আমাদের মূল্যবোধের মূল্য 

Alexander-Prescott-Couch-1440x960
আলেকজান্ডার প্রেসকট-কাউচ
দার্শনিক

হিউম্যান, অল টু হিউম্যান (১৮৭৮) গ্রন্থে ফ্রেডরিক নিৎশে লিখেছিলো ‘সকল দার্শনিকের ব্যর্থতার মূল উৎস হলো একটা জোরালো ইতিহাসবোধের ঘাটতি।’ দার্শনিকদের মধ্যে ইতিহাসবোধের ঘাটতি থাকার অভিযোগ নিৎশে তুলেছে, তা উনিশ শতকের কিছু চলতি প্রবণতারই প্রতিধ্বনি। আঠার শতককে যদি বলা হয় ‘দার্শনিক’ তবে তার তুলনায় উনিশ শতককে বলা চলে একটা ‘ঐতিহাসিক শতক।’ কেননা এই শতকে মানুষের যুক্তিবুদ্ধি বিষয়ক গভীর অনুসন্ধান পথ করে দিয়েছে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনাক্রম কীভাবে ভাষা, সংস্কৃতি ও নৈতিক চিন্তাকে প্রভাবিত করে সে বিষয়ে আরো খতিয়ে দেখার।         

উনিশ শতককে আবার ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের শতকও’ বলা যায়। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব (Philology) হলো বিভিন্ন লিখিত নথির উৎস, তাদের ভাষাগত বৈশিষ্ট্য, গ্রহণযোগ্যতার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিষয়ক গভীর অধ্যয়ন। আজকের দিনে এ শব্দটা বেশ সেকেলে মনে হয়। শুনলেই মনে হয় ধূলাজমা পুরানো বই মুখস্থ করে এসে কেউ উৎসকেন্দ্রিক খুঁতখুঁতে সমালোচনা করছে। কিন্তু উনিশ শতকের জার্মানিতে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব জ্ঞানের অন্যতম প্রধান শাখা হিসেবে গণ্য হতো। তার প্রধান কারণ ছিল খুব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনের কারণে প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলি বোঝাপড়ায় আমাদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। ফলে উৎস চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়, অনুমানভিত্তিক প্রকল্পগুলো নিরুৎসাহিত হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে আরো বিস্তৃত তুলনামূলক অধ্যয়নের সূত্রপাত ঘটে। এসব প্রকরণ ও পদ্ধতি ছিল মোটাদাগে বেশ পান্ডিত্যপূর্ণ, এমনকি কখনও কখনও পাণ্ডিত্যবাদীও ছিল। তবে এসবের প্রয়োগের সাংস্কৃতিক প্রভাব এতটাই জোরালো ছিল যে একাডেমিক জার্নালগুলো ছাড়াও তা গণচৈতন্যের অংশ হয়ে যাচ্ছিল।  


চলতি এই চিন্তাগুলোকে যুবক বয়সেই  নিৎশে আত্মস্থ করে নিয়েছিল। নিৎশে ছিল সকল বিষয়ে পারদর্শী এক মেধাবী ছাত্র (তার দূর্বলতা ছিল শুধু অঙ্কে)। ফলে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল স্কুল্পফোর্টায়, যা মানবিক বিষয়গুলির জন্য জার্মানির সবচেয়ে সম্মানজনক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি। উঠতি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীদের জন্য প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে এ  বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্রুপদী প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য বিশেষভাবে পড়ানো হতো। নিৎশে ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় ভালোমত শিক্ষাগ্রহণ করেছিল, ভলতেয়ার ও সিসেরোর ঐতিহাসিক লেখাগুলো ভালোমত পড়েছিল। নিজে এরমানারিখের আখ্যান ও গ্রিক কবি থিয়োগনিসের উপর তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক সন্দর্ভও লিখেছে।    

তার এই ভাষাতাত্ত্বিক শিক্ষা কেবল দ্য বার্থ অফ ট্র‍্যাজেডি(১৮৭২) মত তার শুরুর দিককার রচনার উপরেই ছাপ রেখেছে তা নয়, নৈতিকতা ও নৈতিক মনস্তত্ত্বের উপর তার পরবর্তী রচনাগুলোর মধ্যেও এর প্রভাব টের পাওয়া যায়। দার্শনিক দিক দিয়ে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ, অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি (১৮৮৭) বইটার গুরুত্ব ও তার দর্শনের ব্যুৎপত্তিগত পদ্ধতির স্বরূপ বুঝতে হলে তার এই তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক তালিমের বিষয়টি আমলে নিতেই হবে।   

