বিষয় অসমতা: সেরা ৭ সিনেমা

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক

বিত্তহীন আর বিত্তবানদের  (পাওয়া না পাওয়াদের) গল্পের বয়স ইতিহাসের বয়সের সমান। যেদিন থেকে মানুষ সমাজে বাস করে আসছে, তখন থেকেই কিছু মানুষের অনেক আছে এবং কিছু মানুষ থেকে গেছে না পাওয়াদের দলে। গত কয়েক বছর ধরেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, সম্পদের বৈষম্য, আয়ের অসমতা, এবং লিঙ্গ, সম্প্রদায় বিষয়ক নানামুখী আলোচনা আমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে।          

তারপর সামাজিক বৈষম্য ফুটিয়ে তোলে, এমন অনেক মুভিই আমাদের সামনে এলো। প্রান্তিকীকরণের পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছে- এমন অসংখ্য মুভির জন্য ২০১০ এর দশককে যেতে পারে শ্রেণিযুদ্ধের সিনেমার দশক। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারদের সাথে ফাইট দেওয়া জোকার থেকে শুরু করে ছোট্ট ছেলেটার সাথে নিজেই প্রতারণা করা উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট – শ্রেণি সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুভি-সিনেমার মত যুতসই মাধ্যম আর হয় না।    

অবশ্য, সামাজিক অসাম্য নিয়ে সিনেমা কেবল অতীতের বিষয় না। এক শ’ বছরের বেশি সময়ে, বেশ কিছু দারুণ মুভি তৈরি হয়েছে, যেগুলো উদ্ভাবনী গল্প বলার কায়দায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর ব্যক্তিগত পক্ষপাত নিয়ে দূরদর্শী বার্তা দিয়েছে। হতে পারে সেটা ২০ এর দশকের রাশিয়ার লেবার ইউনিয়ন নিয়ে বলা রূপক কাহিনী অথবা একজন টেলিমার্কেটারকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কমেডি। সামাজিক অসাম্য আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যের পুরোভাগেই আছে আর একই রকম গুরুত্ব পাচ্ছে সিনেমার ফ্রেমেও।    

এই লিস্টে আছে এই সময়ের সবচে আইকনিক, আলোচিত ৭টি সিনেমা। এই লিস্টে অবশ্য কিছু পুরাতন সেরা মুভিও আছে, যেগুলো এই কালচারাল আলাপগুলোকে সিনেমায় স্থান পাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। এখানে সামাজিক অসাম্য নিয়ে সেরা ৭টি  মুভির কথা বলছি। বলা বাহুল্য লিস্টমাত্রই অপূর্ণাঙ্গ ও সাবজেক্টিভ এবং নির্দিষ্ট মাত্রার বায়াস অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেকে যাবেই। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের মুভি আছে দুটি। এশিয়ার মুভি দুটি, ইউরোপের দুইটি অর্থাৎ কোনো সামঞ্জস্য নাই। কেবল একটি বিষয় সবগুলো মুভির ক্ষেত্রে কমনঃ প্রতিটি সিনেমাতেই সামাজিক অসমতা কেন্দ্রীয় অংশজুড়ে আছে। তবে আমাদের বিবেচনায় সামাজিক অসাম্যের বাইরেও গল্পগুলো গল্প, অভিনয় কুশলতা ও নির্মাণশৈলীর কারণে অনন্য। আসুন দেখে নিই ‘সেমসেম সেরা-৭’ এর প্রথম সিনেমা লিস্ট।   

 ৭.  ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট (২০১৭)  [যুক্তরাষ্ট্র] 

‘দ্য ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট’ সিনেমার পোস্টার

দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট  সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলির হৃদয়-বিদারক চিত্র। দারিদ্র্যে জর্জরিত পরিবার। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের কাছের একটা স্ট্রিপ মোটেলে বাস করা এই পরিবারের আকস্মিক একটা ঘটনা দিয়ে পরিচালক গল্প শুরু করলেও এটা মানুষের মরিয়া হয়ে ওঠা আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে  সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতা  আর সংকটকে তুলে ধরে।

