এক গল্পের বিপদ

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

আমি একজন গল্পকার। আমার ব্যক্তিগত কিছু গল্প আপনাদের সাথে আজ আমি শেয়ার করতে যাচ্ছি। আমি এর নাম দিয়েছি, ‘এক গল্পের বিপত্তি’। আমার বেড়ে ওঠা পূর্ব নাইজেরিয়ার এক ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। মা বলেন, আমি নাকি সেই ২ বছর বয়স থেকেই বই পড়া শুরু করেছিলাম। আমি অবশ্য মনে করি এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। যতদূর মনে পড়ে আমি ৪ বছর বয়স থেকে বই পড়া শুরু করি। মোটকথা, অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ দ্রুত পড়তে শিখে গেছিলাম। ব্রিটিশ আর আমেরিকান বইগুলো বেশি পড়া হতো তখন। লেখালেখিটাও আমার বেশ অল্প বয়স থেকে শুরু হয়। ৭ বছর বয়সে ক্রেয়ন রঙে আঁকিবুকির সঙ্গে পেন্সিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে গল্প লিখতাম। সেই দূর্বোধ্য গল্পের একমাত্র পাঠক ছিল আমার বেচারি মা।  সেসময় আমি তেমন গল্পই লিখতাম যা আমি পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার সব চরিত্র ছিল ফর্সা বর্ণের আর তাদের চোখের রঙ ছিল নীল। তারা তুষার বরফে খেলতো, আপেল খেত, আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতো, আর কথা বলতো মেঘ সরে গিয়ে সূর্য তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়ার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। আমি তখনও নাইজেরিয়ার বাইরে যাইনি। নাইজেরিয়ায় কখনো তুষারপাত হতো না। আম ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আর আবহাওয়া নিয়ে কখনো আমাদের কথা বলার প্রয়োজনই হয়নি। আমার গল্পের চরিত্রগুলো জিঞ্জার বিয়ার খেতো, কারণ ওইযে, ব্রিটিশ বইয়ের ওরাও খেতো বলে। যদিও জিঞ্জার বিয়ার যে আদতে কী তা-ই আমার জানা ছিল না। এমনকি কিছু বছর পর আমার জিঞ্জার বিয়ার টেস্ট করার বেশ শখও জেগেছিল। সে এক অন্য গল্প। আজ এই গল্পেই থাকি। এই সামান্য গল্পগুলো আমার ওপর, বিশেষভাবে আমার মত শিশুদের ওপর তখন এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলছিল। ছোটবেলায় আমার পড়া বইগুলোর সকল চরিত্র ছিল বিদেশি। বিদেশি বইয়ের প্রভাব এতটাই ছিল যে আমি বিশ্বাস করতাম, বিদেশি চরিত্র ছাড়া কোনো বই-ই নেই এই পৃথিবীতে। আর বইয়ে এমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার সঙ্গে আমি নিজের কিংবা আমার চারপাশের মিল খুঁজে পেতে পারি। বইয়ের দুনিয়াটা বুঝি যথারীতি আমার দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে। আমি জানলাম, আমার মতো যাদের চকলেট বর্ণের গায়ের রং আর কোকড়া চুল, তারাও হতে পারে গল্পের অংশ, তাদেরও স্থান আছে সাহিত্যে। তাই সেই দেখাদেখি আমিও লিখতে শুরু করলাম নিজের পরিচিত দুনিয়া নিয়ে। আমি সেই আমেরিকান আর ব্রিটিশ বইগুলোকেও সমানভাবেই ভালোবাসতাম। আমার কল্পনার জগতের ঢাকনাটা যে তারাই খুলে দিয়েছিল। নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করি আমি তাদের হাত ধরেই। তবে তার অনিচ্ছাকৃত ফল হলো আমার মতো মানুষরাও যে সেই দুনিয়ার অংশ হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তাই আফ্রিকান বই আমাকে যা দিয়েছে তা হলো ‘বই কী’ সেই বিষয়ে পুরোপুরি এক ভিন্ন ধারণা, আর পরিচয় করিয়েছে আমার পরিচিত বইয়ের দুনিয়ার সঙ্গে।  

