সাম্য যেভাবে হারিয়ে গেলো

kim sterelny
কিম স্টেরেলনি

আমরা যে সমাজে বাস করি, প্রায় সবক্ষেত্রেই সমাজটি বৈষম্যপূর্ণ। সমাজের ছোট একটি অংশের কাছে অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ও সম্পত্তি কুক্ষিগত হয়ে আছে। আর যারা বঞ্চিত হয়েছে তাদের কারও কাছেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, সমাজে একটি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা গেলে সকলেই যার যার অবস্থান থেকে অংশগ্রহণমূলক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে। কিন্তু, যখন কেউ নিজের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দখল করে, তখনই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। সমাজে বিদ্যমান এ বৈষম্য নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। 

আমাদের মধ্যে অভিজাত অংশটি অন্যদের তুলনায় সংখ্যায় এতোটাই কম যে এ সমাজকে পাঠ করে বৈষম্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটাই দুরূহ। কোথা থেকে এ বৈষম্যের শুরুটা হলো, তা বোঝার ক্ষেত্রে শুধু বর্তমান সমাজব্যবস্থা পর্যালোচনা করে উত্তর খোঁজাটা প্রায় অসম্ভব। কেননা, মানব জাতি আলাদা একটি প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আজ প্রায় তিন লাখ বছর। এর মধ্যে দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরেই আমরা বৈষয়িকভাবে বেশ দরিদ্র ছিলাম কিন্তু সে সময় জুড়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হবার প্রায় পুরো সময় জুড়েই আমরা খাবারের খোঁজে যাযাবর জীবন যাপন করেছি। এক জায়গায় খাবারের অভাব দেখা দিলে পুরনো আবাস ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছি। যদিও একই বিশাল অঞ্চল জুড়ে মানুষের যাযাবর গোষ্ঠীগুলো ঘুরপাক খেয়েছে।  

যাযাবর এ দলগুলোর একেকটিতে দশ থেকে একশো’ জন পর্যন্ত সদস্য থাকতো এবং ধারেকাছের অন্যান্য যাবাবর দলগুলোও কোন না কোনভাবে একে অপরের আত্মীয় ছিল। এভাবে একেকটি অঞ্চলে কয়েক শত বা কয়েক হাজার সদস্য নিয়ে একেকটি যাযাবর গোষ্ঠী বিরাজ করতো যারা আবার বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খাবার সংগ্রহ করতো। বহু ক্ষেত্রেই, একটি যাযাবর গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতো, তারা ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতো। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে চড়ে বেড়ানো মানুষের সাথে সুমেরু অঞ্চলে বাস করা মানুষগুলোর মিল সম্ভবত খুব অল্পই ছিল। আর সম্ভবত দুটো গোষ্ঠীই আবার কঙ্গো অববাহিকার মানুষগুলোর চেয়ে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের সামাজিক জীবন যাপনের ধরণে মিল ছিল। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অবশ্যই বয়োবৃদ্ধ ও তরুণ সদস্য ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে দলপতি বা নেতার ধারণা ছিল না। দলের যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে আদেশ দেবার বা অধীনস্থ করে রাখার এখতিয়ার কারোরই ছিল না। লিঙ্গভেদে অবশ্য এ সম্পর্কের তারতম্য ছিল, কিন্তু অনেক যাযাবর সমাজে নারীর অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। নারীরা ছিল দক্ষ, স্বাধীন এবং দলের এগিয়ে চলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নারীরা গাছের ফল, সবজী ও ছোট শিকার সংগ্রহ করতো এবং নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জামগুলো নিজেরাই বানিয়ে নিতো। সামাজিকতা ও যৌনতার ক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারতো যার উপর পুরুষদেরও নির্ভর করতে হতো।

কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার চাইতে যাযাবার সমাজে শিশু ও কিশোররা তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পেতো এবং বিভিন্ন বয়সের বন্ধুদের সাথে বড় হয়ে নিজে নিজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও বেঁচে থাকার শিক্ষা অর্জন করতো। মার্কিন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ মার্শাল শালিন্স তার লেখা ‘দি অরিজিনাল অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি’ (১৯৭২), রচনাটিতে সম্ভবত যাযাবর জীবনের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, তবে এ বিষয়টি ঠিক যে, যাযাবর দলগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ঠিকঠাক ও পর্যাপ্ত পরিমাণেই সংগ্রহ করতে পারতো এবং এ পর্যাপ্ততায় নিজেদের মধ্যে খাবার ও উপকরণ ভাগাভাগি করে নেবার প্রবণতা একটি বড় ভূমিকা রেখেছিলো। যাযাবর গোষ্ঠীগুলো সম্পূর্ণভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মধ্যে ন্যায়ের একটি ধারণা ছিল। কানাডিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রায়ান হাইডেন এ বিষয়ে বলেছেন, প্রতিটি সমাজেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উগ্র মেজাজের লোকজন পাওয়া যায় যারা দলপতি হবার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকে, তবে যাযাবরদের মধ্যে এই প্রবণতাটি কম ছিল।

