বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ওই দিকের কিছু অঞ্চলে মেয়েদের প্রথমবার পিরিয়ড হলে বাসায় পায়েস বা সিন্নি টাইপ কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা টুকটাক দেখতেও আসে। নতুন জামা দেয়। এই সংস্কৃতিটা জানার ও দেখার পর আমি পুলকিত অনুভব করেছিলাম। এরপর বিষয়টি মূল খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়ে বড় হয়েছে, ভালো পাত্র থাকলে জানাবেন—মূলত আত্মীয় ও প্রতিবেশিকে এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই পিরিয়ড নিয়ে এত আয়োজন।
এই অঞ্চলে মেয়েদের বড় করা হয় একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এই উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বিয়ে। এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে।
জন্ম থেকে শুরু
একসময় কারও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে আত্নীয়স্বজনরা নতুন বাবাকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিতো। মেয়ে বড় হবে, মেয়ের সাথে সাথে গাছও বড় হবে। বিয়ের বয়স হলে এই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। মূল উদ্দেশ্য মেয়ের জন্য সেভিংস করা। সরি, মেয়ের জন্য না; বাক্যটা হবে, মেয়ের বিয়ের জন্য সেভিংস।
কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই এই অঞ্চলে বিয়ের ঝনঝনানি শুনবেন। গায়ের রঙ কালো হলে শুনবেন, বিয়ের দিতে খবর আছে। টাকা বেশি করে জমাও।
গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সমস্যা। তখন শুনতে হয়–এত সুন্দর মেয়ে। মা গো মা। এই মেয়ের জন্য জামাই পাওয়া যাবে না।
এই অঞ্চলে দাদিদের অন্যতম অবসর বিনোদন হচ্ছে বিয়ে দেয়া। সিরিয়াস বিয়ে না। খেলনা বিয়ে। বেশিরভাগ দাদিকেই দেখবেন, অবসরে বসে নিজের বাচ্চাবাচ্চা নাতি-নাতনীদের বিয়ে ঠিক করছে। প্রিয় পাঠক, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছোটবেলায় আপনার দাদি কোন কাজিনের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছিল?
ছোটবেলায় দাদির দেয়া এই কাজিন ম্যারিজ থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, চট্টগ্রামবাসী আর বের হতে পারেনি!
পড়ালেখাটাও বিয়ের জন্যই
ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। আমার মতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে মেয়েদের জীবনের লক্ষ রচনায় একটা উদ্দেশ্যই থাকা উচিৎ, বড় হয়ে বউ হতে চাই। কেন, বুঝিয়ে বলছি।
এই অঞ্চলে মেয়েদের পড়ালেখার একটা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিয়ের বাজারের জন্য তাকে প্রস্তুত করা। একটু টেকনোলজির ভাষায় বললে, মেয়েদের পড়ালেখা এখানে বিয়ের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ ফিচার। গ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেয়েদের চাহিদা বেশি, এজন্য দেখবেন মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী। বাজার চাহিদার যোগান দিতে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে অধিনস্ত একজনকে চায়, যে তার কথায় উঠবে আর বসবে। তারা মনে করে, মেয়ে স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলে একটু চালাক হয়ে যায়, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও চালাক। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বিয়ের বাজারে প্রচলিত আছে, বেশি শিক্ষিত মেয়ে জামাইকে দাম দেয় না, মুখের উপর কথা বলে। সোজা কথায়, বেশি শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষের জন্য চ্যালেঞ্জের। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে দেশি পুরুষের প্রথম পছন্দ নবম ও দশম শ্রেণীর কনে। আর একটা ফিচার অবশ্য তাদের আছে। এই ধরনের মেয়েরা সন্তান-সন্ততির প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু সারতে পারবে।
যারা মনে করে সংসার সামলানোর জন্য একটু চালাক মেয়ের দরকার আছে, তাদের পছন্দের শীর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। এখানে একটা বিশাল অংশ সোল্ড আউট হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর একটা বড় অংশকে ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা অনার্সে ভর্তি করিয়ে রেখে বাবা-মা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলতে পারলে চুকে যায় পড়ালেখার পর্বটাও। যেন বিয়ে করাই ছিল পৃথিবীতে মেয়েটির জন্ম নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য।
আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে একটু খোঁজ নিলে দেখবেন একজন শিক্ষক আছেন যিনি শিক্ষতার পাশাপাশি পার্ট টাইম ম্যাচ মেকিং এর কাজও করেন। কোনো বিবাহযোগ্য পাত্রের বাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সোর্সও তিনিই বটে।
বিয়ের জন্য প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করা
‘কনে দেখা আলো’ বলে দারুণ একটা জিনিস আছে বাংলা ভাষায়। জিনিসটা শুনতে ব্যাপক রোমান্টিক মনে হলেও এই ‘কনে দেখা আলোর’ মিনিং কিন্তু আবার ভিন্ন। মূলত শেষ বিকেলের বা গোধূলির সূর্যের কমলা রঙের আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এই আলোতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বেড়ে যায়। অনেক আগে গ্রামে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাদেখির কাজটা হতো উঠানে। বিকেলের এই কমলা রঙা আলোটা কনের গায়ে এসে পড়লে কনেকে উজ্জ্বল দেখাতো। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কী ডেডিকেশন দেখুন, প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করে ফেলেছি। প্রকৃতি বাদ দিলেও মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর, ওঝাদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ আনার গল্প তো বেশ পুরোনো নয়। কোথাও কোথাও এখনও এমন হয় না, এমনটাও বলা যায় না।
আর্থিক বিনিয়োগ কেমন?