আমি খুবই সাধারণ, মধ্যবিত্ত নাইজেরিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা প্রফেসর ছিলেন। আমার মা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। আর পাঁচজনের মত আমাদের বাড়িতেও গৃহকর্মী রাখা হতো। আমার বয়স যেবার আট হলো, আমাদের বাড়িতে এক নতুন কাজের ছেলে আসে, নাম ফাইদ। মা তার সম্পর্কে শুধু একটাই কথা বলেছিল যে, ফাইদের পরিবার খুব গরিব। মা প্রায়ই ফাইদের বাড়িতে মিষ্টি আলু, ভাত এবং আমাদের পুরানো কাপড় পাঠাতো। আর আমি কখনো খাবার প্লেটে রেখে উঠে যেতে গেলেই মা বলতেন, ‘এক্ষুনি খাবার শেষ করো। দেখতে পাওনা ফাইদের মতো পরিবারগুলোর যে কিছু নেই?’ আমার ফাইদের পরিবারের জন্য প্রচুর করুণা হতো। তারপর এক শনিবার আমরা তার গ্রামে বেড়াতে যাই। এবং ফাইদের মা তার ভাইয়ের বানানো রঙ্গিন রাফিয়া দিয়ে তৈরি সুন্দর ডিজাইনের এক ঝুড়ি দেখান আমাদের। আমি চমকে উঠি। আমার কখনো মনেই হয় নি যে তার পরিবারের কেউ আসলে কিছু করতে পারে। আমি তাদের সম্পর্কে শুধু এটাই শুনেছি যে তারা কতটা গরিব। তাই তাদেরকে দরিদ্র ছাড়া অন্য কিছু হিসাবে কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিয়ে আমার জানা একমাত্র গল্প, একমাত্র ধারণা, একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গী।    

অনেক বছর পর ফাইদের গল্পটা আমার আবারও মনে পড়লো যখন আমি নাইজেরিয়া ছেড়ে আমেরিকার এক ভার্সিটিতে পড়তে আসি। আমি তখন ১৯ বছরের তরুনী। আমার মার্কিন রুমমেট তো আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর একেবারে হতভম্ব! জিজ্ঞেস করে বসেছিল, কোথা থেকে আমি এত ভালো ইংরেজি বলতে শিখেছি। তবে সে আরও জোরদার হতভম্ব হলো যখন জানতে পারলো নাইজেরিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। এরপর সে কৌতুহলবশত আমাদের ‘আদিবাসি গান’ শুনতে চাইলো। বেচারি আমি মারিয়া ক্যারের গানের ক্যাসেট  বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো তার ‘আদিবাসি গান’ শোনার বাসনায় আমি পানি ঢেলে দিয়েছি! এমনকি সে ভাবতো যে আমি বুঝি চুলাও জ্বালাতে জানি না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমার প্রতি তার ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া ছিল করুণা, যদিও তা নেতিবাচক করুনা নয়, উদ্দেশ্য তার ভালোই ছিল। আমার রুমমেট আফ্রিকা সম্বন্ধে একটি গল্পই জানতো। আফ্রিকার বিপর্যয়ের গল্প। এই গল্পে আফ্রিকান কোনো মানুষের সঙ্গে তার মিল থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমার জন্যে করুণা ছাড়া অন্য কোন জটিল অনুভূতির জায়গা ছিল না তার। আমাকে তার সমানভাবে দেখারও কোন সম্ভাবনা ছিল না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আমি নিজেকে সেভাবে আফ্রিকান ভাবতাম না। কিন্তু সেখানে আফ্রিকার নাম এলেই মানুষ আমার দিকে ফিরে তাকাতো। আমি অবশ্য আমার এই নতুন পরিচয়টাকে আপন করে নিতে শিখেছি। আমি নিজেকে এখন আফ্রিকান বলেই মনে করি। যদিও আফ্রিকাকে দেশ বললে আমি এখনও বেশ বিরক্ত হই। একটা উদাহরণ দিই। দুইদিন আগে লাগোস থেকে ফেরার সময় ফ্লাইটে ‘ভারত, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের’ দাতব্যমূলক কাজের বর্ণনা দিচ্ছিল। 

