WhatsApp Image 2024-09-19 at 12.36.18
মাহীন হক
লেখক ও অনুবাদক
অলঙ্করণ: শফিক হীরা

বাকস্বাধীনতা কী, অন্তত কাগজে-কলমে, আমরা অনেকেই হয়তো জানি। কিন্তু এর সীমা-পরিসীমা কতটুকু, বাকস্বাধীনতা ও ঘৃণামূলক বক্তব্যের মধ্যে সীমারেখাটা ঠিক কোনখানে টানা হবে, এর পরিণতি কী হতে পারে— তার একটা রূপরেখা নির্মাণের চেষ্টা এই লেখাটা।   

‘তুমি যা বলছো আমি তার সাথে একমত নই, কিন্তু তোমার সে কথা বলার অধিকার রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব।’ ভলতয়েয়ারের নামে বহুলপ্রচলিত এই উক্তিটির মধ্যে বাকস্বাধীনতার চেতনা/স্পিরিট সবচেয়ে সফলভাবে ফুটে উঠেছে। বাকস্বাধীনতার মূল অনুষঙ্গ হলো যে কথা আমার শুনতে ভালো লাগছে না, সেটাও কারো বলতে পারার অধিকারের জন্য লড়াই করা। আফটার অল, যে কথা শুনতে ভালোই লাগে সেটাকে তো কেউ থামাতেও যাবে না। সুতরাং, বাকস্বাধীনতা সম্ভবত তখনই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যখন অপছন্দের কোনো কথা বলা হচ্ছে। গণতন্ত্রের, সহিষ্ণু সমাজকাঠামো গঠনের অন্যতম মূল ভিত্তি হচ্ছে বাকস্বাধীনতা।    

জাতিসঙ্ঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ১৯তম অনুচ্ছেদে এবং আমেরিকার সংবিধানের প্রথম সংশোধনে সকল মানুষের যেকোনো মত ধারণ করার ও তা নির্ভয়ে প্রকাশ করার অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।

বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে আলাদা করে প্রথম গুরুত্ব আরোপ করেন ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল। তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন লিবার্টি’র বিশাল এক অংশ জুড়ে রয়েছে অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশের অধিকার ও প্রয়োজনীয়তার আলাপ। মিলের মতে, বাকস্বাধীনতা কেবল ব্যক্তিগত উন্নতির জন্যই নয়, বরং জাতিগত অগ্রগতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিল মনে করতেন একটা মুক্ত সমাজে অসংখ্য মতামত মার্বেলের মত ঠোকাঠুকি করবে এবং তার মধ্যে দিয়েই কল্যাণকর সত্যের উত্থান হবে। এমনকি একটা অভিমত যদি সত্যও হয়, মিল মনে করে তাহলেও সেটাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করা একটা সুস্থ চর্চা। এই চর্চা সেই সত্যটাকে নির্জীব মৌলবাদে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করে, এবং বারবার বিরোধিতার মোকাবেলা করে নতুনরূপে আবির্ভূত হওয়ার সুযোগ করে দেয়।  সেজন্য কোনো প্রকার কর্তৃপক্ষের দ্বারা কোনো মত দমন করার একদমই পক্ষপাতী ছিলেন না মিল। তিনি বলেন:
 
‘কোনো অভিমতে অভিব্যক্তি দমন করার মূল খারাপ দিক হলো এটা সমগ্র মানবজাতিকে বঞ্চিত করে; বঞ্চিত করে বিদ্যমান প্রজন্মকে এবং অনাগত প্রজন্মকে; যারা সেই ভিন্নমত ধারণ করে না তাদেরকেই বরং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। যদি সেই অভিমতটা ঠিক হয় তাহলে মানুষ বঞ্চিত হয় ভ্রান্তির বদলে সত্য লাভ করার সুযোগ থেকে। আর যদি অভিমতটা ভুলও হয়, তবুও গোটা প্রজন্ম বঞ্চিত হয় আরো চমৎকার এক সুযোগ থেকে, সেটা হলো ভ্রান্তির সাথে বিরোধের মধ্য দিয়ে সত্যের ব্যাপারে আরো উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত ধারণা লাভ করা।’

