মিডিয়াতে নারীর দৈহিক গড়ন কীভাবে দেখানো নিয়ে তা লোকে সাধারণত কথা বলে। কিন্তু পুরুষদেরও বডি ইমেজের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে পুরুষের ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা নারীদের তুলনায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।
পুরুষদের তুলনায় নারীদের উপস্থিতির উপর মিডিয়া এখনও বেশি মনোযোগ দেয়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে আদর্শ শরীর অর্জনের জন্য পুরুষদের উপর কোন চাপ নেই। যদিও সময়ের সাথে আকর্ষণীয় পুরুষ দেহের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে, আপনি দেখতে পাবেন যে, নারীদের ক্ষেত্রেও, ‘নিখুঁত’-এর সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।
এবার একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। যাওয়া যাক নিওলিথিক যুগে যখন পুরুষদের নিখুঁত শরীরের ধরন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। আনুমানিক ১২,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে মানুষ শিকারী/সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিকেন্দ্রিক জীবনযাপণ শুরু করেছিল। সারাদিন মহিষ চড়ানোর পরিবর্তে ঘরের সামনে ফসল ফলিয়ে মানুষ নিজের জীবনকে কিছুটা সহজ করে তুলেছিল।
পিটার জেনিসজেউস্কি একজন বিজ্ঞানী যিনি স্থূলতা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়াশোনা করেছেন। পিটার ‘ওবিসিটি প্যানাসিয়া’ নামক ব্লগের লেখক। ব্লগটি স্থূলতা দূর করতে নিবেদিত। পিটার বলেছেন যে সেই সময়ে একজন আদর্শ পুরুষ স্থূল ছিল। যারা কৃষিজমির মালিক ছিল তারা বিশাল ভোজ উপভোগ করত এবং এর ফলে তাদের ওজন বৃদ্ধি পেত। আর একজন স্থূল শরীরের পুরুষকে তার জীর্ণশীর্ণ সমকক্ষদের চেয়ে দেখতে বেশি স্বচ্ছল ও আবেদনময়ী লাগত।
প্রাচীন গ্রিস (৮০০–১৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
প্রাচীন গ্রিকরা তাদের সৌন্দর্যের আদর্শ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিল, যা তাদের শিল্পকর্মে আজও আমরা দেখতে পাই। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে, তারা বড় দেহের কোনো ভোজনপ্রিয় পুরুষে আগ্রহী ছিল না; বরং পেশীবহুল এবং জীর্ণশীর্ণ শরীরের পুরুষই ছিল আদর্শ। তারা দেখতেও ছিল অনেকটা আজকালকার ম্যাগাজিনে দেখতে পাওয়া মডেলদের মতো। যদি গ্রিকদের এই মূর্তিগুলোর মধ্যে কোনো একটি জীবন্ত হয়ে উঠে আসে আর পরবর্তী মার্ভেল মুভিগুলোর জন্য অডিশন দেয় তাহলে অন্তত একটি কলব্যাক পাওয়া তো নিশ্চিত ।
গ্রিক সৌন্দর্যের জন্য নির্দিষ্ট অনুপাত থাকলেও সেগুলো বাস্তবসম্মত ছিল না। দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ‘তাদের মতো পেশীগুচ্ছ অর্জন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। আপনি এক বছরের জন্য প্রতিদিন জিমে গেলেও এই মূর্তিগুলোর মতো অ্যাপোলো’স বেল্ট বানিয়ে বড়াই করতে পারবেন না।’
