজ বা নজর দেখাদেখির রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফিল্ম থিয়োরি ও সমালোচনা থেকে জন্ম নেয়া শব্দটি দিয়ে বুঝানো হয় আমরা কীভাবে এই ভিজুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনকে দেখি, বুঝি। বিজ্ঞাপন, টিভি প্রোগ্রাম ও সিনেমা এর মধ্যে পড়ে। চিত্র সমালোচকরা gaze বা নজর নিয়ে কথা বলার সময় প্রায়ই male gaze বা পুরুষ নজর-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু পুরুষ নজর বলতে আসলেই কী বুঝায়? আর শব্দটির নারী সমতুল কিছু আছে কি?
‘মেইল গেইজ’ কথাটা কোথা থেকে এলো?
ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিয়োরির একটি আইডিয়া হলো এই পুরুষ নজর (male gaze)। পুরুষ নজরের ধারনা স্কলার এবং সিনেমানির্মাতা লরা মালভি তার ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় প্রবন্ধের বই Visual Pleasure and Narrative Cinema তে হাজির করেন।
পুরুষ নজর দেখার যৌনরাজনীতি তুলে ধরে। যৌনাত্মক নজরে দেখতে উৎসাহিত করে। পুরুষের ক্ষমতায়ন করে এবং নারীদেরকে অবজেক্টিফাই করে। এই পুরুষ নজরে দৃশ্য মাধ্যমে নারীকে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর মত করে উপস্থাপন করা হয়। এখানে নারীর অনুভুতি, ভাবনা ও তার নিজের বাসনা পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হিসেবে ‘ফ্রেমবন্দি’ হওয়ার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়।
মনোবিশ্লেষণের ভাষা ব্যবহার করে মালভি বলেন, বস্তাপঁচা হলিউডি ফিল্মগুলো গভীরে প্রোথিত তাড়না – স্কোপোফিলিয়া বা দেখার মাধ্যমে পাওয়া যৌনানন্দকে কাজে লাগায়। মালভির মতে, জনপ্রিয়তম সিনেমাগুলো পুরুষালি যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে ধারণ করা হয়। মালভির ধারণাটিকে male gaze বলে মাঝেমধ্যে বর্ণনা করা হলেও, একে আরও নিখুঁতভাবে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ নজর বলা যায়। দৃশ্য মাধ্যম পুরুষ দর্শকদের জন্য নারীকে যৌনায়িত করে পুরুষালি ভয়ারিজম (Voyeurism) ছড়ায়। মালভির মতে, সিনেমায় নারীরা তাদের ‘to-be-looked-at-ness’ বৈশিষ্ট্য দিয়ে পরিচিত; যেন নারী হচ্ছে কেবল দর্শনীয় মনোরম দৃশ্য আর পুরুষ সেই দৃশ্যের দর্শক।
দ্য পোস্টম্যান অলয়েজ রিংজ টুয়াইস (১৯৪৬) সিনেমা পুরুষ নজরের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। চলচ্চিত্রটির মূল নারী চরিত্র কোরা স্মিথের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে ক্যামেরা দর্শকদের কোরার দেহের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এভাবে সেক্সুয়াল, ভয়ারিস্টিক এবং পুরুষ চরিত্রের নজর ভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত দেখার একটা মাধ্যম তৈরি করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নায়কের কোরারযে প্রতি আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা আছে তা কোরা বোঝে কিন্তু শক্তিশালি মেসেজটি হলো কোরা যৌন আবেদনময়ী। দর্শকরা কোরার নাম জানার আগেই জেনে যায় যে কোরা সেক্সি। এমনকি একজন দর্শক যদি বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব নাও করেন তারপরেও দৃশ্যটি বোঝা যায়। সারাজীবন ধরে টিভি, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এসবে নারীদেরকে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে দেখা আমাদেরকে পুরুষ নজর বা মেল গেজ এর সাথে অভ্যস্ত করে ফেলেছে।
পুরুষ নজর-এর সন্ধানে পুরুষ নজর-এর অনেক ধরণ আছে কিন্তু একে চেনা যায় এমন পরিস্থিতিতে যেখানে নারী চরিত্ররা নিয়ন্ত্রিত হয় নায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাসনা দিয়ে। আর বেশিরভাগ সময়ই তারা নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। বাড বয়েত্তিচা ১৯৫০ এর দশকে কিছু ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন মুভি নির্মাণ করেন। তার মতে, ‘নায়িকা যেটির প্রতিনিধিত্ব করবেন তার থেকে তিনি কী বোঝাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই একমাত্র, ভালোবাসা বা ভয় অথবা দুশ্চিন্তা সে নায়কের মধ্যে সঞ্চালিত করে, নায়ক যেমন আচরণ করছেন তার কারণেই নায়ক এমন। নায়িকার নিজের মধ্যে তার ন্যূনতম গুরুত্ব নেই।’
ক্যামেরা বারবার যেভাবে নারীর শরীরে তাক করে আমাদের দেখাতে চায় এটা বিভিন্নভাবে দেখা যায়। রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪) এ নারীর শরীরের আক্ষরিক অর্থেই গঠন বা কাঠামোর জন্য কিংবা শি’জ অল দ্যাট (১৯৯৯)- এ নারী পুরোপুরি রুপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। আরো পরের নমুনা হিসেবে, ট্রান্সফর্মার (২০০৬-২০১৪) ফিল্ম সিরিজে নারীদের যৌনআবেদনময়ী, আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
