কমলা ভাসিন–এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-২ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

এটা কি সত্যি যে, নারীবাদীরা পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়?

প্রশ্নটি নারীবাদ সম্পর্কে সামগ্রিক ভুল বোঝাবুঝিকেই তুলে ধরে অথবা এটি নারীবাদকে কলঙ্কিত করার একটি প্রয়াস। আপনি কি এমন কোনও নারীবাদীর কথা শুনেছেন যিনি বলেছেন অথবা লিখেছেন যে তিনি পুরুষতন্ত্রের বদলে মাতৃতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান? যদি আপনি এমন উক্তি স্মরণ করতে না পারেন, তবে নারী-পুরুষ সমতা মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে আপনার নিজস্ব অক্ষমতা থেকে সম্ভবত এই প্রশ্ন উদ্ভুত হয়। 

এতে প্রতীয়মান হয় যে, কিছু মানুষ শুধুমাত্র ক্ষমতার ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করতে পারেন না। 

নারীবাদীদের অবস্থান, দাসত্ব, ক্ষমতার স্তরবিন্যাস এবং সকল প্রকার অসমতার বিরুদ্ধে এবং তার স্বাধীনতা, সমতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। 

বলা হয়ে থাকে, যখন কোনও নারী পুরুষের মতো হয়,  তখন সে হয় একটি ডাইনি, কিন্তু একজন পুরুষ যখন নারীসুলভ গুণ অর্জন করে তখন সে হয় একজন সাধু। তাহলে কেন নারীবাদীরা পুরুষের মতো হতে চায়? 

প্রথমত, আমরা বিশ্বাস করি না বা স্বীকার করি না যে, পুরুষদের এক ধরণের বৈশিষ্ট্য আছে বা থাকা উচিত এবং নারীদের আরেক ধরণের আরেক ধরণের। আমরা বিশ্বাস করি যে, পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই তথাকথিত ‘পুরুষসুলভ’ গুণ (শক্তি, সাহসিকতা, নির্ভীকতা, কর্তৃত্ব, প্রতিযোগিতার মনোভাব ইত্যাদি) এবং তথাকথিত ‘নারীসুলভ’ গুণ (যত্ন, সেবা ভালোবাসা, ভীরুতা, বশ্যতা ইত্যাদি) থাকতে পারে বা বিকাশ লাভ করতে পারে। এই সবই মানবীয় গুণ পুরুষের জন্য আর কিছু নারীদের জন্য আলাদাভাবে ধার্য করে দেয়। এটি চাপিয়ে দেয়া গুণাবলিরই ফলাফল যা প্রভাবশালী, অসহিষ্ণু, আক্রমণকারী পুরুষ ও অনুগত, মেরুদণ্ডহীন, ভীতু নারী তৈরিতে প্রণোদনা দেয়। আমরা চাই যে, মেয়ে এবং ছেলে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই ইতিবাচক ‘পুরুষসুলভ’ এবং ‘নারীসুলভ’ গুণাবলি পরিহার করে তাদের সামর্থ্যের  বিকাশ ঘটাতে পারবে। 

আমাদের প্রত্যেকেরই মধ্যেই নারী এবং পুরুষ উভয় গুণাবলি আছে এবং উভয় গুণাবলির অনুশীলন প্রয়োজন। 

নারীবাদীরা কখনও পুরুষদের নেতিবাচক গুণাবলি এবং বৈশিষ্ট্যাবলি গ্রহণ করতে আগ্রহী নয়। এই পৃথিবী ইতোমধ্যেই পুরুষদের হিংস্রতা এবং আক্রমণে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এবং এর জন্য অতিরিক্ত উৎপীড়নের প্রয়োজন নেই।  আসলে, আমরা বরং চাই যে পুরুষরাও আরও বেশি নারীদের মতো হয়ে উঠুক, অর্থাৎ তারা সন্তানদের এবং বৃদ্ধদের দেখাশোনা ও যত্ন করবে, সংসার পরিচালনা করবে ইত্যাদি। এর ফলে পুরুষরা আরও ভদ্র, অনুভুতিপ্রবণ এবং হৃদয়বান হয়ে উঠবে এবং নারীদের অনেক কাজের ভার লাঘব হবে। 

যদিও সাহসিকতা, নির্ভীকতা, যৌক্তিকতা, দক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলি পুরুষের বলে বিবেচিত হয়, তথাপি নারীদের অবশ্যই এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জন এবং অনুশীলন করা উচিত। 

নারীবাদীরা কি পুরুষবিদ্বেষী?

