KM Rakib
কে এম রাকিব
ভাষায় বসতি

সমাজে সমস্ত প্রকার বৈষম্য সহনীয় করে তুলতে  ভাষাগত ব্যবস্থা নেয়াও খুব জরুরী। 

এই ভাষা হয় সুভাষণ (ইউফেমিজম) আর কোমলতায় গড়া। নকল অলঙ্কারে ঝলমল করতে থাকে ভাষার শরীর। তাকাইলে চোখে ধাঁধা লাগে। আর তাই সতর্ক না হইলে সেই ধাঁধাঁ-লাগা চোখে সত্যিগুলা ধরাই পড়ে না। 

কারণ ভাষা  প্রকাশ করে না শুধু, গোপনও করে। শুধু সংযুক্ত নয় বিযুক্তও করে।  

কনফুসিয়াসের নামে একটা কাহিনী চালু আছে। কনফুসিয়াসরে একবার জিগানো হইলো যে, তিনি পৃথিবীর সম্রাট হইলে কোন কাজটা প্রথমে করতেন? উনি কইছিলেন, তার প্রথম কাজ হবে ভাষারে বদলায়ে ফেলা।   

কনফুসিয়াস ভাষারে বদলানোর সুযোগ  না পাইলেও আধুনিক যুগে আইসা অধিপতি শ্রেণির হাতে ভাষারে অনেকাংশে গড়েপিটে নেওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

জর্জ ওরয়েলের  সেই  ‘১৯৮৪’ বইটার কথা মনে পড়বে আমাদের  যেইখানে নিউস্পিক বা নয়াজবান চালু হইছিল। সব ভালো কথা কইতে হবে। নেগেটিভ কিচ্ছু বলা যাবে না। ফলে ভাষার এমন বাস্তবতা তৈরি করতে হবে যাতে শ্রেণী-ক্ষমতা-কর্তৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠবে না।  

সুশীল সমাজ টিভি মিডিয়া পত্রিকার কলামিস্ট সেই নয়াজবানের খেদমতগার। কেউ জ্ঞানত, কেউ অজ্ঞানত। যে লোক প্রকৃতপক্ষে, ‘লেবার’ বা যে বদলা খাটে/ কামলা খাটে তারে মর্যাদাপূর্ণ ‘শ্রমিক’ নামে ডাকা হয়। বাসার যে কাজের বুয়া, কাজের মাইয়া/ ছেমড়ি/ছেড়ি তার জন্যও সুন্দর-মার্জিত এবং ‘তৎসমায়িত’ নাম বরাদ্দ করা হইছে: গৃহপরিচারিকা। ‘গার্মেন্সে কাম’  যারা করে তাদেরও মহিমান্বিত নাম ‘পোষাকশ্রমিক’।       

সুভাষণ কী? 

সোনার বাংলায় প্রবন্ধ-নিবন্ধের ক্ষেত্রে অলিখিত তরিকা হইলো, লেখার শিরোনামের মূলশব্দটা নিয়া  প্যাচাল পারা, ত্যানা প্যাচানো। যেমন, ধরেন, ক্যাকটাস নিয়ে লিখতে গিয়ে  আদিতে গ্রীকভাষায় শব্দটার মানে কী ছিলো?  ‘অন্ডকোষ। এইবারে শব্দটা ভাঙো, কোন্‌ অংশের কী অর্থ, সবমিলে কী দাঁড়াইল…  এইসব ইনায়ে- বিনায়ে লিখতে হবে কমসে কম এক পৃষ্ঠা। তারপর আলোচ্য বিষয়ে বিখ্যাত লোকেদের কয়েকটা বানী এস্তেমাল করা। 

সেই রাস্তা ফলো করা যাক, কিন্তু সংক্ষেপে।                

সুভাষণ বাংলা প্রতিশব্দটা  (সুভাষন) নিজেই  সুভাষণের একটা উদাহরণ। ইংরেজি ‘ইউফেমিজম’ শব্দটার গোড়া গ্রীক। অর্থ:  ‘যে কথা শুনতে ভালো লাগে’। সুভাষিত করে বললে, ‘শ্রুতিমধুর বচন’। 

ভাষাচার্য  সুকুমার সেন, সুভাষণ পরিচয় দিছেন এইভাবে:  

অকল্যাণসূচক অথবা নিন্দিত বা কুৎসিত  অর্থকে কল্যাণসূচকরূপে বা ভদ্রভাবে প্রকাশ করিবার জন্য সুভাষণ (Euphemism) অলঙ্কারের আশ্রয় লওয়া হয়।

বিখ্যাত একটা ডিকশনারি অনুযায়ী,‘অস্বস্তিকর বা বিব্রতকর কোনো বিষয়ে বলতে, যেমন, মৃত্যু ও সেক্স,  লোকে যে শিষ্ট শব্দ কিংবা অভিব্যক্তি ব্যবহার করে তা-ই সুভাষণ।‘  

সুভাষণ উপরের সংজ্ঞা দুইটার চাইতে বিস্তৃত হইলেও এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলবে। উদাহরণ: ‘মরা’র পরিবর্তে সুভাষণ ‘শেষনিশ্বাস ত্যাগ করা’।   

কি চমৎকার দেখা গেল! 