প্রায় দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরে এমন স্বাধীনতা ভোগ করার পর, নিজেদের উপরে কারও প্রভুত্ব সহ্য না করে এখন আমরা সবাই কোন না কোনভাবে বৈষম্যের শিকার। যদিও সমাজের ক্ষুদ্র শক্তিশালী একটি অভিজাত শ্রেণির ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। আর এটাও সত্য যে বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সুবিধাভোগী এ শ্রেণির অধীনস্থতা বেশিরভাগ লোকেই মেনে নিয়েছে। সমাজের ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণিটির কাছেই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং তারাই সেনাবাহিনী, পুলিশ আর রাষ্ট্রের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কাছ থেকে জোর করে ক্ষমতা কেড়ে নিতে আরও বড় ক্ষমতা থাকা দরকার অথবা অন্য একটি উপায় হতে পারে বিপ্লব। কিন্তু ইতিহাসে সফল বিপ্লবগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবগুলো মূলত একটি সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেকটি অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে আর তার জন্য প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, বিশেষ করে গরীব মানুষ। ফলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা তাদের জীবনের জন্য ভালো বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘মেনে নিতে শেখা’ এবং শোষিত হবার মধ্য দিয়েই যতটা সম্ভব ভালো থাকা যায় বা নিজের উন্নতি কীভাবে করা যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

কোন সমাজই যাযাবর গোষ্ঠী থেকে রাতারাতি অভিজাতদের অধীনস্থ রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়নি, বরং ধীরে ধীরে বৈষম্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাযাবর দলগুলোর মধ্যে আধা-অভিজাত একটি শ্রেণি শক্তিশালী হয়েছে। তবে তখনও তারা রাষ্ট্র বা নিয়মতান্ত্রিক সমাজ গঠন করেনি। ক্রিস্টোফার বোয়েম তার ‘হায়ারারকি ইন দা ফরেস্ট’ ১৯৯৯, ও স্টিফেন পিংকার তার ‘দি বেটার এঞ্জেলস অব আওয়ার নেচার’, ২০১১ রচনাগুলোতে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাক-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সহিংসতা ও বৈষম্য দানা বেঁধে উঠেছে। কিন্তু আইনের ছলনা ও নিয়ম-নীতি বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কীভাবে বৈষম্য সমাজে স্থান করে নিলো?

বর্তমান রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে সামরিক শক্তি দ্বারা যাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ক্ষমতা ভোগ করে এসেছে এবং সামনেও তাদের উত্তরাধিকারেরা এ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। কীভাবে এ শ্রেণিটি সবসময় ক্ষমতায় থাকে তা অবশ্য এ ক্ষমতা বলয়ে প্রবেশ করার পথে হাজারো বৈষম্য ও বাধা দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব। ফলে, এখন প্রশ্ন দাড়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক সমাজের বাইরে গ্রামভিত্তিক সমাজগুলোতে আসলে কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে?  

এ ধরণের গ্রামীণ সমাজে বড় মিয়া (‘বিগ ম্যান’) গোছের কিছু মানুষ থাকে (যেমনটা দেখা যায় নিউ গিনি বা মেলানেশিয়ার গ্রামগুলোতে)। তারা অর্থ ও প্রতিপত্তিতে অন্যদের চেয়ে কিছুটা সম্পদশালী ও গণ্যমান্য। কিন্তু তাদের শাসনপ্রকৃতির মধ্যে কোন অধিকারবোধ নেই, যে কারণে তাদের ক্ষমতা তাদের সন্তানসন্ততিরা পায় না। এ ধরণের সমাজগুলোতেই সাধারণত বৈষম্য দানা বাঁধে। আর যখনই এ ধরণের সমাজ গঠন শুরু হয়, আমরা সমতাভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলো থেকে ধীরে ধীরে বৈষম্যমূলক সমাজের দিকে চলতে শুরু করি যেখানে বৈষম্য আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বৈষম্যই স্বাভাবিকতা।    

যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দুটো পরিবর্তন মূলত পরবর্তীকালে বৈষম্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তার প্রথমটি হচ্ছে ‘গোত্র’ ধারণার আবির্ভাব। গোত্রের ধারণার মধ্যেই নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা ও গোত্রের সবার সাথে সবার একটি অনন্য আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপার আছে যা এক সময় গিয়ে ব্যক্তির পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। গোত্রের ধারণার পর ব্যক্তি নিজেকে বা অন্যকে প্রধানত গোত্রের ভিত্তিতে লেবেল করতে শুরু করে। কোন বিপদে-আপদে সে তার গোত্র থেকেই সহায়তা পায় বা পাওয়ার আশা রাখে। এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদ রেমন্ড সি কেলি তার ‘ওয়ারলেস সোসাইটিস অ্যান্ড দি অরিজিন অব ওয়ার’, ২০০০, এ বলেন, কৃষি এবং কৃষিজাত ফসলের উদ্ধৃত অংশ মজুদ করে রাখার ধারণা তৈরি হবার ফলে ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ ধারণাগুলোর অভাবনীয় বিকাশ ঘটে। এই ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ মজুদ বা সম্পত্তি রক্ষা করতে অধুনা শাসকরা গোত্রের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে এবং বৈষয়িক বিস্তার বাড়াতেও গোত্রকে ব্যবহার করেছে। 

দ্বিতীয় পরিবর্তনটি এসেছে তথ্য ও জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার মধ্য দিয়ে। প্রাচীন সম্পত্তি ও ক্ষমতার বাইরেও যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান থাকতো তাদের মধ্যেও সম্মানবোধ এবং নিজেকে উচ্চতর ভাবার প্রবণতা জেগে ওঠে। এর পেছনে ছিল সে সময়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও কৌশল। যাযাবর জীবনযাত্রায় দিগনির্ণয়, শিকারের পায়ের ছাপ বা চিহ্ন বুঝতে পারা, গাছ চিনতে পারা, পশুপাখির বৈশিষ্ট্য ও ভাষা বুঝতে পারা, শৈল্পিক গুণাবলী, অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরিসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বেঁচে থাকার জন্য অত্যাধিক প্রয়োজনীয় ছিল। যারা এসব বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং তাদের জ্ঞান দিয়ে অন্যদের সহায়তা করতো বা দলের জন্য বড় শিকার ধরতে ভূমিকা রাখতো তারা আলাদাভাবে দলীয় সম্মান পেতে শুরু করে। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জোসেফ হেনরিখ তার রচনা ‘দি সিক্রেট অব আওয়ার সাকসেস’, ২০১৫, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ জেরোমি লুইস দেখিয়েছেন, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি শুধু বেঁচে থাকার বিদ্যা নয়, গান কবিতা বা গল্প বলতে পারা অথবা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জ্ঞানের ক্ষেত্রেও কাজ করে। এ অনুষ্ঠানগুলো শুধু বিনোদন বা কৃত্যের জন্যই করা হতো এমনটি নাও হতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি দিগনির্ণয়, গাছ চেনা বা শিকারের কোন নির্দিষ্ট কৌশল হয়তো নিয়মিত ব্যবহৃত হয় না কিন্তু তা মনে রাখা অথবা অভ্যাসে রাখার জন্যও অনুষ্ঠান বা গানকে একটি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অস্ট্রেলিয়ার অবোরিজিনালদের গানের বাক্যে এমন শিক্ষামাধ্যমের উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়, আর শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, এর বাইরেও এই মতটি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন লেইন কেলি। তার ‘নলেজ অ্যান্ড পাওয়ার ইন প্রিহিস্টোরিক সোসাইটিস’, ২০১৫, রচনায় তিনি এ বিষয়ক বহু উদাহরণ তুলে ধরেছেন। অনুষ্ঠান বা গানে শুধু বেঁচে থাকার শিক্ষাই নয়, ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত উপাদানের চর্চাও ছিল।

