Solnit-Rebecca
রেবেকা সোলনিট
লেখক
Syed Farhad
সৈয়দ ফরহাদ
কবি ও গায়ক
অলঙ্করণ: সামিউল ইসলাম

ডেভিড গ্রেবার হাসিখুশি আর আমুদে মানুষ ছিলেন। মতাদর্শের লড়াইয়ে, তার সকল সম্ভাবনার উত্তাপ নিয়েই, তিনি ছিলেন বাকপটু আর কৌতূহলী। সেই শূন্য দশকের শুরুতে, নিউ হ্যাভেনে, কিংবা ২০২০ সালে তার মৃত্যুর বছর কয়েক আগেও লন্ডনে, যতবারই দেখেছি, তিনি ছিলেন সেই একই রকম। দীপ্তিময়, ঝাঁঝালো এক ক্লান্তিহীন প্রাণ। দেখে মনে হয়েছিল, তার মাথায় যেন সর্বক্ষণ বয়ে চলেছে চিন্তার ঝড়, শব্দগুলো যেন ছুটছে, উপচে পড়ছে, বরাবরের মতোই এক অপ্রতিরোধ্য প্রাচুর্যে। একজন ভাল শ্রোতা হিসেবেও এক্টিভিস্ট সার্কেলে তিনি সম্মানিত ছিলেন এবং তিনি যে কী ভীষণভাবে সমতায় বিশ্বাস করতেন এটা চারপাশের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখেই বোঝা যেত।   

তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন নৃতাত্ত্বিক। মাদাগাস্কারের পরম্পরা-ঘেষা মানুষদের মাঝে মাঠপর্যায়ে কাজ করার পর, তিনি কখনোই থেমে যাননি। বরং নিজের সমাজের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। নৃবিজ্ঞানীর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তার ‘ডেড জোনস অব দি ইম্যাজিনেশন: অন ভায়োলেন্স, ব্যুরোক্রেসি, অ্যান্ড ইন্টারপ্রেটিভ লেবার’ এর মতো প্রবন্ধে এবং বুলশিট জবস এর মতো গ্রন্থে তিনি এমন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন যেগুলোকে সাধারণত বোরিং হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কখনো বা সেসব বিষয় থেকে যায় উপেক্ষিত। ২০১১ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘ডেট’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে অর্থ এবং আর্থিক ব্যবস্থা কল্যাণের জন্য পুনর্গঠিত হতে পারে।    

তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, শিল্পোন্নত ইউরো-আমেরিকান সভ্যতা আর দশটা সভ্যতার অতীত কিংবা বর্তমানের মতোই, কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত একটা দশা মাত্র। তিনি সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন যখন সমাজগুলো কৃষি বা প্রযুক্তি বা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যখন সামাজিক গোষ্ঠীগুলি এমন কিছু বেছে নিয়েছিল, যেগুলো প্রায়ই ‘আদিম’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়। আদতে সমাজগুলো ছিল আরও মুক্ত। তিনি সেইসব বয়ানকেও প্রত্যাখান করেছিলেন, যেইসব বয়ান দাবি করে মানুষের আদিম সরলতা হ্রাস পাচ্ছে কিংবা আদিম বর্বরতা থেকে মানুষের মুক্তি ঘটছে ইত্যাদি। তার বদলে তিনি বহু বৈচিত্রের এক সমাজের কথা বলছেন, সমাজকে দেখেছেন এক চলমান নিরীক্ষা হিসেবে আর মানুষকে দেখেছেন সীমাহীন সৃজনশীল হিসেবে। এই বৈচিত্রই ছিল তার আশার উৎস, তার একগুঁয়েমির ভিত্তি, যে কারণে তিনি মনে করতেন- সবকিছু এভাবে আর চলতে পারেনা।    

