বিত্তহীন আর বিত্তবানদের (পাওয়া না পাওয়াদের) গল্পের বয়স ইতিহাসের বয়সের সমান। যেদিন থেকে মানুষ সমাজে বাস করে আসছে, তখন থেকেই কিছু মানুষের অনেক আছে এবং কিছু মানুষ থেকে গেছে না পাওয়াদের দলে। গত কয়েক বছর ধরেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, সম্পদের বৈষম্য, আয়ের অসমতা, এবং লিঙ্গ, সম্প্রদায় বিষয়ক নানামুখী আলোচনা আমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে।
তারপর সামাজিক বৈষম্য ফুটিয়ে তোলে, এমন অনেক মুভিই আমাদের সামনে এলো। প্রান্তিকীকরণের পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছে- এমন অসংখ্য মুভির জন্য ২০১০ এর দশককে যেতে পারে শ্রেণিযুদ্ধের সিনেমার দশক। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারদের সাথে ফাইট দেওয়া জোকার থেকে শুরু করে ছোট্ট ছেলেটার সাথে নিজেই প্রতারণা করা উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট – শ্রেণি সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুভি-সিনেমার মত যুতসই মাধ্যম আর হয় না।
অবশ্য, সামাজিক অসাম্য নিয়ে সিনেমা কেবল অতীতের বিষয় না। এক শ’ বছরের বেশি সময়ে, বেশ কিছু দারুণ মুভি তৈরি হয়েছে, যেগুলো উদ্ভাবনী গল্প বলার কায়দায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর ব্যক্তিগত পক্ষপাত নিয়ে দূরদর্শী বার্তা দিয়েছে। হতে পারে সেটা ২০ এর দশকের রাশিয়ার লেবার ইউনিয়ন নিয়ে বলা রূপক কাহিনী অথবা একজন টেলিমার্কেটারকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কমেডি। সামাজিক অসাম্য আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যের পুরোভাগেই আছে আর একই রকম গুরুত্ব পাচ্ছে সিনেমার ফ্রেমেও।
এই লিস্টে আছে এই সময়ের সবচে আইকনিক, আলোচিত ৭টি সিনেমা। এই লিস্টে অবশ্য কিছু পুরাতন সেরা মুভিও আছে, যেগুলো এই কালচারাল আলাপগুলোকে সিনেমায় স্থান পাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। এখানে সামাজিক অসাম্য নিয়ে সেরা ৭টি মুভির কথা বলছি। বলা বাহুল্য লিস্টমাত্রই অপূর্ণাঙ্গ ও সাবজেক্টিভ এবং নির্দিষ্ট মাত্রার বায়াস অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেকে যাবেই। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের মুভি আছে দুটি। এশিয়ার মুভি দুটি, ইউরোপের দুইটি অর্থাৎ কোনো সামঞ্জস্য নাই। কেবল একটি বিষয় সবগুলো মুভির ক্ষেত্রে কমনঃ প্রতিটি সিনেমাতেই সামাজিক অসমতা কেন্দ্রীয় অংশজুড়ে আছে। তবে আমাদের বিবেচনায় সামাজিক অসাম্যের বাইরেও গল্পগুলো গল্প, অভিনয় কুশলতা ও নির্মাণশৈলীর কারণে অনন্য। আসুন দেখে নিই ‘সেমসেম সেরা-৭’ এর প্রথম সিনেমা লিস্ট।
৭. ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট (২০১৭) [যুক্তরাষ্ট্র]

দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলির হৃদয়-বিদারক চিত্র। দারিদ্র্যে জর্জরিত পরিবার। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের কাছের একটা স্ট্রিপ মোটেলে বাস করা এই পরিবারের আকস্মিক একটা ঘটনা দিয়ে পরিচালক গল্প শুরু করলেও এটা মানুষের মরিয়া হয়ে ওঠা আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতা আর সংকটকে তুলে ধরে।