অ্যাপোলো’স বেল্ট (অ্যাডোনিস বেল্ট নামেও পরিচিত) হলো পেটের ভি পেশী যা অনেক পুরুষই অর্জন করার চেষ্টা করে। তাই বর্তমানে এমন অনেক মডার্ন ওয়ার্কআউট তৈরি হয়েছে যেগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো প্রাচীন গ্রিসের আদর্শ পুরুষের মতো ২১ শতকের পুরুষদের দৈহিক গড়ন বানানো।

মধ্যযুগ (৮০০-১০০ খ্রিষ্টাব্দ)
ধারণা করা হয় যে ২০ শতকের আগে মানুষেরা বর্তমান সময়ের তুলনায় খাটো এবং দুর্বল ছিল। কিন্তু অধ্যাপক রিচার্ড স্টেকেলের মতে এই ধারনা ভুল। স্টেকেল গবেষণার উপর ভিত্তি করে ওহাইয়ো স্টেট রিসার্চ নিউজ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মানুষের উচ্চতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে রিপোর্ট করে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে, পুরুষরা ২১ শতকের পুরুষদের মতোই লম্বা ছিল। বিগত ১২০০ বছর আগের হাজার হাজার কঙ্কাল অধ্যয়ন করে তিনি দেখতে পান যে মধ্যযুগে পুরুষদের বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়, তবে ১৭০০ দশকের দিকে তা আড়াই ইঞ্চি হ্রাস পায়। স্টেকেল-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘আড়াই ইঞ্চির এই হ্রাস ১৯ শতকের বিভিন্ন শিল্প বিপ্লবের সময় দেখা যে কোনো উচ্চতার ওঠানামাকে বিশেষভাবে ছাড়িয়ে গেছে।’ আমাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে উচ্চতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কারণ উচ্চতার মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও জানা যায়। লম্বা মানুষ মানেই হচ্ছে সুস্থ মানুষ।
তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন পুরুষেরা সংকুচিত হয়েছে? স্টেকেল বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। আদি মধ্যযুগের সময় উষ্ণ জলবায়ু ছিল, তাই ফসলও সম্ভবত বেশি পরিমাণে ছিল। বেশি খাবার মানেই স্বাস্থ্যকর শরীর। এছাড়াও, মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলনায়মূলক বেশি বাস করত। মধ্যযুগে কোনো ব্যস্ত শহর ছিল না, ফলে দ্রুত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কম ছিল। নগরায়ন উৎপত্তির সাথে সাথে জলবায়ু উষ্ণ থেকে ঠান্ডা হওয়া, রোগজীবাণুর বিস্তার ও খাদ্যের সম্ভাব্য অভাবে মানুষের স্বাস্থ্য ও গড়নের হ্রাস ঘটাতে থাকে।
সুতরাং, ছেলেরা তখন অপ্রত্যাশিতভাবে লম্বা ছিল, কিন্তু একজন ‘নিখুঁত’ পুরুষের দেহ দেখতে কেমন ছিল? মধ্যযুগের শিল্পগুলো একজন আদর্শ পুরুষের চিত্র নির্ধারণে খুব একটা সাহায্য করেনি। কারণ শিল্পগুলো মূলত ধর্মের জন্য নিবেদিত ছিল। তাই শিল্পগুলোতে পুরুষ এবং নারীকে আবৃত অবস্থায় দেখা যায় আর অ্যাডোনিসের দিনগুলো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শিল্পগুলো পুরুষদের স্বাস্থ্যকর এবং স্বাভাবিক গড়ন প্রদর্শন করে, এর বেশি কিছু না।
রেনেসাঁ (১৪৫০-১৬০০)
