পুরুষের ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা যুগে যুগে যেভাবে বদলেছে 

 

মিডিয়াতে নারীর দৈহিক গড়ন কীভাবে দেখানো নিয়ে তা লোকে সাধারণত কথা বলে। কিন্তু পুরুষদেরও বডি ইমেজের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আসলে সময়ের সাথে সাথে পুরুষের ‘নিখুঁত’ গড়নের সংজ্ঞা নারীদের তুলনায় ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে।   

পুরুষদের তুলনায় নারীদের উপস্থিতির উপর মিডিয়া এখনও বেশি মনোযোগ দেয়। অবশ্য এর মানে এই নয় যে আদর্শ শরীর  অর্জনের জন্য পুরুষদের উপর কোন চাপ নেই। যদিও সময়ের সাথে আকর্ষণীয় পুরুষ দেহের ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে, আপনি দেখতে পাবেন যে, নারীদের ক্ষেত্রেও, ‘নিখুঁত’-এর সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত অস্পষ্ট।           

এবার একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক। যাওয়া যাক নিওলিথিক যুগে যখন পুরুষদের নিখুঁত শরীরের ধরন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল। আনুমানিক ১২,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৮০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে মানুষ শিকারী/সংগ্রাহক সমাজ থেকে কৃষিকেন্দ্রিক জীবনযাপণ শুরু করেছিল। সারাদিন মহিষ চড়ানোর পরিবর্তে ঘরের সামনে ফসল ফলিয়ে মানুষ নিজের জীবনকে কিছুটা সহজ করে তুলেছিল।     

পিটার জেনিসজেউস্কি একজন বিজ্ঞানী যিনি স্থূলতা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়াশোনা করেছেন। পিটার  ‘ওবিসিটি প্যানাসিয়া’ নামক ব্লগের লেখক। ব্লগটি  স্থূলতা দূর করতে নিবেদিত। পিটার বলেছেন যে সেই সময়ে একজন আদর্শ পুরুষ স্থূল ছিল। যারা কৃষিজমির মালিক ছিল তারা বিশাল ভোজ উপভোগ করত এবং এর ফলে তাদের ওজন বৃদ্ধি পেত। আর একজন স্থূল শরীরের পুরুষকে তার জীর্ণশীর্ণ সমকক্ষদের চেয়ে দেখতে বেশি স্বচ্ছল ও আবেদনময়ী লাগত।   

প্রাচীন গ্রিস (৮০০–১৪৬ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)    

প্রাচীন গ্রিকরা তাদের সৌন্দর্যের আদর্শ সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহী ছিল, যা তাদের শিল্পকর্মে আজও আমরা দেখতে পাই। দ্য গার্ডিয়ান-এর মতে, তারা বড় দেহের কোনো ভোজনপ্রিয় পুরুষে আগ্রহী ছিল না; বরং পেশীবহুল এবং জীর্ণশীর্ণ শরীরের পুরুষই ছিল আদর্শ। তারা দেখতেও ছিল অনেকটা আজকালকার ম্যাগাজিনে দেখতে পাওয়া মডেলদের মতো। যদি গ্রিকদের এই মূর্তিগুলোর মধ্যে কোনো একটি জীবন্ত হয়ে উঠে আসে আর পরবর্তী মার্ভেল মুভিগুলোর জন্য অডিশন দেয় তাহলে অন্তত একটি কলব্যাক পাওয়া তো নিশ্চিত ।                

গ্রিক সৌন্দর্যের জন্য নির্দিষ্ট অনুপাত থাকলেও সেগুলো বাস্তবসম্মত ছিল না। দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ‘তাদের মতো পেশীগুচ্ছ অর্জন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব না। আপনি এক বছরের জন্য প্রতিদিন জিমে গেলেও এই মূর্তিগুলোর মতো অ্যাপোলো’স বেল্ট বানিয়ে বড়াই করতে পারবেন না।’   

অ্যাপোলো’স বেল্ট (অ্যাডোনিস বেল্ট নামেও পরিচিত) হলো পেটের ভি পেশী যা অনেক পুরুষই অর্জন করার চেষ্টা করে। তাই বর্তমানে এমন অনেক মডার্ন ওয়ার্কআউট তৈরি হয়েছে যেগুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো প্রাচীন গ্রিসের আদর্শ পুরুষের মতো ২১ শতকের পুরুষদের দৈহিক গড়ন বানানো।

