সাহিত্যপাঠকে সম্পদ-আহরণকারী জীবনের দলিল হিসেবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আমি যে পরিবেশ-সচেতন পাঠচিন্তার রূপরেখা দিতে চাইছি, এটা তার একটামাত্র দিক। কারণ সাহিত্য কেবল আমাদের যৌথসিদ্ধান্তগুলোর নথি নয়; সাহিত্য নিজেও সেই সিদ্ধান্তগুলো থেকেই জন্মায়। অন্যভাবে বললে, সাহিত্য কোনো নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক নয়, নিজেও গভীরভাবে জড়িত এক অংশগ্রহণকারী।
সাহিত্য কতটা গভীরভাবে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর জীবনের সঙ্গে জড়িত তা বোঝানোর সবচেয়ে ভালো উপায় হলো এর প্রযুক্তিগত মাত্রার দিকে নজর দেওয়া, অর্থাৎ লেখার ইতিহাসে। এই ধরনের বিশ্লেষণ শুরু করতে সবচেয়ে উপযুক্ত পাঠ্য হলো গিলগামেশ মহাকাব্য। এটা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয় যে এই পাঠ্যটি একদিকে যেমন সম্পদ আহরণের একটি মহান দলিল, তেমনি এটি লিখিত সাহিত্যের বিকাশেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দুইটি দিক একে অপরের সঙ্গে পদ্ধতির দিক দিয়ে গভীরভাবে যুক্ত।
বিশ্বের প্রথম পূর্ণাঙ্গ লেখন-পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছিল মেসোপটেমিয়ার প্রাচীনতম নগরসভ্যতাগুলিতে। গিলগামেশ মহাকাব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সেই সভ্যতা নির্মিত হয়েছিল মাটিপোড়ানো ইট দিয়ে। এই চমৎকার নির্মাণপদ্ধতিই ছিল মেসোপটমীয় নগর-সভ্যতার ভিত্তি। তবে মাটি কেবল ইট, দেয়াল, ঘরবাড়ি বানানোর জন্যই উপযুক্ত ছিল না। আপনি যদি এনকিদুর মত একজন মেসোপটমীয় ঈশ্বর হতেন, তাহলে মাটি লেখালেখির কাজেও আসতো। কিউনিফর্ম লেখন-পদ্ধতির জন্য প্রয়োজন হতো আর্দ্র মাটি, যার ওপর ত্রিমাত্রিক খোদাই করা যেত, পরে এই মাটির ফলকগুলোকে রোদে শুকিয়ে অথবা আরও টেকসই করতে চুল্লিতে পুড়িয়ে শক্ত করা হতো।
গিলগামেশ মহাকাব্যে যতটা গর্বের সঙ্গে উরুকের নগরকাঠামোর কথা বলা আছে, ঠিক ততটাই গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করা আছে কাদার ওপর শব্দ বসিয়ে লেখার শিল্পটির কথা। এমনকি এতে খুব গর্বের সঙ্গে বলা হয় যে গিলগামেশ নিজেই লেখার কৌশল জানতো। হোমারের মহাকাব্যগুলো যেখানে এমন এক জগৎকে তুলে ধরে যেখানে লিখিত সাহিত্যের অস্তিত্ব নেই (ইলিয়াডে এর একটি ব্যতিক্রম আছে) এবং এখনো সেখানে সাহিত্যের মৌখিক ধারাটাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় হয়, সেখানে গিলগামেশ যে একটি লিখিত সাহিত্য তা বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে বারবার প্রকাশ করা হয়।
এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মেসোপটেমীয় লিপিকাররা এর উদ্ভবের পেছনের একটা গল্প লিখে রেখেছিলেন। গল্পটার কেন্দ্রবিন্দু উরুক শহর, যা গিলগামেশ মহাকাব্যটিরও মূল পটভূমি। এই ঘটনা আবর্তিত হয় উরুকের এক প্রাচীন রাজা (গিলগামেশের পূর্বসূরি) এনমেরকার ও পাশেই অবস্থিত আরাট্টা নগরের রাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ঘিরে। আরাট্টাকে অধীনস্থ করার লক্ষ্যে এনমেরকার তাকে আক্রমণ করার হুমকি দিয়ে একজন দূত পাঠান। আরাট্টার রাজা এতে বিচলিত না হয়ে পাল্টা হুমকি পাঠান। এই আদান-প্রদান কয়েকবার চলে: এনমেরকার চ্যালেঞ্জের জবাব দেন ও আরও হুমকি পাঠান, আরাট্টা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে নতুন