লিপি, বসতি ও সাহিত্যপাঠের নতুন নজর 

martin-puchner-2822
মার্টিন পুখনার
সাহিত্য সমালোচক ও সংস্কৃতি গবেষক
WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
সাহিত্য কতটা গভীরভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর জীবনের সঙ্গে জড়িত তা বোঝানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এর প্রযুক্তিগত মাত্রার দিকে নজর দেওয়া। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

সাহিত্যপাঠকে সম্পদ-আহরণকারী জীবনের দলিল হিসেবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমি যে পরিবেশ-সচেতন পাঠচিন্তার রূপরেখা দিতে চাইছি, এটা তার একটামাত্র দিক। কারণ সাহিত্য কেবল আমাদের যৌথসিদ্ধান্তগুলোর নথি নয়; সাহিত্য নিজেও সেই সিদ্ধান্তগুলো থেকেই জন্মায়। অন্যভাবে বললে, সাহিত্য কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নয়, নিজেও গভীরভাবে জড়িত এক অংশগ্রহণকারী।  

সাহিত্য কতটা গভীরভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর জীবনের সঙ্গে জড়িত তা বোঝানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এর প্রযুক্তিগত মাত্রার দিকে নজর দেওয়া, অর্থাৎ লেখার ইতিহাসে। এই ধরনের বিশ্লেষণ শুরু করতে সবচেয়ে উপযুক্ত পাঠ্য হলো গিলগামেশ মহাকাব্য। এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে এই পাঠ্যটি একদিকে যেমন সম্পদ আহরণের একটি মহান দলিল, তেমনি এটি লিখিত সাহিত্যের বিকাশেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুইটি দিক একে অপরের সঙ্গে পদ্ধতির দিক দিয়ে গভীরভাবে যুক্ত।  

বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ লেখন-পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল মেসোপটেমিয়ার প্রাচীনতম নগরসভ্যতাগুলিতে। গিলগামেশ মহাকাব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সেই সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল মাটিপোড়ানো ইট দিয়ে। এই চমৎকার নির্মাণপদ্ধতিই ছিল মেসোপটমীয় নগর-সভ্যতার ভিত্তি। তবে মাটি কেবল ইট, দেয়াল, ঘরবাড়ি বানানোর জন্যই উপযুক্ত ছিল না। আপনি যদি এনকিদুর মত একজন মেসোপটমীয় ঈশ্বর হতেন, তাহলে মাটি লেখালেখির কাজেও আসতো। কিউনিফর্ম লেখন-পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন হতো আর্দ্র মাটি, যার ওপর ত্রিমাত্রিক খোদাই করা যেত, পরে এই মাটির ফলকগুলোকে রোদে শুকিয়ে অথবা আরও টেকসই করতে চুল্লিতে পুড়িয়ে শক্ত করা হতো।

গিলগামেশ মহাকাব্যে যতটা গর্বের সঙ্গে উরুকের নগরকাঠামোর কথা বলা আছে, ঠিক ততটাই গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা আছে কাদার ওপর শব্দ বসিয়ে লেখার শিল্পটির কথা। এমনকি এতে খুব গর্বের সঙ্গে বলা হয় যে গিলগামেশ নিজেই লেখার কৌশল জানতো। হোমারের মহাকাব্যগুলো যেখানে এমন এক জগৎকে তুলে ধরে যেখানে লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব নেই (ইলিয়াডে এর একটি ব্যতিক্রম আছে) এবং এখনো সেখানে সাহিত্যের মৌখিক ধারাটাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় হয়, সেখানে গিলগামেশ যে একটি লিখিত সাহিত্য তা বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে বারবার প্রকাশ করা হয়। 

এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মেসোপটেমীয় লিপিকাররা এর উদ্ভবের পেছনের একটা গল্প লিখে রেখেছিলেন। গল্পটার কেন্দ্রবিন্দু উরুক শহর, যা গিলগামেশ মহাকাব্যটিরও মূল পটভূমি। এই ঘটনা আবর্তিত হয় উরুকের এক প্রাচীন রাজা (গিলগামেশের পূর্বসূরি) এনমেরকার ও পাশেই অবস্থিত আরাট্টা নগরের রাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঘিরে। আরাট্টাকে অধীনস্থ করার লক্ষ্যে এনমেরকার তাকে আক্রমণ করার হুমকি দিয়ে একজন দূত পাঠান। আরাট্টার রাজা এতে বিচলিত না হয়ে পাল্টা হুমকি পাঠান। এই আদান-প্রদান কয়েকবার চলে: এনমেরকার চ্যালেঞ্জের জবাব দেন ও আরও হুমকি পাঠান, আরাট্টা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে নতুন চ্যালেঞ্জ পাঠান। অবশেষে, এনমেরকার এতটাই ক্ষিপ্ত হন যে তিনি লম্বা সময় ধরে অত্যন্ত বাগ্মিতার সাথে আরাট্টাকে হুমকি-ধামকি দেন। যে বিশ্বস্ত দূত এতদিন ধরে এই দুই রাজার মধ্যকার বার্তা আদান-প্রদান করছিল সে এই দীর্ঘ ভাষণ শুনে ভয় পেয়ে যায়, কারণ বক্তৃতাটি এত লম্বা যে তার পক্ষে তা মুখস্থ রাখা সম্ভব নয়। এই দিশাহারা অবস্থার মুখে এনমেরকার কিছু মাটি নেন, নিজের বক্তব্য মাটির ওপর লিখে দেন, এবং সেই মাটির ফলকসহ দূতকে আবার আরাট্টায় পাঠান।
দূত যখন হাতে করে এই নতুন যন্ত্রটা নিয়ে আরাট্টায় হাজির হয়, তখন ফলকটি আরাট্টার রাজার ওপর এমন গভীর প্রভাব ফেলে যে অবশেষে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। 

এই কাহিনিতে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, এটি লেখার শক্তিকে তুলে ধরে: একটা ছোট্ট ফলক আক্রমণের হাজারো মৌখিক হুমকির চেয়ে বেশি কার্যকর। (বলা বাহুল্য, এটি লেখার শক্তির ওপর একটা স্বার্থপর বর্ণনা, যা এমন লিপিকাররাই লিখেছেন যারা চাইছিলেন আমরা যেন তাঁদের পেশার গুরুত্ব বুঝি।) দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো—এই কাহিনির লেখার সঙ্গে গল্প বলার কোনো সম্পর্ক নেই। মেসোপটেমিয়ায় লেখার প্রাথমিক ব্যবহার ছিল এনমেরকার ও আরাট্টার কাহিনির মতোই—রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি। লেখাকে ব্যবহার করা হতো নথিপত্র রাখার কাজে, প্রথম দিককার রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র গঠনে, এবং এটি শাসকদের ক্ষমতা দূর-দূরান্তে পৌঁছে দেওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল, যেমনটা আমরা আরাট্টায় দেখলাম। শেষপর্যন্ত, লেখার মাধ্যমেই নগর-রাষ্ট্রগুলো নিজেদেরকে প্রথম ভূখণ্ড-ভিত্তিক সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়।
লেখার আবিষ্কারের কয়েক শত বছর পরেই গিলগামেশ মহাকাব্য-এর প্রাথমিক সংস্করণগুলোর মতো দীর্ঘ লিখিত কাহিনিগুলোর উদ্ভব ঘটে। তবে এই কাহিনিগুলোও আঞ্চলিক সম্প্রসারণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, কিংবা অন্তত এর সুফল ভোগ করেছে। মহাকাব্যের টুকরোগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া যাওয়ার মধ্য দিয়ে এটা আরো স্পষ্ট হয়। 

নগর-রাষ্ট্র ও লেখার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে গিলগামেশ মহাকাব্য কেন শহর ও বনের মধ্যে একটি রেখা টানতে এতটা আগ্রহী। নগর ও জঙ্গলের এই ফারাক, বলতে গেলে, খোদ লিখনপদ্ধতির ইতিহাসেই খোদিত হয়ে আছে। ফলে, যখন আমরা পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে গিলগামেশ মহাকাব্য পড়ি, তখন আমরা এমন একটি প্রকাশভঙ্গির মুখোমুখি হই, যা গভীরভাবে নগরায়নের সাথে জড়িত ও তার অংশীদার। এটাই সেই কারণ, যে কারণে সাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে—সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত—নগরায়ন, বসতি জীবন, শ্রম বিভাজন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ছিল।

আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে, সাহিত্যের সঙ্গে নগরজীবন ও সম্পদ আহরণের যে সংশ্লিষ্টতা আছে, তা আবশ্যিকভাবে খারাপ কিছু নয়। গিলগামেশ মহাকাব্য দেখায় সাহিত্য কোন মাত্রায় বসতি জীবন থেকে উপজাত এবং কিভাবে এটি মানুষের কেমন করে বাস করা উচিত, কী খাওয়া উচিত, কোন কোন সম্পদ ব্যবহার করা উচিত, এবং যদি তারা এমন কোনো অস্তিত্বের মুখোমুখি হয় যারা এই শৃঙ্খলা মানতে নারাজ, তবে তাদের সঙ্গে কী করা উচিত ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়াকে আকার দিয়েছে (শেষোক্ত প্রশ্নের দুঃখজনক উত্তর হলো—তাদের হয় হত্যা করা উচিত, যেমন হাম্বাবার ক্ষেত্রে, নয়তো অন্ধ করে দেওয়া উচিত, যেমন পলিফেমাস, অথবা তাদের ফুসলে বসতি জীবনে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া উচিত, যেমন এনকিদু)।

মেসোপটেমিয়ায় যখন নগরজীবনের একটি উপজাত হিসেবে লিখনপদ্ধতির উদ্ভব হলো এবং নগরভিত্তিক মূল্যবোধগুলো পল্লি অঞ্চলে (যাকে তখন থেকে ‘বনাঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ছড়িয়ে দেয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন থেকে এই প্রযুক্তি অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় ছড়িয়ে পড়ে—যেমন মিশর, আসিরিয়া এবং চীন। এই সব সংস্কৃতির মধ্যেও একটি বিষয় ছিল অভিন্ন—উন্নত কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন, যা নতুন ধরনের শ্রম বিভাজনকে সম্ভব করেছিল এবং যার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি নতুন শ্রেণির মানুষ—লিপিকার—যারা কৃষি-উৎপাদন, বিক্রয় ও রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার হিসাব রাখতে পারবে। এই লিপিকাররাই ছিলেন আদিকালের ‘হোয়াইট-কলার’ হিসাবরক্ষক।

এই প্রাচীন লেখন-সভ্যতাগুলোর আরেকটি মিল ছিল তারা সবাই একই ভূখণ্ডে অবস্থিত: ইউরেশীয় মহাদেশে। একটা সম্ভাবনা আছে, যদিও তা প্রমাণ করা কঠিন, যে উরুক ও আরাট্টার কাহিনিতে যেভাবে লেখার ধারণা বর্ণিত হয়েছে, তা একবারেই উদ্ভাবিত হয়েছিল এবং পরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর ও চীনের মতো অন্যান্য প্রাথমিক লেখন-সভ্যতায়। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এর মানে দাঁড়ায়—আমরা সাহিত্যকে যেভাবে জানি, তা কোনো একক অনুপ্রেরণার ফল।

তবে লেখার একটি দ্বিতীয়, সম্পূর্ণ স্বাধীন উৎস বিদ্যমান, যা মধ্য আমেরিকায় (মেসোআমেরিকা) দেখা যায়। যখন হার্নান কোর্তেস ইউকাটান অঞ্চলে পৌঁছান—যেটি আজকের দক্ষিণ মেক্সিকো—তিনি শুধু কামান ও ইস্পাত নয়, বরং সদ্য মুদ্রিত বাইবেলও সঙ্গে এনেছিলেন; কারণ ইয়োহানেস গুটেনবার্গ সেসময় চীনা ছাপাখানা প্রযুক্তিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন। কোর্তেস এখানে এমন এক সংস্কৃতির মুখোমুখি হন, যা হাজার হাজার বছর ধরে ইউরেশিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল এবং নিজেরাই নিজেদের মত করে লেখার এবং সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল। বৃহৎ পরিসরে সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক ভাবনার সবচেয়ে বিস্ময়কর ফলাফলগুলোর একটা হলো এটা। মায়া সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস এখনো পর্যন্ত অল্প কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই প্রায় সম্পূর্ণ অজানা, যদিও এর বয়স ১৫০০ বছরেরও বেশি।

