পুরুষ নজর, নারী নজর: দেখাদেখির রাজনীতি

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

দর্শকরা কীভাবে ভিজুয়াল মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত হয়? তারা কীভাবে ‘দেখে’?

দেখাদেখির বা নজরের রাজনীতি নিয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকেই তাত্ত্বিকরা ভাবছেন। পুঁজির দুনিয়া সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষকেও কিভাবে কমোডিফায়েড করে তা নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ব্যাপক আকারে তাত্ত্বিক রচনা প্রকাশ করে। পঞ্চাশের দশকে রোলা বার্থ তার ‘মিথলজিস’ এর  চিহ্নগত রাজনীতি থেকে নব্বইয়ের দশকের বদ্রিয়ার ‘সিমুলাক্রা এন্ড সিমুলেশন’ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা কাজ করেছেন। এই পরম্পরার অংশ হিসেবে দৃশ্য মাধ্যমে চিহ্নের লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকরা। 

মেইল গেইজ বা পুরুষালি নজরকে এই চিহ্নবিদ্যার নারীবাদী ভাবনার সম্প্রসারণ।  গেইজ বা নজর দেখাদেখির রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফিল্ম থিয়োরি ও সমালোচনা থেকে জন্ম নেয়া শব্দটি দিয়ে বুঝানো হয় আমরা কীভাবে এই ভিজুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনকে দেখি, বুঝি। বিজ্ঞাপন, টিভি প্রোগ্রাম ও সিনেমা এর মধ্যে পড়ে। চিত্র সমালোচকরা gaze বা নজর  নিয়ে কথা বলার সময় প্রায়ই male gaze বা পুরুষ নজর-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু পুরুষ নজর বলতে আসলেই কী বুঝায়? আর শব্দটির নারী সমতুল কিছু আছে কি?               

‘মেইল গেইজ’ কথাটা কোথা থেকে এলো?   

ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিয়োরির একটি আইডিয়া হলো এই পুরুষ নজর (male gaze)। পুরুষ নজরের ধারনা স্কলার এবং সিনেমানির্মাতা লরা মালভি তার ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় প্রবন্ধের বই Visual Pleasure and Narrative Cinema তে হাজির করেন।     

পুরুষ নজর দেখার যৌনরাজনীতি তুলে ধরে। যৌনাত্মক নজরে দেখতে উৎসাহিত করে। পুরুষের  ক্ষমতায়ন করে এবং নারীদেরকে অবজেক্টিফাই করে। এই পুরুষ নজরে দৃশ্য মাধ্যমে নারীকে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর মত করে উপস্থাপন করা হয়। এখানে নারীর অনুভুতি, ভাবনা ও তার নিজের বাসনা পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হিসেবে ‘ফ্রেমবন্দি’ হওয়ার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়।      

মনোবিশ্লেষণের ভাষা ব্যবহার করে মালভি বলেন, বস্তাপঁচা হলিউডি ফিল্মগুলো গভীরে প্রোথিত তাড়না – স্কোপোফিলিয়া বা দেখার মাধ্যমে পাওয়া যৌনানন্দকে কাজে লাগায়। মালভির মতে, জনপ্রিয়তম সিনেমাগুলো পুরুষালি যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে ধারণ করা হয়। মালভির ধারণাটিকে male gaze বলে মাঝেমধ্যে বর্ণনা করা হলেও, একে আরও নিখুঁতভাবে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ নজর বলা যায়। দৃশ্য মাধ্যম পুরুষ দর্শকদের জন্য নারীকে যৌনায়িত করে পুরুষালি ভয়ারিজম (Voyeurism) ছড়ায়। মালভির মতে, সিনেমায় নারীরা তাদের ‘to-be-looked-at-ness’ বৈশিষ্ট্য দিয়ে পরিচিত; যেন নারী হচ্ছে কেবল দর্শনীয় মনোরম দৃশ্য আর পুরুষ সেই দৃশ্যের দর্শক।       

দ্য পোস্টম্যান অলয়েজ রিংজ টুয়াইস  (১৯৪৬) সিনেমা পুরুষ নজরের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। চলচ্চিত্রটির মূল নারী চরিত্র কোরা স্মিথের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে ক্যামেরা দর্শকদের কোরার দেহের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এভাবে সেক্সুয়াল, ভয়ারিস্টিক এবং পুরুষ চরিত্রের নজর ভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত দেখার একটা মাধ্যম তৈরি করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নায়কের কোরারযে  প্রতি আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা আছে তা কোরা বোঝে কিন্তু শক্তিশালি মেসেজটি হলো কোরা যৌন আবেদনময়ী। দর্শকরা কোরার নাম জানার আগেই জেনে যায় যে কোরা সেক্সি। এমনকি একজন দর্শক যদি বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব নাও করেন তারপরেও দৃশ্যটি বোঝা যায়। সারাজীবন ধরে টিভি, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এসবে নারীদেরকে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে দেখা আমাদেরকে পুরুষ নজর বা মেল গেজ এর সাথে অভ্যস্ত করে ফেলেছে।         

