IMG-20240430-WA0003
নাজমুল হোসেন
হিউমারিস্ট
স্যাটায়ারিস্টের আসলে বিপদের শেষ নাই! হামলা, মামলা, গালাগালি খাওয়া এমনকি মৃত্যুর ভয় পর্যন্ত আছে। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

লেখা শুরু করা যাক ছাপোষা এক মানুষের গল্প দিয়ে। ধরা যাক, তার নাম জাভেদ। দিন আনে দিন খায় ঘরানার মানুষ। বড় কোনো অপরাধ করেনি। কারও তেমন কোনো ক্ষতিও করেনি। রাজনৈতিক দল করে না। ব্যবসাও করে না। সকালে কাজে বের হয়, সন্ধায় বাসায় ফিরে। ২০ তারিখের পর পকেটে টাকা থাকে না। ধার করে চলে। গাড়ি নাই, বাড়ি নাই। অনেক পৈত্রিক প্রতিপত্তিও নেই।           

জাভেদ এমন একজন মানুষ, যার বড় কোনো শত্রু থাকার কথা না। চুরি, ছিনতাই, ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশি হয়রানি কিংবা দোকানদার নকল সিগারেট গছিয়ে দেয়া ছাড়া বড় কোনো ক্ষতির আশঙ্কাও জাভেদের জীবনে থাকার কথা না। কিন্তু জাভেদের নামের পাশে যখন স্যাটায়ারিস্ট পরিচয়টা যুক্ত হয়ে যায় তখন ঘটে সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা! জাভেদ আবিষ্কার করে তার অনেক শত্রু এবং শত্রুদের বেশিরভাগকেই জাভেদ চিনে না। তারা জাভেদকে কখনও সামনে পেলে হত্যাও করতে চায়।   

আর্থিক কিংবা সামাজিক অবস্থান ভিন্ন হতে পারে; তবে জাভেদের এই গল্পটি প্রতিটি স্যাটায়ারিস্টেরই গল্প। শুধু স্যাটায়ারিস্ট না অ্যাক্টিভিস্টদের শত্রু জন্ম নেয়ার গল্পটাও আসলে এমন। তবে স্যাটায়ারিস্টের ভাগ্য এক্ষেত্রে ট্রাজিক অন্য কারণে–বোবা ও স্যাটায়ারিস্টের মধ্যে পার্থক্য হলো স্যাটায়ারিস্ট কথা বলে। আর শুধু কথা বলার জন্যই স্যাটায়ারিস্টের এত শত্রু।    

অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।


ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কোনো ব্যক্তি যদি আরামের জীবন ছেড়ে স্যাটায়ারিস্ট হতে চান তাহলে আচানক অচেনা শত্রু তৈরি করার জন্য তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। দেশ-বিদেশের নানান ঘটনা, নিজের ও আশেপাশের মানুষদের অভিজ্ঞতা থেকে একজন স্যাটায়ারিস্টের বিপদকে আমি কয়েকভাবে ভাগ করেছি।   

ইন্টারনেটের যুগে প্রাথমিক বিপদ হল, কমেন্ট ও ইনবক্সে গালি আর হত্যার হুমকি। ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ফ্যামিলির ছবি এডিট করে বুলিং। নারীদের উপর অনলাইন সেক্সুয়াল অ্যাটাক। এরপর আসতে পারে, থ্রেট দিয়ে ফোনকল। চেহারা পরিচিত হলে মব আক্রমনের শিকার। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। কোনো কার্টুন বা লেখা সরকারের বেশি অপছন্দ হয়ে গেলে কিশোর-এর মতো সরকারি নির্যাতন ও দেশ ত্যাগ। কোনো উগ্রপন্থি গোষ্ঠীর অপছন্দ হয়ে গেলে স্যাটায়ার ম্যাগাজিন শার্লি এব্দোর অফিসের কর্মীদের মতো দলগতভাবে গুলি খেয়ে মৃত্যু।    

