এক গল্পের বিপদ

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে।

আমি একজন গল্পকার। আমার ব্যক্তিগত কিছু গল্প আপনাদের সাথে আজ আমি শেয়ার করতে যাচ্ছি। আমি এর নাম দিয়েছি, ‘এক গল্পের বিপত্তি’। আমার বেড়ে ওঠা পূর্ব নাইজেরিয়ার এক ভার্সিটি ক্যাম্পাসে। মা বলেন, আমি নাকি সেই ২ বছর বয়স থেকেই বই পড়া শুরু করেছিলাম। আমি অবশ্য মনে করি এটি পুরোপুরি ঠিক নয়। যতদূর মনে পড়ে আমি ৪ বছর বয়স থেকে বই পড়া শুরু করি। মোটকথা, অন্য শিশুদের তুলনায় বেশ দ্রুত পড়তে শিখে গেছিলাম। ব্রিটিশ আর আমেরিকান বইগুলো বেশি পড়া হতো তখন। লেখালেখিটাও আমার বেশ অল্প বয়স থেকে শুরু হয়। ৭ বছর বয়সে ক্রেয়ন রঙে আঁকিবুকির সঙ্গে পেন্সিল দিয়ে আঁকাবাঁকা হাতে গল্প লিখতাম। সেই দূর্বোধ্য গল্পের একমাত্র পাঠক ছিল আমার বেচারি মা।  সেসময় আমি তেমন গল্পই লিখতাম যা আমি পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। আমার সব চরিত্র ছিল ফর্সা বর্ণের আর তাদের চোখের রঙ ছিল নীল। তারা তুষার বরফে খেলতো, আপেল খেত, আবহাওয়া নিয়ে কথা বলতো, আর কথা বলতো মেঘ সরে গিয়ে সূর্য তার উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়ার চমৎকার সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। আমি তখনও নাইজেরিয়ার বাইরে যাইনি। নাইজেরিয়ায় কখনো তুষারপাত হতো না। আম ছিল আমাদের খুব পছন্দের। আর আবহাওয়া নিয়ে কখনো আমাদের কথা বলার প্রয়োজনই হয়নি। আমার গল্পের চরিত্রগুলো জিঞ্জার বিয়ার খেতো, কারণ ওইযে, ব্রিটিশ বইয়ের ওরাও খেতো বলে। যদিও জিঞ্জার বিয়ার যে আদতে কী তা-ই আমার জানা ছিল না। এমনকি কিছু বছর পর আমার জিঞ্জার বিয়ার টেস্ট করার বেশ শখও জেগেছিল। সে এক অন্য গল্প। আজ এই গল্পেই থাকি। এই সামান্য গল্পগুলো আমার ওপর, বিশেষভাবে আমার মত শিশুদের ওপর তখন এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলছিল। ছোটবেলায় আমার পড়া বইগুলোর সকল চরিত্র ছিল বিদেশি। বিদেশি বইয়ের প্রভাব এতটাই ছিল যে আমি বিশ্বাস করতাম, বিদেশি চরিত্র ছাড়া কোনো বই-ই নেই এই পৃথিবীতে। আর বইয়ে এমন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না যার সঙ্গে আমি নিজের কিংবা আমার চারপাশের মিল খুঁজে পেতে পারি। বইয়ের দুনিয়াটা বুঝি যথারীতি আমার দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    

তবে আমার ধারণা বদলে যায় যখন আমি আফ্রিকান বই পড়তে শুরু করি। বিদেশি বইয়ের মতো এদের সচরাচর খুঁজে পাওয়া যেতো না, এমনকি অতো আফ্রিকান বই ছিলও না। কিন্তু চিনুয়া আচেবে আর কামেরা লেই-এর মতো লেখকদের হাত ধরে সাহিত্য বা গল্প সম্পর্কে আমার মস্ত বড় মানসিক পরিবর্তন আসে। আমি জানলাম, আমার মতো যাদের চকলেট বর্ণের গায়ের রং আর কোকড়া চুল, তারাও হতে পারে গল্পের অংশ, তাদেরও স্থান আছে সাহিত্যে। তাই সেই দেখাদেখি আমিও লিখতে শুরু করলাম নিজের পরিচিত দুনিয়া নিয়ে। আমি সেই আমেরিকান আর ব্রিটিশ বইগুলোকেও সমানভাবেই ভালোবাসতাম। আমার কল্পনার জগতের ঢাকনাটা যে তারাই খুলে দিয়েছিল। নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করি আমি তাদের হাত ধরেই। তবে তার অনিচ্ছাকৃত ফল হলো আমার মতো মানুষরাও যে সেই দুনিয়ার অংশ হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। তাই আফ্রিকান বই আমাকে যা দিয়েছে তা হলো ‘বই কী’ সেই বিষয়ে পুরোপুরি এক ভিন্ন ধারণা, আর পরিচয় করিয়েছে আমার পরিচিত বইয়ের দুনিয়ার সঙ্গে।  

