ঝাল কি আসলেই গরিবের খাবার? 

WhatsApp Image 2024-03-04 at 3.12.56 PM
সৈয়দ খালেদ সাইফুল্লাহ
খাদ্যোৎসাহী
অলঙ্করণ: রিসাদ

ওই ঝাল ঝাল খাবার? ওটা তো রজিলদের খাদ্য!  

মুঘল অন্দরমহলে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সম্রাট আজ তশরিফ রেখেছেন, কী সৌভাগ্য! সাধারণত সম্রাট যখন এমন ঘোষণা দিয়ে আসেন, বুঝে নিতে হবে বিবির কাছে বসে ওনার পরিপাটি আহার সারার ইচ্ছে হয়েছে। এমন না যে অন্য কোথাও সম্রাটের খাওয়ার জায়গা নেই। একঘণ্টার নোটিশে দুইশ লোকের ব্যাপক ভোজনের ব্যবস্থা মুঘল হেঁশেলে সবসময় রাখা হতো। সেটা চেক, ডবল চেক হয়ে নানা নিরাপত্তায় সম্রাটের সামনে এসে পৌঁছুতো। কিন্তু অন্দরমহলের যখন ব্যাপার, এখানে বিবির হাতের রান্নার, বা বিবির পছন্দের খাবারের একটা ব্যাপার-স্যাপার থাকতে হবে। 

শুরু হয়েছে খাবার। দেওয়ালের খাঁজে খাঁজে লুকানো মোমবাতির আলো তৈরী করেছে একটা রোমান্টিক আবহ।  বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে আগরবাতির সুবাস। শত পদের খাবার সামনে, সম্রাট কোনোটা চাখছেন, কোনোটা দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, কোনোটা আবার রানির পীড়াপিড়িতে বেশ কয়েকগাল খাচ্ছেন। হুট করে একটা খাবার খেতে গিয়ে থমকে গেলেন তিনি। ঘি-মালাই-বাদামের সমারোহে যে মুঘল খানা-খাদ্য, এটার ঘ্রাণটা যেন ভিন্নরকম! কী এটা? সম্রাটের চোখে প্রশ্ন।

জাঁহাপনা, আপনার হিন্দুস্তানি দরবারীরা খুব আগ্রহ করে খায় এটা। ঝাল নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি এটার মাঝে ওদের মতো মরিচ দেইনি। মরিচ ফেঁড়ে বীজগুলো ফেলে দিয়ে সবুজ শাঁসটা গাভীর দুধে ভিজিয়ে রেখেছিলাম। তারপর সেই শাঁস ফেলে দিয়ে দুধটুকু দিয়েছি মাংসে। খেয়ে দেখুন, আপনার ভালো লাগবে।

সম্রাট আস্তে করে বললেন, ও… ওই গরীবদের খাদ্য? 

তিনি তো আমাদের মতো বাংলায় বলেননি, ফারসিতে বলেছিলেন, রজিলদের খাদ্য?  

তারপর পাতে নিলেন, ঝালে একটু হু-হা করলেন, বললেন স্বাদটা খারাপ না!

 ওই যে ‘রজিলদের খাদ্য’ বললেন, খাবারের নামটা পরিচিতি পেয়ে গেল এই নামেই। বলুন তো এই খাবারের এখনকার ভার্সনকে আমরা কী বলে ডাকি? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, রেজালা!

গল্পটা মশলা মাখানো, তবে মূল ঘটনা সত্য। মুঘল সম্রাট সত্যিই ‘রজিলদের খাদ্য’ বলে ডেকেছিলেন দাবী খাদ্য গবেষকদের।

এখন প্রশ্ন হলো, ‘রজিল’ বা দরিদ্র মানুষের খাবারকে সম্রাটের মতো উন্নাসিক মানুষের পাতে উঠতে কী করতে হয়েছে? এককথায় উত্তর—ঝালটা ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে।

তাহলে দুর্মুখেরা যে বলে, গরিবমানুষ ঝাল বেশি খায়—সত্যি নাকি ব্যাপারটা? কী অন্যায় ব্যাপার বলেন তো! একটা মানুষ স্রেফ ঝাল বেশি খায় দেখে তাকে একটা ভাগে ফেলে দেবেন? বা তার পূর্বপুরুষ কেমন ছিল হিসাব করে ফেলবেন? বৈষম্যহীন ব্যবস্থা নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, তখন স্বাদের ভিত্তিতে এ কেমন বিভাজন? সুকুমার রায় বেঁচে থাকলে এর প্রতিবাদে হয়তো ছড়াও লিখে ফেলতেন—

ঝালের আমি, ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা।

এমনটি বলবে না!

আবার, এত এত মানুষ ‘গরিবমানুষ ঝাল খায় বেশি’ কথাটা বলেছে, ঠিক উড়িয়ে দিতে মন চাইলেও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ফেলুদার মতো আমাদেরও তাই বলতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কালটিভেট করতে হচ্ছে মশাই!  

সেই ‘কালটিভেট’ করতে আমাদের প্রয়োজন ঝালের সাগরে ডুব দেওয়া। আর সেজন্য প্রথমে দরকার, ঝালের ইতিহাস-পাতিহাসটা হালকা করে ঘুরে আসা। ওটা না জানলে ঝালের পোস্টমর্টেম আর করা যাবে কীভাবে? পাঠক, ঝালের ভুবনে আপনাকে স্বাগতম।

ঝাল মশলার রাজনীতি

দেশীয় যেকোনো খাবারেই আমরা মনের মাধুরী মিশিয়ে কাঁচামরিচ ঠাসি। আলুভর্তায় দেই, পান্তাভাতে দেই, মাছ-মাংসের ঝোলে তো দেই-ই। অন্যদিকে, যেসব বিদেশি খাবার আমরা মোটামুটি চিনি, সেগুলোয় কাঁচামরিচটা পারতপক্ষে এড়িয়ে যাই। পাস্তায় কাঁচামরিচ? বার্গারে কাঁচামরিচ? হাহা, মানুষ শুনলে হাসবে তো! ওইসব জায়গায় ব্ল্যাক পিপার ব্যবহার করাই রীতি। এইসব দেখে একটা ধারণা জন্মানো স্বাভাবিক, কাঁচামরিচ হচ্ছে আমাদের দিশি খাদ্য। জন্ম-জন্মান্তরের ভাই। অন্যদিকে গোলমরিচ বা ব্ল্যাক পিপার হচ্ছে বিদেশি সৎ ভাই। অথচ, পুরো ব্যাপারটাই উল্টো!

