মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারী একজন লোক বিশ বছর আমেরিকার বিমান বাহিনীতে কাজ করার পর এখন একটা টেকনিকাল কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে হাতের কাজ, নির্মাণকার্য এবং পণ্য ও সেবাদানের দুনিয়ার নিকটবর্তী করার ব্যাপারে আমি সহানুভূতিশীল। কিন্তু খোদ শিক্ষাই যেন কোনো ভোগ্যবস্তু না হয়ে পড়ে সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখা দরকার। যখন শিক্ষা হয়ে পড়ে একটা পণ্য, আর শিক্ষার্থীরা পরিণত হয় ভোক্তায়, তখন জন্ম নেয় এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা যা কেবল জম্বি উৎপাদন করতে সক্ষম। শিক্ষাকে খণ্ডিত করে পাওয়ারপয়েন্ট কণিকায় ভেঙে সহজপাচ্য টুকরায় পরিণত করার চর্চার মধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ধরণের জম্বি শিক্ষাব্যবস্থা নির্বোধভাবে আরো পণ্য ভোগের দিকে এগিয়ে দেয়। এই পরিণতি লোভ দ্বারা চালিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, কিন্তু আদর্শভিত্তিক গণতন্ত্রের সাথে কোনোভাবেই না।
বুদ্ধিহীন ভোগ তো এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু এই জম্বিরা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও নির্বোধ হয়ে থাকে। আর এই কারণেই স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো খুব করে চেষ্টা করে ক্ষমতার চূড়ায় ওঠার প্রক্রিয়ায় এদেরকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করতে। এখানে এ্যাডলফ আইখম্যানের ব্যাপারে হানাহ আরেন্টের পর্যালোচনাটা বিবেচনা করা যাক। আইখম্যানের ব্যাপারে তার মূল্যায়ন ছিল যে তার চাকরির দাবি-দাওয়া (ইউরোপ থেকে ইহুদিদের নির্মূলকরণ) তাকে পুরোপুরি দখল করে রেখেছে, অর্থাৎ সে ছিল একজন গতানুগতিক কেরিয়ারবাদী চিন্তার দাস যে নাৎসি দলের আদর্শিক সীমার বাইরে কোনোকিছু ভাবতেই সক্ষম ছিল না।
তবে এর অর্থনৈতিক গুরুত্বের দিকটাতে ফিরে যাওয়া যাক। ওয়াল স্ট্রিট: মানি নেভার স্লিপস (২০১০) সিনেমায় মাইকেল ডাগলাস অভিনীত বিখ্যাত চরিত্র গর্ডোন গেকো সে বছরের স্নাতক শিক্ষার্থীদেরকে নিনজা (নো ইনকাম, নো জবস, নো অ্যাসেটস) বলে অভিহিত করেন। সোজা কথায়, ‘তাদের আকাশ ভরা তারা…’, তিনি বলেন। আর সেটা সত্য বলে ভেবে নেয়া যেতে পারে যদি কলেজ ডিগ্রিকে একটা ভালো টাকা-পয়সাওয়ালা চাকরির পাসপোর্ট হিসেবে দেখেন।
কিন্তু সত্যিকারের শিক্ষা এর চেয়ে অনেক বেশি কিছু। প্রকৃত শিক্ষা আমূল রূপান্তর ঘটায়। একইসাথে আত্মাকে সমৃদ্ধ করে এবং আত্মার সাথে সংযোগ ঘটায়। জীবনযাপনের এমন বহু বিকল্প পথ খুলে দেয় যার শুরু ও শেষ কোনো অফিসঘরের নয়। তা হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি ও পরিপূর্ণতার একটা পরিমাপক যা কেবল বেতন ও টাকা-পয়সার মধ্যে সীমিত না।
আর্থিক উন্নতি ছাড়াও উচ্চশিক্ষা একজন মানুষের জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করবে, কিংবা অন্তত তাই করা উচিত। চরিত্রের উন্নতিসাধন ও রুচির উৎকর্ষও এর সাথে জড়িত। একইসাথে তা আমাদেরকে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক বানিয়ে তুলবে যাদের মধ্যে গণতন্ত্রের প্রতি কদর ও নিষ্ঠা হবে আরো আন্তরিক ও তীব্র।
সেজন্যই উচ্চশিক্ষার জন্য জনগণের পক্ষ থেকে আরো আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে। উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক তহবিল অবশ্যই আগের পর্যায়ে পুনর্গঠন করতে হবে, কেননা শিক্ষিত ও আত্মপ্রত্যয়ী ব্যক্তিরাই সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক মঙ্গল নিশ্চিত করতে পারে।
সোজা কথায়, শিক্ষা কোনো ভোগ্যপণ্য নয়—বরং তা জাতিগত সম্পদ।
কিন্তু শিক্ষার ব্যাপারে আজকের দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই সংকীর্ণ যে একে ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতি ও চাকরির জন্য প্রস্তুতিপর্ব হিসেবেই দেখা হয়। স্টেমের (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত) প্রতি ঝোঁক বাড়ার পিছনে এই প্রবণতা বড় একটা কারণ। কিন্তু এর গভীরেও প্রোথিত রয়েছে কড়া শ্রেণিভিত্তিক পক্ষপাত। শিক্ষার্থীদেরকে বলা হয় যে স্বার্থপর হওয়াই ভালো এবং সমাজে তাদের প্রধান ভূমিকা হলো স্রষ্টা নয়, ভোক্তা হওয়া; স্বপ্নদ্রষ্টা নয়, প্রথানুসারী হওয়া।

