হোজ্জার গাধা কিংবা অবকাঠামোগত ভায়োলেন্স 

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
দৃশ্যমান সহিংসতার বাইরেও আছে পদ্ধতিগত বা সিস্টেমেটিক নানান ভায়োলেন্স । অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

গাধার পিঠে চেপে হোজ্জা প্রায়ই ইরান, গ্রিস চলে যান। প্রতিবারই গাধার পিঠে দুই বোঝা খড় চাপিয়ে নিয়ে যেতেন এবং ফিরে আসতেন পায়ে হেঁটে। প্রতিবার তাকে তল্লাশি করা হতো বেআইনি সামগ্রীর খোঁজে। কিছুই পাওয়া যেত না।

সীমান্তরক্ষীরা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নিয়ে যান আপনি, হোজ্জা?
এর উত্তরে হোজ্জা বললেন, আমি একজন চোরাচালানি।
কয়েক বছর পর হোজ্জার অবস্থা আরও রমরমা। মিশরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। সেখানে একদিন এক সীমান্তরক্ষী তার
সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। 
তিনি বললেন, বলুন হোজ্জা, কী করে গ্রিস ও ইরানের আইন ফাঁকি দিয়ে গেলেন আর এখানেও বেশ ভালোই আছেন।  কী চোরাচালান করতেন যে কখনোই ধরা যেত না?
হোজ্জা খুব খুশি খুশি মনে বললেন, গাধা।

হোজ্জার গাধা পাচারের কাহিনীরই একটা মডার্ন ভ্যারিয়েশন নিচের গল্পটা।
কারখানার এক শ্রমিককে সন্দেহ করা হচ্ছে যে সে কিছু একটা চুরি করছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে একটা হুইলব্যারো (ছোট এক চাকার ঠেলাগাড়ি জাতীয় বাহন) ঠেলতে ঠেলতে সে বের হয়ে যায়। বাইরের রক্ষীরা প্রতিবার তাকে আটকে খোঁজ করার পরেও কিছুই খুঁজে পায় না, হুইলব্যারোটায় কিছুই থাকে না। শেষমেশ আসল খবর একদিন জানা গেল। ব্যাটা আসলে হুইলব্যারোই চুরি করে রোজ।           

একদম জিজেকীয় ঢঙে, নিজের ‘ভায়োলেন্স’ বইটা স্লাভয় জিজেক শুরু করেন এই গল্পটা দিয়ে। গল্পটার মধ্য দিয়ে জিজেক সহিংসতা, তথা ভায়োলেন্সের তিনটি স্তরভেদ স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন। সহিংসতার খুব দৃশ্যমান নজির হিসেবে আমরা বলতে পারি চুরি-ছিনতাই জাতীয় বিভিন্ন অপরাধ, নাগরিক অশান্তি অথবা নানা মাত্রার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের কথা। এ-জাতীয় স্পষ্ট সহিংস ঘটনা, যা ‘স্বাভাবিকতার’ ধারাবাহিকতায় ছেদ টানে, তা সাধারণত ঘটে খুবই দৃশ্যমান কোনো কর্তার হাত ধরে। এসব ক্ষেত্রে দোষী কে তা নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া খুব সহজ। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে রুষে ওঠা, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠাও সম্ভব। কিন্তু জিজেক আমাদের বলবেন একটু থেমে আরেকবার ভাবতে। উপরে যে ধরণের সহিংস ঘটনার নজির তুলে ধরলাম, সেটাকে জিজেক বলবেন ‘সাবজেক্টিভ ভায়োলেন্স।’ এর একটা মর্মানুবাদ করা যায় দৃশ্যমান সহিংসতা। এ-ধরণের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত কে ও কীভাবে হচ্ছে, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের কারণ-টারণ বেশ স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। এই দৃশ্যমান সহিংসতা বাদেও আরো দুই ধরণের সহিংসতার কথা জিজেক উল্লেখ করছেন। একটা হলো প্রতীকী সহিংসতা, যা ভাষায় কিংবা আমাদের আচরণের গভীর অংশে প্রোথিত। আরেকটা হলো, অবকাঠামোগত সহিংসতা। আমাদের আলোচনা মূলত এই অবকাঠামোগত সহিংসতা ও দৃশ্যমান সহিংসতা নিয়েই।  

