KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি

সমাজে সমস্ত প্রকার বৈষম্য সহনীয় করে তুলতে  ভাষাগত ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরী। 

এই ভাষা হয় সুভাষণ (ইউফেমিজম) আর কোমলতায় গড়া। নকল অলঙ্কারে ঝলমল করতে থাকে ভাষার শরীর। তাকাইলে চোখে ধাঁধা লাগে। আর তাই সতর্ক না হইলে সেই ধাঁধাঁ-লাগা চোখে সত্যিগুলা ধরাই পড়ে না। 

কারণ ভাষা  প্রকাশ করে না শুধু, গোপনও করে। শুধু সংযুক্ত নয় বিযুক্তও করে।  

কনফুসিয়াসের নামে একটা কাহিনী চালু আছে। কনফুসিয়াসরে একবার জিগানো হইলো যে, তিনি পৃথিবীর সম্রাট হইলে কোন কাজটা প্রথমে করতেন? উনি কইছিলেন, তার প্রথম কাজ হবে ভাষারে বদলায়ে ফেলা।   

কনফুসিয়াস ভাষারে বদলানোর সুযোগ  না পাইলেও আধুনিক যুগে আইসা অধিপতি শ্রেণির হাতে ভাষারে অনেকাংশে গড়েপিটে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

জর্জ ওরয়েলের  সেই  ‘১৯৮৪’ বইটার কথা মনে পড়বে আমাদের  যেইখানে নিউস্পিক বা নয়াজবান চালু হইছিল। সব ভালো কথা কইতে হবে। নেগেটিভ কিচ্ছু বলা যাবে না। ফলে ভাষার এমন বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে শ্রেণী-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না।  

সুশীল সমাজ টিভি মিডিয়া পত্রিকার কলামিস্ট সেই নয়াজবানের খেদমতগার। কেউ জ্ঞানত, কেউ অজ্ঞানত। যে লোক প্রকৃতপক্ষে, ‘লেবার’ বা যে বদলা খাটে/ কামলা খাটে তারে মর্যাদাপূর্ণ ‘শ্রমিক’ নামে ডাকা হয়। বাসার যে কাজের বুয়া, কাজের মাইয়া/ ছেমড়ি/ছেড়ি তার জন্যও সুন্দর-মার্জিত এবং ‘তৎসমায়িত’ নাম বরাদ্দ করা হইছে: গৃহপরিচারিকা। ‘গার্মেন্সে কাম’  যারা করে তাদেরও মহিমান্বিত নাম ‘পোষাকশ্রমিক’।       

সুভাষণ কী? 

সোনার বাংলায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের ক্ষেত্রে অলিখিত তরিকা হইলো, লেখার শিরোনামের মূলশব্দটা নিয়া  প্যাচাল পারা, ত্যানা প্যাচানো। যেমন, ধরেন, ক্যাকটাস নিয়ে লিখতে গিয়ে  আদিতে গ্রীকভাষায় শব্দটার মানে কী ছিলো?  ‘অন্ডকোষ। এইবারে শব্দটা ভাঙো, কোন্‌ অংশের কী অর্থ, সবমিলে কী দাঁড়াইল…  এইসব ইনায়ে- বিনায়ে লিখতে হবে কমসে কম এক পৃষ্ঠা। তারপর আলোচ্য বিষয়ে বিখ্যাত লোকেদের কয়েকটা বানী এস্তেমাল করা। 

সেই রাস্তা ফলো করা যাক, কিন্তু সংক্ষেপে।                

সুভাষণ বাংলা প্রতিশব্দটা  (সুভাষন) নিজেই  সুভাষণের একটা উদাহরণ। ইংরেজি ‘ইউফেমিজম’ শব্দটার গোড়া গ্রীক। অর্থ:  ‘যে কথা শুনতে ভালো লাগে’। সুভাষিত করে বললে, ‘শ্রুতিমধুর বচন’। 

ভাষাচার্য  সুকুমার সেন, সুভাষণ পরিচয় দিছেন এইভাবে:  

অকল্যাণসূচক অথবা নিন্দিত বা কুৎসিত  অর্থকে কল্যাণসূচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করিবার জন্য সুভাষণ (Euphemism) অলঙ্কারের আশ্রয় লওয়া হয়।

বিখ্যাত একটা ডিকশনারি অনুযায়ী,‘অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর কোনো বিষয়ে বলতে, যেমন, মৃত্যু ও সেক্স,  লোকে যে শিষ্ট শব্দ কিংবা অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তা-ই সুভাষণ।‘  

সুভাষণ উপরের সংজ্ঞা দুইটার চাইতে বিস্তৃত হইলেও এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলবে। উদাহরণ: ‘মরা’র পরিবর্তে সুভাষণ ‘শেষনিশ্বাস ত্যাগ করা’।   

কি চমৎকার দেখা গেল! 