১৫২০ বা ৩০ অথবা তার কাছাকাছি সময়ে এই উপমহাদেশে কাঁচামরিচের আগমন। তার আগে আমাদের ঝাল ছিল আদা, লবঙ্গ, দারচিনি, চুইঝাল, গোলমরিচ, বনের মাঝে জন্মানো পিপ্পলি। এই গোলমরিচ নিয়ে আরবরা বাণিজ্যও করত জলপথে। বাণিজ্য বলতে, তারা নিয়ে বিক্রি করত মিশরে। সেই মিশর রোমানদের অধীনে থাকায় মশলা সেখান থেকে চলে যেত ইউরোপে। সারা ইউরোপ তখন খাচ্ছে এই অঞ্চলের ব্ল্যাক পেপার। ইয়োর কান্ট্রি, আওয়ার পিপার স্যার। উই আর ভেরি প্রাউড স্যার!

ঘটনা এরপর ঘটিয়ে ফেলল মুসলমানরা। তারা মিশরের দখল নিয়ে ফেলে ইউরোপের সাথে কানেকশন দিল ঘ্যাচাং করে। এবার ইউরোপ কী করে? খাবারে একটু ঝাল না হলে হবে কী করে? লাগাও অভিযান, আরবদের ওপর ভরসা না করে নিজেদেরই ভারতবর্ষে আসার পথ বের করতে হবে।

এইভাবেই স্পেনের ক্রিস্টোফার কলম্বাস সাহেব ভারতবর্ষ আবিষ্কার করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেললেন আমেরিকা মহাদেশ! কী অসাধারণ ভুল! সুকুমার রায়ও সম্ভবত তার ননসেন্স রাইমে এমন ‘আবোল-তাবোল’ লিখতে পারতেন না। যাই হোক, কলম্বাস সেখানে মরিচও পান, আর সেটা ইউরোপে নিয়ে আসার পাশাপাশি ইউরোপীয় বণিকদের জন্যও খুলে দেন এক নতুন দুয়ার, ঝাল ব্যবসার দুয়ার।

ওই যে শুরুতে বললাম, ১৫২০-১৫৩০, এরমাঝে কোনো একটা সময়েই পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের জাহাজে ভারতের গোয়া দিয়ে ঝাল ভরা হয়। মানে, গোয়া বন্দরে ঝালের জাহাজ ভেড়ানো হয়। সেই যে উপমহাদেশবাসীর মরিচপ্রেম শুরু, দিনে দিনে তা কেবল বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। আর যে ইউরোপের হাত ধরে এ অঞ্চলে মরিচ আসলো, সেই ইউরোপের লোকজন মরিচ খাওয়ায় রয়ে গেল আমাদের কাছে শিশু। 

ইতিহাস-পাতিহাস ঘোরা হলো, এবার ইতিহাস থেকে একটা জোক শোনা যাক। 

উপমহাদেশীয় নেটিভের বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত ছিল এক বৃটিশ কর্মকর্তার। বুঝতেই পারছেন, বৃটিশ আমলের জোক। খেলেন-দেলেন, বাড়ি ফিরলেন ভদ্রলোক। সকালে স্ত্রীকে বললেন, এখন আমি জানি, এখানকার নেটিভরা কেন খাওয়ার পর পানি ব্যবহার করে।

স্ত্রী প্রশ্ন করলেন—কেন?  

কারণ আমাদের মতো ওরা টিস্যু পেপার ব্যবহার করলে আগুন ধরে যেত!

কিন্তু আমরা, মানে উপমহাদেশের মানুষরা, কেন মরিচ বেশি খায়?

তার আগে প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ কেন মরিচ খায়। 

বিজ্ঞানীরা এক অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করেছেন—ঝাল কোনো স্বাদ না। ঝাল একটা অনুভূতির নাম! ভাবছেন পপুলার একটা ইমোশনাল বাক্য ঝেড়ে দিলাম? না স্যার, ঝালের অনুভূতি তৈরি হয় একধরনের জ্বালাপোড়া ও উষ্ণতা থেকে। আমাদের জিভে প্রায় ১০ হাজার স্বাদগ্রন্থি আর ধারক কোষ থাকে, যা আমাদের পাঁচ ধরনের স্বাদ বুঝতে সাহায্য করে। এই পাঁচ ধরনে ঝালের অস্তিত্ব নেই! কী আছে সেটাও বলে দিচ্ছি, টক, মিষ্টি, তিতা, নোনতা আর উমামি। জিভের ডগা বা অগ্রভাগে মিষ্টি এবং পেছনের দিকটায় তিক্ত বা তেতো স্বাদগ্রাহক থাকে, অগ্রভাগের কিছু পরে এবং মাঝখানে লবণাক্ত বা নোনতা, দুইপাশে টক ও উমামি স্বাদ গ্রহণের জন্য একটা করে অংশ থাকে। কারও যদি উমামির স্বাদ কেমন জানতে ইচ্ছা করে, পনির খান; কিংবা সয়া সস খান। ওটার মাঝে উমামির স্বাদ আছে!

তাহলে এই জ্বালাপোড়া পাওয়ার জন্য মানুষ ঝাল কেন খায়?

