‘আম্মাজান’, নারীর ইজ্জত ও এজেন্সির ধারণা 

WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
আম্মাজান সিনেমা অবলম্বনে অলঙ্করণ করেছেন শফিক হীরা

ধর্ষণ খারাপ। এইটুকুতে সবাই একমত। এর আগে-পিছে, ধর্ষণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে নানাজন নানান গোঁজামিল দিতে চাইলেও, ওইটুকুতে অন্তত সবাই একমত। কিন্তু ওই আগ-পরের হিসাবটুকুই জরুরি। কারণ, আর সব অপরাধের মতই, ধর্ষণ শূন্যে উৎপন্ন কোনো ঘটনা না। নারীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট খুচরা আগ্রাসনের চূড়ান্ত রূপ হলো ধর্ষণ। বলে রাখা ভালো, ছেলেরাও অবশ্যই ধর্ষণের শিকার হয়। যেমন, বাংলাদেশের সমাজে ছেলেদের মধ্যে শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিত হয়। কারণ ছোট ছেলেরা ক্ষমতা-সম্পর্কে নিচের দিকে অবস্থান করে। ধর্ষণ যে কোনো যৌনাচার না, বরং বলপ্রয়োগের একপ্রকার চর্চা, তা এতেই প্রমাণিত হয়। তবে এই লেখাটার মূল ফোকাস হলো, কীভাবে নারীর সতীত্ব, কর্তাসত্তা, চরিত্র ইত্যাদি ধারণার মধ্য দিয়ে সমাজ ধর্ষণের মত অপরাধ বেশি মাত্রায় ঘটার জমিন তৈয়ার করে রাখে এবং তার সামাজিক প্রভাবকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। এর খুব ভাল একটা কেস স্টাডি হতে পারে কাজী হায়াতের পরিচালিত ‘আম্মাজান’ সিনেমাটি। 

বাংলাদেশের মানুষের সামষ্টিক স্মৃতিতে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘আম্মাজান’ একটা বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই। সিনেমার গল্পটা কারো অজানা থাকার কথা না। মান্না এখানে বাদশা’র চরিত্রে অভিনয় করে। খুব ছোটবেলায় বাদশার বাবা মারা যায়। বাবার পাওনা বেতন ও ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গেলে বাদশা’র মা’কে ধর্ষণ করে অফিসের মালিক। এই ঘটনা বাদশা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে। সে খুন করে ফেলে সেই মালিককে। খুনের দায়ে বাদশা আর তার মা’কে জেলে যেতে হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর দেখা যায় বাদশা বিশাল প্রভাবশালী এক মাস্তান, টাকাপয়সার অভাব নাই। ধর্ষণ ‘আম্মাজান’ সিনেমার খুব কেন্দ্রীয় একটা থিম ধর্ষণ। ছোটবেলায় চোখের সামনে নিজের মা’কে ধর্ষিত হতে দেখা স্বাভাবিকভাবেই ট্রমায় ফেলে দেয় বাদশাকে। বড় হওয়ার পরও সেই ট্রমা দিয়েই তার ও তার মায়ের যৌথজীবন শাসিত হতে থাকে। মা কখনোই আর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, হাসতে পারেন না। আর বাদশা তার সমস্ত প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটায় মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।  

অনেকটা ব্যাটম্যানীয় ঢঙে, বাদশা নিজের সাথে হওয়া অপরাধের ট্রমার সাথে ডিল করে ভিজিলান্টি হয়ে ওঠার মাধ্যমে। কোথাও কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সে নিজের ক্ষমতার জোরে হাজির হয় সেখানে, নিজেই মেরে ফেলে সেই ধর্ষককে। মারতে যাওয়ার আগে মায়ের দোয়া নিয়ে যায়। অবশ্য, সিনেমায় যে বাদশা ধর্ষকদের জাস্টিস সার্ভ করে বেড়ায়, সেটা নারীর কর্তাসত্তার প্রতি কোনোপ্রকার শ্রদ্ধাবোধ থেকে নয়। সে মূলত তাড়িত হয় নিজের মায়ের ধর্ষণের ও সমাজের আচরণের ট্রমা দিয়ে। ধর্ষণ তার কাছে বড় অপরাধ এই কারণে নয় যে তা নারীর নিজ দেহের এজেন্সির ভায়োলেশন, বরং এজন্য যে, ধর্ষণের মাধ্যমে নারীর ‘ইজ্জত’ খোয়া যায়।       

