আদিবাসীরা কি সাপ-ব্যাঙ খায়: খাদ্য সংস্কৃতির ভৌগোলিক রাজনীতি 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী

আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসছে বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ। তার সুসজ্জিত ক্যান্টিনে খেতে বসেছেন এক মার্কিন নাগরিক। হুট করে খেয়াল করলেন, পাশেই বসে খাচ্ছেন এক মহিলা। মার্কিন ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কোথায়?  

আফ্রিকা, মহিলা উত্তর দিলেন। 

আফ্রিকা? আচ্ছা, আপনারা কি এখনও মানুষ খান? 

মহিলা একটুখানি চুপ থেকে খেতে খেতে উত্তর দিলেন, না, সুযোগ আর পাই কোথায়? পাশে পেয়ে গেলে মাঝেমধ্যে খাই। 

প্রচলিত কৌতুক। পড়ে আমরা হয়তো ঠা-ঠা করে হাসি। এই আমরাই কারও ‘আদিবাসী’ পরিচয় পেলে নাকমুখ চোখা করে জিজ্ঞেস করি, তোমরা তো আদিবাসী, সাপ-ব্যাঙ খাও?  

ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়, সাপ-ব্যাঙ খাওয়াটা খুব লজ্জার বিষয়। এই একবিংশ শতাব্দীতে কেউ সাপ-ব্যাঙ খায় কীভাবে? বলাই বাহুল্য, এই যুক্তিতে সমর্থক পাবেন। একবাক্যে সমর্থন দেবে সাপ আর ব্যাঙ! এই সমর্থকদের পাশাপাশি দাঁড় করাবেন না যেন, একটা আরেকটাকে কপ করে খেয়ে নেবে।  

এই যে স্বজাত্যবোধের অহংকার, অন্যদেরকে একটু ‘আদারিং’ করে ফেলে কিঞ্চিত খাটো করে ফেলা, ব্যাপারটা যে এই একবিংশ শতাব্দীর অভিনব আবিষ্কার এমন না। হয়তো দেখা যাবে ডায়নোসররাও এমন ফুড-শেমিং বা খাদ্য-তাচ্ছিল্যে অভ্যস্ত ছিলো। এক টি-রেক্স হয়তো আরেক টি-রেক্সকে বলত, এই দ্যাখ দ্যাখ ওরা ট্রাইসেরাটস বাদ দিয়ে অ্যাডমন্টাসোরাসের মাংস খায়। ছিছি! 

কল্পনা করার দরকার কী? মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবুর তার আত্মজীবনীতে বলে গেছেন, ঘোড়ার মাংস খুব প্রিয় দেখে হিন্দুস্তানের আমির-অমাত্যরা কীরকম অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখত। নেহায়েত সম্রাট মানুষ, হাসিঠাট্টা তো আর করা যায় না! তাই তারা চুপ করে থাকতেন। বাবুর অবশ্য ঠিকই সেই চাহনিটা টের পেতেন!

খাদ্য তাচ্ছিল্য বাবুরও ফিরিয়ে দিয়েছেন। বারবার হাহাকার করেছেন, ‘এ কোন মরার দেশে এসেছেন’ বলে। বাবুরের বোন খানজাদা কাবুল থেকে তরমুজ পাঠিয়েছেন শুনে একেবারে বাচ্চাদের মতো হাপুস-হুপুস করে খেয়েছেন। তারপর বলেছেন, যেমন কাষ্ঠং-সুষ্ঠং দেশ, তেমনি খটখটে তার ফল। হ্যাঁ, ওই আম নামের ফলটা একটু ভালো। তবে, কাবুলের ফলের তুলনায় সেটা আসলে একটুই। 

ঠিক তার তিন প্রজন্ম পরের সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেশ কিন্তু হিন্দুস্তানই। কাবুলকে ঠেস দিয়ে তিনি বললেন, আমের মতো একটা ফলের সমতুল্য ফল তামাম কাবুলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা কী আসলে? খাবারটা রূপক এখানে। আড়ালে নিজের জাতটাকে বড় করে দেখানোর চেষ্টা। 

আরও কয়েক শতক পর মাইকেল মধুসূদন বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ প্রহসনে দেখালেন, গ্রাম্য মাতবরের টাকা খাওয়া কুচুটে বুড়ি মুসলমান বাড়িতে এসেছে কৃষকের সুন্দরী বউকে হাত করতে। বৃদ্ধ মাতবরের একটু আশনাই করার শখ আরকি। বুড়ি এসেছে তো ঠিকই, কিন্তু মুসলমান বাড়ির চারদিকে শুধু মুরগির পাখা আর পেঁয়াজের খোসা দেখে সে নাক কুঁচকায়। কুঁকড়োর পাখা, প্যাঁজের খোসা… থু থু! বুদ্ধিমান পাঠক, এটাই আদারিং! 

