সাম্য যেভাবে হারিয়ে গেলো

kim sterelny
কিম স্টেরেলনি

আমরা যে সমাজে বাস করি, প্রায় সবক্ষেত্রেই সমাজটি বৈষম্যপূর্ণ। সমাজের ছোট একটি অংশের কাছে অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ও সম্পত্তি কুক্ষিগত হয়ে আছে। আর যারা বঞ্চিত হয়েছে তাদের কারও কাছেই বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক অর্থনীতিবিদরা দেখিয়েছেন, সমাজে একটি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রতিষ্ঠা করা গেলে সকলেই যার যার অবস্থান থেকে অংশগ্রহণমূলক ও সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ করে। কিন্তু, যখন কেউ নিজের প্রাপ্যের চেয়ে বেশি দখল করে, তখনই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। সমাজে বিদ্যমান এ বৈষম্য নিয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প। 

আমাদের মধ্যে অভিজাত অংশটি অন্যদের তুলনায় সংখ্যায় এতোটাই কম যে এ সমাজকে পাঠ করে বৈষম্যের কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করাটাই দুরূহ। কোথা থেকে এ বৈষম্যের শুরুটা হলো, তা বোঝার ক্ষেত্রে শুধু বর্তমান সমাজব্যবস্থা পর্যালোচনা করে উত্তর খোঁজাটা প্রায় অসম্ভব। কেননা, মানব জাতি আলাদা একটি প্রজাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আজ প্রায় তিন লাখ বছর। এর মধ্যে দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরেই আমরা বৈষয়িকভাবে বেশ দরিদ্র ছিলাম কিন্তু সে সময় জুড়ে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হবার প্রায় পুরো সময় জুড়েই আমরা খাবারের খোঁজে যাযাবর জীবন যাপন করেছি। এক জায়গায় খাবারের অভাব দেখা দিলে পুরনো আবাস ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছি। যদিও একই বিশাল অঞ্চল জুড়ে মানুষের যাযাবর গোষ্ঠীগুলো ঘুরপাক খেয়েছে।  

যাযাবর এ দলগুলোর একেকটিতে দশ থেকে একশো’ জন পর্যন্ত সদস্য থাকতো এবং ধারেকাছের অন্যান্য যাবাবর দলগুলোও কোন না কোনভাবে একে অপরের আত্মীয় ছিল। এভাবে একেকটি অঞ্চলে কয়েক শত বা কয়েক হাজার সদস্য নিয়ে একেকটি যাযাবর গোষ্ঠী বিরাজ করতো যারা আবার বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে খাবার সংগ্রহ করতো। বহু ক্ষেত্রেই, একটি যাযাবর গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অন্য গোষ্ঠীর চেয়ে ভিন্ন বৈশিষ্ট্য ধারণ করতো, তারা ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতো। পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে চড়ে বেড়ানো মানুষের সাথে সুমেরু অঞ্চলে বাস করা মানুষগুলোর মিল সম্ভবত খুব অল্পই ছিল। আর সম্ভবত দুটো গোষ্ঠীই আবার কঙ্গো অববাহিকার মানুষগুলোর চেয়ে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের সামাজিক জীবন যাপনের ধরণে মিল ছিল। গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অবশ্যই বয়োবৃদ্ধ ও তরুণ সদস্য ছিল কিন্তু তাদের মধ্যে দলপতি বা নেতার ধারণা ছিল না। দলের যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকে আদেশ দেবার বা অধীনস্থ করে রাখার এখতিয়ার কারোরই ছিল না। লিঙ্গভেদে অবশ্য এ সম্পর্কের তারতম্য ছিল, কিন্তু অনেক যাযাবর সমাজে নারীর অবস্থান বিশেষ গুরুত্ব বহন করতো। নারীরা ছিল দক্ষ, স্বাধীন এবং দলের এগিয়ে চলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। নারীরা গাছের ফল, সবজী ও ছোট শিকার সংগ্রহ করতো এবং নিত্য ব্যবহার্য সরঞ্জামগুলো নিজেরাই বানিয়ে নিতো। সামাজিকতা ও যৌনতার ক্ষেত্রে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারতো যার উপর পুরুষদেরও নির্ভর করতে হতো।

কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার চাইতে যাযাবার সমাজে শিশু ও কিশোররা তুলনামূলক বেশি স্বাধীনতা পেতো এবং বিভিন্ন বয়সের বন্ধুদের সাথে বড় হয়ে নিজে নিজে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সামাজিক ও বেঁচে থাকার শিক্ষা অর্জন করতো। মার্কিন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ববিদ মার্শাল শালিন্স তার লেখা ‘দি অরিজিনাল অ্যাফ্লুয়েন্ট সোসাইটি’ (১৯৭২), রচনাটিতে সম্ভবত যাযাবর জীবনের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে একটু বাড়িয়ে বলেছেন, তবে এ বিষয়টি ঠিক যে, যাযাবর দলগুলো তাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো ঠিকঠাক ও পর্যাপ্ত পরিমাণেই সংগ্রহ করতে পারতো এবং এ পর্যাপ্ততায় নিজেদের মধ্যে খাবার ও উপকরণ ভাগাভাগি করে নেবার প্রবণতা একটি বড় ভূমিকা রেখেছিলো। যাযাবর গোষ্ঠীগুলো সম্পূর্ণভাবে ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু তাদের মধ্যে ন্যায়ের একটি ধারণা ছিল। কানাডিয়ান প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্রায়ান হাইডেন এ বিষয়ে বলেছেন, প্রতিটি সমাজেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও উগ্র মেজাজের লোকজন পাওয়া যায় যারা দলপতি হবার জন্য আগ্রহী হয়ে থাকে, তবে যাযাবরদের মধ্যে এই প্রবণতাটি কম ছিল।

প্রায় দু’ লাখ নব্বই হাজার বছর ধরে এমন স্বাধীনতা ভোগ করার পর, নিজেদের উপরে কারও প্রভুত্ব সহ্য না করে এখন আমরা সবাই কোন না কোনভাবে বৈষম্যের শিকার। যদিও সমাজের ক্ষুদ্র শক্তিশালী একটি অভিজাত শ্রেণির ক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা। আর এটাও সত্য যে বর্তমান সময়ের রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সুবিধাভোগী এ শ্রেণির অধীনস্থতা বেশিরভাগ লোকেই মেনে নিয়েছে। সমাজের ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণিটির কাছেই সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত এবং তারাই সেনাবাহিনী, পুলিশ আর রাষ্ট্রের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কাছ থেকে জোর করে ক্ষমতা কেড়ে নিতে আরও বড় ক্ষমতা থাকা দরকার অথবা অন্য একটি উপায় হতে পারে বিপ্লব। কিন্তু ইতিহাসে সফল বিপ্লবগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবগুলো মূলত একটি সুবিধাভোগী অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেকটি অভিজাত শ্রেণিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে আর তার জন্য প্রাণ হারিয়েছে হাজারো মানুষ, বিশেষ করে গরীব মানুষ। ফলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা তাদের জীবনের জন্য ভালো বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে ‘মেনে নিতে শেখা’ এবং শোষিত হবার মধ্য দিয়েই যতটা সম্ভব ভালো থাকা যায় বা নিজের উন্নতি কীভাবে করা যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

কোন সমাজই যাযাবর গোষ্ঠী থেকে রাতারাতি অভিজাতদের অধীনস্থ রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে পরিণত হয়নি, বরং ধীরে ধীরে বৈষম্যের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রাথমিকভাবে যাযাবর দলগুলোর মধ্যে আধা-অভিজাত একটি শ্রেণি শক্তিশালী হয়েছে। তবে তখনও তারা রাষ্ট্র বা নিয়মতান্ত্রিক সমাজ গঠন করেনি। ক্রিস্টোফার বোয়েম তার ‘হায়ারারকি ইন দা ফরেস্ট’ ১৯৯৯, ও স্টিফেন পিংকার তার ‘দি বেটার এঞ্জেলস অব আওয়ার নেচার’, ২০১১ রচনাগুলোতে দেখিয়েছেন কীভাবে প্রাক-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় সহিংসতা ও বৈষম্য দানা বেঁধে উঠেছে। কিন্তু আইনের ছলনা ও নিয়ম-নীতি বা রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কীভাবে বৈষম্য সমাজে স্থান করে নিলো?

বর্তমান রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজে সামরিক শক্তি দ্বারা যাদের ক্ষমতা সুরক্ষিত তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরাধিকার সূত্রে তাদের ক্ষমতা ভোগ করে এসেছে এবং সামনেও তাদের উত্তরাধিকারেরা এ ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে। কীভাবে এ শ্রেণিটি সবসময় ক্ষমতায় থাকে তা অবশ্য এ ক্ষমতা বলয়ে প্রবেশ করার পথে হাজারো বৈষম্য ও বাধা দিয়ে ব্যাখ্যা সম্ভব। ফলে, এখন প্রশ্ন দাড়ায় রাষ্ট্রভিত্তিক নিয়মতান্ত্রিক সমাজের বাইরে গ্রামভিত্তিক সমাজগুলোতে আসলে কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে?  

