পুরুষ নজর, নারী নজর: দেখাদেখির রাজনীতি

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক
অলঙ্করণঃ শফিক হীরা

দর্শকরা কীভাবে ভিজুয়াল মাধ্যমগুলোর সাথে যুক্ত হয়? তারা কীভাবে ‘দেখে’?

দেখাদেখির বা নজরের রাজনীতি নিয়ে বিশ শতকের ত্রিশের দশক থেকেই তাত্ত্বিকরা ভাবছেন। পুঁজির দুনিয়া সংস্কৃতির পাশাপাশি মানুষকেও কিভাবে কমোডিফায়েড করে তা নিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল ব্যাপক আকারে তাত্ত্বিক রচনা প্রকাশ করে। পঞ্চাশের দশকে রোলা বার্থ তার ‘মিথলজিস’ এর  চিহ্নগত রাজনীতি থেকে নব্বইয়ের দশকের বদ্রিয়ার ‘সিমুলাক্রা এন্ড সিমুলেশন’ পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক ও দার্শনিকেরা কাজ করেছেন। এই পরম্পরার অংশ হিসেবে দৃশ্য মাধ্যমে চিহ্নের লৈঙ্গিক রাজনীতি নিয়ে কাজ করেছেন নারীবাদী তাত্ত্বিকরা। 

মেইল গেইজ বা পুরুষালি নজরকে এই চিহ্নবিদ্যার নারীবাদী ভাবনার সম্প্রসারণ।  গেইজ বা নজর দেখাদেখির রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে ফিল্ম থিয়োরি ও সমালোচনা থেকে জন্ম নেয়া শব্দটি দিয়ে বুঝানো হয় আমরা কীভাবে এই ভিজুয়াল রেপ্রিজেন্টেশনকে দেখি, বুঝি। বিজ্ঞাপন, টিভি প্রোগ্রাম ও সিনেমা এর মধ্যে পড়ে। চিত্র সমালোচকরা gaze বা নজর  নিয়ে কথা বলার সময় প্রায়ই male gaze বা পুরুষ নজর-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু পুরুষ নজর বলতে আসলেই কী বুঝায়? আর শব্দটির নারী সমতুল কিছু আছে কি?               

‘মেইল গেইজ’ কথাটা কোথা থেকে এলো?   

ফেমিনিস্ট ফিল্ম থিয়োরির একটি আইডিয়া হলো এই পুরুষ নজর (male gaze)। পুরুষ নজরের ধারনা স্কলার এবং সিনেমানির্মাতা লরা মালভি তার ১৯৭৫ সালের জনপ্রিয় প্রবন্ধের বই Visual Pleasure and Narrative Cinema তে হাজির করেন।     

পুরুষ নজর দেখার যৌনরাজনীতি তুলে ধরে। যৌনাত্মক নজরে দেখতে উৎসাহিত করে। পুরুষের  ক্ষমতায়ন করে এবং নারীদেরকে অবজেক্টিফাই করে। এই পুরুষ নজরে দৃশ্য মাধ্যমে নারীকে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষদের আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর মত করে উপস্থাপন করা হয়। এখানে নারীর অনুভুতি, ভাবনা ও তার নিজের বাসনা পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত বস্তু হিসেবে ‘ফ্রেমবন্দি’ হওয়ার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়।      

মনোবিশ্লেষণের ভাষা ব্যবহার করে মালভি বলেন, বস্তাপঁচা হলিউডি ফিল্মগুলো গভীরে প্রোথিত তাড়না – স্কোপোফিলিয়া বা দেখার মাধ্যমে পাওয়া যৌনানন্দকে কাজে লাগায়। মালভির মতে, জনপ্রিয়তম সিনেমাগুলো পুরুষালি যৌনাকাঙ্ক্ষাকে সন্তুষ্ট করতে ধারণ করা হয়। মালভির ধারণাটিকে male gaze বলে মাঝেমধ্যে বর্ণনা করা হলেও, একে আরও নিখুঁতভাবে হেটারোসেক্সুয়াল পুরুষ নজর বলা যায়। দৃশ্য মাধ্যম পুরুষ দর্শকদের জন্য নারীকে যৌনায়িত করে পুরুষালি ভয়ারিজম (Voyeurism) ছড়ায়। মালভির মতে, সিনেমায় নারীরা তাদের ‘to-be-looked-at-ness’ বৈশিষ্ট্য দিয়ে পরিচিত; যেন নারী হচ্ছে কেবল দর্শনীয় মনোরম দৃশ্য আর পুরুষ সেই দৃশ্যের দর্শক।       