অন দ্য জিনিওলজি অফ মোরালিটি বেশ দুরূহ বই। নৈতিক দর্শনের ধ্রুপদী কিছু বিষয় মোকাবেলা করতে চেয়েছে এই বই। যেমন শুভ-অশুভের ধারণা, স্বাধীন ইচ্ছা, নৈতিক দায়-দায়িত্ব, অনুতাপ ইত্যাদি। তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে সে প্রচলিত দার্শনিক ধারায় অনুসন্ধান চালায়নি—উদাহরণস্বরূপ, যখন নিৎশে জিজ্ঞেস করে ‘কোনটা ভালো?’  বা ‘আমাদের কি স্বাধীন ইচ্ছা আছে?’ তখন সে খুব ঐতিহাসিক কায়দায় এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে, শুভ-অশুভ, সন্তাপ, স্বাধীন ইচ্ছার ধারণাগুলোর উদ্ভব কোথা থেকে হলো সে বিষয়ে আলোচনা করে।     

এ-জাতীয় ঐতিহাসিক প্রশ্নের উত্তরে নিৎশে যা বলেছে তা, কমিয়ে বললেও, ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। অযথাই তো নিজেকে সে ডাইনামাইট বলে ডাকতো না। যেমন, নিৎশে যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে সমকালীন পাশ্চাত্যে সাম্য ও মানবতার যত ধারণা আছে সবই এক প্রকার ‘দাস নৈতিকতা’ যার উদ্ভব হয়েছিলো যাজকবর্গের প্রতি হতাশা ও অসন্তোষ থেকে। এই দাস নৈতিকতা ছিল মূলত প্রভু নৈতিকতারই একটি প্রতিক্রিয়া। নিৎশের মতে ‘প্রভু নৈতিকতা’ হলো এমন কতগুলো নৈতিক উপাদান যা মহত্ত্ব, সুস্বাস্থ্য, সামাজিক স্তরের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদিকে মহিমান্বিত করে। এই প্রভু নৈতিকতা ক্ষমতাকে মহিমান্বিত করে আর যাজকবর্গের ধর্মীয় নেতাদের ভীরুতা ও পুঁথিগত জ্ঞানকে খাটো করে দেখে। 

নিৎশের মতে, এই প্রভু নৈতিকতার প্রত্যুত্তরে ধর্মগুরুরা একটা নতুন মূল্যায়ন-কাঠামো (Evaluative Framework) উদ্ভাবন করে যাতে করে তারাই সর্বোচ্চ স্তরে অবস্থান করে—এই কাঠামো অনুসারে আগ্রাসী মনোভাবকে খারাপ এবং ভীরুতা ও পরোপকারকে ভালো হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারা পুনর্মূল্যায়ন দাঁড় করালো। এই নৈতিক পূর্বানুমানগুলি পরে একসময় নিচুতলার দাসেরা আত্মস্থ করে নেয়। ফলে নিজেদের নিচু অবস্থানকেই তারা মহীয়ান করে তোলে, এবং নিজেদের অক্ষমতাকেই পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়। অর্থাৎ, নিৎশের নজরে, আমাদের মৌলিক নৈতিক অবস্থানের অনেকগুলোই আসলে জন্মেছে প্রাচীন অবস্থানগত লড়াইয়ের গর্ভ থেকে।           

নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত অনুসন্ধানের ব্যাপারে অনেক পাঠক যে ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি তা হলো এইসব ঐতিহাসিক দাবির সাথে দার্শনিক প্রশ্নের সম্বন্ধটা ঠিক কী। নিৎশে উল্লেখ করেছিল যে তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘সকল মূল্যবোধের পুনর্মূল্যায়ন’, কিন্তু তার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এই ঐতিহাসিক নজিরগুলো কীরকম অবদান রাখবে বা রাখতে পারবে তা অতটা স্পষ্ট না। ইতিহাসের দিকে নজর ফেরানোতে মনে হতে পারে নিৎশে কেবল নৈতিক দর্শনের বিষয়ের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে চাইছে। অনেকটা সেই পুরান প্রবাদের মত যা বলে যদি যা নিয়ে কথা হচ্ছে তা তোমার পছন্দ না হয়, তাহলে আলাপের বিষয়ই বদলে ফেলো। কেননা যত যাই হোক, নৈতিক মূল্যবোধের প্রকৃতি, মূল্য ও কর্তৃত্বের ব্যাপারে দার্শনিক প্রশ্নগুলোর চাইতে সে মূল্যবোধের উদ্ভব কোথা থেকে হলো সেই প্রশ্ন ভীষণ আলাদা। নিৎশে যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে ইতিহাসের ব্যবহার করতে যায়, তাহলে মনে হতে পারে সে একটা ফ্যালাসির ব্যবহার করছে, যাকে বলে ‘ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসি’।’ কোনো কিছুর উৎসস্থল খারাপ প্রমাণ করা গেলেই যে বস্তুটা নিজেও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না। কোনো কিছুর উৎস বা অতীতের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বর্তমানে তার মূল্যায়ন করতে গেলে এই ফ্যালাসি হয়। যেমন ধরুন, আপনার এক বন্ধু হঠাৎ এসে বললো, আপনার বিয়ের আংটি পরবেন না কেননা আগেকার দিনে মহিলারা যাতে স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে না যেতে পারে সেজন্য গোড়ালিতে যে শেকল পরানো হতো তারই প্রতীক রূপে বিয়ের আংটি এখনো টিকে আছে। বিয়ের আংটির যদি এমন বাজে ইতিহাস থেকেও থাকে, সেই ইতিহাসের কারণে এটা প্রমাণিত হয় না যে এখন আর এটা পরা যাবে না। নিৎশে যখন খ্রিষ্টীয় নৈতিক মূল্যবোধগুলিকে তাদের উৎসকাহিনী ধরে বিচার করার দাবি তোলে, তখন আমাদের সন্দেহ জাগতেই পারে সেও একই রকম কুযুক্তি অবলম্বন করছে কিনা।          