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে নানান কারণে আম্মাজান গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

নারীর জন্য এই ‘ইজ্জত’ জিনিসটা যে প্রাণের চেয়েও কেন্দ্রীয়, রক্ষণীয়, তা আজকের ধারণা না। সেই ইজ্জত অবস্থান করে নারীর দেহে, নারীর ‘সতীত্বে’, এবং ধর্ষণের মাধ্যমে তা হরণ করা যায়। রামায়ণে যার জন্য এত লঙ্কাকান্ড ঘটে গেল, সেই সীতাকেই রাম ত্যাগ করলো সতীত্বের প্রশ্নে। এছাড়াও, আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে রোমান ঐতিহাসিক লিভির গ্রন্থে পাওয়া যায় লুক্রেশিয়ার গল্প। লুক্রেশিয়ার স্বামী লুসিয়াস টার্কিনিয়াস কোল্যাটিনাস একদল অভিজাত রোমানদের সাথে বাজি ধরেন। বাজির বিষয়বস্তু হলো কার স্ত্রী সবচেয়ে সচ্চরিত্র তা পরখ করা। যখন একে একে প্রত্যেকের ঘরে ঢু মেরে দেখা হলো, দেখা গেল প্রত্যেকের স্ত্রী সখীদের সাথে আড্ডা মারছে, হাসাহাসি করছে। একমাত্র লুক্রেশিয়া বসে বসে একমনে সেলাই করছিল। ফলে, প্রমাণিত হলো লুসিয়াসের স্ত্রী লুক্রেশিয়াই সবচেয়ে সচ্চরিত্রবতী। বাজি হেরে চটে গেছিল অভিজাতদের একজন—সেক্সটাস টারকিনিয়াস। পরদিন রাতের বেলা সে লুক্রেশিয়ার বেডরুমে ঢুকে তার গলায় একটা চাকু ধরে ধর্ষণ করতে যায়। যদি সে তা না দেয়, তাহলে তাকে ও তার এক দাসকে খুন করে সেই দাসের নগ্ন শরীর তার শরীরের উপর ফেলে রাখা হবে। তার স্বামীকে বলা হবে যে সে তাকে দাসের সাথে নষ্টামি করতে দেখেছিল, তাই দুজনকেই খুন করে ফেলেছে। অতএব, তার ইজ্জত এমনিতেও থাকবে না। তো, ধর্ষিত হলো লুক্রেশিয়া। অবশ্য সে সময় ধর্ষণের ধারণা ওইভাবে ছিল না রোমে, বরং এই অপরাধটা বোঝানোর জন্য শ্লীলতাহানি, সম্ভ্রমহানি, কালিমালেপন, চুরি, জবরদস্তি, এমনকি স্রেফ যৌনতা ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল। ধর্ষিত হওয়ার পর লুক্রেশিয়া নিজের বাবা ও স্বামীকে ডেকে সব খুলে বললো এবং জানালো যে সে আত্মহত্যা করবে। তাদের বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও লুক্রেশিয়া থামে না, যাতে ‘ভবিষ্যতে কোনো অসতী নারী আমার নজির দেখিয়ে পার না পেতে পারে।’ এরপর সে একটা খঞ্জর নিজের বুকের মধ্যে গেঁথে দেয়। এখন, সম্ভাবনা হলো লুক্রেশিয়ার এই গল্প যতটা না বাস্তবিক তার চেয়ে বেশি একটা নীতিগল্প। আর এই গল্প হাজার বছর ধরে ভীষণ মহিমার সাথে বারবার উচ্চারণ করা হয়ে আসছে। শেক্সপিয়র এই ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখেই খ্যাতি অর্জন করেন। টিশিয়ান, বোত্তিচেল্লি, ড্যুরের প্রমুখ শিল্পীর তুলিতে শোভা পেয়েছে তার ছবি।  