দ্য পোস্টম্যান অলয়েজ রিংজ টুয়াইস  (১৯৪৬) সিনেমা পুরুষ নজরের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ। চলচ্চিত্রটির মূল নারী চরিত্র কোরা স্মিথের সাথে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। ক্লোজআপ শট ব্যবহার করে ক্যামেরা দর্শকদের কোরার দেহের দিকে তাকাতে বাধ্য করে। এভাবে সেক্সুয়াল, ভয়ারিস্টিক এবং পুরুষ চরিত্রের নজর ভঙ্গির সাথে সম্পর্কিত দেখার একটা মাধ্যম তৈরি করে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নায়কের কোরারযে  প্রতি আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা আছে তা কোরা বোঝে কিন্তু শক্তিশালি মেসেজটি হলো কোরা যৌন আবেদনময়ী। দর্শকরা কোরার নাম জানার আগেই জেনে যায় যে কোরা সেক্সি। এমনকি একজন দর্শক যদি বাস্তব জীবনে নারীদের প্রতি আকর্ষণ অনুভব নাও করেন তারপরেও দৃশ্যটি বোঝা যায়। সারাজীবন ধরে টিভি, মিউজিক ভিডিও, বিজ্ঞাপন এসবে নারীদেরকে যৌনাবেদনময়ী হিসেবে দেখা আমাদেরকে পুরুষ নজর বা মেল গেজ এর সাথে অভ্যস্ত করে ফেলেছে।         

পুরুষ নজর-এর সন্ধানে 
পুরুষ নজর-এর  অনেক ধরণ আছে কিন্তু একে চেনা যায় এমন পরিস্থিতিতে যেখানে নারী চরিত্ররা নিয়ন্ত্রিত হয় নায়কের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাসনা দিয়ে। আর বেশিরভাগ সময়ই তারা নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। বাড বয়েত্তিচা ১৯৫০ এর দশকে কিছু ক্লাসিক ওয়েস্টার্ন মুভি নির্মাণ করেন। তার মতে, ‘নায়িকা যেটির প্রতিনিধিত্ব করবেন তার থেকে তিনি কী বোঝাচ্ছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই একমাত্র, ভালোবাসা বা ভয় অথবা দুশ্চিন্তা সে নায়কের মধ্যে সঞ্চালিত করে, নায়ক যেমন আচরণ করছেন তার কারণেই নায়ক এমন। নায়িকার নিজের মধ্যে তার ন্যূনতম গুরুত্ব নেই।’  
  

ক্যামেরা বারবার যেভাবে নারীর শরীরে তাক করে আমাদের দেখাতে চায় এটা বিভিন্নভাবে দেখা যায়। রিয়ার উইন্ডো (১৯৫৪)
এ নারীর শরীরের আক্ষরিক অর্থেই গঠন বা কাঠামোর জন্য কিংবা শি’জ অল দ্যাট (১৯৯৯)- এ নারী পুরোপুরি রুপান্তরের মধ্য দিয়ে যায়। আরো পরের নমুনা হিসেবে, ট্রান্সফর্মার (২০০৬-২০১৪) ফিল্ম সিরিজে নারীদের যৌনআবেদনময়ী,  আকাঙ্ক্ষার বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।    


