WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক


মিরেই গুইলিয়ানো পাতলা গড়নের সফল এক নারী। তার জন্ম ফ্রান্সে আর জাতিসঙ্ঘের হয়ে দোভাষী হিসেবে কাজ করার আগে তিনি প্যারিস থেকে পড়াশুনা শেষ করেন। তারপর কিছুদিন তিনি শ্যাম্পেনের ব্যবসায় ছিলেন। ১৯৮৪ সালে যোগদান করেন ভ্যুভ ক্লিকো’তে, যার কাজকর্ম সেসময় মোটেই খুব একটা আকর্ষণীয় ছিল না। কিন্তু তার সাহায্যে কোম্পানিটা উন্নতি লাভ করতে থাকে এবং একসময় আমেরিকায় একটা শাখাও খুলতে সক্ষম হয়। ১৯৯১ সালে তিনি এই কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর পদ গ্রহণ করেন ও ভীষণ সফলতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। ডাউনটাউন ম্যানহ্যাটানের দিক মুখ করা অ্যাপার্টমেন্টে বসে তিনি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে ঠাট্টা করে বলেন, ‘জানেনই তো আমি পানি কতটা ভালোবাসি।’ ঠিকই। ‘ফরাসি কায়দায়’ ওজন কমানোর ও পাতলা থাকার ব্যাপারে তার বেস্টসেলিং ফ্রেঞ্চ উইমেন ডোন্ট গেট ফ্যাট বইটাতে প্রধান বিধান হলো প্রচুর পানি খাওয়া।      

বইতে তিনি কিশোরী বয়সের নিজের অস্বস্তির কথা লেখেন। সেসময় গ্রীষ্মকালের ছুটি কাটাতে আমেরিকায় থাকাকালীন তার ওজন বেড়ে যায়। এই অস্বস্তি আরো বেড়ে যায় যখন আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে ফেরার পর তার বাবা ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরার বদলে, বলে ওঠেন তাকে দেখতে ‘একটা আলুর বস্তার মত লাগছে।’ এরপর তিনি নিজের খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি বদলে ফেলেন, নিজের পুরনো ফরাসি অভ্যাস আবার মনে করলেন (অনেক পানি, পরিমিত খাবার, নিয়মিত চলাচল) এবং সৌভাগ্যের কাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেন।       

সফল একজন নারী হিসেবে তিনি নিজের বাহ্যিক রূপ ও ওজন নিয়ে কথা বলেন। সে হিসেবে তিনি বেশ বিরল। তিনি বলেন, ‘কেউই এ বিষয়ে তেমন কথা বলতে চায় না। এর চেয়ে এই ভান করা অনেক সহজ যে এসব এমনি এমনিই হয়ে যায়।’ নারীবাদের একের পর এক তরঙ্গ স্মার্ট নারীদেরকে বলেছে যে তাদের উচিত এতদিনে আত্মগরিমা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করা—যেভাবে তারা গৃহকর্ম ও স্রেফ সন্তান উৎপাদন দ্বারা চিহ্নিত অস্তিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এসেছে।       

কিন্তু নিজের শরীর ও ওজনের ব্যাপারে মন্তব্যের কারণে গভীরভাবে বিচলিত হওয়ার ক্ষেত্রে নারী হিসেবে তিনি একা নন। ওজন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পডকাস্ট মেইন্টেনেন্স ফেজ এর সহ-উপস্থাপিকা অব্রে গর্ডনকে দশ বছর বয়সে এক ডাক্তার বলেছিল যে তার ওজন অতিরিক্ত বেশি। আমেরিকান লেখিকা  রোক্সেন গে বোর্ডিং স্কুল থেকে ফেরার পর আগের চেয়ে ৩০ পাউন্ড (প্রায় ১৪ কেজি) ওজন বেড়ে যাওয়ায় নিজের বাবা-মা’র হতবাক দশার কথা লিখেছিলেন।   