 আবার অন্যভাবে দেখলে, সিনেমাটি ছয় বছর বয়সী মুনি এবং তার উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদেরও গল্প। এরা ম্যাজিক ক্যাসল হোটেলে কারো তত্ত্বাবধান ছাড়াই থাকে, হালকা পাতলা দুষ্টামি করে আর পাগলের মত ছোটাছুটি করে। এদিকে তার মায়ের একটা সুস্থির জীবন যাপন করতেই যুদ্ধ করতে হয়। এমন বাজেটে তার সংসার চলে যেখানে একবার বাড়ি ভাড়া দিতে লেট করলেই বাসা ছাড়তে হতে পারে। প্রয়োজন মেটাতে সে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিন্তু হিসাব করা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় – যেমন ডিজনী ওয়ার্ল্ডের পাস চুরি করা, গেস্ট রুমের খাবারের চার্জ ধরা এবং এক পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিও। শিশুর উচ্ছ্বল আনন্দে ভরা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি আর করুণ দারিদ্র্যের বৈপরীত্য এমন সব মুহূর্তের বুনন তৈরি করে যা দর্শকদের সহানুভুতি তৈরি করে। নির্মাতা শন বেকারের স্বভাবসুলভ তীর্যক ভঙ্গি এই সিনেমাতেও পাওয়া যাবে।      

৬. রোমা (২০১৮) [মেক্সিকো]

রোমা সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার

‘ই তু মামা তামবিয়েন’ (Y tu mamá también) –এর পর প্রথম আলফোনসো  কুয়ারোনের মাতৃভাষায় প্রথম সিনেমা। ১৯৭০ এর দশকের মেহিকো সিটির কোলোনিয়া রোমা এলাকার এক ডাক্তার পরিবারের এক নারী গৃহকর্মী। নাম ক্লেওদেগারিয়া ‘ক্লেও’ গুতিয়েররেজ। চাকরিদাতা পরিবারের প্রধান কাজের সূত্রে কুইবেক যায় ( পরে প্রকাশ পায় যে সে আসলে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে চলে যায়)। ক্লেও পরিবারের কাজকর্ম করে অনেকটা অন্তরালে থেকেই। আবার ক্লেও দেখে তার চাকরিদাতার ফ্যামিলি ভেঙে পড়তেছে। অন্যদিকে তার নতুন বয়ফ্রেন্ড ফারমিন-এর সঙ্গে কয়েকটা ডেট করার পরে এক পর্যায়ে ক্লেও আবিষ্কার করে সে প্রেগনেন্ট। অন্যদিকে ফারমিনকে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া এমনকি ক্লেওর সঙ্গে একসাথে থাকতেও ফারমিনের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে ক্লেও তার চাকরীদাতা লোকটাকে জানানোর চাপও বোধ করে। মেহিকোর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল এক সময় ক্লেওর ব্যক্তিগত জীবনে এইসব ঘটনা ঘটে। এবং সময় সময় সেই সংঘাতের উত্তাপ এসে পড়ে ক্লেও ও তার চাকরিদাতার জীবনে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর নির্বিচার সরকারি আক্রমণ চলে। কুয়ারোনের টেকনিক হচ্ছে  রাজনৈতিক গন্ডোগোল নিম্নবিত্ত এক নারীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন মামুলি ঘটনাবলির পটভূমিকায় হাজির হয়।  

একই সঙ্গে হিউমার ও হররের মিশেল সিনেমায় পাওয়া যাবে কারণ এটা আলফোনসো কুয়োরানের সিনেমা। আপনি ই তু মামা তামবিয়েন (Y tu mamá tambien) দেখে থাকলে আলফোনসের কমেডিক টাইমিং কতটা দুর্দান্ত তা জানার কথা! রোমা সিরিয়াস ও স্যাড সিনেমা কিন্তু অতর্কিতে ও চোরাগোপ্তা হিউমার এখানেও দেখা যায়।  

রোমা এমন এক সিনেমা যা ভাবাবে, কিছু দৃশ্য আপনার মাথায় দীর্ঘদিনের জন্য গেঁথে থাকবে। ফাস্ট এন ফিউরিয়াস ধরণের সুপার-ফাস্ট মুভির দর্শকদের কাছে মুভিটা কিছু স্লো ঠেকতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে একবার কিছুক্ষণ দেখলে, আপনাকে ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা মুভিতে আছে। নানান সূক্ষ্ম সৌন্দর্য, ইনট্রিগ ও ভাবনাজাগানিয়া উপাদান রোমা-তে আছে। সেমসেম টিমের পরামর্শঃ গিভ ইট আ ট্রাই!    