ক্ষমতা-আধিপত্য ভাষার উপর দাপট চালাইতে থাকে। ভাষারে খাটায়ে নেয় তারা। শতভাগ  সফল অবশ্য হয় না। ভাষার ভেতরে কিছু ‘টির‍্যানি’  বা স্বৈরাচারী দিক আছে বইলা  লুদভিগ হ্বিটগেনস্টাইন মন্তব্য করছিলেন তার নোটবুকে। 

যাহোক, সেই দাপটের বিষয়ে আসা যাক। ওয়েস্টার্ন মিডিয়া, বিবিসি, সিএনএন, ফক্স এইসব মিডিয়া যেগুলোতে, বঙ্গীয় সুশীলের নিরঙ্কুশ আস্থা, তারাই, আফ্রিকায় দাঙ্গাটাংগা হলে, নাম দেয় ‘ট্রাইবাল কনফ্লিক্ট’ আর  ইউরোপের আশেপাশে ঘটলে নাম হয় ‘এথনিক ক্লিনজিং’। ফলে জোসেফ কনরাডের ১৮৯৭ সালের গল্প, ‘অ্যান আউটপোস্ট অফ প্রগ্রেস’ –এ দেখা যায়, যারা অন্য দেশ দখল করতে যায়, তারা তীর্থযাত্রী (‘পিলগ্রিম’); আর লুঠ-করা সামগ্রীর গুদামের নাম, ‘ফেটিশ’! 

গায়ের জোর দিয়া তো মনের ক্ষোভ কমানো যায় না, ফলে ভাষারে যতটা সম্ভব আদুরে বানানো হয়। নির্ভেজাল হত্যাকান্ডের নামও দেয়া হয়, পারিপার্শ্বিক ক্ষয়ক্ষতি (কো-ল্যাটারাল ড্যামেজ)। ২০ শতকের ৯০ এর দশকে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এক নারীকে যৌন-হেনস্থার অভিযোগ উঠলে, অনেক বাকবিতণ্ডার পর, তিনি স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তার আচরণ অসঙ্গত (‘ইনএ্যাপ্রোপ্রিয়েট’) ছিল। বলা বাহুল্য পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ভার্বাল এপ্রোচটা কিন্তু সঙ্গত (এপ্রোপ্রিয়েট) ছিল! এইরকমই হয় ভাষা পরিস্থিতিতে। প্রথম ইরাক যুদ্ধের সময় জানা গেল, অন্য দেশে বোমা ফেলতে যাইতেছে যে বিমান, তার নাম:  প্যাট্রিয়ট। (এই প্রসঙ্গে কারও মনে পড়তে পারে, সোনার বাংলায়ও এভাবে  কেউ কেউ ‘দেশপ্রেমিক’ উপাধি পায়)।     

শুধুমাত্র ডান্ডা দিয়া  মানুষরে পোষ মানানো যায় না।  যে গরুরে হাজার বছর ধরে পোষ মানায়ে নেওয়া হইছে, সেই গরুও  (মানে বাছুর) জন্মেই  তিড়িংবিড়িং লাফ মারে।

মানুষরে পোষ মানাইতে অনেক প্রকার সাংস্কৃতিক ট্রেনিং বা সুশীলায়নের দরকার হয়; চমস্কির ইনডকট্রিনেশন সিস্টেমের বাংলা করেছেন সেলিম রেজা নিউটন: দীক্ষায়ন প্রকৌশল (পোষমানা মানুষ বানানোর প্রক্রিয়া বলা যায়)। আর ভাষাও সেইখানে একটা বড় রোল প্লে করে; যদিও আদমের বেটা মানুষরে পুরোপুরি ডোমেস্টিক বানানো যায় না। অনেকখানি যায়।         

এই কথার প্রমাণ পাবেন যখন দেখবেন,  সন্ত্রাসী বা কথিত সন্ত্রাসীরে বা নিরীহ লোককে ( পাঠক, ঝালকাঠির  তরুণ লিমনের কথা মনে আছে আপনার?) ঠান্ডা মাথায় কমান্ডো স্টাইলে খুন করারেও তাই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বইলা চালাইতে হয়। চাষীর জমি কাইড়া নিয়া কারখানা বানানোর নাম দেয়া হয়, ‘শিল্পায়ন’। 