এই আদারিং-এর পাল্লায় পড়ে বাঙালি বলে ঘটিরা হলো চিংড়ি নামের পোকা খাওয়া বোকা, ঘটি বলে আলসে বাঙালি চেনে খালি বালিশ আর ইলিশ। এভাবেই ‘গরুখেকো’ মুসলিম, ‘কাছিম খাওয়া’ হিন্দু, ‘শুয়োর খাওয়া’ ক্রিশ্চান, ব্যাঙ খাওয়া ফরাসি, সাপ খাওয়া চাইনিজ, কুকুর খাওয়া কোরিয়ান, খেজুর খাওয়া আরব! 

কিন্তু কথা তো সেটা না! কথা হলো আদিবাসীরা তো সাপ-ব্যাঙ খায়। খায় তো! আমাদের দেশে বিশেষ করে মারমা সম্প্রদায় ব্যাঙ খাবার জন্য প্রসিদ্ধ। কিন্তু তারাই পৃথিবীর একমাত্র ব্যাঙখেকো জাতি নয়! এই ব্যাপারে পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ হলো ফরাসিরা। ছবির দেশে কবিতার দেশে পাঠকের অজানা নয় যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসি প্রেমিকা মার্গারিটের সাথে দেখা করতে প্যারিসে এসে খুব আগ্রহের সাথে বললেন, এবার তাহলে ব্যাঙ খাওয়া যাক! মার্গারিট অবাক। ব্যাঙ তো সেও আগে খায়নি! এ তো খুব বড়লোকের খাবার।    

দুজনে মিলে টাকা দিয়ে ব্যাঙের পা কিনল। তারপর মাখনে ভেজে নিয়ে ভয়ে ভয়ে মুখে দিল। মুখে দিয়েই অবাক বিস্ময়ে চিৎকার! এত অপূর্ব স্বাদ হবে তারাও ভাবতে পারেনি! 

তারমানে কী দাঁড়াল? আদিবাসীদের মতো প্যারিসবাসীও ব্যাঙ খায়। আজ পর্যন্ত কোনো ফরাসিকে দেখলে কাউকে বলতে শুনেছেন যে ‘ও, ফ্রেঞ্চ? তোমরা ব্যাঙ খাও?’ কেন বলে না? কারণ ফরাসিদের সাথে আমাদের এই আদারিংটা করার দরকার নেই। 

চাইনিজরা শুধু সাপ না, হেন কোনো প্রাণী সম্ভবত বাদ নেই যেটা তারা খাবার জন্য মুখে নেয় না। সৈয়দ মুজতবা আলী তো চাইনিজদের আরশোলা প্রীতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই ইঙ্গিত রেখেছেন। বলবেন চাইনিজ দেখলে এই কথা? বলবেন না। বলবেন আদিবাসী দেখলে: খাস তো তোরা সাপ ব্যাঙ!   

আদিবাসী বললে আমাদের সামনে এমন একটা অবয়ব ভেসে ওঠে, আদিবাসী মাত্রই নিজের ভাষা ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না, আদিবাসী মানেই সব এক ধর্মের অনুসারী, আদিবাসী মানেই দেশের সাড়ে ষোলো লাখ মানুষ প্রতিদিন একটা খাবারই খায়। আর কী সেই খাবার? ঠিক ধরেছেন। সাপ আর ব্যাঙ। এক অবিচ্ছেদ্য ডুয়ো। একটা ছাড়া আরেকটা জমেই না। ঠিক যেন জ্যাম আর পাউরুটি।   

