KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি

সমাজে সমস্ত প্রকার বৈষম্য সহনীয় করে তুলতে  ভাষাগত ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরী। 

এই ভাষা হয় সুভাষণ (ইউফেমিজম) আর কোমলতায় গড়া। নকল অলঙ্কারে ঝলমল করতে থাকে ভাষার শরীর। তাকাইলে চোখে ধাঁধা লাগে। আর তাই সতর্ক না হইলে সেই ধাঁধাঁ-লাগা চোখে সত্যিগুলা ধরাই পড়ে না। 

কারণ ভাষা  প্রকাশ করে না শুধু, গোপনও করে। শুধু সংযুক্ত নয় বিযুক্তও করে।  

কনফুসিয়াসের নামে একটা কাহিনী চালু আছে। কনফুসিয়াসরে একবার জিগানো হইলো যে, তিনি পৃথিবীর সম্রাট হইলে কোন কাজটা প্রথমে করতেন? উনি কইছিলেন, তার প্রথম কাজ হবে ভাষারে বদলায়ে ফেলা।   

কনফুসিয়াস ভাষারে বদলানোর সুযোগ  না পাইলেও আধুনিক যুগে আইসা অধিপতি শ্রেণির হাতে ভাষারে অনেকাংশে গড়েপিটে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

জর্জ ওরয়েলের  সেই  ‘১৯৮৪’ বইটার কথা মনে পড়বে আমাদের  যেইখানে নিউস্পিক বা নয়াজবান চালু হইছিল। সব ভালো কথা কইতে হবে। নেগেটিভ কিচ্ছু বলা যাবে না। ফলে ভাষার এমন বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে শ্রেণী-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না।  

সুশীল সমাজ টিভি মিডিয়া পত্রিকার কলামিস্ট সেই নয়াজবানের খেদমতগার। কেউ জ্ঞানত, কেউ অজ্ঞানত। যে লোক প্রকৃতপক্ষে, ‘লেবার’ বা যে বদলা খাটে/ কামলা খাটে তারে মর্যাদাপূর্ণ ‘শ্রমিক’ নামে ডাকা হয়। বাসার যে কাজের বুয়া, কাজের মাইয়া/ ছেমড়ি/ছেড়ি তার জন্যও সুন্দর-মার্জিত এবং ‘তৎসমায়িত’ নাম বরাদ্দ করা হইছে: গৃহপরিচারিকা। ‘গার্মেন্সে কাম’  যারা করে তাদেরও মহিমান্বিত নাম ‘পোষাকশ্রমিক’।       

সুভাষণ কী? 

সোনার বাংলায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের ক্ষেত্রে অলিখিত তরিকা হইলো, লেখার শিরোনামের মূলশব্দটা নিয়া  প্যাচাল পারা, ত্যানা প্যাচানো। যেমন, ধরেন, ক্যাকটাস নিয়ে লিখতে গিয়ে  আদিতে গ্রীকভাষায় শব্দটার মানে কী ছিলো?  ‘অন্ডকোষ। এইবারে শব্দটা ভাঙো, কোন্‌ অংশের কী অর্থ, সবমিলে কী দাঁড়াইল…  এইসব ইনায়ে- বিনায়ে লিখতে হবে কমসে কম এক পৃষ্ঠা। তারপর আলোচ্য বিষয়ে বিখ্যাত লোকেদের কয়েকটা বানী এস্তেমাল করা। 

সেই রাস্তা ফলো করা যাক, কিন্তু সংক্ষেপে।                

সুভাষণ বাংলা প্রতিশব্দটা  (সুভাষন) নিজেই  সুভাষণের একটা উদাহরণ। ইংরেজি ‘ইউফেমিজম’ শব্দটার গোড়া গ্রীক। অর্থ:  ‘যে কথা শুনতে ভালো লাগে’। সুভাষিত করে বললে, ‘শ্রুতিমধুর বচন’। 

ভাষাচার্য  সুকুমার সেন, সুভাষণ পরিচয় দিছেন এইভাবে:  

অকল্যাণসূচক অথবা নিন্দিত বা কুৎসিত  অর্থকে কল্যাণসূচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করিবার জন্য সুভাষণ (Euphemism) অলঙ্কারের আশ্রয় লওয়া হয়।

বিখ্যাত একটা ডিকশনারি অনুযায়ী,‘অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর কোনো বিষয়ে বলতে, যেমন, মৃত্যু ও সেক্স,  লোকে যে শিষ্ট শব্দ কিংবা অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তা-ই সুভাষণ।‘  

সুভাষণ উপরের সংজ্ঞা দুইটার চাইতে বিস্তৃত হইলেও এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলবে। উদাহরণ: ‘মরা’র পরিবর্তে সুভাষণ ‘শেষনিশ্বাস ত্যাগ করা’।   

কি চমৎকার দেখা গেল! 