ক্ষমতা-আধিপত্য ভাষার উপর দাপট চালাইতে থাকে। ভাষারে খাটায়ে নেয় তারা। শতভাগ  সফল অবশ্য হয় না। ভাষার ভেতরে কিছু ‘টির‍্যানি’  বা স্বৈরাচারী দিক আছে বইলা  লুদভিগ হ্বিটগেনস্টাইন মন্তব্য করছিলেন তার নোটবুকে। 

যাহোক, সেই দাপটের বিষয়ে আসা যাক। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স এইসব মিডিয়া যেগুলোতে, বঙ্গীয় সুশীলের নিরঙ্কুশ আস্থা, তারাই, আফ্রিকায় দাঙ্গাটাংগা হলে, নাম দেয় ‘ট্রাইবাল কনফ্লিক্ট’ আর  ইউরোপের আশেপাশে ঘটলে নাম হয় ‘এথনিক ক্লিনজিং’। ফলে জোসেফ কনরাডের ১৮৯৭ সালের গল্প, ‘অ্যান আউটপোস্ট অফ প্রগ্রেস’ –এ দেখা যায়, যারা অন্য দেশ দখল করতে যায়, তারা তীর্থযাত্রী (‘পিলগ্রিম’); আর লুঠ-করা সামগ্রীর গুদামের নাম, ‘ফেটিশ’! 

গায়ের জোর দিয়া তো মনের ক্ষোভ কমানো যায় না, ফলে ভাষারে যতটা সম্ভব আদুরে বানানো হয়। নির্ভেজাল হত্যাকান্ডের নামও দেয়া হয়, পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি (কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ)। ২০ শতকের ৯০ এর দশকে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এক নারীকে যৌন-হেনস্থার অভিযোগ উঠলে, অনেক বাকবিতণ্ডার পর, তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তার আচরণ অসঙ্গত (‘ইনএ্যাপ্রোপ্রিয়েট’) ছিল। বলা বাহুল্য পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ভার্বাল এপ্রোচটা কিন্তু সঙ্গত (এপ্রোপ্রিয়েট) ছিল! এইরকমই হয় ভাষা পরিস্থিতিতে। প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় জানা গেল, অন্য দেশে বোমা ফেলতে যাইতেছে যে বিমান, তার নাম:  প্যাট্রিয়ট। (এই প্রসঙ্গে কারও মনে পড়তে পারে, সোনার বাংলায়ও এভাবে  কেউ কেউ ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পায়)।     

শুধুমাত্র ডান্ডা দিয়া  মানুষরে পোষ মানানো যায় না।  যে গরুরে হাজার বছর ধরে পোষ মানায়ে নেওয়া হইছে, সেই গরুও  (মানে বাছুর) জন্মেই  তিড়িংবিড়িং লাফ মারে।

মানুষরে পোষ মানাইতে অনেক প্রকার সাংস্কৃতিক ট্রেনিং বা সুশীলায়নের দরকার হয়; চমস্কির ইনডকট্রিনেশন সিস্টেমের বাংলা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন: দীক্ষায়ন প্রকৌশল (পোষমানা মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া বলা যায়)। আর ভাষাও সেইখানে একটা বড় রোল প্লে করে; যদিও আদমের বেটা মানুষরে পুরোপুরি ডোমেস্টিক বানানো যায় না। অনেকখানি যায়।         

এই কথার প্রমাণ পাবেন যখন দেখবেন,  সন্ত্রাসী বা কথিত সন্ত্রাসীরে বা নিরীহ লোককে ( পাঠক, ঝালকাঠির  তরুণ লিমনের কথা মনে আছে আপনার?) ঠান্ডা মাথায় কমান্ডো স্টাইলে খুন করারেও তাই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বইলা চালাইতে হয়। চাষীর জমি কাইড়া নিয়া কারখানা বানানোর নাম দেয়া হয়, ‘শিল্পায়ন’। 