চ্যালেঞ্জ পাঠান। অবশেষে, এনমেরকার এতটাই ক্ষিপ্ত হন যে তিনি লম্বা সময় ধরে অত্যন্ত বাগ্মিতার সাথে আরাট্টাকে হুমকি-ধামকি দেন। যে বিশ্বস্ত দূত এতদিন ধরে এই দুই রাজার মধ্যকার বার্তা আদান-প্রদান করছিল সে এই দীর্ঘ ভাষণ শুনে ভয় পেয়ে যায়, কারণ বক্তৃতাটি এত লম্বা যে তার পক্ষে তা মুখস্থ রাখা সম্ভব নয়। এই দিশাহারা অবস্থার মুখে এনমেরকার কিছু মাটি নেন, নিজের বক্তব্য মাটির ওপর লিখে দেন, এবং সেই মাটির ফলকসহ দূতকে আবার আরাট্টায় পাঠান।
দূত যখন হাতে করে এই নতুন যন্ত্রটা নিয়ে আরাট্টায় হাজির হয়, তখন ফলকটি আরাট্টার রাজার ওপর এমন গভীর প্রভাব ফেলে যে অবশেষে তিনি আত্মসমর্পণ করেন।
এই কাহিনিতে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, এটি লেখার শক্তিকে তুলে ধরে: একটা ছোট্ট ফলক আক্রমণের হাজারো মৌখিক হুমকির চেয়ে বেশি কার্যকর। (বলা বাহুল্য, এটি লেখার শক্তির ওপর একটা স্বার্থপর বর্ণনা, যা এমন লিপিকাররাই লিখেছেন যারা চাইছিলেন আমরা যেন তাঁদের পেশার গুরুত্ব বুঝি।) দ্বিতীয় যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো—এই কাহিনির লেখার সঙ্গে গল্প বলার কোনো সম্পর্ক নেই। মেসোপটেমিয়ায় লেখার প্রাথমিক ব্যবহার ছিল এনমেরকার ও আরাট্টার কাহিনির মতোই—রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি। লেখাকে ব্যবহার করা হতো নথিপত্র রাখার কাজে, প্রথম দিককার রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র গঠনে, এবং এটি শাসকদের ক্ষমতা দূর-দূরান্তে পৌঁছে দেওয়ার পথ তৈরি করে দিয়েছিল, যেমনটা আমরা আরাট্টায় দেখলাম। শেষপর্যন্ত, লেখার মাধ্যমেই নগর-রাষ্ট্রগুলো নিজেদেরকে প্রথম ভূখণ্ড-ভিত্তিক সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়।
লেখার আবিষ্কারের কয়েক শত বছর পরেই গিলগামেশ মহাকাব্য-এর প্রাথমিক সংস্করণগুলোর মতো দীর্ঘ লিখিত কাহিনিগুলোর উদ্ভব ঘটে। তবে এই কাহিনিগুলোও আঞ্চলিক সম্প্রসারণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, কিংবা অন্তত এর সুফল ভোগ করেছে। মহাকাব্যের টুকরোগুলো মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পাওয়া যাওয়ার মধ্য দিয়ে এটা আরো স্পষ্ট হয়।
নগর-রাষ্ট্র ও লেখার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে গিলগামেশ মহাকাব্য কেন শহর ও বনের মধ্যে একটি রেখা টানতে এতটা আগ্রহী। নগর ও জঙ্গলের এই ফারাক, বলতে গেলে, খোদ লিখনপদ্ধতির ইতিহাসেই খোদিত হয়ে আছে। ফলে, যখন আমরা পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে গিলগামেশ মহাকাব্য পড়ি, তখন আমরা এমন একটি প্রকাশভঙ্গির মুখোমুখি হই, যা গভীরভাবে নগরায়নের সাথে জড়িত ও তার অংশীদার। এটাই সেই কারণ, যে কারণে সাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে—সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত—নগরায়ন, বসতি জীবন, শ্রম বিভাজন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে ছিল।
আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে, সাহিত্যের সঙ্গে নগরজীবন ও সম্পদ আহরণের যে সংশ্লিষ্টতা আছে, তা আবশ্যিকভাবে খারাপ কিছু নয়। গিলগামেশ মহাকাব্য দেখায় সাহিত্য কোন মাত্রায় বসতি জীবন থেকে উপজাত এবং কিভাবে এটি মানুষের কেমন করে বাস করা উচিত, কী খাওয়া উচিত, কোন কোন সম্পদ ব্যবহার করা উচিত, এবং যদি তারা এমন কোনো অস্তিত্বের মুখোমুখি হয় যারা এই শৃঙ্খলা মানতে নারাজ, তবে তাদের সঙ্গে কী করা উচিত ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের বোঝাপড়াকে আকার দিয়েছে (শেষোক্ত প্রশ্নের দুঃখজনক উত্তর হলো—তাদের হয় হত্যা করা উচিত, যেমন হাম্বাবার ক্ষেত্রে, নয়তো অন্ধ করে দেওয়া উচিত, যেমন পলিফেমাস, অথবা তাদের ফুসলে বসতি জীবনে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া উচিত, যেমন এনকিদু)।
মেসোপটেমিয়ায় যখন নগরজীবনের একটি উপজাত হিসেবে লিখনপদ্ধতির উদ্ভব হলো এবং নগরভিত্তিক মূল্যবোধগুলো পল্লি অঞ্চলে (যাকে তখন থেকে ‘বনাঞ্চল’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়) ছড়িয়ে দেয়ার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন থেকে এই প্রযুক্তি অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় ছড়িয়ে পড়ে—যেমন মিশর, আসিরিয়া এবং চীন। এই সব সংস্কৃতির মধ্যেও একটি বিষয় ছিল অভিন্ন—উন্নত কৃষিভিত্তিক জীবনযাপন, যা নতুন ধরনের শ্রম বিভাজনকে সম্ভব করেছিল এবং যার জন্য প্রয়োজন হয়েছিল একটি নতুন শ্রেণির মানুষ—লিপিকার—যারা কৃষি-উৎপাদন, বিক্রয় ও রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার হিসাব রাখতে পারবে। এই লিপিকাররাই ছিলেন আদিকালের ‘হোয়াইট-কলার’ হিসাবরক্ষক।
এই প্রাচীন লেখন-সভ্যতাগুলোর আরেকটি মিল ছিল তারা সবাই একই ভূখণ্ডে অবস্থিত: ইউরেশীয় মহাদেশে। একটা সম্ভাবনা আছে, যদিও তা প্রমাণ করা কঠিন, যে উরুক ও আরাট্টার কাহিনিতে যেভাবে লেখার ধারণা বর্ণিত হয়েছে, তা একবারেই উদ্ভাবিত হয়েছিল এবং পরে তা ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর ও চীনের মতো অন্যান্য প্রাথমিক লেখন-সভ্যতায়। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তবে এর মানে দাঁড়ায়—আমরা সাহিত্যকে যেভাবে জানি, তা কোনো একক অনুপ্রেরণার ফল।
তবে লেখার একটি দ্বিতীয়, সম্পূর্ণ স্বাধীন উৎস বিদ্যমান, যা মধ্য আমেরিকায় (মেসোআমেরিকা) দেখা যায়। যখন হার্নান কোর্তেস ইউকাটান অঞ্চলে পৌঁছান—যেটি আজকের দক্ষিণ মেক্সিকো—তিনি শুধু কামান ও ইস্পাত নয়, বরং সদ্য মুদ্রিত বাইবেলও সঙ্গে এনেছিলেন; কারণ ইয়োহানেস গুটেনবার্গ সেসময় চীনা ছাপাখানা প্রযুক্তিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছিলেন। কোর্তেস এখানে এমন এক সংস্কৃতির মুখোমুখি হন, যা হাজার হাজার বছর ধরে ইউরেশিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল এবং নিজেরাই নিজেদের মত করে লেখার এবং সাহিত্যের জন্ম দিয়েছিল। বৃহৎ পরিসরে সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক ভাবনার সবচেয়ে বিস্ময়কর ফলাফলগুলোর একটা হলো এটা। মায়া সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাস এখনো পর্যন্ত অল্প কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়া বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই প্রায় সম্পূর্ণ অজানা, যদিও এর বয়স ১৫০০ বছরেরও বেশি।
মায়া সাহিত্য অনন্য হওয়ার একটি প্রধান কারণ হলো এটি বিশ্বের একমাত্র সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সাহিত্যিক ঐতিহ্য। যদিও কোর্তেসের পর স্প্যানিয়ার্ডরা মায়া বইপত্র ধ্বংস করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল, তবুও কিছু সাহিত্যকর্ম টিকে যায়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মহাকাব্য হলো পোপোল ভুহ।