বাংলাদেশে মোট ৫০ সম্প্রদায়ের আদিবাসী বাস করে। এর মাঝে অনেকেই বাস করে পাহাড়ি অঞ্চলে । কেউ কেউ সমতলে। নানা ধর্মের অনুসারী এই আদিবাসীরা। এদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলে বাস করা সাঁওতালের সাথে সিলেটে বাস করা মণিপুরী আদিবাসীর খাদ্যাভ্যাসে মিল খুঁজতে যাওয়াটা বাতুলতাই বলা যায়। তামাম বাংলাদেশ যেমন বিভিন্ন আঞ্চলিক খাবার খাচ্ছে, ওরাও খাক যেটায় ওরা অভ্যস্ত। 

খানাখাদ্য নিয়ে এই যে কাউকে নমো নমো করা, আবার কাউকে ছিছি করে নাক কুঁচকানো, অর্থনৈতিক অগ্রসরতা দিয়ে একে সহজভাবে ধরতে পারা যায়। মধ্যযুগ মাত্র শেষ হয়েছে। তমসা থেকে অল্প অল্প গা ঝাড়া দিয়ে উঠছে ইউরোপ। উপমহাদেশে তখন ধন-সম্পদের রমরমা। টুকটাক যেসব ইউরোপীয় বনিক এ অঞ্চলে পাড়া দেয়া শুরু করেছে, তারা এখানকার ধন-দৌলত দেখে মুগ্ধ, এখানকার খাবার-দাবার দেখে মুগ্ধ। সে মুগ্ধতাই আবার পালটে গেল, যখন পাশার দান উলটে ইউরোপীয়রা এই অঞ্চলের শাসন-শোষণের মালিক। ইংরেজ ঐতিহাসিকদের সে সময়ের বিবরণ পড়লে চোখে ভেসে ওঠে সভ্য ও সৌখিন বৃটিশ শাসকদল ভারতীয় উপনিবেশে বসে কাঁটাচামচে স্টু ঠুকছে, স্যুপ খেয়ে ন্যাপকিনে ব্লট করছে, আদর করে পুডিং খাচ্ছে, শ্যাম্পনের গবলেটে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে। অন্যদিকে হতভাগা নেটিভরা? গামলা গামলা ভাত হয় মাংস-চর্বি দিয়ে ঠুসছে, না হয় বসে বসে রুটির জাবর কাটছে! কী গরীব… কী গরীব…  

ইউরোপ ধন-দৌলতে ভারতের নিচে আর নামেনি। কাজেই তাদের খাওয়া-খাদ্যও আমাদের কাছে হয়ে থেকেছে সভ্যতার পরম উৎকর্ষ, খাদ্য-ভদ্রতার স্ট্যান্ডার্ড। খাবার সময় ঢেঁকুর তোলা যাবে না, হাঁচি-কাশি দেয়া যাবে না, মুখে চপ চপ শব্দ করা যাবে না… অনেক নিয়ম। সে নিয়ম খারাপ কেউ বলছে না, কিন্তু নিজের খাদ্য সংস্কৃতি দিয়ে সারা বিশ্বের স্ট্যান্ডার্ড মাপার তুমি কে, হরিরাম? 

পাশ্চাত্যের খাবারের খুব কদর তখন, সেসময়ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটতে লাগল চীন, জাপানের। পাশ্চাত্য খাদ্য সংস্কৃতির উল্টোই বলা যায় সবকিছু। হাতে চপস্টিক থাকলেই হলো, সেটাই কারির বোলে ডোবাও, সেটাই মুখে দাও, সেটাই সবার সাথে অন্যান্য খাবার ভাগ করে খাও। আর শব্দ? নুডলস খাবার সময় যদি আপনি হুশ-হুশ জাতীয় কোনো শব্দ না-ই করে থাকেন, রাঁধুনীকে অপমান করলেন!   

কী আশ্চর্য, চীন-জাপানের অর্থনীতিটা চাঙ্গা হবার পর পাশ্চাত্যের কাছে যে খাবার রীতি ‘অসভ্য’ বলে মনে হতে পারত, সেই রীতিটাই লুফে নিলো সবাই। আমাদের দেশেও এল চাইনিজ রেস্তোঁরা। তাতে চামচের টুংটাং, গ্লাসের ঝনঝন সবই চলল। চাইনিজ খাওয়াটা তখন আভিজাত্যের প্রতীক, পয়সাওয়ালার লক্ষণ। বৃটিশ ভদ্রতার সাথে এটিকেট মিলছে না? খামোশ!