এই অভিজ্ঞতাগুলো গভীরভাবে ব্যক্তিগত, আবার একইসাথে ভীষণ সার্বজনীন, অন্তত উন্নত বিশ্বে। নারীদের উপর ‘আদর্শ’ এক রূপের যে ধারণা চাপিয়ে দেয়া হয় তারই প্রতিফলন ঘটে এতে। এই আদর্শ সময়ের সাথে বদলেছে অনেক। রেনেসাঁসের নগ্ন ছবিগুলোতে নারীর দেহে পর্যাপ্ত স্থূলতা ও ভাঁজ লক্ষ করা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পাতলা শরীরকেই আদর্শ বলে ধরে নেয়া হয়। টম উলফ-এর উপন্যাস বনফায়ার অফ দ্য ভ্যানিটিজ থেকে ধার করে ১৯৮০’র দশকে ‘সামাজিক এক্স-রে’ দিয়ে বোঝানো হতো সেইসব নারীদেরকে যারা এতটাই চিকন যেন তাদের গোটা অস্তিত্বই দ্বিমাত্রিক।  
    

৯০ এর দশকের লন্ডনে আবার এটাকে বলা হতো ‘হিরোইন শিক।’ আজকের দিনে আদর্শ শারীরিক গঠন হলো ‘উইজেল বড’, লস অ্যাঞ্জেলিনা জানান, যাকে সারাক্ষণ ঘেরাও করে রাখে নিখুঁত শরীরের জন্য মরিয়া নারীরা। এই নারীরা বেজির মত চিকন হতে চান, যেন কোনো আলোড়ন না তুলে পানির মধ্য দিয়েও তরতর করে চলে যেতে পারেন।  

নারীদের দেহের উপর যে বাড়তি গুরুত্ব চাপানো হয় তা সব নারীই একসময় বুঝে ফেলেন। যেনবা মেয়েরা অসচেতনভাবে একটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায় আর তারপর একসময় তাদেরকে গাছগুলো দেখানো হয়। তারপর তারা ভাবতে পারে গাছগুলো ওখানে এলো কী করে, কতদিন ধরে ওগুলো বড় হচ্ছে আর তাদের শিকড় ঠিক কত গভীর পর্যন্ত যায়। কিন্তু গাছগুলোর ব্যাপারে তাদের করার তেমন কিছুই নেই এবং দুনিয়াটা অন্য কোনোভাবে কল্পনা করাও প্রায় অসম্ভব। আর যদিও একটা গপ্পো প্রচলিত আছে যে চালাক ও উচ্চাশাসম্পন্ন নারীরা, যারা শ্রমবাজারে নিজেদের মেধা ও শিক্ষার মাধ্যমে অবদান রাখতে পারেন তাদের নিজেদের শরীরের ব্যাপারে অত সচেতন হওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু প্রমাণাদি ঘেটে দেখলে বোঝা যায় এমনটা বিশ্বাস করার তেমন কোনো ভিত্তি নেই। কেননা শরীরের ওজন তাদের আয় ও বেতনের উপরও প্রভাব ফেলে। দরিদ্র দেশগুলোতে, যেখানে গরীবদের চাইতে ধনীরাই ওজনে একটু ভারি, সেখানে এই সম্পর্কটা একটু অন্যরকমের। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি ও সাউথ করিয়ার মত ধনী এশিয়ান দেশগুলায় ধনীরা গরীবদের চেয়ে চিকন হয়। সাধারণত ওজনের বেশিরভাগ পরিমাপক, যেমন দেহের ভরের সূচক, অতিরিক্ত স্থূলতার নিয়ামক, অথবা মোট জনসংখ্যায় স্থূলতার হার ইত্যাদির সাথে আয় ও দারিদ্র্যহারের নিচে বাস করার মধ্যে একটা নিম্নমুখী সম্পর্ক থাকে। 