আমি খুবই সাধারণ, মধ্যবিত্ত নাইজেরিয়ান পরিবার থেকে এসেছি। আমার বাবা প্রফেসর ছিলেন। আমার মা ছিলেন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। আর পাঁচজনের মত আমাদের বাড়িতেও গৃহকর্মী রাখা হতো। আমার বয়স যেবার আট হলো, আমাদের বাড়িতে এক নতুন কাজের ছেলে আসে, নাম ফাইদ। মা তার সম্পর্কে শুধু একটাই কথা বলেছিল যে, ফাইদের পরিবার খুব গরিব। মা প্রায়ই ফাইদের বাড়িতে মিষ্টি আলু, ভাত এবং আমাদের পুরানো কাপড় পাঠাতো। আর আমি কখনো খাবার প্লেটে রেখে উঠে যেতে গেলেই মা বলতেন, ‘এক্ষুনি খাবার শেষ করো। দেখতে পাওনা ফাইদের মতো পরিবারগুলোর যে কিছু নেই?’ আমার ফাইদের পরিবারের জন্য প্রচুর করুণা হতো। তারপর এক শনিবার আমরা তার গ্রামে বেড়াতে যাই। এবং ফাইদের মা তার ভাইয়ের বানানো রঙ্গিন রাফিয়া দিয়ে তৈরি সুন্দর ডিজাইনের এক ঝুড়ি দেখান আমাদের। আমি চমকে উঠি। আমার কখনো মনেই হয় নি যে তার পরিবারের কেউ আসলে কিছু করতে পারে। আমি তাদের সম্পর্কে শুধু এটাই শুনেছি যে তারা কতটা গরিব। তাই তাদেরকে দরিদ্র ছাড়া অন্য কিছু হিসাবে কল্পনা করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দারিদ্র্য ছিল তাদের নিয়ে আমার জানা একমাত্র গল্প, একমাত্র ধারণা, একমাত্র দৃষ্টিভঙ্গী।    

অনেক বছর পর ফাইদের গল্পটা আমার আবারও মনে পড়লো যখন আমি নাইজেরিয়া ছেড়ে আমেরিকার এক ভার্সিটিতে পড়তে আসি। আমি তখন ১৯ বছরের তরুনী। আমার মার্কিন রুমমেট তো আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর একেবারে হতভম্ব! জিজ্ঞেস করে বসেছিল, কোথা থেকে আমি এত ভালো ইংরেজি বলতে শিখেছি। তবে সে আরও জোরদার হতভম্ব হলো যখন জানতে পারলো নাইজেরিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ইংরেজি। এরপর সে কৌতুহলবশত আমাদের ‘আদিবাসি গান’ শুনতে চাইলো। বেচারি আমি মারিয়া ক্যারের গানের ক্যাসেট  বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো তার ‘আদিবাসি গান’ শোনার বাসনায় আমি পানি ঢেলে দিয়েছি! এমনকি সে ভাবতো যে আমি বুঝি চুলাও জ্বালাতে জানি না। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, আমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার বহু আগেই আমার প্রতি তার ডিফল্ট প্রতিক্রিয়া ছিল করুণা, যদিও তা নেতিবাচক করুনা নয়, উদ্দেশ্য তার ভালোই ছিল। আমার রুমমেট আফ্রিকা সম্বন্ধে একটি গল্পই জানতো। আফ্রিকার বিপর্যয়ের গল্প। এই গল্পে আফ্রিকান কোনো মানুষের সঙ্গে তার মিল থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাই আমার জন্যে করুণা ছাড়া অন্য কোন জটিল অনুভূতির জায়গা ছিল না তার। আমাকে তার সমানভাবে দেখারও কোন সম্ভাবনা ছিল না। আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে আমি নিজেকে সেভাবে আফ্রিকান ভাবতাম না। কিন্তু সেখানে আফ্রিকার নাম এলেই মানুষ আমার দিকে ফিরে তাকাতো। আমি অবশ্য আমার এই নতুন পরিচয়টাকে আপন করে নিতে শিখেছি। আমি নিজেকে এখন আফ্রিকান বলেই মনে করি। যদিও আফ্রিকাকে দেশ বললে আমি এখনও বেশ বিরক্ত হই। একটা উদাহরণ দিই। দুইদিন আগে লাগোস থেকে ফেরার সময় ফ্লাইটে ‘ভারত, আফ্রিকা ও অন্যান্য দেশের’ দাতব্যমূলক কাজের বর্ণনা দিচ্ছিল। 