ঠিক তথ্য থেকে ভুল তথ্যের পরিশোধনের খাতিরে স্টুয়ার্ট মিলকে একটা সেনসরশিপ ব্যবস্থার কথা বলা হলে, তখন মিল হয়তো বলবেন কোনো নিখুঁত সেনসরশিপ ব্যবস্থা আসলে সম্ভব না। বরং বেশিরভাগ সময়ই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় এমন ক্ষমতাকাঠামো দ্বারা যা নির্ধারণ করে দিতে চায় কোন ধরণের মতামত প্রচারিত হবে এবং কোনগুলো হবে না। সত্য কিংবা কল্যাণ খুব কম সময়ই তাদের বিবেচ্য থাকে। ইতিহাসে এর অনেক নজির পাওয়া যায়। যেমন, ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক গ্যালিলিও কিংবা ব্রুনোর কণ্ঠরোধের কাহিনি আমরা সবাই জানি। অথচ এখন তাদের মতামতই সত্য বলে গৃহীত। অতএব, সত্যতার নিরিখে কারো মতামত যদি কেউ রোধ করতে চায়, তাহলে তাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে সে নিজে সম্পূর্ণভাবে সত্যের দাবিদার। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় তেমনটা হয় না।    
সেজন্যই স্টুয়ার্ট মিল একটা মুক্ত সমাজ ও সেখানে অসংখ্য মতামতের অবাধ প্রচলনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে মিলের বক্তব্য সংক্ষেপে এরকম একটা উপপাদ্যে প্রকাশ করা যায়:

সূত্র ১: সত্য অনেক মূল্যবান এবং মানুষকে সত্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা অবাধ করে দিতে হবে
সূত্র ২: বাকস্বাধীনতা মানুষকে সত্যে পৌঁছতে সাহায্য করে
সিদ্ধান্ত: অতএব, বাকস্বাধীনতা অত্যন্ত মূল্যবান এবং বাকস্বাধীনতার  সংরক্ষণ জরুরি

তবে কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা রয়েছে যখন কারো বাকস্বাধীনতা প্রয়োগের ফলে অপর কারো নিরাপত্তা সরাসরি হুমকির মুখে পড়তে। যেমন, বিচারক অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র স্মরণীয় এক বক্তব্য দিয়েছিলেন যে, একটা ভিড় গিজগিজে থিয়েটারে “আগুন! আগুন!” বলে চিৎকার করা তো বাকস্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত না। কারণ আপনার সেই মশকরার কারণে অসংখ্য মানুষ আহত, এমনকি নিহতও হতে পারে। 

অলঙ্করণ: রাজিব কান্তি রায়


এ ক্ষেত্রে এখনো মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’ প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। মিলের ‘হার্ম প্রিন্সিপল’- এর  মূল কথা হলো: ‘একমাত্র এই কারণেই একটা সভ্য সমাজের সদস্যের উপর ন্যায্যভাবে জোর খাটানো যেতে পারে। তা হলো তাকে অন্য কারো ক্ষতি করা থেকে আটকানোর জন্য।’  কিন্তু এখানে মিল অত্যন্ত সতর্ক। সরাসরি অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন বক্তব্য ছাড়া কারো মতপ্রকাশের অধিকারে তিনি হস্তক্ষেপ করতে রাজি নন: ‘যদি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ কোনো বিষয়ে একমত হয়, এবং একজন মানুষ তার বিরুদ্ধমত ধারণ করে, তাহলে পৃথিবীর সবার সেই একজনের কণ্ঠরোধ করা যতটুকু ন্যায্য, সেই একজনের দ্বারাও বাকি প্রত্যেকের কণ্ঠরোধ করা ততটুকুই ন্যায্য।’ 



স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী/ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য