২০১৩ সালের উথালপাতাল সময়ের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। শাহবাগ ও শাপলার দ্বন্দ্বে অ্যাক্টিভিস্টদের পাশাপাশি স্যাটায়ারিস্টরাও ভিক্টিম হয়েছিল। তখনকার অনেক স্যাটায়ারিস্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট দেশ ছেড়েছে, এমনকি তারা এখনও দেশকে নিরাপদ মনে করেন না। এমনই একজন স্যাটায়ারিস্ট ও ভ্লগারের সবাক পাখি। দেশ ছেড়ে ভিন্ন দেশে থাকলেও নিরাপত্তার জন্য নিজের অবস্থান জানাতে চান না তিনি। বেনার নিউজকে দেয়া সাক্ষাতকারে এই স্যাটায়ারিস্ট, ভ্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, ‘আজীবনের জন‍্য আমি তাদের টার্গেট। দেশে ফিরে গেলে ওরা সুযোগ পেলেই মেরে ফেলবে। ১৬ কোটি মানুষের মাঝে আমার মৃত‍্যু কেবলই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এর বেশি কিছু না।’  

২০১৩ সালে বাংলাদেশে অনেক ভ্লগারই উগ্রপন্থিদের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে সে সময়ে ছিলেন প্রাণ হারানোর শঙ্কায়। সে সময়কার দুজন স্যাটায়ারিস্ট, ভ্লগার ও অ্যাক্টিভিস্টের সাথে আড্ডায় উঠে এসেছে তখনকার পরিস্থিতি। একজন জানিয়েছেন, তিনি বাসায় যেতেন ভয়ে ভয়ে। প্রতিবারই মনে হতো, বাসায় কেউ না কেউ ঘাপটি মেরে বসে আসে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই তাদের চাপাতির আঘাতে প্রাণ যাবে। 

আরেকজন স্যাটায়ারিস্ট মেইন রাস্তা থেকে তার বাসা পর্যন্ত যাওয়ার অল্প কয়েক মিটার পথ হেঁটে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বাস থেকে তিনি নেমেছেন, হেঁটে বাসায় যাবেন। পুরো রাস্তা ফাঁকা। সে ছাড়া মাত্র একজন মানুষকে দেখা যাচ্ছে। দেখতে শুনতে নিরীহ! হয়তো আম পাবলিক। তবু, এই পথটুকু পাড়ি দেয়া ছিল এই স্যাটায়ারিস্টের জন্য রীতিমত একটা যুদ্ধ। হাঁটছেন। কিন্তু সবসময় একটা ভয় মাথায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকটাই চাপাতি নিয়ে তাকে আঘাত করবে না তো? 

যদিও সেই যাত্রায় কোনো বিপদ ছাড়াই তিনি বাসায় পৌঁছাতে পেরেছেন, তবে জলাঞ্জলি দিয়েছেন নিজের স্যাটায়ারিস্ট পরিচয়কে। এরপর রাজনীতি ও সোসাইটি নিয়ে স্যাটায়ার করা একদমই ছেড়ে দিয়েছেন।   

একসময় বাংলাদেশের অনেক পত্রিকার প্রথম পাতাতে কার্টুন দেখা যেত। শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া, এরশাদ থেকে শুরু করে ছোটবড় সব নেতারই কার্টুন হতো। কিন্তু সরকারি নানান এজেন্সির রোষানল, কার্টুনিস্টদের নামে মামলা, গ্রেফতারসহ নানান কারণে সেটা ধীরে ধীরে কমে আসে। একসময় কার্টুন প্রায়ই হারিয়েই গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছিল যে, ২০১৮ সালে বিবিসি বাংলা ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্যাটায়ার করা কতটা কঠিন’–শিরোনামে একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন। সে প্রতিবেদনের জন্য প্রখ্যাত এক কার্টুনিস্টের বক্তব্য চাওয়া হলে তিনি বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।  

একসময় বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ছিল আলপিন। বাংলাদেশের প্রভাবশালী পত্রিকা প্রথম আলো এই ফান ম্যাগাজিনটি বের করতো। ধর্মীয় বিতর্কের মুখে একসময় ম্যাগাজিনটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়েছিল যে, প্রথম আলোর সম্পাদককে ক্ষমা চেয়ে তৌহিদী জনতাকে ঠান্ডা করতে হয়। আলপিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু বছর পর রস+আলো নামে আরও একটি স্যাটায়ার ম্যাগাজিন শুরু করে প্রথম আলো। কয়েক বছরের পথচলায় এটিও বন্ধ হয়ে যায়।    