ক্ষমতা-আধিপত্য ভাষার উপর দাপট চালাইতে থাকে। ভাষারে খাটায়ে নেয় তারা। শতভাগ  সফল অবশ্য হয় না। ভাষার ভেতরে কিছু ‘টির‍্যানি’  বা স্বৈরাচারী দিক আছে বইলা  লুদভিগ হ্বিটগেনস্টাইন মন্তব্য করছিলেন তার নোটবুকে। 

যাহোক, সেই দাপটের বিষয়ে আসা যাক। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স এইসব মিডিয়া যেগুলোতে, বঙ্গীয় সুশীলের নিরঙ্কুশ আস্থা, তারাই, আফ্রিকায় দাঙ্গাটাংগা হলে, নাম দেয় ‘ট্রাইবাল কনফ্লিক্ট’ আর  ইউরোপের আশেপাশে ঘটলে নাম হয় ‘এথনিক ক্লিনজিং’। ফলে জোসেফ কনরাডের ১৮৯৭ সালের গল্প, ‘অ্যান আউটপোস্ট অফ প্রগ্রেস’ –এ দেখা যায়, যারা অন্য দেশ দখল করতে যায়, তারা তীর্থযাত্রী (‘পিলগ্রিম’); আর লুঠ-করা সামগ্রীর গুদামের নাম, ‘ফেটিশ’! 

গায়ের জোর দিয়া তো মনের ক্ষোভ কমানো যায় না, ফলে ভাষারে যতটা সম্ভব আদুরে বানানো হয়। নির্ভেজাল হত্যাকান্ডের নামও দেয়া হয়, পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি (কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ)। ২০ শতকের ৯০ এর দশকে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এক নারীকে যৌন-হেনস্থার অভিযোগ উঠলে, অনেক বাকবিতণ্ডার পর, তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তার আচরণ অসঙ্গত (‘ইনএ্যাপ্রোপ্রিয়েট’) ছিল। বলা বাহুল্য পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ভার্বাল এপ্রোচটা কিন্তু সঙ্গত (এপ্রোপ্রিয়েট) ছিল! এইরকমই হয় ভাষা পরিস্থিতিতে। প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় জানা গেল, অন্য দেশে বোমা ফেলতে যাইতেছে যে বিমান, তার নাম:  প্যাট্রিয়ট। (এই প্রসঙ্গে কারও মনে পড়তে পারে, সোনার বাংলায়ও এভাবে  কেউ কেউ ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পায়)।     

শুধুমাত্র ডান্ডা দিয়া  মানুষরে পোষ মানানো যায় না।  যে গরুরে হাজার বছর ধরে পোষ মানায়ে নেওয়া হইছে, সেই গরুও  (মানে বাছুর) জন্মেই  তিড়িংবিড়িং লাফ মারে।

মানুষরে পোষ মানাইতে অনেক প্রকার সাংস্কৃতিক ট্রেনিং বা সুশীলায়নের দরকার হয়; চমস্কির ইনডকট্রিনেশন সিস্টেমের বাংলা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন: দীক্ষায়ন প্রকৌশল (পোষমানা মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া বলা যায়)। আর ভাষাও সেইখানে একটা বড় রোল প্লে করে; যদিও আদমের বেটা মানুষরে পুরোপুরি ডোমেস্টিক বানানো যায় না। অনেকখানি যায়।         

এই কথার প্রমাণ পাবেন যখন দেখবেন,  সন্ত্রাসী বা কথিত সন্ত্রাসীরে বা নিরীহ লোককে ( পাঠক, ঝালকাঠির  তরুণ লিমনের কথা মনে আছে আপনার?) ঠান্ডা মাথায় কমান্ডো স্টাইলে খুন করারেও তাই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বইলা চালাইতে হয়। চাষীর জমি কাইড়া নিয়া কারখানা বানানোর নাম দেয়া হয়, ‘শিল্পায়ন’। 

