রান্নাঘরে জেন্ডার বায়াস   

images
সিমু নাসের
পলিটিকাল স্যাটায়ারিস্ট ও অধিকারকর্মী।
বাংলার পুরুষরা যেহেতু রান্নাঘরে সময় কাটায় না, কাটানোর সম্ভাবনাও নেই, সেখানে থাকে স্ত্রী বা সস্তা শ্রমের কোনো কমবয়সী/বয়সী নারী তাই তারা এই রুমটার ফাংশনালিটি ছাড়া কমফোর্ট নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

আমি জীবনের একটা সময় পর্যন্ত কখনো রান্না করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকি নাই। কেন ঢুকি নাই? এ নিয়ে একটু ভাবছিলাম সকাল থেকে। বিদেশে এলেই আমি খুব আগ্রহ নিয়ে রান্না করি কিন্তু বাংলাদেশে গেলে করি না। কেন? 

বসবাসের জন্য বিদেশ এসে হঠাৎ করে দুঃখের সঙ্গে খেয়াল করলাম, রান্নার তেমন বিশেষ কোনো জ্ঞান আমার নেই, দিয়ারও নেই। কিন্তু খেয়ে তো বাঁচতে হবে। বাইরে বাইরে খেয়ে আর কতদিন! আমাদের তো ব্যাংক লুট করা অঢেল টাকা নাই! 

একদিন রান্না করার পরিকল্পনা করার আগে আম্মার ভাত আর ডাল রান্নার পদ্ধতিটা মনে করার চেষ্টা করলাম…ভাতের শেষ পর্যায়ে মাড় গালার একটা ব্যাপার আছে আর ডালের মাঝখানে আছে ‘ছ্যাত’ করে একটা আওয়াজ হওয়ার ব্যাপার। চালে পানি দিয়ে রান্না করার শেষে গিয়ে ঢাকনা দিয়ে উপুড় করে দেখি মাড় বলে কোনো বস্তু তাতে আর নাই। ওকে, সেদ্ধ যেহেতু হয়েছে তাইলে আর চিন্তা নেই। ভাত খাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক কষ্ট করেও মনে করতে পারলাম না ডাল রান্নার কোন পর্যায়ে ‘ছ্যাত’ করে আওয়াজ করার ব্যাপারটা করতে হবে। ঢাকা আর ইউএস টাইমের এত পার্থক্য যে রাত ৩টায় আম্মাকে ঘুম থেকে তুলে ডাল রান্নার ব্যাপারে জ্ঞান নিবো সেটাও করা ঠিক হবে না মনে হলো। তেল-লবন-পেয়াজ-রসুন যা যা ঘরে ছিলো দিয়ে ডাল রান্না বসিয়ে দিলাম। খেতে মোটামুটি জঘন্য হলো। তবে সবচেয়ে বেশি রিস্ক নিলাম গরুর কলিজা (নাকি কিডনি) রান্না করতে গিয়ে। দুনিয়ার সব মসলা দিয়ে রান্না বসিয়েও দেখি উহা থেকে উৎকট হিসুর (ইউরিয়া টাইপ) গন্ধ আসছে। কোনো অবস্থাতেই সেই গন্ধ দূর করতে পারলাম না। দিয়াও বাসার চিপাচাপা থেকে আরও কিছু মসলা ঢেলে দিলো। কিন্তু পুরো বাসা দূর্গন্ধে ভরে উঠলো। শেষমেষ সেটা বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে এসে বাসার দরজা-জানালা খুলে দিয়ে গন্ধ দূর করলাম। এবং এই ঘটনার পর থেকে আমরা দুজন আর কলিজা খেতে পারি না। নাকের কাছে নিলেই সেই উৎকট গন্ধ পাই। রেডিমিক্স খিচুড়ি রান্না করতে গিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। ওয়েট ও স্পেস কমানোর জন্য বাইরের কাগজের প্যাকেট খুলে শুধু খিচুড়ির প্যাকেট নিয়ে এসেছি। ইন্সট্রাকশন তো নাই, সেটা ছিলো বাইরের রঙিন প্যাকেটে যেটা ফেলে এসেছি। এখন কয় কাপ পানি দেবো, লবন দেবো কিনা, মরিচ কি দেওয়া আছে? ফাইনালি কীভাবে সেই রেডিমিক্স খিচুড়ি রান্না হলো সেইটা আরেক কাহিনী।