গরীবদের ওজন যে ধনীদের চাইতে বেশি হয় তার ব্যাখ্যা আগেও দেয়া হয়েছে এইভাবে যে উন্নত বিশ্বে স্থূলতা আদতে দারিদ্র্যের পরিচায়ক। দরিদ্র লোকেরা প্রায়সময়ই সুস্বাস্থ্যকর খাদ্য কিনে খেতে পারে না। তারা ফাস্ট ফুড অথবা প্রসেসড খাবার বেছে নেয় কারণ হয়তো বাসায় তারা খাবার রান্না করার সময় পায় না অথবা ব্যায়াম করার মতও পর্যাপ্ত সময় তাদের জোটে না, কেননা কম-বেতনের চাকরিগুলোতে সাধারণত অনেক লম্বা শিফট ধরে কাজ করতে হয় এবং ‘ল্যাপটপ শ্রেণীর’ লোকেদের চাকরিগুলোর তুলনায় সেগুলো অনেক কম ফ্লেক্সিবল। আবার যেহেতু বেশিরভাগ সময় শিক্ষার স্বল্পতার কারণেই মানুষ অল্প বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হয়, ফলে ধরে নেয়া যায় এই শিক্ষার অভাবের কারণেই তারা অনেকসময় জানেই না কীভাবে সুস্বাস্থ্য ধরে রাখা যায়। 

এতসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সমস্যা হলো উন্নত দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার আয় ও ওজনের এই দ্বিমুখী সম্পর্কের প্রায় পুরোটাই সচল রেখেছে নারীরা। আমেরিকা ও ইতালিতে আয় ও স্থূলতার সম্পর্কের ঢাল পুরুষদের ক্ষেত্রে সমতল ও নারীদের জন্য নিম্নমুখী। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই ঢাল পুরুষদের ক্ষেত্রে ও ঊর্ধ্বমুখী কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা এতটাই নিম্নমুখী যে দুইয়ে প্রায় কাটাকাটি হয়ে যায়। ফ্রান্সে আবার ঢালটা পুরুষদের জন্যও খানিকটা নিম্নমুখী, কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি। এরকমটা প্রায় সকল ধনী দেশেই দেখা যায় এবং ওজন কিংবা স্থূলতা মাপার যেকোনো পরিমাপকের ক্ষেত্রেই তা বহাল থাকে। 

ডাচেসের বিধান 

অন্যভাবে বললে, ধনী নারীরা গরিব নারীদের চাইতে অনেক চিকন কিন্তু বড়লোক পুরুষেরা আর গরিব পুরুষেরা প্রায় সমান মোটা। ওয়ালিস সিম্পসন, যাকে বিয়ে করার কারণে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডকে সিংহাসন ছাড়তে হয়, তিনি নাকি বলেছিলেন একজন নারী ‘যতই চিকন বা ধনী হোক না কেন তা পর্যাপ্ত নয়।’ এখন তিনি নিজে হয় দুটোই ছিলেন না হয় কোনোটাই না। যারা মনে করে স্থূলতার প্রধান কারণ দারিদ্র্য অথবা অনেক টাকা-পয়সা থাকলেই সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা যায় তারা এখানে একটু খটকায় পড়বেন। কেননা তাহলে ব্যাখ্যা করতে হবে এই সমীকরণ কেবল নারীদের ক্ষেত্রেই কেন কার্যকর। হয়তো উভয় লিঙ্গের জন্যই এই সমীকরণের ফলাফল একই হওয়ার কথা, কিন্তু তাদের পেশার কারণেই তারতম্য দেখা যায়। তুলনামূলকভাবে পুরুষরাই বেশির ভাগ কম-বেতনের ও কায়িক পরিশ্রমের চাকরিগুলোতে নিয়োজিত, যেমন নির্মাণকাজ (যদিও হাসপাতালের নার্সরাও প্রায় রাজমিস্ত্রীদের সমান হাঁটাচলা করেন ও দাঁড়িয়ে থাকেন, ও তাদের অধিকাংশই নারী।) অনেক সময় অভিনেত্রীদেরকে সিনেমার কাজ পাওয়ার জন্য এমনিতেই পাতলা শরীর ধরে রাখতে হয়।  

