সাম্য যেভাবে হারিয়ে গেলো

kim sterelny
কিম স্টেরেলনি

আমরা যে সমাজে বাস করি, প্রায় সবক্ষেত্রেই সমাজটি বৈষম্যপূর্ণ। সমাজের ছোট একটি অংশের কাছে অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ও সম্পত্তি কুক্ষিগত হয়ে আছে। আর যারা বঞ্চিত হয়েছে তাদের কারও কাছেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, সমাজে একটি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা গেলে সকলেই যার যার অবস্থান থেকে অংশগ্রহণমূলক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে। কিন্তু, যখন কেউ নিজের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দখল করে, তখনই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। সমাজে বিদ্যমান এ বৈষম্য নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। 

আমাদের মধ্যে অভিজাত অংশটি অন্যদের তুলনায় সংখ্যায় এতোটাই কম যে এ সমাজকে পাঠ করে বৈষম্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটাই দুরূহ। কোথা থেকে এ বৈষম্যের শুরুটা হলো, তা বোঝার ক্ষেত্রে শুধু বর্তমান সমাজব্যবস্থা পর্যালোচনা করে উত্তর খোঁজাটা প্রায় অসম্ভব। কেননা, মানব জাতি আলাদা একটি প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আজ প্রায় তিন লাখ বছর। এর মধ্যে দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরেই আমরা বৈষয়িকভাবে বেশ দরিদ্র ছিলাম কিন্তু সে সময় জুড়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হবার প্রায় পুরো সময় জুড়েই আমরা খাবারের খোঁজে যাযাবর জীবন যাপন করেছি। এক জায়গায় খাবারের অভাব দেখা দিলে পুরনো আবাস ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছি। যদিও একই বিশাল অঞ্চল জুড়ে মানুষের যাযাবর গোষ্ঠীগুলো ঘুরপাক খেয়েছে।  

যাযাবর এ দলগুলোর একেকটিতে দশ থেকে একশো’ জন পর্যন্ত সদস্য থাকতো এবং ধারেকাছের অন্যান্য যাবাবর দলগুলোও কোন না কোনভাবে একে অপরের আত্মীয় ছিল। এভাবে একেকটি অঞ্চলে কয়েক শত বা কয়েক হাজার সদস্য নিয়ে একেকটি যাযাবর গোষ্ঠী বিরাজ করতো যারা আবার বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খাবার সংগ্রহ করতো। বহু ক্ষেত্রেই, একটি যাযাবর গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতো, তারা ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতো। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে চড়ে বেড়ানো মানুষের সাথে সুমেরু অঞ্চলে বাস করা মানুষগুলোর মিল সম্ভবত খুব অল্পই ছিল। আর সম্ভবত দুটো গোষ্ঠীই আবার কঙ্গো অববাহিকার মানুষগুলোর চেয়ে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের সামাজিক জীবন যাপনের ধরণে মিল ছিল। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অবশ্যই বয়োবৃদ্ধ ও তরুণ সদস্য ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে দলপতি বা নেতার ধারণা ছিল না। দলের যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে আদেশ দেবার বা অধীনস্থ করে রাখার এখতিয়ার কারোরই ছিল না। লিঙ্গভেদে অবশ্য এ সম্পর্কের তারতম্য ছিল, কিন্তু অনেক যাযাবর সমাজে নারীর অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। নারীরা ছিল দক্ষ, স্বাধীন এবং দলের এগিয়ে চলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নারীরা গাছের ফল, সবজী ও ছোট শিকার সংগ্রহ করতো এবং নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জামগুলো নিজেরাই বানিয়ে নিতো। সামাজিকতা ও যৌনতার ক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারতো যার উপর পুরুষদেরও নির্ভর করতে হতো।

কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার চাইতে যাযাবার সমাজে শিশু ও কিশোররা তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পেতো এবং বিভিন্ন বয়সের বন্ধুদের সাথে বড় হয়ে নিজে নিজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও বেঁচে থাকার শিক্ষা অর্জন করতো। মার্কিন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ মার্শাল শালিন্স তার লেখা ‘দি অরিজিনাল অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি’ (১৯৭২), রচনাটিতে সম্ভবত যাযাবর জীবনের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, তবে এ বিষয়টি ঠিক যে, যাযাবর দলগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ঠিকঠাক ও পর্যাপ্ত পরিমাণেই সংগ্রহ করতে পারতো এবং এ পর্যাপ্ততায় নিজেদের মধ্যে খাবার ও উপকরণ ভাগাভাগি করে নেবার প্রবণতা একটি বড় ভূমিকা রেখেছিলো। যাযাবর গোষ্ঠীগুলো সম্পূর্ণভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মধ্যে ন্যায়ের একটি ধারণা ছিল। কানাডিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রায়ান হাইডেন এ বিষয়ে বলেছেন, প্রতিটি সমাজেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উগ্র মেজাজের লোকজন পাওয়া যায় যারা দলপতি হবার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকে, তবে যাযাবরদের মধ্যে এই প্রবণতাটি কম ছিল।