অলঙ্করণঃ রাজিব কান্তি

জন এফ কেনেডি ১৯৬৩ সালে সেপ্টেম্বরে  এক টিভি ইন্টারভিউতে ভিয়েতনামের সৈন্য পাঠানোর  ব্যাপারে যেমন বলেন,  ‘… আমরা সেইখানে আমাদের লোকজনরে উপদেষ্টা হিসেবে পাঠাইতে পারি, তবে, ভিয়েতনামের জনগণরে কিন্তু জিততে হবে।‘  সেই উপদেষ্টাদের চেহারা ও স্বভাব ভিয়েতনাম যুদ্ধের ইতিহাসে জানা যায়। যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তর  ‘সুভাষণ’-এর একটা মাত্র নমুনাঃ নাপাম বোমার পরিবর্তে সুভাষিত হালকা/ বাছাইকৃত রসদ-এর ব্যবহার। 

উরুগুয়ের লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানো তার বইয়ে বেশ কিছু উদাহরণ হাজির করছেন। যেমন:  

ভিক্টোরিয়ান আমলে অবিবাহিত নারীর সামনে কেউ ট্রাউজারস-এর উল্লেখ করত না। তেমনি, কিছু জিনিস আছে যা জনসম্মুখে আজকাল একজন চাইলেই বলতে পারে না:

★ সাম্রাজ্যবাদরে বলা হয় ‘বিশ্বায়ন’ 

★ বামনরে যেমন বলা যাইতে পারে শিশু তেমনি সাম্রাজ্যবাদের শিকারগুলোরে বলা হয় ‘উন্নয়নশীল দেশ’

★ সুবিধাবাদিতাকে বলা হয় ‘বাস্তববাদিতা’

★ গরিব লোকদের বলা হয় ‘অল্প আয়ের লোক’ 

★কোন কৈফিয়ত বা জবাবদিহিতা ছাড়া কর্মীদের ছাটাই/ বহিষ্কার করতে মালিকের ক্ষমতারে বলা হয় ‘নমনীয়  শ্রম বাজার’ (flexible labor market)

★জুলুমরে বলা হয় ‘অবৈধ জবরদস্তি’ অথবা ‘শারীরিক এবং মানসিক চাপ’

★ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদের জনসম্পদ লুটপাট ‘বেআইনি সমৃদ্ধি’র নাম 

★ একজন কৃষ্ণাঙ্গ হইল ‘বর্ণময় মানুষ’

★ সামরিক অপারেশনে নিহত লোকেরা মৃত না, যুদ্ধে নিহতেরা হইলো ‘ক্ষয়ক্ষতি’ 

★ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে, ১৯৯৫ সালে, ফ্রান্স যখন নিউক্লিয়ার পরীক্ষা চালায়, তখন নিউজিল্যান্ডে ফরাসি রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি বোমা শব্দটা পছন্দ করি না। এগুলো বোমা না, এগুলো বিস্ফোরক বস্তু।

কেন সুভাষণ?  

ব্রাজিলিয়ান লেখক রুবেন ফনসেকার একটা ডার্ক কমেডিক গল্পে একজন আইনের প্রফেসরের সুভাষণের প্রতি এতো ঝোঁক ছিল, বা ট্যাবু-টার্মের প্রতি এমন বিরাগ ছিল যে, সে সঙ্গম বা সেক্স শব্দের কোনো প্রতিশব্দই ব্যবহার করতেন না কথাবার্তায়। নিতান্ত বাধ্য হইলে ল্যাটিন ‘ইন্ত্রোদাকসিও পিনিস ইন্ত্রা ভাস’ কথাটা কইতেন। 

আমাদের দেশেও ইংরেজ-ব্রাহ্ম বাহিত সুশীল সম্প্রদায়  রুচিতে ভিক্টোরিয়ানদের চেয়েও বেশি ভিক্টোরিয়ান।       

কী কী আমাদেরে বিব্রত করে জানতে-বুঝতে চমৎকার একটা উপায় হইতে পারে আমাদের ভাষিক পরিহার–প্রবণতার দিকে নজর দেওয়া। কারণ সেসব আমাদের মনের অবস্থার প্রতি ইশারা করে। কোনটা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলে, বিব্রত করে, কোন বিষয়, প্রসঙ্গ বা আলোচ্য বিষয় ট্যাবু আমাদের কাছে? কোন কথাটারে ঘুরায়ে বদলায়ে বলতে হয়?   