কিন্তু তবুও এত বিশাল ফারাক ব্যাখ্যা করার জন্য এটাও পর্যাপ্ত বলে মনে হয় না। আমেরিকার শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে মোট জনসংখ্যার কেবল ৩.৫% লোক প্রচণ্ড মাত্রার কায়িক শ্রমে নিয়োজিত (এবং সেসব পেশার অনেকগুলোতেই নারীরা বহুলাংশে রয়েছেন, যেমন নাচ কিংবা ব্যায়ামের প্রশিক্ষক।) কেবল ০.১% মানুষ অভিনয়ের মত পেশার সাথে যুক্ত। আয় ও ওজনের দ্বিমুখী সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে একটি লৈঙ্গিক ফারাক রয়েছে, এবং তা নারী ও পুরুষের মধ্যকার অন্যান্য পার্থক্য দিয়ে ব্যাখ্যাও করা যাচ্ছে না, সুতরাং পুরো ব্যাপারটা অন্য এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়: হয়তো চিকন হওয়া নারীদের জন্য ধনী হওয়ার পথ সহজ করে দেয়।  

অসংখ্য গবেষণায় পাওয়া গেছে যে স্থূল নারীরা তাদের চিকন সহকর্মিনীদের তুলনায় কম বেতন পান। অপরদিকে স্থূলকায় পুরুষ ও ‘স্বাভাবিক’ ওজনের পুরুষদের বেতনের মাত্রার মধ্যে তেমন কোনো তারতম্য নেই। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে: একটা সুইডিশ গবেষণাপত্র অনুযায়ী, দেখা গেছে যে স্থূলকায় পুরুষরাই কম বেতন পায়, নারীরা না। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা ও ডেনমার্কের গবেষণা হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে, স্থূল নারীরাই বেতন কম পায়। একজন নারীকে মোটা হওয়ার বেশ ভালোই মূল্য চোকাতে হয়, এতে তার বেতনের প্রায় ১০% কাটা পড়ে। 

স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যও বেড়েছে  

দেহের মাপের জন্য যাকে কোনোদিন কোনো চাকরি দেয়া হয়নি তার জন্য আয়ের এই ফারাকটা আঁচ করা অনেক কঠিন হবে। কেবল শরীরের গড়ন পাতলা হওয়ার কারণে একজন নারী এত বেশি বেতন পেতে পারেন যে, তার জন্য আরো বেশি পড়াশুনা করার চাইতে ওজন কমানোতে মনোযোগ দেয়াই বেশি লাভজনক হবে। একটা মাস্টার্স ডিগ্রি একজনের বেতনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে ১৮%। একজন নারী কেবল ৬৫ পাউন্ড ওজন কমানোর মাধ্যমে এর ১.৮ ভাগ বেতন বৃদ্ধি করাতে পারেন। শ্বেতাঙ্গ নারীদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি ঘটে—কৃষ্ণাঙ্গ কিংবা হিসপ্যানিক নারীদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটার নজির তুলনামূলক অনেক কম (যদিও এর কারণ হতে পারে যে গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত বিএমআই মাপা হয়, এবং সে ক্ষেত্রে এইসব নারীদেরকে প্রায়ই ভুলভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়।) 

মোটা নারীর সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য মোটেই কমেনি। অর্থনীতিবিদ ডেভিড লেম্পার্ট লিখেছিলেন, ‘স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমরা আশা করতে পারি তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য কমে আসবে। কেননা আজকের দিনে ওজন বেড়ে যাওয়া বেশ স্বাভাবিক। অথচ বর্তমানে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যও বেড়েছে। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে এর মাত্রা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তার মতে এর কারণ হলো, ‘পাতলা দেহ বর্তমানে আরো বিরল হয়ে পড়ার কারণে সেটাকেই প্রিমিয়াম মনে করা হয়।’   