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

জন এফ কেনেডি ১৯৬৩ সালে সেপ্টেম্বরে  এক টিভি ইন্টারভিউতে ভিয়েতনামের সৈন্য পাঠানোর  ব্যাপারে যেমন বলেন,  ‘… আমরা সেইখানে আমাদের লোকজনরে উপদেষ্টা হিসেবে পাঠাইতে পারি, তবে, ভিয়েতনামের জনগণরে কিন্তু জিততে হবে।‘  সেই উপদেষ্টাদের চেহারা ও স্বভাব ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে জানা যায়। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর  ‘সুভাষণ’-এর একটা মাত্র নমুনাঃ নাপাম বোমার পরিবর্তে সুভাষিত হালকা/ বাছাইকৃত রসদ-এর ব্যবহার। 

উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানো তার বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ হাজির করছেন। যেমন:  

ভিক্টোরিয়ান আমলে অবিবাহিত নারীর সামনে কেউ ট্রাউজারস-এর উল্লেখ করত না। তেমনি, কিছু জিনিস আছে যা জনসম্মুখে আজকাল একজন চাইলেই বলতে পারে না:

★ সাম্রাজ্যবাদরে বলা হয় ‘বিশ্বায়ন’ 

★ বামনরে যেমন বলা যাইতে পারে শিশু তেমনি সাম্রাজ্যবাদের শিকারগুলোরে বলা হয় ‘উন্নয়নশীল দেশ’

★ সুবিধাবাদিতাকে বলা হয় ‘বাস্তববাদিতা’

★ গরিব লোকদের বলা হয় ‘অল্প আয়ের লোক’ 

★কোন কৈফিয়ত বা জবাবদিহিতা ছাড়া কর্মীদের ছাটাই/ বহিষ্কার করতে মালিকের ক্ষমতারে বলা হয় ‘নমনীয়  শ্রম বাজার’ (flexible labor market)

★জুলুমরে বলা হয় ‘অবৈধ জবরদস্তি’ অথবা ‘শারীরিক এবং মানসিক চাপ’

★ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের জনসম্পদ লুটপাট ‘বেআইনি সমৃদ্ধি’র নাম 

★ একজন কৃষ্ণাঙ্গ হইল ‘বর্ণময় মানুষ’

★ সামরিক অপারেশনে নিহত লোকেরা মৃত না, যুদ্ধে নিহতেরা হইলো ‘ক্ষয়ক্ষতি’ 

★ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে, ১৯৯৫ সালে, ফ্রান্স যখন নিউক্লিয়ার পরীক্ষা চালায়, তখন নিউজিল্যান্ডে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বোমা শব্দটা পছন্দ করি না। এগুলো বোমা না, এগুলো বিস্ফোরক বস্তু।

কেন সুভাষণ?  

ব্রাজিলিয়ান লেখক রুবেন ফনসেকার একটা ডার্ক কমেডিক গল্পে একজন আইনের প্রফেসরের সুভাষণের প্রতি এতো ঝোঁক ছিল, বা ট্যাবু-টার্মের প্রতি এমন বিরাগ ছিল যে, সে সঙ্গম বা সেক্স শব্দের কোনো প্রতিশব্দই ব্যবহার করতেন না কথাবার্তায়। নিতান্ত বাধ্য হইলে ল্যাটিন ‘ইন্ত্রোদাকসিও পিনিস ইন্ত্রা ভাস’ কথাটা কইতেন। 

আমাদের দেশেও ইংরেজ-ব্রাহ্ম বাহিত সুশীল সম্প্রদায়  রুচিতে ভিক্টোরিয়ানদের চেয়েও বেশি ভিক্টোরিয়ান।       

কী কী আমাদেরে বিব্রত করে জানতে-বুঝতে চমৎকার একটা উপায় হইতে পারে আমাদের ভাষিক পরিহার–প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া। কারণ সেসব আমাদের মনের অবস্থার প্রতি ইশারা করে। কোনটা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, বিব্রত করে, কোন বিষয়, প্রসঙ্গ বা আলোচ্য বিষয় ট্যাবু আমাদের কাছে? কোন কথাটারে ঘুরায়ে বদলায়ে বলতে হয়?   