মার্কাস রেডিকার যেমন, ডেভিডের একটি বই- পাইরেট এনলাইটেনমেন্ট– এর পর্যালোচনাতে লিখেছেন, ‘গ্রেবার যা যা লিখেছেন তা একই সাথে বর্তমানের কুলজি, একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ কেমন হতে পারে তার একটি বিবরণ।’ জেন্ডার বৈষম্য এবং সমাজের অপরাপর বৈষম্যসহ, সব ধরণের বৈষম্য নিয়েই তিনি ভাবতেন। যে সহিংসতা, অসমতা এবং পরাধীনতাকে উসকে দেয়, সেগুলো কিভাবে সমাজে বৈধতা হারাতে পারে আর কখন এ থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারে তিনি সেসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এক কথায়, তার সাধনার মূলে ছিল স্বাধীনতা; এবং তা অর্জনে প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করা।   

কখনো কখনো তাকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের ‘আমরাই ৯৯ পারসেন্ট’ স্লোগানটির জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু কোন কৃতিত্বের দাবিদার না হয়ে তিনি বরং নিজেকে ওই ৯৯ শতাংশের একজন মনে করতেন। তবে স্লোগানটি এতোই প্রভাব বিস্তার করে যে আজও ১ শতাংশ এলিটদের বোঝাতে বাক্যটি ব্যবহৃত হয়। ‘৯৯ পারসেন্ট’ আজ এক আশার বাক্য। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির বিপরীতে শ্রমিক ও মধ্যবিত্তকে ওই এক শব্দবন্ধেই আজ গ্রেপ্তার করা যায়। আর এটি একটি দাবিও, যা নিয়ে আমরা সকলে সোচ্চার। বিশেষ করে যারা রুটি-রুজির সংগ্রাম করছে, রুটি-রুজির সংস্থান যাদের অনিশ্চিত তাদের তো এই বিপুল বিত্তের মালিকদের বিরুদ্ধে একজোট হবার যথেষ্ট কারণ আছে।      

ডেভিড তার কাজে যেমন আনন্দ খুঁজে পেতেন, তেমনি বহু আন্দোলনের সঙ্গে তার কাজ ছিল প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ১৯৯০ এর দশকের শেষ দিকে কর্পোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই আন্দোলনের জেরে ১৯৯৯ সালের সিয়াটলের ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সের আয়োজন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ১৯৯৪ সালে মেক্সিকোর জাপাতিস্তা অভ্যুত্থান, আর ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে তো তিনি সরাসরিই যুক্ত ছিলেন।   

নিজের ধারণাগুলোর বাস্তবায়ন কিংবা তার নানা দিক উন্মোচনের মধ্য দিয়েই তো এমন আনন্দ খুঁজে নেওয়া উচিৎ। ডেভিড অন্তত তাই মনে করতেন। ডেভিডের ভাষায়, ‘দুনিয়ার এক অমোঘ সত্য হলো, সত্য আমরা নিজেরাই নির্মাণ করি, এমনকি ভিন্ন ভিন্নভাবে নির্মাণ করি।’     

এখন আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আপনার প্রস্তাবিত ধারণায় ভিন্ন ভিন্ন পূর্বানুমান আর মূল্যবোধের দুনিয়া হাজির আছে তবে পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল আপনি হাতে-নাতে পাবেন। আর তা হবে পুরোনো অনুমান আর মূল্যবোধ পালটে গিয়ে।  

আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এই ধারণাগুলোই আমাদের অস্ত্র। ডেভিড এই অস্ত্রগুলোই সবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। অথবা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেগুলো আমাদের সঙ্গেই আছে। আর এ কারণেই, একটি সহজবোধ্য লেখার স্টাইল গড়ে তুলতে তিনি তার সমস্ত শ্রম ব্যয় করেছেন। তাতে সফলও হয়েছেন। তবে এই পথটুকু যে সবসময় সহজ ছিল তা কিন্তু নয়। 