তবে আফ্রিকান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বছর কাটানোর পর আমার প্রতি সেই রুমমেটের প্রতিক্রিয়া আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, আমি  যদি নাইজেরিয়ায় বেড়ে না উঠতাম, তবে আমিও ভাবতাম আফ্রিকা মানে সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা এক স্থান যেখানে সুন্দরসব প্রাণী আর অসংখ্য মানুষের বাস, যারা প্রতিনিয়ত লড়ে যাচ্ছে অর্থহীন যুদ্ধ, মরছে এইডস কিংবা দরিদ্রতায় ভুগে। নেই তাদের নিজেদের হয়ে প্রতিবাদ করার সামর্থ্য। তারা তাই অপেক্ষা করছে কবে এক সহৃদয়, শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ব্যক্তি এসে রক্ষা করবে তাদের। ছোটবেলায় নাইজেরিয়াতে না থাকলে আমি ফাইদের পরিবারকে যেভাবে দেখতাম, ঠিক সেভাবেই দেখতাম আফ্রিকানদেরও। আমার মনে হয় আফ্রিকানদের প্রতি এই একতরফা ধারণাটা এসেছে পশ্চিমা সাহিত্য থেকে। ১৫৬১ সালে পশ্চিম আফ্রিকা পাড়ি দেওয়া বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী জন লক ব্ল্যাক আফ্রিকানদের সম্বোধন করেছিলেন ‘গৃহহীন জানোয়ার’ হিসেবে। ‘মুণ্ডুহীন মানুষ, যাদের চোখ আর মুখ থাকে তাদের স্তনে/বুকে’, এভাবেই জন লক বর্ণনা করেছেন আফ্রিকানদের। জন লকের বর্ণনা আমি যতবার পড়ি, হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। সত্যিই জন লকের কল্পনা করার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। এমন সব লেখা দিয়েই শুরু হয়েছিল পশ্চিমা বিশ্বে আফ্রিকান গল্পের চল। তাই সাব-সাহারান আফ্রিকাকে সকলে এক অদ্ভুত অন্ধকার জায়গা আর এর বাসিন্দাদের রুডইয়ার্ড কিপলিং এর ভাষায় ‘হাফ ডেভিল, হাফ চাইল্ড’ (অর্ধেক শয়তান আর অর্ধেক শিশু) হিসেবেই দেখতো। ফলে আমিও বুঝতে শুরু করলাম আমার সেই রুমমেটও বোধহয় সারাজীবন আফ্রিকানদের বিষয়ে এমন এক ধরনের গল্পই শুনে গেছে ভিন্ন আদলে কিংবা ভিন্ন আঙ্গিকে। শুধু আমার রুমমেট নয়, এমন এক গল্পের বিপত্তির স্বীকার হয়েছিলেন আমার এক প্রফেসরও। সেই প্রফেসর আমার উপন্যাস পড়ে বলেছিলেন তা নাকি ঠিক ‘খাঁটি আফ্রিকান’ উপন্যাস হয়নি। যদিও ‘খাঁটি আফ্রিকানত্ব’ কীভাবে অর্জন করা যায় বা ইহা যে আসলে কি জিনিস তাই আমার জানা ছিল না। শেষমেশ প্রফেসর জানালেন, আমার গল্পের চরিত্র নাকি এক সাধাসিধে, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত লোক, যিনি অনেকটা তার মতো। আমার চরিত্রদের নিজস্ব গাড়ি ছিল। তারা না খেতে পেয়ে মরছে না বলে নাকি তারা খাঁটি আফ্রিকান নন!   