সুভাষণ স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ জনসম্মুখে/ পাবলিকলি বলতে হেল্পায়। এমনভাবে, যেন ব্যবহারকারী সেইগুলা (বিষয়গুলা) নিয়া না, অন্য কিছু নিয়ে বলতেছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এজেন্ট এদের করা ম্যানিপুলেশনে সুভাষণ প্রায়শই  অন্যতম হাতিয়ার হয়া ওঠে। খালি ট্যাবুটার্মগুলো বলতেই সুভাষণ ব্যবহৃত হয় তা না, বরং সত্যিরে, বাস্তবতারে প্রায়ই ঢাইকা রাখতে, চরম বৈষম্যরে সহনীয় কইরা তুলতে, ক্ষমতা-শ্রেণি-কর্তৃত্বকে ভাষিক অভিব্যক্তিগুলা থিকা আড়াল করতে সুভাষণ  খুবই ফলদায়ক। যেই সমাজে বৈষম্য যত বেশি, গুটিকয়েকের আধিপত্য যত বেশি সেই সমাজের শাসক-সুবিধাভোগী শ্রেণিরে ততবেশি সুভাষিত হইতে হয়।   

বিশ্বজুড়ে সুভাষণের প্রধান ভোক্তাশ্রেণি মিডলক্লাস। গবেষকেরা দেখছেন, যারা লোয়ার ক্লাস থেকে আপার ক্লাসের দিকে যায়, তাদের উক্তি বেশি সুভাষিত। কারণ তাদের কাছে সুভাষণ ক্লাস-মার্কার বিশেষ। অবশ্য এর মানে এইটা না যে লোয়ার থেকে আপারের দিকে যত যাওয়া যাবে সুভাষন তত বাড়বে। বরং উলটা আপার এবং লোয়ার- উভয় ক্লাসই মিডলক্লাসের চেয়ে কম সুভাষিত উক্তি ইউজ করে।  

মধ্যবিত্তের (ইকোনমিক ও কালচারাল উভয় বিবেচনায় মধ্যবিত্তের কথা বলা হইতেছে) সুভাষনের সাথে লেপ্টে থাকতে চাওয়ার কারণ খালি  সত্যরে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলারে এড়ানো বা গোপন রাখার প্রবণতা না। সুভাষণ মধ্যবিত্তের খুব প্রিয় কারণ  সামাজিক আড়ম্বরের প্রতি তাদের আকুল-আকাঙ্ক্ষায়  সুভাষন সাহায্য করে, হেল্পায়। এইটা সম্ভব হয়, কারণ বেশিরভাগ সুভাষনে সিলেবল বাড়ায়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আর মধ্যবিত্ত মনন সংখ্যায় বিপুল হওয়ারে ওজন ও মূল্যে বিপুল হওয়ার সাথে গোল পাকায়ে ফেলে।      

অলঙ্করণঃ ঈহা

অবশ্য সুভাষণ  মানেই যে সবসময় অধিপতির শ্রেণিস্বার্থ কায়েমে ষড়যন্ত্রবিশেষ –এইটা বলা যায় না।  বেশিরভাগ সময়,অবশ্য, এইটা শ্রেণী স্বার্থে উপাদেয় ফল দেয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে সদর্থেও  সুভাষণ ব্যবহৃত হইতে পারে। ভাষিক সৌন্দর্য বাড়ায় কখনো কখনো। খুব বেদনাদায়ক কিছু করার আগেও  রোগীকে ডাক্তার হয়ত বলতেছে, ‘একটু লাগবে কিন্তু’।   

সুভাষণের স্বভাব-চরিত্র

সুভাষণ যে শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তার চাইতে অবশ্যই  আকারে বড় হয়। আর বলাবাহুল্য স্বাদু ও  শ্রুতিমধুর হয়। গার্মেন্সে যে কাজ করে তার নাম হয়, পোশাকশ্রমিক। লেবার উপযুক্ত শব্দ। কাজের মেয়ে, ছেমড়ির চেয়ে ‘গৃহপরিচারিকা’ আকারে বড়। 

হিউ রসন তার ‘Dictionary of Euphemisms and other Doubletalk’ এর ভূমিকায় সুভাষনের নীতিটা লিখছেন:

‘সুভাষণ যত দীর্ঘ  তত ভালো। সাধারণত… যে শব্দগুলারে সুভাষণ প্রতিস্থাপিত করে, সুভাষন তাদের চাইতে  দীর্ঘ হয়। বেশি বর্ণযুক্ত, বেশি অক্ষরযুক্ত (সিলেবল অর্থে), প্রায়ই এক অক্ষরের বদলে দুই বা ততোধিক অক্ষর প্রয়োগ করা হয়।’    