ইদানিং অবশ্য অনেক ফিল্ম নির্মাতা প্রায়ই নারী চরিত্রগুলাকে তাদের জটিল ব্যাকস্টোরি, দৃঢ় ইচ্ছা ও সক্রিয় ভূমিকা বাদ দিয়ে তাদেরকে ‘নিছক’ যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়টি এড়াতে চেষ্টা করেন। এরপরও পুরুষালি নজর (masculine gaze) অনেক স্বাভাবিক। দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস (২০১২) -এ ক্যাটওমেন এর ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন আছে। এরপরও তাকে এমনভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে যেন তাকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা লাগে।
তাকানোর বিভিন্ন ধরন চল্লিশ বছর আগে রচিত মালভির প্রবন্ধ এখনও জোড়ালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই সিনেমায় অবজেক্টিফাই করা হয়—একটা সাধারণ উত্তর। গিল্ডা (১৯৪৬) সিনেমায় জনি ফ্যারেল (গ্লেন ফোর্ড) কি গিল্ডা মান্ডসনের (রিটা হেইওয়ার্থ) মতই সেক্সি নয়? বিবিসি টেলিসিরিজের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস (১৯৯৫)-এর ফিটজ উইলিয়াম ডার্সি এলিজাবেথ বেনেটের মতই সুন্দর নয় কি? নিঃসন্দেহে এসব হেটারোসেক্সুয়াল নারী নজরের উপস্থিতির জানান দেয়।
এ ধরণের আলোচনা নারীদের ক্রমাগতভাবে সেক্সুয়াল অবজেক্টের মত দেখানোকে বিবেচনা করে না। দ্য হকেয়ি ইনিশিয়েটিভ (The Hawkeye Initiative) প্রজেক্টটি কমিকস ও চলচ্চিত্রে পুরুষ এবং নারী সুপারহিরোদের ভিন্নভাবে উপস্থাপনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিচের ইলাস্ট্রেশনটিতে এভেঞ্জার্স (The Avengers)-এর পুরুষ হিরোদের ফিল্মটির একমাত্র নারী চরিত্র ব্ল্যাক উইডোর মত করেই হাইপার-সেক্সুয়ালাইজডভাবে দেখিয়েছে।
হকাই ইনিশিয়েটিভ এর চোখে পুরুষ নজর এভেঞ্জারের ওপর প্রয়োগ করলে যেমন দেখাতো
ইলাস্ট্রেশনটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে তুলে ধরে। কিন্তু মজাটা আসে পুরুষদের নারীদের মতো যৌনায়িত নজরে দেখায় অনভ্যস্ততা থেকে। আরেকটা আলোচনা হল, সিনেমায় নারীদের পুরুষদেহ আকাঙ্ক্ষা করতে উৎসাহিত করে না বরং নারী দর্শকদের পুরুষ আকাঙ্ক্ষিত নায়িকার সাথে আইডেন্টিফাই করতে বাধ্য করা হয়। এই যুক্তি অনুযায়ী ফিটজউইলিয়াম ডার্সির ভেজা আন্ডারশার্ট নয়, বরং এলিজাবেথের প্রতি ডার্সির তীব্র আকাঙ্ক্ষাই নারী দর্শকদের প্রকৃতভাবে আকর্ষণ করে। নারী নজর (female gaze) বলে কিছু আছে কি? অনেক সিনেমা নারীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে non gaze উপায়সমূহের মাধ্যমে। জেন ক্যাম্পিয়নের দ্যি পিয়ানো (১৯৯৩) সিনেমায় নায়িকার তীব্র সেন্টিমেন্টাল প্রকৃতি জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সোফিয়া কপ্পোলার দ্য ভার্জিন সুইসাইডস (১৯৯৯) সিনেমায় টিনেজ চরিত্রদের জীবন তুলে আনার মাধ্যমে নারীদের অভিজ্ঞতা শব্দ এবং ভিজুয়াল এস্থেটিক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল প্রকাশে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে উষ্ণ টোন (হলুদ, স্যামন), ‘মেয়েলি’ প্রতীক (ফুল, ইউনিকর্ন) এবং গান ব্যবহার করা হয়েছে। কপ্পোলা একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন ম্যারি অ্যানটোয়েনেট (২০০৬) সিনেমাতেও। তিনি ফ্লোরিড সেট ডিজাইনের মাধ্যমে ভার্সাই শহরে নারীদের আবদ্ধ, দমবন্ধ জীবন দেখিয়েছেন।
নারীদের আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে ভালো প্রকাশ হয় নজর বা gaze এর পরিবর্তে অনুভূতির মাধ্যমে। এই বয়ান বলে, গতানুগতিক পুরুষালি আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমূলক, অন্যদিকে নারীরা অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু পুরুষের অভ্যন্তরীন জীবন সবসময়ই শব্দ এবং অনুভবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যেমন, র্যাম্বো (২০০৮) অথবা ক্যাসিনো রয়্যাল (২০০৬) পুরুষের যন্ত্রণা ও আগ্রাসন দিয়ে ভরপুর করে রেখেছে অনুভূতি। নারী নজর (female gaze) কি আছে তাহলে? অবশ্যই আছে। সিনেমায় সুদর্শন পুরুষের আধিক্য আছে। কিন্তু নারীদের সমান পুরুষ নজর স্পষ্টত নেই। পুরুষ নজর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। পুরুষ নজর পুরুষতান্ত্রিক স্ট্যাটাস-কো কে সমর্থন করে নারীদের বাস্তব জীবনে যৌনবস্তুকরণকে স্থায়ী করে।
