অর্থনীতির চোখে মেয়েদের বিয়ের বাজার

IMG-20240430-WA0003
নাজমুল হোসেন
হিউমারিস্ট

বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ওই দিকের কিছু অঞ্চলে মেয়েদের প্রথমবার পিরিয়ড হলে বাসায় পায়েস বা সিন্নি টাইপ কিছু রান্না করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা টুকটাক দেখতেও আসে। নতুন জামা দেয়। এই সংস্কৃতিটা জানার ও দেখার পর আমি পুলকিত অনুভব করেছিলাম। এরপর বিষয়টি মূল খুঁজতে গিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, মেয়ে বড় হয়েছে, ভালো পাত্র থাকলে জানাবেন—মূলত আত্মীয় ও প্রতিবেশিকে এই বার্তাটি দেয়ার জন্যই পিরিয়ড নিয়ে এত আয়োজন। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের বড় করা হয় একটা মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। আর এই উদ্দেশ্যটি হচ্ছে বিয়ে। এখানে বেশিরভাগ মেয়ের জীবনে পরিবার ও সমাজের প্রতিটি বিনিয়োগই হয় বিয়েকে কেন্দ্র করে।  


জন্ম থেকে শুরু  

একসময় কারও কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথে আত্নীয়স্বজনরা নতুন বাবাকে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিতো। মেয়ে বড় হবে, মেয়ের সাথে সাথে গাছও বড় হবে। বিয়ের বয়স হলে এই গাছ বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে। মূল উদ্দেশ্য মেয়ের জন্য সেভিংস করা। সরি, মেয়ের জন্য না; বাক্যটা হবে, মেয়ের বিয়ের জন্য সেভিংস।

কন্যা সন্তান জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই এই অঞ্চলে বিয়ের ঝনঝনানি শুনবেন। গায়ের রঙ কালো হলে শুনবেন, বিয়ের দিতে খবর আছে। টাকা বেশি করে জমাও। 

গায়ের রঙ ফর্সা হলেও সমস্যা। তখন শুনতে হয়–এত সুন্দর মেয়ে। মা গো মা। এই মেয়ের জন্য জামাই পাওয়া যাবে না।  

এই অঞ্চলে দাদিদের অন্যতম অবসর বিনোদন হচ্ছে বিয়ে দেয়া। সিরিয়াস বিয়ে না। খেলনা বিয়ে। বেশিরভাগ দাদিকেই দেখবেন, অবসরে বসে নিজের বাচ্চাবাচ্চা নাতি-নাতনীদের বিয়ে ঠিক করছে। প্রিয় পাঠক, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ছোটবেলায় আপনার দাদি কোন কাজিনের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক করেছিল?  

ছোটবেলায় দাদির দেয়া এই কাজিন ম্যারিজ থেকে অনেকে বের হয়ে আসতে পারলেও, চট্টগ্রামবাসী আর বের হতে পারেনি! 

পড়ালেখাটাও বিয়ের জন্যই   

ছোটবেলায় জীবনের লক্ষ্য রচনায় আমরা সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইতাম। আমার মতে ছেলেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা ঠিক আছে। তবে মেয়েদের জীবনের লক্ষ রচনায় একটা উদ্দেশ্যই থাকা উচিৎ, বড় হয়ে বউ হতে চাই। কেন, বুঝিয়ে বলছি। 

এই অঞ্চলে মেয়েদের পড়ালেখার একটা অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিয়ের বাজারের জন্য তাকে প্রস্তুত করা। একটু টেকনোলজির ভাষায় বললে, মেয়েদের পড়ালেখা এখানে বিয়ের জন্য একটা এক্সক্লুসিভ ফিচার। গ্রামে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ালেখা করা মেয়েদের চাহিদা বেশি, এজন্য দেখবেন মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে প্রচুর মেয়ে শিক্ষার্থী। বাজার চাহিদার যোগান দিতে মাধ্যমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে একটা বড় অংশের বিয়ে হয়ে যায়।  

বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে নবম-দশম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে কিছু কারণ আছে। বেশিরভাগ পুরুষই স্ত্রী হিসেবে অধিনস্ত একজনকে চায়, যে তার কথায় উঠবে আর বসবে। তারা মনে করে, মেয়ে স্কুল ছেড়ে কলেজে গেলে একটু চালাক হয়ে যায়, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আরও চালাক। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর বিয়ের বাজারে প্রচলিত আছে, বেশি শিক্ষিত মেয়ে জামাইকে দাম দেয় না, মুখের উপর কথা বলে। সোজা কথায়, বেশি শিক্ষিত মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা পুরুষের জন্য চ্যালেঞ্জের। সেজন্য নিয়ন্ত্রণ করার স্বার্থে দেশি পুরুষের প্রথম পছন্দ নবম ও দশম শ্রেণীর কনে। আর একটা ফিচার অবশ্য তাদের আছে। এই ধরনের মেয়েরা সন্তান-সন্ততির প্রাথমিক শিক্ষার কাজটুকু সারতে পারবে।  

