মোল্লা নসরুদ্দীনের অর্থনীতি 

Akbar ali khan
আকবর আলি খান
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
মোল্লা নসরুদ্দিনের কৌতুককর কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে অর্থশাস্ত্রের অনেক শিক্ষা। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

‘খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর’; আমি খুঁজে বেড়াই অর্থনীতিবিদ। মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন, তার চেয়েও অনেক বেশি শক্ত হল মনের মতন অর্থনীতিবিদের হদিস। অর্থনীতিবিদদের মতের ও পথের শেষ নেই। কথায় বলে, যেখানে দু’জন অর্থনীতিবিদ্ রয়েছেন, সেখানে দুটো নয় তিনটে মত দেখা যাবে। এমনকি যেখানে একজন অর্থনীতিবিদ্ রয়েছেন সেখানেও একাধিক মত দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান বলতেন, তিনি এমন অর্থনীতিবিদ্ চান না যার দুটো হাত রয়েছে; তাঁর দরকার এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ্। ট্রুম্যান সাহেবের এ অদ্ভুত বায়নার অবশ্য কারণ আছে। যখনই কোন সমস্যা সম্পর্কে তিনি অর্থনীতিবিদের মতামত জানতে চেয়েছেন তখনই তিনি জবাব পেয়েছেন, ‘On the one hand’ (এক দিকে) এটা ঘটতে পারে, ‘On the other hand’ (আর এক দিকে) অন্য রকমের সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রুম্যান সাহেব তাই মনে করতেন, অর্থনীতিবিদের দুটো হাত থাকলেই বিপদ, কেননা তার কাছ থেকে সুস্পষ্ট কোন সুপারিশ পাওয়া যাবে না।

অর্থনীতিবিদগণ শুধু দ্ব্যর্থক ও অস্পষ্ট উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন না। তাঁদের অনেকেই ক্ষণে ক্ষণে মত বদলান। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল বিংশ শতাব্দীর সেরা অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস। এত ঘন ঘন মত বদলানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল। লর্ড সাহেব উত্তর দেন, তিনি নষ্ট ঘড়ির কাঁটা নন যা দিনে দু বার মাত্র সঠিক সময় দেয়। তিনি দাবি করেন, তিনি হচ্ছেন একটি চলন্ত ঘড়ি, তাঁর কাঁটাও তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে পরিবর্তিত হয়। লর্ড কেইনসের মত দ্রুত পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা আমার মত গোবেচারার পক্ষে কষ্টকর। লর্ড কেইনসের তুলনায় মোল্লা নসরুদ্দীনকে তাই আমার অনেক বেশি পছন্দ। কথিত আছে, এক ব্যক্তি মোল্লার কাছে তাঁর বয়স জানতে চেয়েছিল। মোল্লা বললেন যে, তাঁর বয়স চল্লিশ। উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, দশ বছর আগেও মোল্লা বলেছেন তাঁর বয়স চল্লিশ; কাজেই দশ বছর পরে তাঁর বয়স চল্লিশ হওয়া সম্ভব নয়। মোল্লা জবাব দেন, তিনি এক কথার মানুষ; কয়দিন পর পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন না। কাজেই দশ বছর আগে তিনি যা বলেছেন আজও একই কথা বলছেন। এ ধরনের অর্থনীতিবিদরাই হলেন ট্রুম্যান সাহেবের এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ। আমার মনের মতন অর্থনীতিবিদ।   

