(অনুবাদকের ভূমিকা:
লুস ইরিগেরে একজন ফরাসি নারীবাদী, দার্শনিক, ভাষাবিজ্ঞানী, মনোভাষাবিজ্ঞানী, মনোবিশ্লেষক এবং সংস্কৃতি তাত্ত্বিক। জ্যাক লাকাঁ ছিলেন তাঁর শিক্ষক। কিন্তু “জ্বি-স্যার, হ্যাঁ-স্যার” না বলে লুস ইরিগেরে তাঁর শিক্ষকের ভুল ধরতে শুরু করেন।
জাক লাকাঁর মতানুসারে, একটা শিশু যখন বড় হতে থাকে, তখন একটা পর্যায়ে সে তাঁর নিজেকে একটা আলাদা মানুষ হিসেবে চিনতে শুরু করে এবং, যে সমাজে সে থাকে, সে সমাজের নিয়মানুসারে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকে। এইযে এই সমাজ, সমাজের নিয়মকানুন, সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা, সবার সাথে মানিয়ে চলা—এইসবকিছুই, লাকাঁর মতে, একটা বৃহত্তর সিম্বলিক অর্ডারের অংশ। অর্থাৎ, প্রতিটা মানুষ তাঁর থেকে বৃহৎ একটা সাজানো-গোছানো সিস্টেমের অংশ। লাকাঁ বলেন যে এই সিম্বলিক অর্ডারের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে “ফ্যালাস”…এখন, ফ্যালাসের আক্ষরিক অর্থ হলো পুরুষাঙ্গ, কিন্তু লাকাঁর তত্ত্বে এই শব্দটি ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে। অর্থাৎ এটা কেবল একটি প্রতীক—কিন্তু, যেই সমাজ প্রতীকের উপরেই ভর করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই সমাজে যেকোনও প্রতীক কেন আছে বা কিভাবে আছে বা সেটা থাকার ফলে কি হচ্ছে/না হচ্ছে, সেগুলোও বিবেচ্য।
সেই চিন্তা থেকেই লুস ইরিগেরে প্রশ্ন তুলেন এই প্রতীকী ফ্যালাসের নিরপেক্ষতা নিয়ে। যে সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে পুরুষাঙ্গকে রাখা হয়, সেই সমাজ কি স্বাভাবিকভাবেই পুরুষতান্ত্রিক হবেনা? লুস ইরিগেরে এই প্রশ্নের জের ধরে দাবি করেন যে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞানে ও দর্শনে নারীদেরকে কেবল পুরুষের জন্য দরকারি কোন না কোন ভূমিকায় রাখা হয়েছে—অর্থাত, হয়তো মা-য়ের ভূমিকায়, কিংবা বৌয়ের; এতে করে, নারীদের নিজেদের কোন আলাপ, চিন্তা বা ভাষা তৈরি হয়নাই এই তত্ত্বীয় জায়গাগুলাতে।
এখন এর সমাধান কি? লুস ইরিগেরে নিজে এই সমস্যার সমাধান হিসেবে একটা নতুন সিম্বলিক অর্ডার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেছেন, যেখানে নারীরা সারাক্ষণ পেনিস-এনভিতে ভোগে না, বা পুরুষদের পৌরুষের অনুপস্থিতির প্রতীক হয়ে জীবন কাটায় না। এটা এমন এক সিম্বলিক অর্ডার, যেখানে ভাষা নারীদের হয়ে কথা বলে, নারীদের কথা বলে, নারীদের মতন করে কথা বলে। এখন, এই “নারীদের মতন”, “পুরুষদের মতন” এসব বলার কারণে ইরিগেরের সমালোচকের অভাব নাই, যারা মনে করেন যে তিনি এসেনশিয়ালিজম থেকে বের হতে পারেন না—তবে, প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমটাও যেহেতু এসেনশিয়ালিজমের চর্চাই করে, স্ট্র্যাটেজিক এসেনশিয়ালিজমের দরকার আছে, এমনটাও বলেন অনেকে।
ইরিগেরে আরেকটা কাজ করেন—তিনি নারীদের মধ্যের সম্পর্ক নিয়ে কথা বলেন, নারীর বড় হয়ে ওঠা নিয়ে কথা বলেন, মেয়েদেরকে পুরুষদের আতশ কাচের নিচ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে তাদেরকে নিজেদের কথা বলতে উৎসাহ দেয়ার কথা বলেন।
এই প্রবন্ধটায় একটা মেয়ে তাঁর মায়ের সাথে কথা বলছে। কিন্তু, তাঁর মা কেবল তাঁর মা-ই নয়, বরং নারীত্বও। আবার এই মেয়েটাও কেবল একজন মেয়ে নয়, বরং সকল মেয়ের ভেতরের মন। ইরিগেরের ভাষা আপাতভাবে খুব সহজ—পড়লে মনে হয় যেন চিঠি পড়ছে কেও। কিন্তু সেই সহজ ভাষা থেকে তাঁর চিন্তাগুলো খুঁজে বের করে বুঝতে পারাটা হয়তো একটু কঠিন। কিন্তু কঠিন হলেও, অসম্ভব নয়—বিশেষ করে কারোর যদি ফ্রয়েড আর লাকাঁর চিন্তার সাথে পরিচয় থেকে থাকে। এই প্রবন্ধের কথক সেই সকল মেয়ে, যারা বড় হয় এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়, যারা জীবনের কোন এক পর্যায়ে তাদের মায়ের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ অনুভব করে কোন কারণ ছাড়াই, বা হয়তো তীব্র ঘৃণা, বা একটা অকথিত লজ্জা। যারা বাবার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, পুরুষের চোখে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তোলার জন্য এটা-সেটা করে। আর যারা আরেকটু বড় হওয়ার পর মায়ের প্রতি তীব্র মমতা বোধ করে, সমাজটা কিভাবে কাজ করে তা বুঝতে পেরে হুট করে বিশ্বাসের স্তম্ভগুলো নড়বড়ে হয়ে ওঠে যাদের। এই প্রবন্ধে, মোদ্দা কথায়, এক নারী (বা সব নারী) কথা বলছে আরেক নারীর (বা সব নারীর) সাথে—দুই প্রজন্মের এক একপাক্ষিক আলাপ হিসেবেও ধরা যেতে পারে। )
তোমার দুধের সাথে, আম্মা, আমি বরফ গিলেছিলাম। আর এখন, এইযে এখানে আমি, আমার ভেতরটা জমাট বেধে আছে। আমার নড়তে কষ্ট হয়, তোমার থেকেও বেশি কষ্ট হয়—আমি তোমার থেকেও কম নড়াচড়া করি, আম্মা। তুমি আমার ভেতর স্রোতের মতন এসেছিলে- আর সেই উষ্ণ স্রোত বিষ হয়ে আমাকে অসাড় করে দিলো। আমার পায়ে বা হাতে আর রক্ত চলাচল করেনা—মাথা পর্যন্ত তো যায়ই না। আমার রক্ত জমাট বেধে আছে—বরফের শীতলতায় জমে আছে আমার ভেতরটা- খন্ড খন্ড বরফ বাধাগ্রস্ত করছে রক্তের চলাচলকে। আমার রক্ত ঘন হয়ে আমার হৃদয়ে, হৃদয়ের আশেপাশে জমতে থাকে। আমি যা ভালোবাসি, তার কাছে আমি তাই দৌড়ে যেতে পারিনা। যত ভালোবাসি আমি, ততই যেন আটকা পরে যাই—এক ভার আমাকে আটকে রাখে, আমাকে নিশ্চল করে রাখে। আমি রেগে যাই, ছাড়া পাওয়ার জন্য হাতপা ছোড়াছুঁড়ি করি—আমি চিৎকার করি—আমি এই কারাগার থেকে বের হতে চাই! কিন্তু কিসের কারাগার?! কোথায় এই কারাগার? দেখা তো যায়না খালি চোখে। বুঝতে পারি, কারাগার আমার ভেতরে, আর আমিই এতে বন্দী। তাহলে, কিভাবে বের হবো? আর কেনই বা আমি এভাবে আটকে আছি?
তুমি আমাকে দেখে রাখো, আমার খেয়াল রাখো। তুমি চাও আমাকে তোমার চোখে চোখে রাখতে—যেন তুমি আমাকে নিরাপদ রাখতে পারো। তোমার ভয় হয় যে আমার কিছু একটা হবে। তোমার কি ভয় লাগে যে খারাপ কিছু হবে? কিন্তু, আম্মা, এইযে আমি দিনরাত সটান হয়ে শুয়ে থাকি, এর থেকে খারাপ আর কিই বা হতে পারে! আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ হয়েও বাচ্চাদের দোলনায় দুলছি। এখনো নির্ভর করছি কারোর উপর যে আমাকে দেখে রাখবে, আমাকে বয়ে বেড়াবে সারাদিন। কে আমার দেখে রাখবে, বলো?
আমার মধ্যে কোত্থেকে এক আলো আসে। আমার ভেতরের কিছু একটা আড়মোড়া ভেঙে উঠতে শুরু করে। নতুন কিছু আমাকে জাগিয়ে তুলেছে। মনে হচ্ছে আমি যেন নিজের ভেতর প্রথম পা ফেললাম। যেন এক দমকা হাওয়া এসে ঢুকছে সম্পূর্ণ পাথর হয়ে যাওয়া এক অস্তিত্বের ভেতর, তার স্থবিরতা ভেঙে দিচ্ছে। যেন এক গভীর ঘুম থেকে আমাকে ডেকে তুলছে। প্রাচীন এক স্বপ্ন থেকে। এমন এক স্বপ্ন যা আমার নিজের স্বপ্ন না, বরং সেই স্বপ্ন যার ভেতর আমি বন্দী ছিলাম।
আমি কি এই স্বপ্নে অংশ নিয়েছিলাম, নাকি আমিই স্বপ্ন ছিলাম? অন্য কারোর স্বপ্নে—অন্যকে নিয়ে দেখা স্বপ্নে? আমি নিশ্বাস নিতে শুরু করি, বা, আমি ‘আবার’ নিশ্বাস নিতে শুরু করি। অদ্ভুত। আমি স্থির হয়ে থাকি, এবং অনুভব করি যে আমার ভেতরে কিছু একটা নড়ছে। অদ্ভুত! আমার ভেতরে ঢুকে এটা, আমাকে ছেড়ে যায়, আবার ফিরে আসে, আবার চলে যায়। আমি একাই এই নড়াচড়া করি। কেও আমাকে সহায়তা করেনা। আমার ভেতরেই আমার একটা বাড়ি আছে, আর আরেকটা আছে বাইরে, আর আমি একাই আমার নিজেকে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে নিয়ে যাই। তোমার পেট, তোমার হাত বা তোমার চোখ আর প্রয়োজন নেই আমার। চলে যাওয়া বা ফিরে আসার জন্য তোমার অনুমতির দরকার নেই আমার। আমি এখনোও তোমার কত্ত কাছে, আবার একইসাথে অনেক দূরে। এখন সকাল, আমার প্রথম সকাল। এই, আম্মা, দেখো! তুমি ওখানে। আমি এখানে। আমাদের দু’জনের মাঝে কত্ত বাতাস, আলো, জায়গা—যা আমরা একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে পারি। আমি আর অধৈর্য্যের মতন লাথি মারিনা, কারন আমার হাতে এখন সময় আছে।

