কমলা ভাসিন-এর নারীবাদ পরিচিতি । পর্ব-১ 

kamla bhasin
কমলা ভাসিন

 

পিতৃতন্ত্র শব্দটি প্রায়ই শোনা যায়। সংক্ষেপে পিতৃতন্ত্র বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি? 

শব্দটির অর্থ পিতার বা গোষ্ঠীপ্রধানের শাসন। শব্দটি এমন এক সমাজব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে পুরুষই পরিবারের সকল সদস্যদের সম্পর্ক, সম্পত্তি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নিয়ন্ত্রণ করে আর সকল বিষয়ে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেয়।

এই সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাস করা হয় যে, পুরুষ নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ, পুরুষদের দ্বারা নারীদের নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিৎ আর নারীরা পুরুষের সম্পত্তি।  এই চিন্তাধারা আমাদের অনেক ধর্মীয় আইন ও অনুশীলনের ভিত গঠন করেছে। এই মতাদর্শ সমাজের এসব আচার-ব্যবহারকে বৈধতা দেয় যা নারীদের ঘরে আবদ্ধ রাখে, তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে।  

আমাদের নৈতিক ডাবল স্ট্যান্ডার্ড, আমাদের আইন-কানুন ও ব্যবস্থা যা নারীদের চেয়ে পুরুষদের বেশি অধিকার ক্ষমতা প্রদান করে তা পিতৃতান্ত্রিকতার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এগুলো ব্যক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয় উভয় পরিমণ্ডলে নারীদের নির্যাতিত করে এবং পুরুষদের অধীন করে রাখে।

ঘরকন্নায় বেশি সংশ্লিষ্ট হওয়ায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে কম উৎপাদনক্ষম— নারী-পুরুষের অসমতাই কি এর প্রকৃত কারণ নয়? 

পরিবারের প্রধান হিসেবে একজন পুরুষ একটি ‘পরিবার মজুরি’ পায় –এই মতের ভিত্তিতে ধনতন্ত্র উপরের যুক্তিটি ব্যবহার করে। ‘পরিবার মজুরি’ হলো পরিবার প্রধান, তার স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণের খরচ। এই মতে, কারখানায় নিযুক্ত নারীরা সংসারের জন্য অতিরিক্ত আয়ের উদ্দেশ্যে কাজ করে। তাই কাজটি সমান গুরুত্বের হলেও, তাদের কম মজুরি দেওয়া হয়।

বাস্তবতা কিন্তু আলাদা। এ বিষয়ে গবেষণা থেকে জানা যায়, অনেক দেশে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পরিবার চলে নারীদের উপার্জন দ্বারা অথবা এক নারী অভিভাবকের আয়ে। এ নারীদের অধিকাংশই দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করে অথবা অল্প বেতনে চাকরি করে এবং কর্মক্ষেত্রে উপরোক্ত ধনতান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক শর্তাবলির দ্বারা অসমতার শিকার হয়। 

এও সত্যি কথা যে, কলকারখানা, মাঠ অথবা ফসলের ক্ষেতে কাজ করা ছাড়াও নারীদের পারিবারিক কাজে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়, যেমন- রান্নাবান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাজাঘষা, অন্য জায়গা থেকে পানি আনা, জ্বালানি কাঠ আনা, শিশুদের যত্ন নেওয়া এবং আরও অনেক কিছু। 


সুতরাং  নারীদের দ্বিগুণ দিন, দ্বিগুণ বোঝা, দ্বিগুণ শিফটের কাজ করতে হয়। অর্থের বিনিময়ে কাজের বোঝা (মোট শ্রমশক্তির অংশ হিসাবে) ও বিনা পয়সার কাজের বোঝা (যেমন, ঘরের কাজ) বহন করতে হয়। এই দ্বিগুণ ভার, নারীদের পক্ষে ভালো কাজ সংগ্রহ করা, প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং পেশার উচ্চতর ধাপে ওঠা কঠিন করে ফেলে। শিক্ষায় কম সুযোগ পাওয়ার কারণে কম দক্ষতার এবং স্বল্প বেতনের চাকরিতে ঢোকে।  

অবশ্য, এতগুলো কারণ সত্ত্বেও কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা তাদের কাজে কম উৎপাদনক্ষম। প্রকৃতপক্ষে, অনেক শিল্প কারখানায় নারী শ্রমিকদেরই অগ্রাধিকার দেয়া হয়। কারণ, তারা অধিক পরিশ্রমী, হাতের কাজে পারদর্শী এবং সুশৃঙ্খল। 