৫. বাইসাইকেল থিভস (১৯৪৮) [ইতালি] 

দ্য বাইসাইকেল থিফ সিনেমার পোস্টার

সত্যজিৎ রায় কিংবা অনুরাগ কাশ্যপের মতো বিখ্যাত নির্মাতাদের প্রিয়তম মুভি।   গল্পের কেন্দ্রে বাবা আন্তোনিয়ো রিচ্চি ও আর ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর সম্পর্ক। আবার দারিদ্রের চক্র আর এক ব্যক্তি সেই দুষ্টচক্র এড়াতে কোন মাত্রায় যেতে পারে, কতটা বেপরোয়া হতে পারে– তার হৃদয়বিদারক গল্পও।   

আন্তোনিও যখন পুলিশের কাছে তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল সাইকেল চুরি যাওয়ার রিপোর্ট করে, মানুষ গা করে না। অথচ সেই একই কাজ (চুরি) যখন আন্তোনিও নিজে করে, পুরো শহর যেন তারে থামাইতে উঠে পড়ে লাগে, ছি ছি রি রি পড়ে যায়। ছোট ছেলে, ব্রুনো আতঙ্কিত। তার বাবাকে ঘিরে আছে ক্রুদ্ধ জনতার ভিড়। কারণ তার বাবা একটা বাইক চুরি করেছে। তাকে টেনে হিচড়ে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে, সাইকেলের মালিক অশ্রুশিক্ত ব্রুনোকে দেখে আর্দ্র হয়ে পড়েন, মমতাবশত ব্রুনোর বাবাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। 

ব্রুনো বাবার হাত ধরে। পিতা যেমন পুত্রকে ক্ষমা করে দেয়, তেমনি এই সিনেমায় পুত্র পিতাকে ক্ষমা করে দেয়। বাপ-বেটায় ভিড়ের মধ্যে হারায় যায়। সুখি সমাপ্তি বলা যায়। এইরকম সহজ সরল এক কাহিনী। বলা যায় এই লিস্টের সবচেয়ে সহজ ও সিম্পল কাহিনী দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমাটা সাধারণভাবে দেখলে এক রকম অনুভুতি; অথচ  শুরু থেকে ব্রুনোর চোখে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    


৪. প্ল্যাটফর্ম (২০২০) [স্পেন]

দ্য প্ল্যাটফর্ম সিনেমার পোস্টার

তিন ধরণের মানুষ আছে পৃথিবীতে: যারা থাকে উপরে, যারা নিচে থাকে আর যাদের পতন ঘটে।  

—ত্রিমাগাসি | প্ল্যাটফর্ম | ২০২০ 

বিশাল এক ভার্টিক্যাল জেলখানা। অবশ্য মালিক কোম্পানির ভাষ্যমতে, এটি জেলখানা না, ‘ভার্টিকেল সেলফ-ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।’ তবে কয়েদিরা বলে ‘গভীর গর্ত’। প্রতিটি ফ্লোরে একটা করে ছোট রুমে থাকে দুইজন করে কয়েদি। প্রত্যেকটা রুমের মাঝখান বরাবর বিশাল এক আয়তাকার গর্ত, যা পুরা বিল্ডিং-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চলে গেছে। সেই গর্ত হয়ে উপরে থেকে লিফট টাইপ একটা প্ল্যাটফর্মে করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য নামে। সমস্ত কয়েদিদের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন যে উপরের লেভেলের কয়েদিরা প্রথমে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্ল্যাটফর্মটা কয়েক মিনিট পর পর নিচের লেভেল নামে। তারপর পরের লেভেল, তাদের পরে আরও নিচের লেভেল, এইভাবে। সমস্যা হচ্ছে উপরের লেভেলগুলাতে যারা থাকে তারা প্রয়োজনের চাইতে বেশি খায় বা খাবার নষ্ট করে। ফলে নিচের লেভেল কয়েদিরা পায় না।  

নিচের দিকের লোকগুলা জীবন বাঁচাতে তখন কী কী করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? স্পয়লার দেবো না। 

তবে আপনার অনুমানকে আরও অনিশ্চিত করতে এই জেলখানার আরেকটা মজার বৈশিষ্ট্য বলি। প্রত্যেক মাসে কয়েদিদের সেল বদল হয়। যে এখন আছে, ৪৮ নাম্বার সেলে, একমাস পরে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে ২০২ কিংবা ৮  নাম্বার সেলে। প্ল্যাটফর্ম এক ডিস্টোপিয়ান মাস্টারপিস। 