সময় গড়ায়। আমি ক্ষুধার্ত। ইশ! আমার যদি শক্তি থাকতো হাঁটার। যদি দৌড়ানোর শক্তি থাকতো—তোমার কাছে আসার বা তোমার থেকে দূরে যাওয়ার। আমি যা ভালোবাসি, তার কাছে যেতে পারতাম যদি! তুমি খাবার তৈরি করেছো। তুমিই সেটা আমার কাছে নিয়ে আসো। তুমি আমার মুখে তোমার নিজেকে তুলে দিচ্ছো। কিন্তু তুমি বেশিই দিয়ে দিচ্ছো আমাকে! যেন তুমি তোমার আদর দিয়ে আমাকে ভরে তুলতে চাও! তুমি তোমার নিজেকেই যেন বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছো—আমার মুখে পুরে দিচ্ছো নিজেকে…আমার দম আটকে আসছে। আম্মা, তোমার পুরোটা আমাকে দিও না…যতটুকু দিবে ততটুকু দেখার সুযোগ দাও আমাকে। আমি তোমাকে দেখতে চাই, যখন তুমি আমাকে আদর করো—আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকো, যখন আমি তোমাকে চুমুকে চুমুকে নিজের ভেতর নেই। তুমি বাইরে থাকো? তোমার ভেতর থেকে যে বিশাল সাগর প্রবাহিত হয় আমার দিকে, তাতে ডুবে যেওনা—আমাকেও ডুবাতে চেওনা, আম্মা। আমরা দু’জনই বাইরে থাকি? আমি চাই আমরা দুইজনই যেন একসাথে পাশাপাশি থাকি—কেউ যেন কারোর মধ্যে মিশে উধাও না হয়ে যাই। যেন আমরা একে অন্যকে অনুভব করতে পারি, একে অন্যের কথা শুনতে পারি, একে অন্যকে চোখ ভরে দেখতে পারি—একসাথে।
আমি তোমার মতন দেখতে, আম্মা, আর তুমি দেখতে আমার মতন। আমি তোমার মধ্যের আমাকে দেখি, আর তুমি দেখো আমার মধ্যের তোমাকে। তুমি কত্ত বড়! আমি এখনো অনেক ছোট। কিন্তু, আমি তোমার কাছ থেকেই এসেছি—আর দেখো, তোমার চোখের সামনেই, এই আমি আরেক তুমি!
কিন্তু তোমার তো কতশত চিন্তা—তুমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাও। তুমি আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের অস্তিত্বের উপস্থিতি নিশ্চিত করো, আর এরপর রান্নার দিকে মন দাও। ঘড়ির সাথে সাথে তুমি তোমার নিজেকে বদলাও। নিজের রূপ বদলাও দিনের সময়ের সাথে। কিন্তু, কিসের সময়? সময়টা কার? সময়টা কিসের জন্য? ইশ! আমার ইচ্ছা করে এই ঘড়িটা ভেঙ্গে ফেলতে…আর এরপর তোমাকে দেখতে। তোমার মধ্যের আমাকে দেখতে। এইযে আমরা এক এবং একইসাথে ভিন্ন—এটা কিন্তু মজার ব্যাপার! আমরা কিন্তু চাইলে খেলতে পারি, আম্মা—একবার তুমি নিজেকে না ভুলে আমি হবে, আরেকবার আমি নিজের মতন থেকেই হবো তুমি! আমরা জীবন্ত আয়না হবো, একে অন্যের জন্য!
আমরা খেলতাম, তুমি আর আমি। কিন্তু কে বুঝবে যে আমরা খেলনা বল দিয়ে খেলি না? তুমি আমার দিকে এক চিত্র ছুড়ে দাও, আমি ধরে ফেলি! ধরে, আবার তোমার দিকে ছুড়ে দেই, যা তুমি নিয়ে আবারও আমার দিকে ছুড়ে মারো। এভাবেই চলতে থাকে অনন্ত কাল ধরে। কে বুঝবে আমাদের এই খেলা? আর মানে…কে বুঝবে যে এই খেলা খেলার জন্য আমাদের কোন বল-টলের দরকার নাই! আমি তোমার এক রূপ তোমার দিকে ছুড়ে মারি, আর তুমি ওটা আবার আমার দিকে ছুড়ে মারো।
কিন্তু এরপর কিছুক্ষণের জন্য তুমি তোমার নিজেকে কিভাবে যেন ধরে রাখতে পারো, আর তারপর আবার তুমি আমার দিকে ছুড়ে মারো নিজেকে, ‘তুই খাবি একটু, মা? খাওয়ার সময় হয়েছে। বড় হতে হলে খেতে হবে তো’।
এইযে আবার তুমি গলে গলে পুষ্টিতে রূপান্তরিত হলে। আমরা আবারো উধাও হয়ে গেলাম একে অন্যকে গ্রাস করে। তোমার দিকে যেতে না যেতেই, তোমাকে দেখতে না দেখতেই তুমি আমার সেবায় নিয়োজিত হয়ে গেলে আবার! আবারো তুমি আমাকে মুখ ভরে খাওয়াতে চাও, আমার পেট ভরাতে চাও, তোমার নিজেকে আমার মুখ ও পেটের জন্য বিসর্জন দিতে চাও—যেন তোমার আর আমার মাঝে রক্ত, দুধ, মধু আর মাংস ছাড়া আর কিছুই নাই! কিন্তু না না, সব মাংস দিও না, আম্মা, আমি চাইনা তুমি আমার ভেতর মরে যাও! আমাদের মধ্যে কি এই…শূন্যতা পূরন করার…এই খেলা ব্যতীত কোন ভালোবাসা থাকবেনা, আম্মা? আমাদের মধ্যে কত্ত কি হতে পারতো- সেই সব সম্ভাবনাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দেয়াই কি তোমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা আমরা হয় খাবো, নয় খাবার হবো—এরকমটাই চাও তুমি?
