হোজ্জার গাধা কিংবা অবকাঠামোগত ভায়োলেন্স 

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
দৃশ্যমান সহিংসতার বাইরেও আছে পদ্ধতিগত বা সিস্টেমেটিক নানান ভায়োলেন্স । অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

গাধার পিঠে চেপে হোজ্জা প্রায়ই ইরান, গ্রিস চলে যান। প্রতিবারই গাধার পিঠে দুই বোঝা খড় চাপিয়ে নিয়ে যেতেন এবং ফিরে আসতেন পায়ে হেঁটে। প্রতিবার তাকে তল্লাশি করা হতো বেআইনি সামগ্রীর খোঁজে। কিছুই পাওয়া যেত না।

সীমান্তরক্ষীরা তখন তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী নিয়ে যান আপনি, হোজ্জা?
এর উত্তরে হোজ্জা বললেন, আমি একজন চোরাচালানি।
কয়েক বছর পর হোজ্জার অবস্থা আরও রমরমা। মিশরের উদ্দেশে রওনা দিলেন। সেখানে একদিন এক সীমান্তরক্ষী তার
সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। 
তিনি বললেন, বলুন হোজ্জা, কী করে গ্রিস ও ইরানের আইন ফাঁকি দিয়ে গেলেন আর এখানেও বেশ ভালোই আছেন।  কী চোরাচালান করতেন যে কখনোই ধরা যেত না?
হোজ্জা খুব খুশি খুশি মনে বললেন, গাধা।

হোজ্জার গাধা পাচারের কাহিনীরই একটা মডার্ন ভ্যারিয়েশন নিচের গল্পটা।
কারখানার এক শ্রমিককে সন্দেহ করা হচ্ছে যে সে কিছু একটা চুরি করছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাজ সেরে একটা হুইলব্যারো (ছোট এক চাকার ঠেলাগাড়ি জাতীয় বাহন) ঠেলতে ঠেলতে সে বের হয়ে যায়। বাইরের রক্ষীরা প্রতিবার তাকে আটকে খোঁজ করার পরেও কিছুই খুঁজে পায় না, হুইলব্যারোটায় কিছুই থাকে না। শেষমেশ আসল খবর একদিন জানা গেল। ব্যাটা আসলে হুইলব্যারোই চুরি করে রোজ।           

একদম জিজেকীয় ঢঙে, নিজের ‘ভায়োলেন্স’ বইটা স্লাভয় জিজেক শুরু করেন এই গল্পটা দিয়ে। গল্পটার মধ্য দিয়ে জিজেক সহিংসতা, তথা ভায়োলেন্সের তিনটি স্তরভেদ স্পষ্ট করে দিতে চাইছেন। সহিংসতার খুব দৃশ্যমান নজির হিসেবে আমরা বলতে পারি চুরি-ছিনতাই জাতীয় বিভিন্ন অপরাধ, নাগরিক অশান্তি অথবা নানা মাত্রার আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বের কথা। এ-জাতীয় স্পষ্ট সহিংস ঘটনা, যা ‘স্বাভাবিকতার’ ধারাবাহিকতায় ছেদ টানে, তা সাধারণত ঘটে খুবই দৃশ্যমান কোনো কর্তার হাত ধরে। এসব ক্ষেত্রে দোষী কে তা নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া খুব সহজ। এসব ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে রুষে ওঠা, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠাও সম্ভব। কিন্তু জিজেক আমাদের বলবেন একটু থেমে আরেকবার ভাবতে। উপরে যে ধরণের সহিংস ঘটনার নজির তুলে ধরলাম, সেটাকে জিজেক বলবেন ‘সাবজেক্টিভ ভায়োলেন্স।’ এর একটা মর্মানুবাদ করা যায় দৃশ্যমান সহিংসতা। এ-ধরণের সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত কে ও কীভাবে হচ্ছে, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের কারণ-টারণ বেশ স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। এই দৃশ্যমান সহিংসতা বাদেও আরো দুই ধরণের সহিংসতার কথা জিজেক উল্লেখ করছেন। একটা হলো প্রতীকী সহিংসতা, যা ভাষায় কিংবা আমাদের আচরণের গভীর অংশে প্রোথিত। আরেকটা হলো, অবকাঠামোগত সহিংসতা। আমাদের আলোচনা মূলত এই অবকাঠামোগত সহিংসতা ও দৃশ্যমান সহিংসতা নিয়েই।  

