মোল্লা নসরুদ্দীনের অর্থনীতি 

Akbar ali khan
আকবর আলি খান
শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ
মোল্লা নসরুদ্দিনের কৌতুককর কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে অর্থশাস্ত্রের অনেক শিক্ষা। অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

‘খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ পাথর’; আমি খুঁজে বেড়াই অর্থনীতিবিদ। মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন, তার চেয়েও অনেক বেশি শক্ত হল মনের মতন অর্থনীতিবিদের হদিস। অর্থনীতিবিদদের মতের ও পথের শেষ নেই। কথায় বলে, যেখানে দু’জন অর্থনীতিবিদ্ রয়েছেন, সেখানে দুটো নয় তিনটে মত দেখা যাবে। এমনকি যেখানে একজন অর্থনীতিবিদ্ রয়েছেন সেখানেও একাধিক মত দেখা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান বলতেন, তিনি এমন অর্থনীতিবিদ্ চান না যার দুটো হাত রয়েছে; তাঁর দরকার এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ্। ট্রুম্যান সাহেবের এ অদ্ভুত বায়নার অবশ্য কারণ আছে। যখনই কোন সমস্যা সম্পর্কে তিনি অর্থনীতিবিদের মতামত জানতে চেয়েছেন তখনই তিনি জবাব পেয়েছেন, ‘On the one hand’ (এক দিকে) এটা ঘটতে পারে, ‘On the other hand’ (আর এক দিকে) অন্য রকমের সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রুম্যান সাহেব তাই মনে করতেন, অর্থনীতিবিদের দুটো হাত থাকলেই বিপদ, কেননা তার কাছ থেকে সুস্পষ্ট কোন সুপারিশ পাওয়া যাবে না।

অর্থনীতিবিদগণ শুধু দ্ব্যর্থক ও অস্পষ্ট উপদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হন না। তাঁদের অনেকেই ক্ষণে ক্ষণে মত বদলান। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল বিংশ শতাব্দীর সেরা অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস। এত ঘন ঘন মত বদলানোর কারণ ব্যাখ্যা করতে তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছিল। লর্ড সাহেব উত্তর দেন, তিনি নষ্ট ঘড়ির কাঁটা নন যা দিনে দু বার মাত্র সঠিক সময় দেয়। তিনি দাবি করেন, তিনি হচ্ছেন একটি চলন্ত ঘড়ি, তাঁর কাঁটাও তাই সেকেন্ডে সেকেন্ডে পরিবর্তিত হয়। লর্ড কেইনসের মত দ্রুত পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলা আমার মত গোবেচারার পক্ষে কষ্টকর। লর্ড কেইনসের তুলনায় মোল্লা নসরুদ্দীনকে তাই আমার অনেক বেশি পছন্দ। কথিত আছে, এক ব্যক্তি মোল্লার কাছে তাঁর বয়স জানতে চেয়েছিল। মোল্লা বললেন যে, তাঁর বয়স চল্লিশ। উপস্থিত তৃতীয় ব্যক্তি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিল যে, দশ বছর আগেও মোল্লা বলেছেন তাঁর বয়স চল্লিশ; কাজেই দশ বছর পরে তাঁর বয়স চল্লিশ হওয়া সম্ভব নয়। মোল্লা জবাব দেন, তিনি এক কথার মানুষ; কয়দিন পর পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন না। কাজেই দশ বছর আগে তিনি যা বলেছেন আজও একই কথা বলছেন। এ ধরনের অর্থনীতিবিদরাই হলেন ট্রুম্যান সাহেবের এক হাতওয়ালা অর্থনীতিবিদ। আমার মনের মতন অর্থনীতিবিদ।   