……
দেখো, আমি আর এই আটকে থাকার স্থবির জীবন চাইনা। না, আমি মুক্ত বাতাস চাই। আর যদি তুমি বারবার, বারবার আমাকে এই অন্ধকারচ্ছন্ন জায়গায় নিয়ে আসো, যেখানে কেবল তোমার বিভিন্ন রূপ আসে আর যায় (কিন্তু, তুমি কে আসলে?), যদি তুমি তোমার মুখ আমার থেকে সরিয়ে নাও, আর আমাকে কেবল দাও তোমার এক নিঃসাড় রূপ, যদি আমাকে দক্ষ পুরুষদের হাতে তুলে দাও এই আশায় যে তারা আমার এই অসাড়তা ভেঙ্গে দিবে, তাহলে আমি আব্বার দিকে ফিরে তাকাবো। আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো, তোমার থেকে বেশি জীবন্ত কারোর কাছে যাবো। আমি এমন কারোর কাছে যাবো যে আমার ক্ষুধা লাগার আগেই আমার খাওয়ার জন্য খাবার রান্না করেনা। এমন কেও, যে আমাকে তার পুরাটা দেয়না—যে আমাকে তৃষ্ণার্ত রাখে—আমি হা করে থাকি, তার সত্যকে পাওয়ার জন্য। আমি অন্ধ ভক্তের মতন তার পিছেপিছে ঘুরবো, সে যা বলবে আমি শুনবো।
সে বাসা থেকে বের হয়—আমি তার পিছে পিছে যাই। আম্মা, আমি যাই, আমি কিছুতেই তোমার মতন হবোনা কখনো।
আমি এখন নিয়মিত ব্যায়াম করি। আমার এই রোগ সারানোর জন্য আমি ব্যায়াম করি। আমি প্রশিক্ষিত এক রোবট হবো। আমি আমার শরীর নাড়াবো—কিন্তু তাতে কোন প্রাণ থাকবেনা। আমাকে যেই যেই ব্যায়াম করতে বলা হয়েছে, আমি সেই সেই ব্যায়াম করছি। আমি আমার হাত-পা ছুঁড়ে নাচি—কিন্তু সেই নাচে কোন ভালোবাসা নেই, কেবল প্রচেষ্টা আছে। দিনের প্রতিটি ঘণ্টা আমাকে নিবিষ্ট করে রাখে: ডাক্তারদের আদেশ মানতে চেষ্টা করছি। ডাক্তার আমাকে আমার রোগ সম্পর্কে যা যা বলেছে, আমি তার সাথে একদম একমত। আমি চিকিৎসার জন্য সবকিছু করি। রোগমুক্তির জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তাদের নিরীক্ষণ যে সঠিক, তার জীবন্ত প্রমাণ হবো আমি। জীবন্ত হয়ে ওঠার মাধ্যমে তাদের যে আদর পাই, তাতে আমি পুনরুজ্জীবিত অনুভব করি।
তুমি দূর থেকে দেখতে পাচ্ছো তো—এইযে আমি কিভাবে মাপা পায়ে হাটছি, যেই আমি একসময় রাগে বরফ হয়ে ছিলাম? আমি এখন ভালো আছি না, আম্মা? প্রায় নিখুঁত এক মেয়ে না আমি? কেবল কয়েকটা জামা, কিছু অলংকার, কিছু প্রসাধনী, একটা ছদ্মদেশ থাকলেই একদম পুরোপুরি নিখুঁত একজন মেয়ে হয়ে উঠবো আমি। আমাকে যেমন দেখতে চায় সবাই, তেমনই লাগে এখন আমাকে দেখতে। আরেকটু চেষ্টা করলেই—তোমার (তুমি, যেই তুমি আমাকে খালি ছোট রাখতে চাও, আমাকে খালি তোমার মতন করে খাওয়াতে চাও, আমাকে তোমার মতন পোশাক পরতে দিতে চাওনা) উপর আরেকটু রাগ করলেই আমি এই স্বপ্ন থেকে বের হতে পারবো। আমার এই রোগ থেকে মুক্তি পাবো। আমার ভেতরের তোমার থেকে মুক্তি পাবো—তোমার ভেতরের আমি থেকেও। আমি আমাদেরকে ছেড়ে যাবো। আমি অন্য এক বাসায় যাবো। আমি আমার জীবন যাপন করবো, আম্মা, আমার গল্প লিখবো আমি।
দেখো, কত সুস্থ্য আছি আমি এখন। আমার এখন আর কোন পুরুষের পিছে পিছে দৌড়াতে হয়না—সে-ই আমার কাছে আসে। সে ধীরপায়ে আমার কাছে আসে। আমি অপেক্ষা করি তার জন্য। আমি এতটাই স্থির হয়ে অপেক্ষা করি, যে আমার পায়ে শেকড় গজিয়ে যায়। সে একদম কাছে চলে এসেছে—আমি আবার অসাড় হয়ে উঠি। আমার রক্ত চলাচল করেনা নির্বিঘ্নে। আমার নিশ্বাস ছোট হয়ে আসে। আমি চলে যাই। আমি তোমাকে বলতে পারবোনা আমি কোথায় যাই। আমাকে ভুলে যাও, আম্মা। আমার ভেতরের তোমাকে ভুলে যাও, তোমার ভেতরের আমাকেও ভুলে যাও। দয়া করে আমাদেরকে ভুলে যাও। জীবন চলতে থাকে—
—
তুমি আয়নায় তোমার নিজের দিকে তাকাও। আয়নার প্রতিচ্ছবিতে তুমি তোমার মা-কে দেখো। একটুপরেই আবার তোমার মেয়েকে দেখো—তোমার মনে পরে যে তুমি মা হয়েছো। এইযে তোমার মা আর তোমার মেয়ে—এই দুইজনের মাঝে তুমি কই? তোমার নিজের জায়গা কই? কেবল তোমার নিজের জন্য কতটুকু জায়গা বরাদ্দ? আর এইযে একবার মেয়ের মুখোশ, আরেকবার মায়ের মুখোশ পরো তুমি—এসব মুখোশের ভীরে তোমার মুখ কোথায় হারিয়ে যায়?