ছেলের বিয়ের জন্য বাপ-মা টাকা জমাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে শোনা যায় না। তবে গ্রাম থেকে শহর, বস্তিবাসী থেকে গুলশানবাসী–প্রত্যেকটা বাবা-মাকে দেখবেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণটাও একদমই ফেলে দেয়ার মত না। পরিবারের আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ও তারও বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয় শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য।
এই বিনিয়োগটা তো শুধু মেয়ের বিয়ের দিনকে কেন্দ্র করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কালচারে এই বিনিয়োগ চলে মেয়ের বিয়ের পর বাকি জীবন। প্রথম এক বছরকে ধরা যেতে পারে গোল্ডেন পিরিয়ড। এই এক বছরে প্রতিটি সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ঋতু পরিবর্তন হওয়াকে কেন্দ্র করেও মেয়ের শশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই যে, মেয়ের বাবা রীতিমত আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে মেয়ের শশুর বাড়িতে কোরবানীর ইদের গরু উপহার পাঠায়। চট্টগ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এমন অন্তত একটা ঘটনা সে আপনাকে জানাতে পারবে। ব্যাংকগুলো চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটা লোনের ব্যবস্থাও করতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কিছু না জেনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম, ব্যবসায় সবুজ বাত্তি। পরে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েন।
অলঙ্করণঃ রিসাদ
মাইক্রো ক্রেডিট এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর ঘটনাও আমি দেখেছি। এই সংক্রান্ত একটা দারুণ পরিহাসও আছে। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন নিয়ে এনজিওগুলো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে সেসব এনজিওর মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বাবা-মা মেয়ের শশুর বাড়িতে বাধ্যতামূলক উপহার পাঠাচ্ছে। এনজিওগুলো এইসব জানেন না নিশ্চয়ই। ওনারা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। অবশ্য বিয়েতে এই বিনিয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করলে সেটা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার চেয়ে কম না।
মেয়ের বিয়ের জন্য ভিক্ষা করার ঘটনা তো শহরের লোকাল বাসে কিংবা গ্রামের কোনো রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। দু-এক টাকা দিয়েছেনও হয়তো। গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। হিসেব করলে বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ের এই বাজারে এই অধমেরও হাজার খানেক টাকার বিনিয়োগ আছে। গ্রামের দিকে কিন্তু কোনো মেয়ের জন্য টাকা দেয়াটা এক ধরনের সমাজসেবা। কোনো সমাজসেবক এলাকায় কতটি মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করেছে–এটা সমাজসেবকদের পোর্টফোলিও মাপার অন্যতম নিয়ামক।
এই ব্যাপারটায় ছেলেদের জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোসই লাগে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে দায়িত্ববান বাবা-মা বলবে, কিছু টাকা পেয়েও যাবেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে ‘হাহা’ রিএ্যাক্ট দেবে।
স্কিল বিনিয়োগ
বাংলাদেশে একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে যে সকল স্কিল শেখে বা তাকে শেখানো হয় সেখান থেকে কয়েকটি স্কিল কি দেখানো যাবে, যেগুলো বিয়েকে উদ্দেশ্য করে শেখা না! আমি অন্তত খুব একটা দেখি না। রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা পালা, পিঠা-পুলি বানানো সবকিছু শেখানো হয় বিয়েকে উদ্দেশ্য করে। বিয়ের পর যেন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করা যায়। এর মধ্যে অনেক পরিবার মেয়েকে কিছু ক্রিয়েটিভ স্কিলও শেখায়। নকশিকাঁথা সেলাই, কালাভূনা রান্না কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটু গানের গলা থাকা। মেয়েদের এইসব স্কিল বিয়ের বাজারে অনেকটা এক্সট্রা একটা এমবিএ ডিগ্রির মত কাজ করে। চট্টগ্রামে ব্যাংকের মত স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও এমন ইন্সটিউটিউট গড়ে উঠতে পারে। যারা মেয়েদেরকে নানান স্কিল শেখানোর মাধ্যমে বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।
চলুন একটা মেয়ের গল্প শুনে লেখাটা শেষ করে ফেলি। লাপাত্তা লেডিস (২০২৩) সিনেমার একটি চরিত্র জয়া। থাকে ভারতের একটি গ্রামে। স্মার্ট, আধুনিক, বুদ্ধিমান। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজটা আয়ত্ত করে ফেলেছে বেশ। তার স্বপ্ন অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা-মাকে জানিয়েছে, দেরাদুনে পড়তে যাবে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে বলে একটা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিনিয়োগটা কিসের জন্য বলুন তো? না, অর্গানিক ফার্মিং এর জন্য না, জমি বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। জামাইকে যৌতুক দেয়ার জন্য। মা জয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বিয়ের পর জামাইকে রাজি করাতে পারলে পড়ালেখা করবে, নইলে করবে না।
জয়ার এই গল্প আসলে উপমহাদেশের অধিকাংশ মেয়েরই গল্প। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করা, গয়না বিক্রি করা, সম্পদ বন্ধক দেয়া বাংলাদেশেরই নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ ঠিকই আছে, শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ঠিক নাই।
ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’
[elementor-template id="1854"]
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
সিমু নাসের
আরেফিন
আরেফিন
স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।
আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।
আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে। পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।
একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য। আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে। কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর।
নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।
স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়।
মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন – ‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক।
মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।
মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’
পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।
পুঁজির একনায়কতন্ত্র
কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।
ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে।
কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো- কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব।
যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।
পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।
সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ, উৎপাদন যখন অবস্তুগত হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।
বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান।
নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব।
বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।
অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় ।
আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে।
ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।
আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়? ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়।
আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’
নজরদারী স্বৈরাচার
শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।
কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর।
তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।
বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।
গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা। তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই।
যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়।
স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়। এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।
নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।
বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই।
স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।
স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’
এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।
সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।
লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে।
আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে।
আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ। কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।
যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো- সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে।
স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি।
স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।