এ ধরণের গ্রামীণ সমাজে বড় মিয়া (‘বিগ ম্যান’) গোছের কিছু মানুষ থাকে (যেমনটা দেখা যায় নিউ গিনি বা মেলানেশিয়ার গ্রামগুলোতে)। তারা অর্থ ও প্রতিপত্তিতে অন্যদের চেয়ে কিছুটা সম্পদশালী ও গণ্যমান্য। কিন্তু তাদের শাসনপ্রকৃতির মধ্যে কোন অধিকারবোধ নেই, যে কারণে তাদের ক্ষমতা তাদের সন্তানসন্ততিরা পায় না। এ ধরণের সমাজগুলোতেই সাধারণত বৈষম্য দানা বাঁধে। আর যখনই এ ধরণের সমাজ গঠন শুরু হয়, আমরা সমতাভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলো থেকে ধীরে ধীরে বৈষম্যমূলক সমাজের দিকে চলতে শুরু করি যেখানে বৈষম্য আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বৈষম্যই স্বাভাবিকতা।    

যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দুটো পরিবর্তন মূলত পরবর্তীকালে বৈষম্যের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তার প্রথমটি হচ্ছে ‘গোত্র’ ধারণার আবির্ভাব। গোত্রের ধারণার মধ্যেই নিজেদের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা ও গোত্রের সবার সাথে সবার একটি অনন্য আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপার আছে যা এক সময় গিয়ে ব্যক্তির পরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। গোত্রের ধারণার পর ব্যক্তি নিজেকে বা অন্যকে প্রধানত গোত্রের ভিত্তিতে লেবেল করতে শুরু করে। কোন বিপদে-আপদে সে তার গোত্র থেকেই সহায়তা পায় বা পাওয়ার আশা রাখে। এ বিষয়ে নৃতত্ত্ববিদ রেমন্ড সি কেলি তার ‘ওয়ারলেস সোসাইটিস অ্যান্ড দি অরিজিন অব ওয়ার’, ২০০০, এ বলেন, কৃষি এবং কৃষিজাত ফসলের উদ্ধৃত অংশ মজুদ করে রাখার ধারণা তৈরি হবার ফলে ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ ধারণাগুলোর অভাবনীয় বিকাশ ঘটে। এই ‘আমার’ ও ‘আমাদের’ মজুদ বা সম্পত্তি রক্ষা করতে অধুনা শাসকরা গোত্রের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তাদের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়িয়েছে এবং বৈষয়িক বিস্তার বাড়াতেও গোত্রকে ব্যবহার করেছে। 

দ্বিতীয় পরিবর্তনটি এসেছে তথ্য ও জ্ঞান কুক্ষিগত করে রাখার মধ্য দিয়ে। প্রাচীন সম্পত্তি ও ক্ষমতার বাইরেও যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও জ্ঞান থাকতো তাদের মধ্যেও সম্মানবোধ এবং নিজেকে উচ্চতর ভাবার প্রবণতা জেগে ওঠে। এর পেছনে ছিল সে সময়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও কৌশল। যাযাবর জীবনযাত্রায় দিগনির্ণয়, শিকারের পায়ের ছাপ বা চিহ্ন বুঝতে পারা, গাছ চিনতে পারা, পশুপাখির বৈশিষ্ট্য ও ভাষা বুঝতে পারা, শৈল্পিক গুণাবলী, অস্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরিসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান বেঁচে থাকার জন্য অত্যাধিক প্রয়োজনীয় ছিল। যারা এসব বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং তাদের জ্ঞান দিয়ে অন্যদের সহায়তা করতো বা দলের জন্য বড় শিকার ধরতে ভূমিকা রাখতো তারা আলাদাভাবে দলীয় সম্মান পেতে শুরু করে। বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী জোসেফ হেনরিখ তার রচনা ‘দি সিক্রেট অব আওয়ার সাকসেস’, ২০১৫, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ জেরোমি লুইস দেখিয়েছেন, জ্ঞানীয় প্রতিপত্তির এ দিকটি শুধু বেঁচে থাকার বিদ্যা নয়, গান কবিতা বা গল্প বলতে পারা অথবা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জ্ঞানের ক্ষেত্রেও কাজ করে। এ অনুষ্ঠানগুলো শুধু বিনোদন বা কৃত্যের জন্যই করা হতো এমনটি নাও হতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য জরুরি দিগনির্ণয়, গাছ চেনা বা শিকারের কোন নির্দিষ্ট কৌশল হয়তো নিয়মিত ব্যবহৃত হয় না কিন্তু তা মনে রাখা অথবা অভ্যাসে রাখার জন্যও অনুষ্ঠান বা গানকে একটি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অস্ট্রেলিয়ার অবোরিজিনালদের গানের বাক্যে এমন শিক্ষামাধ্যমের উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায়, আর শুধু অস্ট্রেলিয়াতেই নয়, এর বাইরেও এই মতটি বিশদভাবে আলোচনা করেছেন লেইন কেলি। তার ‘নলেজ অ্যান্ড পাওয়ার ইন প্রিহিস্টোরিক সোসাইটিস’, ২০১৫, রচনায় তিনি এ বিষয়ক বহু উদাহরণ তুলে ধরেছেন। অনুষ্ঠান বা গানে শুধু বেঁচে থাকার শিক্ষাই নয়, ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত উপাদানের চর্চাও ছিল।