মেসোআমেরিকা যেন সাহিত্যের একটি নিয়ন্ত্রিত পরীক্ষাগার—যেখানে দেখা যায় যদি কোনো সমাজ সম্পূর্ণরূপে অপর কোনো শিক্ষা-সংস্কৃতির সংস্পর্শ ছাড়াই সাহিত্যের বিকাশ ঘটায়, তবে তার ফলাফল কী হয়। বিস্ময়করভাবে, মায়া অভিজ্ঞতার ফলাফল ইউরেশিয়ার মতোই: পোপোল ভুহ তাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের ব্যাপারে গভীরভাবে সচেতন, এবং বিশেষভাবে এতে ভুট্টাকে সমাজের প্রধান ফসল হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
পোপোল ভুহ-তে মানুষের সৃষ্টির একটি বিবরণ রয়েছে, যা অনেক অন্যান্য মহাকাব্যের তুলনায় বেশি জটিল, কারণ এখানে মানুষ সফলভাবে সৃষ্টি হয় চতুর্থ প্রচেষ্টায়। প্রথম প্রচেষ্টায় মানুষ নয়, বরং বনজ প্রাণীরা সৃষ্টি হয়, যারা কথা বলতে পারে না এবং ফলত তারা তাদের সৃষ্টিকর্তাদের প্রচণ্ডভাবে হতাশ করে। কিন্তু দেবতারা থেমে যান না। তারা আবার চেষ্টা করেন এবং কাদামাটি দিয়ে প্রাণী সৃষ্টি করেন। কিন্তু এদের গড়ন বিকৃত হয়, তারা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে না, এবং শেষ পর্যন্ত পানিতে গলে যায়। এই (দ্বিতীয়) পরীক্ষার ব্যর্থতা মেসোপটেমীয় সৃষ্টি-মিথ বা হিব্রু বাইবেলের সৃষ্টিকাহিনির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, যেখানে মানুষ সফলভাবে কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টি হয়। স্পষ্টতই, মায়া সভ্যতার কাছে কাদা বা মাটি অতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না—এটা বোঝা যায় কারণ তাদের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও মন্দিরগুলো কাদার ইট দিয়ে নয়, পাথর দিয়ে তৈরি হতো (এবং এ কারণেই সেগুলোর অনেকগুলো আজও টিকে আছে)।
কাদামাটি দিয়ে সৃষ্টির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর, দেবতারা আরেকটি নমনীয় উপকরণ ব্যবহার করেন: কোরাল গাছের কাঠ। এবার ফলাফল আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়—সাবধানে খোদাই করা প্রাণীগুলো দেখতে এবং কথাবার্তায় মানুষের মতোই হয়। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যেই বোঝা যায়, এদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ গুণের অভাব রয়েছে—তা হলো স্মরণশক্তি ও যুক্তিবোধ। এই দুর্বলতা সত্ত্বেও, কাঠের তৈরি মানুষরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত এক মহাপ্লাবনের মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজকের দিনে শুধুমাত্র বাঁদররা সেই (তৃতীয়) ব্যর্থ সৃষ্টিচেষ্টার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে থেকে গেছে।
যেন বারবার এই মানুষ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে, পোপোল ভুহ এবার দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অন্যদিকে—এবার শুরু হয় দৈব-অর্ধদেবতাদের পাতাললোকে নেমে গিয়ে বিপজ্জনক বল-খেলায় অংশ নেওয়ার গল্প, আর অলক্ষ্মী যমজদের কাহিনি যারা প্রতারণার সাহায্যে তাদের স্বর্গীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারায়।