রেনেসাঁর সময়ে পুরুষের নিখুঁত গড়ন কেমন হবে তা খুঁজে বের করতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বিশেষ অবদান রেখেছেন। তার চিত্রকর্ম ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এ পুরুষের নিখুঁত গড়ন তুলে ধরেছেন। গড়নটা শুধু শীর্ণতা, স্থূলতা বা পেশী সম্পর্কে ছিল না, ছিল নিখুঁত শরীরের অনুপাত খোঁজার বিষয়ে। এছাড়াও, পুরুষকে ঘিরে আঁকা বৃত্ত এবং বর্গক্ষেত্রগুলো কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, এর পেছনে গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে।
এনপিআর-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে দ্য ভিঞ্চি’স গোস্ট-এর লেখক টবি লেস্টারের মতে, ‘বৃত্তটি দ্বারা, প্রাচীনকাল থেকে, মানে, ঐশ্বরিক ও মহাজাগতিক জিনিস বোঝানো হয়েছে। এটি নিখুঁত আকৃতি যার কেন্দ্র পরিধির সমস্ত বিন্দু কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত এবং এই আকৃতি কথিত সমস্ত এককেন্দ্রিক ভয়কে নিয়ন্ত্রিত করেছিল যা মহাজগতকে তৈরি করেছিল। এরপর আসে জিনিসের মানবিক উপাদান; বর্গক্ষেত্র, যেখানে সমস্ত কিছু পৃথিবীতে পতিত হয় আর সেগুলোর অর্থ নির্ধারিত হয়।’ ভিট্রুভিয়ান ম্যান কেবল উচ্চাভিলাষী এক আকর্ষণীয় শরীর ছিল না, স্বর্গ এবং পৃথিবীর এক পরম সংযোগও ছিল।
ফপের পূর্বসূরী, ম্যাকারোনিরা মূলত ছিল ব্রিটিশ যুবক যারা বিদেশে গিয়ে ইতালীয় খাবার ‘ম্যাকারোনি’ এবং ইউরোপীয় পোশাকের প্রেমে পড়েছিলেন। ইতিহাসবিদ গেরি ওয়ালটনের মতে, তারা সম্প্রতি ইতালিতে গিয়েছে,
পুরুষরা সাধারণত এটা বোঝাতে ম্যাকারোনি অর্ডার দিত। ফলে তাদের ডাকনাম হয়ে গেল ‘ম্যাকারোনিজ’। ১৭৭৫ সালের ‘ইজি ফ্র্যাজিওলজি’ বইতে জোসেফ বারেটি লিখেছিলেন ‘অদ্ভুত ব্যাপার, এই শব্দটির অর্থ ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে আসার সময় এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে ইতালিতে এর অর্থ একজন ব্লক-হেড, মানে বোকা; এবং ইংল্যান্ডে এর অর্থ হচ্ছে একজন জমকালো পোশাক অনুরাগী!’ তারা আরও ফ্যাশনেবল এবং একটু মেয়েলি পোশাকও পরতে শুরু করে। ট্রিম ফিগার বেশি পছন্দের ছিল কারণ অনেকগুলো স্তর শরীরের সাথে লেগে থাকত। মূলত, তারা ছিল হিপস্টার।
এক পর্যায়ে, ম্যাকারোনিরা হাসির পাত্র হয়ে ওঠে । বিশাল পরচুলা, ভারী মুখমন্ডল এবং অলংকার ও হাস্যকর অনুসঙ্গ দিয়ে তাদের চেহারা এতটাই চরম হয়ে উঠেছিল যে ১৭৭৫ সালের মধ্যে লোকেরা এই চেহারাকে ‘মেয়েলি’ বলতে শুরু করে। সেই সময়ের অক্সফোর্ড ম্যাগাজিন বলেছিল, ‘এমন এক ধরণের প্রাণী আছে যারা না পুরুষ, না নারী, এরা হচ্ছে আমাদের মাঝে বসবাস করা এক নিরপেক্ষ লিঙ্গের প্রাণী। একে ম্যাকারোনি বলা হয়… আমি হয়তো, ভবিষ্যতের সেই ভদ্রনারী-সু্লভ ভদ্রলোকদের নিন্দা করতে পারি, যারা নিজেদের পুরুষ ভাবতে হতাশবোধ করে আর নারীদের মতো হতে ইচ্ছা পোষণ করে।’