তবে আফ্রিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বছর কাটানোর পর আমার প্রতি সেই রুমমেটের প্রতিক্রিয়া আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আমি  যদি নাইজেরিয়ায় বেড়ে না উঠতাম, তবে আমিও ভাবতাম আফ্রিকা মানে সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা এক স্থান যেখানে সুন্দরসব প্রাণী আর অসংখ্য মানুষের বাস, যারা প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছে অর্থহীন যুদ্ধ, মরছে এইডস কিংবা দরিদ্রতায় ভুগে। নেই তাদের নিজেদের হয়ে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তারা তাই অপেক্ষা করছে কবে এক সহৃদয়, শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ব্যক্তি এসে রক্ষা করবে তাদের। ছোটবেলায় নাইজেরিয়াতে না থাকলে আমি ফাইদের পরিবারকে যেভাবে দেখতাম, ঠিক সেভাবেই দেখতাম আফ্রিকানদেরও। আমার মনে হয় আফ্রিকানদের প্রতি এই একতরফা ধারণাটা এসেছে পশ্চিমা সাহিত্য থেকে। ১৫৬১ সালে পশ্চিম আফ্রিকা পাড়ি দেওয়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী জন লক ব্ল্যাক আফ্রিকানদের সম্বোধন করেছিলেন ‘গৃহহীন জানোয়ার’ হিসেবে। ‘মুণ্ডুহীন মানুষ, যাদের চোখ আর মুখ থাকে তাদের স্তনে/বুকে’, এভাবেই জন লক বর্ণনা করেছেন আফ্রিকানদের। জন লকের বর্ণনা আমি যতবার পড়ি, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। সত্যিই জন লকের কল্পনা করার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। এমন সব লেখা দিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে আফ্রিকান গল্পের চল। তাই সাব-সাহারান আফ্রিকাকে সকলে এক অদ্ভুত অন্ধকার জায়গা আর এর বাসিন্দাদের রুডইয়ার্ড কিপলিং এর ভাষায় ‘হাফ ডেভিল, হাফ চাইল্ড’ (অর্ধেক শয়তান আর অর্ধেক শিশু) হিসেবেই দেখতো। ফলে আমিও বুঝতে শুরু করলাম আমার সেই রুমমেটও বোধহয় সারাজীবন আফ্রিকানদের বিষয়ে এমন এক ধরনের গল্পই শুনে গেছে ভিন্ন আদলে কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে। শুধু আমার রুমমেট নয়, এমন এক গল্পের বিপত্তির স্বীকার হয়েছিলেন আমার এক প্রফেসরও। সেই প্রফেসর আমার উপন্যাস পড়ে বলেছিলেন তা নাকি ঠিক ‘খাঁটি আফ্রিকান’ উপন্যাস হয়নি। যদিও ‘খাঁটি আফ্রিকানত্ব’ কীভাবে অর্জন করা যায় বা ইহা যে আসলে কি জিনিস তাই আমার জানা ছিল না। শেষমেশ প্রফেসর জানালেন, আমার গল্পের চরিত্র নাকি এক সাধাসিধে, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত লোক, যিনি অনেকটা তার মতো। আমার চরিত্রদের নিজস্ব গাড়ি ছিল। তারা না খেতে পেয়ে মরছে না বলে নাকি তারা খাঁটি আফ্রিকান নন!   

তবে আমিও যে এই এক গল্পের বিপত্তিতে পড়িনি তা কিন্তু নয়। কয়েক বছর আগে আমি মেক্সিকো ঘুরতে যাই। তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল বেশ উত্তপ্ত, অভিবাসন নিয়ে চলছিল নানা তর্ক-বিতর্ক। আর তখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর/অভিবাসনের মানেই ছিল মেক্সিকান। মেক্সিকানদের ঘিরে ছিল লুকিয়ে সীমান্ত পার করা, সীমান্ত পার করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার গল্প। আমার মনে আছে, প্রথমদিন মেক্সিকোর গুয়াদালাজারায় ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সেখানে মানুষ গতানুগতিকভাবে কাজে যাচ্ছে, বাজারে টর্টিলা তৈরি হচ্ছে, কেউ বা ধূমপান করছে, কেউ বা প্রাণখুলে হাসছে। তৎক্ষণাৎ এমন চিত্র দেখে কিছুটা অবাক হলেও, পরমুহূর্তেই আমি লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আমেরিকায় মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপর মিডিয়া কাভারেজ দেখতে দেখতে আমিও তাদের শুধুমাত্র দুঃস্থ অভিবাসী হিসেবেই দেখা শুরু করেছিলাম। আমি নিজেও মেক্সিকানদের এক গল্পে, এক পরিচয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই এভাবে শুধু এক গল্পের মাধ্যমে মানুষকে দেখলে, চিনলে আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলো বারবার শুনতে থাকলে, সেই গল্পের বাইরে মানুষগুলোর অস্তিত্ব চিন্তা করা প্রায় কঠিন হয়ে যায়। এক গল্প সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ক্ষমতার প্রসঙ্গ আসেই। একটা ইগবো শব্দ আছে ‘এনকালি’ (nkali) মোটাদাগে যার অর্থ ‘অন্যের চেয়ে মহৎ’। বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে ভাবতে গেলেই শব্দটি আমার মনে পড়ে। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুনিয়ার মতো, গল্পগুলাকে এনকালির নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায়। গল্প কে বলছে, কীভাবে বলছে, কখন বলছে, কতগুলি গল্প বলছে, সবকিছুই ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা শুধু অন্য ব্যক্তির গল্প বলে দেওয়ার ক্ষমতা না, একটি গল্পই ব্যক্তির চূড়ান্ত গল্প বলে প্রতিষ্ঠা করা। ফিলিস্তিনী কবি মুরিদ বারঘুতি লিখেছেন যে, আপনি যদি কাউকে অধিকারচ্যুত করতে চান, সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের গল্প বলা এবং ‘দ্বিতীয়ত’ দিয়ে শুরু করা। 

