ডেভিড গ্রেবার হাসিখুশি আর আমুদে মানুষ ছিলেন। মতাদর্শের লড়াইয়ে, তার সকল সম্ভাবনার উত্তাপ নিয়েই, তিনি ছিলেন বাকপটু আর কৌতূহলী। সেই শূন্য দশকের শুরুতে, নিউ হ্যাভেনে, কিংবা ২০২০ সালে তার মৃত্যুর বছর কয়েক আগেও লন্ডনে, যতবারই দেখেছি, তিনি ছিলেন সেই একই রকম। দীপ্তিময়, ঝাঁঝালো এক ক্লান্তিহীন প্রাণ। দেখে মনে হয়েছিল, তার মাথায় যেন সর্বক্ষণ বয়ে চলেছে চিন্তার ঝড়, শব্দগুলো যেন ছুটছে, উপচে পড়ছে, বরাবরের মতোই এক অপ্রতিরোধ্য প্রাচুর্যে। একজন ভাল শ্রোতা হিসেবেও এক্টিভিস্ট সার্কেলে তিনি সম্মানিত ছিলেন এবং তিনি যে কী ভীষণভাবে সমতায় বিশ্বাস করতেন এটা চারপাশের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখেই বোঝা যেত।
তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন নৃতাত্ত্বিক। মাদাগাস্কারের পরম্পরা-ঘেষা মানুষদের মাঝে মাঠপর্যায়ে কাজ করার পর, তিনি কখনোই থেমে যাননি। বরং নিজের সমাজের দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন। নৃবিজ্ঞানীর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে তার ‘ডেড জোনস অব দি ইম্যাজিনেশন: অন ভায়োলেন্স, ব্যুরোক্রেসি, অ্যান্ড ইন্টারপ্রেটিভ লেবার’ এর মতো প্রবন্ধে এবং বুলশিট জবস এর মতো গ্রন্থে তিনি এমন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন যেগুলোকে সাধারণত বোরিং হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কখনো বা সেসব বিষয় থেকে যায় উপেক্ষিত। ২০১১ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘ডেট’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজে অর্থ এবং আর্থিক ব্যবস্থা কল্যাণের জন্য পুনর্গঠিত হতে পারে।
তিনি বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, শিল্পোন্নত ইউরো-আমেরিকান সভ্যতা আর দশটা সভ্যতার অতীত কিংবা বর্তমানের মতোই, কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত একটা দশা মাত্র। তিনি সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেছেন যখন সমাজগুলো কৃষি বা প্রযুক্তি বা সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। যখন সামাজিক গোষ্ঠীগুলি এমন কিছু বেছে নিয়েছিল, যেগুলো প্রায়ই ‘আদিম’ বলে খারিজ করে দেওয়া হয়। আদতে সমাজগুলো ছিল আরও মুক্ত। তিনি সেইসব বয়ানকেও প্রত্যাখান করেছিলেন, যেইসব বয়ান দাবি করে মানুষের আদিম সরলতা হ্রাস পাচ্ছে কিংবা আদিম বর্বরতা থেকে মানুষের মুক্তি ঘটছে ইত্যাদি। তার বদলে তিনি বহু বৈচিত্রের এক সমাজের কথা বলছেন, সমাজকে দেখেছেন এক চলমান নিরীক্ষা হিসেবে আর মানুষকে দেখেছেন সীমাহীন সৃজনশীল হিসেবে। এই বৈচিত্রই ছিল তার আশার উৎস, তার একগুঁয়েমির ভিত্তি, যে কারণে তিনি মনে করতেন- সবকিছু এভাবে আর চলতে পারেনা।