অলঙ্করণঃ ঈহা

মধ্যযুগ (৮০০-১০০ খ্রিষ্টাব্দ) 

ধারণা করা হয় যে ২০ শতকের আগে মানুষেরা বর্তমান সময়ের তুলনায় খাটো এবং দুর্বল ছিল। কিন্তু অধ্যাপক রিচার্ড স্টেকেলের মতে এই ধারনা ভুল। স্টেকেল গবেষণার উপর ভিত্তি করে ওহাইয়ো স্টেট রিসার্চ নিউজ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মানুষের উচ্চতা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে রিপোর্ট করে। মধ্যযুগের প্রথম দিকে, পুরুষরা ২১ শতকের পুরুষদের মতোই লম্বা ছিল। বিগত ১২০০ বছর আগের হাজার হাজার কঙ্কাল অধ্যয়ন করে তিনি দেখতে পান যে মধ্যযুগে পুরুষদের বৃদ্ধি ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হয়, তবে ১৭০০ দশকের দিকে তা আড়াই ইঞ্চি হ্রাস পায়। স্টেকেল-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘আড়াই ইঞ্চির এই হ্রাস ১৯ শতকের বিভিন্ন শিল্প বিপ্লবের সময় দেখা যে কোনো উচ্চতার ওঠানামাকে বিশেষভাবে ছাড়িয়ে গেছে।’  আমাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানতে উচ্চতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কারণ উচ্চতার মাধ্যমে মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কেও জানা যায়। লম্বা মানুষ মানেই হচ্ছে সুস্থ মানুষ।      

তাহলে প্রশ্ন আসে, কেন পুরুষেরা সংকুচিত হয়েছে? স্টেকেল বেশ কিছু সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। আদি মধ্যযুগের সময় উষ্ণ জলবায়ু ছিল, তাই ফসলও সম্ভবত বেশি পরিমাণে ছিল। বেশি খাবার মানেই স্বাস্থ্যকর শরীর। এছাড়াও, মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে তুলনায়মূলক বেশি বাস করত। মধ্যযুগে কোনো ব্যস্ত শহর ছিল না, ফলে দ্রুত রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনাও কম ছিল। নগরায়ন উৎপত্তির সাথে সাথে জলবায়ু উষ্ণ থেকে ঠান্ডা হওয়া, রোগজীবাণুর বিস্তার ও খাদ্যের সম্ভাব্য অভাবে মানুষের স্বাস্থ্য ও গড়নের হ্রাস ঘটাতে থাকে।          

সুতরাং, ছেলেরা তখন অপ্রত্যাশিতভাবে লম্বা ছিল, কিন্তু একজন ‘নিখুঁত’ পুরুষের দেহ দেখতে কেমন ছিল? মধ্যযুগের শিল্পগুলো একজন আদর্শ পুরুষের চিত্র নির্ধারণে খুব একটা সাহায্য করেনি। কারণ শিল্পগুলো মূলত ধর্মের জন্য নিবেদিত ছিল। তাই শিল্পগুলোতে পুরুষ এবং নারীকে আবৃত অবস্থায় দেখা যায় আর অ্যাডোনিসের দিনগুলো অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। শিল্পগুলো পুরুষদের স্বাস্থ্যকর এবং স্বাভাবিক গড়ন প্রদর্শন করে, এর বেশি কিছু না।    


রেনেসাঁ (১৪৫০-১৬০০) 

রেনেসাঁর সময়ে পুরুষের নিখুঁত গড়ন কেমন হবে তা খুঁজে বের করতে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি  বিশেষ অবদান রেখেছেন। তার চিত্রকর্ম ‘ভিট্রুভিয়ান ম্যান’-এ পুরুষের নিখুঁত গড়ন তুলে ধরেছেন। গড়নটা শুধু শীর্ণতা, স্থূলতা বা পেশী সম্পর্কে ছিল না, ছিল নিখুঁত শরীরের অনুপাত খোঁজার বিষয়ে। এছাড়াও, পুরুষকে ঘিরে আঁকা বৃত্ত এবং বর্গক্ষেত্রগুলো কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, এর পেছনে গভীর অর্থ লুকিয়ে আছে।     