আবার অন্যভাবে দেখলে, সিনেমাটি ছয় বছর বয়সী মুনি এবং তার উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদেরও গল্প। এরা ম্যাজিক ক্যাসল হোটেলে কারো তত্ত্বাবধান ছাড়াই থাকে, হালকা পাতলা দুষ্টামি করে আর পাগলের মত ছোটাছুটি করে। এদিকে তার মায়ের একটা সুস্থির জীবন যাপন করতেই যুদ্ধ করতে হয়। এমন বাজেটে তার সংসার চলে যেখানে একবার বাড়ি ভাড়া দিতে লেট করলেই বাসা ছাড়তে হতে পারে। প্রয়োজন মেটাতে সে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিন্তু হিসাব করা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় – যেমন ডিজনী ওয়ার্ল্ডের পাস চুরি করা, গেস্ট রুমের খাবারের চার্জ ধরা এবং এক পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিও। শিশুর উচ্ছ্বল আনন্দে ভরা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি আর করুণ দারিদ্র্যের বৈপরীত্য এমন সব মুহূর্তের বুনন তৈরি করে যা দর্শকদের সহানুভুতি তৈরি করে। নির্মাতা শন বেকারের স্বভাবসুলভ তীর্যক ভঙ্গি এই সিনেমাতেও পাওয়া যাবে।
৬. রোমা (২০১৮) [মেক্সিকো]

‘ই তু মামা তামবিয়েন’ (Y tu mamá también) –এর পর প্রথম আলফোনসো কুয়ারোনের মাতৃভাষায় প্রথম সিনেমা। ১৯৭০ এর দশকের মেহিকো সিটির কোলোনিয়া রোমা এলাকার এক ডাক্তার পরিবারের এক নারী গৃহকর্মী। নাম ক্লেওদেগারিয়া ‘ক্লেও’ গুতিয়েররেজ। চাকরিদাতা পরিবারের প্রধান কাজের সূত্রে কুইবেক যায় ( পরে প্রকাশ পায় যে সে আসলে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে চলে যায়)। ক্লেও পরিবারের কাজকর্ম করে অনেকটা অন্তরালে থেকেই। আবার ক্লেও দেখে তার চাকরিদাতার ফ্যামিলি ভেঙে পড়তেছে। অন্যদিকে তার নতুন বয়ফ্রেন্ড ফারমিন-এর সঙ্গে কয়েকটা ডেট করার পরে এক পর্যায়ে ক্লেও আবিষ্কার করে সে প্রেগনেন্ট। অন্যদিকে ফারমিনকে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া এমনকি ক্লেওর সঙ্গে একসাথে থাকতেও ফারমিনের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে ক্লেও তার চাকরীদাতা লোকটাকে জানানোর চাপও বোধ করে। মেহিকোর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল এক সময় ক্লেওর ব্যক্তিগত জীবনে এইসব ঘটনা ঘটে। এবং সময় সময় সেই সংঘাতের উত্তাপ এসে পড়ে ক্লেও ও তার চাকরিদাতার জীবনে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর নির্বিচার সরকারি আক্রমণ চলে। কুয়ারোনের টেকনিক হচ্ছে রাজনৈতিক গন্ডোগোল নিম্নবিত্ত এক নারীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন মামুলি ঘটনাবলির পটভূমিকায় হাজির হয়।
একই সঙ্গে হিউমার ও হররের মিশেল সিনেমায় পাওয়া যাবে কারণ এটা আলফোনসো কুয়োরানের সিনেমা। আপনি ই তু মামা তামবিয়েন (Y tu mamá tambien) দেখে থাকলে আলফোনসের কমেডিক টাইমিং কতটা দুর্দান্ত তা জানার কথা! রোমা সিরিয়াস ও স্যাড সিনেমা কিন্তু অতর্কিতে ও চোরাগোপ্তা হিউমার এখানেও দেখা যায়।
রোমা এমন এক সিনেমা যা ভাবাবে, কিছু দৃশ্য আপনার মাথায় দীর্ঘদিনের জন্য গেঁথে থাকবে। ফাস্ট এন ফিউরিয়াস ধরণের সুপার-ফাস্ট মুভির দর্শকদের কাছে মুভিটা কিছু স্লো ঠেকতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে একবার কিছুক্ষণ দেখলে, আপনাকে ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা মুভিতে আছে। নানান সূক্ষ্ম সৌন্দর্য, ইনট্রিগ ও ভাবনাজাগানিয়া উপাদান রোমা-তে আছে। সেমসেম টিমের পরামর্শঃ গিভ ইট আ ট্রাই!