কিন্তু হার্ম প্রিন্সিপল কোন সীমা পর্যন্ত বাকস্বাধীনতাকে রক্ষা করবে সেটা পুরোপুরি স্পষ্ট না। কোনো বক্তব্য কোন পর্যায় পর্যন্ত সরাসরি কারো ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটা নির্ধারণ করা বেশ জটিল। যেমন, কথা বলার অবাধ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে যুক্তিটা ক্ষমতাসীনরা দিয়ে থাকে তা হলো নির্দিষ্ট কিছু মতের প্রচারণা রুদ্ধ করা একান্ত প্রয়োজন, কেননা তা সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। এই ধারণার প্রচারকদের মধ্যে প্রথম একজন ছিলেন প্লেটো। প্লেটো কবি/শিল্পীদেরকে বহিষ্কৃত কিংবা শিল্পমাধ্যমের স্বাধীনতা সীমিত করার পক্ষে বিস্তর লিখেছেন তার দ্য রিপাবলিক গ্রন্থে। তার মতে, কবিরা সমাজে মিথ্যা ছড়ান। তাছাড়া খারাপ ব্যক্তিদের মহিমান্বিত করার ও অনুসরণীয় ব্যক্তিদের হীন প্রমাণ করার ক্ষমতা কবিদের থাকে। ফলে রাষ্ট্রের ও সমাজের স্থিতিশীলতার খাতিরে এদের কণ্ঠরোধ করার মধ্যে প্লেটো কোনো সমস্যা দেখতে পাননি। অথচ দুঃখের ব্যাপার হলো, প্লেটোর গুরুকে এই অজুহাতেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সক্রেটিসের ব্যাপারে বলা হয় তিনি এথেন্সের যুবসমাজকে কলুষিত করেছিলেন এবং সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছিলেন। সক্রেটিসের কাছে সুযোগ ছিল মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে যাওয়ার। শর্ত দেয়া হয়েছিল তিনি যদি বাকি জীবন চুপচাপ কোনো অশান্তি সৃষ্টি না করে অতিবাহিত করতে রাজি হন তাহলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে। কিন্তু সক্রেটিস তা মেনে নেননি। যিনি নিজেকে ডাঁশমাছি বা গ্যাডফ্লাই  নামে ডাকতেন, এথেন্সকে বিরক্ত করা, অস্থিতিশীল করাকেই নিজের কর্তব্য বলে মনে করতেন, তার পক্ষে এটা মেনে নেয়ার কথাও না। অর্থাৎ, বেশিরভাগ সময় সমাজের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করার যুক্তিটাকে রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ নিজেদের বিরুদ্ধে যেকোনো সমালোচনা ও ভিন্নমতকে দমন করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।   

আবার, ধর্মপরায়ণ কারো কাছে নিজের ধর্মের ব্যাপারে কোনো সমালোচনা বা কটূক্তি সহ্য করা বেশ কঠিন। এটা তাকে মানসিকভাবে পীড়িতও করতে পারে। কিন্তু সেটা কি কারো মতপ্রকাশের অধিকারকে খর্বিত করার এখতিয়ার দেয়? ১৯৭৭ সালে যুক্তরাজ্যের জেমস কার্কাপের একটা কবিতা প্রকাশের জন্য সে ‘গে নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদককে জরিমানা ও কারাভোগ করতে হয়। সেই কবিতায় যীশুখ্রিষ্টকে এমনভাবে চিত্রিত করা হয় যার কারণে বহু খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী ভীষণভাবে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। সেসময় পিটার ট্যাচেল লেখেন: ‘খ্রিষ্টান ধর্মকে সকল প্রকার ভিন্নমত ও সমালোচনা থেকে সুরক্ষিত থাকার বিশেষ সুযোগ কেন দেয়া হবে? অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান তো এরকম ঢালাওভাবে বিরোধী মত ও ধারণা রুদ্ধ করার অধিকার উপভোগ করে না। বাকস্বাধীনতা, প্রতিবাদের অধিকার ও শৈল্পিক স্বাধীনতার খাতিরে ধর্মদ্রোহিতার আইনের অবলুপ্তি প্রয়োজন।’ 

