পুরুষের ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা যুগে যুগে যেভাবে বদলেছে 

 

মিডিয়াতে নারীর দৈহিক গড়ন কীভাবে দেখানো নিয়ে তা লোকে সাধারণত কথা বলে। কিন্তু পুরুষদেরও বডি ইমেজের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে পুরুষের ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা নারীদের তুলনায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।   

পুরুষদের তুলনায় নারীদের উপস্থিতির উপর মিডিয়া এখনও বেশি মনোযোগ দেয়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে আদর্শ শরীর  অর্জনের জন্য পুরুষদের উপর কোন চাপ নেই। যদিও সময়ের সাথে আকর্ষণীয় পুরুষ দেহের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে, আপনি দেখতে পাবেন যে, নারীদের ক্ষেত্রেও, ‘নিখুঁত’-এর সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।           

এবার একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। যাওয়া যাক নিওলিথিক যুগে যখন পুরুষদের নিখুঁত শরীরের ধরন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। আনুমানিক ১২,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে মানুষ শিকারী/সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিকেন্দ্রিক জীবনযাপণ শুরু করেছিল। সারাদিন মহিষ চড়ানোর পরিবর্তে ঘরের সামনে ফসল ফলিয়ে মানুষ নিজের জীবনকে কিছুটা সহজ করে তুলেছিল।     

পিটার জেনিসজেউস্কি একজন বিজ্ঞানী যিনি স্থূলতা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়াশোনা করেছেন। পিটার  ‘ওবিসিটি প্যানাসিয়া’ নামক ব্লগের লেখক। ব্লগটি  স্থূলতা দূর করতে নিবেদিত। পিটার বলেছেন যে সেই সময়ে একজন আদর্শ পুরুষ স্থূল ছিল। যারা কৃষিজমির মালিক ছিল তারা বিশাল ভোজ উপভোগ করত এবং এর ফলে তাদের ওজন বৃদ্ধি পেত। আর একজন স্থূল শরীরের পুরুষকে তার জীর্ণশীর্ণ সমকক্ষদের চেয়ে দেখতে বেশি স্বচ্ছল ও আবেদনময়ী লাগত।   

প্রাচীন গ্রিস (৮০০–১৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)    

প্রাচীন গ্রিকরা তাদের সৌন্দর্যের আদর্শ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিল, যা তাদের শিল্পকর্মে আজও আমরা দেখতে পাই। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে, তারা বড় দেহের কোনো ভোজনপ্রিয় পুরুষে আগ্রহী ছিল না; বরং পেশীবহুল এবং জীর্ণশীর্ণ শরীরের পুরুষই ছিল আদর্শ। তারা দেখতেও ছিল অনেকটা আজকালকার ম্যাগাজিনে দেখতে পাওয়া মডেলদের মতো। যদি গ্রিকদের এই মূর্তিগুলোর মধ্যে কোনো একটি জীবন্ত হয়ে উঠে আসে আর পরবর্তী মার্ভেল মুভিগুলোর জন্য অডিশন দেয় তাহলে অন্তত একটি কলব্যাক পাওয়া তো নিশ্চিত ।                

গ্রিক সৌন্দর্যের জন্য নির্দিষ্ট অনুপাত থাকলেও সেগুলো বাস্তবসম্মত ছিল না। দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ‘তাদের মতো পেশীগুচ্ছ অর্জন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। আপনি এক বছরের জন্য প্রতিদিন জিমে গেলেও এই মূর্তিগুলোর মতো অ্যাপোলো’স বেল্ট বানিয়ে বড়াই করতে পারবেন না।’   

অ্যাপোলো’স বেল্ট (অ্যাডোনিস বেল্ট নামেও পরিচিত) হলো পেটের ভি পেশী যা অনেক পুরুষই অর্জন করার চেষ্টা করে। তাই বর্তমানে এমন অনেক মডার্ন ওয়ার্কআউট তৈরি হয়েছে যেগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো প্রাচীন গ্রিসের আদর্শ পুরুষের মতো ২১ শতকের পুরুষদের দৈহিক গড়ন বানানো।