নারীবাদীরা পুরুষদের ঘৃণা করে না। তারা পিতৃতন্ত্র, পুরুষের আধিপত্য এবং পুরুষের মধ্যকার পুরুষালি আচরণের বিরুদ্ধে। যেসব নারী পুরুষের আধিপত্য, আক্রমণ ও হিংস্রতাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করে, নারীবাদীরা তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। নারীবাদীরা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং আদর্শের বিরোধী। এই আদর্শ ও ব্যবস্থা পুরুষকে উৎকৃষ্ট বলে বিবেচনা করে এবং তাদেরকে অধিক অধিকার ও সুযোগ প্রদান করে। 

সকল ব্যবস্থা ও নিয়মকানুন মানুষই টিকিয়ে রাখে। কোনও নিয়ম বা ব্যবস্থা কখনও কখনও নারীকে ধর্ষণ অথবা নির্যাতন করে না, করে একজন পুরুষ। নিয়ম কোনও দিন কন্যাসন্তানকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে না, করে একজন পিতা। 

সুতরাং, আমরা সেই সব পুরুষের বিরুদ্ধে, যারা নারীদের নিজেদের সমান বলে স্বীকার করে না, যারা নারীদের নিজেদের সম্পত্তি বলে গণ্য করে এবং পণ্য বলে বিবেচনা করে। 

দুর্ভাগ্যবশত অনেক পুরুষই আধিপত্য বিস্তারকারী এবং তাদের ভিতরে এ ধরণের গুণাবলি রয়েছে। এমনকি অনেক অতি উৎসাহী গণতান্ত্রিক এবং সমাজবাদী পুরুষের ক্ষেত্রেও এ তথ্য সত্য। তারা সমাজে সাম্যের বানী প্রচার করে অথচ বাড়িতে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেই সাম্য অনুশীলন করে না।

আমরা অবশ্য বিশ্বাস করি, নারী যেমন প্রাকৃতিকভাবেই যত্নশীল এবং সেবাপরায়ণ নয়, পুরুষও তেমনি প্রকৃতিগতভাবেই আক্রমণাত্মক এবং আধিপত্য বিস্তারকারী নয়। তারা আসলে শিশুকালের শিক্ষাদীক্ষা পদ্ধতি এবং সামাজিক অবস্থার শিকার। যার ফলে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত ভাবমূর্তির ফাঁদে তারা আটকে আছে।  

আমাদের সমস্যা হলো যে অধিকাংশ পুরুষ এই বিষয়টি স্বীকার করে না এবং খুব অল্পসংখ্যক পুরুষই এই ব্যাপার থেকে নিজেকে মুক্ত করে মানবিক এবং প্রকৃত গণতান্ত্রিক হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে। তাছাড়া, কিছু পুরুষ নারীদের দ্বারা প্রস্তাবিত যে কোনও পরিবর্তনের বিরোধী। 

যে নারীরা পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে, সমর্থন করে অথবা ঠিক বলে মনে করে তাদেরকেও নারীবাদীরা যথেষ্ট সমালোচনা করে। অন্যভাবে বলা যায়, যারা স্বৈরতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, আক্রমণাত্মক, তাদেরকেও নারীবাদীরা সমালোচনা করে। আমাদের অনেকেই ম্যাডেলিন অলব্রাইটের মতো নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। 

জেন্ডার সমতার ইস্যুটি নারী এবং পুরুষের মধ্যকার বিরোধ নিয়ে নয়। বরং যারা নারী-পুরুষের সমতায় বিশ্বাস করে এবং সমতা চায় এবং যারা তা চায় না বরং পুরুষের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়, তাদের মধ্যকার বিরোধ।

আমরা সবাই জানি যে, এই উভয় শিবিরে পুরুষ ও নারী আছে। অনেক পুরুষই আজকাল তাদের পুরুষত্ব, তাদের অধিকার এবং আচরণের নমুনা পরীক্ষা করে দেখছে। এই প্রথমবারের মতো পুরুষের বিভিন্ন গুণাবলি, পুরুষের শক্তি, পুরুষের যৌনশক্তি, পুরুষের জ্ঞানপদ্ধতি, পুরুষের যুদ্ধকৌশল, পরীক্ষা নিরীক্ষার সম্মুখীন এবং পরীক্ষাকারীদের মধ্যে পুরুষ এবং নারী উভয়ই আছে। সুতরাং নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের জন্য লড়াই করাটা নারী ও পুরুষের মধ্যে যুদ্ধ, এই রকম চিন্তা করাটা ভুল।