এতকিছু সত্ত্বেও, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, আধুনিকায়নের সাথে সাথে নারীরা সমাজে তাদের যথাযথ স্থান পাবে। তাদের অবস্থান শুধু ঘরেই থাকবে না। তারা বাইরের পৃথিবীতে পদার্পন করে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করবে।

বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ছেলেদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাই আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া থেকে মেয়েদের আলাদা করে রাখছে; এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে মেয়েদেরকে কর্মশক্তির বাইরেই রাখা হচ্ছে।  

উদাহরণ হিসেবে উভয় পাঞ্জাবের (ভারত ও পাকিস্তান) সবুজ বিপ্লবের কথা বলা যায়। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজে অংশগ্রহণ থেকে নারীরা বাদ পড়ে যায়। সেখানে কৃষির আধুনিকায়নের সাথে সাথে কারিগরি জ্ঞানের দরকার হলো এবং যেহেতু আধুনিক কারিগরি জ্ঞান প্রধানত পুরুষদেরই রয়েছে বলে মনে করা হতো, তাই নারীদেরকে অন্যায়ভাবে বেকারত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হলো। 

এছাড়া এসব ব্যবস্থার ফলে পুরুষ কৃষকরা অতিরিক্ত সম্পদ উপার্জন করা শুরু করলো। আর তার ফলে তাদের পক্ষে পরিবারের মেয়েদেরকে ঘরে বন্দি করে রাখা সম্ভব হলো— যা তাদের সমৃদ্ধি ও বর্ধিত সম্মানেরই তথাকথিত পরিচয়। 

শ্রীলঙ্কার মহাভ্যালি প্রকল্পের ফলাফলও একই ধরণের সমস্যা তৈরি করেছে। এ প্রকল্পের অধীনে স্বাধীন নারী কৃষকদের জন্য অতি সামান্য জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। ঋণ, প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে এ সকল নারী বঞ্চিত হয়েছে। এভাবে তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে স্বল্প বেতনের কাজের দিকে অথবা আবারও ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে তাদের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের সব সুযোগ। 

একই অবস্থা চলছে বাংলাদেশ ও নেপালে। সে কারণে বর্তমানে প্রচলিত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন ব্যবস্থা আমাদের দেশের নারীদের প্রকৃত সম্মান ও অবস্থার উন্নতি সাধন করবে, সেই আশা ক্ষীণ। এ অবস্থার দুর্বল দিকগুলো তুলে ধরা আর বর্তমানের চেয়ে ভালো নীতি ও ব্যবস্থার দাবি করা প্রয়োজন। যাচাই-বাছাই এবং এতে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে নারী গবেষকদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র ও নারীদের জন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রক্রিয়া হলো ‘অপউন্নয়ন’ এবং ‘পুরুষের উন্নয়ন’। 

যে নারী শুধু একজন গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে কি নারীবাদী বলা যায়?

প্রথমত, একজন গৃহিণী কাজের ব্যাপ্তি জানা সত্ত্বেও আমাদের কখনও ‘শুধু’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিৎ নয়। নারীবাদীরা কখনও গৃহিণী কিংবা ঘরের কাজকে হেয় করে নি বা নিচু চোখে দেখে নি। আসলে ঘরের কাজকে মূল্যবান মনে করা ও যথাযথ স্বীকৃতি দেওয়া আমাদের প্রধান দাবিগুলো অন্যতম। যদি গৃহিণীরা তাদের কাজের প্রাপ্য মর্যাদা, পরিচিতি ও মূল্য পায়, তবে পুরুষরা বুঝবে শুধু তাই নয়, তারা হয়তো ঘরের কাজে অংশহণ করাও শুরু করবে।  

বিশ্বজুড়ে নারীবাদীদের সংগ্রামই বাধ্য করেছে সব সরকারকে গৃহিণীদের মজুরিবিহীন কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করতে এবং এভাবে নারীদের অবদান সম্পর্কে সচেতনতা আনতে।  ১৯৯৫ সালের ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুসারে, নারীদের সকল কাজের মোট মূল্য এসে দাঁড়ায় ১১ ট্রিলিয়ন আমেরিকান ডলার ( ১ ট্রিলিয়ন = ১০০০ বিলিয়ন এবং ১ বিলিয়ন = ১০০০ মিলিয়ন বা ১০০ কোটি)। 