ব্রিটিশদের আগমনের বদলে নেটিভ আমেরিকানদে তীর-ধনুক দিয়ে শুরু করুন, দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পকে প্রতিস্থাপন করুণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলির ইতিহাস থেকে, পাবেন ভিন্ন স্বাদের গল্প।  

আমি সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলতে গেছি। একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলেন, নাইজেরিয়ার সকল পুরুষই যে শারীরিক নির্যাতনকারী তা জেনে সে খুবই হতাশ হয়েছে। কারণ আমার লেখা বইটির বাবা চরিত্রটি ছিল শারীরিক নির্যাতনকারী। তখন আমি তাকে বললাম, ‘আমি সবেমাত্র ‘আমেরিকান সাইকো’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। ‘সেই উপন্যাসের চরিত্রের মত আমেরিকার তরুনরাও সবাই সিরিয়াল কিলার সেটি জানতে পেরে আমিও বেশ হতাশ হলাম’ অবশ্যই কথাটি আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আর কিছুটা মজা করেই বলেছি। একটি মার্কিন উপন্যাসের চরিত্র সিরিয়াল কিলার ছিল বলে আমি নিশ্চয়ই সকল আমেরিকানকে সিরিয়াল কিলার ভাবছি না। এমন নয় যে আমি সেই শিক্ষার্থী থেকে ভালো মানুষ বলে আমেরিকানদের নিয়ে আমি এভাবে ভাবছি, বরং এক গল্প পড়েই আমেরিকানদের সিরিয়াল কিলার না ভাবার কারণ বিশ্বজুড়ে তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিস্তৃতি। আমি আমেরিকার আরও অনেক গল্প পড়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তাই আমার তাদেরকে এক গল্প দিয়ে বিচার করতে হয়নি। আমি টাইলার আর আপডাইক যেমন পড়েছি, তেমনি পড়েছি স্টেইনব্যাক কিংবা গ্যাটস্কিল। আমেরিকা নিয়ে আমার একটি নয়, অনেক গল্পই জানা ছিল, একটি নয়। 

কয়ের বছর আগে আমি জানতে পারি শৈশব সুখের হলে নাকি সফল লেখক হওয়া যায় না! এরপর থেকে আমার বাবা-মা কীভাবে ছোটবেলায় আমার সঙ্গে কী কী বাজে ব্যবহার করেছে তার স্মৃতি খুড়তে শুরু করি। কিন্তু আদতে আমার ছেলেবেলা ছিল আমার ছোট্ট পরিবারের সঙ্গে খুব হাসিখুশি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবুও কঠিন সময় যে যায়নি তা কিন্তু নয়। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন আমার দাদা মারা গেছিলেন। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে আমার চাচাতো ভাই পল মারা যান। আমার বন্ধু ওকোলামা মারা যায় প্লেন দূর্ঘটনায়। আমি যেই সামরিক সরকারের শাসনে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শিক্ষার মূল্য ছিল না, প্রায়ই আমার বাবা-মা বেতন পেতো না।  হুট করেই কোন একদিন সকালে উঠে দেখতাম নাস্তার টেবিল থেকে জেলির বয়াম উধাও হয়ে গেছে। কোনদিন আবার হয়তো মার্জারিন উধাও হয়ে যেত, আস্তে আস্তে পাউরুটির দাম বাড়তে লাগলো, এরপর দুধ আগের মত যত ইচ্ছে খাওয়া যেত না, বুঝেশুনে নিতে হতো। আমাদের জীবনে খুব সাধারণভাবেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্থিরভাবে বিরাজমান ছিল। এই গল্পগুলোই আজ আমাকে আমি করে তুলেছে। কিন্তু শুধু এই অসুন্দর গল্পগুলো দিয়ে আমাকে বিচার করা যাবে না। এক গল্প খুব সহজেই স্টেরিওটাইপ তৈরি করে ফেলে। এই বাঁধাধরা কিংবা স্টেরিওটিপিকাল গল্পগুলো সত্য, তবে পুরোপুরি নয়। এক গল্পের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানে সেটাকেই একমাত্র গল্প বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু তার বাইরেও যে অসংখ্য গল্প আছে।  