প্রায় দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরে এমন স্বাধীনতা ভোগ করার পর, নিজেদের উপরে কারও প্রভুত্ব সহ্য না করে এখন আমরা সবাই কোন না কোনভাবে বৈষম্যের শিকার। যদিও সমাজের ক্ষুদ্র শক্তিশালী একটি অভিজাত শ্রেণির ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। আর এটাও সত্য যে বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সুবিধাভোগী এ শ্রেণির অধীনস্থতা বেশিরভাগ লোকেই মেনে নিয়েছে। সমাজের ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণিটির কাছেই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং তারাই সেনাবাহিনী, পুলিশ আর রাষ্ট্রের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কাছ থেকে জোর করে ক্ষমতা কেড়ে নিতে আরও বড় ক্ষমতা থাকা দরকার অথবা অন্য একটি উপায় হতে পারে বিপ্লব। কিন্তু ইতিহাসে সফল বিপ্লবগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবগুলো মূলত একটি সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেকটি অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে আর তার জন্য প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, বিশেষ করে গরীব মানুষ। ফলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা তাদের জীবনের জন্য ভালো বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘মেনে নিতে শেখা’ এবং শোষিত হবার মধ্য দিয়েই যতটা সম্ভব ভালো থাকা যায় বা নিজের উন্নতি কীভাবে করা যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

কোন সমাজই যাযাবর গোষ্ঠী থেকে রাতারাতি অভিজাতদের অধীনস্থ রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়নি, বরং ধীরে ধীরে বৈষম্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাযাবর দলগুলোর মধ্যে আধা-অভিজাত একটি শ্রেণি শক্তিশালী হয়েছে। তবে তখনও তারা রাষ্ট্র বা নিয়মতান্ত্রিক সমাজ গঠন করেনি। ক্রিস্টোফার বোয়েম তার ‘হায়ারারকি ইন দা ফরেস্ট’ ১৯৯৯, ও স্টিফেন পিংকার তার ‘দি বেটার এঞ্জেলস অব আওয়ার নেচার’, ২০১১ রচনাগুলোতে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাক-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সহিংসতা ও বৈষম্য দানা বেঁধে উঠেছে। কিন্তু আইনের ছলনা ও নিয়ম-নীতি বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কীভাবে বৈষম্য সমাজে স্থান করে নিলো?

বর্তমান রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে সামরিক শক্তি দ্বারা যাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ক্ষমতা ভোগ করে এসেছে এবং সামনেও তাদের উত্তরাধিকারেরা এ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। কীভাবে এ শ্রেণিটি সবসময় ক্ষমতায় থাকে তা অবশ্য এ ক্ষমতা বলয়ে প্রবেশ করার পথে হাজারো বৈষম্য ও বাধা দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব। ফলে, এখন প্রশ্ন দাড়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক সমাজের বাইরে গ্রামভিত্তিক সমাজগুলোতে আসলে কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে?  

এ ধরণের গ্রামীণ সমাজে বড় মিয়া (‘বিগ ম্যান’) গোছের কিছু মানুষ থাকে (যেমনটা দেখা যায় নিউ গিনি বা মেলানেশিয়ার গ্রামগুলোতে)। তারা অর্থ ও প্রতিপত্তিতে অন্যদের চেয়ে কিছুটা সম্পদশালী ও গণ্যমান্য। কিন্তু তাদের শাসনপ্রকৃতির মধ্যে কোন অধিকারবোধ নেই, যে কারণে তাদের ক্ষমতা তাদের সন্তানসন্ততিরা পায় না। এ ধরণের সমাজগুলোতেই সাধারণত বৈষম্য দানা বাঁধে। আর যখনই এ ধরণের সমাজ গঠন শুরু হয়, আমরা সমতাভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলো থেকে ধীরে ধীরে বৈষম্যমূলক সমাজের দিকে চলতে শুরু করি যেখানে বৈষম্য আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বৈষম্যই স্বাভাবিকতা।    

যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দুটো পরিবর্তন মূলত পরবর্তীকালে বৈষম্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তার প্রথমটি হচ্ছে ‘গোত্র’ ধারণার আবির্ভাব। গোত্রের ধারণার মধ্যেই নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা ও গোত্রের সবার সাথে সবার একটি অনন্য আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপার আছে যা এক সময় গিয়ে ব্যক্তির পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। গোত্রের ধারণার পর ব্যক্তি নিজেকে বা অন্যকে প্রধানত গোত্রের ভিত্তিতে লেবেল করতে শুরু করে। কোন বিপদে-আপদে সে তার গোত্র থেকেই সহায়তা পায় বা পাওয়ার আশা রাখে। এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদ রেমন্ড সি কেলি তার ‘ওয়ারলেস সোসাইটিস অ্যান্ড দি অরিজিন অব ওয়ার’, ২০০০, এ বলেন, কৃষি এবং কৃষিজাত ফসলের উদ্ধৃত অংশ মজুদ করে রাখার ধারণা তৈরি হবার ফলে ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ ধারণাগুলোর অভাবনীয় বিকাশ ঘটে। এই ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ মজুদ বা সম্পত্তি রক্ষা করতে অধুনা শাসকরা গোত্রের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে এবং বৈষয়িক বিস্তার বাড়াতেও গোত্রকে ব্যবহার করেছে। 

দ্বিতীয় পরিবর্তনটি এসেছে তথ্য ও জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার মধ্য দিয়ে। প্রাচীন সম্পত্তি ও ক্ষমতার বাইরেও যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান থাকতো তাদের মধ্যেও সম্মানবোধ এবং নিজেকে উচ্চতর ভাবার প্রবণতা জেগে ওঠে। এর পেছনে ছিল সে সময়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও কৌশল। যাযাবর জীবনযাত্রায় দিগনির্ণয়, শিকারের পায়ের ছাপ বা চিহ্ন বুঝতে পারা, গাছ চিনতে পারা, পশুপাখির বৈশিষ্ট্য ও ভাষা বুঝতে পারা, শৈল্পিক গুণাবলী, অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরিসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বেঁচে থাকার জন্য অত্যাধিক প্রয়োজনীয় ছিল। যারা এসব বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং তাদের জ্ঞান দিয়ে অন্যদের সহায়তা করতো বা দলের জন্য বড় শিকার ধরতে ভূমিকা রাখতো তারা আলাদাভাবে দলীয় সম্মান পেতে শুরু করে। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জোসেফ হেনরিখ তার রচনা ‘দি সিক্রেট অব আওয়ার সাকসেস’, ২০১৫, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ জেরোমি লুইস দেখিয়েছেন, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি শুধু বেঁচে থাকার বিদ্যা নয়, গান কবিতা বা গল্প বলতে পারা অথবা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জ্ঞানের ক্ষেত্রেও কাজ করে। এ অনুষ্ঠানগুলো শুধু বিনোদন বা কৃত্যের জন্যই করা হতো এমনটি নাও হতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি দিগনির্ণয়, গাছ চেনা বা শিকারের কোন নির্দিষ্ট কৌশল হয়তো নিয়মিত ব্যবহৃত হয় না কিন্তু তা মনে রাখা অথবা অভ্যাসে রাখার জন্যও অনুষ্ঠান বা গানকে একটি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অস্ট্রেলিয়ার অবোরিজিনালদের গানের বাক্যে এমন শিক্ষামাধ্যমের উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়, আর শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, এর বাইরেও এই মতটি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন লেইন কেলি। তার ‘নলেজ অ্যান্ড পাওয়ার ইন প্রিহিস্টোরিক সোসাইটিস’, ২০১৫, রচনায় তিনি এ বিষয়ক বহু উদাহরণ তুলে ধরেছেন। অনুষ্ঠান বা গানে শুধু বেঁচে থাকার শিক্ষাই নয়, ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত উপাদানের চর্চাও ছিল।