এ ব্যাপারে যদিও একটা দাবি আছে যে বাকস্বাধীনতা মানে কাউকে আঘাত করা নয়। কিন্তু তাহলে আবারো আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে যেতে হবে। বাকস্বাধীনতা তখনই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক যখন তা কাউকে আঘাত করতে পারে বা কারো অপছন্দের কারণ হতে পারে। যে কথা কারো মধ্যে বিরূপতার জন্ম দেয় না সেটাকে রক্ষা করারও তেমন প্রয়োজন পড়ে না। এ বিষয়ে অলিভার কামের বক্তব্যও কাছাকাছি: ‘বাকস্বাধীনতা কখনো কারো মনে আঘাত দিতে পারবে না এই ধারণাটাকেও প্রশ্ন করতে হবে। কেননা এখানে ধরে নেয়া হয় যে আঘাত দেয়াটা এড়িয়ে যাওয়াই কর্তব্য। বাকস্বাধীনতা অবশ্যই কখনো-কখনো আঘাত করে থাকে, কিন্তু তাতে কোনো ভুল নেই। বাজে চিন্তার ধ্বংসের মাধ্যমেই জ্ঞান এগিয়ে চলে। আর এ প্রক্রিয়ায় কটাক্ষ ও মশকরাও খুব কার্যকর হাতিয়ার।’  অর্থাৎ এ ধরণের “আঘাত” বা চিন্তার সংঘর্ষ অনেক সময়ই আমাদের মনে চিন্তার নতুন শাখার জন্ম দিতে পারে। মিল যখন বিভিন্ন মতামতের অবাধ প্রচলনের মাধ্যমে মানুষের ব্যক্তিগত অগ্রগতির কথা বলতে গিয়া হয়তো এই ব্যাপারটাই ইঙ্গিত করেছিলেন। 



তবে, কিছু চরমপন্থী উদাহরণও রয়েছে যেখানে বাকস্বাধীনতার সীমানা টেনে দিতে হয়। যেমন, হেইট স্পিচ বা ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য। হেইট স্পিচ বেশিরভাগ সময় তাদেরকেই আক্রমণ করে যারা ইতোমধ্যে লৈঙ্গিক, আর্থিক, বা সামাজিক অবস্থানের কারণে নাজুক অবস্থায় রয়েছেন। ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্যের একটা অন্যতম উদ্দেশ্য হয় সমমনা আরো মানুষ জড়ো করা। এমতাবস্থায়, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আরো সহজ শিকারে পরিণত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে একটা বিখ্যাত নজির রয়েছে। ১৯৭৭ সালে নব্য-নাৎসির একটি দল ইলিনোয়ের স্কোকি নামে একটি গ্রামে মিছিল করার পরিকল্পনা করে। সেই গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ ছিল হয় হলোকস্ট থেকে ফিরে আসা লোক, বা তাদের নিকটজনের কেউ হলোকস্টে মৃত্যুবরণ করে। এ ব্যাপারে বিতর্কের তুমুল ঝড় উঠেছিল সে সময়। শেষ পর্যন্ত মিছিলটা যদিও স্কোকিতে হয়নি, কিন্তু শিকাগোরই একটা পার্কে তা সংঘটিত হয়েছিল। এরপর থেকে স্কোকি একটা বাকস্বাধীনতার চেতনার প্রতীকে পরিণত হয়।