আফ্রিকাতে একের পর এক বিপর্যয় লেগেই ছিল, আছে, থাকবে। আফ্রিকা ঘিরে যেমন আছে দগদগে ক্ষত রেখে যাওয়া কঙ্গোর সেই ভয়ানক ধর্ষণের কাহিনী, তেমনি আছে নাইজেরিয়ায় একটি মাত্র চাকরির জন্য ৫০০০ মানুষ আবেদন করার মত হতাশাজনক কাহিনী। কিন্তু আফ্রিকা মানেই কী শুধু দুঃসংবাদ? বিপর্যয়ের গল্প ছাড়াও নিশ্চয়ই আফ্রিকার আরও গল্প আছে। আর সেগুলো নিয়েও কথা বলা সমান গুরুত্বপূর্ণ।    

আমি মনে করি কোনো জায়গা বা মানুষ সম্পর্কে তার সকল রকমের গল্প না শুনে সেই স্থান বা মানুষের সঙ্গে মেশা প্রায় অসম্ভব। আমার মনেহয় এক গল্প দিয়ে মানুষকে বিচার করা মানে তার মর্যাদা কেড়ে নেওয়া/ তার সম্মান কেড়ে নেওয়া। এক গল্প দিয়ে বিচার করলে আমরা তখন সেই মানুষটাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখি না। সেই মানুষটার সঙ্গে আমার মিল খোঁজার বদলে সে কীভাবে আমার থেকে অন্যরকম সেদিকে আমাদের নজর চলে যায়। যদি আমি মেক্সিকোতে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমেরিকা-মেক্সিকোর অভিবাসন দ্বন্দ্ব উভয় দিক থেকে পর্যবেক্ষন করতাম কিংবা যদি আমার মা ছোটবেলায় আমাকে বলতো ফাইদের পরিবার গরীব কিন্তু তারা কঠোর পরিশ্রমি কিংবা যদি থাকতো কোন আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখানো হতো আফ্রিকার বিচিত্র সব গল্প, তাহলে হয়তো নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবের ভাষায় ‘গল্পের মাঝে সমতা’ খুঁজে পেতে আমাদের এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। 

আমার সেই রুমমেট নাইজেরিয়া সম্পর্কে যদি  অন্য গল্পগুলো জানতো তবে আমায় দেখে হয়তো তার করুণা হতো না। সে যদি জানতো নাইজেরিয়ান প্রকাশক মুক্তা বাকারার কথা, যিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে প্রকাশনী সংস্থা খুলে বসেন। তখন খুব প্রচলিত ছিল যে নাইজেরিয়ানরা তেমন পড়ুয়া নন, তাই সাহিত্য তাদের জন্য নয়। কিন্তু মুক্তা বাকারা বেঁকে বসেছিলেন। তিনি মনে করতেন হাতের কাছে নিয়ে গেলে আর সহজলভ্য করলে যাদের পড়ার তারা ঠিকই পড়বে। তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর আমি লাগোসে এক সাক্ষাৎকার দিতে যাই।  সেখানে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করা এক মহিলা এসে আমাকে বলেন, ‘আপনার উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু শেষটা ভালো লাগেনি। আপনার একটা সিক্যুয়েল লেখা উচিৎ যেখানে আপনি এসব জিনিস লিখবেন…’। এরপর তিনি বলতে লাগলেন কীভাবে সিক্যুয়েলটা লিখতে হবে। এ ব্যাপারটায় যে আমি শুধু মজা পেয়েছি তা না, আমি বেশ মুগ্ধও হয়েছি। এক সাধারণ নাইজেরিয়ান মহিলা, যার হয়তো বা আমার বইটা পড়ার কোনো কথাই ছিল না, সে আমার বইটা পড়ে আমি বইয়ের সিক্যুয়েলে কী লিখতে পারি তা নিয়েও নিজের মত জানিয়ে গেছেন। এভাবেই আমার রুমমেট যদি আরও জানতো আমার লাগোসের দুঃস্বাহসী বন্ধু ফুমি ওন্ডার কথা, নিজের টিভি শো’তে সে প্রতিনিয়ত এমন সব গল্প তুলে আনে যা আমরা ভুলে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদি সেই রুমমেট শুনতো জে-জি থেকে ফেলা, বব মার্লে থেকে তার আগেকার প্রজন্ম, সকলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংরেজি, পিজিন, ইগবো, ইয়োরুবা আর ইজো ভাষায় গাওয়া নাইজেরিয়ার সমসাময়িক গানগুলো। যদি আমার রুমমেট জানতো সেই নাইজেরিয়ান মহিলা আইনজীবীর কথা, আদালতে নারীদের পুনরায় পাসপোর্ট করতে হলে যিনি স্বামীর সম্মতি নেওয়ার মতো হাস্যকর নাইজেরিয়ান আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিংবা যদি আমার রুমমেট জানতো নলিউড সম্পর্কে, যেখানে অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েও গুণীসব মানুষ বানিয়ে চলছেন অসাধারণ সিনেমা। যদি সে জানতো আমার হেয়ার ব্রেইডার কীভাবে নিজস্ব হেয়ার এক্সটেনশনের ব্যবসা শুরু করেছে কিংবা যদি জানতো আরও লাখ লাখ নাইজেরিয়ানদের গল্প যারা নিজ উদ্যোগে ব্যাবসা শুরু করে, ব্যর্থ হয়, কিন্তু তবুও হাল ছাড়ে না।  

