আমাদের মূল্যবোধের মূল্য 

Alexander-Prescott-Couch-1440x960
আলেকজান্ডার প্রেসকট-কাউচ
দার্শনিক

হিউম্যান, অল টু হিউম্যান (১৮৭৮) গ্রন্থে ফ্রেডরিক নিৎশে লিখেছিলো ‘সকল দার্শনিকের ব্যর্থতার মূল উৎস হলো একটা জোরালো ইতিহাসবোধের ঘাটতি।’ দার্শনিকদের মধ্যে ইতিহাসবোধের ঘাটতি থাকার অভিযোগ নিৎশে তুলেছে, তা উনিশ শতকের কিছু চলতি প্রবণতারই প্রতিধ্বনি। আঠার শতককে যদি বলা হয় ‘দার্শনিক’ তবে তার তুলনায় উনিশ শতককে বলা চলে একটা ‘ঐতিহাসিক শতক।’ কেননা এই শতকে মানুষের যুক্তিবুদ্ধি বিষয়ক গভীর অনুসন্ধান পথ করে দিয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাক্রম কীভাবে ভাষা, সংস্কৃতি ও নৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখার।         

উনিশ শতককে আবার ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের শতকও’ বলা যায়। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব (Philology) হলো বিভিন্ন লিখিত নথির উৎস, তাদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ক গভীর অধ্যয়ন। আজকের দিনে এ শব্দটা বেশ সেকেলে মনে হয়। শুনলেই মনে হয় ধূলাজমা পুরানো বই মুখস্থ করে এসে কেউ উৎসকেন্দ্রিক খুঁতখুঁতে সমালোচনা করছে। কিন্তু উনিশ শতকের জার্মানিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে গণ্য হতো। তার প্রধান কারণ ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনের কারণে প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলি বোঝাপড়ায় আমাদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। ফলে উৎস চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, অনুমানভিত্তিক প্রকল্পগুলো নিরুৎসাহিত হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে আরো বিস্তৃত তুলনামূলক অধ্যয়নের সূত্রপাত ঘটে। এসব প্রকরণ ও পদ্ধতি ছিল মোটাদাগে বেশ পান্ডিত্যপূর্ণ, এমনকি কখনও কখনও পাণ্ডিত্যবাদীও ছিল। তবে এসবের প্রয়োগের সাংস্কৃতিক প্রভাব এতটাই জোরালো ছিল যে একাডেমিক জার্নালগুলো ছাড়াও তা গণচৈতন্যের অংশ হয়ে যাচ্ছিল।  


চলতি এই চিন্তাগুলোকে যুবক বয়সেই  নিৎশে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। নিৎশে ছিল সকল বিষয়ে পারদর্শী এক মেধাবী ছাত্র (তার দূর্বলতা ছিল শুধু অঙ্কে)। ফলে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল স্কুল্পফোর্টায়, যা মানবিক বিষয়গুলির জন্য জার্মানির সবচেয়ে সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। উঠতি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে এ  বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদী প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য বিশেষভাবে পড়ানো হতো। নিৎশে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় ভালোমত শিক্ষাগ্রহণ করেছিল, ভলতেয়ার ও সিসেরোর ঐতিহাসিক লেখাগুলো ভালোমত পড়েছিল। নিজে এরমানারিখের আখ্যান ও গ্রিক কবি থিয়োগনিসের উপর তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভও লিখেছে।    

তার এই ভাষাতাত্ত্বিক শিক্ষা কেবল দ্য বার্থ অফ ট্র‍্যাজেডি(১৮৭২) মত তার শুরুর দিককার রচনার উপরেই ছাপ রেখেছে তা নয়, নৈতিকতা ও নৈতিক মনস্তত্ত্বের উপর তার পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্যেও এর প্রভাব টের পাওয়া যায়। দার্শনিক দিক দিয়ে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি (১৮৮৭) বইটার গুরুত্ব ও তার দর্শনের ব্যুৎপত্তিগত পদ্ধতির স্বরূপ বুঝতে হলে তার এই তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক তালিমের বিষয়টি আমলে নিতেই হবে।   

অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি বেশ দুরূহ বই। নৈতিক দর্শনের ধ্রুপদী কিছু বিষয় মোকাবেলা করতে চেয়েছে এই বই। যেমন শুভ-অশুভের ধারণা, স্বাধীন ইচ্ছা, নৈতিক দায়-দায়িত্ব, অনুতাপ ইত্যাদি। তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে সে প্রচলিত দার্শনিক ধারায় অনুসন্ধান চালায়নি—উদাহরণস্বরূপ, যখন নিৎশে জিজ্ঞেস করে ‘কোনটা ভালো?’  বা ‘আমাদের কি স্বাধীন ইচ্ছা আছে?’ তখন সে খুব ঐতিহাসিক কায়দায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে, শুভ-অশুভ, সন্তাপ, স্বাধীন ইচ্ছার ধারণাগুলোর উদ্ভব কোথা থেকে হলো সে বিষয়ে আলোচনা করে।     

এ-জাতীয় ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তরে নিৎশে যা বলেছে তা, কমিয়ে বললেও, ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। অযথাই তো নিজেকে সে ডাইনামাইট বলে ডাকতো না। যেমন, নিৎশে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে সমকালীন পাশ্চাত্যে সাম্য ও মানবতার যত ধারণা আছে সবই এক প্রকার ‘দাস নৈতিকতা’ যার উদ্ভব হয়েছিলো যাজকবর্গের প্রতি হতাশা ও অসন্তোষ থেকে। এই দাস নৈতিকতা ছিল মূলত প্রভু নৈতিকতারই একটি প্রতিক্রিয়া। নিৎশের মতে ‘প্রভু নৈতিকতা’ হলো এমন কতগুলো নৈতিক উপাদান যা মহত্ত্ব, সুস্বাস্থ্য, সামাজিক স্তরের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করে। এই প্রভু নৈতিকতা ক্ষমতাকে মহিমান্বিত করে আর যাজকবর্গের ধর্মীয় নেতাদের ভীরুতা ও পুঁথিগত জ্ঞানকে খাটো করে দেখে। 

নিৎশের মতে, এই প্রভু নৈতিকতার প্রত্যুত্তরে ধর্মগুরুরা একটা নতুন মূল্যায়ন-কাঠামো (Evaluative Framework) উদ্ভাবন করে যাতে করে তারাই সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করে—এই কাঠামো অনুসারে আগ্রাসী মনোভাবকে খারাপ এবং ভীরুতা ও পরোপকারকে ভালো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা পুনর্মূল্যায়ন দাঁড় করালো। এই নৈতিক পূর্বানুমানগুলি পরে একসময় নিচুতলার দাসেরা আত্মস্থ করে নেয়। ফলে নিজেদের নিচু অবস্থানকেই তারা মহীয়ান করে তোলে, এবং নিজেদের অক্ষমতাকেই পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়। অর্থাৎ, নিৎশের নজরে, আমাদের মৌলিক নৈতিক অবস্থানের অনেকগুলোই আসলে জন্মেছে প্রাচীন অবস্থানগত লড়াইয়ের গর্ভ থেকে।           

নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনেক পাঠক যে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি তা হলো এইসব ঐতিহাসিক দাবির সাথে দার্শনিক প্রশ্নের সম্বন্ধটা ঠিক কী। নিৎশে উল্লেখ করেছিল যে তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘সকল মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়ন’, কিন্তু তার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক নজিরগুলো কীরকম অবদান রাখবে বা রাখতে পারবে তা অতটা স্পষ্ট না। ইতিহাসের দিকে নজর ফেরানোতে মনে হতে পারে নিৎশে কেবল নৈতিক দর্শনের বিষয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে। অনেকটা সেই পুরান প্রবাদের মত যা বলে যদি যা নিয়ে কথা হচ্ছে তা তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে আলাপের বিষয়ই বদলে ফেলো। কেননা যত যাই হোক, নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃতি, মূল্য ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর চাইতে সে মূল্যবোধের উদ্ভব কোথা থেকে হলো সেই প্রশ্ন ভীষণ আলাদা। নিৎশে যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে ইতিহাসের ব্যবহার করতে যায়, তাহলে মনে হতে পারে সে একটা ফ্যালাসির ব্যবহার করছে, যাকে বলে ‘ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসি’।’ কোনো কিছুর উৎসস্থল খারাপ প্রমাণ করা গেলেই যে বস্তুটা নিজেও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না। কোনো কিছুর উৎস বা অতীতের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বর্তমানে তার মূল্যায়ন করতে গেলে এই ফ্যালাসি হয়। যেমন ধরুন, আপনার এক বন্ধু হঠাৎ এসে বললো, আপনার বিয়ের আংটি পরবেন না কেননা আগেকার দিনে মহিলারা যাতে স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে না যেতে পারে সেজন্য গোড়ালিতে যে শেকল পরানো হতো তারই প্রতীক রূপে বিয়ের আংটি এখনো টিকে আছে। বিয়ের আংটির যদি এমন বাজে ইতিহাস থেকেও থাকে, সেই ইতিহাসের কারণে এটা প্রমাণিত হয় না যে এখন আর এটা পরা যাবে না। নিৎশে যখন খ্রিষ্টীয় নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে তাদের উৎসকাহিনী ধরে বিচার করার দাবি তোলে, তখন আমাদের সন্দেহ জাগতেই পারে সেও একই রকম কুযুক্তি অবলম্বন করছে কিনা।          