এভাবে সাম্যভিত্তিক সমাজকাঠামোতে দুটি বৈষম্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এবং প্রায় ১০ হাজার বছর আগে কৃষি ও শস্যের মজুদের মাধ্যমে বৈষম্যের ভিত্তিগুলো আরও মজবুত হতে থাকে যখন যাযাবর দলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট স্থানে থিতু হতে শুরু করে। অনেক যাযাবর দল তাদের শস্যের বা খাদ্যের মজুদকে ঘিরে বসবাস করতে শুরু করে। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিকারী ও জেলে সম্প্রদায় স্যামন মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক উপকরণ পাওয়া যায় এমন জায়গাগুলো বেছে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। তাছাড়া সমসাময়িক সময়ে ইউরোপের হিমবাহ অঞ্চলের বাসিন্দারা সেখানে প্রাপ্ত শিকার শুকিয়ে বা জমা করে তার আশেপাশেই বসবাস শুরু করে দিয়েছে – এমনটা হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী আবাস তৈরি করার মূল কারণ হলো কৃষি বিপ্লব এবং নতুন হলোসিন জলবায়ু (খ্রি. পূ. ৯৭০০ সালে সর্বশেষ হিমযুগের সমাপ্তি পরবর্তী জলবায়ু)।

কেবল কয়েকটি শস্য জাতীয় প্রজাতির আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই কৃষি বিপ্লব সম্ভব হয়নি, শস্য ফলানোর আবহাওয়া বিষয়ক জ্ঞান অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছিলো। হলোসিন শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে আবহাওয়া আগের চেয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র হতে শুরু করেছিলো, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল হলোসিন জলবায়ুর স্থিতিশীলতা। বছর ঘুরে একই ঋতু বার বার ফিরতে শুরু করেছিল এবং মানুষ তখন ঋতু ও আবহাওয়া অনুমান করতে শুরু করে। অ্যাবোরিজিনাল অস্ট্রেলিয়াতে কৃষি বিকশিত হয়নি। আর পেছনের মূল কারণ ছিল একেক বছরে একেক ঋতুর আগমন, জলবায়ুর কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিল না। সে অবস্থায় কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া আত্মহত্যার শামিল। কৃষি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, এর ফলাফল আর প্রভাব ছিল বিশাল। কৃষির মধ্যে দিয়ে জমির মালিকানার ধারণা তৈরি হলো, মজুদ ব্যবস্থার বিকাশের ফলে লোকে তখন আর উদ্বৃত খাদ্য ভাগাভাগি করে দেবার চাইতে মজুদ করে রাখার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করলো। এর সাথে শুরু হলো শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, ধনী-দরিদ্র, গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিভেদে সামাজিক মর্যাদার তারতম্য।

প্রথমত, মজুদের কথাই ধরা যাক। যাযাবর দলগুলোর জন্য খাবার ভাগাভাগি করে নেওয়াটা ছিল এক ধরণের বীমা বা ইন্সুরেন্সের মত সামাজিক সুরক্ষা। শিকার করার পুরো ব্যাপারটাই ছিল বেশ ভাগ্যনির্ভর। কোন দিন ভাগ্যের জেরে কেউ বড় শিকার পেতো, অন্যদিন সে হয়তো কিছুই পেতো না। ফলে আজ যার ভাগ্য ভালো ছিল সে তার খাবার অন্যদের ভাগ করে দিলে, যেদিন তার শিকারে কিছুই জুটতো না সেদিন সে অন্যদের কাছ থেকে খাবারের ভাগ পেতো। ছোট ছোট ফল বা ছোট প্রাণীর শিকারের ক্ষেত্রে ভাগ্য হয়তো অতোটা জরুরি ছিল না এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেসব পাওয়া যেতো তবু এসব ক্ষেত্রেও ভাগাভাগি করে খাবার রীতি ছিল। কারণ কে কী শিকার করছে বা পেয়েছে তা গোপন রাখা কষ্টকর ছিল আর এই ভাগ করে নেবার মধ্য দিয়ে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্পর্ক গড়ে উঠতো।

মজুদ ব্যবস্থা শুরু হবার পর থেকে মানুষের সামাজিক ইন্সুরেন্সের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, নতুন ইন্সুরেন্স হয়ে দাঁড়ালো তার নিজের শস্যের মজুদ। ফলে উদ্বৃত খাবার বিলিয়ে দেবার বদলে মানুষ তা মজুদ করতে শুরু করে। না খেয়ে থাকার ঝুঁকির মধ্যে দূর্ভিক্ষ, খরা, অতিবৃষ্টির মত বিষয়গুলো ছিল কিন্তু এসব দুর্যোগ শুধু একজন ব্যক্তির উপর এসে হাজির হয় না, তার সমাজের প্রত্যেকের উপরই এসে পড়ে। ফলে, যাযাবর সমাজের মত খাবার ভাগ করে না খেয়ে থাকার ঝুঁকি থেকে বাঁচার কোন সুরক্ষা কৃষিভিত্তিক সমাজে ছিল না। কৃষিভিত্তিক সমাজে যদি কারো ফলন ভালো আর অন্যজনের খারাপ হতো, তাহলে হয়তো ভাগাভাগির একটি সম্ভাবনা দেখা দিতো। কিন্তু এ ব্যবস্থায় যখন ফলন ভালো হয় তখন সবার ভালো হয়, যখন খারাপ হয় তখন সবারই খারাপ হয়। ফলে একে অন্যকে আর আগের মত প্রয়োজন হয় না।

