বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ওই দিকের কিছু অঞ্চলে মেয়েদের প্রথমবার পিরিয়ড হলে বাসায় পায়েস বা সিন্নি টাইপ কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা টুকটাক দেখতেও আসে। নতুন জামা দেয়। এই সংস্কৃতিটা জানার ও দেখার পর আমি পুলকিত অনুভব করেছিলাম। এরপর বিষয়টি মূল খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়ে বড় হয়েছে, ভালো পাত্র থাকলে জানাবেন—মূলত আত্মীয় ও প্রতিবেশিকে এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই পিরিয়ড নিয়ে এত আয়োজন।
এই অঞ্চলে মেয়েদের বড় করা হয় একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এই উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বিয়ে। এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে।
জন্ম থেকে শুরু
একসময় কারও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে আত্নীয়স্বজনরা নতুন বাবাকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিতো। মেয়ে বড় হবে, মেয়ের সাথে সাথে গাছও বড় হবে। বিয়ের বয়স হলে এই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। মূল উদ্দেশ্য মেয়ের জন্য সেভিংস করা। সরি, মেয়ের জন্য না; বাক্যটা হবে, মেয়ের বিয়ের জন্য সেভিংস।
কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই এই অঞ্চলে বিয়ের ঝনঝনানি শুনবেন। গায়ের রঙ কালো হলে শুনবেন, বিয়ের দিতে খবর আছে। টাকা বেশি করে জমাও।
গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সমস্যা। তখন শুনতে হয়–এত সুন্দর মেয়ে। মা গো মা। এই মেয়ের জন্য জামাই পাওয়া যাবে না।
এই অঞ্চলে দাদিদের অন্যতম অবসর বিনোদন হচ্ছে বিয়ে দেয়া। সিরিয়াস বিয়ে না। খেলনা বিয়ে। বেশিরভাগ দাদিকেই দেখবেন, অবসরে বসে নিজের বাচ্চাবাচ্চা নাতি-নাতনীদের বিয়ে ঠিক করছে। প্রিয় পাঠক, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছোটবেলায় আপনার দাদি কোন কাজিনের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছিল?
ছোটবেলায় দাদির দেয়া এই কাজিন ম্যারিজ থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, চট্টগ্রামবাসী আর বের হতে পারেনি!
পড়ালেখাটাও বিয়ের জন্যই
ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। আমার মতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে মেয়েদের জীবনের লক্ষ রচনায় একটা উদ্দেশ্যই থাকা উচিৎ, বড় হয়ে বউ হতে চাই। কেন, বুঝিয়ে বলছি।
এই অঞ্চলে মেয়েদের পড়ালেখার একটা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিয়ের বাজারের জন্য তাকে প্রস্তুত করা। একটু টেকনোলজির ভাষায় বললে, মেয়েদের পড়ালেখা এখানে বিয়ের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ ফিচার। গ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেয়েদের চাহিদা বেশি, এজন্য দেখবেন মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী। বাজার চাহিদার যোগান দিতে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে অধিনস্ত একজনকে চায়, যে তার কথায় উঠবে আর বসবে। তারা মনে করে, মেয়ে স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলে একটু চালাক হয়ে যায়, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও চালাক। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বিয়ের বাজারে প্রচলিত আছে, বেশি শিক্ষিত মেয়ে জামাইকে দাম দেয় না, মুখের উপর কথা বলে। সোজা কথায়, বেশি শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষের জন্য চ্যালেঞ্জের। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে দেশি পুরুষের প্রথম পছন্দ নবম ও দশম শ্রেণীর কনে। আর একটা ফিচার অবশ্য তাদের আছে। এই ধরনের মেয়েরা সন্তান-সন্ততির প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু সারতে পারবে।
যারা মনে করে সংসার সামলানোর জন্য একটু চালাক মেয়ের দরকার আছে, তাদের পছন্দের শীর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। এখানে একটা বিশাল অংশ সোল্ড আউট হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর একটা বড় অংশকে ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা অনার্সে ভর্তি করিয়ে রেখে বাবা-মা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলতে পারলে চুকে যায় পড়ালেখার পর্বটাও। যেন বিয়ে করাই ছিল পৃথিবীতে মেয়েটির জন্ম নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য।
আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে একটু খোঁজ নিলে দেখবেন একজন শিক্ষক আছেন যিনি শিক্ষতার পাশাপাশি পার্ট টাইম ম্যাচ মেকিং এর কাজও করেন। কোনো বিবাহযোগ্য পাত্রের বাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সোর্সও তিনিই বটে।
বিয়ের জন্য প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করা
‘কনে দেখা আলো’ বলে দারুণ একটা জিনিস আছে বাংলা ভাষায়। জিনিসটা শুনতে ব্যাপক রোমান্টিক মনে হলেও এই ‘কনে দেখা আলোর’ মিনিং কিন্তু আবার ভিন্ন। মূলত শেষ বিকেলের বা গোধূলির সূর্যের কমলা রঙের আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এই আলোতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বেড়ে যায়। অনেক আগে গ্রামে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাদেখির কাজটা হতো উঠানে। বিকেলের এই কমলা রঙা আলোটা কনের গায়ে এসে পড়লে কনেকে উজ্জ্বল দেখাতো। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কী ডেডিকেশন দেখুন, প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করে ফেলেছি। প্রকৃতি বাদ দিলেও মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর, ওঝাদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ আনার গল্প তো বেশ পুরোনো নয়। কোথাও কোথাও এখনও এমন হয় না, এমনটাও বলা যায় না।
আর্থিক বিনিয়োগ কেমন?