দৃশ্যমান সহিংসতা যদি স্বাভাবিকতার মসৃণ কাপড়ে একেকটা দৃষ্টিকটু চির বলে মনে হয়, তাহলে অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো সেই কাপড়ের আড়ালে ক্রমাগত সংঘটিত হতে থাকা নৃশংস ঘটনাগুলো। কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে একটা মন্তব্যের কারণে জিজেককে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বলেছিলেন হিটলারের চাইতে মহাত্মা গান্ধী বেশি সহিংস। কীভাবে? হিটলার এত এত মানুষকে খুন করেছিল কোনোরকমের বদল ঠেকাতে। যে পরিবর্তনের জোয়ার এসে ধাক্কা দিয়েছিল জার্মানিকে, সেটা রোধ করতেই হিটলার এত নির্মম কর্মকাণ্ড করতে গেছিলেন। অপরদিকে মহাত্মা গান্ধীর আপাত অহিংস কর্মকাণ্ড ছিল সমাজের খুব গভীরে গেঁথে থাকা শিকড় উপড়ে ফেলার নিমিত্তে। তাই জিজেকের বিচারে হিটলারের চাইতে বহুগুণে বেশি ‘সহিংস’ ছিল গান্ধী। এইখানেই দৃশ্যমান সহিংসতা ও অবকাঠামোগত সহিংসতার তফাত। দৃশ্যমান সহিংসতা হলো বিরূপ একটা কিছু, যা স্বাভাবিকতাকে ভঙ্গ করে। আর অবকাঠামোগত সহিংসতা হলো খোদ একটা আপাত স্বাভাবিকতাকে টিকিয়ে রাখতে যে নৃশংসতা চালানো হয় সেটা। জিজেকের ভাষায় সেটা হলো ‘স্বাভাবিকতায় অন্তর্নিহিত সহিংসতা।’ এবং এই সর্বব্যাপী, অদৃশ্য নিপীড়নের স্বভাব যদি না বোঝা যায়, তাহলে ব্যক্তিপর্যায়ের একেকটা বিচ্ছিন্ন ও আচানক সহিংস ঘটনার স্বরূপও বোঝা সম্ভব হবে না।    

 
ধরা যাক, ফার্মগেটের খোলা রাস্তায় সবার সামনে একজন কারো পেটের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। অথবা জ্যামের মধ্যে কতগুলো ছোকরা কারো গলা থেকে একটা চেইন টান দিয়ে দৌড় দিল। ধারণা করা যায় এসব ঘটনা বেশ আলোড়ন তুলবে। গণমাধ্যম বেশ আমলে নেবে, আর মানুষজন প্রতিবাদও করবে বেশ জোরেসোরে। কিন্তু ধরুন, এইযে গতবছর এক রিক্সাওয়ালা গরমকালে হঠাৎ স্ট্রোক করে রাস্তার ধারে মরে পড়ে থাকল, কিংবা কেউএকজন কাউকে কোনো কারণ না জানিয়ে আত্মহত্যা করে বসলো, অথবা সারাজীবন জঘন্য বিষাক্ত বাতাসের একটা শহরে বসবাস করে অকালেই আপনার ফুসফুস বিকল হয়ে পড়ল, তখন? এ-ধরণের ঘটনায় সহানুভূতিতে আমাদের মন ভরে উঠতে পারে, কিন্তু একটু ৎ্‌চ ৎ্‌চ করে ওঠার চেয়ে বেশি কিছু হয়তো করার মত পাব না। তার কারণ হলো, প্রথম ক্ষেত্রে দোষটা আসলে কার, কাকে ধরে সাইজ করতে হবে তা অনেক স্পষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অপরাধীটা কে তা বের করা সহজ না। এমনকি এও মনে হতে পারে যে কোনো দোষীই নেই, ব্যস এমনিতেই ঘটে গেছে। একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আদতে তা না। এ-সমস্ত ‘স্বাভাবিক’ ঘটনা হররোজ আমাদের একটু একটু করে খুন করে চলেছে, নাহয় সর্বক্ষণ মৃত্যু অথবা বড়সড় কোনো ক্ষতির ঝুঁকিতে রাখে। বিশেষ করে আমাদের দেশে এটা অনেক বেশি মাত্রায় ঘটে। ফলে মানুষের নিত্য নাগরিক জীবন হয়ে ওঠে দুঃসহ।