এ লড়াইটি হচ্ছে দুটি মতাদর্শ ও বিশ্বাসের মধ্যে। এর দিকে রয়েছে যারা নারী-পুরুষের বৈষম্য ও উপর নিচের ধারণাকে বাতিল করে সমতা, ন্যায়বিচার, উঁচু-নিচু ধাপমুক্ত সমাজ গড়তে চায়, অন্যদিকে রয়েছে যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।

এটা অস্বীকার করা যায় না যে, পুরুষ এবং নারীর মধ্যে কিছু মেরুকরণ এবং স্বার্থগত দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব অবশ্যই এই জন্য নয় যে, তারা কেউ পুরুষ এবং কেউ নারী। বরং এর পেছনে কারণটি হলো নারী-পুরুষভিত্তিক শ্রমবিভাজন যা তাদের উপর চাপানো হয়েছে এবং যা বিভিন্ন দায়িত্ব ও তার পথ ধরে ভিন্ন ভিন্ন অধিকার ও চাহিদার সৃষ্টি করেছে। এই মেরুকরণ এবং দ্বন্দ্ব অবশ্যই স্বীকার করতে হবে এবং তার নিরসনে কাজ করতে হবে। 

এই সবকিছুই মনে হয় যুক্তিপূর্ণ। তবে নারীবাদকে এত ভয় কেন? কেন একে হাস্যকর এবং ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়? কেন এটা এত বিরোধিতার মুখোমুখি হয়? 

এটা সত্য যে, অনেকেই নারীবাদের বিরুদ্ধে যাবতীয় গুজবকে বিশ্বাস করতে ও নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারকে সমর্থন করতে খুবই আগ্রহী। তারা নারীবাদীদের সমালোচনা এবং উপহাস করতেও খুব পছন্দ করে। এর কারণ, নারীবাদ সম্বন্ধে তাদের একটা নিজস্ব অস্বস্তি রয়েছে। সময় সময় এই অস্বস্তি হাস্যকর কৌতুক হিসেবে প্রকাশ পায় (তুমি কি সেই ব্রা পোড়ানোদের দলের কেউ হা হা হা), কখনও কখনও ভয় ( শোনো, আমার স্ত্রীর কাছে খুব বেশি সময় থেকো না। আমি ঘরে কোনো নারীবাদ চাই না।)। কখনও কখনও এরা নারীবাদীদের সরাসরি আক্রমণ করে বসে। 

আবার কোনও নারীবাদীর ব্যক্তিগত দূর্বলতা এবং ভুলগুলোকে ‘নারীবাদের দোষ’ হিসেবে দেখা হয়। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি একজন নারীবাদী ধূমপান করে অথবা মদ্যপান করে, তবে তার জন্য নারীবাদকেই দোষারোপ করা হয় না। লোকেরা শ্রমজীবী শ্রেণির নারীদের ধূমপানকে দোষ মনে করে না। অনেকে মনে হয় এটাও ভুলে যায় যে, যেসব নারীরা নারীবাদকে অনুসরণ করে বং সমর্থন করে তারাও মানুষ এবং এই কারণে তারাও ধূমপান করতে পারে, মদ্যপান করতে পারে, রেগে যেতে পারে, অযৌক্তিক আচরণ করতে পারে, বাচ্চাদের অবহেলা করতে পারে ইত্যাদি।  

আমাদের দুর্বলতা এবং ভুলের জন্য নারীবাদ দায়ী নয়। আমরা নারীরা মানুষের অধিকার চাই। আমাদের দুর্বলতা এবং ভুল কাজের দায়িত্ব স্বীকার করি। 

অনেক কর্মজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী ধূমপান করে, তাদের পছন্দমতো জামাকাপড় পরে, তাদের পছন্দমতো কেশবিন্যাস করে। যার মাধ্যমে তারা নারীবাদী চিন্তা-চেতনার চেয়ে তাদের স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীনতার চিহ্নকেই ফুটিয়ে তোলে বেশি। আসলে, এইসব ‘সাহসী’ নারীদের অনেকেই হয়তো নারীবাদী হিসেবে পরিচিত হতে চায় না। নারীবাদকে যে অনেকেই হুমকি বলে মনে করে তা মোটেই বিস্ময়কর নয়। তারা সততার সঙ্গেই বলে, ‘তোমরা জানো যে, আমরা নারীর কল্যাণ বা এই ধরণের কোনও কিছুর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু এই নারীবাদ আসলেই একটা সমস্যা।’ 