সভ্যতার ইতিহাসের সুদীর্ঘ পটভূমিতে অর্থনীতি একটি অর্বাচীন শাস্ত্র। গণিত, দৰ্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি শাস্ত্র কমপক্ষে অর্থনীতির দু’হাজার বছর আগে জন্ম নিয়েছে। এডাম স্মিথের ‘An Inquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’  বইটির প্রকাশনার তারিখ ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দকে সাধারণত অর্থনীতির জন্মলগ্ন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এর প্রায় পাঁচশ বছর আগে অর্থাৎ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুরস্কের খোর্তো গ্রামে নসরুদ্দীন খোজার জন্ম। তিনি শুধু সুপণ্ডিত ও সুকবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ ইমাম। পাশ্চাত্য জগতে তিনি তাই মোল্লা হিসাবে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতকের মোল্লার পক্ষে আজকের অর্থনীতিবিদদের মত পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক তত্ত্ব প্রণয়ন সম্ভব ছিল না। মোল্লার সময়ে শাস্ত্র হিসেবে অর্থনীতির জন্ম হয়নি বটে, কিন্তু অর্থনীতির মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে মোল্লার জন্মের অনেক আগেই দার্শনিকগণ চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন। মোল্লার জন্মের আঠারো শ বছর আগে গ্রীক দার্শনিকগণ অর্থনীতির মৌল প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। গ্রীক দার্শনিকগণ অর্থনীতি সংক্রান্ত যে সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি, মোল্লা নসরুদ্দীন তাঁদের অনেকগুলি সমাধান করেছেন। এরিস্টটলের কাছে বাজারের মূল্য নির্ধারণ-পদ্ধতি ছিল একটি প্রহেলিকা। তিনি বলতেন যে, জল-যার অপর নাম জীবন তা বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, অথচ হীরক – যার কোন প্রত্যক্ষ উপকারিতা নেই, বাজারে অতি চড়া দামে বিক্রি হয়। গ্রীক দার্শনিকদের মতে তাই বাজারের মূল্য-নির্ধারণ পদ্ধতি হল অন্যায্য। মোল্লা নসরুদ্দীনের কাছে মূল্য-নির্ধারণ ব্যবস্থা দুর্জ্ঞেয় রহস্য বলে মনে হয়নি। এ সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের একটি গল্প স্মরণ করা যেতে পারে। এক ব্যক্তি মোল্লা নসরুদ্দীনের কাছে শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে চায়। মোল্লা তাকে বললেন যে, সত্য সম্পর্কে জানতে হলে অনেক চড়া মূল্য দিতে হবে। হবু শিষ্য বললেন যে, সত্য জানার জন্য কেন এত বেশি দাম দিতে হবে তা বুঝতে সে অক্ষম। মোল্লা তাকে বললেন, ‘সত্য হল দুষ্প্রাপ্য এবং সকল দুষ্প্রাপ্য দ্রব্যই চড়া দামে কিনতে হয়।’ 

অর্থনীতি সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রাচীন ও আধুনিক – উভয় ধরনের অর্থনীতিবিদদের পদ্ধতি থেকে ভিন্ন। আধুনিক অর্থনীতির বিশ্লেষণ হল গণিত—ভিত্তিক। প্রাচীন অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ ছিল দর্শনভিত্তিক। মোল্লা নসরুদ্দীন গণিতবিদও ছিলেন না, আনুষ্ঠানিকভাবে দার্শনিকও ছিলেন না। তাঁর বক্তব্য বেঁচে আছে কতগুলি মশকরা ও মজার গল্পে। অবশ্য হাসতে হাসতে মোল্লা যা বলে গেছেন আজকের অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরা অনেক পরিশ্রম করেও তার চেয়ে খুব বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেননি।   

