কমলা ভাসিন-এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-১ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

 

পিতৃতন্ত্র শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। সংক্ষেপে পিতৃতন্ত্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি? 

শব্দটির অর্থ পিতার বা গোষ্ঠীপ্রধানের শাসন। শব্দটি এমন এক সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে পুরুষই পরিবারের সকল সদস্যদের সম্পর্ক, সম্পত্তি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে আর সকল বিষয়ে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেয়।

এই সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয় যে, পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, পুরুষদের দ্বারা নারীদের নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ আর নারীরা পুরুষের সম্পত্তি।  এই চিন্তাধারা আমাদের অনেক ধর্মীয় আইন ও অনুশীলনের ভিত গঠন করেছে। এই মতাদর্শ সমাজের এসব আচার-ব্যবহারকে বৈধতা দেয় যা নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখে, তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।  

আমাদের নৈতিক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, আমাদের আইন-কানুন ও ব্যবস্থা যা নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি অধিকার ক্ষমতা প্রদান করে তা পিতৃতান্ত্রিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এগুলো ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় পরিমণ্ডলে নারীদের নির্যাতিত করে এবং পুরুষদের অধীন করে রাখে।

ঘরকন্নায় বেশি সংশ্লিষ্ট হওয়ায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে কম উৎপাদনক্ষম— নারী-পুরুষের অসমতাই কি এর প্রকৃত কারণ নয়? 

পরিবারের প্রধান হিসেবে একজন পুরুষ একটি ‘পরিবার মজুরি’ পায় –এই মতের ভিত্তিতে ধনতন্ত্র উপরের যুক্তিটি ব্যবহার করে। ‘পরিবার মজুরি’ হলো পরিবার প্রধান, তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ। এই মতে, কারখানায় নিযুক্ত নারীরা সংসারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উদ্দেশ্যে কাজ করে। তাই কাজটি সমান গুরুত্বের হলেও, তাদের কম মজুরি দেওয়া হয়।

বাস্তবতা কিন্তু আলাদা। এ বিষয়ে গবেষণা থেকে জানা যায়, অনেক দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পরিবার চলে নারীদের উপার্জন দ্বারা অথবা এক নারী অভিভাবকের আয়ে। এ নারীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে অথবা অল্প বেতনে চাকরি করে এবং কর্মক্ষেত্রে উপরোক্ত ধনতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক শর্তাবলির দ্বারা অসমতার শিকার হয়। 

এও সত্যি কথা যে, কলকারখানা, মাঠ অথবা ফসলের ক্ষেতে কাজ করা ছাড়াও নারীদের পারিবারিক কাজে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়, যেমন- রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাজাঘষা, অন্য জায়গা থেকে পানি আনা, জ্বালানি কাঠ আনা, শিশুদের যত্ন নেওয়া এবং আরও অনেক কিছু। 


সুতরাং  নারীদের দ্বিগুণ দিন, দ্বিগুণ বোঝা, দ্বিগুণ শিফটের কাজ করতে হয়। অর্থের বিনিময়ে কাজের বোঝা (মোট শ্রমশক্তির অংশ হিসাবে) ও বিনা পয়সার কাজের বোঝা (যেমন, ঘরের কাজ) বহন করতে হয়। এই দ্বিগুণ ভার, নারীদের পক্ষে ভালো কাজ সংগ্রহ করা, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং পেশার উচ্চতর ধাপে ওঠা কঠিন করে ফেলে। শিক্ষায় কম সুযোগ পাওয়ার কারণে কম দক্ষতার এবং স্বল্প বেতনের চাকরিতে ঢোকে।  

অবশ্য, এতগুলো কারণ সত্ত্বেও কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা তাদের কাজে কম উৎপাদনক্ষম। প্রকৃতপক্ষে, অনেক শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কারণ, তারা অধিক পরিশ্রমী, হাতের কাজে পারদর্শী এবং সুশৃঙ্খল। 