এর বিভিন্ন কারণ আছে। সব ধর্মের নেটারাই নারীবাদীদেরকে অপছন্দ করে। তার কারণ, নারীবাদীরা সব সময় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও নারীবিরোধী ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন ও ঐতিহ্যের সমালোচনা করে থাকে। কোনও কোনও সময় ধর্মীয় নেতাদের ক্রোধ এত তীব্র হয়ে যায় যে, তারা বলিষ্ঠ নারীবাদীদের মৃত্যুদন্ডের চেয়ে কম কোনও শাস্তি প্রদানের দাবি ওঠে এবং পাকিস্তানে নারীবাদীদের এবং মানবাধিকার আইনবিদ ও কর্মীদের বিরুদ্ধে অবিরত হুমকি দেয়া হয়। 

অনুরুপভাবে, অনেক দেশেই ক্যাথলিক চার্চগুলো সেইসব নারীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছে যারা তাদের সন্তান জন্মদান এবং নিজ শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থী খ্রিষ্টানরা গর্ভপাতের বিরোধিতা করে। তারা শুধু যারা গর্ভপাত করছেন সেই সকল নারীর বিরুদ্ধেই হিংস্র হচ্ছে না, বরং তারা সেই সব ডাক্তারকেও হত্যা করছে যারা নারীদের গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। ডানপন্থী ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা নারীবাদীদের পরিবারবিরোধী, ঐতিহ্যবিরোধী এবং ধর্মবিরোধী বলে অভিযুক্ত করছে। 

দক্ষিণ এশিয়ায় ধর্মীয় নেতারা নারীবাদীদের দ্বারা আনীত প্রগতিশীল পারিবারিক আইনের তীব্র বিরোধিতা করছে। পুঁজিবাদী পুরুষরাও বিশেষভাবে নারীবাদের বিরোধী। কারণ, তারা জানে যদি নারীরা সচেতন হয় তবে তারা ক্রেতা হিসাবে আর চালাকির শিকার হতে চাইবে না,  এবং অল্প মজুরি, নিচু মানের কাজ আর গ্রহণ করবে না। 

বর্তমানে তারা সেই ধরণের কাজগুলোর মাঝেই অবরুদ্ধ হয়ে আছে। তারা ওই সকল নারীবাদীদের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন যারা পর্নোগ্রাফি (যা নারীদের যৌন বস্তুতে পরিণত করে তোলে), প্রসাধনী শিল্প (যা সৌন্দর্য্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করে), শিশুখাদ্য (যা বিপুল পরিমাণ শিশুমৃত্যুর কারণ), জন্ম নিবারক (যা তৃতীয় বিশ্বের নারীদের গিনিপিগ হিসাবে গণ্য করছে এবং অনিরাপদ জন্ম নিবারণ পদ্ধতি সরবরাহ করছে), ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে। এ সকল ইন্ডাস্ট্রিতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে, এগুলোর মালিকদের আয়ত্তে আছে প্রচুর সম্পদ যার দ্বারা তারা তাদের অসৎ অভিসন্ধির বিরুদ্ধে যে কোনও চ্যালেঞ্জ বা হুমকি নস্যাৎ করে দিতে সমর্থ। 

সামরিক প্রতিষ্ঠানও নারীবাদীদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। নারীবাদীরা বেশিরভাগই যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তি আন্দোলনের পুরোভাগে আছেন। 

প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত ব্যক্তিরাও নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করেন। কারণ, নারীবাদী পন্ডিতরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মানুবর্তিতা এবং রীতি-নীতির ক্ষেত্রে যে পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতিত্ব বিরাজমান সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সদস্যরাও এইসব প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে নারীদের প্রতি যে আচরণ করা হয় সে সম্পর্কে নারীবাদীরা যে প্রশ্ন করে থাকে তা অপছন্দ করে। 

আর একটি কারনে সাধারণ মানুশ নারীবাদীদের ব্যাপারে অস্বস্তিবোধ করে। তার কারণ সম্ভবত এই যে, এই একটিমাত্র মতাদর্শ ঘরের পবিত্রতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আমাদের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে, আমাদের একান্ত বিশ্বাস, আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আচরণের ধরণগুলো সম্পর্কে, এমনকি আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছে। এ কারণেই নারীবাদ হুমকি হিসেবে গণ্য হয়। 

