বিষয় অসমতা: সেরা ৭ সিনেমা

semsemlog
সেমসেম ডেস্ক

বিত্তহীন আর বিত্তবানদের  (পাওয়া না পাওয়াদের) গল্পের বয়স ইতিহাসের বয়সের সমান। যেদিন থেকে মানুষ সমাজে বাস করে আসছে, তখন থেকেই কিছু মানুষের অনেক আছে এবং কিছু মানুষ থেকে গেছে না পাওয়াদের দলে। গত কয়েক বছর ধরেই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র, সম্পদের বৈষম্য, আয়ের অসমতা, এবং লিঙ্গ, সম্প্রদায় বিষয়ক নানামুখী আলোচনা আমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু হয়ে এসেছে।          

তারপর সামাজিক বৈষম্য ফুটিয়ে তোলে, এমন অনেক মুভিই আমাদের সামনে এলো। প্রান্তিকীকরণের পরিণতি ফুটিয়ে তুলেছে- এমন অসংখ্য মুভির জন্য ২০১০ এর দশককে যেতে পারে শ্রেণিযুদ্ধের সিনেমার দশক। ওয়াল স্ট্রিট ব্যাংকারদের সাথে ফাইট দেওয়া জোকার থেকে শুরু করে ছোট্ট ছেলেটার সাথে নিজেই প্রতারণা করা উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট – শ্রেণি সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য মুভি-সিনেমার মত যুতসই মাধ্যম আর হয় না।    

অবশ্য, সামাজিক অসাম্য নিয়ে সিনেমা কেবল অতীতের বিষয় না। এক শ’ বছরের বেশি সময়ে, বেশ কিছু দারুণ মুভি তৈরি হয়েছে, যেগুলো উদ্ভাবনী গল্প বলার কায়দায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আর ব্যক্তিগত পক্ষপাত নিয়ে দূরদর্শী বার্তা দিয়েছে। হতে পারে সেটা ২০ এর দশকের রাশিয়ার লেবার ইউনিয়ন নিয়ে বলা রূপক কাহিনী অথবা একজন টেলিমার্কেটারকে নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কমেডি। সামাজিক অসাম্য আমাদের সাংস্কৃতিক চৈতন্যের পুরোভাগেই আছে আর একই রকম গুরুত্ব পাচ্ছে সিনেমার ফ্রেমেও।    

এই লিস্টে আছে এই সময়ের সবচে আইকনিক, আলোচিত ৭টি সিনেমা। এই লিস্টে অবশ্য কিছু পুরাতন সেরা মুভিও আছে, যেগুলো এই কালচারাল আলাপগুলোকে সিনেমায় স্থান পাওয়ার রাস্তা করে দিয়েছে। এখানে সামাজিক অসাম্য নিয়ে সেরা ৭টি  মুভির কথা বলছি। বলা বাহুল্য লিস্টমাত্রই অপূর্ণাঙ্গ ও সাবজেক্টিভ এবং নির্দিষ্ট মাত্রার বায়াস অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেকে যাবেই। যেমনঃ যুক্তরাষ্ট্রের মুভি আছে দুটি। এশিয়ার মুভি দুটি, ইউরোপের দুইটি অর্থাৎ কোনো সামঞ্জস্য নাই। কেবল একটি বিষয় সবগুলো মুভির ক্ষেত্রে কমনঃ প্রতিটি সিনেমাতেই সামাজিক অসমতা কেন্দ্রীয় অংশজুড়ে আছে। তবে আমাদের বিবেচনায় সামাজিক অসাম্যের বাইরেও গল্পগুলো গল্প, অভিনয় কুশলতা ও নির্মাণশৈলীর কারণে অনন্য। আসুন দেখে নিই ‘সেমসেম সেরা-৭’ এর প্রথম সিনেমা লিস্ট।   

 ৭.  ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট (২০১৭)  [যুক্তরাষ্ট্র] 

‘দ্য ফ্লোরিডা প্রোজেক্ট’ সিনেমার পোস্টার

দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট  সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলির হৃদয়-বিদারক চিত্র। দারিদ্র্যে জর্জরিত পরিবার। ডিজনি ওয়ার্ল্ডের কাছের একটা স্ট্রিপ মোটেলে বাস করা এই পরিবারের আকস্মিক একটা ঘটনা দিয়ে পরিচালক গল্প শুরু করলেও এটা মানুষের মরিয়া হয়ে ওঠা আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে  সিদ্ধান্ত নেওয়ার জটিলতা  আর সংকটকে তুলে ধরে।

 আবার অন্যভাবে দেখলে, সিনেমাটি ছয় বছর বয়সী মুনি এবং তার উচ্ছৃঙ্খল বন্ধুদেরও গল্প। এরা ম্যাজিক ক্যাসল হোটেলে কারো তত্ত্বাবধান ছাড়াই থাকে, হালকা পাতলা দুষ্টামি করে আর পাগলের মত ছোটাছুটি করে। এদিকে তার মায়ের একটা সুস্থির জীবন যাপন করতেই যুদ্ধ করতে হয়। এমন বাজেটে তার সংসার চলে যেখানে একবার বাড়ি ভাড়া দিতে লেট করলেই বাসা ছাড়তে হতে পারে। প্রয়োজন মেটাতে সে অত্যন্ত বিপজ্জনক কিন্তু হিসাব করা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় – যেমন ডিজনী ওয়ার্ল্ডের পাস চুরি করা, গেস্ট রুমের খাবারের চার্জ ধরা এবং এক পর্যায়ে পতিতাবৃত্তিও। শিশুর উচ্ছ্বল আনন্দে ভরা শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি আর করুণ দারিদ্র্যের বৈপরীত্য এমন সব মুহূর্তের বুনন তৈরি করে যা দর্শকদের সহানুভুতি তৈরি করে। নির্মাতা শন বেকারের স্বভাবসুলভ তীর্যক ভঙ্গি এই সিনেমাতেও পাওয়া যাবে।      

৬. রোমা (২০১৮) [মেক্সিকো]

রোমা সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার

‘ই তু মামা তামবিয়েন’ (Y tu mamá también) –এর পর প্রথম আলফোনসো  কুয়ারোনের মাতৃভাষায় প্রথম সিনেমা। ১৯৭০ এর দশকের মেহিকো সিটির কোলোনিয়া রোমা এলাকার এক ডাক্তার পরিবারের এক নারী গৃহকর্মী। নাম ক্লেওদেগারিয়া ‘ক্লেও’ গুতিয়েররেজ। চাকরিদাতা পরিবারের প্রধান কাজের সূত্রে কুইবেক যায় ( পরে প্রকাশ পায় যে সে আসলে পরিবার ছেড়ে চলে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে চলে যায়)। ক্লেও পরিবারের কাজকর্ম করে অনেকটা অন্তরালে থেকেই। আবার ক্লেও দেখে তার চাকরিদাতার ফ্যামিলি ভেঙে পড়তেছে। অন্যদিকে তার নতুন বয়ফ্রেন্ড ফারমিন-এর সঙ্গে কয়েকটা ডেট করার পরে এক পর্যায়ে ক্লেও আবিষ্কার করে সে প্রেগনেন্ট। অন্যদিকে ফারমিনকে বাচ্চার দায়িত্ব নেওয়া এমনকি ক্লেওর সঙ্গে একসাথে থাকতেও ফারমিনের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। ফলে ক্লেও তার চাকরীদাতা লোকটাকে জানানোর চাপও বোধ করে। মেহিকোর সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের উত্তাল এক সময় ক্লেওর ব্যক্তিগত জীবনে এইসব ঘটনা ঘটে। এবং সময় সময় সেই সংঘাতের উত্তাপ এসে পড়ে ক্লেও ও তার চাকরিদাতার জীবনে। ব্যাকগ্রাউন্ডে বিক্ষোভকারী ছাত্রদের উপর নির্বিচার সরকারি আক্রমণ চলে। কুয়ারোনের টেকনিক হচ্ছে  রাজনৈতিক গন্ডোগোল নিম্নবিত্ত এক নারীর একান্ত ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন মামুলি ঘটনাবলির পটভূমিকায় হাজির হয়।  