সভ্যতার ইতিহাসের সুদীর্ঘ পটভূমিতে অর্থনীতি একটি অর্বাচীন শাস্ত্র। গণিত, দৰ্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি শাস্ত্র কমপক্ষে অর্থনীতির দু’হাজার বছর আগে জন্ম নিয়েছে। এডাম স্মিথের ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’  বইটির প্রকাশনার তারিখ ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দকে সাধারণত অর্থনীতির জন্মলগ্ন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এর প্রায় পাঁচশ বছর আগে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কের খোর্তো গ্রামে নসরুদ্দীন খোজার জন্ম। তিনি শুধু সুপণ্ডিত ও সুকবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ইমাম। পাশ্চাত্য জগতে তিনি তাই মোল্লা হিসাবে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতকের মোল্লার পক্ষে আজকের অর্থনীতিবিদদের মত পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রণয়ন সম্ভব ছিল না। মোল্লার সময়ে শাস্ত্র হিসেবে অর্থনীতির জন্ম হয়নি বটে, কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে মোল্লার জন্মের অনেক আগেই দার্শনিকগণ চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। মোল্লার জন্মের আঠারো শ বছর আগে গ্রীক দার্শনিকগণ অর্থনীতির মৌল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। গ্রীক দার্শনিকগণ অর্থনীতি সংক্রান্ত যে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি, মোল্লা নসরুদ্দীন তাঁদের অনেকগুলি সমাধান করেছেন। এরিস্টটলের কাছে বাজারের মূল্য নির্ধারণ-পদ্ধতি ছিল একটি প্রহেলিকা। তিনি বলতেন যে, জল-যার অপর নাম জীবন তা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, অথচ হীরক – যার কোন প্রত্যক্ষ উপকারিতা নেই, বাজারে অতি চড়া দামে বিক্রি হয়। গ্রীক দার্শনিকদের মতে তাই বাজারের মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি হল অন্যায্য। মোল্লা নসরুদ্দীনের কাছে মূল্য-নির্ধারণ ব্যবস্থা দুর্জ্ঞেয় রহস্য বলে মনে হয়নি। এ সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের একটি গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি মোল্লা নসরুদ্দীনের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে চায়। মোল্লা তাকে বললেন যে, সত্য সম্পর্কে জানতে হলে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে। হবু শিষ্য বললেন যে, সত্য জানার জন্য কেন এত বেশি দাম দিতে হবে তা বুঝতে সে অক্ষম। মোল্লা তাকে বললেন, ‘সত্য হল দুষ্প্রাপ্য এবং সকল দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যই চড়া দামে কিনতে হয়।’ 

অর্থনীতি সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রাচীন ও আধুনিক – উভয় ধরনের অর্থনীতিবিদদের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। আধুনিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ হল গণিত—ভিত্তিক। প্রাচীন অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ ছিল দর্শনভিত্তিক। মোল্লা নসরুদ্দীন গণিতবিদও ছিলেন না, আনুষ্ঠানিকভাবে দার্শনিকও ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য বেঁচে আছে কতগুলি মশকরা ও মজার গল্পে। অবশ্য হাসতে হাসতে মোল্লা যা বলে গেছেন আজকের অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা অনেক পরিশ্রম করেও তার চেয়ে খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেননি।   

অর্থনীতি সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের জ্ঞান ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। পদ্ধতিগত দিক থেকে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মোল্লার আস্থা ছিল না, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জ্ঞান অর্জন করতেন। এ সম্পর্কে একটি সুন্দর কাহিনী রয়েছে। মোল্লা একবার একটি গলির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি লোক ছাদ থেকে মোল্লার ঘাড়ের উপর পড়ে। যে লোকটি পড়ে তার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। মোল্লাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে মোল্লার অবস্থার উন্নতি হলে শিষ্যরা জানতে চান, এ ঘটনা থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। মোল্লা জবাব দেন, ‘কার্যকারণের অবশ্যম্ভাবিতায় বিশ্বাস করো না। ছাদ থেকে পড়লো লোকটা; ঘাড়টা ভাঙল আমার। ভবিষ্যতে এই ধরনের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে কখনও পৌঁছবে না, যে কোন লোক ছাদ থেকে পড়লেই তার নিজের ঘাড় ভাঙবে।’  