যারা মনে করে সংসার সামলানোর জন্য একটু চালাক মেয়ের দরকার আছে, তাদের পছন্দের শীর্ষে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া মেয়ে। এখানে একটা বিশাল অংশ সোল্ড আউট হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক শেষে আর একটা বড় অংশকে ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে কিংবা অনার্সে ভর্তি করিয়ে রেখে বাবা-মা বিয়ের জন্য অপেক্ষা করে। বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলতে পারলে চুকে যায় পড়ালেখার পর্বটাও। যেন বিয়ে করাই ছিল পৃথিবীতে মেয়েটির জন্ম নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য।

আর একটা মজার বিষয় হচ্ছে, গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে একটু খোঁজ নিলে দেখবেন একজন শিক্ষক আছেন যিনি শিক্ষতার পাশাপাশি পার্ট টাইম ম্যাচ মেকিং এর কাজও করেন। কোনো বিবাহযোগ্য পাত্রের বাবার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সোর্সও তিনিই বটে।   

বিয়ের জন্য প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট  করা

‘কনে দেখা আলো’ বলে দারুণ একটা জিনিস আছে বাংলা ভাষায়। জিনিসটা শুনতে ব্যাপক রোমান্টিক মনে হলেও এই ‘কনে দেখা আলোর’ মিনিং কিন্তু আবার ভিন্ন। মূলত শেষ বিকেলের বা গোধূলির সূর্যের কমলা রঙের আলোকে কনে দেখা আলো বলে। কারণ এই আলোতে মেয়েদের সৌন্দর্য্য বেড়ে যায়। অনেক আগে গ্রামে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখাদেখির কাজটা হতো উঠানে। বিকেলের এই কমলা রঙা আলোটা কনের গায়ে এসে পড়লে কনেকে উজ্জ্বল দেখাতো। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য আমাদের কী ডেডিকেশন দেখুন, প্রকৃতিকেও ম্যানিপুলেট করে ফেলেছি। প্রকৃতি বাদ দিলেও মেয়ের বিয়ের জন্য হুজুর, ওঝাদের কাছ থেকে তাবিজ-কবজ আনার গল্প তো বেশ পুরোনো নয়। কোথাও কোথাও এখনও এমন হয় না, এমনটাও বলা যায় না।  

আর্থিক বিনিয়োগ কেমন?  

ছেলের বিয়ের জন্য বাপ-মা টাকা জমাচ্ছে, এই ধরনের ঘটনা বাংলাদেশে শোনা যায় না। তবে গ্রাম থেকে শহর, বস্তিবাসী থেকে গুলশানবাসী–প্রত্যেকটা বাবা-মাকে দেখবেন মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে। বিনিয়োগের পরিমাণটাও একদমই ফেলে দেয়ার মত না। পরিবারের আর্থিক অবস্থান বিবেচনায় সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ ও তারও বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয় শুধু মাত্র মেয়ের বিয়ের জন্য।  

এই বিনিয়োগটা তো শুধু মেয়ের বিয়ের দিনকে কেন্দ্র করে না। বাংলাদেশের সামাজিক কালচারে এই বিনিয়োগ চলে মেয়ের বিয়ের পর বাকি জীবন। প্রথম এক বছরকে ধরা যেতে পারে গোল্ডেন পিরিয়ড। এই এক বছরে প্রতিটি সামাজিক, ধর্মীয় উৎসব, এমনকি ঋতু পরিবর্তন হওয়াকে কেন্দ্র করেও মেয়ের শশুর বাড়িতে উপহার পাঠাতে হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিষয়টার গুরুত্ব এতটাই যে, মেয়ের বাবা রীতিমত আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে মেয়ের শশুর বাড়িতে কোরবানীর ইদের গরু উপহার পাঠায়। চট্টগ্রামের যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এমন অন্তত একটা ঘটনা সে আপনাকে জানাতে পারবে। ব্যাংকগুলো চাইলে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সম্পর্কিত একটা লোনের ব্যবস্থাও করতে পারে। ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে কিছু না জেনেও চোখ বন্ধ করে বলে দিলাম, ব্যবসায় সবুজ বাত্তি। পরে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েন।    