অর্থনীতি সম্পর্কে মোল্লা নসরুদ্দীনের জ্ঞান ছিল বাস্তব অভিজ্ঞতাপ্রসূত। পদ্ধতিগত দিক থেকে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মোল্লার আস্থা ছিল না, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জ্ঞান অর্জন করতেন। এ সম্পর্কে একটি সুন্দর কাহিনী রয়েছে। মোল্লা একবার একটি গলির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি লোক ছাদ থেকে মোল্লার ঘাড়ের উপর পড়ে। যে লোকটি পড়ে তার তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। মোল্লাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে মোল্লার অবস্থার উন্নতি হলে শিষ্যরা জানতে চান, এ ঘটনা থেকে কি শিক্ষা গ্রহণ করা যায়। মোল্লা জবাব দেন, ‘কার্যকারণের অবশ্যম্ভাবিতায় বিশ্বাস করো না। ছাদ থেকে পড়লো লোকটা; ঘাড়টা ভাঙল আমার। ভবিষ্যতে এই ধরনের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে কখনও পৌঁছবে না, যে কোন লোক ছাদ থেকে পড়লেই তার নিজের ঘাড় ভাঙবে।’  

আধুনিক অর্থনীতিতে আমরা অনেক নতুন নতুন তত্ত্ব শিখছি। কিন্তু এ সকল তত্ত্ব সবই মৌলিক তা মনে করা ঠিক হবে না। একজন দার্শনিক যথার্থই মন্তব্য করেছেন, মৌলিকতা হচ্ছে ধরা না পড়ে অন্যের ভাব চুরি করা। প্রকৃতপক্ষে সকল নতুন তত্ত্বেরই বীজ সংগৃহীত হয় পূর্ববর্তীদের নিকট থেকে। স্যার আইজাক নিউটন তাই বলতেন : ‘If I have been able to see farther than others, it was because I stood on the shoulders of giants.’  (আমি যদি অন্যদের চেয়ে বেশি দূরে দেখে থাকি, তার কারণ হল আমি অস্বাভাবিক বড় মাপের মানুষের কাঁধের উপর দাঁড়িয়েছিলাম।) আজকের অর্থনীতিবিদরাও তেমনি অনেক ধারণাই গ্রহণ করেছেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের মানুষদের কাছ থেকে। মোল্লা নসরুদ্দীনের চুটকিগুলি বিশ্লেষণ করলে আমরা শুধু নির্মল আমোদই লাভ করি না, আমরা তাঁর ভূয়োদর্শন থেকেও জ্ঞান লাভ করি। ভালভাবে তলিয়ে দেখলে মোল্লা নসরুদ্দীনকে দু’ধরনের অর্থনৈতিক তত্ত্বের পথিকৃত বলে মনে হয়।
প্রথমত, মোল্লা অর্থনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কে অনেক মূল্যবান বক্তব্য রেখে গেছেন।
দ্বিতীয়ত, মহাজনদের আচরণ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল গভীর। মহাজনদের আচরণ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য আজকের বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মোল্লার হাসির গল্পগুলি বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের আচরণ সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করতে অতি সহায়ক।   

অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

প্রথমে ঝুঁকি নিয়ে শুরু করা যেতে পারে। ঝুঁকির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল risk ইংরেজী ভাষায় risk-এর শাব্দিক অর্থ হল সাহস করা। এ সাহস দেখানো হয় যা অজানা বা অনিশ্চিত তার ক্ষেত্রে। সবচেয়ে অনিশ্চিত হল ভবিষ্যত। প্রাচীনকালে সবাই মনে করত যে, ভবিষ্যত নিয়ে মানুষের কিছুই করার নেই। ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রিত হয় দেবদেবতাদের খেয়ালখুশিতে। যে সব দার্শনিক অজানা ভবিষ্যতের ঝুঁকির রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে এগিয়ে আসেন তাঁরা সত্যিই ছিলেন অত্যন্ত দুঃসাহসী তাত্ত্বিক। পিটার এল বার্নস্টাইন (Peter L. Bernstein) নামে একজন বিশেষজ্ঞ ঝুঁকি সম্পর্কিত তত্ত্বের একটি ইতিহাস লিখেছেন। বইটির তিনি নাম দিয়েছেন ‘Against the Gods : the Remarkable Story of Risk’ (বিধাতার বিপক্ষে : ঝুঁকির অসামান্য কাহিনী)। বার্নস্টাইনের মতে গ্রীক লোককাহিনীর নায়ক প্রমিথিউস যেমন দেবতাদের অমান্য করে অন্ধকার থেকে আলো ছিনিয়ে এনেছে, ঝুঁকি সম্পর্কিত তাত্ত্বিকরা তেমনি তমসাবৃত ভবিষ্যতের রহস্য ভেদ করে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বার্নস্টাইনের ইতিহাসে ঝুঁকি সম্পর্কিত বিশ্লেষণের পথিকৃতদের তালিকায় মোল্লা নসরুদ্দীনের নাম নেই। তার তালিকা শুরু হয়েছে সপ্তদশ শতকের ফরাসী ভূস্বামী শেভালিয়ে দ্য মেয়ার (Chevalier de Mere)-এর নাম দিয়ে। এ তালিকায় রয়েছে সপ্তদশ শতকের পাসক্যাল ও ফারম্যাট, অষ্টদশ শতকের লাইবনিজ, আব্রাহাম দ্য মোয়াভ (Abraham de Moivre), ও বার্নোলি (Bernoulli)। ত্রয়োদশ শতকের মোল্লা নসরুদ্দীন কিন্তু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মূল বৈজ্ঞানিক সূত্রসমূহ অনেক আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর অর্থনীতিবিদ মার্কভিজ (Markowitz) ১৯৫২ সালে তাঁর পত্রকোষ বা portfolio তত্ত্ব উপস্থাপন করেন। পত্রকোষ বা portfolio-এর শাব্দিক অর্থ হল একজন ব্যক্তির সকল কাগুজে সম্পদের (যথা শেয়ারের কাগজ) সংগ্রহ (যা সাধারণত একটি ‘পোর্টফোলিও’ ব্যাগের মধ্যে রাখা হয়)। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হল, এক ধরনের সম্পদে বিনিয়োগ করা হলে যদি এ সম্পদের দাম কমে যায় তবে বিনিয়োগকারী ফতুর হয়ে যাবে। এক ঝুড়িতে সকল ডিম রাখা যেমন বুদ্ধিমানের কাজ নয় তেমনি এক ধরনের সম্পদে – যা আপাতদৃষ্টিতে যত লাভজনকই হোক না কেন, বিনিয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ। মার্কভিজের পরামর্শ হল সম্পদের বৈচিত্র্যায়ন (diversification) হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ পথ। এ তত্ত্ব পত্রকোষ বা portfolio theory নামেও পরিচিত।   

মার্কভিজের প্রায় সাতশ বছর আগে মোল্লা নসরুদ্দীন ঝুঁকি বৈচিত্র্যায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। মোল্লা নিজের জীবনেও তাঁর চর্চা করেছেন। মোল্লার দুই মেয়ে ছিল। তিনি একজনকে বিয়ে দেন চাষীর সাথে, অন্য মেয়ের বিয়ে দেন ইটের ভাটার মালিকের সাথে। ভালো বৃষ্টি হলে চাষীর ঘরণী আরামে থাকত। আর বৃষ্টি না হলে বা কম হলে ইটের ভাটার মালিকের স্ত্রীর থাকত রমরমা অবস্থা। বৃষ্টি কম হোক আর বেশি হোক মোল্লার এক কন্যা অন্তত ভাল অবস্থাতে থাকত। অবশ্য বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক পরিবারই মোল্লার চেয়েও অনেক বেশি চালাক। এ ধরনের পরিবার এক ছেলেকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলে ভর্তি করে আর অন্য ছেলেদের বিরোধী দলের সমর্থক করে রাখে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও কোন না কোন ছেলে ক্ষমতাসীন থেকে যায়। 

মোল্লা বৈচিত্র্যায়নে এত গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, তিনি এ তত্ত্ব পরকালের ক্ষেত্রে পর্যন্ত প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। ইদ্রিস শাহ তাঁর ‘The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasruddin’ গ্রন্থে নিম্নরূপ কাহিনী বর্ণনা করেছেন—  