দিয়া ইউটিউব খুলে বসলো। বাংলাদেশি সকল রান্নার রেসিপির ভিডিও দীর্ঘ ভিডিও। শুরুতে হাজার খানেক প্যাচাল, তারপর আরও প্যাচাল এরপর আরও প্যাচাল। আরে ডাল রান্নার টিউটোরিয়ালে এত প্যাচাল কেন ভাই!  বাগাড় দেবো কখন সেইটা বলেন। সেইটার প্রিপারেশন কী? চুলা জ্বলছে, পানি গরম হয়ে গেছে এখন কি সময় আছে আপনার প্যাচাল শোনার? অবশেষে খুঁজে খুঁজে দিয়া ‘বাংলার রান্নাঘর’ টাইপের একটা চ্যানেল বের করলো তাতে প্যাচাল কম, শর্টকাটে ২/৩ মিনিটে দেখিয়ে দেয় কীভাবে কী রান্না করতে হবে। আর আমি খুঁজতে বসলাম আমাদের দেশের ব্যবহৃত মসলাগুলোর আসলে কাজ কী? লবন বুঝলাম কিন্তু আদা আসলে কী করে, জিরার কাজ কী, রসুন কেন? বুঝতে গিয়ে বুঝলাম এইটা তো একটা দারুন জিনিস। হলুদ কেন বাংলার রান্নায় খুবই অপরিহার্য একটা বিষয় সেদিন প্রথম টের পেলাম। উহা ব্যাকটেরিয়া নিরোধক। ফ্রিজ ছিলো না আমাদের বাংলাদেশে আগে। তাই মাছ বা মাংস যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য হলুদ দিয়ে জ্বাল দিয়ে রাখা হতো। কাঁচা মরিচ কী ফ্লেভার দেয় আর কোথায় শুকনা মরিচ ব্যবহার করতে হবে…ইহা তো একটা সত্যিকারের ‘কেমিস্ট্রি’।  

আমি রান্নায় ব্যাপক আনন্দ খুঁজে পেলাম। দিয়াও তেহারি রান্নার একটা রেসিপি শিখে ফেললো। গ্যাসের চুলায় বেগুন পুড়িয়ে ভর্তা করার জটিল পদ্ধতির পরিবর্তে  আবিষ্কার করলাম একটা সহজ পদ্ধতি। বেগুন ছিলে কাটাচামচ দিয়ে অসংখ্য ফুটো করে একটা জিপলক ব্যাগে ঢুকিয়ে মাইক্রোওয়েভ ওভেনে ৮/১০ মিনিট রাখলে সেদ্ধ হয়ে যায়। এরপর সেটা ভর্তা বানিয়ে সরিষার তেল, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে ভাজলে দারুণ হয় খেতে। রসুন ছেলার সহজ পদ্ধতি হাতেকলমে শিখিয়ে দিলেন সিয়ালটলের খোকন ভাই। রসুনের কোয়ার গোড়া কেটে ছুড়ি দিয়ে ডলা দিলেই হয়। এরপর তার খোসা ছড়ানো সহজ। নিউ অর্লিয়ন্সে আমাকে একটা দেশি কাঁচামরিচের গাছ উপহার দিলেন জিনিয়া আপা। প্রতিদিন সেখানে থেকে ৫/৭টা মরিচ পাওয়া যায়।

