জম্বি উৎপাদনকারী শিক্ষাব্যবস্থা

William J astore
উইলিয়াম জে. অ্যাস্টোর
অধ্যাপক ও সামরিক ইতিহাস গবেষক
শিক্ষা হয়ে পড়ে একটা পণ্য, আর শিক্ষার্থীরা পরিণত হয় ভোক্তায়, তখন জন্ম নেয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যা কেবল জম্বি উৎপাদন করতে সক্ষম। অলঙ্করণ: সামিউল

মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী একজন লোক বিশ বছর আমেরিকার বিমান বাহিনীতে কাজ করার পর এখন একটা টেকনিকাল কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে হাতের কাজ, নির্মাণকার্য এবং পণ্য ও সেবাদানের দুনিয়ার নিকটবর্তী করার ব্যাপারে আমি সহানুভূতিশীল। কিন্তু খোদ শিক্ষাই যেন কোনো ভোগ্যবস্তু না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা দরকার। যখন শিক্ষা হয়ে পড়ে একটা পণ্য, আর শিক্ষার্থীরা পরিণত হয় ভোক্তায়, তখন জন্ম নেয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যা কেবল জম্বি উৎপাদন করতে সক্ষম। শিক্ষাকে খণ্ডিত করে পাওয়ারপয়েন্ট কণিকায় ভেঙে সহজপাচ্য টুকরায় পরিণত করার চর্চার মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরণের জম্বি শিক্ষাব্যবস্থা নির্বোধভাবে আরো পণ্য ভোগের দিকে এগিয়ে দেয়। এই পরিণতি লোভ দ্বারা চালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু আদর্শভিত্তিক গণতন্ত্রের সাথে কোনোভাবেই না।        

বুদ্ধিহীন ভোগ তো এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু এই জম্বিরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও নির্বোধ হয়ে থাকে। আর এই কারণেই স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো খুব করে চেষ্টা করে ক্ষমতার চূড়ায় ওঠার প্রক্রিয়ায় এদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে। এখানে এ্যাডলফ আইখম্যানের ব্যাপারে হানাহ আরেন্টের পর্যালোচনাটা বিবেচনা করা যাক। আইখম্যানের ব্যাপারে তার মূল্যায়ন ছিল যে তার চাকরির দাবি-দাওয়া (ইউরোপ থেকে ইহুদিদের নির্মূলকরণ) তাকে পুরোপুরি দখল করে রেখেছে, অর্থাৎ সে ছিল একজন গতানুগতিক কেরিয়ারবাদী চিন্তার দাস যে নাৎসি দলের আদর্শিক সীমার বাইরে কোনোকিছু ভাবতেই সক্ষম ছিল না।   

তবে এর অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিকটাতে ফিরে যাওয়া যাক। ওয়াল স্ট্রিট: মানি নেভার স্লিপস (২০১০) সিনেমায় মাইকেল ডাগলাস অভিনীত বিখ্যাত চরিত্র গর্ডোন গেকো সে বছরের স্নাতক শিক্ষার্থীদেরকে নিনজা (নো ইনকাম, নো জবস, নো অ্যাসেটস) বলে অভিহিত করেন। সোজা কথায়, ‘তাদের আকাশ ভরা তারা…’, তিনি বলেন। আর সেটা সত্য বলে ভেবে নেয়া যেতে পারে যদি কলেজ ডিগ্রিকে একটা ভালো টাকা-পয়সাওয়ালা চাকরির পাসপোর্ট হিসেবে দেখেন।   

কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষা এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। প্রকৃত শিক্ষা আমূল রূপান্তর ঘটায়। একইসাথে আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং আত্মার সাথে সংযোগ ঘটায়। জীবনযাপনের এমন বহু বিকল্প পথ খুলে দেয় যার শুরু ও শেষ কোনো অফিসঘরের নয়। তা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার একটা পরিমাপক যা কেবল বেতন ও টাকা-পয়সার মধ্যে সীমিত না।    

আর্থিক উন্নতি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা একজন মানুষের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করবে, কিংবা অন্তত তাই করা উচিত। চরিত্রের উন্নতিসাধন ও রুচির উৎকর্ষও এর সাথে জড়িত। একইসাথে তা আমাদেরকে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক বানিয়ে তুলবে যাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি কদর ও নিষ্ঠা হবে আরো আন্তরিক ও তীব্র।  

সেজন্যই উচ্চশিক্ষার জন্য জনগণের পক্ষ থেকে আরো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে। উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক তহবিল অবশ্যই আগের পর্যায়ে পুনর্গঠন করতে হবে, কেননা শিক্ষিত ও আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিরাই সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক মঙ্গল নিশ্চিত করতে পারে। 

সোজা কথায়, শিক্ষা কোনো ভোগ্যপণ্য নয়—বরং তা জাতিগত সম্পদ।  

কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে আজকের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই সংকীর্ণ যে একে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি ও চাকরির জন্য প্রস্তুতিপর্ব হিসেবেই দেখা হয়। স্টেমের (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) প্রতি ঝোঁক বাড়ার পিছনে এই প্রবণতা বড় একটা কারণ। কিন্তু এর গভীরেও প্রোথিত রয়েছে কড়া শ্রেণিভিত্তিক পক্ষপাত। শিক্ষার্থীদেরকে বলা হয় যে স্বার্থপর হওয়াই ভালো এবং সমাজে তাদের প্রধান ভূমিকা হলো স্রষ্টা নয়, ভোক্তা হওয়া; স্বপ্নদ্রষ্টা নয়, প্রথানুসারী হওয়া। 

বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মদদপুষ্ট শিক্ষকরা ‘প্রতিযোগিতার’ ব্যাপারে গতানুগতিক ফাঁপা মন্তব্য উগড়ে দিতে থাকে। অলঙ্করণ: শফিক হীরা

স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও এ ধরণের পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মদদপুষ্ট শিক্ষকরা ‘প্রতিযোগিতার’ ব্যাপারে গতানুগতিক ফাঁপা মন্তব্য উগড়ে দিতে থাকেন। শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা স্নাতক শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে বলে যে জীবনে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো ইতিবাচক মনোভাব, সময়ানুবর্তিতা আর স্মার্ট জামাকাপড়।     

শিক্ষাকে যদি আমরা ভোগ্যবস্তুর এই দুনিয়ার আর দশটা জিনিসের মত একটা পণ্য হিসেবে দেখতে থাকি, তাহলে আমাদের বাচ্চারাও তাই শিখবে। তাদের উপর সারাক্ষণ যত আজেবাজে পণ্যনির্ভর, কর্পোরেট অর্থায়নে প্রচারিত তথ্য চাপিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোর সাথে জোড়াতালি দিয়ে তারা শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে শিখবে। ক্রিটিকাল চিন্তা? নাগরিক শিক্ষা? —এসব ভীষণ একঘেয়ে। এখন একটু চুপ করবে, প্লিজ? আমার এই ফোনটা ধরতে হবে/টুইট করতে হবে/ফেসবুকে নতুন একটা স্ট্যাটাস দিতে হবে। 

ইতোমধতেই তারা এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে ঘুরতে ঘুরতে এইসব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে ফাঁকা দৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকে। অর্থাৎ জম্বি পদ অর্জন করার অর্ধেক পথ তারা অতিক্রম করে ফেলেছে। তার উপর এই পণ্যনির্ভর জম্বি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদেরকে আরো সংক্রামিত না করলেই ভালো।  

কী করা যেতে পারে?
ইতিহাস আমাদেরকে পথের দিশা দিতে পারে। প্রখ্যাত যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান-প্রচারক জন টিন্ডালের কথাগুলো খেয়াল করুন। ১৮৬৮ সালে, আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে তার ‘শিক্ষার্থীদের প্রতি ভাষণে’ টিন্ডাল ব্যক্ত করেন:  ‘ছাত্রদের শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কিংবা অন্তত হওয়া উচিত তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বুদ্ধিদীপ্ত চর্চার সুযোগ করে দেয়া, তাদের প্রবৃত্তিকে প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশনা দেয়া, আর এই চর্চা ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তাদের মনোজগতকে জ্ঞান এমনভাবে সজ্জিত করা যাতে সে নিজের জীবন উপযোগিতা, সৌন্দর্য ও সততার সাথে যাপন করতে পারে।’    

অবশ্যই, সে সময় এ ধরণের শিক্ষার সুযোগ কেবল যুবক ছেলেদের জন্যই সীমিত ছিল। আজকে আমরা ‘ছাত্র’দের পাশাপাশি ‘ছাত্রী’দেরকেও এই আওতায় সংযুক্ত করতে পেরে নিজেদের পিঠ চাপড়াই— বর্ণভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক ও নৃজাতিভিত্তিক এ ধরণের শব্দের পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈচিত্র‍্যের প্রচারণার আরেকটি ধাপ বলে গণ্য করি।  

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার বৈচিত্র‍্যের কী হবে? যে শিক্ষাব্যবস্থা কেবল পরিচয়বাদী রাজনীতি ও আন্তরিকতা-বিবর্জিত উপযোগিতা বাদেও জীবনের সৌন্দর্য ও সততার আদর্শের উপর জোর দেবে। নিজস্ব বিচারবুদ্ধি লালন করার ক্ষমতা, পূর্বনির্ধারিত মতাদর্শভিত্তিক বাইনারি চিন্তাপদ্ধতিকে অতিক্রম করে নিজস্ব চিন্তা গড়ে তোলার ক্ষমতা যা বিভিন্ন ঘটনা, পরিস্থিতি ও দ্বিধার ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করতে দেবে, তা কোথায়?  

কিন্তু জম্বিরা তো সৌন্দর্য বা সততার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত না। তারা কোনো ক্ষেত্রেই বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে আগ্রহী না, বিশেষ করে নৈতিক ক্ষেত্রে। তারা শুধু চায় ভোগ করতে। তাদের ভোগরুচিই তাদের একমাত্র পরিচয়। তারা ফাঁপা মানুষ, সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় — এবং সহজেই ভুল পথে চালিত করা যায়। 

যতদিন পর্যন্ত আমরা শিক্ষাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে হাটে তুলব, ততদিন এই জম্বিদের আগমন ঘটতেই থাকবে। এমনকি তারা নিজেদের পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থাও করে নিতে পারবে। কিন্তু স্নাতক শেষ করার পর তারা জম্বি থেকে ফের মানুষ হয়ে যাবে সে প্রত্যাশা রাখবেন না। তাদের কাছ থেকে আশা করবেন না যে হুট করে তারা এমন সৎ নাগরিক হয়ে উঠবে যে প্রকৃত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, বা সেই সৌন্দর্য রক্ষা করতে আওয়াজ তুলবে। 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।