একই সঙ্গে হিউমার ও হররের মিশেল সিনেমায় পাওয়া যাবে কারণ এটা আলফোনসো কুয়োরানের সিনেমা। আপনি ই তু মামা তামবিয়েন (Y tu mamá tambien) দেখে থাকলে আলফোনসের কমেডিক টাইমিং কতটা দুর্দান্ত তা জানার কথা! রোমা সিরিয়াস ও স্যাড সিনেমা কিন্তু অতর্কিতে ও চোরাগোপ্তা হিউমার এখানেও দেখা যায়।  

রোমা এমন এক সিনেমা যা ভাবাবে, কিছু দৃশ্য আপনার মাথায় দীর্ঘদিনের জন্য গেঁথে থাকবে। ফাস্ট এন ফিউরিয়াস ধরণের সুপার-ফাস্ট মুভির দর্শকদের কাছে মুভিটা কিছু স্লো ঠেকতে পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে একবার কিছুক্ষণ দেখলে, আপনাকে ধরে রাখার নানা ব্যবস্থা মুভিতে আছে। নানান সূক্ষ্ম সৌন্দর্য, ইনট্রিগ ও ভাবনাজাগানিয়া উপাদান রোমা-তে আছে। সেমসেম টিমের পরামর্শঃ গিভ ইট আ ট্রাই!    

৫. বাইসাইকেল থিভস (১৯৪৮) [ইতালি] 

দ্য বাইসাইকেল থিফ সিনেমার পোস্টার

সত্যজিৎ রায় কিংবা অনুরাগ কাশ্যপের মতো বিখ্যাত নির্মাতাদের প্রিয়তম মুভি।   গল্পের কেন্দ্রে বাবা আন্তোনিয়ো রিচ্চি ও আর ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর সম্পর্ক। আবার দারিদ্রের চক্র আর এক ব্যক্তি সেই দুষ্টচক্র এড়াতে কোন মাত্রায় যেতে পারে, কতটা বেপরোয়া হতে পারে– তার হৃদয়বিদারক গল্পও।   

আন্তোনিও যখন পুলিশের কাছে তার উপার্জনের একমাত্র সম্বল সাইকেল চুরি যাওয়ার রিপোর্ট করে, মানুষ গা করে না। অথচ সেই একই কাজ (চুরি) যখন আন্তোনিও নিজে করে, পুরো শহর যেন তারে থামাইতে উঠে পড়ে লাগে, ছি ছি রি রি পড়ে যায়। ছোট ছেলে, ব্রুনো আতঙ্কিত। তার বাবাকে ঘিরে আছে ক্রুদ্ধ জনতার ভিড়। কারণ তার বাবা একটা বাইক চুরি করেছে। তাকে টেনে হিচড়ে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলে, সাইকেলের মালিক অশ্রুশিক্ত ব্রুনোকে দেখে আর্দ্র হয়ে পড়েন, মমতাবশত ব্রুনোর বাবাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেন। 

ব্রুনো বাবার হাত ধরে। পিতা যেমন পুত্রকে ক্ষমা করে দেয়, তেমনি এই সিনেমায় পুত্র পিতাকে ক্ষমা করে দেয়। বাপ-বেটায় ভিড়ের মধ্যে হারায় যায়। সুখি সমাপ্তি বলা যায়। এইরকম সহজ সরল এক কাহিনী। বলা যায় এই লিস্টের সবচেয়ে সহজ ও সিম্পল কাহিনী দ্য বাইসাইকেল থিফ-এর। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমাটা সাধারণভাবে দেখলে এক রকম অনুভুতি; অথচ  শুরু থেকে ব্রুনোর চোখে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন।    


৪. প্ল্যাটফর্ম (২০২০) [স্পেন]

দ্য প্ল্যাটফর্ম সিনেমার পোস্টার

তিন ধরণের মানুষ আছে পৃথিবীতে: যারা থাকে উপরে, যারা নিচে থাকে আর যাদের পতন ঘটে।  

—ত্রিমাগাসি | প্ল্যাটফর্ম | ২০২০ 

বিশাল এক ভার্টিক্যাল জেলখানা। অবশ্য মালিক কোম্পানির ভাষ্যমতে, এটি জেলখানা না, ‘ভার্টিকেল সেলফ-ম্যানেজমেন্ট সেন্টার।’ তবে কয়েদিরা বলে ‘গভীর গর্ত’। প্রতিটি ফ্লোরে একটা করে ছোট রুমে থাকে দুইজন করে কয়েদি। প্রত্যেকটা রুমের মাঝখান বরাবর বিশাল এক আয়তাকার গর্ত, যা পুরা বিল্ডিং-এর উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চলে গেছে। সেই গর্ত হয়ে উপরে থেকে লিফট টাইপ একটা প্ল্যাটফর্মে করে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাদ্য নামে। সমস্ত কয়েদিদের জন্যে পর্যাপ্ত খাদ্যই সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থাটা এমন যে উপরের লেভেলের কয়েদিরা প্রথমে খাওয়ার সুযোগ পায়। প্ল্যাটফর্মটা কয়েক মিনিট পর পর নিচের লেভেল নামে। তারপর পরের লেভেল, তাদের পরে আরও নিচের লেভেল, এইভাবে। সমস্যা হচ্ছে উপরের লেভেলগুলাতে যারা থাকে তারা প্রয়োজনের চাইতে বেশি খায় বা খাবার নষ্ট করে। ফলে নিচের লেভেল কয়েদিরা পায় না।  

নিচের দিকের লোকগুলা জীবন বাঁচাতে তখন কী কী করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? স্পয়লার দেবো না। 

তবে আপনার অনুমানকে আরও অনিশ্চিত করতে এই জেলখানার আরেকটা মজার বৈশিষ্ট্য বলি। প্রত্যেক মাসে কয়েদিদের সেল বদল হয়। যে এখন আছে, ৪৮ নাম্বার সেলে, একমাস পরে ঘুম থেকে উঠে সে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে ২০২ কিংবা ৮  নাম্বার সেলে। প্ল্যাটফর্ম এক ডিস্টোপিয়ান মাস্টারপিস। 

৩. প্যারাসাইট (২০১৯) [দক্ষিণ কোরিয়া]