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

জন এফ কেনেডি ১৯৬৩ সালে সেপ্টেম্বরে  এক টিভি ইন্টারভিউতে ভিয়েতনামের সৈন্য পাঠানোর  ব্যাপারে যেমন বলেন,  ‘… আমরা সেইখানে আমাদের লোকজনরে উপদেষ্টা হিসেবে পাঠাইতে পারি, তবে, ভিয়েতনামের জনগণরে কিন্তু জিততে হবে।‘  সেই উপদেষ্টাদের চেহারা ও স্বভাব ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে জানা যায়। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর  ‘সুভাষণ’-এর একটা মাত্র নমুনাঃ নাপাম বোমার পরিবর্তে সুভাষিত হালকা/ বাছাইকৃত রসদ-এর ব্যবহার। 

উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানো তার বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ হাজির করছেন। যেমন:  

ভিক্টোরিয়ান আমলে অবিবাহিত নারীর সামনে কেউ ট্রাউজারস-এর উল্লেখ করত না। তেমনি, কিছু জিনিস আছে যা জনসম্মুখে আজকাল একজন চাইলেই বলতে পারে না:

★ সাম্রাজ্যবাদরে বলা হয় ‘বিশ্বায়ন’ 

★ বামনরে যেমন বলা যাইতে পারে শিশু তেমনি সাম্রাজ্যবাদের শিকারগুলোরে বলা হয় ‘উন্নয়নশীল দেশ’

★ সুবিধাবাদিতাকে বলা হয় ‘বাস্তববাদিতা’

★ গরিব লোকদের বলা হয় ‘অল্প আয়ের লোক’ 

★কোন কৈফিয়ত বা জবাবদিহিতা ছাড়া কর্মীদের ছাটাই/ বহিষ্কার করতে মালিকের ক্ষমতারে বলা হয় ‘নমনীয়  শ্রম বাজার’ (flexible labor market)

★জুলুমরে বলা হয় ‘অবৈধ জবরদস্তি’ অথবা ‘শারীরিক এবং মানসিক চাপ’

★ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের জনসম্পদ লুটপাট ‘বেআইনি সমৃদ্ধি’র নাম 

★ একজন কৃষ্ণাঙ্গ হইল ‘বর্ণময় মানুষ’

★ সামরিক অপারেশনে নিহত লোকেরা মৃত না, যুদ্ধে নিহতেরা হইলো ‘ক্ষয়ক্ষতি’ 

★ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে, ১৯৯৫ সালে, ফ্রান্স যখন নিউক্লিয়ার পরীক্ষা চালায়, তখন নিউজিল্যান্ডে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বোমা শব্দটা পছন্দ করি না। এগুলো বোমা না, এগুলো বিস্ফোরক বস্তু।

কেন সুভাষণ?  

ব্রাজিলিয়ান লেখক রুবেন ফনসেকার একটা ডার্ক কমেডিক গল্পে একজন আইনের প্রফেসরের সুভাষণের প্রতি এতো ঝোঁক ছিল, বা ট্যাবু-টার্মের প্রতি এমন বিরাগ ছিল যে, সে সঙ্গম বা সেক্স শব্দের কোনো প্রতিশব্দই ব্যবহার করতেন না কথাবার্তায়। নিতান্ত বাধ্য হইলে ল্যাটিন ‘ইন্ত্রোদাকসিও পিনিস ইন্ত্রা ভাস’ কথাটা কইতেন। 

আমাদের দেশেও ইংরেজ-ব্রাহ্ম বাহিত সুশীল সম্প্রদায়  রুচিতে ভিক্টোরিয়ানদের চেয়েও বেশি ভিক্টোরিয়ান।       

কী কী আমাদেরে বিব্রত করে জানতে-বুঝতে চমৎকার একটা উপায় হইতে পারে আমাদের ভাষিক পরিহার–প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া। কারণ সেসব আমাদের মনের অবস্থার প্রতি ইশারা করে। কোনটা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, বিব্রত করে, কোন বিষয়, প্রসঙ্গ বা আলোচ্য বিষয় ট্যাবু আমাদের কাছে? কোন কথাটারে ঘুরায়ে বদলায়ে বলতে হয়?   