অর্থাৎ আমি আর দিয়া তখন পুরোদমে রান্না শুরু করলাম। একসাথে রান্না করা আমরা এমন উপভোগ করা শুরু করলাম যে বলার না। প্রাথমিকভাবে গিনিপিগ হিসেবে বাসায় দাওয়াত দিতে থাকলাম আমেরিকান বন্ধু-বান্ধবদের। প্রতিটা খাবারের আমরা নতুন নাম দিলাম। খিচুড়িকে তাদের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলাম ‘রেইনি ডে রাইস’ হিসেবে। ব্যাখ্যা হিসেবে বললাম, বাংলাদেশে বৃষ্টি এলেই মানুষ ঘরের সকল রান্না রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে এই ‘রেইনি ডে রাইস’ খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়। এটা একধরনের রিচ্যুয়াল বলতে পার। সাথে আমাদের বেগুন ভাজা আর ভর্তা খেয়ে তারা মুগ্ধ। আমাদের কনফিডেন্স আরও বেড়ে গেলো। আমরা হাত দিলাম গরুর মাংস, স্যামন মাছ রান্নার দিকে। সেই প্রথম বুঝতে পারলাম, মাছ বিশেষ করে স্যামন বেশি রান্না করলে ইটের মতো শক্ত হতে থাকে। খেতে গিয়ে চাপা ব্যাথা হয়ে যায়। রান্নার সময় তাপের বেসিক যে সূত্র অর্থাৎ জ্বাল দিলেই সবকিছু নরম হয়, সেটা নাও হতে পারে।

আমাদের কনফিডেন্স এমন বেড়ে গেলো যে বিদেশের বিভিন্ন শহরে আমরা যেসব লোকাল হোস্টদের বাসায় ‘কাউচসার্ফিং’-এর মাধ্যমে থাকতাম তাদের একটা করে ডিশ রান্না করে খাওয়াতে শুরু করলাম। রীতিমতো স্থানীয় কাঁচাবাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে রান্না। আমরা শিখে ফেললাম মিষ্টি কুমড়ার স্যুপ কীভাবে বানাতে হয়, চিকেন যে রান্নার বদলে ভর্তা করে খেতে বেশি মজা সেটাও প্রচার করতে শুরু করলাম। আমি বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করলাম সেদ্ধ আলু, সবজি আর ডিমের একটা রেসিপিতে। একদমই আমার নিজের রেসিপি, দশে এগারো মার্ক পাওয়ার মতো রান্না।  

করোনায় আমরা ঢাকায় এসে আটকা পড়ে গেলাম। একটা বাসা ভাড়া নিয়ে নিজেরা রান্না করতে গিয়ে দেখি রান্নায় ঠিক সেই আনন্দ আর পাচ্ছি না। আমি আর দিয়া দুজনেই বেশ কয়েকবার ট্রাই করলাম। উহু হচ্ছে না। কঠোর লকডাউনের মাঝেও অর্ডার করেই খেতে হচ্ছে। হলোটা কী? 

ভাবতে গিয়ে কয়েকটা জিনিস খেয়াল করলাম। বিদেশের যেসব বাসায় আমরা থেকে রান্না করা উপভোগ করেছি সবগুলোই ওপেন কিচেন ধরনের। খোলামেলা। একজন পেঁয়াজ-সবজি কাটছি তো আরেকজন নাড়া দিচ্ছি। জায়গার সমস্যা নেই। স্পিকারে বাজছে গান বা অডিও বুক বা পডকাস্ট। অথবা সামনেই টিভিতে চলছে কোনো হালকা সিরিজ। চুলার উপরেই শক্তিশালী ভেন্ট। এসি বা ফ্যান থাকায় আরামদায়ক আবহাওয়া। উঁচু টুলে বসার ব্যবস্থা বা সোফায় গিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। এবার ঢাকার বাসার রান্নাঘরগুলোর দিকে একটু তাকাই। রান্নাঘরটা থাকে বাসার সবচেয়ে ঘুপচির মাঝে। ছোট্ট। আলাদা একটা রুম। সেখানে এসি বা ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। ড্রয়িংরুমের মূল বিনোদন কেন্দ্র থেকে দূরে। পুরাই আইসোলেটেড। উত্তর-দক্ষিমুখী বাসা হলে রান্নাঘর হয় প্রায়ই পশ্চিম দিকে। সেদিকে বাংলাদেশের সূর্য্য সবচেয়ে বেশি তাপ দেয়।