এই বিষয়ে একটা গবেষণা আছে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার মনোরোগবিদ পল রোজিনের। তিনি খেয়াল করেন, বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খায় না, মানুষ বাদে। প্রচুর মানুষকে গবেষণার অংশ হিসেবে ঝাল খাইয়ে খাইয়ে তিনি যে পরীক্ষাটা করেছেন, তাতে ঝাল খাওয়ার বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছেন ভূতের সিনেমা দেখে মানুষ ভয় পেলেও ভৌতিক সিনেমার প্রতি আসক্তির সাথে। রোজিনের কথা, মানুষ হচ্ছে একমাত্র প্রাণী যারা অতি নেতিবাচক বিষয়কেও উপভোগ করতে পারে।

ঝাল আসলে মরিচ গাছের আত্মরক্ষার একটা কৌশল। বিভিন্ন মরিচের মধ্যে ক্যাপসাইসিন নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এই জিনিস মরিচ ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদে পাওয়া যায় না। এখন তার তো বংশবৃদ্ধি করা দরকার। এইদিকে স্তন্যপায়ী প্রাণী মরিচ খেলে বীজসুদ্ধো হজম করে ফেলে। তাহলে স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মরিচ খাইয়ে মরিচ গাছের কী লাভ? কাজেই বাড়াও ক্যাপসাইসিন। স্তন্যপায়ী ঠেকাও। সেইসাথে পোকামাকড় ঠেকাও। 

আরেকদিকে, পাখিরা বেশিরভাগই মরিচ খেলে বীজ হজম করে ফেলে না। তারা মরিচ খেলে লাভ। তাই, পাখির টেস্টবাডে মরিচের ঝাল কোনো জ্বালাও-পোড়াও করে না। প্রকৃতির কী অদ্ভুত খেলা! 

টিয়াপাখিকে দেখবেন কপকপিয়ে মরিচ খায়। তার বিষ্ঠার সাথে মনের আনন্দে চলে মরিচ গাছের বংশবৃদ্ধি। এমন প্রাণীকে খাইয়েই তো লাভ!

মানুষ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা ঝালে এমনই আসক্ত, মরিচ গাছ বছর বছর ঝাল বাড়িয়েও এদের থামাতে পারছে না। একটু পরিসংখ্যান শোনাই, বিবিসির দেওয়া তথ্য। এই তথ্য অনুযায়ী ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বিশ্বের মরিচের উৎপাদন ২৭ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৭ মিলিয়ন টন। নতুন প্রজন্ম মনে হয় আরও বেশি বেশি ঝাল খাচ্ছে! 

ঝাল সহযোগে খাওয়ার প্রতীকী ছবি। একেছেন সামিউল

এইবার আসা যাক ভারতীয় উপমহাদেশের লোকজন কেন ঝাল বেশি খায় প্রসঙ্গে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা তিনটা কারণ বলেছেন। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে না, তুলনামূলক উষ্ণ জলবায়ুর দেশগুলোর মানুষের ঝাল খাওয়ার একইরকম কারণ। এর মাঝে তুরষ্ক আছে, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া আছে, মেক্সিকো, আফ্রিকান দেশগুলোও আছে। 

প্রথম কারণ, গরম দেশে খাবার-দাবার ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে তাড়াতাড়ি পঁচে যায়। কী ছোটোলোক জীব, মানুষ যা খায়, তার সেখানে ভাগ বসাতে হবেই! শীতপ্রধান দেশে তো এইসব ফ্যাসিজম চলবে না! ঠান্ডা আবহাওয়াই ব্যাকটেরিয়াকে সাইজ করে দেবে। গরম দেশে ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে মশলাই ভরসা। অন্যান্য মশলার পাশাপাশি ক্যাপসাইসিন ব্যাকটেরিয়া ঠেকাতে ভালো ভূমিকা রাখে। কাজেই, ঠাসো ঝাল! খাবার ফিট তো রাঁধুনি হিট!

দ্বিতীয় কারণ, ক্যাপসাইসিন শুধু জিভেই জ্বালাপোড়া শুরু করে না, ভালোরকম ঝাল খেলে দেখবেন কপালে চিকন ঘাম দেওয়া শুরু করেছে। আরেকটু খেলে সারা শরীরে ঘাম। এই যে স্বেদগ্রন্থি ঘাম ছেড়ে দিচ্ছে, শরীরের উত্তাপও কিন্তু তাতে যাচ্ছে কমে। গরমের মাঝেও আপনি পাবেন ফুরফুরে এক অনুভূতি। এজন্য হলেও ঝাল খাবেন। ঘামেই শান্তি!

তৃতীয় কারণ, এইরকম গরম আবহাওয়ায় মরিচ ভালো জন্মায়। ব্যস, এই একটা কারণই তো যথেষ্ট মরিচ খাওয়ার জন্য। ফলন বেশি, দাম কম—মানুষের খেতে কী আর লাগে? বাসায় তরকারি নাই? লাগাও মরিচ দিয়ে কোনো ভর্তা। তরকারি পছন্দ না? লাগাও পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে ডিমভাজা।

এই পর্যন্ত কারণগুলো শুনে কী মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে না যে গরম দেশ হওয়ায় মানুষজন ঝাল বেশি খায়—এর সাথে গরিবহওয়ার সম্পর্ক কী? তাহলে বাকী কারণগুলো শুনুন।

চতুর্থ কারণ, স্তন্যপায়ী প্রাণী, কয়েকটা পাখি আর পোকামাকড়ের জন্য ক্যাপসাইসিন যে বিষ হিসেবে কাজ করে, মানুষ এটাকে ভালোভাবে কাজে লাগায়। বেশি করে মরিচ খেলে ঘামের সাথে ক্যাপসাইসিনের যে ঘ্রাণ বের হয়, পোকামাকড় তাতেই কাত! এইভাবে আফ্রিকায় মানুষ সেৎসি মাছি ঠেকায়, এদিককার মানুষ ম্যালেরিয়া ঠেকায়।  এবার বলুন আপনি, মশা-মাছি কাদের এলাকায় দেখা যায়? ইউরোপে? আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া জাপানে? নাকি আফ্রিকা, ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট, কড়াইলের বস্তিতে? তাহলে ঝালটা কারা খাবে? বড়লোকরা?