একজন ধর্মতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ অসুস্থ ছিলেন। তিনি শুনেছিলেন যে নসরুদ্দীন একজন মরমি সাধক। অর্ধচেতন অবস্থায় তাঁর কাছে মনে হল এ খবর হয়ত সত্যি। তিনি মোল্লাকে ডেকে পাঠালেন।  

তিনি বললেন, ‘হে মোল্লা, আপনার সুনাম রয়েছে যে অন্য জগতের সাথে আপনার যোগাযোগ রয়েছে। আপনি আমাকে এমন একটি মন্ত্র দিন যাতে আমি বিনা যন্ত্রণায় অন্য জগতে যেতে পারি।’  

নসরুদ্দীন বললেন, ‘এতো খুশির সাথেই করব। এই হল আপনার মন্ত্র : বিধাতা আমাকে সাহায্য কর, অসুর আমাকে মদদ দাও।’ 

স্তম্ভিত হয়ে লোকটি তাঁর অসুখের কথা ভুলে গিয়ে সোজা হয়ে বসে পড়লেন। তিনি বললেন, ‘মোল্লা নিশ্চয়ই আপনার মাথা খারাপ হয়েছে।’ 

মোল্লা জবাব দিলেন, ‘প্রিয় বন্ধু, আপনার কথা মোটেও সত্য নয়। আপনার যা অবস্থা, আপনি ঝুঁকি নিতে পারেন না। যখন দুটি বিকল্প রয়েছে, তখন দুটি বিকল্পের জন্যই বন্দোবস্ত রাখা বুদ্ধিমানের কাজ।’   

স্পষ্টতই মোল্লা এখানে ঝুঁকি বৈচিত্র্যায়নের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে মোল্লা একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। পার্থিব বৈচিত্র্যায়ন তত্ত্ব পরকালের ক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব নয়। যারা ধার্মিক তাদের কাছে পরকালের কোন বিকল্প নেই। কাজেই একই সাথে একাধিক ব্যবস্থা গ্রহণের কোন সুযোগ নেই। অবশ্য মোল্লা নিজে পরকাল সম্পর্কেও খুব নিশ্চিত ছিলেন না। মোল্লা মরার আগে নাকি ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন যে, মরার পর তাঁকে নতুন কবরে সমাহিত না করে পুরাতন কবরে যেন তাঁর লাশ রাখা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা তাঁর এই অদ্ভুত অনুরোধের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, পুরানো কবরে ফেরেশতারা আসলে বলে দেওয়া সম্ভব হবে যে, কবরে সমাহিত ব্যক্তির ইতোমধ্যে সাজা হয়ে গেছে। কাজেই ফেরেশতারা শাস্তির ব্যবস্থা না করেই চলে যাবে। তাতে অন্তত কেয়ামত পর্যন্ত তিনি শাস্তির হাত থেকে বাঁচবেন। 

তবে মোল্লার ঝুঁকি-বৈচিত্র্যায়ন সম্পর্কিত পরামর্শ পরকালের জন্য প্রযোজ্য না হলেও ইহকালের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বিনিয়োগ, ব্যবসা, বাণিজ্য এমনকি রাজনীতির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যায়ন ঝুঁকি হ্রাসের একটি কার্যকর উপায়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, পরিবেশের জন্যও বৈচিত্র্যায়ন শুধু কল্যাণকরই নয় অত্যন্ত জরুরীও বটে। সম্প্রতি কৃষি ক্ষেত্রে উচ্চফলনশীল বীজ চাষ করতে গিয়ে অল্প কয়েকটি জাতের ধান ও গম চাষ হচ্ছে। এ সব বীজের ফলন চিরাচরিত জাতের চেয়ে বেশি সন্দেহ নেই। কিন্তু অল্প কয়েকটি জাতের বীজের উপর নির্ভরশীলতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন প্রজাতির বীজ বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। কাজেই নানাবিধ প্রজাতির বীজের চাষ করলে বন্যা ও খরার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ফসলের ক্ষতি কম হয়। এক ধরনের উচ্চ ফলনশীল বীজ চাষ করলে একবার কীট পতঙ্গের উপদ্রব হলে সকল ফসলই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভিন্ন ভিন্ন জাতের বীজ চাষ করলে এক ধরনের পোকা সব ধরনের ফসলের ক্ষতি করতে পারে না। বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে সকল পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকাই হল বুদ্ধিমানের কাজ।   