এভাবে সাম্যভিত্তিক সমাজকাঠামোতে দুটি বৈষম্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়। এবং প্রায় ১০ হাজার বছর আগে কৃষি ও শস্যের মজুদের মাধ্যমে বৈষম্যের ভিত্তিগুলো আরও মজবুত হতে থাকে যখন যাযাবর দলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে না থেকে ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট স্থানে থিতু হতে শুরু করে। অনেক যাযাবর দল তাদের শস্যের বা খাদ্যের মজুদকে ঘিরে বসবাস করতে শুরু করে। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শিকারী ও জেলে সম্প্রদায় স্যামন মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক উপকরণ পাওয়া যায় এমন জায়গাগুলো বেছে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। তাছাড়া সমসাময়িক সময়ে ইউরোপের হিমবাহ অঞ্চলের বাসিন্দারা সেখানে প্রাপ্ত শিকার শুকিয়ে বা জমা করে তার আশেপাশেই বসবাস শুরু করে দিয়েছে – এমনটা হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী আবাস তৈরি করার মূল কারণ হলো কৃষি বিপ্লব এবং নতুন হলোসিন জলবায়ু (খ্রি. পূ. ৯৭০০ সালে সর্বশেষ হিমযুগের সমাপ্তি পরবর্তী জলবায়ু)।

কেবল কয়েকটি শস্য জাতীয় প্রজাতির আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই কৃষি বিপ্লব সম্ভব হয়নি, শস্য ফলানোর আবহাওয়া বিষয়ক জ্ঞান অর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছিলো। হলোসিন শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে আবহাওয়া আগের চেয়ে উষ্ণ ও আর্দ্র হতে শুরু করেছিলো, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল হলোসিন জলবায়ুর স্থিতিশীলতা। বছর ঘুরে একই ঋতু বার বার ফিরতে শুরু করেছিল এবং মানুষ তখন ঋতু ও আবহাওয়া অনুমান করতে শুরু করে। অ্যাবোরিজিনাল অস্ট্রেলিয়াতে কৃষি বিকশিত হয়নি। আর পেছনের মূল কারণ ছিল একেক বছরে একেক ঋতুর আগমন, জলবায়ুর কোন নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ছিল না। সে অবস্থায় কৃষির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া আত্মহত্যার শামিল। কৃষি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবার পেছনে কারণ যাই থাকুক না কেন, এর ফলাফল আর প্রভাব ছিল বিশাল। কৃষির মধ্যে দিয়ে জমির মালিকানার ধারণা তৈরি হলো, মজুদ ব্যবস্থার বিকাশের ফলে লোকে তখন আর উদ্বৃত খাদ্য ভাগাভাগি করে দেবার চাইতে মজুদ করে রাখার দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করলো। এর সাথে শুরু হলো শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক, ধনী-দরিদ্র, গোত্রভিত্তিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিভেদে সামাজিক মর্যাদার তারতম্য।

প্রথমত, মজুদের কথাই ধরা যাক। যাযাবর দলগুলোর জন্য খাবার ভাগাভাগি করে নেওয়াটা ছিল এক ধরণের বীমা বা ইন্সুরেন্সের মত সামাজিক সুরক্ষা। শিকার করার পুরো ব্যাপারটাই ছিল বেশ ভাগ্যনির্ভর। কোন দিন ভাগ্যের জেরে কেউ বড় শিকার পেতো, অন্যদিন সে হয়তো কিছুই পেতো না। ফলে আজ যার ভাগ্য ভালো ছিল সে তার খাবার অন্যদের ভাগ করে দিলে, যেদিন তার শিকারে কিছুই জুটতো না সেদিন সে অন্যদের কাছ থেকে খাবারের ভাগ পেতো। ছোট ছোট ফল বা ছোট প্রাণীর শিকারের ক্ষেত্রে ভাগ্য হয়তো অতোটা জরুরি ছিল না এবং প্রায় নিশ্চিতভাবেই সেসব পাওয়া যেতো তবু এসব ক্ষেত্রেও ভাগাভাগি করে খাবার রীতি ছিল। কারণ কে কী শিকার করছে বা পেয়েছে তা গোপন রাখা কষ্টকর ছিল আর এই ভাগ করে নেবার মধ্য দিয়ে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্পর্ক গড়ে উঠতো।

মজুদ ব্যবস্থা শুরু হবার পর থেকে মানুষের সামাজিক ইন্সুরেন্সের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলো, নতুন ইন্সুরেন্স হয়ে দাঁড়ালো তার নিজের শস্যের মজুদ। ফলে উদ্বৃত খাবার বিলিয়ে দেবার বদলে মানুষ তা মজুদ করতে শুরু করে। না খেয়ে থাকার ঝুঁকির মধ্যে দূর্ভিক্ষ, খরা, অতিবৃষ্টির মত বিষয়গুলো ছিল কিন্তু এসব দুর্যোগ শুধু একজন ব্যক্তির উপর এসে হাজির হয় না, তার সমাজের প্রত্যেকের উপরই এসে পড়ে। ফলে, যাযাবর সমাজের মত খাবার ভাগ করে না খেয়ে থাকার ঝুঁকি থেকে বাঁচার কোন সুরক্ষা কৃষিভিত্তিক সমাজে ছিল না। কৃষিভিত্তিক সমাজে যদি কারো ফলন ভালো আর অন্যজনের খারাপ হতো, তাহলে হয়তো ভাগাভাগির একটি সম্ভাবনা দেখা দিতো। কিন্তু এ ব্যবস্থায় যখন ফলন ভালো হয় তখন সবার ভালো হয়, যখন খারাপ হয় তখন সবারই খারাপ হয়। ফলে একে অন্যকে আর আগের মত প্রয়োজন হয় না।