এ কারণে, নারী নজর, পুরুষ নজর-এর মত হতে পারেনা। বরং নারীদের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে বানানো চলচ্চিত্রগুলো বিধ্বংসী। ফিশ ট্যাংক (২০০৯) চলচ্চিত্রটি সুবিধাবঞ্চিত একজন মেয়ের দুর্বলতা নিয়ে, তার সাবালক হয়ে ওঠার গল্প। ইন দ্য কাট (২০০৩) সিনেমা একজন নারীর যৌনতার অনুসন্ধানের গল্প নিয়ে। নারীদের যৌনতা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হওয়ার জন্য সেন্সরশীপের সম্মুখীন হয়। যেমন, দ্য কুলার (২০০৩), বয়েজ ডোন্ট ক্রাই (১৯৯৯) এবং ব্লু ভ্যালেন্টাইন (২০১০) এর নির্মাতা তাদের সিনেমার অথবা এন.সি-১৭ এর কাতারে পড়ে নারী যোনীলেহন বর্ণনা করার জন্য। এরকম দৃশ্য নারীর তৃপ্তির দিকে গুরুত্ব দেয় এবং নারীর to-be-looked-at-ness-কে ছোট করে দেখায়। দ্য পিয়ানো, ইন দ্যা কাট বা ম্যারি অ্যানটোইনেট-এর মত সিনেমা গান, কামোত্তেজক দৃশ্য এবং ভিজুয়াল এসথেটিক্স ব্যবহার করে নারীবাদি নজর প্রকাশ করতে পারে। এভাবে এ সিনেমাগুলো নারীকে অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার না করে সাবজেক্ট হিসেবে দেখিয়ে নজর-এর (gaze) বিরোধিতা করে এবং সিনেমা ও মিডিয়ায় পুরুষ নজরকে পুরোপুরি অনুকরণ না করে, এগুলো পুরুষালি দুনিয়ার নজর ভঙ্গির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে।
ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’
[elementor-template id="1854"]
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।
আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।
আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে। পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।
একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য। আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে। কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর।
নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়।
মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন – ‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক।
মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।
মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’
পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।
পুঁজির একনায়কতন্ত্র
কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।
ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে।
কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো- কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব।
যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।
পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।
সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ, উৎপাদন যখন অবস্তুগত হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।
বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান।
নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব।
বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।
অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় ।
আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে।
ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।
আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়? ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়।
আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’
নজরদারী স্বৈরাচার
শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।
কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর।
তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।
বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।
গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা। তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই।
যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়।
স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়। এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।
নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।
বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই।
স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।
স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’
এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।
সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।
লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে।
আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ। কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।
যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো- সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি।
স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।