লুক্রেশিয়ার এই আত্মহত্যা ছিল বীরত্বপূর্ণ, সম্ভ্রমের প্রতীক। বলা বাহুল্য, এই গল্পের কথক ও প্রচারক বেশিরভাগই ছিল পুরুষমানুষ। আর এই গল্পের নিহিত নীতিবাক্য হলো, মেয়েমানুষের ইজ্জত যখন চলে যায় তখন তার প্রাণও আর রাখার যোগ্য থাকে না। অথচ লিভির বইতেই এর উলটো অনেক নজির পাওয়া যায়। যেমন, ১৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান কনসাল নেয়াস ম্যানলিউস ভুলসো’র অধীনের একটি দলের সেপাই অভিযানের সময় কেল্টিক রানি কিয়োমারাকে ধর্ষণ করে। পরে কিয়োমারা সুযোগ বুঝে সেই সেপাইকে হত্যা করেন। ঐতিহাসিক সত্যতার যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও কিয়োমারার গল্প তেমন চাউর হয়নি। কোন গল্পগুলো যুগের পর যুগ চর্চিত হয়ে বাঁধা বুলি হয়ে ওঠে, আর কোনগুলা ইতিহাসে হারিয়ে যায়, সেটা খেয়াল করলেও অনেককিছু বোঝা সম্ভব। এডওয়ার্ড গিবনও গথদের দ্বারা রোমান নারীদের ধর্ষণকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘হত্যার চেয়েও নিকৃষ্ট’ এক অপরাধ বলে। এই একই ধারায়, ‘আম্মাজান’ সিনেমায় আমরা দেখব, যেই তিনজন নারী ধর্ষিত হন, তারা তিনজনই আত্মহত্যা করেন কিংবা করতে চান। জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর থেকে বাদশা নিজের মায়ের ঘরেই ঘুমায়, যাতে করে সে হুট করে আত্মহত্যা করে না বসে। অন্য এক মেয়ে যখন ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা করে, তখন তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বাদশা তার বাবাকে বলে যে মেয়েরা যেহেতু আম্মাজানের জাত, ফলে এ-ধরণের ঘটনা তাদেরকে খুব বাজেভাবে প্রভাবিত করে। তাই এর পর থেকে তাদের চোখে চোখে রাখতে হয়, নাহলে আত্মহত্যার ঝুঁকি থেকে যায়। এই কথাটা ধর্ষণের সেই ইজ্জতকেন্দ্রিক মনোভাবকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করে। আম্মাজান হলো বিশুদ্ধতার, পবিত্রতার প্রতীক। আর ধর্ষণ হলো আম্মাজানের জাতের কাছ থেকে সেই পবিত্রতা, যা তার জানের চেয়েও এসেনশিয়াল, তা ছিনিয়ে নেয়ার হাতিয়ার। ওই মেয়ে আত্মহত্যা করে ভালোই করেছে, না হলে বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা হতো, সমাজ তাকে আরো অনেক লাঞ্ছিত করতো। এই কথাগুলো বাদশা নিজ থেকে বলে এমন না, বরং সমাজের প্রতি তার ক্ষোভ থেকে একটা শ্লেষাত্মক স্বরেই বলে।       