দৃশ্যমান সহিংসতা যদি স্বাভাবিকতার মসৃণ কাপড়ে একেকটা দৃষ্টিকটু চির বলে মনে হয়, তাহলে অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো সেই কাপড়ের আড়ালে ক্রমাগত সংঘটিত হতে থাকা নৃশংস ঘটনাগুলো। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে একটা মন্তব্যের কারণে জিজেককে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেছিলেন হিটলারের চাইতে মহাত্মা গান্ধী বেশি সহিংস। কীভাবে? হিটলার এত এত মানুষকে খুন করেছিল কোনোরকমের বদল ঠেকাতে। যে পরিবর্তনের জোয়ার এসে ধাক্কা দিয়েছিল জার্মানিকে, সেটা রোধ করতেই হিটলার এত নির্মম কর্মকাণ্ড করতে গেছিলেন। অপরদিকে মহাত্মা গান্ধীর আপাত অহিংস কর্মকাণ্ড ছিল সমাজের খুব গভীরে গেঁথে থাকা শিকড় উপড়ে ফেলার নিমিত্তে। তাই জিজেকের বিচারে হিটলারের চাইতে বহুগুণে বেশি ‘সহিংস’ ছিল গান্ধী। এইখানেই দৃশ্যমান সহিংসতা ও অবকাঠামোগত সহিংসতার তফাত। দৃশ্যমান সহিংসতা হলো বিরূপ একটা কিছু, যা স্বাভাবিকতাকে ভঙ্গ করে। আর অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো খোদ একটা আপাত স্বাভাবিকতাকে টিকিয়ে রাখতে যে নৃশংসতা চালানো হয় সেটা। জিজেকের ভাষায় সেটা হলো ‘স্বাভাবিকতায় অন্তর্নিহিত সহিংসতা।’ এবং এই সর্বব্যাপী, অদৃশ্য নিপীড়নের স্বভাব যদি না বোঝা যায়, তাহলে ব্যক্তিপর্যায়ের একেকটা বিচ্ছিন্ন ও আচানক সহিংস ঘটনার স্বরূপও বোঝা সম্ভব হবে না।    

 
ধরা যাক, ফার্মগেটের খোলা রাস্তায় সবার সামনে একজন কারো পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। অথবা জ্যামের মধ্যে কতগুলো ছোকরা কারো গলা থেকে একটা চেইন টান দিয়ে দৌড় দিল। ধারণা করা যায় এসব ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলবে। গণমাধ্যম বেশ আমলে নেবে, আর মানুষজন প্রতিবাদও করবে বেশ জোরেসোরে। কিন্তু ধরুন, এইযে গতবছর এক রিক্সাওয়ালা গরমকালে হঠাৎ স্ট্রোক করে রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকল, কিংবা কেউএকজন কাউকে কোনো কারণ না জানিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো, অথবা সারাজীবন জঘন্য বিষাক্ত বাতাসের একটা শহরে বসবাস করে অকালেই আপনার ফুসফুস বিকল হয়ে পড়ল, তখন? এ-ধরণের ঘটনায় সহানুভূতিতে আমাদের মন ভরে উঠতে পারে, কিন্তু একটু ৎ্‌চ ৎ্‌চ করে ওঠার চেয়ে বেশি কিছু হয়তো করার মত পাব না। তার কারণ হলো, প্রথম ক্ষেত্রে দোষটা আসলে কার, কাকে ধরে সাইজ করতে হবে তা অনেক স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অপরাধীটা কে তা বের করা সহজ না। এমনকি এও মনে হতে পারে যে কোনো দোষীই নেই, ব্যস এমনিতেই ঘটে গেছে। একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আদতে তা না। এ-সমস্ত ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হররোজ আমাদের একটু একটু করে খুন করে চলেছে, নাহয় সর্বক্ষণ মৃত্যু অথবা বড়সড় কোনো ক্ষতির ঝুঁকিতে রাখে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এটা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটে। ফলে মানুষের নিত্য নাগরিক জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ।