একবার যখন নারীরা পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্যের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে তখন আমরা অনিবার্যভাবেই আমাদের নিজেদের বাবা, ভাই, স্বামী, পুত্র এবং বন্ধুদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরি। কেননা এ সেই পুরুষ যারা পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের জন্য মূর্ত করে তুলেছে। 

সমাজের প্রতিটি স্তরে আন্তঃব্যক্তিক ও পারিবারিক সম্পর্ক এবং উভয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান সামাজিক স্থিতাবস্থাকে নারীবাদ চ্যালেঞ্জ করে। 

পুরুষতান্ত্রিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ পুরুষদের জন্যই শুধু বেদনাদায়ক নয় বরং ওই সকল নারীদের জন্যেও বেদনাদায়ক যারা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তাদের জন্যও বেদনাদায়ক যাদের কাছে সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষা করা অধিক প্রয়োজনীয়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নারীরাই কেবল লাভবান হতে পারে। কারণ, ‘তাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই’’। নারীবাদীরা যে নতুন সমাজ গঠন করতে চায়, তা করতে অনেক পুরুশ এগিয়ে আসতে পারে। তবে তাদের অনেকেই দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ পরিহার করতে ইচ্ছুক নয়। 

অনেক সময় আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, পুরুষতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করা ঠিক কিনা? এটি আসলেই গুরুত্বপূর্ণ কিনা? আমরা যদি সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের গৃহে, কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজে সংঘটিত অতিসূক্ষ্ম লিঙ্গ বৈষম্যগুলোর মুখোমুখি হই তবে আমরা কষ্টদায়ক পরিস্থিতি এড়াতে পারবো কিনা? 

আমাদের স্বামীরা যখন আমাদের শ্রমের ফলে লাভবান হয় অথবা যখন তাদের কাজ বা পেশা আমাদের কাজ বা পেশার চাইতে অগ্রাধিকার পায়, তখন আমরা কী করি? 

একজন মেয়ে শিশু যখন দেখে যে, তার ভাইকে বেশি খাবার দেয়া হয়, স্কুলে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং অন্য যে কোনও বিষয়ে তাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়, তখন সে কী করে? যখন একজন কন্যা সন্তান পারিবারিক সম্পত্তিতে ভাগ পায় না অথবা একজন পুত্র যখন একজন পুরুষ হিসেবে মায়ের উপর তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়, তখন কী ঘটে সেই কন্যা বা সেই মায়ের? 

আমাদের নিয়ে যখন ঠাট্টা মশকরা করা হয়, আমরা যখন অপমানিত হই এবং আমাদের উপর নির্যাতন করা হয়, তখন আমরা কী করি? 

যদি এই ধরণের আচরণের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিবাদের ইঙ্গিতও হুমকি হিসাবে দেখা হয়, তা আশ্চর্যের কিছু নয়। কারণ যে কোনও চ্যালেঞ্জই বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

জেন্ডার বিষয়টি যে খুবই ব্যক্তিগত এবং সে কারণে খুবই স্পর্শকাতর ও আবেগময় একটি বিষয় তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এগুলো আমাদের শুধু বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথা, স্কুল-কলেজ, আইনি ব্যবস্থা, রাষ্ট্র, পুঁজিবাদ ইত্যাদির বিষয়ে মুখোমুখি হতেই বাধ্য করছে তাই নয় বরং আমাদের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক (স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, মা-মেয়ে) এবং আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধগুলোরও মুখোমুখি করেছে। অনেক সময়ই ভিন্ন স্বার্থের কারণে দুটি ভিন্ন দল/সম্প্রদায়ের মাঝে দ্বন্দ্ব হয়।  একই পরিবারের সদস্যদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা যায়। অনেক সময় একই ব্যক্তির দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মাঝেও দ্বন্দ্ব দেখা যায়। 

আমাদের কোনও একটি পক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন হলে অনেক সময় এমন হয় যে, দুটোর ভেতর একটি বেছে নিতে বেশ কষ্ট হয়। আমরা হতভম্ব হয়ে যাই যখন আমরা আবিষ্কার করি যে, আমাদের খুব কাছের লোকেরা আমাদের স্বার্থে আঘাত হানছে, আমাদেরকে নানাভাবে শোষণ করছে এবং আমাদেরকে সমান দৃষ্টিতে গ্রহণ করছে না। 