সন্ধ্যা হয়েছে। তুমি এখন একা, আর একা বলেই তোমার কোন ছদ্মবেশ ধরা লাগেনা। তাই তুমি তোমার সব মুখোশ খুলে ফেলো। তুমি এখন কোন মায়ের মেয়ে নও, কোন মেয়ের মা নও। আয়নায় আর তোমার চেহারা দেখা যায়না—তোমার আর কোন চেহারা নাই! তুমি নরম হয়ে যেতে থাকো। তুমি গলে যাও। তুমি তরল হয়ে তোমার থেকে গড়িয়ে পড়ে যেতে থাকো।
কিন্তু তোমাকে তোলার জন্য তো কেও নাই, আম্মা! আর কিছুতেই তো এই উপচে পরা প্রবাহ থামছেনা! যদি এই ক্ষরণ চলতে থাকে, তাহলে তো এই দিন শেষ হওয়ার আগেই তুমি শেষ হয়ে যাবে। এইযে তুমি মেয়ে ছিলে, আর মা হলে- এই দুই পরিচয়ের মাঝের যে সময়টুক, তার কোন ছবি বা স্মৃতি পর্যন্ত থাকবেনা! তোমার কোন কাজের কোন চিহ্ন থাকবেনা। কোন চিহ্ন বা স্মৃতি তৈরি হওয়ার আগে থেকেই তো তুমি লালন করতে শুরু করো তোমার অন্য পরিচয়। কেবল ছোট একটা বিরতি আছে, যেই বিরতির মাঝে তুমি এক পরিচয় থেকে অন্যটিতে আবর্তন করো। যে নিজেকে দান করে, তাকে কেও দেখার আগেই তো তাকে গ্রাস করা হয়ে যায়। তুমি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছো। তোমাকে আর কেও দেখতে পায়না—তোমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়—কেবল…সেই স্রোতের মধ্যে থাকো তুমি, যা তোমার থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে পরে অন্যজনের মাংসের ভেতর ঢুকে। তোমার সবটুক অন্যজনের ভেতর প্রবাহিত হয়—তার শরীরের সবটুকু জায়গা দখল করে নেয়। তোমার আর তার মধ্যের যত দুরত্ব, যত ব্যবধান, সবই দূর হয়ে যায়। শেষতক কেবল থাকে এই তরল, এই প্রবাহমান স্রোত যা একজনের থেকে আরেকজনের কাছে যায়—এই স্রোতের তো কোন নাম নাই।
আজ রাতে তোমাকে নিজের মধ্যে নেয়ার কেও নাই, আম্মা। কেও নাই যে তোমার জন্য তৃষ্ণার্ত, যে তোমাকে তার নিজের মধ্যে গ্রহণ করবে। কেও আর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার তাড়নায় তার ঠোঁট ফাঁক করে তোমাকে তার ভেতর সাঁতরে ঢুকতে দেয়না। কেও তোমার অস্তিত্বের কথা, তোমার নিজের থেকে সরে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য নাই। কেও নাই, যে বলবে, “আসো এখানে, এখানে থাকো”, কেও নাই যে বলবে তোমাকে, “আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা আর বারবার নিজেকে হারানো- এই দুইয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেওনা।“ এখন তোমার থেকে বিচ্ছিন্ন আরেক তুমি। তোমার ভেতরে সেই আরেক তোমার অস্তিত্বর অভাব অনুভব করছো তুমি। দুইটি মৃত সত্তা, একে অন্যের থেকে অনেক দূরে এবং তাদের ভেতর এখন আর কোন বন্ধন নাই। তোমার যে অংশ লালনপালনে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলো, সে অংশ এখন তোমার আয়নায় তুমি যাকে দেখো তার থেকে বিচ্ছিন্ন। আর আমি যেহেতু চলে এসেছি, তোমার সবটুকু তুমি যেই পাত্রে ঢেলে দিয়েছিলে, সেই পাত্রও তুমি হারিয়ে ফেলেছো। তুমি যে তোমার সর্বস্ব কাওকে দিয়েছো, তার প্রমাণও তোমার কাছে আর নেই।
মানে, তুমি তা-ই ভেবেছিলে আরকি। কিন্তু, তোমার ভেতরে জমে থাকা বরফ আমাকে যখন দিয়েছো তখন তুমি কি আমার তৃষ্ণাও মেটাও নি তোমার অসাড়তা দিয়ে? তোমার নিজের জীবন্ত চেহারা কখনো দেখোনি বলে কি তুমি কি আমাকে জীবনহীনতা দিয়ে হলেও পেলেপুষে বড় করোনি? তোমার রক্তে, তোমার দুধে, বালুর মরীচিকা বাক খেয়ে যেতো নদীর মতন। এরমধ্যে ছিলো সেই তরল যা আমাদের দু’জনের ছুড়োছুড়ির মধ্যে বরফ হয়ে গিয়েছে সময়ের সাথে সাথে—যার ফলে এখন আমাদের মধ্যে এক অসম্ভবতা গড়ে উঠেছে। প্রয়োজনের খাতিরেই আমি তোমার প্রতিচ্ছবির এমন এক জায়গা হয়ে উঠেছি যেখানে বসবাস করা যায়না। তুমি চেয়েছিলে আমি যেন বড় হই, হাটতে শিখি, দৌড়াতে শিখি—যেন তোমার দূর্বলতাকে ধ্বংস করে দিতে পারি।