ইদানিং অবশ্য অনেক ফিল্ম নির্মাতা প্রায়ই নারী চরিত্রগুলাকে তাদের জটিল ব্যাকস্টোরি, দৃঢ় ইচ্ছা ও সক্রিয় ভূমিকা বাদ দিয়ে তাদেরকে ‘নিছক’ যৌন আবেদনময়ী বস্তু হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়টি এড়াতে চেষ্টা করেন। এরপরও পুরুষালি  নজর (masculine gaze) অনেক স্বাভাবিক। দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস (২০১২) -এ  ক্যাটওমেন এর ব্যক্তিগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মোটিভেশন আছে। এরপরও তাকে এমনভাবে উপস্থাপণ করা হয়েছে যেন তাকে দেখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা লাগে।         

তাকানোর বিভিন্ন ধরন  
চল্লিশ বছর আগে রচিত মালভির প্রবন্ধ এখনও জোড়ালো প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই সিনেমায় অবজেক্টিফাই করা হয়—একটা সাধারণ উত্তর। গিল্ডা (১৯৪৬) সিনেমায় জনি ফ্যারেল (গ্লেন ফোর্ড) কি গিল্ডা মান্ডসনের (রিটা হেইওয়ার্থ) মতই সেক্সি নয়?  বিবিসি টেলিসিরিজের প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস (১৯৯৫)-এর  ফিটজ উইলিয়াম ডার্সি এলিজাবেথ বেনেটের মতই সুন্দর নয় কি? নিঃসন্দেহে এসব হেটারোসেক্সুয়াল নারী নজরের উপস্থিতির জানান দেয়।  

এ ধরণের আলোচনা নারীদের ক্রমাগতভাবে সেক্সুয়াল অবজেক্টের মত দেখানোকে বিবেচনা করে না। দ্য হকেয়ি ইনিশিয়েটিভ (The Hawkeye Initiative) প্রজেক্টটি কমিকস ও চলচ্চিত্রে পুরুষ এবং নারী সুপারহিরোদের ভিন্নভাবে   উপস্থাপনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিচের ইলাস্ট্রেশনটিতে এভেঞ্জার্স  (The Avengers)-এর  পুরুষ হিরোদের ফিল্মটির একমাত্র নারী চরিত্র ব্ল্যাক উইডোর মত করেই হাইপার-সেক্সুয়ালাইজডভাবে দেখিয়েছে।       

হকাই ইনিশিয়েটিভ এর চোখে পুরুষ নজর এভেঞ্জারের ওপর প্রয়োগ করলে যেমন দেখাতো


ইলাস্ট্রেশনটি ডাবল স্ট্যান্ডার্ডকে তুলে ধরে। কিন্তু মজাটা আসে পুরুষদের নারীদের মতো যৌনায়িত নজরে দেখায় অনভ্যস্ততা থেকে। আরেকটা আলোচনা হল, সিনেমায় নারীদের পুরুষদেহ আকাঙ্ক্ষা করতে উৎসাহিত করে না বরং নারী দর্শকদের পুরুষ আকাঙ্ক্ষিত নায়িকার সাথে আইডেন্টিফাই করতে বাধ্য করা হয়। এই যুক্তি অনুযায়ী ফিটজউইলিয়াম ডার্সির ভেজা আন্ডারশার্ট নয়, বরং এলিজাবেথের প্রতি ডার্সির তীব্র আকাঙ্ক্ষাই নারী দর্শকদের প্রকৃতভাবে আকর্ষণ করে।   

নারী নজর  (female gaze) বলে কিছু আছে কি?   