৫. বাইসাইকেল থিভস (১৯৪৮) [ইতালি]

সত্যজিৎ রায় কিংবা অনুরাগ কাশ্যপের মতো বিখ্যাত নির্মাতাদের প্রিয়তম মুভি। গল্পের কেন্দ্রে বাবা আন্তোনিয়ো রিচ্চি ও আর ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর সম্পর্ক। আবার দারিদ্রের চক্র আর এক ব্যক্তি সেই দুষ্টচক্র এড়াতে কোন মাত্রায় যেতে পারে, কতটা বেপরোয়া হতে পারে– তার হৃদয়বিদারক গল্পও।
আন্তোনিও যখন পুলিশের কাছে তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল সাইকেল চুরি যাওয়ার রিপোর্ট করে, মানুষ গা করে না। অথচ সেই একই কাজ (চুরি) যখন আন্তোনিও নিজে করে, পুরো শহর যেন তারে থামাইতে উঠে পড়ে লাগে, ছি ছি রি রি পড়ে যায়। ছোট ছেলে, ব্রুনো আতঙ্কিত। তার বাবাকে ঘিরে আছে ক্রুদ্ধ জনতার ভিড়। কারণ তার বাবা একটা বাইক চুরি করেছে। তাকে টেনে হিচড়ে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে, সাইকেলের মালিক অশ্রুশিক্ত ব্রুনোকে দেখে আর্দ্র হয়ে পড়েন, মমতাবশত ব্রুনোর বাবাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন।
ব্রুনো বাবার হাত ধরে। পিতা যেমন পুত্রকে ক্ষমা করে দেয়, তেমনি এই সিনেমায় পুত্র পিতাকে ক্ষমা করে দেয়। বাপ-বেটায় ভিড়ের মধ্যে হারায় যায়। সুখি সমাপ্তি বলা যায়। এইরকম সহজ সরল এক কাহিনী। বলা যায় এই লিস্টের সবচেয়ে সহজ ও সিম্পল কাহিনী দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমাটা সাধারণভাবে দেখলে এক রকম অনুভুতি; অথচ শুরু থেকে ব্রুনোর চোখে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
৪. প্ল্যাটফর্ম (২০২০) [স্পেন]

তিন ধরণের মানুষ আছে পৃথিবীতে: যারা থাকে উপরে, যারা নিচে থাকে আর যাদের পতন ঘটে।
—ত্রিমাগাসি | প্ল্যাটফর্ম | ২০২০
বিশাল এক ভার্টিক্যাল জেলখানা। অবশ্য মালিক কোম্পানির ভাষ্যমতে, এটি জেলখানা না, ‘ভার্টিকেল সেলফ-ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।’ তবে কয়েদিরা বলে ‘গভীর গর্ত’। প্রতিটি ফ্লোরে একটা করে ছোট রুমে থাকে দুইজন করে কয়েদি। প্রত্যেকটা রুমের মাঝখান বরাবর বিশাল এক আয়তাকার গর্ত, যা পুরা বিল্ডিং-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চলে গেছে। সেই গর্ত হয়ে উপরে থেকে লিফট টাইপ একটা প্ল্যাটফর্মে করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য নামে। সমস্ত কয়েদিদের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন যে উপরের লেভেলের কয়েদিরা প্রথমে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্ল্যাটফর্মটা কয়েক মিনিট পর পর নিচের লেভেল নামে। তারপর পরের লেভেল, তাদের পরে আরও নিচের লেভেল, এইভাবে। সমস্যা হচ্ছে উপরের লেভেলগুলাতে যারা থাকে তারা প্রয়োজনের চাইতে বেশি খায় বা খাবার নষ্ট করে। ফলে নিচের লেভেল কয়েদিরা পায় না।
নিচের দিকের লোকগুলা জীবন বাঁচাতে তখন কী কী করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? স্পয়লার দেবো না।