কৃষি ব্যবস্থা খুবই শ্রম ও সময়সাপেক্ষ একটি পদ্ধতি যেখানে ফলাফল খুবই অল্প। প্রাথমিক কৃষিভিত্তিক দলগুলো কোন সমৃদ্ধ সমাজ তৈরি করতে পেরেছিলো এমনটা প্রমাণ মেলে না। কৃষির জন্য বন পরিষ্কার করে জমি তৈরি করতে হতো, এরপর সেখানে চাষ করা, বীজ বোনা, আগাছা-পোকা-ইঁদুর-পাখি তাড়ানো, জমি রক্ষা করা, ক্ষেত্রবিশেষে সেচ দেওয়াসহ বছরের পর বছর নিয়মিতভাবে ব্যয় করতে হতো কৃষি জমির পেছনে। এতোকিছুর পর জমি সে জমি ‘নিজের’ বলে গণ্য না হয় অথবা জমির মালিকানার বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্টা না হয় তাহলে তা কৃষকের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাছাড়া, কৃষকের সন্তানরা ছোটবেলা থেকে তাদের বাবা মায়ের জমিতে পরিশ্রম কেনই বা করবে, যদি না উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সে জমির মালিকানা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাচ্ছে! ফলে শস্যভিত্তিক মজুদ ব্যবস্থা এমন একটি জনগোষ্ঠী তৈরি করলো যাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল পারিবারিক কৃষি উপার্জন। পারিবারিক এ উত্তরাধিকারের ধারাই পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম চর্চিত হয়ে বৈষম্য বাড়িয়েছে। শুধু সন্তান কম বা বেশি থাকার কারণেই কোন পরিবারের সম্পত্তি বেশি করে ভাগ হয়েছে, তো কোন পরিবারে সম্পত্তি ভাগাভাগি কম করতে হয়েছে। আবার কোন পরিবার কৃষি কাজের জন্য শ্রম দেবার সন্তান বেশি পেয়েছে, কোন পরিবার কম পেয়েছে। আর সম্পত্তির বৈষম্য সমাজে শুরু হলে তা কখনো কমানো সম্ভব হয়। এর পেছনে স্বাভাবিক যুক্তি যে, অধিক সম্পদশালী পরিবার তার অধিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পত্তি যে হারে বাড়ায়, দরিদ্র পরিবারের ক্ষমতা ও সম্পদ কম থাকার কারণে তারা সে হারে বাড়ে না। ফলে ধনী আরও ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। 

মজুদ ব্যবস্থার ফলে জোরপূর্বক শ্রম শোষণের পথ খুলে যায়। যাযাবর সমাজে মানুষ একটি বড় এলাকা জুড়ে শিকার ও উদ্ভিজ্জ আহারের খোঁজে ঘুরে বেড়াতো। তিন-চারজনের একেকটি দল সকালে বেরিয়ে পড়তো এবং দিনের আলো থাকতে ফিরে আসা যায় এমন দূরত্ব পর্যন্ত গিয়ে শিকারের খোঁজ করতো। তিন চারজনের দল করার একটি উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব বড় এলাকা জুড়ে দলের সবাই মিলে ছড়িয়ে পড়ে শিকারের খোঁজ করা। ফলে তাদের জীবন যাপনের দৈনন্দিন ভৌগলিক বিস্তৃতি কৃষিভিত্তিক সমাজের চাইতে শতগুণ বড় ছিল। এ বিশাল মুক্তাঞ্চলে কাওকে দাস বানানো সম্ভব না, কারণ দাস পালিয়ে যাবে। আর দাসদের বন্দী করে রাখার জন্য ঠিক সে পরিমাণেই পাহাড়াদার নিয়োগ করতে হবে – যা একটি অসম্ভব ব্যপার ছিল। অন্যদিকে কৃষি ব্যবস্থায় অল্প বিস্তৃত কৃষি জমিতে কাওকে জোরপূর্বক কাজ করতে বাধ্য করা খুবই সহজ, তাকে আটকে রাখাও সহজ। তাছাড়া কৃষিব্যবস্থা শিকারের চাইতে অনেক বেশি ক্লান্তিকর। ধনুর্বিদ্যা যেভাবে অলিম্পিকের অংশ হয়েছে, সেভাবে লাঙল টানা বা আগাছা দমন সম্ভবত কখনো অলিম্পিকে খেলা হবে না। প্রাক-কৃষি যুগে শ্রমিক পাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে সম্ভব না হলে কাজের চাপ নারী ও শিশুদের উপরই বেশি পড়তো, যেহেতু তাদের বাধা দানের ক্ষমতা কম ছিল। শস্যভিত্তিক মজুদদারিতে মানুষের স্বাধীনতা কমে গিয়েছিল, বেড়েছিলো শোষণ।

