WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক


মিরেই গুইলিয়ানো পাতলা গড়নের সফল এক নারী। তার জন্ম ফ্রান্সে আর জাতিসঙ্ঘের হয়ে দোভাষী হিসেবে কাজ করার আগে তিনি প্যারিস থেকে পড়াশুনা শেষ করেন। তারপর কিছুদিন তিনি শ্যাম্পেনের ব্যবসায় ছিলেন। ১৯৮৪ সালে যোগদান করেন ভ্যুভ ক্লিকো’তে, যার কাজকর্ম সেসময় মোটেই খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না। কিন্তু তার সাহায্যে কোম্পানিটা উন্নতি লাভ করতে থাকে এবং একসময় আমেরিকায় একটা শাখাও খুলতে সক্ষম হয়। ১৯৯১ সালে তিনি এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেন ও ভীষণ সফলতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। ডাউনটাউন ম্যানহ্যাটানের দিক মুখ করা অ্যাপার্টমেন্টে বসে তিনি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে ঠাট্টা করে বলেন, ‘জানেনই তো আমি পানি কতটা ভালোবাসি।’ ঠিকই। ‘ফরাসি কায়দায়’ ওজন কমানোর ও পাতলা থাকার ব্যাপারে তার বেস্টসেলিং ফ্রেঞ্চ উইমেন ডোন্ট গেট ফ্যাট বইটাতে প্রধান বিধান হলো প্রচুর পানি খাওয়া।      

বইতে তিনি কিশোরী বয়সের নিজের অস্বস্তির কথা লেখেন। সেসময় গ্রীষ্মকালের ছুটি কাটাতে আমেরিকায় থাকাকালীন তার ওজন বেড়ে যায়। এই অস্বস্তি আরো বেড়ে যায় যখন আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে ফেরার পর তার বাবা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার বদলে, বলে ওঠেন তাকে দেখতে ‘একটা আলুর বস্তার মত লাগছে।’ এরপর তিনি নিজের খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি বদলে ফেলেন, নিজের পুরনো ফরাসি অভ্যাস আবার মনে করলেন (অনেক পানি, পরিমিত খাবার, নিয়মিত চলাচল) এবং সৌভাগ্যের কাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন।       

সফল একজন নারী হিসেবে তিনি নিজের বাহ্যিক রূপ ও ওজন নিয়ে কথা বলেন। সে হিসেবে তিনি বেশ বিরল। তিনি বলেন, ‘কেউই এ বিষয়ে তেমন কথা বলতে চায় না। এর চেয়ে এই ভান করা অনেক সহজ যে এসব এমনি এমনিই হয়ে যায়।’ নারীবাদের একের পর এক তরঙ্গ স্মার্ট নারীদেরকে বলেছে যে তাদের উচিত এতদিনে আত্মগরিমা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করা—যেভাবে তারা গৃহকর্ম ও স্রেফ সন্তান উৎপাদন দ্বারা চিহ্নিত অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এসেছে।       

কিন্তু নিজের শরীর ও ওজনের ব্যাপারে মন্তব্যের কারণে গভীরভাবে বিচলিত হওয়ার ক্ষেত্রে নারী হিসেবে তিনি একা নন। ওজন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পডকাস্ট মেইন্টেনেন্স ফেজ এর সহ-উপস্থাপিকা অব্রে গর্ডনকে দশ বছর বয়সে এক ডাক্তার বলেছিল যে তার ওজন অতিরিক্ত বেশি। আমেরিকান লেখিকা  রোক্সেন গে বোর্ডিং স্কুল থেকে ফেরার পর আগের চেয়ে ৩০ পাউন্ড (প্রায় ১৪ কেজি) ওজন বেড়ে যাওয়ায় নিজের বাবা-মা’র হতবাক দশার কথা লিখেছিলেন।   