আধুনিক অর্থনীতিতে আমরা অনেক নতুন নতুন তত্ত্ব শিখছি। কিন্তু এ সকল তত্ত্ব সবই মৌলিক তা মনে করা ঠিক হবে না। একজন দার্শনিক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, মৌলিকতা হচ্ছে ধরা না পড়ে অন্যের ভাব চুরি করা। প্রকৃতপক্ষে সকল নতুন তত্ত্বেরই বীজ সংগৃহীত হয় পূর্ববর্তীদের নিকট থেকে। স্যার আইজাক নিউটন তাই বলতেন : ‘If I have been able to see farther than others, it was because I stood on the shoulders of giants.’  (আমি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে দেখে থাকি, তার কারণ হল আমি অস্বাভাবিক বড় মাপের মানুষের কাঁধের উপর দাঁড়িয়েছিলাম।) আজকের অর্থনীতিবিদরাও তেমনি অনেক ধারণাই গ্রহণ করেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের মানুষদের কাছ থেকে। মোল্লা নসরুদ্দীনের চুটকিগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা শুধু নির্মল আমোদই লাভ করি না, আমরা তাঁর ভূয়োদর্শন থেকেও জ্ঞান লাভ করি। ভালভাবে তলিয়ে দেখলে মোল্লা নসরুদ্দীনকে দু’ধরনের অর্থনৈতিক তত্ত্বের পথিকৃত বলে মনে হয়।
প্রথমত, মোল্লা অর্থনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কে অনেক মূল্যবান বক্তব্য রেখে গেছেন।
দ্বিতীয়ত, মহাজনদের আচরণ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। মহাজনদের আচরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আজকের বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মোল্লার হাসির গল্পগুলি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আচরণ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে অতি সহায়ক।   

অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

প্রথমে ঝুঁকি নিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ঝুঁকির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল risk ইংরেজী ভাষায় risk-এর শাব্দিক অর্থ হল সাহস করা। এ সাহস দেখানো হয় যা অজানা বা অনিশ্চিত তার ক্ষেত্রে। সবচেয়ে অনিশ্চিত হল ভবিষ্যত। প্রাচীনকালে সবাই মনে করত যে, ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের কিছুই করার নেই। ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রিত হয় দেবদেবতাদের খেয়ালখুশিতে। যে সব দার্শনিক অজানা ভবিষ্যতের ঝুঁকির রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে এগিয়ে আসেন তাঁরা সত্যিই ছিলেন অত্যন্ত দুঃসাহসী তাত্ত্বিক। পিটার এল বার্নস্টাইন (Peter L. Bernstein) নামে একজন বিশেষজ্ঞ ঝুঁকি সম্পর্কিত তত্ত্বের একটি ইতিহাস লিখেছেন। বইটির তিনি নাম দিয়েছেন ‘Against the Gods : the Remarkable Story of Risk’ (বিধাতার বিপক্ষে : ঝুঁকির অসামান্য কাহিনী)। বার্নস্টাইনের মতে গ্রীক লোককাহিনীর নায়ক প্রমিথিউস যেমন দেবতাদের অমান্য করে অন্ধকার থেকে আলো ছিনিয়ে এনেছে, ঝুঁকি সম্পর্কিত তাত্ত্বিকরা তেমনি তমসাবৃত ভবিষ্যতের রহস্য ভেদ করে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বার্নস্টাইনের ইতিহাসে ঝুঁকি সম্পর্কিত বিশ্লেষণের পথিকৃতদের তালিকায় মোল্লা নসরুদ্দীনের নাম নেই। তার তালিকা শুরু হয়েছে সপ্তদশ শতকের ফরাসী ভূস্বামী শেভালিয়ে দ্য মেয়ার (Chevalier de Mere)-এর নাম দিয়ে। এ তালিকায় রয়েছে সপ্তদশ শতকের পাসক্যাল ও ফারম্যাট, অষ্টদশ শতকের লাইবনিজ, আব্রাহাম দ্য মোয়াভ (Abraham de Moivre), ও বার্নোলি (Bernoulli)। ত্রয়োদশ শতকের মোল্লা নসরুদ্দীন কিন্তু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মূল বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহ অনেক আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদ মার্কভিজ (Markowitz) ১৯৫২ সালে তাঁর পত্রকোষ বা portfolio তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। পত্রকোষ বা portfolio-এর শাব্দিক অর্থ হল একজন ব্যক্তির সকল কাগুজে সম্পদের (যথা শেয়ারের কাগজ) সংগ্রহ (যা সাধারণত একটি ‘পোর্টফোলিও’ ব্যাগের মধ্যে রাখা হয়)। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, এক ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ করা হলে যদি এ সম্পদের দাম কমে যায় তবে বিনিয়োগকারী ফতুর হয়ে যাবে। এক ঝুড়িতে সকল ডিম রাখা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয় তেমনি এক ধরনের সম্পদে – যা আপাতদৃষ্টিতে যত লাভজনকই হোক না কেন, বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কভিজের পরামর্শ হল সম্পদের বৈচিত্র্যায়ন (diversification) হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ পথ। এ তত্ত্ব পত্রকোষ বা portfolio theory নামেও পরিচিত।   