কৃষি ব্যবস্থা খুবই শ্রম ও সময়সাপেক্ষ একটি পদ্ধতি যেখানে ফলাফল খুবই অল্প। প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক দলগুলো কোন সমৃদ্ধ সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলো এমনটা প্রমাণ মেলে না। কৃষির জন্য বন পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হতো, এরপর সেখানে চাষ করা, বীজ বোনা, আগাছা-পোকা-ইঁদুর-পাখি তাড়ানো, জমি রক্ষা করা, ক্ষেত্রবিশেষে সেচ দেওয়াসহ বছরের পর বছর নিয়মিতভাবে ব্যয় করতে হতো কৃষি জমির পেছনে। এতোকিছুর পর জমি সে জমি ‘নিজের’ বলে গণ্য না হয় অথবা জমির মালিকানার বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্টা না হয় তাহলে তা কৃষকের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, কৃষকের সন্তানরা ছোটবেলা থেকে তাদের বাবা মায়ের জমিতে পরিশ্রম কেনই বা করবে, যদি না উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সে জমির মালিকানা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে! ফলে শস্যভিত্তিক মজুদ ব্যবস্থা এমন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করলো যাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল পারিবারিক কৃষি উপার্জন। পারিবারিক এ উত্তরাধিকারের ধারাই পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চর্চিত হয়ে বৈষম্য বাড়িয়েছে। শুধু সন্তান কম বা বেশি থাকার কারণেই কোন পরিবারের সম্পত্তি বেশি করে ভাগ হয়েছে, তো কোন পরিবারে সম্পত্তি ভাগাভাগি কম করতে হয়েছে। আবার কোন পরিবার কৃষি কাজের জন্য শ্রম দেবার সন্তান বেশি পেয়েছে, কোন পরিবার কম পেয়েছে। আর সম্পত্তির বৈষম্য সমাজে শুরু হলে তা কখনো কমানো সম্ভব হয়। এর পেছনে স্বাভাবিক যুক্তি যে, অধিক সম্পদশালী পরিবার তার অধিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পত্তি যে হারে বাড়ায়, দরিদ্র পরিবারের ক্ষমতা ও সম্পদ কম থাকার কারণে তারা সে হারে বাড়ে না। ফলে ধনী আরও ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। 

মজুদ ব্যবস্থার ফলে জোরপূর্বক শ্রম শোষণের পথ খুলে যায়। যাযাবর সমাজে মানুষ একটি বড় এলাকা জুড়ে শিকার ও উদ্ভিজ্জ আহারের খোঁজে ঘুরে বেড়াতো। তিন-চারজনের একেকটি দল সকালে বেরিয়ে পড়তো এবং দিনের আলো থাকতে ফিরে আসা যায় এমন দূরত্ব পর্যন্ত গিয়ে শিকারের খোঁজ করতো। তিন চারজনের দল করার একটি উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব বড় এলাকা জুড়ে দলের সবাই মিলে ছড়িয়ে পড়ে শিকারের খোঁজ করা। ফলে তাদের জীবন যাপনের দৈনন্দিন ভৌগলিক বিস্তৃতি কৃষিভিত্তিক সমাজের চাইতে শতগুণ বড় ছিল। এ বিশাল মুক্তাঞ্চলে কাওকে দাস বানানো সম্ভব না, কারণ দাস পালিয়ে যাবে। আর দাসদের বন্দী করে রাখার জন্য ঠিক সে পরিমাণেই পাহাড়াদার নিয়োগ করতে হবে – যা একটি অসম্ভব ব্যপার ছিল। অন্যদিকে কৃষি ব্যবস্থায় অল্প বিস্তৃত কৃষি জমিতে কাওকে জোরপূর্বক কাজ করতে বাধ্য করা খুবই সহজ, তাকে আটকে রাখাও সহজ। তাছাড়া কৃষিব্যবস্থা শিকারের চাইতে অনেক বেশি ক্লান্তিকর। ধনুর্বিদ্যা যেভাবে অলিম্পিকের অংশ হয়েছে, সেভাবে লাঙল টানা বা আগাছা দমন সম্ভবত কখনো অলিম্পিকে খেলা হবে না। প্রাক-কৃষি যুগে শ্রমিক পাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভব না হলে কাজের চাপ নারী ও শিশুদের উপরই বেশি পড়তো, যেহেতু তাদের বাধা দানের ক্ষমতা কম ছিল। শস্যভিত্তিক মজুদদারিতে মানুষের স্বাধীনতা কমে গিয়েছিল, বেড়েছিলো শোষণ।