যেসব আকস্মিক ঘটনার কোনো পূর্বনজির নেই, আগেভাগে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই, সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় একইরকমের দুর্ঘটনা বারবার বারবার ঘটতেই থাকে, এবং সেগুলো ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে তা নিশ্চিত করার কোনো প্রয়াস রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে দেখা যায় না। বাংলাদেশের সড়ক ‘দুর্ঘটনার’ কথাই বলা যায়। এসব এখন আমাদের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এখন আর কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যুর খবর শুনলে যেন অবাকও হতে পারে না। এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ২৪ জন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি ৪ হাজার ৪৭৫। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৯০২ জন। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে এরকম হয়েই আসছে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই বেখেয়ালি চালক অথবা পথচারীদেরকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো আইন বলবৎকরণ ও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের আচরণকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করা যাতে এ-ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটে। ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হন। অধ্যাপক ড. শামসুল হক সে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানান, ‘যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার রাস্তার বাঁকও ছিল অবৈজ্ঞানিক। ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে যা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাক স্পট ছিল, এই বাঁক তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতিবছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’  তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মারা যাওয়ার পর সেই মহাসড়কের এই বিপজ্জনক বাঁকগুলো ঠিক করা হয় এবং সেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যায়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, দেশের আর দশটা সাধারণ মানুষের মৃত্যু নীতিনির্ধারকদের এরকম পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ করে না। এছাড়াও দেশের রাস্তায় অসংখ্য ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল তো করতেই থাকে, তাদের অনেক চালকের লাইসেন্সও নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে অথবা ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স আদায় করে নেয়ার চল ভালোভাবেই এখানে আছে। এমনকি এমনও অনেক ঘটে যে সশরীরে ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে না গিয়েই লাইসেন্স বাগিয়ে নেয় চালকেরা। এসব অনিয়ম ক্রমাগত ঘটতে দেয়া হয়, এবং এর পরিণাম সম্পর্কে যে কেউ জানে না তাও তো না। ফলে বলা চলে এমন অসংখ্য ‘দুর্ঘটনার’ মাধ্যমে এত এত মানুষের মৃত্যুর সকল বন্দোবস্ত আসলে করাই থাকে। এমন অবস্থায় দুর্ঘটনা না হলেই বরং অবাক হতে হবে। এগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে বরং অনীহাপ্রসূত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলাই বেশি যুৎসই।

সড়কের হিসাব বাদ দিলেও আরো বহুবিধ কাঠামোগত সহিংসতার শিকার বাংলাদেশের মানুষকে হতে হয়। অগ্নিকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। গতবছর ফেব্রুয়ারিতেই বেইলি রোডের একটা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের। পরে জানা যায় ওই ভবনে রেস্তোরাঁ চালানোর অনুমতিই ছিল না। সেখানে আগুন লাগার ক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। ফায়ার এক্সিট, ফায়ার অ্যালার্ম ইত্যাদি কোনো পূর্বব্যবস্থা ছিল না। ভবনটির নির্মাতা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, বিভিন্ন তলার মালিক, ব্যবসায়ী, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন প্রত্যেকেই একে অপরের উপর দায় চাপাতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। অথচ এরকম ভয়াবহ একটি ঘটনার দায় কেউই এড়াতে পারে না। একাধিক পর্যায়ে তাদের এই গাফেলতির কারণে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল। তাও এই অগ্নিকাণ্ডে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছুটা মনোযোগ তা পায়। বিভিন্ন কল-কারখানার অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের মৃত্যুও একটা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশন্সের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দমকল বাহিনির লোকেরা গিয়ে দেখেন সেখানকার কলাপসিবল গেট আটকে রাখা হয়েছিল কাচামাল রক্ষা করার জন্য। শ্রমিকরা সেই তালা ভাঙার, গেট ভাঙার অনেক চেষ্টা করেছিল। যারা পেরেছিল লাফিয়ে জানালা থেকে বের হয়ে গেছিল। সেই ভবনেও কোনো আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাশালী নেতা হওয়ায় এত বছরেও তাজরীন ফ্যাশনের পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের কোনো বিচারই হয়নি। রানা প্লাজার কথাও উল্লেখ করা যায়। এসবকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। সোজা কথায় এগুলো খুন। নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকরা, যেখানে তারা দিনের বড় একটা অংশ কাটান, সেখানে এভাবে প্রতি মুহূর্তে জানের ঝুঁকিতে থাকেন।