বিশ শতকের দার্শনিক কার্ল পপারের প্রস্তাবিত একটি ধারণা ছিল ‘প্যারাডক্স অফ টলারেন্স” তথা ‘সহিষ্ণুতার গ্যাঁড়াকল।’ এর মূল বক্তব্য হলো, অসহিষ্ণুতাকেও আপনি নিজের সমাজে সহ্য করবেন কিনা? অর্থাৎ, যারা সমাজের নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে, তাদেরকে কোনো স্থান না দিতে বদ্ধপরিকর, আপনি তাদেরকেও স্থান দেবেন কিনা? যদি দেন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি না দেন, তাহলে আপনার সহিষ্ণুতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এই জটিলতার জায়গা থেকেই স্কোকি গ্রামের ঘটনাটা এত গুরুত্বপূর্ণ। ঘৃণামূলক বক্তব্যকে আপনার মোকাবেলা করতে হবে পালটা বক্তব্যের মাধ্যমেই। আপনি যদি এই ধরণের মতামত দমন করতে চান, তাহলে তার ফল আরো কদর্য হতে পারে। কেননা জোরপূর্বক এসব ঘৃণ্য বক্তব্যের প্রচারণা দমন করা গেলেও, এই বক্তব্যগুলো যে মনোভাব থেকে জন্ম নেয় সেগুলো আরো ফুঁসে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়াও একবার যদি ‘ঘৃণাসঞ্চারী বক্তব্য’ আখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট বক্তব্যকে নিষিদ্ধ করার চল শুরু হয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে সেই তকমার সীমানা বাড়তে বাড়তে যেকোনো প্রকার প্রথাবিরোধী মতকে দমনের কাজে তা ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে, সংলাপনির্ভর সংঘর্ষের  মঞ্চ খোলা থাকাই ভালো। সে ক্ষেত্রে, কোনো স্থায়ী পরিবর্তনের সম্ভাবনা আরো বাড়ে।

 

অর্থাৎ, বাকস্বাধীনতার মর্মকথাই এই যে, এমনকি নির্বোধ ঘৃণাজীবীদেরও আমাদের মোকাবেলা করতে হবে বাকস্বাধীনতা দিয়েই। জোরপূর্বক দমন-পীড়ন কেবল সেইসব বিষাক্ত মনোভাবকে নজরের অন্তরালে আরো ফুলে-ফেপে ওঠার সুযোগ করে দেয়।

ইন্টারনেটের যুগে বাকস্বাধীনতা

ইন্টারনেটের কল্যাণে গণমাধ্যমের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটে গেছে। যেকোনো বার্তা এখন মুহূর্তে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এমন এক সময়ে বাকস্বাধীনতার সুফল-কুফল পুনর্মূল্যায়নের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। একদিকে যেমন কোনোপ্রকার জবাবদিহিতা ছাড়া পরিচয় গোপন রেখে যা ইচ্ছা তাই গণপরিসরে ছড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে, অপরদিকে বহু ধ্যানধারণার সংমিশ্রণ ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগও অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে একটা ভিন্ন চিত্রও লক্ষ করা যায়। ইন্টারনেট বা সোশ্যাল মিডিয়াগুলো যে অ্যালগরিদম দ্বারা শাসিত সেখানে আপনার সকল তথ্যই এখানে মূলত পণ্য। আর  সেই তথ্য ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়া ভিন্নমতের সাথে পরিচিত করার বদলে আপনি ইতোমধ্যে যেসব ধ্যান-ধারণার সাথে এমনিতেই একমত সেগুলোর সম্মুখীন করে। ফলে চিন্তার সংঘর্ষের বদলে নির্দিষ্ট কিছু ভাবনাবলয়ের মধ্যেই আমরা ঘুরপাক খেতে থাকি। ক্রমশ আমরা একটা সংকীর্ণ চিন্তাপ্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকি। যার ফলে নতুন কোনো মত বা বক্তব্য আমাদেরকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি প্রবলভাবে আক্রান্ত করতে পারে। দেখা গেছে ইন্টারনেটে যেকোনো তর্ক-বিতর্ক খুব সহজেই মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। গডউইনের নিয়ম বলে, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা বিতর্ক যতক্ষণ ধরে চলতে থাকে, সেখানে ‘নাৎসি’ শব্দটা ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়তে থাকে।’  অর্থাৎ, সহিষ্ণুতার সাথে ভিন্নমত মোকাবেলা করার বদলে অহেতুক তকমা লাগিয়ে দেয়ার কিংবা খারিজ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ইন্টারনেটের কল্যাণে একটা স্বস্তির বুদ্বুদে যে আমরা বাস করি, সেই অভ্যস্ততাই হয়তো এই অসহিষ্ণুতার হেতু। 

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।