প্যারাসাইট সিনেমার অফিশিয়াল পোস্টার


অস্কার পাওয়া প্রথম দক্ষিণ কোরীয় সিনেমা  প্যারাসাইট। তবে কেবল পুরষ্কার দিয়ে  প্যারাসাইটকে বিচার করলে মুভিটার প্রতি অবিচারই করা হবে। 

শ্রেণিসমস্যা ও সমাজ কাঠামোর জটিলতা নিয়ে গভীরভাবে আগ্রহী একজন ফিল্মমেকার বং জুন-হো। প্যারাসাইটের আগের মুভিগুলাও যদি দেখেন, যেমন, স্নোপিয়ার্স, ওকজা বা হোস্ট, একই বিষয়বস্তু ভিন্ন চেহারায় মোকাবেলা করেছেন। প্যারাসাইটকেশ্রেণি বিভাজন ও মানব প্রকৃতি বিষয়ে তার অনুমানের নিখুঁত সিন্থেসিস বলা যায়।  প্যারাসাইট এক কথায় শ্রেণিসংগ্রামের সিনেমা। 

যেকোনো কোরিয়ান সিনেমায় কিম আর পার্ক নাম আপনি ঘুরেফিরে পাবেন– এই মুভিতেও যার ব্যত্যয় ঘটে নি!  
গল্প শুরু হয় কিম ফ্যামিলিকে ঘিরে। বেজমেন্ট ধরণের ছোট ঘরে গাদাগাদি করে থাকা একটা পরিবার কোনো মতে টানাটানিতে যাদের সংসার চলে যায়। ফ্যামিলির প্রত্যেক সদস্য নানা ধরণের অড জব করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে সবাই পার্ক ফ্যামিলিতে বিভিন্ন ধরণের কাজে নিযুক্ত হয়।  পার্ক ফ্যামিলি আবার কিম ফ্যামিলির ঠিক বিপরীত। বিলাসবহুল বিন্দাস জীবন কাটায়। বেশ বন্ধুসুলভ অথচ শীতল। পার্ক পরিবারের কাছ থেকে গোপন রাখা হয় যে কিম পরিবারের সদস্যরা পার্ক ফ্যামিলির কাছে গোপন রাখে। এক পর্যায়ে তারা পার্ক ফ্যামিলির দখল নেওয়া শুরু করে। দুই পরিবারের মধ্যে পরিষ্কার লড়াই হয়।   


কিম ফ্যামিলি আবিষ্কার করে তারা যা-ই করে না কেন, দুনিয়ায় তারা মিসফিটই থেকে যায়। এই দুনিয়া তাদেরকে ‘অপর’ই করে রাখে। সেই অপরায়নের প্রেক্ষিতে কিম ফ্যামিলির প্রতিক্রিয়ার নিষ্ঠুর কিন্তু দুর্দান্ত ইন্ট্রিগিং সিনেমা প্যারাসাইট। দর্শককে আবিষ্ট করে রাখা টানটান উত্তেজনার এক সিনেমা। ওহ, সম্ভব হলে বং জুন-হো’র মেমরিজ অভ মার্ডার মুভিটাও দেখুন।   

২. শপলিফটার্স (২০১৯) — [জাপান]

শপলিফটার্স সিনেমার পোস্টার

টোকিয়ো শহরের এক কোণে বাস করে দরিদ্র এক পরিবার। বেঁচে থাকার জন্য দোকান থেকে দোকানে চুরি করে বেড়ায়। পরিবারের মোটামুটি সবাই চোর। সে ফ্যামিলিতে এক ছোট মেয়ে ঘটনাক্রমে যুক্ত হয়ে পড়ে।  

শপলিফটার্স জটিল, সূক্ষ্ম ও রহস্যময় ফিল্ম। দারুণ চমকের এন্ডিং। সাইকোলজিকাল রহস্যকাহিনীর মতো টুইস্ট আছে। অথচ জন্রা বিবেচনায় ফিল্মটা সম্পূর্ণ আলাদা। এটা ক্লাসিকাল জাপানি স্টাইলের সূক্ষ্ম ফ্যামিলি ড্রামা,  কোরে-এদা যার একজন ওস্তাদ। আপনি যেন টেরই পাবেন না এমন মৃদু লয়ে এগোতে এগোতে, হুট করে চূড়ান্ত অংশে এসে হাজির হয় হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। নিত্য অনটনের শপলিটার্সের ফ্যামিলির তেমন কিছু নাই, তারা বেঁচে থাকতেই হিমশিম খায় অথচ এরকম একটা মুভি দেখে চোখে পানি ধরে রাখা কঠিন। সত্যি বলতে, ডিসফাংশনাল ফ্যামিলির দর্শকদেরকে যা স্পর্শ করে তাই হইতেছে, তাদের যাবতীয় সীমাবদ্ধতা, দ্বন্দ্ব সংঘাত সত্ত্বেও, প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি তাদের এক হয়ে থাকার চেষ্টা। এক কথায় জাপানিজ ফিল্ম মায়েস্ত্রো হিরুকাজু কোরে-এদা’র মাস্টারপিস।   

১. সুলিভান’স ট্রাভেলস (১৯৪১) [যুক্তরাষ্ট্র]   

সুলিভান’স ট্রাভেলস এর প্রথম অফিশিয়াল পোস্টার

সুলিভান’স ট্রাভেলস মুভি বিষয়ক মেটাকমেন্টারি যা একইসাথে স্ল্যাপস্টিক কমেডি। ত্রিশের দশকে মহামন্দার সময়ে শ্রমজীবী শ্রেণির সংগ্রাম উঠে আসলেও, মূলত একটা মধুর প্রেমের গল্প। প্রেস্টন এমন একটা মুভি বানাতে পেরেছেন যা তার বক্তব্য তুলে ধরলেও শেষ পর্যন্ত আমাদের আজকের পৃথিবীর সংগ্রামকেও যেন স্পর্শ করে। মজার বিষয় হচ্ছে, জ্ঞান দেওয়া মুলক মুভির বিরক্তিকর দিক সম্পর্কে জ্ঞান দেয় অথচ সিনেমাটি মজার। প্যারাডক্সের মতো ঠেকলেও শেষ পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ এমেরিকান মুভি।  


হলিউডের চিত্রনির্মাতা জন সুলিভান (জোয়েল ম্যাকক্রি) ‘সস্তা’ কমেডি বানিয়ে বিখ্যাত ও ধনী হয়েছে। তবে তার আফসোস নিপীড়িত মজলুম মানুষদের দুর্দশাগ্রস্ত জীবন ও মহামন্দা বিষয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। সিরিয়াস শৈল্পিক সিনেমা। সিনেমার নামও ঠিক করেনঃ ও ব্রাদার, হোয়্যার আর্ট দাউ?  