এই ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসির শিকার হওয়া নিয়ে যে দুশ্চিন্তা, তাতে নৈতিক দর্শনের ইতিহাসবোধের ঘাটতি আরো প্রকট হয়। কোনো কিছু উৎসগত দিক দিয়ে খারাপ তা প্রমাণ করা গেলেই সেই জিনিসটাও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না, এটা আগেই উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে। আবার আমাদের মূল্যবোধগুলোর মূল্যায়নের জন্য তাদের উৎস বিবেচনা করাও অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আমাদের নৈতিক বিশ্বাস ও চর্চার মূল্যায়নের জন্য শুধু তাদের পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো দেখলেই হয়ে যায়; সেসবে আমাদের বিশ্বাস করার মূল কার‍ণগুলো খতিয়ে না দেখলেও চলে। যেমন, সাম্যবাদের সমালোচনা করতে হলে আমাদের উচিত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে কীরকম আপত্তি উঠতে পারে সেগুলো বিবেচনায় আনা। যেমন, একটি পয়েন্ট হলো যে সাম্যবাদ সকল মানুষকে নিচের পর্যায়ে নেমে আসতে বলে, মানবের প্রতিভার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে বাধা দেয়, অথবা নৈতিক চিন্তার ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে না। এসব সমালোচনার কথা যখন কেউ মাথায় আনবে, তখন মনে হতে পারে এরকম সমালোচনার জন্য এই মূল্যবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখার তেমন কোনো দরকার নেই। যদি দাবিগুলো সত্য হয়, তাহলে তো ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করেই তো নৈতিক দর্শন চলতে পারে: নৈতিক দর্শনের লক্ষ্য যদি হয় আমাদের মূল্যবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়ন, আর তা করার ক্ষেত্রে যদি তাদের উৎসের কাহিনি জরুরি বা পর্যাপ্ত কোনোটাই না হয়, তবে নৈতিক দর্শনে এইসব উৎসের কাহিনি আদৌ প্রাসঙ্গিক না।  

নিৎশের কাছে এ ধরণের যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। যদিও তার সেই মনে হওয়ার ব্যাপারে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। তার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ব্যাপারে দুইরকম বোঝাপড়া রয়েছে: হয় সে মনে করতো ঐতিহাসিক বাস্তবতা কোনো নৈতিক ধারণার ন্যায্যতা বা কর্তৃত্বের প্রশ্নে সরাসরি প্রাসঙ্গিক, নয়তো সে মনে করতো যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা পরোক্ষভাবে হলেও এটা প্রমাণ করতে সাহায্য করে যে আমাদের নৈতিক অভ্যাস বহুলাংশে আমাদের অবদমিত অনুভূতি দ্বারা নির্ধারিত ও তা মানুষের মহৎ অর্জনের পথে বাধা। 

আমাদের মূল্যবোধের সাথে ইতিহাস কীভাবে সরাসরি জড়িত তা বুঝতে হলে, আমাদের আগেভাগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, বহু মানবিক অনুষঙ্গের মূল্যই নির্ভর করে তাদের ইতিহাসের উপর। পিকাসোর একটি চিত্রকর্ম তার নিখুঁত রেপ্লিকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান কেননা ওগুলো পিকাসোর নিজের হাতে আঁকা, কোনো অনুকারকের নয়। আপনার পারিবারিক স্মৃতিবাহী বিভিন্ন বস্তু আপনার মনে বিশেষ স্থান অধিকার করে রাখে কেননা তা আপনার পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের মূল্যবোধ সম্পর্কেও এটা সত্যি হতে পারে।      