তখন পর্যন্ত আরবরা বেশ গরীব। মাটির নিচে তেলের আভাস পাওয়া যায়নি। আরবের বেদুইনরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়, একযোগে বসে খাবার ভাগাভাগি করে খায়। কী জীবন, কী জীবন। ওদের খাবার আর খাওয়া কী, ওদের খাদ্য উপহার দিয়েই বরং বাঁচিয়ে রাখা উচিত। একসাথে এক থালে সবাই যে বসে খাচ্ছে, কেমন অস্বস্তি লাগে না? 

সেই আরবদের পয়সা হলো। ভুল বললাম, পেট্রো ডলার হলো। হাবিবি হাবিবিদের কদর বাড়ল বিশ্বজুড়ে। সেইসাথে কদর বাড়ল তাদের খাবারেরও। সবাই মিলে এক পাতের থেকেই তুলে তুলে খাওয়া? কী রাজসিক ব্যাপার! কী মানবিক উদারতা!  

হয়তো বাঙালিরও একসময় পয়সা হবে। তামাম বিশ্ব হয়তো সেই সময় গোগ্রাসে পোড়া মরিচ আর লবণ ডলা দিয়ে পান্তা মাখিয়ে খাবে। শীতের সিজনে ফুলকপি আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ইনস্টায় ছবি দিয়ে ভাইরাল হবে স্কুলপড়ুয়া কোনো মার্কিন কিশোরী।  

আর আদিবাসীরা টাকা-পয়সায় ধাঁই-ধাঁই উন্নতি করলে? সে উত্তর শেষে গিয়ে বলছি। 

অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে খাদ্যমোহে ভোগার একটা ব্যাপার আছে বোঝা গেল। কিন্তু তার মানে কি খাদ্য তাচ্ছিল্য করাটা খুবই যৌক্তিক? মানবিক? না। কেন আমরা এই খাদ্য তাচ্ছিল্য দেখাই, সেটার কারণগুলোই বলা হলো আরকি। 

শুধু খাদ্য গলাধঃকরণ নিয়েই আমরা আদারিং করি? মোটেই না। অন্য খাওয়া নিয়েও আমরা জাত-বেজাত বুঝিয়ে দেই। তাই আমাদের সমাজে দেখতে পাওয়া যায় ছ্যাঁকা-খাওয়া মজনুকে, আছাড়-খাওয়া শহুরে চাচাতো ভাইকে, ধরা-খাওয়া ব্যবসায়ীকে, পল্টি-খাওয়া রাজনীতিবিদকে, দৌড়ানি খাওয়া পকেটমারকে। 

নাটকে মোশাররফ করীম ফারুক আহমেদকে বলছিলেন, ‘দুনিয়াটা আসলে খাওয়াখাওয়ির খেলা।’ সত্যিই তাই। দুনিয়াটা খাওয়ার, অন্যকে খাওয়ানোর, আগামী প্রজন্মও যাতে ভালোভাবে খেয়ে পরে বাঁচে তার ব্যবস্থা করে যাওয়া। কিন্তু, খাদ্য-তাচ্ছিল্য করা? নৈব নৈব চ!  

আদিবাসীদের কথায় ফেরত আসি। তারা টাকা-পয়সার হিসেবে দাপট খাটানো পরিবর্তন নিয়ে আসলে কী হবে? কিচ্ছু হবে না, আমরা সম্ভবত খাবারেই পড়ে থাকব। খুব আগ্রহ নিয়ে বলব, ‘আদিবাসী আপনি? ওয়াও! নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে মজার মজার সাপ-ব্যাঙ খান!’   