এই ব্যুৎপত্তিগত ফ্যালাসির শিকার হওয়া নিয়ে যে দুশ্চিন্তা, তাতে নৈতিক দর্শনের ইতিহাসবোধের ঘাটতি আরো প্রকট হয়। কোনো কিছু উৎসগত দিক দিয়ে খারাপ তা প্রমাণ করা গেলেই সেই জিনিসটাও খারাপ তা প্রমাণিত হয় না, এটা আগেই উদাহরণ দিয়ে দেখানো হয়েছে। আবার আমাদের মূল্যবোধগুলোর মূল্যায়নের জন্য তাদের উৎস বিবেচনা করাও অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না। আমাদের নৈতিক বিশ্বাস ও চর্চার মূল্যায়নের জন্য শুধু তাদের পক্ষের ও বিপক্ষের যুক্তিগুলো দেখলেই হয়ে যায়; সেসবে আমাদের বিশ্বাস করার মূল কার‍ণগুলো খতিয়ে না দেখলেও চলে। যেমন, সাম্যবাদের সমালোচনা করতে হলে আমাদের উচিত সাম্যবাদের বিরুদ্ধে কীরকম আপত্তি উঠতে পারে সেগুলো বিবেচনায় আনা। যেমন, একটি পয়েন্ট হলো যে সাম্যবাদ সকল মানুষকে নিচের পর্যায়ে নেমে আসতে বলে, মানবের প্রতিভার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে বাধা দেয়, অথবা নৈতিক চিন্তার ভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে না। এসব সমালোচনার কথা যখন কেউ মাথায় আনবে, তখন মনে হতে পারে এরকম সমালোচনার জন্য এই মূল্যবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখার তেমন কোনো দরকার নেই। যদি দাবিগুলো সত্য হয়, তাহলে তো ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করেই তো নৈতিক দর্শন চলতে পারে: নৈতিক দর্শনের লক্ষ্য যদি হয় আমাদের মূল্যবোধের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়ন, আর তা করার ক্ষেত্রে যদি তাদের উৎসের কাহিনি জরুরি বা পর্যাপ্ত কোনোটাই না হয়, তবে নৈতিক দর্শনে এইসব উৎসের কাহিনি আদৌ প্রাসঙ্গিক না।  

নিৎশের কাছে এ ধরণের যুক্তি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়েছে। যদিও তার সেই মনে হওয়ার ব্যাপারে পণ্ডিতমহলে বিতর্ক রয়েছে। তার ঐতিহাসিক পর্যালোচনার ব্যাপারে দুইরকম বোঝাপড়া রয়েছে: হয় সে মনে করতো ঐতিহাসিক বাস্তবতা কোনো নৈতিক ধারণার ন্যায্যতা বা কর্তৃত্বের প্রশ্নে সরাসরি প্রাসঙ্গিক, নয়তো সে মনে করতো যে ঐতিহাসিক বাস্তবতা পরোক্ষভাবে হলেও এটা প্রমাণ করতে সাহায্য করে যে আমাদের নৈতিক অভ্যাস বহুলাংশে আমাদের অবদমিত অনুভূতি দ্বারা নির্ধারিত ও তা মানুষের মহৎ অর্জনের পথে বাধা। 

আমাদের মূল্যবোধের সাথে ইতিহাস কীভাবে সরাসরি জড়িত তা বুঝতে হলে, আমাদের আগেভাগে স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, বহু মানবিক অনুষঙ্গের মূল্যই নির্ভর করে তাদের ইতিহাসের উপর। পিকাসোর একটি চিত্রকর্ম তার নিখুঁত রেপ্লিকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান কেননা ওগুলো পিকাসোর নিজের হাতে আঁকা, কোনো অনুকারকের নয়। আপনার পারিবারিক স্মৃতিবাহী বিভিন্ন বস্তু আপনার মনে বিশেষ স্থান অধিকার করে রাখে কেননা তা আপনার পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। আমাদের মূল্যবোধ সম্পর্কেও এটা সত্যি হতে পারে।      