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,  আমাদের মূল্যবোধের স্বর যদি হয় আদেশমূলক, তবে হয়তো ঐতিহাসিকভাবে সে মূল্যবোধ কর্তৃত্বের সাথে, মান্যতার সাথে জড়িত। বহু আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে আদেশদাতার কর্তৃত্বের উপর। এবং একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজক যারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে তাদেরকে তো ঠিক কর্তৃত্ববাদী নির্দেশদাতা বলে মনে হয় না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, কারো মনে হতে পারে যে নৈতিক আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে বিশুদ্ধ যুক্তি অথবা ঈশ্বরপ্রদত্ত বাণীর উপর। কিন্তু ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে যদি পাওয়া যায় যে এসবের উদ্ভব ভীষণ ইহলৌকিক, ‘মানবিক, খুবই মানবিক’ একটা উৎস থেকে, তবে ইতিহাস হয়তো তাদের কর্তৃত্বকে খাটো করে দেখতে পারে। যদি জানা যায় যে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের উদ্ভব হয়েছে আমাদেরই অবদমিত অনুভূতি থেকে, তবে আমাদের নজরে আজ তার মূল্য অনেকটাই খর্বিত হয়। একইভাবে, তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে যদি বাইবেলের ইহলৌকিক উৎসের ছাপ খুঁজে বের করা যায়, তাহলে বাইবেলের নৈতিক বাণীগুলো যে যীশু ও ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেনি তা প্রমাণিত হলে সেই বাণীগুলোর ওজন আমাদের কাছে কমে যায়।     

আরও একভাবে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সাথে তাদের ইতিহাস সরাসরি জড়িত। আমার কোনো এক নৈতিক বিশ্বাসে ফাটল ধরতে পারে যদি আমি জানতে পারি যে, যে প্রক্রিয়ায় আমি সেই বিশ্বাসটি গ্রহণ করেছিলাম সেটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ধরা যাক, আমি একটা গুজবে বিশ্বাস করি যে আমার দাদা গীর্জার দানবাক্স থেকে টাকা-পয়সা চুরি করতো, এবং এই তথ্য আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। কিন্তু তারপর আমি একদিন জানতে পারলাম যে আমার বাবা এই তথ্য পেয়েছিল আমার ভাইয়ের কাছ থেকে, যে কুখ্যাত মিথ্যুক এবং ধর্মীয় জোরজবরদস্তির উপর ভীষণ বিরক্ত। ফলে যেহেতু আমার এই বিশ্বাসটার সূত্র গিয়ে ঠেকেছে একটা অবিশ্বাসযোগ্য উৎসে, ফলে যৌক্তিকভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে আমার এই বিশ্বাসের কোনো ন্যায্যতা নেই। যদি নৈতিক বিশ্বাসগুলোর উৎস হয় অবদমিত অনুভূতি, তবে স্বাভাবিকভাবে তাদের ন্যায্যতার উপরেও প্রশ্ন চলে আসে। একইভাবে, হতে পারে আমাদের নৈতিক বিশ্বাস আমরা পেয়েছি আমাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে, তারা আবার সেই বিশ্বাসগুলো পেয়েছিল তাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে। এভাবে পিছনে যেতে যেতে মূল উৎস হিসেবে পাবো একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকদলকে। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকরা যদি নৈতিক সত্যের ভরসাযোগ্য কাণ্ডারি না হন, তবে তো আমাদেরকে বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া আমাদের শিক্ষা ও নৈতিক বিশ্বাসগুলোকেও অস্বীকার করতে হবে। ফলে নিৎশের ঐতিহাসিক গল্প আমাদের লালিত অনির্ভরযোগ্য বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার মত তথ্য হাজির করে এনে আমাদের ভ্রমগুলো ভেঙে দিতে পারে।   

নৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে দার্শনিকরা প্রায়ই ন্যায্যতার ও কর্তৃত্বের প্রশ্ন তোলেন। হতে পারে নিৎশে এমনই কিছু করতে চাইছিলেন। কিন্তু আমপাঠক ও ভাষ্যকাররা নিৎশের লেখার মর্ম হিসেবে যা ধরে এসেছেন তার সাথে এই পাঠ পুরোপুরি মেলে না। যেমন, স্নাতকের ছাত্ররা যখন এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের সাথে পরিচিত হয়, তখন তারা ধরে নেয় যে নিৎশের ইতিহাসপাঠ মোতাবেক সদ্গুণ, শুভবোধ ও ন্যায়ের ধারণার উৎস আমরা যতটা নির্দোষ বলে মনে করি ততটা না – বরং এই ধারণাগুলো কোনো-না-কোনোভাবে নীচ প্রতিশোধস্পৃহা, আত্মম্ভরিতা এবং ক্ষমতাবান ও উচ্চকোটির লোকেদের প্রতি অবজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। তবে এখানে যাজক, যোদ্ধা ও দাসেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে নিৎশে যে 

দাবিগুলো উত্থাপন করছেন সেটাই বেশি মনোযোগের দাবি করে, সেই সত্তাগুলো কেউ যে ঐশী কর্তৃত্বধারী বা নির্ভরযোগ্য নয় সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।   

মূল্যবোধের উপর নিৎশের পর্যালোচনায় এসব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য কীরকম ভূমিকা পালন করে? হয়তো নিৎশে ধরে নিচ্ছে যে নৈতিক ধ্যানধারণাগুলোর উৎস যদি হয় অবদমিত অনুভূতি, তাহলে তাতে সরাসরি সেই মূল্যবোধগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি যদি এখন আর সেসব ধারণা পোষণকারীরা একই উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত নাও হয়। কিন্তু নিৎশের এমন কোনো পূর্বানুমান রাখার প্রয়োজনও নেই। খুব সম্ভবত নিজের ঐতিহাসিক আখ্যানটা নিৎশে আরো পরোক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক মনে করে, বর্তমান সমাজেও একইরকম মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধির প্রমাণ হিসেবে। এই দিক দিয়ে দেখলে, নৈতিকতার পর্যালোচনার জন্য ব্যুৎপত্তিগত অধ্যয়ন এজন্যেও প্রাসঙ্গিক যে তা প্রমাণ করে যে আমাদের সমকালীন নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যেও আপত্তিকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো ঐতিহাসিক কিছু না, যেমন উদ্দেশ্যের অসততা।  

গৃহীত অনেক নৈতিক ধ্যান-ধারণার উদ্দেশ্য যে প্রশ্নবিদ্ধ সেটা মানুষকে খাওয়ানো কঠিন কিছু না। বিশেষত আধুনিক ইন্টারনেট সংস্কৃতির কল্যাণে তা আরো সহজ। সে ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণের জন্য এত ইতিহাস ঘাটানোর দরকারটা কী তাও ভাবা যেতে পারে। এর পিছনে দুইটা কারণ আছে। প্রথমত, নিৎশের ইতিহাসপাঠের মাধ্যমে আমাদের সামনে এইসব মিথস্ক্রিয়া খুবই সরল ও অনাবৃত রূপে হাজির হয়। বর্তমান নৈতিকতার ধারণায় অনেক জটিলতা ও ব্যাখ্যা হাজির আছে। যদি একবার অতীতের দিকে ঘুরে তাকাই, তাহলে এমন অনেক মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধি আমাদের নজরে পড়বে যা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। নিৎশের পাঠে, ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয়েছে বর্তমানের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য।  

দ্বিতীয়ত, অতীতের ঘটনাবলি নিরীক্ষণে আমাদের ব্যক্তিগত ও অনুভূতিগত সংশ্লিষ্টতা কম থাকে, ফলে অতীতের ব্যাপারে আরো নির্মোহ ও বাস্তবিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা সহজ হয়। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলো উদ্দেশ্যগতভাবে যে অবদমিত অনুভূতি দ্বারা চালিত তা ভেবে হয়তো আমাদের ভীষণ রাগ উঠবে, কিন্তু সময়ের দিক দিয়ে যারা এখন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে তাদের মধ্যে এই প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করা আমাদের জন্য আরো সহজ, এবং তারই জের ধরে নিজেদের মধ্যেও সেই প্রবণতাগুলো আমরা চিনতে পারি। একটা জোরালো ইতিহাসবোধ আমাদেরকে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখার হাত থেকে রক্ষা করে।  