সুভাষণ স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ জনসম্মুখে/ পাবলিকলি বলতে হেল্পায়। এমনভাবে, যেন ব্যবহারকারী সেইগুলা (বিষয়গুলা) নিয়া না, অন্য কিছু নিয়ে বলতেছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এজেন্ট এদের করা ম্যানিপুলেশনে সুভাষণ প্রায়শই  অন্যতম হাতিয়ার হয়া ওঠে। খালি ট্যাবুটার্মগুলো বলতেই সুভাষণ ব্যবহৃত হয় তা না, বরং সত্যিরে, বাস্তবতারে প্রায়ই ঢাইকা রাখতে, চরম বৈষম্যরে সহনীয় কইরা তুলতে, ক্ষমতা-শ্রেণি-কর্তৃত্বকে ভাষিক অভিব্যক্তিগুলা থিকা আড়াল করতে সুভাষণ  খুবই ফলদায়ক। যেই সমাজে বৈষম্য যত বেশি, গুটিকয়েকের আধিপত্য যত বেশি সেই সমাজের শাসক-সুবিধাভোগী শ্রেণিরে ততবেশি সুভাষিত হইতে হয়।   

বিশ্বজুড়ে সুভাষণের প্রধান ভোক্তাশ্রেণি মিডলক্লাস। গবেষকেরা দেখছেন, যারা লোয়ার ক্লাস থেকে আপার ক্লাসের দিকে যায়, তাদের উক্তি বেশি সুভাষিত। কারণ তাদের কাছে সুভাষণ ক্লাস-মার্কার বিশেষ। অবশ্য এর মানে এইটা না যে লোয়ার থেকে আপারের দিকে যত যাওয়া যাবে সুভাষন তত বাড়বে। বরং উলটা আপার এবং লোয়ার- উভয় ক্লাসই মিডলক্লাসের চেয়ে কম সুভাষিত উক্তি ইউজ করে।  

মধ্যবিত্তের (ইকোনমিক ও কালচারাল উভয় বিবেচনায় মধ্যবিত্তের কথা বলা হইতেছে) সুভাষনের সাথে লেপ্টে থাকতে চাওয়ার কারণ খালি  সত্যরে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলারে এড়ানো বা গোপন রাখার প্রবণতা না। সুভাষণ মধ্যবিত্তের খুব প্রিয় কারণ  সামাজিক আড়ম্বরের প্রতি তাদের আকুল-আকাঙ্ক্ষায়  সুভাষন সাহায্য করে, হেল্পায়। এইটা সম্ভব হয়, কারণ বেশিরভাগ সুভাষনে সিলেবল বাড়ায়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আর মধ্যবিত্ত মনন সংখ্যায় বিপুল হওয়ারে ওজন ও মূল্যে বিপুল হওয়ার সাথে গোল পাকায়ে ফেলে।      

অলঙ্করণঃ ঈহা

অবশ্য সুভাষণ  মানেই যে সবসময় অধিপতির শ্রেণিস্বার্থ কায়েমে ষড়যন্ত্রবিশেষ –এইটা বলা যায় না।  বেশিরভাগ সময়,অবশ্য, এইটা শ্রেণী স্বার্থে উপাদেয় ফল দেয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে সদর্থেও  সুভাষণ ব্যবহৃত হইতে পারে। ভাষিক সৌন্দর্য বাড়ায় কখনো কখনো। খুব বেদনাদায়ক কিছু করার আগেও  রোগীকে ডাক্তার হয়ত বলতেছে, ‘একটু লাগবে কিন্তু’।   

সুভাষণের স্বভাব-চরিত্র

সুভাষণ যে শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তার চাইতে অবশ্যই  আকারে বড় হয়। আর বলাবাহুল্য স্বাদু ও  শ্রুতিমধুর হয়। গার্মেন্সে যে কাজ করে তার নাম হয়, পোশাকশ্রমিক। লেবার উপযুক্ত শব্দ। কাজের মেয়ে, ছেমড়ির চেয়ে ‘গৃহপরিচারিকা’ আকারে বড়। 

হিউ রসন তার ‘Dictionary of Euphemisms and other Doubletalk’ এর ভূমিকায় সুভাষনের নীতিটা লিখছেন:

‘সুভাষণ যত দীর্ঘ  তত ভালো। সাধারণত… যে শব্দগুলারে সুভাষণ প্রতিস্থাপিত করে, সুভাষন তাদের চাইতে  দীর্ঘ হয়। বেশি বর্ণযুক্ত, বেশি অক্ষরযুক্ত (সিলেবল অর্থে), প্রায়ই এক অক্ষরের বদলে দুই বা ততোধিক অক্ষর প্রয়োগ করা হয়।’    