মার্কাস রেডিকার যেমন, ডেভিডের একটি বই- পাইরেট এনলাইটেনমেন্ট– এর পর্যালোচনাতে লিখেছেন, ‘গ্রেবার যা যা লিখেছেন তা একই সাথে বর্তমানের কুলজি, একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ কেমন হতে পারে তার একটি বিবরণ।’ জেন্ডার বৈষম্য এবং সমাজের অপরাপর বৈষম্যসহ, সব ধরণের বৈষম্য নিয়েই তিনি ভাবতেন। যে সহিংসতা, অসমতা এবং পরাধীনতাকে উসকে দেয়, সেগুলো কিভাবে সমাজে বৈধতা হারাতে পারে আর কখন এ থেকে সমাজ মুক্ত হতে পারে তিনি সেসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। এক কথায়, তার সাধনার মূলে ছিল স্বাধীনতা; এবং তা অর্জনে প্রতিবন্ধকতাগুলো খুঁজে বের করা।
কখনো কখনো তাকে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের ‘আমরাই ৯৯ পারসেন্ট’ স্লোগানটির জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হতো। কিন্তু কোন কৃতিত্বের দাবিদার না হয়ে তিনি বরং নিজেকে ওই ৯৯ শতাংশের একজন মনে করতেন। তবে স্লোগানটি এতোই প্রভাব বিস্তার করে যে আজও ১ শতাংশ এলিটদের বোঝাতে বাক্যটি ব্যবহৃত হয়। ‘৯৯ পারসেন্ট’ আজ এক আশার বাক্য। সমাজের বিত্তবান শ্রেণির বিপরীতে শ্রমিক ও মধ্যবিত্তকে ওই এক শব্দবন্ধেই আজ গ্রেপ্তার করা যায়। আর এটি একটি দাবিও, যা নিয়ে আমরা সকলে সোচ্চার। বিশেষ করে যারা রুটি-রুজির সংগ্রাম করছে, রুটি-রুজির সংস্থান যাদের অনিশ্চিত তাদের তো এই বিপুল বিত্তের মালিকদের বিরুদ্ধে একজোট হবার যথেষ্ট কারণ আছে।
ডেভিড তার কাজে যেমন আনন্দ খুঁজে পেতেন, তেমনি বহু আন্দোলনের সঙ্গে তার কাজ ছিল প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে ১৯৯০ এর দশকের শেষ দিকে কর্পোরেট বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ওই আন্দোলনের জেরে ১৯৯৯ সালের সিয়াটলের ওয়ার্ল্ড ট্রেড অরগানাইজেশন মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সের আয়োজন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ১৯৯৪ সালে মেক্সিকোর জাপাতিস্তা অভ্যুত্থান, আর ২০১১ সালের অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনে তো তিনি সরাসরিই যুক্ত ছিলেন।
নিজের ধারণাগুলোর বাস্তবায়ন কিংবা তার নানা দিক উন্মোচনের মধ্য দিয়েই তো এমন আনন্দ খুঁজে নেওয়া উচিৎ। ডেভিড অন্তত তাই মনে করতেন। ডেভিডের ভাষায়, ‘দুনিয়ার এক অমোঘ সত্য হলো, সত্য আমরা নিজেরাই নির্মাণ করি, এমনকি ভিন্ন ভিন্নভাবে নির্মাণ করি।’
এখন আপনি যদি বিশ্বাস করেন, আপনার প্রস্তাবিত ধারণায় ভিন্ন ভিন্ন পূর্বানুমান আর মূল্যবোধের দুনিয়া হাজির আছে তবে পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ ফল আপনি হাতে-নাতে পাবেন। আর তা হবে পুরোনো অনুমান আর মূল্যবোধ পালটে গিয়ে।
আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এই ধারণাগুলোই আমাদের অস্ত্র। ডেভিড এই অস্ত্রগুলোই সবার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন। অথবা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেগুলো আমাদের সঙ্গেই আছে। আর এ কারণেই, একটি সহজবোধ্য লেখার স্টাইল গড়ে তুলতে তিনি তার সমস্ত শ্রম ব্যয় করেছেন। তাতে সফলও হয়েছেন। তবে এই পথটুকু যে সবসময় সহজ ছিল তা কিন্তু নয়।
আমাদের দুজনেরই বন্ধু, লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, এবং ঋণ ব্যবস্থা বিলোপ আন্দোলনের কর্মী আস্ট্রা টেইলর তাকে একবার টেক্সট করেছিলেন, ‘ডেট’ বইটি আবার পড়ছি। আপনি সত্যিই দুর্দান্ত লেখক। বামপন্থীদের মধ্যে এই দক্ষতা বিরল।’ সেই আগস্টে, তার মৃত্যুর এক মাস আগে ডেভিড উত্তর দিয়েছিলেন: ‘সত্যি বলতে ধন্যবাদ পাওয়ার মতো কিছু নেই আমার! এই কাজটি বেশ যত্ন নিয়ে করি, এই যা। আমি বরং এটাকে ‘পাঠকের প্রতি সদয় থাকা’ হিসেবে ধরে নিই। এটা আমার রাজনীতিরই অংশ।’

জবরদস্তিমূলক প্রতিষ্ঠান ছাড়াও মানুষ নিজেদেরকে শাসন করতে পারে। এই বিশ্বাস সমুন্নত রেখেই অ্যানারকিস্টদের সাধারণ জনগণের ওপর আস্থা রাখতে হবে। ডেভিড গ্রেবারও তাই রেখেছিলেন। হান্না আরেন্ট সম্পর্কে একবার লিন্ডসে স্টোনব্রিঞ্জ যেমন লিখেছিলেন- ‘তার ব্যতিক্রমী মনের ওপর মনোযোগ দেওয়ার মানে হলো তার চিন্তার গুরুত্বপূর্ণ পাঠ মিস করে যাওয়া। চিন্তা নিয়ে তার পাঠ হলো- চিন্তা সহজাত। আর এটাই চিন্তার শক্তি।’ একই কথা ডেভিডের বেলায়ও প্রযোজ্য।
প্রতিভা ও মৌলিকতা, এই দুটোই তার ছিল। তারপরও তার একাডেমিক ক্যারিয়ার একেবারেই মসৃণ ছিলনা। হতে পারে, তা না হওয়ার কারণ ওই দুটো বিষয়। তার যে বইটি আমি প্রথম পড়েছিলাম, ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যান্থ্রপলজি’, ছোট্ট একটি বই। কিন্তু বড় বড় আইডিয়া দিয়ে ঠাসা। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমেরিকায় খোঁজ করলেই গন্ডায় গন্ডায় মার্ক্সবাদী একাডেমিশিয়ান পাওয়া যায়, কিন্তু তেরো জন একাডেমিশিয়ানও খুঁজে পাওয়া যাবেনা যারা নিজেদের অন্তত অ্যানার্কিস্ট বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তার মানে, মার্ক্সবাদের সাথে একাডেমির যে সখ্য আছে, সেটা অ্যানার্কিজম কখনোই গড়ে তুলতে পারবে না। যদিও দিনশেষে, এটা ছিল একমাত্র সামাজিক আন্দোলন যার শুরুটা একজন একাডেমিক স্কলারের হাত ধরেই। পরবর্তীতে এটি শ্রমিক শ্রেণীকে জড়ো করার আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল।’ মার্ক্সবাদের সঙ্গে তুলনা করে তিনি যুক্তি দেন যে, অ্যানার্কিজম আদতে তা ছিল না, বরং এটার শুরু কিছু বুদ্ধিজীবীর নেতৃত্বে। বরং তার ভাষায়, ‘অ্যানার্কিজমের মৌলিক নীতিগুলিগুলো হলো –স্বতস্ফুর্ত ভাবে গড়ে ওঠা সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, পারস্পরিক সহায়তা, এইসব’, যেগুলো কিনা সহজাতভাবেই, যতদিন ধরে দুনিয়ায় ‘মানবতা আছে’ ততদিন ধরেই আছে।