যেসব আকস্মিক ঘটনার কোনো পূর্বনজির নেই, আগেভাগে ঠেকানোর কোনো উপায় নেই, সেগুলোকে দুর্ঘটনা বলা চলে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় একইরকমের দুর্ঘটনা বারবার বারবার ঘটতেই থাকে, এবং সেগুলো ভবিষ্যতে যেন আর না ঘটে তা নিশ্চিত করার কোনো প্রয়াস রাষ্ট্রপক্ষের তরফ থেকে দেখা যায় না। বাংলাদেশের সড়ক ‘দুর্ঘটনার’ কথাই বলা যায়। এসব এখন আমাদের জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এখন আর কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় কারো মৃত্যুর খবর শুনলে যেন অবাকও হতে পারে না। এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে তা। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৫ হাজার ২৪ জন। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি ৪ হাজার ৪৭৫। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ৯০২ জন। বছরের পর বছর ধরে আমাদের দেশে এরকম হয়েই আসছে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শই বেখেয়ালি চালক অথবা পথচারীদেরকে দোষারোপ করা হয়। কিন্তু নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো আইন বলবৎকরণ ও দূরদর্শী পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষের আচরণকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করা যাতে এ-ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটে। ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর নিহত হন। অধ্যাপক ড. শামসুল হক সে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়ে জানান, ‘যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানকার রাস্তার বাঁকও ছিল অবৈজ্ঞানিক। ১১ ফুট প্রশস্ত ওই রাস্তায় কোনো বাঁক থাকলে রাস্তার বক্রতার ধরন অনুসারে অংশটি অন্তত ১৩ ফুট চওড়া হওয়ার কথা ছিল। বাস্তবে যা ছিল না। একই সঙ্গে বাঁকটিতে গাছপালা থাকায় দৃষ্টিসীমা ছিল একদম কম। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যেসব ব্ল্যাক স্পট ছিল, এই বাঁক তার একটি। মানিকগঞ্জের জোকায় তখন প্রতিবছর তিনটির বেশি করে দুর্ঘটনা ঘটছিল। এখন সেখানে ডিভাইডার করা হয়েছে, রাস্তা চওড়া হয়েছে, ফলে এখন আর সেখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে না।’  তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মারা যাওয়ার পর সেই মহাসড়কের এই বিপজ্জনক বাঁকগুলো ঠিক করা হয় এবং সেখানে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যায়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, দেশের আর দশটা সাধারণ মানুষের মৃত্যু নীতিনির্ধারকদের এরকম পরিবর্তন আনতে উদ্বুদ্ধ করে না। এছাড়াও দেশের রাস্তায় অসংখ্য ফিটনেসবিহীন বাস চলাচল তো করতেই থাকে, তাদের অনেক চালকের লাইসেন্সও নেই। রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে অথবা ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স আদায় করে নেয়ার চল ভালোভাবেই এখানে আছে। এমনকি এমনও অনেক ঘটে যে সশরীরে ড্রাইভিং পরীক্ষা দিতে না গিয়েই লাইসেন্স বাগিয়ে নেয় চালকেরা। এসব অনিয়ম ক্রমাগত ঘটতে দেয়া হয়, এবং এর পরিণাম সম্পর্কে যে কেউ জানে না তাও তো না। ফলে বলা চলে এমন অসংখ্য ‘দুর্ঘটনার’ মাধ্যমে এত এত মানুষের মৃত্যুর সকল বন্দোবস্ত আসলে করাই থাকে। এমন অবস্থায় দুর্ঘটনা না হলেই বরং অবাক হতে হবে। এগুলোকে দুর্ঘটনা না বলে বরং অনীহাপ্রসূত কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড বলাই বেশি যুৎসই।