এনপিআর-এর সাথে একটি সাক্ষাৎকারে দ্য ভিঞ্চি’স গোস্ট-এর লেখক টবি লেস্টারের মতে, ‘বৃত্তটি দ্বারা, প্রাচীনকাল থেকে, মানে, ঐশ্বরিক ও মহাজাগতিক জিনিস বোঝানো হয়েছে। এটি নিখুঁত আকৃতি যার কেন্দ্র পরিধির সমস্ত বিন্দু কেন্দ্র থেকে সমান দূরত্বে অবস্থিত এবং এই আকৃতি কথিত সমস্ত এককেন্দ্রিক ভয়কে নিয়ন্ত্রিত করেছিল যা মহাজগতকে তৈরি করেছিল। এরপর আসে জিনিসের মানবিক উপাদান; বর্গক্ষেত্র, যেখানে সমস্ত কিছু পৃথিবীতে পতিত হয় আর সেগুলোর অর্থ নির্ধারিত হয়।’ ভিট্রুভিয়ান ম্যান কেবল উচ্চাভিলাষী এক আকর্ষণীয় শরীর ছিল না, স্বর্গ এবং পৃথিবীর এক পরম সংযোগও ছিল।                   

ফপের  পূর্বসূরী, ম্যাকারোনিরা মূলত ছিল ব্রিটিশ যুবক যারা বিদেশে গিয়ে ইতালীয় খাবার ‘ম্যাকারোনি’ এবং ইউরোপীয় পোশাকের প্রেমে পড়েছিলেন। ইতিহাসবিদ গেরি ওয়ালটনের মতে, তারা সম্প্রতি ইতালিতে গিয়েছে,
পুরুষরা সাধারণত এটা বোঝাতে ম্যাকারোনি অর্ডার দিত। ফলে তাদের ডাকনাম হয়ে গেল ‘ম্যাকারোনিজ’। ১৭৭৫ সালের ‘ইজি ফ্র্যাজিওলজি’ বইতে জোসেফ বারেটি লিখেছিলেন ‘অদ্ভুত ব্যাপার, এই শব্দটির অর্থ ইতালি থেকে ইংল্যান্ডে আসার সময় এতটাই পরিবর্তিত হয়েছে যে ইতালিতে এর অর্থ একজন ব্লক-হেড, মানে বোকা; এবং ইংল্যান্ডে এর অর্থ হচ্ছে একজন জমকালো পোশাক অনুরাগী!’ তারা আরও ফ্যাশনেবল এবং একটু মেয়েলি পোশাকও পরতে শুরু করে। ট্রিম ফিগার বেশি পছন্দের ছিল কারণ অনেকগুলো স্তর শরীরের সাথে লেগে থাকত। মূলত, তারা ছিল হিপস্টার।    

এক পর্যায়ে, ম্যাকারোনিরা হাসির পাত্র হয়ে ওঠে । বিশাল পরচুলা, ভারী মুখমন্ডল এবং অলংকার ও হাস্যকর অনুসঙ্গ দিয়ে তাদের চেহারা এতটাই চরম হয়ে উঠেছিল যে ১৭৭৫ সালের মধ্যে লোকেরা এই চেহারাকে ‘মেয়েলি’ বলতে শুরু করে। সেই সময়ের অক্সফোর্ড ম্যাগাজিন বলেছিল, ‘এমন এক ধরণের প্রাণী আছে যারা না পুরুষ, না নারী, এরা হচ্ছে আমাদের মাঝে বসবাস করা এক নিরপেক্ষ লিঙ্গের প্রাণী। একে ম্যাকারোনি বলা হয়… আমি হয়তো, ভবিষ্যতের সেই ভদ্রনারী-সু্লভ ভদ্রলোকদের নিন্দা করতে পারি, যারা নিজেদের পুরুষ ভাবতে হতাশবোধ করে আর নারীদের মতো হতে ইচ্ছা পোষণ করে।’      