এখন, এই দৃষ্টিভঙ্গিও তো ধর্ষণকে দোষারোপ করে। 
তাহলে সমস্যা কী? 
মোটাদাগে, এই দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হলো তা নারীর কর্তাসত্তা বা এজেন্সির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা রাখে না, সম্মতির ব্যাপারে কোনো বোঝাপড়া রাখে না, স্বীকার করে না যে ধর্ষণে নারীর ইজ্জত-টিজ্জত খোয়া যায় না, বরং তাতে তার নিজ শরীরের উপরকার স্বরাজকে খর্বিত করা হয়। এটা প্রমাণিত হয় যখন আম্মাজান সিনেমাতেই বাদশা’র মা যখন নিতান্তই নিজ মনে বলে ওঠেন ‘এরকম একটা মেয়ে যদি আমার ব্যাটার বউ হতো’ তখনই বাদশা মৌসুমিকে জোর করে তুলে নিয়ে আসে। ধর্ষণকে সম্ভ্রমহানি হিসেবে দেখার আরো বড় সমস্যা হলো, এই ধারণা থেকে উদ্ভট সব আইনের জন্ম হয়েছে। কয়েক দশক আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড-আমেরিকাতেও ধর্ষণের মামলা গৃহীত হওয়ার জন্য সতীত্বের প্রমাণ দিতে হতো, বোঝাতে হতো যে ধর্ষিতা সম্ভ্রমশীলা ছিল। যার ফলে কৃষ্ণাঙ্গ, উপনিবেশবাসী, যৌনকর্মী ইত্যাদি বর্গের নারীদের ধর্ষণের মামলা গ্রহণ করা হতো না, কারণ মনে করা হতো তাদের এমনিতেও ইজ্জত নেই। তাছাড়া, বাদশা শ্লেষের স্বরে যা বলে সেটাও সত্য। ইজ্জতের বুলিকে হাতিয়ার বানিয়ে আরো একবার নাজেহাল করে তো ফেলা হয়ই ধর্ষিতাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রচণ্ড ট্রমাটিক কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও যদি তার পরিপার্শ্ব ভাল ও সহমর্মী হয়, তাহলে তার সেই অভিজ্ঞতা ভালমত সামাল দিতে পারার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। অপরদিকে, খুব মামুলি কোনো দুর্ঘটনার মানসিক অভিঘাত অনেক ভয়াবহ হতে পারে যদি সার্বক্ষণিক পরিবেশ হয় অসহযোগিতাপূর্ণ। এরকম তিলে তিলে ভিক্টিমকে মানসিকভাবে নাজেহাল করে ফেলাকে বলা হয় ক্রমিক ট্রমায়ন (Sequential Traumatization) এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ভিক্টিমদের এই অবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হয়।  

এই সবই বাংলাদেশের খুব মৌলিক সমস্যা। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় মারকাট এস্থেটিক্স, ভিজুয়াল এফেক্টের বাড়াবাড়ি, বেহুদা মর্দানির অনুকরণে যেসব সিনেমা নির্মিত হয় তার সাথে এই দেশের জমিনের সম্পর্ক খুবই কম। তার বিপরীতে ‘আম্মাজান’ সিনেমাটা বাংলা সিনেমার এমন এক সময়ের সাক্ষ্য দেয় যে সময় নিজ সাধ্যমত বাংলাদেশের বাস্তবিক সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে চাইত। ডিসফাংশনাল একটা সমাজে প্রচণ্ড ট্রমাটাইজড এক ব্যক্তি হলেন বাদশা, যে বড় হয়ে ওঠে ন্যায়-বিচারের একটা আধাখেঁচড়া বোধ নিয়ে। এ সমাজই বাদশাদেরর জন্ম দেয়। খোদ ভিক্টিমের মধ্য দিয়েই কীভাবে অপরাধ নিজেকে জিইয়ে রাখে, সেটাই দর্শকের চোখের সামনে মেলে ধরে ‘আম্মাজান।’      

সহায়ক সূত্রঃ
Rape: From Lucretia to #MeToo, Mithu Sanyal
Ab Urbe Condita, Livy

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।