সুভাষণ স্পর্শকাতর বিষয়সমূহ জনসম্মুখে/ পাবলিকলি বলতে হেল্পায়। এমনভাবে, যেন ব্যবহারকারী সেইগুলা (বিষয়গুলা) নিয়া না, অন্য কিছু নিয়ে বলতেছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এজেন্ট এদের করা ম্যানিপুলেশনে সুভাষণ প্রায়শই  অন্যতম হাতিয়ার হয়া ওঠে। খালি ট্যাবুটার্মগুলো বলতেই সুভাষণ ব্যবহৃত হয় তা না, বরং সত্যিরে, বাস্তবতারে প্রায়ই ঢাইকা রাখতে, চরম বৈষম্যরে সহনীয় কইরা তুলতে, ক্ষমতা-শ্রেণি-কর্তৃত্বকে ভাষিক অভিব্যক্তিগুলা থিকা আড়াল করতে সুভাষণ  খুবই ফলদায়ক। যেই সমাজে বৈষম্য যত বেশি, গুটিকয়েকের আধিপত্য যত বেশি সেই সমাজের শাসক-সুবিধাভোগী শ্রেণিরে ততবেশি সুভাষিত হইতে হয়।   

বিশ্বজুড়ে সুভাষণের প্রধান ভোক্তাশ্রেণি মিডলক্লাস। গবেষকেরা দেখছেন, যারা লোয়ার ক্লাস থেকে আপার ক্লাসের দিকে যায়, তাদের উক্তি বেশি সুভাষিত। কারণ তাদের কাছে সুভাষণ ক্লাস-মার্কার বিশেষ। অবশ্য এর মানে এইটা না যে লোয়ার থেকে আপারের দিকে যত যাওয়া যাবে সুভাষন তত বাড়বে। বরং উলটা আপার এবং লোয়ার- উভয় ক্লাসই মিডলক্লাসের চেয়ে কম সুভাষিত উক্তি ইউজ করে।  

মধ্যবিত্তের (ইকোনমিক ও কালচারাল উভয় বিবেচনায় মধ্যবিত্তের কথা বলা হইতেছে) সুভাষনের সাথে লেপ্টে থাকতে চাওয়ার কারণ খালি  সত্যরে, স্পর্শকাতর বিষয়গুলারে এড়ানো বা গোপন রাখার প্রবণতা না। সুভাষণ মধ্যবিত্তের খুব প্রিয় কারণ  সামাজিক আড়ম্বরের প্রতি তাদের আকুল-আকাঙ্ক্ষায়  সুভাষন সাহায্য করে, হেল্পায়। এইটা সম্ভব হয়, কারণ বেশিরভাগ সুভাষনে সিলেবল বাড়ায়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আর মধ্যবিত্ত মনন সংখ্যায় বিপুল হওয়ারে ওজন ও মূল্যে বিপুল হওয়ার সাথে গোল পাকায়ে ফেলে।      

অলঙ্করণঃ ঈহা

অবশ্য সুভাষণ  মানেই যে সবসময় অধিপতির শ্রেণিস্বার্থ কায়েমে ষড়যন্ত্রবিশেষ –এইটা বলা যায় না।  বেশিরভাগ সময়,অবশ্য, এইটা শ্রেণী স্বার্থে উপাদেয় ফল দেয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে সদর্থেও  সুভাষণ ব্যবহৃত হইতে পারে। ভাষিক সৌন্দর্য বাড়ায় কখনো কখনো। খুব বেদনাদায়ক কিছু করার আগেও  রোগীকে ডাক্তার হয়ত বলতেছে, ‘একটু লাগবে কিন্তু’।   

সুভাষণের স্বভাব-চরিত্র

সুভাষণ যে শব্দের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়, তার চাইতে অবশ্যই  আকারে বড় হয়। আর বলাবাহুল্য স্বাদু ও  শ্রুতিমধুর হয়। গার্মেন্সে যে কাজ করে তার নাম হয়, পোশাকশ্রমিক। লেবার উপযুক্ত শব্দ। কাজের মেয়ে, ছেমড়ির চেয়ে ‘গৃহপরিচারিকা’ আকারে বড়। 

হিউ রসন তার ‘Dictionary of Euphemisms and other Doubletalk’ এর ভূমিকায় সুভাষনের নীতিটা লিখছেন:

‘সুভাষণ যত দীর্ঘ  তত ভালো। সাধারণত… যে শব্দগুলারে সুভাষণ প্রতিস্থাপিত করে, সুভাষন তাদের চাইতে  দীর্ঘ হয়। বেশি বর্ণযুক্ত, বেশি অক্ষরযুক্ত (সিলেবল অর্থে), প্রায়ই এক অক্ষরের বদলে দুই বা ততোধিক অক্ষর প্রয়োগ করা হয়।’    