মার্কভিজের প্রায় সাতশ বছর আগে মোল্লা নসরুদ্দীন ঝুঁকি বৈচিত্র্যায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। মোল্লা নিজের জীবনেও তাঁর চর্চা করেছেন। মোল্লার দুই মেয়ে ছিল। তিনি একজনকে বিয়ে দেন চাষীর সাথে, অন্য মেয়ের বিয়ে দেন ইটের ভাটার মালিকের সাথে। ভালো বৃষ্টি হলে চাষীর ঘরণী আরামে থাকত। আর বৃষ্টি না হলে বা কম হলে ইটের ভাটার মালিকের স্ত্রীর থাকত রমরমা অবস্থা। বৃষ্টি কম হোক আর বেশি হোক মোল্লার এক কন্যা অন্তত ভাল অবস্থাতে থাকত। অবশ্য বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক পরিবারই মোল্লার চেয়েও অনেক বেশি চালাক। এ ধরনের পরিবার এক ছেলেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে ভর্তি করে আর অন্য ছেলেদের বিরোধী দলের সমর্থক করে রাখে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও কোন না কোন ছেলে ক্ষমতাসীন থেকে যায়। 

মোল্লা বৈচিত্র্যায়নে এত গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি এ তত্ত্ব পরকালের ক্ষেত্রে পর্যন্ত প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। ইদ্রিস শাহ তাঁর ‘The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasruddin’ গ্রন্থে নিম্নরূপ কাহিনী বর্ণনা করেছেন—  

একজন ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অসুস্থ ছিলেন। তিনি শুনেছিলেন যে নসরুদ্দীন একজন মরমি সাধক। অর্ধচেতন অবস্থায় তাঁর কাছে মনে হল এ খবর হয়ত সত্যি। তিনি মোল্লাকে ডেকে পাঠালেন।  

তিনি বললেন, ‘হে মোল্লা, আপনার সুনাম রয়েছে যে অন্য জগতের সাথে আপনার যোগাযোগ রয়েছে। আপনি আমাকে এমন একটি মন্ত্র দিন যাতে আমি বিনা যন্ত্রণায় অন্য জগতে যেতে পারি।’  

নসরুদ্দীন বললেন, ‘এতো খুশির সাথেই করব। এই হল আপনার মন্ত্র : বিধাতা আমাকে সাহায্য কর, অসুর আমাকে মদদ দাও।’ 

স্তম্ভিত হয়ে লোকটি তাঁর অসুখের কথা ভুলে গিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘মোল্লা নিশ্চয়ই আপনার মাথা খারাপ হয়েছে।’ 

মোল্লা জবাব দিলেন, ‘প্রিয় বন্ধু, আপনার কথা মোটেও সত্য নয়। আপনার যা অবস্থা, আপনি ঝুঁকি নিতে পারেন না। যখন দুটি বিকল্প রয়েছে, তখন দুটি বিকল্পের জন্যই বন্দোবস্ত রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।’   

স্পষ্টতই মোল্লা এখানে ঝুঁকি বৈচিত্র্যায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে মোল্লা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। পার্থিব বৈচিত্র্যায়ন তত্ত্ব পরকালের ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। যারা ধার্মিক তাদের কাছে পরকালের কোন বিকল্প নেই। কাজেই একই সাথে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। অবশ্য মোল্লা নিজে পরকাল সম্পর্কেও খুব নিশ্চিত ছিলেন না। মোল্লা মরার আগে নাকি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে, মরার পর তাঁকে নতুন কবরে সমাহিত না করে পুরাতন কবরে যেন তাঁর লাশ রাখা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা তাঁর এই অদ্ভুত অনুরোধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, পুরানো কবরে ফেরেশতারা আসলে বলে দেওয়া সম্ভব হবে যে, কবরে সমাহিত ব্যক্তির ইতোমধ্যে সাজা হয়ে গেছে। কাজেই ফেরেশতারা শাস্তির ব্যবস্থা না করেই চলে যাবে। তাতে অন্তত কেয়ামত পর্যন্ত তিনি শাস্তির হাত থেকে বাঁচবেন। 