বাংলা ভাষার সুভাষণ স্বাভাবিকভাবে ইংরেজির থেকে আলাদা। ইংরেজিতে যেমন ভাষিক ভদ্রায়নে ল্যাটিনাইজেশনের ব্যবহার তেমনি বাংলায় সংস্কৃতায়ন। ইংরেজিতে, স্কুল/ কলেজ যেমন ‘একাডেমিয়া’ ( তা-ও আবার  সিউডোল্যাটিন) হয়া যায়, বাংলায় তেমনি গাঁজা শব্দ ভদ্রস্থ  করতে ‘গঞ্জিকা’র মতো শব্দ বানাইতে হয়। আদতে গঞ্জিকা বলে কোনো সংস্কৃত শব্দ নাই। কেউ শুয়ারের বাচ্চা না বললে, বরাহ শাবক বলে গালি দিলে বুঝবেন, সে তার ভদ্রলোকত্বের সিগন্যাল দিচ্ছে।  

সুভাষনের জনপ্রিয়তম মাধ্যম শিষ্টতা (পোলাইটনেস)। শিষ্টতা নিয়া, অন্তত দুইজন খ্যাতনামা অভিধান রচয়িতা তাদের অভিধানে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করছেন। স্যামুয়েল জনসন আর অ্যামব্রোস বায়ার্স।  প্রথমজনের মতে,  শিষ্টতা হইলো, ‘ভুয়া ভালোমানুষী’  আর ২য় জনের মতে, ‘সবচে গ্রহণযোগ্য ভন্ডামি’   

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বুরদিও’র মতে, কথা বলার সময় সুভাষণ মুনাফারে দ্বিগুণ কইরা দেয়ঃ “the profit of saying and the profit of denying what is said.”  বুরদিও অবশ্য মনে করেন, মানুষের সমস্ত ভাষিক যোগাযোগই কম বা বেশি মাত্রায় সুভাষিত। প্রত্যেকেই কথা বলার/ লেখার আগে নিয়মিত তার অডিয়েন্সের কথা মাথায় রাইখাই সেন্সর করে। সেই অর্থে সবার ভাষাই কম-বেশি ইউফেমিস্টিক। জনাব বুরদিও অবশ্য বলতে ভোলেন না যে,  এই কম-বেশির তফাৎ বিবেচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কারা ব্যবহার করে, কখন, কীভাবে এবং কাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়  সেইটা দেখাও জরুরি।           

‘বিশুদ্ধতা’ জিনিসটার ভেতরেই ( ভিত্রে/মধ্যে, এমনকি আরেকটু রাশভারী, সুশীল করতে ‘অন্তর্গত’ শব্দটাও কইতে পারেন) একটা প্রতিক্রিয়াশীলতা লেপ্টে আছে বলে মনে হয়। অন্তত, বড় রকমের রিজিডিটি  আছে  সন্দেহ নাই।  স্ট্যান্ডার্ড, প্রমিত, মানদন্ড ( এইখানে ‘দন্ড’ কথাটায় একটু নজর দেয়া যায়। দন্ড, মানে ডান্ডা- শাস্তি আর কি।  দেখেন নিরীহ শব্দটার ভিত্রেও কতকিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে) প্রতিক্রিয়াশীল জিনিস। 

বিশুদ্ধতা বলবে এইটা ঠিক/কারেক্ট, ওইটা ভুল/রং। যদিও সুশীল বয়ানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাব্জেক্টিভিটির কথা উচ্চকিত হয়, এইক্ষেত্রে ‘অব্জেক্টিভিটি’ তাদের চাওয়া। এবং সেই তথাকথিত ‘অবজেক্টিভিটি’ আবার খুবই শ্রেণিস্বার্থ ঘেঁষা। ফলে ভাষাগত দিক দিয়া এই বিশুদ্ধতাবাদীরা আসলে ‘মৌলবাদী’, মৌলবাদের  সুশীল যে মিনিং দাঁড়াইছে সেই অর্থে বললাম। 

কেননা তাদের প্রেসক্রাইব করা ভাষার বাইরে কিছু দেখলেই তেনাদের গা জ্বলে  (‘গাত্রদাহ’ বললে একটু ভদ্রস্থ শোনায় না?), আপনি’র জায়গায় ‘আপনে’  দেখলেই  সেই ভাষারে ‘অসাধু’ মনে হওয়া হেতু ‘তাহাদের’ মাথার চান্দি (অথবা ধরেন ব্রহ্মতালু) গরম হইয়া যায়।      