নারীসুলভ এই চেহারাকে লোকে ঘৃণা করতে শুরু করে। অবশ্য কিছুকাল পরেই ফ্যাশনের বাইরে চলে যায় আর পুরুষালি চেহারার গুরুত্ব বেড়ে যায়। মজার ঘটনা: ‘ইয়াঙ্কি ডুডল ড্যান্ডি’ গানে ব্রিটিশরা আমেরিকানদের তাদের ছেঁড়া এবং জীর্ণ পোশাক নিয়ে ব্যঙ্গ করে। তাই  ‘Stuck a feather in his hat and called it Macaroni’ এই লাইনের মাধ্যমে বোঝানো হয় যে ওয়াশিংটন মনে করে একজন চটকদার ড্রেসার হওয়ার জন্য একটি পালকই যথেষ্ট এবং একই সাথে ম্যাকারোনিদেরকেও বোঝানো হয়। আমরা সবাই বাল্যকালে যে পাস্তা পছন্দ করতাম (এবং এখনও করি), এখানে কিন্তু সেই পাস্তার কথা বলা হয় নাই।       

সৌখিনদারদের যুগ (১৮ শতকের শেষ- ১৯ শতকের শুরু)  

আপনি ‘ড্যাড বড’ এর বড় ভক্ত হয়ে থাকলে, পুরুষের নিখুঁত গড়নের জন্য স্বর্ণালি যুগ আপনার সবচেয়ে প্রিয় হবে। নিওলিথিক যুগে ওজনই ছিল মানুষের স্ট্যাটাসের মাপদন্ড। সুতরাং, মোটা পুরুষরাই আদর্শ ছিল। মোটা হওয়া মানে ছিল তাদের প্রচুর পয়সা আছে, কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন নেই। ‘লুকিং গুড’ বই অনুযায়ী, বড় পেটকে আকর্ষণীয় ভাবা হতো। ওজন বেশি হওয়াটা এত জনপ্রিয় ছিল যে ফ্যাট মেনজ নামে একটা ক্লাবও ছিল।      

ফ্যাট মেনজ ক্লাবে যোগদানের জন্য ওজন ২০০ পাউন্ডের বেশি হওয়া লাগত। বোস্টন গ্লোব ১৯০৪ সালে একটি মিটিং সম্পর্কে লিখেছিল, ‘আজ রাতে এই গ্রামটা গোলাকার, ঝুলে থাকা পেট এবং ডাবল চিনে ভরে যাবে, কারণ নিউ ইংল্যান্ডের ফ্যাট মেনজ ক্লাব হেল’স ট্যাভার্নে  জমায়েত হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দারা, যাদের বেশিরভাগই হাড্ডিসার, প্রতিটি ট্রেনে করে আসা নাদুসনুদুস, লালচে মুখের দিকে ঈর্ষার সাথে তাকিয়ে থাকে।’          

এমনকি কার ওজন সবচেয়ে বেশি, এই ধরণের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবচেয়ে স্থূল পুরুষকে সেলিব্রেটও করা হতো। এনপিআর ১৮৮৫ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি আর্টিকেলের উদ্ধৃতি দিয়েছিল, ‘আমার ওজন এখন ৩০০ পাউন্ডেরও বেশি করতে হবে’, জর্জ ক্যাপ গর্বের সাথে কথাটা বলেন। কিন্তু, ২৪৩ পাউন্ডে এসেই থেকে গেলেন… তার বন্ধু্দের মতে সন্ধ্যার আগে সে দুঃখে কমপক্ষে ২০ পাউন্ডের বেশি শুকিয়ে গেছে। বলা বাহুল্য যে মোটা হওয়া শুধু পুরুষদের জন্য ফ্যাশনেবল ছিল, নারীদের জন্য না। তবে আকর্ষণের মানদন্ড হিসেবে বড় পেটের এটাই ছিলো সর্বশেষ যুগ।    

হলিউড (১৯২০-এর দশক) 

হলিউডি সিনেমার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বাড়ার সাথে সাথে পুরুষ এবং নারীদের জন্য সৌন্দর্যের আদর্শ রূপও নির্ধারিত হয়ে যায়। এটা পুরানো গল্প যে নারীদের সবসময় হলিউডে শীর্ণ থাকার জন্য চাপ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।    