মুদ্রাদোষ হইতে সাবধান

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

হাত নেই, পা নেই, নাক নেই, চোখ নেই, কান নেই, এমন কি মাথা পর্যন্ত নেই, এরকম মানুষও বেশ দেখা যায়; কিন্তু কোনো ‘মুদ্রাদোষ’ নেই, এরকম মানুষ দেখা যায় না। মানুষ হলেই তার মুদ্রাদোষ থাকবেই। কলকাতার মত বর শহরে যেখানে, লোকসমাগম সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুদ্রাদোষের যে ভ্যারাইটি দেখা যায়, এমনতি আর অন্যত্র কোথাও দেখা যায় না। স্ট্যাটিস্টিসিয়ানরা ভালো করে অনুসন্ধান করলে নানারকমের মুদ্রাদোষের একটা শ্রেণীবদ্ধ ‘টেবল’ তৈরি করতে পারেন এবং তার ফ্রিকুয়েন্সি ডিস্ট্রিবিউশনও স্টাডি করতে পারেন। এখানে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, কারণ আমি সংখ্যাবিজ্ঞানী নই, এরকম কোনো অনুসন্ধানের কাজ বোধহয় কোনো সমাজবিজ্ঞানী বা মনোবিজ্ঞানী করেন নি। তবু মনে হয় যে, মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে মুদ্রাদোষের একটা নিকট-সম্পর্ক আছে এবং ‘মুদ্রাদোষ’ মোটামুটি ‘নিউরোসিসে’র মধ্যে গণ্য। যতদূর লক্ষ্য করেছি তাতে মনে হয়েছে ‘মুদ্রাদোষ’ তিন শ্রেণীর আছে— (১) আঙ্গিক, (২) বাচনিক ও (৩) কাল্পনিক। হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। ‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষ সাধারণত কথার মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ, কথা বলতে বলতে যেসব কথা ঝড়ের মুখে আবর্জনার মতন আসে, কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ হল ‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ। কোনো একটা ‘কল্পনা’ বা ‘আকাঙ্ক্ষা’ (সাধারণত অবদমিত ও অপূর্ণ) সবসময় মনের মধ্যে পাক খেতে থাকে এবং সুযোগ পেলেই দৈনন্দিন জীবনের আলাপ আলোচনায় আত্মপ্রকাশ করে। যিনি প্রকাশ করেন তার তো কোনো চেতনাই থাকে না, এমনকি যাদের সামনে প্রকাশ করেন তাদেরও চৈতন্য প্রায় লোপ পাবার উপক্রম হয়। এই তিন শ্রেণীর মুদ্রাদোষ, কলকাতা শহরের নানা ধরণের লোকের মধ্যে যা নজরে পড়েছে, তাই এখানে উল্লেখ করব। উল্লেখ এই জন্যই করা প্রয়োজন যে মধ্যে মধ্যে মুদ্রাদুষ্ট মানুষ পকেটমারের চাইতেও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন, কিন্তু যেহেতু সকলেরই কিছু কিছু মুদ্রাদোষ আছে, সেজন্য কেউ কাউকে সাবধানও করতে পারেন না। ‘পকেটমার’ ‘কে’ বা ‘কোথায়’ আছে যেমন কেউ জানে না, কিন্তু ট্রেনে বাসে সর্বত্রই লেখা থাকে যে ‘পকেটমার কাছেই আছে, সাবধান!’ ঠিক তেমনি ‘মুদ্রাদোষ’ কার আছে বা কার নেই কেউ জানে না, অতএব প্রত্যেকেরই ও-সম্বন্ধে সাবধান হওয়া কর্তব্য।

হাত নাড়া, পা নাড়া, মুখভঙ্গি করা ইত্যাদিকে ‘আঙ্গিক’ মুদ্রাদোষ বলা যেতে পারে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

যারা বসে বসে দোলেন, হাটু নাচান, পা নাচান, হাত নাড়েন এবং নানারকমের বিকট মুখভঙ্গিমা করেন কথা বলার সময়, তারা সাধারণত নিরীহ টাইপের, তাদের দেখে খুব বেশি ভয় পাবার কারণ নেই। তাদের কাছাকাছি বসে স্বচ্ছন্দে আলাপ-আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু এদের মধ্যে একটু উপরের স্তরের যারা তাদের মধ্যে একটা দৈহিক আক্রমণের ঝোক দেখা যায়। কথা বলতে বলতে খুব জোরে হাত-পা ছোড়া, টেবিলে ঘুষি মারা, টেবিল চাপড়ানো, এসব উপসর্গ নির্ভরযোগ্য নয়। অর্থাৎ যাদের এসব উপসর্গ আছে তাদের ধারেকাছে, অন্তত গজ দুইয়ের মধ্যে থাকা উচিৎ নয়, আর সবসময় এদের বাঁদিকে থাকাই নিরাপদ (বামপন্থীদের ছাড়া)। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের যারা সত্যি সত্যি একেবারে সোজা অফেনসিভ নিয়ে বসেন। আড্ডায় আলোচনায় দু-একজনকে দেখেছি, খুব বেশি ফূর্তি হলে বা কোনো হাসির মজার কথা হলে, হাসতে হাসতে পাশের লোককে সাপটে জড়িয়ে ধরতে এবং উত্তেজনার মাত্রা বাড়লে সোজা কিল ঘুষি মেরে তা প্রকাশ করতে। আঙ্গিক মুদ্রাদোষের এইটাই বোধহয় চরম স্তর। এই ধরণের লোক কেমন করে যে দাম্পত্য জীবন যাপন করেন ভগবান জানেন, তবে এদের অবস্থা দেখে মনে হয় যে ‘ব্যাচিলার’ থাকাই এদের কর্তব্য, কারণ স্বামীর যত আনন্দই হোক, কোনো স্ত্রীই প্রচন্ড কিল চড় ঘুষিতে তা উপভোগ করতে রাজী নয়। 