স্বেচ্ছায় গৃহিণী হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত যে নারী নেন এবং মনে করেন এতেই তার ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটবে, তাকেও নারীবাদী বলা যায়। নারীবাদী মানে এমন না যে সে ঘরের বাইরেই কাজ করবে। 

আসল কথা হলো, সমান সুযোগের ভিত্তিতে প্রকৃত সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের ধারণা, নারীদের যদি সুযোগ থাকতো তাহলে শুধুমাত্র গৃহিণী হিসেবে কাজ করার চেয়ে অন্য কোনো কাজও তারা বেছে নিতো। তবে এ ধরণের সিদ্ধান্ত অবশ্যই স্বতস্ফূর্ত ও বাধ্যবাধকতামুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কোনো শর্তসাপেক্ষে, কিংবা কোনো রকম পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ চাপের মুখে, অথবা অন্য কোনো উপায় না দেখে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ নয়।

কোনো সিদ্ধান্ত শর্তসাপেক্ষে নেয়া হচ্ছে, না কি শর্ত ছাড়াই নেয়া হচ্ছে, এটা নির্ণয় করা খুবই কঠিন। 

এক্ষেত্রে আরো একটা কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি। একজন নারীবাদী অবশ্যই গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে পারবেন, যদি এ পেশায় তিনি সন্তুষ্ট থাকেন ও তার ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় রাখতে পারেন । আর তিনি আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নন বলে তার স্বামী তার উপর কোনো রকম চাপ সৃষ্টি না করেন। পরিবারের সদস্যদের মধ্য অবশ্যই সাম্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা থাকা উচিৎ। নারীবাদ শুধুমাত্র নারীদের কী করা উচিৎ এবং কী করা অনুচিত তা নির্ধারণ করার জন্য নয়। নারীবাদীরা এমন একটি সমাজের জন্য সংগ্রাম করছে, যেখানে একজন মেয়ে স্বাধীনভাবে তার জীবন বেছে নিতে পারবে, যেখানে সে গৃহিণীর পেশা বেছে নিতে বাধ্য নয়, যেখানে তাকে গতানুগতিক ‘মেয়েলি’ চরিত্রের অধিকারী এবং স্বপ্ন বেতনের ‘মেয়েলি’ চাকরি করতে হবে না এবং সর্বোপরি, যেখানে নারীদের উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হবে। 

আমরা নারী-পুরুষের অসমতারও একইভাবে বিরোধিতা করছি। 

প্রতিটি মেয়েরই, তার ইচ্ছা এবং যোগ্যতায় সে কী করবে, সে কী করতে চায় সে বিষয়ে সুযোগ ও স্বাধীনতা থাকা উচিৎ। মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলে পুতুল, হাড়ি-পাতিলই তার খেলনা হবে না; যে বস্ত্রে তার শিরা উপশিরা আচ্ছাদিত থাকে, শুধু তাই তার কাপড় হবে না; তাকে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধ করে রাখা চলবে না, কিংবা শুধুমাত্র স্বামীর পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাকে বিনীত হতে হবে— এটাও আমরা মনে করি না। 

নারীবাদীদের চিন্তাধারাগুলো খুবই সহজ এবং যুক্তিযুক্ত।

নারীবাদীদের ধ্যানধারণা শুধুমাত্র হাতেগোনা কিছু ‘নারী ইস্যু’ যেমন, ধর্ষণ, স্ত্রীকে প্রহার করা, বন্ধ্যাত্ম এবং সমান মজুরি ইত্যাদি ইস্যুতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি যে, পৃথিবীর সবকিছুর সঙ্গেই নারীরা জড়িয়ে আছে কারণ সবই আমাদের প্রভাবিত করছে। 

সব ইস্যুই নারীবাদী ইস্যু। নারীবাদীরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সকল বৈষম্য, অসমতা, আধিপত্য ও বঞ্চনা দূর করে একটি ন্যায়সম্মত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। তারা জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সকল বিষয়কে নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পৃক্ত করে সচেষ্ট। 

১৯৯৫ সালে বেইজিং কনফারেন্সের স্লোগান অনুসারে, নারীবাদীরা মনে করে ‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’।

