ধর্ষণ খারাপ। এইটুকুতে সবাই একমত। এর আগে-পিছে, ধর্ষণের কার্য-কারণ সম্বন্ধে নানাজন নানান গোঁজামিল দিতে চাইলেও, ওইটুকুতে অন্তত সবাই একমত। কিন্তু ওই আগ-পরের হিসাবটুকুই জরুরি। কারণ, আর সব অপরাধের মতই, ধর্ষণ শূন্যে উৎপন্ন কোনো ঘটনা না। নারীর বিরুদ্ধে অনেকগুলো অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট খুচরা আগ্রাসনের চূড়ান্ত রূপ হলো ধর্ষণ। বলে রাখা ভালো, ছেলেরাও অবশ্যই ধর্ষণের শিকার হয়। যেমন, বাংলাদেশের সমাজে ছেলেদের মধ্যে শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিত হয়। কারণ ছোট ছেলেরা ক্ষমতা-সম্পর্কে নিচের দিকে অবস্থান করে। ধর্ষণ যে কোনো যৌনাচার না, বরং বলপ্রয়োগের একপ্রকার চর্চা, তা এতেই প্রমাণিত হয়। তবে এই লেখাটার মূল ফোকাস হলো, কীভাবে নারীর সতীত্ব, কর্তাসত্তা, চরিত্র ইত্যাদি ধারণার মধ্য দিয়ে সমাজ ধর্ষণের মত অপরাধ বেশি মাত্রায় ঘটার জমিন তৈয়ার করে রাখে এবং তার সামাজিক প্রভাবকে আরো ভয়াবহ করে তোলে। এর খুব ভাল একটা কেস স্টাডি হতে পারে কাজী হায়াতের পরিচালিত ‘আম্মাজান’ সিনেমাটি।
বাংলাদেশের মানুষের সামষ্টিক স্মৃতিতে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘আম্মাজান’ একটা বিশেষ স্থান দখল করে রেখেছে সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই। সিনেমার গল্পটা কারো অজানা থাকার কথা না। মান্না এখানে বাদশা’র চরিত্রে অভিনয় করে। খুব ছোটবেলায় বাদশার বাবা মারা যায়। বাবার পাওনা বেতন ও ক্ষতিপূরণ আদায় করতে গেলে বাদশা’র মা’কে ধর্ষণ করে অফিসের মালিক। এই ঘটনা বাদশা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখে। সে খুন করে ফেলে সেই মালিককে। খুনের দায়ে বাদশা আর তার মা’কে জেলে যেতে হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর দেখা যায় বাদশা বিশাল প্রভাবশালী এক মাস্তান, টাকাপয়সার অভাব নাই। ধর্ষণ ‘আম্মাজান’ সিনেমার খুব কেন্দ্রীয় একটা থিম ধর্ষণ। ছোটবেলায় চোখের সামনে নিজের মা’কে ধর্ষিত হতে দেখা স্বাভাবিকভাবেই ট্রমায় ফেলে দেয় বাদশাকে। বড় হওয়ার পরও সেই ট্রমা দিয়েই তার ও তার মায়ের যৌথজীবন শাসিত হতে থাকে। মা কখনোই আর ছেলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন না, হাসতে পারেন না। আর বাদশা তার সমস্ত প্রভাব ও প্রতিপত্তি খাটায় মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য।