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,  আমাদের মূল্যবোধের স্বর যদি হয় আদেশমূলক, তবে হয়তো ঐতিহাসিকভাবে সে মূল্যবোধ কর্তৃত্বের সাথে, মান্যতার সাথে জড়িত। বহু আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে আদেশদাতার কর্তৃত্বের উপর। এবং একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজক যারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে তাদেরকে তো ঠিক কর্তৃত্ববাদী নির্দেশদাতা বলে মনে হয় না। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, কারো মনে হতে পারে যে নৈতিক আদেশের কর্তৃত্ব নির্ভর করে বিশুদ্ধ যুক্তি অথবা ঈশ্বরপ্রদত্ত বাণীর উপর। কিন্তু ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে যদি পাওয়া যায় যে এসবের উদ্ভব ভীষণ ইহলৌকিক, ‘মানবিক, খুবই মানবিক’ একটা উৎস থেকে, তবে ইতিহাস হয়তো তাদের কর্তৃত্বকে খাটো করে দেখতে পারে। যদি জানা যায় যে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধের উদ্ভব হয়েছে আমাদেরই অবদমিত অনুভূতি থেকে, তবে আমাদের নজরে আজ তার মূল্য অনেকটাই খর্বিত হয়। একইভাবে, তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে যদি বাইবেলের ইহলৌকিক উৎসের ছাপ খুঁজে বের করা যায়, তাহলে বাইবেলের নৈতিক বাণীগুলো যে যীশু ও ঈশ্বরের কাছ থেকে আসেনি তা প্রমাণিত হলে সেই বাণীগুলোর ওজন আমাদের কাছে কমে যায়।     

আরও একভাবে আমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সাথে তাদের ইতিহাস সরাসরি জড়িত। আমার কোনো এক নৈতিক বিশ্বাসে ফাটল ধরতে পারে যদি আমি জানতে পারি যে, যে প্রক্রিয়ায় আমি সেই বিশ্বাসটি গ্রহণ করেছিলাম সেটাই বিশ্বাসযোগ্য নয়। ধরা যাক, আমি একটা গুজবে বিশ্বাস করি যে আমার দাদা গীর্জার দানবাক্স থেকে টাকা-পয়সা চুরি করতো, এবং এই তথ্য আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। কিন্তু তারপর আমি একদিন জানতে পারলাম যে আমার বাবা এই তথ্য পেয়েছিল আমার ভাইয়ের কাছ থেকে, যে কুখ্যাত মিথ্যুক এবং ধর্মীয় জোরজবরদস্তির উপর ভীষণ বিরক্ত। ফলে যেহেতু আমার এই বিশ্বাসটার সূত্র গিয়ে ঠেকেছে একটা অবিশ্বাসযোগ্য উৎসে, ফলে যৌক্তিকভাবে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে আমার এই বিশ্বাসের কোনো ন্যায্যতা নেই। যদি নৈতিক বিশ্বাসগুলোর উৎস হয় অবদমিত অনুভূতি, তবে স্বাভাবিকভাবে তাদের ন্যায্যতার উপরেও প্রশ্ন চলে আসে। একইভাবে, হতে পারে আমাদের নৈতিক বিশ্বাস আমরা পেয়েছি আমাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে, তারা আবার সেই বিশ্বাসগুলো পেয়েছিল তাদের বাবা-মা’র (এবং বৃহত্তর সংস্কৃতির) কাছ থেকে। এভাবে পিছনে যেতে যেতে মূল উৎস হিসেবে পাবো একদল প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকদলকে। কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ যাজকরা যদি নৈতিক সত্যের ভরসাযোগ্য কাণ্ডারি না হন, তবে তো আমাদেরকে বাবা-মা’র কাছ থেকে পাওয়া আমাদের শিক্ষা ও নৈতিক বিশ্বাসগুলোকেও অস্বীকার করতে হবে। ফলে নিৎশের ঐতিহাসিক গল্প আমাদের লালিত অনির্ভরযোগ্য বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার মত তথ্য হাজির করে এনে আমাদের ভ্রমগুলো ভেঙে দিতে পারে।   

নৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রাসঙ্গিকতার ক্ষেত্রে দার্শনিকরা প্রায়ই ন্যায্যতার ও কর্তৃত্বের প্রশ্ন তোলেন। হতে পারে নিৎশে এমনই কিছু করতে চাইছিলেন। কিন্তু আমপাঠক ও ভাষ্যকাররা নিৎশের লেখার মর্ম হিসেবে যা ধরে এসেছেন তার সাথে এই পাঠ পুরোপুরি মেলে না। যেমন, স্নাতকের ছাত্ররা যখন এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের সাথে পরিচিত হয়, তখন তারা ধরে নেয় যে নিৎশের ইতিহাসপাঠ মোতাবেক সদ্গুণ, শুভবোধ ও ন্যায়ের ধারণার উৎস আমরা যতটা নির্দোষ বলে মনে করি ততটা না – বরং এই ধারণাগুলো কোনো-না-কোনোভাবে নীচ প্রতিশোধস্পৃহা, আত্মম্ভরিতা এবং ক্ষমতাবান ও উচ্চকোটির লোকেদের প্রতি অবজ্ঞা থেকে উদ্ভূত। তবে এখানে যাজক, যোদ্ধা ও দাসেদের স্বার্থ ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে নিৎশে যে 