মায়া সাহিত্য অনন্য হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো এটি বিশ্বের একমাত্র সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সাহিত্যিক ঐতিহ্য। যদিও কোর্তেসের পর স্প্যানিয়ার্ডরা মায়া বইপত্র ধ্বংস করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, তবুও কিছু সাহিত্যকর্ম টিকে যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাকাব্য হলো পোপোল ভুহ
মেসোআমেরিকা যেন সাহিত্যের একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগার—যেখানে দেখা যায় যদি কোনো সমাজ সম্পূর্ণরূপে অপর কোনো শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শ ছাড়াই সাহিত্যের বিকাশ ঘটায়, তবে তার ফলাফল কী হয়। বিস্ময়করভাবে, মায়া অভিজ্ঞতার ফলাফল ইউরেশিয়ার মতোই: পোপোল ভুহ তাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন, এবং বিশেষভাবে এতে ভুট্টাকে সমাজের প্রধান ফসল হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

পোপোল ভুহ-তে মানুষের সৃষ্টির একটি বিবরণ রয়েছে, যা অনেক অন্যান্য মহাকাব্যের তুলনায় বেশি জটিল, কারণ এখানে মানুষ সফলভাবে সৃষ্টি হয় চতুর্থ প্রচেষ্টায়। প্রথম প্রচেষ্টায় মানুষ নয়, বরং বনজ প্রাণীরা সৃষ্টি হয়, যারা কথা বলতে পারে না এবং ফলত তারা তাদের সৃষ্টিকর্তাদের প্রচণ্ডভাবে হতাশ করে। কিন্তু দেবতারা থেমে যান না। তারা আবার চেষ্টা করেন এবং কাদামাটি দিয়ে প্রাণী সৃষ্টি করেন। কিন্তু এদের গড়ন বিকৃত হয়, তারা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না, এবং শেষ পর্যন্ত পানিতে গলে যায়। এই (দ্বিতীয়) পরীক্ষার ব্যর্থতা মেসোপটেমীয় সৃষ্টি-মিথ বা হিব্রু বাইবেলের সৃষ্টিকাহিনির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যেখানে মানুষ সফলভাবে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি হয়। স্পষ্টতই, মায়া সভ্যতার কাছে কাদা বা মাটি অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না—এটা বোঝা যায় কারণ তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও মন্দিরগুলো কাদার ইট দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে তৈরি হতো (এবং এ কারণেই সেগুলোর অনেকগুলো আজও টিকে আছে)।

কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, দেবতারা আরেকটি নমনীয় উপকরণ ব্যবহার করেন: কোরাল গাছের কাঠ। এবার ফলাফল আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়—সাবধানে খোদাই করা প্রাণীগুলো দেখতে এবং কথাবার্তায় মানুষের মতোই হয়। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই বোঝা যায়, এদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের অভাব রয়েছে—তা হলো স্মরণশক্তি ও যুক্তিবোধ। এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, কাঠের তৈরি মানুষরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত এক মহাপ্লাবনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজকের দিনে শুধুমাত্র বাঁদররা সেই (তৃতীয়) ব্যর্থ সৃষ্টিচেষ্টার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থেকে গেছে।

যেন বারবার এই মানুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে, পোপোল ভুহ এবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অন্যদিকে—এবার শুরু হয় দৈব-অর্ধদেবতাদের পাতাললোকে নেমে গিয়ে বিপজ্জনক বল-খেলায় অংশ নেওয়ার গল্প, আর অলক্ষ্মী যমজদের কাহিনি যারা প্রতারণার সাহায্যে তাদের স্বর্গীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারায়।
শুধু মহাকাব্যের দ্বিতীয়-শেষ অংশে এসে আবার সৃষ্টির বিষয়টি উঠে আসে, এবং এবার অবশেষে তা সফল হয়: প্রথম “মা-বাবা”-দের সৃষ্টি হয়—তাদের এভাবে ডাকা হয়—এবং সৌভাগ্যবশত তারা কথা বলতে পারে, তাদের যুক্তিবোধ রয়েছে, এবং তারা টিকে থাকে। তবে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্যটা হলো উপাদানে: এবার দেবতারা ব্যবহার করেন ভুট্টা। মহাকাব্যটিতে তা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:

“তারপর হলুদ ভুট্টা ও সাদা ভুট্টা বেটে নেওয়া হলো, এবং জ্‌মুকানে (Xmucane) তা নয়বার বাটেন। কিছু খাদ্য ব্যবহার করা হলো, সঙ্গে তাঁর হাত ধোয়ার পানি, আর যখন তাতে হাত দিলেন সর্ববাহী, জন্মদাতা, সার্বভৌম পালকযুক্ত সর্প, তখন তা পরিণত হলো মানুষের চর্বিতে। তারপর তারা তা শব্দে প্রকাশ করল:

হলুদ ভুট্টা দিয়ে আমাদের প্রথম মা-বাবার গঠন নির্মাণ,
ও কেবল সাদা ভুট্টা দিয়েই তাদের মাংস,
খাদ্য দিয়েই তৈরি আমাদের প্রথম পিতাদের
মানব শরীরের হাত-পা—চার মানব কর্মের উপাদান।
কেবল প্রধান খাদ্য দিয়েই গঠিত ছিল তাদের দেহ।”

ভুট্টা এক অলৌকিক সৃষ্টির উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। এই উদ্ভিদ সমৃদ্ধ শস্য দেয়, যাকে গুঁড়ো করা যায়—যদিও তা নয়বার করতে হয়—এবং পানির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা যায় মানব দেহ। ভুট্টা অলৌকিক হলেও এটি একই সঙ্গে একেবারে সাধারণ, মায়া কৃষির মূল স্তম্ভ।
এই সৃষ্টিকাহিনিতে উল্লিখিত সাদা ও হলুদ ভুট্টা উভয়ই মায়াদের বৃহৎ শহরগুলিকে খাদ্য জোগাতো, যেমন পালেনকে এবং আরও অনেক পিরামিড-আকৃতির মন্দিরবিশিষ্ট স্থান। সাম্প্রতিক ইনফ্রারেড চিত্রে দেখা গেছে, এই ভুট্টা-ভিত্তিক বসতির নেটওয়ার্ক—শহর, নগর, গ্রাম—আগে যা মনে করা হতো তার থেকেও অনেক বিস্তৃত ছিল। এর মানে হচ্ছে, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনো ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছেন ক্লাসিকাল মায়া সভ্যতার পূর্ণ ব্যাপ্তি, যার অনেকটাই চিয়াপাস ও গুয়াতেমালার ঘন জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

তারপর, হঠাৎ করেই এই পরিপক্ব ও চমৎকার নগরসভ্যতার পতন ঘটে। বৃহত্তম শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়, মন্দিরগুলো ভেঙে পড়ে এবং দ্রুত জঙ্গলের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। জীবন আবার ফিরে যায় অপেক্ষাকৃত অঘন, কম নগরভিত্তিক রূপে, যেখানে বেশিরভাগ মায়ান নাগরিক টিকে থাকে ছোট ছোট গ্রাম ও বসতিতে।

এই দ্রুত পতনের কারণ—যা স্প্যানিশদের আগমনের বহু শতাব্দী আগেই ঘটে—এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো ভুট্টার উৎপাদনের পতন। হয়তো একফসলি চাষ (monoculture) ও অতিরিক্ত চাষাবাদের (overcultivation) কারণে এই পতন ঘটে। পোপোল ভুহ ঠিক গিলগামেশ মহাকাব্যের মতই বসতি জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়, যদিও তা নগরজীবনের পরিবেশগত প্রয়োজনের প্রসঙ্গ অতটা স্পষ্টভাবে তোলে না।

ধসটি মর্মান্তিক হলেও পরিপূর্ণভাবে হয়নি। মায়া সংস্কৃতির সবচেয়ে নগরায়িত পর্যায়ের পরেও যে কটি কীর্তি টিকে ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল তাদের লিপি বা লেখার রীতি, যা স্প্যানিয়ার্ডদের আগমনের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চর্চা করা হতো। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ও আরও গভীর পতনের ধারা—প্রথমে স্প্যানিশ বিজেতাদের প্ররোচিত গৃহযুদ্ধ, পরে তাদের দ্বারা আনা গুটি বসন্ত, এবং অবশেষে ক্রমবর্ধমান স্প্যানিশ বসতি স্থাপন, যা মায়া জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয় এবং যারা বেঁচে ছিল, তাদেরকে বাধ্য করে দাসত্ব ও জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত হতে।