সচেতনতা বৃদ্ধির এই প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে খুবই বেদনাদায়ক। শুধু পুরুষরাই নয় বেশিরভাগ নারীও এই ধরণের অবস্থার মুখোমুখি এবং হতভম্ব হওয়ার পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চায়। আমরা নারীবাদ নিয়ে অস্বস্তি বোধ করি। কারণ, নারীবাদ আমাদের নারীদেরকেও চ্যালেঞ্জ করে। আমরা কীভাবে শোষিত হই, আমাদের নারীত্বকে কীভাবে ব্যবহার করি, মেয়েলি আচরণ নিয়ে খেলা খেলি, অন্যদের কিভাবে শোষণ করি, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের অগণতান্ত্রিক এবং কর্তৃত্বপূর্ণ হয়ে উঠি, এ সবকিছুর প্রতিও নারীবাদ সমালোচনাপূর্ণ দৃষ্টি দেয়। 

অন্য কথায়, আমাদের নারীদের ভেতরে যে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে, পুরুষসুলভ উৎপীড়ন ও ক্ষমতালোভের যে উৎস আছে, নারীবাদ সেগুলোকে পরীক্ষা করে দেখার জন্য চ্যালেঞ্জ করে। মোট কথা, নারীরাও যে নিজেদের ভেতরে পুরুশতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করে। আমরাও পুরুষদের মতো একইভাবে পুরুশতান্ত্রিক পরিবারে বড় হই, একই ধর্মীয় ঐতিহ্যে বেড়ে উঠি এবং একই পুরুষতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করি। যার ফলে, বহু নারীই বিশ্বাস করে যে, পুরুষরাই শ্রেষ্ঠ; তারাও তাদের কন্যাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করে। তাদের গতিবিধির উপর, পছন্দ অপছন্দের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, তাদের কন্ঠ রোধ করে। দীর্ঘ সময় ধরে যা আমরা বিশ্বাস করে আসছি, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা এবং তা পরিবর্তন করা আমাদের নারীদের জন্যেও খুবই কষ্টদায়ক। 

মারিয়া মাইস-এর মতানুযায়ী, আমাদের সমাজের অধিকাংশ নারী এবং পুরুষ, সামাজিক লিঙ্গীয় সম্পর্কগুলোর প্রকৃত রূপ পরীক্ষা করার ব্যাপারটি এড়িয়ে চলে। কারণ, তারা ভয় পায় যে অর্থ উপার্জন, শক্তির খেলা এবং আকাঙ্ক্ষার এই শীতল নৃশংস পৃথিবীতে শান্তি ও সংহতির শেষ দ্বীপ পরিবারটি এই কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। 

এছাড়া, যদি তারা এই বিষয়ে সচেতন দৃষ্টি দেয়, তাহলে তাদের স্বীকার করতে হবে যে, তারা (নারীরা) নিজেরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পুরুষরা যাদেরকে ভিলেন হিসেবে গণ্য করে তারাও নারীর মতোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তারা উভয়েই দুষ্কর্মের সহচর। যদি তারা সত্যিই স্বাধীন ও মানবিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায় তবে তাদেরকে এই দুষ্কর্মের সহচর হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। 

এটা শুধু সেসব পুরুষদের জন্যই সত্য নয় যাদের সুবিধার শিকড় এই ব্যবস্থা মধ্যে নিহিত রয়েছে এটা ঐ সকল নারীদের জন্যও সত্য যাদের বস্তুগত অবস্থান এর সঙ্গে যুক্ত। 

নারীবাদীরা কোনও বড় সফলতা অর্জন করেছে সেখানেই প্রতিপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে তীব্র নিপীড়নমূলক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কয়েক বছর আগে কানাডায় এক ব্যক্তি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে ১৪ জন ছাত্রীকে গুলি করে এবং তারপর আত্মহত্যা করে। সে যে চিঠি রেখে যায়, তাতে সে স্পষ্টভাবেই বলেছে যে, সে ‘নতুন নারীদের’ উপর খুবই ক্ষুব্ধ। 