লুকিং গুড অনুযায়ী, ফিল্মে অভিনেতাদের ওজন প্রায় ২০ পাউন্ড বেড়ে যায়, তাই পরিচালকরা শীর্ন দেহের অভিনেতাদের পছন্দ করে। বর্তমানে ইন্ডাস্ট্রি যেহেতু তীব্র ঠান্ডার পূর্ব উপকূল থেকে সদা রৌদ্রোজ্জ্বল ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে এসেছে, লোকে সারাবছর আরও বেশি খোলামেলা থাকতে পারে। এছাড়া, তখনকার সময়ের সিনেমাগুলোতে পুরুষদের ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার লড়াই এবং বেশ কিছু স্টান্ট করতে হতো, তাই কাজের সুবিধার্থে পুরুষদের একটা নির্দিষ্ট আকারে থাকতে হতো। ফ্যাট মেনজ ক্লাব-যুগের ১৫ বছরের মধ্যেই শীর্ণ ড্যাশিং ফিগার সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, আর মোটা হওয়া হয়ে গেল ওল্ড ফ্যাশন। 

চার্লস অ্যাটলাস (বিশ শতকের ৩০ ও ৪০ এর দশক)    

হলিউডের পুরুষেরা যখন পাতলা হতে শুরু করল, তখন চার্লস অ্যাটলাস করলেন ঠিক এর উল্টো। অ্যাটলাস ছিলেন প্রথম ফিটনেস গুরু। তিনি তার দৈহিক গড়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। স্মিথসোনিয়ান ম্যাগাজিনে বিস্তারিত বলা হয় যে অ্যাটলাস ৯৭ পাউন্ডের এক পুরুষে ছিলেন যিনি ওজনের জন্য লাগাতার বুলি হতে হতে  বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই তিনি ওয়ার্ক আউট করতে শুরু করেন, ‘ডাইনামিক টেনশন’ (আইসোমেট্রিক ব্যায়ামের একটি রূপ) নামের ব্যায়াম প্র্যাকটিস করেন। অবশেষে একজন আইকনে রূপান্তরিত হন। ১৯৩০ এবং ‘৪০ এর দশকের কঠিন সময়ে মানুষ অ্যাটলাসের গল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলো।        

‘Fit for America: Health, Fitness, Sport and American Society, 1830-1940’-এর লেখক হার্ভে গ্রীন স্মিথসোনিয়ানকে বলেছেন যে, ডিপ্রেশন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য অ্যাটলাসের সমাধান ছিল ‘বাকি সবার চেয়ে আকারে বড় হওয়া। তাহলে কেউ তোমার সাথে ঝামেলা করবে না। শারীরিক আকার আপনাকে আত্মবিশ্বাস দিতে পারে এটা একটা শক্তিশালী বার্তা ছিল।’  এর ফলে সত্যিকার অর্থে প্রথম ফিটনেস মুভমেন্ট শুরু হয়। পুরুষদের শক্তিশালী দৈহিক গড়ন বানানোর ট্রেন্ড শুরু হয়।      

এক্সিকিউটিভ লুক (১৯৫০- ১৯৬০ এর দশক)  

যুদ্ধ আর হতাশার কাল পেরিয়ে,  পুরুষরা দেখতে শক্তিশালী না হতে চাইলেও আকারে বড় হতে আগ্রহী ছিল। এক্সিকিউটিভ লুকের যুগে পুরুষদের জন্য নিখুঁত শারীরিক গড়ন মানেই ছিল আকারে বড়সড় হওয়া। তখনকার সময়ে স্যুট জ্যাকেট এবং ওভারকোটের কাঁধ ছিল বড় ও বক্সী আর ফিটিং ছিল অনেক বেশি ঢিলেঢালা। সেই সময় সরু কোমরের চাহিদা ছিল অনেক, কিন্তু লম্বা গড়ন আর চওড়া কাঁধকেই নিখুঁত শরীর হিসেবে গণ্য করা হতো। 