এ ব্যবস্থায় আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের মাত্রা বেড়েছে। যাযাবর সমাজে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক আছে। একটি মতে, প্লাইস্টোসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শেষের দিক পর্যন্ত যাযাবর সমাজে অনেক সংঘাত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েল বোলস ও হারবার্ট গিন্টিস তাদের বই ‘এ কো-অপারেটিভ স্পিসিস’, ২০১১, তে এসব সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এমন কোন সংঘাত নিয়ে প্লাইস্টোসিন যুগের শেষপর্যন্ত একটিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে যাযাবর একটি দলকে আক্রমণ করার কাজটি ছিল কঠিন এবং আক্রমণ করার পেছনে কোন যুক্তি অন্য যাযাবর দলের ছিল না। দলের বাইরের কারও পক্ষে সে দলের অবস্থান জানাটাই ছিল কঠিন, যেহেতু দলটি প্রতিনিয়তই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতো। তাছাড়া একটি দলকে আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার মত সম্পত্তি বা মজুদ তখন ছিল না। প্রতিটি দলই তাদের নিজস্ব এলাকা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতো, তাদের এলাকায় গিয়ে তাদের না জানিয়ে আচমকা আক্রমণ করা সহজ কোন কাজ ছিল না। আর যাযাবরদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো, কেউ কারোর অধীনস্থ ছিল না। ফলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আরেকটি দলের উপর আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। 

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে কৃষক ও খাদ্য সংগ্রাহকদের জন্য এমন সংঘাত খুবই নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবেশীর শস্য ভান্ডার, তার গোয়ালের গৃহপালিত পশুর দল, তার উর্বর জমি, এমনকি শ্রমিক বা উপপত্নী হিসেবে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর লোভ আক্রমণ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রতিবেশীর পরিবার শুধু যে সম্ভাব্য শ্রমিক হবে তা নয়, তাদের দমন করার মধ্য দিয়ে নিজের পরিবারের সুরক্ষাও বাড়তো। সে সময় নাগাদ মৃৎপাত্র, লোহা বা অন্যান্য তৈজসপত্র বা অলঙ্কারের ব্যবহার শুরু হয় যার লোভেও সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংঘাতের ঝুঁকি এ সমাজের একটি চিরায়ত ব্যাপারে পরিণত হয়। আর স্থায়ী এ সমস্যার সমাধান, সালিশ, মধ্যস্থতা, সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব এসে পড়ে সমাজপতিদের ঘাড়ে। ফলে সমাজপতিদেরও একটি আলাদা প্রতিপত্তি ও অধুনা আভিজাত্যের ধারা শুরু হয়।

কৃষি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আগে নারীদের একবার জন্মদানের পর সে সন্তানের পালন ও তাকে বহন করার ব্যস্ততায় আরেকটি সন্তান জন্মদানের মধ্যে একটি বিরতি ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এ বিরতির ব্যাপারটি আর থাকে না। সন্তানকে বহন করে বহুদূর নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও ছিল না। আর খাবারের পরিমাণ, যোগান ও প্রাপ্তি তুলনামূলক সহজ হয়েছিল। যদিও কৃষি খুবই শ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ কিন্তু এ ব্যবস্থায় মানুষের অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্থান থেকে নেমে আসায় খাদ্যের যোগান বেড়েছিলো। সার দেওয়া বা সেচ দেবার মাধ্যমে এ যোগান আরও বাড়ে। যদিও যাযাবর সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ অধিকতর পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য ভোগ করতো, কৃষি আসার পর এ পুষ্টিমান অনেক কমে যায় এবং খাবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যাযাবর সমাজের জনসংখ্যা কম থাকায় সবার সাথে সবার সম্পর্ক ও সামাজিকতার সুযোগ ছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজের আকার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক এ সম্পর্ক দূর্বল হয়ে পড়ে এবং সংঘাত বাড়ে।