দাবিগুলো উত্থাপন করছেন সেটাই বেশি মনোযোগের দাবি করে, সেই সত্তাগুলো কেউ যে ঐশী কর্তৃত্বধারী বা নির্ভরযোগ্য নয় সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।   

মূল্যবোধের উপর নিৎশের পর্যালোচনায় এসব স্বার্থ ও উদ্দেশ্য কীরকম ভূমিকা পালন করে? হয়তো নিৎশে ধরে নিচ্ছে যে নৈতিক ধ্যানধারণাগুলোর উৎস যদি হয় অবদমিত অনুভূতি, তাহলে তাতে সরাসরি সেই মূল্যবোধগুলো প্রশ্নবিদ্ধ, এমনকি যদি এখন আর সেসব ধারণা পোষণকারীরা একই উদ্দেশ্য দ্বারা চালিত নাও হয়। কিন্তু নিৎশের এমন কোনো পূর্বানুমান রাখার প্রয়োজনও নেই। খুব সম্ভবত নিজের ঐতিহাসিক আখ্যানটা নিৎশে আরো পরোক্ষভাবে প্রাসঙ্গিক মনে করে, বর্তমান সমাজেও একইরকম মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধির প্রমাণ হিসেবে। এই দিক দিয়ে দেখলে, নৈতিকতার পর্যালোচনার জন্য ব্যুৎপত্তিগত অধ্যয়ন এজন্যেও প্রাসঙ্গিক যে তা প্রমাণ করে যে আমাদের সমকালীন নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যেও আপত্তিকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে যেগুলো ঐতিহাসিক কিছু না, যেমন উদ্দেশ্যের অসততা।  

গৃহীত অনেক নৈতিক ধ্যান-ধারণার উদ্দেশ্য যে প্রশ্নবিদ্ধ সেটা মানুষকে খাওয়ানো কঠিন কিছু না। বিশেষত আধুনিক ইন্টারনেট সংস্কৃতির কল্যাণে তা আরো সহজ। সে ক্ষেত্রে এই পর্যবেক্ষণের জন্য এত ইতিহাস ঘাটানোর দরকারটা কী তাও ভাবা যেতে পারে। এর পিছনে দুইটা কারণ আছে। প্রথমত, নিৎশের ইতিহাসপাঠের মাধ্যমে আমাদের সামনে এইসব মিথস্ক্রিয়া খুবই সরল ও অনাবৃত রূপে হাজির হয়। বর্তমান নৈতিকতার ধারণায় অনেক জটিলতা ও ব্যাখ্যা হাজির আছে। যদি একবার অতীতের দিকে ঘুরে তাকাই, তাহলে এমন অনেক মনস্তাত্ত্বিক গতিবিধি আমাদের নজরে পড়বে যা এখন ঢাকা পড়ে গেছে। নিৎশের পাঠে, ইতিহাসকে ব্যবহার করা হয়েছে বর্তমানের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য।  

দ্বিতীয়ত, অতীতের ঘটনাবলি নিরীক্ষণে আমাদের ব্যক্তিগত ও অনুভূতিগত সংশ্লিষ্টতা কম থাকে, ফলে অতীতের ব্যাপারে আরো নির্মোহ ও বাস্তবিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা সহজ হয়। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসগুলো উদ্দেশ্যগতভাবে যে অবদমিত অনুভূতি দ্বারা চালিত তা ভেবে হয়তো আমাদের ভীষণ রাগ উঠবে, কিন্তু সময়ের দিক দিয়ে যারা এখন থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে তাদের মধ্যে এই প্রবণতাগুলো চিহ্নিত করা আমাদের জন্য আরো সহজ, এবং তারই জের ধরে নিজেদের মধ্যেও সেই প্রবণতাগুলো আমরা চিনতে পারি। একটা জোরালো ইতিহাসবোধ আমাদেরকে আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখার হাত থেকে রক্ষা করে।  