বাংলাদেশের ডিজিটাল স্পেসে মজা লস নামে খুবই জনপ্রিয় একটা স্যাটায়ার পেজ ছিল। যেটিও রাষ্ট্রিয় চাপে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। এটাই আসলে একটা স্যাটায়ার পত্রিকার নিয়তি। স্যাটায়ার পত্রিকা চালুই হয় রাজনৈতিক, রাষ্ট্রিয় কিংবা ধর্মীয় চাপে বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। প্রাণী ও স্যাটায়ার পত্রিকার মধ্যে একটা মিল হলো, প্রতিটি প্রাণীকেই যেমন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে, তেমনি প্রতিটি স্যাটায়ার পত্রিকাকেও!  

গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী অনেক রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নেতা প্রশ্ন করে বসতেই পারেন, পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে শুধু স্যাটায়ারিস্টের কেন এত বিপদ! স্যাটায়ারিস্টরা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো আকাম করে! আকাম যে একটা স্যাটায়ারিস্টরা করে তা অবশ্য ভুল কথা না। 

স্যাটায়ারিস্টরা মূলত উপরে ফিটফাট মানুষের ভেতরের সদরঘাটটাকে সবার সামনে প্রকাশ করে দেয়। বিখ্যাত দার্শনিক হেগেল এমনটাই বলেছেন। অর্থাৎ আপনার কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠানের উপরের ফিটফাট অবস্থা ও ভেতরের সদরঘাটের অবস্থা পরস্পর বিপরীতমুখী হলেই কেবল আপনি একজন স্যাটায়ারিস্টের কলমের তলে, কার্টুনিস্টের পেন্সিলের তলে কিংবা মিমারের মিমের তলে পড়বেন।  

মোটাদাগে খেয়াল করলে দেখবেন, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও আর্থিকভাবে ক্ষমতাবান বেশিরভাগের মানুষের অন্দর আর বাহিরের মিল থাকে না। সেই অমিলটা সবার সামনে তুলে নিয়ে আসে স্যাটায়ারিস্ট। ফলে তার দ্বন্দ্বটা সবসময় ক্ষমতার সাথে। একজন স্যাটায়ারিস্ট নীরেন্দ্রনাথের সেই শিশুটির মতো, সবাই চুপ থাকলেও যে শিশুটি রাজার দিকে আঙুল তুলে বলে দেয়, ওই রাজা তুই ন্যাংটা কেন?   

ন্যাংটাকে ন্যাংটা বললে ন্যাংটা যে সেটা পছন্দ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। একজন স্যাটায়ারিস্ট ন্যাংটাকে ন্যাংটা বলবে এটাও স্বাভাবিক। ফলে একজন স্যাটায়ারিস্টের কাজই আসলে তার বিপদ। যেই বিপদ সবসময় তার পোদে পোদে থাকে। 

লেনি ব্রুস, জর্জ কার্লিন, নজরুল, আবুল মনসুর আহমদ, হুমায়ূন আজাদ, ব্রাত্য রাইসু কিংবা গিয়াস উদ্দিন তাহেরী–ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, আইন নানান কিছু নিয়ে স্যাটায়ার করেছেন। পকেটে বিপদ নিয়ে ঘুরেছেন। কেউ খুন হয়েছেন, কেউ জেলে গিয়েছেন, কেউ তৌহিদী জনতার রোষানলে পড়েছেন। তবে মজার বিষয় হইতেছে, স্যাটায়ার থেমে থাকে নাই। এরপরও দুনিয়াতে মানুষ জন্মাবে। তারা বড় হবে। কেউ নেতা হবে আর কেউ স্যাটায়ারিস্ট।    

