অর্থনীতির চোখে মেয়েদের বিয়ের বাজার

IMG-20240430-WA0003
নাজমুল হোসেন
হিউমারিস্ট

বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ওই দিকের কিছু অঞ্চলে মেয়েদের প্রথমবার পিরিয়ড হলে বাসায় পায়েস বা সিন্নি টাইপ কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা টুকটাক দেখতেও আসে। নতুন জামা দেয়। এই সংস্কৃতিটা জানার ও দেখার পর আমি পুলকিত অনুভব করেছিলাম। এরপর বিষয়টি মূল খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়ে বড় হয়েছে, ভালো পাত্র থাকলে জানাবেন—মূলত আত্মীয় ও প্রতিবেশিকে এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই পিরিয়ড নিয়ে এত আয়োজন। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের বড় করা হয় একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এই উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বিয়ে। এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে।  


জন্ম থেকে শুরু  

একসময় কারও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে আত্নীয়স্বজনরা নতুন বাবাকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিতো। মেয়ে বড় হবে, মেয়ের সাথে সাথে গাছও বড় হবে। বিয়ের বয়স হলে এই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। মূল উদ্দেশ্য মেয়ের জন্য সেভিংস করা। সরি, মেয়ের জন্য না; বাক্যটা হবে, মেয়ের বিয়ের জন্য সেভিংস।

কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই এই অঞ্চলে বিয়ের ঝনঝনানি শুনবেন। গায়ের রঙ কালো হলে শুনবেন, বিয়ের দিতে খবর আছে। টাকা বেশি করে জমাও। 

গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সমস্যা। তখন শুনতে হয়–এত সুন্দর মেয়ে। মা গো মা। এই মেয়ের জন্য জামাই পাওয়া যাবে না।  

এই অঞ্চলে দাদিদের অন্যতম অবসর বিনোদন হচ্ছে বিয়ে দেয়া। সিরিয়াস বিয়ে না। খেলনা বিয়ে। বেশিরভাগ দাদিকেই দেখবেন, অবসরে বসে নিজের বাচ্চাবাচ্চা নাতি-নাতনীদের বিয়ে ঠিক করছে। প্রিয় পাঠক, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছোটবেলায় আপনার দাদি কোন কাজিনের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছিল?  

ছোটবেলায় দাদির দেয়া এই কাজিন ম্যারিজ থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, চট্টগ্রামবাসী আর বের হতে পারেনি! 

পড়ালেখাটাও বিয়ের জন্যই   

ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। আমার মতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে মেয়েদের জীবনের লক্ষ রচনায় একটা উদ্দেশ্যই থাকা উচিৎ, বড় হয়ে বউ হতে চাই। কেন, বুঝিয়ে বলছি। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের পড়ালেখার একটা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিয়ের বাজারের জন্য তাকে প্রস্তুত করা। একটু টেকনোলজির ভাষায় বললে, মেয়েদের পড়ালেখা এখানে বিয়ের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ ফিচার। গ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেয়েদের চাহিদা বেশি, এজন্য দেখবেন মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী। বাজার চাহিদার যোগান দিতে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে যায়।  

বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে অধিনস্ত একজনকে চায়, যে তার কথায় উঠবে আর বসবে। তারা মনে করে, মেয়ে স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলে একটু চালাক হয়ে যায়, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও চালাক। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বিয়ের বাজারে প্রচলিত আছে, বেশি শিক্ষিত মেয়ে জামাইকে দাম দেয় না, মুখের উপর কথা বলে। সোজা কথায়, বেশি শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষের জন্য চ্যালেঞ্জের। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে দেশি পুরুষের প্রথম পছন্দ নবম ও দশম শ্রেণীর কনে। আর একটা ফিচার অবশ্য তাদের আছে। এই ধরনের মেয়েরা সন্তান-সন্ততির প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু সারতে পারবে।  

যারা মনে করে সংসার সামলানোর জন্য একটু চালাক মেয়ের দরকার আছে, তাদের পছন্দের শীর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। এখানে একটা বিশাল অংশ সোল্ড আউট হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর একটা বড় অংশকে ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা অনার্সে ভর্তি করিয়ে রেখে বাবা-মা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলতে পারলে চুকে যায় পড়ালেখার পর্বটাও। যেন বিয়ে করাই ছিল পৃথিবীতে মেয়েটির জন্ম নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য।

আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে একটু খোঁজ নিলে দেখবেন একজন শিক্ষক আছেন যিনি শিক্ষতার পাশাপাশি পার্ট টাইম ম্যাচ মেকিং এর কাজও করেন। কোনো বিবাহযোগ্য পাত্রের বাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সোর্সও তিনিই বটে।   

বিয়ের জন্য প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট  করা

‘কনে দেখা আলো’ বলে দারুণ একটা জিনিস আছে বাংলা ভাষায়। জিনিসটা শুনতে ব্যাপক রোমান্টিক মনে হলেও এই ‘কনে দেখা আলোর’ মিনিং কিন্তু আবার ভিন্ন। মূলত শেষ বিকেলের বা গোধূলির সূর্যের কমলা রঙের আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এই আলোতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বেড়ে যায়। অনেক আগে গ্রামে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাদেখির কাজটা হতো উঠানে। বিকেলের এই কমলা রঙা আলোটা কনের গায়ে এসে পড়লে কনেকে উজ্জ্বল দেখাতো। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কী ডেডিকেশন দেখুন, প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করে ফেলেছি। প্রকৃতি বাদ দিলেও মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর, ওঝাদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ আনার গল্প তো বেশ পুরোনো নয়। কোথাও কোথাও এখনও এমন হয় না, এমনটাও বলা যায় না।  

আর্থিক বিনিয়োগ কেমন?  