ছেলের বিয়ের জন্য বাপ-মা টাকা জমাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে শোনা যায় না। তবে গ্রাম থেকে শহর, বস্তিবাসী থেকে গুলশানবাসী–প্রত্যেকটা বাবা-মাকে দেখবেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণটাও একদমই ফেলে দেয়ার মত না। পরিবারের আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ও তারও বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয় শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য।
এই বিনিয়োগটা তো শুধু মেয়ের বিয়ের দিনকে কেন্দ্র করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কালচারে এই বিনিয়োগ চলে মেয়ের বিয়ের পর বাকি জীবন। প্রথম এক বছরকে ধরা যেতে পারে গোল্ডেন পিরিয়ড। এই এক বছরে প্রতিটি সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ঋতু পরিবর্তন হওয়াকে কেন্দ্র করেও মেয়ের শশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই যে, মেয়ের বাবা রীতিমত আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে মেয়ের শশুর বাড়িতে কোরবানীর ইদের গরু উপহার পাঠায়। চট্টগ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এমন অন্তত একটা ঘটনা সে আপনাকে জানাতে পারবে। ব্যাংকগুলো চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটা লোনের ব্যবস্থাও করতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কিছু না জেনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম, ব্যবসায় সবুজ বাত্তি। পরে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েন।

মাইক্রো ক্রেডিট এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর ঘটনাও আমি দেখেছি। এই সংক্রান্ত একটা দারুণ পরিহাসও আছে। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন নিয়ে এনজিওগুলো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে সেসব এনজিওর মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বাবা-মা মেয়ের শশুর বাড়িতে বাধ্যতামূলক উপহার পাঠাচ্ছে। এনজিওগুলো এইসব জানেন না নিশ্চয়ই। ওনারা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। অবশ্য বিয়েতে এই বিনিয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করলে সেটা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার চেয়ে কম না।
মেয়ের বিয়ের জন্য ভিক্ষা করার ঘটনা তো শহরের লোকাল বাসে কিংবা গ্রামের কোনো রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। দু-এক টাকা দিয়েছেনও হয়তো। গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। হিসেব করলে বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ের এই বাজারে এই অধমেরও হাজার খানেক টাকার বিনিয়োগ আছে। গ্রামের দিকে কিন্তু কোনো মেয়ের জন্য টাকা দেয়াটা এক ধরনের সমাজসেবা। কোনো সমাজসেবক এলাকায় কতটি মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করেছে–এটা সমাজসেবকদের পোর্টফোলিও মাপার অন্যতম নিয়ামক।
এই ব্যাপারটায় ছেলেদের জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোসই লাগে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে দায়িত্ববান বাবা-মা বলবে, কিছু টাকা পেয়েও যাবেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে ‘হাহা’ রিএ্যাক্ট দেবে।
স্কিল বিনিয়োগ
বাংলাদেশে একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে যে সকল স্কিল শেখে বা তাকে শেখানো হয় সেখান থেকে কয়েকটি স্কিল কি দেখানো যাবে, যেগুলো বিয়েকে উদ্দেশ্য করে শেখা না! আমি অন্তত খুব একটা দেখি না। রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা পালা, পিঠা-পুলি বানানো সবকিছু শেখানো হয় বিয়েকে উদ্দেশ্য করে। বিয়ের পর যেন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করা যায়। এর মধ্যে অনেক পরিবার মেয়েকে কিছু ক্রিয়েটিভ স্কিলও শেখায়। নকশিকাঁথা সেলাই, কালাভূনা রান্না কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটু গানের গলা থাকা। মেয়েদের এইসব স্কিল বিয়ের বাজারে অনেকটা এক্সট্রা একটা এমবিএ ডিগ্রির মত কাজ করে। চট্টগ্রামে ব্যাংকের মত স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও এমন ইন্সটিউটিউট গড়ে উঠতে পারে। যারা মেয়েদেরকে নানান স্কিল শেখানোর মাধ্যমে বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।
চলুন একটা মেয়ের গল্প শুনে লেখাটা শেষ করে ফেলি। লাপাত্তা লেডিস (২০২৩) সিনেমার একটি চরিত্র জয়া। থাকে ভারতের একটি গ্রামে। স্মার্ট, আধুনিক, বুদ্ধিমান। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজটা আয়ত্ত করে ফেলেছে বেশ। তার স্বপ্ন অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা-মাকে জানিয়েছে, দেরাদুনে পড়তে যাবে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে বলে একটা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিনিয়োগটা কিসের জন্য বলুন তো? না, অর্গানিক ফার্মিং এর জন্য না, জমি বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। জামাইকে যৌতুক দেয়ার জন্য। মা জয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বিয়ের পর জামাইকে রাজি করাতে পারলে পড়ালেখা করবে, নইলে করবে না।

জয়ার এই গল্প আসলে উপমহাদেশের অধিকাংশ মেয়েরই গল্প। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করা, গয়না বিক্রি করা, সম্পদ বন্ধক দেয়া বাংলাদেশেরই নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ ঠিকই আছে, শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ঠিক নাই।