বাংলা ভাষার সুভাষণ স্বাভাবিকভাবে ইংরেজির থেকে আলাদা। ইংরেজিতে যেমন ভাষিক ভদ্রায়নে ল্যাটিনাইজেশনের ব্যবহার তেমনি বাংলায় সংস্কৃতায়ন। ইংরেজিতে, স্কুল/ কলেজ যেমন ‘একাডেমিয়া’ ( তা-ও আবার  সিউডোল্যাটিন) হয়া যায়, বাংলায় তেমনি গাঁজা শব্দ ভদ্রস্থ  করতে ‘গঞ্জিকা’র মতো শব্দ বানাইতে হয়। আদতে গঞ্জিকা বলে কোনো সংস্কৃত শব্দ নাই। কেউ শুয়ারের বাচ্চা না বললে, বরাহ শাবক বলে গালি দিলে বুঝবেন, সে তার ভদ্রলোকত্বের সিগন্যাল দিচ্ছে।  

সুভাষনের জনপ্রিয়তম মাধ্যম শিষ্টতা (পোলাইটনেস)। শিষ্টতা নিয়া, অন্তত দুইজন খ্যাতনামা অভিধান রচয়িতা তাদের অভিধানে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করছেন। স্যামুয়েল জনসন আর অ্যামব্রোস বায়ার্স।  প্রথমজনের মতে,  শিষ্টতা হইলো, ‘ভুয়া ভালোমানুষী’  আর ২য় জনের মতে, ‘সবচে গ্রহণযোগ্য ভন্ডামি’   

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বুরদিও’র মতে, কথা বলার সময় সুভাষণ মুনাফারে দ্বিগুণ কইরা দেয়ঃ “the profit of saying and the profit of denying what is said.”  বুরদিও অবশ্য মনে করেন, মানুষের সমস্ত ভাষিক যোগাযোগই কম বা বেশি মাত্রায় সুভাষিত। প্রত্যেকেই কথা বলার/ লেখার আগে নিয়মিত তার অডিয়েন্সের কথা মাথায় রাইখাই সেন্সর করে। সেই অর্থে সবার ভাষাই কম-বেশি ইউফেমিস্টিক। জনাব বুরদিও অবশ্য বলতে ভোলেন না যে,  এই কম-বেশির তফাৎ বিবেচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কারা ব্যবহার করে, কখন, কীভাবে এবং কাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়  সেইটা দেখাও জরুরি।           

‘বিশুদ্ধতা’ জিনিসটার ভেতরেই ( ভিত্রে/মধ্যে, এমনকি আরেকটু রাশভারী, সুশীল করতে ‘অন্তর্গত’ শব্দটাও কইতে পারেন) একটা প্রতিক্রিয়াশীলতা লেপ্টে আছে বলে মনে হয়। অন্তত, বড় রকমের রিজিডিটি  আছে  সন্দেহ নাই।  স্ট্যান্ডার্ড, প্রমিত, মানদন্ড ( এইখানে ‘দন্ড’ কথাটায় একটু নজর দেয়া যায়। দন্ড, মানে ডান্ডা- শাস্তি আর কি।  দেখেন নিরীহ শব্দটার ভিত্রেও কতকিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে) প্রতিক্রিয়াশীল জিনিস। 

বিশুদ্ধতা বলবে এইটা ঠিক/কারেক্ট, ওইটা ভুল/রং। যদিও সুশীল বয়ানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাব্জেক্টিভিটির কথা উচ্চকিত হয়, এইক্ষেত্রে ‘অব্জেক্টিভিটি’ তাদের চাওয়া। এবং সেই তথাকথিত ‘অবজেক্টিভিটি’ আবার খুবই শ্রেণিস্বার্থ ঘেঁষা। ফলে ভাষাগত দিক দিয়া এই বিশুদ্ধতাবাদীরা আসলে ‘মৌলবাদী’, মৌলবাদের  সুশীল যে মিনিং দাঁড়াইছে সেই অর্থে বললাম। 

কেননা তাদের প্রেসক্রাইব করা ভাষার বাইরে কিছু দেখলেই তেনাদের গা জ্বলে  (‘গাত্রদাহ’ বললে একটু ভদ্রস্থ শোনায় না?), আপনি’র জায়গায় ‘আপনে’  দেখলেই  সেই ভাষারে ‘অসাধু’ মনে হওয়া হেতু ‘তাহাদের’ মাথার চান্দি (অথবা ধরেন ব্রহ্মতালু) গরম হইয়া যায়।      