এ ব্যবস্থায় আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও বিরোধের মাত্রা বেড়েছে। যাযাবর সমাজে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ছিল কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক আছে। একটি মতে, প্লাইস্টোসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে শেষের দিক পর্যন্ত যাযাবর সমাজে অনেক সংঘাত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ স্যামুয়েল বোলস ও হারবার্ট গিন্টিস তাদের বই ‘এ কো-অপারেটিভ স্পিসিস’, ২০১১, তে এসব সংঘাত নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এমন কোন সংঘাত নিয়ে প্লাইস্টোসিন যুগের শেষপর্যন্ত একটিও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে যাযাবর একটি দলকে আক্রমণ করার কাজটি ছিল কঠিন এবং আক্রমণ করার পেছনে কোন যুক্তি অন্য যাযাবর দলের ছিল না। দলের বাইরের কারও পক্ষে সে দলের অবস্থান জানাটাই ছিল কঠিন, যেহেতু দলটি প্রতিনিয়তই নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করতো। তাছাড়া একটি দলকে আক্রমণ করে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবার মত সম্পত্তি বা মজুদ তখন ছিল না। প্রতিটি দলই তাদের নিজস্ব এলাকা নিয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকতো, তাদের এলাকায় গিয়ে তাদের না জানিয়ে আচমকা আক্রমণ করা সহজ কোন কাজ ছিল না। আর যাযাবরদের প্রত্যেকেই যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতো, কেউ কারোর অধীনস্থ ছিল না। ফলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আরেকটি দলের উপর আক্রমণের সম্ভাবনা খুবই কম। 

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে কৃষক ও খাদ্য সংগ্রাহকদের জন্য এমন সংঘাত খুবই নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবেশীর শস্য ভান্ডার, তার গোয়ালের গৃহপালিত পশুর দল, তার উর্বর জমি, এমনকি শ্রমিক বা উপপত্নী হিসেবে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উপর লোভ আক্রমণ পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রতিবেশীর পরিবার শুধু যে সম্ভাব্য শ্রমিক হবে তা নয়, তাদের দমন করার মধ্য দিয়ে নিজের পরিবারের সুরক্ষাও বাড়তো। সে সময় নাগাদ মৃৎপাত্র, লোহা বা অন্যান্য তৈজসপত্র বা অলঙ্কারের ব্যবহার শুরু হয় যার লোভেও সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সংঘাতের ঝুঁকি এ সমাজের একটি চিরায়ত ব্যাপারে পরিণত হয়। আর স্থায়ী এ সমস্যার সমাধান, সালিশ, মধ্যস্থতা, সুরক্ষা প্রদানের দায়িত্ব এসে পড়ে সমাজপতিদের ঘাড়ে। ফলে সমাজপতিদেরও একটি আলাদা প্রতিপত্তি ও অধুনা আভিজাত্যের ধারা শুরু হয়।

কৃষি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। আগে নারীদের একবার জন্মদানের পর সে সন্তানের পালন ও তাকে বহন করার ব্যস্ততায় আরেকটি সন্তান জন্মদানের মধ্যে একটি বিরতি ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এ বিরতির ব্যাপারটি আর থাকে না। সন্তানকে বহন করে বহুদূর নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটিও ছিল না। আর খাবারের পরিমাণ, যোগান ও প্রাপ্তি তুলনামূলক সহজ হয়েছিল। যদিও কৃষি খুবই শ্রমসাপেক্ষ একটি কাজ কিন্তু এ ব্যবস্থায় মানুষের অবস্থান খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বোচ্চ স্থান থেকে নেমে আসায় খাদ্যের যোগান বেড়েছিলো। সার দেওয়া বা সেচ দেবার মাধ্যমে এ যোগান আরও বাড়ে। যদিও যাযাবর সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ অধিকতর পুষ্টিকর এবং সুষম খাদ্য ভোগ করতো, কৃষি আসার পর এ পুষ্টিমান অনেক কমে যায় এবং খাবার গ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যাযাবর সমাজের জনসংখ্যা কম থাকায় সবার সাথে সবার সম্পর্ক ও সামাজিকতার সুযোগ ছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজের আকার বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক এ সম্পর্ক দূর্বল হয়ে পড়ে এবং সংঘাত বাড়ে।