স্প্যানিশরা সাথে করে ফ্রান্সিসকান যাজকদেরও নিয়ে এসেছিল, যারা একদিকে ঔপনিবেশিকতার কিছু চরম নির্যাতনের প্রতিবাদ করতেন, আবার অন্যদিকে মায়াদের খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তরিত করতেও চাইতেন। শুরুতে ফ্রান্সিসকানদের মনে হয়েছিল ধর্মান্তরণ খুব ভালোভাবে কাজ করছে, যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারলেন যে মায়ারা নতুন খ্রিষ্টান দেবতাকে একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেয়নি, বরং কেবল তাদের পুরনো দেবতাদের পাশাপাশি জায়গা দিয়েছে। এই ‘প্রতারণা’ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ফ্রান্সিসকানরা পুরনো দেবতা ও আচার-অনুষ্ঠানকে শিকড়সহ তুলে ফেলতে চাইল।

কিন্তু সেই পুরনো বিশ্বাসগুলোর শিকড় কী ছিল? তা ছিল তথাকথিত ‘কাউন্সিল বুকস’, যেখানে মায়াদের কাহিনিগুলো তাদের নিজস্ব লিপিতে লেখা ছিল—এই লিপিগুলো কিছুটা মিশরীয় হায়ারোগ্লিফের মতো কাজ করত। এগুলো একধরনের কাগজে লেখা হতো, পাতাগুলো অ্যাকর্ডিয়নের মতো ভাঁজ করা থাকত। এমন বই সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না, সেজন্য সেগুলো ছিল অমূল্য এবং পরিবারে পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে রক্ষিত। কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডরা সেগুলো খুঁজে বের করে যতবার পারত, পুড়িয়ে ফেলত। ‘পৌত্তলিক দেবতাদের’ ধ্বংসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফ্রান্সিসকানরা প্রায় সব মায়া গ্রন্থই ধ্বংস করে ফেলেছিল। এমন সময়ে হাতে গোনা কয়েকজন মায়া লিপিকার এক ভয়ংকর সংকটের মুখে পড়েন। তাদের পৃথিবী দখল করে নিয়েছে বিদেশি সৈন্য, মহামারি ও পুরোহিতেরা, এবং তাদের প্রিয় গ্রন্থগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা লক্ষ করলেন তাদের লিপি দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছে। তাহলে কি তাদের লেখালেখির সংস্কৃতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে?

বেঁচে থাকা তিনজন লিপিকার একটি চালাক কিন্তু করুণ সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা তাদের কাহিনি সংরক্ষণ করতে চাইলেন—যেমন মানুষের ভুট্টা থেকে সৃষ্টির গল্প—যাতে ভবিষ্যতের কেউ তা পড়তে পারে। কিন্তু তারা বুঝতে পারলেন সেই ভবিষ্যৎ হয়তো মায়া লিপিতে কেউ পড়তে পারবে না। তাই তারা বিজয়ীদের লিপি, ল্যাটিন অক্ষরে লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এইভাবেই গোপনে লেখা হলো পপোল ভুহ, মায়া লিপি ও গল্প বলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত থাকল। এই তিনজন বেনামি লিপিকার না থাকলে, আজকের দিনে আমরা এই মহৎ ও অনন্য মহাকাব্য, যা তার নিজস্ব কৃষিভিত্তির সাথে গভীরভাবে জড়িত, তা পেতাম না।

লেখন-প্রযুক্তির প্রতিটি নতুন বিপ্লব—যেমন কাগজ, প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট; নতুন লেখার মাধ্যম—ট্যাবলেট, স্ক্রল, বই; এবং পরবর্তীকালে চীনের কাঠখোদাই ছাপা প্রযুক্তি ও গুটেনবার্গের ছাপাখানা—লিখিত ও মৌখিক ভাষার মধ্যকার সম্পর্ককে পুনর্গঠন করেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল



উপরের ইউরেশিয়া থেকে আমেরিকা পর্যন্ত লেখার ইতিহাসের যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তার বিপরীত পাশে রয়েছে মৌখিক ধারার (orality) অব্যাহত প্রাধান্য। লেখার প্রসারকে এমনভাবে কল্পনা করা ভুল হবে যে এটি ধীরে ধীরে মৌখিকতাকে প্রতিস্থাপন করেছে। বরং, লেখন-প্রযুক্তির প্রতিটি নতুন বিপ্লব—যেমন কাগজ, প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট; নতুন লেখার মাধ্যম—ট্যাবলেট, স্ক্রল, বই; এবং পরবর্তীকালে চীনের কাঠখোদাই ছাপা প্রযুক্তি ও গুটেনবার্গের ছাপাখানা—লিখিত ও মৌখিক ভাষার মধ্যকার সম্পর্ককে পুনর্গঠন করেছে। লিখিত ও মৌখিক ধারা যেন এক দ্বিমুখী সমীকরণ: একটি উপাদান বদলালে অপরটিও বদলায়।