অলঙ্করণঃ ঈহা

মধ্যযুগ (৮০০-১০০ খ্রিষ্টাব্দ) 

ধারণা করা হয় যে ২০ শতকের আগে মানুষেরা বর্তমান সময়ের তুলনায় খাটো এবং দুর্বল ছিল। কিন্তু অধ্যাপক রিচার্ড স্টেকেলের মতে এই ধারনা ভুল। স্টেকেল গবেষণার উপর ভিত্তি করে ওহাইয়ো স্টেট রিসার্চ নিউজ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মানুষের উচ্চতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে রিপোর্ট করে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে, পুরুষরা ২১ শতকের পুরুষদের মতোই লম্বা ছিল। বিগত ১২০০ বছর আগের হাজার হাজার কঙ্কাল অধ্যয়ন করে তিনি দেখতে পান যে মধ্যযুগে পুরুষদের বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়, তবে ১৭০০ দশকের দিকে তা আড়াই ইঞ্চি হ্রাস পায়। স্টেকেল-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘আড়াই ইঞ্চির এই হ্রাস ১৯ শতকের বিভিন্ন শিল্প বিপ্লবের সময় দেখা যে কোনো উচ্চতার ওঠানামাকে বিশেষভাবে ছাড়িয়ে গেছে।’  আমাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে উচ্চতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কারণ উচ্চতার মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও জানা যায়। লম্বা মানুষ মানেই হচ্ছে সুস্থ মানুষ।      

তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন পুরুষেরা সংকুচিত হয়েছে? স্টেকেল বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। আদি মধ্যযুগের সময় উষ্ণ জলবায়ু ছিল, তাই ফসলও সম্ভবত বেশি পরিমাণে ছিল। বেশি খাবার মানেই স্বাস্থ্যকর শরীর। এছাড়াও, মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলনায়মূলক বেশি বাস করত। মধ্যযুগে কোনো ব্যস্ত শহর ছিল না, ফলে দ্রুত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কম ছিল। নগরায়ন উৎপত্তির সাথে সাথে জলবায়ু উষ্ণ থেকে ঠান্ডা হওয়া, রোগজীবাণুর বিস্তার ও খাদ্যের সম্ভাব্য অভাবে মানুষের স্বাস্থ্য ও গড়নের হ্রাস ঘটাতে থাকে।          

সুতরাং, ছেলেরা তখন অপ্রত্যাশিতভাবে লম্বা ছিল, কিন্তু একজন ‘নিখুঁত’ পুরুষের দেহ দেখতে কেমন ছিল? মধ্যযুগের শিল্পগুলো একজন আদর্শ পুরুষের চিত্র নির্ধারণে খুব একটা সাহায্য করেনি। কারণ শিল্পগুলো মূলত ধর্মের জন্য নিবেদিত ছিল। তাই শিল্পগুলোতে পুরুষ এবং নারীকে আবৃত অবস্থায় দেখা যায় আর অ্যাডোনিসের দিনগুলো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শিল্পগুলো পুরুষদের স্বাস্থ্যকর এবং স্বাভাবিক গড়ন প্রদর্শন করে, এর বেশি কিছু না।    


রেনেসাঁ (১৪৫০-১৬০০) 

রেনেসাঁর সময়ে পুরুষের নিখুঁত গড়ন কেমন হবে তা খুঁজে বের করতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি  বিশেষ অবদান রেখেছেন। তার চিত্রকর্ম ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এ পুরুষের নিখুঁত গড়ন তুলে ধরেছেন। গড়নটা শুধু শীর্ণতা, স্থূলতা বা পেশী সম্পর্কে ছিল না, ছিল নিখুঁত শরীরের অনুপাত খোঁজার বিষয়ে। এছাড়াও, পুরুষকে ঘিরে আঁকা বৃত্ত এবং বর্গক্ষেত্রগুলো কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, এর পেছনে গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে।     