এতকিছু সত্ত্বেও, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আধুনিকায়নের সাথে সাথে নারীরা সমাজে তাদের যথাযথ স্থান পাবে। তাদের অবস্থান শুধু ঘরেই থাকবে না। তারা বাইরের পৃথিবীতে পদার্পন করে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করবে।

বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ছেলেদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া থেকে মেয়েদের আলাদা করে রাখছে; এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে কর্মশক্তির বাইরেই রাখা হচ্ছে।  

উদাহরণ হিসেবে উভয় পাঞ্জাবের (ভারত ও পাকিস্তান) সবুজ বিপ্লবের কথা বলা যায়। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজে অংশগ্রহণ থেকে নারীরা বাদ পড়ে যায়। সেখানে কৃষির আধুনিকায়নের সাথে সাথে কারিগরি জ্ঞানের দরকার হলো এবং যেহেতু আধুনিক কারিগরি জ্ঞান প্রধানত পুরুষদেরই রয়েছে বলে মনে করা হতো, তাই নারীদেরকে অন্যায়ভাবে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। 

এছাড়া এসব ব্যবস্থার ফলে পুরুষ কৃষকরা অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জন করা শুরু করলো। আর তার ফলে তাদের পক্ষে পরিবারের মেয়েদেরকে ঘরে বন্দি করে রাখা সম্ভব হলো— যা তাদের সমৃদ্ধি ও বর্ধিত সম্মানেরই তথাকথিত পরিচয়। 

শ্রীলঙ্কার মহাভ্যালি প্রকল্পের ফলাফলও একই ধরণের সমস্যা তৈরি করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে স্বাধীন নারী কৃষকদের জন্য অতি সামান্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে এ সকল নারী বঞ্চিত হয়েছে। এভাবে তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে স্বল্প বেতনের কাজের দিকে অথবা আবারও ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের সব সুযোগ। 

একই অবস্থা চলছে বাংলাদেশ ও নেপালে। সে কারণে বর্তমানে প্রচলিত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ব্যবস্থা আমাদের দেশের নারীদের প্রকৃত সম্মান ও অবস্থার উন্নতি সাধন করবে, সেই আশা ক্ষীণ। এ অবস্থার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরা আর বর্তমানের চেয়ে ভালো নীতি ও ব্যবস্থার দাবি করা প্রয়োজন। যাচাই-বাছাই এবং এতে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে নারী গবেষকদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র ও নারীদের জন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া হলো ‘অপউন্নয়ন’ এবং ‘পুরুষের উন্নয়ন’। 

যে নারী শুধু একজন গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে কি নারীবাদী বলা যায়?

প্রথমত, একজন গৃহিণী কাজের ব্যাপ্তি জানা সত্ত্বেও আমাদের কখনও ‘শুধু’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। নারীবাদীরা কখনও গৃহিণী কিংবা ঘরের কাজকে হেয় করে নি বা নিচু চোখে দেখে নি। আসলে ঘরের কাজকে মূল্যবান মনে করা ও যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্রধান দাবিগুলো অন্যতম। যদি গৃহিণীরা তাদের কাজের প্রাপ্য মর্যাদা, পরিচিতি ও মূল্য পায়, তবে পুরুষরা বুঝবে শুধু তাই নয়, তারা হয়তো ঘরের কাজে অংশহণ করাও শুরু করবে।  

বিশ্বজুড়ে নারীবাদীদের সংগ্রামই বাধ্য করেছে সব সরকারকে গৃহিণীদের মজুরিবিহীন কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করতে এবং এভাবে নারীদের অবদান সম্পর্কে সচেতনতা আনতে।  ১৯৯৫ সালের ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, নারীদের সকল কাজের মোট মূল্য এসে দাঁড়ায় ১১ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার ( ১ ট্রিলিয়ন = ১০০০ বিলিয়ন এবং ১ বিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন বা ১০০ কোটি)। 