লেজিটিমেট ভাষা,  বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ভাষা ব্যবহারে। তখন, যেকোনো ভাষিক অভিব্যক্তিরে (এক্সপ্রেশন) বিবেচনা করা হয় সেই লেজিটিমেট ভাষার সাপেক্ষে। লেজিটিমেট  ভাষা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও হাসির, উপহাসের এমনকি তিরস্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি’ শব্দটার জায়গায় ‘আপনে’ বসালেই বেশ ফানি ফানি লাগে। 

আমাদের টিভি-নাটক-সিনেমায় দেখবেন, যখনই হিউমারের ঘাটতি পড়ে, তখন ডায়ালেক্ট (আঞ্চলিক ভাষাও বলা যায়, যদিও সবসময় ‘আঞ্চলিক’ আর ‘ডায়ালেক্ট’ সমার্থক না) আইনা খামতি পূর্ণ করা হয়। 

আগে যেমন কলকাত্তাই সিনেমায় ভাঁড় চরিত্রগুলার মুখে ‘বাঙাল’ ভাষা দেখা যাইতো খুব তেমনি  বর্তমানে ‘বাঙাল’ ভাষার জায়গায় এদেশি টিভি-সিনেমায় ডায়ালেক্টগুলা হাস্যরস সাপ্লাই দিতে থাকে। তারও আগে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্রপাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো; গ্রাম্য লোকের  (গাইয়া লোকের) মতো, শহুরে লোকদের আনন্দ দেবার জন্য। 

কিন্তু কেন ডায়ালেক্টগুলা ফানি লাগে? 

ফানি লাগে লেজিটিমেট জায়গা থেকে প্রতিসরণ বা বিচ্যুতি ঘটে বলে?  দর্শক শ্রোতাকে সাময়িক সুপিরিয়রিটির বোধ দিতে থাকে এইরকম হিউমার?  (এমনকি, প্রিয় পাঠক/ পাঠিকা, আপনি সুশীল হইলে,  এই লেখাটা পড়তে গিয়া যদি ২-১টা শব্দ পড়তে গিয়া মৃদু অস্বস্তি লাগে, তবে অবাক হবেন না) 

সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, সুভাষণ সবসময় লেজিটিমেট ভাষার গা ঘেষে চলে। এই লেখাটা সুভাষণ নিয়া, লেজিটিমেট ভাষা কিংবা ভাষার উচু-নিচু বা স্ট্যাটাস  নিয়ে না। বিস্তারিত সেই আলাপ  অন্যত্র করবো। তবু প্রয়োজনে দুই-একটা খুচরো মন্তব্য রেখে যেতে হলো।         

তবুও যদি আপনি খুবই ইনোসেন্ট ধরনের হন আর বলেন,  প্রমিত বা মান ভাষা বলে বাজারে চালু  জিনিসের গলদটা কোথায়?

গলদটা এইখানে যে ভাষার ডাইনামিক ও সৃষ্টিশীল দিকটা অনেক সময় ভাষা হারিয়ে ফেলে, কিংবা অনেক সময় হারিয়ে ফেলা হয় (যেমনটা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে) হয়া যায় টেকনোক্রেটিক শাসনের মতো সেই ভাষা। এবং সেই ভাষা ক্ষমতা-সম্পর্ক রিপ্রডিউস করতে হেল্পায়। 

তখন মুখস্ত বুলি কপচানো পাখির মতো হইয়া যায়, অর্থাৎ ভাষার প্রাঞ্জলতা থাকে না, সৃজনশীলতা থাকে না। সবচে বড় কথা, ভাষার মধ্যে (ভেতরে/ ভিত্রে) বানোয়াট জিনিসপাতি চলতে থাকে। তখন কী হয়, তার প্রমাণ পাবেন, আমাদের বামেরা ‘শোষিত’ শ্রেণির কাছে যে পৌছাতে পারে না , অনেকগুলা কারণের মধ্যে বামদের ভাষাও হয়তো একটা কারণ। ভাষার এহেন অবস্থায়, ভাষার প্রাণটাই যেন মইরা যায়, মেকানিকাল হয়া যায়। কানপাতলে শোনা যায়, ভাষা যেমন জীবন উৎসারিত হওয়ার কথা, সেইরকম ‘কালচার নেচারের ভাষায় কথা বলছে’না।   