এই গবেষণাপত্র যে উপসংহারের দিকে ইঙ্গিত দেয় তাতে ক্রুদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। স্থূলকায় নারীদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গোটা জীবন ধরে চাপিয়ে দেয়া আয়ের বৈষম্য তাদেরকে জেঁকে ধরে। তাদের শুরুর বেতনও হয় অনেক অল্প, এবং গোটা কেরিয়ারে পদোন্নতি পান তারা অনেক কম। তার গবেষণা অনুযায়ী, ‘১৯৮১ সালে এক ২০ বছর বয়সী নারীর তুলনায় ২০০৪ সালে এক ৪৩ বছর বয়সী স্থূলকায় নারী বেতনের ক্ষেত্রে অধিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।’   


তাছাড়া স্থূলকায় কর্মচারীরা যে মালিকদের অধিক খরচার কারণ হয় তার আংশিক প্রতিফলনও এখানে ঘটে। বিশেষ করে আমেরিকায় এমনটা বেশি ঘটে। হেলথ ইন্স্যুরেন্সের খরচ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তারাই বহন করেন। আর স্থূলকায় মানুষদের পিছনে এ ক্ষেত্রে বেশি খরচ হয়, কেননা বয়স বাড়ার সাথে সাথে এরা বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগতে থাকেন।  


তবু, এসবের ভার কেবল নারীদের উপরই কেন চাপিয়ে দেয়া হবে তা অস্পষ্টই থেকে যায়। এবং কানাডা ও ইউরোপ, যেখানে হেলথ-কেয়ারের খরচ সরকার বহন করে, সেখানেও নারীদের ক্ষেত্রে একইরকম আয়গত ঘাটতি লক্ষ করা যায়।   

স্থূলতার কারণে আয়ের বৈষম্য যে বাড়ছে বই কমছে না—তার প্রমাণ পাওয়া যায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত ‘অন্তর্গত পক্ষপাত’ পরীক্ষার মাধ্যমে। পরীক্ষার্থীদের এখানে বলা হয় বিভিন্ন মানুষের জাতি, লিঙ্গ, সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশান কিংবা ওজনের উপর ভিত্তি করে তাদেরকে ভালো কিংবা খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করতে। এবং এ ক্ষেত্রে ফলাফল বেশ ইতিবাচক দিকেই মোড় নিচ্ছে। জাতিগত ও লৈঙ্গিক বৈষম্য গত এক দশকে বেশ কমে এসেছে। সমকামীদের প্রতি বিরূপ মনোভাবও এক তৃতীয়াংশ কমেছে। কিন্তু ওজনের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। শারীরিকভাবে ভারী মানুষের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব আগের চেয়ে বেড়েছে।    

এই প্রেক্ষাপটে নারীরা ওজন কমানোর জন্য এত চাপ ও নিজের ওজন নিয়ে এতটা হীনমন্য কেন বোধ করে তার পিছনের অন্যসব কারণ ও ব্যাখ্যাগুলো বেশ অসম্পূর্ণ মনে হয়। হয়তো নারীরা নিজেদের শরীর নিয়ে এত হীনমন্য  বোধ করে কারণ সারাক্ষণ তারা ম্যাগাজিনের তন্বী মডেলদের দেখে ভাবে সেগুলো একদম এডিটেড না এবং নিজেদের সাথে তুলনা করে। কিংবা হয়তো কোনো ডাক্তার অথবা বাবা-মা ছোটবেলায় তাদের শরীর নিয়ে কোনো মন্তব্য করেছিল। বর্তমান বাজারের এসব চাপের পাশাপাশি: নারীরা হয়তো মনে করে যে ওজন কমাতে না পারলে তাদেরকে তার খেসারত দিতে হবে। আর সেটা সত্য।   

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, পড়াশুনায় সময় দেয়া বুদ্ধিমান কাজ কেননা শ্রমবাজারে তার স্পষ্ট লাভ পাওয়া যায়। একইভাবে একজন নারীর জন্য ওজন কমাতে চাওয়াও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। কোন খাবার কতটুকু খেতে হবে এই নিয়ে মাথা ঘামানো ও ব্যয়বহুল ব্যায়ামের পিছনে টাকা খরচ করা আসলে এক প্রকার বিনিয়োগ পরবর্তীতে যার রিটার্ন পাওয়া যায়। পুরুষদের জন্য এমনটা হয় না।        