ভ্যান্স প্যাকার্ড ১৯৬২ সালের কর্পোরেট জগতের সাফল্য সম্পর্কে একটি বই ‘ইন দি পিরামিড ক্লাইম্বার্স’-এ একজন আদর্শ এক্সিকিউটিভ দেখতে কেমন হওয়া উচিত তা বর্ণনা করেছেন। ‘এখনকার ফ্যাশন বড় গড়নের পুরুষদের জন্য। পুরানো দিনে কিছু কিছু কোম্পানিতে সবচেয়ে লম্বা এক্সিকিউটিভের উচ্চতা ছিল পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, কিন্তু এখন ফ্যাশন হচ্ছে দীর্ঘ গড়নের পুরুষদের জন্য, যদিও প্রচুর ছোট গড়নের পুরুষরা দুর্দান্ত কাজ করছে।’ তিনি এমন ঘটনারও উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে তাকে শুধুমাত্র ছয় ফুটের বেশি লম্বা প্রার্থীদের অ্যাপ্লিকেশন জমা দিতে বলা হয়েছিল। ফলে তার অনুমান যে বড় গড়নের পুরুষদের পছন্দ করা হয় কারণ ‘তাদের এক নির্দিষ্ট মূল্য আছে।’     


আসলে ৫০-এর দশকে ছোট শারীরিক গড়নের পুরুষদেরকে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হতো। প্যাকার্ড বলেছেন, ‘যদি কেউ ছোট গড়নের হয়, তবে তাকে এনার্জি ও সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে এই কমতি পূরণ করা উচিত।’ 

ষাটের দশক 

৬০-এর দশকে ফরমাল লুক বাদ দিয়ে ভদ্র ও  স্টাইলিশ পুরুষরা ফ্যাশনেবল হয়ে ওঠে। GQ ম্যাগাজিন এই যুগের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল পুরুষদের একটি তালিকা করে। সেখানে আপনি দেখবেন পুরুষদের চেহারা ছিলো স্বচ্ছ এবং স্যুটগুলি শরীরের সাথে ফিট ছিল। কর্পোরেট জগতের পুরুষরা এই বাটন-আপ স্টাইল বজায় রাখে, অন্যদিকে রক তারকারা ও তরুণেরা বোহেমিয়ান লুকের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ফ্যাশনের ক্ষেত্রে পুরুষদের কাছে ‘আমি কী কালো স্যুট জ্যাকেট পরব না গাঢ় ধূসর?’ -এর চেয়ে আরও বেশি অপশন থাকতে শুরু করে।   

এই যুগের নিখুঁত পুরুষ গড়নের উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় শন কনেরি,  ‘007’ মুভির প্রথম হিরো। তার শরীর ছিল সরু, খুব একটা পেশীবহুল ছিল না এবং তার বুকে লোম  ছিল। মাইকেল কেইনকে, বিশেষত ‘আলফি’ মুভির পর থেকে, সুদর্শন লিডিং ম্যান হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কিন্তু তার শার্টলেস লুক হয়তো আজকের স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী অপ্রীতিকর ছিল। সেই সময়ে পুরুষরা চওড়া কাঁধ এবং চর্বিহীন ফ্ল্যাট পেট অর্জন করাতেই ব্যস্ত ছিল, তখন কাট বাইসেপ এবং সিক্স প্যাক অ্যাবসের তেমন চাহিদা ছিল না।   

৬০-এর শেষ থেকে ৭০-এর শুরু   

ম্যাকারোনিদের যুগের পর থেকে প্রথমবারের মতো পুরুষদের নিখুঁত গড়ন হিসেবে একটু কম রূঢ় পুরুষালি লুক স্টাইলে এসেছে। ডেভিড বাউয়ি এবং এমনকি মাইক জ্যাগারের জন্যও অ্যান্ড্রোজিনি ছিল এক বিশাল ব্যাপার। দ্য গার্ডিয়ানের মতে, তারা দুজনেই ম্যাস্কুলিন ও ফেমিনিন লুক নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে মজা পেয়েছেন। এই লুকের ফলোয়ারদের মাঝে সরু ও লম্বা বডি ফ্রেম জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যদিও ইউনিসেক্স জামাকাপড়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে এতে জেন্ডার রোলের উপর কোনো প্রভাব পড়ে আর নাই নিখুঁত গড়নের গুরুত্ব কমে নাই।  

প্রফেসর জো পাওলেটি তার সেক্স এন্ড ইউনিসেক্স বইয়ে বলেছেন, ‘অ্যাডাল্ট ইউনিসেক্স ফ্যাশনের  আবেদনময়তার অংশ ছিল পরিধানকারী এবং পোশাকের মধ্যে সেক্সি বৈসাদৃশ্য, যা আসলে পুরুষ বা নারীদের শরীরকে আকর্ষণীয় করে তোলে।’   