কিন্তু স্টুডিয়ো বস মনে করে, এটা বাজে চিন্তা এবং সুলিভানরে চ্যালেঞ্জ জানায়ে বলে যে সুলিভান আসলে গরিবের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানে না। কিন্তু সুলিভান দমার পাত্র নয়। সে পকেটে মাত্র ১০ সেন্ট নিয়ে দেশ ঘুরে দেখের প্রজেক্ট নেয়, যাতে সে গরিবরা কিভাবে জীবন যাপন করে তা দেখতে পারে। যতবারই সে যাত্রা শুরু করে নানা দুর্ঘটনা তাকে লস এঞ্জেলসে ফেরত নিয়ে আসে। 

এরকমই একবার ফেরার সময়, একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় সুলিভানের। মেয়েটা ব্যর্থ অভিনেত্রী, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে হতাশ। এক পর্যায়ে সুলিভান ফাস করে যে এইরকম গরিবি পোশাক সত্ত্বেও সে একজন বিখ্যাত পরিচালক। এবং সুলিভান মেয়েটাকে তার জার্নিতে আমন্ত্রণ জানায়। মিসএডচেঞ্চার চলতে থাকে। শেষদিকে সুলিভান প্রকৃত যন্ত্রণা-দুর্দশা চাক্ষুষ ও উপলব্ধি করতে পারে যে সে এই অভিজ্ঞতার জন্য কতটা অপ্রস্তুত ছিলো! এইসব সত্ত্বেও স্টার্জেসের সিনেমায় কমেডির কোনো ঘাটতি থাকে না।  সুলিভান’স ট্রাভেলস যদি না দেখে থাকেন, অবশ্যই দেখে ফেলুন। বিশ্বসিনেমার অন্যতম সেরা ব্যালান্সড কমেডি। বাস্তবজীবন ঘনিষ্ঠ হয়েও হাস্যরসে ভরপুর। 

[ট্রিভিয়া: নির্মাতা প্রেস্টন স্টার্জেসকে ট্রিবিউট দিতে কোয়েন ব্রাদার্স তাদের বিখ্যাত ও ব্রাদার হোয়্যার আর্ট দাউ?  (২০০০) মুভিটা বানান।]   

স্বাধীনতার সংকট

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

স্বাধীনতা এক ক্ষণিকের বিরাম স্থান হিসেবেই থেকে যাবে। আমরা যখন এক ধরনের যাপন থেকে, ভিন্ন আরেক ধরনের যাপনের স্বাদ পাই, অন্তত ওই ‘ভিন্ন’ যাপনও ক্লিশে হবার হওয়ার আগ পর্যন্ত, আমাদের মনে হয় যে, স্বাধীনতা তো পেয়েই গেছি। তবে নতুন এই ‘স্বাধীনতা’ আমাদের পরাধীনতার স্বাদ দিতে থাকে। ব্যক্তির নিয়তি আসলে এমনই। যেহেতু তার গোড়ায় আছে অধীনতার ইতিহাস।  

আজকের দুনিয়ায় আমরা নিজেদের আর পরাধীন ভাবি না। বরং নিজেদেরকে নিরন্তর এক গড়াপেটা প্রকল্পের অংশ মনে করি। আর এই প্রকল্পের অংশ হতে পারলেই নিজেদেরকে স্বাধীন মানুষ মনে হতে থাকে। কিন্তু এই প্রকল্প আমাদের পূর্বের চেয়ে আরও কার্যকরী পন্থায়, এক নতুন ধরনের  জবরদস্তি আর বাধার মুখোমুখি করে। যদিও এই ‘স্বাধীনতা’ প্রকল্প দেখাতে চায় যে ব্যক্তি কোন বহিরাগত কিংবা ভিনদেশি অধীনতায় নাই। কিন্তু একই সঙ্গে ব্যক্তি ওই প্রকল্পের নানা সীমাবদ্ধতা আর বাধার মুখে এমনই নতি স্বীকার করে যে, ফলশ্রুতিতে তাকে ‘সাফল্য’ আর ‘অর্জন’ এর এক বাধ্যতামূলক রেসে অবতীর্ণ হতে হয়।    

আমরা ইতিহাসের এমন এক পর্যায়ে আছি, যখন স্বাধীনতাই উলটা আমাদের বাধ্যবাধকতা আর প্রতিবন্ধকতা উপহার দিচ্ছে।  পুরোনো ব্যবস্থা মানুষকে বিধি-নিষেধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতো, আর আজকের ব্যবস্থা সীমাহীন ‘সম্ভাবনা’র কথা বলে নিয়ন্ত্রণ করছে।  আর এভাবেই, বাধ্যবাধকতায় পর্যবসিত ‘সম্ভাবনা’ সীমাহীনই বটে। ফলে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করছি এক পরস্পর বিরোধী পরিস্থিতিতে। সাধারণত, স্বাধীনতার মানে হলো বাধ্যবাধকতার উলটা। কিন্তু আজকের স্বাধীনতা, এক ধরনের বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এহেন স্বাধীনতার বদৌলতে আমরা নানান মানসিক সমস্যায়, যেমন – বিষণ্ণতা আর বার্ন আউটে ভুগছি।     

একজন আপাত স্বাধীন ব্যক্তি নিজেকে স্বাধীন মনে করলেও বাস্তবে সে আসলে দাস। কোনো হুকুমদার ছাড়াই নিজেকে সে স্বেচ্ছায় শোষণ করে। আর এভাবে সে পরিণত হয় আধুনিক দুনিয়ার দাসে। যেখানে কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করছে না, কিন্তু তারপরও সে নিজেই বেছে নিচ্ছে একটা খাওয়া-পড়ার জীবন। খাওয়া-পড়ার জীবন আর শ্রম, এই দুই হলো একই মুদ্রার দুই পিঠ। এই খাওয়া-পড়া বা কেবল শরীরী জীবনের আরেক নাম হলো স্বাস্থ্য।  আজকের নিও-লিবারেল দাসের কোনো সার্বভৌমত্ব, এমনকি কোন স্বাধীনতাও নাই। ওইটা কেবল হেগেলের ডায়ালেকটিকে  ‘প্রভু’-র যে ধারণা, তার ছিল। যে ‘প্রভু’ নিজে কোন শ্রম দেয় না, কেবল উপভোগ করে। হেগেলের মতে, প্রভুর এই সার্বভৌমত্ব আসে খাওয়া-পড়ার জীবনকে অতিক্রম করে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার মধ্য দিয়ে। এমন বেঁচে থাকারও অধিক, এক উপভোগের জীবন, দাসের কাছে অপরিচিত; তার একমাত্র উদ্বেগ নিজের খাওয়া পড়া নিয়ে।  কিন্তু হেগেল যা ধারণা করেছিলেন- বাস্তবে ঘটে তার উল্টোটা। শ্রম দাসকে মুক্ত করে না। বরং সে নিজেই শ্রমের দাস হয়ে থাকে। এখন এমনকি দাস নিজেই প্রভুকে শ্রমে বাধ্য করছে। আজকের প্রভু ও দাসের দ্বান্দ্বিকতা দাঁড়িয়ে আছে সর্বব্যাপী শ্রমের উপর। 