এভাবে সাম্যভিত্তিক সমাজকাঠামোতে দুটি বৈষম্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এবং প্রায় ১০ হাজার বছর আগে কৃষি ও শস্যের মজুদের মাধ্যমে বৈষম্যের ভিত্তিগুলো আরও মজবুত হতে থাকে যখন যাযাবর দলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট স্থানে থিতু হতে শুরু করে। অনেক যাযাবর দল তাদের শস্যের বা খাদ্যের মজুদকে ঘিরে বসবাস করতে শুরু করে। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিকারী ও জেলে সম্প্রদায় স্যামন মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক উপকরণ পাওয়া যায় এমন জায়গাগুলো বেছে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। তাছাড়া সমসাময়িক সময়ে ইউরোপের হিমবাহ অঞ্চলের বাসিন্দারা সেখানে প্রাপ্ত শিকার শুকিয়ে বা জমা করে তার আশেপাশেই বসবাস শুরু করে দিয়েছে – এমনটা হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী আবাস তৈরি করার মূল কারণ হলো কৃষি বিপ্লব এবং নতুন হলোসিন জলবায়ু (খ্রি. পূ. ৯৭০০ সালে সর্বশেষ হিমযুগের সমাপ্তি পরবর্তী জলবায়ু)।

কেবল কয়েকটি শস্য জাতীয় প্রজাতির আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই কৃষি বিপ্লব সম্ভব হয়নি, শস্য ফলানোর আবহাওয়া বিষয়ক জ্ঞান অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছিলো। হলোসিন শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে আবহাওয়া আগের চেয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র হতে শুরু করেছিলো, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল হলোসিন জলবায়ুর স্থিতিশীলতা। বছর ঘুরে একই ঋতু বার বার ফিরতে শুরু করেছিল এবং মানুষ তখন ঋতু ও আবহাওয়া অনুমান করতে শুরু করে। অ্যাবোরিজিনাল অস্ট্রেলিয়াতে কৃষি বিকশিত হয়নি। আর পেছনের মূল কারণ ছিল একেক বছরে একেক ঋতুর আগমন, জলবায়ুর কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিল না। সে অবস্থায় কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া আত্মহত্যার শামিল। কৃষি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, এর ফলাফল আর প্রভাব ছিল বিশাল। কৃষির মধ্যে দিয়ে জমির মালিকানার ধারণা তৈরি হলো, মজুদ ব্যবস্থার বিকাশের ফলে লোকে তখন আর উদ্বৃত খাদ্য ভাগাভাগি করে দেবার চাইতে মজুদ করে রাখার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করলো। এর সাথে শুরু হলো শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, ধনী-দরিদ্র, গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিভেদে সামাজিক মর্যাদার তারতম্য।

প্রথমত, মজুদের কথাই ধরা যাক। যাযাবর দলগুলোর জন্য খাবার ভাগাভাগি করে নেওয়াটা ছিল এক ধরণের বীমা বা ইন্সুরেন্সের মত সামাজিক সুরক্ষা। শিকার করার পুরো ব্যাপারটাই ছিল বেশ ভাগ্যনির্ভর। কোন দিন ভাগ্যের জেরে কেউ বড় শিকার পেতো, অন্যদিন সে হয়তো কিছুই পেতো না। ফলে আজ যার ভাগ্য ভালো ছিল সে তার খাবার অন্যদের ভাগ করে দিলে, যেদিন তার শিকারে কিছুই জুটতো না সেদিন সে অন্যদের কাছ থেকে খাবারের ভাগ পেতো। ছোট ছোট ফল বা ছোট প্রাণীর শিকারের ক্ষেত্রে ভাগ্য হয়তো অতোটা জরুরি ছিল না এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেসব পাওয়া যেতো তবু এসব ক্ষেত্রেও ভাগাভাগি করে খাবার রীতি ছিল। কারণ কে কী শিকার করছে বা পেয়েছে তা গোপন রাখা কষ্টকর ছিল আর এই ভাগ করে নেবার মধ্য দিয়ে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্পর্ক গড়ে উঠতো।

মজুদ ব্যবস্থা শুরু হবার পর থেকে মানুষের সামাজিক ইন্সুরেন্সের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, নতুন ইন্সুরেন্স হয়ে দাঁড়ালো তার নিজের শস্যের মজুদ। ফলে উদ্বৃত খাবার বিলিয়ে দেবার বদলে মানুষ তা মজুদ করতে শুরু করে। না খেয়ে থাকার ঝুঁকির মধ্যে দূর্ভিক্ষ, খরা, অতিবৃষ্টির মত বিষয়গুলো ছিল কিন্তু এসব দুর্যোগ শুধু একজন ব্যক্তির উপর এসে হাজির হয় না, তার সমাজের প্রত্যেকের উপরই এসে পড়ে। ফলে, যাযাবর সমাজের মত খাবার ভাগ করে না খেয়ে থাকার ঝুঁকি থেকে বাঁচার কোন সুরক্ষা কৃষিভিত্তিক সমাজে ছিল না। কৃষিভিত্তিক সমাজে যদি কারো ফলন ভালো আর অন্যজনের খারাপ হতো, তাহলে হয়তো ভাগাভাগির একটি সম্ভাবনা দেখা দিতো। কিন্তু এ ব্যবস্থায় যখন ফলন ভালো হয় তখন সবার ভালো হয়, যখন খারাপ হয় তখন সবারই খারাপ হয়। ফলে একে অন্যকে আর আগের মত প্রয়োজন হয় না।