বাংলা ভাষার সুভাষণ স্বাভাবিকভাবে ইংরেজির থেকে আলাদা। ইংরেজিতে যেমন ভাষিক ভদ্রায়নে ল্যাটিনাইজেশনের ব্যবহার তেমনি বাংলায় সংস্কৃতায়ন। ইংরেজিতে, স্কুল/ কলেজ যেমন ‘একাডেমিয়া’ ( তা-ও আবার  সিউডোল্যাটিন) হয়া যায়, বাংলায় তেমনি গাঁজা শব্দ ভদ্রস্থ  করতে ‘গঞ্জিকা’র মতো শব্দ বানাইতে হয়। আদতে গঞ্জিকা বলে কোনো সংস্কৃত শব্দ নাই। কেউ শুয়ারের বাচ্চা না বললে, বরাহ শাবক বলে গালি দিলে বুঝবেন, সে তার ভদ্রলোকত্বের সিগন্যাল দিচ্ছে।  

সুভাষনের জনপ্রিয়তম মাধ্যম শিষ্টতা (পোলাইটনেস)। শিষ্টতা নিয়া, অন্তত দুইজন খ্যাতনামা অভিধান রচয়িতা তাদের অভিধানে বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্য করছেন। স্যামুয়েল জনসন আর অ্যামব্রোস বায়ার্স।  প্রথমজনের মতে,  শিষ্টতা হইলো, ‘ভুয়া ভালোমানুষী’  আর ২য় জনের মতে, ‘সবচে গ্রহণযোগ্য ভন্ডামি’   

ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়ের বুরদিও’র মতে, কথা বলার সময় সুভাষণ মুনাফারে দ্বিগুণ কইরা দেয়ঃ “the profit of saying and the profit of denying what is said.”  বুরদিও অবশ্য মনে করেন, মানুষের সমস্ত ভাষিক যোগাযোগই কম বা বেশি মাত্রায় সুভাষিত। প্রত্যেকেই কথা বলার/ লেখার আগে নিয়মিত তার অডিয়েন্সের কথা মাথায় রাইখাই সেন্সর করে। সেই অর্থে সবার ভাষাই কম-বেশি ইউফেমিস্টিক। জনাব বুরদিও অবশ্য বলতে ভোলেন না যে,  এই কম-বেশির তফাৎ বিবেচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেশি কারা ব্যবহার করে, কখন, কীভাবে এবং কাদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়  সেইটা দেখাও জরুরি।           

‘বিশুদ্ধতা’ জিনিসটার ভেতরেই ( ভিত্রে/মধ্যে, এমনকি আরেকটু রাশভারী, সুশীল করতে ‘অন্তর্গত’ শব্দটাও কইতে পারেন) একটা প্রতিক্রিয়াশীলতা লেপ্টে আছে বলে মনে হয়। অন্তত, বড় রকমের রিজিডিটি  আছে  সন্দেহ নাই।  স্ট্যান্ডার্ড, প্রমিত, মানদন্ড ( এইখানে ‘দন্ড’ কথাটায় একটু নজর দেয়া যায়। দন্ড, মানে ডান্ডা- শাস্তি আর কি।  দেখেন নিরীহ শব্দটার ভিত্রেও কতকিছু স্পর্শকাতর বিষয় আছে) প্রতিক্রিয়াশীল জিনিস। 

বিশুদ্ধতা বলবে এইটা ঠিক/কারেক্ট, ওইটা ভুল/রং। যদিও সুশীল বয়ানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাব্জেক্টিভিটির কথা উচ্চকিত হয়, এইক্ষেত্রে ‘অব্জেক্টিভিটি’ তাদের চাওয়া। এবং সেই তথাকথিত ‘অবজেক্টিভিটি’ আবার খুবই শ্রেণিস্বার্থ ঘেঁষা। ফলে ভাষাগত দিক দিয়া এই বিশুদ্ধতাবাদীরা আসলে ‘মৌলবাদী’, মৌলবাদের  সুশীল যে মিনিং দাঁড়াইছে সেই অর্থে বললাম। 

কেননা তাদের প্রেসক্রাইব করা ভাষার বাইরে কিছু দেখলেই তেনাদের গা জ্বলে  (‘গাত্রদাহ’ বললে একটু ভদ্রস্থ শোনায় না?), আপনি’র জায়গায় ‘আপনে’  দেখলেই  সেই ভাষারে ‘অসাধু’ মনে হওয়া হেতু ‘তাহাদের’ মাথার চান্দি (অথবা ধরেন ব্রহ্মতালু) গরম হইয়া যায়।      