লিখিত ধারা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মৌখিক ধারার স্থায়ী শক্তির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পশ্চিম আফ্রিকার সুন্জাতা মহাকাব্য। এই মহাকাব্য মধ্যযুগের শেষভাগে বিদ্যমান একটি সাম্রাজ্যের কথা বলে, যা বর্তমান মালির অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এবং যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজা সুন্জাতা।

তাঁর কাহিনির আরম্ভ শুভ হয় না, কারণ তিনি জন্মগ্রহণ করেন গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে—সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না। এক প্রতিদ্বন্দ্বীর অভিশাপের ফলে তার এই অবস্থা হয়। যখন তিনি নিজের শক্তি জুগিয়ে এই অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন, তখন তার মা তাকে নির্বাসনে নিয়ে যান, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল। এভাবে শুরু হয় দীর্ঘ নির্বাসনের জীবন, যেখানে তরুণ সুন্জাতা ও তার মা উদ্বাস্তু জীবন যাপন করেন—নিজভূমি থেকে বিতাড়িত, বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর, কখনো দয়ার পাত্র, কখনো নিপীড়নের শিকার—সবসময়ই অপরিচিতদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। অনেক বছরের নির্বাসনের পর একসময় তাকে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন তার দেশ যুদ্ধে জর্জরিত ও দুর্বল। নিজ দেশে মর্যাদার আসনে বসার আগে তাকে একের পর এক যুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।

সুন্জাতা মহাকাব্য কোনো বসতি জীবনের গৌরবগাথা নয়, বরং এর বিপরীত—ঘরহারা থাকার যন্ত্রণা নিয়ে রচিত। এই অর্থে এটি গিলগামেশ মহাকাব্যের চেয়ে অডিসি-র সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ, যদিও গিলগামেশ-এও একটি অংশ আছে যেখানে শোকাতুর গিলগামেশ হতাশায় পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফলে, সুন্জাতা মহাকাব্যে বসতিভিত্তিক নগরজীবনের কৃষিকেন্দ্রিক ভিতের ওপর তেমন জোর নেই।

তবে কখনো কখনো কৃষি নেপথ্য থেকে উঠে আসে, যেমনটি হোমারের কাব্যেও দেখা যায়। একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে, স্বদেশ থেকে আসা দূতেরা নির্বাসিত সুন্জাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে, যিনি তখন তার ছোট্ট সঙ্গীসমেত লুকিয়ে রয়েছেন (তার মা ইতিমধ্যে মারা গেছেন)। নির্বাসিতরা স্বদেশের খাবারের জন্য আকুল, বিশেষ করে দাদো, অর্থাৎ শুকনো হিবিস্কাস ফুল, যা এক বিশেষ ধরনের সসে মসলার মতো ব্যবহার করা হয়। স্বদেশ থেকে আসা দুই দূত কিছু দাদো বাজারে বিক্রির জন্য এনেছে। নির্বাসিতরা দাদো দেখে এতটাই লোভে পড়ে যে একদম বাজারের ভিড়ের মধ্যেই তা কোনো দরদাম ছাড়াই নিয়ে নেয়। এই সুস্পষ্ট লক্ষণের ভিত্তিতে দূতেরা বুঝে ফেলে তারা সুন্জাতার দলের লোক। কারণ দাদো এই অঞ্চলে, নির্বাসনে, উৎপাদিত হয় না, নির্দিষ্টভাবে তা স্বদেশের জিনিস। 

সুন্জাতা ও তাঁর সাম্রাজ্যের কাহিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়েছে—এমনকি আরব পণ্ডিতেরা ইসলাম এবং তার লেখন-সংস্কৃতি আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে আসার পরেও। মহাকাব্যটি কিছুটা ইসলামি রূপ লাভ করে, ইসলাম ও ইসলামি পাণ্ডিত্যের ছোঁয়া এতে উঠে আসে, তবু প্রাক-ইসলামি উপাদানগুলোর অনেকটাই অক্ষত থাকে।