কৃষি ব্যবস্থা খুবই শ্রম ও সময়সাপেক্ষ একটি পদ্ধতি যেখানে ফলাফল খুবই অল্প। প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক দলগুলো কোন সমৃদ্ধ সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলো এমনটা প্রমাণ মেলে না। কৃষির জন্য বন পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হতো, এরপর সেখানে চাষ করা, বীজ বোনা, আগাছা-পোকা-ইঁদুর-পাখি তাড়ানো, জমি রক্ষা করা, ক্ষেত্রবিশেষে সেচ দেওয়াসহ বছরের পর বছর নিয়মিতভাবে ব্যয় করতে হতো কৃষি জমির পেছনে। এতোকিছুর পর জমি সে জমি ‘নিজের’ বলে গণ্য না হয় অথবা জমির মালিকানার বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্টা না হয় তাহলে তা কৃষকের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, কৃষকের সন্তানরা ছোটবেলা থেকে তাদের বাবা মায়ের জমিতে পরিশ্রম কেনই বা করবে, যদি না উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সে জমির মালিকানা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে! ফলে শস্যভিত্তিক মজুদ ব্যবস্থা এমন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করলো যাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল পারিবারিক কৃষি উপার্জন। পারিবারিক এ উত্তরাধিকারের ধারাই পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চর্চিত হয়ে বৈষম্য বাড়িয়েছে। শুধু সন্তান কম বা বেশি থাকার কারণেই কোন পরিবারের সম্পত্তি বেশি করে ভাগ হয়েছে, তো কোন পরিবারে সম্পত্তি ভাগাভাগি কম করতে হয়েছে। আবার কোন পরিবার কৃষি কাজের জন্য শ্রম দেবার সন্তান বেশি পেয়েছে, কোন পরিবার কম পেয়েছে। আর সম্পত্তির বৈষম্য সমাজে শুরু হলে তা কখনো কমানো সম্ভব হয়। এর পেছনে স্বাভাবিক যুক্তি যে, অধিক সম্পদশালী পরিবার তার অধিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পত্তি যে হারে বাড়ায়, দরিদ্র পরিবারের ক্ষমতা ও সম্পদ কম থাকার কারণে তারা সে হারে বাড়ে না। ফলে ধনী আরও ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। 

মজুদ ব্যবস্থার ফলে জোরপূর্বক শ্রম শোষণের পথ খুলে যায়। যাযাবর সমাজে মানুষ একটি বড় এলাকা জুড়ে শিকার ও উদ্ভিজ্জ আহারের খোঁজে ঘুরে বেড়াতো। তিন-চারজনের একেকটি দল সকালে বেরিয়ে পড়তো এবং দিনের আলো থাকতে ফিরে আসা যায় এমন দূরত্ব পর্যন্ত গিয়ে শিকারের খোঁজ করতো। তিন চারজনের দল করার একটি উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব বড় এলাকা জুড়ে দলের সবাই মিলে ছড়িয়ে পড়ে শিকারের খোঁজ করা। ফলে তাদের জীবন যাপনের দৈনন্দিন ভৌগলিক বিস্তৃতি কৃষিভিত্তিক সমাজের চাইতে শতগুণ বড় ছিল। এ বিশাল মুক্তাঞ্চলে কাওকে দাস বানানো সম্ভব না, কারণ দাস পালিয়ে যাবে। আর দাসদের বন্দী করে রাখার জন্য ঠিক সে পরিমাণেই পাহাড়াদার নিয়োগ করতে হবে – যা একটি অসম্ভব ব্যপার ছিল। অন্যদিকে কৃষি ব্যবস্থায় অল্প বিস্তৃত কৃষি জমিতে কাওকে জোরপূর্বক কাজ করতে বাধ্য করা খুবই সহজ, তাকে আটকে রাখাও সহজ। তাছাড়া কৃষিব্যবস্থা শিকারের চাইতে অনেক বেশি ক্লান্তিকর। ধনুর্বিদ্যা যেভাবে অলিম্পিকের অংশ হয়েছে, সেভাবে লাঙল টানা বা আগাছা দমন সম্ভবত কখনো অলিম্পিকে খেলা হবে না। প্রাক-কৃষি যুগে শ্রমিক পাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভব না হলে কাজের চাপ নারী ও শিশুদের উপরই বেশি পড়তো, যেহেতু তাদের বাধা দানের ক্ষমতা কম ছিল। শস্যভিত্তিক মজুদদারিতে মানুষের স্বাধীনতা কমে গিয়েছিল, বেড়েছিলো শোষণ।