শুধু মহাকাব্যের দ্বিতীয়-শেষ অংশে এসে আবার সৃষ্টির বিষয়টি উঠে আসে, এবং এবার অবশেষে তা সফল হয়: প্রথম “মা-বাবা”-দের সৃষ্টি হয়—তাদের এভাবে ডাকা হয়—এবং সৌভাগ্যবশত তারা কথা বলতে পারে, তাদের যুক্তিবোধ রয়েছে, এবং তারা টিকে থাকে। তবে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্যটা হলো উপাদানে: এবার দেবতারা ব্যবহার করেন ভুট্টা। মহাকাব্যটিতে তা এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
“তারপর হলুদ ভুট্টা ও সাদা ভুট্টা বেটে নেওয়া হলো, এবং জ্মুকানে (Xmucane) তা নয়বার বাটেন। কিছু খাদ্য ব্যবহার করা হলো, সঙ্গে তাঁর হাত ধোয়ার পানি, আর যখন তাতে হাত দিলেন সর্ববাহী, জন্মদাতা, সার্বভৌম পালকযুক্ত সর্প, তখন তা পরিণত হলো মানুষের চর্বিতে। তারপর তারা তা শব্দে প্রকাশ করল:
হলুদ ভুট্টা দিয়ে আমাদের প্রথম মা-বাবার গঠন নির্মাণ,
ও কেবল সাদা ভুট্টা দিয়েই তাদের মাংস,
খাদ্য দিয়েই তৈরি আমাদের প্রথম পিতাদের
মানব শরীরের হাত-পা—চার মানব কর্মের উপাদান।
কেবল প্রধান খাদ্য দিয়েই গঠিত ছিল তাদের দেহ।”
ভুট্টা এক অলৌকিক সৃষ্টির উপকরণ হয়ে দাঁড়ায়। এই উদ্ভিদ সমৃদ্ধ শস্য দেয়, যাকে গুঁড়ো করা যায়—যদিও তা নয়বার করতে হয়—এবং পানির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা যায় মানব দেহ। ভুট্টা অলৌকিক হলেও এটি একই সঙ্গে একেবারে সাধারণ, মায়া কৃষির মূল স্তম্ভ।
এই সৃষ্টিকাহিনিতে উল্লিখিত সাদা ও হলুদ ভুট্টা উভয়ই মায়াদের বৃহৎ শহরগুলিকে খাদ্য জোগাতো, যেমন পালেনকে এবং আরও অনেক পিরামিড-আকৃতির মন্দিরবিশিষ্ট স্থান। সাম্প্রতিক ইনফ্রারেড চিত্রে দেখা গেছে, এই ভুট্টা-ভিত্তিক বসতির নেটওয়ার্ক—শহর, নগর, গ্রাম—আগে যা মনে করা হতো তার থেকেও অনেক বিস্তৃত ছিল। এর মানে হচ্ছে, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এখনো ধীরে ধীরে আবিষ্কার করছেন ক্লাসিকাল মায়া সভ্যতার পূর্ণ ব্যাপ্তি, যার অনেকটাই চিয়াপাস ও গুয়াতেমালার ঘন জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে।
তারপর, হঠাৎ করেই এই পরিপক্ব ও চমৎকার নগরসভ্যতার পতন ঘটে। বৃহত্তম শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়, মন্দিরগুলো ভেঙে পড়ে এবং দ্রুত জঙ্গলের দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। জীবন আবার ফিরে যায় অপেক্ষাকৃত অঘন, কম নগরভিত্তিক রূপে, যেখানে বেশিরভাগ মায়ান নাগরিক টিকে থাকে ছোট ছোট গ্রাম ও বসতিতে।
এই দ্রুত পতনের কারণ—যা স্প্যানিশদের আগমনের বহু শতাব্দী আগেই ঘটে—এখনো পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, তবে একটি সম্ভাব্য কারণ হলো ভুট্টার উৎপাদনের পতন। হয়তো একফসলি চাষ (monoculture) ও অতিরিক্ত চাষাবাদের (overcultivation) কারণে এই পতন ঘটে। পোপোল ভুহ ঠিক গিলগামেশ মহাকাব্যের মতই বসতি জীবনের পক্ষে দাঁড়ায়, যদিও তা নগরজীবনের পরিবেশগত প্রয়োজনের প্রসঙ্গ অতটা স্পষ্টভাবে তোলে না।
ধসটি মর্মান্তিক হলেও পরিপূর্ণভাবে হয়নি। মায়া সংস্কৃতির সবচেয়ে নগরায়িত পর্যায়ের পরেও যে কটি কীর্তি টিকে ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল তাদের লিপি বা লেখার রীতি, যা স্প্যানিয়ার্ডদের আগমনের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে চর্চা করা হতো। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় ও আরও গভীর পতনের ধারা—প্রথমে স্প্যানিশ বিজেতাদের প্ররোচিত গৃহযুদ্ধ, পরে তাদের দ্বারা আনা গুটি বসন্ত, এবং অবশেষে ক্রমবর্ধমান স্প্যানিশ বসতি স্থাপন, যা মায়া জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেয় এবং যারা বেঁচে ছিল, তাদেরকে বাধ্য করে দাসত্ব ও জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত হতে।