লেজিটিমেট ভাষা,  বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ভাষা ব্যবহারে। তখন, যেকোনো ভাষিক অভিব্যক্তিরে (এক্সপ্রেশন) বিবেচনা করা হয় সেই লেজিটিমেট ভাষার সাপেক্ষে। লেজিটিমেট  ভাষা থেকে সামান্য বিচ্যুতিও হাসির, উপহাসের এমনকি তিরস্কারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘আপনি’ শব্দটার জায়গায় ‘আপনে’ বসালেই বেশ ফানি ফানি লাগে। 

আমাদের টিভি-নাটক-সিনেমায় দেখবেন, যখনই হিউমারের ঘাটতি পড়ে, তখন ডায়ালেক্ট (আঞ্চলিক ভাষাও বলা যায়, যদিও সবসময় ‘আঞ্চলিক’ আর ‘ডায়ালেক্ট’ সমার্থক না) আইনা খামতি পূর্ণ করা হয়। 

আগে যেমন কলকাত্তাই সিনেমায় ভাঁড় চরিত্রগুলার মুখে ‘বাঙাল’ ভাষা দেখা যাইতো খুব তেমনি  বর্তমানে ‘বাঙাল’ ভাষার জায়গায় এদেশি টিভি-সিনেমায় ডায়ালেক্টগুলা হাস্যরস সাপ্লাই দিতে থাকে। তারও আগে, সংস্কৃত ভাষায় লিখিত নাটকে নিম্নবর্গের পাত্রপাত্রীরা অপভ্রংশে কথা বলতো; গ্রাম্য লোকের  (গাইয়া লোকের) মতো, শহুরে লোকদের আনন্দ দেবার জন্য। 

কিন্তু কেন ডায়ালেক্টগুলা ফানি লাগে? 

ফানি লাগে লেজিটিমেট জায়গা থেকে প্রতিসরণ বা বিচ্যুতি ঘটে বলে?  দর্শক শ্রোতাকে সাময়িক সুপিরিয়রিটির বোধ দিতে থাকে এইরকম হিউমার?  (এমনকি, প্রিয় পাঠক/ পাঠিকা, আপনি সুশীল হইলে,  এই লেখাটা পড়তে গিয়া যদি ২-১টা শব্দ পড়তে গিয়া মৃদু অস্বস্তি লাগে, তবে অবাক হবেন না) 

সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, সুভাষণ সবসময় লেজিটিমেট ভাষার গা ঘেষে চলে। এই লেখাটা সুভাষণ নিয়া, লেজিটিমেট ভাষা কিংবা ভাষার উচু-নিচু বা স্ট্যাটাস  নিয়ে না। বিস্তারিত সেই আলাপ  অন্যত্র করবো। তবু প্রয়োজনে দুই-একটা খুচরো মন্তব্য রেখে যেতে হলো।         

তবুও যদি আপনি খুবই ইনোসেন্ট ধরনের হন আর বলেন,  প্রমিত বা মান ভাষা বলে বাজারে চালু  জিনিসের গলদটা কোথায়?

গলদটা এইখানে যে ভাষার ডাইনামিক ও সৃষ্টিশীল দিকটা অনেক সময় ভাষা হারিয়ে ফেলে, কিংবা অনেক সময় হারিয়ে ফেলা হয় (যেমনটা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে) হয়া যায় টেকনোক্রেটিক শাসনের মতো সেই ভাষা। এবং সেই ভাষা ক্ষমতা-সম্পর্ক রিপ্রডিউস করতে হেল্পায়। 

তখন মুখস্ত বুলি কপচানো পাখির মতো হইয়া যায়, অর্থাৎ ভাষার প্রাঞ্জলতা থাকে না, সৃজনশীলতা থাকে না। সবচে বড় কথা, ভাষার মধ্যে (ভেতরে/ ভিত্রে) বানোয়াট জিনিসপাতি চলতে থাকে। তখন কী হয়, তার প্রমাণ পাবেন, আমাদের বামেরা ‘শোষিত’ শ্রেণির কাছে যে পৌছাতে পারে না , অনেকগুলা কারণের মধ্যে বামদের ভাষাও হয়তো একটা কারণ। ভাষার এহেন অবস্থায়, ভাষার প্রাণটাই যেন মইরা যায়, মেকানিকাল হয়া যায়। কানপাতলে শোনা যায়, ভাষা যেমন জীবন উৎসারিত হওয়ার কথা, সেইরকম ‘কালচার নেচারের ভাষায় কথা বলছে’না।   