একটা ৮/৯ বছরের ছেলে বা পোলা, ‘বাসাবাড়িতে’ কাজ করে, চেনে ঘোড়া আর পাখি। একদিন পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেইখা বলে উঠল, ‘ঘোড়াপাখি’  ‘ঘোড়াপাখি’। যদিও সে পড়তে পারে না, জানে না পেগাসাস বা পঙ্ক্ষীরাজ বলে কোন পৌরাণিক প্রাণীর কথা।  ‘ঘোড়াপাখি’র মতো একটা সৃজনশীল শব্দ তৈরিতে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় কিন্তু সে দিছে।  কিংবা এই বস্তিতে থাকা শিশুরে যদি বলেন, ঝলমল করছে মানে কী? সে যদি উজ্জ্বল না বইলা, ‘যেন লাইট মারছে’ বলে অবাক হবেন না। কারণ এদের ভাষা মধ্যে জীবন উপস্থিত।

দুর্নীতি মানে জিজ্ঞেস করলে, ভদ্রলোক হয়ত বলবে, অন্যায় কাজ, রীতিলঙ্ঘন ইত্যাদি। যে নিরক্ষর সে আপনারে  হয়তো বলতে গিয়া বর্ণনাই দিয়ে ফেলল, ‘দুর্নীতি মানে ধরেন, র‍্যাশন কার্ড আনতে গেছি, ঘুষ নেল’। যা ক্ষমতা-কাঠামোর বুকের সাথে লেপ্টে থাকা  ‘প্রায়’ মেকানিকাল ভাষা (অঙ্গীভূত হয়েছেও বলতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নাই) আপনাকে এই সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্ছিত করবে।     

কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘শব্দের ভেতর দিয়েই চিন্তার জন্ম হয়’।আর আমাদের  চিন্তা-ভাবনা আগে ভাগেই  ভাষার আবেষ্টনে আবদ্ধ থাকে  অনেকখানি (অলরেডি এনকমপাসড বাই দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ দ্যাট ইজ আওয়ার ওন’)

(কীভাবে, কেমনে হয়, সে- আলাপ বিস্তারের সুযোগ এখানে নাই বলে দুইজন উল্লেখযোগ্য ভাষাবিদের উদ্ধৃতি রেখে গেলাম। এই ব্যাপারে ভিন্নমতের বা কৌতূহলী যে কারুর সাথে সতর্ক ( তর্কের সহিত বর্তমান) আলাপে আমার কোনো আপত্তি নাই। )    

এই প্রভাবিত/ নির্ধারিত হওয়াটা একতরফা না যে খালি ভাষাব্যবহারই চিন্তারে ডমিনেট করবে, বরং প্রক্রিয়াটা দ্বান্দ্বিক। সংস্কৃতি যেমন ভাষার রূপরীতি ঠিক করে দেয়, একটা সমাজের চিন্তাজগতও প্রভাবিত হয় আবার সেই সমাজের প্রচলিত ভাষা-কাঠামোরে কেন্দ্র কইরা। ভাষা গবেষকেরা নিঃসন্দেহ, ব্যক্তির চিন্তা তার সমাজের বিদ্যমান ভাষা-কাঠামো দ্বারা  প্রভাবিত হয়। যত কল্পনাশক্তি বা সৃজনশীলতার অধিকারী আপনি হননা কেন, যে ভাষিক আবহাওয়া ও জলবায়ুতে আপনার থাকা, বেড়ে ওঠা, সেই ভাষার কাঠামোর বাইরে গিয়া চিন্তা বা ভাষিক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করা খুব কঠিন। 

তো, কী  করতে পারেন?

ভাষা ব্যবহারেও হয়ত বড়জোর লড়াই না হোক, প্রতিরোধী অবস্থানটা জানাইতে পারেন।

সুভাষণ যখন শোষণে সহায়ক, শ্রেণি-কর্তৃত্বের আধিপত্যের সহায়ক তখন  (যতটা সম্ভব) এভয়েড করা গেলে তো ভালোই, নতুন শব্দও ব্যবহার করতে পারেন। জরুরী ভাষা ব্যবহারে চোখ-কান খোলা রাখা সচেতনতা। কেউ কেউ সেই চেষ্টা করেন নাই এমন না, মার্ক্সিস্ট শব্দটার বাজার চলতি নেগেটিভ দিকটা টের পায়া ধূর্জটিপ্রসাদ নিজের পরিচয় দিতেন মার্ক্সোলজিস্ট বলে। ভেরিয়ার এলউইন এ্যান্থ্রোপলজিস্ট না বলতে নিজেরে বলতে চাইতেন, ফিল্যানথ্রোপলজিস্ট। বাংলায় যারা এনার্কিজম নিয়ে আগ্রহী, তারাও প্রথমে ‘নৈরাজ্যবাদ’ বললেও শব্দটার নেগেটিভ এ্যাসোসিয়েশন টের পেয়ে ‘অরাজপন্থা’ বলা শুরু করছেন। 