স্প্যানিশরা সাথে করে ফ্রান্সিসকান যাজকদেরও নিয়ে এসেছিল, যারা একদিকে ঔপনিবেশিকতার কিছু চরম নির্যাতনের প্রতিবাদ করতেন, আবার অন্যদিকে মায়াদের খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তরিত করতেও চাইতেন। শুরুতে ফ্রান্সিসকানদের মনে হয়েছিল ধর্মান্তরণ খুব ভালোভাবে কাজ করছে, যতক্ষণ না তারা বুঝতে পারলেন যে মায়ারা নতুন খ্রিষ্টান দেবতাকে একমাত্র ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেয়নি, বরং কেবল তাদের পুরনো দেবতাদের পাশাপাশি জায়গা দিয়েছে। এই ‘প্রতারণা’ দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ফ্রান্সিসকানরা পুরনো দেবতা ও আচার-অনুষ্ঠানকে শিকড়সহ তুলে ফেলতে চাইল।
কিন্তু সেই পুরনো বিশ্বাসগুলোর শিকড় কী ছিল? তা ছিল তথাকথিত ‘কাউন্সিল বুকস’, যেখানে মায়াদের কাহিনিগুলো তাদের নিজস্ব লিপিতে লেখা ছিল—এই লিপিগুলো কিছুটা মিশরীয় হায়ারোগ্লিফের মতো কাজ করত। এগুলো একধরনের কাগজে লেখা হতো, পাতাগুলো অ্যাকর্ডিয়নের মতো ভাঁজ করা থাকত। এমন বই সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না, সেজন্য সেগুলো ছিল অমূল্য এবং পরিবারে পরিবারে উত্তরাধিকার সূত্রে রক্ষিত। কিন্তু স্প্যানিয়ার্ডরা সেগুলো খুঁজে বের করে যতবার পারত, পুড়িয়ে ফেলত। ‘পৌত্তলিক দেবতাদের’ ধ্বংসে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফ্রান্সিসকানরা প্রায় সব মায়া গ্রন্থই ধ্বংস করে ফেলেছিল। এমন সময়ে হাতে গোনা কয়েকজন মায়া লিপিকার এক ভয়ংকর সংকটের মুখে পড়েন। তাদের পৃথিবী দখল করে নিয়েছে বিদেশি সৈন্য, মহামারি ও পুরোহিতেরা, এবং তাদের প্রিয় গ্রন্থগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তারা লক্ষ করলেন তাদের লিপি দ্রুত বিস্মৃত হচ্ছে। তাহলে কি তাদের লেখালেখির সংস্কৃতি পুরোপুরি বিলুপ্ত হবে?
বেঁচে থাকা তিনজন লিপিকার একটি চালাক কিন্তু করুণ সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা তাদের কাহিনি সংরক্ষণ করতে চাইলেন—যেমন মানুষের ভুট্টা থেকে সৃষ্টির গল্প—যাতে ভবিষ্যতের কেউ তা পড়তে পারে। কিন্তু তারা বুঝতে পারলেন সেই ভবিষ্যৎ হয়তো মায়া লিপিতে কেউ পড়তে পারবে না। তাই তারা বিজয়ীদের লিপি, ল্যাটিন অক্ষরে লিখে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। এইভাবেই গোপনে লেখা হলো পপোল ভুহ, মায়া লিপি ও গল্প বলার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত থাকল। এই তিনজন বেনামি লিপিকার না থাকলে, আজকের দিনে আমরা এই মহৎ ও অনন্য মহাকাব্য, যা তার নিজস্ব কৃষিভিত্তির সাথে গভীরভাবে জড়িত, তা পেতাম না।

উপরের ইউরেশিয়া থেকে আমেরিকা পর্যন্ত লেখার ইতিহাসের যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তার বিপরীত পাশে রয়েছে মৌখিক ধারার (orality) অব্যাহত প্রাধান্য। লেখার প্রসারকে এমনভাবে কল্পনা করা ভুল হবে যে এটি ধীরে ধীরে মৌখিকতাকে প্রতিস্থাপন করেছে। বরং, লেখন-প্রযুক্তির প্রতিটি নতুন বিপ্লব—যেমন কাগজ, প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট; নতুন লেখার মাধ্যম—ট্যাবলেট, স্ক্রল, বই; এবং পরবর্তীকালে চীনের কাঠখোদাই ছাপা প্রযুক্তি ও গুটেনবার্গের ছাপাখানা—লিখিত ও মৌখিক ভাষার মধ্যকার সম্পর্ককে পুনর্গঠন করেছে। লিখিত ও মৌখিক ধারা যেন এক দ্বিমুখী সমীকরণ: একটি উপাদান বদলালে অপরটিও বদলায়।