এ ব্যবস্থায় আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের মাত্রা বেড়েছে। যাযাবর সমাজে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক আছে। একটি মতে, প্লাইস্টোসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শেষের দিক পর্যন্ত যাযাবর সমাজে অনেক সংঘাত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েল বোলস ও হারবার্ট গিন্টিস তাদের বই ‘এ কো-অপারেটিভ স্পিসিস’, ২০১১, তে এসব সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এমন কোন সংঘাত নিয়ে প্লাইস্টোসিন যুগের শেষপর্যন্ত একটিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে যাযাবর একটি দলকে আক্রমণ করার কাজটি ছিল কঠিন এবং আক্রমণ করার পেছনে কোন যুক্তি অন্য যাযাবর দলের ছিল না। দলের বাইরের কারও পক্ষে সে দলের অবস্থান জানাটাই ছিল কঠিন, যেহেতু দলটি প্রতিনিয়তই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতো। তাছাড়া একটি দলকে আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার মত সম্পত্তি বা মজুদ তখন ছিল না। প্রতিটি দলই তাদের নিজস্ব এলাকা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতো, তাদের এলাকায় গিয়ে তাদের না জানিয়ে আচমকা আক্রমণ করা সহজ কোন কাজ ছিল না। আর যাযাবরদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো, কেউ কারোর অধীনস্থ ছিল না। ফলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আরেকটি দলের উপর আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। 

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে কৃষক ও খাদ্য সংগ্রাহকদের জন্য এমন সংঘাত খুবই নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবেশীর শস্য ভান্ডার, তার গোয়ালের গৃহপালিত পশুর দল, তার উর্বর জমি, এমনকি শ্রমিক বা উপপত্নী হিসেবে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর লোভ আক্রমণ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রতিবেশীর পরিবার শুধু যে সম্ভাব্য শ্রমিক হবে তা নয়, তাদের দমন করার মধ্য দিয়ে নিজের পরিবারের সুরক্ষাও বাড়তো। সে সময় নাগাদ মৃৎপাত্র, লোহা বা অন্যান্য তৈজসপত্র বা অলঙ্কারের ব্যবহার শুরু হয় যার লোভেও সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংঘাতের ঝুঁকি এ সমাজের একটি চিরায়ত ব্যাপারে পরিণত হয়। আর স্থায়ী এ সমস্যার সমাধান, সালিশ, মধ্যস্থতা, সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব এসে পড়ে সমাজপতিদের ঘাড়ে। ফলে সমাজপতিদেরও একটি আলাদা প্রতিপত্তি ও অধুনা আভিজাত্যের ধারা শুরু হয়।

কৃষি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আগে নারীদের একবার জন্মদানের পর সে সন্তানের পালন ও তাকে বহন করার ব্যস্ততায় আরেকটি সন্তান জন্মদানের মধ্যে একটি বিরতি ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এ বিরতির ব্যাপারটি আর থাকে না। সন্তানকে বহন করে বহুদূর নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও ছিল না। আর খাবারের পরিমাণ, যোগান ও প্রাপ্তি তুলনামূলক সহজ হয়েছিল। যদিও কৃষি খুবই শ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ কিন্তু এ ব্যবস্থায় মানুষের অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্থান থেকে নেমে আসায় খাদ্যের যোগান বেড়েছিলো। সার দেওয়া বা সেচ দেবার মাধ্যমে এ যোগান আরও বাড়ে। যদিও যাযাবর সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ অধিকতর পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য ভোগ করতো, কৃষি আসার পর এ পুষ্টিমান অনেক কমে যায় এবং খাবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যাযাবর সমাজের জনসংখ্যা কম থাকায় সবার সাথে সবার সম্পর্ক ও সামাজিকতার সুযোগ ছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজের আকার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক এ সম্পর্ক দূর্বল হয়ে পড়ে এবং সংঘাত বাড়ে।