আমি প্রতিবার বাড়িতে ফিরলেই নাইজেরিয়ানদের দেখি আমাদের ব্যর্থ সরকার, অবকাঠামো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ব্যর্থ সিস্টেমের মধ্যে থেকেও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত পৌঁছে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। আমি প্রতি বছর গ্রীষ্মে লাগোসে লেখালেখির ওপর একটা কর্মশালা নেই। সেই কর্মশালার প্রতি সকলের আগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবি, কত মানুষ গল্প লিখতে চায়, নিজের গল্পগুলো বলতে চায়। নাইজেরিয়ান সেই প্রকাশক আর আমার এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ফারাফিনা ট্রাস্ট। আমাদের স্বপ্ন হলো বিশাল বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করা, আর পুরোনো লাইব্রেরিগুলো সংস্কার করা। এছাড়াও যেসব সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো বই নেই তাদের জন্য বই দেওয়া। আর নিজেদের গল্পগুলো বলতে যারা মুখিয়ে আছে তাদের জন্য বই পড়া ও লেখালেখির ওপর অসংখ্য অসংখ্য কর্মশালার আয়োজন করা। গল্প বলাটা খুব দরকার। আর অনেক ধরণের গল্প বলা আরও বেশি দরকার। কষ্ট, উৎখাত কিংবা অপমানের গল্প তো অনেক বলা হলো। গল্প যে দিতে পারে সাহস, ক্ষমতা আর জাগ্রত করতে পারে মনুষ্যত্বকেও। গল্পগুলো যেমন হতে পারে মানুষের সম্মান, মর্যাদা কেড়ে নেওয়া নিয়ে, তেমনি হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরে পাওয়ার।   

আমেরিকান লেখক এ্যালিস ওয়াকার তার দক্ষিনের আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কের বলেছিলেন যারা উত্তরে চলে এসেছে।  দক্ষিনের জীবন-যাপন বিষয়ক একটি বইয়ে তাদেরকে হাজির করেছেন এ্যালিস। ‘তারা গোল হয়ে বসতো,  পরস্পরকে বই পড়ে শোনাতো, আমার বই পড়া শুনতো, এবং এক ধরণের স্বর্গ যেন সেখানে নেমে আসতো’। 

আমি কথা শেষ করার আগে শুধু এটি বলবোঃ একটামাত্র গল্প প্রত্যাখ্যান করলে, যখন আমরা বুঝতে পারি যে কোনো স্থান নিয়ে একটামাত্র গল্প কোনোকালেই ছিল না, আমরা এক ধরণের স্বর্গ খুঁজে পাই। ধন্যবাদ। 

[ বর্তমান লেখাটি ২০০৬ সালে চিমামান্দার ‘ডেঞ্জার অফ ওয়ান স্টোরি’ শীর্ষক টেড টক- এর বঙ্গানুবাদ। সেমসেমের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাবিহা শারমিন ইভা।]

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।