সড়কের হিসাব বাদ দিলেও আরো বহুবিধ কাঠামোগত সহিংসতার শিকার বাংলাদেশের মানুষকে হতে হয়। অগ্নিকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। গতবছর ফেব্রুয়ারিতেই বেইলি রোডের একটা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৪৬ জনের। পরে জানা যায় ওই ভবনে রেস্তোরাঁ চালানোর অনুমতিই ছিল না। সেখানে আগুন লাগার ক্ষেত্রে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না। ফায়ার এক্সিট, ফায়ার অ্যালার্ম ইত্যাদি কোনো পূর্বব্যবস্থা ছিল না। ভবনটির নির্মাতা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, বিভিন্ন তলার মালিক, ব্যবসায়ী, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন প্রত্যেকেই একে অপরের উপর দায় চাপাতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। অথচ এরকম ভয়াবহ একটি ঘটনার দায় কেউই এড়াতে পারে না। একাধিক পর্যায়ে তাদের এই গাফেলতির কারণে এতগুলো মানুষ প্রাণ হারাল। তাও এই অগ্নিকাণ্ডে উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় কিছুটা মনোযোগ তা পায়। বিভিন্ন কল-কারখানার অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের মৃত্যুও একটা নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ২০১২ সালের নভেম্বরে তাজরীন ফ্যাশন্সের অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দমকল বাহিনির লোকেরা গিয়ে দেখেন সেখানকার কলাপসিবল গেট আটকে রাখা হয়েছিল কাচামাল রক্ষা করার জন্য। শ্রমিকরা সেই তালা ভাঙার, গেট ভাঙার অনেক চেষ্টা করেছিল। যারা পেরেছিল লাফিয়ে জানালা থেকে বের হয়ে গেছিল। সেই ভবনেও কোনো আগাম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাশালী নেতা হওয়ায় এত বছরেও তাজরীন ফ্যাশনের পরিচালক দেলোয়ার হোসেনের কোনো বিচারই হয়নি। রানা প্লাজার কথাও উল্লেখ করা যায়। এসবকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলা চলে না। সোজা কথায় এগুলো খুন। নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রমিকরা, যেখানে তারা দিনের বড় একটা অংশ কাটান, সেখানে এভাবে প্রতি মুহূর্তে জানের ঝুঁকিতে থাকেন।

প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা বাদেও এ দেশের নাগরিকদের পদে পদে নানাপ্রকার হেনস্থার শিকার হতে হয়। ঢাকার বাতাসের অবস্থা, যানজট, নগর পরিকল্পনা এসবই তার জন্য দায়ী। পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ফুটওভার ব্রিজের চল এখন আর নেই। বাংলাদেশে এখনো পথচারীদের সুবিধার কোনো তোয়াক্কা না করে ব্রিজে করে রাস্তা পার হতে বলে দেয়া হয়। ব্রিজগুলো একে তো হয় অনেক দূরে দূরে অবস্থিত, তারউপর বৃদ্ধ, অন্তঃসত্ত্বা বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এখানে একদমই অগ্রাহ্য করা হয়। অথচ সকলপ্রকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা না করে কোনো নগর পরিকল্পনা করা সম্ভবই না। সমস্যা হলো, এসব সমস্যা এমনভাবেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে যে এগুলোকে আলাদা করে শনাক্ত করাও কঠিন। গণমাধ্যমগুলোও বারবার চেষ্টা করে এসব গভীরে প্রোথিত, অগোচর সমস্যাগুলোর চাইতে দৃশ্যমান খুচরা সহিংসতার দিকে ফোকাস দিতে। জিজেকের মতে, এই কাজগুলোর উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে একটা ভুয়া তাড়াহুড়া ও পারস্পরিক অনাস্থা সৃষ্টি করে আসল সমস্যা থেকে নজর ফিরিয়ে রাখা। বের্টোল্ট ব্রেখটের একটা লেখায় তিনি বলছেন, ‘একটা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার তুলনায় একটা ব্যাংক ডাকাতি খুবই মামুলি অপরাধ।’ এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাই হলো জিজেকের সেই অবকাঠামোগত সহিংসতা, যা মহাসমারোহে অথচ চোখের আড়ালেই ঘটে যেতে থাকে রোজ। ব্যাংক ডাকাতি কিংবা খুনাখুনি যে কোনো অপরাধ না, বা তাতে আমরা পাত্তা দেব না তা না। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই, এসব আকস্মিক বিস্ফোরণ গভীরতর কোনো সমস্যারই উপসর্গ। বের্টোল্ট ব্রেখটেরই ‘নিষ্ফলতা বিষয়ক’ নামে একটা কবিতা আছে: 

‘যে ফলগাছ কোনো ফল দেয় না
তাকে বলা হয় নিষ্ফলা। কিন্তু
মাটিটা কেউ পরখ করে দেখেছে কি?

যে ডাল ভেঙে পড়ে, তারে সহজেই
নষ্ট ডাল বলে ডাকা যায়। কিন্তু কেউ
দেখেনি কতটা তুষারের ভারে নুয়ে পড়েছিল সে?’

পোড়োজমিতে চিরকাল নিষ্ফলা গাছই জন্মাবে। জিজেকের আর্জি হলো, এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর ব্যাপারে তাড়াহুড়া করে কোনো প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তে আসার আগে অন্তত এর গূঢ়তর কারণগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল যেন আমরা হই।

কৃতজ্ঞতাস্বীকার:
ভায়োলেন্স, স্লাভোয় জিজেক
সড়ক থেকে কর্মক্ষেত্র: বাংলাদেশে কাঠামোগত দুর্ঘটনা, কল্লোল মোস্তফা 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।