শস্য মজুদ করে রাখা সহজ হবার ফলে পরিবারগুলো ভবিষ্যৎ ও দুর্যোগের কথা ভেবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য জমিয়ে রাখে। জমে রাখা এ খাদ্যের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে এ খাদ্য স্থানীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবারের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন পরিবারে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তাদের শস্য ধার দেবার মধ্য দিয়ে তাদের কিছুটা নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে রাখা যায়। এছাড়া অতিরিক্ত খাদ্যের বিনিময়ে পরিবারটি বিলাসবহুল পণ্য বা সেবা কিনতে শুরু করে। শস্যের বিনিময়ে মদ, পশু এমনকি সাজপোষাক বা অলঙ্কারও কেনা সম্ভব হয়। এসব দ্রব্যের বিকিকিনির মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতা, প্রভাব ও ক্ষমতার ব্যবহার।

এভাবে কৃষি, পশুপালন ও মজুদব্যবস্থা বহু ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তার করে সাম্যভিত্তিক সমাজকে পরিবর্তন করে সংঘাতপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে সে মালিকানা নিয়ে অনিরাপত্তাবোধ এবং মালিকানার আকার বৃদ্ধির প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বৃত খাবার স্থানীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, এছাড়া উদ্বৃত খাবারের উপর ভিত্তি করে অভিজাত অভ্যাস যেমন ভোজসভা বা ব্যয়সাপেক্ষ অনুষ্ঠান, ঘটা করে উদযাপন বা লোক দেখানো আভিজাত্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সে পরিবারটির সমাজে আলাদা করে নিজের অবস্থান জাহির করা এবং এসব অনুষ্ঠান সমাজে অন্যান্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

একটি বাড়িতে ঘটা করে উৎসব হলে সে বাড়ির খবর পাশের গ্রাম বা সম্প্রদায়ের কাছে গিয়েও পৌঁছায়। এসব লোক দেখানো উৎসব সেসব গ্রামকে গৃহস্থের প্রভাব প্রতিপত্তি বিষয়ক ধারণা দেয় এবং এক ধরণের বার্তা দেয় – আমি তোমার শত্রু হবার সক্ষমতা রাখি কিন্তু এর পাশাপাশি তুমি আর আমি সমান মর্যাদাবান হওয়ার ফলে আমরা চাইলে একত্রে বাণিজ্য করতে পারি বা বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা জোট গড়ে তুলতে পারি। 

ফলে সে গৃহস্থের উপর বাইরে থেকে আক্রমণের একটি ঝুঁকি তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু ঝুঁকি পাশ কাটিয়ে, যদি বাইরের কোন দল এসে বাণিজ্য করতে চাইলে, অংশীদারিত্ব বা আলোচনা করতে চাইলে সে বিগ ম্যান (বড় মিয়া)-ই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু উৎসব পরিচালনা ও সম্পত্তির মালিক হবার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সমাজেও তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। দেখা যায়, বছর কয়েকের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের বাণিজ্য, বিনিময়, বিবাদ বা অন্য সব সম্পর্কের প্রধান মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হয় সে বড় মিয়া। তার এ ক্ষমতা ও বিনিময়ের প্রতিটি বিষয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে তার ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পলি উইসনারের ২০০২ সালে এ প্রক্রিয়ার উপর একটি দারুণ নিবন্ধ লিখেছিলেন যার নাম ‘দি ভাইন্স অব কমপ্লেক্সিটি’। তিনি পাপুয়া নিউ গিনির কেস স্টাডিতে সমাজ বিবর্তনের রূপগুলো তুলে ধরেছেন। সেখানে একটি বড় গৃহস্থ যদি ১০টি শূকর জবেহ করে গ্রামবাসীকে ভোজ করায়, কয়েক প্রজন্ম পরে সে গৃহস্থের পক্ষেই তখন ২৫০ শূকর জবেহ করে ভোজ উৎসব আয়োজন করার সক্ষমতা তৈরি হয়।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পত্তিকে পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানো, আবার সে ক্ষমতাবলে সম্পত্তি বাড়ানো একটি চাকায় পরিণত হয়। কৃষি পূর্ববর্তী সমাজে কেউ অধিকতর ক্ষমতাবান বা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাকে বাধা দেবার জন্য সামাজিক ঐক্যমত গঠন করা সহজ ছিল। সে সমাজে সকলেই একটি পরিবারের মত বাস করতো এবং গুহা বা আবাসস্থলে নিজেদের মধ্যে কোন দেয়াল পর্যন্ত ছিল না। সবার মতামত বিনিময়ের অবাধ সুযোগ ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এমন অবাধ মেলামেশা বিলুপ্ত হয় এবং পরিবারগুলো আলাদা আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে সবার ঐক্যমতে পৌঁছে শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া সমাজপতিকে তোষণ করে, তার শোষণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া একটি শ্রেণিরও উদ্ভব হয় যাদের উদ্দেশ্য থাকে বড় মিয়ার সকল কার্যক্রমকে বৈধতা দান, সমর্থন করা এবং এর বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করা। এসব কারণে নতুন এ সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন একটি কাজ। 