স্বেচ্ছায় গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত যে নারী নেন এবং মনে করেন এতেই তার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটবে, তাকেও নারীবাদী বলা যায়। নারীবাদী মানে এমন না যে সে ঘরের বাইরেই কাজ করবে। 

আসল কথা হলো, সমান সুযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের ধারণা, নারীদের যদি সুযোগ থাকতো তাহলে শুধুমাত্র গৃহিণী হিসেবে কাজ করার চেয়ে অন্য কোনো কাজও তারা বেছে নিতো। তবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত অবশ্যই স্বতস্ফূর্ত ও বাধ্যবাধকতামুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো শর্তসাপেক্ষে, কিংবা কোনো রকম পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চাপের মুখে, অথবা অন্য কোনো উপায় না দেখে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়।

কোনো সিদ্ধান্ত শর্তসাপেক্ষে নেয়া হচ্ছে, না কি শর্ত ছাড়াই নেয়া হচ্ছে, এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। 

এক্ষেত্রে আরো একটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। একজন নারীবাদী অবশ্যই গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে পারবেন, যদি এ পেশায় তিনি সন্তুষ্ট থাকেন ও তার ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখতে পারেন । আর তিনি আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নন বলে তার স্বামী তার উপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি না করেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্য অবশ্যই সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ। নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের কী করা উচিৎ এবং কী করা অনুচিত তা নির্ধারণ করার জন্য নয়। নারীবাদীরা এমন একটি সমাজের জন্য সংগ্রাম করছে, যেখানে একজন মেয়ে স্বাধীনভাবে তার জীবন বেছে নিতে পারবে, যেখানে সে গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে বাধ্য নয়, যেখানে তাকে গতানুগতিক ‘মেয়েলি’ চরিত্রের অধিকারী এবং স্বপ্ন বেতনের ‘মেয়েলি’ চাকরি করতে হবে না এবং সর্বোপরি, যেখানে নারীদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হবে। 

আমরা নারী-পুরুষের অসমতারও একইভাবে বিরোধিতা করছি। 

প্রতিটি মেয়েরই, তার ইচ্ছা এবং যোগ্যতায় সে কী করবে, সে কী করতে চায় সে বিষয়ে সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে পুতুল, হাড়ি-পাতিলই তার খেলনা হবে না; যে বস্ত্রে তার শিরা উপশিরা আচ্ছাদিত থাকে, শুধু তাই তার কাপড় হবে না; তাকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ করে রাখা চলবে না, কিংবা শুধুমাত্র স্বামীর পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাকে বিনীত হতে হবে— এটাও আমরা মনে করি না। 

নারীবাদীদের চিন্তাধারাগুলো খুবই সহজ এবং যুক্তিযুক্ত।

নারীবাদীদের ধ্যানধারণা শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু ‘নারী ইস্যু’ যেমন, ধর্ষণ, স্ত্রীকে প্রহার করা, বন্ধ্যাত্ম এবং সমান মজুরি ইত্যাদি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গেই নারীরা জড়িয়ে আছে কারণ সবই আমাদের প্রভাবিত করছে। 

সব ইস্যুই নারীবাদী ইস্যু। নারীবাদীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য, অসমতা, আধিপত্য ও বঞ্চনা দূর করে একটি ন্যায়সম্মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল বিষয়কে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পৃক্ত করে সচেষ্ট। 

১৯৯৫ সালে বেইজিং কনফারেন্সের স্লোগান অনুসারে, নারীবাদীরা মনে করে ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’।

যেহেতু সকল ইস্যুই নারীদের ইস্যু, সব বিষয়েই নারীদের নিজস্ব মতামত থাকা উচিৎ, হোক সেটা পরমাণু যুদ্ধ, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ, সাংস্কৃতিক সংঘাত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং উন্নয়নমূলক নীতি, মানবাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা কিংবা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়। সত্যিকার অর্থে, সীমিত মানব সমপদ সত্ত্বেও এবং অন্যান্য সম্পদের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নারী সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই এ ধরণের কাজে জড়িত হয়েছে। 