তোমার নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছায় নিজেকে জীবন্ত হতে দেখতে চেয়েছিলে বলে তুমি আমাকে আটকে রেখেছিলে। তুমি আমাকে চেয়েছিলে, আম্মা, তোমার মতন করে—তোমার ভালোবাসায়, আমি ধীরে ধীরে এক মূর্তি হয়ে উঠলাম। আমার মধ্যে তোমার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়ার যে প্রবল ইচ্ছা তোমার, সেই ইচ্ছার ভারে আমি কেবল তোমার জীবনের এক ছায়া হয়ে উঠলাম।
যেখানে তুমি দৃশ্যমান হতে চেয়েছিলে, সেখানে কেবলই স্বচ্ছ হলে। এমন এক পরিবেশ তৈরি হলো, যেখানে তোমার ছায়াও নেই—তোমার শরীর তার নিজেকে চিনলো না। তুমি দিগ-দিগন্ত ঘুরে দেখলেও কখনো নিজের সাথে দেখা হবেনা এ দশায়। কখনো নিজের সাথে ধাক্কা খাবেনা—আর এতে করে তোমার/আমার বিকাশ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আলোর দিকে যাওয়ার সব রাস্তা কি এক বিচ্ছিরি কারণে অন্ধকার হয়ে যায়।
তুমি কে? আমি কে, আম্মা? এই অহেতুক বাধার সামনে আমাদের এই স্বচ্ছ অস্তিত্বের জবাব কে দিবে?
আর আমি যদি চলে যাই, আম্মা, তুমি তোমার নিজেকে আর খুঁজে পাওনা। আমি না থাকলে কি তুমি উধাও হয়ে যেতে না? তোমার অনুপুস্থিতিতে তোমার জায়গায় তো আমিই থাকি। এইযে তুমি নাই, সেই নাইকে পাহাড়া দেই তো আমিই। আমিই তো তোমাকে বারবার বলি যে “তুমি সবসময়ই নিজেরে খুঁজে পাবা, নিজেরে জড়ায়ে ধরতে পারবা—যেকোন সময় তুমি তোমার নিজেরে আগলায়ে রাখতে পারবা আদরে। নিজেরে বাঁচায়ে রাখতে পারবা”। আমি তো তোমাকে বলি, আম্মা, “তোমার নিজের যত্ন নাও। তোমার নিজেরে দুধ দাও, রক্ত দাও, মধু দাও—এই পৃথিবীতে তোমার নিজের জায়গাটা বুঝে নাও আবার।“
কিন্তু এই সন্ধ্যায় কেও আসেনা। তুমি এমন এক ভবিষ্যতের দিকে আগাও, যেখানে বড্ড অভাব। সেখানে তোমার স্বপ্ন মনে রাখার কেও নাই। সেখানের বাড়িটায়, বাড়ির সামনের বাগানটায় তুমি নাই। তুমি তোমাকে খুঁজে বেড়াও সব ঘরে, কিন্তু কোন লাভ হয়না। তোমার চোখের সামনে কিছু নাই যা তোমাকে তোমার কথা মনে করাবে। তুমি এমন কিছুকে স্পর্শ করতে পারোনা, যা তোমাকে তোমার কথা বলবে। এমন কিছুই নাই, যা তোমাকে তোমার নিজের প্রতিচ্ছবি অন্য কারোর মধ্যে দেখার সুযোগ দিবে। এইজন্য তুমি বিহবল হয়ে তোমার নিজেকে আবারো আমার মধ্যে পুরে দিতে চাও, যাতে আর কিছু না থাকলেও তোমার স্মৃতিটা আমার মধ্যে বেঁচে থাকে। না, আম্মা, তা-ও আর পারবেনা। আমি তো চলে গিয়েছি।
কিন্তু, আমি কি কখনো তোমাকে পেয়েছি? মানে সবসময়ই তো তুমি চলে যাওাই ছিলে। আর, তোমার চলে যাওয়ার মূল কারণ কখনোই আমি ছিলাম না। যখন তুমি তোমার নিজেকে আমার মধ্যে ঢালছিলে, তখন—না, তারও আগে তুমি চলে গিয়েছিলে। তার আগেই তুমি অন্য কোথাও বন্দী হয়ে গিয়েছিলে। কারোর দৃষ্টিতে তোমার জীবন যাপন করছিলে। কারোর চোখের নিচে দিন কাটাচ্ছিলে। তুমি এমন এক পৃথিবীর দিকে হাটছিলে, যে জগতে আমার পা ফেলার কোন অধিকার ছিলোনা। আমি তোমাকে কেবল তোমার হারিয়ে যাওয়া অবস্থাতেই পেয়েছিলাম। আমার উপস্থিতি তোমকে সাহায্য করতো তোমার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট ভুলে থাকতে। আমার উপস্থিতি দিয়ে আমি তোমার অনুপস্থিতিকে ঘন করে তুলতাম।