এই অভিজ্ঞতাগুলো গভীরভাবে ব্যক্তিগত, আবার একইসাথে ভীষণ সার্বজনীন, অন্তত উন্নত বিশ্বে। নারীদের উপর ‘আদর্শ’ এক রূপের যে ধারণা চাপিয়ে দেয়া হয় তারই প্রতিফলন ঘটে এতে। এই আদর্শ সময়ের সাথে বদলেছে অনেক। রেনেসাঁসের নগ্ন ছবিগুলোতে নারীর দেহে পর্যাপ্ত স্থূলতা ও ভাঁজ লক্ষ করা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাতলা শরীরকেই আদর্শ বলে ধরে নেয়া হয়। টম উলফ-এর উপন্যাস বনফায়ার অফ দ্য ভ্যানিটিজ থেকে ধার করে ১৯৮০’র দশকে ‘সামাজিক এক্স-রে’ দিয়ে বোঝানো হতো সেইসব নারীদেরকে যারা এতটাই চিকন যেন তাদের গোটা অস্তিত্বই দ্বিমাত্রিক।  
    

৯০ এর দশকের লন্ডনে আবার এটাকে বলা হতো ‘হিরোইন শিক।’ আজকের দিনে আদর্শ শারীরিক গঠন হলো ‘উইজেল বড’, লস অ্যাঞ্জেলিনা জানান, যাকে সারাক্ষণ ঘেরাও করে রাখে নিখুঁত শরীরের জন্য মরিয়া নারীরা। এই নারীরা বেজির মত চিকন হতে চান, যেন কোনো আলোড়ন না তুলে পানির মধ্য দিয়েও তরতর করে চলে যেতে পারেন।  

নারীদের দেহের উপর যে বাড়তি গুরুত্ব চাপানো হয় তা সব নারীই একসময় বুঝে ফেলেন। যেনবা মেয়েরা অসচেতনভাবে একটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায় আর তারপর একসময় তাদেরকে গাছগুলো দেখানো হয়। তারপর তারা ভাবতে পারে গাছগুলো ওখানে এলো কী করে, কতদিন ধরে ওগুলো বড় হচ্ছে আর তাদের শিকড় ঠিক কত গভীর পর্যন্ত যায়। কিন্তু গাছগুলোর ব্যাপারে তাদের করার তেমন কিছুই নেই এবং দুনিয়াটা অন্য কোনোভাবে কল্পনা করাও প্রায় অসম্ভব। আর যদিও একটা গপ্পো প্রচলিত আছে যে চালাক ও উচ্চাশাসম্পন্ন নারীরা, যারা শ্রমবাজারে নিজেদের মেধা ও শিক্ষার মাধ্যমে অবদান রাখতে পারেন তাদের নিজেদের শরীরের ব্যাপারে অত সচেতন হওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রমাণাদি ঘেটে দেখলে বোঝা যায় এমনটা বিশ্বাস করার তেমন কোনো ভিত্তি নেই। কেননা শরীরের ওজন তাদের আয় ও বেতনের উপরও প্রভাব ফেলে। দরিদ্র দেশগুলোতে, যেখানে গরীবদের চাইতে ধনীরাই ওজনে একটু ভারি, সেখানে এই সম্পর্কটা একটু অন্যরকমের। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি ও সাউথ করিয়ার মত ধনী এশিয়ান দেশগুলায় ধনীরা গরীবদের চেয়ে চিকন হয়। সাধারণত ওজনের বেশিরভাগ পরিমাপক, যেমন দেহের ভরের সূচক, অতিরিক্ত স্থূলতার নিয়ামক, অথবা মোট জনসংখ্যায় স্থূলতার হার ইত্যাদির সাথে আয় ও দারিদ্র্যহারের নিচে বাস করার মধ্যে একটা নিম্নমুখী সম্পর্ক থাকে। 