নারীসুলভ এই চেহারাকে লোকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অবশ্য কিছুকাল পরেই ফ্যাশনের বাইরে চলে যায় আর পুরুষালি চেহারার গুরুত্ব বেড়ে যায়। মজার ঘটনা: ‘ইয়াঙ্কি ডুডল ড্যান্ডি’ গানে ব্রিটিশরা আমেরিকানদের তাদের ছেঁড়া এবং জীর্ণ পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ করে। তাই ‘Stuck a feather in his hat and called it Macaroni’ এই লাইনের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে ওয়াশিংটন মনে করে একজন চটকদার ড্রেসার হওয়ার জন্য একটি পালকই যথেষ্ট এবং একই সাথে ম্যাকারোনিদেরকেও বোঝানো হয়। আমরা সবাই বাল্যকালে যে পাস্তা পছন্দ করতাম (এবং এখনও করি), এখানে কিন্তু সেই পাস্তার কথা বলা হয় নাই।
সৌখিনদারদের যুগ (১৮ শতকের শেষ- ১৯ শতকের শুরু)
আপনি ‘ড্যাড বড’ এর বড় ভক্ত হয়ে থাকলে, পুরুষের নিখুঁত গড়নের জন্য স্বর্ণালি যুগ আপনার সবচেয়ে প্রিয় হবে। নিওলিথিক যুগে ওজনই ছিল মানুষের স্ট্যাটাসের মাপদন্ড। সুতরাং, মোটা পুরুষরাই আদর্শ ছিল। মোটা হওয়া মানে ছিল তাদের প্রচুর পয়সা আছে, কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। ‘লুকিং গুড’ বই অনুযায়ী, বড় পেটকে আকর্ষণীয় ভাবা হতো। ওজন বেশি হওয়াটা এত জনপ্রিয় ছিল যে ফ্যাট মেনজ নামে একটা ক্লাবও ছিল।
ফ্যাট মেনজ ক্লাবে যোগদানের জন্য ওজন ২০০ পাউন্ডের বেশি হওয়া লাগত। বোস্টন গ্লোব ১৯০৪ সালে একটি মিটিং সম্পর্কে লিখেছিল, ‘আজ রাতে এই গ্রামটা গোলাকার, ঝুলে থাকা পেট এবং ডাবল চিনে ভরে যাবে, কারণ নিউ ইংল্যান্ডের ফ্যাট মেনজ ক্লাব হেল’স ট্যাভার্নে জমায়েত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা, যাদের বেশিরভাগই হাড্ডিসার, প্রতিটি ট্রেনে করে আসা নাদুসনুদুস, লালচে মুখের দিকে ঈর্ষার সাথে তাকিয়ে থাকে।’
এমনকি কার ওজন সবচেয়ে বেশি, এই ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবচেয়ে স্থূল পুরুষকে সেলিব্রেটও করা হতো। এনপিআর ১৮৮৫ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিকেলের উদ্ধৃতি দিয়েছিল, ‘আমার ওজন এখন ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি করতে হবে’, জর্জ ক্যাপ গর্বের সাথে কথাটা বলেন। কিন্তু, ২৪৩ পাউন্ডে এসেই থেকে গেলেন… তার বন্ধু্দের মতে সন্ধ্যার আগে সে দুঃখে কমপক্ষে ২০ পাউন্ডের বেশি শুকিয়ে গেছে। বলা বাহুল্য যে মোটা হওয়া শুধু পুরুষদের জন্য ফ্যাশনেবল ছিল, নারীদের জন্য না। তবে আকর্ষণের মানদন্ড হিসেবে বড় পেটের এটাই ছিলো সর্বশেষ যুগ।
হলিউড (১৯২০-এর দশক)
হলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়ার সাথে সাথে পুরুষ এবং নারীদের জন্য সৌন্দর্যের আদর্শ রূপও নির্ধারিত হয়ে যায়। এটা পুরানো গল্প যে নারীদের সবসময় হলিউডে শীর্ণ থাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
লুকিং গুড অনুযায়ী, ফিল্মে অভিনেতাদের ওজন প্রায় ২০ পাউন্ড বেড়ে যায়, তাই পরিচালকরা শীর্ন দেহের অভিনেতাদের পছন্দ করে। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু তীব্র ঠান্ডার পূর্ব উপকূল থেকে সদা রৌদ্রোজ্জ্বল ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এসেছে, লোকে সারাবছর আরও বেশি খোলামেলা থাকতে পারে। এছাড়া, তখনকার সময়ের সিনেমাগুলোতে পুরুষদের ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার লড়াই এবং বেশ কিছু স্টান্ট করতে হতো, তাই কাজের সুবিধার্থে পুরুষদের একটা নির্দিষ্ট আকারে থাকতে হতো। ফ্যাট মেনজ ক্লাব-যুগের ১৫ বছরের মধ্যেই শীর্ণ ড্যাশিং ফিগার সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, আর মোটা হওয়া হয়ে গেল ওল্ড ফ্যাশন।