কিন্তু, স্মৃতিসৌধ হঠাত উধাও হয়ে গেলে, স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। আর এইতো তুমি এখন, এই সন্ধ্যায়, শোক পালন করছো কিন্তু কেন বা কিসের শোক তা তোমার আর মনে নাই। তুমি এমন এক শূন্যতা নিজের মধ্যে নিয়ে ঘুরছো, যে শূণ্যতা সব স্মৃতিকে ভুলিয়ে দেয়—নিজের প্রতিধ্বনিতে নিজেই চিৎকার করে উঠে—তোমার বন্দিশালার দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই শূন্যতা তোমাকে তোমার ভবিষ্যতের দিকে যেতে দেয়না।
তুমি নিচে যাও, তুমি আবার নিচে নামতে থাকো একা একা, মাটির নিচে। যে মাটির নিচে তুমি আমি হাটি। হয় তুমি বা আমি, বা আমরা দু’জনই। তুমি তোমার দৃঢ়তা হারাও। একাকিত্বের সঙ্গী হয়ে যে স্থিরতা আসে, তা তোমার মুখের রেখাগুলকে, তোমার প্রতিটা পদক্ষেপকে শক্ত করে তুলেছে। তুমি এই গুহায় ফিরে আসো, যে গুহার মুখ তুমি খুঁজে পাচ্ছিলে না। এই ঘরে ফিরে আসো তুমি, যে ঘরে ফেরার পথ তুমি ভুলে গিয়েছিলে। তোমার স্মৃতির এই গর্তে ফিরে আসো, যেখানে তোমার থেকে আমার জন্মের নিরবতাকে কবর দেয়া হয়েছিল, তোমার থেকে যেই আমি কখনো আলাদা হতে পারবোনা, সেই আমার আলাদা হওয়ার নিরবতাকে কবর দেয়া হয়েছিল। আমাকে তোমার ভেতরে নেয়ার রহস্যের কাছে ফিরে আসো।
কি হয়েছিলো তোমার পেটের ভেতরের রাত্রিতে? কিভাবে জানলে তুমি যে আমি আর নাই? কখন আমরা দুইজন এক হয়ে গেলাম? আমাদের দুইজনের মধ্যে, কে সেই একজন আর কে অন্যজন?
তুমি যখন আমাকে বড় করছিলে তোমার ভেতর, তোমার ভেতর কিসের আলো জন্মাচ্ছিল, আম্মা? নাকি ছায়া বড় হচ্ছিলো কোন? তুমি কি সেই আলোয় আলোকিত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠোনি, আম্মা? আমি যখন তোমার মাটিতে শেকড় পুতলাম, তখন তুমি কি অন্ধকারে ডুবতে থাকোনি?
তোমার দুধের সাথে, আম্মা, তুমি আমাকে বরফ গিলিয়েছিলে। আর আমি যদি এখন চলে যাই, তুমি তোমার জীবনের প্রতিচ্ছবিকে হারাবে। আর আমি যদি থাকি, তাহলে…তাহলে আমি কি কেবল তোমার আসন্ন মৃত্যুর কথাই তোমাকে মনে করিয়ে দিবোনা? আমাদের দুইজনের একজনেরও নিজের কোন একক ছবি নাই—আমাদের নিজের কোন রূপ নাই, নিজের শরীর নাই। একজন কষ্ট পেলে অন্যজন কাঁদে। তুমি আয়নায় নিজেকে হারিয়েছো, তাই আমি এখন অসাড় হয়ে আছি।
আমি তো সেই ফুল ছিলাম, যে ফুলকে কেও পানি দেয়না। যে ফুল নিজের মধ্যে বেড়ে ওঠে কখনো নিজেকে দেখতে না চেয়ে। এমন এক বেড়ে ওঠা যা কোন গৎবাঁধা নিয়মে বেড়ে ওঠা না। যেই ফুল জানেনা সে গোলাপ হবে না ঘাসফুল হবে। যে ঘন্টায় ঘন্টায় তার রং-রূপ বদলায়। বদলানোর এই খেলায় সে মত্ত। সে ঘুরতে থাকে, চলতে থাকে বড় হওয়ার তাগিদে—ফুটতে থাকে—তার দুনিয়ায় এখনো কোন চিত্র নেই, কোন মাপকাঠি নেই। সে তার নিজের ইচ্ছায়, নিজের মতন করে বাঁচতে থাকে—কারোর নজরের চাপ পরেনি তার উপর। পরিপূর্ণভাবে প্রস্ফুটিত হওয়ার পর, হঠাত এক হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছার বন্ধনে তাকে বাঁধা হয়। এক প্রশ্নের অন্ধ ঘরে সে আটকে থাকে, কোন উত্তর ছাড়া।