গরীবদের ওজন যে ধনীদের চাইতে বেশি হয় তার ব্যাখ্যা আগেও দেয়া হয়েছে এইভাবে যে উন্নত বিশ্বে স্থূলতা আদতে দারিদ্র্যের পরিচায়ক। দরিদ্র লোকেরা প্রায়সময়ই সুস্বাস্থ্যকর খাদ্য কিনে খেতে পারে না। তারা ফাস্ট ফুড অথবা প্রসেসড খাবার বেছে নেয় কারণ হয়তো বাসায় তারা খাবার রান্না করার সময় পায় না অথবা ব্যায়াম করার মতও পর্যাপ্ত সময় তাদের জোটে না, কেননা কম-বেতনের চাকরিগুলোতে সাধারণত অনেক লম্বা শিফট ধরে কাজ করতে হয় এবং ‘ল্যাপটপ শ্রেণীর’ লোকেদের চাকরিগুলোর তুলনায় সেগুলো অনেক কম ফ্লেক্সিবল। আবার যেহেতু বেশিরভাগ সময় শিক্ষার স্বল্পতার কারণেই মানুষ অল্প বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হয়, ফলে ধরে নেয়া যায় এই শিক্ষার অভাবের কারণেই তারা অনেকসময় জানেই না কীভাবে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা যায়। 

এতসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সমস্যা হলো উন্নত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার আয় ও ওজনের এই দ্বিমুখী সম্পর্কের প্রায় পুরোটাই সচল রেখেছে নারীরা। আমেরিকা ও ইতালিতে আয় ও স্থূলতার সম্পর্কের ঢাল পুরুষদের ক্ষেত্রে সমতল ও নারীদের জন্য নিম্নমুখী। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ঢাল পুরুষদের ক্ষেত্রে ও ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা এতটাই নিম্নমুখী যে দুইয়ে প্রায় কাটাকাটি হয়ে যায়। ফ্রান্সে আবার ঢালটা পুরুষদের জন্যও খানিকটা নিম্নমুখী, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। এরকমটা প্রায় সকল ধনী দেশেই দেখা যায় এবং ওজন কিংবা স্থূলতা মাপার যেকোনো পরিমাপকের ক্ষেত্রেই তা বহাল থাকে। 

ডাচেসের বিধান 

অন্যভাবে বললে, ধনী নারীরা গরিব নারীদের চাইতে অনেক চিকন কিন্তু বড়লোক পুরুষেরা আর গরিব পুরুষেরা প্রায় সমান মোটা। ওয়ালিস সিম্পসন, যাকে বিয়ে করার কারণে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডকে সিংহাসন ছাড়তে হয়, তিনি নাকি বলেছিলেন একজন নারী ‘যতই চিকন বা ধনী হোক না কেন তা পর্যাপ্ত নয়।’ এখন তিনি নিজে হয় দুটোই ছিলেন না হয় কোনোটাই না। যারা মনে করে স্থূলতার প্রধান কারণ দারিদ্র্য অথবা অনেক টাকা-পয়সা থাকলেই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা যায় তারা এখানে একটু খটকায় পড়বেন। কেননা তাহলে ব্যাখ্যা করতে হবে এই সমীকরণ কেবল নারীদের ক্ষেত্রেই কেন কার্যকর। হয়তো উভয় লিঙ্গের জন্যই এই সমীকরণের ফলাফল একই হওয়ার কথা, কিন্তু তাদের পেশার কারণেই তারতম্য দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে পুরুষরাই বেশির ভাগ কম-বেতনের ও কায়িক পরিশ্রমের চাকরিগুলোতে নিয়োজিত, যেমন নির্মাণকাজ (যদিও হাসপাতালের নার্সরাও প্রায় রাজমিস্ত্রীদের সমান হাঁটাচলা করেন ও দাঁড়িয়ে থাকেন, ও তাদের অধিকাংশই নারী।) অনেক সময় অভিনেত্রীদেরকে সিনেমার কাজ পাওয়ার জন্য এমনিতেই পাতলা শরীর ধরে রাখতে হয়।  