৩. প্যারাসাইট (২০১৯) [দক্ষিণ কোরিয়া]

প্যারাসাইট সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার


অস্কার পাওয়া প্রথম দক্ষিণ কোরীয় সিনেমা  প্যারাসাইট। তবে কেবল পুরষ্কার দিয়ে  প্যারাসাইটকে বিচার করলে মুভিটার প্রতি অবিচারই করা হবে। 

শ্রেণিসমস্যা ও সমাজ কাঠামোর জটিলতা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী একজন ফিল্মমেকার বং জুন-হো। প্যারাসাইটের আগের মুভিগুলাও যদি দেখেন, যেমন, স্নোপিয়ার্স, ওকজা বা হোস্ট, একই বিষয়বস্তু ভিন্ন চেহারায় মোকাবেলা করেছেন। প্যারাসাইটকেশ্রেণি বিভাজন ও মানব প্রকৃতি বিষয়ে তার অনুমানের নিখুঁত সিন্থেসিস বলা যায়।  প্যারাসাইট এক কথায় শ্রেণিসংগ্রামের সিনেমা। 

যেকোনো কোরিয়ান সিনেমায় কিম আর পার্ক নাম আপনি ঘুরেফিরে পাবেন– এই মুভিতেও যার ব্যত্যয় ঘটে নি!  
গল্প শুরু হয় কিম ফ্যামিলিকে ঘিরে। বেজমেন্ট ধরণের ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা একটা পরিবার কোনো মতে টানাটানিতে যাদের সংসার চলে যায়। ফ্যামিলির প্রত্যেক সদস্য নানা ধরণের অড জব করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সবাই পার্ক ফ্যামিলিতে বিভিন্ন ধরণের কাজে নিযুক্ত হয়।  পার্ক ফ্যামিলি আবার কিম ফ্যামিলির ঠিক বিপরীত। বিলাসবহুল বিন্দাস জীবন কাটায়। বেশ বন্ধুসুলভ অথচ শীতল। পার্ক পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখা হয় যে কিম পরিবারের সদস্যরা পার্ক ফ্যামিলির কাছে গোপন রাখে। এক পর্যায়ে তারা পার্ক ফ্যামিলির দখল নেওয়া শুরু করে। দুই পরিবারের মধ্যে পরিষ্কার লড়াই হয়।   


কিম ফ্যামিলি আবিষ্কার করে তারা যা-ই করে না কেন, দুনিয়ায় তারা মিসফিটই থেকে যায়। এই দুনিয়া তাদেরকে ‘অপর’ই করে রাখে। সেই অপরায়নের প্রেক্ষিতে কিম ফ্যামিলির প্রতিক্রিয়ার নিষ্ঠুর কিন্তু দুর্দান্ত ইন্ট্রিগিং সিনেমা প্যারাসাইট। দর্শককে আবিষ্ট করে রাখা টানটান উত্তেজনার এক সিনেমা। ওহ, সম্ভব হলে বং জুন-হো’র মেমরিজ অভ মার্ডার মুভিটাও দেখুন।   

২. শপলিফটার্স (২০১৯) — [জাপান]

শপলিফটার্স সিনেমার পোস্টার

টোকিয়ো শহরের এক কোণে বাস করে দরিদ্র এক পরিবার। বেঁচে থাকার জন্য দোকান থেকে দোকানে চুরি করে বেড়ায়। পরিবারের মোটামুটি সবাই চোর। সে ফ্যামিলিতে এক ছোট মেয়ে ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে।  