শস্য মজুদ করে রাখা সহজ হবার ফলে পরিবারগুলো ভবিষ্যৎ ও দুর্যোগের কথা ভেবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য জমিয়ে রাখে। জমে রাখা এ খাদ্যের পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে এ খাদ্য স্থানীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবারের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। কোন পরিবারে খাদ্যের অভাব দেখা দিলে তাদের শস্য ধার দেবার মধ্য দিয়ে তাদের কিছুটা নির্ভরশীল ও মুখাপেক্ষী করে রাখা যায়। এছাড়া অতিরিক্ত খাদ্যের বিনিময়ে পরিবারটি বিলাসবহুল পণ্য বা সেবা কিনতে শুরু করে। শস্যের বিনিময়ে মদ, পশু এমনকি সাজপোষাক বা অলঙ্কারও কেনা সম্ভব হয়। এসব দ্রব্যের বিকিকিনির মধ্য দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রতিযোগিতা, প্রভাব ও ক্ষমতার ব্যবহার।

এভাবে কৃষি, পশুপালন ও মজুদব্যবস্থা বহু ধারাবাহিক প্রভাব বিস্তার করে সাম্যভিত্তিক সমাজকে পরিবর্তন করে সংঘাতপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। জমির মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবার মধ্য দিয়ে সে মালিকানা নিয়ে অনিরাপত্তাবোধ এবং মালিকানার আকার বৃদ্ধির প্রবৃত্তি সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বৃত খাবার স্থানীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, এছাড়া উদ্বৃত খাবারের উপর ভিত্তি করে অভিজাত অভ্যাস যেমন ভোজসভা বা ব্যয়সাপেক্ষ অনুষ্ঠান, ঘটা করে উদযাপন বা লোক দেখানো আভিজাত্যের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সে পরিবারটির সমাজে আলাদা করে নিজের অবস্থান জাহির করা এবং এসব অনুষ্ঠান সমাজে অন্যান্যদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাও বাড়িয়ে দিয়েছে।

একটি বাড়িতে ঘটা করে উৎসব হলে সে বাড়ির খবর পাশের গ্রাম বা সম্প্রদায়ের কাছে গিয়েও পৌঁছায়। এসব লোক দেখানো উৎসব সেসব গ্রামকে গৃহস্থের প্রভাব প্রতিপত্তি বিষয়ক ধারণা দেয় এবং এক ধরণের বার্তা দেয় – আমি তোমার শত্রু হবার সক্ষমতা রাখি কিন্তু এর পাশাপাশি তুমি আর আমি সমান মর্যাদাবান হওয়ার ফলে আমরা চাইলে একত্রে বাণিজ্য করতে পারি বা বহিঃশক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা জোট গড়ে তুলতে পারি। 

ফলে সে গৃহস্থের উপর বাইরে থেকে আক্রমণের একটি ঝুঁকি তৈরি হয় ঠিকই কিন্তু ঝুঁকি পাশ কাটিয়ে, যদি বাইরের কোন দল এসে বাণিজ্য করতে চাইলে, অংশীদারিত্ব বা আলোচনা করতে চাইলে সে বিগ ম্যান (বড় মিয়া)-ই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু উৎসব পরিচালনা ও সম্পত্তির মালিক হবার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সমাজেও তার গ্রহণযোগ্যতা আছে। দেখা যায়, বছর কয়েকের মধ্যে দুই সম্প্রদায়ের বাণিজ্য, বিনিময়, বিবাদ বা অন্য সব সম্পর্কের প্রধান মধ্যস্থতাকারীতে পরিণত হয় সে বড় মিয়া। তার এ ক্ষমতা ও বিনিময়ের প্রতিটি বিষয়ে নিজের স্বার্থ রক্ষার মাধ্যমে তার ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। পলি উইসনারের ২০০২ সালে এ প্রক্রিয়ার উপর একটি দারুণ নিবন্ধ লিখেছিলেন যার নাম ‘দি ভাইন্স অব কমপ্লেক্সিটি’। তিনি পাপুয়া নিউ গিনির কেস স্টাডিতে সমাজ বিবর্তনের রূপগুলো তুলে ধরেছেন। সেখানে একটি বড় গৃহস্থ যদি ১০টি শূকর জবেহ করে গ্রামবাসীকে ভোজ করায়, কয়েক প্রজন্ম পরে সে গৃহস্থের পক্ষেই তখন ২৫০ শূকর জবেহ করে ভোজ উৎসব আয়োজন করার সক্ষমতা তৈরি হয়।

এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পত্তিকে পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা বাড়ানো, আবার সে ক্ষমতাবলে সম্পত্তি বাড়ানো একটি চাকায় পরিণত হয়। কৃষি পূর্ববর্তী সমাজে কেউ অধিকতর ক্ষমতাবান বা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও তাকে বাধা দেবার জন্য সামাজিক ঐক্যমত গঠন করা সহজ ছিল। সে সমাজে সকলেই একটি পরিবারের মত বাস করতো এবং গুহা বা আবাসস্থলে নিজেদের মধ্যে কোন দেয়াল পর্যন্ত ছিল না। সবার মতামত বিনিময়ের অবাধ সুযোগ ছিল। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজে এমন অবাধ মেলামেশা বিলুপ্ত হয় এবং পরিবারগুলো আলাদা আলাদা হয়ে যাওয়ার ফলে সবার ঐক্যমতে পৌঁছে শোষকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যায়। তাছাড়া সমাজপতিকে তোষণ করে, তার শোষণের পক্ষে অবস্থান নেওয়া একটি শ্রেণিরও উদ্ভব হয় যাদের উদ্দেশ্য থাকে বড় মিয়ার সকল কার্যক্রমকে বৈধতা দান, সমর্থন করা এবং এর বিনিময়ে তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করা। এসব কারণে নতুন এ সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন একটি কাজ। 

এ বৈষম্য বজায় রাখার চমৎকার একটি প্রবণতা হলো ক্ষমতার সঙ্গে ধর্মের আঁতাত। হাইডেন তার ‘দি পাওয়ার অব রিচুয়াল ইন প্রিহিস্টোরি’, ২০১৮, নিবন্ধে এ প্রবণতাকে উপস্থাপন করেছেন। সম্প্রদায়ভিত্তিক এ সমাজগুলোর জীবনযাপনের ধারায় ধর্ম একটি বড় প্রভাব বিস্তার করে এবং ধর্মের এ প্রভাবকে সমাজপতিরাও পুঁজি করে। আদিবাসী বিভিন্ন গোত্রে প্রায়শই দেখা যায় বিয়ে করার জন্য কনেকে এক শূকর মূল্য বা এক গরুর মূল্য উপহার দিতে হয়। ফলে বিয়ে করার জন্য দরিদ্র লোকদের হয় সে পরিমাণ সম্পত্তির মালিক হতে হয় অথবা কোন ধনী ব্যক্তির কাছে ধরণা দিতে হয় যে তাকে এক শূকর বা এক গরু পরিমাণ সম্পত্তি ধার দিবে বা দান করবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে ধনী লোকটির প্রতি তার নির্ভরশীলতা ও ঋণগ্রস্থতা তৈরি হয়। এখানে ধর্ম বা সামাজিক নিয়মের মাধ্যমে ধনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারটি ঘটে। অভিজাত শ্রেণি তাই ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন রীতি নিজেদের স্বার্থেই চালু করে এবং তা নিয়মিতভাবে পালন করে। নৃতাত্ত্বিক প্রত্নতত্ত্ববিদ কেন্ট ফ্লানেরি এবং জয়েস মারকুস সলোমন দ্বীপপুঞ্জের একটি কেস স্টাডিতেও এমনটা দেখতে পেয়েছেন। সেখানে তারা একজন ধনী ব্যক্তির উদাহরণ দিয়েছেন যিনি প্রতিপত্তি বাড়াতে নিজ অর্থায়নে প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করেছেন এবং সেখানকার ধর্মীয় আচার পালনকারীরা তার সাথে দেবতার বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছে। 

সমাজে বৈষম্য প্রতিষ্ঠা হবার এ ধারাবাহিকতা যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে মূল বিষয় দাঁড়ায় চারটি। প্রথমত, মজুদ করার অর্থনীতি এবং সমাজের গোত্রভিত্তিক জনসংখ্যার বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে বৈষম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাযাবর গোষ্ঠীগুলো প্রথমে গোত্রভিত্তিক হয়েছে এবং পরে কৃষি ভিত্তিক বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় পৌঁছেছে। তৃতীয়ত, সমাজপতি ও ধর্মীয় রীতি-নীতির যোগসাজেশ বৈষম্যভিত্তিক কাঠামো তৈরি করেছে। এবং সর্বশেষ, এ ধরণের সমাজ গড়ে উঠে আন্তঃসাম্প্রদায়িক দ্বন্দের মধ্য দিয়ে যেখানে সহিংসতা একটি হুমকি কিন্তু মোকাবেলাযোগ্য।

শেষ কথা: সাম্যভিত্তিক সহযোগিতাপূর্ণ মানব সমাজ সৃষ্টি অবশ্যই সম্ভব। বড় পরিসরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির অভ্যাস এবং সবাই মিলে ঐক্যমতে পৌঁছানো মানব প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমনকি মানব জাতির ইতিহাসজুড়ে প্রায় পুরো সময়টাতেই আমরা এভাবেই বাস করে এসেছি। তার মানে এই নয় যে আমরা সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্লাইস্টোসিন যুগের আদিমতা ফিরিয়ে আনবো। কিন্তু আমাদের কাছে আধুনিক যুগের নতুন সব সামাজিক প্রযুক্তি আছে। চীন যেরকমটা নজির সৃষ্টি করেছে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধনীক শ্রেণিকে নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে রাখার মাধ্যমে। আশা রাখি এ প্রযুক্তিগুলো সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে এগিয়ে নিতে এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখবে।

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।