নিও লিবারাল দুনিয়ায়, যে মানুষ নিজেকে নিজের মালিক মনে করছে, তার আসলে এমনকি একটা উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব গড়ে তোলারও সামর্থ্য নাই। আদতে উদ্দেশ্যহীন বন্ধুত্ব কেমন তার কোন ধারণাই এইসব মানুষদের নাই। এককালে ‘স্বাধীন’ হওয়া বলতে বোঝাতো বন্ধুদের মাঝে থাকা। ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা বংশে ‘স্বাধীনতা’ (freedom) ও ‘বন্ধুত্ব’ (friendship) এই দুই শব্দেরই মূল একই। স্বাধীনতা বলতে বোঝায় সম্পর্ক। সত্যিকারের স্বাধীনতার অনুভূতি তো কেবল অর্থবহ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই সাকার হয়। যেখানে অন্যদের সঙ্গে থাকা, জীবনে আনন্দ বয়ে নিয়ে আসে। কিন্তু আজকের নিওলিবারেল ব্যবস্থা  মানুষকে চরম এক নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই অর্থে, এই ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃত অর্থে স্বাধীন করে না। তাই প্রশ্নটা হলো, ‘স্বাধীনতা’ শব্দটির নতুন করে অর্থ নির্মানের। ফলে নির্মান করতে হবে এমন এক স্বাধীনতার ধারণা, যা কিনা আমাদের এই মরনোন্মুখ দ্বান্দ্বিকতা থেকে মুক্তি দিতে পারে। 

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল।

স্বাধীনতাকে কৌশলে শোষণ করার এক কার্যকর পদ্ধতি হলো নিওলিবারেলিজম। স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত চর্চা এবং প্রকাশের ধরণ- যেমন আবেগ, খেলা এবং যোগাযোগ, সবই শোষিত হয় এই সিস্টেমে। মানুষকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে শোষণ করাটা তেমন কাজের না। যখন কাউকে জোর করে শোষন করা হয়, তখন লাভ হয় সামান্যই। আসল লাভ হয় তখনই, যখন স্বাধীনতাকেই শোষণ করা যায়। 

মজার বিষয় হলো, কার্ল মার্ক্সও স্বাধীনতাকে  ‘অন্যদের সঙ্গে সফল সম্পর্ক’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন –
‘শুধুমাত্র কমিউনিটির মাঝেই ব্যক্তি তার ক্ষমতাগুলোকে সব দিকে বিকশিত করার উপায় খুঁজে পায়। সুতরাং কেবল কমিউনিটির মধ্যেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্ভব।’ এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, স্বাধীনতার মানে হলো অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিকশিত করা। স্বাধীনতা এখানে একটি কার্যকর কমিউনিটির সমার্থক। 

মার্ক্সের দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আসলে একটা চালাকি। এটা হলো পুঁজির একটা কৌশল। ‘মুক্ত প্রতিযোগিতা’, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ধারণার উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এটা মূলত পুঁজির ‘নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু’। অর্থাৎ, পুঁজির এক অঙ্গের সঙ্গে অন্য অঙ্গের যোগাযোগ। এটাই পুঁজির আসল খাসলত।

মুক্ত প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে পুঁজি নিজেরই আরেক অঙ্গের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে বংশ বৃদ্ধি ঘটায়। তার মানে পুঁজি এমন স্বমেহনের পথ নেয় ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম ভাঙায়ে। এইভাবে  যত বেশি মানুষ এই ‘মুক্ত প্রতিযোগিতায়’ অংশ নেয়, পুঁজি ততই বিকশিত হয়। এইভাবে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একরকম দাসত্বেই পরিণত হয়। যতক্ষন এটা পুঁজির দখলে থাকে এবং পুঁজি একে নিজের বাড়বাড়ন্তের টুল হিসেবে ব্যবহার করে। তার মানে, পুঁজি নিজের ছানা পোনা বাড়াতে ব্যক্তি স্বাধীনতাকে শোষণ করে। তাই মার্ক্সের ভাষায়, ‘মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কেউ মুক্ত হয় না, বরং পুঁজি নিজে মুক্ত হয়।’ 

পুঁজির স্বাধীনতা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এতে করে ব্যক্তি, পুঁজির জননাঙ্গে পরিণত হয়। আর ঠিক এইভাবে ব্যক্তি স্বাধীনতা পুঁজিকে ব্যক্তিসত্তা প্রদান করে। ফলে পুঁজি নিজের পুনরুৎপাদনে সক্ষম হয়। এভাবে পুঁজি নিজেই ক্রমাগত নিজের সন্তানাদি পয়দা করতে থাকে। আজকের দিনে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে বিকার দেখা যাচ্ছে, এটা আসলে পুঁজির বিকারেরই আরেক বহিঃপ্রকাশ।

পুঁজির একনায়কতন্ত্র

কার্ল মার্ক্সের মতে, সমাজ বিকাশের একটা নির্দিষ্ট স্তরে উৎপাদনশক্তির সঙ্গে উৎপাদনসম্পর্কের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্বের কারণ হলো, উৎপাদনশক্তির রূপান্তর। সে ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকে।

ফলে, শিল্পায়ন যখন সমাজে নতুন ধরনের উৎপাদনশক্তির জন্ম দেয়, তখন তা এমন পুরনো মালিকানা ও শাসনকাঠামোর (সামন্তীয়) সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। এই দ্বন্দ্ব থেকেই সমাজে এমন এক সংকট দেখা দেয়, যার মধ্য দিয়ে পুরনো উৎপাদনসম্পর্কে ভাঙ্গনের পরিস্থিতি তৈয়ার হয়। মার্ক্স মনে করেন, শ্রমিক শ্রেণিকে, বুর্জোয়া শ্রেণির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্বে জয় লাভ করতে হবে । আর এই সংগ্রাম এক সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের নিয়ে যাবে। 

কিন্তু মার্ক্সের এই ধারণার বিপরীর মত হলো-  কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তি ও উৎপাদনসম্পর্কের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তার বিলয় সম্ভব নয়। এই দ্বন্দ্বের কোনো দ্বান্দ্বিক উত্তরণ নাই। পুঁজিবাদ ভবিষ্যতের দিকে নিরন্তর পলায়নপর। কারণ এর মূলেই আছে স্থায়ী দ্বন্দ্ব। 

যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুঁজিবাদ এখন নিওলিবারেলিজম ও আর্থিক পুঁজিবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। কমিউনিজমে রূপান্তরিত হবার পরিবর্তে এটা এক ধরণের পোস্ট ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও অবস্তুগত উৎপাদন দশায় পরিণত হয়েছে।  

পুঁজিবাদের রূপান্তরিত রূপ হিসেবে, নিওলিবারেলিজম শ্রমিককে উদ্যোক্তায় পরিণত করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আজকে কোনো সাম্যবাদী বিপ্লবই শ্রমজীবী শ্রেণির বিলোপ ঘটাচ্ছে না। আজ প্রত্যেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের প্রতিষ্ঠানের ভেতরে নিজেকে শোষণ করে চলেছে। মানুষ আজ একই সঙ্গে মালিক ও দাস। এমনকি শ্রেণি-সংগ্রামও আজ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।  