চার্লস অ্যাটলাস (বিশ শতকের ৩০ ও ৪০ এর দশক)
হলিউডের পুরুষেরা যখন পাতলা হতে শুরু করল, তখন চার্লস অ্যাটলাস করলেন ঠিক এর উল্টো। অ্যাটলাস ছিলেন প্রথম ফিটনেস গুরু। তিনি তার দৈহিক গড়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে বিস্তারিত বলা হয় যে অ্যাটলাস ৯৭ পাউন্ডের এক পুরুষে ছিলেন যিনি ওজনের জন্য লাগাতার বুলি হতে হতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি ওয়ার্ক আউট করতে শুরু করেন, ‘ডাইনামিক টেনশন’ (আইসোমেট্রিক ব্যায়ামের একটি রূপ) নামের ব্যায়াম প্র্যাকটিস করেন। অবশেষে একজন আইকনে রূপান্তরিত হন। ১৯৩০ এবং ‘৪০ এর দশকের কঠিন সময়ে মানুষ অ্যাটলাসের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো।
‘Fit for America: Health, Fitness, Sport and American Society, 1830-1940’-এর লেখক হার্ভে গ্রীন স্মিথসোনিয়ানকে বলেছেন যে, ডিপ্রেশন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অ্যাটলাসের সমাধান ছিল ‘বাকি সবার চেয়ে আকারে বড় হওয়া। তাহলে কেউ তোমার সাথে ঝামেলা করবে না। শারীরিক আকার আপনাকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে এটা একটা শক্তিশালী বার্তা ছিল।’ এর ফলে সত্যিকার অর্থে প্রথম ফিটনেস মুভমেন্ট শুরু হয়। পুরুষদের শক্তিশালী দৈহিক গড়ন বানানোর ট্রেন্ড শুরু হয়।
এক্সিকিউটিভ লুক (১৯৫০- ১৯৬০ এর দশক)
যুদ্ধ আর হতাশার কাল পেরিয়ে, পুরুষরা দেখতে শক্তিশালী না হতে চাইলেও আকারে বড় হতে আগ্রহী ছিল। এক্সিকিউটিভ লুকের যুগে পুরুষদের জন্য নিখুঁত শারীরিক গড়ন মানেই ছিল আকারে বড়সড় হওয়া। তখনকার সময়ে স্যুট জ্যাকেট এবং ওভারকোটের কাঁধ ছিল বড় ও বক্সী আর ফিটিং ছিল অনেক বেশি ঢিলেঢালা। সেই সময় সরু কোমরের চাহিদা ছিল অনেক, কিন্তু লম্বা গড়ন আর চওড়া কাঁধকেই নিখুঁত শরীর হিসেবে গণ্য করা হতো।
ভ্যান্স প্যাকার্ড ১৯৬২ সালের কর্পোরেট জগতের সাফল্য সম্পর্কে একটি বই ‘ইন দি পিরামিড ক্লাইম্বার্স’-এ একজন আদর্শ এক্সিকিউটিভ দেখতে কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করেছেন। ‘এখনকার ফ্যাশন বড় গড়নের পুরুষদের জন্য। পুরানো দিনে কিছু কিছু কোম্পানিতে সবচেয়ে লম্বা এক্সিকিউটিভের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, কিন্তু এখন ফ্যাশন হচ্ছে দীর্ঘ গড়নের পুরুষদের জন্য, যদিও প্রচুর ছোট গড়নের পুরুষরা দুর্দান্ত কাজ করছে।’ তিনি এমন ঘটনারও উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে তাকে শুধুমাত্র ছয় ফুটের বেশি লম্বা প্রার্থীদের অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে বলা হয়েছিল। ফলে তার অনুমান যে বড় গড়নের পুরুষদের পছন্দ করা হয় কারণ ‘তাদের এক নির্দিষ্ট মূল্য আছে।’
