গাধার পিঠে চেপে হোজ্জা প্রায়ই ইরান, গ্রিস চলে যান। প্রতিবারই গাধার পিঠে দুই বোঝা খড় চাপিয়ে নিয়ে যেতেন এবং ফিরে আসতেন পায়ে হেঁটে। প্রতিবার তাকে তল্লাশি করা হতো বেআইনি সামগ্রীর খোঁজে। কিছুই পাওয়া যেত না।
সীমান্তরক্ষীরা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নিয়ে যান আপনি, হোজ্জা?
এর উত্তরে হোজ্জা বললেন, আমি একজন চোরাচালানি।
কয়েক বছর পর হোজ্জার অবস্থা আরও রমরমা। মিশরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। সেখানে একদিন এক সীমান্তরক্ষী তার
সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।
তিনি বললেন, বলুন হোজ্জা, কী করে গ্রিস ও ইরানের আইন ফাঁকি দিয়ে গেলেন আর এখানেও বেশ ভালোই আছেন। কী চোরাচালান করতেন যে কখনোই ধরা যেত না?
হোজ্জা খুব খুশি খুশি মনে বললেন, গাধা।
হোজ্জার গাধা পাচারের কাহিনীরই একটা মডার্ন ভ্যারিয়েশন নিচের গল্পটা।
কারখানার এক শ্রমিককে সন্দেহ করা হচ্ছে যে সে কিছু একটা চুরি করছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে একটা হুইলব্যারো (ছোট এক চাকার ঠেলাগাড়ি জাতীয় বাহন) ঠেলতে ঠেলতে সে বের হয়ে যায়। বাইরের রক্ষীরা প্রতিবার তাকে আটকে খোঁজ করার পরেও কিছুই খুঁজে পায় না, হুইলব্যারোটায় কিছুই থাকে না। শেষমেশ আসল খবর একদিন জানা গেল। ব্যাটা আসলে হুইলব্যারোই চুরি করে রোজ।
একদম জিজেকীয় ঢঙে, নিজের ‘ভায়োলেন্স’ বইটা স্লাভয় জিজেক শুরু করেন এই গল্পটা দিয়ে। গল্পটার মধ্য দিয়ে জিজেক সহিংসতা, তথা ভায়োলেন্সের তিনটি স্তরভেদ স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন। সহিংসতার খুব দৃশ্যমান নজির হিসেবে আমরা বলতে পারি চুরি-ছিনতাই জাতীয় বিভিন্ন অপরাধ, নাগরিক অশান্তি অথবা নানা মাত্রার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের কথা। এ-জাতীয় স্পষ্ট সহিংস ঘটনা, যা ‘স্বাভাবিকতার’ ধারাবাহিকতায় ছেদ টানে, তা সাধারণত ঘটে খুবই দৃশ্যমান কোনো কর্তার হাত ধরে। এসব ক্ষেত্রে দোষী কে তা নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া খুব সহজ। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে রুষে ওঠা, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠাও সম্ভব। কিন্তু জিজেক আমাদের বলবেন একটু থেমে আরেকবার ভাবতে। উপরে যে ধরণের সহিংস ঘটনার নজির তুলে ধরলাম, সেটাকে জিজেক বলবেন ‘সাবজেক্টিভ ভায়োলেন্স।’ এর একটা মর্মানুবাদ করা যায় দৃশ্যমান সহিংসতা। এ-ধরণের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত কে ও কীভাবে হচ্ছে, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের কারণ-টারণ বেশ স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। এই দৃশ্যমান সহিংসতা বাদেও আরো দুই ধরণের সহিংসতার কথা জিজেক উল্লেখ করছেন। একটা হলো প্রতীকী সহিংসতা, যা ভাষায় কিংবা আমাদের আচরণের গভীর অংশে প্রোথিত। আরেকটা হলো, অবকাঠামোগত সহিংসতা। আমাদের আলোচনা মূলত এই অবকাঠামোগত সহিংসতা ও দৃশ্যমান সহিংসতা নিয়েই।
দৃশ্যমান সহিংসতা যদি স্বাভাবিকতার মসৃণ কাপড়ে একেকটা দৃষ্টিকটু চির বলে মনে হয়, তাহলে অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো সেই কাপড়ের আড়ালে ক্রমাগত সংঘটিত হতে থাকা নৃশংস ঘটনাগুলো। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে একটা মন্তব্যের কারণে জিজেককে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেছিলেন হিটলারের চাইতে মহাত্মা গান্ধী বেশি সহিংস। কীভাবে? হিটলার এত এত মানুষকে খুন করেছিল কোনোরকমের বদল ঠেকাতে। যে পরিবর্তনের জোয়ার এসে ধাক্কা দিয়েছিল জার্মানিকে, সেটা রোধ করতেই হিটলার এত নির্মম কর্মকাণ্ড করতে গেছিলেন। অপরদিকে মহাত্মা গান্ধীর আপাত অহিংস কর্মকাণ্ড ছিল সমাজের খুব গভীরে গেঁথে থাকা শিকড় উপড়ে ফেলার নিমিত্তে। তাই জিজেকের বিচারে হিটলারের চাইতে বহুগুণে বেশি ‘সহিংস’ ছিল গান্ধী। এইখানেই দৃশ্যমান সহিংসতা ও অবকাঠামোগত সহিংসতার তফাত। দৃশ্যমান সহিংসতা হলো বিরূপ একটা কিছু, যা স্বাভাবিকতাকে ভঙ্গ করে। আর অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো খোদ একটা আপাত স্বাভাবিকতাকে টিকিয়ে রাখতে যে নৃশংসতা চালানো হয় সেটা। জিজেকের ভাষায় সেটা হলো ‘স্বাভাবিকতায় অন্তর্নিহিত সহিংসতা।’ এবং এই সর্বব্যাপী, অদৃশ্য নিপীড়নের স্বভাব যদি না বোঝা যায়, তাহলে ব্যক্তিপর্যায়ের একেকটা বিচ্ছিন্ন ও আচানক সহিংস ঘটনার স্বরূপও বোঝা সম্ভব হবে না।
ধরা যাক, ফার্মগেটের খোলা রাস্তায় সবার সামনে একজন কারো পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। অথবা জ্যামের মধ্যে কতগুলো ছোকরা কারো গলা থেকে একটা চেইন টান দিয়ে দৌড় দিল। ধারণা করা যায় এসব ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলবে। গণমাধ্যম বেশ আমলে নেবে, আর মানুষজন প্রতিবাদও করবে বেশ জোরেসোরে। কিন্তু ধরুন, এইযে গতবছর এক রিক্সাওয়ালা গরমকালে হঠাৎ স্ট্রোক করে রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকল, কিংবা কেউএকজন কাউকে কোনো কারণ না জানিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো, অথবা সারাজীবন জঘন্য বিষাক্ত বাতাসের একটা শহরে বসবাস করে অকালেই আপনার ফুসফুস বিকল হয়ে পড়ল, তখন? এ-ধরণের ঘটনায় সহানুভূতিতে আমাদের মন ভরে উঠতে পারে, কিন্তু একটু ৎ্চ ৎ্চ করে ওঠার চেয়ে বেশি কিছু হয়তো করার মত পাব না। তার কারণ হলো, প্রথম ক্ষেত্রে দোষটা আসলে কার, কাকে ধরে সাইজ করতে হবে তা অনেক স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অপরাধীটা কে তা বের করা সহজ না। এমনকি এও মনে হতে পারে যে কোনো দোষীই নেই, ব্যস এমনিতেই ঘটে গেছে। একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আদতে তা না। এ-সমস্ত ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হররোজ আমাদের একটু একটু করে খুন করে চলেছে, নাহয় সর্বক্ষণ মৃত্যু অথবা বড়সড় কোনো ক্ষতির ঝুঁকিতে রাখে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এটা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটে। ফলে মানুষের নিত্য নাগরিক জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ।
যেসব আকস্মিক ঘটনার কোনো পূর্বনজির নেই, আগেভাগে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই, সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় একইরকমের দুর্ঘটনা বারবার বারবার ঘটতেই থাকে, এবং সেগুলো ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে তা নিশ্চিত করার কোনো প্রয়াস রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে দেখা যায় না। বাংলাদেশের সড়ক ‘দুর্ঘটনার’ কথাই বলা যায়। এসব এখন আমাদের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এখন আর কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যুর খবর শুনলে যেন অবাকও হতে পারে না। এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ২৪ জন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি ৪ হাজার ৪৭৫। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৯০২ জন। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে এরকম হয়েই আসছে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই বেখেয়ালি চালক অথবা পথচারীদেরকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো আইন বলবৎকরণ ও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের আচরণকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করা যাতে এ-ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটে। ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হন। অধ্যাপক ড. শামসুল হক সে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানান, ‘যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার রাস্তার বাঁকও ছিল অবৈজ্ঞানিক। ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে যা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাক স্পট ছিল, এই বাঁক তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতিবছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’ তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মারা যাওয়ার পর সেই মহাসড়কের এই বিপজ্জনক বাঁকগুলো ঠিক করা হয় এবং সেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যায়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, দেশের আর দশটা সাধারণ মানুষের মৃত্যু নীতিনির্ধারকদের এরকম পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ করে না। এছাড়াও দেশের রাস্তায় অসংখ্য ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল তো করতেই থাকে, তাদের অনেক চালকের লাইসেন্সও নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে অথবা ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স আদায় করে নেয়ার চল ভালোভাবেই এখানে আছে। এমনকি এমনও অনেক ঘটে যে সশরীরে ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে না গিয়েই লাইসেন্স বাগিয়ে নেয় চালকেরা। এসব অনিয়ম ক্রমাগত ঘটতে দেয়া হয়, এবং এর পরিণাম সম্পর্কে যে কেউ জানে না তাও তো না। ফলে বলা চলে এমন অসংখ্য ‘দুর্ঘটনার’ মাধ্যমে এত এত মানুষের মৃত্যুর সকল বন্দোবস্ত আসলে করাই থাকে। এমন অবস্থায় দুর্ঘটনা না হলেই বরং অবাক হতে হবে। এগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে বরং অনীহাপ্রসূত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলাই বেশি যুৎসই।
সড়কের হিসাব বাদ দিলেও আরো বহুবিধ কাঠামোগত সহিংসতার শিকার বাংলাদেশের মানুষকে হতে হয়। অগ্নিকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। গতবছর ফেব্রুয়ারিতেই বেইলি রোডের একটা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের। পরে জানা যায় ওই ভবনে রেস্তোরাঁ চালানোর অনুমতিই ছিল না। সেখানে আগুন লাগার ক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। ফায়ার এক্সিট, ফায়ার অ্যালার্ম ইত্যাদি কোনো পূর্বব্যবস্থা ছিল না। ভবনটির নির্মাতা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, বিভিন্ন তলার মালিক, ব্যবসায়ী, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন প্রত্যেকেই একে অপরের উপর দায় চাপাতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। অথচ এরকম ভয়াবহ একটি ঘটনার দায় কেউই এড়াতে পারে না। একাধিক পর্যায়ে তাদের এই গাফেলতির কারণে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল। তাও এই অগ্নিকাণ্ডে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছুটা মনোযোগ তা পায়। বিভিন্ন