উনিশ শতকে ফরাসি ঔপনিবেশিকরা যখন আসে, তারা নিজেদের বর্ণমালা ও লেখার সংস্কৃতি নিয়ে আসে। তবুও মহাকাব্যটি ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র, প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি তখনও মৌখিকভাবে চলতে থাকে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে ধাপে ধাপে লেখ্যরূপ পায় এই মহাকাব্য। প্রথমে একে পাঁচ অঙ্কের নাটক হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় (ফরাসি নাটকের ছাঁচে), পরে এটিকে উপন্যাসে রূপান্তর করার ভাবনা আসে (ফরাসি মধ্য-শতকের উপন্যাসের ছাঁচে)। কিন্তু এই সব ধাঁচ কোনোটাই ভালোমত কাজ করে না—কারণ এই কাব্যিক বহু প্রজন্মের কথক দ্বারা গঠিত, যাদের সৃষ্টির ধরণ ভিন্ন। ফলে সুন্জাতা মহাকাব্য আজও মৌখিকভাবে আবৃত্ত হয়।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ডেভিড সি. কনরাডের সঙ্গে কাজ করার, যিনি ম্যান্ডে গায়ক তাসে কন্ডের সঙ্গে এই মহাকাব্যের একটি অনন্য লিখিত সংস্করণ নির্মাণে সহযোগিতা করেন । এটি ১৯৯৪ সালের সরাসরি মঞ্চায়ন থেকে রেকর্ড করা হয়েছিল, যেটিকে কনরাড ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং বিশ ও একবিংশ শতকে লিখিত মহাকাব্যে রূপান্তর করেন—যা আমি মনে করি, এ পর্যন্ত মহাকাব্যটির সেরা লিখিত রূপ।

এই লিখিত ও মৌখিক ধারার চলমান পারস্পরিক সম্পর্ক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে লেখার প্রসার খুব সহজেই মৌখিক ঐতিহ্যকে অপ্রাসঙ্গিক বা অবহেলিত করে তোলে, অথচ লেখ্যতা ও মৌখিকতা—এই দুইকে একসঙ্গে একটি সমন্বিত কাঠামোর অংশ হিসেবে বোঝা উচিত। মৌখিক জ্ঞানের পুনরুদ্ধারে এখনো বহু কাজ বাকি রয়েছে যেগুলো প্রায়শই প্রচলিত লেখ্য সংস্কৃতির কেন্দ্রের বাইরে। বিশেষত তা দেশীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে (অবশ্য এদের মধ্যেও ছাপা সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে)।

সৌভাগ্যবশত, পরিবেশ-সমালোচনা (ecocriticism) ও নৃবিজ্ঞান (anthropology) এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে স্মৃতি ও গল্প বলার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছে। এর সাহায্যে অতীতের পরিবেশগত সংকটগুলোকেও পুনর্গঠন করা সম্ভব, যেগুলোর প্রভাব মৌখিক গল্প-ঐতিহ্যে রয়ে যায়—যেমন পশ্চিম আমেরিকায় দেখা যায়।

লেখার ইতিহাস নিয়ে ভাবার মাধ্যমে আমরা সাহিত্যের সাথে বসতি জীবন ও সম্পদ আহরণের সম্পর্ক মূল্যায়ন করার ভিত্তি নির্মাণ করতে পারব। একইসাথে এর মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় সাহিত্য একটি সাংস্কৃতিক কৌশল হিসেবে ঠিক কতদূর অব্দি জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এই ধরণের ইতিহাসের উদ্দেশ্য গত চার হাজার বছর ধরে লেখা সাহিত্যকে খারিজ করা নয়, বরং উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সাহিত্যপাঠের একটি উপযুক্ত পদ্ধতি হাজির করা, আরো ভালো করে বোঝা যে ঠিক কোন ধরণের গল্পকথনের ঐতিহ্য আজ আমাদের এই সঙ্কটাবস্থায় নিয়ে এসেছে। পরিবেশ-সচেতনভাবে সাহিত্য পাঠ করার ফলে আমরা এই চার হাজার বছরের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারব। এর মাধ্যমে হয়তো আমরা পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে পারব। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।