আসলে ৫০-এর দশকে ছোট শারীরিক গড়নের পুরুষদেরকে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হতো। প্যাকার্ড বলেছেন, ‘যদি কেউ ছোট গড়নের হয়, তবে তাকে এনার্জি ও সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে এই কমতি পূরণ করা উচিত।’
ষাটের দশক
৬০-এর দশকে ফরমাল লুক বাদ দিয়ে ভদ্র ও স্টাইলিশ পুরুষরা ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠে। GQ ম্যাগাজিন এই যুগের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল পুরুষদের একটি তালিকা করে। সেখানে আপনি দেখবেন পুরুষদের চেহারা ছিলো স্বচ্ছ এবং স্যুটগুলি শরীরের সাথে ফিট ছিল। কর্পোরেট জগতের পুরুষরা এই বাটন-আপ স্টাইল বজায় রাখে, অন্যদিকে রক তারকারা ও তরুণেরা বোহেমিয়ান লুকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পুরুষদের কাছে ‘আমি কী কালো স্যুট জ্যাকেট পরব না গাঢ় ধূসর?’ -এর চেয়ে আরও বেশি অপশন থাকতে শুরু করে।
এই যুগের নিখুঁত পুরুষ গড়নের উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় শন কনেরি, ‘007’ মুভির প্রথম হিরো। তার শরীর ছিল সরু, খুব একটা পেশীবহুল ছিল না এবং তার বুকে লোম ছিল। মাইকেল কেইনকে, বিশেষত ‘আলফি’ মুভির পর থেকে, সুদর্শন লিডিং ম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু তার শার্টলেস লুক হয়তো আজকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অপ্রীতিকর ছিল। সেই সময়ে পুরুষরা চওড়া কাঁধ এবং চর্বিহীন ফ্ল্যাট পেট অর্জন করাতেই ব্যস্ত ছিল, তখন কাট বাইসেপ এবং সিক্স প্যাক অ্যাবসের তেমন চাহিদা ছিল না।
৬০-এর শেষ থেকে ৭০-এর শুরু
ম্যাকারোনিদের যুগের পর থেকে প্রথমবারের মতো পুরুষদের নিখুঁত গড়ন হিসেবে একটু কম রূঢ় পুরুষালি লুক স্টাইলে এসেছে। ডেভিড বাউয়ি এবং এমনকি মাইক জ্যাগারের জন্যও অ্যান্ড্রোজিনি ছিল এক বিশাল ব্যাপার। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, তারা দুজনেই ম্যাস্কুলিন ও ফেমিনিন লুক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে মজা পেয়েছেন। এই লুকের ফলোয়ারদের মাঝে সরু ও লম্বা বডি ফ্রেম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও ইউনিসেক্স জামাকাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে এতে জেন্ডার রোলের উপর কোনো প্রভাব পড়ে আর নাই নিখুঁত গড়নের গুরুত্ব কমে নাই।
প্রফেসর জো পাওলেটি তার সেক্স এন্ড ইউনিসেক্স বইয়ে বলেছেন, ‘অ্যাডাল্ট ইউনিসেক্স ফ্যাশনের আবেদনময়তার অংশ ছিল পরিধানকারী এবং পোশাকের মধ্যে সেক্সি বৈসাদৃশ্য, যা আসলে পুরুষ বা নারীদের শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলে।’