‘বাচনিক’ মুদ্রাদোষের অসংখ্য ভ্যারাইটি আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে কমন হচ্ছে ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’। ‘মানে’ ও ‘বুঝেছেন’ মাত্রার তোড়ে আপনি ভেসে যাবেন এবং শেষ পর্যন্ত যে বক্তা কি বলতে চান তার ‘মানে’ কিছুই বুঝতে পারবেন না। ‘মানে সমস্ত জিনিসটা যদি ভেবে দেখা যায় মানে, তাহলেই দেখবেন মানে গলদ কোথায় মানে?’ অথবা এই ‘মানে’রই আর এক সংস্করণঃ ‘এই যে লোকগুলো বুঝেছেন, এরা যাকে বলে বুঝেছেন একেবারের যে যার স্বার্থ নিয়ে বুঝেছেন কিনা—‘ ইত্যাদি।  এরপরে বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল। এই ‘বুঝেছেন’-এরই অনেক ভ্যারাইটি আছে, যেমন, ‘বুঝেছেন’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, ‘বুঝেছেন কিনা’ থেকে ক্রমে সংক্ষিপ্ত আকারে ‘বোয়েন’, ‘বাঁ, বাঁ’ পর্যন্ত। ‘বুঝেছেন’ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে যখন ‘বাঁ বাঁ’ হয় তখন তার উপরে জোর পড়ে খুব বেশি, হেঁচকির মতন। যেমন—’যদি মানে আপনারা আসেন বাঁ, তাহলে বাঁ, মানে ওটা আমি দু-একমাসের মধ্যেই তৈরি করে দেব বাঁ’, ওর জন্য কোনো অসুবিধা হবে না বাঁ—’। একে ‘বাঁ,’ তার উপর ‘মানে’ একসঙ্গে দুই মুদ্রার সংযোগ, সবার উপরে বাঁ মুদ্রাটি ‘বুঝেছেন’ কথার সংক্ষিপ্ত রূপ হবার জন্যে তার ওপর এ্যাকসেন্ট খুব বেশি। এই ধরণের লোকের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে হলে অসম্ভব ধৈর্যের দরকার। একজনের দেখেছি ‘কথা হচ্ছে’। কিছু বলতে হলেই তিনি আরম্ভ করবেন: কতাহ হচ্ছে কি জানেন? যত দিন যাচ্ছে, ততই কথা হচ্ছে, ততই মানুষের কথা হচ্ছে, কংগ্রেসের ওপর, সেই আগেকার বিশ্বাস, কথা হচ্ছে আর থাকছে না।‘ তার কারণ কথা হচ্ছে—’। একটু অসাধারণ হলেও আর একটি বাচনিক মুদ্রাদোষ শুনেছি—‘যদি বলি কেন’। যেমনঃ ‘ব্যাপারটা কি জান, এদের যতই বল, এরা কিছুতেই শুনবে না। যদি বল কেন, এদের স্বভাবই হল তাই। যদি বল কেন, এরা চিরকাল ঐ করে এসেছে। যদি বল কেন—’। এ ছাড়া কথা কথায় কথ্য কথা বলা যেমন, ‘ব্যাটাচ্ছেলে সোয়াইন ইডিয়ট ইত্যাদি’ এ তো অনেকেরই মুদ্রাদোষ আছে। সবচেয়ে বিচিত্র একটি মুদ্রাদোষ বাঙালি ভদ্রলোকের মধ্যেই বিশেষভাবে দেখা যায়, সেটা হল বাংলা কথা ইংরেজিতে অনুবাদ করার মুদ্রাদোষ। ‘আমার বাবা, মানে আমার ফাদার, বুঝতে পেরেছেন’- এটা একেবারে ত্র্যহস্পর্শযোগ বলা চলে। অর্থাৎ ‘মানে’, ‘বুঝতে পেরেছেন’, এবং বাংলার ‘ইংরেজি অনুবাদ’ তিন মুদ্রার যোগাযোগ। এদের সঙ্গে বাক্যালাপ করা সতযিই বিরক্তিকর। যেমন মনে করুন একজন বলছেনঃ ‘আমি মানে একসময় খুব পড়াশুনা করতাম, আই ওয়াজ এ ভোরেশাস রিডার, বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু পরে দেখলাম ওসব একেবারে বাজে মানে এ্যাবসলিউটলি মিনিংলেস, বুঝতে পেরেছেন’—ইত্যাদি। সাধারণ বাঙালী শিক্ষিত ভদ্রলোকদের এই হল কথাবার্তার ধরণ বা প্যাটার্ন। এই মারাত্মক মুদ্রাদোষ থেকে আমি খুব কম ভদ্রলোককেই মুক্ত দেখেছি। এ সম্বন্ধে সত্যিই আমাদের সাবধান হওয়া উচিৎ। ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘বাজে’ মানে ‘মিনিংলিস’ একথা আলাপের সময় না বলাই ভাল নয় কি?