অনেকটা ব্যাটম্যানীয় ঢঙে, বাদশা নিজের সাথে হওয়া অপরাধের ট্রমার সাথে ডিল করে ভিজিলান্টি হয়ে ওঠার মাধ্যমে। কোথাও কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে সে নিজের ক্ষমতার জোরে হাজির হয় সেখানে, নিজেই মেরে ফেলে সেই ধর্ষককে। মারতে যাওয়ার আগে মায়ের দোয়া নিয়ে যায়। অবশ্য, সিনেমায় যে বাদশা ধর্ষকদের জাস্টিস সার্ভ করে বেড়ায়, সেটা নারীর কর্তাসত্তার প্রতি কোনোপ্রকার শ্রদ্ধাবোধ থেকে নয়। সে মূলত তাড়িত হয় নিজের মায়ের ধর্ষণের ও সমাজের আচরণের ট্রমা দিয়ে। ধর্ষণ তার কাছে বড় অপরাধ এই কারণে নয় যে তা নারীর নিজ দেহের এজেন্সির ভায়োলেশন, বরং এজন্য যে, ধর্ষণের মাধ্যমে নারীর ‘ইজ্জত’ খোয়া যায়।

নারীর জন্য এই ‘ইজ্জত’ জিনিসটা যে প্রাণের চেয়েও কেন্দ্রীয়, রক্ষণীয়, তা আজকের ধারণা না। সেই ইজ্জত অবস্থান করে নারীর দেহে, নারীর ‘সতীত্বে’, এবং ধর্ষণের মাধ্যমে তা হরণ করা যায়। রামায়ণে যার জন্য এত লঙ্কাকান্ড ঘটে গেল, সেই সীতাকেই রাম ত্যাগ করলো সতীত্বের প্রশ্নে। এছাড়াও, আজ থেকে ২৬০০ বছর আগে রোমান ঐতিহাসিক লিভির গ্রন্থে পাওয়া যায় লুক্রেশিয়ার গল্প। লুক্রেশিয়ার স্বামী লুসিয়াস টার্কিনিয়াস কোল্যাটিনাস একদল অভিজাত রোমানদের সাথে বাজি ধরেন। বাজির বিষয়বস্তু হলো কার স্ত্রী সবচেয়ে সচ্চরিত্র তা পরখ করা। যখন একে একে প্রত্যেকের ঘরে ঢু মেরে দেখা হলো, দেখা গেল প্রত্যেকের স্ত্রী সখীদের সাথে আড্ডা মারছে, হাসাহাসি করছে। একমাত্র লুক্রেশিয়া বসে বসে একমনে সেলাই করছিল। ফলে, প্রমাণিত হলো লুসিয়াসের স্ত্রী লুক্রেশিয়াই সবচেয়ে সচ্চরিত্রবতী। বাজি হেরে চটে গেছিল অভিজাতদের একজন—সেক্সটাস টারকিনিয়াস। পরদিন রাতের বেলা সে লুক্রেশিয়ার বেডরুমে ঢুকে তার গলায় একটা চাকু ধরে ধর্ষণ করতে যায়। যদি সে তা না দেয়, তাহলে তাকে ও তার এক দাসকে খুন করে সেই দাসের নগ্ন শরীর তার শরীরের উপর ফেলে রাখা হবে। তার স্বামীকে বলা হবে যে সে তাকে দাসের সাথে নষ্টামি করতে দেখেছিল, তাই দুজনকেই খুন করে ফেলেছে। অতএব, তার ইজ্জত এমনিতেও থাকবে না। তো, ধর্ষিত হলো লুক্রেশিয়া। অবশ্য সে সময় ধর্ষণের ধারণা ওইভাবে ছিল না রোমে, বরং এই অপরাধটা বোঝানোর জন্য শ্লীলতাহানি, সম্ভ্রমহানি, কালিমালেপন, চুরি, জবরদস্তি, এমনকি স্রেফ যৌনতা ইত্যাদি শব্দের প্রচলন ছিল। ধর্ষিত হওয়ার পর লুক্রেশিয়া নিজের বাবা ও স্বামীকে ডেকে সব খুলে বললো এবং জানালো যে সে আত্মহত্যা করবে। তাদের বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও লুক্রেশিয়া থামে না, যাতে ‘ভবিষ্যতে কোনো অসতী নারী আমার নজির দেখিয়ে পার না পেতে পারে।’ এরপর সে একটা খঞ্জর নিজের বুকের মধ্যে গেঁথে দেয়। এখন, সম্ভাবনা হলো লুক্রেশিয়ার এই গল্প যতটা না বাস্তবিক তার চেয়ে বেশি একটা নীতিগল্প। আর এই গল্প হাজার বছর ধরে ভীষণ মহিমার সাথে বারবার উচ্চারণ করা হয়ে আসছে। শেক্সপিয়র এই ঘটনা নিয়ে কবিতা লিখেই খ্যাতি অর্জন করেন। টিশিয়ান, বোত্তিচেল্লি, ড্যুরের প্রমুখ শিল্পীর তুলিতে শোভা পেয়েছে তার ছবি। লুক্রেশিয়ার এই আত্মহত্যা ছিল বীরত্বপূর্ণ, সম্ভ্রমের প্রতীক। বলা বাহুল্য, এই গল্পের কথক ও প্রচারক বেশিরভাগই ছিল পুরুষমানুষ। আর এই গল্পের নিহিত নীতিবাক্য হলো, মেয়েমানুষের ইজ্জত যখন চলে যায় তখন তার প্রাণও আর রাখার যোগ্য থাকে না। অথচ লিভির বইতেই এর উলটো অনেক নজির পাওয়া যায়। যেমন, ১৮৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমান কনসাল নেয়াস ম্যানলিউস ভুলসো’র অধীনের একটি দলের সেপাই অভিযানের সময় কেল্টিক রানি কিয়োমারাকে ধর্ষণ করে। পরে কিয়োমারা সুযোগ বুঝে সেই সেপাইকে হত্যা করেন। ঐতিহাসিক সত্যতার যথেষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও কিয়োমারার গল্প তেমন চাউর হয়নি। কোন গল্পগুলো যুগের পর যুগ চর্চিত হয়ে বাঁধা বুলি হয়ে ওঠে, আর কোনগুলা ইতিহাসে হারিয়ে যায়, সেটা খেয়াল করলেও অনেককিছু বোঝা সম্ভব। এডওয়ার্ড গিবনও গথদের দ্বারা রোমান নারীদের ধর্ষণকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘হত্যার চেয়েও নিকৃষ্ট’ এক অপরাধ বলে। এই একই ধারায়, ‘আম্মাজান’ সিনেমায় আমরা দেখব, যেই তিনজন নারী ধর্ষিত হন, তারা তিনজনই আত্মহত্যা করেন কিংবা করতে চান। জেলখানা থেকে বের হওয়ার পর থেকে বাদশা নিজের মায়ের ঘরেই ঘুমায়, যাতে করে সে হুট করে আত্মহত্যা করে না বসে। অন্য এক মেয়ে যখন ধর্ষিত হয়ে আত্মহত্যা করে, তখন তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বাদশা তার বাবাকে বলে যে মেয়েরা যেহেতু আম্মাজানের জাত, ফলে এ-ধরণের ঘটনা তাদেরকে খুব বাজেভাবে প্রভাবিত করে। তাই এর পর থেকে তাদের চোখে চোখে রাখতে হয়, নাহলে আত্মহত্যার ঝুঁকি থেকে যায়। এই কথাটা ধর্ষণের সেই ইজ্জতকেন্দ্রিক মনোভাবকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করে। আম্মাজান হলো বিশুদ্ধতার, পবিত্রতার প্রতীক। আর ধর্ষণ হলো আম্মাজানের জাতের কাছ থেকে সেই পবিত্রতা, যা তার জানের চেয়েও এসেনশিয়াল, তা ছিনিয়ে নেয়ার হাতিয়ার। ওই মেয়ে আত্মহত্যা করে ভালোই করেছে, না হলে বিয়ে দিতে অনেক ঝামেলা হতো, সমাজ তাকে আরো অনেক লাঞ্ছিত করতো। এই কথাগুলো বাদশা নিজ থেকে বলে এমন না, বরং সমাজের প্রতি তার ক্ষোভ থেকে একটা শ্লেষাত্মক স্বরেই বলে।
এখন, এই দৃষ্টিভঙ্গিও তো ধর্ষণকে দোষারোপ করে।
তাহলে সমস্যা কী?