এনপিআর-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে দ্য ভিঞ্চি’স গোস্ট-এর লেখক টবি লেস্টারের মতে, ‘বৃত্তটি দ্বারা, প্রাচীনকাল থেকে, মানে, ঐশ্বরিক ও মহাজাগতিক জিনিস বোঝানো হয়েছে। এটি নিখুঁত আকৃতি যার কেন্দ্র পরিধির সমস্ত বিন্দু কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত এবং এই আকৃতি কথিত সমস্ত এককেন্দ্রিক ভয়কে নিয়ন্ত্রিত করেছিল যা মহাজগতকে তৈরি করেছিল। এরপর আসে জিনিসের মানবিক উপাদান; বর্গক্ষেত্র, যেখানে সমস্ত কিছু পৃথিবীতে পতিত হয় আর সেগুলোর অর্থ নির্ধারিত হয়।’ ভিট্রুভিয়ান ম্যান কেবল উচ্চাভিলাষী এক আকর্ষণীয় শরীর ছিল না, স্বর্গ এবং পৃথিবীর এক পরম সংযোগও ছিল।                   

ফপের  পূর্বসূরী, ম্যাকারোনিরা মূলত ছিল ব্রিটিশ যুবক যারা বিদেশে গিয়ে ইতালীয় খাবার ‘ম্যাকারোনি’ এবং ইউরোপীয় পোশাকের প্রেমে পড়েছিলেন। ইতিহাসবিদ গেরি ওয়ালটনের মতে, তারা সম্প্রতি ইতালিতে গিয়েছে,
পুরুষরা সাধারণত এটা বোঝাতে ম্যাকারোনি অর্ডার দিত। ফলে তাদের ডাকনাম হয়ে গেল ‘ম্যাকারোনিজ’। ১৭৭৫ সালের ‘ইজি ফ্র্যাজিওলজি’ বইতে জোসেফ বারেটি লিখেছিলেন ‘অদ্ভুত ব্যাপার, এই শব্দটির অর্থ ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে আসার সময় এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে ইতালিতে এর অর্থ একজন ব্লক-হেড, মানে বোকা; এবং ইংল্যান্ডে এর অর্থ হচ্ছে একজন জমকালো পোশাক অনুরাগী!’ তারা আরও ফ্যাশনেবল এবং একটু মেয়েলি পোশাকও পরতে শুরু করে। ট্রিম ফিগার বেশি পছন্দের ছিল কারণ অনেকগুলো স্তর শরীরের সাথে লেগে থাকত। মূলত, তারা ছিল হিপস্টার।    

এক পর্যায়ে, ম্যাকারোনিরা হাসির পাত্র হয়ে ওঠে । বিশাল পরচুলা, ভারী মুখমন্ডল এবং অলংকার ও হাস্যকর অনুসঙ্গ দিয়ে তাদের চেহারা এতটাই চরম হয়ে উঠেছিল যে ১৭৭৫ সালের মধ্যে লোকেরা এই চেহারাকে ‘মেয়েলি’ বলতে শুরু করে। সেই সময়ের অক্সফোর্ড ম্যাগাজিন বলেছিল, ‘এমন এক ধরণের প্রাণী আছে যারা না পুরুষ, না নারী, এরা হচ্ছে আমাদের মাঝে বসবাস করা এক নিরপেক্ষ লিঙ্গের প্রাণী। একে ম্যাকারোনি বলা হয়… আমি হয়তো, ভবিষ্যতের সেই ভদ্রনারী-সু্লভ ভদ্রলোকদের নিন্দা করতে পারি, যারা নিজেদের পুরুষ ভাবতে হতাশবোধ করে আর নারীদের মতো হতে ইচ্ছা পোষণ করে।’      