তবে আপনার অনুমানকে আরও অনিশ্চিত করতে এই জেলখানার আরেকটা মজার বৈশিষ্ট্য বলি। প্রত্যেক মাসে কয়েদিদের সেল বদল হয়। যে এখন আছে, ৪৮ নাম্বার সেলে, একমাস পরে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে ২০২ কিংবা ৮ নাম্বার সেলে। প্ল্যাটফর্ম এক ডিস্টোপিয়ান মাস্টারপিস।
৩. প্যারাসাইট (২০১৯) [দক্ষিণ কোরিয়া]

অস্কার পাওয়া প্রথম দক্ষিণ কোরীয় সিনেমা প্যারাসাইট। তবে কেবল পুরষ্কার দিয়ে প্যারাসাইটকে বিচার করলে মুভিটার প্রতি অবিচারই করা হবে।
শ্রেণিসমস্যা ও সমাজ কাঠামোর জটিলতা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী একজন ফিল্মমেকার বং জুন-হো। প্যারাসাইটের আগের মুভিগুলাও যদি দেখেন, যেমন, স্নোপিয়ার্স, ওকজা বা হোস্ট, একই বিষয়বস্তু ভিন্ন চেহারায় মোকাবেলা করেছেন। প্যারাসাইটকেশ্রেণি বিভাজন ও মানব প্রকৃতি বিষয়ে তার অনুমানের নিখুঁত সিন্থেসিস বলা যায়। প্যারাসাইট এক কথায় শ্রেণিসংগ্রামের সিনেমা।
যেকোনো কোরিয়ান সিনেমায় কিম আর পার্ক নাম আপনি ঘুরেফিরে পাবেন– এই মুভিতেও যার ব্যত্যয় ঘটে নি!
গল্প শুরু হয় কিম ফ্যামিলিকে ঘিরে। বেজমেন্ট ধরণের ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা একটা পরিবার কোনো মতে টানাটানিতে যাদের সংসার চলে যায়। ফ্যামিলির প্রত্যেক সদস্য নানা ধরণের অড জব করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সবাই পার্ক ফ্যামিলিতে বিভিন্ন ধরণের কাজে নিযুক্ত হয়। পার্ক ফ্যামিলি আবার কিম ফ্যামিলির ঠিক বিপরীত। বিলাসবহুল বিন্দাস জীবন কাটায়। বেশ বন্ধুসুলভ অথচ শীতল। পার্ক পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখা হয় যে কিম পরিবারের সদস্যরা পার্ক ফ্যামিলির কাছে গোপন রাখে। এক পর্যায়ে তারা পার্ক ফ্যামিলির দখল নেওয়া শুরু করে। দুই পরিবারের মধ্যে পরিষ্কার লড়াই হয়।
কিম ফ্যামিলি আবিষ্কার করে তারা যা-ই করে না কেন, দুনিয়ায় তারা মিসফিটই থেকে যায়। এই দুনিয়া তাদেরকে ‘অপর’ই করে রাখে। সেই অপরায়নের প্রেক্ষিতে কিম ফ্যামিলির প্রতিক্রিয়ার নিষ্ঠুর কিন্তু দুর্দান্ত ইন্ট্রিগিং সিনেমা প্যারাসাইট। দর্শককে আবিষ্ট করে রাখা টানটান উত্তেজনার এক সিনেমা। ওহ, সম্ভব হলে বং জুন-হো’র মেমরিজ অভ মার্ডার মুভিটাও দেখুন।
২. শপলিফটার্স (২০১৯) — [জাপান]

টোকিয়ো শহরের এক কোণে বাস করে দরিদ্র এক পরিবার। বেঁচে থাকার জন্য দোকান থেকে দোকানে চুরি করে বেড়ায়। পরিবারের মোটামুটি সবাই চোর। সে ফ্যামিলিতে এক ছোট মেয়ে ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে।
শপলিফটার্স জটিল, সূক্ষ্ম ও রহস্যময় ফিল্ম। দারুণ চমকের এন্ডিং। সাইকোলজিকাল রহস্যকাহিনীর মতো টুইস্ট আছে। অথচ জন্রা বিবেচনায় ফিল্মটা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ক্লাসিকাল জাপানি স্টাইলের সূক্ষ্ম ফ্যামিলি ড্রামা, কোরে-এদা যার একজন ওস্তাদ। আপনি যেন টেরই পাবেন না এমন মৃদু লয়ে এগোতে এগোতে, হুট করে চূড়ান্ত অংশে এসে হাজির হয় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। নিত্য অনটনের শপলিটার্সের ফ্যামিলির তেমন কিছু নাই, তারা