কিন্তু তবুও এত বিশাল ফারাক ব্যাখ্যা করার জন্য এটাও পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। আমেরিকার শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে মোট জনসংখ্যার কেবল ৩.৫% লোক প্রচণ্ড মাত্রার কায়িক শ্রমে নিয়োজিত (এবং সেসব পেশার অনেকগুলোতেই নারীরা বহুলাংশে রয়েছেন, যেমন নাচ কিংবা ব্যায়ামের প্রশিক্ষক।) কেবল ০.১% মানুষ অভিনয়ের মত পেশার সাথে যুক্ত। আয় ও ওজনের দ্বিমুখী সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে একটি লৈঙ্গিক ফারাক রয়েছে, এবং তা নারী ও পুরুষের মধ্যকার অন্যান্য পার্থক্য দিয়ে ব্যাখ্যাও করা যাচ্ছে না, সুতরাং পুরো ব্যাপারটা অন্য এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়: হয়তো চিকন হওয়া নারীদের জন্য ধনী হওয়ার পথ সহজ করে দেয়।  

অসংখ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে যে স্থূল নারীরা তাদের চিকন সহকর্মিনীদের তুলনায় কম বেতন পান। অপরদিকে স্থূলকায় পুরুষ ও ‘স্বাভাবিক’ ওজনের পুরুষদের বেতনের মাত্রার মধ্যে তেমন কোনো তারতম্য নেই। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে: একটা সুইডিশ গবেষণাপত্র অনুযায়ী, দেখা গেছে যে স্থূলকায় পুরুষরাই কম বেতন পায়, নারীরা না। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা ও ডেনমার্কের গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্থূল নারীরাই বেতন কম পায়। একজন নারীকে মোটা হওয়ার বেশ ভালোই মূল্য চোকাতে হয়, এতে তার বেতনের প্রায় ১০% কাটা পড়ে। 

স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যও বেড়েছে  

দেহের মাপের জন্য যাকে কোনোদিন কোনো চাকরি দেয়া হয়নি তার জন্য আয়ের এই ফারাকটা আঁচ করা অনেক কঠিন হবে। কেবল শরীরের গড়ন পাতলা হওয়ার কারণে একজন নারী এত বেশি বেতন পেতে পারেন যে, তার জন্য আরো বেশি পড়াশুনা করার চাইতে ওজন কমানোতে মনোযোগ দেয়াই বেশি লাভজনক হবে। একটা মাস্টার্স ডিগ্রি একজনের বেতনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে ১৮%। একজন নারী কেবল ৬৫ পাউন্ড ওজন কমানোর মাধ্যমে এর ১.৮ ভাগ বেতন বৃদ্ধি করাতে পারেন। শ্বেতাঙ্গ নারীদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি ঘটে—কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা হিসপ্যানিক নারীদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটার নজির তুলনামূলক অনেক কম (যদিও এর কারণ হতে পারে যে গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত বিএমআই মাপা হয়, এবং সে ক্ষেত্রে এইসব নারীদেরকে প্রায়ই ভুলভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়।) 

মোটা নারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য মোটেই কমেনি। অর্থনীতিবিদ ডেভিড লেম্পার্ট লিখেছিলেন, ‘স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমরা আশা করতে পারি তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য কমে আসবে। কেননা আজকের দিনে ওজন বেড়ে যাওয়া বেশ স্বাভাবিক। অথচ বর্তমানে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যও বেড়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এর মাত্রা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তার মতে এর কারণ হলো, ‘পাতলা দেহ বর্তমানে আরো বিরল হয়ে পড়ার কারণে সেটাকেই প্রিমিয়াম মনে করা হয়।’   