কিছু মানুষ মনে করে বিশ্বব্যাপী পর্নোগ্রাফি এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার যে বৃদ্ধি ঘটেছে তা নারীদের তাদের আগের স্থানে নিয়ে যাবার একটি প্রচেষ্টা। দক্ষিণ এশিয়ায় যে সকল নারী পর্দা নিয়ে তাদের শরীর ঢেকে রাখে না, তাদের কারও কারও উপর এসিড নিক্ষেপ করার ঘটনা ঘটে এবং নারীদের অনাবৃত বাহুতে আঘাত করা হয়। 

নিম্নবর্ণের হিন্দুরা, কৃষকরা, শ্রমিকরা, কৃষাঙ্গরা যখন সংগঠিত হয় এবং বিদ্যমান অন্যায় ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে তখন তাদের বিরুদ্ধে যে হিংস্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়, তার সঙ্গে নারীদের বিরুদ্ধে যে সকল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার কী কোনও পার্থক্য আছে? 

নারীবাদীদের বিরুদ্ধে শত্রুতা কেবল এ কথাই প্রমাণ করে যে, নারীবাদীরা এমন একটি সুরক্ষিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছে, যেখানে শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তি লাভবান হয়। ঐ সকল ব্যক্তির সুবিধা এবং মুনাফাসমূহ হুমকির সম্মুখীন হওয়ার ফলে তারা প্রকাশ্যে শত্রুতা এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে প্রচারণার আশ্রয় নিচ্ছে।

যুক্তি পুরুষদের মুক্তির সঙ্গে নারীর মুক্তি সম্পর্কিত হয় এবং যদি  তারাও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ফাঁদে বন্দি হয়ে থাকে, তবে তারা নারীবাদের ব্যাপারে এত ভীত কেন? 

সব পুরুষই নারীবাদের ব্যাপারে ভীত নয় এবং তারা সকলেই এর বিরুদ্ধেও নয়। তবে বিপুলসংখ্যক পুরুষ ভীত এবং এর বিরুদ্ধে। কারণ, বর্তমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাদের জন্য সুবিধাজনক। তাছাড়া নারীবাদ পুরুষ প্রাধান্য ও পুরুষ কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে এবং প্রাকৃতিক জেন্ডারভিত্তিক পুরুষ আধিপত্য সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। এটা পুরুষদেরকে তাদের মনোভাব, আচরণ এবং পদমর্যাদা পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখতে চাপ দেয়— যা মোটেও সহজ বা আনন্দদায়ক নয়। মোটের উপর, কোনও শাসকই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করে না। 

বর্তমান ব্যবস্থায় পুরুষদের সুযোগ-সুবিধা অসংখ্য, তাদের জন্মের মুহূর্ত থেকেই উচ্চমর্যাদা, ভালোবাসা এবং সম্মান দেওয়া শুরু হয়। ছেলে শিশুদের জন্য অপেক্ষাকৃত ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসা এবং ভালো শিক্ষার সুযোগ থাকে এবং একইভাবে তাদের স্বাধীনতাও থাকে— চলাফেরার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের এবং পছন্দের স্বাধীনতা।

পুরুষরা উত্তরাধিকারসূত্রে নারীদের চেয়ে বেশি পৈত্রিক সম্পত্তি পায় এবং অনেক আইন এখনও পুরুষদের অনুকুলে, পক্ষপাতমূলক। 

শতকরা নব্বই ভাগের উপর সংসদীয় আসন এবং শতকরা ৮০ ভাগের উপর ব্যবস্থাপক পদ দখল করে আছে পুরুষরা। নারীবাদীরা নারী-পুরুষের অসম সম্পর্কের ব্যাপারে নীরবতা ভেঙেছে এবং পরিবারের ভেতরে যে অসমতা এবং নির্যাতন রয়েছে তা প্রকাশ করেছে। তাই পুরুষরা স্বনির্ভর ও সাহসী নারীদেরকে ভয় পায়। তারা ভীত যে, নারীরা চাকরির জন্য তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হবে। 

নারীদের ভূমিকাকে যদি শুধুমাত্র গৃহিণীর কাজ বলে গণ্য করা হয়, তবে প্রয়োজনের সময় তাদের পারিশ্রমিক দিয়ে রাখা যায় এবং প্রয়োজন ফুরালে তাদের যখন তখন ছাঁটাই করা যায়। 

যদি নারীদের ভূমিকা সম্পর্কিত সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা যায় এবং নারীদের যোগ্যতা ও ক্ষমতা প্রকাশের সামর্থ্য বৃদ্ধি পায় তবে এই ধরণের বৈষম্য অব্যাহত রাখা আর সম্ভব হবে না। সকলেই তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, পুরুষ বা নারী হিসেবে নয়। তবে পুরুষরা কখনও এই অনিবার্যতাকে বিশেষভাবে স্বাগত জানাবে না। 