সব পুরুষ কিন্তু জেন্ডারের ভেদবিধি ভেঙে ফেলতে ইচ্ছুক ছিল না। তারা গোঁফ মুখেই বেল বটম ট্রেন্ড ফলো করতে শুরু করে। পুরুষের জামাকাপড় অতীতের তুলনায় আরো আঁটসাঁট হয়ে গেল। তাই তাদের একটা নির্দিষ্ট শারীরিক গড়ন ধরে রাখতে হতো। তখনও সিক্স প্যাক অ্যাবসের চাহিদা ছিল না, তবে হাই ওয়েস্টেড প্যান্ট এবং স্ন্যাজি জাম্পসুট পড়ে ভুঁড়ি লুকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।   

আশির দশক 

৮০-এর দশকে পুরুষদের নিখুঁত গড়ন দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দিকে চলে গেছে। একদিকে ছিল সিলভেস্টার স্ট্যালোন এবং আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার মতো অ্যাকশন হিরোদের শক্তিশালী বডি। সুসান জেফোর্ডস তার ‘হার্ড বডিজ’ বইয়ে লিখেছেন যে, সেই সময়ের অ্যাকশন ফিল্মগুলো এবং প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের ‘মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তন’ ৮০ দশকের ম্যাস্কুলিন আদর্শকে সংজ্ঞায়িত করত।  এই দশকে শুধু চওড়া কাঁধ থাকলেই চলতো না, রিগ্যানের যুগে পুরুষত্ব অর্জন করতে জিমে কঠোর পরিশ্রম করা ছিল অপরিহার্য।   

অন্য দিকে গ্ল্যাম মেটালের উত্থান হচ্ছিল। আনা কুরেনায়া তার ‘লুক হোয়াট দি ক্যাট ড্র্যাগড ইন’ বইয়ে বলেছেন, ‘গ্ল্যাম মেটালের ধারা ছিল মাথাভর্তি চুল, উদ্ভট পোশাক  আর  বিপরীত জেন্ডারের প্রতি লোভনীয় লালসা, যা জেন্ডার, যৌনতা এবং সত্যতা সম্পর্কে আমাদের সম্মিলিত ধারণাগুলোকে উপেক্ষা করে একটি জটিল সীমালঙ্ঘনের পরিসর গঠন করে।’  যদিও “টক ডার্টি টু মি” এবং “আনস্কিনি বপ”-এর মতো গানগুলো জেন্ডার রোলকে চ্যালেঞ্জ করেছে বলে মনে নাও হতে পারে, এই হাইপার-ম্যাস্কুলিন ব্যান্ডগুলোর ফেমিনিন সাজ ৮০ দশকে এক সম্পূর্ণ নতুন ধারণা বয়ে নিয়ে আসে।    

অলঙ্করণঃ ঈহা


আরও বেশি পেশীবহুল (১৯৯০-বর্তমান)

৮০ দশকের শুরু থেকে পেশীবহুল পুরুষদের আদর্শ হওয়ার ধারণা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সুপারহিরো মুভির যুগে এই ধারণাটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ১৯৮৭ সালের ‘সুপারম্যান-ফোর’ মুভির ক্রিস্টোফার রিভকে হেনরি ক্যাভিলের সাথে তুলনা করে দেখুন।  দুজনেই সুপারম্যানের চরিত্রে অভিনয় করেছে (১৯৭৮-১৯৮৭ থেকে রিভ এবং ২০১৩-২০১৬ সালে ক্যাভিল) আর যদিও তারা দুজনেই দুর্দান্ত শেপে ছিল, ক্যাভিলের তুলনায় রিভকে দেখতে অল্প বয়স্ক ছেলের মতো লাগে। এখন, ফিল্মে  ‘হট গাই’ চরিত্রে কেউ অভিনয় করলে তাকে অবশ্যই ম্যাস্কুলিন হতে হয়। তাই নায়কদের জন্য শুধু সরু বা অ্যাথলেটিক হওয়াই যথেষ্ট না। আর নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত, লুকের চাহিদা কেবল বেড়েই চলেছে।      