মোটাদাগে, এই দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা হলো তা নারীর কর্তাসত্তা বা এজেন্সির প্রতি কোনো শ্রদ্ধা রাখে না, সম্মতির ব্যাপারে কোনো বোঝাপড়া রাখে না, স্বীকার করে না যে ধর্ষণে নারীর ইজ্জত-টিজ্জত খোয়া যায় না, বরং তাতে তার নিজ শরীরের উপরকার স্বরাজকে খর্বিত করা হয়। এটা প্রমাণিত হয় যখন আম্মাজান সিনেমাতেই বাদশা’র মা যখন নিতান্তই নিজ মনে বলে ওঠেন ‘এরকম একটা মেয়ে যদি আমার ব্যাটার বউ হতো’ তখনই বাদশা মৌসুমিকে জোর করে তুলে নিয়ে আসে। ধর্ষণকে সম্ভ্রমহানি হিসেবে দেখার আরো বড় সমস্যা হলো, এই ধারণা থেকে উদ্ভট সব আইনের জন্ম হয়েছে। কয়েক দশক আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ড-আমেরিকাতেও ধর্ষণের মামলা গৃহীত হওয়ার জন্য সতীত্বের প্রমাণ দিতে হতো, বোঝাতে হতো যে ধর্ষিতা সম্ভ্রমশীলা ছিল। যার ফলে কৃষ্ণাঙ্গ, উপনিবেশবাসী, যৌনকর্মী ইত্যাদি বর্গের নারীদের ধর্ষণের মামলা গ্রহণ করা হতো না, কারণ মনে করা হতো তাদের এমনিতেও ইজ্জত নেই। তাছাড়া, বাদশা শ্লেষের স্বরে যা বলে সেটাও সত্য। ইজ্জতের বুলিকে হাতিয়ার বানিয়ে আরো একবার নাজেহাল করে তো ফেলা হয়ই ধর্ষিতাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রচণ্ড ট্রমাটিক কোনো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরেও যদি তার পরিপার্শ্ব ভাল ও সহমর্মী হয়, তাহলে তার সেই অভিজ্ঞতা ভালমত সামাল দিতে পারার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। অপরদিকে, খুব মামুলি কোনো দুর্ঘটনার মানসিক অভিঘাত অনেক ভয়াবহ হতে পারে যদি সার্বক্ষণিক পরিবেশ হয় অসহযোগিতাপূর্ণ। এরকম তিলে তিলে ভিক্টিমকে মানসিকভাবে নাজেহাল করে ফেলাকে বলা হয় ক্রমিক ট্রমায়ন (Sequential Traumatization) এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধর্ষণের ভিক্টিমদের এই অবস্থার মধ্য দিয়েই যেতে হয়।
এই সবই বাংলাদেশের খুব মৌলিক সমস্যা। বর্তমানে দক্ষিণ ভারতীয় মারকাট এস্থেটিক্স, ভিজুয়াল এফেক্টের বাড়াবাড়ি, বেহুদা মর্দানির অনুকরণে যেসব সিনেমা নির্মিত হয় তার সাথে এই দেশের জমিনের সম্পর্ক খুবই কম। তার বিপরীতে ‘আম্মাজান’ সিনেমাটা বাংলা সিনেমার এমন এক সময়ের সাক্ষ্য দেয় যে সময় নিজ সাধ্যমত বাংলাদেশের বাস্তবিক সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে চাইত। ডিসফাংশনাল একটা সমাজে প্রচণ্ড ট্রমাটাইজড এক ব্যক্তি হলেন বাদশা, যে বড় হয়ে ওঠে ন্যায়-বিচারের একটা আধাখেঁচড়া বোধ নিয়ে। এ সমাজই বাদশাদেরর জন্ম দেয়। খোদ ভিক্টিমের মধ্য দিয়েই কীভাবে অপরাধ নিজেকে জিইয়ে রাখে, সেটাই দর্শকের চোখের সামনে মেলে ধরে ‘আম্মাজান।’
সহায়ক সূত্রঃ
Rape: From Lucretia to #MeToo, Mithu Sanyal
Ab Urbe Condita, Livy