যেহেতু সকল ইস্যুই নারীদের ইস্যু, সব বিষয়েই নারীদের নিজস্ব মতামত থাকা উচিৎ, হোক সেটা পরমাণু যুদ্ধ, দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ, সাংস্কৃতিক সংঘাত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং উন্নয়নমূলক নীতি, মানবাধিকার এবং নাগরিক স্বাধীনতা কিংবা পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়। সত্যিকার অর্থে, সীমিত মানব সমপদ সত্ত্বেও এবং অন্যান্য সম্পদের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও নারী সংগঠনগুলো ইতোমধ্যেই এ ধরণের কাজে জড়িত হয়েছে। 

শ্রীলঙ্কায় নারীরা সক্রিয়ভাবে উপজাতীয় সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চাইছে। পাকিস্তানে নারীরা ধারাবাহিকভাবে এবং খুবই দুঃসাহসিকতার সঙ্গে প্রাচীন নারীবিরোধী আইনগুলোর বিরোধিতা করছে– যেগুলো নারীদের উপর এবং পাকিস্তানী সমাজের উপর ইসলামের নামে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানি নারীরা সামাজিক আইন ও ইসলামী মৌলবাদেরও বিরোধিতা করে আসছে। নেপালে নারীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশে নারীবাদীরা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও রাষ্ট্রের মৌলবাদী আন্দোলন, পরিবেশ বিপর্যয় ও ‘গরিব-বিরোধী’ উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে সংগ্রামে অংশীদার।  

ভারতে নারীরা পরিবেশ রক্ষা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরোধী সংগ্রামসহ অনেক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের দলগুলো নারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও নীতিসমূহের সমালোচনা করে এবন জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অংশগ্রহণ করে। এছাড়াও তারা পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার এবং সামরিকীকরণের বিরুদ্ধেও সংঘবদ্ধ হয়ে কাজ করছে। 

নারীবাদীরা কি ছোট ছোট বিষয়ে অহেতুক উত্তেজনা সৃষ্টি করছে না? যেমনঃ কোনও নারীকে ‘চেয়ারম্যান’ বলাতে ক্ষতি কী? বাস্তবিকপক্ষে আমরা কি সবকিছুতেই পরিবর্তন আনতে পারবো?

আমাদের বৃহত্তর আন্দোলন ও প্রচারণাগুলো কখনও ভাষাকে প্রধান একটি বিষয় হিসেবে দেখে নি। তবুও আমরা ভাষাকে চ্যালেঞ্জ করায় এবং পরিবর্তনের গুরুত্ব খুঁজে পাই। কেননা, ভাষাও পুরুষতান্ত্রিক।  

আমাদের স্বীকার করতে হবে যে ভাষা ও শব্দ দুটোই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের ভাষাগুলো জেন্ডারভিত্তিক। ভাষাও পুরুষের শ্রেষ্ঠতা ও প্রাধান্য বহন করে। নারীদের হেয় ও বর্জন করে। ধর্ম ও মতাদর্শের মতো ভাষাও পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গি সংরক্ষণের পক্ষপাতী হয়ে থাকে। তবে আমরাই বা কেন এই রকম কিছু মেনে নেবো যা সমাজের আমাদের অস্তিত্ব ও প্রকৃত অবদান কোনোটাই স্বীকার করে না, আমাদের বিরুদ্ধে প্রভেদ সৃষ্টি করে। আমাদের অপমান করে।

আগের দিনে যখন নারীরা প্রকাশ্যে বৃহত্তর অনেক ক্ষেত্রেই প্রবেশ করে নি অর্থাৎ যখন সভা পরিচালন, খেলাধুলা সাংবাদিকতা বা অন্যান্য ধরণের পেশা গ্রহণ করে নি, যখন কোনো নারী ‘বৈজ্ঞানিক বা ধর্মতাত্ত্বিক ছিল না, তখন চেয়ারম্যান স্পোর্টসম্যান , মিডিয়াম্যান এই ধরণের ভাষা বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করতো। 

ভাষার এই দৃষ্টিভঙ্গি এখন সেকেলে হয়ে গেছে, কারণ সামাজিক বাস্তবতাও পালটে গেছে। এখন নারীরাও সক্রিয়ভাবে এ ধরণের কাজ করছে। এসব কাজে নারীদের বেশি মাত্রায় পাওয়া যাচ্ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে চেয়ারপার্সন, স্পোর্টস-পার্সন, মিডিয়া পার্সন, নারী ইত্যাদি শব্দগুলো না আসার কোনও কারণ নেই। 

নারীদের প্রতি ভাষাগত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য খুব বেশি প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এই শব্দগুলো ব্যবহার করা এবং শব্দকোষের অংশ করে তোলার জন্য প্রয়োজন কেবল সচেতন প্রচেষ্টার। অবশ্য ঠাট্টার ছলে আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে, আমরা ‘নরখাদক’ ও ‘ম্যানহোল’ এর মতো শব্দগুলো পরিবর্তন করার উপর জোর দেবো না!