লেজিটিমেট ভাষা,  বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ভাষা ব্যবহারে। তখন, যেকোনো ভাষিক অভিব্যক্তিরে (এক্সপ্রেশন) বিবেচনা করা হয় সেই লেজিটিমেট ভাষার সাপেক্ষে। লেজিটিমেট  ভাষা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও হাসির, উপহাসের এমনকি তিরস্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি’ শব্দটার জায়গায় ‘আপনে’ বসালেই বেশ ফানি ফানি লাগে। 

আমাদের টিভি-নাটক-সিনেমায় দেখবেন, যখনই হিউমারের ঘাটতি পড়ে, তখন ডায়ালেক্ট (আঞ্চলিক ভাষাও বলা যায়, যদিও সবসময় ‘আঞ্চলিক’ আর ‘ডায়ালেক্ট’ সমার্থক না) আইনা খামতি পূর্ণ করা হয়। 

আগে যেমন কলকাত্তাই সিনেমায় ভাঁড় চরিত্রগুলার মুখে ‘বাঙাল’ ভাষা দেখা যাইতো খুব তেমনি  বর্তমানে ‘বাঙাল’ ভাষার জায়গায় এদেশি টিভি-সিনেমায় ডায়ালেক্টগুলা হাস্যরস সাপ্লাই দিতে থাকে। তারও আগে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্রপাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো; গ্রাম্য লোকের  (গাইয়া লোকের) মতো, শহুরে লোকদের আনন্দ দেবার জন্য। 

কিন্তু কেন ডায়ালেক্টগুলা ফানি লাগে? 

ফানি লাগে লেজিটিমেট জায়গা থেকে প্রতিসরণ বা বিচ্যুতি ঘটে বলে?  দর্শক শ্রোতাকে সাময়িক সুপিরিয়রিটির বোধ দিতে থাকে এইরকম হিউমার?  (এমনকি, প্রিয় পাঠক/ পাঠিকা, আপনি সুশীল হইলে,  এই লেখাটা পড়তে গিয়া যদি ২-১টা শব্দ পড়তে গিয়া মৃদু অস্বস্তি লাগে, তবে অবাক হবেন না) 

সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, সুভাষণ সবসময় লেজিটিমেট ভাষার গা ঘেষে চলে। এই লেখাটা সুভাষণ নিয়া, লেজিটিমেট ভাষা কিংবা ভাষার উচু-নিচু বা স্ট্যাটাস  নিয়ে না। বিস্তারিত সেই আলাপ  অন্যত্র করবো। তবু প্রয়োজনে দুই-একটা খুচরো মন্তব্য রেখে যেতে হলো।         

তবুও যদি আপনি খুবই ইনোসেন্ট ধরনের হন আর বলেন,  প্রমিত বা মান ভাষা বলে বাজারে চালু  জিনিসের গলদটা কোথায়?

গলদটা এইখানে যে ভাষার ডাইনামিক ও সৃষ্টিশীল দিকটা অনেক সময় ভাষা হারিয়ে ফেলে, কিংবা অনেক সময় হারিয়ে ফেলা হয় (যেমনটা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে) হয়া যায় টেকনোক্রেটিক শাসনের মতো সেই ভাষা। এবং সেই ভাষা ক্ষমতা-সম্পর্ক রিপ্রডিউস করতে হেল্পায়। 

তখন মুখস্ত বুলি কপচানো পাখির মতো হইয়া যায়, অর্থাৎ ভাষার প্রাঞ্জলতা থাকে না, সৃজনশীলতা থাকে না। সবচে বড় কথা, ভাষার মধ্যে (ভেতরে/ ভিত্রে) বানোয়াট জিনিসপাতি চলতে থাকে। তখন কী হয়, তার প্রমাণ পাবেন, আমাদের বামেরা ‘শোষিত’ শ্রেণির কাছে যে পৌছাতে পারে না , অনেকগুলা কারণের মধ্যে বামদের ভাষাও হয়তো একটা কারণ। ভাষার এহেন অবস্থায়, ভাষার প্রাণটাই যেন মইরা যায়, মেকানিকাল হয়া যায়। কানপাতলে শোনা যায়, ভাষা যেমন জীবন উৎসারিত হওয়ার কথা, সেইরকম ‘কালচার নেচারের ভাষায় কথা বলছে’না।   