প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা বাদেও এ দেশের নাগরিকদের পদে পদে নানাপ্রকার হেনস্থার শিকার হতে হয়। ঢাকার বাতাসের অবস্থা, যানজট, নগর পরিকল্পনা এসবই তার জন্য দায়ী। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ফুটওভার ব্রিজের চল এখন আর নেই। বাংলাদেশে এখনো পথচারীদের সুবিধার কোনো তোয়াক্কা না করে ব্রিজে করে রাস্তা পার হতে বলে দেয়া হয়। ব্রিজগুলো একে তো হয় অনেক দূরে দূরে অবস্থিত, তারউপর বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এখানে একদমই অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ সকলপ্রকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না করে কোনো নগর পরিকল্পনা করা সম্ভবই না। সমস্যা হলো, এসব সমস্যা এমনভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে যে এগুলোকে আলাদা করে শনাক্ত করাও কঠিন। গণমাধ্যমগুলোও বারবার চেষ্টা করে এসব গভীরে প্রোথিত, অগোচর সমস্যাগুলোর চাইতে দৃশ্যমান খুচরা সহিংসতার দিকে ফোকাস দিতে। জিজেকের মতে, এই কাজগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে একটা ভুয়া তাড়াহুড়া ও পারস্পরিক অনাস্থা সৃষ্টি করে আসল সমস্যা থেকে নজর ফিরিয়ে রাখা। বের্টোল্ট ব্রেখটের একটা লেখায় তিনি বলছেন, ‘একটা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার তুলনায় একটা ব্যাংক ডাকাতি খুবই মামুলি অপরাধ।’ এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাই হলো জিজেকের সেই অবকাঠামোগত সহিংসতা, যা মহাসমারোহে অথচ চোখের আড়ালেই ঘটে যেতে থাকে রোজ। ব্যাংক ডাকাতি কিংবা খুনাখুনি যে কোনো অপরাধ না, বা তাতে আমরা পাত্তা দেব না তা না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই, এসব আকস্মিক বিস্ফোরণ গভীরতর কোনো সমস্যারই উপসর্গ। বের্টোল্ট ব্রেখটেরই ‘নিষ্ফলতা বিষয়ক’ নামে একটা কবিতা আছে: 

‘যে ফলগাছ কোনো ফল দেয় না
তাকে বলা হয় নিষ্ফলা। কিন্তু
মাটিটা কেউ পরখ করে দেখেছে কি?

যে ডাল ভেঙে পড়ে, তারে সহজেই
নষ্ট ডাল বলে ডাকা যায়। কিন্তু কেউ
দেখেনি কতটা তুষারের ভারে নুয়ে পড়েছিল সে?’

পোড়োজমিতে চিরকাল নিষ্ফলা গাছই জন্মাবে। জিজেকের আর্জি হলো, এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তে আসার আগে অন্তত এর গূঢ়তর কারণগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যেন আমরা হই।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার:
ভায়োলেন্স, স্লাভোয় জিজেক
সড়ক থেকে কর্মক্ষেত্র: বাংলাদেশে কাঠামোগত দুর্ঘটনা, কল্লোল মোস্তফা 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।