পুরুষ নজর-এর সন্ধানে 
পুরুষ নজর-এর  অনেক ধরণ আছে কিন্তু একে চেনা যায় এমন পরিস্থিতিতে যেখানে নারী চরিত্ররা নিয়ন্ত্রিত হয় নায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাসনা দিয়ে। আর বেশিরভাগ সময়ই তারা নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। বাড বয়েত্তিচা ১৯৫০ এর দশকে কিছু ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন মুভি নির্মাণ করেন। তার মতে, ‘নায়িকা যেটির প্রতিনিধিত্ব করবেন তার থেকে তিনি কী বোঝাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই একমাত্র, ভালোবাসা বা ভয় অথবা দুশ্চিন্তা সে নায়কের মধ্যে সঞ্চালিত করে, নায়ক যেমন আচরণ করছেন তার কারণেই নায়ক এমন। নায়িকার নিজের মধ্যে তার ন্যূনতম গুরুত্ব নেই।’  
  

ক্যামেরা বারবার যেভাবে নারীর শরীরে তাক করে আমাদের দেখাতে চায় এটা বিভিন্নভাবে দেখা যায়। রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪)
এ নারীর শরীরের আক্ষরিক অর্থেই গঠন বা কাঠামোর জন্য কিংবা শি’জ অল দ্যাট (১৯৯৯)- এ নারী পুরোপুরি রুপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। আরো পরের নমুনা হিসেবে, ট্রান্সফর্মার (২০০৬-২০১৪) ফিল্ম সিরিজে নারীদের যৌনআবেদনময়ী,  আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।    


ইদানিং অবশ্য অনেক ফিল্ম নির্মাতা প্রায়ই নারী চরিত্রগুলাকে তাদের জটিল ব্যাকস্টোরি, দৃঢ় ইচ্ছা ও সক্রিয় ভূমিকা বাদ দিয়ে তাদেরকে ‘নিছক’ যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়টি এড়াতে চেষ্টা করেন। এরপরও পুরুষালি  নজর (masculine gaze) অনেক স্বাভাবিক। দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস (২০১২) -এ  ক্যাটওমেন এর ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন আছে। এরপরও তাকে এমনভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে যেন তাকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা লাগে।         

তাকানোর বিভিন্ন ধরন  
চল্লিশ বছর আগে রচিত মালভির প্রবন্ধ এখনও জোড়ালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই সিনেমায় অবজেক্টিফাই করা হয়—একটা সাধারণ উত্তর। গিল্ডা (১৯৪৬) সিনেমায় জনি ফ্যারেল (গ্লেন ফোর্ড) কি গিল্ডা মান্ডসনের (রিটা হেইওয়ার্থ) মতই সেক্সি নয়?  বিবিসি টেলিসিরিজের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস (১৯৯৫)-এর  ফিটজ উইলিয়াম ডার্সি এলিজাবেথ বেনেটের মতই সুন্দর নয় কি? নিঃসন্দেহে এসব হেটারোসেক্সুয়াল নারী নজরের উপস্থিতির জানান দেয়।  

এ ধরণের আলোচনা নারীদের ক্রমাগতভাবে সেক্সুয়াল অবজেক্টের মত দেখানোকে বিবেচনা করে না। দ্য হকেয়ি ইনিশিয়েটিভ (The Hawkeye Initiative) প্রজেক্টটি কমিকস ও চলচ্চিত্রে পুরুষ এবং নারী সুপারহিরোদের ভিন্নভাবে   উপস্থাপনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিচের ইলাস্ট্রেশনটিতে এভেঞ্জার্স  (The Avengers)-এর  পুরুষ হিরোদের ফিল্মটির একমাত্র নারী চরিত্র ব্ল্যাক উইডোর মত করেই হাইপার-সেক্সুয়ালাইজডভাবে দেখিয়েছে।       

হকাই ইনিশিয়েটিভ এর চোখে পুরুষ নজর এভেঞ্জারের ওপর প্রয়োগ করলে যেমন দেখাতো


ইলাস্ট্রেশনটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে তুলে ধরে। কিন্তু মজাটা আসে পুরুষদের নারীদের মতো যৌনায়িত নজরে দেখায় অনভ্যস্ততা থেকে। আরেকটা আলোচনা হল, সিনেমায় নারীদের পুরুষদেহ আকাঙ্ক্ষা করতে উৎসাহিত করে না বরং নারী দর্শকদের পুরুষ আকাঙ্ক্ষিত নায়িকার সাথে আইডেন্টিফাই করতে বাধ্য করা হয়। এই যুক্তি অনুযায়ী ফিটজউইলিয়াম ডার্সির ভেজা আন্ডারশার্ট নয়, বরং এলিজাবেথের প্রতি ডার্সির তীব্র আকাঙ্ক্ষাই নারী দর্শকদের প্রকৃতভাবে আকর্ষণ করে।   

নারী নজর  (female gaze) বলে কিছু আছে কি?   