নারীবাদীরা কি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে নয়? আর তারা কি শান্তিপূর্ণ সংসার ধ্বংস করছে না? 

আমরা কোনো দেশের এমন কোনো নারীবাদী সম্পর্কে জানি না যিনি বলেছেন তিনি বিয়ে এবং পরিবারের বিরুদ্ধে। তবে আমরা এমন অনেককেই জানি যারা অসুখি, অসম, অন্যায্য বিয়ে এবং সংসারের বিরুদ্ধে। অনেক নারীবাদী  বাস্তবিকভাবেই সংসার ধ্বংস করতে পারে (শান্তিপূর্ণ দিকটির প্রতি আমরা পরে মনোযোগ দেব)। তবে তা শুধু সেভাবেই যেভাবে হরিজনরা একটি ‘শান্তিপূর্ণ সম্প্রদায়’ ধ্বংস করে, যখন তারা অবমাননাকর কিছু গ্রহণ করতে অসম্মত হয়। অথবা কৃষক/শ্রমিকরা যখন কোন জমিদার/শিল্পপতির সামনে দাঁড়িয়ে আপোষহীনভাবে ন্যায় বিচার চায়। 


একজনের শান্তি অন্য ব্যক্তির অশান্তির কারণ হতে পারে। নারীদের জন্য এটা কি অন্যায় যদি সে গৃহের অভ্যন্তরের নিপীড়ন সম্পর্কে নীরবতা ভাঙে?

যদি কোনও নারী তার গুরুত্বহীন জীবন, কঠোর পরিশ্রম, যান্ত্রিকতা ও একঘেয়ে গৃহকর্ম এবং প্রতি বছর সন্তান প্রসব ইত্যাদিতে বিরক্ত হয় এবং প্রতিবাদ করে, তাকে কি ‘সংসার বিধ্বংসী’ বলা যায়? যে নারী তার স্বামীর ছায়া হতে চায় না, যে শুধুমাত্র তার স্বামীর ইচ্ছাগুলোর প্রতিধ্বনি করে না, সে তার জীবনের বাকি সময় স্বামীর ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অথবা শুধুমাত্র স্বামীর আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে অস্বীকার করে, তাকে কি আমরা সমস্যা সৃষ্টিকারী বলতে পারি? 

যে নারী তার নিজের জন্যেও বাঁচতে চায়, যার নিজস্ব স্বপ্ন এবং লক্ষ্য আছে, যে একজন আদর্শ, বাধ্য অবরুদ্ধ স্ত্রী হতে চায় না, সে কি সংসার নষ্টকারী? প্রকৃত বিচারে, এসব ক্ষেত্রে পুরুষই কি ‘সংসার ধ্বংসকারী’ নয়? 

যদি কোনো নারী সম্মানজনক আচরণ চায়, তার পরিবার ও তার স্বামী যদি তা না দেয়, তবে নিশ্চয়ই নারীদের উপর গৃহের শান্তি নষ্ট করার দোষ চাপিয়ে অন্যদের উপরে চাপানো উচিত। 

নারীবাদীরা ( যারা সম্মান ও মর্যাদা চায়) মনে করে, সংসারে অশান্তি থাকলে  ভালো থাকা যায় না। কারণ, বেশির ভাগ সংসারে ‘শান্তিপূর্ণতা’ হচ্ছে একটি ঘরের সামনের ছবি, যার পেছনে অনেক নারীর অনুভুতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আবেগ এবং স্বপ্ন বিধ্বস্ত অবস্থায় থাকে। 

যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা এই ধরণের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বিরাজ করে। যতক্ষণ পর্যন্ত নারীরা পুরুষদেরকে ঘরের কাজে সহায়তা করতে বলে না, রাতের বেলা জেগে-ওঠা ক্রন্দনরত শিশুর পরিচর্যা করতে বলে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে শান্তি বজায় থাকে। যখনই নারীরা সমতা এবং ন্যায় বিচার চাইতে শুরু করে, তখনই সমস্যার শুরু হয়। যখন নারীরা যন্ত্রণা, অপমান আর হতাশায় ক্রুদ্ধ হতে শুরু করে এবং যখন তারা তা প্রকাশ করতে শুরু করে, তখনই শান্তি নষ্ট হতে থাকে। আর তাদেরকে এই ধরণের মন্তব্য শুনতে হয় যে ‘সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই ধরণের অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হতেই কি আমি ঘরে ফিরে আসি?’ 