একটা ৮/৯ বছরের ছেলে বা পোলা, ‘বাসাবাড়িতে’ কাজ করে, চেনে ঘোড়া আর পাখি। একদিন পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেইখা বলে উঠল, ‘ঘোড়াপাখি’  ‘ঘোড়াপাখি’। যদিও সে পড়তে পারে না, জানে না পেগাসাস বা পঙ্ক্ষীরাজ বলে কোন পৌরাণিক প্রাণীর কথা।  ‘ঘোড়াপাখি’র মতো একটা সৃজনশীল শব্দ তৈরিতে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় কিন্তু সে দিছে।  কিংবা এই বস্তিতে থাকা শিশুরে যদি বলেন, ঝলমল করছে মানে কী? সে যদি উজ্জ্বল না বইলা, ‘যেন লাইট মারছে’ বলে অবাক হবেন না। কারণ এদের ভাষা মধ্যে জীবন উপস্থিত।

দুর্নীতি মানে জিজ্ঞেস করলে, ভদ্রলোক হয়ত বলবে, অন্যায় কাজ, রীতিলঙ্ঘন ইত্যাদি। যে নিরক্ষর সে আপনারে  হয়তো বলতে গিয়া বর্ণনাই দিয়ে ফেলল, ‘দুর্নীতি মানে ধরেন, র‍্যাশন কার্ড আনতে গেছি, ঘুষ নেল’। যা ক্ষমতা-কাঠামোর বুকের সাথে লেপ্টে থাকা  ‘প্রায়’ মেকানিকাল ভাষা (অঙ্গীভূত হয়েছেও বলতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নাই) আপনাকে এই সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্ছিত করবে।     

কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘শব্দের ভেতর দিয়েই চিন্তার জন্ম হয়’।আর আমাদের  চিন্তা-ভাবনা আগে ভাগেই  ভাষার আবেষ্টনে আবদ্ধ থাকে  অনেকখানি (অলরেডি এনকমপাসড বাই দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ দ্যাট ইজ আওয়ার ওন’)

(কীভাবে, কেমনে হয়, সে- আলাপ বিস্তারের সুযোগ এখানে নাই বলে দুইজন উল্লেখযোগ্য ভাষাবিদের উদ্ধৃতি রেখে গেলাম। এই ব্যাপারে ভিন্নমতের বা কৌতূহলী যে কারুর সাথে সতর্ক ( তর্কের সহিত বর্তমান) আলাপে আমার কোনো আপত্তি নাই। )    

এই প্রভাবিত/ নির্ধারিত হওয়াটা একতরফা না যে খালি ভাষাব্যবহারই চিন্তারে ডমিনেট করবে, বরং প্রক্রিয়াটা দ্বান্দ্বিক। সংস্কৃতি যেমন ভাষার রূপরীতি ঠিক করে দেয়, একটা সমাজের চিন্তাজগতও প্রভাবিত হয় আবার সেই সমাজের প্রচলিত ভাষা-কাঠামোরে কেন্দ্র কইরা। ভাষা গবেষকেরা নিঃসন্দেহ, ব্যক্তির চিন্তা তার সমাজের বিদ্যমান ভাষা-কাঠামো দ্বারা  প্রভাবিত হয়। যত কল্পনাশক্তি বা সৃজনশীলতার অধিকারী আপনি হননা কেন, যে ভাষিক আবহাওয়া ও জলবায়ুতে আপনার থাকা, বেড়ে ওঠা, সেই ভাষার কাঠামোর বাইরে গিয়া চিন্তা বা ভাষিক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করা খুব কঠিন। 

তো, কী  করতে পারেন?

ভাষা ব্যবহারেও হয়ত বড়জোর লড়াই না হোক, প্রতিরোধী অবস্থানটা জানাইতে পারেন।

সুভাষণ যখন শোষণে সহায়ক, শ্রেণি-কর্তৃত্বের আধিপত্যের সহায়ক তখন  (যতটা সম্ভব) এভয়েড করা গেলে তো ভালোই, নতুন শব্দও ব্যবহার করতে পারেন। জরুরী ভাষা ব্যবহারে চোখ-কান খোলা রাখা সচেতনতা। কেউ কেউ সেই চেষ্টা করেন নাই এমন না, মার্ক্সিস্ট শব্দটার বাজার চলতি নেগেটিভ দিকটা টের পায়া ধূর্জটিপ্রসাদ নিজের পরিচয় দিতেন মার্ক্সোলজিস্ট বলে। ভেরিয়ার এলউইন এ্যান্থ্রোপলজিস্ট না বলতে নিজেরে বলতে চাইতেন, ফিল্যানথ্রোপলজিস্ট। বাংলায় যারা এনার্কিজম নিয়ে আগ্রহী, তারাও প্রথমে ‘নৈরাজ্যবাদ’ বললেও শব্দটার নেগেটিভ এ্যাসোসিয়েশন টের পেয়ে ‘অরাজপন্থা’ বলা শুরু করছেন। 