বাংলার পুরুষরা যেহেতু রান্নাঘরে সময় কাটায় না, কাটানোর সম্ভাবনাও নেই, সেখানে থাকে স্ত্রী বা সস্তা শ্রমের কোনো কমবয়সী/বয়সী নারী তাই তারা এই রুমটার ফাংশনালিটি ছাড়া কমফোর্ট নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

মনে পড়লো জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ রোমেন রায়হানের একটা গবেষণার কথা। শহরের নারীরা গ্রামের তুলনায় রান্নাজনিত বায়ুদূষনের শিকার বেশি হয়। গ্রামের রান্নাঘরগুলো তাও একটু ভেন্টিলেশন থাকে কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের রান্নাঘরগুলোতে  কিচেন হুড নাই, নাই প্রপার ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। জানালা যাও থাকে সেটাও হয়তবা ঠিকমতো খোলা যায় না। এছাড়া গরমের দিন রান্নাঘর হয়ে উঠে একটা নরক। পাশাপাশি ফ্রিজের পেছন দিক দিয়ে বের হওয়া গরম বাতাস তো আছেই।   

আর বাসার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা কোনটা? ড্রয়িংরুম। সেখানে টিভি থাকে, থাকে সোফা। সেখানে অফিস শেষে ‘ক্লান্ত পুরুষটি’ বাসায় এসে একটু আরাম করে। আর এই রান্নাঘরটিতে যেহেতু পুরুষরা খুব একটা সময় কাটায় না, তাই তাদের এটার আরাম নিয়েও কোনো ভাবনা নেই। আর পুরো ব্যাপারটিরই আর্কিটেকচারাল নকশা করে থাকেন সাধারণত একজন পুরুষ আর্কিটেক্ট।

বাংলার পুরুষরা যেহেতু রান্নাঘরে সময় কাটায় না, কাটানোর সম্ভাবনাও নেই, সেখানে থাকে স্ত্রী বা সস্তা শ্রমের কোনো কমবয়সী/বয়সী নারী তাই তারা এই রুমটার ফাংশনালিটি ছাড়া কমফোর্ট নিয়ে তেমন একটা ভাবেন না। একজন আর্কিটেক্টের সাথে এ নিয়ে একবার কথা বলেছিলাম, তিনি বলেছিলেন, আমাদের উপমহাদেশের রান্নায় প্রচুর মসলা ব্যবহার হয় বলে রান্নার সময় প্রচুর স্পাইসিনেস ছড়িয়ে পড়ে, তাই হয়তবা আলাদা একটা রুমে কিচেনের চিন্তাভাবনা গড়ে উঠেছে। কিন্তু আমার ধারণা বিদেশী বাসার আর্কিটেক্টরাও একসময় ভাবতো না। নিউ অর্লিয়েন্সের কিছু পুরোনো বাসায় গিয়ে আমি দেখেছি প্রায় কাছাকাছি ঘুপচি রান্নাঘর। তারা তো কখনোই স্পাইসি রান্না করতো না। কিন্তু যখনই পুরুষদেরও রান্নাঘরে আসার প্রয়োজন হলো তারা ওপেন ও কমফোর্ট বেজড ডিজাইনের দিকে আগাতে থাকলো নিজের কমফোর্টের জন্য। একটু বিয়ার খেতে খেতে, একটু টিভির বড় পর্দায় খেলা দেখতে দেখতে রান্না করবে ইত্যাদি। আরও খেয়াল করলাম দেশের রান্নাঘর-বাথরুম থেকে শুরু করে সবকিছুই তীব্রভাবে পুরুষের সুবিধার জন্য ডিজাইন করা। বিশেষ করে সুস্থ-সবল পুরুষের জন্য। আমি নিশ্চিত বাংলার পুরুষরা যেদিন থেকে আস্তে আস্তে রান্নাঘরে ঢোকা শুরু করবে সেদিন থেকে বাংলার রান্নাঘরের কমফোর্টও বাড়তে থাকবে, ডিজাইনও চেঞ্জ হবে।

আরও দ্রুত চেঞ্জ হবে যদি নারী আর্কিটেক্টদের এই পেশায় সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারি আমরা, তারাও যদি সমান তালে বাসাবাড়ি ডিজাইন শুরু করতে পারে। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।