একজন নারীকে
তখনই নারীবাদী বলা হয়
প্রতি মুহূর্তে সে যখন
পাপোশের মতো ব্যবহৃত হতে চায় না। 

আসুন আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গৃহের দিকে আরেকটু গভীরভাবে দৃষ্টি দিই। 

পরিবারের মধ্যে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, চাপা উত্তেজনা ও অত্যাচারের প্রচুর নজির আছে। সমাজের সকল স্তরেই অসংখ্য পরিবারের স্ত্রীরা চোখ রাঙানি, নির্যাতন এবং অপমানের শিকার। দক্ষিণ এশিয়ার হাজার হাজার পরিবারে মেয়ে শিশুর জন্মকেই অশুভ লক্ষণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের মধ্যে মেয়ে ও শিশু হত্যার অপরাধ ঘটে চলেছে। এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে, ভারতীয়রা নারী ভ্রুণ হত্যাও ঘটাচ্ছে। অনেক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ছেলে শিশুদের তুলনায় মেয়ে শিশুদের কম সময় বুকের দুধ খাওয়ানো হয়, কম খাবার দেওয়া হয় এবং কম চিকিৎসা প্রদান করা হয়। 

নারীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রয়োজনগুলোর প্রতি খুব সামান্যই নজর দেয়া হয়। প্রতি বছর দক্ষিণ এশিয়ায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাজার হাজার অল্পবয়সী নারী মৃত্যুবরণ করে।
নারীদের বিরুদ্ধে এই সকল অবহেলা এবং নির্যাতনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার-সমতার হার ভয়ংকর রকমের কম। পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন, অবহেলা, বৈষম্যের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার ৭৪ মিলিয়ন নারীর হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। এটা কি নারীদের শান্তির উদাহরণ? 

নববধুদেরকে অপর্যাপ্ত যৌতুকের জন্য পুড়িয়ে মারা হয়, তালাক দেয়া হয় অথবা আত্মীয়স্বজনরা তাদের শারীরিকভাবে আহত, হত্যা করে। এটাও কি নারীর শান্তিপূর্ণ জীবনের নমুনা?

নারীবাদীদের মাধ্যমে নয় বরং আমাদের সরকার আর জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনগুলো থেকে সংগৃহীত পরিসংখ্যানের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই, পরিবারই সম্ভবত নারী শিশুদের জন্য সবচাইতে অনিরাপদ স্থান! 

দ্বন্দ্ব ও অবিচারে পূর্ণ পরিবারগুলোর ঘোমটা সরিয়ে দিয়ে নারীবাদীরা চেষ্টা করছে পরিবারের সুখ শান্তি প্রতিষ্ঠার। 

একজন ডাক্তার যিনি আমাদের দেহের অসুস্থতা সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেন, তাকে নিশ্চয়ই আমরা শত্রু বলে অভিহিত করতে পারি না। আমরা সেই ডাক্তারের কাছেই যাই যে ডাক্তার রোগ নির্ণয়ে দক্ষ। ঠিক তেমনই নারীবাদীদের সাহস, সরলতা এবং আমাদের পরিবারের সুস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন করার জন্য আমাদের উচিত তাদেরকে অভিনন্দিত করা।

যারা যে কোনও মূল্যে প্রচলিত অন্যায়ভিত্তিক শান্তিকে টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের তুলনা করা যেতে পারে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সঙ্গে যারা বর্ণপ্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় এবং ভারতীয় গ্রামগুলোর তথাকথিত সংহতি সংরক্ষণ করতে চায়; অথবা জমিদারদের সঙ্গে যারা দাসত্বমূলক শ্রমিকপ্রথা বজায় রাখতে চায়। 

এটা কি ন্যাক্কারজনক নয় যে, মেয়েদের কথা উঠলেই প্রগতিশীল লোকেরা ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যাকুল হন?

কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি কোনও ব্যবস্থার পরিবর্তন চাইলে এবং পরিবর্তন আনলে তারা ঐতিহ্য বিনাশের দায়ে অভিযুক্ত হয়। সংসার ধ্বংস করার জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাই কি দায়ী নয়? যখন অধিকাংশ নারীবাদীই সংসার ও পরিবারের বিরুদ্ধে নয় তখন আমরা উভয়কে রক্ষা করার একটি মাত্র পথ হিসাবে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন পাল্টানোর জন্য কাজ করার অবস্থান নিতে পারি। 

নারীদের ক্ষতি সাধন করে সংসারের শান্তি ও সামঞ্জস্য আর রক্ষা করা যাবে না। 

আমরা পরিবারের ভেতর পুরুষদের একনায়কতন্ত্র মেনে নিয়ে পরিবারের বাইরে গণতন্ত্র সম্পর্কে বড় বড় কথা বলতে পারি না। 

আমরা প্রকৃত পক্ষে বিশ্বাস করি যে, গণতন্ত্র, নারী-পুরুষের সমতা সমাজে সত্যিকার অর্থে তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা আমাদের পরিবারগুলোতে গণতন্ত্র, সমতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা করতে পারবো।সমাজের সত্যিকারের শান্তি কেবল তখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে, যখন আমরা পরিবারে শান্তি অভিজ্ঞতা লাভ করবো। 

অনেক নারীবাদিই মনে করেন যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগত মনোনয়ন ও পছন্দের ভিত্তিতে পরিবার, বিয়ে এবং পার্টনারশিপের বিভিন্ন ধরণ হতে পারে।  হেটারোসেক্সুয়াল কার্যকলাপ এবং বিয়ে হচ্ছে একট ধরণ এবং হোমোসেক্সুয়াল পরিবার এবং বিয়ে হচ্ছে আরেক ধরণ।  

কেউ ইচ্ছা করলে বিয়ে না করেও একসঙ্গে বসবাস করতে পারে আবার কয়েকজন মিলে একট সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারে, যেখানে তারা পারিবারিক দায়িত্ব ও ধনসম্পত্তি সমভাবে ভাগ করে নিতে পারবে। 

নারীবাদীরা কী মাতৃত্ববিরোধী? 

 এ ধরণের প্রশ্ন কেন? মাঝে মাঝে আমাদের এমন সব প্রশ্ন করা হয় এবং নারীবাদীদের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ করা হয় যা খুবই বিরক্তিকর। এই ধরণের প্রশ্নগুলো বারবার নারীবাদীদের অস্বস্তিকর অবসথায় ফেলে দেয়।

সুস্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন যে নারীবাদীরা সন্তান গ্রহণের বিরুদ্ধে নয়। তবে মাতৃত্বকে প্রত্যেক নারীর একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে আমরা গণ্য করতে পারি না। নারীত্বকে মাতৃত্বের সমকক্ষ বলেও আমরা মনে করি না। 

আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেক নারীর সন্তান নেয়া বা না নেয়ার ব্যাপারে তার নিজস্ব পছন্দ থাকা উচিত। বর্তমানে আমাদের অনেক দেশেই আইনগত সামাজিক অথবা মনস্তাত্ত্বিক কোনোভাবেই এই ধরণের পছন্দ করার সুযোগ নেই। অতএব নারীরা যাতে তাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, পছন্দ-অপছন্দের মূল্য দিতে পারে, সেই জন্য আমাদের সংগ্রাম। 

এছাড়া আমরা মনে করি, যদিও একজন নারীই একটি সন্তান ধারণ করতে পারে, কিন্তু যে কেউ (পুরুষও হতে পারে) সে শিশুকে লালন-পালন করতে পারে এবং তাকে মায়ের স্নেহ দিতে পারে। 

মাতৃত্ব বলতে কেবল শারীরিকভাবে সন্তান জন্ম দেয়াকেই বোঝায় না। এর অর্থ আরেকজন মানব সন্তানের দেখাশোনা, সেবা এবং তত্ত্বাবধান করা। এর অর্থ আরেকজন ব্যক্তিকে শারীরিকভাবে, আবেগ দিয়ে এবং মানসিকভাবে বুদ্ধিপ্রাপ্ত হতে সাহায্য করা। 