সব পুরুষ কিন্তু জেন্ডারের ভেদবিধি ভেঙে ফেলতে ইচ্ছুক ছিল না। তারা গোঁফ মুখেই বেল বটম ট্রেন্ড ফলো করতে শুরু করে। পুরুষের জামাকাপড় অতীতের তুলনায় আরো আঁটসাঁট হয়ে গেল। তাই তাদের একটা নির্দিষ্ট শারীরিক গড়ন ধরে রাখতে হতো। তখনও সিক্স প্যাক অ্যাবসের চাহিদা ছিল না, তবে হাই ওয়েস্টেড প্যান্ট এবং স্ন্যাজি জাম্পসুট পড়ে ভুঁড়ি লুকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।
আশির দশক
৮০-এর দশকে পুরুষদের নিখুঁত গড়ন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে চলে গেছে। একদিকে ছিল সিলভেস্টার স্ট্যালোন এবং আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার মতো অ্যাকশন হিরোদের শক্তিশালী বডি। সুসান জেফোর্ডস তার ‘হার্ড বডিজ’ বইয়ে লিখেছেন যে, সেই সময়ের অ্যাকশন ফিল্মগুলো এবং প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ‘মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তন’ ৮০ দশকের ম্যাস্কুলিন আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করত। এই দশকে শুধু চওড়া কাঁধ থাকলেই চলতো না, রিগ্যানের যুগে পুরুষত্ব অর্জন করতে জিমে কঠোর পরিশ্রম করা ছিল অপরিহার্য।
অন্য দিকে গ্ল্যাম মেটালের উত্থান হচ্ছিল। আনা কুরেনায়া তার ‘লুক হোয়াট দি ক্যাট ড্র্যাগড ইন’ বইয়ে বলেছেন, ‘গ্ল্যাম মেটালের ধারা ছিল মাথাভর্তি চুল, উদ্ভট পোশাক আর বিপরীত জেন্ডারের প্রতি লোভনীয় লালসা, যা জেন্ডার, যৌনতা এবং সত্যতা সম্পর্কে আমাদের সম্মিলিত ধারণাগুলোকে উপেক্ষা করে একটি জটিল সীমালঙ্ঘনের পরিসর গঠন করে।’ যদিও “টক ডার্টি টু মি” এবং “আনস্কিনি বপ”-এর মতো গানগুলো জেন্ডার রোলকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে মনে নাও হতে পারে, এই হাইপার-ম্যাস্কুলিন ব্যান্ডগুলোর ফেমিনিন সাজ ৮০ দশকে এক সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বয়ে নিয়ে আসে।

আরও বেশি পেশীবহুল (১৯৯০-বর্তমান)
৮০ দশকের শুরু থেকে পেশীবহুল পুরুষদের আদর্শ হওয়ার ধারণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সুপারহিরো মুভির যুগে এই ধারণাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯৮৭ সালের ‘সুপারম্যান-ফোর’ মুভির ক্রিস্টোফার রিভকে হেনরি ক্যাভিলের সাথে তুলনা করে দেখুন। দুজনেই সুপারম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছে (১৯৭৮-১৯৮৭ থেকে রিভ এবং ২০১৩-২০১৬ সালে ক্যাভিল) আর যদিও তারা দুজনেই দুর্দান্ত শেপে ছিল, ক্যাভিলের তুলনায় রিভকে দেখতে অল্প বয়স্ক ছেলের মতো লাগে। এখন, ফিল্মে ‘হট গাই’ চরিত্রে কেউ অভিনয় করলে তাকে অবশ্যই ম্যাস্কুলিন হতে হয়। তাই নায়কদের জন্য শুধু সরু বা অ্যাথলেটিক হওয়াই যথেষ্ট না। আর নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, লুকের চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে।
দ্য টেলিগ্রাফ-এর মতে, এই অ্যাকশন হিরোরা ছেলেদের মধ্যে বডি ইমেজের সমস্যা তৈরি করেছে। সংবাদপত্রটি আলফা ম্যাগাজিনের একটি সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়েছে যেখানে দেখা যায় যে, পুরুষরা পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২০১৫ সালে তাদের শরীর নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। টিএমজি-এর মতো সাইটগুলো পুরো একটা সেকশন ‘লিভিন লার্জ’-কে নিয়েই। সাইটগুলো ওজন বেড়েছে এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অপ্রীতিকর ছবি প্রকাশ করে।