পঞ্চম কারণ, রাস্তায় বসে এক লোকের খাওয়া দেখছিলাম। খুব যত্ন করে একটা সেদ্ধ আলু ছিলল। তাতে গুচ্ছের মরিচ আর লবণ মেশালো। তারপর সামনে পলিথিনের ওপর রাখা পাহাড়সম ভাতে একটু একটু করে মাখিয়ে গবগব করে গিলে ফেলল। এটা আর কিছু না, দরিদ্র হওয়ার খুব নিষ্ঠুর অর্থনীতি। আপনাকে খুব উত্তেজক আর সস্তা খাবার দিয়ে অনেকখানি ভাত খেয়ে পেট ভরিয়ে ফেলতে হবে। হ্যাঁ, নুন দিয়েও সম্ভব। কিন্তু ঝালের যে মজা, নুনে তো ওটা পাবেন না! ডোমিনিক ল্যাপিয়ের তার কলকাতাকে নিয়ে লেখা সিটি অব জয়তে ক্ষুধার সাথে ঝালের একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যদি কেউ খুব ঝাল খাবার খায়, একটু খেলেই মস্তিষ্ক সিগন্যাল দেবে পেট ভরে গেছে! যদিও তাতে না ভরেছে পেট, না পূরণ হয়েছে পুষ্টি!

গরিবমানুষের মস্তিষ্কও সম্ভবত খুব দ্রুত অর্থনীতি বুঝে যায়!

ষষ্ঠ কারণ, জিভে লেগেছে ঝাল। শুরু হয়েছে জ্বালা-পোড়া। সিগন্যাল চলে গেছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কও তো বসে থাকার বান্দা না! সে সাথে সাথে ছাড়া শুরু করল এন্ডরফিন নামে একধরনের রাসায়নিক। এটা একধরনের নিউরোকেমিক্যাল, বাংলায় বলা যেতে পারে স্নায়বিক রাসায়নিক। এই এন্ডরফিন ব্যথা কমিয়ে দেবে আপনার। কিন্তু এই মস্তিষ্কের কাজ কি শুধু ব্যথা কমানো? এই যে ‘ব্যথা’ পেয়ে আপনার মন যে বিষণ্ণ হলো, সেটা ঠিক করবে কে? ইউসুফ সরকার? উঁহু, কাজটা মস্তিষ্কই করবে। শরীরে এন্ডরফিন নিঃসরণের পাশাপাশি মস্তিষ্ক ডোপামিন নামে আরেক ধরনের রাসায়নিক নিঃসরণ করে। যার কারণে আমাদের মধ্যে ভালো লাগা, খুশি থাকা, সুখের অনুভূতি তৈরি হয়।

এইবার, আপনার কাছে জিজ্ঞাসা। মন ভালো করতে আপনি কী করেন? শপিং করেন? ভালো ভালো খাবার খান? দেশে-বিদেশে ঘুরতে যান? এগুলো কিছু করেন না? কী বললেন? ঝাল খান?

অভিনন্দন, আপনি গরীবস। পকেটে পয়সা থাকলে কেউ এত সস্তায় সুখী হওয়ার চেষ্টা করে না।

সপ্তম কারণ, বিখ্যাত আমেরিকান শেফ কাম লেখক অ্যান্থনি বোর্ডেইন প্রায় প্রায়ই বলতেন, গরিবদেশগুলোর খাবারই সবচেয়ে মজা, কারণ মজা না করে তাদের উপায় নাই! যদি গরুর সবচেয়ে ভালো জায়গার অংশটা বা টাটকা অ্যাসপ্যারাগাস প্রতিদিন খাওয়ার মতো অর্থ আপনার হাতে থাকে, তাহলে আপনার খুব ক্রিয়েটিভ হওয়ার দরকার নাই। কিন্তু কসাইয়ের দোকানের মাথার মাংস, ভূঁড়ি, লেজ, জিহবাই যদি আপনাকে বাধ্য হয়ে খেতে হয়, কোনো না কোনো ক্রিয়েটিভ উপায়ে এই রান্না মজা না করে আপনার উপায় নাই। আর ঝাল, মশলা এই ক্রিয়েটিভিটির অন্যতম অস্ত্র।

কী বুঝলেন? অ্যান্থনি বোর্ডেইন তার অভিজ্ঞতায় তার পরিচিত খাবারের কথা বলেছেন। কিন্তু চিন্তা করেন তো নিজের টেবিলের কথা? একদিন দুইদিন পান্তা খেতে ভালোই লাগে। অর্থের কারণে প্রতিদিন যদি এটাই খেতে হয়? কয়দিন পারবেন মশলার, ঝালের  সাহায্য নেওয়া ছাড়া?

নজরুল চাইলে লিখতেও পারতেন— 

হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান

তুমি মোরে খাইয়েছ ঝালের বিরান।

তাহলে? গরীবদের বেশি ঝাল খাওয়া কি প্রমাণিত?

২০১৮ সালে চাও মা, জে সং ও আরও কয়েকজন মিলে একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তাতে দেখা যায়, চায়নার মাঝে সিচুয়ান অঞ্চলের খাবার সবচেয়ে ঝাল। আর সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়! অন্যান্য প্রদেশের ক্ষেত্রে আস্তে আস্তে ঝালের মাত্রা যত কমতে থাকে, সেই প্রদেশের অর্থনীতির অবস্থাও ততো চাঙ্গা! শেষমেষ মনে হচ্ছিলো, চায়নার কোনো প্রদেশ চমচম খাওয়া শুরু করলে ওদের উন্নতি কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না!