অলঙ্করণঃ রিসাদ

মাইক্রো ক্রেডিট এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শশুরবাড়িতে উপহার পাঠানোর ঘটনাও আমি দেখেছি। এই সংক্রান্ত একটা দারুণ পরিহাসও আছে। একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, যৌতুক প্রথা, নারী নির্যাতন নিয়ে এনজিওগুলো ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে সেসব এনজিওর মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বাবা-মা মেয়ের শশুর বাড়িতে বাধ্যতামূলক উপহার পাঠাচ্ছে। এনজিওগুলো এইসব জানেন না নিশ্চয়ই। ওনারা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ঋণ দেন। অবশ্য বিয়েতে এই বিনিয়োগের গুরুত্ব বিবেচনা করলে সেটা তো ক্ষুদ্র ব্যবসার চেয়ে কম না।   

মেয়ের বিয়ের জন্য ভিক্ষা করার ঘটনা তো শহরের লোকাল বাসে কিংবা গ্রামের কোনো রাস্তায় নিশ্চয়ই আপনার চোখে পড়েছে। দু-এক টাকা দিয়েছেনও হয়তো। গ্রামে প্রচুর দেখা যায়। হিসেব করলে বাংলাদেশে মেয়ের বিয়ের এই বাজারে এই অধমেরও হাজার খানেক টাকার বিনিয়োগ আছে। গ্রামের দিকে কিন্তু কোনো মেয়ের জন্য টাকা দেয়াটা এক ধরনের সমাজসেবা। কোনো সমাজসেবক এলাকায় কতটি মেয়ের বিয়েতে আর্থিক সাহায্য করেছে–এটা সমাজসেবকদের পোর্টফোলিও মাপার অন্যতম নিয়ামক।    

এই ব্যাপারটায় ছেলেদের জন্য আমার মাঝে মাঝে আফসোসই লাগে। মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে দায়িত্ববান বাবা-মা বলবে, কিছু টাকা পেয়েও যাবেন। কিন্তু ছেলের বিয়ের জন্য টাকা চান, সমাজ আপনাকে ‘হাহা’ রিএ্যাক্ট দেবে। 


স্কিল বিনিয়োগ 

বাংলাদেশে একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে যে সকল স্কিল শেখে বা তাকে শেখানো হয় সেখান থেকে কয়েকটি স্কিল কি দেখানো যাবে, যেগুলো বিয়েকে উদ্দেশ্য করে শেখা না! আমি অন্তত খুব একটা দেখি না। রান্না, ঘর গোছানো, বাচ্চাকাচ্চা পালা, পিঠা-পুলি বানানো সবকিছু শেখানো হয় বিয়েকে উদ্দেশ্য করে। বিয়ের পর যেন শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ইমপ্রেস করা যায়। এর মধ্যে অনেক পরিবার মেয়েকে কিছু ক্রিয়েটিভ স্কিলও শেখায়। নকশিকাঁথা সেলাই, কালাভূনা রান্না কিংবা শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে একটু গানের গলা থাকা। মেয়েদের এইসব স্কিল বিয়ের বাজারে অনেকটা এক্সট্রা একটা এমবিএ ডিগ্রির মত কাজ করে।  চট্টগ্রামে ব্যাংকের মত স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও এমন ইন্সটিউটিউট গড়ে উঠতে পারে। যারা মেয়েদেরকে নানান স্কিল শেখানোর মাধ্যমে বিয়ের বাজারের জন্য প্রস্তুত করে তুলবে।  

চলুন একটা মেয়ের গল্প শুনে লেখাটা শেষ করে ফেলি। লাপাত্তা লেডিস (২০২৩) সিনেমার একটি চরিত্র জয়া। থাকে ভারতের একটি গ্রামে। স্মার্ট, আধুনিক, বুদ্ধিমান। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজটা আয়ত্ত করে ফেলেছে বেশ। তার স্বপ্ন অর্গানিক ফার্মিং নিয়ে পড়াশোনা করার। বাবা-মাকে জানিয়েছে, দেরাদুনে পড়তে যাবে। জয়ার বাবা জয়ার জন্য বিনিয়োগ করবে বলে একটা জমি বিক্রি করে দিয়েছে। বিনিয়োগটা কিসের জন্য বলুন তো? না, অর্গানিক ফার্মিং এর জন্য না, জমি বিক্রি করা হয়েছে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য। জামাইকে যৌতুক দেয়ার জন্য। মা জয়াকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে , বিয়ের পর জামাইকে রাজি করাতে পারলে পড়ালেখা করবে, নইলে করবে না।      

জয়ার এই গল্প আসলে উপমহাদেশের অধিকাংশ মেয়েরই গল্প। মেয়ের বিয়ের জন্য জমি বিক্রি করা, গয়না বিক্রি করা, সম্পদ বন্ধক দেয়া বাংলাদেশেরই নিয়মিত ঘটনা। মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ ঠিকই আছে, শুধু বিনিয়োগের ক্ষেত্রটা ঠিক নাই। 

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।