তুমি কি আগে থেকেই ঠিক করে রাখোনি যে আমি তোমার অস্তিত্বের বাহক হবো ভবিষ্যতে? আমি কি তোমার সেই চেহারাই না—যা অন্য কেও তোমার থেকে চুরি করে নিতো আমি না আসলে? যেই ত্বকে অন্য কেও দাবী বসাতো, সেই ত্বকের অধিকারীই কি আমি না? তুমি তো আমার ভেতরেই বিচরণ করো সারাক্ষণ—আমার প্রতিটি পদক্ষেপে তোমার যন্ত্রণাদায়ক চলাচল অনুভব করি আমি। আমার ভেতর তোমার অচেনা এক পরিচয়কে তুমি গড়ে তুলছো যত্ন করে। সেই পরিচয় কি হবে, তা এখনো সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়নি। তবে, তুমি কিন্তু ঠিকই ঠিক করে ফেলেছো…ফেলোনি? এইযে, এই মেয়েটা তা-ই হবে যা আমি হতে চেয়েছিলাম বা চাই বা হবো—এটাই কি ভাবোনি আমার জন্মের পর আমাকে দেখে? আমার নিজের সত্ত্বা সৃষ্টি করার সুযোগ আর আমি পেলাম কই বলো! তোমার বাইরে কি আমি জীবন শুরু করতে পারবো? কিন্তু, আমি যখন তোমার ভেতরে ছিলাম, তখনও তো তুমি আমাকে বাইরেই রাখতে, আম্মা।
আর আমি যখন চলে যাবো, সেটা কি তোমার বিদায়েরই পূর্বাভাস দিবেনা? আর যখন আমার পালা আসবে? অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার? আমিও তো আম্মা বন্দী হয়ে যাই যখন কোন ছেলে আমাকে তার দৃষ্টিতে রাখে; আমিও তো নিজের থেকে আলাদা হয়ে যাই। সেই ছেলে আমাকে যেমনটা দেখতে চায়, তেমনটা হওয়ার ভারে আমি নিশ্চল হয়ে উঠি। তার দৃষ্টি যে ধরনের চেহারা দেখে আনন্দ পাবে, সেধরনের চেহারা পরে থাকার অভ্যাস করি—নিজের থেকে হারিয়ে যাই ক্রমশ। তার স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর মরিচিকার সাথে সাথে আমি বদলাই; হুট করেই এক একক লক্ষ্য আমার সামনে উপস্থিত হয়। আমার এখন একটাই দায়িত্ব, সেই দায়িত্বেই আমি বন্দীঃ মাতৃত্ব।
—–
আমি কি তোমাকে ধরিনাই, আম্মা? তুমি কি আমাকে ধরতে দাওনাই? আমি তোমার মুখটা আমার দুইহাতে ধরেছিনা? আমি কি তোমার শরীর চিনিনা? আমি তোমার শরীরের ভেতর জন্ম নিয়েছি, বেড়ে উঠেছি। তোমার থেকে আমার হওয়ার যে পথ, সেই পথ কি আমার পরিচিত না? তোমার শরীরের পূর্ণতায় বেঁচে ছিলাম আমি। সে শরীরে পৌঁছানোর যে রাস্তা—তোমার আর আমার মধ্যের সে-ই রাস্তাটা অনুভব করে করেই তো আমি বেঁচে ছিলাম। তোমার দৃষ্টি থেকে এক বাতাসের মতন নরম কাথা তৈরি করেছিলাম তোমার আর আমার মিলগুলো থেকে আমাকে রক্ষা করতে। তোমার/আমার মুখ থেকে, এক অশেষ দীগন্তের শুরু। আমাদের লিঙ্গগত মিলের কারণে, তোমার আমার মধ্যে, তোমার আমার বাইরে ও ভেতরে এই অশেষ দীগন্ত। আমাদের ত্বকের সমান। না খুব বড় বা ছোট। একদম খোলা না, আবার শেলাইও করা না মুখ। ছেড়া না, কিন্তু আবার একটু খোলা।
কেন আমাকে আর কোন কষ্ট দেয়া হবে, আম্মা? আমি কি তোমার শরীর—তোমার ঠোঁট নিয়েই জন্মাইনি? আর এই শরীর—এই শরীর তো সবসময়ই আমরা যা একে অপরকে দিতে থাকি, বলতে থাকি, তা দেয়ার জন্য আর পাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নিরবতায় কি এক ফাটল! সেই ফাটলে আমরা বারবার একে অন্যকে জড়িয়ে ধরি আবার জন্ম নেয়ার জন্য। এখানে আমরা নিজেদেরকে জানতে আসি, শিখতে আসি নিজেদের নিয়ে, নারী হতে আসি, আর আসি মা হয়ে উঠতে, বারবার বারবার।
কিন্তু আমরা কখনো, কখনোই একে অন্যের সাথে কথা বলিনাই। আর সবসময়ই এমন ভয়ংকর এক খাদ তোমাকে আর আমাকে আলাদা করে যে আমি তোমাকে ছেড়ে গেলেও কখনোই তোমার থেকে পুরোপুরি আলাদা হতে পারবোনা, কারণ আমি সবসময়ই তোমার গর্ভে আটকা পরে আছি। তোমার পেটের ছায়ায় ঢাকা। আমাদের বন্দীশালায় বন্দী।
এবং—একজন অন্যজনকে ছাড়া নড়ে না। কেবল একসাথেই আমরা চলতে পারি, কিন্তু আমরা একসাথে চলিনা। যখন একজন পৃথিবীতে আসে, অন্যজন মাটির গহবরে ঢুকে যায়। যখন একজন জীবন ধারণ করে, অন্যজন মারা যায়। আর আমি তোমার কাছে কি চেয়েছিলাম, জানো আম্মা? আমি কেবল চেয়েছিলাম যে, আমাকে জীবন দিতে গিয়ে যেন তুমি নিজে মরে না যাও।