ছেলের বিয়ের জন্য বাপ-মা টাকা জমাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে শোনা যায় না। তবে গ্রাম থেকে শহর, বস্তিবাসী থেকে গুলশানবাসী–প্রত্যেকটা বাবা-মাকে দেখবেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণটাও একদমই ফেলে দেয়ার মত না। পরিবারের আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ও তারও বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয় শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য।  

এই বিনিয়োগটা তো শুধু মেয়ের বিয়ের দিনকে কেন্দ্র করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কালচারে এই বিনিয়োগ চলে মেয়ের বিয়ের পর বাকি জীবন। প্রথম এক বছরকে ধরা যেতে পারে গোল্ডেন পিরিয়ড। এই এক বছরে প্রতিটি সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ঋতু পরিবর্তন হওয়াকে কেন্দ্র করেও মেয়ের শশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই যে, মেয়ের বাবা রীতিমত আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে মেয়ের শশুর বাড়িতে কোরবানীর ইদের গরু উপহার পাঠায়। চট্টগ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এমন অন্তত একটা ঘটনা সে আপনাকে জানাতে পারবে। ব্যাংকগুলো চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটা লোনের ব্যবস্থাও করতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কিছু না জেনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম, ব্যবসায় সবুজ বাত্তি। পরে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েন।    

অলঙ্করণঃ রিসাদ

মাইক্রো ক্রেডিট এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর ঘটনাও আমি দেখেছি। এই সংক্রান্ত একটা দারুণ পরিহাসও আছে। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন নিয়ে এনজিওগুলো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে সেসব এনজিওর মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বাবা-মা মেয়ের শশুর বাড়িতে বাধ্যতামূলক উপহার পাঠাচ্ছে। এনজিওগুলো এইসব জানেন না নিশ্চয়ই। ওনারা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। অবশ্য বিয়েতে এই বিনিয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করলে সেটা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার চেয়ে কম না।   

মেয়ের বিয়ের জন্য ভিক্ষা করার ঘটনা তো শহরের লোকাল বাসে কিংবা গ্রামের কোনো রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। দু-এক টাকা দিয়েছেনও হয়তো। গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। হিসেব করলে বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ের এই বাজারে এই অধমেরও হাজার খানেক টাকার বিনিয়োগ আছে। গ্রামের দিকে কিন্তু কোনো মেয়ের জন্য টাকা দেয়াটা এক ধরনের সমাজসেবা। কোনো সমাজসেবক এলাকায় কতটি মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করেছে–এটা সমাজসেবকদের পোর্টফোলিও মাপার অন্যতম নিয়ামক।    

এই ব্যাপারটায় ছেলেদের জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোসই লাগে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে দায়িত্ববান বাবা-মা বলবে, কিছু টাকা পেয়েও যাবেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে ‘হাহা’ রিএ্যাক্ট দেবে। 


স্কিল বিনিয়োগ 

বাংলাদেশে একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে যে সকল স্কিল শেখে বা তাকে শেখানো হয় সেখান থেকে কয়েকটি স্কিল কি দেখানো যাবে, যেগুলো বিয়েকে উদ্দেশ্য করে শেখা না! আমি অন্তত খুব একটা দেখি না। রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা পালা, পিঠা-পুলি বানানো সবকিছু শেখানো হয় বিয়েকে উদ্দেশ্য করে। বিয়ের পর যেন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করা যায়। এর মধ্যে অনেক পরিবার মেয়েকে কিছু ক্রিয়েটিভ স্কিলও শেখায়। নকশিকাঁথা সেলাই, কালাভূনা রান্না কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটু গানের গলা থাকা। মেয়েদের এইসব স্কিল বিয়ের বাজারে অনেকটা এক্সট্রা একটা এমবিএ ডিগ্রির মত কাজ করে।  চট্টগ্রামে ব্যাংকের মত স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও এমন ইন্সটিউটিউট গড়ে উঠতে পারে। যারা মেয়েদেরকে নানান স্কিল শেখানোর মাধ্যমে বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।  

চলুন একটা মেয়ের গল্প শুনে লেখাটা শেষ করে ফেলি। লাপাত্তা লেডিস (২০২৩) সিনেমার একটি চরিত্র জয়া। থাকে ভারতের একটি গ্রামে। স্মার্ট, আধুনিক, বুদ্ধিমান। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজটা আয়ত্ত করে ফেলেছে বেশ। তার স্বপ্ন অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা-মাকে জানিয়েছে, দেরাদুনে পড়তে যাবে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে বলে একটা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিনিয়োগটা কিসের জন্য বলুন তো? না, অর্গানিক ফার্মিং এর জন্য না, জমি বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। জামাইকে যৌতুক দেয়ার জন্য। মা জয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বিয়ের পর জামাইকে রাজি করাতে পারলে পড়ালেখা করবে, নইলে করবে না।      

জয়ার এই গল্প আসলে উপমহাদেশের অধিকাংশ মেয়েরই গল্প। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করা, গয়না বিক্রি করা, সম্পদ বন্ধক দেয়া বাংলাদেশেরই নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ ঠিকই আছে, শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ঠিক নাই। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।