‘প্রলেতারিয়েত’-এর উত্তরসূরি হিসেবে আন্তোনিয়ো নেগ্রি যে ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ কে উচ্চ প্রশংসা করেছেন, তা আদতে সমসাময়িক উৎপাদনব্যবস্থাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। বরং, বর্তমান বাস্তবতায় এমন নিঃসঙ্গ এবং বিচ্ছিন্ন উদ্যোক্তার দেখা পাওয়া যাচ্ছে, যিনি নিজেই নিজের সঙ্গে লড়তে লড়তে আত্মশোষণে আচ্ছন্ন। এই প্রেক্ষাপটে, কোন ‘সম্মিলিত জনসমষ্টি’ একদিন পরজীবী এই শাসন কাঠামোকে উৎখাত করে সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে, এমন বিশ্বাস ভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। মার্ক্সীয় বীক্ষার প্রতি নেগ্রির যে আনুগত্য, তাও আরেকটি ভ্রান্ত কল্পনা বলেই প্রমাণিত হবে।

সত্যিটা হলো, নিওলিবারেল রেজিমে কোনো প্রলেতারিয়েত (শ্রমিকশ্রেণি) শ্রেণির আর অস্তিত্বই থাকে না। কারণ,  উৎপাদন যখন অবস্তুগত  হয়ে যায়, তখন প্রত্যেকেই  উৎপাদন মাধ্যমের মালিক হয়ে ওঠে। নিওলিবারেল সিস্টেমে, প্রচলিত অর্থে যে শ্রেণি, তা নাই। এখানে এমন কোন শ্রেণিই নাই যাদের মধ্যে পারস্পরিক বৈরী সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এই দ্বন্দ্বহীন অবস্থাই এই সিস্টেমের স্থিতিশীলতার জন্য দায়ী।  

বর্তমানে, প্রলেতারিয়েত ও বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে কার্যত কোন তফাৎ আর নাই। আক্ষরিক অর্থে ‘প্রলেতারিয়েত’ হলো তারাই যাদের নিজের ‘সম্পদ’ বলতে কেবল সন্তানই আছে। অর্থাৎ জৈবিক পুনরুৎপাদনেই যার মালিকানা সীমিত। কিন্তু আজ এমনই এক বিভ্রম কাজ করছে যে, প্রতিটি মানুষই নিজেকে এক অসীম সম্ভাবনাময়, স্বাধীন, এবং মাত্রাছাড়া সৃষ্টিশীল প্রতিভার একেকটি প্রকল্প হিসেবে কল্পনা করছে। এই বিভ্রমের কারণেই, ‘প্রলেতারিয়েত একনায়কতন্ত্র’, কার্যত কাঠামোগতভাবে অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, পুঁজির একনায়কতন্ত্রের ছড়ি আজ সর্বত্র বিরাজমান। 

নিওলিবারেল রেজিম শোষণের ধারণাই বদলে দিয়েছে- অন্যের দ্বারা শোষণের ব্যবস্থা আজ নিজের দ্বারা নিজেই শোষণে রূপ নিয়েছে। আর শোষণের এই ধরণটি সব শ্রেণিতেই বিদ্যমান। আত্ম-শোষণের এই রূপটি মার্ক্সের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা জিনিস। ফলত মার্ক্স প্রস্তাবিত- জালিম ও মজলুম মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভিত্তিতে যে সমাজ বিপ্লব, তা কার্যত অসম্ভব। 

বরং, আত্মশোষণকারী ‘স্ব-শাসিত’ ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করে, যাদের পক্ষে ‘আমরা’ নামক কোন সম্মিলিত সত্ত্বা হয়ে ওঠার কোন সম্ভাবনাও থাকে না, যারা প্রতিবাদ করবে এবং সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখবে।

অর্জন-ভিত্তিক নিওলিবারেল সমাজে যারা ব্যর্থ হয়, তারা এই ব্যর্থতার জন্য সমাজ অথবা সিস্টেমকে প্রশ্ন করার বদলে নিজের ভাগ্যকে তো দুষতে থাকেই, বরং লজ্জিত বোধও করে। নিওলিবারেল সিস্টেমের চালাকি এখানেই। প্রতিরোধ তাই সুদূরপরাহত। বিপরীত ধারণাটি হলো, যখন অন্যের দ্বারা শোষণমূলক ব্যবস্থা বিরাজ করে, তখন শোষিতরা ‘আমরা’ হয়ে উঠে এবং শোষকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। 

আর মার্ক্সের ‘প্রলেতারিয়েতের একনায়কতন্ত্র’ ধারণাটি তো এই যুক্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই, দমন এবং শোষণের একটা পূর্বধারণা সটান দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজকের আত্মশোষণমূলক নিওলিবারেল শাসন ব্যবস্থায়, মানুষ নিজের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠছে। এই আত্ম-আগ্রাসন শোষিত মানুষকে বিপ্লবের দিকে নয়, বরং বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় । 

আজকের দুনিয়ায় নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে, নিজের জন্য আমরা আর যতই খাটা-খাটনি করিনা কেন, আমরা আসলে খাটুনি দিই পুঁজির জন্য। পুঁজি নিজেই নিজের চাহিদা তৈয়ার করে, কিন্তু ভুলবশত আমরা ধরে নিই, ওই চাহিদাগুলো বোধহয় আমাদেরও। ফলে পুঁজি এমন এক ধরনের অতিলৌকিকতা হাজির করতে পারছে, যা আমাদের আত্মপরিচয়কে এক ভিন্ন ধরনের গড়ন দিচ্ছে। ফলে, আমরা নিজের একান্ত জীবন থেকে নির্বাসিত হয়ে, নিজেদের সমর্পন করছি পুঁজির চাহিদার কাছে। 

ধর্মীয় বিধিবিধানকে অতিক্রম করেই আধুনিক রাজনীতির শর্ত তৈরি হয়। কেবল এই আধুনিক শর্তের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই গোটা সমাজের রাজনীতিকরণ ঘটতে পারে। অর্থাৎ বাইরের চাপিয়ে দেওয়া কোন শর্ত নয়, বরং সমাজের অভ্যন্তরীন যুক্তির ভিত্তিতেই গড়ে উঠবে সিদ্ধান্ত। সমাজ নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেকে নির্মাণ করবে- এটাই আধুনিক ধারণা। কিন্তু পুঁজির এই অতিলৌকিকতা নতুন প্রভু রূপে আবির্ভুত হলে সমাজের এই স্বাধীনতা বিলুপ্ত হয়। তখন রাজনীতি পুঁজির সেবাদাসে পরিণত হয়।  

আমরা কি সত্যিই মুক্ত হতে চাই? ঈশ্বরের ধারণা কি আমরা এইজন্যেই তৈরি করেছি যাতে আমাদের মুক্ত হতে না হয়?  ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই ঋণগ্রস্ত, অপরাধী। আর এই ঋন, এই অপরাধবোধ আমাদের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের রাজনীতিবিদরাও ঋণের কথা বলেই, জনগণকে বোঝাতে চান যে, তাদের হাত-পা কতটা বাঁধা। কিন্তু আমরা যদি ঋনমুক্ত এক জীবন পেতাম, তবে আমরা সত্যিকারের মুক্ত হতাম। আর মুক্ত মানুষ মানেই স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারা। এমন হতে পারে, আমরা হয়তো স্বেচ্ছায় এইসব ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ি যাতে আমাদের মুক্তও হতে না হয়, আবার ঋনের দোহাই দিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়। 