নারীসুলভ এই চেহারাকে লোকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অবশ্য কিছুকাল পরেই ফ্যাশনের বাইরে চলে যায় আর পুরুষালি চেহারার গুরুত্ব বেড়ে যায়। মজার ঘটনা: ‘ইয়াঙ্কি ডুডল ড্যান্ডি’ গানে ব্রিটিশরা আমেরিকানদের তাদের ছেঁড়া এবং জীর্ণ পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ করে। তাই  ‘Stuck a feather in his hat and called it Macaroni’ এই লাইনের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে ওয়াশিংটন মনে করে একজন চটকদার ড্রেসার হওয়ার জন্য একটি পালকই যথেষ্ট এবং একই সাথে ম্যাকারোনিদেরকেও বোঝানো হয়। আমরা সবাই বাল্যকালে যে পাস্তা পছন্দ করতাম (এবং এখনও করি), এখানে কিন্তু সেই পাস্তার কথা বলা হয় নাই।       

সৌখিনদারদের যুগ (১৮ শতকের শেষ- ১৯ শতকের শুরু)  

আপনি ‘ড্যাড বড’ এর বড় ভক্ত হয়ে থাকলে, পুরুষের নিখুঁত গড়নের জন্য স্বর্ণালি যুগ আপনার সবচেয়ে প্রিয় হবে। নিওলিথিক যুগে ওজনই ছিল মানুষের স্ট্যাটাসের মাপদন্ড। সুতরাং, মোটা পুরুষরাই আদর্শ ছিল। মোটা হওয়া মানে ছিল তাদের প্রচুর পয়সা আছে, কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। ‘লুকিং গুড’ বই অনুযায়ী, বড় পেটকে আকর্ষণীয় ভাবা হতো। ওজন বেশি হওয়াটা এত জনপ্রিয় ছিল যে ফ্যাট মেনজ নামে একটা ক্লাবও ছিল।      

ফ্যাট মেনজ ক্লাবে যোগদানের জন্য ওজন ২০০ পাউন্ডের বেশি হওয়া লাগত। বোস্টন গ্লোব ১৯০৪ সালে একটি মিটিং সম্পর্কে লিখেছিল, ‘আজ রাতে এই গ্রামটা গোলাকার, ঝুলে থাকা পেট এবং ডাবল চিনে ভরে যাবে, কারণ নিউ ইংল্যান্ডের ফ্যাট মেনজ ক্লাব হেল’স ট্যাভার্নে  জমায়েত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা, যাদের বেশিরভাগই হাড্ডিসার, প্রতিটি ট্রেনে করে আসা নাদুসনুদুস, লালচে মুখের দিকে ঈর্ষার সাথে তাকিয়ে থাকে।’          

এমনকি কার ওজন সবচেয়ে বেশি, এই ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবচেয়ে স্থূল পুরুষকে সেলিব্রেটও করা হতো। এনপিআর ১৮৮৫ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিকেলের উদ্ধৃতি দিয়েছিল, ‘আমার ওজন এখন ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি করতে হবে’, জর্জ ক্যাপ গর্বের সাথে কথাটা বলেন। কিন্তু, ২৪৩ পাউন্ডে এসেই থেকে গেলেন… তার বন্ধু্দের মতে সন্ধ্যার আগে সে দুঃখে কমপক্ষে ২০ পাউন্ডের বেশি শুকিয়ে গেছে। বলা বাহুল্য যে মোটা হওয়া শুধু পুরুষদের জন্য ফ্যাশনেবল ছিল, নারীদের জন্য না। তবে আকর্ষণের মানদন্ড হিসেবে বড় পেটের এটাই ছিলো সর্বশেষ যুগ।    

হলিউড (১৯২০-এর দশক) 

হলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়ার সাথে সাথে পুরুষ এবং নারীদের জন্য সৌন্দর্যের আদর্শ রূপও নির্ধারিত হয়ে যায়। এটা পুরানো গল্প যে নারীদের সবসময় হলিউডে শীর্ণ থাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।    