এই গবেষণাপত্র যে উপসংহারের দিকে ইঙ্গিত দেয় তাতে ক্রুদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। স্থূলকায় নারীদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গোটা জীবন ধরে চাপিয়ে দেয়া আয়ের বৈষম্য তাদেরকে জেঁকে ধরে। তাদের শুরুর বেতনও হয় অনেক অল্প, এবং গোটা কেরিয়ারে পদোন্নতি পান তারা অনেক কম। তার গবেষণা অনুযায়ী, ‘১৯৮১ সালে এক ২০ বছর বয়সী নারীর তুলনায় ২০০৪ সালে এক ৪৩ বছর বয়সী স্থূলকায় নারী বেতনের ক্ষেত্রে অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।’   


তাছাড়া স্থূলকায় কর্মচারীরা যে মালিকদের অধিক খরচার কারণ হয় তার আংশিক প্রতিফলনও এখানে ঘটে। বিশেষ করে আমেরিকায় এমনটা বেশি ঘটে। হেলথ ইন্স্যুরেন্সের খরচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারাই বহন করেন। আর স্থূলকায় মানুষদের পিছনে এ ক্ষেত্রে বেশি খরচ হয়, কেননা বয়স বাড়ার সাথে সাথে এরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগতে থাকেন।  


তবু, এসবের ভার কেবল নারীদের উপরই কেন চাপিয়ে দেয়া হবে তা অস্পষ্টই থেকে যায়। এবং কানাডা ও ইউরোপ, যেখানে হেলথ-কেয়ারের খরচ সরকার বহন করে, সেখানেও নারীদের ক্ষেত্রে একইরকম আয়গত ঘাটতি লক্ষ করা যায়।   

স্থূলতার কারণে আয়ের বৈষম্য যে বাড়ছে বই কমছে না—তার প্রমাণ পাওয়া যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ‘অন্তর্গত পক্ষপাত’ পরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষার্থীদের এখানে বলা হয় বিভিন্ন মানুষের জাতি, লিঙ্গ, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশান কিংবা ওজনের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে ভালো কিংবা খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করতে। এবং এ ক্ষেত্রে ফলাফল বেশ ইতিবাচক দিকেই মোড় নিচ্ছে। জাতিগত ও লৈঙ্গিক বৈষম্য গত এক দশকে বেশ কমে এসেছে। সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবও এক তৃতীয়াংশ কমেছে। কিন্তু ওজনের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। শারীরিকভাবে ভারী মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব আগের চেয়ে বেড়েছে।    

এই প্রেক্ষাপটে নারীরা ওজন কমানোর জন্য এত চাপ ও নিজের ওজন নিয়ে এতটা হীনমন্য কেন বোধ করে তার পিছনের অন্যসব কারণ ও ব্যাখ্যাগুলো বেশ অসম্পূর্ণ মনে হয়। হয়তো নারীরা নিজেদের শরীর নিয়ে এত হীনমন্য  বোধ করে কারণ সারাক্ষণ তারা ম্যাগাজিনের তন্বী মডেলদের দেখে ভাবে সেগুলো একদম এডিটেড না এবং নিজেদের সাথে তুলনা করে। কিংবা হয়তো কোনো ডাক্তার অথবা বাবা-মা ছোটবেলায় তাদের শরীর নিয়ে কোনো মন্তব্য করেছিল। বর্তমান বাজারের এসব চাপের পাশাপাশি: নারীরা হয়তো মনে করে যে ওজন কমাতে না পারলে তাদেরকে তার খেসারত দিতে হবে। আর সেটা সত্য।   

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, পড়াশুনায় সময় দেয়া বুদ্ধিমান কাজ কেননা শ্রমবাজারে তার স্পষ্ট লাভ পাওয়া যায়। একইভাবে একজন নারীর জন্য ওজন কমাতে চাওয়াও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। কোন খাবার কতটুকু খেতে হবে এই নিয়ে মাথা ঘামানো ও ব্যয়বহুল ব্যায়ামের পিছনে টাকা খরচ করা আসলে এক প্রকার বিনিয়োগ পরবর্তীতে যার রিটার্ন পাওয়া যায়। পুরুষদের জন্য এমনটা হয় না।        