স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও এ ধরণের পক্ষপাত লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মদদপুষ্ট শিক্ষকরা ‘প্রতিযোগিতার’ ব্যাপারে গতানুগতিক ফাঁপা মন্তব্য উগড়ে দিতে থাকেন। শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা স্নাতক শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে বলে যে জীবনে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো ইতিবাচক মনোভাব, সময়ানুবর্তিতা আর স্মার্ট জামাকাপড়।
শিক্ষাকে যদি আমরা ভোগ্যবস্তুর এই দুনিয়ার আর দশটা জিনিসের মত একটা পণ্য হিসেবে দেখতে থাকি, তাহলে আমাদের বাচ্চারাও তাই শিখবে। তাদের উপর সারাক্ষণ যত আজেবাজে পণ্যনির্ভর, কর্পোরেট অর্থায়নে প্রচারিত তথ্য চাপিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোর সাথে জোড়াতালি দিয়ে তারা শিক্ষাকে মূল্যায়ন করতে শিখবে। ক্রিটিকাল চিন্তা? নাগরিক শিক্ষা? —এসব ভীষণ একঘেয়ে। এখন একটু চুপ করবে, প্লিজ? আমার এই ফোনটা ধরতে হবে/টুইট করতে হবে/ফেসবুকে নতুন একটা স্ট্যাটাস দিতে হবে।
ইতোমধতেই তারা এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে ঘুরতে ঘুরতে এইসব ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে ফাঁকা দৃষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকে। অর্থাৎ জম্বি পদ অর্জন করার অর্ধেক পথ তারা অতিক্রম করে ফেলেছে। তার উপর এই পণ্যনির্ভর জম্বি শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে তাদেরকে আরো সংক্রামিত না করলেই ভালো।
কী করা যেতে পারে?
ইতিহাস আমাদেরকে পথের দিশা দিতে পারে। প্রখ্যাত যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান-প্রচারক জন টিন্ডালের কথাগুলো খেয়াল করুন। ১৮৬৮ সালে, আজ থেকে ১৪৫ বছর আগে তার ‘শিক্ষার্থীদের প্রতি ভাষণে’ টিন্ডাল ব্যক্ত করেন: ‘ছাত্রদের শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো, কিংবা অন্তত হওয়া উচিত তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বুদ্ধিদীপ্ত চর্চার সুযোগ করে দেয়া, তাদের প্রবৃত্তিকে প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশনা দেয়া, আর এই চর্চা ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তাদের মনোজগতকে জ্ঞান এমনভাবে সজ্জিত করা যাতে সে নিজের জীবন উপযোগিতা, সৌন্দর্য ও সততার সাথে যাপন করতে পারে।’
অবশ্যই, সে সময় এ ধরণের শিক্ষার সুযোগ কেবল যুবক ছেলেদের জন্যই সীমিত ছিল। আজকে আমরা ‘ছাত্র’দের পাশাপাশি ‘ছাত্রী’দেরকেও এই আওতায় সংযুক্ত করতে পেরে নিজেদের পিঠ চাপড়াই— বর্ণভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক ও নৃজাতিভিত্তিক এ ধরণের শব্দের পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈচিত্র্যের প্রচারণার আরেকটি ধাপ বলে গণ্য করি।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার বৈচিত্র্যের কী হবে? যে শিক্ষাব্যবস্থা কেবল পরিচয়বাদী রাজনীতি ও আন্তরিকতা-বিবর্জিত উপযোগিতা বাদেও জীবনের সৌন্দর্য ও সততার আদর্শের উপর জোর দেবে। নিজস্ব বিচারবুদ্ধি লালন করার ক্ষমতা, পূর্বনির্ধারিত মতাদর্শভিত্তিক বাইনারি চিন্তাপদ্ধতিকে অতিক্রম করে নিজস্ব চিন্তা গড়ে তোলার ক্ষমতা যা বিভিন্ন ঘটনা, পরিস্থিতি ও দ্বিধার ব্যাপারে নিজের মতামত প্রকাশ করতে দেবে, তা কোথায়?
কিন্তু জম্বিরা তো সৌন্দর্য বা সততার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র বিচলিত না। তারা কোনো ক্ষেত্রেই বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করতে আগ্রহী না, বিশেষ করে নৈতিক ক্ষেত্রে। তারা শুধু চায় ভোগ করতে। তাদের ভোগরুচিই তাদের একমাত্র পরিচয়। তারা ফাঁপা মানুষ, সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় — এবং সহজেই ভুল পথে চালিত করা যায়।
যতদিন পর্যন্ত আমরা শিক্ষাকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে হাটে তুলব, ততদিন এই জম্বিদের আগমন ঘটতেই থাকবে। এমনকি তারা নিজেদের পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থাও করে নিতে পারবে। কিন্তু স্নাতক শেষ করার পর তারা জম্বি থেকে ফের মানুষ হয়ে যাবে সে প্রত্যাশা রাখবেন না। তাদের কাছ থেকে আশা করবেন না যে হুট করে তারা এমন সৎ নাগরিক হয়ে উঠবে যে প্রকৃত গণতন্ত্রের সৌন্দর্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হবে, বা সেই সৌন্দর্য রক্ষা করতে আওয়াজ তুলবে।