এ বৈষম্য বজায় রাখার চমৎকার একটি প্রবণতা হলো ক্ষমতার সঙ্গে ধর্মের আঁতাত। হাইডেন তার ‘দি পাওয়ার অব রিচুয়াল ইন প্রিহিস্টোরি’, ২০১৮, নিবন্ধে এ প্রবণতাকে উপস্থাপন করেছেন। সম্প্রদায়ভিত্তিক এ সমাজগুলোর জীবনযাপনের ধারায় ধর্ম একটি বড় প্রভাব বিস্তার করে এবং ধর্মের এ প্রভাবকে সমাজপতিরাও পুঁজি করে। আদিবাসী বিভিন্ন গোত্রে প্রায়শই দেখা যায় বিয়ে করার জন্য কনেকে এক শূকর মূল্য বা এক গরুর মূল্য উপহার দিতে হয়। ফলে বিয়ে করার জন্য দরিদ্র লোকদের হয় সে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হতে হয় অথবা কোন ধনী ব্যক্তির কাছে ধরণা দিতে হয় যে তাকে এক শূকর বা এক গরু পরিমাণ সম্পত্তি ধার দিবে বা দান করবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে ধনী লোকটির প্রতি তার নির্ভরশীলতা ও ঋণগ্রস্থতা তৈরি হয়। এখানে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের মাধ্যমে ধনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারটি ঘটে। অভিজাত শ্রেণি তাই ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন রীতি নিজেদের স্বার্থেই চালু করে এবং তা নিয়মিতভাবে পালন করে। নৃতাত্ত্বিক প্রত্নতত্ত্ববিদ কেন্ট ফ্লানেরি এবং জয়েস মারকুস সলোমন দ্বীপপুঞ্জের একটি কেস স্টাডিতেও এমনটা দেখতে পেয়েছেন। সেখানে তারা একজন ধনী ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন যিনি প্রতিপত্তি বাড়াতে নিজ অর্থায়নে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করেছেন এবং সেখানকার ধর্মীয় আচার পালনকারীরা তার সাথে দেবতার বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছে। 

সমাজে বৈষম্য প্রতিষ্ঠা হবার এ ধারাবাহিকতা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে মূল বিষয় দাঁড়ায় চারটি। প্রথমত, মজুদ করার অর্থনীতি এবং সমাজের গোত্রভিত্তিক জনসংখ্যার বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাযাবর গোষ্ঠীগুলো প্রথমে গোত্রভিত্তিক হয়েছে এবং পরে কৃষি ভিত্তিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় পৌঁছেছে। তৃতীয়ত, সমাজপতি ও ধর্মীয় রীতি-নীতির যোগসাজেশ বৈষম্যভিত্তিক কাঠামো তৈরি করেছে। এবং সর্বশেষ, এ ধরণের সমাজ গড়ে উঠে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দের মধ্য দিয়ে যেখানে সহিংসতা একটি হুমকি কিন্তু মোকাবেলাযোগ্য।

শেষ কথা: সাম্যভিত্তিক সহযোগিতাপূর্ণ মানব সমাজ সৃষ্টি অবশ্যই সম্ভব। বড় পরিসরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির অভ্যাস এবং সবাই মিলে ঐক্যমতে পৌঁছানো মানব প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি মানব জাতির ইতিহাসজুড়ে প্রায় পুরো সময়টাতেই আমরা এভাবেই বাস করে এসেছি। তার মানে এই নয় যে আমরা সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্লাইস্টোসিন যুগের আদিমতা ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু আমাদের কাছে আধুনিক যুগের নতুন সব সামাজিক প্রযুক্তি আছে। চীন যেরকমটা নজির সৃষ্টি করেছে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধনীক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে রাখার মাধ্যমে। আশা রাখি এ প্রযুক্তিগুলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এগিয়ে নিতে এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখবে।

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।