অলংঙ্করণঃ ঈহা

নারীরাও এই ব্যাপারে বেশ সচেতন। এক প্রজন্ম আগেও এ ব্যাপারটাকে তারা তেমন আমলে নিত না। ‘চাকরির পরে—কিংবা এর মধ্যেই সবচেয়ে মৌলিক যে বিষয়টা সামলাতে হবে তা হলো নিজেকে দেখতে কেমন লাগছে ও কেমন বোধ হচ্ছে। একজন নারী যে সবকিছু পেতে চায়, সে মোটা হয়ে থাকতে চাইবে তা ভাবাই যায় না’,  নিজের বই হ্যাভিং ইট অল-এ লিখেছিলেন ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে কসমোপলিটান ম্যাগাজিনের সম্পাদক হেলেন গার্লি-ব্রাউন। এই বইতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন কীভাবে দিনে ৮০০ ক্যালোরির খাবার খেয়ে টিকে থাকতে হবে, এবং  নারীদেরকে উপদেশ দিয়েছেন প্রতিদিন নিজেদের ওজন মেপে দেখতে ও মেনে নিতে যে ‘ডায়েট করা একদম জাহান্নাম, এবং এই নিয়ে এত মন খারাপ করার কিছু নেই!’   

আজ থেকে চার দশক আগে এরকম মনোভাব বেশ গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা খুব একটা বদলেছে বলে মনে হয় না। বদলেছে শুধু বয়ানটা, যা এখন সকল প্রকার শারীরিক গঠনের প্রতি সহিষ্ণু হয়েছে এবং ডায়েট করাকে নাকচ করেছে। সাউথ-বীচ ডায়েট কিংবা অ্যাটকিন্স খাদ্য বাতিলকরণের বদলে এখন বলা হয় গ্লুটেন-মুক্ত, ভিগান, লো-শুগার—সুস্বাস্থ্যের ছদ্মবেশে এখন এসবের প্রচারণা চালানো হয়। মানুষ বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে সোল সাইকেল ক্লাসে যায় ফিট থাকার জন্য, ক্যালোরি বার্ন করার জন্য না। জিয়া টলেন্টিনো তার ট্রিক মিরর বইয়ে লিখেছেন,  ‘এখনকার চকচকে ম্যাগাজিনগুলোও আগের মত আর  নারীর আদর্শ কোনো রূপের প্রচারণা চালায় না…কিন্তু একজন আদর্শ নারীর সেই পরজীবী ধারণা বর্তমান আপাত-বিরূপ আবহের মধ্যেও টিকে আছে।’ নারীবাদ ‘আদর্শ নারীর ধারণার দুঃশাসনকে নির্মূল করার পরিবর্তে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে।’ 

পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ধারণাটা ভ্রান্ত

ওজন বাড়ার সাথে সাথে যেহেতু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়, ফলে অনেকেই বলে থাকেন যে নারীর উপর ওজন কমানোর যে চাপ দেয়া হয় তা তেমন খারাপ কিছু না। কিন্তু এই যুক্তির ভিত্তি বেশ নড়বড়ে।
প্রথমত, মানুষের ওজন সবসময় তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। 

দ্বিতীয়ত, লজ্জা একটা কার্যকর হাতিয়ার। বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী একটু কম খেলে ও বেশি নড়াচড়া করলেই ওজন কমে যায়, ফলে এমনটা মনে করা স্বাভাবিক যে ওজন ও স্থূলতা সহজেই পরিবর্তনীয়। মনে হতে পারে চিকন মানুষেরা কষ্ট করে এই শারীরিক গঠন অর্জন করেছে ও মোটা ব্যক্তিরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনটা হলে নারীরা চাইলেই এই ওজন-বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারেন, সমাজ তাদের কাছে যেরকম শারীরিক গড়ন আশা করে সেটা মেনে নিলেই হয়।   