তবে আমিও যে এই এক গল্পের বিপত্তিতে পড়িনি তা কিন্তু নয়। কয়েক বছর আগে আমি মেক্সিকো ঘুরতে যাই। তখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আবহাওয়া ছিল বেশ উত্তপ্ত, অভিবাসন নিয়ে চলছিল নানা তর্ক-বিতর্ক। আর তখন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর/অভিবাসনের মানেই ছিল মেক্সিকান। মেক্সিকানদের ঘিরে ছিল লুকিয়ে সীমান্ত পার করা, সীমান্ত পার করতে গিয়ে গ্রেফতার হওয়ার গল্প। আমার মনে আছে, প্রথমদিন মেক্সিকোর গুয়াদালাজারায় ঘুরতে গিয়ে দেখলাম সেখানে মানুষ গতানুগতিকভাবে কাজে যাচ্ছে, বাজারে টর্টিলা তৈরি হচ্ছে, কেউ বা ধূমপান করছে, কেউ বা প্রাণখুলে হাসছে। তৎক্ষণাৎ এমন চিত্র দেখে কিছুটা অবাক হলেও, পরমুহূর্তেই আমি লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। আমেরিকায় মেক্সিকান অভিবাসীদের ওপর মিডিয়া কাভারেজ দেখতে দেখতে আমিও তাদের শুধুমাত্র দুঃস্থ অভিবাসী হিসেবেই দেখা শুরু করেছিলাম। আমি নিজেও মেক্সিকানদের এক গল্পে, এক পরিচয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলাম। তাই এভাবে শুধু এক গল্পের মাধ্যমে মানুষকে দেখলে, চিনলে আর এক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলো বারবার শুনতে থাকলে, সেই গল্পের বাইরে মানুষগুলোর অস্তিত্ব চিন্তা করা প্রায় কঠিন হয়ে যায়। এক গল্প সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ক্ষমতার প্রসঙ্গ আসেই। একটা ইগবো শব্দ আছে ‘এনকালি’ (nkali) মোটাদাগে যার অর্থ ‘অন্যের চেয়ে মহৎ’। বিশ্বের ক্ষমতা কাঠামো সম্পর্কে ভাবতে গেলেই শব্দটি আমার মনে পড়ে। আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুনিয়ার মতো, গল্পগুলাকে এনকালির নিয়মে ব্যাখ্যা করা যায়। গল্প কে বলছে, কীভাবে বলছে, কখন বলছে, কতগুলি গল্প বলছে, সবকিছুই ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। ক্ষমতা শুধু অন্য ব্যক্তির গল্প বলে দেওয়ার ক্ষমতা না, একটি গল্পই ব্যক্তির চূড়ান্ত গল্প বলে প্রতিষ্ঠা করা। ফিলিস্তিনী কবি মুরিদ বারঘুতি লিখেছেন যে, আপনি যদি কাউকে অধিকারচ্যুত করতে চান, সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের গল্প বলা এবং ‘দ্বিতীয়ত’ দিয়ে শুরু করা। 

ব্রিটিশদের আগমনের বদলে নেটিভ আমেরিকানদে তীর-ধনুক দিয়ে শুরু করুন, দেখবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক গল্প। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর হারিয়ে যাওয়ার গল্পকে প্রতিস্থাপন করুণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় কলোনিগুলির ইতিহাস থেকে, পাবেন ভিন্ন স্বাদের গল্প।  