ক্ষমতা-কর্তৃত্ব-শোষণে সুভাষণের যেভাবে ব্যবহার হইতেছে, সেই বিষয়ে সচেতনতাও কাজের। কোনো কৌশলের ব্যাপারে সতেচন হওয়া মানে সেই কৌশলকেই অনেকখানি অকেজো কইরা দেওয়া।      

এমন এককালে আমরা বাস করি যখন গনহত্যারে বলা হয় দুর্ঘটনা। 

গরিবের-কৃষকের জমি দখলের নাম  শিল্পায়ন,. প্রানপ্রকৃতি ধ্বংসের নাম ডেভেলাপমেন্ট (উন্নয়ন-এর চেয়ে স্মার্ট, মিষ্টিও লাগে শুনতে)। পাছায় বাঁশ ঢুকাইতে ঢুকাইতে বলা হয়, ইতিবাচক হও। থিংক পজিটিভ। বি পজিটিভ। 

আইডিওলজিক্যাল পজিটিভিজমের এই রমরমা সময়ে, ইতিবাচকতার মহামারির এই কালে এক নম্বর মিথ্যাবাক্য, আপনা ভালো তো জগত ভালো। আপনি ভালো হলেই জগত ভালো হবে না। আপনার ভাষিক অভিব্যক্তি যতই ‘ইতিবাচক’  আর সুভাষণে ভরপুর হোক, তা কেবল বাস্তবতারে, সত্যরে আড়াল করতে থাকবে।

গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস বলতেন, বলতেন ওয়াল্টার বেনইয়ামিনও, প্রতিটি সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের আগে মুখোশ পইড়া নেয়।    


[ টীকাটিপ্পনী: 

একাডেমিক লেখার মতো উদ্ধৃতি-পাদটীকা দিতে আমার বিরক্তি লাগে। এইখানে, পন্ডিত লোকের বই-এর উদ্ধৃতি দেখলে যাদের লেখকের প্রতি সমীহ জাইগা ওঠে,- আরিব্বাবা উনি তো বেশ জ্ঞানী লোক- সেইসব সুশীলদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তি উপহার প্রদানের নিমিত্তে, তাহাদের শ্রীচরণে এই রেফারেন্সগুলা নিবেদিত।     

  সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত। বর্ধমান সাহিত্যসভা, বর্ধমান, ১৯৫৭ সাল, ৫ম সংস্করণ।

জন সিনক্লেয়ার প্রণীত, কলিন্স কোবিল্ড লার্নার’স ইলাস্ট্রটেড ডিকশনারি, ২০০৯ সংস্করণ। 

এদুয়ার্দো গালেয়ানো, আপসাইড ডাউন এ প্রাইমার ফর দ্য লুকিং-গ্লাস ওয়ার্ল্ড। বইয়ের ‘দ্য লুকিং-গ্লাস স্কুল’ অধ্যায়ের  ‘ইনজাস্টিস ১০১’  অংশ দ্রষ্টব্য।    

  হিউ রঅসন, দ্য ডিকশনারি অফ ইউফেমিজমস এন্ড আদার ডাব্‌লটক, পৃ: ১০,  ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮১। বন্ধনীর ভেতরে শব্দ বর্তমান লেখকের।   

স্যামুয়েল জনসনরে প্রায় সবাই অভিধানপ্রণেতা হিসেবে জানলেও সাহিত্যিক অ্যামব্রোস বায়ার্স যে, ‘দ্য ডেভিল্‌স  ডিকশনারি’ নামে প্রজ্ঞা ও ব্ল্যাক হিউমারে ভরপুর একখানা অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটা হয়ত অনেকেই জানে না।  

গৌতম ভদ্র, ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার যায়?’ পৃ: ২৩  ছাতিম, কলকাতা। যদিও বইটা ভিন্ন বিষয়ের, মন্তব্যটা আমার ভাল্লাগছে।      

  এল. এস. ভাইগটস্কি, থট এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৬২, পৃ: ১৫৩  

এইচ.  জি. গাডামার, ফিলসফিকাল হের্মেনিউটিক্স, ১৯৭৬, পৃ: ৬২ ]  

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।