শস্য মজুদ করে রাখা সহজ হবার ফলে পরিবারগুলো ভবিষ্যৎ ও দুর্যোগের কথা ভেবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য জমিয়ে রাখে। জমে রাখা এ খাদ্যের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে এ খাদ্য স্থানীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবারের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন পরিবারে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তাদের শস্য ধার দেবার মধ্য দিয়ে তাদের কিছুটা নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে রাখা যায়। এছাড়া অতিরিক্ত খাদ্যের বিনিময়ে পরিবারটি বিলাসবহুল পণ্য বা সেবা কিনতে শুরু করে। শস্যের বিনিময়ে মদ, পশু এমনকি সাজপোষাক বা অলঙ্কারও কেনা সম্ভব হয়। এসব দ্রব্যের বিকিকিনির মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতা, প্রভাব ও ক্ষমতার ব্যবহার।

এভাবে কৃষি, পশুপালন ও মজুদব্যবস্থা বহু ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তার করে সাম্যভিত্তিক সমাজকে পরিবর্তন করে সংঘাতপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে সে মালিকানা নিয়ে অনিরাপত্তাবোধ এবং মালিকানার আকার বৃদ্ধির প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বৃত খাবার স্থানীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, এছাড়া উদ্বৃত খাবারের উপর ভিত্তি করে অভিজাত অভ্যাস যেমন ভোজসভা বা ব্যয়সাপেক্ষ অনুষ্ঠান, ঘটা করে উদযাপন বা লোক দেখানো আভিজাত্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সে পরিবারটির সমাজে আলাদা করে নিজের অবস্থান জাহির করা এবং এসব অনুষ্ঠান সমাজে অন্যান্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

একটি বাড়িতে ঘটা করে উৎসব হলে সে বাড়ির খবর পাশের গ্রাম বা সম্প্রদায়ের কাছে গিয়েও পৌঁছায়। এসব লোক দেখানো উৎসব সেসব গ্রামকে গৃহস্থের প্রভাব প্রতিপত্তি বিষয়ক ধারণা দেয় এবং এক ধরণের বার্তা দেয় – আমি তোমার শত্রু হবার সক্ষমতা রাখি কিন্তু এর পাশাপাশি তুমি আর আমি সমান মর্যাদাবান হওয়ার ফলে আমরা চাইলে একত্রে বাণিজ্য করতে পারি বা বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা জোট গড়ে তুলতে পারি। 

ফলে সে গৃহস্থের উপর বাইরে থেকে আক্রমণের একটি ঝুঁকি তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু ঝুঁকি পাশ কাটিয়ে, যদি বাইরের কোন দল এসে বাণিজ্য করতে চাইলে, অংশীদারিত্ব বা আলোচনা করতে চাইলে সে বিগ ম্যান (বড় মিয়া)-ই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু উৎসব পরিচালনা ও সম্পত্তির মালিক হবার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সমাজেও তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। দেখা যায়, বছর কয়েকের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের বাণিজ্য, বিনিময়, বিবাদ বা অন্য সব সম্পর্কের প্রধান মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হয় সে বড় মিয়া। তার এ ক্ষমতা ও বিনিময়ের প্রতিটি বিষয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে তার ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পলি উইসনারের ২০০২ সালে এ প্রক্রিয়ার উপর একটি দারুণ নিবন্ধ লিখেছিলেন যার নাম ‘দি ভাইন্স অব কমপ্লেক্সিটি’। তিনি পাপুয়া নিউ গিনির কেস স্টাডিতে সমাজ বিবর্তনের রূপগুলো তুলে ধরেছেন। সেখানে একটি বড় গৃহস্থ যদি ১০টি শূকর জবেহ করে গ্রামবাসীকে ভোজ করায়, কয়েক প্রজন্ম পরে সে গৃহস্থের পক্ষেই তখন ২৫০ শূকর জবেহ করে ভোজ উৎসব আয়োজন করার সক্ষমতা তৈরি হয়।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পত্তিকে পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানো, আবার সে ক্ষমতাবলে সম্পত্তি বাড়ানো একটি চাকায় পরিণত হয়। কৃষি পূর্ববর্তী সমাজে কেউ অধিকতর ক্ষমতাবান বা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাকে বাধা দেবার জন্য সামাজিক ঐক্যমত গঠন করা সহজ ছিল। সে সমাজে সকলেই একটি পরিবারের মত বাস করতো এবং গুহা বা আবাসস্থলে নিজেদের মধ্যে কোন দেয়াল পর্যন্ত ছিল না। সবার মতামত বিনিময়ের অবাধ সুযোগ ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এমন অবাধ মেলামেশা বিলুপ্ত হয় এবং পরিবারগুলো আলাদা আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে সবার ঐক্যমতে পৌঁছে শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া সমাজপতিকে তোষণ করে, তার শোষণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া একটি শ্রেণিরও উদ্ভব হয় যাদের উদ্দেশ্য থাকে বড় মিয়ার সকল কার্যক্রমকে বৈধতা দান, সমর্থন করা এবং এর বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করা। এসব কারণে নতুন এ সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন একটি কাজ। 