এই বিষয়গুলো নিৎশের চিন্তাকাঠামোর একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারা তুলে ধরে। কিন্তু পরোক্ষ প্রমাণ হিসেবে নিৎশে যেভাবে ইতিহাসকে ব্যবহার করেছে সেভাবে গ্রহণ করার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ইতিহাসের এমন ব্যাখ্যা অতীতকে কেবল বর্তমানের একটা সরলীকৃত সংস্করণ হিসেবে দেখে, বর্তমান সমাজের থেকে যার পার্থক্যগুলো অত গুরুত্বপূর্ণ না। ফলে, এই ইতিহাসবাদের নজরে আমাদের সামাজিক অভ্যাসের জন্য ইতিহাসে যেসব তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক ও পরিবর্তন হয়েছিল সেগুলোকে উপেক্ষা করে। নিৎশের এই ব্যুৎপত্তিগত হিসাব-নিকাশই যদি পুরো গল্পটা হতো, তাহলে মনে হতে পারতো যে খোদ নিৎশের ইতিহাসবোধেই ঘাটতি আছে। এসব ইতিহাসবাদী পূর্বানুমানকে নিৎশের ব্যুৎপত্তিগত বোঝাপড়া কীভাবে গ্রহণ করে তা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে নিৎশের নিজের এই ব্যুৎপত্তিগত পাঠের ব্যুৎপত্তির দিকে। অর্থাৎ, আমাদের ফিরে যেতে হবে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জায়গায়।    

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি রায়


নিৎশের সময়ে তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিকদের মূল আগ্রহের জায়গা ছিল প্রাচীন ও পবিত্র গ্রন্থগুলো কতটা জটিল কাঠামোর অংশ, এবং বহুবিধ পরস্পরবিরোধী উৎস থেকে নানানরকমের উপাদান একসাথে এইসব গ্রন্থে এসে মেশে সে ব্যাপারে অনুসন্ধান করা। যেমন, জুলিয়াস ওয়েলহাউসেন যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছিল যে হিব্রু ভাষার বাইবেল, পেন্টাটিউখ একটা মানব-নির্মিত গ্রন্থ এবং একে ভাঙলে চার রকমের স্বতন্ত্র উৎস হতে প্রাপ্ত গ্রন্থের হদিস পাওয়া যায়। আর এর প্রতিটিরই উদ্ভব হয়েছে মোজেসের আমলের অনেক পরে (কিন্তু মনে করা হতো মোজেসই সে বাইবেলের একমাত্র রচয়িতা, ঈশ্বরের গোস্টরাইটার)। এই উৎসগত পর্যালোচনার কল্যাণে আমরা এখন হিব্রু বাইবেলকে একটা একক গ্রন্থ হিসেবে দেখার বদলে ভিন্ন ভিন্ন উপাদান ও ইতিহাসের একটি সংকলন হিসেবে দেখতে পারি। এই তথ্যটি পাওয়ার কারণে এখন আমরা বাইবেলকে একটা অখণ্ড ধর্মতত্ত্ব হিসেবে দেখতে নিরুৎসাহিত হই। ফলে বাইবেলের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে ধর্মতাত্ত্বিক নজরটা একটু সরিয়ে রাখতে পারি।    

 

কিশোর বয়সেই স্কুল্পফোর্টায় পড়ার কল্যাণে নিৎশে প্রাচীন গ্রন্থগুলোর প্রতি এই উদার ভাষাতাত্ত্বিক পন্থার সাথে পরিচিত ছিল। যেমন, তার শিক্ষক ফ্রেডরিখ অগাস্ট কোবেরস্টাইন (যে নিজেও একজন শ্রদ্ধেয় পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ) তাকে বুদ্ধি দিয়েছিল চতুর্থ শতকের অস্ত্রোগথ রাজা এরমানারিখের ব্যাপারে একটা কবিতার উপর গবেষণা করার। কবিতাটা অত্যন্ত গোলমেলে, কেননা কিছু অংশে এরমানারিখকে একজন মহান বীর হিসেবে দেখানো হয়, আবার অপর কিছু অংশে তাকে দেখানো একজন ভীতু হিসেবে যে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেছে। পাঠকের এরমানারিখের ব্যাপারে কী ভাবা উচিত তা ঠিক স্পষ্ট না। একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে নিৎশে দেখিয়েছিল যে কবিতাটার মধ্যকার এই স্ববিরোধের কারণ হলো এই কবিতার কোনো একক রচয়িতা নেই, বরং নানান উৎস থেকে এই কবিতার উদ্ভব হয়েছে। নিকট প্রাচ্য, জার্মানি, ডেনমার্ক ও ব্রিটেনের নানান অংশ থেকে আসা বহু বিভিন্ন অনুষঙ্গ মিশে তৈরি হয়েছে বহু স্তরপূর্ণ এই কবিতাটি।