দ্য টেলিগ্রাফ-এর মতে, এই অ্যাকশন হিরোরা ছেলেদের মধ্যে বডি ইমেজের সমস্যা তৈরি করেছে। সংবাদপত্রটি আলফা ম্যাগাজিনের একটি সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়েছে যেখানে দেখা যায় যে, পুরুষরা পাঁচ বছর আগের তুলনায় ২০১৫ সালে তাদের শরীর নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। টিএমজি-এর মতো সাইটগুলো পুরো একটা সেকশন ‘লিভিন লার্জ’-কে নিয়েই। সাইটগুলো ওজন বেড়েছে এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের অপ্রীতিকর ছবি প্রকাশ করে। 

যদিও এমন পরিস্থিতির সঙ্গে নারীরা কয়েক দশক ধরে মোকাবেলা করে আসছে,   পুরুষরাও এখন মিডিয়ার কাছ থেকে অসম্ভব শারীরিক গড়ন অর্জনের জন্য সমান চাপ অনুভব করছে। চাইলে তারা এজন্য সুপারম্যানকে দোষারোপ করতে পারে।            

নিখুঁত পুরুষের জন্য একটি জিনিসটি ধ্রুব রয়ে গেছে? একমাথা চুল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পুরুষ তার মাথার চুল পড়ে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছে। 

‘লুকিং গুড’-এর লেখক আরব্য রজনী থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে একজন নারী বলছেন, ‘পৃথিবীতে একজন পুরুষের আর্টিচোকের মতো টাক এবং দাড়িহীন হওয়ার চেয়ে কুৎসিত আর কিছু আছে কি?’  বই অনুসারে, জুলিয়াস সিজার মাথার টাক লুকানোর জন্যই তার সিগনেচার তাজটি পরতেন। গেটি ব্লগ অনুসারে, প্রাচীন রোমে টাক পড়া মানেই ছিল জ্ঞানী হওয়া আর তাই অনেক দার্শনিককে টাক মাথায় দেখানো হতো, কিন্তু বাকিরা টাক মাথাকে আড়াল করার জন্য যা যা দরকার তা সবই করত। পুরুষরা তাদের ধূসর রঙের চুলকে রঙ করত, কেননা তারা তাদের চুলের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো খুবই আবেগের। সম্রাট ডোমিশিয়ান চুল সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘নিশ্চিত থাকুন যে চুলের চেয়ে বেশি আনন্দদায়ক আর কিছু নয়, তবে স্বল্পস্থায়ীও আর কিছু নয়।’  সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও মাথায় টাক পড়ার দুঃখিত তিনি লুকিয়ে রাখতে পারেনি।

লুকিং গুড অনুযায়ী, পুরুষরা তাদের মাথার টাক লুকানোর জন্য পরচুলা পরতে শুরু করে এবং বছর পার হওয়ার সাথে সাথে মাথায় চুল গজানোর জন্য সন্দেহজনক ওষুধ আবিষ্কৃত হতে থাকে। একুশ শতকে টাক মাথার একজন পুরুষ আকর্ষণীয় বিবেচিত হতে পারে (রক এবং ভিন ডিজেল হচ্ছে সেরা উদাহরণ), তবে চুল পড়ার ট্রিটমেন্ট ইন্ডাসট্রি এখনও প্রতি বছর ১ বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে। যদিও স্টাইল এবং বডি টাইপ সময়ের সাথে সাথে পাল্টাতে থাকবে,  তবে পুরুষদের লম্বা ও ঘন চুলের চাহিদা কখনো পাল্টাবে না।  
  

নিখুঁত-এর পরিবর্তনশীল ধারণা

পুরুষের নিখুঁত গড়নের সংজ্ঞা বছরের পর বছর ধরে এতটাই বদলেছে যে এ ধরনের খামখেয়ালী আদর্শ ফলো করা হবে মূর্খতার পরিচয় । ফ্যাট মেনজ ক্লাব-এর সেই পুরুষদের সম্পর্কে ভাবুন যাদেরকে প্রাইম হটি হি্সেবে বিবেচনা করা হতো কিন্তু পরবর্তীতে হলিউডের সরু শরীরের হিরোদের জন্য তাদেরকে আর গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পেশী নিয়ে এই ঘোর একসময় অবশ্যই কেটে যাবে এবং একদিন আসবে যেদিন আপনার স্বাভাবিক দৈহিক গড়নই হবে ‘নিখুঁত’ গড়ন।     

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।