আমাদের দুজনেরই বন্ধু, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং ঋণ ব্যবস্থা বিলোপ আন্দোলনের কর্মী আস্ট্রা টেইলর তাকে একবার টেক্সট করেছিলেন, ‘ডেট’ বইটি আবার পড়ছি। আপনি সত্যিই দুর্দান্ত লেখক। বামপন্থীদের মধ্যে এই দক্ষতা বিরল।’ সেই আগস্টে, তার মৃত্যুর এক মাস আগে ডেভিড উত্তর দিয়েছিলেন: ‘সত্যি বলতে ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কিছু নেই আমার! এই কাজটি বেশ যত্ন নিয়ে করি, এই যা। আমি বরং এটাকে ‘পাঠকের প্রতি সদয় থাকা’ হিসেবে ধরে নিই। এটা আমার রাজনীতিরই অংশ।’   

অলঙ্করণ: রিসাদ

জবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মানুষ নিজেদেরকে শাসন করতে পারে। এই বিশ্বাস সমুন্নত রেখেই অ্যানারকিস্টদের সাধারণ জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। ডেভিড গ্রেবারও তাই রেখেছিলেন। হান্না আরেন্ট সম্পর্কে একবার লিন্ডসে স্টোনব্রিঞ্জ যেমন লিখেছিলেন- ‘তার ব্যতিক্রমী মনের ওপর মনোযোগ দেওয়ার মানে হলো তার চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ মিস করে যাওয়া। চিন্তা নিয়ে তার পাঠ হলো- চিন্তা সহজাত। আর এটাই চিন্তার শক্তি।’ একই কথা ডেভিডের বেলায়ও প্রযোজ্য।         

প্রতিভা ও মৌলিকতা, এই দুটোই তার ছিল। তারপরও তার একাডেমিক ক্যারিয়ার একেবারেই মসৃণ ছিলনা। হতে পারে, তা না হওয়ার কারণ ওই দুটো বিষয়। তার যে বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম, ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যান্থ্রপলজি’, ছোট্ট একটি বই। কিন্তু বড় বড় আইডিয়া দিয়ে ঠাসা। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমেরিকায় খোঁজ করলেই গন্ডায় গন্ডায় মার্ক্সবাদী একাডেমিশিয়ান পাওয়া যায়, কিন্তু তেরো জন একাডেমিশিয়ানও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যারা নিজেদের অন্তত অ্যানার্কিস্ট বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার মানে, মার্ক্সবাদের সাথে একাডেমির যে সখ্য আছে, সেটা অ্যানার্কিজম কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না। যদিও দিনশেষে, এটা ছিল একমাত্র সামাজিক আন্দোলন যার শুরুটা একজন একাডেমিক স্কলারের হাত ধরেই। পরবর্তীতে এটি শ্রমিক শ্রেণীকে জড়ো করার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।’ মার্ক্সবাদের সঙ্গে তুলনা করে তিনি যুক্তি দেন যে, অ্যানার্কিজম আদতে তা ছিল না, বরং এটার শুরু কিছু বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্বে। বরং তার ভাষায়, ‘অ্যানার্কিজমের মৌলিক নীতিগুলিগুলো হলো –স্বতস্ফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পারস্পরিক সহায়তা, এইসব’, যেগুলো কিনা সহজাতভাবেই, যতদিন ধরে দুনিয়ায় ‘মানবতা আছে’ ততদিন ধরেই আছে।   