শ্রীলঙ্কায় নারীরা সক্রিয়ভাবে উপজাতীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাইছে। পাকিস্তানে নারীরা ধারাবাহিকভাবে এবং খুবই দুঃসাহসিকতার সঙ্গে প্রাচীন নারীবিরোধী আইনগুলোর বিরোধিতা করছে– যেগুলো নারীদের উপর এবং পাকিস্তানী সমাজের উপর ইসলামের নামে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানি নারীরা সামাজিক আইন ও ইসলামী মৌলবাদেরও বিরোধিতা করে আসছে। নেপালে নারীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে নারীবাদীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও রাষ্ট্রের মৌলবাদী আন্দোলন, পরিবেশ বিপর্যয় ও ‘গরিব-বিরোধী’ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশীদার।  

ভারতে নারীরা পরিবেশ রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী সংগ্রামসহ অনেক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের দলগুলো নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিসমূহের সমালোচনা করে এবন জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও তারা পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার এবং সামরিকীকরণের বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। 

নারীবাদীরা কি ছোট ছোট বিষয়ে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে না? যেমনঃ কোনও নারীকে ‘চেয়ারম্যান’ বলাতে ক্ষতি কী? বাস্তবিকপক্ষে আমরা কি সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে পারবো?

আমাদের বৃহত্তর আন্দোলন ও প্রচারণাগুলো কখনও ভাষাকে প্রধান একটি বিষয় হিসেবে দেখে নি। তবুও আমরা ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করায় এবং পরিবর্তনের গুরুত্ব খুঁজে পাই। কেননা, ভাষাও পুরুষতান্ত্রিক।  

আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ভাষা ও শব্দ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ভাষাগুলো জেন্ডারভিত্তিক। ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠতা ও প্রাধান্য বহন করে। নারীদের হেয় ও বর্জন করে। ধর্ম ও মতাদর্শের মতো ভাষাও পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণের পক্ষপাতী হয়ে থাকে। তবে আমরাই বা কেন এই রকম কিছু মেনে নেবো যা সমাজের আমাদের অস্তিত্ব ও প্রকৃত অবদান কোনোটাই স্বীকার করে না, আমাদের বিরুদ্ধে প্রভেদ সৃষ্টি করে। আমাদের অপমান করে।

আগের দিনে যখন নারীরা প্রকাশ্যে বৃহত্তর অনেক ক্ষেত্রেই প্রবেশ করে নি অর্থাৎ যখন সভা পরিচালন, খেলাধুলা সাংবাদিকতা বা অন্যান্য ধরণের পেশা গ্রহণ করে নি, যখন কোনো নারী ‘বৈজ্ঞানিক বা ধর্মতাত্ত্বিক ছিল না, তখন চেয়ারম্যান স্পোর্টসম্যান , মিডিয়াম্যান এই ধরণের ভাষা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করতো। 

ভাষার এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন সেকেলে হয়ে গেছে, কারণ সামাজিক বাস্তবতাও পালটে গেছে। এখন নারীরাও সক্রিয়ভাবে এ ধরণের কাজ করছে। এসব কাজে নারীদের বেশি মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে চেয়ারপার্সন, স্পোর্টস-পার্সন, মিডিয়া পার্সন, নারী ইত্যাদি শব্দগুলো না আসার কোনও কারণ নেই। 

নারীদের প্রতি ভাষাগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য খুব বেশি প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এই শব্দগুলো ব্যবহার করা এবং শব্দকোষের অংশ করে তোলার জন্য প্রয়োজন কেবল সচেতন প্রচেষ্টার। অবশ্য ঠাট্টার ছলে আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে, আমরা ‘নরখাদক’ ও ‘ম্যানহোল’ এর মতো শব্দগুলো পরিবর্তন করার উপর জোর দেবো না!