অনেক সিনেমা নারীর আকাঙ্ক্ষাকে প্রকাশ করে non gaze উপায়সমূহের মাধ্যমে। জেন ক্যাম্পিয়নের দ্যি পিয়ানো (১৯৯৩) সিনেমায় নায়িকার তীব্র সেন্টিমেন্টাল প্রকৃতি জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে প্রকাশ করে। সোফিয়া কপ্পোলার দ্য ভার্জিন সুইসাইডস (১৯৯৯) সিনেমায় টিনেজ চরিত্রদের জীবন তুলে আনার মাধ্যমে নারীদের অভিজ্ঞতা শব্দ এবং ভিজুয়াল এস্থেটিক্সের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। মেয়েদের বয়ঃসন্ধিকাল প্রকাশে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে উষ্ণ টোন (হলুদ, স্যামন), ‘মেয়েলি’ প্রতীক (ফুল, ইউনিকর্ন) এবং গান ব্যবহার করা হয়েছে। কপ্পোলা একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করেন ম্যারি অ্যানটোয়েনেট (২০০৬) সিনেমাতেও। তিনি ফ্লোরিড সেট ডিজাইনের মাধ্যমে ভার্সাই শহরে নারীদের আবদ্ধ, দমবন্ধ জীবন দেখিয়েছেন।    

নারীদের আকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে ভালো প্রকাশ হয় নজর বা gaze এর পরিবর্তে অনুভূতির মাধ্যমে। এই বয়ান বলে, গতানুগতিক পুরুষালি আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমূলক, অন্যদিকে নারীরা অনুভূতিপ্রবণ। কিন্তু পুরুষের অভ্যন্তরীন জীবন সবসময়ই শব্দ এবং অনুভবের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। যেমন, র‍্যাম্বো (২০০৮) অথবা ক্যাসিনো রয়্যাল (২০০৬) পুরুষের যন্ত্রণা ও আগ্রাসন দিয়ে ভরপুর করে রেখেছে অনুভূতি।           
নারী নজর  (female gaze) কি আছে তাহলে?
অবশ্যই আছে। সিনেমায়  সুদর্শন পুরুষের আধিক্য আছে। কিন্তু নারীদের সমান পুরুষ নজর স্পষ্টত নেই। পুরুষ নজর ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। পুরুষ নজর পুরুষতান্ত্রিক স্ট্যাটাস-কো কে সমর্থন করে নারীদের বাস্তব জীবনে যৌনবস্তুকরণকে স্থায়ী করে।  


এ কারণে, নারী নজর, পুরুষ নজর-এর মত হতে পারেনা। বরং নারীদের অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে বানানো চলচ্চিত্রগুলো বিধ্বংসী। ফিশ ট্যাংক (২০০৯) চলচ্চিত্রটি সুবিধাবঞ্চিত একজন মেয়ের দুর্বলতা নিয়ে, তার সাবালক হয়ে ওঠার গল্প। ইন দ্য কাট (২০০৩) সিনেমা একজন নারীর যৌনতার অনুসন্ধানের গল্প নিয়ে।     
নারীদের যৌনতা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হওয়ার জন্য সেন্সরশীপের সম্মুখীন হয়। যেমন, দ্য  কুলার (২০০৩), বয়েজ ডোন্ট ক্রাই (১৯৯৯) এবং ব্লু ভ্যালেন্টাইন (২০১০) এর নির্মাতা তাদের সিনেমার  অথবা এন.সি-১৭ এর কাতারে পড়ে নারী যোনীলেহন বর্ণনা  করার জন্য। এরকম দৃশ্য নারীর তৃপ্তির দিকে গুরুত্ব দেয় এবং নারীর to-be-looked-at-ness-কে ছোট করে দেখায়। দ্য পিয়ানো, ইন দ্যা কাট বা ম্যারি অ্যানটোইনেট-এর মত সিনেমা গান, কামোত্তেজক দৃশ্য এবং ভিজুয়াল এসথেটিক্স ব্যবহার করে নারীবাদি নজর প্রকাশ করতে পারে। এভাবে এ সিনেমাগুলো নারীকে অবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার না করে সাবজেক্ট হিসেবে দেখিয়ে নজর-এর (gaze) বিরোধিতা করে এবং সিনেমা ও  মিডিয়ায় পুরুষ নজরকে পুরোপুরি অনুকরণ না করে, এগুলো পুরুষালি দুনিয়ার নজর ভঙ্গির প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করে।  

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।