এই বিষয়গুলো নিৎশের চিন্তাকাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা তুলে ধরে। কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে নিৎশে যেভাবে ইতিহাসকে ব্যবহার করেছে সেভাবে গ্রহণ করার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইতিহাসের এমন ব্যাখ্যা অতীতকে কেবল বর্তমানের একটা সরলীকৃত সংস্করণ হিসেবে দেখে, বর্তমান সমাজের থেকে যার পার্থক্যগুলো অত গুরুত্বপূর্ণ না। ফলে, এই ইতিহাসবাদের নজরে আমাদের সামাজিক অভ্যাসের জন্য ইতিহাসে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক ও পরিবর্তন হয়েছিল সেগুলোকে উপেক্ষা করে। নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত হিসাব-নিকাশই যদি পুরো গল্পটা হতো, তাহলে মনে হতে পারতো যে খোদ নিৎশের ইতিহাসবোধেই ঘাটতি আছে। এসব ইতিহাসবাদী পূর্বানুমানকে নিৎশের ব্যুৎপত্তিগত বোঝাপড়া কীভাবে গ্রহণ করে তা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে নিৎশের নিজের এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের ব্যুৎপত্তির দিকে। অর্থাৎ, আমাদের ফিরে যেতে হবে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জায়গায়।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি রায়


নিৎশের সময়ে তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিকদের মূল আগ্রহের জায়গা ছিল প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলো কতটা জটিল কাঠামোর অংশ, এবং বহুবিধ পরস্পরবিরোধী উৎস থেকে নানানরকমের উপাদান একসাথে এইসব গ্রন্থে এসে মেশে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা। যেমন, জুলিয়াস ওয়েলহাউসেন যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে হিব্রু ভাষার বাইবেল, পেন্টাটিউখ একটা মানব-নির্মিত গ্রন্থ এবং একে ভাঙলে চার রকমের স্বতন্ত্র উৎস হতে প্রাপ্ত গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায়। আর এর প্রতিটিরই উদ্ভব হয়েছে মোজেসের আমলের অনেক পরে (কিন্তু মনে করা হতো মোজেসই সে বাইবেলের একমাত্র রচয়িতা, ঈশ্বরের গোস্টরাইটার)। এই উৎসগত পর্যালোচনার কল্যাণে আমরা এখন হিব্রু বাইবেলকে একটা একক গ্রন্থ হিসেবে দেখার বদলে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান ও ইতিহাসের একটি সংকলন হিসেবে দেখতে পারি। এই তথ্যটি পাওয়ার কারণে এখন আমরা বাইবেলকে একটা অখণ্ড ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখতে নিরুৎসাহিত হই। ফলে বাইবেলের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক নজরটা একটু সরিয়ে রাখতে পারি।    

 

কিশোর বয়সেই স্কুল্পফোর্টায় পড়ার কল্যাণে নিৎশে প্রাচীন গ্রন্থগুলোর প্রতি এই উদার ভাষাতাত্ত্বিক পন্থার সাথে পরিচিত ছিল। যেমন, তার শিক্ষক ফ্রেডরিখ অগাস্ট কোবেরস্টাইন (যে নিজেও একজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ) তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল চতুর্থ শতকের অস্ত্রোগথ রাজা এরমানারিখের ব্যাপারে একটা কবিতার উপর গবেষণা করার। কবিতাটা অত্যন্ত গোলমেলে, কেননা কিছু অংশে এরমানারিখকে একজন মহান বীর হিসেবে দেখানো হয়, আবার অপর কিছু অংশে তাকে দেখানো একজন ভীতু হিসেবে যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছে। পাঠকের এরমানারিখের ব্যাপারে কী ভাবা উচিত তা ঠিক স্পষ্ট না। একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে নিৎশে দেখিয়েছিল যে কবিতাটার মধ্যকার এই স্ববিরোধের কারণ হলো এই কবিতার কোনো একক রচয়িতা নেই, বরং নানান উৎস থেকে এই কবিতার উদ্ভব হয়েছে। নিকট প্রাচ্য, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ব্রিটেনের নানান অংশ থেকে আসা বহু বিভিন্ন অনুষঙ্গ মিশে তৈরি হয়েছে বহু স্তরপূর্ণ এই কবিতাটি।