লিখিত ধারা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মৌখিক ধারার স্থায়ী শক্তির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো পশ্চিম আফ্রিকার সুন্জাতা মহাকাব্য। এই মহাকাব্য মধ্যযুগের শেষভাগে বিদ্যমান একটি সাম্রাজ্যের কথা বলে, যা বর্তমান মালির অঞ্চলে অবস্থিত ছিল এবং যার নেতৃত্বে ছিলেন রাজা সুন্জাতা।
তাঁর কাহিনির আরম্ভ শুভ হয় না, কারণ তিনি জন্মগ্রহণ করেন গুরুতর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে—সোজা হয়ে হাঁটতেও পারেন না। এক প্রতিদ্বন্দ্বীর অভিশাপের ফলে তার এই অবস্থা হয়। যখন তিনি নিজের শক্তি জুগিয়ে এই অভিশাপ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হন, তখন তার মা তাকে নির্বাসনে নিয়ে যান, কারণ প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল। এভাবে শুরু হয় দীর্ঘ নির্বাসনের জীবন, যেখানে তরুণ সুন্জাতা ও তার মা উদ্বাস্তু জীবন যাপন করেন—নিজভূমি থেকে বিতাড়িত, বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়ানো যাযাবর, কখনো দয়ার পাত্র, কখনো নিপীড়নের শিকার—সবসময়ই অপরিচিতদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। অনেক বছরের নির্বাসনের পর একসময় তাকে ফিরিয়ে আনা হয়, তখন তার দেশ যুদ্ধে জর্জরিত ও দুর্বল। নিজ দেশে মর্যাদার আসনে বসার আগে তাকে একের পর এক যুদ্ধে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।
সুন্জাতা মহাকাব্য কোনো বসতি জীবনের গৌরবগাথা নয়, বরং এর বিপরীত—ঘরহারা থাকার যন্ত্রণা নিয়ে রচিত। এই অর্থে এটি গিলগামেশ মহাকাব্যের চেয়ে অডিসি-র সঙ্গে বেশি সাদৃশ্যপূর্ণ, যদিও গিলগামেশ-এও একটি অংশ আছে যেখানে শোকাতুর গিলগামেশ হতাশায় পৃথিবীজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফলে, সুন্জাতা মহাকাব্যে বসতিভিত্তিক নগরজীবনের কৃষিকেন্দ্রিক ভিতের ওপর তেমন জোর নেই।
তবে কখনো কখনো কৃষি নেপথ্য থেকে উঠে আসে, যেমনটি হোমারের কাব্যেও দেখা যায়। একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যে, স্বদেশ থেকে আসা দূতেরা নির্বাসিত সুন্জাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে, যিনি তখন তার ছোট্ট সঙ্গীসমেত লুকিয়ে রয়েছেন (তার মা ইতিমধ্যে মারা গেছেন)। নির্বাসিতরা স্বদেশের খাবারের জন্য আকুল, বিশেষ করে দাদো, অর্থাৎ শুকনো হিবিস্কাস ফুল, যা এক বিশেষ ধরনের সসে মসলার মতো ব্যবহার করা হয়। স্বদেশ থেকে আসা দুই দূত কিছু দাদো বাজারে বিক্রির জন্য এনেছে। নির্বাসিতরা দাদো দেখে এতটাই লোভে পড়ে যে একদম বাজারের ভিড়ের মধ্যেই তা কোনো দরদাম ছাড়াই নিয়ে নেয়। এই সুস্পষ্ট লক্ষণের ভিত্তিতে দূতেরা বুঝে ফেলে তারা সুন্জাতার দলের লোক। কারণ দাদো এই অঞ্চলে, নির্বাসনে, উৎপাদিত হয় না, নির্দিষ্টভাবে তা স্বদেশের জিনিস।
সুন্জাতা ও তাঁর সাম্রাজ্যের কাহিনি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মৌখিকভাবে প্রচারিত হয়েছে—এমনকি আরব পণ্ডিতেরা ইসলাম এবং তার লেখন-সংস্কৃতি আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে আসার পরেও। মহাকাব্যটি কিছুটা ইসলামি রূপ লাভ করে, ইসলাম ও ইসলামি পাণ্ডিত্যের ছোঁয়া এতে উঠে আসে, তবু প্রাক-ইসলামি উপাদানগুলোর অনেকটাই অক্ষত থাকে।