এ বৈষম্য বজায় রাখার চমৎকার একটি প্রবণতা হলো ক্ষমতার সঙ্গে ধর্মের আঁতাত। হাইডেন তার ‘দি পাওয়ার অব রিচুয়াল ইন প্রিহিস্টোরি’, ২০১৮, নিবন্ধে এ প্রবণতাকে উপস্থাপন করেছেন। সম্প্রদায়ভিত্তিক এ সমাজগুলোর জীবনযাপনের ধারায় ধর্ম একটি বড় প্রভাব বিস্তার করে এবং ধর্মের এ প্রভাবকে সমাজপতিরাও পুঁজি করে। আদিবাসী বিভিন্ন গোত্রে প্রায়শই দেখা যায় বিয়ে করার জন্য কনেকে এক শূকর মূল্য বা এক গরুর মূল্য উপহার দিতে হয়। ফলে বিয়ে করার জন্য দরিদ্র লোকদের হয় সে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হতে হয় অথবা কোন ধনী ব্যক্তির কাছে ধরণা দিতে হয় যে তাকে এক শূকর বা এক গরু পরিমাণ সম্পত্তি ধার দিবে বা দান করবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে ধনী লোকটির প্রতি তার নির্ভরশীলতা ও ঋণগ্রস্থতা তৈরি হয়। এখানে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের মাধ্যমে ধনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারটি ঘটে। অভিজাত শ্রেণি তাই ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন রীতি নিজেদের স্বার্থেই চালু করে এবং তা নিয়মিতভাবে পালন করে। নৃতাত্ত্বিক প্রত্নতত্ত্ববিদ কেন্ট ফ্লানেরি এবং জয়েস মারকুস সলোমন দ্বীপপুঞ্জের একটি কেস স্টাডিতেও এমনটা দেখতে পেয়েছেন। সেখানে তারা একজন ধনী ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন যিনি প্রতিপত্তি বাড়াতে নিজ অর্থায়নে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করেছেন এবং সেখানকার ধর্মীয় আচার পালনকারীরা তার সাথে দেবতার বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছে। 

সমাজে বৈষম্য প্রতিষ্ঠা হবার এ ধারাবাহিকতা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে মূল বিষয় দাঁড়ায় চারটি। প্রথমত, মজুদ করার অর্থনীতি এবং সমাজের গোত্রভিত্তিক জনসংখ্যার বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাযাবর গোষ্ঠীগুলো প্রথমে গোত্রভিত্তিক হয়েছে এবং পরে কৃষি ভিত্তিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় পৌঁছেছে। তৃতীয়ত, সমাজপতি ও ধর্মীয় রীতি-নীতির যোগসাজেশ বৈষম্যভিত্তিক কাঠামো তৈরি করেছে। এবং সর্বশেষ, এ ধরণের সমাজ গড়ে উঠে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দের মধ্য দিয়ে যেখানে সহিংসতা একটি হুমকি কিন্তু মোকাবেলাযোগ্য।

শেষ কথা: সাম্যভিত্তিক সহযোগিতাপূর্ণ মানব সমাজ সৃষ্টি অবশ্যই সম্ভব। বড় পরিসরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির অভ্যাস এবং সবাই মিলে ঐক্যমতে পৌঁছানো মানব প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি মানব জাতির ইতিহাসজুড়ে প্রায় পুরো সময়টাতেই আমরা এভাবেই বাস করে এসেছি। তার মানে এই নয় যে আমরা সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্লাইস্টোসিন যুগের আদিমতা ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু আমাদের কাছে আধুনিক যুগের নতুন সব সামাজিক প্রযুক্তি আছে। চীন যেরকমটা নজির সৃষ্টি করেছে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধনীক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে রাখার মাধ্যমে। আশা রাখি এ প্রযুক্তিগুলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এগিয়ে নিতে এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখবে।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।