একটা ৮/৯ বছরের ছেলে বা পোলা, ‘বাসাবাড়িতে’ কাজ করে, চেনে ঘোড়া আর পাখি। একদিন পত্রিকার পাতায় একটা ছবি দেইখা বলে উঠল, ‘ঘোড়াপাখি’  ‘ঘোড়াপাখি’। যদিও সে পড়তে পারে না, জানে না পেগাসাস বা পঙ্ক্ষীরাজ বলে কোন পৌরাণিক প্রাণীর কথা।  ‘ঘোড়াপাখি’র মতো একটা সৃজনশীল শব্দ তৈরিতে উচ্চতর দক্ষতার পরিচয় কিন্তু সে দিছে।  কিংবা এই বস্তিতে থাকা শিশুরে যদি বলেন, ঝলমল করছে মানে কী? সে যদি উজ্জ্বল না বইলা, ‘যেন লাইট মারছে’ বলে অবাক হবেন না। কারণ এদের ভাষা মধ্যে জীবন উপস্থিত।

দুর্নীতি মানে জিজ্ঞেস করলে, ভদ্রলোক হয়ত বলবে, অন্যায় কাজ, রীতিলঙ্ঘন ইত্যাদি। যে নিরক্ষর সে আপনারে  হয়তো বলতে গিয়া বর্ণনাই দিয়ে ফেলল, ‘দুর্নীতি মানে ধরেন, র‍্যাশন কার্ড আনতে গেছি, ঘুষ নেল’। যা ক্ষমতা-কাঠামোর বুকের সাথে লেপ্টে থাকা  ‘প্রায়’ মেকানিকাল ভাষা (অঙ্গীভূত হয়েছেও বলতে পারেন, আমার কোন আপত্তি নাই) আপনাকে এই সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্ছিত করবে।     

কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘শব্দের ভেতর দিয়েই চিন্তার জন্ম হয়’।আর আমাদের  চিন্তা-ভাবনা আগে ভাগেই  ভাষার আবেষ্টনে আবদ্ধ থাকে  অনেকখানি (অলরেডি এনকমপাসড বাই দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ দ্যাট ইজ আওয়ার ওন’)

(কীভাবে, কেমনে হয়, সে- আলাপ বিস্তারের সুযোগ এখানে নাই বলে দুইজন উল্লেখযোগ্য ভাষাবিদের উদ্ধৃতি রেখে গেলাম। এই ব্যাপারে ভিন্নমতের বা কৌতূহলী যে কারুর সাথে সতর্ক ( তর্কের সহিত বর্তমান) আলাপে আমার কোনো আপত্তি নাই। )    

এই প্রভাবিত/ নির্ধারিত হওয়াটা একতরফা না যে খালি ভাষাব্যবহারই চিন্তারে ডমিনেট করবে, বরং প্রক্রিয়াটা দ্বান্দ্বিক। সংস্কৃতি যেমন ভাষার রূপরীতি ঠিক করে দেয়, একটা সমাজের চিন্তাজগতও প্রভাবিত হয় আবার সেই সমাজের প্রচলিত ভাষা-কাঠামোরে কেন্দ্র কইরা। ভাষা গবেষকেরা নিঃসন্দেহ, ব্যক্তির চিন্তা তার সমাজের বিদ্যমান ভাষা-কাঠামো দ্বারা  প্রভাবিত হয়। যত কল্পনাশক্তি বা সৃজনশীলতার অধিকারী আপনি হননা কেন, যে ভাষিক আবহাওয়া ও জলবায়ুতে আপনার থাকা, বেড়ে ওঠা, সেই ভাষার কাঠামোর বাইরে গিয়া চিন্তা বা ভাষিক অভিব্যক্তি সৃষ্টি করা খুব কঠিন। 

তো, কী  করতে পারেন?

ভাষা ব্যবহারেও হয়ত বড়জোর লড়াই না হোক, প্রতিরোধী অবস্থানটা জানাইতে পারেন।

সুভাষণ যখন শোষণে সহায়ক, শ্রেণি-কর্তৃত্বের আধিপত্যের সহায়ক তখন  (যতটা সম্ভব) এভয়েড করা গেলে তো ভালোই, নতুন শব্দও ব্যবহার করতে পারেন। জরুরী ভাষা ব্যবহারে চোখ-কান খোলা রাখা সচেতনতা। কেউ কেউ সেই চেষ্টা করেন নাই এমন না, মার্ক্সিস্ট শব্দটার বাজার চলতি নেগেটিভ দিকটা টের পায়া ধূর্জটিপ্রসাদ নিজের পরিচয় দিতেন মার্ক্সোলজিস্ট বলে। ভেরিয়ার এলউইন এ্যান্থ্রোপলজিস্ট না বলতে নিজেরে বলতে চাইতেন, ফিল্যানথ্রোপলজিস্ট। বাংলায় যারা এনার্কিজম নিয়ে আগ্রহী, তারাও প্রথমে ‘নৈরাজ্যবাদ’ বললেও শব্দটার নেগেটিভ এ্যাসোসিয়েশন টের পেয়ে ‘অরাজপন্থা’ বলা শুরু করছেন। 