নারীবাদ বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সমাজের মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করে। এর ফলে পুরুষরা তাদের বর্তমান অন্যায্য সুবিধাদি হারাবে। এই জন্যে তারা নারীবাদকে ভয় পায়। 


তার মানে কি এই যে, পুরুষরা যদিও উপলব্ধি করতে পারছে না, তবুও শেষ পর্যন্ত নারীবাদ নারী এবং পুরুষ উভয়ের জন্যই কল্যাণকর হবে? 

ঠিক তাই। নারীবাদীরা সকল প্রকার অসমতা, কর্তৃত্ব এবং নির্যাতন বিলোপ করার মাধ্যমে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং পারিবারিক ক্ষেত্রে নয়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও একটি ন্যায্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এই নতুন ব্যবস্থায় অনিবার্যভাবে পুরুষরাও অন্তর্ভুক্ত হবে। এই ব্যবস্থার ফলে অবশ্যই তারা কিছু কিছু সামাজিক সুবিধা হারাবে— তবে অন্যভাবে তারা লাভবান হবে, সমাজও লাভবান হবে। 

যেমন, যদি পরিবারের প্রত্যেক শিশুকে (শুধু ছেলে শিশু নয়) একইভাবে বড় করা হয় এবং তাদের উন্নতির জন্য একই ধরণের সুবিধা এবং উৎসাহ প্রদান করা হয়, তবে পরিবার এবং সমাজ উভয় স্থানেই আরও বেশি প্রতিভা বিকশিত হবে এবং সৃজনশীলতা বাড়বে। যদি নারীদের জোরপূর্বক নির্ভরশীল, অসহায়, অন্যের মুখাপেক্ষী করে রাখা না হয় তবে পরিবারগুলো আরও সম্ভাবনাময়, অর্থনৈতিকভাবে আরও মজবুত এবং সকল দিক থেকেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে। 

এই নতুন সমাজে পুরুষদের অর্থনৈতক দায়-দায়িত্ব এবং চাপও কম হবে এবং তারা আরও সহজভাবে তাদের নিজস্ব আশা আকাঙ্ক্ষাগুলো প্রকাশ করতে পারবে। যে কাজগুলো তথাকথিতভাবে ‘মেয়েলি’ বলে বিবেচিত, তারাও সে কাজ করতে পারবে এবং চাইলেই ঘরে বসে থাকতে পারবে। পুরুষরা যা বর্তমানে নারীসুলভ গুণাবলি হিসেবে বিবেচিত সেগুলোর অনুশীলন করতে পারবে। নানাবিধ জীবনদায়ী কার্যকলাপ যা থেকে এখন পুরুষ বঞ্চিত তাতে তাদের প্রবেশাধিকার ঘটবে। বর্তমান সমাজ পুরুষদের কাছ থেকে যে ভূমিকা ও ভাবমূর্তি দাবি করে নারীবাদ তাদের তা থেকে মুক্ত করে দিত। পুরুশ ও নারী উভয়ই তাদের প্রকৃত স্বভাব বুঝতে সক্ষম হবে। 

নারীবাদীদের উদ্দেশ্য বর্তমান ব্যবস্থায় অর্ধেক স্থান নারীদের দ্বারা পূর্ণ করা নয়, বর্তমান অসম এবং অন্যায্য  ক্ষমতা কাঠামোতে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব অর্জন করা নয় বরং সমাজ এবং সামাজিক সম্পর্কের পরিবর্তন নিশ্চিত করা। 

এছাড়াও, আমাদের মতে নারীবাদ বলতে কেবল নারী কর্তৃক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা গ্রহণ করা, উপযোগী করা এবং অবলম্বন করাকে বুঝায় না বরং প্রত্যেকটা বিষয়ে পুনঃপর্যালোচনা এবং পুনর্মূল্যায়ন বুঝায়। অন্য কথায়, নারীদের পুরুষদের মতো হয়ে যাওয়াটা নারীবাদ নয়। একটি বিকল্প সংস্কৃতি  তৈরির ক্ষেত্রে নারী এবং পুরুষ উভয়ের প্তহের ভেতরে কোনটা ভালো তা অনুসন্ধান করাই নারীবাদের কাজ। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।