আমি সম্প্রতি এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলতে গেছি। একজন শিক্ষার্থী আমাকে বলেন, নাইজেরিয়ার সকল পুরুষই যে শারীরিক নির্যাতনকারী তা জেনে সে খুবই হতাশ হয়েছে। কারণ আমার লেখা বইটির বাবা চরিত্রটি ছিল শারীরিক নির্যাতনকারী। তখন আমি তাকে বললাম, ‘আমি সবেমাত্র ‘আমেরিকান সাইকো’ উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম। ‘সেই উপন্যাসের চরিত্রের মত আমেরিকার তরুনরাও সবাই সিরিয়াল কিলার সেটি জানতে পেরে আমিও বেশ হতাশ হলাম’ অবশ্যই কথাটি আমি কিছুটা বিরক্তি নিয়ে আর কিছুটা মজা করেই বলেছি। একটি মার্কিন উপন্যাসের চরিত্র সিরিয়াল কিলার ছিল বলে আমি নিশ্চয়ই সকল আমেরিকানকে সিরিয়াল কিলার ভাবছি না। এমন নয় যে আমি সেই শিক্ষার্থী থেকে ভালো মানুষ বলে আমেরিকানদের নিয়ে আমি এভাবে ভাবছি, বরং এক গল্প পড়েই আমেরিকানদের সিরিয়াল কিলার না ভাবার কারণ বিশ্বজুড়ে তাদের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির বিস্তৃতি। আমি আমেরিকার আরও অনেক গল্প পড়েছি, পড়ার সুযোগ পেয়েছি, তাই আমার তাদেরকে এক গল্প দিয়ে বিচার করতে হয়নি। আমি টাইলার আর আপডাইক যেমন পড়েছি, তেমনি পড়েছি স্টেইনব্যাক কিংবা গ্যাটস্কিল। আমেরিকা নিয়ে আমার একটি নয়, অনেক গল্পই জানা ছিল, একটি নয়। 

কয়ের বছর আগে আমি জানতে পারি শৈশব সুখের হলে নাকি সফল লেখক হওয়া যায় না! এরপর থেকে আমার বাবা-মা কীভাবে ছোটবেলায় আমার সঙ্গে কী কী বাজে ব্যবহার করেছে তার স্মৃতি খুড়তে শুরু করি। কিন্তু আদতে আমার ছেলেবেলা ছিল আমার ছোট্ট পরিবারের সঙ্গে খুব হাসিখুশি আর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। তবুও কঠিন সময় যে যায়নি তা কিন্তু নয়। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন আমার দাদা মারা গেছিলেন। পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার অভাবে আমার চাচাতো ভাই পল মারা যান। আমার বন্ধু ওকোলামা মারা যায় প্লেন দূর্ঘটনায়। আমি যেই সামরিক সরকারের শাসনে বেড়ে উঠেছি তাদের কাছে শিক্ষার মূল্য ছিল না, প্রায়ই আমার বাবা-মা বেতন পেতো না।  হুট করেই কোন একদিন সকালে উঠে দেখতাম নাস্তার টেবিল থেকে জেলির বয়াম উধাও হয়ে গেছে। কোনদিন আবার হয়তো মার্জারিন উধাও হয়ে যেত, আস্তে আস্তে পাউরুটির দাম বাড়তে লাগলো, এরপর দুধ আগের মত যত ইচ্ছে খাওয়া যেত না, বুঝেশুনে নিতে হতো। আমাদের জীবনে খুব সাধারণভাবেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা স্থিরভাবে বিরাজমান ছিল। এই গল্পগুলোই আজ আমাকে আমি করে তুলেছে। কিন্তু শুধু এই অসুন্দর গল্পগুলো দিয়ে আমাকে বিচার করা যাবে না। এক গল্প খুব সহজেই স্টেরিওটাইপ তৈরি করে ফেলে। এই বাঁধাধরা কিংবা স্টেরিওটিপিকাল গল্পগুলো সত্য, তবে পুরোপুরি নয়। এক গল্পের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে যাওয়া মানে সেটাকেই একমাত্র গল্প বলে মেনে নেওয়া। কিন্তু তার বাইরেও যে অসংখ্য গল্প আছে।  

আফ্রিকাতে একের পর এক বিপর্যয় লেগেই ছিল, আছে, থাকবে। আফ্রিকা ঘিরে যেমন আছে দগদগে ক্ষত রেখে যাওয়া কঙ্গোর সেই ভয়ানক ধর্ষণের কাহিনী, তেমনি আছে নাইজেরিয়ায় একটি মাত্র চাকরির জন্য ৫০০০ মানুষ আবেদন করার মত হতাশাজনক কাহিনী। কিন্তু আফ্রিকা মানেই কী শুধু দুঃসংবাদ? বিপর্যয়ের গল্প ছাড়াও নিশ্চয়ই আফ্রিকার আরও গল্প আছে। আর সেগুলো নিয়েও কথা বলা সমান গুরুত্বপূর্ণ।    