লুকিং গুড অনুযায়ী, ফিল্মে অভিনেতাদের ওজন প্রায় ২০ পাউন্ড বেড়ে যায়, তাই পরিচালকরা শীর্ন দেহের অভিনেতাদের পছন্দ করে। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু তীব্র ঠান্ডার পূর্ব উপকূল থেকে সদা রৌদ্রোজ্জ্বল ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এসেছে, লোকে সারাবছর আরও বেশি খোলামেলা থাকতে পারে। এছাড়া, তখনকার সময়ের সিনেমাগুলোতে পুরুষদের ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার লড়াই এবং বেশ কিছু স্টান্ট করতে হতো, তাই কাজের সুবিধার্থে পুরুষদের একটা নির্দিষ্ট আকারে থাকতে হতো। ফ্যাট মেনজ ক্লাব-যুগের ১৫ বছরের মধ্যেই শীর্ণ ড্যাশিং ফিগার সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, আর মোটা হওয়া হয়ে গেল ওল্ড ফ্যাশন। 

চার্লস অ্যাটলাস (বিশ শতকের ৩০ ও ৪০ এর দশক)    

হলিউডের পুরুষেরা যখন পাতলা হতে শুরু করল, তখন চার্লস অ্যাটলাস করলেন ঠিক এর উল্টো। অ্যাটলাস ছিলেন প্রথম ফিটনেস গুরু। তিনি তার দৈহিক গড়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে বিস্তারিত বলা হয় যে অ্যাটলাস ৯৭ পাউন্ডের এক পুরুষে ছিলেন যিনি ওজনের জন্য লাগাতার বুলি হতে হতে  বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি ওয়ার্ক আউট করতে শুরু করেন, ‘ডাইনামিক টেনশন’ (আইসোমেট্রিক ব্যায়ামের একটি রূপ) নামের ব্যায়াম প্র্যাকটিস করেন। অবশেষে একজন আইকনে রূপান্তরিত হন। ১৯৩০ এবং ‘৪০ এর দশকের কঠিন সময়ে মানুষ অ্যাটলাসের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো।        

‘Fit for America: Health, Fitness, Sport and American Society, 1830-1940’-এর লেখক হার্ভে গ্রীন স্মিথসোনিয়ানকে বলেছেন যে, ডিপ্রেশন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অ্যাটলাসের সমাধান ছিল ‘বাকি সবার চেয়ে আকারে বড় হওয়া। তাহলে কেউ তোমার সাথে ঝামেলা করবে না। শারীরিক আকার আপনাকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে এটা একটা শক্তিশালী বার্তা ছিল।’  এর ফলে সত্যিকার অর্থে প্রথম ফিটনেস মুভমেন্ট শুরু হয়। পুরুষদের শক্তিশালী দৈহিক গড়ন বানানোর ট্রেন্ড শুরু হয়।      

এক্সিকিউটিভ লুক (১৯৫০- ১৯৬০ এর দশক)  

যুদ্ধ আর হতাশার কাল পেরিয়ে,  পুরুষরা দেখতে শক্তিশালী না হতে চাইলেও আকারে বড় হতে আগ্রহী ছিল। এক্সিকিউটিভ লুকের যুগে পুরুষদের জন্য নিখুঁত শারীরিক গড়ন মানেই ছিল আকারে বড়সড় হওয়া। তখনকার সময়ে স্যুট জ্যাকেট এবং ওভারকোটের কাঁধ ছিল বড় ও বক্সী আর ফিটিং ছিল অনেক বেশি ঢিলেঢালা। সেই সময় সরু কোমরের চাহিদা ছিল অনেক, কিন্তু লম্বা গড়ন আর চওড়া কাঁধকেই নিখুঁত শরীর হিসেবে গণ্য করা হতো। 