বিভিন্ন গ্রন্থের প্রতি এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি সমকালীন নীতিবোধের ব্যাপারে নিৎশের চিন্তাকে মদদ জুগিয়েছে। জিনিওলজি গ্রন্থের মুখবন্ধে নিৎশে নীতিবোধকে বলেছে ‘দীর্ঘ, অর্থোদ্ধারে জটিল এক চিত্রিলিপিতে লেখা’। আমাদের বর্তমান নৈতিক মূল্যবোধগুলিতে নজর দিলে দেখা যায় সেখানে দৃশ্যত কিছু মৃদু বিরোধ আছে। যেমন অনেকেই মনে করে মানুষের চমৎকার কোনো অর্জনের বিনিময়ে বিশেষ কিছু প্রতিদান ও সম্মান তার প্রাপ্য, এবং একইসাথে মানুষ মনে করে কেবল কোনো বড় অর্জনের বিনিময়েই মানুষের বিশেষ প্রতিদান পাওয়া উচিত। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বড় অর্জনগুলো আসে কিছু সহজাত প্রতিভার কারণে যা সেই ব্যক্তির অর্জন করতে হয়নি। ফলে এই চিন্তার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। নৈতিক দর্শনের একটা প্রধান কাজই হলো আমাদের স্বজ্ঞালব্ধ এইসব ধারণার মধ্যকার স্ববিরোধগুলো খুঁজে বের করে তার নিষ্পত্তির পথ বের করা। ধর্মতাত্ত্বিকদের বাইবেল পাঠের একটা অংশ যেমন বাইবেলের মধ্যকার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ধর্মতাত্ত্বিক দাবিগুলোকে শনাক্ত করা, তাদের মধ্যকার বিরোধগুলো বের করা ও তা সমাধানের চেষ্টা করা।        

তবে নিৎশের ধর্মতাত্ত্বিক নজর একটু আলাদা। ওয়েলহাউসেন হিব্রু বাইবেলের যেরকম ঐতিহাসিক পাঠ হাজির করেছিল, একইভাবে নিৎশে আমাদের নৈতিক কাঠামোর বিভিন্ন অংশের নানান ভিন্ন উৎস তদন্ত করে বের করতে চেয়েছিল। এর শুদ্ধতাবাদী অংশগুলো আসে যোদ্ধাদের কাছ থেকে, সাম্যবাদের বাণীগুলো আসে যাজকবর্গ ও দাসবর্গের কাছ থেকে, এবং আমাদের নৈতিক কাঠামোর আরো যেসব অংশ আছে – যেমন পূর্বজদের প্রতি শ্রদ্ধা – সেগুলোরও আলাদা উৎস আছে। এমন না যে এখানে অনেকগুলো ভিন্ন ধারা এসে একসাথে মিশেছে, বরং আমাদের হাতে আছে একটা বিধানলিপি, সময়ের সাথে সাথে যার বহুবার পুনর্লিখন ও পুনর্ব্যাখ্যা হাজির হয়েছে। আর প্রতিবার এ পুনর্লিখনগুলো ঘটেছে বহুবিধ জটিল ও স্ববিরোধী উদ্দেশ্যে। নৈতিকতার প্রতি এই ভাষাতাত্ত্বিক নজর একে একই মূল্যায়ন-কাঠামোর চেয়ে একটা জটিল সন্নিবেশ হিসেবে দেখতে সাহায্য করে।  

প্রথাগত নৈতিক দর্শনের কাঠামোর চেয়ে এটা ভিন্ন কেননা এই ধারায় ‘ন্যায় কী?’ –এ জাতীয় প্রশ্নের কোনো একক অখণ্ড উত্তর খোঁজা হয় না, অন্তত যদি এর উত্তরটার আরো অনেক স্বজ্ঞাগত ধারণার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সম্ভাবনা থাকে। বরং, আমাদের নীতিবোধের মধ্যে কত ধরণের ভিন্ন ধারা একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত সেটাই খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়, দেখানো হয় যে এর কোনো চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়তো সম্ভব না। বাইবেলকে একটা বৈজ্ঞানিক ভাষাতাত্ত্বিক নজর দিয়ে দেখতে গেলে যেমন খ্রিষ্টীয় ধর্মতাত্ত্বিক পূর্বানুমানগুলিকে উপেক্ষা করে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, কেননা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের মধ্যে যে একটা একক ধর্মতাত্ত্বিক কাঠামো খুঁজে পাওয়া যাবে সে ব্যাপারেই এরা একমত হবে না। একইভাবে আমাদের নৈতিক কাঠামোকেও যখন ভাষাতত্ত্বের জায়গা থেকে দেখলে নৈতিকতার কোনো একক ধারা যেটা আমাদের সকল নৈতিক আচার ও বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দান করবে এমন কিছুতে বিশ্বাস রাখা সম্ভব হবে না। ঐতিহাসিকের নজরে দেখলে নৈতিক দর্শনের একটা বড় অংশকে মনে হবে অমীমাংসিতব্যের মীমাংসা করার একটা কাচুমাচু ব্যর্থ প্রয়াস। প্রভু ও দাসেদের মধ্যে এর চেয়ে বড় আপস আর হয় না।                                                       