একজন একডেমিশিয়ান এবং একটিভিস্ট হিসেবে ডেভিড যে কথা বার বার বলে গেছেন, তা হলো- ‘সবকিছু আর এইভাবে চলতে পারেনা।’ যেখানে একাডেমিয়ার লোকজন দুনিয়া বদলানোর কর্মকান্ড থেকে প্রায়শই একটা শীতল আর নিরাপদ দূরত্ব রাখতে চান, সেখানে তিনি এই কাজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত আগ্রহী আর আন্তরিক। তিনি দেখতে চাইতেন আইডিয়া কাজে পরিণত হয়ে দুনিয়া বদলে দিচ্ছে। টেইলর উল্লেখ করেছেন, ‘একদিকে তিনি একাডেমিক ব্যুরোক্রেসির ঢিলেমি ঘৃণা করতেন, আবার অন্যদিকে একটিভিস্টদের সঙ্গে আড্ডা, তাদের সঙ্গে নানান আদর্শিক তর্কে অংশ নেওয়া উপভোগ করতেন। পছন্দ করতেন তাদের সঙ্গে নানা পরিকল্পনা আর খুনসুটিতে মেতে থাকতে।’
তিনি আশাবাদী ছিলেন, তবে অবশ্যই সেটা বাছবিচারহীনভাবে নয়। বরং যে সাক্ষী-সাবুদ তিনি সংগ্রহ করেছেন সমাজ থেকে, তাতে তিনি দেখেছেন যে মানব সমাজ এ যাবৎ নানা চেহারায় হাজির হয়েছে। ফলে তিনি মনে করতেন, আজ যাদের ক্ষমতাহীন বলা হচ্ছে তারা ঐক্যবদ্ধ হলেই ক্ষমতায়িত হতে পারে। আর ঠিক এখানেই দরকার আইডিয়া।
ডেভিড তার ‘ফ্র্যাগমেন্টস অফ অ্যান অ্যানার্কিস্ট অ্যানথ্রোপোলজি’ বইতে মাদাগাস্কারের সাকালাভা জনগোষ্ঠীর একটি আচারের কথা উল্লেখ করেছিলেন; যেখানে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মৃত রাজাদের সম্মান জানায়। তবে এই রাজাদের মনোবাসনা প্রকাশিত হয় ‘এক আধ্যাত্মিক মধ্যস্ততাকারীর মাধ্যমে, যারা আবার অনভিজাত সাধারণ বয়স্ক নারী।’ অর্থাৎ, আচার অনুষ্ঠানটি অভিজাত বংশের পুরুষদের দিয়ে পরিচালিত হলেও, তা আবার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অনভিজাত নারীদের দ্বারা।
বুদ্ধিজীবী ও এক্টিভিস্টদের জন্য আশা জিনিসটা খুব গোলমেলে। অন্যদিকে হতাশাবাদ মানবপ্রকৃতি এবং রাজনৈতিক সম্ভাবনার বিরোধী হলেও এটাকে বেশ বাস্তবধর্মী বলে মনে করা হয়। সাধারণত দুনিয়ার যা পরিস্থিতি তা দেখলে হতাশাকেই বাস্তবসম্মত মনে হয়, আশাবাদকে মনে হয় বালখিল্যতা। যদিও এর উল্টোটা মাঝেমধ্যেই হয়ে থাকে। আশা ব্যাপারটা রিস্কি। আশা করে আপনি হারতে পারেন, হেরেও থাকেন প্রায়শই, কিন্তু রেকর্ড ট্র্যাক করলে দেখা যাবে, চেষ্টা করলে কিছু কিছু সময় আপনি জিতেও যান।
তার ‘ডেস্পায়ার ফ্যাটিগ’ নামের প্রবন্ধটা শুরু হয় এরকম লাইন দিয়ে: ‘নিরাশা ব্যাপারটাকে কি বোরিং লাগা সম্ভব?’ ডেভিডের অসম্ভব শক্তির জায়গা এটাই ছিল যে তিনি আউটসাইডারের মতো করে ভাবতেন। তিনি প্রতিষ্ঠিত স্বতঃসিদ্ধগুলোকে ঠিক ধরে নিয়ে তারপর এগুতেন না, বরং প্রশ্ন করতেন, ‘এই জিনিসটা যদি মেনে না নেই তাহলে কী হতে পারে?’ যদি এই জিনিসটার আদি ও অন্ত খুঁজি, প্রভাব বিশ্লেষণ করি, খারিজ করি, এপিঠ ওপিঠ নেড়েচেড়ে দেখি, তাহলে আসলে আমরা কী পেতে পারি? এমনও তো হতে পারে এভাবে মিলে গেল মুক্তির পথ!