তবে মোল্লার ঝুঁকি-বৈচিত্র্যায়ন সম্পর্কিত পরামর্শ পরকালের জন্য প্রযোজ্য না হলেও ইহকালের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বিনিয়োগ, ব্যবসা, বাণিজ্য এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যায়ন ঝুঁকি হ্রাসের একটি কার্যকর উপায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, পরিবেশের জন্যও বৈচিত্র্যায়ন শুধু কল্যাণকরই নয় অত্যন্ত জরুরীও বটে। সম্প্রতি কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল বীজ চাষ করতে গিয়ে অল্প কয়েকটি জাতের ধান ও গম চাষ হচ্ছে। এ সব বীজের ফলন চিরাচরিত জাতের চেয়ে বেশি সন্দেহ নেই। কিন্তু অল্প কয়েকটি জাতের বীজের উপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন প্রজাতির বীজ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। কাজেই নানাবিধ প্রজাতির বীজের চাষ করলে বন্যা ও খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসলের ক্ষতি কম হয়। এক ধরনের উচ্চ ফলনশীল বীজ চাষ করলে একবার কীট পতঙ্গের উপদ্রব হলে সকল ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভিন্ন ভিন্ন জাতের বীজ চাষ করলে এক ধরনের পোকা সব ধরনের ফসলের ক্ষতি করতে পারে না। বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে সকল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকাই হল বুদ্ধিমানের কাজ।   

৭০০ বছর আগে মোল্লা যখন মারা যান তখন বিশ্ব ব্যাংক অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কথা কেউ কল্পনা করেনি। এমনকি ওয়াশিংটন শহরে –যেখানে প্রতিষ্ঠান দুটির সদর দফতর অবস্থিত–সেখানে কোন শহরই ছিল না, আদৌ কোন বসতি ছিল কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু মোল্লা বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল না দেখলেও অনেক মহাজন দেখেছেন। মহাজনদের আচরণ জানতে পারলেই এ দুটো প্রতিষ্ঠানের নিয়ম নীতি আঁচ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মোল্লার একটি কাহিনী মনে পড়ছে। কথিত আছে মোল্লা নসরুদ্দীনের একটি হাতি দেখে খুবই পছন্দ হয়। তিনি হাতিটি কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনের দোরে গিয়ে হাজির হলেন।
মোল্লা মহাজনকে বললেন, ‘আমাকে কিছু টাকা ধার দিন।’
মহাজন বললেন, ‘কেন?’ মোল্লা জবাব দিলেন, ‘আমি একটি হাতি কিনতে চাই।’
মহাজন প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার যদি টাকা না থাকে তুমি হাতি পালবে কি করে?’
মোল্লা আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি আপনার কাছে টাকার জন্য এসেছি, উপদেশের জন্য নয়।’  