আমি মনে করি কোনো জায়গা বা মানুষ সম্পর্কে তার সকল রকমের গল্প না শুনে সেই স্থান বা মানুষের সঙ্গে মেশা প্রায় অসম্ভব। আমার মনেহয় এক গল্প দিয়ে মানুষকে বিচার করা মানে তার মর্যাদা কেড়ে নেওয়া/ তার সম্মান কেড়ে নেওয়া। এক গল্প দিয়ে বিচার করলে আমরা তখন সেই মানুষটাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখি না। সেই মানুষটার সঙ্গে আমার মিল খোঁজার বদলে সে কীভাবে আমার থেকে অন্যরকম সেদিকে আমাদের নজর চলে যায়। যদি আমি মেক্সিকোতে ঘুরতে যাওয়ার আগে আমেরিকা-মেক্সিকোর অভিবাসন দ্বন্দ্ব উভয় দিক থেকে পর্যবেক্ষন করতাম কিংবা যদি আমার মা ছোটবেলায় আমাকে বলতো ফাইদের পরিবার গরীব কিন্তু তারা কঠোর পরিশ্রমি কিংবা যদি থাকতো কোন আফ্রিকান টেলিভিশন নেটওয়ার্ক যার মাধ্যমে পুরো বিশ্বকে দেখানো হতো আফ্রিকার বিচিত্র সব গল্প, তাহলে হয়তো নাইজেরিয়ান লেখক চিনুয়া আচেবের ভাষায় ‘গল্পের মাঝে সমতা’ খুঁজে পেতে আমাদের এত কাঠখড় পোড়াতে হতো না। 

আমার সেই রুমমেট নাইজেরিয়া সম্পর্কে যদি  অন্য গল্পগুলো জানতো তবে আমায় দেখে হয়তো তার করুণা হতো না। সে যদি জানতো নাইজেরিয়ান প্রকাশক মুক্তা বাকারার কথা, যিনি নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে প্রকাশনী সংস্থা খুলে বসেন। তখন খুব প্রচলিত ছিল যে নাইজেরিয়ানরা তেমন পড়ুয়া নন, তাই সাহিত্য তাদের জন্য নয়। কিন্তু মুক্তা বাকারা বেঁকে বসেছিলেন। তিনি মনে করতেন হাতের কাছে নিয়ে গেলে আর সহজলভ্য করলে যাদের পড়ার তারা ঠিকই পড়বে। তার প্রকাশনা সংস্থা থেকে আমার প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশ হওয়ার কিছুদিন পর আমি লাগোসে এক সাক্ষাৎকার দিতে যাই।  সেখানে বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করা এক মহিলা এসে আমাকে বলেন, ‘আপনার উপন্যাসটি আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু শেষটা ভালো লাগেনি। আপনার একটা সিক্যুয়েল লেখা উচিৎ যেখানে আপনি এসব জিনিস লিখবেন…’। এরপর তিনি বলতে লাগলেন কীভাবে সিক্যুয়েলটা লিখতে হবে। এ ব্যাপারটায় যে আমি শুধু মজা পেয়েছি তা না, আমি বেশ মুগ্ধও হয়েছি। এক সাধারণ নাইজেরিয়ান মহিলা, যার হয়তো বা আমার বইটা পড়ার কোনো কথাই ছিল না, সে আমার বইটা পড়ে আমি বইয়ের সিক্যুয়েলে কী লিখতে পারি তা নিয়েও নিজের মত জানিয়ে গেছেন। এভাবেই আমার রুমমেট যদি আরও জানতো আমার লাগোসের দুঃস্বাহসী বন্ধু ফুমি ওন্ডার কথা, নিজের টিভি শো’তে সে প্রতিনিয়ত এমন সব গল্প তুলে আনে যা আমরা ভুলে যেতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। যদি সেই রুমমেট শুনতো জে-জি থেকে ফেলা, বব মার্লে থেকে তার আগেকার প্রজন্ম, সকলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ইংরেজি, পিজিন, ইগবো, ইয়োরুবা আর ইজো ভাষায় গাওয়া নাইজেরিয়ার সমসাময়িক গানগুলো। যদি আমার রুমমেট জানতো সেই নাইজেরিয়ান মহিলা আইনজীবীর কথা, আদালতে নারীদের পুনরায় পাসপোর্ট করতে হলে যিনি স্বামীর সম্মতি নেওয়ার মতো হাস্যকর নাইজেরিয়ান আইনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। কিংবা যদি আমার রুমমেট জানতো নলিউড সম্পর্কে, যেখানে অসংখ্য প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে গিয়েও গুণীসব মানুষ বানিয়ে চলছেন অসাধারণ সিনেমা। যদি সে জানতো আমার হেয়ার ব্রেইডার কীভাবে নিজস্ব হেয়ার এক্সটেনশনের ব্যবসা শুরু করেছে কিংবা যদি জানতো আরও লাখ লাখ নাইজেরিয়ানদের গল্প যারা নিজ উদ্যোগে ব্যাবসা শুরু করে, ব্যর্থ হয়, কিন্তু তবুও হাল ছাড়ে না।  