ভ্যান্স প্যাকার্ড ১৯৬২ সালের কর্পোরেট জগতের সাফল্য সম্পর্কে একটি বই ‘ইন দি পিরামিড ক্লাইম্বার্স’-এ একজন আদর্শ এক্সিকিউটিভ দেখতে কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করেছেন। ‘এখনকার ফ্যাশন বড় গড়নের পুরুষদের জন্য। পুরানো দিনে কিছু কিছু কোম্পানিতে সবচেয়ে লম্বা এক্সিকিউটিভের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, কিন্তু এখন ফ্যাশন হচ্ছে দীর্ঘ গড়নের পুরুষদের জন্য, যদিও প্রচুর ছোট গড়নের পুরুষরা দুর্দান্ত কাজ করছে।’ তিনি এমন ঘটনারও উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে তাকে শুধুমাত্র ছয় ফুটের বেশি লম্বা প্রার্থীদের অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে বলা হয়েছিল। ফলে তার অনুমান যে বড় গড়নের পুরুষদের পছন্দ করা হয় কারণ ‘তাদের এক নির্দিষ্ট মূল্য আছে।’     


আসলে ৫০-এর দশকে ছোট শারীরিক গড়নের পুরুষদেরকে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হতো। প্যাকার্ড বলেছেন, ‘যদি কেউ ছোট গড়নের হয়, তবে তাকে এনার্জি ও সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে এই কমতি পূরণ করা উচিত।’ 

ষাটের দশক 

৬০-এর দশকে ফরমাল লুক বাদ দিয়ে ভদ্র ও  স্টাইলিশ পুরুষরা ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠে। GQ ম্যাগাজিন এই যুগের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল পুরুষদের একটি তালিকা করে। সেখানে আপনি দেখবেন পুরুষদের চেহারা ছিলো স্বচ্ছ এবং স্যুটগুলি শরীরের সাথে ফিট ছিল। কর্পোরেট জগতের পুরুষরা এই বাটন-আপ স্টাইল বজায় রাখে, অন্যদিকে রক তারকারা ও তরুণেরা বোহেমিয়ান লুকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পুরুষদের কাছে ‘আমি কী কালো স্যুট জ্যাকেট পরব না গাঢ় ধূসর?’ -এর চেয়ে আরও বেশি অপশন থাকতে শুরু করে।   

এই যুগের নিখুঁত পুরুষ গড়নের উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় শন কনেরি,  ‘007’ মুভির প্রথম হিরো। তার শরীর ছিল সরু, খুব একটা পেশীবহুল ছিল না এবং তার বুকে লোম  ছিল। মাইকেল কেইনকে, বিশেষত ‘আলফি’ মুভির পর থেকে, সুদর্শন লিডিং ম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু তার শার্টলেস লুক হয়তো আজকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অপ্রীতিকর ছিল। সেই সময়ে পুরুষরা চওড়া কাঁধ এবং চর্বিহীন ফ্ল্যাট পেট অর্জন করাতেই ব্যস্ত ছিল, তখন কাট বাইসেপ এবং সিক্স প্যাক অ্যাবসের তেমন চাহিদা ছিল না।   

৬০-এর শেষ থেকে ৭০-এর শুরু   

ম্যাকারোনিদের যুগের পর থেকে প্রথমবারের মতো পুরুষদের নিখুঁত গড়ন হিসেবে একটু কম রূঢ় পুরুষালি লুক স্টাইলে এসেছে। ডেভিড বাউয়ি এবং এমনকি মাইক জ্যাগারের জন্যও অ্যান্ড্রোজিনি ছিল এক বিশাল ব্যাপার। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, তারা দুজনেই ম্যাস্কুলিন ও ফেমিনিন লুক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে মজা পেয়েছেন। এই লুকের ফলোয়ারদের মাঝে সরু ও লম্বা বডি ফ্রেম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও ইউনিসেক্স জামাকাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে এতে জেন্ডার রোলের উপর কোনো প্রভাব পড়ে আর নাই নিখুঁত গড়নের গুরুত্ব কমে নাই।  

প্রফেসর জো পাওলেটি তার সেক্স এন্ড ইউনিসেক্স বইয়ে বলেছেন, ‘অ্যাডাল্ট ইউনিসেক্স ফ্যাশনের  আবেদনময়তার অংশ ছিল পরিধানকারী এবং পোশাকের মধ্যে সেক্সি বৈসাদৃশ্য, যা আসলে পুরুষ বা নারীদের শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলে।’   