কিন্তু খুব বড় পরিসরে এমন আর গবেষণা খুঁজে পাওয়া গেল না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে টুকটাক গবেষণা কিছু দেখা যায়, ফলাফল ওই আগেরটাই। 

সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু হুট করে যদি পিছিয়ে যাই সাড়ে তিনশ বছর? সম্রাট আওরংজেবের আমলে? নিখিল ভারতবর্ষ তখনও ঝাল খেত, ভালোভাবেই খেত। তারা কি গরিবতখন? সেই সময়ে পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ কর যারা দেয়, তাদের গরিববলবেন কীভাবে? সেই সময়ের ঝাল-খেকো হিন্দুস্তানীদের ক্ষেত্রে এই ‘গরিব মানেই ঝাল’ তত্ত্ব খাটবে কীভাবে? বা ইউরোপের যখন মধ্যযুগ, খুব কি ঝাল-মশলা খেত তারা? তখনই বা ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপীয়দের’ জন্য এই তত্ত্ব কোথায় যায়?

সম্ভবত ঝাল-তত্ত্ব সময়ের সাথে সাথে চলমান একটা সাইন কার্ভের মতো। সময় কখনও বলবে ঝাল খায় গরীবরা। কখনও বলবে ঝাল খায় ধনীরা, ট্যালট্যালে স্যুপ, নুন ছেটানো মাছ হচ্ছে গরীবদের জন্য। কে জানে?   

তবে, আমার এত কঠিন তত্ত্ব টানার কী দরকার? এখনকার জ্ঞানীগুণীরা যখন বলছেন, হয়তো কিছু চিন্তা করেই বলছেন। ভবিষ্যতে নতুন কোনো তত্ত্ব, কোনো গবেষণার ফলাফল হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত মেনে নেওয়াই ভালো যে গরীবরা ঝাল বেশি খায়।

সেক্ষেত্রে সুকুমার রায় হয়তো তার কবিতাটা আবার সংশোধন করে লিখতেন—

ঝালের আমি ঝালের তুমি

ঝাল দিয়ে যায় চেনা

চৌধুরী বংশের মেয়ের সাথে

তুই ব্যাটা মিশবি না।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

ম্যাচ শেষে আফগানিস্তান কোচ জনাথন ট্রট বলেন তার এই ব্যাপারে কোন ধারণাই নেই, ‘আমার কোন ধারণা নেই। কখনো কি দুটি সুপার ওভার হয়েছে? আমি এটাই বলার চেষ্টা করেছি। এটা একদমই নতুন ব্যাপার। নিয়মগুলো আমরা প্রতিনিয়ত পরীক্ষা করছি, জানছি।’

সিমু নাসের

সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক

'টুয়েলফথ ফেল'কে কেন্দ্র করে মানুষের প্রতিক্রিয়া নিয়েই এই লেখা। ভারত ও বাংলাদেশে 'টুয়েলফথ ফেল' সিনেমাটির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো এর প্রেমকাহিনী।

খাওয়ার বদলে ‘বাইরে খাওয়া’—বাঙালি মধ্যবিত্তের নতুন বন্দোবস্ত?

নব্বই দশকের এক্কেবারে শুরুর দিক। হুট করে বাড়িতে ফুপা এসেছেন। যেমন-তেমন আসা না। বিদেশ থেকে এসেছেন, ঢাকায় একবেলা বিশ্রাম নিয়ে তারপর আস্তে-ধীরে বাড়িতে যাবেন। যেহেতু হুট করে আসা, বাসায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ‘অগত্যা’ আনানো হলো নান্নার মোরগ-পোলাও। জামাই-মানুষ, তারপরও রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার আনানো হচ্ছে, বাসার মানুষদের মনে হচ্ছে খুবই কুণ্ঠিত। আমাদের ছোটোদের তাতে কী আসে যায়! বাসার মাঝে ‘হোটেলের খাবার’, নতুন ব্যাপার-স্যাপার! বহুদিন মুখে লেগে ছিল সেই মোরগ পোলাওয়ের স্বাদ।  

একই বাসা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে বাসার ‘মুরুব্বির আসন’। আবার এসেছে জামাই, সেটা আমার বোন-জামাই। সিদ্ধান্ত হলো, প্রায় প্রায়ই যেহেতু এখানে-সেখানে এটা-সেটা খাওয়ানো হয়, জামাইয়ের সম্মানে এবার ঘরে রান্না করা হবে। হলো রান্না। একেবারে আয়োজন করা রান্না—এখনকার সময়ে অনেকটা বিরল অভিজ্ঞতা! এই খাবারের স্বাদও মুখে লেগে রইল অনেকদিন।  

ওপরের উদাহরণটা নিছকই উদাহরণ, নিজের জীবন থেকে নেওয়া একটা উদাহরণ আরকি। কিন্তু এদেশের অন্তত শহরাঞ্চলে তাকালে দেখা যায়, এটা মোটেও আমার একার উদাহরণ না। গত কয়েক দশকে ঢাকার মধ্যবিত্ত সমাজের ‘বাইরে খাওয়া’ বিষয়টা ‘একেবারে না-পারতে’ বা ‘ঠ্যাকায় পড়ে খাওয়া’ থেকে হয়ে উঠেছে প্রাত্যাহিক বাস্তবতা। এটা এখন এমনই এক বাস্তব সত্য, যেটাকে যুক্তি-তর্ক দিয়ে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করার কিছু নেই। তারপরও বলি। বাংলাদেশের কুইক সার্ভিস রেস্তোরাঁ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে এই বাজারে আয় হয়েছে প্রায় ১৭৫৪ মিলিয়ন ডলার। ২০২৮ সালেই যা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬৫৩ মিলিয়ন ডলারে। বুঝতে পারছেন ব্যাপার? ফুলেফেঁপে কলাগাছ পার হয়ে বটগাছ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো দ্রুত পরিবর্তিত কর্মজীবন, বাড়ন্ত মধ্যবিত্ত আর খাবারের অনলাইন ডেলিভারি।

কিন্তু কেন বলছে বিশেষজ্ঞরা এমন? আসলেই কি যুক্তি-পাল্টা যুক্তি দিয়ে ধরা যায় একে?
চলুন চেষ্টা করি। 