 এ ধরণের মাতৃত্ব যে কারও হতে পারে। শুধুমাত্র যে নারী সন্তান জন্ম দেবে, অপরিহার্যভাবে তার দ্বারাই হতে হবে তা নয়। এমন অনেক নারী আছেন যারা সন্তান জন্ম দিতে পারেন নি কিন্তু তারা চমৎকার মা। এমন অনেক নারীও আছেন যারা সন্তানের জন্ম দিলেও মা হিসেবে ভালো নন, এমনকি সহিংসও। 

যাই হোক, বেশিরভাগ নারীই মাতৃত্বকে তাদের নিয়তি হিসাবে দেখে থাকে। তবে তা বিকল্পের অভাব এবং মাতৃত্বের গৌরববোধ এই উভয় কারণেই। নারীরা তাদের ত্যাগ স্বীকার, কষ্ট স্বীকার এবং অন্যের জন্য বাঁচার যে ইচ্ছা সে কারণে প্রশংসিত হয়ে থাকে। এটি নারীর জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ হয়ে আছে। এই ধরণের গৌরব আরোপ হচ্ছে তেতো ঔষধের উপর চিনির প্রলেপ মেশানোর মতো। নারীরা বংশপরম্পরায় এই চিনির দানার মোহে পড়ে আছে এবং তারা এমন ভূমিকা পালন করেছে যা তাদেরকে অবরুদ্ধ করেছে, তাদের শ্বাসরোধ করেছে এবং তাদেরকে গতিহীন করেছে। 

নারীদের সন্তান দেখাশোনার জন্য বিশেষ অঙ্গ নেই বা এমন বিশেষ গ্রন্থিও নেই যা ভালোবাসা ও যত্ন উৎপাদন করে। 

যদি একজন নারী রাঁধতে পারে
তবে একজন পুরুষও তা পারবে
কারণ
নারী তার জরায়ুর সাহায্যে রান্না করে না!

সত্যিই যদি এ পৃথিবী মাতৃত্ব, ত্যাগ স্বীকার, অন্যের সেবা করা এবং অন্যের জন্য বেঁচে থাকতে সব কাজের মধ্যে সবচেয়ে মহৎ বলে গণ্য করতো (যদি এর জন্য তুমি নোবেল পুরস্কার পেতে) তবে পুরুষরা কখনও নারীদের এক্ষেত্রে একচেটিয়াভাবে কর্তৃত্ব করতে দিত না।

মাতৃত্বের প্রশংসা পুরুষরা ঠিকই করে, কিন্তু নিজেরা এর অনুশীলন করতে অনিচ্ছুক। 

বস্তুত অন্যের জন্য আমাদের জীবন উৎসর্গ করাটা যদি সকল কাজের চেয়ে উৎকৃষ্ট হয়, তবে আমরা নারীরা নিঃস্বার্থভাবে পুরুষদেরকে মাতৃত্ব, অংশীদারিত্ব এবং যত্ন গ্রহণের সুযোগ দিতে পারি। 

মায়ের ক্ষমতা ও যোগ্যতা অপরিহার্যভাবে প্রাকৃতিক নয়, কাজেই শারীরিকভাবেও নির্ধারিত নয়। 

পুরুষরাও মা হতে পারেন এবং অনেক পুরুষ তা করেনও। মহাত্ম গান্ধী সম্ভবত বলেছিলেন যে, তিনি নিজেকে একজন ভালো মানবসন্তান হিসেবে তখনই মনে করবেন যখন তিনি মাতৃসুলভ গুণাবলি অর্জন করতে পারবেন। আমাদের মতে, পুরুষতান্ত্রিক যে সকল নিকৃষ্টতম কাজ করেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, নারী ও পুরুষ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, আবেগময়তা ও যুক্তিশীলতার মাঝে অপ্রয়োজনীয় বিভেদ সৃষ্টি করা। পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুঁজিবাদ পুরুষদের সন্তান লালন-পালন ও দেখাশোনার দায়িত্ব অস্বীকার করে। যার ফলে অধিকাংশ পুরুষ কঠোর, কর্কশ, অসংবেদনশীল এবং অযত্নশীল হয়ে পড়ে। 

অনেক নারীবাদীই এটা বিশ্বাস করে যে, প্রত্যেকেই ভদ্র কিন্তু বলিষ্ঠ সেবাপরায়ণ, ত্যাগী, অনুভুতিপ্রবণ এবং যুক্তিবাদী হতে পারে এবং হওয়া উচিত। 

থেকে আরও পড়ুন

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।