সব পুরুষ কিন্তু জেন্ডারের ভেদবিধি ভেঙে ফেলতে ইচ্ছুক ছিল না। তারা গোঁফ মুখেই বেল বটম ট্রেন্ড ফলো করতে শুরু করে। পুরুষের জামাকাপড় অতীতের তুলনায় আরো আঁটসাঁট হয়ে গেল। তাই তাদের একটা নির্দিষ্ট শারীরিক গড়ন ধরে রাখতে হতো। তখনও সিক্স প্যাক অ্যাবসের চাহিদা ছিল না, তবে হাই ওয়েস্টেড প্যান্ট এবং স্ন্যাজি জাম্পসুট পড়ে ভুঁড়ি লুকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।   

আশির দশক 

৮০-এর দশকে পুরুষদের নিখুঁত গড়ন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে চলে গেছে। একদিকে ছিল সিলভেস্টার স্ট্যালোন এবং আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার মতো অ্যাকশন হিরোদের শক্তিশালী বডি। সুসান জেফোর্ডস তার ‘হার্ড বডিজ’ বইয়ে লিখেছেন যে, সেই সময়ের অ্যাকশন ফিল্মগুলো এবং প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ‘মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তন’ ৮০ দশকের ম্যাস্কুলিন আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করত।  এই দশকে শুধু চওড়া কাঁধ থাকলেই চলতো না, রিগ্যানের যুগে পুরুষত্ব অর্জন করতে জিমে কঠোর পরিশ্রম করা ছিল অপরিহার্য।   

অন্য দিকে গ্ল্যাম মেটালের উত্থান হচ্ছিল। আনা কুরেনায়া তার ‘লুক হোয়াট দি ক্যাট ড্র্যাগড ইন’ বইয়ে বলেছেন, ‘গ্ল্যাম মেটালের ধারা ছিল মাথাভর্তি চুল, উদ্ভট পোশাক  আর  বিপরীত জেন্ডারের প্রতি লোভনীয় লালসা, যা জেন্ডার, যৌনতা এবং সত্যতা সম্পর্কে আমাদের সম্মিলিত ধারণাগুলোকে উপেক্ষা করে একটি জটিল সীমালঙ্ঘনের পরিসর গঠন করে।’  যদিও “টক ডার্টি টু মি” এবং “আনস্কিনি বপ”-এর মতো গানগুলো জেন্ডার রোলকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে মনে নাও হতে পারে, এই হাইপার-ম্যাস্কুলিন ব্যান্ডগুলোর ফেমিনিন সাজ ৮০ দশকে এক সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বয়ে নিয়ে আসে।    

অলঙ্করণঃ ঈহা


আরও বেশি পেশীবহুল (১৯৯০-বর্তমান)

৮০ দশকের শুরু থেকে পেশীবহুল পুরুষদের আদর্শ হওয়ার ধারণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সুপারহিরো মুভির যুগে এই ধারণাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯৮৭ সালের ‘সুপারম্যান-ফোর’ মুভির ক্রিস্টোফার রিভকে হেনরি ক্যাভিলের সাথে তুলনা করে দেখুন।  দুজনেই সুপারম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছে (১৯৭৮-১৯৮৭ থেকে রিভ এবং ২০১৩-২০১৬ সালে ক্যাভিল) আর যদিও তারা দুজনেই দুর্দান্ত শেপে ছিল, ক্যাভিলের তুলনায় রিভকে দেখতে অল্প বয়স্ক ছেলের মতো লাগে। এখন, ফিল্মে  ‘হট গাই’ চরিত্রে কেউ অভিনয় করলে তাকে অবশ্যই ম্যাস্কুলিন হতে হয়। তাই নায়কদের জন্য শুধু সরু বা অ্যাথলেটিক হওয়াই যথেষ্ট না। আর নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, লুকের চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে।      