নারীবাদীরা কি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে নয়? আর তারা কি শান্তিপূর্ণ সংসার ধ্বংস করছে না? 

আমরা কোনো দেশের এমন কোনো নারীবাদী সম্পর্কে জানি না যিনি বলেছেন তিনি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে। তবে আমরা এমন অনেককেই জানি যারা অসুখি, অসম, অন্যায্য বিয়ে এবং সংসারের বিরুদ্ধে। অনেক নারীবাদী  বাস্তবিকভাবেই সংসার ধ্বংস করতে পারে (শান্তিপূর্ণ দিকটির প্রতি আমরা পরে মনোযোগ দেব)। তবে তা শুধু সেভাবেই যেভাবে হরিজনরা একটি ‘শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায়’ ধ্বংস করে, যখন তারা অবমাননাকর কিছু গ্রহণ করতে অসম্মত হয়। অথবা কৃষক/শ্রমিকরা যখন কোন জমিদার/শিল্পপতির সামনে দাঁড়িয়ে আপোষহীনভাবে ন্যায় বিচার চায়। 


একজনের শান্তি অন্য ব্যক্তির অশান্তির কারণ হতে পারে। নারীদের জন্য এটা কি অন্যায় যদি সে গৃহের অভ্যন্তরের নিপীড়ন সম্পর্কে নীরবতা ভাঙে?

যদি কোনও নারী তার গুরুত্বহীন জীবন, কঠোর পরিশ্রম, যান্ত্রিকতা ও একঘেয়ে গৃহকর্ম এবং প্রতি বছর সন্তান প্রসব ইত্যাদিতে বিরক্ত হয় এবং প্রতিবাদ করে, তাকে কি ‘সংসার বিধ্বংসী’ বলা যায়? যে নারী তার স্বামীর ছায়া হতে চায় না, যে শুধুমাত্র তার স্বামীর ইচ্ছাগুলোর প্রতিধ্বনি করে না, সে তার জীবনের বাকি সময় স্বামীর ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অথবা শুধুমাত্র স্বামীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে অস্বীকার করে, তাকে কি আমরা সমস্যা সৃষ্টিকারী বলতে পারি? 

যে নারী তার নিজের জন্যেও বাঁচতে চায়, যার নিজস্ব স্বপ্ন এবং লক্ষ্য আছে, যে একজন আদর্শ, বাধ্য অবরুদ্ধ স্ত্রী হতে চায় না, সে কি সংসার নষ্টকারী? প্রকৃত বিচারে, এসব ক্ষেত্রে পুরুষই কি ‘সংসার ধ্বংসকারী’ নয়? 

যদি কোনো নারী সম্মানজনক আচরণ চায়, তার পরিবার ও তার স্বামী যদি তা না দেয়, তবে নিশ্চয়ই নারীদের উপর গৃহের শান্তি নষ্ট করার দোষ চাপিয়ে অন্যদের উপরে চাপানো উচিত। 

নারীবাদীরা ( যারা সম্মান ও মর্যাদা চায়) মনে করে, সংসারে অশান্তি থাকলে  ভালো থাকা যায় না। কারণ, বেশির ভাগ সংসারে ‘শান্তিপূর্ণতা’ হচ্ছে একটি ঘরের সামনের ছবি, যার পেছনে অনেক নারীর অনুভুতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ এবং স্বপ্ন বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকে। 

যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা এই ধরণের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বিরাজ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা পুরুষদেরকে ঘরের কাজে সহায়তা করতে বলে না, রাতের বেলা জেগে-ওঠা ক্রন্দনরত শিশুর পরিচর্যা করতে বলে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বজায় থাকে। যখনই নারীরা সমতা এবং ন্যায় বিচার চাইতে শুরু করে, তখনই সমস্যার শুরু হয়। যখন নারীরা যন্ত্রণা, অপমান আর হতাশায় ক্রুদ্ধ হতে শুরু করে এবং যখন তারা তা প্রকাশ করতে শুরু করে, তখনই শান্তি নষ্ট হতে থাকে। আর তাদেরকে এই ধরণের মন্তব্য শুনতে হয় যে ‘সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই ধরণের অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হতেই কি আমি ঘরে ফিরে আসি?’ 