৭০০ বছর আগে মোল্লা যখন মারা যান তখন বিশ্ব ব্যাংক অথবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কথা কেউ কল্পনা করেনি। এমনকি ওয়াশিংটন শহরে –যেখানে প্রতিষ্ঠান দুটির সদর দফতর অবস্থিত–সেখানে কোন শহরই ছিল না, আদৌ কোন বসতি ছিল কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু মোল্লা বিশ্ব ব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল না দেখলেও অনেক মহাজন দেখেছেন। মহাজনদের আচরণ জানতে পারলেই এ দুটো প্রতিষ্ঠানের নিয়ম নীতি আঁচ করা সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মোল্লার একটি কাহিনী মনে পড়ছে। কথিত আছে মোল্লা নসরুদ্দীনের একটি হাতি দেখে খুবই পছন্দ হয়। তিনি হাতিটি কেনার অর্থ সংগ্রহের জন্য মহাজনের দোরে গিয়ে হাজির হলেন।
মোল্লা মহাজনকে বললেন, ‘আমাকে কিছু টাকা ধার দিন।’
মহাজন বললেন, ‘কেন?’ মোল্লা জবাব দিলেন, ‘আমি একটি হাতি কিনতে চাই।’
মহাজন প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার যদি টাকা না থাকে তুমি হাতি পালবে কি করে?’
মোল্লা আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমি আপনার কাছে টাকার জন্য এসেছি, উপদেশের জন্য নয়।’  

যে কোন উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে মোল্লার আক্ষেপই শোনা যাবে। এইত কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করতে মস্কো যান। আলোচনার পর সাংবাদিকগণ রাশিয়ার তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী প্রিমাকভের কাছে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চান। প্রিমাকভ সাংবাদিকদের জানান যে, তিনি আশা করেছিলেন, মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় তাঁর ব্রীফ কেস ভর্তি করে ডলার নিয়ে এসেছেন; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি তাঁর ব্রীফ কেস ভর্তি করে নিয়ে এসেছেন শর্তের কাগজপত্র। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তাবলী স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের সবচেয়ে খারাপ দুঃস্বপ্ন। একটু নমনীয় হলেও বিশ্ব ব্যাংকও একই পথের পথিক।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তসমূহকে শর্তনির্ভরশীলতা বা conditionality বলা হয়ে থাকে। শর্তনির্ভরশীলতাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নসিহত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একজন বিশেষজ্ঞের মতে শর্তনির্ভরশীলতা হল সে সব নীতি যা অনুসরণ করলে তহবিলের সাহায্য প্রদান করা হয়। মোল্লার মহাজনের উপদেশ না শোনার অধিকার ছিল, অনুন্নত দেশসমূহের আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শ না শোনার জো নেই। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলে অন্য দাতাদের সাহায্যও কমে যায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল মনে করে যে, তার নির্ধারিত শর্তাবলী শুধু সংশ্লিষ্ট দেশের জন্যই প্রযোজ্য নয়, এ সব শর্ত বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থার জন্য সামগ্রিকভাবে হিতকর। অবশ্য মুদ্রা তহবিলের সমালোচকরা এ মতের সাথে মোটেও একমত নন। তাঁরা বলেন যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সকল দেশের জন্য একই দাওয়াই দিয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই এ দাওয়াই রোগের চেয়েও খারাপ। শর্তাবলীর মধ্যে সাধারণত থাকে সরকারের ব্যয়-হ্রাস, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, কর-সংস্কার, বেসরকারীকরণ, বাণিজ্য সংস্কার এবং জ্বালানি ও কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি। সামগ্রিকভাবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের সংস্কার অর্থনৈতিক সংকোচনের জন্ম দেয়। অর্থনীতিবিদ্রা এ ধরনের ব্যবস্থাকে কল্যাণকর মনে করতে পারেন, কিন্তু রাজনীতিবিদদের মতে এসব সংস্কার হচ্ছে রাজনৈতিক আত্মহননের শামিল। রাজনীতিবিদগণ তাই এ ধরনের তেতো ওষুধ গিলতে চান না। এর ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ একটি নতুন দাওয়াই আবিষ্কার করেছেন। তাঁরা এর নাম দিয়েছেন প্রাক-কর্মসূচী শর্তনির্ভরশীলতা (upfront conditionality)। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে সম্মত কর্মসূচী গ্রহণের আগেই এ ধরনের শর্ত পালন করতে হয়। অবশ্য এ ধরনের শর্তনির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আবিষ্কার করেনি। এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা ত্রয়োদশ শতাব্দীতেই মোল্লা সাহেব চিন্তা করে গেছেন। মোল্লা একবার একটি ছোট ছেলেকে একটি পাত্রে কুয়ো থেকে পানি তুলে আনতে বলেন। ছেলেটির হাতে পাত্রটি তুলে তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘খেয়াল রেখো পাত্রটি যাতে কোন মতেই না ভাঙে’ এবং তার পরেই ছেলেটিকে থাপ্পড় মারলেন। ঘটনার সময় অন্য এক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। তিনি মোল্লার কাছে জানতে চাইলেন যে, মোল্লা কেন বিনা কারণে ছেলেটিকে আঘাত করলেন। মোল্লা বললেন, ‘আহাম্মক, তুমি বুঝতে পারছ না, পাত্রটি ভাঙ্গার পর ছেলেটিকে শাস্তি দিয়ে কোন লাভ হবে না। কাজেই আগে শাস্তি দিলাম।’ মোল্লার মত আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পাত্র ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি নয়, তারা আগেই স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে থাপ্পড় মারে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নীতিমালার সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলো কখনও একাত্ম হতে পারে না। এরা ভালো উপদেশ দিলেও উন্নয়নশীল দেশসমূহ আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সন্দেহ করে।       

আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কখনও এ কথা স্বীকার করে না যে তারা মহাজন। কিন্তু মোল্লা মহাজনদের যে সব লক্ষণ বর্ণনা করেছেন তার সবই রয়েছে এ সব প্রতিষ্ঠানের। তাই এ সব প্রতিষ্ঠান দেখলে তিনি হয়ত মোটেও অবাক হতেন না। মাংস চুরি হওয়ার পর মোল্লা তাঁর স্ত্রীকে যে প্রশ্ন করেছিলেন হয়ত আজ বেঁচে থাকলে একই ধরনের প্রশ্ন তিনি করতেন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে। মোল্লার মাংস চুরির গল্পটি হচ্ছে নিম্নরূপ : 
বাজারে গিয়ে মোল্লা খুব ভালো মাংস পেয়ে খুশি হয়ে এক সের মাংস নিয়ে বাড়িতে আসেন। এসেই স্ত্রীকে মাংসটা ভালো করে রান্না করার নির্দেশ দিলেন। মোল্লার স্ত্রী মাংস রান্না করলেন। কিন্তু রান্না করা মাংস চেখে তাঁর এত ভাল লাগল যে তিনি নিজেই পুরো মাংসটা খেয়ে ফেললেন। মোল্লা খেতে এসে যখন মাংস চাইলেন তখন তার স্ত্রী বললেন যে, মাংস বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। মোল্লা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বিড়াল কি পুরো মাংসই খেয়েছে?’ মোল্লার স্ত্রী বললেন যে, পুরো মাংসই বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। বিড়ালটা কাছেই ছিল। নসরুদ্দীন সেটাকে দাঁড়ি পাল্লায় চড়িয়ে দেখলেন যে বিড়ালটির ওজন ঠিক এক সের। ‘এটাই যদি সেই বিড়াল হয়’, মোল্লা বললেন, ‘তাহলে মাংস কোথায়? আর এটাই যদি সেই মাংস হয়, তাহলে বিড়াল কোথায়?’ 