দ্য টেলিগ্রাফ-এর মতে, এই অ্যাকশন হিরোরা ছেলেদের মধ্যে বডি ইমেজের সমস্যা তৈরি করেছে। সংবাদপত্রটি আলফা ম্যাগাজিনের একটি সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়েছে যেখানে দেখা যায় যে, পুরুষরা পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২০১৫ সালে তাদের শরীর নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। টিএমজি-এর মতো সাইটগুলো পুরো একটা সেকশন ‘লিভিন লার্জ’-কে নিয়েই। সাইটগুলো ওজন বেড়েছে এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অপ্রীতিকর ছবি প্রকাশ করে। 

যদিও এমন পরিস্থিতির সঙ্গে নারীরা কয়েক দশক ধরে মোকাবেলা করে আসছে,   পুরুষরাও এখন মিডিয়ার কাছ থেকে অসম্ভব শারীরিক গড়ন অর্জনের জন্য সমান চাপ অনুভব করছে। চাইলে তারা এজন্য সুপারম্যানকে দোষারোপ করতে পারে।            

নিখুঁত পুরুষের জন্য একটি জিনিসটি ধ্রুব রয়ে গেছে? একমাথা চুল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পুরুষ তার মাথার চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে। 

‘লুকিং গুড’-এর লেখক আরব্য রজনী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে একজন নারী বলছেন, ‘পৃথিবীতে একজন পুরুষের আর্টিচোকের মতো টাক এবং দাড়িহীন হওয়ার চেয়ে কুৎসিত আর কিছু আছে কি?’  বই অনুসারে, জুলিয়াস সিজার মাথার টাক লুকানোর জন্যই তার সিগনেচার তাজটি পরতেন। গেটি ব্লগ অনুসারে, প্রাচীন রোমে টাক পড়া মানেই ছিল জ্ঞানী হওয়া আর তাই অনেক দার্শনিককে টাক মাথায় দেখানো হতো, কিন্তু বাকিরা টাক মাথাকে আড়াল করার জন্য যা যা দরকার তা সবই করত। পুরুষরা তাদের ধূসর রঙের চুলকে রঙ করত, কেননা তারা তাদের চুলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো খুবই আবেগের। সম্রাট ডোমিশিয়ান চুল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত থাকুন যে চুলের চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক আর কিছু নয়, তবে স্বল্পস্থায়ীও আর কিছু নয়।’  সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও মাথায় টাক পড়ার দুঃখিত তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেনি।

লুকিং গুড অনুযায়ী, পুরুষরা তাদের মাথার টাক লুকানোর জন্য পরচুলা পরতে শুরু করে এবং বছর পার হওয়ার সাথে সাথে মাথায় চুল গজানোর জন্য সন্দেহজনক ওষুধ আবিষ্কৃত হতে থাকে। একুশ শতকে টাক মাথার একজন পুরুষ আকর্ষণীয় বিবেচিত হতে পারে (রক এবং ভিন ডিজেল হচ্ছে সেরা উদাহরণ), তবে চুল পড়ার ট্রিটমেন্ট ইন্ডাসট্রি এখনও প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। যদিও স্টাইল এবং বডি টাইপ সময়ের সাথে সাথে পাল্টাতে থাকবে,  তবে পুরুষদের লম্বা ও ঘন চুলের চাহিদা কখনো পাল্টাবে না।  
  

নিখুঁত-এর পরিবর্তনশীল ধারণা

পুরুষের নিখুঁত গড়নের সংজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে এতটাই বদলেছে যে এ ধরনের খামখেয়ালী আদর্শ ফলো করা হবে মূর্খতার পরিচয় । ফ্যাট মেনজ ক্লাব-এর সেই পুরুষদের সম্পর্কে ভাবুন যাদেরকে প্রাইম হটি হি্সেবে বিবেচনা করা হতো কিন্তু পরবর্তীতে হলিউডের সরু শরীরের হিরোদের জন্য তাদেরকে আর গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পেশী নিয়ে এই ঘোর একসময় অবশ্যই কেটে যাবে এবং একদিন আসবে যেদিন আপনার স্বাভাবিক দৈহিক গড়নই হবে ‘নিখুঁত’ গড়ন।     

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।