অলংঙ্করণঃ ঈহা

নারীরাও এই ব্যাপারে বেশ সচেতন। এক প্রজন্ম আগেও এ ব্যাপারটাকে তারা তেমন আমলে নিত না। ‘চাকরির পরে—কিংবা এর মধ্যেই সবচেয়ে মৌলিক যে বিষয়টা সামলাতে হবে তা হলো নিজেকে দেখতে কেমন লাগছে ও কেমন বোধ হচ্ছে। একজন নারী যে সবকিছু পেতে চায়, সে মোটা হয়ে থাকতে চাইবে তা ভাবাই যায় না’,  নিজের বই হ্যাভিং ইট অল-এ লিখেছিলেন ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে কসমোপলিটান ম্যাগাজিনের সম্পাদক হেলেন গার্লি-ব্রাউন। এই বইতে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন কীভাবে দিনে ৮০০ ক্যালোরির খাবার খেয়ে টিকে থাকতে হবে, এবং  নারীদেরকে উপদেশ দিয়েছেন প্রতিদিন নিজেদের ওজন মেপে দেখতে ও মেনে নিতে যে ‘ডায়েট করা একদম জাহান্নাম, এবং এই নিয়ে এত মন খারাপ করার কিছু নেই!’   

আজ থেকে চার দশক আগে এরকম মনোভাব বেশ গ্রহণযোগ্য ছিল। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা খুব একটা বদলেছে বলে মনে হয় না। বদলেছে শুধু বয়ানটা, যা এখন সকল প্রকার শারীরিক গঠনের প্রতি সহিষ্ণু হয়েছে এবং ডায়েট করাকে নাকচ করেছে। সাউথ-বীচ ডায়েট কিংবা অ্যাটকিন্স খাদ্য বাতিলকরণের বদলে এখন বলা হয় গ্লুটেন-মুক্ত, ভিগান, লো-শুগার—সুস্বাস্থ্যের ছদ্মবেশে এখন এসবের প্রচারণা চালানো হয়। মানুষ বিশাল অঙ্কের টাকা খরচ করে সোল সাইকেল ক্লাসে যায় ফিট থাকার জন্য, ক্যালোরি বার্ন করার জন্য না। জিয়া টলেন্টিনো তার ট্রিক মিরর বইয়ে লিখেছেন,  ‘এখনকার চকচকে ম্যাগাজিনগুলোও আগের মত আর  নারীর আদর্শ কোনো রূপের প্রচারণা চালায় না…কিন্তু একজন আদর্শ নারীর সেই পরজীবী ধারণা বর্তমান আপাত-বিরূপ আবহের মধ্যেও টিকে আছে।’ নারীবাদ ‘আদর্শ নারীর ধারণার দুঃশাসনকে নির্মূল করার পরিবর্তে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে।’ 

পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের ধারণাটা ভ্রান্ত

ওজন বাড়ার সাথে সাথে যেহেতু স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়, ফলে অনেকেই বলে থাকেন যে নারীর উপর ওজন কমানোর যে চাপ দেয়া হয় তা তেমন খারাপ কিছু না। কিন্তু এই যুক্তির ভিত্তি বেশ নড়বড়ে।
প্রথমত, মানুষের ওজন সবসময় তার নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। 

দ্বিতীয়ত, লজ্জা একটা কার্যকর হাতিয়ার। বেশিরভাগ মানুষের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী একটু কম খেলে ও বেশি নড়াচড়া করলেই ওজন কমে যায়, ফলে এমনটা মনে করা স্বাভাবিক যে ওজন ও স্থূলতা সহজেই পরিবর্তনীয়। মনে হতে পারে চিকন মানুষেরা কষ্ট করে এই শারীরিক গঠন অর্জন করেছে ও মোটা ব্যক্তিরা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনটা হলে নারীরা চাইলেই এই ওজন-বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারেন, সমাজ তাদের কাছে যেরকম শারীরিক গড়ন আশা করে সেটা মেনে নিলেই হয়।   