বিভিন্ন গ্রন্থের প্রতি এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সমকালীন নীতিবোধের ব্যাপারে নিৎশের চিন্তাকে মদদ জুগিয়েছে। জিনিওলজি গ্রন্থের মুখবন্ধে নিৎশে নীতিবোধকে বলেছে ‘দীর্ঘ, অর্থোদ্ধারে জটিল এক চিত্রিলিপিতে লেখা’। আমাদের বর্তমান নৈতিক মূল্যবোধগুলিতে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে দৃশ্যত কিছু মৃদু বিরোধ আছে। যেমন অনেকেই মনে করে মানুষের চমৎকার কোনো অর্জনের বিনিময়ে বিশেষ কিছু প্রতিদান ও সম্মান তার প্রাপ্য, এবং একইসাথে মানুষ মনে করে কেবল কোনো বড় অর্জনের বিনিময়েই মানুষের বিশেষ প্রতিদান পাওয়া উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বড় অর্জনগুলো আসে কিছু সহজাত প্রতিভার কারণে যা সেই ব্যক্তির অর্জন করতে হয়নি। ফলে এই চিন্তার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। নৈতিক দর্শনের একটা প্রধান কাজই হলো আমাদের স্বজ্ঞালব্ধ এইসব ধারণার মধ্যকার স্ববিরোধগুলো খুঁজে বের করে তার নিষ্পত্তির পথ বের করা। ধর্মতাত্ত্বিকদের বাইবেল পাঠের একটা অংশ যেমন বাইবেলের মধ্যকার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ধর্মতাত্ত্বিক দাবিগুলোকে শনাক্ত করা, তাদের মধ্যকার বিরোধগুলো বের করা ও তা সমাধানের চেষ্টা করা।        

তবে নিৎশের ধর্মতাত্ত্বিক নজর একটু আলাদা। ওয়েলহাউসেন হিব্রু বাইবেলের যেরকম ঐতিহাসিক পাঠ হাজির করেছিল, একইভাবে নিৎশে আমাদের নৈতিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশের নানান ভিন্ন উৎস তদন্ত করে বের করতে চেয়েছিল। এর শুদ্ধতাবাদী অংশগুলো আসে যোদ্ধাদের কাছ থেকে, সাম্যবাদের বাণীগুলো আসে যাজকবর্গ ও দাসবর্গের কাছ থেকে, এবং আমাদের নৈতিক কাঠামোর আরো যেসব অংশ আছে – যেমন পূর্বজদের প্রতি শ্রদ্ধা – সেগুলোরও আলাদা উৎস আছে। এমন না যে এখানে অনেকগুলো ভিন্ন ধারা এসে একসাথে মিশেছে, বরং আমাদের হাতে আছে একটা বিধানলিপি, সময়ের সাথে সাথে যার বহুবার পুনর্লিখন ও পুনর্ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে। আর প্রতিবার এ পুনর্লিখনগুলো ঘটেছে বহুবিধ জটিল ও স্ববিরোধী উদ্দেশ্যে। নৈতিকতার প্রতি এই ভাষাতাত্ত্বিক নজর একে একই মূল্যায়ন-কাঠামোর চেয়ে একটা জটিল সন্নিবেশ হিসেবে দেখতে সাহায্য করে।  

প্রথাগত নৈতিক দর্শনের কাঠামোর চেয়ে এটা ভিন্ন কেননা এই ধারায় ‘ন্যায় কী?’ –এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো একক অখণ্ড উত্তর খোঁজা হয় না, অন্তত যদি এর উত্তরটার আরো অনেক স্বজ্ঞাগত ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। বরং, আমাদের নীতিবোধের মধ্যে কত ধরণের ভিন্ন ধারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, দেখানো হয় যে এর কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়তো সম্ভব না। বাইবেলকে একটা বৈজ্ঞানিক ভাষাতাত্ত্বিক নজর দিয়ে দেখতে গেলে যেমন খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক পূর্বানুমানগুলিকে উপেক্ষা করে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, কেননা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মধ্যে যে একটা একক ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারেই এরা একমত হবে না। একইভাবে আমাদের নৈতিক কাঠামোকেও যখন ভাষাতত্ত্বের জায়গা থেকে দেখলে নৈতিকতার কোনো একক ধারা যেটা আমাদের সকল নৈতিক আচার ও বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দান করবে এমন কিছুতে বিশ্বাস রাখা সম্ভব হবে না। ঐতিহাসিকের নজরে দেখলে নৈতিক দর্শনের একটা বড় অংশকে মনে হবে অমীমাংসিতব্যের মীমাংসা করার একটা কাচুমাচু ব্যর্থ প্রয়াস। প্রভু ও দাসেদের মধ্যে এর চেয়ে বড় আপস আর হয় না।                                                       