কল-কারখানার অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের মৃত্যুও একটা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশন্সের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দমকল বাহিনির লোকেরা গিয়ে দেখেন সেখানকার কলাপসিবল গেট আটকে রাখা হয়েছিল কাচামাল রক্ষা করার জন্য। শ্রমিকরা সেই তালা ভাঙার, গেট ভাঙার অনেক চেষ্টা করেছিল। যারা পেরেছিল লাফিয়ে জানালা থেকে বের হয়ে গেছিল। সেই ভবনেও কোনো আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাশালী নেতা হওয়ায় এত বছরেও তাজরীন ফ্যাশনের পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের কোনো বিচারই হয়নি। রানা প্লাজার কথাও উল্লেখ করা যায়। এসবকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। সোজা কথায় এগুলো খুন। নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকরা, যেখানে তারা দিনের বড় একটা অংশ কাটান, সেখানে এভাবে প্রতি মুহূর্তে জানের ঝুঁকিতে থাকেন।
প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা বাদেও এ দেশের নাগরিকদের পদে পদে নানাপ্রকার হেনস্থার শিকার হতে হয়। ঢাকার বাতাসের অবস্থা, যানজট, নগর পরিকল্পনা এসবই তার জন্য দায়ী। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ফুটওভার ব্রিজের চল এখন আর নেই। বাংলাদেশে এখনো পথচারীদের সুবিধার কোনো তোয়াক্কা না করে ব্রিজে করে রাস্তা পার হতে বলে দেয়া হয়। ব্রিজগুলো একে তো হয় অনেক দূরে দূরে অবস্থিত, তারউপর বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এখানে একদমই অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ সকলপ্রকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না করে কোনো নগর পরিকল্পনা করা সম্ভবই না। সমস্যা হলো, এসব সমস্যা এমনভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে যে এগুলোকে আলাদা করে শনাক্ত করাও কঠিন। গণমাধ্যমগুলোও বারবার চেষ্টা করে এসব গভীরে প্রোথিত, অগোচর সমস্যাগুলোর চাইতে দৃশ্যমান খুচরা সহিংসতার দিকে ফোকাস দিতে। জিজেকের মতে, এই কাজগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে একটা ভুয়া তাড়াহুড়া ও পারস্পরিক অনাস্থা সৃষ্টি করে আসল সমস্যা থেকে নজর ফিরিয়ে রাখা। বের্টোল্ট ব্রেখটের একটা লেখায় তিনি বলছেন, ‘একটা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার তুলনায় একটা ব্যাংক ডাকাতি খুবই মামুলি অপরাধ।’ এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাই হলো জিজেকের সেই অবকাঠামোগত সহিংসতা, যা মহাসমারোহে অথচ চোখের আড়ালেই ঘটে যেতে থাকে রোজ। ব্যাংক ডাকাতি কিংবা খুনাখুনি যে কোনো অপরাধ না, বা তাতে আমরা পাত্তা দেব না তা না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই, এসব আকস্মিক বিস্ফোরণ গভীরতর কোনো সমস্যারই উপসর্গ। বের্টোল্ট ব্রেখটেরই ‘নিষ্ফলতা বিষয়ক’ নামে একটা কবিতা আছে:
‘যে ফলগাছ কোনো ফল দেয় না
তাকে বলা হয় নিষ্ফলা। কিন্তু
মাটিটা কেউ পরখ করে দেখেছে কি?
যে ডাল ভেঙে পড়ে, তারে সহজেই
নষ্ট ডাল বলে ডাকা যায়। কিন্তু কেউ
দেখেনি কতটা তুষারের ভারে নুয়ে পড়েছিল সে?’
পোড়োজমিতে চিরকাল নিষ্ফলা গাছই জন্মাবে। জিজেকের আর্জি হলো, এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তে আসার আগে অন্তত এর গূঢ়তর কারণগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যেন আমরা হই।
কৃতজ্ঞতাস্বীকার:
ভায়োলেন্স, স্লাভোয় জিজেক
সড়ক থেকে কর্মক্ষেত্র: বাংলাদেশে কাঠামোগত দুর্ঘটনা, কল্লোল মোস্তফা