যে কোন উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে মোল্লার আক্ষেপই শোনা যাবে। এইত কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করতে মস্কো যান। আলোচনার পর সাংবাদিকগণ রাশিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। প্রিমাকভ সাংবাদিকদের জানান যে, তিনি আশা করেছিলেন, মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় তাঁর ব্রীফ কেস ভর্তি করে ডলার নিয়ে এসেছেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর ব্রীফ কেস ভর্তি করে নিয়ে এসেছেন শর্তের কাগজপত্র। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তাবলী স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন। একটু নমনীয় হলেও বিশ্ব ব্যাংকও একই পথের পথিক।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তসমূহকে শর্তনির্ভরশীলতা বা conditionality বলা হয়ে থাকে। শর্তনির্ভরশীলতাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নসিহত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একজন বিশেষজ্ঞের মতে শর্তনির্ভরশীলতা হল সে সব নীতি যা অনুসরণ করলে তহবিলের সাহায্য প্রদান করা হয়। মোল্লার মহাজনের উপদেশ না শোনার অধিকার ছিল, অনুন্নত দেশসমূহের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ না শোনার জো নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলে অন্য দাতাদের সাহায্যও কমে যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মনে করে যে, তার নির্ধারিত শর্তাবলী শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ সব শর্ত বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য সামগ্রিকভাবে হিতকর। অবশ্য মুদ্রা তহবিলের সমালোচকরা এ মতের সাথে মোটেও একমত নন। তাঁরা বলেন যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সকল দেশের জন্য একই দাওয়াই দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এ দাওয়াই রোগের চেয়েও খারাপ। শর্তাবলীর মধ্যে সাধারণত থাকে সরকারের ব্যয়-হ্রাস, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কর-সংস্কার, বেসরকারীকরণ, বাণিজ্য সংস্কার এবং জ্বালানি ও কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের সংস্কার অর্থনৈতিক সংকোচনের জন্ম দেয়। অর্থনীতিবিদ্রা এ ধরনের ব্যবস্থাকে কল্যাণকর মনে করতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিবিদদের মতে এসব সংস্কার হচ্ছে রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল। রাজনীতিবিদগণ তাই এ ধরনের তেতো ওষুধ গিলতে চান না। এর ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি নতুন দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন প্রাক-কর্মসূচী শর্তনির্ভরশীলতা (upfront conditionality)। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে সম্মত কর্মসূচী গ্রহণের আগেই এ ধরনের শর্ত পালন করতে হয়। অবশ্য এ ধরনের শর্তনির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আবিষ্কার করেনি। এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই মোল্লা সাহেব চিন্তা করে গেছেন। মোল্লা একবার একটি ছোট ছেলেকে একটি পাত্রে কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে বলেন। ছেলেটির হাতে পাত্রটি তুলে তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘খেয়াল রেখো পাত্রটি যাতে কোন মতেই না ভাঙে’ এবং তার পরেই ছেলেটিকে থাপ্পড় মারলেন। ঘটনার সময় অন্য এক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তিনি মোল্লার কাছে জানতে চাইলেন যে, মোল্লা কেন বিনা কারণে ছেলেটিকে আঘাত করলেন। মোল্লা বললেন, ‘আহাম্মক, তুমি বুঝতে পারছ না, পাত্রটি ভাঙ্গার পর ছেলেটিকে শাস্তি দিয়ে কোন লাভ হবে না। কাজেই আগে শাস্তি দিলাম।’ মোল্লার মত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পাত্র ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়, তারা আগেই স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে থাপ্পড় মারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নীতিমালার সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলো কখনও একাত্ম হতে পারে না। এরা ভালো উপদেশ দিলেও উন্নয়নশীল দেশসমূহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সন্দেহ করে।       

আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনও এ কথা স্বীকার করে না যে তারা মহাজন। কিন্তু মোল্লা মহাজনদের যে সব লক্ষণ বর্ণনা করেছেন তার সবই রয়েছে এ সব প্রতিষ্ঠানের। তাই এ সব প্রতিষ্ঠান দেখলে তিনি হয়ত মোটেও অবাক হতেন না। মাংস চুরি হওয়ার পর মোল্লা তাঁর স্ত্রীকে যে প্রশ্ন করেছিলেন হয়ত আজ বেঁচে থাকলে একই ধরনের প্রশ্ন তিনি করতেন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে। মোল্লার মাংস চুরির গল্পটি হচ্ছে নিম্নরূপ : 
বাজারে গিয়ে মোল্লা খুব ভালো মাংস পেয়ে খুশি হয়ে এক সের মাংস নিয়ে বাড়িতে আসেন। এসেই স্ত্রীকে মাংসটা ভালো করে রান্না করার নির্দেশ দিলেন। মোল্লার স্ত্রী মাংস রান্না করলেন। কিন্তু রান্না করা মাংস চেখে তাঁর এত ভাল লাগল যে তিনি নিজেই পুরো মাংসটা খেয়ে ফেললেন। মোল্লা খেতে এসে যখন মাংস চাইলেন তখন তার স্ত্রী বললেন যে, মাংস বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। মোল্লা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিড়াল কি পুরো মাংসই খেয়েছে?’ মোল্লার স্ত্রী বললেন যে, পুরো মাংসই বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। বিড়ালটা কাছেই ছিল। নসরুদ্দীন সেটাকে দাঁড়ি পাল্লায় চড়িয়ে দেখলেন যে বিড়ালটির ওজন ঠিক এক সের। ‘এটাই যদি সেই বিড়াল হয়’, মোল্লা বললেন, ‘তাহলে মাংস কোথায়? আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তাহলে বিড়াল কোথায়?’ 