একজন নারীকে
তখনই নারীবাদী বলা হয়
প্রতি মুহূর্তে সে যখন
পাপোশের মতো ব্যবহৃত হতে চায় না। 

আসুন আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গৃহের দিকে আরেকটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিই। 

পরিবারের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, চাপা উত্তেজনা ও অত্যাচারের প্রচুর নজির আছে। সমাজের সকল স্তরেই অসংখ্য পরিবারের স্ত্রীরা চোখ রাঙানি, নির্যাতন এবং অপমানের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার হাজার হাজার পরিবারে মেয়ে শিশুর জন্মকেই অশুভ লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের মধ্যে মেয়ে ও শিশু হত্যার অপরাধ ঘটে চলেছে। এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে, ভারতীয়রা নারী ভ্রুণ হত্যাও ঘটাচ্ছে। অনেক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়ে শিশুদের কম সময় বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, কম খাবার দেওয়া হয় এবং কম চিকিৎসা প্রদান করা হয়। 

নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলোর প্রতি খুব সামান্যই নজর দেয়া হয়। প্রতি বছর দক্ষিণ এশিয়ায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাজার হাজার অল্পবয়সী নারী মৃত্যুবরণ করে।
নারীদের বিরুদ্ধে এই সকল অবহেলা এবং নির্যাতনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার-সমতার হার ভয়ংকর রকমের কম। পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন, অবহেলা, বৈষম্যের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ মিলিয়ন নারীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কি নারীদের শান্তির উদাহরণ? 

নববধুদেরকে অপর্যাপ্ত যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা হয়, তালাক দেয়া হয় অথবা আত্মীয়স্বজনরা তাদের শারীরিকভাবে আহত, হত্যা করে। এটাও কি নারীর শান্তিপূর্ণ জীবনের নমুনা?

নারীবাদীদের মাধ্যমে নয় বরং আমাদের সরকার আর জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, পরিবারই সম্ভবত নারী শিশুদের জন্য সবচাইতে অনিরাপদ স্থান! 

দ্বন্দ্ব ও অবিচারে পূর্ণ পরিবারগুলোর ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে নারীবাদীরা চেষ্টা করছে পরিবারের সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার। 

একজন ডাক্তার যিনি আমাদের দেহের অসুস্থতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন, তাকে নিশ্চয়ই আমরা শত্রু বলে অভিহিত করতে পারি না। আমরা সেই ডাক্তারের কাছেই যাই যে ডাক্তার রোগ নির্ণয়ে দক্ষ। ঠিক তেমনই নারীবাদীদের সাহস, সরলতা এবং আমাদের পরিবারের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন করার জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে অভিনন্দিত করা।

যারা যে কোনও মূল্যে প্রচলিত অন্যায়ভিত্তিক শান্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের তুলনা করা যেতে পারে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে যারা বর্ণপ্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এবং ভারতীয় গ্রামগুলোর তথাকথিত সংহতি সংরক্ষণ করতে চায়; অথবা জমিদারদের সঙ্গে যারা দাসত্বমূলক শ্রমিকপ্রথা বজায় রাখতে চায়। 

এটা কি ন্যাক্কারজনক নয় যে, মেয়েদের কথা উঠলেই প্রগতিশীল লোকেরা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যাকুল হন?

কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি কোনও ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলে এবং পরিবর্তন আনলে তারা ঐতিহ্য বিনাশের দায়ে অভিযুক্ত হয়। সংসার ধ্বংস করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই কি দায়ী নয়? যখন অধিকাংশ নারীবাদীই সংসার ও পরিবারের বিরুদ্ধে নয় তখন আমরা উভয়কে রক্ষা করার একটি মাত্র পথ হিসাবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন পাল্টানোর জন্য কাজ করার অবস্থান নিতে পারি। 

নারীদের ক্ষতি সাধন করে সংসারের শান্তি ও সামঞ্জস্য আর রক্ষা করা যাবে না। 

আমরা পরিবারের ভেতর পুরুষদের একনায়কতন্ত্র মেনে নিয়ে পরিবারের বাইরে গণতন্ত্র সম্পর্কে বড় বড় কথা বলতে পারি না। 

আমরা প্রকৃত পক্ষে বিশ্বাস করি যে, গণতন্ত্র, নারী-পুরুষের সমতা সমাজে সত্যিকার অর্থে তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা আমাদের পরিবারগুলোতে গণতন্ত্র, সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা করতে পারবো।সমাজের সত্যিকারের শান্তি কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা পরিবারে শান্তি অভিজ্ঞতা লাভ করবো। 

অনেক নারীবাদিই মনে করেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত মনোনয়ন ও পছন্দের ভিত্তিতে পরিবার, বিয়ে এবং পার্টনারশিপের বিভিন্ন ধরণ হতে পারে।  হেটারোসেক্সুয়াল কার্যকলাপ এবং বিয়ে হচ্ছে একট ধরণ এবং হোমোসেক্সুয়াল পরিবার এবং বিয়ে হচ্ছে আরেক ধরণ।  

কেউ ইচ্ছা করলে বিয়ে না করেও একসঙ্গে বসবাস করতে পারে আবার কয়েকজন মিলে একট সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে, যেখানে তারা পারিবারিক দায়িত্ব ও ধনসম্পত্তি সমভাবে ভাগ করে নিতে পারবে। 

নারীবাদীরা কী মাতৃত্ববিরোধী? 

 এ ধরণের প্রশ্ন কেন? মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব প্রশ্ন করা হয় এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ করা হয় যা খুবই বিরক্তিকর। এই ধরণের প্রশ্নগুলো বারবার নারীবাদীদের অস্বস্তিকর অবসথায় ফেলে দেয়।

সুস্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে নারীবাদীরা সন্তান গ্রহণের বিরুদ্ধে নয়। তবে মাতৃত্বকে প্রত্যেক নারীর একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে আমরা গণ্য করতে পারি না। নারীত্বকে মাতৃত্বের সমকক্ষ বলেও আমরা মনে করি না। 

আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক নারীর সন্তান নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে তার নিজস্ব পছন্দ থাকা উচিত। বর্তমানে আমাদের অনেক দেশেই আইনগত সামাজিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক কোনোভাবেই এই ধরণের পছন্দ করার সুযোগ নেই। অতএব নারীরা যাতে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দিতে পারে, সেই জন্য আমাদের সংগ্রাম। 

এছাড়া আমরা মনে করি, যদিও একজন নারীই একটি সন্তান ধারণ করতে পারে, কিন্তু যে কেউ (পুরুষও হতে পারে) সে শিশুকে লালন-পালন করতে পারে এবং তাকে মায়ের স্নেহ দিতে পারে। 

মাতৃত্ব বলতে কেবল শারীরিকভাবে সন্তান জন্ম দেয়াকেই বোঝায় না। এর অর্থ আরেকজন মানব সন্তানের দেখাশোনা, সেবা এবং তত্ত্বাবধান করা। এর অর্থ আরেকজন ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে, আবেগ দিয়ে এবং মানসিকভাবে বুদ্ধিপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করা। 

 এ ধরণের মাতৃত্ব যে কারও হতে পারে। শুধুমাত্র যে নারী সন্তান জন্ম দেবে, অপরিহার্যভাবে তার দ্বারাই হতে হবে তা নয়। এমন অনেক নারী আছেন যারা সন্তান জন্ম দিতে পারেন নি কিন্তু তারা চমৎকার মা। এমন অনেক নারীও আছেন যারা সন্তানের জন্ম দিলেও মা হিসেবে ভালো নন, এমনকি সহিংসও। 