ক্ষমতা-কর্তৃত্ব-শোষণে সুভাষণের যেভাবে ব্যবহার হইতেছে, সেই বিষয়ে সচেতনতাও কাজের। কোনো কৌশলের ব্যাপারে সতেচন হওয়া মানে সেই কৌশলকেই অনেকখানি অকেজো কইরা দেওয়া।      

এমন এককালে আমরা বাস করি যখন গনহত্যারে বলা হয় দুর্ঘটনা। 

গরিবের-কৃষকের জমি দখলের নাম  শিল্পায়ন,. প্রানপ্রকৃতি ধ্বংসের নাম ডেভেলাপমেন্ট (উন্নয়ন-এর চেয়ে স্মার্ট, মিষ্টিও লাগে শুনতে)। পাছায় বাঁশ ঢুকাইতে ঢুকাইতে বলা হয়, ইতিবাচক হও। থিংক পজিটিভ। বি পজিটিভ। 

আইডিওলজিক্যাল পজিটিভিজমের এই রমরমা সময়ে, ইতিবাচকতার মহামারির এই কালে এক নম্বর মিথ্যাবাক্য, আপনা ভালো তো জগত ভালো। আপনি ভালো হলেই জগত ভালো হবে না। আপনার ভাষিক অভিব্যক্তি যতই ‘ইতিবাচক’  আর সুভাষণে ভরপুর হোক, তা কেবল বাস্তবতারে, সত্যরে আড়াল করতে থাকবে।

গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস বলতেন, বলতেন ওয়াল্টার বেনইয়ামিনও, প্রতিটি সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের আগে মুখোশ পইড়া নেয়।    


[ টীকাটিপ্পনী: 

একাডেমিক লেখার মতো উদ্ধৃতি-পাদটীকা দিতে আমার বিরক্তি লাগে। এইখানে, পন্ডিত লোকের বই-এর উদ্ধৃতি দেখলে যাদের লেখকের প্রতি সমীহ জাইগা ওঠে,- আরিব্বাবা উনি তো বেশ জ্ঞানী লোক- সেইসব সুশীলদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তি উপহার প্রদানের নিমিত্তে, তাহাদের শ্রীচরণে এই রেফারেন্সগুলা নিবেদিত।     

  সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত। বর্ধমান সাহিত্যসভা, বর্ধমান, ১৯৫৭ সাল, ৫ম সংস্করণ।

জন সিনক্লেয়ার প্রণীত, কলিন্স কোবিল্ড লার্নার’স ইলাস্ট্রটেড ডিকশনারি, ২০০৯ সংস্করণ। 

এদুয়ার্দো গালেয়ানো, আপসাইড ডাউন এ প্রাইমার ফর দ্য লুকিং-গ্লাস ওয়ার্ল্ড। বইয়ের ‘দ্য লুকিং-গ্লাস স্কুল’ অধ্যায়ের  ‘ইনজাস্টিস ১০১’  অংশ দ্রষ্টব্য।    

  হিউ রঅসন, দ্য ডিকশনারি অফ ইউফেমিজমস এন্ড আদার ডাব্‌লটক, পৃ: ১০,  ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮১। বন্ধনীর ভেতরে শব্দ বর্তমান লেখকের।   

স্যামুয়েল জনসনরে প্রায় সবাই অভিধানপ্রণেতা হিসেবে জানলেও সাহিত্যিক অ্যামব্রোস বায়ার্স যে, ‘দ্য ডেভিল্‌স  ডিকশনারি’ নামে প্রজ্ঞা ও ব্ল্যাক হিউমারে ভরপুর একখানা অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটা হয়ত অনেকেই জানে না।  

গৌতম ভদ্র, ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার যায়?’ পৃ: ২৩  ছাতিম, কলকাতা। যদিও বইটা ভিন্ন বিষয়ের, মন্তব্যটা আমার ভাল্লাগছে।      

  এল. এস. ভাইগটস্কি, থট এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৬২, পৃ: ১৫৩  

এইচ.  জি. গাডামার, ফিলসফিকাল হের্মেনিউটিক্স, ১৯৭৬, পৃ: ৬২ ]  

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।