যদিও এমন পরিস্থিতির সঙ্গে নারীরা কয়েক দশক ধরে মোকাবেলা করে আসছে, পুরুষরাও এখন মিডিয়ার কাছ থেকে অসম্ভব শারীরিক গড়ন অর্জনের জন্য সমান চাপ অনুভব করছে। চাইলে তারা এজন্য সুপারম্যানকে দোষারোপ করতে পারে।
নিখুঁত পুরুষের জন্য একটি জিনিসটি ধ্রুব রয়ে গেছে? একমাথা চুল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পুরুষ তার মাথার চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে।
‘লুকিং গুড’-এর লেখক আরব্য রজনী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে একজন নারী বলছেন, ‘পৃথিবীতে একজন পুরুষের আর্টিচোকের মতো টাক এবং দাড়িহীন হওয়ার চেয়ে কুৎসিত আর কিছু আছে কি?’ বই অনুসারে, জুলিয়াস সিজার মাথার টাক লুকানোর জন্যই তার সিগনেচার তাজটি পরতেন। গেটি ব্লগ অনুসারে, প্রাচীন রোমে টাক পড়া মানেই ছিল জ্ঞানী হওয়া আর তাই অনেক দার্শনিককে টাক মাথায় দেখানো হতো, কিন্তু বাকিরা টাক মাথাকে আড়াল করার জন্য যা যা দরকার তা সবই করত। পুরুষরা তাদের ধূসর রঙের চুলকে রঙ করত, কেননা তারা তাদের চুলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো খুবই আবেগের। সম্রাট ডোমিশিয়ান চুল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত থাকুন যে চুলের চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক আর কিছু নয়, তবে স্বল্পস্থায়ীও আর কিছু নয়।’ সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও মাথায় টাক পড়ার দুঃখিত তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেনি।
লুকিং গুড অনুযায়ী, পুরুষরা তাদের মাথার টাক লুকানোর জন্য পরচুলা পরতে শুরু করে এবং বছর পার হওয়ার সাথে সাথে মাথায় চুল গজানোর জন্য সন্দেহজনক ওষুধ আবিষ্কৃত হতে থাকে। একুশ শতকে টাক মাথার একজন পুরুষ আকর্ষণীয় বিবেচিত হতে পারে (রক এবং ভিন ডিজেল হচ্ছে সেরা উদাহরণ), তবে চুল পড়ার ট্রিটমেন্ট ইন্ডাসট্রি এখনও প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। যদিও স্টাইল এবং বডি টাইপ সময়ের সাথে সাথে পাল্টাতে থাকবে, তবে পুরুষদের লম্বা ও ঘন চুলের চাহিদা কখনো পাল্টাবে না।
নিখুঁত-এর পরিবর্তনশীল ধারণা
পুরুষের নিখুঁত গড়নের সংজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে এতটাই বদলেছে যে এ ধরনের খামখেয়ালী আদর্শ ফলো করা হবে মূর্খতার পরিচয় । ফ্যাট মেনজ ক্লাব-এর সেই পুরুষদের সম্পর্কে ভাবুন যাদেরকে প্রাইম হটি হি্সেবে বিবেচনা করা হতো কিন্তু পরবর্তীতে হলিউডের সরু শরীরের হিরোদের জন্য তাদেরকে আর গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পেশী নিয়ে এই ঘোর একসময় অবশ্যই কেটে যাবে এবং একদিন আসবে যেদিন আপনার স্বাভাবিক দৈহিক গড়নই হবে ‘নিখুঁত’ গড়ন।