‘কাল্পনিক’ মুদ্রাদোষ সবচেয়ে মারাত্মক, কারণ সেটা প্রায় মনোবিকারের স্তরে পড়ে। সাধারন লেখক, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতিদের মধ্যে এই মুদ্রাদোষ খুব বেশি দেখা যায়। কথাবার্তার সময় প্রত্যেকে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং নিজে যে কি কি ভয়ানক ব্যাপার করেছেন, তার একটা অযাচিত বিরক্তিকর ফিরিস্তি দিতে বসেন। এটা তাদের শেষ পর্যন্ত  একটা মুদ্রাদোষেই পরিণত হয়ে যায়, এবং কি বলছেন, কোথায় বলছেন, কেন বলছেন, বলার দরকার কি, সে সম্বন্ধে কোনো চেতনাই আর থাকে না। এদের মধ্যেই এক টাইপের লোক আছেন, যাদের ধারণা তারা ‘এক বিরাট পিতার পুত্র’ অথবা ‘সর্বগুণসমন্বিতা স্ত্রীর স্বামী’।  কেউ শু অতে না চাইলেও এরা যেকোনো কথা উপলক্ষ করে বলবেনঃ ‘আমাদের ফাদারও বুঝেছেন, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় কোনদিন টলারেট করেন নি—’ ইত্যাদি। বলবার উদ্দেশ্য হল এই যে তিনি নিজে যে ‘গ্রেট’ সেটা অনেকটা যে ‘হেরডিটারি’ তাই প্রমাণ করা। অর্থাৎ  ‘গ্রেটনেসটা’ তার ব্যক্তিগত গুণ নয় শুধু, বংশগত গুণ। তেমনি অনেককে বলতে শুনেছিঃ ‘আমার ওয়াইফ গ্র্যাজুয়েট বুঝেছেন, কিন্তু সব কাজ নিএর হাতে কারে, রান্নাবান্না সেলাই পর্যন্ত’। হঠাৎ কোথাও কিছু নেইঃ ‘আমার ওয়াইফের হাতের লেখা একেবারে ছাপার মতো বুঝেছেন, দেখলে অবাক হয়ে যাবেন।‘ হোটেলে বসে মাংস খাচ্ছেন, হঠাতঃ ‘আমার ওয়াইফ বুঝেছেন এত চমৎকার মাংস রাঁধে, খেলে আর ভুলবেন না’। একটা কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন, হঠাৎঃ ‘আমার ওয়াইফ অদ্ভুত রিসাইট করে বুঝেছেন, অনেক মেডেল পেয়েছে—’ ইত্যাদি। এসব কথা বলার যে কি দরকার তা বুঝি না। আপনার ‘বাবা’ মানে ‘ফাদার’ অথবা ‘স্ত্রী’ মানে ওয়াইফ যে রকমই হন না কেন, তাতে অন্যের কি আসে যায়, কেউ তা জানবার জন্যে উদ্গ্রীব নয় জানবেন। অতএব ‘ওয়াইফ’ ও ‘ফাদারের’ মুদ্রাদোষ ছাড়ুন।