যুক্তি ১: সময় কখনও ‘নানের’ জন্য অপেক্ষা করে না 

আজকের শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে মহামূল্য এক সম্পদ, তার নাম সময়। বিশেষ করে যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি, সেখানে বাসায় ফিরে রান্না-বান্না করার সময়ই কই; সেইসাথে মানসিক শক্তি আর আগ্রহই বা কই। আগে যেখানে স্কুল বা অফিস আর বিকালে টিভি দেখে, আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় টিভি দেখা ছিলো চক্রের মতো চলমান; এখনকার জীবনে কী যে হয়ে যাচ্ছে সেই তাল মেলানোই কঠিন! দ্রুতগামী, ব্যস্ত ও অনেকখানি বিশৃঙ্খল। 

কর্মব্যস্ত পরিবারে যদি বলা হয় ছুটির দিনটা বাইরেই খাওয়া যাক—এরচেয়ে খুশীর কথা আর নেই। অফিস শেষে জ্যাম ঠেলে বাড়ি এসে আবার বাজার করা, রান্না করা—এসবের বদলে ১৫ মিনিটে রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসে পড়া কী যে স্বস্তির! অনেকে আবার থাকেন ব্যাচেলর। একা বাসায় নিজের জন্য রান্না আর কতক্ষণ ভাল্লাগে—অন্তত বিকল্প যখন হাতের কাছেই আছে? তাই রেস্টুরেন্ট হয়ে উঠছে এক বিকল্প সংসার। সেই রেস্টুরেন্টের জানালার ছবি তুলেই মানুষ স্টোরিতে মিউজিক বসায়—আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়।  

পাল্টা যুক্তি ১: ফুড ডেলিভারি অ্যাপেও তো সময় বাঁচে। তাহলে মানুষ রেস্টুরেন্টে যায় কেন? 

ভালো যুক্তি। ফুড ডেলিভারি অ্যাপ আছে। অ্যাপের ব্যবহারও আছে। বিশেষ করে ব্যস্ত অফিসের ফাঁকে টুক করে পছন্দের খাবারটা খেয়ে নিতে, কিংবা রেস্টুরেন্টে যাবার আলস্যি বা অসুবিধা থেকে বাঁচতে ঘরে বসেই অর্ডার করেন অনেকে। আছে বিভিন্ন হোম কিচেন, সোশ্যাল মিডিয়া পেইজ। মানুষ সেখান থেকেও অর্ডার করছে। বিশেষ করে কোভিডের লকডাউনে এইসবই মানুষকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ দিয়েছিল ভালোভাবে। 

এই পাল্টা যুক্তির উত্তরও আবার আছে। খাওয়ার ব্যাপারটা এই সময়ে এসে আপনি শুধু উদরপূর্তি দিয়ে দেখলেই তো হবে না! রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াটা একধরনের সামাজিকতা, মুড পরিবর্তন, সময় কাটানো। অনেক সময় ফ্লেক্স নেওয়াও। এই আউটিঙের স্বাদ ভাই আপনাকে ফুড ডেলিভারি দিতে পারবে না! হ্যাঁ, ফুড ডেলিভারিতে অর্ডার করে খাচ্ছে মানুষ। কিন্তু আরও বহু বহু মানুষ রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে। ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছে, হাহাহিহি করছে, ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানান দিচ্ছে—দেখো আমি একটা সুখের সময় কাটাচ্ছি, রেস্টুরেন্টে ভালোটা-মন্দটা খাচ্ছি। 

যুক্তি ২: রেস্টুরেন্টের ছাড়া বিনোদনের আর বিকল্প কোথায়? বিকল্প দেখানোর মানুষটাও তো এখন নাই! 

হ্যাঁ, মানুষ ছিলেন একজন আমাদের। তিনি আমাদের ডিমের বিকল্প দেখিয়েছেন, বেগুনের বিকল্প দেখিয়েছেন, মাংসের বিকল্প দেখিয়েছেন। ওই যে, কাঁঠালের বার্গার বানিয়ে খেতে বললেন। কিন্তু, মানুষটা চলে যাওয়ার পর কেউ আর আমাদের বিকল্প দেখায় না! ঢাকা শহরে বিনোদনের জন্য খুব অল্প পার্ক, আরও অল্প খেলার মাঠ। মানুষ দুদণ্ড বসবে কোথায়? আর যেখানে গিয়ে বসতে পারে, সে জায়গার নিরাপত্তা কোথায়? আর যে জায়গায় এগুলোও ম্যানেজ করা সম্ভব, তেমন জায়গায় এন্টারটেইনের সুযোগ কোথায়? হাতেগোনা লাইব্রেরি, ধীরে ধীরে কমতে থাকা সিনেমা হল, নাট্যমঞ্চ। নাটোরের বনলতা সেনও নেই, আর আপনিও জীবনানন্দ দাশ না যে কেউ আপনাকে দুদণ্ড শান্তি দেবে। তাহলে?

শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে কমছে বিকল্প বিনোদনের জায়গাগুলো। আর, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে রেস্টুরেন্ট। সেটারও নানান রকমভেদ। কাজিনরা সব একসাথে হলে হইহই করে পুরান ঢাকায়, অফিসিয়াল মিটিঙে ধানমণ্ডির কোনো কফিশপ, বনানির কোনো রুফটপ রেস্টুরেন্ট। একান্তে নিজের মানুষটার সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে হয়তো পাঁচতারা হোটেলে বাই ওয়ান গেট ওয়ান কার্ড যোগাড় করে ব্যুফে! অথবা রাস্তার কোনো সস্তা হোটেলে বদ্ধ কেবিনে বন্দী দুজনে রুদ্ধশ্বাস কত অপেক্ষার! খাবার এখানে মুখ্য না, উপলক্ষ মাত্র। 

এমনকি রেস্টুরেন্টে জন্মদিন পালন, অফিসের ফেয়ারওয়েল, স্কুল-কলেজের রিইউনিয়ন, আর প্রপোজ করার ঘটনাও এখন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার যেন পার্শ্বচরিত্র, প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘স্থান’।

পাল্টা যুক্তি ২: কিছু খোলা পার্ক, বইমেলা, কিংবা রবীন্দ্র সরোবরও তো আছে! 