কিন্তু পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণের এই ধারণাটাই ভুল। অনেকেরই অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট সেবন শুরু করার পরে ওজন বাড়তে শুরু করে; পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিন্ড্রোম জাতীয় সমস্যার কারণে নারীরা আরো বেশি মাত্রায় এসবের সম্মুখীন হন। গে বলেছিলেন যে যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরবর্তীতে তার ওজন বেড়ে যায়। এছাড়াও প্রশ্ন জাগে ১৯৮০ সালের পর মানুষের খাদ্যাভ্যাস এভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল কেন? কেননা ১৯৮০ সাল থেকেই উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্থূলতার হার অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে শুরু করে। বিজ্ঞানীরাও এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না (কেউ কেউ প্রক্রিয়াজাত খাবারের দিকে আঙুল তোলেন) কিন্তু তারা একমত যে নিজের ইচ্ছামত ওজন কমিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব—এবং এমনটা করতে পারাদের সংখ্যা খুবই কম। সে তুলনায় এমন মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি যারা সারাজীবন ওজন কমানোর চেষ্টা করে যায়, তারপর ব্যর্থ হয়ে নিজেদেরকে দোষারোপ করতে থাকে।     

হয়তো চক্ষুলজ্জা কারো কারো জন্য কাজে দেয়। মিসেস গুইলিয়ানোর জন্য দিয়েছিল। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হলো বাবার মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাকে এড়িয়ে যাওয়ার বদলে তিনি ওজন কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, কিছুক্ষণ তিনি চুপ করে থাকলেন। তিনি বললেন, ‘কিন্তু, অবশ্যই, বাবা তো ঠিকই বলেছিলেন।’  

মূল্যটা ভীষণ চড়া 

ওজন বেড়ে যাওয়ার যে কলঙ্ক, লজ্জা বা ভয় মেয়েদের মধ্যে কাজ করে, তার বদলে মেয়েদেরকে যে খেসারত দিতে হয় সেটার কথাও ভাবুন। নারী হিসেবে এ দুনিয়ায় চলাফেরা করলে নারীদেরকে কী পরিমাণ সময় নিজেদের খাবারের হিসাব রাখায়, ডায়েটের বই পড়ায়, ব্যায়ামের ক্লাস করায় ব্যয় করে তা নজর এড়ানো প্রায় অসম্ভব। জীবনে যারা কখনো জুস ক্লেঞ্জ কিংবা বাধাকপির স্যুপের ডায়েট করেছেন তারা জানেন যে ওজন কমানোর এই প্রচেষ্টার কারণে মেয়েরা নিজেদের পছন্দের অন্য অনেক কাজই আর করতে পারে না, যেমন পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়া কিংবা নিজেদের পছন্দের খাবার খাওয়া।   

কিছু জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ছয় বছর বয়সী মেয়েরাও নিজেদের উপর চিকন শরীর ধরে রাখার চাপ অনুভব করে থাকে। আর বয়ঃসন্ধিকাল পার করার সময় তারা ‘আচানক সৌন্দর্যের এক অবাস্তব প্রত্যাশার চাপে নাজেহাল হয়ে পড়ে, এবং ভাইরাসের মত তাদের মধ্যে ক্ষুধামান্দ্য কিংবা বুলিমিয়ার মত রোগ ছড়াতে থাকে,’  লিখেছেন মিসেস টোলেন্টিনো। আর সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো এখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। বেশিরভাগ নারীই এসবের সাথে মানিয়ে নেন। কেউ কেউ মেনে নেন না। আর অনেকে স্রেফ ব্যর্থ হন। কিন্তু যে পথটাই তারা বেছে নিক না কেন, তার মূল্যটা ভীষণ চড়া।  

[লেখাটি দি একোনমিস্ট পত্রিকায় ২০ ডিসেম্বর ২০২২ এর ক্রিসমাস স্পেশাল সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিলোঃ দ্য ওয়েইট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। ]      

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।