ক্ষমতা-কর্তৃত্ব-শোষণে সুভাষণের যেভাবে ব্যবহার হইতেছে, সেই বিষয়ে সচেতনতাও কাজের। কোনো কৌশলের ব্যাপারে সতেচন হওয়া মানে সেই কৌশলকেই অনেকখানি অকেজো কইরা দেওয়া।      

এমন এককালে আমরা বাস করি যখন গনহত্যারে বলা হয় দুর্ঘটনা। 

গরিবের-কৃষকের জমি দখলের নাম  শিল্পায়ন,. প্রানপ্রকৃতি ধ্বংসের নাম ডেভেলাপমেন্ট (উন্নয়ন-এর চেয়ে স্মার্ট, মিষ্টিও লাগে শুনতে)। পাছায় বাঁশ ঢুকাইতে ঢুকাইতে বলা হয়, ইতিবাচক হও। থিংক পজিটিভ। বি পজিটিভ। 

আইডিওলজিক্যাল পজিটিভিজমের এই রমরমা সময়ে, ইতিবাচকতার মহামারির এই কালে এক নম্বর মিথ্যাবাক্য, আপনা ভালো তো জগত ভালো। আপনি ভালো হলেই জগত ভালো হবে না। আপনার ভাষিক অভিব্যক্তি যতই ‘ইতিবাচক’  আর সুভাষণে ভরপুর হোক, তা কেবল বাস্তবতারে, সত্যরে আড়াল করতে থাকবে।

গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস বলতেন, বলতেন ওয়াল্টার বেনইয়ামিনও, প্রতিটি সমাজ-সভ্যতা ধ্বংসের আগে মুখোশ পইড়া নেয়।    


[ টীকাটিপ্পনী: 

একাডেমিক লেখার মতো উদ্ধৃতি-পাদটীকা দিতে আমার বিরক্তি লাগে। এইখানে, পন্ডিত লোকের বই-এর উদ্ধৃতি দেখলে যাদের লেখকের প্রতি সমীহ জাইগা ওঠে,- আরিব্বাবা উনি তো বেশ জ্ঞানী লোক- সেইসব সুশীলদের কিঞ্চিৎ অস্বস্তি উপহার প্রদানের নিমিত্তে, তাহাদের শ্রীচরণে এই রেফারেন্সগুলা নিবেদিত।     

  সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত। বর্ধমান সাহিত্যসভা, বর্ধমান, ১৯৫৭ সাল, ৫ম সংস্করণ।

জন সিনক্লেয়ার প্রণীত, কলিন্স কোবিল্ড লার্নার’স ইলাস্ট্রটেড ডিকশনারি, ২০০৯ সংস্করণ। 

এদুয়ার্দো গালেয়ানো, আপসাইড ডাউন এ প্রাইমার ফর দ্য লুকিং-গ্লাস ওয়ার্ল্ড। বইয়ের ‘দ্য লুকিং-গ্লাস স্কুল’ অধ্যায়ের  ‘ইনজাস্টিস ১০১’  অংশ দ্রষ্টব্য।    

  হিউ রঅসন, দ্য ডিকশনারি অফ ইউফেমিজমস এন্ড আদার ডাব্‌লটক, পৃ: ১০,  ক্রাউন পাবলিশার্স, নিউ ইয়র্ক, ১৯৮১। বন্ধনীর ভেতরে শব্দ বর্তমান লেখকের।   

স্যামুয়েল জনসনরে প্রায় সবাই অভিধানপ্রণেতা হিসেবে জানলেও সাহিত্যিক অ্যামব্রোস বায়ার্স যে, ‘দ্য ডেভিল্‌স  ডিকশনারি’ নামে প্রজ্ঞা ও ব্ল্যাক হিউমারে ভরপুর একখানা অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন এটা হয়ত অনেকেই জানে না।  

গৌতম ভদ্র, ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার যায়?’ পৃ: ২৩  ছাতিম, কলকাতা। যদিও বইটা ভিন্ন বিষয়ের, মন্তব্যটা আমার ভাল্লাগছে।      

  এল. এস. ভাইগটস্কি, থট এন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ, ১৯৬২, পৃ: ১৫৩  

এইচ.  জি. গাডামার, ফিলসফিকাল হের্মেনিউটিক্স, ১৯৭৬, পৃ: ৬২ ]  

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।