আমি প্রতিবার বাড়িতে ফিরলেই নাইজেরিয়ানদের দেখি আমাদের ব্যর্থ সরকার, অবকাঠামো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে। কিন্তু এই ব্যর্থ সিস্টেমের মধ্যে থেকেও কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত পৌঁছে যাচ্ছে নতুন উচ্চতায়। আমি প্রতি বছর গ্রীষ্মে লাগোসে লেখালেখির ওপর একটা কর্মশালা নেই। সেই কর্মশালার প্রতি সকলের আগ্রহ দেখে আমি অবাক হয়ে ভাবি, কত মানুষ গল্প লিখতে চায়, নিজের গল্পগুলো বলতে চায়। নাইজেরিয়ান সেই প্রকাশক আর আমার এক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আছে, নাম ফারাফিনা ট্রাস্ট। আমাদের স্বপ্ন হলো বিশাল বিশাল লাইব্রেরি তৈরি করা, আর পুরোনো লাইব্রেরিগুলো সংস্কার করা। এছাড়াও যেসব সরকারি স্কুলের লাইব্রেরিতে কোনো বই নেই তাদের জন্য বই দেওয়া। আর নিজেদের গল্পগুলো বলতে যারা মুখিয়ে আছে তাদের জন্য বই পড়া ও লেখালেখির ওপর অসংখ্য অসংখ্য কর্মশালার আয়োজন করা। গল্প বলাটা খুব দরকার। আর অনেক ধরণের গল্প বলা আরও বেশি দরকার। কষ্ট, উৎখাত কিংবা অপমানের গল্প তো অনেক বলা হলো। গল্প যে দিতে পারে সাহস, ক্ষমতা আর জাগ্রত করতে পারে মনুষ্যত্বকেও। গল্পগুলো যেমন হতে পারে মানুষের সম্মান, মর্যাদা কেড়ে নেওয়া নিয়ে, তেমনি হতে পারে সেই হারিয়ে যাওয়া সম্মান ফিরে পাওয়ার।   

আমেরিকান লেখক এ্যালিস ওয়াকার তার দক্ষিনের আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কের বলেছিলেন যারা উত্তরে চলে এসেছে।  দক্ষিনের জীবন-যাপন বিষয়ক একটি বইয়ে তাদেরকে হাজির করেছেন এ্যালিস। ‘তারা গোল হয়ে বসতো,  পরস্পরকে বই পড়ে শোনাতো, আমার বই পড়া শুনতো, এবং এক ধরণের স্বর্গ যেন সেখানে নেমে আসতো’। 

আমি কথা শেষ করার আগে শুধু এটি বলবোঃ একটামাত্র গল্প প্রত্যাখ্যান করলে, যখন আমরা বুঝতে পারি যে কোনো স্থান নিয়ে একটামাত্র গল্প কোনোকালেই ছিল না, আমরা এক ধরণের স্বর্গ খুঁজে পাই। ধন্যবাদ। 

[ বর্তমান লেখাটি ২০০৬ সালে চিমামান্দার ‘ডেঞ্জার অফ ওয়ান স্টোরি’ শীর্ষক টেড টক- এর বঙ্গানুবাদ। সেমসেমের জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সাবিহা শারমিন ইভা।]

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।