কিন্তু পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের এই ধারণাটাই ভুল। অনেকেরই অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট সেবন শুরু করার পরে ওজন বাড়তে শুরু করে; পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম জাতীয় সমস্যার কারণে নারীরা আরো বেশি মাত্রায় এসবের সম্মুখীন হন। গে বলেছিলেন যে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরবর্তীতে তার ওজন বেড়ে যায়। এছাড়াও প্রশ্ন জাগে ১৯৮০ সালের পর মানুষের খাদ্যাভ্যাস এভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল কেন? কেননা ১৯৮০ সাল থেকেই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্থূলতার হার অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে শুরু করে। বিজ্ঞানীরাও এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না (কেউ কেউ প্রক্রিয়াজাত খাবারের দিকে আঙুল তোলেন) কিন্তু তারা একমত যে নিজের ইচ্ছামত ওজন কমিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব—এবং এমনটা করতে পারাদের সংখ্যা খুবই কম। সে তুলনায় এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি যারা সারাজীবন ওজন কমানোর চেষ্টা করে যায়, তারপর ব্যর্থ হয়ে নিজেদেরকে দোষারোপ করতে থাকে।     

হয়তো চক্ষুলজ্জা কারো কারো জন্য কাজে দেয়। মিসেস গুইলিয়ানোর জন্য দিয়েছিল। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো বাবার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাকে এড়িয়ে যাওয়ার বদলে তিনি ওজন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে থাকলেন। তিনি বললেন, ‘কিন্তু, অবশ্যই, বাবা তো ঠিকই বলেছিলেন।’  

মূল্যটা ভীষণ চড়া 

ওজন বেড়ে যাওয়ার যে কলঙ্ক, লজ্জা বা ভয় মেয়েদের মধ্যে কাজ করে, তার বদলে মেয়েদেরকে যে খেসারত দিতে হয় সেটার কথাও ভাবুন। নারী হিসেবে এ দুনিয়ায় চলাফেরা করলে নারীদেরকে কী পরিমাণ সময় নিজেদের খাবারের হিসাব রাখায়, ডায়েটের বই পড়ায়, ব্যায়ামের ক্লাস করায় ব্যয় করে তা নজর এড়ানো প্রায় অসম্ভব। জীবনে যারা কখনো জুস ক্লেঞ্জ কিংবা বাধাকপির স্যুপের ডায়েট করেছেন তারা জানেন যে ওজন কমানোর এই প্রচেষ্টার কারণে মেয়েরা নিজেদের পছন্দের অন্য অনেক কাজই আর করতে পারে না, যেমন পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া কিংবা নিজেদের পছন্দের খাবার খাওয়া।   

কিছু জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ছয় বছর বয়সী মেয়েরাও নিজেদের উপর চিকন শরীর ধরে রাখার চাপ অনুভব করে থাকে। আর বয়ঃসন্ধিকাল পার করার সময় তারা ‘আচানক সৌন্দর্যের এক অবাস্তব প্রত্যাশার চাপে নাজেহাল হয়ে পড়ে, এবং ভাইরাসের মত তাদের মধ্যে ক্ষুধামান্দ্য কিংবা বুলিমিয়ার মত রোগ ছড়াতে থাকে,’  লিখেছেন মিসেস টোলেন্টিনো। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো এখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। বেশিরভাগ নারীই এসবের সাথে মানিয়ে নেন। কেউ কেউ মেনে নেন না। আর অনেকে স্রেফ ব্যর্থ হন। কিন্তু যে পথটাই তারা বেছে নিক না কেন, তার মূল্যটা ভীষণ চড়া।  

[লেখাটি দি একোনমিস্ট পত্রিকায় ২০ ডিসেম্বর ২০২২ এর ক্রিসমাস স্পেশাল সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিলোঃ দ্য ওয়েইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। ]      

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।