গত পঞ্চাশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উন্নয়নের নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা যদি মোল্লা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি হয়ত তৃতীয় বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি দেখিয়ে বলতেন, ‘এই যদি উন্নয়ন হয়, তবে বিনিয়োগকৃত অর্থ কোথায়, আর এই যদি বিনিয়োগ হয়, তবে উন্নয়ন গেল কোথায়?’   

আজকের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মোল্লা নসরুদ্দীনের গাল-গল্পকে অর্থনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে মানতে চাইবেন না। পক্ষান্তরে মোল্লা যদি আজকে জীবিত থাকতেন তিনি ও হয়ত পেশাদারদের গাণিতিক অর্থনীতিকে বাস্তব হিসাবে স্বীকার করতেন না। তিনিও হয়ত গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডি (G. H. Hardy)-এর সাথে সুর মিলিয়ে বলতেন, ‘একজন গণিতজ্ঞ হচ্ছেন সে ধরনের ব্যক্তি যিনি কি সম্পর্কে বলছেন তা জানেন না ও তার পরোয়াও করেন না’। গণিতজ্ঞের কাজ হচ্ছে সঠিকভাবে অঙ্ক করা, ফলাফল নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। গণিতজ্ঞের কোন লক্ষ্য নেই, কোন দায়দায়িত্ব নেই, পদ্ধতি সঠিক হলেই তিনি সন্তুষ্ট। যে সব অর্থনীতিবিদ গণিতের ভিত্তিতে তাঁদের তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলছেন তাঁদের অনেকেই গণিতজ্ঞদের ত্রুটিতে সংক্রমিত হয়েছেন। তাঁদের গণিত নির্ভুল হতে পারে; কিন্তু তাঁদের তত্ত্ব সঠিক নয়।   

আজকের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন যে, একমাত্র তাঁদের পেশাদারী জ্ঞান প্রয়োগ করলেই উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। অবশ্য তাঁরা ভুলে যান যে, টাইটানিক জাহাজ সে সময়ের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞরা নির্মাণ করেছে এবং প্রথম সমুদ্র যাত্রাতেই জাহাজটি ডুবে যায়। আর হজরত নূহ (আঃ)-এর কিস্তি তৈরি করেছিল আনাড়িরা; নূহের কিস্তি কিন্তু শত ঝড় ঝঞ্ঝাতেও ডোবেনি। সেনাপতিদের সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ যে শুধু সেনানায়কদের কাছে যুদ্ধ সম্পর্কে সকল সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। অর্থনৈতিক সমস্যাও এত গুরুত্বপূর্ণ যে তা শুধু পেশাদার অর্থনীতিবিদদের কাছে ছেড়ে রাখা সম্ভব নয়। মোল্লা নসরুদ্দীনের মত চিন্তাবিদদের আজকের দিনেও তাই আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। 

.

তথ্যসূত্র 

১. সৈয়দ মুজতবা আলী, চতুরঙ্গ (ঢাকা : ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৮৯), পৃষ্ঠা ২৮ 

২. Peter, Lawrence J., Peter’s Quotations (New York : Quill, 1977), p. 437

৩. Bernstein, Peter L., Against the Gods: The Remarkable Story of Risk (New York: John Wiley and Sons, 1996 ) 

৪. Shah, Idries, The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasruddin (New York: E. P. Datton & Co, 1968), p. 91 

৫. Bright, Chris, Life Out of Bounds (New York: W. W. Norton & Company, 1998) 

৬. Guitian, Manuel, Fund Conditionaity (Washington : IMF, 1986) 

থেকে আরও পড়ুন

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।