আমাদের ঋণগুলোই স্বাক্ষ্য দিচ্ছে যে আমরা স্বাধীন নই। আর পুঁজি পরিণত হয়েছে এক নতুন খোদায় যে আমাদের অপরাধবোধ আর ঋণের বোঝায় জর্জরিত করে তুলছে। জার্মান দার্শনিক ওয়ালটার বেনিয়ামিনের ভাষায়—পুঁজিবাদ নিজেই একটা ধর্ম। তাঁর ভাষায়, পুঁজিবাদে ভক্তি কিংবা মানত, মানুষকে মুক্তি তো দেয়-ই না, বরং অপরাধবোধ আর ঋণগ্রস্থ করে। পুঁজির ধর্মে অপরাধবোধ থেকে মুক্তির কোনো সুযোগ নাই, উল্টো এক চিরস্থায়ী পরাধীন দশায় মানুষ টিকে থাকে। বেনিয়ামিন বলেন— ‘এইসব ভক্তি সমর্পনের মধ্য দিয়ে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি ঘটে না, বরং এইসব অপরাধবোধ এক সার্বজনীনতা পায়।’ 

নজরদারী স্বৈরাচার

শুরুতে এক অবাধ স্বাধীন মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করা হতো। মাইক্রোসফটের শুরুর স্লোগান ছিল—Where do you want to go today? এই স্লোগান ওয়েব দুনিয়ার অবারিত স্বাধীনতা আর গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

কিন্তু পরে দেখা গেল, এইসবের বাস্তবতা তো নাই-ই উল্টো এইসব এক ধরণের ভ্রান্তিই ছিল। বর্তমানে কথিত সীমাহীন স্বাধীনতা আর মুক্ত যোগাযোগ, পরিণত হচ্ছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রন আর নজরদারিতে। ক্রমেই সামাজিক মাধ্যমগুলো হয়ে উঠছে ডিজিটাল নজরদারি সিস্টেম। যারা সমাজকে  খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শোষণ করছে নির্মমভাবে। পূর্বের পুরনো ঘরানার নজরদারি ব্যবস্থা থেকে সবেমাত্র মুক্ত হয়ে, আমরা স্বেচ্ছায় নিজেদের বিসর্জন দিলাম, আরও দক্ষ আর ভয়াবহ নজরদারির কাছে। জেরেমি বেনথাম প্রস্তাবিত নজরদারি কারাব্যবস্থায় কয়েদিদের একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হতো, যাতে তারা নিজেদের ভেতর কোনরকম যোগাযোগ করতে না পারে।

কিন্তু আজকের যে ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থা, এতে মানুষ স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং নিজেদের মধ্যে সক্রিয় যোগাযোগ রাখে। এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনও স্বেচ্ছায় প্রকাশ করতে থাকে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই নজরদারি ব্যবস্থার অংশীদার তো বটেই, সহযোগীও হয়ে ওঠে। 

ডিজিটাল নজরদারি সমাজ ব্যক্তিস্বাধীনতাকে তার প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কারণ হলো, এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নির্ভরই করে জনসমক্ষে নিজেকে প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ যেন  জর্জ অরওয়েলের সেই ‘বিগ ব্রাদার’, বলা ভালো, ডিজিটাল বিগ ব্রাদার, যে তার হাত-পা গুটিয়ে রেখে বসিয়ে আছে, আর তার সমস্ত কাজ বন্দীরাই করে দিচ্ছে। ফলে তথ্য সংগ্রহ করতে কোনরকম জোরজবরদস্তির প্রয়োজন হচ্ছে না। বরং মানুষ তার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই, ‘বিগ ব্রাদার’ এর হাতে তথ্য তুলে দিচ্ছে। আর এই কারণেই এই নতুন নজরদারির ব্যবস্থা এতো দক্ষ আর কার্যকর। 

তথ্যের স্বাধীনতার নামে এখন স্বচ্ছতা দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে, এটা নিওলিবারেল ব্যবস্থার একটি হাতিয়ার ছাড়া আর কিছু নয়। এই দাবির মানেটা হলো, যা কিছু ব্যক্তিগত, সব জোর করে ফাঁস করে দাও, আর ওইসবের নাম দাও ‘তথ্য’।

বর্তমানে যে অবস্তুগত উৎপাদন ব্যবস্থা জারি আছে, সেখানে তথ্য ও যোগাযোগের যত বার বাড়ন্ত ঘটে, উৎপাদনশীলতার গতি এবং প্রবৃদ্ধিও তত বাড়ে। তাছাড়া আজকের যে সময়, সেখানে তথ্যের একটা ইতিবাচক গুরুত্ব আছে। যেহেতু এইসব তথ্যের ভেতরে কোন সার নেই, সেহেতু এটা যে কোন অবস্থাতেই, স্বাধীনভাবে ছুটে বেড়াতে পারে। ফলে, তথ্যের প্রবাহ কোন নৈতিক কারণ ছাড়াই খেয়াল খুশি মতো বাড়ানো কমানো সম্ভব হয়।

গোপনীয়তা, ভিন্নতা এবং পৃথকীকরণ, এই সমস্ত কিছু যেহেতু অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা তৈয়ার করে, ফলে স্বচ্ছতার নামে এগুলোকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে ফেলা হচ্ছে। যোগাযোগ দ্রুত হয় তখনই, যখন যোগাযোগের পথে অন্তরায় এমন সমস্ত সীমারেখা, প্রাচীর আর ফাঁকফোকর সরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু এর মাধ্যমে মানুষের অন্তরাত্মাকে শুষে নিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কারণ ওই অন্তরাত্মা বা গভীর উপলোব্ধি সম্পন্ন যে ব্যক্তি, সে-ই মূলত অবাধ যোগাযোগের পথে বাঁধা।  তবে এই ছোবড়াকরণ প্রকল্প জোর করে ঘটে না, ঘটে ব্যক্তির কবুলিয়তের মধ্য দিয়েই। 

যা কিছু ভিন্নতর, তার তো নেতিবাচকতাও আছে। কিন্তু নিওলিবারেল ব্যবস্থায় এইসব নেতিবাচকতাকে ‘ইতিবাচক’ চেহারা দিয়ে ভোগযোগ্য আর প্রচারযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়, আর তার নাম দেওয়া হয় ‘বৈচিত্র‍্য’। অন্যদিকে, তথ্যপ্রবাহ ও যোগাযোগের গতি বাড়াতে  ‘স্বচ্ছতার’ যে নির্মান ঘটে, তা ব্যক্তিকে সম্পূর্ণভাবে উদোম করে দেয়। আর এমন উদোম অবস্থাই অবাধ যোগাযোগকে সহজ করে তোলে। অন্যদিকে, একান্ত সংলগ্নতা, পরিমিতিবোধ এবং অন্তর্মুখিতাকে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ঠাউর করা হয়। 