উনিশ শতকে ফরাসি ঔপনিবেশিকরা যখন আসে, তারা নিজেদের বর্ণমালা ও লেখার সংস্কৃতি নিয়ে আসে। তবুও মহাকাব্যটি ক্ষমতার নতুন কেন্দ্র, প্রশাসন ও শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি তখনও মৌখিকভাবে চলতে থাকে। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে ধাপে ধাপে লেখ্যরূপ পায় এই মহাকাব্য। প্রথমে একে পাঁচ অঙ্কের নাটক হিসেবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয় (ফরাসি নাটকের ছাঁচে), পরে এটিকে উপন্যাসে রূপান্তর করার ভাবনা আসে (ফরাসি মধ্য-শতকের উপন্যাসের ছাঁচে)। কিন্তু এই সব ধাঁচ কোনোটাই ভালোমত কাজ করে না—কারণ এই কাব্যিক বহু প্রজন্মের কথক দ্বারা গঠিত, যাদের সৃষ্টির ধরণ ভিন্ন। ফলে সুন্জাতা মহাকাব্য আজও মৌখিকভাবে আবৃত্ত হয়।
আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ডেভিড সি. কনরাডের সঙ্গে কাজ করার, যিনি ম্যান্ডে গায়ক তাসে কন্ডের সঙ্গে এই মহাকাব্যের একটি অনন্য লিখিত সংস্করণ নির্মাণে সহযোগিতা করেন । এটি ১৯৯৪ সালের সরাসরি মঞ্চায়ন থেকে রেকর্ড করা হয়েছিল, যেটিকে কনরাড ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং বিশ ও একবিংশ শতকে লিখিত মহাকাব্যে রূপান্তর করেন—যা আমি মনে করি, এ পর্যন্ত মহাকাব্যটির সেরা লিখিত রূপ।
এই লিখিত ও মৌখিক ধারার চলমান পারস্পরিক সম্পর্ক আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে লেখার প্রসার খুব সহজেই মৌখিক ঐতিহ্যকে অপ্রাসঙ্গিক বা অবহেলিত করে তোলে, অথচ লেখ্যতা ও মৌখিকতা—এই দুইকে একসঙ্গে একটি সমন্বিত কাঠামোর অংশ হিসেবে বোঝা উচিত। মৌখিক জ্ঞানের পুনরুদ্ধারে এখনো বহু কাজ বাকি রয়েছে যেগুলো প্রায়শই প্রচলিত লেখ্য সংস্কৃতির কেন্দ্রের বাইরে। বিশেষত তা দেশীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সংরক্ষিত থাকে (অবশ্য এদের মধ্যেও ছাপা সংস্কৃতির নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে)।
সৌভাগ্যবশত, পরিবেশ-সমালোচনা (ecocriticism) ও নৃবিজ্ঞান (anthropology) এই ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে স্মৃতি ও গল্প বলার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছে। এর সাহায্যে অতীতের পরিবেশগত সংকটগুলোকেও পুনর্গঠন করা সম্ভব, যেগুলোর প্রভাব মৌখিক গল্প-ঐতিহ্যে রয়ে যায়—যেমন পশ্চিম আমেরিকায় দেখা যায়।
লেখার ইতিহাস নিয়ে ভাবার মাধ্যমে আমরা সাহিত্যের সাথে বসতি জীবন ও সম্পদ আহরণের সম্পর্ক মূল্যায়ন করার ভিত্তি নির্মাণ করতে পারব। একইসাথে এর মাধ্যমে পরিমাপ করা যায় সাহিত্য একটি সাংস্কৃতিক কৌশল হিসেবে ঠিক কতদূর অব্দি জলবায়ু পরিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এই ধরণের ইতিহাসের উদ্দেশ্য গত চার হাজার বছর ধরে লেখা সাহিত্যকে খারিজ করা নয়, বরং উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সাহিত্যপাঠের একটি উপযুক্ত পদ্ধতি হাজির করা, আরো ভালো করে বোঝা যে ঠিক কোন ধরণের গল্পকথনের ঐতিহ্য আজ আমাদের এই সঙ্কটাবস্থায় নিয়ে এসেছে। পরিবেশ-সচেতনভাবে সাহিত্য পাঠ করার ফলে আমরা এই চার হাজার বছরের সাহিত্য-ঐতিহ্যকে নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারব। এর মাধ্যমে হয়তো আমরা পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে নতুন করে ভাবতে পারব।