এখন নিৎশের এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যদি শুধু দার্শনিক পদ্ধতিতেই প্রাসঙ্গিক হতো, তাহলে বিদ্যায়তনিক তর্ক-বিতর্কের বাইরে এ ব্যাপারে কারো তেমন কোনো আগ্রহ থাকার কথা না। কিন্তু নৈতিকতার প্রতি তার এই নজর শুধু সমকালীন নৈতিক দর্শনের সমস্যাই তুলে ধরে না, আরো একটি সমস্যাও তুলে ধরে। কেননা আমাদের নীতিবোধ যে খণ্ডিত ও বিচ্ছিন্ন উৎস হতে আসে সেটাই একটা সমস্যা নিয়ে হাজির হয়। এর মানে হলো আমাদের আচরণে ধারাবাহিকতা ও কার্যকারিতা ধরে রাখা অনেক কঠিন, এবং কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অসংখ্য বিরোধী মতগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোনো উপায়ই নেই। অর্থাৎ আমরা নিজেদেরকে বিচার করি বেশকিছু স্ববিরোধী মানদণ্ডের নিরিখে; আবার সেই মানদণ্ডগুলো পুরোপুরি মেনে চলাও আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। এটা আমাদেরকে নিজেদেরই বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমাদের ধ্যান-ধারণার মধ্যকার এইসব স্ববিরোধ ও বিচ্ছিন্নতাকে নিৎশে এক প্রকার ব্যাধি হিসেবে দেখতো, এবং তার মতে গোটা আধুনিক সমাজটাই ব্যাধিগ্রস্ত।   
 

ভাষাতত্ত্বের হাতিয়ারগুলো কীভাবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় তা দেখতে পেলে আরো সহজে বোঝা যাবে আমাদের সমকালীন সংস্কৃতির বিভিন্ন পরিসরেও এর প্রাসঙ্গিকতা কীরকম। যেসব নিয়ম-নীতি আমাদের সামাজিক পরিচয়ের কাঠামোকে বলবৎ রেখেছে সেগুলোর ইতিহাস ঘেটে দেখলে আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে প্রাত্যহিক জীবনে লুকিয়ে থাকা নানা ধরণের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের স্বরূপ উদ্ঘাটন করা। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের লৈঙ্গিক ভূমিকার ব্যাপারে যেসব নিয়ম প্রচলিত আছে তার ইতিহাস তদন্ত করে দেখলে আমরা তার সাথে লিঙ্গের বর্তমান ধারণার মধ্যে বিভিন্ন বিরোধ খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন আপনি যদি একজন নারী হন, তবে আপনার একইসাথে ঘরের লক্ষ্মী ও গার্লবস হতে হবে। আবার আপনি যদি পুরুষ হন তবে আপনার একইসাথে আলফা মেইল হতে হবে আবার টক্সিক পুরুষও হওয়া যাবে না। যারা এসব পরিচয় অবলম্বন করতে চান তাদের মধ্যে এই বিরোধগুলো একটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। আর এই দ্বন্দ্ব সম্পর্কে আরেকটু স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারলে এসব বিরোধী ধারণাগুলোর সমন্বয় সাধন করার ব্যর্থ ও বিরক্তিকর প্রয়াস থেকে আমরা নিজেদের বাঁচাতে পারব।      

অবশ্য বিচ্ছিন্নতা ও স্ববিরোধ মানেই যে নেতিবাচক তা কিন্তু না। নিৎশে বুঝতে পেরেছিল যে ইতিবাচক বিরোধও হতে পারে। পরবর্তীতে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে যে তাত্ত্বিকেরা এই ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে তারা এর মুক্তিকামী সম্ভাবনার দিকে বিশেষ জোর দিয়েছে। যেমন, জাতীয় ইতিহাসকে এই রকম বহুমুখী উৎস থেকে বোঝার প্রয়াস সংস্কৃতি সম্ভারের বৈচিত্র্যকে বুঝতে, মূল্যায়ন করতে সাহায্য করে, এবং সাংস্কৃতিক এককেন্দ্রিকতার সাধারণীকরণকেও টেক্কা দেয়। ‘একতা’ সকল ক্ষেত্রেই ইতিবাচক কিছু না।    

একটু পিছিয়ে দেখলে, নিৎশের ব্যাপারে যে ব্যাপারটা বুঝতে একটু কষ্ট হয় তা হলো তার মত স্বঘোষিত ‘ভবিষ্যতের দার্শনিক’ কেন অতীত নিয়ে এত আগ্রহী। নিৎশের ইতিহাসবোধের ইতিহাস ঘেটে দেখলেই এর উত্তর খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। যথেষ্ট গভীরভাবে ভাষাতত্ত্বকে অবলম্বন করা গেলে তা কেবল অতীত বিচরণেই সাহায্য করে না, বরং সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যৎ নির্মাণেও ভূমিকা রাখে।  

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।