বেঁচে থাকতেই হিমশিম খায় অথচ এরকম একটা মুভি দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কঠিন। সত্যি বলতে, ডিসফাংশনাল ফ্যামিলির দর্শকদেরকে যা স্পর্শ করে তাই হইতেছে, তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত সত্ত্বেও, প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি তাদের এক হয়ে থাকার চেষ্টা। এক কথায় জাপানিজ ফিল্ম মায়েস্ত্রো হিরুকাজু কোরে-এদা’র মাস্টারপিস।
১. সুলিভান’স ট্রাভেলস (১৯৪১) [যুক্তরাষ্ট্র]

সুলিভান’স ট্রাভেলস মুভি বিষয়ক মেটাকমেন্টারি যা একইসাথে স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ত্রিশের দশকে মহামন্দার সময়ে শ্রমজীবী শ্রেণির সংগ্রাম উঠে আসলেও, মূলত একটা মধুর প্রেমের গল্প। প্রেস্টন এমন একটা মুভি বানাতে পেরেছেন যা তার বক্তব্য তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের আজকের পৃথিবীর সংগ্রামকেও যেন স্পর্শ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞান দেওয়া মুলক মুভির বিরক্তিকর দিক সম্পর্কে জ্ঞান দেয় অথচ সিনেমাটি মজার। প্যারাডক্সের মতো ঠেকলেও শেষ পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এমেরিকান মুভি।
হলিউডের চিত্রনির্মাতা জন সুলিভান (জোয়েল ম্যাকক্রি) ‘সস্তা’ কমেডি বানিয়ে বিখ্যাত ও ধনী হয়েছে। তবে তার আফসোস নিপীড়িত মজলুম মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন ও মহামন্দা বিষয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। সিরিয়াস শৈল্পিক সিনেমা। সিনেমার নামও ঠিক করেনঃ ও ব্রাদার, হোয়্যার আর্ট দাউ?
কিন্তু স্টুডিয়ো বস মনে করে, এটা বাজে চিন্তা এবং সুলিভানরে চ্যালেঞ্জ জানায়ে বলে যে সুলিভান আসলে গরিবের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু সুলিভান দমার পাত্র নয়। সে পকেটে মাত্র ১০ সেন্ট নিয়ে দেশ ঘুরে দেখের প্রজেক্ট নেয়, যাতে সে গরিবরা কিভাবে জীবন যাপন করে তা দেখতে পারে। যতবারই সে যাত্রা শুরু করে নানা দুর্ঘটনা তাকে লস এঞ্জেলসে ফেরত নিয়ে আসে।
এরকমই একবার ফেরার সময়, একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় সুলিভানের। মেয়েটা ব্যর্থ অভিনেত্রী, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে হতাশ। এক পর্যায়ে সুলিভান ফাস করে যে এইরকম গরিবি পোশাক সত্ত্বেও সে একজন বিখ্যাত পরিচালক। এবং সুলিভান মেয়েটাকে তার জার্নিতে আমন্ত্রণ জানায়। মিসএডচেঞ্চার চলতে থাকে। শেষদিকে সুলিভান প্রকৃত যন্ত্রণা-দুর্দশা চাক্ষুষ ও উপলব্ধি করতে পারে যে সে এই অভিজ্ঞতার জন্য কতটা অপ্রস্তুত ছিলো! এইসব সত্ত্বেও স্টার্জেসের সিনেমায় কমেডির কোনো ঘাটতি থাকে না। সুলিভান’স ট্রাভেলস যদি না দেখে থাকেন, অবশ্যই দেখে ফেলুন। বিশ্বসিনেমার অন্যতম সেরা ব্যালান্সড কমেডি। বাস্তবজীবন ঘনিষ্ঠ হয়েও হাস্যরসে ভরপুর।
[ট্রিভিয়া: নির্মাতা প্রেস্টন স্টার্জেসকে ট্রিবিউট দিতে কোয়েন ব্রাদার্স তাদের বিখ্যাত ও ব্রাদার হোয়্যার আর্ট দাউ? (২০০০) মুভিটা বানান।]