গত পঞ্চাশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ উন্নয়নের নামে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা যদি মোল্লা দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি হয়ত তৃতীয় বিশ্বের দিকে অঙ্গুলি দেখিয়ে বলতেন, ‘এই যদি উন্নয়ন হয়, তবে বিনিয়োগকৃত অর্থ কোথায়, আর এই যদি বিনিয়োগ হয়, তবে উন্নয়ন গেল কোথায়?’   

আজকের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মোল্লা নসরুদ্দীনের গাল-গল্পকে অর্থনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে মানতে চাইবেন না। পক্ষান্তরে মোল্লা যদি আজকে জীবিত থাকতেন তিনি ও হয়ত পেশাদারদের গাণিতিক অর্থনীতিকে বাস্তব হিসাবে স্বীকার করতেন না। তিনিও হয়ত গণিতজ্ঞ জি. এইচ. হার্ডি (G. H. Hardy)-এর সাথে সুর মিলিয়ে বলতেন, ‘একজন গণিতজ্ঞ হচ্ছেন সে ধরনের ব্যক্তি যিনি কি সম্পর্কে বলছেন তা জানেন না ও তার পরোয়াও করেন না’। গণিতজ্ঞের কাজ হচ্ছে সঠিকভাবে অঙ্ক করা, ফলাফল নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। গণিতজ্ঞের কোন লক্ষ্য নেই, কোন দায়দায়িত্ব নেই, পদ্ধতি সঠিক হলেই তিনি সন্তুষ্ট। যে সব অর্থনীতিবিদ গণিতের ভিত্তিতে তাঁদের তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলছেন তাঁদের অনেকেই গণিতজ্ঞদের ত্রুটিতে সংক্রমিত হয়েছেন। তাঁদের গণিত নির্ভুল হতে পারে; কিন্তু তাঁদের তত্ত্ব সঠিক নয়।   

আজকের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন যে, একমাত্র তাঁদের পেশাদারী জ্ঞান প্রয়োগ করলেই উন্নয়নশীল দেশসমূহের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব। অবশ্য তাঁরা ভুলে যান যে, টাইটানিক জাহাজ সে সময়ের শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞরা নির্মাণ করেছে এবং প্রথম সমুদ্র যাত্রাতেই জাহাজটি ডুবে যায়। আর হজরত নূহ (আঃ)-এর কিস্তি তৈরি করেছিল আনাড়িরা; নূহের কিস্তি কিন্তু শত ঝড় ঝঞ্ঝাতেও ডোবেনি। সেনাপতিদের সম্পর্কে যথার্থই বলা হয়ে থাকে যে, যুদ্ধ এত গুরুত্বপূর্ণ যে শুধু সেনানায়কদের কাছে যুদ্ধ সম্পর্কে সকল সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। অর্থনৈতিক সমস্যাও এত গুরুত্বপূর্ণ যে তা শুধু পেশাদার অর্থনীতিবিদদের কাছে ছেড়ে রাখা সম্ভব নয়। মোল্লা নসরুদ্দীনের মত চিন্তাবিদদের আজকের দিনেও তাই আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। 

.

তথ্যসূত্র 

১. সৈয়দ মুজতবা আলী, চতুরঙ্গ (ঢাকা : ষ্টুডেন্ট ওয়েজ, ১৯৮৯), পৃষ্ঠা ২৮ 

২. Peter, Lawrence J., Peter’s Quotations (New York : Quill, 1977), p. 437

৩. Bernstein, Peter L., Against the Gods: The Remarkable Story of Risk (New York: John Wiley and Sons, 1996 ) 

৪. Shah, Idries, The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasruddin (New York: E. P. Datton & Co, 1968), p. 91 

৫. Bright, Chris, Life Out of Bounds (New York: W. W. Norton & Company, 1998) 

৬. Guitian, Manuel, Fund Conditionaity (Washington : IMF, 1986) 

থেকে আরও পড়ুন

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।