এখন নিৎশের এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি শুধু দার্শনিক পদ্ধতিতেই প্রাসঙ্গিক হতো, তাহলে বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কের বাইরে এ ব্যাপারে কারো তেমন কোনো আগ্রহ থাকার কথা না। কিন্তু নৈতিকতার প্রতি তার এই নজর শুধু সমকালীন নৈতিক দর্শনের সমস্যাই তুলে ধরে না, আরো একটি সমস্যাও তুলে ধরে। কেননা আমাদের নীতিবোধ যে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন উৎস হতে আসে সেটাই একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। এর মানে হলো আমাদের আচরণে ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতা ধরে রাখা অনেক কঠিন, এবং কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অসংখ্য বিরোধী মতগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোনো উপায়ই নেই। অর্থাৎ আমরা নিজেদেরকে বিচার করি বেশকিছু স্ববিরোধী মানদণ্ডের নিরিখে; আবার সেই মানদণ্ডগুলো পুরোপুরি মেনে চলাও আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এটা আমাদেরকে নিজেদেরই বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের ধ্যান-ধারণার মধ্যকার এইসব স্ববিরোধ ও বিচ্ছিন্নতাকে নিৎশে এক প্রকার ব্যাধি হিসেবে দেখতো, এবং তার মতে গোটা আধুনিক সমাজটাই ব্যাধিগ্রস্ত।   
 

ভাষাতত্ত্বের হাতিয়ারগুলো কীভাবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা দেখতে পেলে আরো সহজে বোঝা যাবে আমাদের সমকালীন সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিসরেও এর প্রাসঙ্গিকতা কীরকম। যেসব নিয়ম-নীতি আমাদের সামাজিক পরিচয়ের কাঠামোকে বলবৎ রেখেছে সেগুলোর ইতিহাস ঘেটে দেখলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে প্রাত্যহিক জীবনে লুকিয়ে থাকা নানা ধরণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের লৈঙ্গিক ভূমিকার ব্যাপারে যেসব নিয়ম প্রচলিত আছে তার ইতিহাস তদন্ত করে দেখলে আমরা তার সাথে লিঙ্গের বর্তমান ধারণার মধ্যে বিভিন্ন বিরোধ খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন আপনি যদি একজন নারী হন, তবে আপনার একইসাথে ঘরের লক্ষ্মী ও গার্লবস হতে হবে। আবার আপনি যদি পুরুষ হন তবে আপনার একইসাথে আলফা মেইল হতে হবে আবার টক্সিক পুরুষও হওয়া যাবে না। যারা এসব পরিচয় অবলম্বন করতে চান তাদের মধ্যে এই বিরোধগুলো একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। আর এই দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারলে এসব বিরোধী ধারণাগুলোর সমন্বয় সাধন করার ব্যর্থ ও বিরক্তিকর প্রয়াস থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাতে পারব।      

অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ও স্ববিরোধ মানেই যে নেতিবাচক তা কিন্তু না। নিৎশে বুঝতে পেরেছিল যে ইতিবাচক বিরোধও হতে পারে। পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে তাত্ত্বিকেরা এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে তারা এর মুক্তিকামী সম্ভাবনার দিকে বিশেষ জোর দিয়েছে। যেমন, জাতীয় ইতিহাসকে এই রকম বহুমুখী উৎস থেকে বোঝার প্রয়াস সংস্কৃতি সম্ভারের বৈচিত্র্যকে বুঝতে, মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে, এবং সাংস্কৃতিক এককেন্দ্রিকতার সাধারণীকরণকেও টেক্কা দেয়। ‘একতা’ সকল ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কিছু না।    

একটু পিছিয়ে দেখলে, নিৎশের ব্যাপারে যে ব্যাপারটা বুঝতে একটু কষ্ট হয় তা হলো তার মত স্বঘোষিত ‘ভবিষ্যতের দার্শনিক’ কেন অতীত নিয়ে এত আগ্রহী। নিৎশের ইতিহাসবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখলেই এর উত্তর খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। যথেষ্ট গভীরভাবে ভাষাতত্ত্বকে অবলম্বন করা গেলে তা কেবল অতীত বিচরণেই সাহায্য করে না, বরং সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণেও ভূমিকা রাখে।  

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।