অনেক সিনেমা নারীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে non gaze উপায়সমূহের মাধ্যমে। জেন ক্যাম্পিয়নের দ্যি পিয়ানো (১৯৯৩) সিনেমায় নায়িকার তীব্র সেন্টিমেন্টাল প্রকৃতি জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সোফিয়া কপ্পোলার দ্য ভার্জিন সুইসাইডস (১৯৯৯) সিনেমায় টিনেজ চরিত্রদের জীবন তুলে আনার মাধ্যমে নারীদের অভিজ্ঞতা শব্দ এবং ভিজুয়াল এস্থেটিক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল প্রকাশে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে উষ্ণ টোন (হলুদ, স্যামন), ‘মেয়েলি’ প্রতীক (ফুল, ইউনিকর্ন) এবং গান ব্যবহার করা হয়েছে। কপ্পোলা একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন ম্যারি অ্যানটোয়েনেট (২০০৬) সিনেমাতেও। তিনি ফ্লোরিড সেট ডিজাইনের মাধ্যমে ভার্সাই শহরে নারীদের আবদ্ধ, দমবন্ধ জীবন দেখিয়েছেন।    

নারীদের আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে ভালো প্রকাশ হয় নজর বা gaze এর পরিবর্তে অনুভূতির মাধ্যমে। এই বয়ান বলে, গতানুগতিক পুরুষালি আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমূলক, অন্যদিকে নারীরা অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু পুরুষের অভ্যন্তরীন জীবন সবসময়ই শব্দ এবং অনুভবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যেমন, র‍্যাম্বো (২০০৮) অথবা ক্যাসিনো রয়্যাল (২০০৬) পুরুষের যন্ত্রণা ও আগ্রাসন দিয়ে ভরপুর করে রেখেছে অনুভূতি।           
নারী নজর  (female gaze) কি আছে তাহলে?
অবশ্যই আছে। সিনেমায়  সুদর্শন পুরুষের আধিক্য আছে। কিন্তু নারীদের সমান পুরুষ নজর স্পষ্টত নেই। পুরুষ নজর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। পুরুষ নজর পুরুষতান্ত্রিক স্ট্যাটাস-কো কে সমর্থন করে নারীদের বাস্তব জীবনে যৌনবস্তুকরণকে স্থায়ী করে।  


এ কারণে, নারী নজর, পুরুষ নজর-এর মত হতে পারেনা। বরং নারীদের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে বানানো চলচ্চিত্রগুলো বিধ্বংসী। ফিশ ট্যাংক (২০০৯) চলচ্চিত্রটি সুবিধাবঞ্চিত একজন মেয়ের দুর্বলতা নিয়ে, তার সাবালক হয়ে ওঠার গল্প। ইন দ্য কাট (২০০৩) সিনেমা একজন নারীর যৌনতার অনুসন্ধানের গল্প নিয়ে।     
নারীদের যৌনতা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হওয়ার জন্য সেন্সরশীপের সম্মুখীন হয়। যেমন, দ্য  কুলার (২০০৩), বয়েজ ডোন্ট ক্রাই (১৯৯৯) এবং ব্লু ভ্যালেন্টাইন (২০১০) এর নির্মাতা তাদের সিনেমার  অথবা এন.সি-১৭ এর কাতারে পড়ে নারী যোনীলেহন বর্ণনা  করার জন্য। এরকম দৃশ্য নারীর তৃপ্তির দিকে গুরুত্ব দেয় এবং নারীর to-be-looked-at-ness-কে ছোট করে দেখায়। দ্য পিয়ানো, ইন দ্যা কাট বা ম্যারি অ্যানটোইনেট-এর মত সিনেমা গান, কামোত্তেজক দৃশ্য এবং ভিজুয়াল এসথেটিক্স ব্যবহার করে নারীবাদি নজর প্রকাশ করতে পারে। এভাবে এ সিনেমাগুলো নারীকে অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার না করে সাবজেক্ট হিসেবে দেখিয়ে নজর-এর (gaze) বিরোধিতা করে এবং সিনেমা ও  মিডিয়ায় পুরুষ নজরকে পুরোপুরি অনুকরণ না করে, এগুলো পুরুষালি দুনিয়ার নজর ভঙ্গির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে।  

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।