যাই হোক, বেশিরভাগ নারীই মাতৃত্বকে তাদের নিয়তি হিসাবে দেখে থাকে। তবে তা বিকল্পের অভাব এবং মাতৃত্বের গৌরববোধ এই উভয় কারণেই। নারীরা তাদের ত্যাগ স্বীকার, কষ্ট স্বীকার এবং অন্যের জন্য বাঁচার যে ইচ্ছা সে কারণে প্রশংসিত হয়ে থাকে। এটি নারীর জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ হয়ে আছে। এই ধরণের গৌরব আরোপ হচ্ছে তেতো ঔষধের উপর চিনির প্রলেপ মেশানোর মতো। নারীরা বংশপরম্পরায় এই চিনির দানার মোহে পড়ে আছে এবং তারা এমন ভূমিকা পালন করেছে যা তাদেরকে অবরুদ্ধ করেছে, তাদের শ্বাসরোধ করেছে এবং তাদেরকে গতিহীন করেছে। 

নারীদের সন্তান দেখাশোনার জন্য বিশেষ অঙ্গ নেই বা এমন বিশেষ গ্রন্থিও নেই যা ভালোবাসা ও যত্ন উৎপাদন করে। 

যদি একজন নারী রাঁধতে পারে
তবে একজন পুরুষও তা পারবে
কারণ
নারী তার জরায়ুর সাহায্যে রান্না করে না!

সত্যিই যদি এ পৃথিবী মাতৃত্ব, ত্যাগ স্বীকার, অন্যের সেবা করা এবং অন্যের জন্য বেঁচে থাকতে সব কাজের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ বলে গণ্য করতো (যদি এর জন্য তুমি নোবেল পুরস্কার পেতে) তবে পুরুষরা কখনও নারীদের এক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে কর্তৃত্ব করতে দিত না।

মাতৃত্বের প্রশংসা পুরুষরা ঠিকই করে, কিন্তু নিজেরা এর অনুশীলন করতে অনিচ্ছুক। 

বস্তুত অন্যের জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করাটা যদি সকল কাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হয়, তবে আমরা নারীরা নিঃস্বার্থভাবে পুরুষদেরকে মাতৃত্ব, অংশীদারিত্ব এবং যত্ন গ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। 

মায়ের ক্ষমতা ও যোগ্যতা অপরিহার্যভাবে প্রাকৃতিক নয়, কাজেই শারীরিকভাবেও নির্ধারিত নয়। 

পুরুষরাও মা হতে পারেন এবং অনেক পুরুষ তা করেনও। মহাত্ম গান্ধী সম্ভবত বলেছিলেন যে, তিনি নিজেকে একজন ভালো মানবসন্তান হিসেবে তখনই মনে করবেন যখন তিনি মাতৃসুলভ গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন। আমাদের মতে, পুরুষতান্ত্রিক যে সকল নিকৃষ্টতম কাজ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, নারী ও পুরুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, আবেগময়তা ও যুক্তিশীলতার মাঝে অপ্রয়োজনীয় বিভেদ সৃষ্টি করা। পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদ পুরুষদের সন্তান লালন-পালন ও দেখাশোনার দায়িত্ব অস্বীকার করে। যার ফলে অধিকাংশ পুরুষ কঠোর, কর্কশ, অসংবেদনশীল এবং অযত্নশীল হয়ে পড়ে। 

অনেক নারীবাদীই এটা বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেকেই ভদ্র কিন্তু বলিষ্ঠ সেবাপরায়ণ, ত্যাগী, অনুভুতিপ্রবণ এবং যুক্তিবাদী হতে পারে এবং হওয়া উচিত। 

থেকে আরও পড়ুন

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।