আছে। সেইসাথে এখনকার সময়ের মধ্যবিত্তের ভিন্ন রকম চাহিদাও আছে। পার্কে বসে বাদাম ছিলতে ছিলতে ভাব-ভালোবাসার কথা বলতে ভালোই লাগে। একবার-দুবার, তারপর? তারপরই বসতে গেলে আপনার দরকার হবে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার। একটা আরামদায়ক চেয়ার। ওয়াইফাই। সুযোগ থাকলে এসি। তারচেয়ে বড় জিনিস, প্রাইভেসি! এই জিনিস প্রতিটা মানুষ প্রাপ্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রেস্টুরেন্টেই ওটা এখন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অন্তত অন্যান্য জায়গার মতো রেস্টুরেন্টে আপনি বা আপনারা প্রধান দ্রষ্টব্য না।

তারপর নিরাপত্তা, মশার হাত থেকে বাঁচা, কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটর। ও ভালো কথা, রেস্টুরেন্টে কিন্তু খাবারও পাওয়া যায়। 

এই আধুনিক আরামগুলো নগরবাসী খোঁজে। তাই সে উপভোগ করতে বের হতে চাইলে প্রথমে এটা সেটা বিকল্প হাতড়ায়, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাকেই বলতে শোনা যায়, এই জানিস, অমুক রেস্টুরেন্টের ফিশ বার্গারটা কিন্তু দুর্দান্ত। অ্যাম্বিয়েন্সটাও ইনস্টা ফ্রেন্ডলি। চলে আয় ৫টায়। আড্ডা হবে। 

যুক্তি ৩: সামাজিক স্ট্যাটাস ও মিডিয়া প্রভাব—‘রেস্টুরেন্ট কালচার’ এখন একধরনের স্বীকৃতি

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। আর আপনি কীভাবে খাচ্ছেন, কোন পরিবেশে খাচ্ছেন, সেটা দেখাতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমজমাট সময়টাই তো মোক্ষম!  ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের কল্যাণে খাবার এখন শুধু খাওয়ার বস্তু নয়—এটা দেখানোর, উপস্থাপনের ও ব্র্যান্ডিংয়ের অংশ হয়ে উঠেছে। কফিশপে বসে ‘সিনামন লাতে’ খাওয়ার ছবি, কোনো নতুন ফিউশন রেস্টুরেন্টে গিয়ে ওপেন কিচেনের ভিডিও—এসব এখন একধরনের ‘লাইফস্টাইল স্টেটমেন্ট’। উঁহু, নাক বেঁকিয়ে লাভ নেই, ওটা আপনিও করেন। হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি/ভিডিও/টেক্সট দেন, অথবা দেখেন, অথবা দুটাই করেন। রান্নার মতোই গুরুত্বপূর্ণ এখন ‘রিভিউ করা’, ‘ভ্লগ বানানো’, ‘রেটিং দেওয়া’ । ভোজনরসিকতা এখন শুধু রসনা তৃপ্তি না, সামাজিক পুঁজি অর্জনের পথও বলা চলে।

এই অংশে আরও বলা দরকার—খাদ্যসংস্কৃতির এ যে পরিবর্তনটা ঘটছে, তার মধ্য দিয়ে এখন শ্রেণি, রুচি, ও চিন্তার নতুন ‘সাংস্কৃতিক মানচিত্র’ তৈরি হচ্ছে। বনানীর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আর মোহাম্মদপুরের পারিবারিক খাবারের দোকান—দুটার ভিজ্যুয়াল ও ভাষা আলাদা। ফলে এই রেস্টুরেন্ট কালচার শ্রেণি-ভিত্তিক সংস্কৃতি গঠনের মাধ্যমেও পরিণত হয়েছে।

পাল্টা যুক্তি ৩: আমরা কী খাচ্ছি—সেটা কি এখন গৌণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রবণতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক ধরনের সাংস্কৃতিক বিপন্নতা। খাবার এখন কেবল দেখার বিষয় হয়ে গেছে। স্বাদের, পুষ্টির বা ইতিহাসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ‘প্রেজেন্টেশন’। বুমারসের চাইনিজ প্ল্যাটার নাকি লায়লাতির চাইনিজ প্ল্যাটার—কোনটা ইনস্টাগ্রামে ফটোজেনিক, সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্য ।

সত্যি বলতে, এই প্রবণতা একধরনের বিকৃতি তৈরি করছে। তবে এটাও মানতে হবে, খাবার কেবল পুষ্টি বা স্বাদের বিষয় নয়—এটাও একধরনের গল্প বলার উপায়। রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মাধ্যমে অনেকে নিজেদের অভিব্যক্তি, রুচি এবং চিন্তার পরিচয় দিতে চায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, তবে স্বাদের, শিকড়ের আর অর্থপূর্ণ সামাজিকতার জায়গাটা যেন থাকে।

যুক্তি ৪: মধ্যবিত্তের পকেট ফ্রেন্ডলি বিলাস 

একসময় রেস্টুরেন্ট মানেই বিলাসিতা। এখন সেটাই অনেক মধ্যবিত্তের জন্য ‘সাশ্রয়ী বিলাস’। এক কাপ কফি কিংবা ২০০ টাকার একটি বিরিয়ানি প্লেট দিয়ে আপনি নিজেকে একটু ‘পুরস্কৃত’ করতেই পারেন। ভ্রমণ বা বড় বিনোদনের সুযোগ যেখানে সীমিত, সেখানে এই ছোটো খরচেই অনেক মানুষ আনন্দ খুঁজে নিচ্ছে।

শহুরে ক্লান্তি, কাজের চাপ, পারিবারিক সংকট—সবকিছু থেকে সাময়িক অব্যাহতি পাওয়া যায় এই খাবার-কেন্দ্রিক সামাজিকতায়। অন্য মানুষের কথা কী বলবো, আমিই তো ঠিক করে রেখেছি এই লেখাটা শেষ করে এক প্লেট ঝাল দেওয়া ভেলপুরি খাব। একটা ‘মাইক্রো রিওয়ার্ড’ না পেলে কি চলে?