শপলিফটার্স জটিল, সূক্ষ্ম ও রহস্যময় ফিল্ম। দারুণ চমকের এন্ডিং। সাইকোলজিকাল রহস্যকাহিনীর মতো টুইস্ট আছে। অথচ জন্রা বিবেচনায় ফিল্মটা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ক্লাসিকাল জাপানি স্টাইলের সূক্ষ্ম ফ্যামিলি ড্রামা,  কোরে-এদা যার একজন ওস্তাদ। আপনি যেন টেরই পাবেন না এমন মৃদু লয়ে এগোতে এগোতে, হুট করে চূড়ান্ত অংশে এসে হাজির হয় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। নিত্য অনটনের শপলিটার্সের ফ্যামিলির তেমন কিছু নাই, তারা বেঁচে থাকতেই হিমশিম খায় অথচ এরকম একটা মুভি দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কঠিন। সত্যি বলতে, ডিসফাংশনাল ফ্যামিলির দর্শকদেরকে যা স্পর্শ করে তাই হইতেছে, তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত সত্ত্বেও, প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি তাদের এক হয়ে থাকার চেষ্টা। এক কথায় জাপানিজ ফিল্ম মায়েস্ত্রো হিরুকাজু কোরে-এদা’র মাস্টারপিস।   

১. সুলিভান’স ট্রাভেলস (১৯৪১) [যুক্তরাষ্ট্র]   

সুলিভান’স ট্রাভেলস এর প্রথম অফিশিয়াল পোস্টার

সুলিভান’স ট্রাভেলস মুভি বিষয়ক মেটাকমেন্টারি যা একইসাথে স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ত্রিশের দশকে মহামন্দার সময়ে শ্রমজীবী শ্রেণির সংগ্রাম উঠে আসলেও, মূলত একটা মধুর প্রেমের গল্প। প্রেস্টন এমন একটা মুভি বানাতে পেরেছেন যা তার বক্তব্য তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের আজকের পৃথিবীর সংগ্রামকেও যেন স্পর্শ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞান দেওয়া মুলক মুভির বিরক্তিকর দিক সম্পর্কে জ্ঞান দেয় অথচ সিনেমাটি মজার। প্যারাডক্সের মতো ঠেকলেও শেষ পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এমেরিকান মুভি।  


হলিউডের চিত্রনির্মাতা জন সুলিভান (জোয়েল ম্যাকক্রি) ‘সস্তা’ কমেডি বানিয়ে বিখ্যাত ও ধনী হয়েছে। তবে তার আফসোস নিপীড়িত মজলুম মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন ও মহামন্দা বিষয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। সিরিয়াস শৈল্পিক সিনেমা। সিনেমার নামও ঠিক করেনঃ ও ব্রাদার, হোয়্যার আর্ট দাউ?  


কিন্তু স্টুডিয়ো বস মনে করে, এটা বাজে চিন্তা এবং সুলিভানরে চ্যালেঞ্জ জানায়ে বলে যে সুলিভান আসলে গরিবের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু সুলিভান দমার পাত্র নয়। সে পকেটে মাত্র ১০ সেন্ট নিয়ে দেশ ঘুরে দেখের প্রজেক্ট নেয়, যাতে সে গরিবরা কিভাবে জীবন যাপন করে তা দেখতে পারে। যতবারই সে যাত্রা শুরু করে নানা দুর্ঘটনা তাকে লস এঞ্জেলসে ফেরত নিয়ে আসে। 

এরকমই একবার ফেরার সময়, একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় সুলিভানের। মেয়েটা ব্যর্থ অভিনেত্রী, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে হতাশ। এক পর্যায়ে সুলিভান ফাস করে যে এইরকম গরিবি পোশাক সত্ত্বেও সে একজন বিখ্যাত পরিচালক। এবং সুলিভান মেয়েটাকে তার জার্নিতে আমন্ত্রণ জানায়। মিসএডচেঞ্চার চলতে থাকে। শেষদিকে সুলিভান প্রকৃত যন্ত্রণা-দুর্দশা চাক্ষুষ ও উপলব্ধি করতে পারে যে সে এই অভিজ্ঞতার জন্য কতটা অপ্রস্তুত ছিলো! এইসব সত্ত্বেও স্টার্জেসের সিনেমায় কমেডির কোনো ঘাটতি থাকে না।  সুলিভান’স ট্রাভেলস যদি না দেখে থাকেন, অবশ্যই দেখে ফেলুন। বিশ্বসিনেমার অন্যতম সেরা ব্যালান্সড কমেডি। বাস্তবজীবন ঘনিষ্ঠ হয়েও হাস্যরসে ভরপুর। 

[ট্রিভিয়া: নির্মাতা প্রেস্টন স্টার্জেসকে ট্রিবিউট দিতে কোয়েন ব্রাদার্স তাদের বিখ্যাত ও ব্রাদার হোয়্যার আর্ট দাউ?  (২০০০) মুভিটা বানান।]   

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।