স্বচ্ছতার এই কাঠামো সবকিছুকে সমরূপ করে ফেলে। আর এর অর্থনীতি যেকোন রকমের ভিন্নতাকে দমন করতে চায়।  এক সর্বব্যাপী নেটওয়ার্কিং আর যোগাযোগ এক ধরনের  স্বাত্যন্ত্রহীনতা ঘটায়। এর ফলে সমাজে তৈয়ার হয় এক পারস্পরিক নজরদারি। অন্যদিকে আমাদের কথোপকথনকে কাটছাট করে সমসত্ব রূপ দেওয়ার কাজ করতে থাকে অদৃশ্য মডারেটররা। এই ধরণের প্রাথমিক নজরদারি এমনকি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারির চাইতেও ভয়ানক।  

নিওলিবারেলিজমে নাগরিক এক নিষ্ক্রিয় ভোক্তায় পরিণত হয়। ফলে একজন সচেতন ভোটার হিসেবে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার চাইতে, তার পরিচয় কেবল ভোক্তায় সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তাদের না থাকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, না থাকে সেই সক্ষমতা। ফলে রাজনীতির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন এক অসন্তুষ্ট ভোক্তার মতোই- ঠিকঠাক সেবা না পেলে খালি অভিযোগ করো। রাজনীতিবিদ আর রাজনৈতিক দলগুলোও এই মনোভাবের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। তাদের এখন সেবা ‘ডেলিভারি’ দিতে হয়। তাদের কাজ হলো এইসব ভোক্তাসুলভ ভোটারদের সন্তুষ্ট রাখা।  

বর্তমানে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে স্বচ্ছতা দাবি করা হয় এই জন্য না যে, তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার প্রতি ভোক্তামার্কা নাগরিকদের খুব আগ্রহ। মোটেই তা না। আদতে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আগ্রহ হলো স্বচ্ছতার নামে রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত জীবনের ‘কেলেঙ্কারি’ আর ‘মুখোশ’ উন্মোচন করা। রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার ব্যাপারে এই ভোক্তামার্কা নাগরিকদের আসলে কোন আগ্রহ নাই। 

স্বচ্ছতার এইসব আয়োজনে মনে হয় যেন, এইসব নাগরিক আসলে একদল বোকাচণ্ডী দর্শক। ইনাদের কাজ হলো দেখে যাওয়া। ফলে ‘অংশগ্রহণ’ এর মানে দাঁড়িয়েছে অভিযোগ, নালিশ আর ক্ষোভ ঝাড়া। এইভাবে, দর্শক আর ভোক্তায় ঠাসা এক সমাজের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম নিয়েছে এক দেখনদারি গণতন্ত্রের, যেখানে আছে কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা আর অভিযোগ করা।  

স্বাধীনতার একটি মৌলিক উপাদান হলো তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকার। ১৯৮৪ সালে জার্মানির ফেডারেল সাংবিধানিক আদালত, আদমশুমারি বিষয়ে যে রায় দেয়, তাতে বলা হয়: ‘যদি নাগরিকরা না জানে, কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে তাদের সম্পর্কে তথ্য জানে, তবে তথ্যের ওপর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আইনি শাসনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে পড়ে।’ 

এই রায় এমন এক সময়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকরা মনে করতেন, তারা  রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন এবং তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তথ্য আদায় করে নেওয়া হয়।

সেই দিন গত হয়েছে বহুদিন হলো। আজ আমরা কোনরকম বাধ্যবাধকতা ছাড়াই, নিজের ইচ্ছায়, ইন্টারনেটে নিজেদের সমস্ত তথ্য তুলে দিই। কে, কখন, কোন প্রেক্ষাপটে এসব তথ্য দেখছে বা ব্যবহার করছে তা জানারও চেষ্টা করি না।

লাগামহীন এই তথ্য প্রকাশ আসলে স্বাধীনতার এক গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়, যা নিয়ে আমাদের ভাববার আছে। মানুষ আজকাল তথ্য প্রকাশে এতো বেহুঁশ হয়ে আছে যে গোপনীয়তা রক্ষার ধারণাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। 

আজ আমরা প্রবেশ করছি ‘ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস’ এর জমানায়। এর মানে হলো, আমরা প্রবেশ করছি প্যাসিভ নজরদারি ব্যবস্থা থেকে আরও সক্রিয় নজরদারির ভেতর। ফলে স্বাধীনতার সংকট আরও গভীরতর হয়ে উঠছে কিনা, পাশাপাশি আমাদের ইচ্ছাশক্তি কতটা মুক্ত, এই প্রশ্নটাও উঠছে। 

আজ ‘বিগ ডেটা’ এমন এক কার্যকর সাইকোপলিটিক্যাল অস্ত্র, যার মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগের গতিবিধি জানা এমনকি নিয়ন্ত্রন করাও সম্ভব। এই জানা, নিছক ‘জ্ঞান’ নহে, এটা এমন এক জ্ঞান, যা মনের গহীনে উঁকি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। 

মানুষের স্বাধীনতার জন্য দরকার হয় এক অবারিত ভবিষ্যৎ।  কিন্তু বিগ ডেটা মানুষের আচরণ আগাম অনুমান করতে পারছে। তার মানে মানবজাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠছে নিয়ন্ত্রিত। ডিজিটাল সাইকোপলিটিকস মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নেওয়া সিদ্ধান্তের ‘নেতিবাচকতা’কে, সুনিপুন ছাঁচে ফেলা বাস্তবতায় পালটে দিচ্ছে। ব্যক্তিকে ক্রমশ পরিণত করা হচ্ছে—একটি পরিমাপযোগ্য, হিসাবযোগ্য এক নিয়ন্ত্রিত সত্তায়। ব্যক্তি যেনবা কোন বস্তু। স্বাভাবিকভাবেই, বস্তু কখনোই স্বাধীন হতে পারে না। তবে বস্তু ব্যক্তির চেয়েও অনেক বেশি স্বচ্ছ। এইভাবে বিগ ডেটা ব্যক্তি সত্তার সমাপ্তি ঘোষণা করে।  

যে কোন আধিপত্য কায়েমের কলাকৌশল, কিছু ভক্তিমূলক রিচুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট পয়দা করে। মানুষকে বশ করতে এগুলোর দরকার হয়। এইখানে ‘ভক্তি’ কথাটা আসলে ‘আত্মসমর্পন’ অর্থে। সে বিচারে স্মার্টফোন হলো ডিজিটাল যুগের সেই ‘ভক্তিমূলক বস্তু’। এই জিনিস অনেকটা তসবির মতো-  সব সময় হাতে থাকে, বহনযোগ্য, আর ব্যবহারকারীর চেতনাকে নিরবিচারে নিয়ন্ত্রণ করে। 

স্মার্টফোন ও তসবি, এই দুই জিনিসই আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। সবচেয়ে কার্যকর নজরদারি সেটাই, যেখানে ব্যক্তি নিজেই নিজেকে নজরদারির কাছে সমর্পন করে। আর সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ হলো ডিজিটাল যুগের ‘আমিন’। যখনই আমরা ‘লাইক’ দিই, তখন আমরা নিরবে আধিপত্যের কাছে নিজেদের সমর্পন করি। 

স্মার্টফোন কেবল নজরদারির খাসা একখানা যন্ত্রই না, এটা একটা স্বীকারোক্তি যন্ত্রও বটে। আর ফেসবুক হলো এই ডিজিটাল যুগের মসজিদ, জমানার এক সার্বজনীন উপাসনালয়।