একজন একডেমিশিয়ান এবং একটিভিস্ট হিসেবে ডেভিড যে কথা বার বার বলে গেছেন, তা হলো-  ‘সবকিছু আর এইভাবে চলতে পারেনা।’ যেখানে একাডেমিয়ার লোকজন দুনিয়া বদলানোর কর্মকান্ড থেকে প্রায়শই একটা শীতল আর নিরাপদ দূরত্ব রাখতে চান, সেখানে তিনি এই কাজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী আর আন্তরিক। তিনি দেখতে চাইতেন আইডিয়া কাজে  পরিণত হয়ে দুনিয়া বদলে দিচ্ছে। টেইলর উল্লেখ করেছেন, ‘একদিকে তিনি একাডেমিক ব্যুরোক্রেসির ঢিলেমি ঘৃণা করতেন, আবার অন্যদিকে একটিভিস্টদের সঙ্গে আড্ডা, তাদের সঙ্গে নানান আদর্শিক তর্কে অংশ নেওয়া উপভোগ করতেন। পছন্দ করতেন তাদের সঙ্গে নানা পরিকল্পনা আর খুনসুটিতে মেতে থাকতে।’        

তিনি আশাবাদী ছিলেন, তবে অবশ্যই সেটা বাছবিচারহীনভাবে নয়। বরং যে সাক্ষী-সাবুদ তিনি সংগ্রহ করেছেন সমাজ থেকে, তাতে তিনি দেখেছেন যে মানব সমাজ এ যাবৎ নানা চেহারায় হাজির হয়েছে। ফলে তিনি মনে করতেন, আজ যাদের ক্ষমতাহীন বলা হচ্ছে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেই ক্ষমতায়িত হতে পারে। আর ঠিক এখানেই দরকার আইডিয়া।  

ডেভিড তার ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপোলজি’  বইতে মাদাগাস্কারের সাকালাভা জনগোষ্ঠীর একটি আচারের কথা উল্লেখ করেছিলেন; যেখানে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত রাজাদের সম্মান জানায়। তবে এই রাজাদের মনোবাসনা প্রকাশিত হয় ‘এক আধ্যাত্মিক মধ্যস্ততাকারীর মাধ্যমে, যারা আবার অনভিজাত সাধারণ বয়স্ক নারী।’ অর্থাৎ, আচার অনুষ্ঠানটি অভিজাত বংশের পুরুষদের দিয়ে পরিচালিত হলেও, তা আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অনভিজাত নারীদের দ্বারা।    

বুদ্ধিজীবী ও এক্টিভিস্টদের জন্য আশা জিনিসটা খুব গোলমেলে। অন্যদিকে হতাশাবাদ মানবপ্রকৃতি এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিরোধী হলেও এটাকে বেশ বাস্তবধর্মী বলে মনে করা হয়। সাধারণত দুনিয়ার যা পরিস্থিতি তা দেখলে হতাশাকেই বাস্তবসম্মত মনে হয়, আশাবাদকে মনে হয় বালখিল্যতা। যদিও এর উল্টোটা মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে। আশা ব্যাপারটা রিস্কি। আশা করে আপনি হারতে পারেন, হেরেও থাকেন প্রায়শই, কিন্তু রেকর্ড ট্র্যাক করলে দেখা যাবে, চেষ্টা করলে কিছু কিছু সময় আপনি জিতেও যান।    

তার ‘ডেস্পায়ার ফ্যাটিগ’ নামের প্রবন্ধটা শুরু হয় এরকম লাইন দিয়ে: ‘নিরাশা ব্যাপারটাকে কি বোরিং লাগা সম্ভব?’ ডেভিডের অসম্ভব শক্তির জায়গা এটাই ছিল যে তিনি আউটসাইডারের মতো করে ভাবতেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধগুলোকে ঠিক ধরে নিয়ে তারপর এগুতেন না, বরং প্রশ্ন করতেন, ‘এই জিনিসটা যদি মেনে না নেই তাহলে কী হতে পারে?’ যদি এই জিনিসটার আদি ও অন্ত খুঁজি, প্রভাব বিশ্লেষণ করি, খারিজ করি, এপিঠ ওপিঠ নেড়েচেড়ে দেখি, তাহলে আসলে আমরা কী পেতে পারি? এমনও তো হতে পারে এভাবে মিলে গেল মুক্তির পথ! 

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।