অনেকে একা যান, অনেকে বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন নিয়ে যান। যান অনেকেই। রেস্তোরাঁ আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছে একধরনের মানসিক আশ্রয়।

খাবার কী খাচ্ছেন, তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কীভাবে খাচ্ছেন—খাবার নিয়ে একটা পুরানো দর্শন। এই দর্শনই এখনকার বিশ্বে অনেকটা আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে। অলঙ্করণ করেছেন সামিউল

পাল্টা যুক্তি ৪: এই ‘সস্তা বিলাসিতা’র জন্য কি আমরা হারাচ্ছি দীর্ঘমেয়াদে আত্মনির্ভরতা?

খাবার নিজে রান্না করা, নিজস্ব খাদ্য সংস্কৃতি বজায় রাখা একধরনের আত্মপরিচয়ের অংশ। যখন পরিবার নিজেরা রান্না করা বন্ধ করে দেয়, তখন খাবারের মধ্যে থাকা পারিবারিক বন্ধনও হারিয়ে যেতে পারে।

এ নিয়ে অবশ্যই ভাবা দরকার। তবে প্রতিদিনের একঘেয়েমি ও চাপ থেকে স্বস্তি পেতে যদি রেস্তোরাঁয় যাওয়া হয়, তা হলে সেটাকে পুরোপুরি নেতিবাচক না বলে, তা ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে। হ্যাঁ, সচেতনতা জরুরি—কোথায় থামতে হবে, সেটাও জানতে হবে।

যুক্তি ৫: শ্রেণি-নির্ভর রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি—নতুন সামাজিক বিভাজন?

শহরের রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির প্রসার নতুন এক সাংস্কৃতিক শ্রেণি তৈরি করেছে। দামি রুফটপ ক্যাফে, ফিউশন রেস্টুরেন্টে যাওয়া এখন নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমজীবী মানুষের জন্য দুর্লভ। যার কারণে এই রেস্তোরাঁ সংস্কৃতি একধরনের সামাজিক বিভাজনেরও প্রতীক হয়ে উঠছে—যেখানে কিছু মানুষ শুধু ফেসবুক ছবির মাধ্যমে এই জীবনযাপনকে চেনে।

পাল্টা যুক্তি ৫: নতুন উদ্যোক্তা, ফুড কার্ট, লোকাল খাবার—এই বিভাজন কি কাটিয়ে উঠছে?

হ্যাঁ, ফুড কার্ট, লোকাল ফুড আর নতুন উদ্যোক্তাদের কারণে এই ফাঁকও কিছুটা কমছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তরুণ উদ্যোক্তা বা এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেই এখন এমন অনেক হোম-বেইজড ফুড বিজনেস গড়ে উঠছে যারা তুলনামূলক কম দামে বৈচিত্র্যময় খাবার পরিবেশন করছে। ফলে একধরনের ইনক্লুসিভিটির সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ব্যাপারটা আমাদের মনোযোগ দাবি করে—খাদ্য যদি আত্মপ্রকাশ হয়, তবে তা যেন কেবল এক শ্রেণির একচেটিয়া না হয়। শহুরে খাদ্যচর্চায় একইসাথে ইনক্লুসিভিটি রাখা আর বহুমাত্রিক হওয়া খুবই প্রয়োজন। 

এতসব যুক্তিতে তাহলে কী দাঁড়াল? 

বলতে গেলে কিছু দাঁড়ায় নাই। কোনো কিছু দাঁড় করানো এই লেখার উদ্দেশ্যও না আসলে। এই সময়ে ‘বাইরে খাওয়ার’ দৃশ্যপটটা কথায় কথায় একটু সামনে নিয়ে আসা আরকি।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের বাইরে খাওয়ার প্রবণতা নিয়ে যারা নাক উঁচু করেন, তারা প্রায়ই একটা আদর্শ বাঙালি পরিবার কল্পনা করেন—যেখানে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সবাই একসঙ্গে খায়, মা রাঁধেন, বাবার পছন্দের তরকারি হয়, এবং সন্তানরা ‘বাসার খাবারেই তৃপ্ত’ থাকে। এই কল্পনা এই সময়ে এসে যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি এক ধরনের আদর্শিক নস্টালজিয়া।

বাংলাদেশের শহুরে মধ্যবিত্তের রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভ্যাস তাই এখন আর শুধু খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন না, একটা বিস্তৃত জীবনচর্চার অংশ। এটাকে বলা যায় সময়ের ব্যবস্থাপনা, সামাজিক অবস্থানের প্রকাশ, বিনোদনের ঘাটতির প্রতিক্রিয়া আর একধরনের মানসিক মুক্তির খোঁজ।

শহরে যদি বিকল্প সাংস্কৃতিক পরিসর, নিরাপদ উন্মুক্ত স্থান ও সাশ্রয়ী বিনোদনের ব্যবস্থা বাড়ানো যায়, তাহলে মানুষ রেস্তোরাঁকে একমাত্র আশ্রয়স্থল হিসেবে নির্ভর করা কমিয়ে দেবে—এটা বলতে সায়েন্টিস্ট হওয়া লাগে না। কিন্তু তার আগে আমাদের স্বীকার করতে হবে—রেস্তোরাঁ এখন আর শুধু খাওয়ার জায়গাই না। এটা হয়ে উঠেছে জীবনযাপন, আত্মপ্রকাশ ও আধুনিক শহুরে বাস্তবতার প্রতীকও।

আমাদের প্রয়োজন এই পরিবর্তনের গভীরে যাওয়া—তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বুঝে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভ্যাসকে আরও অর্থবহ, ভারসাম্যপূর্ণ আর সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করা। এই আরকি।