কিছুদিন আগে জনাব তারেক রহমান মেহেদী হকের কার্টুন শেয়ার দিচ্ছেন। অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন। অনেকটা পিঠ চাপড়ে দেয়ার মতো! নিজেও প্রশংসা পাচ্ছেন। কার্টুনের প্রতি, স্যাটায়ারের প্রতি ওনার এই দৃষ্টিভঙ্গি দারুণ। পিআর ক্যাম্পেইন হিসেবে অবশ্যই দশে দশ পাবেন। তবে আমি এক আড্ডায় ভিন্ন একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছি। এই সময়ের খুবই মেধাবী একজন কার্টুনিস্ট বলেছিলেন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এভাবে কার্টুন শেয়ার করে অ্যাপ্রিশিয়েট করাও এক ধরণের সিগন্যাল। তারা হয়তো এই মেসেজটাও দিতে চান, তারা আমাদের উপর চোখ রাখছেন। কার্টুনিস্ট বা স্যাটায়ারিস্টের জন্য এটাও এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। পরেরবার এই নেতার কার্টুন আঁকার ক্ষেত্রে উনি হয়তো অচেতন মনেই নিজের কাজকে সেন্সর করবেন!   

স্যাটায়ারিস্টের আসলে বিপদের শেষ নাই! হামলা, মামলা, গালাগালি খাওয়া এমনকি মৃত্যূর ভয়তো আছেই, এছাড়াও আছে নানামুখী পড়ালেখার ভয়। একবার এক কার্টুন ওয়ার্কশপে গিয়েছি। সেখানে ২ ঘন্টার ২টা ক্লাশ ছিল সেগুলোর বিষয় কার্টুন ছিল না। একটা টপিক ছিল, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ফাঁকি দিয়ে কীভাবে কার্টুন আঁকা যায়। আরেকটা টপিক ছিল, অনুভূতিতে আঘাত না করে কীভাবে কার্টুন আঁকা যায়। মানে বুঝতেই পারছেন, কার্টুন আঁকার জন্য বা স্যাটায়ার করার জন্য আপনাকে একটু আইনও পড়ে নিতে হবে!  

কিছুদিন আগে আমি আরও একটা কোর্স করেছি! যার টপিকও স্যাটায়ার ছিল না। যেখানে আমাকে শেখানো হয়েছে, রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক কিংবা মবের আক্রমণ থেকে অনলাইনে ও অফলাইনে কীভাবে নিজেকে নিরাপদ রাখব। সে অনেক ক্লাশ, ওয়ার্কশপ, অ্যাসাইনমেন্ট নানান কিছু! স্যাটায়ারিস্ট হওয়ার আগে মাথায় নিবেন, এইসব বিপদ।   

স্যাটায়ারে টেকা-পয়সাও নাই! খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলাদেশে কোনো মিলিয়নিয়ার কার্টনিস্ট বা স্যাটায়ারিস্ট নাই। তাদের গাড়ি নাই। ঢাকা কিংবা কানাডায় বাড়ি নাই। থাকে ভাড়া ফ্ল্যাটে। তাও মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট কিংবা মিরপুরের দিকে, যেখানে ভাড়া কম। শ্যালে, লেকশোর কিংবা লোকিতে আপনি কোনো স্যাটায়ারিস্ট কিংবা কার্টুনিস্টকে দেখবেন না। তারা বড়জোর পিকক, গ্যালাক্সি কিংবা খুব বেশি হলে সাকুরাতে যায়।        

এত এত না পাওয়া আর বিপদ দেখে অনেকে হয়তো স্যাটায়ারিস্ট হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারেন। তাই একটা উপকারের কথা দিয়ে লেখা শেষ করি। আমি বাংলাদেশের স্যাটায়ার প্লাটফর্মে কাজ করি দীর্ঘদিন। এই লম্বা সময়ে স্যাটায়ার করে ডিজিটাল মাধ্যমে এত গালি খেয়েছি যে, এখন কেউ আমাকে গালি দিলে আর গায়ে লাগে না। দেহ আর মন হয়ে গেছে গালি প্রুফ! উপকারের মধ্যে এই একটা উপকারই পেয়েছি।   

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।